author
stringclasses 33
values | text
stringlengths 86
1.25M
|
---|---|
কামিনী রায় | এরা যদি জানে
কামিনী রায়
এদেরও তো গড়েছেন নিজে ভগবান্,
নবরূপে দিয়েছেন চেতনা ও প্রাণ;
সুখে দুঃখে হাঁসে কাঁদে স্নেহে প্রেমে গৃহ বাঁধে
বিধে শল্যসম হৃদে ঘৃণা অপমান,
জীবন্ত মানুষ এরা মায়ের সন্তান॥
এরা যদি আপনারে শেখে সম্মানিতে,
এরা দেশ-ভক্ত রূপে জন্মভূমি-হিতে
মরণে মানিবে ধর্ম বাক্য নহে —দিবে কর্ম;
আলস্য বিলাস আজো ইহাদের চিতে
পারেনি বাঁধিতে বাসা, পথ ভুলাইতে॥
এরা হতে পারে দ্বিজ—যদি এরা জানে,
এরা কি সভয় সরি' রহে ব্যবধানে?
এরা হতে পারে ,বীর, এরা দিতে পারে শির,
জননীর, ভগিনীর, পত্নীর সম্মানে,
ভবিষ্যের মঙ্গলের স্বপনে ও ধ্যানে।
এরা যদি জানে॥
উচ্চ কূলে জন্ম ব'লে কত দিন আর
ভাই বিপ্র রবে তব এই অহংকার?
কৃতান্ত সে কুলীনের রাখে না তো মান,
তার কাছে দ্বিজ শূদ্র পারীয়া সমান।
তার স্পর্শে যেই দিন পঞ্চভূতে দেহ লীন
বাহ্মণে চণ্ডালে রহে কত ব্যবধান? |
কামিনী রায় | কত ভালবাসি
কামিনী রায়
জড়ায়ে মায়ের গলা শিশু কহে আসি,—
“মা, তোমারে কত ভালোবাসি!”
“কত ভালবাস ধন?” জননী শুধায়।
“এ-ত।” বলি দুই হাত প্রসারি’ দেখায়।
“তুমি মা আমারে ভালবাস কতখানি?”
মা বলেন “মাপ তার আমি নাহি জানি।”
“তবু কতখানি, বল।”
“যতখানি ধরে
তোমার মায়ের বুকে।”
“নহে তার পরে?”
“তার বাড়া ভালবাসা পারি না বাসিতে।”
“আমি পারি।” বলে শিশু হাসিতে হাসিতে! |
কামিনী রায় | কর'না জিজ্ঞাসা
কামিনী রায়
মোরে প্রিয় কর'না জিজ্ঞাসা,
সুখে আমি আছি কি না আছি।
ডরি আমি রসনার ভাষা ;
দোঁহে যবে এত কাছাকাছি,
মাঝখানে ভাষা কেন চাই ;
বুঝবার আর কিছু নাই ?
হাত মোর বাঁধা তব হাতে,
শ্রান্ত শির তব স্কন্ধোপরি,
জানিনা এ সুস্নিগ্ধ সন্ধ্যাতে
অশ্রু যেন ওঠে আঁখি ভরি।
দুঃখ নয়, ইহা দুঃখ নয়,
এইটুকু জানিও নিশ্চয়।
নীলাকাশে ফুটিতেছে তারা,
জাতি যুথী পল্লব হরিতে ;
অতি শুভ্র, অত্যুজ্জ্বল যারা,
আসে চলি আঁধার তরীতে।
ভেসে আজ নয়নের জলে
কি আসিছে, কে আমারে বলে?
(২)
সুখ সে কেমন যাদুকর,
তাকাইলে হয় অন্তর্ধান,
ডাকিলে সে দেয় না উত্তর,
চাহিলে সে করে না তো দান।
দুঃখ যে হইলে অতীত
সুখ বলি হয়গো প্রতীত !
