author
stringclasses
36 values
text
stringlengths
86
1.25M
অজ্ঞাত
যাও যাও গিরি, আনিতে গৌরী, উমা নাকি বড় কেঁদেছে দেখেছি স্বপন, নারদ বচন, উমা মা মা বলে কেঁদেছে ৷ সোনার বরণী গৌরী আমার, ভাঙড় ভিখারী জামাই তোমার, মায়ের বসন ভূষণ সব আভরণ তাও বেচে নাকি ভাঙ্গ খেয়েছে । মা এসেছে, মা এসেছে রে! (ওরে মা এসেছে, মা এসেছে, মা এসেছে রে) ওরে আয় রে তোরা, শঙ্খ বাজা, ‘আগমনী’ গা-রে । আজ সবার সাথে আনন্দেতে মায়ের চরণ ধূলি নে-রে ॥ (মায়ের চরণ-ধূলি নে-রে) বহুদিন পরে আসিবে ঘরে উমা আমার। উমা বিহনে না হেরি নয়নে ত্রিলোক হয়েছে আঁধার। শরৎ-আকাশে মেঘ ভাসে, উমারে হেরিতে ধায় উল্লাসে, নদী কুলুকুলু রবে নেচে নেচে চলে চরণ ধোয়াবে তার॥ যে ছিল মোর নয়নের মণি, সে আজি হয়েছে শিবের ঘরণি, উমারাণী আমার শ্মশানবাসিনী এই কি ছিল কপালে আমার। (আজি) শরৎ শান্ত ঊষার তিলকে শূন্য কুটীর দ্বারে । (ঐ) এলো গো জননী মুক্ত আলোকে ফুল্ল কুসুম ভারে ॥ সম্ভার শত নাহি মা পূজার ভকত শরণে লহ উপহার, অশিব-নাশিনী শিব কর মা মঞ্জুল ফুল হারে ॥ (পীতাম্বর দাস বা মুকুন্দ দাস রচিত) একবার বিদায় দে মা ঘুরে আসি। হাসি হাসি পরব ফাঁসি দেখবে ভারতবাসী। কলের বোমা তৈরি করে দাঁড়িয়ে ছিলেম রাস্তার ধারে মাগো, বড়লাটকে মারতে গিয়ে মারলাম আরেক ইংলন্ডবাসী। হাতে যদি থাকতো ছোরা তোর ক্ষুদি কি পড়তো ধরা মাগো রক্ত-মাংসে এক করিতাম দেখতো জগতবাসী শনিবার বেলা দশটার পরে জজকোর্টেতে লোক না ধরে মাগো হল অভিরামের দ্বীপ চালান মা ক্ষুদিরামের ফাঁসি বারো লক্ষ তেত্রিশ কোটি রইলো মা তোর বেটা বেটি মাগো তাদের নিয়ে ঘর করিস মা ওদের করিস দাসী দশ মাস দশদিন পরে জন্ম নেব মাসির ঘরে মাগো তখন যদি না চিনতে পারিস দেখবি গলায় ফাঁসি।
অতুলপ্রসাদ সেন
বলো বলো বলো সবে অতুলপ্রসাদ সেন বলো বলো বলো সবে, শত-বীণা-বেণু-রবে, ভারত আবার জগৎসভায় শ্রেষ্ঠ আসন লবে। ধর্মে মহান হবে, কর্মে মহান হবে, নব দিনমণি উদিবে আবার পুরাতন এ পূরবে। আজও গিরিরাজ রয়েছে প্রহরী, ঘিরি তিন দিক নাচিছে লহরী; যায়নি শুকায়ে গঙ্গা গোদাবরী, —এখনও অমৃতবাহিনী। প্রতি প্রান্তর, প্রতি গুহা বন, প্রতিজনপদ, তীর্থ অগণন, কহিছে গৌরব-কাহিনী॥ বিদুষী মৈত্রেয়ী খনা লীলাবতী, সতী সাবিত্রী সীতা অরুন্ধতী, বহু বীরবালা বীরেন্দ্র-প্রসূতি, আমরা তাঁদেরই সন্ততি। অনলে দহিয়া রাখে যারা মান, পতিপুত্র তরে সুখে ত্যজে প্রাণ, —আমরা তাঁদেরই সন্ততি॥ ভোলেনি ভারত ভোলেনি সেকথা, অহিংসার বাণী উঠেছিল হেথা, নানক নিমাই করেছিল ভাই সকল ভারত-নন্দনে। ভুলি ধর্ম-দ্বেষ জাতি অভিমান, ত্রিশ কোটি দেহ হবে এক প্রাণ, একজাতি প্রেম-বন্ধনে॥ মোদের এদেশ নাহি রবে পিছে, ঋষি-রাজকুল জন্মেনি মিছে, দু’দিনের তরে হীনতা সহিছে, জাগিবে আবার জাগিবে। আসিবে শিল্প ধন বাণিজ্য, আসিবে বিদ্যা বিনয় বীর্য, আসিবে আবার আসিবে॥ এসো হে কৃষক কুটির—নিবাসী, এসো অনার্য গিরি—বনবাসী, এসো হে সংসারী, এসো হে সন্ন্যাসী, —মিলো’ হে মায়ের চরণে॥ এসো অবনত, এসো হে শিক্ষিত, পরহিত-ব্রতে হইয়া দীক্ষিত, —মিলো’ হে মায়ের চরণে। এসো হে হিন্দু, এসো মুসলমান, এসো হে পারসী, বৌদ্ধ, খ্রিস্টিয়ান্,—মিল হে মায়ের চরণে॥ উঠোগো ভারতলক্ষ্মী অতুলপ্রসাদ সেন উঠোগো ভারতলক্ষ্মী! উঠো আদি জগত-জন-পূজ্যা, দুঃখ দৈন্য সব নাশি, করো দূরিত ভারত-লজ্জা। ছাড়োগো ছাড়ো শোক-শয্যা, করো সজ্জা পুনঃ কমল কনক ধন-ধান্যে। জননী গো লহ তুলে বক্ষে, সান্ত্বন-বাস দেহ তুলে চক্ষে; কাঁদিছে তব চরণতলে ত্রিংশতি কোটি নরনারী গো। কাণ্ডারী নাহিকো কমলা দুঃখ-লাঞ্ছিত ভারতবর্ষে, শঙ্কিত মোরা সব যাত্রী, কাল-সাগর-কম্পন দর্শে, তোমার অভয় পদ-স্পর্শে, নব হর্ষে, পুনঃ চলিবে তরণী শুভ লক্ষ্যে জননী গো, লহ তুলে বক্ষে, সান্ত্বন-বাস দেহ তুলে চক্ষে; কাঁদিছে তব চরণতলে ত্রিংশতি কোটি নরনারী গো। ভারত-শ্মশান করো পূর্ণ পুনঃ কোকিল-কূজিত কুঞ্জে, দ্বেষ-হিংসা করি’ চূর্ণ, করো পূরিত প্রেম-অলি-গুঞ্জে, দূরিত করি পাপ-পুঞ্জে, তপঃ-তুঞ্জে, পুনঃ বিমল করো ভারত পুণ্যে৷ জননী গো, লহো তুলে বক্ষে, সান্ত্বন-বাস দেহ তুলে চক্ষে; কাঁদিছে তব চরণতলে ত্রিংশতি কোটি নরনারী গো॥ মোদের গরব, মোদের আশা, আ-মরি বাংলা ভাষা অতুলপ্রসাদ সেন মোদের গরব, মোদের আশা, আ-মরি বাংলা ভাষা! তোমার কোলে, তোমার বোলে, কতই শান্তি ভালবাসা। কী যাদু বাংলা গানে! গান গেয়ে দাঁড় মাঝি টানে, (এমন কোথা আর আছে গো!) গেয়ে গান নাচে বাউল, গান গেয়ে ধান কাটে চাষা॥ ঐ ভাষাতেই নিতাই গোরা, আনল দেশে ভক্তি-ধারা, (মরি হায়, হায়রে!) আছে কৈ এমন ভাষা, এমন দুঃখ-শ্রান্তি-নাশা॥ বিদ্যাপতি, চণ্ডি, গোবিন্, হেম, মধু, বঙ্কিম, নবীন; (আরও কত মধুপ গো!) ঐ ফুলেরই মধুর রসে বাঁধলো সুখে মধুর বাসা॥ বাজিয়ে রবি তোমার বীণে, আন্‌লো মালা জগৎ জিনে!- (গরব কোথায় রাখি গো!) তোমার চরণ-তীর্থে আজি জগৎ করে যাওয়া আসা॥ ঐ ভাষাতেই প্রথম বোলে, ডাক্‌নু মায়ে “মা, মা,” বলে; ঐ ভাষাতেই ব’লবো ‘হরি’, সাঙ্গ হ’লে কাঁদা হাসা॥ হও ধরমেতে ধীর, হও করমেতে বীর অতুলপ্রসাদ সেন হও ধরমেতে ধীর, হও করমেতে বীর, হও উন্নতশির—নাহি ভয়। ভুলি ভেদাভেদ-জ্ঞান, হও সবে আগুয়ান, সাথে আছে ভগবান—হবে জয়। নানা ভাষা, নানা মত, নানা পরিধান, বিবিধের মাঝে দেখো মিলন মহান; দেখিয়া ভারতে মহাজাতির উত্থান—জগজন মানিবে বিস্ময়! জগজন মানিবে বিস্ময়॥ তেত্রিশ কোটি মোরা নহি কভু ক্ষীণ, হতে পারি দীন, তবু নহি মোরা হীন; ভারতে জনম, পুনঃ আসিবে সুদিন—ঐ দেখো প্রভাত-উদয়! ঐ দেখো প্রভাত-উদয়॥ ন্যায় বিরাজিত যাদের করে, বিঘ্ন পরাজিত তাদের শরে; সাম্য কভু নাহি স্বার্থে ডরে—সত্যের নাহি পরাজয়! সত্যের নাহি পরাজয়॥ তোর কাছে আসব মাগো অতুলপ্রসাদ সেন তোর কাছে আসব মাগো, শিশুর মত, সব আবরণ ফেলব দুরে আমার হৃদয় জুড়ে আছে যত। দৈন্য যে মা মনের মাঝে, ঘুচবে না তা মিথ্যা সাজে, সব আভরণ করব খালি, দেখবি মা তুই মনের কালি, শূন্য যে মোর প্রেমের থালি, তাই চরণে করব নত। মারবি মাগো যতই মোরে, ডাকব আমি ততই তোরে, ধরব যখন জড়িয়ে হাত, দেখব কেমন করবি আঘাত; তখন মা তুই পাবি ব্যথা, ব্যথা দিতে অবিরত। মনের হরষ মনের আশে; বলব সরল শিশুর ভাষে, সুখের খেলনা হাতে পেয়ে, তোর কাছে মা যাব ধেয়ে; তোর স্নেহাশীষ মাথায় লয়ে, ভবের খেলা খেলব যত॥ দাও হে, ওহে প্রেমসিন্ধু অতুলপ্রসাদ সেন দাও হে, ওহে প্রেমসিন্ধু! দাও এ নবীন যুগলে তোমার প্রেমের মধুর বিন্দু সুর-নর-চিত-বাঞ্চিত। যে প্রেমের শুধু প্রেম পরিণাম, তোমাতে উদয় তোমাতে বিরাম, বিষয়-বাসনা, ধন-জন-মান যে প্রেম করে না লাঞ্চিত। দুইটি হৃদয় হয়ে একাকার, স্বার্থের বাঁধ করিয়া বিদার বিশ্বের বুকে চলুক উদার কখনো না হয়ে কুঞ্চিত। টেনে লও, ওহে প্রেম পারাবার, তব শুভ কোলে হৃদি দুজনার, তোমার মধুর কঠোর শাসনে, কখনো কোরো না বঞ্চিত॥ দে মা দেখা সময় কালে অতুলপ্রসাদ সেন দে মা দেখা সময় কালে তুমি হর্তা কর্তা সর্বকালে॥ যে তোমারে পূজা করে সে থাকে সদা কুশলে কর্ম ধর্ম সকল তুমি জানবে লোকে কালে কালে॥ তুমি যারে ভালোবাস মরণ নাই তার কোনো কালে মৃত্যুঞ্জয়ী নাম ধরো মৃত্যু পালায় নাম শুনিলে॥ দয়াময়ের রাজ্যে তুমি আছো মাগো কৌতূহলে আমি হিসেব করে দেখলাম আবার জগৎ আছে তোমার কোলে॥ দয়াময়ের নামটি তোমার দেও মা আমার হৃদ কমলে আমি জন্ম দুঃখ দিয়া বিদায় পড়ে থাকব চরণ তলে॥ নমো বাণী বীণাপাণি, জগত-চিত্ত-সস্মোহিনী, নমো বাদ-সংগীত মাতঃ.ভারতী ভরতারিণী। সৌরলোক গীতচালিত, দ্যুলোকে ভুলোক গীতমুখরিত; ষড় ঋতু ষড়রাগরঞ্জিত বন্দে চরণে বন্দিনী। সুপ্ত স্মৃতি পুনঃ জীবিত, শান্ত তৃপ্ত তাপিত চিত, সুখী জন সদা নন্দিত তব সংগীত চন্দে। প্রেমমুখর মুরলী রন্ধ্র, সমরে ডমরু মরণমন্দ্র, গীত আদি-বেদ মন্ত্র তব সংগীত ছন্দে। নমো ঈশ্বর নন্দিনী। সংসারে যদি নাহি পাই সাড়া, তুমি তো আমার রহিবে। বহিবারে যদি না পারি এ ভার, তুমি তো বন্ধু, বহিবে। কলুষ আমার, দীনতা আমার, তোমারে আঘাত করে শতবার; আর কেহ যদি না পারে সহিতে, তুমি তো বন্ধু, সহিবে। যাক ছিঁড়ে যাক মোর ফুলমালা, থাক পরে থাক ভরা ফুলডালা। হবে না বিফল মোর ফুল তোলা- তুমি তো চরণে লইবে। দুঃখেরে আমি ডরিব না আর, কন্টক হোক কন্ঠের হার, জানি তুমি মোরে করিবে অমল যতই অনলে দহিবে॥ তোমায় ঠাকুর বলব নিঠুর কোন মুখে? শাসন তোমার যতই শুরু ততই টেনে লও বুকে। সুখ পেলে দিই অবহেলা মরণ মাগি দুখের বেলা; তবু ফেলে যাওনা চলে, সদাই থাক সস্মুখে। প্রতিদিনের অশেষ যতন, ভুলায় দেয় ক্ষণিক বেদন; নিত্য আছি ডুবিয়ে তাই পাসরি প্রেমসিন্ধুকে। সুখের পিছে মরি ঘুরে তাই তো রে সুখ পালায় দুরে; সে আনন্দ, ওরে অন্ধ, বন্ধ মনের । ভুলে যে যাই সবাই আমার, নই তো ভিন্ন আমি সবার; দশের মুখে হাসি রেখে কাঁদব আমি কোন দুখে? ভবের পথে শূন্য থালি, বেড়াই ঘুরে দীন কাঙালী, দৈন্য আমার ঘুচবে যবে পাব দীনবন্ধুকে! তাহারে ভুলিবে বলো কেমনে? গাঁথা যে সে তব শত গানের যতনে। কী হবে রুধিয়া দোর? ভাঙা যে হৃদয় তোর, মানিবে না মন-চোর বাহিরের বারণে॥ যাবি কোন দুর বিজনে পাসরিতে সেই জনে? সেথাও তো গাহে পাখি কাননে। সেথাও তো ফোটে ফুল, বরষা বিরহাকুল; সেথাও তো ওঠে চাঁদ রজনীর গগনে॥ ওহে জগত কারণ অতুলপ্রসাদ সেন ওহে জগত কারণ ! একি নিয়ম তব? এ কি মহোৎসব, এ কি মিলন নব? গ্রহ ডাকিয়া গ্রহে মিলন মাগে? অনু অনুকে ডাকে চির অনুরাগে। হৃদয় হৃদয়ে ডাকে প্রেম-সোহাগে, অখিল নিখিল ভরা এ কি আহবান রব? যে নিয়মে জীবগণ সুখ-দুখ-অন্ধ; প্রেম-পারিজাতে, প্রভু, একি মকরন্দ? দুইটি অন্তর তাই দুরান-র হতে, করিছে শপথ আজ মিলি একসাথে, ‘প্রেম হইবে রথী জীবনের রথে, তুচ্ছ দৈন্য, অতি তুচ্ছ বিভব।’ মিছে তুই ভাবিস মন অতুলপ্রসাদ সেন মিছে তুই ভাবিস মন। তুই গান গেয়ে যা গান গেয়ে যা আজীবন। পাখিরা বনে বনে, গাহে গান আপন-মনে; ওরে নাই বা যদি কেহ শোনে, তুই গেয়ে যা গান অকারণ। ফুলটি ফোটে যবে ভাবে কি কাল কি হবে? না-হয় তাদের মতন শুকিয়ে যাবি গন্ধ করি বিতরণ । মনোদুখ চাপি মনে হেসে নে সবার সনে, যখন ব্যথার ব্যথীর পাবি দেখা জানাস প্রাণের বেদন। আজি তোর যার বিরহে নয়নে অশ্রু বহে ওরে হয়তো তাহার পাবি দেখা গানটি হলে সমাপন। আয়, আয়, আমার সাথে ভাসবি কে আয় অতুলপ্রসাদ সেন আয়, আয়, আমার সাথে ভাসবি কে আয়! আজ আমার জোড় লেগেছে ভাঙা ভেলায়! ঐ দেখ চাঁদের আলো ঐ শোন কলকল কেমনে থাকবি বল শুকনো ডাঙায় ? আয় তোরা কুল ভুলানো কুল ভুলানো এই দরিয়ায়! নায়ে মোর নাই কিছু নাই তাই সবার লাগি হবে রে ঠাঁই। ভুলেছি কুলের বালাই, ভেসেছি তাই। কে তোরা বাঁধা বাটে, কে তোরা বাঁধা ঘাটে, সুখেতে থাকিস যদি থাক তোরা ভাই। যার আঁখি ছলছল চল চল আমার এ নায়! ঐ দেখ সুরধনী ছোটে কার ডাকটি শুনি; আমিও ডাক শুনেছি ‘আয়, ‘আয়, আয়!’ চল আজ স্রোতের সনে, ছুটি সেই ডাকের পানে, যেখানে জীবন মরণ সব ভেসে যায়! যেখানে যাবে জানা সেই অজানায়। পরের শিকল ভাঙিস পরে, নিজের নিগড় ভাই। আপন কারায় বন্ধ তোরা, পরের কারায় বন্দী তাই। হা রে মুর্খ, হা রে অন্ধ, ভাইয়ে ভাইয়ে করি দ্বন্দ্ব। দেশের শক্তি করিস মন্দ তোদের তুচ্ছ করে তাই সবাই। সার ত্যজিয়ে খোসার বড়াই! তাই মন্দিরে মসজিদে লড়াই। প্রবেশ করে দেখবে দু’ভাই অন্দরে যে একজনাই। দেশ-মাতার আর বিশ্ব-মাতার ম্লেচ্ছ কাফের এক পরিবার। নয় তুরস্ক, নয়কো তাতার জন্ম মৃত্যু এই যে ঠাঁই। ভিন্ন জাত আর বংশ, এক জাতি তাই একশো অংশ। হিন্দুরে, তুই হবি ধ্বংস, না ঘুচালে এই বালাই। ভাইকে ছুঁলে পদতলে শুদ্ধ হোস তুই গঙ্গাজলে, ওরে সেই অচ্ছৎ ছেলেই তুলে কোলে তুষ্ট হন যে গঙ্গা মাঈ॥ খাবি নে জল ভাইয়ের দেওয়া? খাসনে অন্ন তাদের ছোঁওয়া? ওরে শবরীর আধ খাওয়া মেওয়া রঘুনাথ তো খেলেন তাই। তোরাই আবার সভাস\’লে হাঁকিস সাম্য উচ্চরোলে সম-তন্ত্র চাস সকলে বিশ্ব প্রেমের দিস দোহাই। জাতির গলায় জাতের ফাঁস, ধর্ম করছে ধর্মনাশ, নিজের পায়ে, পারলি পাশ, দাসত্ব ঘোচে না তাই। ছাড়, দেখি রে রেশারেশি কর প্রাণে প্রাণে মেলামেশি। তখন তোদের সব বিদেশী দাস না বলে বলবে ভাই॥ মোর আজি গাঁথা হল না মালা, পরের তোলা ফুলে ভরা ডালা। তুলিব ফুল যত আপন মনোমত, যদিও কাঁটা শত দিবে জ্বালা। যদিও খুঁছিলে চামেলি নাহি মিলে, সাজাব বনফুলে তার গলা। একেলা তরু ছায় গাঁথিতে সে মালায় যদিও বেলা যায়-যাক বেলা॥ চাঁদিনী রাতে কে গো আসিলে? উজল নয়নে কে গো হাসিলে? মোহন সুরে ধীরে মধুরে পরাণ-বীণায় কে গো বাজিলে? হেম-যমুনায় প্রেম-তরী বায়, ডাকে আমায় ‘আয় গো আয়’- প্রভাতবেলায় সোনার ভেলায় কেমনে চলে যাবে হায়! তব সে ফুলে যাবে কি ভুলে যে ভালোবাসা বাসিলে? এসো গো একা ঘরে একার সাথী। সজল নয়নে বল রব কত রাতি! সুনীলআকাশে চন্দ্র বিকাশে, তামস নাশে; এ আঁধারে হাসিবে তব্ মুখ ভাতি। তোমারে গোপন ব্যথা জানাব গোপনে, তোমারে কুসুমমালা পরাব যতনে। তব সঙ্গ মাগি আছি আমি জাগি সরব-তেয়াগী; তব চরণ লাগি আছি কান পাতি॥ ওগো নিঠুর দরদী, এ কি খেলছ অনুক্ষণ। তোমার কাঁটায় ভরা বন,তোমার প্রেমে ভরা মন॥ মিছে দাও কাঁটার ব্যথা, সহিতে না পার তা ; আমার আঁখিজল তোমার করে গো চঞ্চল, তাই নয় বুঝি বিফল আমার অশ্রু বরিষণ। ডাকিলে কওনা কথা, কি নিঠুর নিরবতা॥ আবার ফিরে চাও, বল, ‘ওগো শুনে যাও; তোমার সাথে আছে আমার অনেক কথন॥ নীচুর কাছে নীচু হতে শিখলি না রে মন, তুই সুখি জনের করিস পূজা, দুঃখীর অযতন। মূঢ় মন, সুখি জনের করিস পূজা, দুঃখীর অযতন। নীচুর কাছে নীচু হতে শিখলি না রে মন। লাগে নি যার পায়ে ধুলি, কি নিবি তার চরণ ধুলি, নয়রে সোনায়, বনের কাঠেই হয় রে চন্দন। মূঢ় মন, হয় রে চন্দন। নীচুর কাছে নীচু হতে শিখলি না রে মন। এ মোধন মায়ের মতন, দুঃখীটুতেই অধিক যতন, এ ধনেতে ধনি যে জন, সেই তো মহাজন। মূঢ় মন, সেই তো মহাজন। বৃথা তোর কৃচ্ছসাধন, সেবাই নরের শ্রেষ্ঠ সাধন, মানবের পরম তীর্থ দীনের শ্রীচরণ। মূঢ় মন, দীনের শ্রীচরণ। মতামতের তর্কে মত্ত, আছিস ভুলে পরম সত্য, সকল ঘরে সকল নরে আছেন নারায়ণ। মূঢ় মন, আছেন নারায়ণ। নীচুর কাছে নীচু হতে শিখলি না রে মন। জল বলে, চল মোর সাথে চল, কখনো তোর আঁখিজল হবে না বিফল। চেয়ে দেখ মোর নীল জলে, শত চাঁদ করে টলমল। বধুরে আন ত্বরা করি, কূলে এসে মধু হেসে ভরবে গাগরি; ভরবে প্রেমে হৃদকলসী, করবে ছলছল। মোরা বাহিরে চঞ্চল, মোরা অন্তরে অতল, সে অতলে সদা জ্বলে রতন উজল। এই বুকে ফোটে সুখে হাসিমুখে শতদল; নহে তীরে, ওই নীরে হ’রি রে শীতল॥ একা মোর গানের তরী অতুলপ্রসাদ সেন একা মোর গানের তরী ভাসিয়েছিলাম নয়ন-জলে। সহসা কে এলে গো এ তরী বাইবে ব’লে যা ছিল কল্পমায়া, সে কি আজ ধরল কায়া? কে আমার বিফল মালা পরিয়ে দিল তোমার গলে। কেন মোর গানের ভেলায় এলে না প্রভাত-বেলায়? হলে না সুখের সাথী জীবনের প্রথম দোলায়। বুঝি মোর করুণ গানে ব্যাথা তাঁর বাজল প্রাণে, এলে কি দু’কুল হতে কূল মেলাতে এ অকূলে॥ আর কতকাল থাকব ব’সে দুয়ার খুলে, বধূ আমার! তোমার বিশ্বকাজে আমারে কি রইলে ভুলে, বধূ আমার। বাহিরে উষ্ণ বায়ে মালা যে যায় শুকায়ে, নয়নের জল, বুঝি তাও, বধূ মোর, যায় ফুরায়ে। শুধু ডোরখানি হায় কোন পরাণে তোমার গলায় দিব তুলে, বধূ আমার। হৃদয়ের শব্দ শুনে চমকি’ভাবি মনে, ঐ বুঝি এল বধূ ধীরে মৃদুল চরণে; পরাণে লাগলে ব্যথা ভাবি বুঝি আমায় ছুঁলে, বধূ আমার। বিরহে দিন কাটিল, কত যে কথা ছিল, কত যে মনের আশা মন-মাঝে রহিল; কী ল’য়ে থাকব বলো তুমি যদি রইলে ভুলে, বধূ আমার॥ আমারে এ আঁধারে এমন ক’রে চালায় কে গো? আমি দেখতে নারি, ধরতে নারি, বুঝতে নারি কিছুই যে গো। নয়নে নাহি ভাতি, মনে হয় চিররাতি, মনে হয় তুমি আমার চিরসাথী; একবার জ্বালিছে বাতি, ঘুচিয়ে রাতি নয়ন ভ’রে দেখা দে গো। কাঁদায়ে কাঁটার ক্রেশে, কঠিন এই পথের শেষে না জানি নিয়ে যাবে কোন বিদেশে। একবার ভালোবেসে, কাছে এসে, কানে কানে ব’লে দে গো । রয়েছিস যদি সাথে, দারুণ এ আঁধার রাতে, ক্লান্ত মোরে চালিয়ে নে যা হাতে হাতে। হস্ত আমার শিথিল হলেও তুই আমারে ছাড়িস নে গো। পাগলা, মনটারে তুই বাঁধ। কেন রে তুই যেথা সেথা পরিস প্রাণে ফাঁদ শীতল বায়ে আসলে নিশি, তুই কেন রে হোস উদাসী? ওরে নীলাকাশে অমন ক’রে হেসেই থাকে চাঁদ। শৈলশিরে সোনার খেলা দেখিস যবে প্রভাতবেলা, তুই কেন রে হোস উতলা দেখে মোহন ছাঁদ? করুণ সুরে গাইলে পাখি তোর কেন রে ঝরে আঁখি? কবে তুই মুছবি নয়ন, ঘুচবে মনের ধাঁদ সংসারেতে উঠলে হাসি তুই শুনিস রে ব্রজের বাঁশি। ওরে ভাবিস কি রে সবই গোকুল, সবই কালাচাঁদ? কতই পেলি ভালোবাসা, তবু না তোর মেটে আশা। এবার তুই একলা ঘরে নয়ন ভ’রে কাঁদ। ওগো, সুখ নাহি চাই। তোমার পরাণ-পাশে দিয়ো মোরে ঠাঁই। তুমি যদি থাক সুখে, আমারে রাখিয়ো সুখে; তুমি যদি পাও দুঃখ যেন দুখ পাই॥ নাহি বুঝি কান্না হাসি, দারিদ্র্য সম্পদরাশি; তোমাছাড়া সুখ দুঃখ সকলি বালাই। ওগো আমার নবীন সাথী অতুলপ্রসাদ সেন ওগো আমার নবীন সাথী, ছিলে তুমি কোন বিমানে? আমার সকল হিয়া মুঞ্জরিছে তোমারি ওই করুণ গানে॥ জগতের গহন বনে ছিনু আমি সঙ্গোপনে, না জানি কি লয়ে মনে এলে উড়ে আমার পানে। লয়ে তোমার মোহন বরণ আমার শুকনো ডালে রাখলে চরণ; আজ আমার জীবন-মরণ কোথা আছে কে বা জানে॥ ঝরে গেছে সকল আশা, ফোটে না আর ভালোবাসা, আজ তুমি বাঁধলে বাসা আমার প্রাণে কোন পরাণে? মেঘের দল বেঁধে যায় কোন দেশে, ও আকাশ, বল আমারে! তারা কেউ বা রঙিন ওড়না গায়ে, কেউ সাদা, কেউ নীল বেশে॥ তারা কোন্ যমুনার নীরে ভরবে গাগরি, কার বাঁশরী শুনল এরা সাগর নাগরী, মরি মরি। তারা বাজিয়ে নূপুর ঝুমুর ঝুমুর, যায় চলে কার উদ্দেশ্যে? কভু বাজিয়ে ডমরু তারা উল্লাসে নাচে, কভু ভানুর সঙ্গে খেলে হোলি প্রভাতে সাঁঝে, মরি মরি! তারা বিধুর সনে কী কথা কয় উজ্জ্বল মধুর হেসে। আকাশ, বল রে আমায় বল, আমার আঁখি জল তাদের মতো জীবনখানি করবে কি শ্যামল-আমায় বল রে। আমি তাদের মতো আমার বধুর সনে মধুর খেলা খেলব কি দিনের শেষে?
অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর
ক্ষীরের পুতুল অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর এক রাজার দুই রানী, দুও আর সুও। রাজবাড়িতে সুওরানীর বড়ো আদর, বড়ো যত্ন। সুওরানী সাতমহল বাড়িতে থাকেন। সাতশো দাসী তাঁর সেবা করে, পা ধোয়ায়, আলতা পরায়, চুল বাঁধে। সাত মালঞ্চের সাত সাজি ফুল, সেই ফুলে সুওরানী মালা গাঁথেন। সাত সিন্দুক-ভরা সাত-রাজার-ধন মানিকের গহনা, সেই গহনা অঙ্গে পরেন। সুওরানী রাজার প্রাণ। আর দুওরানী— বড়োরানী, তাঁর বড়ো অনাদর, বড়ো অযত্ন। রাজা বিষ নয়নে দেখেন। একখানি ঘর দিয়েছেন— ভাঙাচোরা, এক দাসী দিয়েছেন— বোবা-কালা। পরতে দিয়েছেন জীর্ণ শাড়ি, শুতে দিয়েছেন— ছেঁড়া কাঁথা। দুওরানীর ঘরে রাজা একটি দিন আসেন, একবার বসেন, একটি কথা কয়ে উঠে যান। সুওরানী— ছোটোরানী, তারই ঘরে রাজা বারোমাস থাকেন। একদিন রাজা রাজমন্ত্রীকে ডেকে বললেন— মন্ত্রী, দেশবিদেশ বেড়াতে যাব, তুমি জাহাজ সাজাও। রাজার আজ্ঞায় রাজমন্ত্রী জাহাজ সাজাতে গেলেন। সাতখানা জাহাজ সাজাতে সাত মাস গেল। ছ’খানা জাহাজে রাজার চাকরবাকর যাবে, আর সোনার চাঁদোয়া-ঢাকা সোনার জাহাজে রাজা নিজে যাবেন। মন্ত্রী এসে খবর দিলেন— মহারাজ, জাহাজ প্রস্তুত। রাজা বললেন— কাল যাব। মন্ত্রী ঘরে গেলেন। ছোটোরানী— সুওরানী রাজ-অন্তঃপুরে সোনার পালঙ্কে শুয়েছিলেন, সাত সখী সেবা করছিল, রাজা সেখানে গেলেন। সোনার পালঙ্কে মাথার শিয়রে বসে আদরের ছোটোরানীকে বললেন— রানী, দেশ-বিদেশ বেড়াতে যাব, তোমার জন্য কী আনব? রানী ননীর হাতে হীরের চুড়ি ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে বললেন— হীরের রঙ বড়ো শাদা, হাত যেন শুধু দেখায়। রক্তের মতে রাঙা আট-আট গাছ মানিকের চুড়ি পাই তো পরি। রাজা বললেন— আচ্ছা রানী, মানিকের দেশ থেকে মানিকের চুড়ি আনব। রানী রাঙা পা নাচিয়ে নাচিয়ে, পায়ের নূপুর বাজিয়ে বাজিয়ে বললেন— এ নূপুর ভালো বাজে না। আগুনের বরন নিরেট সোনার দশ গাছা মল পাই তো পরি। রাজা বললেন— সোনার দেশ থেকে তোমার পায়ের সোনার মল আনব। রানী গলার গজমতি হার দেখিয়ে বললেন— দেখ রাজা, এ মুক্তো বড়ো ছোটো, শুনেছি কোন দেশে পায়রার ডিমের মতো মুক্তো আছে, তারি একছড়া হার এনো। রাজা বললেন— সাগরের মাঝে মুক্তোর রাজ্য, সেখান থেকে গলার হার আনব। আর কী আনব রানী? তখন আদরিনী সুওরানী সোনার অঙ্গে সোনার আঁচল টেনে বললেন— মা গো, শাড়ি নয় তো বোঝা! আকাশের মতো নীল, বাতাসের মতো ফুরফুরে, জলের মতো চিকন শাড়ি পাই তো পরে বাঁচি। রাজা বললেন— আহা, আহা, তাই তো রানী, সোনার আঁচলে সোনার অঙ্গে ছড় লেগেছে, ননীর দেহে ব্যথা বেজেছে। রানী, হাসিমুখে বিদায় দাও, আকাশের মতো নীল, বাতাসের মতো ফুরফুরে, জলের মতো চিকন শাড়ি আনিগে। ছোটােরানী হাসিমুখে রাজাকে বিদায় করলেন। রাজা বিদায় হয়ে জাহাজে চড়বেন— মনে পড়ল দুখিনী বড়োরানীকে।  দুওরানী— বড়োরানী, ভাঙা ঘরে ছেঁড়া কাঁথায় শুয়ে কাঁদছেন, রাজা সেখানে এলেন। ভাঙা ঘরের ভাঙা দুয়ারে দাঁড়িয়ে বললেন— বড়োরানী, আমি বিদেশ যাব। ছোটোরানীর জন্যে হাতের বালা, গলার মালা, পায়ের মল, পরনের শাড়ি আনব। তোমার জন্যে কী আনব? বলে দাও যদি কিছু সাধ থাকে। রানী বললেন— মহারাজ, ভালোয় ভালোয় তুমি ঘরে এলেই আমার সকল সাধ পূর্ণ হয়। তুমি যখন আমার ছিলে তখন আমার সোহাগও অনেক ছিল, সাধও অনেক ছিল। সোনার শাড়ি অঙ্গে পরে সাতমহল বাড়িতে হাজার হাজার আলো জ্বালিয়ে সাতশো সখীর মাঝে রানী হয়ে বসবার সাধ ছিল, সোনার পিঞ্জরে শুক-শারীর পায়ে সোনার নূপুর পরিয়ে দেবার সাধ ছিল। মহারাজ, অনেক সাধ ছিল, অনেক সাধ মিটেছে। এখন আর সোনার গহনায় সোনার শাড়িতে কী কাজ? মহারাজ, আমি কার সোহাগে হীরের বালা হাতে পরব? মোতির মালা গলায় দেব? মানিকের সিঁথি মাথায় বাঁধব? মহাবাজ, সেদিন কি আর আছে! তুমি সোনার গহনা দেবে, সে সোহাগ তো ফিরে দেবে না! আমার সে সাতশো দাসী সাতমহল বাড়ি তো ফিরে দেবে না! বনের পাখি এনে দেবে, কিন্তু, মহারাজ, সোনার খাঁচা তো দেবে না! ভাঙা ঘরে সোনার গহনা চোর-ডাকাতে লুটে নেবে, ভাঙা খাঁচায় বনের পাখি কেন ধরা দেবে? মহারাজ, তুমি যাও, যাকে সোহাগ দিয়েছ তার সাধ মেটাও গে, ছাই সাধে আমার কাজ নেই। রাজা বললেন— না রানী, তা হবে না, লোকে শুনলে নিন্দে করবে। বল তোমার কী সাধ? রানী বললেন— কোন লাজে গহনার কথা মুখে আনব? মহারাজ, আমার জন্যে পোড়ারমুখ একটা বাঁদর এনো। রাজা বললেন— আচ্ছা রানী, বিদায় দাও। তখন বড়োরানী— দুওরানী ছেঁড়া কাঁথায় লুটিয়ে পড়ে কাঁদতে কাঁদতে রাজাকে বিদায় দিলেন। রাজা গিয়ে জাহাজে চড়লেন। সন্ধ্যাবেলা সোনার জাহাজ সোনার পাল মেলে অগাধ সাগরের নীল জল কেটে সোনার মেঘের মতো পশ্চিম মুখে ভেসে গেল। ভাঙা ঘরে দুওরানী নীল সাগরের পারে চেয়ে, ছেঁড়া কাঁথায় পড়ে রইলেন। আর আদরিনী সুওরানী সাতমহল অন্তঃপুরে, সাতশো সখীর মাঝে, গহনার কথা ভাবতে ভাবতে, সোনার পিঞ্জরে সোনার পাখির গান শুনতে শুনতে, সোনার পালঙ্কে ঘুমিয়ে পড়লেন। রাজাও জাহাজে চড়ে দুঃখিনী বড়োরানীকে ভুলে গেলেন। বিদায়ের দিনে ছোটোরানীর সেই হাসিহাসি মুখ মনে পড়ে আর ভাবেন— এখন রানী কী করছেন? বোধ হয় চুল বাঁধছেন। এবার রানী কী করছেন? বুঝি রাঙা পায়ে আলতা পরছেন। এবার রানী সাত মালঞ্চে ফুল তুলছেন, এবার বুঝি সাত মালঞ্চের সাত সাজি ফুলে রানী মালা গাঁথছেন আর আমার কথা ভাবছেন। ভাবতে ভাবতে বুঝি দুই চক্ষে জল এল, মালা আর গাঁথা হল না। সোনার সুতো, ফুলের সাজি পায়ের কাছে পড়ে রইল; বসে বসে সারা রাত কেটে গেল, রানীর চোখে ঘুম এল না। সুওরানী— ছোটোরানী রাজার আদরিনী, রাজা তারই কথা ভাবেন। আর বড়োরানী রাজার জন্যে পাগল, তার কথা একবার মনেও পড়ে না। এমনি করে জাহাজে দেশ-বিদেশে রাজার বারো-মাস কেটে গেল। তেরো মাসে রাজার জাহাজ মানিকের দেশে এল। মানিকের দেশে সকলই মানিক। ঘরের দেওয়াল মানিক, ঘাটের শান মানিক, পথের কাঁকর মানিক। রাজ সেই মানিকের দেশে সুয়োরানীর চুড়ি গড়ালেন। আট হাজার মানিকের আটগাছি চুড়ি, পরলে মনে হয় গায়ের রক্ত ফুটে পড়ছে।  রাজা সেই মানিকের চুড়ি নিয়ে, সোনার দেশে এলেন। সেই সোনার দেশে স্যাক্‌রার দোকানে নিরেট সোনার দশগাছা মল গড়ালেন। মল জ্বলতে লাগল যেন আগুনের ফিন্‌কি, বাজতে লাগল যেন বীণার ঝংকার— মন্দিরার রিনি-রিনি। রাজা মানিকের দেশে মানিকের চুড়ি নিয়ে, সোনার দেশে সোনার মল গড়িয়ে, মুক্তোর রাজ্যে এলেন। সে দেশে রাজার বাগানে দুটি পায়রা। তাদের মুক্তোর পা, মানিকের ঠোঁট, পান্নার গাছে মুক্তোর ফল খেয়ে মুক্তোর ডিম পাড়ে। দেশের রানী সন্ধ্যাবেলা সেই মুক্তোর মালা গাঁথেন, রাতের বেলায় খোঁপায় পরেন, সকাল বেলায় ফেলে দেন। দাসীরা সেই বাসি মুক্তোর হার এক জাহাজ রুপো নিয়ে বাজারে বেচে আসে। রাজা এক জাহাজ রুপো দিয়ে সুওরানীর গলায় দিতে সেই মুক্তোর এক ছড়া হার কিনলেন। তারপর মানিকের চুড়ি নিয়ে, সোনার দেশে সোনার মল গড়িয়ে, মুক্তোর রাজ্যে মুক্তোর হার গাঁথিয়ে, ছ’মাস পরে রাজা এক দেশে এলেন। সে দেশে রাজকন্যের উপবনে নীল মানিকের গাছে নীল গুটিপোকা নীলকান্ত মণির পাতা খেয়ে, জলের মতো চিকন, বাতাসের মতো ফুরফুরে, আকাশের মতো নীল রেশমের গুটি বাঁধে। রাজার মেয়ে সারা রাত ছাদে বসে, আকাশের সঙ্গে রঙ মিলিয়ে, সেই নীল রেশমে শাড়ি বোনেন। একখানি শাড়ি বুনতে ছ’মাস যায়। রাজকন্যে একটি দিন সেই আকাশের মতো নীল, বাতাসের মতো ফুরফুরে, জলের মতো চিকন শাড়ি পরে শিবের মন্দিরে মহাদেব নীলকণ্ঠের পূজা করেন। ঘরে এসে শাড়ি ছেড়ে দেন, দাসীরা যার কাছে সাত জাহাজ সোনা পায় তার কাছে শাড়ি বেচে। রাজা সাত জাহাজ সোনা দিয়ে আদরিনী সুওরাণীর শখের শাড়ি কিনলেন। তারপর আর ছ’মাসে রাজার সাতখানা জাহাজ সাত সমুদ্র তেরো নদী পার হয়ে ছোটোরানীর মানিকের চুড়ি, সোনার মল, মুক্তোর মালা, সাধের শাড়ি নিয়ে দেশে এল। তখন রাজার মনে পড়ল বড়োরানী বাঁদর চেয়েছেন। রাজা মন্ত্রীকে বললেন— মন্ত্রীবর, বড়ো ভুল হয়েছে। বড়োরানীর বাঁদর আনা হয়নি, তুমি একটা বাঁদরের সন্ধানে যাও। রাজমন্ত্রী একটা বাঁদরের সন্ধানে চলে গেলেন। আর রাজা শ্বেতহস্তী চড়ে লোকারণ্য রাজপথ দিয়ে, ছোটোরানীর সাধের গহনা শখের শাড়ি নিয়ে অন্তঃপুরে চলে গেলেন। ছোটোরানী সাত-মহল বাড়ির সাত-তলার উপরে সোনার আয়না সামনে রেখে, সোনার কাঁকুইয়ে চুল চিরে, সোনার কাঁটা সোনার দড়ি দিয়ে খোঁপা বেঁধে সোনার চেয়াড়িতে সিঁদুর নিয়ে ভুরুর মাঝে টিপ পরছেন, কাজল-লতায় কাজল পেড়ে চোখের পাতায় কাজল পরছেন, রাঙা পায়ে আলতা দিচ্ছেন, সখীরা ফুলের থালা নিয়ে, পানের বাটা নিয়ে রাজরানী ছোটোরানীর সেবা করছে— রাজা সেখানে এলেন। স্ফটিকের সিংহাসনে রানীর পাশে বসে বললেন— এই নাও, রানী! মানিকের দেশে মানিকের ঘাট, মানিকের বাট— সেখান থেকে হাতের চুড়ি এনেছি। সোনার দেশে সোনার ধুলো, সোনার বালি— সেখান থেকে পায়ের মল এনেছি। মুক্তোর রাজ্যে মুক্তোর পা, মানিকের ঠোঁট, দুটি পাখি মুক্তোর ডিম পাড়ে। দেশের রানী সেই মুক্তোর হার গাঁথেন, রাতের বেলায় খোঁপায় পরেন, ভোরের বেলায় ফেলে দেন। রানী, তোমার জন্যে সেই মুক্তোর হার এনেছি। রানী, এক দেশে রাজার মেয়ে, এক-খী রেশমে সাত-খী সুতো কেটে নিশুতি রাতে ছাদে বসে ছ’টি মাসে একখানি শাড়ি বোনেন, এক দিন পরে পুজো করেন, ঘরে এসে ছেড়ে দেন। রানী, আমি সেই রাজার মেয়ের দেশ থেকে সাত জাহাজ সোনা দিয়ে রাজকন্যার হাতে বোনা শাড়ি এনেছি। তুমি একবার চেয়ে দেখ! পৃথিবী খুঁজে গায়ের গহনা, পরনের শাড়ি আনলুম, একবার পরে দেখ!  রানী তখন দু’হাতে আটগাছা চুড়ি পরলেন; মানিকের চুড়ি রানীর হাতে ঢিলে হল, হাতের চুড়ি কাঁধে উঠল। রানী তখন দু’পায়ে দশ-গাছা মল পরলেন; রাঙা পায়ে সোনার মল আল্‌গা হল, দু’পা যেতে দশ গাছা মল শানের উপর খসে পড়ল। রানী মুখ ভার করে মুক্তোর হার গলায় পরলেন; মুক্তোর দেশের মুক্তোর হার রানীর গলায় খাটো হল, হার পরতে গলার মাস কেটে গেল। রানী ব্যথা পেলেন। সাত-পুরু করে শখের শাড়ি অঙ্গে পরলেন; নীল রেশমের নীল শাড়ি হাতে বহরে কম পড়ল। রানীর চোখে জল এল। তখন মানিনী ছোটোরানী আট হাজার মানিকের অাটগাছা চুড়ি খুলে ফেলে, নিরেট সোনার দশগাছা মল পায়ে ঠেলে, মুক্তোর মালা শখের শাড়ি ধুলোয় ফেলে বললেন— ছাই গহনা! ছাই এ শাড়ি! কোন্ পথের কাঁকর কুড়িয়ে এ চুড়ি গড়ালে? মহারাজ, কোন্ দেশের ধুলো বালিতে এ মল গড়ালে? ছি ছি, এ কার বাসি মুক্তোর বাসি হার! এ কোন্ রাজকন্যার পরা শাড়ি! দেখলে যে ঘৃণা আসে, পরতে যে লজ্জা হয়! নিয়ে যাও মহারাজ, এ পরা শাড়ি পরা-গহনায় আমার কাজ নেই। রানী অভিমানে গোসা-ঘরে খিল দিলেন। আর রাজা মলিনমুখে সাত জাহাজ সোনা দিয়ে কেনা সেই সাধের গহনা, শখের শাড়ি নিয়ে রাজসভায় এলেন। রাজমন্ত্রী রাজসিংহাসনের এক পাশে, রাজ্যের মাঠ-ঘাট দোকানপাট সন্ধান করে, যাদুকরের দেশের এক বণিকের জাহাজ থেকে, কানা-কড়ি দিয়ে একটি বাঁদরছানা কিনে বসে আছেন। রাজা এসে বললেন— মন্ত্রীবর, আশ্চর্য হলুম! মাপ দিয়ে ছোটোরানীর গায়ের গহনা, পরনের শাড়ি আনলুম, সে শাড়ি, সে গহনা, রানীর গায়ে হল না! তখন সেই বনের বানর রাজার পায়ে প্রণাম করে বললে—বড়ো ভাগ্যবতী পুণ্যবতী না হলে দেবকন্যের হাতে বোনা, নাগকন্যের হাতে গাঁথা, মায়া-রাজ্যের এ মায়া-গহনা, মায়া-শাড়ি, পরতে পায় না। মহারাজ, রাজভাণ্ডারে তুলে রাখ, যাকে বৌ করবে তাকে পরতে দিও। বানরের কথায় রাজা অবাক হলেন। হাসতে হাসতে মন্ত্রীকে বললেন— মন্ত্রী বানরটা বলে কি? ছেলেই হল না, বৌ অানব কেমন করে? মন্ত্রী, তুমি স্যাকরার দোকানে ছোটোরানীর নতুন গহনা গড়তে দাওগে, তাঁতির তাঁতে রানীর শাড়ি বুনতে দাওগে। এ গহনা, এ শাড়ি, রাজভাণ্ডারে তুলে রাখ; যদি বৌ ঘরে আনি তাকে পরতে দেব। রাজমন্ত্রী স্যাকরার দোকানে ছোটোরানীর নতুন গহনা গড়াতে গেলেন। আর, রাজা সেই বাঁদর-কোলে বড়োরানীব কাছে গেলেন। দুঃখিনী বড়োরানী, জীর্ণ আঁচলে পা মুছিয়ে, ভাঙা ঘরে ছেঁড়া কাঁথায় রাজাকে বসতে দিয়ে কাঁদতে কাঁদতে বললেন— মহারাজ, বোসো। আমার এই ভাঙা ঘরে ছেঁড়া কাঁথায় বোসো। আমার আর কী আছে তোমায় বসতে দেব? হায়, মহারাজ, কতদিন পরে তুমি ফিরে এলে, আমি এমনি অভাগিনী তোমার জন্যে ছেঁড়া কাঁথা পেতে দিলুম। রানীর কথায় রাজার চোখে জল এল। ভাঙা ঘরে ছেঁড়া কাঁথায় বসে বড়োবানীর কোলে বাঁদর-ছানা দিয়ে বললেন— মহারানী, তোমার এ ছেঁড়া কাঁথা ভাঙা ঘর, ছোটোরানীর সোনার সিংহাসন, সোনার ঘরের চেয়ে লক্ষগুণে ভালো। তোমার এ ভাঙা ঘরে অাদর আছে, যত্ন আছে, দুটো মিষ্টি কথা আছে; সেখানে তা তো নেই। রানী, সাত জাহাজ সোনা দিয়ে গায়ের গহনা, পরনের শাড়ি দিয়েছি, ছোটোরানী পায়ে ঠেলেছে; আর কানাকড়ি দিয়ে তোমার বাঁদর এনেছি, তুমি আদর করে কোলে নিয়েছ। রানী, আমি আর তোমায় দুঃখ দেব না। এখন বিদায় দাও, আমি আবার আসব রানী। কিন্তু দেখো, ছোটোরানী যেন জানতে না-পারে! তোমার কাছে এসেছি শুনলে আর রক্ষে রাখবে না! হয় তোমায়, নয়তো আমায়, বিষ খাওয়াবে। এমনি করে রাত কাটল। ছোটোরানীর সোনার পালঙ্কে, ফুলের বিছানায়, রাজার পাশে রাত কাটল; আর বড়োরানীর জলে ঝড়ে, ভাঙা ঘরে, ছেঁড়া কাঁথায় রাত কাটল। সকাল হল। রাজবাড়িতে প্রহরীখানায় প্রহর বাজল, নাকরাখানায় নবৎ বাজল, রাজারানীর ঘুম ভাঙল। রাজা সোনার ভৃঙ্গারে স্ফটিকজলে মুখ ধুয়ে, রাজবেশ অঙ্গে পরে, রাজ-দরবারে নেবে গেলেন। আর ছোটোরানী সোনার পালঙ্কে, ফুলের বিছানায়, ফুলের পাখায় হাওয়া খেতে খেতে পাশ ফিরে ঘুম গেলেন। আর বড়োরানী কী করলেন? ভাঙা ঘরে সোনার রোদ মুখে পড়ল, রানী উঠে বসলেন। এদিক দেখলেন ওদিক দেখলেন, এপাশ দেখলেন, ওপাশ দেখলেন— বানর নেই! রানী এ-ঘর খুঁজলেন ও-ঘর খুঁজলেন ঘরের চাল খুঁজলেন, গাছের ডাল খুঁজলেন— বানর নেই! বড়োবানী কাঁদতে লাগলেন। বানর কোথা গেল? বানর ভাঙা ঘরে ঘুমন্ত রানীকে একলা রেখে রাত না-পোহাতে রাজ-দরবারে চলে গেল। রাজা বার দিয়ে দরবারে বসেছেন। চারিদিকে সভাসদ মন্ত্রী, দুয়ারে সিপাই-সান্ত্রী, আশে-পাশে লোকের ভিড়। রানীর বানর সেই লোকের ভিড় ঠেলে, সিপাই-সান্ত্রীর হাত এড়িয়ে, রাজার পায়ে প্রণাম করে বললে— মহারাজ, বড়ো সুখবর এনেছি, মায়ের আমার ছেলে হবে। রাজা বললেন— ওরে বানর বলিস কী? এ কথা কি সত্য? বড়োরানী দুওরানী তার ছেলে হবে? দেখিস এ কথা যদি মিথ্যা হয় তো তোকেও কাটব আর তোর মা দুওরানীকেও কাটব। বানর বললে— মহারাজ, সে ভাবনা আমার। এখন আমায় খুশি কর, আমি বিদায় হই। রাজা গলার গজমোতি হার খুলে দিয়ে বানরকে বিদায় করলেন। বানর নাচতে নাচতে ভাঙা ঘরে দুওরানী পড়ে পড়ে কাঁদছেন— সেখানে গেল। দুওরানীর চোখের জল, গায়ের ধুলো মুছিয়ে বানর বললে— এই দেখ্ মা, তোর জন্যে কী এনেছি! তুই রাজার রানী, গলায় দিতে হার পাসনে, কাঠের মালা কিনে পরিস, এই মুক্তোর মালা পর! রানী বানরের হাতে গজমোতি হার দেখে বললেন— এই হার তুই কোথা পেলি? এ যে রাজার গলার গজমোতি হার! যখন রানী ছিলুম রাজার জন্যে গেঁথেছিলুম, তুই এ হার কোথা পেলি? বল্ বানর, রাজা কি এ হার ফেলে দিয়েছেন, রাজপথে কি কুড়িয়ে পেলি? বানর বললে— না মা, কুড়িয়ে পাইনি। তোর হাতে গাঁথা রাজার গলার গজমোতি হার কুড়িয়ে কি পাওয়া যায়? রানী বললেন— তবে কি রাজার ঘরে চুরি করলি? বানর বললে— ছি ছি মা, চুরি কি করতে আছে! আজ রাজাকে সু-খবর দিয়েছি তাই রাজা হার দিয়ে খুশি করেছেন। রানী বললেন— ওরে বাছা, তুই যে দুঃখীর সন্তান, বনের বানর! ভাঙা ঘরে দুঃখিনীর কোলে শুয়ে, রাজাকে দিতে কি সুখের সন্ধান পেলি যে রাত না-পোহাতে রাজবাড়িতে ছুটে গেলি? বানর বললে— মা আমি স্বপ্ন পেয়েছি আমার যেন ভাই হয়েছে, তোর কোলে খোকা হয়েছে; সেই খোকা যেন রাজসিংহাসনে রাজা হয়েছে। তাই ছুটে রাজাকে খবর দিলুম— রাজামহাশয়, মায়ের খোকা হবে। তাইতে রাজা খুশি হয়ে গলার হার খুলে দিলেন। রানী বললেন— ওরে, রাজা আজ শুনলেন ছেলে হবে, কাল শুনবেন মিছে কথা। আজ রাজা গলায় দিতে হার দিলেন কাল যে মাথা নিতে হুকুম দেবেন। হায় হায়, কী করলি? একমুঠো খেতে পাই, একপাশে পড়ে থাকি, তবু বছর গেলে রাজার দেখা পাই, তুই আমার তাও ঘোচালি? ওরে তুই কী সর্বনাশ করলি? মিছে খবর কেন রটালি? এ জঞ্জাল কেন ঘটালি? বানর বললে— মা তোর ভয় কী, ভাবিস কেন? এ দশমাস চুপ করে থাক্, সবাই জানুক— বড়োরানীর ছেলে হবে। তারপর রাজা যখন ছেলে দেখবেন তখন তোর কোলে সোনারচাঁদ ছেলে দেব, তুই রাজাকে দেখাস। এখন চল, বেলা হল, খিদে পেয়েছে। রানী বললেন— চল্ বাছা চল্। বাটি পুরে জল রেখেছি, গাছের ফল এনেছি, খাবি চল্। রানী ভাঙা পিঁড়েয় বানরকে খাওয়াতে বসলেন। আর রাজা ছোটোরানীর ঘরে গেলেন। ছোটে রানী কুস্বপ্ন দেখে জেগে উঠে সোনার পলিঙ্কে বসে বসে ভাবছেন, এমন সময় রাজ এসে খবর দিলেন— আরে শুনেছ ছোটোরানী, বড়োরানীর ছেলে হবে! বড়ো ভাবনা ছিল রাজসিংহাসন কাকে দেব, এতদিনে ভাবনা ঘুচল। যদি ছেলে হয় তাকে রাজা করব, আর যদি মেয়ে হয়, তবে তার বিয়ে দিয়ে জামাইকে রাজ্য দেব। রানী, বড়ো ভাবনা ছিল, এতদিনে নিশ্চিন্ত হলুম। রানী বললেন— পারিনে বাপু, আপনার জ্বালায় বাঁচিনে, পরের ভাবনা! রাজা বললেন— সে কী রানী? এমন সুখের দিনে এমন কথা বলতে হয়? রাজপুত্র কোলে পাব, রাজ সিংহাসনে রাজা করব, এ কথা শুনে মুখ-ভার করে? রানী, রাজবাড়িতে সবার মুখে হাসি, তুমি কেন অকল্যাণ কর? রানী বললেন— আর পারিনে! কার ছেলে রাজা হবে, কার মেয়ে রাজ্য পাবে, কে রাজসিংহাসনে বসবে, এত ভাবনা ভাবতে পারিনে। নিজের জ্বালায় মরি, পরের ছেলে মোলো বাঁচল তার খবর রাখিনে। বাবারে, সকালবেলা বকে বকে ঘুম হল না, মাথা ধরল, যাই নেয়ে আসি।  