content
stringlengths 0
129k
|
---|
অধিকাংশ ক্ষেত্রে থিমের পুজোয় দেবীর সাবেকি রূপ থাকে না |
ফলে ছোট একটি দেবী প্রতিমা অতিরিক্ত আনা হয় এবং যাবতীয় বিধি মেনে সেই প্রতিমায় পূজা চলে |
থিম নির্মিত এই প্রতিমাগুলি যেন শুধু শো-করার জন্য! থিম নিয়ে আরও কিছু কথা পরে বলব |
কারণ পরিসর অনেকটাই সীমিত |
সেকাল ও একালের পুজোর মধ্যে আরও একটি লক্ষ্যনীয় পার্থক্য প্রতিমা নির্মাণকারী শিল্পীর পরিচয় |
এই কয়েক বছর আগে পর্যন্ত বাংলার নামজাদা বড় বড় পূজাসংঘের অধিকারীরা প্রতিমা নির্মাণের বায়না দিতেন মূলত কুমোরটুলি ও কৃষ্ণনগরের মৃৎশিল্পীদের কাছে |
যেসব পূজাসংঘের বাজেট কম তারা বায়না করতেন কাছাকাছির কুমোরবাড়ি থেকে |
ইদানীং নামজাদা ডাকসাইটে সেলিব্রিটি ভাস্করকে দিয়ে প্রতিমা নির্মাণের একটা চল দেখতে পাচ্ছি |
অবশ্যই এর পিছনে পুরস্কারের অমোঘ লোভ রয়েছে পূজাসংঘগুলির |
সেটির মধ্যে বিশ্বায়নের প্রভাব রয়েছে পরোক্ষে এবং সেই সব প্রতিমা নির্মাণের উপকরণও বদলে যাচ্ছে অনেক |
মাটির বদলে পাথর, দামী কাঠ, ধাতু বা অন্য দীর্ঘস্থায়ী উপকরণ দিয়ে তৈরী হচ্ছেন মাতৃরূপেন সংস্থিতা মৃন্ময়ী আনন্দময়ী দেবী |
লক্ষ্যনীয় এই সব মূর্তি কিন্তু সরকারী ও বেসরকারী সংস্থার মাধ্যমে পূজার পর ক্রয়পূর্বক সংরক্ষণ চলছে |
মূর্তিটি জায়গা করে নিচ্ছে এলিট মানুষদের বিচরণের পার্কে কিংবা নামী সংরক্ষণশালায়! পূজা সংক্রান্ত এই প্রথাটির কিন্তু বেশি বছর হয়নি এখনও |
অথচ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে ক্রমশ এই ভাবনাটি |
শিল্পের সংরক্ষণ ভালো বিষয় |
কিন্তু এক পিছনে যে সব কর্মকান্ড কিছু ক্ষেত্রে থাকে, তা শিল্প ও শিল্পী উভয়ের কাছেই ক্ষতিকারক |
তবে সেসব এখানে আলোচনার বিষয় নয় |
যেহেতু কর্মটি সত্য, তাই পূজবিষয়ক আলোচনায় সে প্রসঙ্গে আংশিক কথা না বলাও উচিত হত না |
দুর্গাপূজার রীতিপদ্ধতির মধ্যে অন্যতম বিষয় কাঠামোপূজা |
রথযাত্রা কিংবা জন্মাষ্টমীর দিন বিধি মেনে কাঠামো পূজার রেওয়াজ সেকালের নিয়ম মেনে এখনও চলে বহু ঐতিহ্যবাহী মন্দির ও বনোদী বাড়ির পুজোয় |
পুরাতন কাঠামোয় নতুন খড় ও মাটির প্রথম প্রলেপ এই কাঠামো পূজার অন্যতম প্রধান কাজ |
এরপর ধারাবাহিক নিয়মে চলে মৃন্ময়ী প্রতিমার নির্মাণ |
কাঠামো নির্মাণের এই ভাবনাটি সুপ্রাচীন |
বিসর্জনের পর থেকে কাঠামো পূজার আগে পর্যন্ত গত বছরের জীর্ণ কাঠামোই দেবীর স্মারক |