সুখ সাথে আছে, কি না আছে,
কোন নাই প্রশ্ন মিমাংশার,
চলিছে সে পার্শ্বে কিবা পাছে ;
সুখ দুঃখ চেনা বড় ভার ;
আমরা দুজনে দু'জনার,
পিছে পাছে দৃষ্টি কেন আর?
ওগো প্রিয় মোর মনে হয়,
প্রেম যদি থাকে মাঝখানে,
আনন্দ সে দূরে নাহি রয়।
প্রাণ যবে মিলে যায় প্রাণে,
সঙ্গীতে আলোকে পায় লয়,
যত ভয়, যতেক সংশয়। |
কামিনী রায় | কর্তব্যের অন্তরায়
কামিনী রায়
কে তুমি দাঁড়ায়ে কর্তব্যের পথে,
সময় হরিছ মোর ;
কে তুমি আমার জীবন ঘিরিয়া
জড়ালে স্নেহের ডোর,
চির-নিদ্রাহীন নয়নে আমার
আনিছ ঘুমের ঘোর?
দু'নয়ন হ'তে দূরস্থ আলোকে
কেন কর অন্তরাল?
কেমনে লভিব লক্ষ্য জীবনের
পথে কাটাইলে কাল?
আমার রয়েছে কঠোর সাধনা,
ফেলনা মায়ার জাল |
তোমারে দেখিলে গত অনাগত
যাই একেবারে ভুলে
মুগ্ধ হিয়া মম চাহে লুটাইতে
তোমার চরণমূলে,
ফেলে যাও তারে, দলে যাও তারে,
নিওনা, নিওনা তু'লে |
তোমার মমতা অকল্যাণময়ী,
তোমার প্রণয় ক্রূর,
যদি লয়ে যায় ভুলাইয়া পথ,
লয়ে যাবে কত দূর?
এই স্বপ্নাবেশ রহিবার নয়,
চলে যাও হে নিষ্ঠুর | |
কামিনী রায় | ডেকে আন্
কামিনী রায়
পথ ভুলে গিয়াছিল, আবার এসেছে ফিরে,
দাঁড়ায়ে রয়েছে দূরে, লাজে ভয়ে নত শিরে ;
সম্মুখে চলে না পদ, তুলিতে পারে না আঁখি,
কছে গিয়ে, হাত ধরে, ওরে তারে আন্ ডাকি।
ফিরস্ নে মুখ আজ নীরব ধিক্কার করি,
আজি আন্ স্নেহ-সুধা লোচন বচন ভরি।
অতীতে বরষি ঘৃণা কিবা আর হবে ফল?
আঁধার ভবিষ্য ভাবি, হাত ধরে লয়ে চল্।
স্নেহের অভাবে পাছে এই লজ্জানত প্রাণ
সঙ্কোচ হারায়ে ফেলে—আন্ ওরে ডেকে আন্!
আসিয়াছে ধরা দিতে, শত স্নেহ-বাহু-পাশে
বেঁধে ফেল্ ; আজ গেলে আর যদি না-ই আসে।
দিনেকের অবহেলা, দিনেকের ঘৃণাক্রোধ,
একটি জীবন তোরা হারাবি জীবন-শোধ।
তোরা কি জীবন দিবি? উপেক্ষা যে বিষবাণ,
দুঃখ-ভরা ক্ষমা লয়ে, আন্, ওরে ডেকে আন্। |
কামিনী রায় | দিন চলে যায়
কামিনী রায়
একে একে একে হায়! দিনগুলি চলে যায়,
কালের প্রবাহ পরে প্রবাহ গড়ায়,
সাগরে বুদ্বুদ্ মত উন্মত্ত বাসনা যত
হৃদয়ের আশা শত হৃদয়ে মিলায়,
আর দিন চলে যায়।
জীবনে আঁধার করি, কৃতান্ত সে লয় হরি
প্রাণাধিক প্রিয়জনে, কে নিবারে তায়?