রাগভরে ছোটোরানী অাটগাছা চুড়ি, দশগাছা মল্ ঝমঝমিয়ে একদিকে চলে গেলেন। রাজার বড়ো রাগ হল, রাজকুমারকে ছোটোরানী মর্ বললে। রাজা মুখ আঁধার করে বার-মহলে চলে এলেন। রাজা-রানীতে ঝগড়া হল। রাজা আর ছোটোরানীর মুখ দেখলেন না, বড়োরানীর ঘরেও গেলেন না— ছোটোরানী শুনে যদি বিষ খাওয়ায়, বড়োরানীকে প্রাণে মারে! রাজা বার-মহলে একলা রইলেন। এক মাস গেল, দুমাস গেল, দুমাস গিয়ে তিন মাস গেল, রাজা-রানীর ভাব হল না। ঝগড়ায় ঝগড়ায় চার মাস কাটল। পাঁচ মাসে দুওরানীর পোষা বানর রাজার সঙ্গে দেখা করলে। রাজা বললেন— কী হে বানর, খবর কী? বানর বললে— মহারাজ, মায়ের বড়ো দুঃখ! মোটা চালের ভাত মুখে রোচে না, মা আমার না-খেয়ে কাহিল হলেন। রাজা বললেন— এ কথা তো আমি জানিনে। মন্ত্রীবর, যাও এখনি সরু চালের ভাত, পঞ্চাশ ব্যঞ্জন, সোনার থালে সোনার বাটিতে বড়োরানীকে পাঠিয়ে দাও। আজ থেকে আমি যা খাই বড়োরানীও তাই খাবেন। যাও মন্ত্রী, বানরকে হাজার মোহর দিয়ে বিদায় কর। মন্ত্রী বানরকে বিদায় করে রান্নাঘরে গেলেন। অার রানীর বানর মোহরের তোড়া নিয়ে রানীর কাছে এল। রানী বললেন— আজ আবার কোথা ছিলি? এতখানি বেলা হল নাইতে পেলুম না, রাঁধব কখন, খাব কখন? বানর বললে— মা আর তোকে রাঁধতে হবে না। রাজবাড়ি থেকে সোনার থালায় সোনার বাটিতে সরু চালের ভাত, পঞ্চাশ ব্যঞ্জন আসবে, তাড়াতাড়ি নেয়ে আয়। রানী নাইতে গেলেন। বানর একমুঠো মোহর নিয়ে বাজারে গেল। ষোলো থান মোহরে যোলো জন ঘরামি নিলে, ষোলে গাড়ি খড় নিলে, ষোলোশো বাঁশ নিলে। সেই ষোলোশো বাঁশ দিয়ে, যোলো গাড়ি খড় দিয়ে, ষোলোজন ঘরামি খাটিয়ে, চক্ষের নিমেষে দুওরানীর বানর ভাঙাঘর নতুন করলে। শোবার ঘরে নতুন কাঁথা পাতলে, খাবার ঘরে নতুন পিঁড়ি পাতলে, রাজবাড়ির ষোলো বামুনে রানীর ভাত নিয়ে এল; ষোলো মোহর বিদায় পেলে। দুওরানী নেয়ে এলেন। এসে দেখলেন— ঘর নতুন! ঘরের চাল নতুন! চালের খড় নতুন! মেঝেয় নতুন কাঁথা! অালনায় নতুন শাড়ি! রানী অবাক হলেন। বানরকে বললেন— বাছা, ভাঙা ঘর দেখে ঘাটে গেলুম, এসে দেখি নতুন ঘর! কেমন করে হল? বানর বলল— মা, রাজামশায় মোহর দিয়েছেন। সেই মোহরে ভাঙা ঘর নতুন করেছি, ছেঁড়া কাঁথা নতুন করেছি, নতুন পিঁড়ে পেতেছি, তুই সোনার থালে গরম ভাত, সোনার বাটিতে তপ্ত দুধ খাবি চল। রানী খেতে বসলেন। কতদিন পরে সোনার থালায় ভাত খেলেন, সোনার ঘটিতে মুখ ধুলেন, সোনার বাটায় পান খেলেন, তবু মনে সুখ পেলেন না। রানী রাজভোগ খান আর ভাবেন— আজ রাজা সোনার থালে ভাত পাঠালেন, কাল হয়তো মশানে নিয়ে মাথা কাটবেন। এমনি করে ভয়ে-ভয়ে এক মাস, দুমাস, তিন মাস গেল। বড়োরানীর নতুন ঘর পুরোনো হল, ঘরের চাল ফুটাে হল, চালের খড় উড়ে গেল। বানর রাজার সঙ্গে দেখা করলে। রাজা বললেন— কী বানর, কী মনে করে? বানর বললে— মহারাজ, ভয়ে কব না নিৰ্ভয়ে কব? রাজা বললেন— নিৰ্ভয়ে কও। বানর বললে—মহারাজ, ভাঙা ঘরে মা আমার বড়ো দুঃখ পান। ঘরের দুয়োর ফাটা, চালে খড় নেই, শীতের হিম ঘরে আসে। মা আমার গায়ে দিতে নেপ পান না, আগুন জ্বালতে কাঠ পান না, সার রাত শীতে কাঁপেন। রাজা বললেন— তাইতো! তাইতো! একথা বলতে হয়। বানর তোর মাকে রাজবাড়িতে নিয়ে আয়, আমি মহল সাজাতে বলি।  বানর বললে— মহারাজ, মাকে আনতে ভয় হয়, ছোটোরানী বিষ খাওয়াবে। রাজা বললেন— সে ভয় নেই। নতুন মহলে রানীকে রাখব, মহল ঘিরে গড় কাটাব, গড়ের দুয়ারে পাহারা বসাব, ছোটোরানী আসতে পাবে না। সে মহলে বড়োরানী থাকবেন, বড়োরানীর বোবাকালা দাই থাকবে, আর বড়োরানীর পোষা ছেলে তুই থাকবি। বানর বললে— মহারাজ, যাই তবে মাকে আনি। রাজা বললেন— যাও মন্ত্রী, মহল সাজাও গে। মন্ত্রী লক্ষ লক্ষ লোক লাগিয়ে একদিনে বড়োরানীর নতুন মহল সাজালেন। দুওরানী ভাঙা ঘর ছেড়ে, ছেঁড়া কাঁথা ছেড়ে, সোনার শাড়ি পরে নতুন মহলে এলেন। সোনার পালঙ্কে বসলেন, সোনার থালে ভাত খেলেন, দীন-দুঃখীকে দান দিলেন, রাজ্যে জয় জয় হল; রাগে ছোটোরানীর সর্বাঙ্গ জ্বলে উঠল। ডাকিনী ব্রাহ্মণী— ছোটোরানীর ‘মনের কথা’, প্রাণের বন্ধু। ছোটোরানী বলে পাঠালেন— মনের কথাকে আসতে বল, কথা আছে। রানী ডেকেছেন— ডাকিনী বুড়ি তাড়াতাড়ি চলে এল। রানী বললেন— এস ভাই, মনের কথা, কেমন আছ? কাছে বোসো। ডাকিনী ব্রাহ্মণী ছোটোরানীর পাশে বসে বললে— কেন ভাই, ডেকেছ কেন? মুখখানি ভার-ভার, চোখের কোণে জল, হয়েছে কী? রানী বললেন— হয়েছে আমার মাথা আর মুণ্ডু! সতীন আবার ঘরে ঢুকেছে, সে সোনার শাড়ি পরেছে, নতুন মহল পেয়েছে, রাজার প্রেয়সী রানী হয়েছে! ভিখারিনী দুওরানী এত দিনে সুওরানীর রানী হয়ে রাজমহল জুড়ে বসেছে! বামুন সই, দেখে অঙ্গ জ্বলে গেল, আমায় বিষ দে খেয়ে মরি, সতীনের এ অাদর প্রাণ সয় না। ব্রাহ্মণী বললে— ছি! ছি! সই। ও কথা কি মুখে আনে! কোন্ দুঃখে বিষ খাবে? দুওরানী আজ রানী হয়েছে, কাল ভিখারিনী হবে, তুমি যেমন সুওরানী তেমনি থাকবে। সুওরানী বললেন— না-ভাই, বাঁচতে আর সাধ নাই। আজ বাদে কাল দুওরানীর ছেলে হবে, সে ছেলে রাজা হবে! লোকে বলবে আহা, দুওরানী রত্নগর্ভা, রাজার মা হল! আর দেখনা, পোড়ামুখী সুওরানী মহারাজার সুওরানী হল, তবু রাজার কোলে দিতে ছেলে পেলে না! ছি! ছি! অমন অভাগীর মুখ দেখেনা, নাম করলে সারাদিন উপোস যায়! ভাই, এ গঞ্জনা প্রাণে সবে না। তুই বিষ দে, হয় আমি খাই, নয়তো সতীনকে খাওয়াই। ব্রাহ্মণী বললে— চুপ কর রানী, কে কোন্ দিকে শুনতে পাবে। ভাবনা কী? চুপি চুপি বিষ এনে দেব, দুওরানীকে খেতে দিও। এখন বিদায় দাও, বিষের সন্ধানে যাই। রানী বললেন— যাও ভাই। কিন্তু দেখো, বিষ যেন আসল হয়, খেতে-না-খেতে বড়োরানী ঘুরে পড়বে। ডাকিনী বললে— ভয় নেই গো, ভয় নেই! আজ বাদে কাল বড়োরানীকে বিষ খাওয়াব, জন্মের মতো মা হবার সাধ ঘোচাব, তুমি নির্ভয়ে থাক। ডাকিনী বিষের সন্ধানে গেল। বনে বনে খুঁজে খুঁজে ভরসন্ধ্যাবেলা ঝোপের আড়ালে ঘুমন্ত সাপকে মন্ত্রে বশ করে, তার মুখ থেকে কালকূট বিষ এনে দিল। ছোটোরানী সেই বিষে মুগের নাড়ু, ক্ষীরের ছাচ, মতিচুর মেঠাই গড়ালেন। একখানা থালা সাজিয়ে ডাকিনী ব্রাহ্মণীকে বললেন— ভাই এক কাজ কর্, এই বিষের নাড়ু, বড়োরানীকে বেচে আয়। ব্রাহ্মণী থালা হাতে বড়োরানীর নতুন মহলে গেল। বড়োরানী বললেন— আয় লো আয়, এতদিন কোথায় ছিলি? দুওরানী বলে কি ভুলে থাকতে হয়? ডাকিনী বললে— সে কী গো! তোমাদের খাই, তোমাদের পরি, তোমাদের কি ভুলতে পারি? এই দেখ, তোমার জন্যে যতন করে মুগের নাড়ু, ক্ষীরের ছাচ, মতিচুর মেঠাই এনেছি। রানী দেখলেন, বুড়ি ব্রাহ্মণী বড়ো যত্ন করে, থালা সাজিয়ে সামগ্রী এনেছে। খুশি হয়ে তার দুহাতে দুমুঠো মোহর দিয়ে বিদায় করলেন, ব্রাহ্মণী হাসতে হাসতে চলে গেল। রানী ক্ষীরের ছাচ ভেঙে খেলেন, জিবের স্বাদ গেল। মুগের নাড়ু মুখে দিলেন, গলা কাঠ হল। মতিচুর মেঠাই খেলেন, বুক যেন জ্বলে গেল। বানরকে ডেকে বললেন— ব্রাহ্মণী আমায় কী খাওয়ালে! গা-কেমন করছে, বুঝি আর বাঁচব না। বানর বললে— চল্ মা, খাটে শুবি, অসুখ সারবে। রানী উঠে দাঁড়ালেন, সাপের বিষ মাথায় উঠল। রানী চোখে আঁধার দেখলেন, মাথা টলে গেল, সোনার প্রতিমা শানের উপর ঘুরে পড়লেন। বানর রানীর মাথা কোলে নিলে, হাত ধরে নাড়ি দেখলে, চোখের পাতা খুলে চোখ দেখলে— রানী অজ্ঞান, অসাড়! বানর সোনার প্রতিমা বড়োরানীকে সোনার খাটে শুইয়ে দিয়ে ওষুধের সন্ধানে বনে ছুটে গেল। বন থেকে কে জানে কী লতাপাতা, কোন গাছের কী শিকড় এনে নতুন শিলে বেটে বড়োরানীকে খাওয়াতে লাগল। রাজবাড়িতে খবর গেল— বড়োরানী বিষ খেয়েছেন। রাজা উঠতে-পড়তে রানীর মহলে এলেন। রাজমন্ত্রী ছুটতে ছুটতে সঙ্গে এলেন। রাজবৈদ্য মন্তর আওড়াতে আওড়াতে তারপর এলেন। তারপর রাজার লোক-লস্কর, দাসী-বাঁদী যে যেখানে ছিল হাজির হল। বানর বললে— মহারাজ, এত লোক কেন এনেছ? আমি মাকে ওষুধ দিয়েছি, মা আমার ভালো আছেন, একটু ঘুমোতে দাও। এত লোককে যেত বল। রাজা বিষের নাড়ু পরখ করিয়ে রাজবৈদ্যকে বিদায় করলেন। রাজ্যের ভার দিয়ে রাজমন্ত্রীকে বিদায় করলেন। বড়োরানীর মহলে নিজে রইলেন। তিন দিন, তিন রাত বড়োরানী অজ্ঞান। চার দিনে জ্ঞান হল, বড়োরানী চোখ মেলে চাইলেন। বানর রাজাকে এসে খবর দিলে— মহারাজ, বড়োরানী সেরে উঠেছেন, তোমার একটি রাজচক্রবর্তী ছেলে হয়েছে। রাজ বানরকে হীরেব হার খুলে দিয়ে বললেন— চল বানর, বড়োরানীকে আর বড়োরানীর ছেলেকে দেখে আসি। বানর বললে— মহারাজ, গণনা করেছি ছেলের মুখ এখন দেখলে তোমার চক্ষু অন্ধ হবে। ছেলের বিয়ে হলে মুখ দেখো, এখন বড়োরানীকে দেখে এস ছোটোরানী কী দুর্দশা করেছে। রাজা দেখলেন– বিষের জ্বালায় বড়োরানীর সোনার অঙ্গ কালি হয়ে গেছে, রানী পাতাখানার মতো পড়ে আছেন, রানীকে আর চেনা যায় না! রাজা রাজবাড়িতে এসে ছোটোরানীকে প্রহরী-খানায় বন্ধ করলেন, তার ডাকিনী বুড়িকে মাথা মুড়িয়ে ঘোল ঢেলে, উল্‌টো গাধায় চড়িয়ে দেশের বার করে দিলেন। তারপর হুকুম দিলেন– মন্ত্রীবর, আজ বড়ো শুভদিন, এতদিন পরে রাজচক্রবর্তী ছেলে পেয়েছি। তুমি পথে পথে আলো জ্বালাও, ঘরে ঘরে বাজি পোড়াও, দীন-দুঃখী ডেকে রাজ ভাণ্ডার লুটিয়ে দাও, রাজ্যে যেন একটিও ভিখারী না-থাকে। মন্ত্রী রাজার আজ্ঞায় নগরের পথে পথে আলো দিলেন, ঘরে ঘরে বাজি পোড়ালেন, দীন-দুঃখীকে রাজভাণ্ডার লুটিয়ে দিলেন, রাজ্যে জয়-জয়কার হল। এমনি করে নিত্য নতুন আমোদে, দেবতার মন্দিরে পূজা দিয়ে, মা কালীর পায়ে বলি দিয়ে দেখতে দেখতে দশ বৎসর কেটে গেল। রাজা বানরকে ডেকে বললেন– দশ বৎসর তো পূর্ণ হল এখন ছেলে দেখাও!  বানর বললে— মহারাজ, আগে ছেলের বৌ ঠিক কর, তারপর তার বিয়ে দাও, তারপর মুখ দেখো! এখন ছেলে দেখলে অন্ধ হবে। রাজা বানরের কথায় দেশ-বিদেশে ভাট পাঠালেন। কত দেশের কত রাজকন্যার সন্ধান এল, একটিও রাজার মনে ধরল না। শেষে পাটলী দেশের রাজার ভাট সোনার কৌটায় সোনার প্রতিমা রাজকন্যার ছবি নিয়ে এল। কন্যার অঙ্গের বরন কাঁচা সোনা, জোড়াভুরু— বাঁকাধনু, দুটি চোখ টান-টানা, দুটি ঠোঁট হাসি-হাসি, এলিয়ে দিলে মাথার কেশ পায়ে পড়ে। রাজার সেই কন্যা পছন্দ হল। বানরকে ডেকে বললেন– ছেলের বৌ ঠিক করেছি, কাল শুভদিনে শুভলগ্নে বিয়ে দিতে যাব। বানর বললে— মহারাজ, কাল সন্ধ্যাবেলা, বেহারা দিয়ে বরের পাল্‌কি মায়ের দুয়ারে পাঠিয়ে দিও, বরকে নিয়ে বিয়ে দিতে যাব। রাজা বললেন— দেখো বাপু, দশ বৎসর তোমার কথা শুনেছি, কাল ছেলে না-দেখালে অনর্থ করব। বানর বললে, মহারাজ, সে ভাবনা নেই। তুমি বেহাই-বাড়ি চলে যাও, আমরা কাল বর নিয়ে যাব। রাজা পাছে রানীর ছেলেকে দেখে ফেলেন, পাছে চক্ষু অন্ধ হয়, সেই ভয়ে তাড়াতাড়ি বেহাই-বাড়ি চলে গেলেন। আর বানর নতুন মহলে বড়োরানীর কাছে গেল। বড়োরানী ছেলের বিয়ে শুনে অবধি পড়ে পড়ে কাঁদছেন আর ভাবছেন– ছেলে কোথা পাব, এবার রাজাকে কী ছলে ভোলাব! বানর এসে বললে, মা গো মা, ওঠ্। চেলীর জোড় আন্, মাথার টোপর আন্, ক্ষীরের ছেলে গড়ে দে, বর সাজিয়ে বিয়ে দিয়ে আনি। রানী বললেন— বাছারে, প্রাণে কি তোর ভয় নেই? কোন্ সাহসে ক্ষীরের পুতুল বর সাজিয়ে বিয়ে দিতে যাবি? রাজাকে কী ছলে ভোলাবি? বাছা কাজ নেই, ছল করে রাজার প্রেয়সী হলুম, সেই পাপে সতীন বিষ খাওয়ালে, ভাগ্যে-ভাগ্যে বেঁচে উঠেছি, আবার কোন্ সাহসে রাজার সঙ্গে ছল করব? বাছা ক্ষান্ত দে, কেন আর পাপের বোঝা বাড়াস! তুই রাজাকে ডেকে আন্, আমি সব কথা খুলে বলি। বানর বললে— রাজাকে পাব কোথা? দুদিনের পথ কনের বাড়ি, রাজা সেখানে গেছেন। তুই কথা রাখ, ক্ষীরের বর গড়ে দে। রাজা পথ চেয়ে আছেন কখন বর আসবে, বর না-এলে বড়ো অপমান। মা তুই ভাবিসনে, ক্ষীরের পুতুল বিয়ে দিতে পাঠালি, যদি ষষ্ঠীর কৃপা হয় তবে ষষ্ঠীদাস ষেঠের বাছা কোলে পাবি৷ রানী বানরের ভরসায় বুক বেঁধে মনের মতো ক্ষীরের ছেলে গড়লেন। তাকে চেলীর জোড় পরালেন, সোনার টোপর পরালেন, জরির জুতে পায়ে দিলেন। বানর চুপি চুপি ক্ষীরের বর পাল্‌কিতে তুলে রঙিন ঢাকা নামিয়ে দিলে, বরের কেবল দুখানি ছোটো পা, দুপাটি জরির জুতো দেখা যেতে লাগল। ষোলো জন কাহার বরের পাল্‌কি কাঁধে তুল্‌লে। বানর মাথায় পাগড়ি, কোমরে চাদর বেঁধে, নিশেন উড়িয়ে, ঢাক বাজিয়ে, আলো জ্বালিয়ে, ক্ষীরের পুতুলের বিয়ে দিতে গেল। রানী আঁধার পুরে একলা বসে বিপদ-ভঞ্জন বিঘ্নহরণকে ডাকতে লাগলেন। এদিকে বর নিয়ে ষোলো কাহার, মশাল নিয়ে মশালধারী, ঢাক ঢোল নিয়ে ঢাকী ঢুলী, ঘোড়ায় চড়ে বরযাত্রী— সারারাত বাঁশি বাজিয়ে, আলো জ্বালিয়ে ঘোড়া হাঁকিয়ে দিগ্‌নগরে এসে পড়ল। দিগ্‌নগরে দিঘির ধারে ভোর হল। মশাল পুড়ে-পুড়ে নিবে গেল, ঘোড়া ছুটেছুটে বেদম হল, কাহার পাল্‌কি বয়ে হয়রান হল, ঢাক পিটে পিটে ঢাকীর হাতে খিল্ ধরল। বানর দিঘির ধারে তাবু ফেলতে হুকুম দিলে। দিঘির ধারে ষষ্ঠীতলায় বরের পাল্‌কি নামিয়ে কাহারদের ছুটি দিলে, মন্ত্রীকে ডেকে বলে দিলে— মন্ত্রীমশায়, রাজার হুকুম বরকে যেন কেউ না দেখে, আজকের দিনে বর দেখলে বড়ো অমঙ্গল।  