content
stringlengths 0
129k
|
---|
অরুণের বুকে জমা ছিল পাকিস্তানের প্রতি তীব্র ঘৃণা |
সেনাবাহিনীতে যোগদানের মাত্র ছ'মাসের মধ্যেই পাক-ভারত যুদ্ধে লড়ার সুযোগ পেয়ে উত্তেজিত হয়ে উঠেছিলেন ২১ বছরে অরুণ ক্ষেত্রপাল |
তাঁর সেভেনটিন-পুনা হর্স রেজিমেন্টকে দেওয়া হয়েছিল একটি বিশেষ মিশন |
বসন্তর নদীর অস্থায়ী সেতু পেরিয়ে ওপারে পাতা মাইন সরিয়ে পরবর্তী বাহিনীর জন্য আক্রমণের পথ তৈরি করে দিতে হবে |
একই সঙ্গে দখলে রাখতে হবে সেতুটির পাকিস্তানের দিকের অংশ |
১৫ ডিসেম্বর ১৯৭১ |
রাত ৯টা নাগাদ পাকিস্তানের মাটিতে প্রবেশ করেছিল ভারতীয় সেনার ফর্টিসেভেন বিগ্রেড বা 'ব্ল্যাক অ্যারো' |
যেটি সেভেনটিন-পুনা হর্স ও ফোর- হডসন হর্স রেজিমেন্ট নিয়ে গঠিত |
রাতের অন্ধকারে সেনাবাহিনীর ইঞ্জিনিয়াররা 'মাইন স্যুইপার' ট্যাঙ্ক দিয়ে মাটির নীচে পেতে রাখা মাইন পরিষ্কার করে চলেছিলেন |
এলাকা পাহারায় ছিল ভারতের 'এ' এবং 'বি' ট্যাঙ্ক স্কোয়াড্রন |
'এ' স্কোয়াড্রনের কমান্ডার ছিলেন অরুণ ক্ষেত্রপাল |
তিনি নিজে ছিলেন তাঁর 'ফামাগুস্তা' ট্যাঙ্কে |
ট্যাঙ্কটির ড্রাইভার ছিলেন প্রয়াগ সিং, রেডিও অপারেটর ছিলেন নন্দ সিং এবং গানার ছিলেন নাথু সিং |
ইঞ্জিনিয়ারদের মাইন সরানোর কাজ তখন মাঝপথে |
পাকিস্তানের জারপালের কাছে ভারতীয় ইঞ্জিনিয়ারদের ওপর তুমুল হামলা চালিয়েছিল পাক সেনাবাহিনী |
শহিদ হয়েছিলেন ভারতীয় সেনাবাহিনীর বেশ কিছু ইঞ্জিনিয়ার |
ধ্বংস হয়েছিল একটি 'মাইন স্যুইপার' ট্যাঙ্ক |
এই ট্যাঙ্ক বাহিনীর সাহায্য চেয়েছিল অগ্রবর্তী বাহিনীটি |
ট্যাঙ্ক বাহিনী সিদ্ধান্ত নিয়েছিল ইঞ্জিনিয়ার রেজিমেন্টকে বাঁচাবার জন্য মাইন বিছানো পথেই এগোবে |
ফামাগুস্তা ছুটেছিল জারপালের পথে |
১৬ ডিসেম্বর ভোরে সেভেনটিন-পুনা হর্সের 'এ' ও 'বি' ট্যাঙ্ক স্কোয়াড্রন এগিয়ে গিয়েছিল পাকিস্তানের জারপাল গ্রামের দিকে |
এগোনো শুরু করতেই আক্রমণ শুরু করেছিল পাকিস্তানের ট্যাঙ্ক বাহিনী এবং বিভিন্ন জায়গায় ঘাপটি মেরে থাকা মেশিনগান পোস্ট |
প্রথমে অপ্রস্তুত হয়ে গেলেও, কয়েক মিনিটের মধ্যেই ভয়ঙ্কর জবাব দিয়েছিল অরুণ ক্ষেত্রপালের 'এ' স্কোয়াড্রন |
গুঁড়িয়ে দিয়েছিল পাকিস্তানের সবকটি মেশিনগান পোস্ট |
নিপুণভাবে যুদ্ধ পরিচালনা করছিলেন এক একুশ বছরের তরুণ |
তাঁর স্কোয়াড্রনের সবাই বয়সে অরুণের থেকে বড় |
কিন্তু সবাই তাঁকে মানেন |
কারণ তিনি সবাইকে শ্রদ্ধা করেন |
তাই তাঁর স্কোয়াড্রনে ক্ষেত্রপাল স্যারের কথা বেদবাক্য |
'বি' স্কোয়াড্রন এগিয়ে গিয়েছিল 'মাইন স্যুইপার' বাহিনীকে রক্ষা করার জন্য |
অরুণ ক্ষেত্রপালের 'এ' স্কোয়াড্রন এলাকা দখলে রাখছিল |
সকাল আটটা নাগাদ, গোটা জারপাল এলাকা চলে গিয়েছিল পাকিস্তান সেনার তৈরি করা ধোঁয়ার আড়ালে |
ধোঁয়ার সুযোগ নিয়ে পাক সেনার থার্টিন-ল্যান্সার ট্যাঙ্ক বাহিনী অতর্কিতে আক্রমণ হেনেছিল ভারতের 'বি' স্কোয়াড্রনের ওপর |
