text
stringlengths
0
4.32k
পাখি
English
পাখি Aves শ্রেণীর উষ্ণরক্তবিশিষ্ট, দেহ পালকে আবৃত এবং অগ্রপদ ডানায় রূপান্তরিত মেরুদন্ডী প্রাণী। এদের মস্তিষ্ক অপেক্ষাকৃত বড়, দৃষ্টি তীক্ষ্ণ ও শ্রবণশক্তি প্রখর, কিন্তু ঘ্রাণশক্তি কম। ভারী চোয়াল ও দাঁতের পরিবর্তে শক্ত চঞ্চু এবং ফাঁপা হাড় ও অন্যান্য অংশে বায়ুথলী থাকায় পাখির দেহের ওজন কম। প্রায় ১৫ কোটি বছর আগে জুরাসিক সময়ে পাখিদের উৎপত্তি। জানামতে Archaeopteryx lithographica নামের প্রাচীনতম পাখির জীবাশ্ম (১৮৬১ সালে দক্ষিণ জার্মানির বাভারিয়ায় প্রাপ্ত) আবিষ্কৃত হওয়ার ফলেই এই ধারণার জন্ম। এ পাখি জুরাসিক সময়ের শেষ দিকে প্রায় ২০ কোটি বছর আগে বেঁচে ছিল। Archaeopteryx পাখিদের সঙ্গে সর্ম্পকিত হলেও এটির অধিকাংশ হাড়ের গঠন theropod ডাইনোসরদের মতো।সরীসৃপ ও পাখি একই পূর্বপুরুষ থেকে উদ্ভূত। প্রত্নতত্ত্ববিদদের বিশ্বাস, জীবিত সরীসৃপের মধ্যে Crocodilians বা কুমিররাই পাখিদের নিকটতম জ্ঞাতি। পাখির মধ্যে দুটি বড় ধরনের শারীরস্থানগত অভিযোজন ঘটেছে: ১. পালক, সম্ভবত সরীসৃপের অাঁশ থেকে উদ্ভূত যা দেহ আবরকের কাজ করে এবং শরীরের স্থির তাপমাত্রা রক্ষার সামর্থ্য যোগায় এবং ২. ডানা, সম্ভাব্য সরীসৃপীয় পূর্বপুরুষের ৫ আঙুলবিশিষ্ট অগ্রপদ অত্যধিক পরিবর্তিত হয়ে অভিযোজিত পালকসহ পাখনায় রূপান্তরিত হয়েছে, যা পাখিকে ওড়ার ক্ষমতা দিয়েছে।
বর্তমানে প্রায় ৯,০০০ প্রজাতি নিয়ে Aves শ্রেণী গঠিত। Passeriformes (passerines বা গায়ক পাখি হিসেবে পরিচিত) বর্গভুক্ত পাখির প্রজাতির সংখ্যা জানামতে অর্ধেকেরও বেশি। অবশিষ্ট সবগুলি বর্গকে একত্রে non-passerines বলা হয়। পাখির আকার ও আকৃতি বহুবিধ: উটপাখির (Struthio camelus) দাঁড়ানো অবস্থায় উচ্চতা ২.৫ মিটার, আর পৃথিবীর ক্ষুদ্রতম পাখি হামিংবার্ডের (Mellisuga healenae) লেজের ডগা থেকে ঠোঁটের আগা পর্যন্ত দৈর্ঘ্য ৬ সেন্টিমিটারের কম। ভারত উপমহাদেশে ১২ শতাধিক প্রজাতির পাখির বাস। বাংলাদেশে রয়েছে ৬৫০ প্রজাতির পাখি (১৬ বর্গ, ৬৪ গোত্র; ২৭৬ গায়ক, ৩৭৪ অগায়ক)। এগুলির মধ্যে ৩০১ আবাসিক (১৬ বর্গ ও ৬০ গোত্র; ১৭১ গায়ক ও ২১৭ অগায়ক) এবং ২৪৯ পরিযায়ী (১০ বর্গ ও ৩৩ গোত্র; ১০৫ গায়ক ও ১৩৫ অগায়ক)। উপমহাদেশের বৃহত্তম পাখি (দাঁড়ানো উচ্চতা প্রায় ১.৭৫ মিটার) সারস (Grus antigone), সম্প্রতি বাংলাদেশে কদাচিৎ দেখা যায়। গুটিকয় মধুপায়ী ও সানবার্ড চড়ুই অপেক্ষা ছোট, সম্ভবত এরাই এখানকার ক্ষুদ্রতম পাখি। পৃথিবীতে পাখির সংখ্যা প্রতিদিন কমছে। প্রতি ৯ প্রজাতির মধ্যে ১ প্রজাতি বিলুপ্তির পথে। বাংলাদেশে এই মুহূর্তে ৪১ প্রজাতির (৩০১ আবাসিক প্রজাতির মধ্যে) পাখি হুমকিগ্রস্ত। তন্মধ্যে ১৯টি বিপন্ন, ১৮টি বিপন্নপ্রায় ও ৪টি বিপদসীমায়। এখানকার ৩০১ আবাসিক প্রজাতির মধ্যে তথ্যাভাবে ১৪৮ প্রজাতির বর্তমান অবস্থা মূল্যায়ন সম্ভব হয় নি। বাস্ত্তসংস্থানিক পরিবর্তন পাখিকুলের সংস্থিতি ক্ষতিগ্রস্ত করেছে। কয়েক ধরনের বনাঞ্চল বা জলাভূমি সংশ্লিষ্ট আবাসের সঙ্গে জড়িত পাখির সংখ্যা কমেছে। বাংলাদেশে ৭০-৮০ বছর আগে পিঙ্কহেড বা গোলাপী-শির হাঁস (Rhodonessa caryophyllacea), বুঁচা বা কোম্ব হাঁস (Sarkidiornis melanotos), ময়ূর (Pavo cristatus) ও বর্মী ময়ূর (Pavo muticus) যথেষ্ট সংখ্যায় ছড়িয়ে-ছিটিয়ে ছিল যা বর্তমানে বাংলাদেশ থেকে লোপ পেয়েছে।