এই কাঠামো পূজা বারোয়ারি পুজোয় খুব একটা প্রচলন নেই |
তারা মূর্তি সংগ্রহ করে কুমোরবাড়ি থেকে |
বরং ইদানীং বিভিন্ন বারোয়ারি পুজোয় প্রচলন ঘটেছে খুঁটিপূজার |
এই পূজার ভাবনাটি একেবারে নতুনতর |
কাঠামো পূজা সংক্রান্ত সমস্ত আয়োজন যেমন দেবী প্রতিমাকে কেন্দ্র করে, তেমনই এক্ষেত্রে মূল বিষয় মণ্ডপ |
খুঁটিপূজা একটি মাত্র খুঁটিকে কেন্দ্র করে সমাপ্ত হয় এবং নামজাদা কারও হাতের স্পর্শে হৈ হৈ করে সেটিকে মাটিতে প্রথম পুঁতে মণ্ডপ নির্মাণের শুভ সূচনা করা হয় |
এই খুঁটিটির অবস্থান বদলানো হয় না ভুলেও |
সম্পূর্ণ দুর্গোৎসবের সাক্ষী থাকে এটি |
বিশ্বায়নের যুগে এটি অন্যতম পূজাসংঘের বাণিজ্যিক প্রচারের হাতিয়ার |
তবে এখনও এই প্রথাটি বহুল জনপ্রিয় হয়নি, কিন্তু বলতেই হয়, কম জনপ্রিয়ও হয়নি এটি |
ষষ্ঠীর সন্ধ্যায় বিল্ববৃক্ষমূলে দেবীর বহুবিধ উপকরণের মাধ্যমে বোধনের মধ্যে দিয়ে চিরাচরিত দুর্গাপূজার সূচনা করা হলেও ইদানীং দেবীর বোধনের আগে উদ্বোধন চলছে! দেবীর উদ্বোধন করছেন নামী-দামী মানুষেরা |
দেবী প্রতিমার মোড়ক উন্মোচিত করে জন সাধারণের চোখে দেবীকে দৃশ্যমান করার এক এলিট পন্থা এই উদ্বোধন |
পূজাবিধি অনুসারে বেল গাছের তলে দেবীর আবাহনীর পর শুরু হয় দেবীর অধিবাস পর্ব |
যদিও নগরাঞ্চলে গাছের অভাব চিরকালই থাকার দরুণ বেল গাছের কাটা শাখাকেই বেল গাছের প্রতীক মনে করে বোধন সমাধা হয় |
পরদিন সকালে নবপত্রিকা স্নানের মধ্যে দিয়ে শুরু হয় দুর্গাপূজা |
এই নিয়মানুগ বোধনের বহুআগেই উদ্বোধন সম্পন্ন হয় মহালয়া থেকে চতুর্থী খুব জোড় হলে পঞ্চমীর মধ্যে |
উদ্বোধনের সেলিব্রিটি জমকের দেবীদর্শনের সুযোগ মেলে জনসাধারণের |
এই সময়ের দুর্গাপূজার অন্যতম একটি বাণিজ্যিক দিক হল বিজ্ঞাপন |
বিজ্ঞাপনের এমন বহুমাত্রিক ব্যবহার আগে ছিল না |
পূজাসংঘগুলির প্রচারের অন্যতম সেরা মাধ্যম বিজ্ঞাপন |
চমকদার ভাষ্য এর উপজীব্য |
স্তরে স্তরে পূজাসংঘগুলি একটু একটু করে তাদের ভবনার প্রকাশ করেন একটি সাসপেন্স ধরে রেখে |
প্রথম বিজ্ঞাপন থেকে শেষ বিজ্ঞাপনের ভাষায় দেখা যায় আকাশ-পাতাল তফাত |
স্তরে স্তরে চমকের যেন মোড়ক খোলা চলে |
শুধু তাই নয়, এখন শ্রেষ্ঠ বিজ্ঞাপনের জন্যও রয়েছে পুরস্কারের আয়োজন |
তার মূল্যও বেশ কয়েক লাখ টাকা |
তবে এই সব বিজ্ঞাপনগুলিতে দুটি মোটা দাগের পার্থক্য রয়েছে |
কিছু বিজ্ঞাপন গ্র্যাফিক্সের রকমে চকমে ভরপুর, কিছু বিজ্ঞাপন শুধু শব্দের বয়ানেই বাজিমাত করতে আসরে নামে |