অতর্কিত আক্রমণে প্রায় ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল 'বি' স্কোয়াড্রন |
শহিদ হয়েছিলেন 'বি' স্কোয়াড্রনের কমান্ডার |
'বি' স্কোয়াড্রন থেকে সাহায্য চাওয়া হয়েছিল 'এ' স্কোয়াড্রনের কমান্ডার অরুণ ক্ষেত্রপালের কাছে |
যিনি তাঁর স্কোয়াড্রন নিয়ে অবিরাম চারদিকে গোলাবর্ষণ করে এলাকা দখলে রাখছিলেন |
'ফামাগুস্তা' ট্যাঙ্কের রেডিও অপারেটর নন্দ সিংয়ের কাছ থেকে বার্তা পেয়ে অরুণ ক্ষেত্রপাল সঙ্গে সঙ্গেই এগিয়ে গিয়েছিলেন জারপালের দিকে |
যেখানে চরম বিপদে পড়েছে 'বি' স্কোয়াড্রন |
গোলাবর্ষণ করতে করতে এগিয়ে চলেছিল অরুণ ক্ষেত্রপালের স্কোয়াড্রন |
সেকেন্ড লেফটেন্যান্ট অরুণ নিজের হাতে চালাচ্ছিলেন ট্যাঙ্কের ওপরে বসানো মেশিনগান |
'বি' স্কোয়াড্রনের ধ্বংসের খবরে ক্রোধে উন্মত্ত হয়ে গিয়েছিলেন তিনি |
তাঁর স্কোয়াড্রনের দিকে ছুটে আসছিল পাকিস্তানের পদাতিক সেনারা |
অরুণ ক্ষেত্রপাল নির্দেশ দিয়েছিলেন পাক সেনাদের ওপর দিয়েই ট্যাঙ্ক চালিয়ে দিতে |
"না স্যর, আমি আমার ট্যাঙ্ক ছাড়ব না |
কিন্তু জারপাল পৌঁছনোর আগেই এলাকায় এসে গিয়েছিল পাকিস্তান সেনার প্রচুর ট্যাঙ্ক |
উত্তেজিত অরুণ নিজের সুরক্ষার কথা ভুলে ট্যাঙ্কের 'হ্যাচ' দিয়ে শরীরের প্রায় অর্ধেকটা বের করে শত্রু সেনার অবস্থান দেখছিলেন |
সেই মুহূর্তে একটি গোলা এসে পড়েছিল অরুণ ক্ষেত্রপালের ট্যাঙ্কে |
মারাত্মক আহত হয়েছিলেন অরুণ ক্ষেত্রপাল |
রক্তে ভেসে গিয়েছিল 'ফামাগুস্তা' |
আগুন ধরে গিয়েছিল ট্যাঙ্কের একটি অংশে |
নন্দ সিং রেডিওর মাধ্যমে খবর পাঠিয়েছিলেন |
অরুণকে তাঁর রেজিমেন্টের বস বলেছিলেন 'ফামাগুস্তা' ছেড়ে অন্য ট্যাঙ্কে উঠে ফিরে আসতে |
কিন্তু ফিরতে চাননি নাছোড়বান্দা অরুণ |
রক্তাক্ত শরীর নিয়ে হাঁফাতে হাঁফাতে বলেছিলেন, "না স্যর, আমি আমার ট্যাঙ্ক ছাড়ব না |
আমার মেশিনগান ও কামান এখনও কাজ করছে |
আমি এই বেজন্মাদের দেখে নেব |
" তারপর নিজে হাতে বন্ধ করে দিয়েছিলেন রেডিও সেট, যাতে তাঁর সঙ্গে আর যোগাযোগ করতে না পারে তাঁর রেজিমেন্ট |
চক্রব্যূহের অভিমন্যু 'অরুণ ক্ষেত্রপাল' |
কিন্তু পাকিস্তানের ট্যাঙ্কের সংখ্যা অনেক বেশি |
তাই একে একে ধ্বংস হতে শুরু করেছিল অরুণের স্কোয়াড্রনের ট্যাঙ্কগুলি |
এক সময় তাঁর 'ফামাগুস্তা' নিয়ে একা হয়ে গিয়েছিলেন সেকেন্ড লেফটেন্যান্ট অরুণ |
নারওয়ালের বারাপিন্দ গ্রামে, ফামাগুস্তাকে চারদিক থেকে ঘিরে ধরেছিল পাকিস্তানের চোদ্দটি প্যাটন ট্যাঙ্ক |
চক্রব্যূহের ভেতরে থাকা অভিমন্যুর মত বীরবিক্রমে লড়াই শুরু করেছিলেন অরুণ ক্ষেত্রপাল |
আহত বাঘের মত ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন পাকিস্তানের ট্যাঙ্ক বাহিনীর ওপর |
চরকির মতো ঘুরতে ঘুরতে গোলাবর্ষণ করে চলেছিল 'ফামাগুস্তা' |
নিপুণ হাতে মেশিনগান চালিয়ে যাচ্ছিলেন অরুণ |