প্রাক-মুগল আমলের ভারতীয় পাখি সম্পর্কে তথ্যের অভাব রয়েছে। তথ্যের অন্যান্য উৎসের মধ্যে আছে কয়েকটি সংস্কৃত শব্দকোষ। পাখির ডাকভিত্তিক কিছু নাম আছে যেমন, কাউয়ার জন্য ধ্বন্যাত্মক শব্দ ‘কাক’; অন্যগুলি রং, আচরণ, ভঙ্গি, আহার-পদ্ধতি ইত্যাদি ভিত্তিক। কতকগুলি নাম সহজে শনাক্তযোগ্য, আবার কতকগুলি দুর্বোধ্য। পাখি বিশারদ রঘুবীর ওইসব সংস্কৃত নাম থেকে পাখিগুলি সঠিকভাব শনাক্ত করার চেষ্টা করেন এবং জ্ঞাত ভারতীয় পাখি প্রজাতির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ২৫০টি সংস্কৃত শব্দ চিহ্নিত করেন। বৈদিক প্রাজ্ঞরা ভারতীয় কোকিলের পরভৃৎ স্বভাব (brood parasitism) সম্পর্কে সুপরিচিত ছিলেন এবং সংস্কৃত সাহিত্যে তার বর্ণনা দিয়েছেন।বাবর থেকে শাহজাহান পর্যন্ত সকল মুগল সম্রাট দক্ষ ক্রীড়াবিদ ও সর্বতোমুখী প্রকৃতিপ্রেমিক ছিলেন। বাবর ও তাঁর পৌত্র জাহাঙ্গীর ছিলেন একজন প্রকৃতিবিদ। পাখির স্বভাব এবং আচরণ সম্পর্কে তাঁদের ব্যক্তিগত পর্যবেক্ষণের কিছু বৈজ্ঞানিক বিবরণী রয়েছে। ব্রিটিশ আমলে পুলিশ, আমলা, বন ও সেনা কর্মকর্তাদের প্রদত্ত তথ্যাদি বিভিন্ন অঞ্চলের পাখি পর্যবেক্ষণের সুযোগ সৃষ্টি করে। ব্রায়ান হজসন (Brain Hodgson), টি.সি জার্ডন (TC Jerdon) ও এডওয়ার্ড ব্লাইদ (Edward Blyth) প্রমুখ ব্যক্তি পাখি বিষয়ক দিগদর্শী গ্রন্থাদি রচনা করেন। ১৮৬২-১৮৬৪ সালে প্রকাশিত জার্ডনের দুই খন্ডের Birds of India শীর্ষক গ্রন্থ রচনা থেকেই এদেশে যথার্থ পক্ষিবিজ্ঞানের সূচনা। গ্রন্থকার ব্রিটিশ পাখির সঙ্গে সাদৃশ্যের ভিত্তিতে সকল ভারতীয় পাখির একটি ইংরেজি নাম দেন। এদের অনেকগুলিই যুক্তিসঙ্গতভাবে যথার্থ হলেও পরবর্তী গ্রন্থকাররা এসব নামের কিছু সংশোধনের চেষ্টা করেন। দশ খন্ডে প্রকাশিত সালিম আলী ও ডিলন রিপ্লি (Dillon Ripley) প্রণীত Handbook of the Birds of India and Pakistan (১৯৬৮-৭৩) গ্রন্থাবলির সর্বশেষ সংস্করণ পাখির নামকরণ চূড়ান্তরূপ ধারণ করেছিল। ইদানিং পাখির নামকরণে ব্যাপক পরিবর্তন এসেছে।
ভারতীয় পাখি সম্পর্কে প্রাচীনতম ‘আধুনিক’ বিবরণীটি মাদ্রাজ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সার্জন এডওয়ার্ড বাকলে ১৭১৩ সালে প্রকাশ করেন। এতে ছিল সেন্ট জর্জ দুর্গ ও তার আশেপাশের ২২টি পাখির সচিত্র বর্ণনা। আরও কিছু পাখি সংগ্রাহক ও গ্রন্থকার আঠারো শতকের অবশিষ্ট সময়ে একই ধরনের কাজ করে গেছেন। এদের মধ্যে অনেকে হয়তো নতুন আবিষ্কৃত পাখির বর্ণনা দিয়ে বা স্বনামে ঐ নতুন প্রজাতির পাখির নামকরণ করে ও অন্যভাবে ভারতীয় পক্ষিবিজ্ঞানে অবদান রেখে গেছেন। ভূতত্ত্ববিদ ক্যাপ্টেন জেমসের ভারতের আঞ্চলিক পাখি শনাক্তকরণের প্রথম একনিষ্ঠ প্রয়াস ১৮৩১ সালে একটি বৈজ্ঞানিক সাময়িকীতে (Proc. Zool. Soc., London) প্রকাশিত হয়। তিনি বিন্ধ্যপর্বতের শিলা গবেষণায় মধ্যপ্রদেশ ও যুক্তপ্রদেশ অভিযানে যান এবং এইসঙ্গে এশিয়াটিক সোসাইটির জন্য পাখিও সংগ্রহ করেন। সংগৃহীত ১৫৬ জাতের ২০০ পাখির নমুনার মধ্যে ৩০টি ছিল নতুন প্রজাতি।
টি.সি জার্ডনের পর Fauna of British India গ্রন্থমালায় ১৮৮৯ ও ১৮৯৮ সালের মধ্যে ইউজিন ডব্লিউ ওটিস ও ডব্লিউ টি ব্ল্যানফোর্ড প্রণীত পাখির ওপর ৪ খন্ড যুক্ত হওয়ার ফলে ভারতীয় পাখিবিজ্ঞানের আরেকটি মৌলিক অগ্রগতি ঘটে। পূর্বসূরীদের কাজের মতো এতেও অন্তর্বর্তী ২৭ বছরের মাঠ পর্যায়ে ও জাদুঘরে সম্পন্ন ব্যাপক গবেষণার যাবতীয় জ্ঞান সংকলিত হয়।