শিথির হৃদয় নিয়ে, নর শূণ্যালয়ে গিয়ে,
জীবনের বোঝা লয় তুলিয়া মাথায়,
আর দিন চলে যায়।
নিশ্বাস নয়নজল মানবের শোকানল
একটু একটু করি ক্রমশঃ নিবায়,
স্মৃতি শুধু জেগে রহে, অতীত কাহিনী কহে,
লাগে গত নিশীথের স্বপনের প্রায় ;
আর দিন চলে যায়! |
কামিনী রায় | পাছে লোকে কিছু বলে
কামিনী রায়
করিতে পারি না কাজ
সদা ভয় সদা লাজ
সংশয়ে সংকল্প সদা টলে,-
পাছে লোকে কিছু বলে।
আড়ালে আড়ালে থাকি
নীরবে আপনা ঢাকি,
সম্মুখে চরণ নাহি চলে
পাছে লোকে কিছু বলে।
হৃদয়ে বুদবুদ মত
উঠে চিন্তা শুভ্র কত,
মিশে যায় হৃদয়ের তলে,
পাছে লোকে কিছু বলে।
কাঁদে প্রাণ যবে আঁখি
সযতনে শুকায়ে রাখি;-
নিরমল নয়নের জলে,
পাছে লোকে কিছু বলে।
একটি স্নেহের কথা
প্রশমিতে পারে ব্যথা,-
চলে যাই উপেক্ষার ছলে,
পাছে লোকে কিছু বলে।
মহৎ উদ্দেশ্য যবে,
এক সাথে মিলে সবে,
পারি না মিলিতে সেই দলে,
পাছে লোকে কিছু বলে।
বিধাতা দেছেন প্রাণ
থাকি সদা ম্রিয়মাণ;
শক্তি মরে ভীতির কবলে,
পাছে লোকে কিছু বলে। |
কামিনী রায় | মাতৃপূজা
কামিনী রায়
যেইদিন ও চরণে ডালি দিনু এ জীবন,
হাসি অশ্রু সেইদিন করিয়াছি বিসর্জন।
হাসিবার কাঁদিবার অবসর নাহি আর,
দুঃখিনী জনম-ভূমি,—মা আমার, মা আমার!
অনল পুষিতে চাহি আপনির হিয়া মাঝে,
আপনারে অপরেরে নিয়োজিতে তব কাজে ;
ছোটখাটো সুখ-দুঃখ—কে হিসাব রাখে তার
তুমি যবে চাহ কাজ,—মা আমার, মা আমার!
অতীতের কথা কহি' বর্তমান যদি যায়,
সে কথাও কহিব না, হৃদয়ে জপিব তায় ;
গাহি যদি কোন গান, গাব তবে অনিবার,
মরিব তোমারি তরে,—মা আমার, মা আমার!
মরিব তোমারি কাজে, বাঁচিব তোমারি তরে,
নহিলে বিষাদময় এ জীবন কেবা ধরে?
যতদিন না ঘুচিবে তোমার কলঙ্ক-ভার,
থাক্ প্রাণ, যাক্ প্রাণ,—মা আমার, মা আমার! |
কামিনী রায় | সুখ
কামিনী রায়
নাই কিরে সুখ? নাই কিরে সুখ?—
এ ধরা কি শুধু বিষাদময়?
যতনে জ্বলিয়া কাঁদিয়া মরিতে
কেবলি কি নর জনম লয়?—
কাঁদাইতে শুধু বিশ্বরচয়িতা
সৃজেন কি নরে এমন করে'?
মায়ার ছলনে উঠিতে পড়িতে
মানবজীবন অবনী 'পরে?
বল্ ছিন্ন বীণে, বল উচ্চৈঃস্বরে,—
না,—না,—না,—মানবের তরে
আছে উচ্চ লক্ষ্য, সুখ উচ্চতর,
না সৃজিলা বিধি কাঁদাতে নরে।
কার্যক্ষেত্র ওই প্রশস্ত পড়িয়া,
সমর-অঙ্গন সংসার এই,
যাও বীরবেশে কর গিয়ে রণ ;
যে জিনিবে সুখ লভিবে সেই।
পরের কারণে স্বার্থে দিয়া বলি
এ জীবন মন সকলি দাও,
তার মত সুখ কোথাও কি আছে?