বড় দুর্গা ছোট দুর্গা বিষয়ক সামান্য কিছু শব্দের অপূর্ব বিন্যাসই এক্ষেত্রে যথেষ্ট |
বাদ যায় না চটুল বাক্যও |
সারা কলকাতায় এখন ব্যানারের রমরমা দেখলেই বোঝা যায় কতটা বিজ্ঞাপনের এমন ব্যবহার কতটা মূলত কলকাতার পূজাসংঘগুলিকে আকর্ষণ করেছে |
থিমের সাজে পূজামণ্ডপ নির্মাণের প্রকল্পটি বেশ কিছুদিন হল জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে |
বাঁশ কাপড় ও চারুশিল্পের যে সুসম বিন্যাস বিশ শতকের শেষভাগ অবধি বিশেষ জনপ্রিয় ছিল, তা এখন ক্ষয়ীষ্ণু |
থিমের হাত ধরে বিশেষ কোনো স্থান, স্থাপত্য, সংস্কৃতি, সভ্যতার আদল যেমন উঠে আসছে, তেমনই উঠে আসছে উপাদানের রকমফের |
প্লাস্টিক, মুক্ত, ঝিনুক, ভাঁড় প্রভৃতি উপাদানের মাধ্যমে গড়ে উঠছে মণ্ডপ |
থিমের সরাসরি ছোঁয়াচ লাগছে দেবী প্রতিমাতেও |
আবহমান দেবীরূপের থেকে সরে এসে থিমের সাথে মানানসই প্রতিমা নির্মাণের একটা হিড়িক এখন চোখে পড়ে |
কিছু ক্ষেত্রে দেবীর বিচিত্র মূর্তি পীড়াকর মন হলেও, বহুক্ষেত্রে দেবী মূর্তি শৈলীগত সুস্থ |
অনেক মণ্ডপেই এই ধরণের থিমজ দেবীতে পূজা চলে না |
থিমের প্রতিমার পাশাপাশি একসাথে মণ্ডপে থাকে পূজার জন্য আরেকটি ছোট প্রতিমা, যা নিয়ে কিছু কথা আগে বলেছি |
পাশাপাশি একথাও সত্য, এখনও বহু মণ্ডপে থিমের চমক থাকলেও দেবী প্রতিমায় তার প্রভাব পূজাসংঘগুলি সচেতন ভাবেই রাখেন না |
পূজার এই বাহ্যিক দিকটিকে বাহ্যিকই রাখেন তারা |
দুর্গাপূজার অন্যতম আকর্ষণ ছিল বিচিত্র বর্ণময় আলোকসজ্জা |
মূলত চন্দনগরের লাইনিং একটি সময়পর্ব পর্যন্ত কলকাতাতে দাপিয়ে বেড়িয়েছে |
সুচারু নক্সা ও আলোর জ্বলা-নেভার নান্দনিকতা কলকাতার পুজোগুলির একচেটিয়া ছিল |
আলোর গেটের পর আলোর গেট একসময় পার হয়ে মূল মণ্ডপে পৌঁছাতে হত, এখন বিজ্ঞাপনের গেট এসে এর আংশিক আভিজাত্য হারিয়েছে |
থিমের পুজোর হাত ধরে আলোক শিল্পের একদিক যেমন উন্মোচিত হয়েছে, তেমনই বন্ধ হয়েছে আরেকটা দিক |
থিমের মতো করে উপযোগী আলোর ব্যবহার এখন অহরহ দেখা যায় |
অবশ্য কলকাতার কলেজ স্ট্রিট কিংবা গড়িয়াহাট অঞ্চলের পুজোয় এখনও আলোক সজ্জার চমক রয়েছে |
সেটি অনেকাংশে আভিজাত্য বজায় রাখার জন্য সাজানো |
ঠিক একইভাবে ক্ষয় ঘটেছে পুজোর বাদ্যিতে |
ঢাকবাদকের অসধারণ ভঙ্গিমায় নেচে নেচে প্রাণবন্ত ঢাকের বোল ও পূজাপর্বের সাথে মিলিয়ে ধ্বনির ওঠা-পড়া পূজার অন্যতম উপকরণ ছিল বলা চলে |