স্টুয়ার্ট বেকার (Stuart Baker) ঢাকা ও বাংলার অন্যত্র এলাকার পাখি সম্পর্কে সামান্য কিছু কাজ করেন, তবে তাঁর প্রধান কর্মক্ষেত্র ছিল আসাম। ঢাকার মার্কিন কনসাল ই হজ (E Hodge) (১৯৫৭-১৯৬০) দাপ্তরিক কাজে বা ছুটির দিনে বাইরে গেলে যেসব পাখি দেখতেন সেগুলির একটি তালিকার ৫টি মিমিওগ্রাফিক কপি প্রস্ত্তত করেন। বাংলাদেশে হারুন-অর-রশিদের Systematic List of the Birds of East Pakistan (১৯৬৭) শীর্ষক প্রথম সমন্বিত তালিকা এশিয়াটিক সোসাইটি অব পাকিস্তান (১৯৬৯) প্রকাশ করে। স্বাধীনতার পর কাজী জাকের হোসেন ১৯৭৯ সালে Birds of Bangladesh প্রণয়ন করেন। মোহাম্মদ আলী রেজা খানের Wildlife of Bangladesh (১৯৮২) গ্রন্থেও পাখির একটি তালিকা রয়েছে। ডব্লিউ জি হার্ভে লিখিত Birds in Bangladesh তালিকাটিও প্রসঙ্গত উল্লেখ্য।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিজ্ঞান বিভাগেই পাখি বিষয়ক প্রথম শিক্ষা ও গবেষণার সূত্রপাত। বর্তমানে ঢাকা, জাহাঙ্গীরনগর ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিজ্ঞান বিভাগে পক্ষিবিজ্ঞানের কোর্স চালু রয়েছে। গত ২০০০ সালে ইন্টারন্যাশন্যাল ইউনিয়ন ফর কনজারভেশন অব নেচার (IUCN) বাংলাদেশের বিপন্ন পাখির তালিকা প্রকাশ করেছে এবং সেখানে বিভিন্ন প্রজাতির পাখির বর্তমান অবস্থা বর্ণিত হয়েছে।
খাঁচার পাখি (Cage bird) খাঁচায় বন্দি করে সফলভাবে পোষ মানানো যায় এমন পাখি। তারা সেখানেই বংশবৃদ্ধি করে, ফলে তাদের প্রাকৃতিক ও চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য অনেকটা বদলে যায় ও শেষ পর্যন্ত তারা প্রায় গৃহপালিত হয়ে ওঠে।
পোষাপাখির উদাহরণ হলো তোতা (Psittacines or Parrots) এবং ক্যানারি ও মুনিয়ার মতো কিছু চড়ুই জাতীয় পাখি। এদের মধ্যে প্রাচীনতম পোষাপাখি হলো অস্ট্রেলীয় বাজারিগার (Melopsittacus undulatus)। জন গোল্ড অস্ট্রেলিয়া থেকে ১৮৪০ সালে এই তোতাপাখি যুক্তরাজ্যে প্রথম আনেন এবং তখন থেকেই এই পাখি বন্দী অবস্থায় বংশবৃদ্ধি করছে এবং আন্তঃপ্রজনন ও নতুন আনা নমুনাগুলির সঙ্গে আন্তঃপ্রজননের মাধ্যমে নানা রঙের কয়েক ডজন প্রকারভেদ সৃষ্টি করেছে। এই পাখিদের আদি চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যে এতটা পরিবর্তন ঘটেছে যে অনেকে একে ‘পোষা’ প্রজাতি বলে। এটি অস্ট্রেলিয়ায় প্রাকৃতিক প্রজাতি হিসেবে এখনও টিকে আছে। বাজারিগার ১৭-১৯ সেমি লম্বা, ছোট ও হালকা ওজনের পাখি, লেজ দেহের তুলনায় লম্বা।এই পাখির প্রকৃত রং নীলাভ-কালচে, মাথার সামনে থেকে পিঠ পর্যন্ত সাদা ও সবুজ, অনেকটা জেব্রার দেহের মতো সাদা-সবুজে ডোরাকাটা। পাখনা চিত্রবিচিত্র। খাঁচার এই পাখিদের মধ্যে অবশ্য খাঁটি হলুদ ভ্যারাইটিসহ অনেকগুলি মধ্যবর্তী রকমফের রয়েছে।
বাংলাদেশে সচরাচর দৃষ্ট জনপ্রিয় অন্যান্য পোষা পাখিদের মধ্যে রয়েছে ক্যানারি (Serinus canaria), মুনিয়া (Longchura species), লালমুনিয়া (Amandava amandava, Syn. Estrilda amandava), জাভাচড়ুই (Padda oryzivora), সোনালি ফিনচ (Carduelis carduelis), সবুজ ফিনচ (Carduelis chloris) ও ষাঁড় ফিনচ (Pyrhula pyrrhula), লাভ বার্ড (Agapornis species), জেব্রা ফিনচ (Peophila guttata) এবং কোকাটিয়েল (Nymphicus hollandicus), যা আবার হরবোলা কিংবা বহুরূপী। ক্যানারি পাখিরা এসেছে আলজেরিয়ার পশ্চিমের আটলান্টিক মহাসাগরের অ্যাজোরস, ম্যাডেইরা ও ক্যানারি দ্বীপ থেকে। মুনিয়া ও চড়ুই ইত্যাদির আবাস বাংলাদেশ ও এশিয়ার অন্যান্য অংশে। ফিনচজাতীয় পাখিদের আদি বাসভূমি ইউরোপ।