আপনার কথা ভুলিয়া যাও।
পরের কারণে মরণের সুখ ;
'সুখ' 'সুখ' করি কেঁদনা আর,
যতই কাঁদিবে ততই ভাবিবে,
ততই বাড়িবে হৃদয়-ভার।
গেছে যাক ভেঙ্গে সুখের স্বপন
স্বপন অমন ভেঙ্গেই থাকে,
গেছে যাক্ নিবে আলেয়ার আলো
গৃহে এস আর ঘুর'না পাকে।
যাতনা যাতনা কিসেরি যাতনা?
বিষাদ এতই কিসের তরে?
যদিই বা থাকে, যখন তখন
কি কাজ জানায়ে জগৎ ভ'রে?
লুকান বিষাদ আঁধার আমায়
মৃদুভাতি স্নিগ্ধ তারার মত,
সারাটি রজনী নীরবে নীরবে
ঢালে সুমধুর আলোক কত!
লুকান বিষাদ মানব-হৃদয়ে
গম্ভীর নৈশীথ শান্তির প্রায়,
দুরাশার ভেরী, নৈরাশ চীত্কার,
আকাঙ্ক্ষার রব ভাঙ্গে না তায়।
বিষাদ—বিষাদ—বিষাদ বলিয়ে
কেনই কাঁদিবে জীবন ভরে'?
মানবের মন এত কি অসার?
এতই সহজে নুইয়া পড়ে?
সকলের মুখ হাসি-ভরা দেখে
পারনা মুছিতে নয়ন-ধার?
পরহিত-ব্রতে পারনা রাখিতে
চাপিয়া আপন বিষাদ-ভার?
আপনারে লয়ে বিব্রত রহিতে
আসে নাই কেহ অবনী 'পরে,
সকলের তরে সকলে আমরা,
প্রত্যেকে আমরা পরের তরে। |
কামিনী রায় | সে কি?
কামিনী রায়
'প্রণয়?'
'ছি!'
'ভালবাসা—প্রেম?'
'তাও নয়।'
'সে কি তবে?'
'দিও নাম, দিই পরিচয়—
আসক্তি বিহীন শুদ্ধ ঘন অনুরাগ,
আনন্দ সে নাহি তাহে পৃথিবীর দাগ ;
আছে গভীরতা আর উদ্বেল উচ্ছ্বাস,
দু'ধারে সংযম-বেলা, ঊর্দ্ধে নীল আকাশ,
উজ্জ্বল কৌমুদীতলে অনাবৃত প্রাণ,
বিম্ব প্রতিবিম্ব কার প্রাণে অধিষ্ঠান ;
ধরার মাঝারে থাকি ধরা ভুলে যাওয়া,
উন্নত-কামনা-ভরে ঊর্দ্ধ দিকে চাওয়া ;
পবিত্র পরশে যার, মলিন হৃদয়,
আপনাতে প্রতিষ্ঠিত করে দেবালয়,
ভকতি বিহ্বল, প্রিয় দেব-প্রতিমারে
প্রণমিয়া দূরে রহে, নারে ছুঁইবারে ;
আলোকের আলিঙ্গনে, আঁধারের মত,
বাসনা হারায়ে যায়, দুঃখ পরাহত ;
জীবন কবিতা-গীতি, নহে আর্তনাদ,
চঞ্চল নিরাশা, আশা, হর্ষ, অবসাদ।
আপনার বিকাইয়া আপনাতে বাস,
আত্মার বিস্তার ছিঁড়ি' ধরণীর পাশ।
হৃদয়-মাধুরী সেই, পূণ্য তেজোময়,
সে কি তোমাদের প্রেম?—কখনই নয়।
শত মুখে উচ্চারিত, কত অর্থ যার,
সে নাম দিও না এরে মিনতি আমার।' |
End of preview. Expand
in Dataset Viewer.
README.md exists but content is empty.
- Downloads last month
- 56