লুটিয়ে পড়ছিল পাক পদাতিক সেনারা |
ফামাগুস্তার সঙ্গে লড়াইয়ে কিছুতেই এঁটে উঠতে পারছিল না পাকিস্তানি প্যাটন ট্যাঙ্কগুলি |
তাদের কমান্ডাররা বুঝতেই পারছিলেন না অরুণের রণকৌশল |
যেদিকে ধোঁয়া সেদিকে ছুটে যাচ্ছিল অরুণের 'ফামাগুস্তা' |
ধোঁয়ার আড়াল থেকে আঘাত হানছিল পাকিস্তানের ট্যাঙ্কগুলিতে |
ধ্বংস হয়ে যাচ্ছিল একের পর এক পাকিস্তানি প্যাটন |
ফামাগুস্তাকে ঘিরে ধরা চোদ্দটি ট্যাঙ্কের মধ্যে নয়টি ট্যাঙ্ককেই ধ্বংস করে দিয়েছিলেন অরুণ |
পাকিস্তানি সেনারা ভেবেছিল ফামাগুস্তাকে জিনে ভর করেছে |
নাহলে এত গোলা ছুঁড়েও কেন ফামাগুস্তাকে আঘাত করা যাচ্ছে না |
তাঁর দশ নম্বর শিকারটিকে মাত্র একশো মিটার দূর থেকে ধংস করে দিয়েছিলেন অরুণ |
এই দূরত্বই প্রমাণ করে পাকিস্তানি ট্যাঙ্ক বাহিনীকে নিকেশ করার জন্য কতটা মরিয়া হয়ে উঠেছিলেন অরুণ ক্ষেত্রপাল |
পাকিস্তানি কমান্ডাররা ভেবেছিলেন ফামাগুস্তার কমান্ডারের বহু যুদ্ধের অভিজ্ঞতা আছে |
নাহলে এই অবিশাস্য লড়াই করার হিম্মত সবার থাকে না |
বসন্তর যুদ্ধে ধ্বংস হওয়া পাকিস্তানি ট্যাঙ্ক |
যার মধ্যে দশটি ধ্বংস হয়েছিল অরুণ ক্ষেত্রপালের হাতে |
মুগ্ধ হয়েছিল শত্রু সেনাও |
পাকিস্তানের বাকি ট্যাঙ্কগুলিকে ধ্বংস করার জন্য মরিয়া অরুণ ক্ষেত্রপাল আবার ভুলে গিয়েছিলেন নিজের সুরক্ষা |
অরুণের ট্যাঙ্কে এসে পড়েছিল পাকিস্তানের মেজর নাসেরের ট্যাঙ্কের গোলা |
প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই শহিদ হয়েছিলেন রেডিও অপারেটর নন্দ সিং |
ছিন্নভিন্ন হয়ে গিয়েছিল সেকেন্ড লেফটেন্যান্ট অরুণ ক্ষেত্রপালের শরীর |
তবুও শেষঘুমে ঢলে পড়ার আগে মেশিনগানের ট্রিগারে শেষ চাপটি দিয়েছিলেন অবিস্মরণীয় যুদ্ধের নায়ক অরুণ ক্ষেত্রপাল |
জ্বলতে থাকা ফামাগুস্তার দিকে এগিয়ে আসা পাকিস্তানের কয়েকজন পদাতিক সেনা লুটিয়ে পড়েছিল |
তারপর ট্রিগার থেকে সরে গিয়েছিল অরুণ ক্ষেত্রপালের হাত |
লুটিয়ে পড়েছিলেন ট্যাঙ্কের ভেতরে |
পাকিস্তানি সেনারা দৌড়ে এসেছিল জিনে ভর করা ফামাগুস্তার কমান্ডারকে দেখবার জন্য |
তারা ভেবেছিল, ফামাগুস্তার কমান্ডার হবেন কোনও মধ্যবয়স্ক ফৌজি |
স্তম্ভিত হয়ে তারা দেখেছিল ট্যাঙ্কের ভেতর ছিন্নভিন্ন হয়ে লুটিয়ে থাকা এক মিষ্টি চেহারার সদ্য যুবককে |
যাঁর পরনে ছিল কমান্ডারের পোশাক |
দুঃসাহসী অরুণের লড়াই দেখে সেদিন মুগ্ধ হয়েছিল শত্রু সেনারাও |
থেমে গিয়েছিল যুদ্ধ |
ফামাগুস্তা থেকে প্রয়াগ সিং ও নাথু সিংকে বের করে এনেছিল পাকিস্তানি সেনারা |
তাঁদের থেকে পেয়েছিল ফামাগুস্তার কমান্ডারের পরিচয় |
ফামাগুস্তা থেকে পাকিস্তানি সেনা উদ্ধার করেছিল কমান্ডার অরুণ ক্ষেত্রপাল ও নন্দ সিংয়ের দেহ |
Subsets and Splits
No saved queries yet
Save your SQL queries to embed, download, and access them later. Queries will appear here once saved.