শিকারের পাখি (Game bird) শৌখিন শিকারিরা প্রায় নিয়মিত বন্দুক দিয়ে হত্যা করে এমন পাখি। উড়ন্ত পাখির নিশানা ভেদ বা স্রেফ মজা করার জন্যও পাখি মারা হয়। শিকারের পাখিদের অধিকাংশই Galliformes অর্থাৎ বনমোরগ, ময়ূর ও কাঠময়ূর বর্গভুক্ত। Scolopacidae গোত্রভুক্ত কারলিউ, কাদাখোচা, বড়চাগা বা বুনোচাগা পাখি Otididae গোত্রভুক্ত বাস্টার্ড পাখির সঙ্গে সম্পর্কিত। বেঙ্গল ফ্লোরিকান পাখিও শিকারের পাখি হিসেবে গণ্য। পৃথিবীর নানা অঞ্চলের অন্য আরও কিছু গোত্রের পাখি শিকারের পাখির তালিকায় রয়েছে।
বাংলাদেশে সাধারণত শিকারের পাখি হলো বনমোরগ (Gallus gallus), কাঠময়ূর (Polyplectron bicalcaratum), মথুরা বা কালোময়ূর (Lophura leucomelanos), তিতির (Francolinus) প্রজাতি, কোয়েল (Coturnix) প্রজাতি, Turnix-এর দুটি প্রজাতি, এবং Arboriphila ও Bambusicola-র অন্তর্ভুক্ত তিন প্রজাতির প্যাট্রিজ (Patridge) পাখি।
কয়েক দশক আগে বাংলাদেশে ভারতীয় ময়ূর (Pavo cristatus), সবুজ ময়ূর বা বর্মী ময়ূর (Pavo muticus) দেখা যেত। বর্তমানে এসব ময়ূর এদেশ থেকে লোপ পেয়েছে। চট্টগ্রাম ও সিলেট অঞ্চলের জঙ্গলে এখনও বেশ কিছু বনমোরগ ও মথুরা পাখি দেখা যায়।বনমোরগ সুন্দরবনেই বেশি। বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চলে ও দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলের তৃণভূমির একসময়ের বাসিন্দা বেঙ্গল ফ্লোরিকান (Eupodotis bengalensis) সম্ভবত বাংলাদেশ থেকে বিলুপ্ত হয়ে গেছে।
শিকারের পাখিদের এক গোত্র Scolopacidae-এর সব পাখিই পরিযায়ী। এদের মধ্যে সহজদৃষ্ট পরিযায়ী পাখি হলো: গুলিন্দা/Numenius-এর ২টি প্রজাতি, জুরালি/Limosa-এর ২টি প্রজাতি, চাপাখি/Tringa-এর ১৩-১৪ প্রজাতি, চহা বা কাদাখোচা/Gallinago-এর ৫-৬ প্রজাতি, বড়-চাগা বা বুনো-চাগা/Scolopax rusticola, বামন চাপাখির ৩-৪ প্রজাতি, Calidris এবং Ruff (Philomachus pugnax)। এদের মধ্যে কাদাখোঁচা ও বুনোচাগা এককভাবে থাকে এবং অন্য পাখিদের একত্রে কয়েকটি থেকে কয়েক হাজার দেখা যায়। সমুদ্র উপকুলীয় অঞ্চল, নদীর মোহনা, চরাঞ্চল, বিল, হাওর, বাঁওড়, পাহাড়ি নদী ও পুকুরে এদের বেশি দেখা যায়। বড় দল থাকে বড় জলাশয়ের এলাকায়। বুনো-চাগার বসবাস পার্বত্য জেলার গভীর বনের স্রোতস্বিনীর পাড়ে।
পরিযায়ী পাখি (Migratory bird) শীতকালে ও মাঝে-মধ্যে অন্য ঋতুতে বাংলাদেশে আসা কিংবা যাত্রাপথে কিছু দিনের জন্য বিরতি নেয়া অতিথি পাখি। বাংলাদেশে পরিযায়ী পাখিদের বেশির ভাগই আসে উপমহাদেশের উত্তরাংশের পর্বতময় এলাকা অর্থাৎ হিমালয় বা হিমালয়ের ওপাশ থেকে। কিছু প্রজাতির পাখি আসে ইউরোপের বিভিন্ন অঞ্চল ও দূরপ্রাচ্য, যেমন সাইবেরিয়া থেকে। সুতরাং ইউরেশিয়া থেকে দক্ষিণ, দক্ষিণ-পূর্ব ও পূর্ব-এশিয়ায় অর্থাৎ দক্ষিণ দিকেই বিপুল সংখ্যক পাখি পরিযায়ী হয়। কয়েকটি মাত্র প্রজাতি উত্তরমুখে এবং বাংলাদেশ হয়েই যাতায়াত করে। আবার কতকগুলি প্রজাতির পাখি আরও দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্বে যাওয়ার পথে বাংলাদেশের মাটিতে নামে ও দু’একদিন থাকে। এরাই যাত্রাবিরতিকারী (transit) প্রজাতি। আরও কিছু পাখি হেমন্তে দক্ষিণে বা বসন্তে উত্তরে যাত্রাকালে বাংলাদেশে থামে এবং যাত্রাবিরতি অপেক্ষা কিছু বেশি সময় কাটায়। এমন প্রজাতির পাখিও রয়েছে যারা কেবল হেমন্তে বা বসন্তে তাদের গন্তব্যে পৌঁছার সময় বাংলাদেশের আকাশসীমা দিয়ে উড়ে যায়। কিছু পাখি পূর্ব থেকে পশ্চিমেও যায় যারা সম্ভবত বাংলাদেশে আসে না। একই দেশের বা ক্ষুদ্র অঞ্চলের মধ্যে গমনকে স্থানীয় পরিযায়ী বলে।বাংলাদেশে ৬ শতাধিক প্রজাতির পাখি রয়েছে যাদের অন্তত ২০০ প্রজাতি পরিযায়ী। জানা যায় যে, ইউরেশিয়ায় ৩০০ প্রজাতির বেশি প্রজননকারী পাখির এক-তৃতীয়াংশ দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া বা আফ্রিকায় পরিযান করে। এসব পাখির এক-তৃতীয়াংশ বাংলাদেশে আসে। বাংলাদেশে সাইবেরিয়া থেকে কম সংখ্যক পাখিই আসে, অধিকাংশই আসে হিমালয় ও উত্তর এশিয়া থেকে। [আলী রেজা খান]
শিকারি পাখি (Bird of prey) অন্য প্রাণী, বিশেষত মেরুদন্ডী প্রাণী শিকার করে খায় এমন পাখি। এদের বোধশক্তি অত্যন্ত তীক্ষ্ণ এবং ঠোঁট ও নখর খুব ধারাল ও মজবুত। শিকারি পাখিরা দুটি দলভুক্ত: দিবাচর ও নিশাচর। প্রথম দলে আছে ঈগল, শিকরা, বাজ, বাজার্ড, ফ্যালকন, হ্যারিয়ার, চিল, ওসপ্রে (osprey) ও শকুন। আর দ্বিতীয় দলের পাখি হলো পেঁচা।
সারা পৃথিবীতে দিবাচর ও নিশাচর শিকারি পাখির প্রজাতি সংখ্যা প্রায় ৪০০। বাংলাদেশের ৬২৮ প্রজাতির পাখির ৬৮ প্রজাতি শিকারি, তন্মধ্যে ৩৭ আবাসিক ও ৩১ পরিযায়ী। এদের সবগুলি প্রজাতিই Ciconiiformes বর্গভুক্ত এবং শিকারি পাখিরা প্রায় একান্তভাবেই মাংসাশী; খায় উভচর, সরীসৃপ, পাখি ও স্তন্যপায়ী এবং কখনও মাছ। তাদের আছে মজবুত বাঁকা ঠোঁট এবং শিকার আটকে রাখা ও ছিঁড়ে খাওয়ার সহায়ক সুগঠিত পেশিতন্ত্র। আঙুলগুলির ৩টি আছে সামনের দিকে ও ১টি পিছনের দিকে এবং তাতে থাকে লম্বা ধারালো বাঁকা নখর। ওসপ্রে পৃথিবীর সর্বত্র বিস্তৃত। এরা মাছ শিকারি, ছোঁ-মেরে নখর দিয়ে শিকার গেঁথে কাঁটাযুক্ত পায়ের তলায় চেপে ধরে।অধিকাংশ হক ও ঈগল মাটিতে শিকার না দেখা পর্যন্ত আকাশে চক্কর দিতে বা গাছের ডালে বসে থাকে এবং দেখামাত্র উপর থেকে ঝাপিয়ে পড়ে শিকারকে আহত বা নিহত করে। উত্তর গোলার্ধের পেরেগ্রিন ফ্যালকন, হবি ও গোসহকরা উড়ন্ত অবস্থায় তাড়া করে শিকার ধরে। পূর্ব ও পশ্চিম গোলার্ধের শকুনরা শবভুক। মরা প্রাণী আহারের জন্য ওদের মাথা ও ঘাড় পালকহীন এবং ঠোঁট ধারালো। অবশ্য তারা বিভিন্ন গোত্রভুক্ত এবং তাদের সাদৃশ্য আসলে অভিসৃত (convergent) বিবর্তনেরই সাক্ষ্য। ক্ষুদে মিশরীয় শকুন পশুর বিষ্ঠা খায়, বিশেষত সিংহের মল, তাতে থাকে প্রচুর অজীর্ণ প্রোটিন। এরা পাথর দিয়ে ডিম ভেঙ্গেও খায়। শকুনের ডানা লম্বা ও চওড়া এবং নখর অপেক্ষাকৃত সোজা। মৃত প্রাণীর খোঁজে তারা ডানা মেলে আকাশে চক্কর দেয়। এদের শিকারকে বাগ মানাতে হয় না, ছেঁড়ার সময় শুধু আটকে ধরতে হয়।