ঢাকের শব্দের মধ্যে কেমন যেন মন কেমন করা পুজো পুজো ভাব আছে |
ঢাকের পর্যায় ক্রমিক যে নিনাদ ধ্বনি গায়ে কাঁটা ধরিতে তুলত, তা বন্ধ হয়ে গেছে থিম সঙ্গীত ও সিডিতে বদ্ধ ঢাকের বোলের মাধ্যমে |
থিম সঙ্গীত ও সিডির ডাক কতটা পুজোর গন্ধ মাখায় সে বিষয়ে একটু সংশয় তো আছেই |
বিশেষ করে থিমের পুজোয় ঢাকবাদকেরা দেবীর আরাধনা ও আরতির সময় ছাড়া তাদের প্রতিভার নির্দশন ঘটাতে তেমন পারেন না |
যে বঙ্গীয় ভাব ও আগমনীর গন্ধ ঢাকের ধ্বনিতে আছে, তার কতটা থিম সঙ্গীতে রয়েছে, তা নিয়ে সংশয় আছে যথেষ্ট |
বিশ্বায়ন গ্রাস করছে আমাদের প্রতিপদে |
বাদ যাচ্ছে না ভারতীয় উপমহাদেশের পশ্চিমবঙ্গও |
বিশ্বায়ন ও বিশ্ববাণিজ্যের পরোক্ষ প্রভাবে পূজাসংঘগুলি সচেতন ভাবেই নেমে আসছেন পুরস্কারের লড়াইয়ে |
শ্রেষ্ঠ আলো, শ্রেষ্ঠ মণ্ডপ, শ্রেষ্ঠ আবহ, শ্রেষ্ঠ প্রতিমা সহ নানা দিক নিয়ে চলছে তুল্য-মূল্য বিচার |
আমাদের সংস্কৃতি সভ্যতার থেকে দূরে বিশ্বায়নের গ্রাসের দিকে এগিয়ে আসছি আমরা |
এখনও সে ধারণাটি খুব স্পষ্ট নয় |
সময় লাগবে বুঝতে |
আধুনিকতার তীব্রতর লড়াইয়ে আমাদের বঙ্গীয় সংস্কৃতির প্রবহমান আনন্দোৎসব হয়তো ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে |
আমরা হয়তো সরে আসছি শিকড় থেকে |
পূজার নৈষ্ঠিক পদ্ধতির চেয়েও বর্তমানে মনোযোগ থাকছে সকলের বাহ্যিক প্রকরণে |
এতটাও হয়তো উগ্রতা কাম্য নয় |
শিকড়ের বিচ্যূতি ঘটলে গাছের দৃঢ়তা নষ্ট হয়ে যায়, এটি আমাদের বোঝা উচিত |
পূজার মতো মনোজ্ঞ বিষয়ে আধুনিকতা হয়তো ততটুকুই কাম্য, যতটা আধুনিকতায় আমরা আমাদের প্রবহমান আনন্দোৎসবের ঐতিহ্যের রেশ স্পর্শ করে থাকতে পারি প্রজন্মের পর প্রজন্ম |
মিলনোৎসবের ভাব মিলনোৎসবে সীমাবদ্ধ থাকুক, বিশ্বায়নের কূট প্রভাব আমাদের দেশজ সংস্কৃতি থেকে বাণিজ্যমুখীন যতদিন পর্যন্ত কম করে, ততদিনই আমাদের পক্ষে মঙ্গল |
অন্তঃসার শূন্য বাহ্যিক আয়োজনের শৌখিন মজদুরী একটি সময়পর্বে ভয়ংকর হলেও হতে পারে |
আমাদের পূজার সঙ্গে শিল্প সংস্পর্শিত |
শিল্পের কঙ্কাল ভারতীয় উপমহাদেশের সংস্কৃতির বিপরীত মেরুর বিন্দু |
সময়ের অভিযাত্রায় পূজাবিষয়ক অনেক কিছুতেই এসেছে বিবর্তন |
শুধু গ্রহণ বর্জনের দায়িত্ব এখন আমাদের বহন করতে হবে |
Subsets and Splits
No community queries yet
The top public SQL queries from the community will appear here once available.