ফ্যালকনদের শরীর সাধারণত পেশিবহুল, ডানা লম্বা ও চোখা, আঙুল লম্বা যা উড়তে ও উড়ন্ত শিকার ধরার জন্য আবশ্যক। অনেক জাতের চিলের শরীর অপেক্ষাকৃত হালকা গড়নের, পায়ের পাতা দুর্বল ও মোটা অর্থাৎ তারা ততটা শিকারদক্ষ নয়, খায় মরা জীবজন্তু, কিংবা খোঁজে সহজ শিকার। লম্বা-পা হ্যারিয়ার ও স্প্যারোহক ঝোপঝাড়ে হানা দেয়। মজবুত-পা ফ্যালকন প্রায়শ ছুটে গিয়ে উড়ন্ত শিকারকে সজোরে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেয়। কিছু জংলি ঈগলের পাগুলি মোটাসোটা, নখরগুলিও ধারালো, গাছ থেকে ছোঁ-মেরে ধরতে পারে বানর ও অন্যান্য বড়সড় স্তন্যপায়ী। ফ্যালকনরা ঘা মেরে কিংবা ঘাড়/শিরদাঁড়া ভেঙ্গে শিকারকে কাবু করে। Accipitridae গোত্রের হক ও অন্যরা জোরে চেপে ধরে শিকার মারে। সব জাতের শিকারি পাখি থাবা দিয়ে শিকার ধরে ও ঠোঁট দিয়ে ছিড়ে ফেলে।
স্কারলেট ম্যাকাও:
মধ্য ও দক্ষিণ আমেরিকার চিরস্থায়ী আর্দ্র বনাঞ্চলের বাসিন্দা স্কারলেট ম্যাকাও। এরা ম্যাকাও প্রজাতির মধ্যে সবচেয়ে বৃহত্তম ও সুন্দরতম সদস্য। উজ্জ্বল লাল, নীল ও হলুদ রঙের সমাহারে স্কারলেট ম্যাকাওয়ের মোহনীয় রূপ সকলকেই মুগ্ধ করে। সেইসঙ্গে এর উপরের দিকের হলুদ ডানার শেষাংশে সবুজ রঙেরও বেশ সুন্দর একটা প্রলেপ রয়েছে। শক্তিশালী বাঁকা ঠোঁট, দীর্ঘতম সময় উড়তে পারার ক্ষমতাও এদের আলাদা করে চিনিয়ে দেয়। দক্ষিণ-পূর্ব মেক্সিকো থেকে আমাজনীয় পেরু ও বলিভিয়ায় এই পাখি বেশি দেখা যায়। কোইয়া দ্বীপেও রয়েছে বহু স্কারলেট ম্যাকাও। হন্ডুরাস এই পাখিটিকে জাতীয় পাখি ঘোষণা করেছে। স্কারলেট ম্যাকাও বাঁচে প্রায় ৪০-৪৫ বছরের মতো, স্বাভাবিক কারণেই এরা দীর্ঘ আয়ুর পাখি হিসেবেও বিবেচিত হয়। বিশ্বের সবচেয়ে বুদ্ধিমান পাখি বলা হয় এদের, মানুষের কণ্ঠস্বর হুবহু নকল করতে পারে এরা।
গোল্ডেন ফিজ্যান্ট:
গোল্ডেন ফিজ্যান্টের মাথায় ক্রেস্টের মতো দুর্দান্ত গোল্ডেন ফার্ন-সহ একটি প্রাণবন্ত লালচে-কমলা ঘাড় রয়েছে। প্রধানত পশ্চিম চিনের ঘন বনাঞ্চলে দেখা যায় এদের। পাখিটি প্রায় ৯০-১০৫ সেমি পর্যন্ত বড় হয় এবং লেজের দৈর্ঘ্য পাখির আকারের দুই-তৃতীয়াংশ। তবে গোল্ডেন ফিজ্যান্ট নামটি প্রাচীন গ্রীক শব্দ 'খরাসোলোফোস' থেকে এসেছে, যার অর্থ 'আঁকা'। পুরুষ পাখিগুলির ওজন ১.৪ কেজি মতো হয়, এবং স্ত্রী পাখিদের ওজন ১.২ কেজি পর্যন্ত হয়ে থাকে। সঙ্গমের সময় তার সৌন্দর্য্য প্রদর্শনে সহায়তা করার জন্য গোল্ডেন ফিজ্যান্টের ঘাড়ে কমলা কেপ বিশেষ লক্ষ্যনীয়। প্রতি মরসুমে একটি স্ত্রী গোল্ডেন ফিজ্যান্ট ৪০টি পর্যন্ত ডিম দিয়ে থাকে।
ফ্ল্যামিংগো:
আন্টার্কটিকা ছাড়া প্রায় সব দেশেই দেখতে পাওয়া যায় ফ্ল্যামিংগো। পাখিটি মুগ্ধ করে তার কমলা সৌন্দর্য্যে। ফ্ল্যামিংগো নামটি পর্তুগিজ বা স্প্যানিশ শব্দ 'ফ্লামেঙ্গো' থেকে এসেছে, যার অর্থ বর্ণযুক্ত শিখা। ফ্ল্যামিংগোর শরীরে শিখার মতো স্তর দেখতে পাওয়া যায়। দীর্ঘ দূরত্ব একেবারে অতিক্রম করার ক্ষমতা রয়েছে এদের। শুধু তাই নয়, প্রতি ঘন্টায় ৫৬ কিলোমিটার গতিতে উড়ে যেতে পারে এরা। ফ্ল্যামিংগোকে 'ওয়েডিং বার্ড'ও বলা হয়। সাঁতার কাটতেই অত্যন্ত পটু এরা। পৃথিবীতে প্রায় ৬ প্রজাতির ফ্ল্যামিংগো রয়েছে। পূর্ণবয়স্ক ফ্ল্যামিংগো দৈর্ঘ্যে ৪-৫ ফুট ও ওজনে প্রায় সাড়ে তিন কেজি পর্যন্ত হয়। এদের দীর্ঘ গলা ও দীর্ঘ পা কাদা থেকে ছোট মাছ, প্ল্যাঙ্কটন খেতে সাহায্য করে।
ময়ূর:
ময়ূরকে বলা হয় বর্ষার রাণী। এই সময় স্ত্রী ময়ূরের দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য নয়নাভিরাম পেখম মেলে ধরে পুরুষ ময়ূর। এতে বিশেষ দুর্বলতা তৈরি হয় এবং তখনই আকর্ষণীয় নাচ যে পুরুষ ময়ূর দেখাতে পারে, তাকেই সঙ্গী হিসেবে বেছে নেয় স্ত্রী ময়ূর। ফ্যাজিয়ানিডি পরিবারের অন্তর্ভুক্ত অত্যন্ত সুন্দর একটি পাখি হল ময়ূর। এশিয়ায় মূলত নীল ও সবুজ- দুই প্রজাতির ময়ূরের দেখা মেলে। তবে মাঝে মধ্যে জিনগত কারণে সাদা ময়ূরের দেখা পাওয়া যায়। ময়ূর সর্বভুক পাখি। এরা মুরগির মতো ডিম পাড়ে, ডিম ফুটে বাচ্চা বের হয়। ময়ূর বন্য পাখি। এরা মাটির গর্তে বাস করে ও গাছে বিশ্রাম নেয়। শত্রুর হাত থেকে রক্ষার জন্য পায়ের নখ ব্যবহার করে তারা। দক্ষিণ এশিয়ায় সর্বত্রই ময়ূরের দেখা মিললেও ক্রমেই কমে আসছে তাদের সংখ্যা।
ব্লু জে:
মূলত পূর্ব ও মধ্য উত্তর আমেরিকার বনাঞ্চলের পাখি ব্লু জে। নীল, সাদা ও কালো রঙের সমাহারে সাজানো হয় এরা, যা এদের সৌন্দর্য্যের মাত্রা বহুগুণ বাড়িয়ে দেয়। সাধারণত দুষ্ট স্বভাবেপ হওয়ায় এবং শরীরে নীল রঙের প্রভাব বেশি থাকায় এদের নামকরণ হয়েছে ব্লু জে হিসেবে। এমনকী ডাকের সময়ও এরা জে জে বলেই ডাকাডাকি করে। মোহনীয় চেহারা ছাড়াও এই পাখিটির নিজের বুদ্ধিমত্তার জন্যও বিশেষ সুনাম রয়েছে। অন্য পাখিদের ডাক অনুকরণের এক অনন্য ক্ষমতা এদের রয়েছে, যা অন্য পাখিদের বিব্রত করে দেয় মাঝেমধ্যে। অন্য পাখির ডিম ও বাসাও চুরি করে এরা। অন্য পাখিদের ভয় দেখাতে ঈগলের ডাক হুবহু নকল করতেও এদের নাম রয়েছে।
বসন্তবৌরি:
কলকাতার পাখি বলতে কোয়েল, দোয়েল, হাঁড়িচাচা, বউ কথা কও – এরা সবাই বাংলার পাখি। সুন্দর হলুদ পাখি বউ কথা কও-কে সেলিম আলি ‘বাংলার পাখি’ বলে উল্লেখ করেছেন, কারণ বাংলার নানা অঞ্চলে এদের বেশি পাওয়া যায়। নগরায়নের সঙ্গে সঙ্গে পাখি অনেক কমে গিয়েছে কলকাতায়। পাখিদের খাদ্য ও নিরাপত্তা বিঘ্নিত হলে স্থান পরিবর্তন করাটাই স্বাভাবিক। আর প্রধান কারণ বাসস্থানের অভাব। প্রতিদিন রাস্তাঘাট বড়ো হচ্ছে। গড়ে উঠছে বিশাল বিশাল কমপ্লেক্স। বড়ো গাছপালা কমে যাওয়ার দু’টি কারণ। এক, নির্বিচারে গাছ কেটে ফেলা। দুই, আয়লা, আমফানের মতো প্রাকৃতিক বিপর্যয়। এসবের ফলে পাখিরা লোকালয় থেকে শহরের বাইরে চলে যাচ্ছে।
হাঁড়িচাচা:
ঝুট শালিক, নীল গলা বসন্তবৌরি, হাঁড়িচাচা, বসন্তবৌরি, দোয়েল পাখি প্রচুর ছিল কলকাতায়। সকালবেলায় দোয়েলের সুন্দর গান শুনে অনেকের ঘুম ভেঙে যেত। তার জন্য দোয়েলকে বাংলার নাইটিঙ্গেল বলা হয়ে থাকে। এদের কম সংখ্যা চোখে পড়ার মতো। কাক, শালিক, চড়ুই পাখিরা মূলত খাদ্যাভ্যাসের জন্যই লোকালয়ে থাকতে ভালোবাসে। আগে এদের দেখা যেত পাড়ায় পাড়ায় – এখন সেভাবে পাওয়া যায় না। বাড়ির ঘুলঘুলিতে আগে চড়ুইয়ের মতো পাখিরা বাসা করত। শহরের বাড়িঘরে ঘুলঘুলি দেখা যায় না আজকাল। হাঁড়িচাচা, কাঠঠোকরাও কম দেখা যাচ্ছে। পরিযায়ী পাখিরাও খুব কম সময়ের জন্য এসে ফিরে যায়। রবীন্দ্র সরোবর, সল্টলেকের সেন্ট্রাল পার্কের মতো বাগানে অবশ্য বেশ কিছু পাখি থাকে। টিয়া ও হলুদ পা হরিয়াল দু-একটার দেখা মেলে। বনবিতানে আগে যেমন গাছে কয়েকটা পেঁচা প্রায় দেখা যেত, এখন আর নেই। বন বিভাগের তরফ থেকে ওখানে নতুনভাবে গাছ লাগানোর প্রচেষ্টা চালানো হচ্ছে এবং কিছু উদ্ধার করা পাখিকে ওখানে ছেড়ে দেওয়া হচ্ছে। দেখা যাক এতে পাখির সংখ্যা বাড়বে কিনা। সরোবরে চেষ্টা চলছে গাছপালা সংরক্ষণের। বিশেষ করে যাতে আরও বেশি ফলের গাছ লাগানো যায়, সেদিকে জোর দেওয়া হচ্ছে। এই মুহূর্তে ৫৬ রকম প্রজাতির পাখি কলকাতা ও তার আশেপাশে দেখা যায়।
ইষ্টিকুটুম, বেনেবউ:
এক সময় রাজারহাটে তৃণভূমি এবং জলাভূমিতে অনেক পাখি ছিল। এখন তারা সংখ্যায় অনেক কম। স্বল্প সময়ের জন্য হলেও ইকো পার্কের পিছনে ও রাজারহাট গ্রাসল্যান্ডে লালমুনিয়া দেখতে পাওয়া গিয়েছে। হিডকোর সভাপতি দেবাশিস সেন পাখিদের জন্য অনেক উদ্যোগ নেন। ইকো পার্কে গড়ে তোলা হয়েছে পাখিবিতান। বাগানগুলোয় ফলের গাছ যাতে বেশি লাগানো হয়, সেদিকে নজর দেয় হিডকো। দুঃখের কথা, এমন কোনো উদ্যোগ চোখে পড়ে না কলকাতায়। সল্টলেকের বনবিতানে আগে ছিল অনেক মৌটুসি। ফুলের গাছ কাটা হচ্ছে বলে সেগুলো বিরল হয়ে এসেছে। আমি সল্টলেকের বাসিন্দাদের সঙ্গে কথা বলে জেনেছি, আগে যেমন সকালে পাখির ডাক শোনা যেত, এখন প্রায় যায়ই না। চিন্তামণি অভয়ারণ্যের আশেপাশে প্রচুর বসতবাড়ি। তার থেকে শ্যামখোলা এবং বারুইপুরে অনেক বেশি পাখি রয়েছে।
বক পাখি :আমাদের দেশের সবখানেই বক পাখি দেখতে পাওয়া যায় । বক পাখি বিভিন্ন প্রকারের হয়ে থাকে। ছােটো ছােটো এক প্রকার বক পাখি আছে, যাদের পালক খয়েরি রঙের । আর এক প্রকার বক পাখি দেখা যায় ধূসর রঙের। এছাড়াও লাল রঙের ক্ষুদ্রাকৃতির আর এক শ্রেণির বক পাখিকে বর্ষাকালে আমাদের দেশে প্রায় সবখানেই দেখা যায়।
তবে সবচেয়ে জনপ্রিয় বক পাখি হলাে লম্বা গলার সাদা বক। এরা খুবই সুন্দর এবং একসাথে অনেক বক পাখি যখন আকাশের গায়ে সারিবদ্ধভাবে উড়ে, তখন দেখতে একটি বিরাট ফুলের মালার মতাে লাগে। অত্যন্ত মনােমুগ্ধকর হয়ে থাকে দৃশ্যটি । এরা সব সময় ঝাক বেধেই চলাফেরা করে। থাকে। এরা খাল-বিলের এলাকায় অবস্থান করে থাকে। এদের প্রিয় খাবার মাছ ও ব্যাঙ।
কাঠঠোকরা পাখি : কাঠঠোকরা আমাদের দেশের এক অদ্ভুত সুন্দর পাখি। এরা গাছের শুকনাে ডালে ঠোট দিয়ে ঠোকর মেরে কাঠ। কেটে গর্ত করে এবং সেখানে অবস্থান করে। কাঠ যতই শক্ত হােক না কেন এরা ঠোট দিয়ে ঠোকর মেরে তাতে গর্ত করতে পারে ।
জলচর পাখি :
বাংলাদেশের হাওড়-বাঁওড় ও খাল-বিলের আশেপাশে ডাহুক, পানকৌড়ি এবং আরও নানা প্রকার পাখির আনাগােনা। দেখা যায়। এরা বর্ষাকাল এলেই সােচ্চার হয়ে ওঠে। এরা ছােটো ছােটো মাছ শিকার করে খায়। এদের জলচর পাখি বলা হয়।
পাখি
কৃষ্ণ চূড়ার ডালে বসি
গান গাইল একটি অচেনা পাখি ,
নয়ন মেলে দেখি -
এই যে গানের পাখি ।
সেই মধুর গান শুনে আমি
পাখির পানে চেয়েছিলাম একটুখানি ।
পাখিটিকে ছোঁয়ার জন্য আমি -
ভালোবাসার হাত বাড়ালাম ।
গান ফুরালেই পাখি গেলো উড়ে
আমার তরে রইল পড়ে
পাখির বেদনার সুর ।
সেই পাখির গান মনে করে
আমার হৃদয়ে জাগে আজ ব্যাথার বালুচর ।
অচেনা পাখিটি যখন হারিরে গেলো অজানায় -
পথ চেয়ে চেয়ে ক্লান্ত দু' নয়ন
পাখিটিকে খুঁজে ফিরে আমার মন ।
হৃদয়ের স্বপ্নপুরীতে বেদনার কম্পন জাগে ।
উচ্ছল প্রাণবন্ত ঠোঁটে -
গড়িয়ে পড়েনা মিষ্টি হাসি ।
বড় নিঃসঙ্গ লাগে বুক ভারী -
হয়ে যায় নীল বেদনায় ।
পৃথিবীর সব কোলাহোল সাঙ্গ করে
রক্রিম সূর্যটা যখন আস্ত যায় পরন্ত বিকালে
গোধূলি আলোর বর্ণচ্ছায়ায় নানানরঙের
ছোপ ছোপ ছবি আঁকি এই হৃদয়ে ।
নিশিথের আগোমনে - স্বপনের মাঝে
যখন মনে পরে পাখির গান
পাখির উপর হয় যে আমার বড় অভিমান ।
আমিতো পাইনা ভেবে -
কেন ভালোবাসি অচেনা পাখির গান?
বুকে জড়িয়ে নিয়ে রিক্ত হাহাকার ,