মন্ত্রী রাজার হুকুম জারি করলেন। রাজার লোকজন দিঘির জলে নেয়ে, রেঁধে-বেড়ে খেয়ে, তাঁবুর ভিতর শুয়ে রইল, বটগাছের দিকে এল না। গাঁয়ের বৌ-ঝি ষষ্ঠীঠাকরুণের পুজো দিতে এল, রাজার পাহারা হাঁকিয়ে দিলে। সেদিন বটতলায় ষষ্ঠীঠাকরুনের পুজো হল না। ষষ্ঠীঠাকরুন খিদের জ্বালায় অস্থির হলেন, তেষ্টায় গলা শুকিয়ে কাঠ হল। বানর মনে মনে হাসতে লাগল। এমনি বেলা অনেক হল। ষষ্ঠীঠাকরুনের মুখে জলবিন্দু পড়ল না, ঠাকরুন কাঠামোর ভিতর ছট্‌ফট করতে লাগলেন, ঠাকরুনের কালো বেড়াল মিউ-মিউ করে কাঁদতে লাগল। বানর তখন মনে-মনে ফন্দি এঁটে পাল্‌কির দরজা খুলে রেখে আড়ালে গেল। ষষ্ঠীঠাকরুন ভাবলেন— আঃ আপদ গেল! কাঠফাটা রোদে কাঠামো থেকে বার হয়ে নৈবেদ্যের ছোলাটা কলাটা সন্ধান করতে লাগলেন। খুঁজতে খুঁজতে দেখেন, পাল্‌কির ভিতর ক্ষীরের পুতুল। ঠাকরুন আর লোভ সামলাতে পাবলেন না, মনে-মনে ঘুমপাড়ানি মাসি-পিসিকে স্মরণ করলেন। দিগ্‌নগরে যখন দিন, ঘুমের দেশে তখন রাত। ঘুমপাড়ানি মাসি-পিসি সারারাত দিগ্‌নগরে ষষ্ঠীরদাস ষেঠের-বাছা ছেলেদের চোখে ঘুম দিয়ে, সকালবেলা ঘুমের দেশে রাজার মেয়েকে ঘুম পাড়িয়ে, অনেক বেলায় একটুখানি চোখ বুজেছেন, এমন সময় ষষ্ঠীঠাকরুনের ডাক পড়ল। ঘুমের দেশে ঘুমপাড়ানি মাসি জেগে উঠলেন, ঘুমপাড়ানি পিসি উঠে বসলেন, দুই বোনে ঘুমের দেশ ছেড়ে দিগ্‌নগরে এলেন। ষষ্ঠীর পায়ে প্রণাম করে বললেন— ঠাকরুন, দিনে-দুপুরে ডেকেছেন কেন? ঠাকরুন বললেন— বাছারা, এতখানি বেলা হল এখনও ভোগ পাইনি। তোরা একটি কাজ কর, দেশের যে যেখানে আছে ঘুম পাড়িয়ে দে, আমি ডুলির ভিতর ক্ষীরের পুতুলটি খেয়ে আসি। ষষ্ঠীঠাকরুনের কথায় মাসি-পিসি মায়া করলেন, দেশের লোক ঘুমিয়ে পড়ল। মাঠের মাঝে রাখাল, ঘরের মাঝে খোকা, খোকার পাশে খোকার মা, খেলাঘরে খোকার দিদি ঘুমিয়ে পড়ল। ষষ্ঠীতলায় রাজার লোকজন, পাঠশালায় গাঁয়ের ছেলেপিলে ঘুমিয়ে পড়ল। রাজার মন্ত্রী হুঁকোর নল মুখে ঘুমিয়ে পড়লেন, গাঁয়ের গুরু বেত হাতে ঢুলে পড়লেন। দিগ্‌নগরে দিনে-দুপুরে রাত এল। মাসি-পিসি সবার চোখে ঘুম দিলেন— জেগে রইল গাঁয়ের মাঝে রাস্তার শেয়াল-কুকুর, দিঘির ধারে রাজার হাতি-ঘোড়া, বনের মাঝে বনের পাখি, গাছের ডালে রানীর বানর। আর জেগে রইল, ষষ্ঠীরদাস বনের বেড়াল, জলের বেড়াল, গাছের বেড়াল, ঘরের বেড়াল। ষষ্ঠীঠাকরুন তখন ডুলি খুলে ক্ষীরের ছেলে হাতে নিলেন। ক্ষীরের গন্ধে গাছ থেকে কাঠবেড়াল নেমে এল, বন থেকে বনবেড়াল ছুটে এল, জল থেকে উদ্‌বেড়াল উঠে এল, কুনোবেড়াল কোণ ছেড়ে ষষ্ঠীতলায় চলে এল। ষষ্ঠীঠাকরুন ক্ষীরের ছেলের দশটি আঙুল বেড়ালদের খেতে দিলেন। নিজে ক্ষীরের হাত, ক্ষীরের পা, ক্ষীরের বুক পিঠ মাথা খেয়ে, ক্ষীরের দুটি কান মাসি-পিসির হাতে দিয়ে বিদায় করলেন। মাসি-পিসি ঘুমের দেশে চলে গেলেন, দিগ্‌নগরে দিঘিব ঘাটে বরযাত্রীর ঘুম ভাঙল, গাঁয়ের ভিতর ঘরে ঘরে গ্রামবাসীর ঘুম ভাঙল। ষষ্ঠীঠাকরুন তাড়াতাড়ি মুখ মুছে কাঠামোয় ঢুকতে যাবেন, এমন সময় বানর গাছ থেকে লাফিয়ে পড়ে বললে— ঠাকরুন, পালাও কোথা, আগে ক্ষীরের ছেলে দিয়ে যাও! চুরি করে ক্ষীর খাওয়া ধরা পড়েছে, দেশ-বিদেশে কলঙ্ক রটাব। ঠাকরুন ভয় পেয়ে বললেন— আঃ মর! এ মুখপোড়া বলে কী! সর্ সর্, আমি পালাই, লোকে আমায় দেখতে পাবে! বানর বললে— তা হবে না, আগে ছেলে দাও তবে ছেড়ে দেব। নয় তো কাঠামো-সুদ্ধ আজ তোমায় দিঘির জলে ডুবিয়ে যাব, দেবতা হয়ে ক্ষীর চুরির শাস্তি হবে। ঠাকরুন লজ্জায় মরে গেলেন, ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে বললেন— বাছা চুপ কর্, কে কোন্ দিকে শুনতে পাবে? তোর ক্ষীরের ছেলে খেয়ে ফেলেছি ফিরে পাব কোথা? ওই বটতলায় আমার ছেলেরা খেলা করছে, তোর যেটিকে পছন্দ সেটিকে নিয়ে বিয়ে দিগে যা, আমার বরে দুওরানী তাকে আপনার ছেলের মতো দেখবে, এখন আমায় ছেড়ে দে। বানর বললে— কই ঠাকরুণ, বটতলায় তো ছেলের নেই! আমায় দিব্যচক্ষু দাও তবে তো ষষ্ঠীরদাস ষেঠের বাছাদের দেখতে পাব! ষষ্ঠীঠাকরুণ বানরের চোখে হাত বোলালেন, বানরের দিব্যচক্ষু হল। বানর দেখলে— ষষ্ঠীতলা ছেলের রাজ্য, সেখানে কেবল ছেলে— ঘরে ছেলে, বাইরে ছেলে, জলে স্থলে, পথে ঘাটে, গাছের ডালে, সবুজ ঘাসে যেদিকে দেখে সেইদিকেই ছেলের পাল, মেয়ের দল। কেউ কালো, কেউ সুন্দর, কেউ শ্যামলা। কারো পায়ে নূপুর কারো কাঁকালে হেলে, কারো গলায় সোনার দানা। কেউ বাঁশি বাজাচ্ছে কেউ ঝুমঝুমি ঝুম্‌ঝুম্ করছে, কেউবা পায়ের নূপুর বাজিয়ে বাজিয়ে কচি হাত ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে নেচে বেড়াচ্ছে। কারো পায়ে লাল জুতুয়া, কারো মাথায় রাঙা টুপি, কারো গায়ে ফুলদার লক্ষ টাকার মলমলি চাদর। কোনো ছেলে রোগা-রোগা, কোনো ছেলে মোটাসোটা, কেউ দস্যি, কেউ লক্ষ্মী। একদল কাঠের ঘোড়া টক্‌বক্‌ হাঁকাচ্ছে, একদল দিঘির জলে মাছ ধরছে, একদল বাঁধের জলে নাইতে নেমেছে, একদল তলায় ফুল কুড়চ্ছে, একদল গাছের ডালে ফল পাড়ছে, চারিদিকে খেলাধুলো, মারামারি, হাসিকান্না। সে এক নতুন দেশ, স্বপ্নের রাজ্য! সেখানে কেবল ছুটোছুটি, কেবল খেলাধুলো; সেখানে পাঠশালা নেই, পাঠশালের গুরু নেই, গুরুর হাতে বেত নেই। সেখানে আছে দিঘির কালো জল তার ধারে সর বন, তেপান্তর মাঠ তার পরে আমকাঁঠালের বাগান, গাছে গাছে ন্যাজঝোলা টিয়েপাখি, নদীর জলে গোল-চোখ বোয়াল মাছ, কচু বনে মশার ঝাঁক। আর আছেন বনের ধারে বনগাঁ-বাসী মাসি-পিসি, তিনি খৈয়ের মোয়া গড়েন, ঘরের ধারে ডালিম গাছটি তাতে প্রভু নাচেন। নদীর পারে জন্তীগাছটি তাতে জন্তী ফল ফলে, সেখানে নীল ঘোড়া মাঠে মাঠে চরে বেড়াচ্ছে, গৌড় দেশের সোনার ময়ূর পথে ঘাটে গড়াগড়ি যাচ্ছে। ছেলেরা সেই নীল ঘোড়া নিয়ে, সেই সোনার ময়ূর দিয়ে ঘোড়া সাজিয়ে, ঢাক মৃদং ঝাঁঝর বাজিয়ে, ডুলি চাপিয়ে, কমলাপুলির দেশে পুঁটুরানীর বিয়ে দিতে যাচ্ছে। বানর কমলাপুলির দেশে গেল। সে টিয়েপাখির দেশ, সেখানে কেবল ঝাঁকে ঝাঁকে টিয়েপাখি, তারা দাঁড়ে বসে ধান খোঁটে, গাছে বসে কেঁচ্‌মেচ্ করে, আর সে-দেশের ছেলেদের নিয়ে খেলা করে। সেখানে লোকেরা গাই-বলদে চাষ করে, হীরে দিয়ে দাঁত ঘষে! সে এক নতুন দেশ— সেখানে নিমেষে সকাল, পলকে সন্ধ্যা হয়, সে দেশের কাণ্ডই এক! ঝুরঝুরে বালির মাঝে চিক্‌চিকে জল, তারি ধারে এক পাল ছেলে দোলায় চেপে ছ-পণ কড়ি গুণতে গুণতে মাছ ধরতে এসেছে; কার। পায়ে মাছের কাঁটা ফুটেছে, কারো চাঁদমুখে রোদ পড়েছে। জেলেদের ছেলে জাল মুড়ি দিয়ে ঘুম দিচ্ছে— এমন সময় টাপুর-টুপুর বিষ্টি এল, নদীতে বান এল; অমনি সেই ছেলের পাল, সেই কাঠের দোলা, সেই ছ-পণ কড়ি ফেলে, কোন্ পাড়ায় কোন্ ঘরের কোণে ফিরে গেল। পথের মাঝে তাদের মাছগুলো চিলে কেড়ে নিলে, কোলা ব্যাঙে ছিপগুলো টেনে নিলে, খোকাবাবুরা ক্ষেপ্ত হয়ে ঘরে এলেন, মা তপ্ত দুধ জুড়িয়ে খেতে দিলেন। আর সেই চিক্‌চিকে জলের ধারে ঝুর্‌ঝুরে বালির চরে শিবঠাকুর এসে নৌকো বাঁধলেন, তাঁর সঙ্গে তিন কন্যে— এক কন্যে রাঁধলেন বাড়লেন, এক কন্যে খেলেন আর এক কন্যে না-পেয়ে বাপের বাড়ি গেলেন। বানর তার সঙ্গে বাপের বাড়ির দেশে গেল। সেখানে জলের ঘাটে মেয়েগুলি নাইতে এসেছে, কালে কালো চুলগুলি ঝাড়তে লেগেছে। ঘাটের দুপাশে দুই রুই কাতলা ভেসে উঠল, তার একটি গুরুঠাকুর নিলেন, আর একটি নায়ে ভরা দিয়ে টিয়ে আসছিল সে নিলে। তাই দেখে ভোঁদড় টিয়েকে এক হাতে নিয়ে আর মাছকে এক হাতে নিয়ে নাচতে আরম্ভ করলে, ঘরের দুয়োরে খোকার মা খোকাবাবুকে নাচিয়ে নাচিয়ে বললেন— ওরে ভোঁদড় ফিরে চা, খোকার নাচন দেখে যা। বানর দেখলে— ছেলেটি বড়ো সুন্দর, যেন সোনার চাঁদ, তাড়াতাড়ি ছেলেটিকে কেড়ে নিলে! অমনি ষষ্ঠীতলার সেই স্বপ্নের দেশ কোথায় মিলিয়ে গেল, ন্যাজঝোলা টিয়েপাখি আকাশ সবুজ করে কোন্ দেশে উড়ে গেল, শিবঠাকুরের নৌকো কোন্ দেশে ভেসে গেল। ঘাটের মেয়েরা ডুরে শাড়ি ঘুরিয়ে পরে চলে গেল। ষষ্ঠীর দেশে কুনোবেড়াল কোমর বেঁধে, শাশুড়ি ভোলাতে উড়কি ধানের মুড়কি নিয়ে, চার মিন্‌সে কাহার নিয়ে, চার মাগী দাসী সঙ্গে, আম-কাঁঠালের বাগান দিয়ে পুঁটুরানীকে শ্বশুর-বাড়ি নিয়ে যেতে যেতে আমতলার অন্ধকারে মিশে গেল। তেঁতুল গাছের ভোঁদড়গুলো নাচতে নাচতে পাতার সঙ্গে মিলিয়ে গেল— দেশটা যেন মাটির নিচে ডুবে গেল। বানর দেখলে— কোথায় ষষ্ঠীঠাকরুণ, কোথায় কে! বটতলায় দিঘির ধারে ছেলে কোলে একলা দাঁড়িয়ে আছে! তখন বানর লোকজন ডেকে সেই সোনার চাঁদ ছেলেটিকে পাল্‌কি চড়িয়ে, আলো জ্বালিয়ে বাদ্যি বাজিয়ে সন্ধ্যাবেলা দিগ্‌নগর ছেড়ে গেল। এদিকে পাটলি দেশে বেয়াইবাড়ি বসে বসে রাজা ভাবছেন— বানর এখনো এল না? আমার সঙ্গে ছল করলে? রাজ্যে গিয়ে মাথা কাটব। বিয়ের কনেটি ভাবছে— না জানি বর দেখতে কেমন? কনের মা-বাপ ভাবছে— আহা, বুকের বাছা পর হয়ে কার ঘরে চলে যাবে! রাজবাড়ির চাকর-দাসীরা ভাবছে কাজ কখন সারা হবে, ছাদে উঠে বর দেখব। এমন সময় গুরু গুরু ঢোল বাজিয়ে, পোঁ পোঁ বাঁশি বাজিয়ে, টক্‌বক্‌ ঘোড়া হাঁকিয়ে ঝক্‌মক্ আলো জ্বালিয়ে, বানর বর নিয়ে এল। রাজা ছেলেকে হাত ধরে সভায় বসলেন, কনের বাপ বিয়ের সভায় মেয়ের হাত জামাইয়ের হাতে সঁপে দিলেন, পাড়া-পড়শী বরকে বরণ করলে, দাস-দাসী শাঁক বাজালে, হুলু দিলে— বরকনের বিয়ে হল। রাজা ছেলের বিয়ে দিয়ে তার পরদিন বৌ ছেলে নিয়ে, বাঁশি বাজিয়ে, ঘোড়া হাঁকিয়ে বানরের সঙ্গে দেশে ফিরলেন। পাটলি দেশের রাজার বাড়ি এক রাত্তিরে শূন্য হয়ে গেল, মা-বাপের কোলের মেয়ে পরের ঘরে চলে গেল। এদিকে রাজার দেশে বড়রানী দুদিন দুরাত কেঁদে কেঁদে, ভেবে ভেবে, ভোর বেলা ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে স্বপ্ন দেখছেন যষ্ঠীঠাকরুন বলছেন, রানী, ওঠ্। চেয়ে দেখ্ তোর কোলের বাছা ঘরে এল। রানী ঘুম ভেঙে উঠে বসলেন, দুয়ারে শুনলেন দাসীরা ডাকছে ওঠ গো রানী ওঠ, পাটের শাড়ি পর, বৌ-বেটা বরণ করগে! রানী পাটের শাড়ি পরে বাইরে এলেন। এসে দেখলেন সত্যিই রাজা বৌ-বেটা এনেছেন! হাসিমুখে বর-কনেকে কোলে নিলেন, ষষ্ঠীর বরে দুঃখের দিনের ক্ষীরের ছেলের কথা মনে রইল না, ভাবলেন ছেলের জন্য ভেবে ভেবে ক্ষীরের ছেলে স্বপ্ন দেখেছি। রাজা এসে ছেলেকে রাজ্য যৌতুক দিলেন, সেই রাজ্যে বানরকে মন্ত্রী করে দিলেন, তার ছেলের বৌকে মায়ারাজ্যের সেই আট হাজার মানিকের আটগাছি চুড়ি, দশশো ভরি সোনার সেই দশগাছা মল পরিয়ে দিলেন। কন্যের হাতে মানিকের চুড়ি যেন রক্ত ফুটে পড়ল, পায়ে মল রিনিঝিনি বাজতে লাগল, ঝিকিমিকি জ্বলতে লাগল। হিংসেয় ছোটোরানী বুক ফেটে মরে গেল।
অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর
০১. বর্ষামঙ্গল অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর ভূমিকা যত সুখের স্মৃতি এত দুঃখের স্মৃতি আমার মনের এই দুই তারে যা দিয়ে দিয়ে এইসব কথা আমার শ্রুতিধরই শ্রীমতী রানী চন্দ এই লেখায় ধরে নিয়েছেন, সুতরাং এর জন্যে যা কিছু পাওনা তাঁরই প্রাপ্য। মুখের কথা লেখার টানে ধরে রাখা সহজ নয়, প্রায় বাতাসে ফাঁদ পাতার মতও কঠিন ব্যাপার সুতরাং যদি কিছু দোষ থাকে এই বইখানিতে সেটা আমি নিতে রাজি হলেম ইতি শ্রীঅবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর জন্মাষ্টমী ১৩৫১ ————– ১ তোমাদের এখানে আজ বর্ষামঙ্গল হবে? আমাদেরও ছেলেবেলা বর্ষামঙ্গল হত। আমরা কি করতুম জানো? আমরা বর্ষাকালে রথের সময়ে তালপাতার ভেঁপু কিনে বাজাতুম; আর টিনের রথে মাটির জগন্নাথ চাপিয়ে টানতুম, রথের চাকা শব্দ দিত ঝন্‌ ঝন্‌; যেন সেতার নূপুর সব একসঙ্গে বাজছে। আকাশ ভেঙে বৃষ্টি পড়ত দেখতে পেতুম, থেকে থেকে মেঘলা আলোকে রোদ পরাত চাপাই শাড়ি—কি বাহার খুলত! তবে শোনো বলি একটা বাদলার কথা। সন্ধ্যে হতে ঝড়জল আরম্ভ হল, সে কি জল, কি ঝড়! হাওয়ার ঠেলায় জোড়াসাঁকোর তেতালা বাড়ি যেন কাঁপছে, পাকা ছাত ফুটো হয়ে জল পড়ছে সব শোবার ঘরে। পিদিম জ্বালায় দাসীরা, নিবে নিবে যায় বাতাসের জোরে। বিছানাপত্তর গুটিয়ে নিয়ে দাসীরা আমাদের কোলে করে দোতলায় নাচঘরে এনে শোয়ালে। বাবা মা, পিসি পিসে, চাকর দাসী, ছেলেপুলে, সব এক ঘরে। এক কোণে আমাকে নিয়ে আমার পদ্ম দাসী কটর কটর কলাই ভাজা চিবোচ্ছে, আমাকেও দু-একটা দিচ্ছে আর ঘুম পাড়াচ্ছে, চুপি চুপি ছড়া কাটছে—ঘুমতা ঘুমায়; গাল চাপড়াচ্ছে আমার, পা নাচাচ্ছে নিজের ছড়া কাটার তালে তালে। ওদিকে শোঁ-শোঁ শব্দ করছে বাইরের বাতাস; এক-একবার নড়েচড়ে উঠছে বড় ঘরের বড় বড় কাঠের দরজাগুলো। খানিক ঘুমিয়ে খানিক জেগে কাটল ঝড়ের রাত। সকালে কাক পাখি ডাকে না, আকাশ ফরশা হয় না। মাছের বাজারে মাছ আসেনি, পানবারুই পান আনেনি। শশী পরামানিক এসে খবর দেয়, শহরের রাস্তায় হয়েছে এককোমর জল। ও দিব্য ঠাকুর, আজ কি রান্না?—‘ভাতে ভাত খিচুড়ি’ বলে খুন্তি হাতে চলে যায় রান্নাবাড়ির দিকে। কেরঞ্চি গাড়ি? গাড়ি চলল না আপিসের দিকে, গোরুর গাড়িতে ব্যাঙের ছাতার নিচে বসে ব্যাঙ্কের বড়বাবুরা সরকারি কাজে যাচ্ছেন। সিংগিদের পুকুর ভেসে মাছ পালিয়েছে। পাড়ার লোক ধরে ধরে ভেজে খাচ্ছে। হিরু মেথর এসে খবর দিতেই, বেরিয়ে পড়ল বিপনে চাকর ছোট ডিঙি বেয়ে শহরের অলিগলিতে ফিরতে। কাগজের নৌকো চলল আমাদের ভেসে—এ গাছ ঘুরে, ও বাগানে ডুবে-যাওয়া গোল চক্কর ঘুরে, একটানা স্রোতে পড়ে-চলতে চলতে, ফটকের লোহার শিকে ঠেকে উলটে পড়ল কাদায় জলে লট্‌পট্‌ একগোছা বিচিলির লঙর ফেলে। ঈশ্বর দাদা খোঁড়াতে খোঁড়াতে লাঠি ঠকঠকিয়ে ভিস্তিখানায় এসে হাঁকলেন ‘বিশ্বেশ্বর!’ যাই—বলে বিশ্বেশ্বর হুঁকো কল্কে হাতে দিতেই—“শনি সাত, মঙ্গলে তিন, আর সব দিন দিন’ বলতেই হুঁকো শব্দ দিতে থাকল—চুপ চুপ—ছুপ ছুপ —কুর্‌র্‌—ঝুপ ঝুপ। তখন বর্ষাকাল পড়লে সত্যি সত্যি বৃষ্টি ঝড় আকাশ ভেঙে খড়ের চাল খোলার চাল ফুটাে করে আসত। এ দেখেছি। ডালে চালে খিচুড়ি চেপে যেত। মেঘ করলেই শহর বাজার ডুবত জলে, পুকুরের মাছ উঠে আসত রান্নাবাড়ির উঠানে খেলা করতে করতে—ধরা পড়ে ভাজা হয়ে যেত কখন বুঝতেই পারত না। ফুটে ছাত—ভাতে ভাত ভাজ্‌ মাছ। সারারাত সাতদিন ঝমাঝম্‌। মটর ভাজি কড়াই ভাজি ভিজে ছাতি। যেদিকে চাও ভিজে শাড়ি ভিজে কাপড় পরদা টেনে হাওয়ায় দুলছে, তারই তলায় তলায় খেলে বেড়ানো সারাদিন, সন্ধ্যে থেকে কোলা ব্যাঙে বাদ্যি বাজায়, রাজ্যের মশা ঘরে সেঁধোয় টাকাংদিং টাকাংদিং মশারি ঘিরে। দাসী চাকর সরকার বরকার সবার মাথায় চড়ে গোলপাতার ছাতা; শোলার টুপি, ওয়াটারপ্রুভ, রেনকোট ছিল না; ছিল ছেলেবুড়ো মিলে গান গল্প, বাবু ভায়ে মিলে খোস গল্প—আর কত কি মজা আঠারো ভাজা জিবেগজা। গুড়গুড়ি ফরসী দাদুরীর বোল ধরত গুড়ুক ভুড়ুক।
অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর
০২. ছোট ছেলেরা হো-হো করে স্কুলে যায় অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর এখানে দেখি ছোট ছেলেরা হো-হো করে স্কুলে যায়, আসন খাতা বই দু-হাতে বুকে জড়িয়ে নিয়ে। কত ফুর্তি তাদের, এমন স্কুল আমার ছেলেবেলায় পেলে আমিও বুঝিবা একটু আধটু লেখাপড়া শিখলেও শিখতে পারতুম। বাড়ির কাছেই নর্ম্যাল স্কুল; কিন্তু হলে হবে কি? নিজের ইচ্ছেয় কোনোদিন যাইনি স্কুলে। পালিয়ে পালিয়ে বেড়াই, আজ পেটে ব্যথা, কাল মাথাধরার ছুতো— রেহাই নেই কিছুতেই। স্কুলে যাবার জন্য গাড়ি আসে গেটে। চিৎকার কান্নাকাটি—যাব না, কিছুতেই যাব না। চাকররা জোর করে গাড়িতে তুলবেই তুলবে। মনে হয় গাড়ির চাকা দুটো বুকের উপর দিকে চলে যাক্‌—সেও ভালো, তবু স্কুলে যাব না। মহা ধ্বস্তাধস্তি, অতটুকু ছেলে পারব কেন তাদের সঙ্গে? আমার কান্নায় ছোটপিসিমার এক-একদিন দয়া হয়, বলেন ‘ও গুনু, নাইবা গেল অবা আজ স্কুলে। রামলালকে বলেন, ‘রামলাল, আজ আর ও স্কুলে যাবে না, ছেড়ে দে ওকে।’ কোনো কোনো দিন তার কথায় ছাড়া পাই। কিন্তু বেশির ভাগ দিনই চাকররা আমায় দু-হাতে ধরে ঠেলে গাড়ির ভিতরে তুলে দিয়ে দরজা বন্ধ করে দেয়। গাড়ি চলতে শুরু করে, কি আর করি, জোরে না পেরে বন্দী অবস্থায় দু-চোখের জল মুছে গুম হয়ে বসে থাকি। স্কুল ভালো লাগে না মোটেই। ভালো লাগে শুধু স্কুলে একটি ঘরে কাচের আলমারিতে তোলা একখানি খেলনার জাহাজ আর গোটাকয়েক নানা আকারের শঙ্খ—। বেশির ভাগ সময় কাচের আলমারির সামনে বসে বসে সেগুলো দেখি। জানো, আমার ছবি আঁকার হাতেখড়ি হয় সেইখানেই, ওই নর্ম্যাল স্কুলেই। আর কোনো বিদ্যের হাতেখড়ি তো হল না, তবু ভাগ্যিস ওই হাতেখড়িটুকু হয়েছিল। তাই না তোমাদের এখনও একটু ছবি-টবি এঁকে দিয়ে খুশি রাখতে পারি। নয়তো আর কারে কোনো কাজেই লাগতুম না আমি। এখন শোনো তবে সেই হাতেখড়ির গল্প। একটি মেটে কুঁজো, একটি মেটে গ্লাস, ছবির হাতেখড়ি আমার এই দুটি দিয়ে। বললুম তো, আমি তখন নর্মাল স্কুলে, পড়াশুনা করি বলব না, যাওয়া-আসা করি। পাশেই বড় ছেলেদের ক্লাস, সেই ক্লাসের জানালার ধারে গিয়ে সময় সময় বসে থাকি। বোতল বোতল ভরা লাল নীল জল নিয়ে মাস্টারমশায় ঢালাঢালি করেন; লাল হয় নীল, নীল হয় লাল, মাঝে মাঝে লাল নীল দুইই উবে যায়, বোতলে পড়ে থাকে ফিকে রঙের জল খানিকটে, চেয়ে চেয়ে দেখি, ভারি মজা লাগে। কেমিয়াবিদ্যা শেখানো হয়ে গেলে আসেন সাতকড়িবাবু ড্রইং মাস্টার। একটা মোট কাগজে বড় বড় করে আঁকা একটি মেটে কুঁজো ও গ্লাস, সেইটে কালো বোর্ডের গায়ে ঝুলিয়ে দিয়ে ছেলেদের বলেন, ‘দেখে দেখে আঁকো এবারে।’ ছেলেরা তাই আঁকে খাতার পাতায়। মাস্টার ঘুরে ঘুরে সবার কাছে গিয়ে দেখেন। এখন সেই ক্লাসে আছে আমাদের পাশের গলির ভুলু। একসঙ্গেই স্কুলে যাওয়া-আসা করি। তাকে ধরে পড়লুম, ‘কি করে কুঁজো আর গ্লাস আঁকতে হয় আমায় শিখিয়ে দে, ভাই।’ তার কাছে কুঁজো গ্লাস আঁকা শিখে ভারি ফুর্তি আমার। যখন-তখন সুবিধে পেলেই কুঁজো গ্লাস আঁকি। বড় মজা লাগে, কুঁজোর মুখের গোল রেখাটি যখন টানি। মন একেবারে কুঁজোর ভিতরে কুয়োর তলায় ব্যাঙের মতে টুপ করে ডুব দিতে চায়। আর সেই কাচের আলমারির স্টীম জাহাজ—তাতে চড়ে বসে মন কাপ্তেন হয়ে যেতে চায় সাত সমুদ্দর তেরো নদীর পার। কি খেলার জাহাজই ছিল সেটি—পালমাস্তুল, দড়িদড়া, যেখানকার যা হুবহু আসল জাহাজের মতো। ভুলু আমায় প্রায়ই বলে, ‘ভালো করে লেখাপড়া কর্‌—দেখবি এই জাহাজটিই তুই প্রাইজ পেয়ে যাবি। কিন্তু লেখাপড়ায়ই যে মন বসে না আমার, তা প্রাইজ পাবো কোত্থেকে? কোনো আশা নেই জানি, তবুও লোভ হয় মনে এক-আধটা প্রাইজ পেতে। কিন্তু কোনোবার কোনো কিছুরই জন্য প্রাইজ আর পেলেম না নর্ম্যাল স্কুলে। একবার প্রাইজ বিতরণের সময় এল, ইস্কুলে ছিল একটা মস্ত বড় ঘর আগাগোড়া গ্যালারি সাজানো। এক পাশে আছে খানকয়েক চেয়ার ও একটা টেবিল। রোজ ক্লাস আরম্ভ হবার আগে ছোট বড় সব ছেলেরা সেই ঘরে জড়ো হই। রেজিস্টার খুলে মাস্টার একে একে নাম হাঁকেন; আমরা বলি, ‘প্রেজেন্ট স্যার, অ্যাবসেন্ট স্যার।’ নাম ডাকা সারা হলে শুরু হয় ড্রিল। গ্যালারিতে বসে ছিলুম, উঠে দাঁড়াই এবার। মাস্টার হেঁকে চলেন, ‘দক্ষিণ হস্ত উত্তোলন, বাম হস্ত উত্তোলন, অঙ্গুলি সঞ্চালন। অমনি আমাদের পাঁচ পাঁচ দশটা অঙ্গুলি থর থর করে কাঁপতে থাকে যেন কচি কচি আমপাতা নড়ছে হাওয়াতে। তারপর পদক্ষেপ; ডান পা বাঁ পা তুলে বেঞ্চিতে খুব খানিকটে ধুপ ধাপ ঠুকে যার যার ক্লাসে যাই। সেই বড় ঘর সাজানো হয়েছে প্রাইজ বিতরণের দিনে, টেবিলের উপরে লাল ফিতেয় বাঁধা গাদা গাদা চটি মোটা সোনালি রুপোলি নানা রঙের বই। সামনে এক সারি চেয়ার—বিশিষ্ট লোকেরা বসবেন তাতে। আমরাও সকলে হাজির গ্যালারিতে অনেক আগে থেকেই। প্রাইজ বিতরণের আগে জিতেন বাঁড়ুজ্জে কুস্তি দেখালেন—লোহার শিকল ছিঁড়লেন, লোহার বড় বড় বল ছুঁড়ে ছুঁড়ে লুফে নিলেন। মস্ত পালোয়ান তিনি। এবার প্রাইজ বিতরণ হবে। গোপালবাবু হেডমাস্টার, টাকমাথা, ঘাড়ের কাছে একটু একটু চুল, অনেকটা এই এখনকার আমার মতোই; তবে রঙ তাঁর আরো পরিষ্কার। গম্ভীর মানুষ; কামিয়ে জুমিয়ে ফিটফাট হয়ে গলায় চাদর ঝুলিয়ে এসে বসলেন চেয়ারে। ছেলেরা কেউ বুঝুক ন-বুঝুক এই সব উপলক্ষে তিনি ইংরেজিতেই বক্তৃতা করেন। তিনি তাঁর লম্বা ইংরেজি বক্তৃতা শেষ করলেন। তারপর এইবারে একজন মাস্টার উঠে যারা প্রাইজ পাবে তাদের নাম পড়ে যেতে লাগলেন। ছেলেদের নাম ডাকা হতেই তারা টেবিলের কাছে গিয়ে দাঁড়ায়, হেডমাস্টার মশায় তাদের হাতে লাল ফিতেয় বাঁধা প্রাইজ তুলে দেন। এক-একটি প্রাইজ দেওয়া হয় আর আমরা হাততালি দিয়ে উঠি, যে যত জোরে পারি। হাততালির ধুম কি। লাল হয়ে উঠল হাতের তেলো, তবু থামিনে। সেবার অনেকেই প্রাইজ পেলে; তার মধ্যে ভুলু পেলে, সমরদাও একটা পেয়ে গেলেন for good conduct, চেয়ে চেয়ে দেখি আর ভাবি এইবার বুঝি আমার নাম ডাকবে, আমাকে এমনি একটা কিছুর জন্য হয়তে প্রাইজ দিয়ে দেবে। কান পেতে আছি নাম শোনবার জন্য; শেষ প্রাইজটি পর্যন্ত দেওয়া হয়ে গেল, কিন্তু আমার কানে আমার নাম আর পৌঁছল না। প্রাইজ বিতরণ হয়ে গেলে মাস্টার উঠে পড়লেন, ছেলেরা হৈ হৈ করে বাইরে এল ; আর আমি তখন দু-চোখের জলে ভাসছি। ভুলু সাত্ত্বনা দেয়, ‘আরে, তাতে কি হয়েছে, ভাল করে পড়াশুনো কর্‌, সামনের বারে ভালো প্রাইজ ঠিক পাবি তুই।’ সে কথায় কি মন ভোলে? না-পাওয়া মণ্ডার জন্য বাচ্চু বেজিটা যেমন হয়ে থাকে আমারও মনটার তেমনি দশা হয়। চোখের ধারা গড়াইতেই থাকে, থামে না আর। শেষে ভুলু বললে, ‘প্রাইজ চাস তুই, এই কথা তো? আচ্ছা এই নে’—বলে খাতা থেকে একটুকরো সাদা কাগজ ছিঁড়ে তাতে খসখস করে কি সব লিখে আমার হাতে দিলে। আমি তাতেই খুশি। কাগজের টুকরোটি যত্নে ভাঁজ করে পকেটে রেখে চোখের জল মুছে বাড়ি এলেম। বৈঠকখানায় বাবামশায় পিসেমশায় সবাই বসে ছিলেন। বললেন, ‘দেখি কে কি প্রাইজ পেলি।’ সমরদা তাঁর প্রাইজ লালফিতে-বাঁধা টিকিট-মারা সোনালি বই দেখালেন। আমি বললুম, ‘আমিও পেয়েছি।’ পিসেমশায় বললেন, ‘কই দেখি?’ গম্ভীরভাবে পকেট থেকে ভাঁজকরা সাদা কাগজটুকু বের করে তাঁদের সামনে মেলে ধরলুম। উলটেপালটে সেটি দেখে তাঁরা হো-হো করে হেসে উঠলেন। তখন বুঝলুম, ভুলুটা আমায় ঠকিয়েছে। এমন রাগ হল তার উপরে! রাত্তিরে খাওয়াদাওয়া সেরে তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে পড়লুম। সকালে ঘুম ভেঙে দেখি প্রাইজ না-পাওয়ার দুঃখু আর একটুও নেই। তা লেখাপড়ায় মন বসবে কি? তোমাদের মতো তো গাছের ছায়ায় খোলা হাওয়ায় বসে পড়তে পাইনি কখনও। স্কুলের ওই পাকা দেয়াল-ঘেরা বন্ধ ঘরের ভিতরে দম যেন আটকে আসে আমার। যতক্ষণ পারি ঘরের বাইরেই ঘোরাফেরা করি। স্কুলের পাশে শ্যাম মল্লিকের বাড়ি, তাদের বাড়ির একটি মেয়ে পড়তে আসে আমাদের স্কুলে, ইজের চাপকান প’রে, বেণী ঝুলিয়ে। তাদের বাড়িতে একটা পোষা কালো ভাল্লুক চরে বেড়ায় সামনের বাগানে, দেখা যায়, ইস্কুল থেকে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ভাল্লুক দেখি। ইস্কুলঘরের বাইরে যা কিছু সবই আমার কাছে ভালো লাগে। ইস্কুলের গেটের কাছে রাস্তা। নানা রকম লোক যাচ্ছে আসছে, তাদের আনাগোনা দেখি। এই রকম দেখতে দেখতে একদিন যা কাণ্ড। কাবুলিওয়ালার রাগ দেখেছ কখনও? গেটের কাছে কতগুলি কাবুলিওয়ালা রোজই বসে থাকে আঙুর বেদানা নিয়ে। টিফিনের সময়ে ছেলেরা কিনে খায়। সেদিন হয়েছে কি, বড়ছেলেদের মধ্যে কে একজন বুঝি এক কাবুলিকে বলেছে ‘বেইমান’। আর যায় কোথায়! দেখতে দেখতে সব কয়টা কাবুলি উঠল রুখে, দারোয়ান বুদ্ধি করে তাড়াতাড়ি লোহার ফটকটা দিলে বন্ধ করে। বাইরে কাবুলি, ভিতরে ছেলের দল; রাস্তা থেকে পড়তে লাগল টপাটপ কাবলাই বেদানা। মাথার উপরে যেন এক চোট শিলাবৃষ্টি হয়ে গেল। জানো তো, মারপিট দেখলে আমি থাকি বরাবরই সবার পিছনে। শিশুবোধে চাণক্যশ্লোক মনে পড়ে—ন গণস্যাগ্রতো গচ্ছেৎ। তা, বাপু, সত্যি কথাই বলব। আমি ওই পিছনে থেকেই ফাটা বেদানাগুলো ফাঁকতালে কুড়িয়ে কুড়িয়ে খেতে লাগলুম। সেদিনের ঝগড়ায় জিত হল বটে আমারই। কিন্তু ইস্কুলের ছুটির পর বাড়ি ফিরতে হবে; কাবুলিওয়ালার ভয় যায় না। পালকির ভিতরে বসে আচ্ছা করে দরজা বন্ধ করে অতি ভয়ে ভয়ে বাড়ি ফিরি শেষে। নর্ম্যাল স্কুলের এক-এক পণ্ডিতের চেহারা যদি দেখতে তো বুঝতে কেমন পণ্ডিত সব ছিলেন তারা। আমাদের পড়ান লক্ষ্মীনাথ পণ্ডিত, চেহারা তাঁর ঠিক যেন মা দুর্গার অসুর। মস্ত বড় মাথা, কালো কুচকুচে গায়ের রং, বোয়াল মাছের মতো চোখ দুটাে লাল টকটক করছে। তাঁর কাছে পড়ব কি? যতক্ষণ ক্লাসে থাকি শিশুমন কাঁপে বলির পাঠার মতো। কোনো রকমে ছুটির ঘণ্টা পড়ে গেলে হাঁফ ছেড়ে বাঁচি। তারপর পড়ি মাধব পণ্ডিতের কাছে। বাংলা, সংস্কৃত পড়ান; অতি অমায়িক ভটচাজ্জি চেহারা, শিশুবোধের চাণক্য পণ্ডিতের ছবিখানি—মস্ত টিকি। সেই সময়ে একবার দিনে তারা উঠল, হঠাৎ ইস্কুল ছুটি হয়ে গেল। ছুটে সবাই বাইরে এলুম। ইস্কুলে একটা টেলিস্কোপ ছিল, তাই নিয়ে তারা দেখতে ঠেলাঠেলি লেগে গেল। সেই মাধব পণ্ডিতের কাছে পড়ি ‘পত্র পততি’, এমনি সব নানা সাধুভাষার বুলি। সেখান থেকে হেডমাস্টারের হাতে-পায়ে ধরাধরি করে অতিকষ্টে উঠলুম তো হরনাথ পণ্ডিতের কেলাসে। তাঁর চোয়াল দুটাে কেমন অদ্ভুত চওড়া, আর শক্ত রকমের। কথা যখন বলেন চোয়াল দুটে ওঠে পড়ে, মনে হয় যেন চিবোচ্ছেন কিছু। তাঁর কাছে পড়লুম কিছুদিন। এই করতে করতে তিনটে শ্রেণী উঠে গেছি। এইবার মাস্টার মশায়ের হাতে পড়ার পালা। এখন সেই শ্রেণীতে আসেন এক ইংরেজি পড়াবার মাস্টার। তিনি এক ইংলিশ রীডার লিখে বই ছাপিয়ে তা পাঠ্যপুস্তক করিয়ে নিয়েছিলেন। সেই বই আমাদের পড়তে হয়। একদিন হয়েছে কি—ক্লাসে ইংরেজির মাস্টার আমাদের পড়ালেন p-u-d-d-i-n-g—পাডিং। আমার মাথায় কি বুদ্ধি খেলে গেল, বলে উঠলুম, ‘মাস্টারমশায়, এর উচ্চারণ তো পাডিং হবে না, হবে পুডিং, আমি যে বাড়িতে এ জিনিস রোজ খাই।’ মাস্টার ধমকে উঠলেন, ‘বল পাডিং।’ আমি বলি, ‘না পুডিং।’ তিনি যত বলতে বলেন পাডিং, আমি আমার বুলি ছাড়িনে। বা রে, আমি পুডিং খাই যে, পাডিং বলতে যাব কেন? মাস্টার গোঁ ধরলেন পাডিং বলবেনই। আমি বলে চলি পুডিং। বাকি ছেলেরা থ হয়ে বসে দেখে কি হয় কাণ্ড। এই করতে করতে ক্লাসের ঘণ্টা শেষ হল। শাস্তি দিলেন চারটের পর এক ঘণ্টা ‘কনফাইন’। ইস্কুল ছুটি হয়ে গেল; বাড়ির গাড়ি নিয়ে রামলাল অপেক্ষা করছে দরজার সামনে। কিন্তু ‘কনফাইন’, এক ঘণ্টার আগে যেতে পারিনে। মাস্টার নিজের বৈকালিক সেরে এলেন। ঘরে ঢুকে বললেন, ‘এবারে বল্‌ পাডিং।’ উত্তর দিলেম, ‘পুডিং’। যেমন শোনা টানাপাখার দড়ি দিয়ে হাত দুটো বেঁধে তবে রে ব্যাদ্‌ড়া ছেলে, বলবিনে? বলতেই হবে তোকে পাডিং। দেখি কেমন না বলিস!’ বলে সপাসপ জোড়া বেত লাগালেন পিঠে। বেতের ঘায়ে পিঠ হাত লাল হয়ে গেল—তখনও বলছি পুডিং। রামলাল ব্যস্ত হয়ে বারে বারে দরজায় উঁকি দিয়ে দেখে, এ কি কাণ্ড হচ্ছে! যা হোক, বাড়ি এলাম। ছোটপিসিমা বললেন, ‘কি ব্যাপার?’ রামলাল বললে, ‘আমার বাবু আজ বড্ড মার খেয়েছেন।’ আমিও জামা খুলে পিঠ দেখালুম, হাত দেখালুম। দড়ির দাগ বসে গিয়েছিল হাতে। বাবামশায় তৎক্ষণাং নৰ্ম্যাল স্কুল থেকে নাম কাটাবার হুকুম দিলেন; বললেন, ‘কাল থেকে ছেলেরা বাড়িতে পড়বে।’ চুকে গেল ইস্কুল যাবার ভয়; জোড়া বেত খেয়ে ছাড়া পেলুম। এক ‘পাডিং’এই ইংরেজি বিদ্যে শেষ। পরদিন থেকে বাড়িতে বাবামশায়ের মাস্টার যদু ঘোষাল আমায় পড়াবার ভার নিলেন।
অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর
০৩. এখন স্কুলে যাওয়া বন্ধ অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর এখন স্কুলে যাওয়া বন্ধ হয়ে নামকাটা সেপায়ের কি বিপদ হল শোনো। স্কুলে যাওয়ার থেকে তো নিস্তার পেলুম, ভাবলুম বেশ হল, এবার বড়দের মতোই বুঝি আমি স্বাধীন হয়ে গেলুম। যা ইচ্ছে তাই করতে পারব, স্নানের জন্য, ভাত খাবার জন্য চাকররা আর তাড়া দেবে না। নিয়মমতো চলবারও দরকার হবে না। লম্বা পুজোর ছুটি, গরমের ছুটি পেলে যেমন আনন্দ হয় তেমনি আনন্দে দিন কাটবে বুঝি। কবে স্কুল খুলবে সে ভয়ও নেই। এই সব ফুর্তিতেই মাতলুম। কিন্তু দুদিন যেতে না যেতেই দেখি, ওমা, তা তো নয়। যদু ঘোষাল মাস্টার বাড়িতেই থাকেন; ঠিক সময়ে পড়তে বসতে হয় তাঁর কাছে। দশটা বাজলেই চাকররা তাড়া লাগায়। স্নান করে খেয়ে নিতে হয় চটপট। খেয়েদেয়ে ঘুর্‌ ঘুর্‌ করি। স্কুল ছুটি তো শুধু আমারই হয়েছে। দাদা, ইন্দুদা ওঁরা সবাই চলে যান ইস্কুলে। ভেবেছিলেম, বেশ খেলাধুলো হুটোপাটি করে সময় কাটবে রোজ। তা আর হয় না। খেলব কার সঙ্গে? খেলার সাথীরা সবাই স্কুল করে, আমি একলা ঘরে কি করি ভেবে পাইনে। চাকররা থাকে তাদের কাজে ব্যস্ত। রামলাল ধমক দেয়, ‘কোথাও যেয়ো না, চুপটি করে বসে থাকো। এদিকে ওদিকে গেছ কি মুশকিল হবে বলে দিচ্ছি। গলির মোড়ে ওই ওইখানে কন্ধকাটা আছে,ধরে নেবে।’ বলে গলির মোড়ে একটা বাসাবাড়ির নিচে ড্রেনের খিলেন ছিল, সেইটে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়। আগে অন্দরে যেতে পারতুম যখন-তখন। আজকাল সেই যে চাকররা সকালবেলা আমায় বের করে আনে অন্দর থেকে, সারাদিনে আর ভিভরে ঢুকবার হুকুম নেই, তবু দু-এক ফাঁকে ঢুকে পড়ি অন্দরে। মা ব্যস্ত ছোটভাইকে নিয়ে। সুনয়নী বিনয়নী ছোটবোন—তাদের সঙ্গে খেলতে খেলতে খেলনা একটা ভেঙে গেল কি তারা কাঁদতে শুরু করে দিলে, ‘অ্যাঁ, অবনদাদা আমাদের পুতুল ভেঙে দিলে।’ অমনি তাড়া লাগায় আমায় সকলে, ‘তুই এখানে কেন? যা বাইরে যা। সেখানে গিয়ে খেলা কর্‌।’ তাড়া খেয়ে বাইরে চলে আসি। বাইরে এসে ভাবের লোক আর পাইনে কাউকে। সবাই দেখি তাড়া লাগায়, ধমক দেয়। বাবামশায়ের ছিল পোষা একটি কাকাতুয়া গোলাপী রঙের। বারান্দার দেয়ালে-টাঙানো হরিণের শিঙের উপর বসে থাকে, কি সুন্দর লাগে দেখতে। সকালবেলা মা পান সাজেন; মার কাছে গিয়ে পানের বোঁটা খায়। ছোটপিসিমার কাছে ছোলা খায়; আবার এসে শিঙের উপর উঠে বসে। ভাবলুম এবার মানুষ ছেড়ে পশুপাখির সঙ্গেই ভাব করা যাক। এই ভেবে কাকাতুয়ার কাছে গিয়ে দাঁড়াতেই ঝুঁটি তুলে গায়ের পালক ফুলিয়ে সে এল তেড়ে আমায় ঠোকরাতে। ভাব করা থাকুক পড়ে, ছুটে পালিয়ে বাঁচি সেখান থেকে। তার ডানার তলায় তলায় বাবামশায় নিজের হাতে পাউডার মাখান। পাউডার মেখে সে মেমসাহেব হয়ে ঝুঁটি বাগিয়ে বসে থাকে। গুমোর কি তার। সে করবে আবার আমার সঙ্গে ভাব। ভয়ে আর সেদিক দিয়েই যাইনে। বাবামশায়ের আদরের কুকুর কামিনী। কি তার আদরযত্নের ঘটা। কামিনীর জন্য আলাদা চাকর মেথর। তাকে যখন সাবান দিয়ে পরিষ্কার করে স্নান করিয়ে, গায়ে পাউডার মাখিয়ে, পরিপাটি করে আঁচড়ে সিঁথি কেটে, সাজিয়েগুজিয়ে ছেড়ে দেয়, আর কামিনী ঘুরঘুর করে ঘুরে বেড়ায়, যেন বাড়ির খেঁদি মেয়েটি। বাড়ির ছেলে আমাদেরও অত আদরযত্ন হয় না যত হয় কামিনীর। সেই কামিনীর কাছে যাই। সে আমায় তোয়াক্কাই করে না। লেজ নেড়ে চলে যায় বাবামশায়ের ঘরের দিকে। ছোট্ট ছোট্ট এক জোড়া পোষা বাঁদরও আছে বাবামশায়ের। কত তাদের আদরই বা। গ্রেট ঈস্টার্‌ন্‌ হোটেল থেকে বাঁদরের জন্য স্পেশাল লাল টুকটুকে চেরি আসে চিনিমাখানো। বাবামশায় একটি একটি করে ওই চেরি খাওয়ান তাদের। দেখে হিংসেয় জ্বলে মরি। ভাবি ওই চেরিগুলো নিজেরা যদি খেতে পাই, আঃ। তাঁর শখের হরিণও আছে একটি, নাম গোলাপী। গোলাপীর কাছে গেলে মালী আসে হৈ-হৈ করে। দেখো এমন আমার কপাল! পশুপাখির কাছেও পাত্তা পাইনে। ওই একটু যা আদর পাই ছোটপিসিমার কাছে। মাঝে মাঝে তাঁর ঘরে আমায় ডেকে নেন। সেখানে কথকতা হয় রোজ। মাইনে-করা মহিম কথক আছেন। বসে শুনি খানিক। কিন্তু তাও আর কতক্ষণই বা! মহামুশকিল, একলা একলা সময় আর কাটে না। মনের দুঃখে ভাবি, এর চেয়ে বেশ ছিলুম স্কুলেই। গাড়িতে ওঠবার আগেই যত কান্নাকাটি, উঠেই সব ঠাণ্ডা হয়ে যেত। গাড়ি চলত গলির মোড় ঘুরে। সেই শিবমন্দির, কাঁসরঘণ্টা, লোকজন, দোকানপাট, রাস্তার দুদিক দেখতে দেখতে বেশ যেতম। তবুও তো বাইরের জগৎ দেখতে পেতুম কিছুটা; এখন কোন বন্ধখানায় পড়লুম! ফটক পেরিয়ে ওদিকে যাবারই আর উপায় নেই। খোলা ফটক আগলে বসে আছে মনোহর সিং দারোয়ান দেউড়িতে। মনে পড়ে স্কুলের সামনে প্রতাপের লজেঞ্জুসের দোকান। চেয়ে নিয়ে ছোট্ট ছোট্ট হলদে লাল সবুজ লজেঞ্জুস খেতুম। চাইলেই দুটি-একটি হাতে গুঁজে দিত প্রতাপ। আর মনে পড়ে সমবয়সীদের কথা । তাদের নিয়ে হুটোপাটি করেও মন্দ ছিলুম না। আমারই মতো ডানপিটে ছেলেও ছিল একটি-দুটি। একটির কথা বলি, স্কুলে যেতে তারও ছিল বেজায় আপত্তি। স্কুলে যাবার সময় হলেই সে পালিয়ে বেড়ায়। একদিন স্কুলে যাবার সময় হয়েছে; সে এদিকে করেছে কি, বাড়ির পাশেই এক শিবমন্দির, তার ভিতরে ঢুকে কাপড়জামা খুলে অন্ধকার ঘরে কালো পাথরের শিবকে জড়িয়ে ধরে বসে রইল। ছেলেটির রঙও কালো, শিবের কালোয় তার কালোয় মিশে গেল। চাকরবাকররা আর খুঁজে তাকে পায় না। মহা হৈ-চৈ। শেষে কে একজন শিবের মাথায় জল ঢালতে গিয়ে তাকে আবিষ্কার করলে। সেই সব সঙ্গীর কথা মনে পড়ে, আর মন খারাপ হয়ে যায়। নর্ম্যাল স্কুলের বাড়িটিও ছিল কেমন রহস্যময়। প্রকাণ্ড রাজবাড়ি; তাতে কত অলিগলি, অন্দিসন্দি, এখানে ঘর, ওখানে খিলেনদেওয়া বারান্দা, মোটা মোটা থাম; তারি গায়ে দিনের আলো পড়ে চক্চক্‌ করত। ঘুরে ঘুরে দেখতুম এই সব। কোথায় গেল আমার সেই নর্ম্যাল স্কুল! বহুকাল পর এই সেদিন কোন্‌ এক সিনেমাতে দেখলুম সেই বাড়ির ছবি। দেখে ভারি মজা লাগল। যাক সে কথা। এখন আমার একলা থাকার গল্পটাই বলি। সকালবেলাটা লেখাপড়ায় যদিই বা কোনোমতে কেটে যায়, দুপুর আর কাটে না। দাদারা চলে যান স্কুলে, বাবামশায় যান কাছারিতে। ফার্সি পড়াবার মুনশী আসেন; দু-চারটে আ লে বে পড়িয়ে চলে যান। এই মুনশীই দাঁড়িয়ে দেয়ালে নিজের ছায়ার সঙ্গে লড়াই করতেন। একদিন লড়াই করতে গিয়ে রোখের মাথায় ছায়াতে যেমন ঢুঁ-মারা অমনি মুনশীর কপাল ফেটে রক্তপাত। চাকররাও তাদের তোষাখানায় গল্পগুজব করে। বৈঠকখানা শোনশান, একলা আমি সেখানে পড়ে থাকি। থেকে থেকে দাদাদের ডেক্‌সোর ঢাকা তুলে দেখি ভিতরে কি আছে। নেড়েচেড়ে দেখে আবার তেমনি সব ঠিকঠাক রেখে দিই। প্রাণে ভয়, যদি জানতে পারেন হয়তো বকুনি দেবেন। বাবামশায়ের টেবিলটা দেখি। কতরকম রঙ তার উপরে সাজানো। একটা ক্রিস্ট্যালের কলমদানি ছিল, ঠিক যেন সমুদ্রের ঝিনুক একটি। সেইরকম নকশায় গোলবাগানে ফোয়ারা তৈরি করিয়েছিলেন বাবামশায়। এখনও তা আছে। সেদিন যখন গেলুম জোড়াসাঁকোয়, দেখি বাগানের সব কিছু ভেঙে কেটে নষ্ট করে ফেলেছে, একটি গাছও বাকি রাখেনি; কিন্তু ফোয়ারাটি তেমনি আছে সেখানে, ফটিক জলে ভরতি। টেবিলে সেই কলমদানিতে কলম সাজিয়ে রাখা হয়েছে। সেটাতে একবার হাত বুলোই, আবার এসে শুয়ে থাকি। তাও কোথায় শুয়ে থাকতুম জানো? বিলিয়ার্ড টেবিলের নিচে। মাকড়সার জাল, ধুলো বালি, কত কি সেখানে। শুয়ে শুয়ে দেখি মাথার উপরে ঝুলছে সেসব। শোবার জায়গা আমার ওই রকমেরই। ছেঁড়া মাদুরের উপরে, কৌচ-টেবিলের তলায় তলায়, ঢুকে শুয়ে থাকি। ঠিক যেন একটা জানোয়ার। বুদ্ধিও কতকটা আমার তেমনি। তবে একলা থাকার গুণ আছে একটা। দেখতে শুনতে শেখা যায়। ওই অমনি করে একলা থাকতে থাকতেই চোখ আমার দেখতে শিখল, কান শব্দ ধরতে লাগল। তখন থেকেই কত কি বস্তু, কত কি শব্দ যেন মন-হরিণের কাছে এসে পৌঁছতে লেগেছে। মানুষ, পশুপাখি সঙ্গী পেলেম না কাউকেই। ওই অত বড় বাড়িটাই তখন আমার সঙ্গী হয়ে উঠল; নতুন রূপ নিয়ে আমার কাছে দেখা দিতে লাগল। এখানে ওখানে উঁকিঝুঁকি দিয়ে তখন বাড়িটার সঙ্গে আমার পরিচয় হচ্ছে। জোড়াসাঁকোর বাড়িকে যে কত ভালো বেসেছি। বলি যে, ও বাড়ির ইটকাঠগুলিও আমার সঙ্গে কথা কয়, এত চেনাপরিচয় তাদের সঙ্গে; তা ওই তখন থেকেই তার শুরু। পড়ে আছি; দেখছি, ঘরের কোণায় কোথায় কার্নিশের ছায়া পড়েছে, কোথায় টিকটিকিটা পোকা ধরবার জন্য ওত পেতে আছে, চড়ুইপাখি ছোট কুলুঙ্গিতে বাসা বাঁধছে। আবার কোথায় কোন্‌ উঁচুতে ছাদের উপরে লোহার শিকে এক চিল বসে আছে তাকে দেখছি তো দেখছিই। একসময়ে সে চিঃ-ঃ-ঃ করে দুটো চক্কর খেয়ে উড়ে গেল। আবার কখনো বা চেয়ে থাকতুম সামনে সাদা দেওয়ালের দিকে, ওপাশের উত্তরের খড়খড়ির ফাঁক দিয়ে দিনের আলো এসে পড়েছে তাতে; বাইরে মানুষ হেঁটে যায়, ছায়াটিও চলে যায় ঘরের ভিতরে দেয়ালের গা দিয়ে। রঙিন এক-একখানি ছবির মতো তারা আলোর রাস্তা ধরে চলতে চলতে অন্ধকারে মিলিয়ে যায়। এই ছবি-দেখা রোগ আমার এখনো আছে, দিনে দুপুরে ঘরের ভিতরে বসে বসে ছবি দেখি। কাল দুপুরে কৌচে বসে ঝিমোচ্ছি। বাইরের তালগাছের ছায়া এসে পড়েছে দেয়ালে, পাতাগুলি নড়ছে হাওয়াতে, পিছনের আকাশে সাদা মেঘ—ঠিক যেন চাঁদের আলোর ছবি একটি। তখনও সব দেখতুম, একমনে দেখতুম। এই দেখতে যখন আরম্ভ করলুম তখন আর একলা থাকতে খারাপ লাগত না। এদিকে আবার নানারকম শব্দও আসে কানে, দুপুর হতেই গলির মোড়ে শব্দ হল ঠং ঠং, ‘বাসন চাই ​​‌‍বাসন।’ শব্দ চলে গেল দূরে। তার পরে এল ‘চুড়ি চাই, খেলনা চাই।’ প্রায়ই মায়েদের মহলে তাদের ডাক পড়ে, ঝুড়ি ঝুড়ি নান৷ রঙের কাচের চুড়ি সাজিয়ে বসে এসে। একরকমের মজার খেলনা থাকে তাদের ঝুড়িতে; টিনের এতটুকু এতটুকু মাছ আর চুম্বকের কাঠি। মাছটি জলে ভাসিয়ে চুম্বকের কাঠি দিয়ে টানলেই মাছও সঙ্গে সঙ্গে জলের উপর চলতে থাকে, এমন লোভ হয় ওই খেলনার জন্য। বাড়ির অন্য সব ছেলেমেয়েরা প্রায়ই পায় সেই খেলনা, আমি পাই ক্বচিং কখনো। আমাকে কেউ যে খেয়ালই করে না তেমন। তারপর বেলা পড়ে এলে গরমের দিনে বরফওয়ালা হেঁকে যায়, “বরিফ, বরিফ চাই, বরিফ–কুলপি বরিফ। জ্যোতিকাকা মশায় লিখেছিলেন একটা গান ‘বরিফ বরিফ’ ব’লে বরফওয়ালা যান। গা ঢালো রে, নিশি আগুয়ান। ‘বেল ফুল বেল ফুল’ ঘন হাঁকে মালীকুল— সন্ধ্যাবেলার শব্দ হচ্ছে ওই বেলফুল। ‘বেলফুল চাই বেলফুল’ হাঁকতে হাঁকতে শব্দ গলির এদিক থেকে ওদিক চলে যায়। তাদের ডেকে বেলফুল কেনে দাসীরা, মালা গাঁথেন মেয়েরা। ভরসন্ধ্যেবেলা মুশকিল আসান আসে খিড়কির দরজায় চেরাগ হাতে, লম্বা দাড়ি; পিদিম জ্বলছে মিটমিট করে। বারান্দ থেকে দেখি তার চেহারা। দোরগোড়ায় এসেই হাঁক দেয়, ‘মুশকিল আসান, মুশকিল আসান।’ দপ্তরে বরাদ থাকে, মুশকিল আসান এলেই তাকে চাল পয়সা যা হয় দিয়ে দেয়; সে আবার হাঁক দিতে দিতে চলে যায়। আরও একটি শব্দ, সেটি এখনও থেকে থেকে কানে বাজে। দুপুরে সব যখন শোনশান, কোনো সাড়াশব্দ নেই কোথাও, তখন শব্দ কানে আসে ‘কূ-য়ো-র ঘটি তোলা’। মনে হয় ঠিক যেন অদ্ভুত কোন্‌ একটি পাখি ডেকে চলেছে। রাত্তিরে বিছানায় শুয়ে জানালা দিয়ে দেখি ঘনকালো তেঁতুলগাছের মাথা। দাসীরা বলে, বংশের সকলের নাড়ী পোঁতা আছে তার তলায়, মাঝে মাঝে ছাতের উপরে ভোঁদড় চলে বেড়ায়, সেই চলার শব্দে গল্প তৈরি হয় মনের ভিতরে; ব্রহ্মদত্যি হাঁটছে, জটেবুড়ি কাসছে। জটেবুড়ি সত্যিই ছিল, লাঠি ঠক ঠক করে আসত; ময়ূরে তার চোখ উপড়ে নিয়েছিল। ‘ক্ষীরের পুতুল’এ যে ষষ্ঠী বুড়ি এঁকেছি ঠিক সেই রকম ছিল সে দেখতে। ওদিকে নিচে রাত দশটার পর নন্দ ফরাসের ঘরে নোটো খোঁড়ার বেহালা শুরু হয়। একটাই সুর অনেক রাত্তির অবধি চলে একটানা। বেহালা যেন সুরে এক দুই মুখস্থ করছে; এক, দুই, তিন, চার; এক, দুই, তিন, চার। ওই থেকে পরে আমি একটা যাত্রার সুর দিয়েছিলুম। বাবামশায়ের বৈঠক ভাঙলে নন্দ ফরাসের ঘরে বৈঠক বসে—ছিরু মেথর, নোটো খোঁড়া, আরও অনেকের। ভোরবেলা বাড়ির সামনে ঘোড়া মলে টপ টপ ধপধপ। কাকপক্ষী ডাকার আগে এই শব্দ শুনেই ঘুম ভাঙে আমার। রোজ ঘুমোবার আগে আর ঘুম ভেঙে এই দুটি শব্দ শুনি—বেহালার এক, দুই, তিন, চার; আর ঘোড়ামলার টপ টপ ধপ ধপ। তখন এক-একটা সময়ের এক-একটা শব্দ ছিল। এখন সেই শব্দ আর নেই। সব মিলিয়ে যেন কোলাহল চারদিকে। ট্যাক্‌সির ভোঁ-ভোঁ, দোকানদারের চিংকার, রাস্তার হট্টগোল, এসবে ঘরের কোণায়ও কান পাতা দায়। তার উপরে জুটেছে আজকাল মাথার উপরে উড়োজাহাজের ঘড়ঘড়ানি, রেডিওর ভনভনানি, আরও কত কি। তেতালার ছাদে জ্যোতিকাকামশায়ের পিয়ানোর সুর, রবিকার গান, জ্যাঠামশায়ের হাসির ধমক, কোথায় চলে গেল সে সব! তা সেই সময়ে দুপুরে বৈঠকখানাতেই একদিন আমি আবিষ্কার করলুম ‘লণ্ডন নিউজে’র ছবি। বাঁধানো ‘লণ্ডন নিউজ’ পড়েছিল এক কোণায়। সব-কিছু ঘেঁটে ঘেঁটে দেখতে গিয়ে বইয়ের ভিতরে ছবির সন্ধান পেলুম। সে কতরকম কাণ্ডকারখানার ছবি, নিবিষ্ট মনে বসে বসে দেখি। একদিন ঘোষাল মাস্টার এসে ঢুকলেন সেই ঘরে। দিব্যি ভুঁড়িদার চেহারা তার; খালি গায়ে যখন আসেন, তেলচুকচুকে ভুঁড়িটি ঠিক যেন পিতলাই হাড়া একটি। তিনি ঘরে ঢুকে বললেন, ‘দেখি কি দেখছ’—বলে আমার হাত থেকে বইগুলি নিয়ে পাতা উলটে উলটে দেখতে লাগলেন। দেখতে দেখতে একটা পাতায় আছে ফরাসী রানীর ছবি, তিনি সেই ছবিটি সামনে রেখে হাতজোড় করে তিনবার মাথায় ঠেকালেন। তারপর থেকে দেখি রোজই তিনি স্নানের পর ফরাসী রানীর ছবি বের করে তিনবার পেন্নাম করেন। কারণ আর বুঝিনে কিছু। দেবদেবীর ছবি এ নয়, তবে কেন এত পেন্নামের ঘটা। শেষে বড়দাকে একদিন জিজ্ঞেস করি, ‘এর মানে কি বলে না।’ বড়দা হেসে বললেন, ‘ওহো তা বুঝি জানিসনে? ঘোষাল মশায়কে জিজ্ঞেস করেছিলুম যে, তিনি বললেন, এই ফরাসী রানী তাঁর স্ত্রীর মতো দেখতে। তাই রোজ তিনি ওই ছবিকে পেন্নাম করেন।’
অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর
০৪. ছেলেবেলায় খুব গান আর ছবি-আঁকা অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর সেদিন কে যেন আমায় বললে, আপনি বুঝি ছেলেবেলায় খুব গান আর ছবি-আঁকার আবহাওয়ায় বড় হয়েছেন? বললুম, মোটেও তা নয়। কি আবহাওয়ার ভিতর দিয়ে বড় হয়েছি জানতে চাইছ? শোনো তবে। ছবি গান ছিল বইকি বাড়িতে। বাবামশায়ের শখ ছিল ছবি আঁকার; জ্যোতিকাকামশায়ও ছবি আঁকতেন, পোর্‌ট্রেট আঁকবার ঝোঁক ছিল তার; কিন্তু ছবি দেখা তো দূরের কথা, আমরা কি তাঁদের ঘরে ঢুকতে পেরেছি কখনও? গানবাজনাও হত। তখনকার দিনে মাইনে-করা গাইয়ে থাকত বাড়িতে। কেষ্ট বিষ্ণু ছিল দুই মাইনে-করা গাইয়ে। দুর্গাপুজোয় আগমনী বিজয়া তখন গাইত তারা—শোননি কখনও? ভারি মিষ্টি সেসব গান। ওস্তাদি গানের মজলিশও বসত বৈঠকখানায় রোজ সন্ধ্যেবেলা। তখনকার নিয়মই ছিল ওই। পাড়াপড়শি বন্ধুবান্ধব আসতেন বৈঠকি গান শুনতে। নটার তোপও পড়ত, মজলিশও ভেঙে যে যার ঘরে যেতেন। দূর থেকে যেটুকু শুনতুম কিছুই বুঝতুম না তার। তবে হ্যাঁ, গান হত ও-বাড়িতে, তেতলার ছাদে নতুনকাকিমার ঘরে। একদিকে জ্যোতিকাকামশায় পিয়ানো বাজাচ্ছেন, আর একদিকে রবিকা গাইছেন। সেই অল্পবয়সের রবিকার গলা, সে যেমন সুর তেমনি গান। মাত করে দিতেন চারদিক। এ-বাড়ি থেকে শুনতুম আমি কান পেতে। তাই বলি, গান তবু শুনেছি আমি ছেলেবেলায়; কিন্তু ছবি দেখিনি মোটেও। ছবি যা দেখেছি তা আমার ছোটপিসিমার ঘরে। ছুটির দিন দুপুরবেলা ছোটপিসিমার ঘরের দরজায় একটু উঁকিঝুঁকি মারতেই ছোটপিসিমার নজরে পড়ি, তিনি ডাকেন, ‘কে রে অবা? আয় আয় ঘরে আয়।’ কি সুন্দর ঘরটি তাঁর। কতরকমের ছবি, দেশী ধরনের অয়েল-পেটিং, শ্রীকৃষ্ণের পায়েস ভক্ষণ— সামনে নৈবেদ্য সাজিয়ে মুনি চোখ বুজে ধ্যানে বসে আছেন, চুপি চুপি কৃষ্ণ হাত ডুবিয়ে পায়েসটুকু তুলে মুখে দিচ্ছেন, হুবহু কথকঠাকুরের গল্পের ছবি; শকুন্তলার ছবি—তিনটি মেয়ে বনের ভিতর দিয়ে চলেছে, শকুন্তলা বলে বুঝতুম না, তবে ভালো লাগত দেখতে; মদনভস্মের ছবি—মহাদেবের কপাল ফুঁড়ে ঝাঁটার মতো আগুন ছুটে বের হচ্ছে; সরোজিনী নাটকের ছবি; কাদম্বরীর ছবি—রাজপুত্তুর পুকুরধারে গাছতলায় ঘোড়া বেঁধে শিবমন্দিরের দাওয়ায় বসে আছে। কে জানে তখন, সেটা কাদম্বরীর ছবি। এমনি কত সব ছবি। কেষ্টনগরের পুতুলই বা কত রকমের ছিল সেই ঘরে। চেয়ে চেয়ে দেখতে বেলা কাটে। মেঝেতে ঢালা-বিছানায় বুকে বালিশ দিয়ে বসে ছোটপিসিমা পান খান, সেলাই করেন। ও-বাড়িতে বেলা তিনটের ঘণ্টা পড়ে। গুপীদাসী চুল বাঁধার বাক্স, মাদুর নিয়ে আসে। ছোটপিসিমা উঠে উঁচু-পাঁচিল-ঘেরা ছাদে গিয়ে চুল বাঁধতে বসেন, পোষা পায়রাগুলো খোপ থেকে বেরিয়ে এসে ছোটপিসিমাকে ঘিরে ঘাড় নেড়ে বকম বকম বকে বকে নাচ দেখায়। ছোটপিসি আমার হাতে মুঠো মুঠো দানা দেন; ছড়িয়ে দিই, তারা চক্কর বেঁধে কুড়িয়ে কুড়িয়ে খেয়ে উড়ে বসে ছাদের কার্নিশে সারি সারি। পড়ন্ত রোদ তাদের ডানায় ডানায় ঝকমক করে। কোনো কোনো দিন বা দেখি ঘূর্নি হাওয়ায় লাল ধুলো পাক খেয়ে খেয়ে উড়ে গেল। বাইরের ছবিও দেখি। আবার খেলাধুলোর শেষে ঘরের কোণায় সন্ধ্যেবেলা পিতলের পিলসুজের উপর পিদিম জলে, তারই কাছে টিকটিকি নড়েচড়ে পোকা ধরে, তাও দেখি চেয়ে চেয়ে অনেকক্ষণ। এইরকম ঘর-বাইরের কত কি ছবি দেখতে দেখতে বেড়ে উঠেছি। ভিতর দিকটা দেখবার কৌতুহল আমার ছেলেবেলা থেকে আছে। বন্ধ ঘরের ভিতরটা, ঘেরা বাগানের ভিতরটা, দেখতে হবে কি আছে ওখানে। খেলনা, দম দিলে চলে চাকা ঘোরে; দেখতে চাই ভিতরে কি আছে। এই সেদিন পর্যন্তও ছেলেদের খেলনা নিয়ে খুলে খুলে আবার মেরামত করেছি। ছেলেদের খেলনা হাতে নিলেই মা বলতেন, “ওই রে এবার গেল জিনিসটা, ভিতর দেখতে গিয়ে ভাঙবে ওটি।’ তা ছেলেবেলায় একবার ভিতর দেখতে গিয়ে কী কাণ্ডই হয়েছিল শোনো। বড়মা থাকেন তেতলার একটি ঘরে। তাঁরও নানারকম পাখি পোষার শখ। পোষা টিয়ে, পোষা লালমোহন হীরেমোহন; লালমোহনের দাঁড়টি আগাগোড়া ঝকঝক তকতক করছে সোনালি রঙে। ঘরের একপাশে এক আলমারি বোঝাই খেলনা; সে-সব তাঁর শখের খেলনা, কাউকে ধরতে ছুঁতে দেন না। অনেক ক’রে বললে কখনও একটা-দুটাে খেলনা বের করে নিজের হাতে দম দিয়ে চালিয়ে দেন মেঝেতে; আবার তুলে রাখেন। সেই বড়মার ঘরে যেতে হত একটি মেটে ঘোরানো সিঁড়ি বেয়ে। বরাবর তেতলার চিলে-ছাদ অবধি উঠে গেছে সেই গোল সিঁড়ি। তারই মাঝামাঝি এক জায়গায় মাটির একটি হাতদেড়েক কেষ্টমূর্তি, তাকের উপর ধরা। আমার লোভ সেই মাটির কেষ্টটির উপর। একদিন দুপুরে সেই সিঁড়ি বেয়ে উঠে বড়মার কাছে দরবার করলুম, “আমাকে মাটির কেষ্টটি দেবে? বড়মা খানিক ভেবে বললেন, ‘চাস? তা নিয়ে যা। ভাঙিসনে।’ বুড়ী দাসী তাক থেকে কেষ্টটি পেড়ে আমার হাতে দিলে। আমি সেটি বগলদাবা করে তরতর করে নিচে নেমে এলুম। দাদাদেরও নজর ছিল মূর্তিটির উপর, কেউ পাননি। তাদের দেখালুম। ‘দেখো, তোমরা তো পেলে না; আমি কেমন পেয়ে গেছি।’ দাদারা বললেন, ‘হুঃ, ওর ভিতরে কি আছে জানিসনে তো? এই টেবিলটির উপরে চড়ে মূর্তিটি ফেলে দে নিচে, দেখবি, আশ্চর্য জিনিস বের হবে এর ভিতর থেকে।’ দাদাদের অবিশ্বাস করতে পারলেম না। মূর্তির ভিতরের ‘আশ্চর্য’ দেখবার লোভে তাড়াতাড়ি উঁচু টেবিলটায় উঠে দিলেম কেষ্টকে মাটিতে এক আছাড়। ‘আশ্চর্য’ তো দেখা দিল না ; মাটির পুতুল ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে ছড়িয়ে পড়ল ঘরময়। তথন আমার কান্না, দাদার হো-হো করে হেসে হাততালি দিয়ে চম্পট। সেই ভিতর দেখার কৌতুহল আজও আমার ঘুচল না। ছবি, তার ভিতরে কি আছে খুঁজি। নোড়ানুড়িতে খুঁজি, কাঠকুট্‌রোতে খুঁজি। নিজের আর অন্যের মনের ভিতরে খুঁজি, কি আছে না-আছে। খুজি, কিছু পাই না-পাই, এই রকম খোঁজাতেই মজা পাই। হাত আমার তখন ভালো করে পেনসিল ধরতে পারে না, ছবি আঁকা কাকে বলে জানিনে; কিন্তু ছবি দেখতে ভাবতে শিখি সেই পিসিমার ঘরে বসে। মার ঘরে আমরা ঢুকতে পাইনে। মার ঘর একেবারে আলাদা ধরনে সাজানো। মার শোবার ঘর তৈরি হচ্ছে। রাজমিস্ত্রি লেগে গেছে; বাবামশায়ের পছন্দমতো মেঝেতে নানা রঙের টালি পাথর বসানো হচ্ছে, আস্তে আস্তে যাই সেখানে। ঠুকঠাক, মিস্ত্রিরা নকশা মিলিয়ে পাথর বসায়; অবাক হয়ে দেখি। কখনো বা দু-একটা পাথর চেয়ে আনি। দেখতে দেখতে একদিন ঘর তৈরি হয়ে গেল। বাবামশায় নিজের হাতে সে ঘর সাজালেন। চমৎকার সব পালিশ-করা দামী কাঠের আসবাবপত্র, কাটা কাচের নানারকম ফুলদানি, একটি ফুলদানি মনে পড়ে ঠিক যেন পদ্মকোরকটি,—কাচের গোরু-হাতি, কত কি। দেয়ালে দামী দামী অয়েল-পেন্টিং, চারিদিকে নানা জাতের অর্কিড, সে একেবারে অন্য রকমের সাজানো ঘর। আমার কিন্তু ভালো লাগে বেশি ছোটপিসিমার ঘরখানিই। বঙ্কিমবাবুর সূৰ্যমুখীর ঘরের যে বর্ণনা, যেখানে যে জিনিসটি, হুবহু আমার ছোটপিসিমার ঘরের সঙ্গে মিলে যায়। অত বড় বাড়ির মধ্যে আমার শিশুমনকে খুব টানত তেতলার উপর আকাশের কাছাকাছি ছোটপিসিমার ঘর। আর একটি জায়গা, সেটি আমার পরীস্থান। দেখো, যেন শুনে হেসে না। আমার পরীস্থান আকাশের পারে ছিল না। ছিল একতলায় সিঁড়ির নিচে একটা এঁদো ঘরের মধ্যে। সেই ঘরে সারাদিনরাত বন্ধ থাকে দুয়োর, মস্ত তালা। ওত পেতে বসে থাকি সকাল থেকে, বড় সিঁড়ির তলায় দোরগোড়ায়। নন্দফরাশ আমাদের তেলবাতি করে, তার হাতে সেই তালাবন্ধ ঘরের চাবি। সে এসে সকালে তালা খোলে তবে আমি ঢুকতে পাই সেই পরীস্থানে। সেখানে কি দেখি, কাদের দেখি? দেখি কর্তাদের আমলের পুরোনো আসবাবপত্রে ঠাসা সে ঘর। কালে কালে ফ্যাশান বদল হচ্ছে, নতুন জিনিস ঢুকছে বাড়িতে, পুরনোরা স্থান পাচ্ছে আমার সেই পরীস্থানে। কত কালের কত রকমের পুরোনো ঝাড়লণ্ঠন, রঙবেরঙের চিনে মাটির বাতিদান, ফুলদানি, কাচের ফানুষ, আরও কত কি। তারা যেন পুরাকালের পরী—তাকের উপর সারি সারি চুপচাপ, ধুলো গায়ে, ঝুলমাকড়শার জাল মুড়ি দিয়ে বসে আছে; কেউ বা মাথার উপরে কড়ি থেকে ঝুলছে শিকল ধরে। ঘরের মধ্যেটা আবছা অন্ধকার। কাচমোড় ঘুলঘুলি থেকে বাইরের একটু হলদে আলো এসে পড়েছে ঘরে। সেই আলোয় তাদের গায়ে থেকে থেকে চমক দিচ্ছে রামধনুর সাত রঙ। আঙুল দিয়ে একটু ছুঁলেই টুং টাং শব্দে ঘর ভরে যায়। মনে হয়, যেন সাতরঙা সাত পরীর পায়ে ঘুঙুর বাজছে। সেই রঙবেরঙের পরীর রাজত্বে ঢুকে এটা ছুঁই ওটা ছুঁই, একে দেখি তাকে দেখি, কাউকে বা হাতে তুলে ধরি, এমন সময়ে নন্দফরাশ তার তেলবাতি সেরে হাঁক দেয়, ‘বেরিয়ে এসো এবারে, আর নয়, কাল হবে।’ তালাচাবি পড়ে যায় সেদিন রাতটার মতো আমার পরীরাজত্বের ফটকে। সেই যেবার মুকুলের স্কুলে রবিকার ছবির এক্‌জিবিশন হয়, আমি দেখতে গছি ; অমিয় বললে, “আমায় গুরুদেবের ছবি বুঝিয়ে দিন।’ বললুম, দেখে বাপু, খুড়ো-ভাইপোর কথা কাগজে যদি বের না করো তবে এসো আমার সঙ্গে।’ তাকে নিয়ে ঘুরে ঘুরে ছবি দেখাতে লাগলুম। তা ওইখানেই একটি ছবি দেখি; ছোট্ট ছবিখানা, কলম দিয়ে আঁকা; একটি ছেলে, পিছনে অনেকগুলো লাইনের আঁচড়। ছেলেটি লাইনের জালে আর জঙ্গলে আটকে পড়ে থ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। বললুম অমিয়কে, ‘দেখো, এ কি আর সবাই বুঝতে পারে?’ পরীস্থানে ঢুকলে আমার অবস্থা হত ঠিক তেমনি। এখন যখন দেখি ছোট ছেলেরা এসে আমার পুতুলের ঘরে কাচমোড়া আলমারির সামনে ঘুরঘুর করে, মনে পড়ে আমিও একদিন প্রায় এদেরই বয়েসে আমার পরীরাজত্বের দুয়োরে এমনিভাবে দাঁড়িয়ে থাকতুম।—ও অভিজিৎ, রঙ-টঙ নিয়ে অত ঘাঁটাঘাঁটি কোরো না,—বিপদ আছে। এই রঙ-করা নিয়ে আমার ছেলেবেলায় কি কাণ্ড হয়েছে জানো না তো? আমাদের দোতলার বারান্দায় একটা জলভরতি বড় টবে থাকে কতকগুলো লাল মাছ, বাবামশায়ের বড় শখের সেগুলো। রোজ সেই টবে ভিস্তি দিয়ে পরিষ্কার জল ভরতি করা হয়। একদিন দুপুরে লাল মাছ দেখতে দেখতে হঠাৎ আমার খেয়াল হল, লাল মাছ, তার জল লাল হওয়া দরকার। যেমন মনে হওয়া কোত্থেকে খানিকটে মেজেণ্ট না কি রঙ জোগাড় করে এনে দিলুম সেই মাছের টবে গুলে। দেখতে দেখতে আমার মতলব সিদ্ধি। লাল জলে লাল মাছ কিলবিল করতে থাকল। দেখে অন্য খেলা খেলতে চলে গেলাম। বিকেলে শুনি। মালীর চিৎকার। জলে লাল রঙ গুললে কে? মাছ যে মরে ভেসে উঠেছে। বাবামশাই বললেন, ‘কার এই কাজ?’ সারদা পিসেমশায় বলে উঠলেন, ‘এ আর কারো কাজ নয়, ঠিক ওই বোম্বেটের কাজ।’ বোম্বেটে কথাটি চীনে গিয়ে সারদা পিসেমশায় শিখে এসেছিলেন। চীনের খেতাব সেইবারই প্রথম পেলুম; তার পর থেকে সবার কাছে ওই নামেই বিখ্যাত হলুম। রঙ গুলে আমি ওইরূপ খেতাব পেয়েছিলেম। অভিজিৎ, বুঝে-শুনে আমার রঙের বাক্সে হাত দিও। না হলে খেতাব পেয়ে যাবে। আঃ হাঃ, আবার আমার পুতুল গড়বার হাতুড়ি বাটালি নিয়ে টানাটানি কর কেন? স্থির হও, শোনো, আর একটা মজার কথা। ছেলেবেলায় তোমার বয়সে মিস্ত্রি হবার চেষ্টা করেছিলুম একবার। বাবামশায়ের পাখির খাঁচা তৈরি হচ্ছে। খাঁচা তো নয়, যেন মন্দির। বারান্দা জুড়ে সেই খাঁচা, ভিতরে নানারকম গাছ, পাখিদের ওড়বার যথেষ্ট জায়গা, জলখাবার সুন্দর ব্যবস্থা, সব আছে তাতে। চীনে মিস্ত্রিরা লেগে গেছে কাজে; নানারকম কারুকাজ হচ্ছে কাঠের গায়ে। সারাদিন কাজ করে তারা টুকটাক টুকটাক হাতুড়ি বাটালি চালিয়ে দুপুরে খানিকক্ষণের জন্যে টিফিন খেতে যায়; আবার এসে কাজে লাগে। আমি দেখি, শখ যায় অমনি করে বাটালি চালাতে। একদিন, মিস্ত্রিরা যেমন রোজ যায়, তেমনি খেতে গেছে বাইরে, এই ফাঁকে আমি বসে হাতুড়ি বাটালি নিয়ে যেই না মেরেছি কাঠের উপর এক ঠেলা, এই দেখো সেই দাগ, বাটালি একেবারে বাঁ হাতের বুড়ে আঙুলের মাঝ দিয়ে চলে গেল অনেকটা অবধি। তখনি আমি বুড়ো আঙুল চুষতে চুষতে দে ছুট সেখান থেকে। মিস্ত্রিরা এসে কাজ করতে যাবে দেখে, ফোঁটা ফোঁটা রক্ত সে জায়গায় ছড়ানো। কি ব্যাপার, কে কি কাটল? জানা কথা, বোম্বেটে ছাড়া এ আর কারোর কাজ নয়। বাবামশায় ডেকে বললেন, ‘দেখি তোর আঙুল।’ আমি তো ভয়ে জড়োসড়ো, না জানি আজ কি ঘটে যায় আমার কপালে। কতরকম দুষ্টবুদ্ধিই জগত তখন মাথায়। বাবামশায়ের আছে পোষা ক্যানারি, খাঁচাভরা। শখ গেল তাদের ছেড়ে দিয়ে দেখতে হবে কেমন করে ওড়ে। টুনিসাহেব, এক ফিরিঙ্গি ছোঁড়া, আসে প্রায়ই বাবামশায়ের কাছে শ্রীরামপুর থেকে। পাখির শখ ছিল তার। মাঝে মাঝে সুবিধেমতে দুয়েকটি দামী পাখিও সরায়। সেই সাহেব একদিন এসেছে; তাকে ধরে পড়লুম, ‘দাও না ক্যানারি পাখির খাঁচা খুলে। বেশ উড়বে পাখিগুলো। জাল আছে এখানে, আবার ওদের ধরা যাবে।’ অনেক বলাকওয়ার পর সাহেব তো দিলে খাঁচার দরজা খুলে। ফুর্‌ ফুর্‌ করে পাখিগুলো সব বেরিয়ে পড়ল—খাঁচা থেকে বাইরে, মহা আনন্দ। এবার তাদের ধরতে হবে, টুনিসাহেব জাল ফেলছে বারে বারে; কিছুতেই তারা ধরা দেয় না। শেষে সে তো জাল-টাল ফেলে দিয়ে চম্পট; ধরা পড়লুম আমি। এইরকম সব ইচ্ছে ছেলেবয়েসে হত। ইচ্ছে হল কাঠবেড়ালির চলা দেখব, খরগোশের লাফ দেখব, অমনি তাদের ঘরের দরজা খুলে নিতুম বাইরে বের করে। ইচ্ছে হত তো, করব কি, কি বল অভিজিৎ? ও কি ও, স্যাঙাত, সোয়েটার এঁটে এসেছ এরই মধ্যে? আমাদের ছেলেবেলায় কার্তিক মাসের আগে গরম কাপড়ের সিন্দুকই খুলত না ম্যালেরিয়া হলেও। সাদাসিধে ভাবেই মানুষ হয়েছি আমরা। তখন এত উলের ফ্রক, শার্টমাট, সোয়েটার, গেঞ্জি, মোজা পরিয়ে তুলোর হাঁসের মতো সাজিয়ে রাখবার চাল ছিল না। খুব শীত পড়লে একটা জামার উপরে আর একটা সাদা জামা, তার উপরে বড় জোর একটা বনাতের ফতুয়া, এই পর্যন্ত। চীনে বাড়ির জুতে কখনো ক্বচিৎ তৈরি হয়ে আসত—তা সে কোন্‌ আলমারির চালে পড়ে থাকত খবরই হত না, খেলাতেই মত্ত। রাত্রে ঘুমোবার আগে দাসীরা আমাদের খানিকটা দুধ খাইয়ে মশারির ভিতরে ঠেলে দিয়ে থাবড়ে থুবড়ে শুইয়ে চলে যেত। তাদেরও আবার নিজেদের একটা দল ছিল। রাত্তিরবেলা দাসীরা সব একসঙ্গে হয়ে, বারান্দায় একটা লম্বা দোলনা ছিল, তাতে বসে গল্পগুজব হাসিতামাসা করত। আন্দিবুড়ি আসত রাত্রে, সে যা চেহারা তার—কপালজোড়া সিঁদুর, লাল টকটক করছে, গোল এত্তো বড় মুখোশের মতো মুখ, যেন আহ্লাদী পুতুলকে কেউ কালি মাখিয়ে ছেড়ে দিয়েছে। দেখতে যদি তাকে রাত্তিরবেলা! সেই আন্দিবুড়ি দক্ষিণেশ্বর থেকে আসত মায়েদের শ্যামা-সংগীত শোনাতে, আর পয়সা নিতে। তার গলার স্বর ছিল চমৎকার। সে যখন চাঁদের আলোতে বারান্দার দোলনাতে চুল এলিয়ে বসে দাসীদের সঙ্গে গল্প করত, মশারির ভিতর থেকে ঝাপসা ঝাপসা দেখে মনে হত, যেন সব পেত্নী—গুজ্‌গুজ্ ফুস্‌ফুস্‌ করছে। তখন ওই একটা শব্দ ছিল দাসীদের কথাবার্তার—গুজ্‌গুজ্‌, ফুস্‌ফুস্‌। বেশ একটু স্পষ্ট স্পষ্ট কানে আসত। ঘুমই হত না। মাঝে মাঝে আমি কুঁই কুঁই করে উঠি, পদ্মদাসী ছুটে এসে মশারি তুলে মুখে একটা গুড় নারকেলের নাড়ু, তাদের নিজেদের খাবার জন্যেই করে রাখত, সেই একটি নাড়ু মুখে গুঁজে দেয়; বলে, ‘ঘুমো।’ নারকেল-নাড়ুটি চুষতে থাকি। পদ্মদাসী গুন গুন করে ছড়া কাটে আর পিঠ চাপড়ায়; এক সময়ে ঘুমিয়ে পড়ি। তার পরে এক ঘুমে রাত কাবার। তুমি তো অন্ধকার রাত্রে রাস্তায় ভূতের ভয় পাও; আমার পদ্মদাসী আর আন্দিবুড়িকে দেখলে তবে কি করতে জানিনে। দুজনের ঠিক এক চেহারা। আদিবুড়ি ছিল কালো রঙের আহ্লাদী পুতুল, আর আমার পদ্মদাসী ছিল যেন আগুনে ঝলসানো পদ্মফুল। ভালো লাগত আমার দুজনকেই। তাই তাদের কথা এখনও মনে পড়ে। সেই আমাকে মানুষ করা পদ্মদাসীর শেষ কি হল শোনো। একদিন সকালে দাঁড়িয়ে আছি তেতলার সিড়ির রেলিং ধরে; সিঁড়ি বেয়ে তখনও নামতে পারিনে দোতলায়। আমি দাঁড়িয়ে দেখছি তো দেখছিই। মস্ত বড় সিঁড়ির ধাপ ঘুরে ঘুরে নেমে গেছে অন্ধকার পাতালের দিকে। এমন সময়ে শুনি লেগেছে ঝুটােপুটি ঝগড়া পদ্মদাসীতে আর মা’র রসদাসীতে দোতলার সিঁড়ির চাতালে। এই হতে হতে দেখি রসদাসী আমার পদ্মদাসীর চুলের মুঠি ধরে দিলে দেয়ালে মাথাটা ঠুকে। ফটাস করে একটা শব্দ শুনলুম। তার পরেই দেখি পদ্মাসীর মাথা মুখ বেয়ে রক্ত গড়াচ্ছে। এই দেখেই আমার চিৎকার, ‘আমার দাসীকে মেরে ফেললে, মেরে ফেললে।’ পদ্মদাসী আমার কান্না শুনে মুখ তুলে তাকালে। আলুথালু চুল, রক্তমুখী চেহারা, চোখ দুটাে কড়ির মতে সাদা। তার পর কি হল মনে নেই। খানিক পরে পদ্মদাসী এল, মাথায় পটি বাঁধা। আমায় কোলে নিয়ে দুধ খাইয়ে দিয়ে চলে গেল। সেই যে আমার কাছ থেকে গেল আর এল না। শুনলুম দেশে গেছে। তখন গরমি কালটা অনেকেই গঙ্গার ধারে বাগানবাড়িতে গিয়ে কাটাতেন। কোন্নগরের বাগানে বাবামশায় যাবেন, ঠিক হল। মা পিসিমা সবাই যাবেন; সঙ্গে যাব আমি আর সমরদা। দাদা থাকবেন বাড়িতে; বড় হয়েছেন, স্কুলে যান রোজ, বাগানে গেলে পড়াশুনোর ক্ষতি হবে। আমার আনন্দ দেখে কে। কাল সকালবেলায় যাব, কিন্তু রাত পোহায় না। ঘুমোব কি! সারারাত ধরে ভাবছি, কখন ভোর হয়। বাবামশায় ওঠেন রোজ ভোর চারটের সময়ে। উঠে হাতমুখ ধুয়ে সিঁড়ির উপরে ঘড়ির ঘরে বসে কালীসিংহের মহাভারত পড়েন, সঙ্গে থাকেন ঈশ্বরবাবু। ওই একটি সময়ে আমরা বাবামশায়ের কাছে যেতে পেতুম। চাকররা আমাদের ভোর না হতে তুলে হাতমুখ ধুইয়ে নিয়ে আসত বাবামশায়ের কাছে। তিনি পড়তেন, আমাদের শুনতে হত। এই গল্প শোনা দিয়ে শিক্ষা শুরু করেছি তখন। কোনো-কোনোদিন ভালো লাগে গল্প শুনতে, কোনোদিন ঘুমে চোখ জড়িয়ে আসে। মাঝে মাঝে বাবামশায় খানিকটা পড়ে সমরদাকে পড়তে দেন। বলেন, ‘নাও, এবার তুমি পড়ো।’ সমরদা সেই মস্ত মোটা মহাভারতের বই হাতে নিয়ে বেশ গড় গড় করে পড়ে যান। আমাকে কিন্তু বাবামশায় কোনোদিন বলতেন না পড়তে। বললে কি মুশকিলেই পড়তুম তখন বলো তো! এখন কোন্নগরে তো যাওয়া হবে—কত দেরি করেছিল সেদিন সকালটা আসতে। যেমন রামলাল ডাকা ‘ওঠো’, অমনি তড়িঘড়ি বিছানা থেকে লাফিয়ে পড়ে তাড়াতাড়ি হাতমুখ ধুয়ে ইজের কামিজ বদলে তৈরি হয়ে নিলুম। লোকজন আগেই চলে গেছে বাগানে। এবার আমরা যাব। সাদা জুড়িঘোড়া জোতা মস্ত ফিটন দাঁড়াল দেউড়িতে ভোর পাঁচটায়। আমরা উঠলুম তাতে। বাবামশায় বসলেন পিছনের সিটে, আমাদের বসিয়ে দিলেন সামনেরটায়। দুপাশে বসলেন আরও দুজন, পাছে আমরা পড়ে যাই। সেকালের গাড়িগুলির দু-পাশ থাকত খোলা—একটুতেই পড়ে যাবার সম্ভাবনা। মা পিসিমা আগেই রওনা হয়েছেন বন্ধ আপিসগাড়িতে। আমাদের ফিটনের পিছনে দুই দুই সহিস হাঁকছে পঁইস, পঁইস; ঘোড়া পা ফেলছে টগ্‌বগ্‌ টগ্‌বগ্‌। গাড়ি চলতে লাগল জোড়াসাঁকোর গলির মোড়ে শিবমন্দির পেরিয়ে। বড় রাস্তার তেলের আলোগুলি তখনও জ্বলছে, চারদিক আবছা অন্ধকার। ঘুমন্ত শহরের মধ্যে দিয়ে গঙ্গার উপরে হাওড়ার পুলের মুখে এলুম। দূর থেকে দেখি পুলের উপরে উঁচু দুটো প্রকাণ্ড লোহার চাকা, তার আদ্ধেক দেখা যাচ্ছে। হাওড়ার পুল দেখি সেই প্রথম, আমি তো ভয়ে মরি। ওই চাকা দুটোর উপর দিয়েই গাড়ি যাবে নাকি? যদি গাড়ি পড়ে যায় গড়িয়ে গঙ্গায়? যতই গাড়ি এগোয় ততই ভয়ে দু-হাতে গাড়ির গদি শক্ত করে ধরে আঁটসাঁট হয়ে বসি, শেষে দেখি গাড়ি ওই চাকা দুটোর মাঝখান দিয়ে চলে গেল। চাকা দুটোর মাঝখানে যে অমনি সোজা রাস্ত আছে গাড়ি যাবার, তা ভাবতেই পারিনি আমি তখন। হাওড়ার পুলের অপর মুখে টোলঘর পেরিয়ে এগিয়ে যেতে লাগলুম, বড় বড় গাছের নিচে দিয়ে, গাঁয়ের ভিতর দিয়ে—গাঁগুলি তখনো জাগেনি ভালো করে, মাকড়শার জালের মতো ধোঁয়ার মধ্যে দিয়ে অস্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। তার মাঝ দিয়ে চলেছি আমরা। কখনও বা থেকে থেকে দেখা যায় গঙ্গার একটুখানি; ভাবি, এই বুঝি এসে গেলুম বাগানে। আবার বাঁক ঘুরতেই গঙ্গা ঢাকা পড়ে গাছের ঝোপে। শালকের কাছাকাছি এসে কি সুন্দর পোড়া মাটির গন্ধ পেলুম। এখনও মনে পড়ে কি ভালো লেগেছিল সেই সোঁদা গন্ধ। সেদিন গেলুম ওই রাস্তা দিয়েই বালিতে; কিন্তু সেই চমৎকার পল্লীগ্রামের সৌগন্ধ্য পেলুম না। সেই শালকে চিনতেই পারলুম না। শহর যেন পাড়াগাঁকে চেপে মেরেছে। আশেপাশে গলিঘুঁজি, নর্দমা। মাঝরাস্তায় ঘোড়া বদল করে আবার অনেকক্ষণ ধরে চলতে চলতে পৌঁছলুম সবাই কোন্নগরের বাগানে। তখন মোটরগাড়ি ছিল না যে এক ঘণ্টায় পৌছে দেবে শহর থেকে বাগানে। সে ভালো ছিল, ধীরে ধীরে কত কি দেখতে দেখতে যেতুম। গাঁয়ের মেয়েরা পুকুরঘাটে গা ধুতে নেমেছে, পাঠশালায় চলেছে ছেলেরা সরু সরু লাল রাস্তা বেয়ে, মাঝে মাঝে এক-একখানা হাটুরে গাড়ি চলে যাচ্ছে আমাদের গাড়ি বাঁচিয়ে শহরের দিকে। কোনো এক বুড়োমানুষ ঘরের দাওয়ায় উবু হয়ে হুঁকো টানছে। মুদির দোকানে মুদি ঝাঁপ তুলছে। বাঁশঝাড়ে সকালের আলো ঝিলমিল করছে; একটি দুটি দাঁড়কাক ডাকছে সেখানে। রথতলার রথটা খাড়া রয়েছে। এমনি কত কি সুন্দর সুন্দর দৃশ্য! হঠাৎ দেখা দিল ধানখেতের প্রকাণ্ড সবুজ, তার পরই কোতরঙের ইঁটখোলা—সেখানে পাহাড়ের মতো ইঁটের পাজায় আগুন ধরিয়েছে, তা থেকে ধোঁয়া উঠছে আস্তে আস্তে আকাশে। তার পরই কোন্নগরের বাগান আমাদের। দু-থাক ঢালুর উপরে সাদা ছোট্ট বাড়িখানি। উত্তর দিকে মস্ত ছাতার মতো নিচু একটি কাঁঠালগাছ। বাগানবাড়ির সামনে দাড়িয়ে বুড়ো চাটুজ্জেমশাই—সাদা লম্বা পাকা দাড়ি, মাথায় ঝুঁটি বাঁধা, হাতে একটি গেটেবাঁশের লাঠি, ধবধবে গায়ের রঙ, যেন মুনিঋষি। আমাদের কোলে করে গাড়ি থেকে নামিয়ে নিলেন। গঙ্গার পশ্চিম পারে আমাদের কোন্নগরের বাগান, ওপারে পেনিটির বাগান, জ্যোতিকাকা মশায় সেখানে আছেন। কোনোদিন এপার থেকে বাবামশায়ের পানসি যায়, কোনোদিন বা ওপার থেকে জ্যোতিকাকামশায়ের পানসি আসে; এমনি যাওয়া আসা। বন্দুকের আওয়াজ করে সিগ্‌নেলে কথা বলতেন তাঁরা। একবার আমায় দাড় করিয়ে আমার কাঁধের উপর বন্দুক রেখে বাবামশায় বন্দুক ছোঁড়েন, পেনিটির বাগান থেকে ওপারে। জ্যোতিকাকামশায় বন্দুকের আওয়াজে তার সাড়া দেন। কানের কাছে বন্দুকের গুড়ুম গুড়ুম আওয়াজ—গুলি চলে যায় কানের পাশ দিয়ে, চোখ বুজে শক্ত হয়ে দাড়িয়ে থাকি। বাবামশায়ের ভয়ে টুঁ শব্দটি করিনে। আসলে আমায় সাহসী করে তোলাই ছিল তাঁর উদ্দেশ্য; কিন্তু তা হতে পেল না। বাবামশায়ের সাঁতারেও খুব আনন্দ। সাঁতরে তিনি গঙ্গা পার হতেন। আমাকেও সাঁতার শেখাবেন; চাকরদের হুকুম দিলেন, তারা আমার কোমরে গামছা বেঁধে জলে ছুঁড়ে ছুঁড়ে দেয়। সাঁতার দেব কি, ভয়েই অস্থির। কোনো রকম করে আঁচড়ে পাঁচড়ে পারে উঠে পড়ি। একটি ভারি সুন্দর ছোট্ট টাটুঘোড়ার গাড়ি। সেটি ছিল ছোটলাট সাহেবের মেমের; নিলামে কিনেছিলেন বাবামশায়। সে কি আমাদের জন্যে? মোটেও তা নয়। কিনেছিলেন মেয়েদের জন্যে; সুনয়নী বিনয়িনী গাড়িতে চড়ে বেড়াবে। কোন্নগরে সেই গাড়িও যেত আমাদের জন্যে। ছোট্ট টাটুঘোড়ার গাড়িতে চড়ে আমরা রোজ সকালে বেড়াতে যাই। বাগানের বাইরেই কুমোরবাড়ি—চাকা ঘুরছে, সঙ্গে সঙ্গে খুরি গেলাস তৈরি হচ্ছে। ভারি মজা লাগত দেখতে; ইচ্ছে হত, ওদের মতো চাকা ঘুরিয়ে অমনি খুরি গেলাস তৈরি করি। মাঝে মাঝে বড় জুড়িঘোড়া হাঁকিয়ে আসেন উত্তরপাড়ার রাজা। আমার টাটুঘোড়া ভয়ে চোখ বুজে রাস্তার পাশে এসে দাঁড়ায়। জুড়িগাড়ির ভিতরে বসে বৃদ্ধ ডেকে জিজ্ঞেস করেন, ‘কার গাড়ি যায়? কার ছেলে এরা?’ চোখে ভালো দেখতে পেতেন না। সঙ্গে যারা থাকে তারা বলে দেয় পরিচয়। শুনে তিনি বলেন, ‘ও, আচ্ছা আচ্ছা, বেশ, এসেছ তা হলে এখানে। বোলো একদিন যাব আমি।’ তাঁর জুড়িঘোড়া টগবগ করতে করতে তীরের মতো পাশ কাটিয়ে চলে যায়—আমার ছোট্ট টাটুঘোড়া তার দাপটের পাশে খাটো হয়ে পড়ে। দেখে রাস্তার লোক হাসে। যেমন ছোট্ট বাবু তেমনি ছোট্ট গাড়ি, ছোট্ট ঘোড়াটি—সহিসটি খালি বড় ছিল, আর সঙ্গের রামলাল চাকরটি। কোন্নগরে কী আনন্দেই কাটাতুম। সেখানে কুলগাছ থেকে রেশমি গুটি জোগাড় করে বেড়াতুম দুপুরবেলা। প্রজাপতির পায়ে সুতো বেঁধে ওড়াতুম ঘুড়ির মতো। সন্ধ্যেবেলা বাবামশায়, মা, সবাই ঢালুর উপরে একটি চাতাল ছিল, তাতে বসতেন। আমরা বাগানবাড়ির বারান্দার সিঁড়ির ধাপে বসে থাকতুম গঙ্গার দিকে চেয়ে—সামনেই গঙ্গা। ঠিক ওপারটিতে একটি বাঁধানো ঘাট; তিনটি লাল রঙের দরজা-দেওয়া একতলা একটি পাকা ঘর। চোখের উপর স্পষ্ট ছবি ভাসছে; এখনও ঠিক তেমনিটিই এঁকে দেখাতে পারি। চেয়ে থাকি সেই ঘাটের দিকে। লোকেরা চান করতে আসে; কখনও বা একটি দুটি মেয়ের মুখ দরজা খুলে উঁকি মারে, আবার মুখ সরিয়ে দরজা বন্ধ করে দেয়। আর দেখি তর্‌তর্‌ করে গঙ্গা বয়ে চলেছে। নৌকো চলেছে পর পর—কোনোটা পাল তুলে, কোনোটা ধীরে, কোনোটা বা জোরে হু-হু করে। যেদিন গঙ্গার উপরে মেঘ করত দেখতে দেখতে আধখানা গঙ্গা কালো হয়ে যেত, আধখানা গঙ্গা সাদা ধবধব করত; সে কি যে শোভা! জেলেডিঙিগুলো সব তাড়াতাড়ি ঘাটে এসে লাগত ঝড় ওঠবার লক্ষণ দেখে। গঙ্গা হয়ে যেত খালি। যেন একখানা কালো সাদা কাপড় বিছানো রয়েছে। এই গঙ্গার দৃশ্য বড় চমৎকার লাগত। গঙ্গার আর এক দৃশ্য, সে স্নানযাত্রার দিনে। দলের পর দল নৌকো বজরা, তাতে কত লোক গান গাইতে গাইতে, হল্লা করতে করতে চলেছে। ভিতরে ঝাড়লণ্ঠন জ্বলছে; তার আলো পড়েছে রাতের কালো জলে। রাত জেগে খড়খড়ি টেনে দেখতুম, ঠিক যেন একখানি চলন্ত ছবি। এমনি করে চলত আমার চোখের দেখা সারাদিন ধরে। রাত্রে যখন বিছানায় যেতুম তখনও চলত আমার কল্পনা। নানারকম কল্পনায় ডুবে থাকত মন; স্পষ্ট যেন দেখতে পেতুম সব চোখের সামনে। খড়খড়ির সামনে ছিল কঁঠালগাছ। জ্যোৎস্না রাত্তির, চাদের আলোয় কাঁঠালতলায় ছায়া পড়েছে ঘন অন্ধকার। দিনের বেলায় চাটুজ্যে মশায় বলেছিলেন, আজ রাত্তিরে কাঁঠালতলায় কাঠবেড়ালির বিয়ে হবে। রাত জেগে দেখছি চেয়ে, কাঁঠালতলায় যেন সত্যি কাঠবেড়ালির বিয়ে হচ্ছে, খুদে খুদে আলোর মশাল জ্বালিয়ে এল তাদের বরযাত্রী বরকে নিয়ে, মহা হৈ-চৈ, বাদ্যভাণ্ড, দৌড়োদৌড়ি, হুলুস্থুলু ব্যাপার। সব দেখছি কল্পনায়। কাঁঠালতলায় যে জোনাকি পোকা জ্বলছে তা তখন জ্ঞান নেই। সেই সেবার কোন্নগরে আমি কুঁড়েঘর আঁকতে শিখি। তখন একটু আধটু পেনসিল নিয়ে নাড়াচাড়া করি, এটা ওটা দাগি। বাগান থেকে দেখা যেত কয়েকটি কুঁড়েঘর। কুঁড়েঘরের চালটা যে গোল হয়ে নেমে এসেছে, তা তখনই লক্ষ্য করি। এর আগে আঁকতুম কুঁড়েঘর—বিলিতি ড্রইং-বইএ যেমন কুঁড়েঘর আঁকে। দাদাদের কাছে শিখেছিলুম এক সময়ে। বাংলাদেশের কুঁড়েঘর কেমন তা সেইবারই জানলুম, আর এ পর্যন্ত ভুল হল না। কোন্নগরে কতরকম লোক আসত। এক নাপিত ছিল, সে পোষা কাঠবেড়ালির ছানা এনে দিত; খালি বাবুইয়ের বাসা জোগাড় করে এনে দিত। কোনোদিন বহুরূপী এসে নাচ দেখাত। কত মজা। কিছু কিছু পড়াশুনোও করতে হত, শুধু খেলা নয়। গোকুলবাবু পড়া নিতেন আমাদের, বাংলার ইতিহাস মুখস্থ করাতেন। টেবিলের উপরে একটি কাচের গেলাসে আফিমের বড়ি ভিজছে, জলটা লাল হয়ে উঠেছে; ওদিকে মা, ওঁরা বারান্দার বাইরে ছোট চালাঘরে রান্না করছেন। বাবামশায়রা কাঁঠালতলায় গল্পগুজব করছেন, চৌকি পেতে বসে। আমরা মুখস্থ করছি বাংলার ইতিহাসে সিরাজদৌল্লার আমল। একদিন রীতিমত প্রশ্ন লিখে বাবামশায়ের সামনে আমাদের পরীক্ষা দিতে হল; সেই পরীক্ষায় জানো আমি ফার্স্ট প্রাইজ পেয়ে গিয়েছিলুম সমরদাকে টেক্কা দিয়ে, চালাকি নয়। পেয়েছিলুম মস্ত একটা বিলিতি অর্গ্যান বাজনা, এখনও তা আছে আমার কাছে। গানও শিখেছিলুম তখন একটি ওই বুড়ো চাটুজ্যেমশায়ের কাছে। হায় রে সাহেব বেলাকর আমি গাই দেব তুই বাছুর ধর্‌। ওটি শিষ্ট বাছুর, গুঁতোয় নাকো কান দুটো ওর মুচড়ে ধর্‌। হায় রে সাহেব বেলাকর॥ এই আমার প্রথম গান শেখা। ব্লাকইয়র সাহেব রোজ ঘোড়ায় চড়ে বেড়িয়ে ফেরবার সময় গয়লাবাড়ি গিয়ে গয়লানীর কাছে এক পো করে দুধ খেতেন পাড়ার লোকে এই দেখে তার নামে গান বেঁধেছিল।
অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর
০৫. জোড়াসাঁকোর দুটো স্বতন্ত্র বাড়ি অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর জোড়াসাঁকোর দুটো স্বতন্ত্র বাড়িই তো এখন দেখছ? আসল জোড়াসাঁকোর বাড়িই এবার বুঝে দেখো। সে ছেলেবেলার জোড়াসাঁকোর বাড়ি তো আর নেই। দুটো বাড়ির একটা তো লোপাট হয়ে গেছে, একটা আছে পড়ে। আগে ছিল দু-বাড়ি মিলিয়ে এক বাড়ি, এক বাগান, এক পুকুর, এক পাঁচিলে ঘেরা, এক ফটক প্রবেশের, এক ফটক বাইরে যাবার। যেমন এই উত্তরায়ণ, এক ফটক—ভিতরে উদয়ন, কোণার্ক, শ্যামলী, পুনশ্চ, উদীচী, সব মিলিয়ে এক বাড়ি, জোড়াসাঁকোর বাড়িও ছিল তেমনি। এক কর্তা দ্বারকানাথ, তার পর দেবেন্দ্রনাথ, তার পর রবীন্দ্রনাথ— এই তিন কর্তা পর পর। অনেকগুলো ঘর, অনেকগুলো মহল, অনেকখানি বাগান জুড়ে দুই বাড়ি মিলিয়ে এক বাড়ি ছিল ছেলেবেলার জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়ি। এ-বাড়ি ও-বাড়ি বলতুম মুখে, কিন্তু ছেলেবুড়ো চাকরবাকর সবাই জানতুম মনে দুখান বাড়ি এক বাড়ি। কারণ, এক কর্তা ছিল; একই নম্বর ছিল, ৬ নং দ্বারকানাথ ঠাকুরের গলি। একই ফটক ছিল প্রস্থান-প্রবেশের। সেই একই তাল ভাঙা লোহার খোলা ফটক; তার একধারে একটি বুড়ো নিমগাছ, তার কোটরে কোটরে পাপদুয়া, টুনটুনি পাখিদের বাসা; আর একধারে একটি মাত্র গোলকচাঁপার গাছ, আগায় ফুল, গোড়ায় ফুল ফুটিয়ে। এই ফটককে শ্যাম মিস্ত্রি মাঘোৎসবের দিনে লোহার কিরীট পরাত; তাতে আলোর শিখায় জ্বলত ‘একমেবাদ্বিতীয়ম্’। জোড়াসাঁকো নাম ছিল বাড়ির, দুটাে বাড়িও ছিল বটে, কিন্তু ওই দুই সাঁকোর তলা দিয়ে যে এক নদীর স্রোত বইত; সেদিন আর নেই, সে বাড়িও আর নেই। এক ঘণ্টা পড়ত ও-বাড়িতে সকাল ছটায়; এ-বাড়িতে উঠতুম সেই শব্দ শুনে চাকর-দাসী, ছেলে-মেয়ে, মনিব, সবাই। সাতটার ঘণ্টা পড়ত, তখন যে যার কাজে লাগতুম। এমনি নটা দশটা সাড়ে দশটা বাজল, কাছারি খুলল, আমরা খেয়েদেয়ে স্কুলে গেলুম। তারপর আবার ঘণ্টা পড়ত বেলা তিনটেয়। স্কুলের গাড়ি ফিরত, বৈকালিক জলযোগের ব্যবস্থা হত, হাওয়া খেতে যাবার জন্যে গাড়ি জোড়া হত, আমরা খেলা জুড়তুম বাগানে ছুটােছুটি। এমনি চলত নটা পর্যন্ত। ঐ এক ঘন্টার শব্দ দুটাে বাড়ির সব লোককে যেন চালাচ্ছে। রাত নটায় ঘন্টা বাজত নিদ্রার সময় এল এই কথা জানিয়ে। এই ছিল তখন। তুমি কি ভাবছ সামান্ত বাড়ি ছিল? হারিয়ে যাবার ভয় হত এঘর ও-ঘর ঘুরে আসতে। তখনকার দিনে মহল ভাগ করে বাস করার প্রথা ছিল। মোটামুটি বড় ভাগ ছিল অন্দরমহল আর বারমহল; তার ভিতরে আবার ছোট ছোট ভাগ—রান্নাবাড়ি, গোলাবাড়ি, পুজোবাড়ি, গোয়ালবাড়ি, আস্তাবলবাড়ি, এমনি কত বাড়ি। তার মধ্যে আবার কত ঘর ভাগ—ভিস্তিখানা, তোশাখানা, বাবুর্চিখানা, নহবতখানা, দপ্তরখানা, কাছারিখানা, গাড়িখানা, স্কুলঘর, নাচঘর, দূরদালান, দেউড়ি; যেন অনেক খানাখন্দ নিয়ে একটা তল্লাট জুড়ে একখানা ব্যাপার। তেতলায় অন্দর-মহল, দোতলায় বারান্দা। একতলার দক্ষিণ-পশ্চিম দিকে দপ্তরখানা, দক্ষিণ-পুব দিকে ছোট পিসেমশায়ের আপিসঘর। তিনি লম্বা একটা খাতায় ডায়েরি লিখেই যাচ্ছেন—পাশে গিয়ে দাঁড়াই, একবার তাকিয়ে আবার লেখায় মন দেন। বলেন, ‘কি, এসেছিস ? আচ্ছা।’ বলে একমুঠো পাতলা পাতলা লজেঞ্জুসের মতো ওয়েফার হাতে দিয়ে বিদেয় করেন, বলেন, ‘দেখিস খাসনে যেন।’ মাঝখানে যে বড় হলঘরটা সেটা তোশাখানা। তোশাখানা চাকরদের আড্ডাঘর। বাবামশায়ের গোবিন্দ চাকর তোশাখানার সর্দার। অন্য চাকররা তাকে ভয় করে চলে। দাদার গদাধর চাকর—এমন বজ্জাত সে, তাকে যা ভয় করি সবাই! দারুণ প্রহার করে আমাদের। চেহারাও তেমনি, নৰ্ম্যাল স্কুলের লক্ষ্মীনারায়ণ পণ্ডিতের মত ভীষণ। বাড়ির পুরানো চাকর। একবার দেশে গেল আর ফিরে এল না। কি হল গদার, সে আসছে না কেন? গদা বলেই ডাকত সবাই তাকে। শোনা গেল মারা গেছে সে; বুড়ো হয়েছিল, মাঠেই মরে পড়ে ছিল, শেয়াল তাকে খেয়ে সাফ করে ফেলেছে। শিশুমন, তার দৌরাত্মিতেই অস্থির ছিল সারাক্ষণ, মনে মনে ভাবলুম, বেশ হয়েছে, যেমন আমাদের মারত, আপদ গেছে। সমরদার চাকর দুর্গাদাস; আমার রামলাল, ভালোমানুষ সে। পদ্মদাসী চলে যেতে রামলাল বহাল হয় আমার কাজে। রমানাথ ঠাকুরের খাস চাকর ছিল আগে। তিনি চাকর রাখতেন নরম হাত দেখে। গায়ে তেল মাখাতেন বোধ হয়; কড়া হাত গায়ে লাগলেই ধমকে উঠতেন, ‘যাঃ যাঃ, এ যেন গায়ে খড়রা মাজছে।’ রামলালের হাত ছিল নরম। কি কারণে তাকে ছেড়ে দিয়েছিলেন জানিনে; বোধ হয় দেশে গিয়ে ফিরতে দেরি করেছিল। যা হোক আমি তো পড়লুম তার চার্জে। সব ছেলেদের একটি করে চাকর থাকে। তারাই যেন মাস্টার। আদবকায়দা শেখায়, চোখে চোখে রাখে। কারণ, ছেলেরা কিছু করলে দোষ চাকরদেরই। চাকরদের কাছেই জিম্মে থাকে ছেলেদের এক-একজনের এক-একটি আলমারি, তাতে যার যার কাপড়জামা, থালাবাসন, ব্যবহারের যাবতীয় বস্তু। চাবিও থাকে চাকরদের কাছেই। দরকারমত বের করে দেয়, আবার ধুয়ে মুছে সাফ করে তুলে রাখে। দুধ খাবার বাটিও থাকে বাড়ির ভিতরে দাসীর কাছে। তোশাখানা শুধু চাকরদের থাকবার জন্যে, বেয়ারারা থাকে অন্যদিকে। ঘরের উত্তরে দক্ষিণে দু-দিকে দু-সারি আলমারি কাপড়ে বাসনে বোঝাই। পুবে পশ্চিমে কয়েকখানা বড় বড় তক্তা পাতা, তক্তার মাঝখানে একটি করে বাক্স বসানো। ডালা খুলে দেখি, তাদের খেলার দাবার ছক, তাস, আয়না, চিরুনি, এই সব নানা জিনিসপত্রে ভরা। সেই তক্তার উপরেই মাদুর বালিশ বিছিয়ে তারা ঘুমোয়। আবার কোনো কোনো দিন দেখি, বাবামশায়দের বৈঠক ভাঙলে তারা ফিটফাট বাবু সেজে রুপোর ট্রেতে করে সোডা লেমনেড খায়, রুপোর পেয়ালায় চা পান করে। বাবুদের আড্ডা ভাঙলে তাদের আড্ডা শুরু হয়। সে-বয়সে চাকরদের তোশাখানায় যখন-তখনই যেতে পারি, সেখানে যাবার আমার ফ্রী লাইসেন্স, কেউ বারণ করে না। রামলাল বলে, ‘এসেছ? আচ্ছা, থাকো এখানেই।’ তাদেরই তেলচিটচিটে বালিশ মাথায় দিয়ে শুয়ে পড়ি। পাশে রামলাল বসে বাবামশায়ের ধুতি পাট করে দেয় দেখি, দেখতে দেখতে ধুতি চুনোট করে যখন ছেড়ে দেয় ফুলের মত ছড়িয়ে পড়ে। তোশাখানার পাশে উত্তর দিকটায় ভিস্তিখানা। চানের ঘরে যেতে হয় । ভিস্তিখানার ভিতর দিয়ে, বড় হয়েছি, সাতে পড়েছি; এখন তো আর বারান্দায় বসে হাতমুখ ধুলে চলবে না। চাকর তরিবত শেখাচ্ছে। সকালে উঠে চানের ঘরে গিয়ে হাতমুখ ধোয়া অভ্যেস করতে হচ্ছে। একটিই চানের ঘর নিচে। দাদারা ঢুকছেন এক এক করে। তাদের শেষ না হলে তো আর আমি ঢুকতে পারিনে। অপেক্ষা করছি ভিস্তিখানায়। খুব ভোরেই উঠতে হয় আমাদের। বসে বসে দেখছি। বিশ্বেশ্বর হুঁকোবরদার, কোন্‌ রাত থাকতে ওঠে সে। বাবামশায়ের বুদ্ধু বেয়ারা আর বিশ্বেশ্বর এই দুজনে ওঠে সকলের আগে। বাবামশায়ের ছিল খুব ভোরে ওঠা অভ্যেস। বলেছি তো তিনি কত ভোরে উঠে হাতমুখ ধুয়ে রামায়ণ পড়তে বসতেন। বুদ্ধু উঠে বাবামশায়ের ঘর খুলে দিত, বিশ্বেশ্বর ফরসি সাজিয়ে নিয়ে উপস্থিত করত। তা সেই ভিস্তিখানায় বসে দেখছি, একপাশে দ্বারকানাথ ঠাকুরের আমলের পুরোনো একটা টেবিল, খানকয়েক ভাঙা চেয়ার। টেবিলের উপরে বিসুবিয়াসের একটা ছবি, দাউদাউ করে আগুন উঠছে মুখ দিয়ে। তামাক সাজবার ঘর, আগুনের ছবি থাকবে সেখানে। পুরোনো কালের ভালো অয়েলপেন্টিং। অত ভালো অয়েলপেন্টিং ও-রকম করে ফেলে রেখেছিল, তখন অতটা মূল্য বুঝিনি। তা বিশ্বেশ্বর তো সেই টেবিলের উপরে ধুয়ে মুছে পরিষ্কার করে সারি সারি ফরসি সাজিয়ে। দিনরাত সে ওই ভিস্তিখানাতেই থাকে, সময় মত তামাক বদলে বদলে দেয়। তার কাজই তাই । এই বিশ্বেশ্বরই আমাদের তামাক খেতে শিখিয়েছে; বড় হয়েছি—বিশ্বেশ্বর গিয়ে মার কাছ থেকে অনুমতি নিয়ে এল। বললে, ‘বাবুরা বড় হয়েছেন তামাক না খেলে চলবে কেন?’ মা বললেন, ‘তা ওরা খেতে চায় তো খাওয়া?’ বাড়ির বাবুরা তামাক না খেলে তারও যে চাকরি থাকে না। নানারকম করে সেজে আমাদের তামাক অভ্যেস ধরিয়েছে, প্রথম দিন তো একবার নল টেনেই কেশে মরি। সে আবার শেখায় এ-রকম করে আস্তে আস্তে টানুন। অমন ভড়াক করে টানলে তো কাশি উঠবেই। তা ওই ভিস্তিখানাও ছিল একটা দস্তুরমত আড্ডার জায়গা। মণিখুড়ো, নিরুদাদা, ঈশ্বরবাবু, বাড়ির বড় ছেলেরা যারা তামাক খাওয়া সবে শিখছেন সকলেই ঘুরে ফিরে আসতেন সেখানে। ঈশ্বরবাবু প্রতিদিন সকালে বাবামশায়ের কাছে বসে রামায়ণ পড়া শোনেন। রামায়ণ শেষ হয়ে গেলে বুড়ো একটি লাঠি হাতে নিয়ে ঠকাস ঠকাস করে সিঁড়ি দিয়ে নেমে আসেন নিচে ভিস্তিখানায়। এসেই একটা ভাঙা চৌকিতে বসে বলেন, ‘বিশ্বেশ্বর।’ বিশ্বেশ্বরের তৈরিই থাকে সব। ‘এই যে বাবু’ বলে হুঁকোটি হাত বাড়িয়ে ধরলে। ঈশ্বরবাবু তা হাতে নিয়ে ফক্ ফক্‌ করে কয়েকবার ধুঁয়ো ছেড়ে হুঁকোটি ফিরিয়ে দিয়ে পকেট থেকে রুমাল বের করে তা থেকে একটি পয়সা বিশ্বেশ্বরের হাতে দিয়ে বলেন, ‘এই নাও।’ বিশ্বেশ্বর সেটি পকেটে রাখে। ঈশ্বরবাবু খোঁড়াতে খোঁড়াতে চলে যান বাজারে। সন্ধ্যেবেলা যখন উপরে উঠে আসেন ভিস্তিখানা হয়ে, বিশ্বেশ্বর তখন আবার সেই একটি পয়সা ফেরত দেয় তাঁকে, তিনি তা রুমালে বেঁধে রাখেন। রোজই দেখি, এক পয়সার লেন-দেন চলে ঈশ্বরেতে, বিশ্বেশ্বরেতে, এর মানে কি কে জানে তখন! সকালে ঈশ্বরবাবু চলে গেলে আসেন মণিখুড়ো। ‘কই বাবা বিশ্বেশ্বর, আছে কিছু?’ ‘আজ্ঞে হ্যাঁ হ্যাঁ, নিন না, এখনও আছে এতে।’ বলে ঈশ্বরবাবুর সেই হুঁকোটি তার হাতে তুলে দেয়। তিনি আবার ফক্ ফক্‌ করে খানিক ধুঁয়ো ছাড়েন। এই মণিখুড়ো আর বিশ্বেশ্বরে একবার কেমন লেগেছিল শোনো। এখন, সামনে পুজো এসে গেছে, আর বেশি দেরি নেই। মণিখুড়ো বাবামশায়ের কাছে পার্বনী চেয়ে নিয়ে শখ করে বাজার থেকে একজোড়া কালো কুচকুচে বার্নিশকরা জুতো কিনে এনেছেন, পায়ে দিয়ে পুজো দেখতে যাবেন। কাগজে-মোড়া জুতোজোড়া এনে ভিস্তিখানার এক কোণায় গুঁজে রেখে দিলেন—কি জানি চাকরবাকর কেউ যদি সরিয়ে ফেলে, এই ভয়। বিশ্বেশ্বর ঘরেই ছিল, দেখলে ব্যাপারটা—বাবু কি যেন এনে রাখলেন কোণে। মণিখুড়ো তো জুতো রেখে তামাক খেয়ে চলে গেলেন অন্য কাজে। বিশ্বেশ্বর এই ফাঁকে জুতোজোড়া বের করে নিয়ে সেই ঘরেই আর এক কোণে লুকিয়ে রেখে দিলে। এদিকে মণিখুড়ো ফিরে এসে জুতো আর পান না। ঘরের এদিক ওদিক খুঁজে সারা, কোথাও জুতো নেই। বিশ্বেশ্বরকে জিজ্ঞেস করেন, সে বলে, ‘কি জানি বাবু, আমি দেখিনি ওসব। আমি থাকি আমার কাজে ব্যস্ত। তবে কি জানেন, যে আগুন খেয়েছে তাকেই কয়লা ওগরাতে হবে। জুতো যাবে কোথায়?’ মণিখুড়ো বলেন, ‘সে তো বুঝলুম। কিন্তু কে নিলে জুতোজোড়া? শখ করে আনলুম পুজো দেখব বলে।’ বিশ্বেশ্বর সেসব কথায় কানই দেয় না। মণিখুড়ো তাকে তাকে আছেন। পরদিন সকালবেলা বিশ্বেশ্বর রোজকার মতো বাবামশায়ের জন্য তামাক সাজছে; মণিখুড়ো এক কোণায় হুঁকো হাতে বসে। বিশ্বেশ্বর কিসের জন্য যেই না একটু ঘরের বাইরে গেছে, টেবিলের উপর ছিল সারি সারি রুপোর মুখনল সাজানে, মণিখুড়ো তা থেকে বাবামশায়ের মুখনলটা সরিয়ে ফেললেন। বিশ্বেশ্বর ঘরে ঢুকল। মণিখুড়ো ওদিকে বসে হুঁকো হাতে ধোঁয়া ছাড়ছেন আর আড়ে আড়ে এদিকে ওদিকে চাইছেন। বিশ্বেশ্বর তো তামাক সেজে গড়গড়ার নল গোলাপজল দিয়ে, কাঠি দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে সাফ ক’রে, মুখনল পরাতে যাবে, মুখনল নেই। কি হবে এখন? বিশ্বেশ্বরের চক্ষুস্থির। কে নিলে বাবুর ফরসির মুখনল! অস্থির হয়, খুঁজে বেড়াতে লাগল। এদিকে বাবামশায়ের তামাক খাবার সময় হয়ে এসেছে। ঠিক সময়ে তামাক দিতে না পারলে মহামুশকিল। মণিখুড়োকে জিজ্ঞেস করে; তিনি বলেন, ‘কই বাবা, দেখিনি কিছু। আমি তো এখানে বসে সেই থেকে হুঁকো খাচ্ছি। তবে কি জান, যে আগুন খেয়েছে তাকে কয়লা ওগরাতেই হবে। ভেবে কি করবে। এই দেখনা কাল আমার জুতোজোড়াটি কেমন লোপাট হয়ে গেল। খুঁজে দেখ, পাবে হয়তো—যাবে কোথায়? বিশ্বেশ্বর বললে, ‘হ্যাঁ হ্যাঁ, তা হলে খুজে দেখি। আপনার জুতোই বা যাবে কোথায়?’ বলে ঘরের এ-কোণায় ও কোণায় খুঁজতে খুঁজতে এক জায়গা থেকে কাগজে-মোড়া জুতো বের করে আনলে; বললে, ‘বাবু, এই যে আপনার জুতো পাওয়া গেছে।’ মণিখুড়ো বললেন, ‘ওই যে ওই কোণায় তোমার মুখনল চকচক করছে।’ বিশ্বেশ্বর তাড়াতাড়ি জুতো ফেরত দিয়ে মুখনল নিয়ে বাঁচে। দেউড়িতে দরোয়ানদের বৈঠক । মনোহর সিং বুড়ো দরোয়ান—মস্ত লম্বা চওড়া, ফরসা গায়ের রঙ, ধবধব করছে সাদা দাড়ি। সকালে সে একদিকে খালি গায়ে লুঙ্গি প’রে বসে দই দিয়ে দাড়ি মাজে আর চারদিকে অন্য দরোয়ানরা কুস্তি করে, ডাম্বেল ভাঁজে। একপাশে এক দরোয়ান একটা মস্ত গয়েশ্বরী থালাতে একতাল আটার মাঝখানে গর্ত করে তাতে খানিকটা ঘি ঢেলে মাখতে থাকে। সে এক পর্ব সকালবেলায় দেউড়িতে। এদিকে মনোহর সিং দই দিয়ে দাড়িই মাজছে বসে বসে। ঘণ্টাখানেক এইভাবে মেজে বাঁ হাতে ছোট্ট একটি টিনের আয়না মুখের সামনে ধ’রে, একরকম কাঠের চিরুনি থাকত তার ঝুঁটিতে গোঁজা, সেই চিরুনি দিয়ে দাড়ি বেশ করে আঁচড়ে কাপড়জামা পরে কোমরে ফেটি বেঁধে, একপাশে প্রকাণ্ড কাঠের সিন্দুক, তাতে ঠেস দিয়ে দোজানু হয়ে যখন বসে দু উরুতে দু হাত রেখে, কি বলব, ঠিক যেন পাঞ্জাবকেশরী বসে আছে ঢাল-তলোয়ার পাশে নিয়ে। শুভ্রবেশ তার, গলায় মোটা মোটা আমড়ার আঁঠির মতো সোনার কন্ঠি, হাতে বালা, কোমরে গোঁজা বাঁকা ভোজালি, সে ছিল দেউড়ির শোভা। পশমের মতো সাদা লম্বা দাড়ি কি সুন্দর লাগত। ছেলেবুদ্ধি— দেখেই একদিন কি ইচ্ছে হল, হাত দিয়ে ধরে দেখব তা। যেই না মনে হওয়া খপ করে গিয়ে তার দাড়ি চেপে ধরলুম মুঠোর মধ্যে। মনোহর সিং অমনি গর্জন করে কোমরের ভোজালিতে হাত দিলে। আমি তো দে ছুট একেবারে দোতলায়। ভয়ে আর নামিনে একতলায়। প্রাণের ভিতর ধুক্‌ ধুক্‌ করছে, কি জানি কি অন্যায় বুঝি করে ফেলেছি। এবার আমায় দরোয়ানজি কেটেই ফেলবে। উঁকিঝুঁকি দিই, মনোহর সিং আমায় দেখতে পেলেই গর্জন করে ওঠে, আর আমার ভয়ে প্রাণ শুকিয়ে যায়। রামলাল আমায় শিখিয়ে দিলে, ‘দাড়িতে হাত দিয়েছ তুমি, ভারি দোষ করেছ। যাও, হাত জোড় করে দরোয়ানজির কাছে ক্ষমা চেয়ে এস। শেষে একদিন দেউড়িতে গিয়ে ভয়ে ভয়ে অতি কাতর ভাবে দু হাত জোড় করে কচলাতে কচলাতে বললুম, ‘এ দরোয়ানজি, মাপ করো আমার কসুর হয়ে গেছে। আর এমন কাজ কখনও করব না।’ মনোহর সিং মিটির মিটির হেসে ভারি গলায় বললে, ‘আর করবে না তো? ঠিক? আচ্ছা যাও।’ মনোহর সিঙের ক্ষমা পেয়ে তবে আমার ত্ৰাস কাটে, দোতলা থেকে নামতে পেরে বাঁচি। দেউড়িতে মাঝে মাঝে নানারকম মজার কাণ্ড হত। একবার কে একজন এল, সে বাজি রেখে একমণ রসগোল্লা খেতে পারে। ঘোষাল ছিলেন খাইয়ে লোক। তিনি শুনে বললেন, ‘আমিও খাব।’ যে হারবে দশ টাকা দণ্ড দেবে। এ-বাড়ির ও-বাড়ির যত দরোয়ান এসে ভিড় করল দেউড়িতে। আমরাও ছেলেপিলেরা, গাড়িবারান্দায় ছিল সারি সারি গাড়ি সাজানো, কেউ তাতে উঠে, কেউ পাদানিতে দাঁড়িয়ে দেখতে লাগলুম। মনোহর সিঙের সামনে বসে গিয়েছে দুজন রসগোল্লা খেতে। ওদিকে একপাশে মস্ত কড়াইয়ে হালুইকর এসে চাপালে রস; তাতে গরম গরম রসগোল্লা তৈরি হতে লেগেছে। একজন সামনে তাদের পাতে সেই রসগোল্লা তুলে দিচ্ছে, অন্যরা গুনছে। ঘোষাল খেয়েই চলেছেন। যত রসগোল্লাই তার পাতে দেওয়া হয় নিরেট ভুঁড়িতে তলিয়ে যায়। খেতে খেতে যখন ষোল গণ্ডা রসগোল্লা খাওয়া হয়েছে তখন ঘোষাল হুপ্‌ হুপ্‌ করে হেঁচকি তুলতে লাগলেন। দেওয়ানজি যোগেশদাদা বললেন, ‘আর নয়, ঘোষাল, হেঁচকি তুলে ফেললে তোমারই হার হল। ঘোষাল মশায় হেরে দশ টাকা গুনে দিয়ে উঠে পড়লেন। অন্য লোকটা শেষ অবধি পুরো পরিমাণ রসগোল্লা খেয়ে আধকড়াই রস চুমুক দিয়ে টাকা ট্যাঁকে গুজে চলে গেল। হোলির দিনে এই দেউড়ি গমগম করত; লালে লাল হয়ে যেত মনোহর সিঙের সাদা দাড়ি পর্যন্ত। ওই একটি দিন তার দাড়িতে হাত দিতে পেতুম আবির মাখাতে গিয়ে। সেদিন আর সে তেড়ে আসত না। একদিকে হত সিদ্ধি গোলা; প্রকাণ্ড পাত্রে কয়েকজন সিদ্ধি ঘুঁটছে তো ঘুঁটছেই। ঢোল বাজছে গামুর গুমুর ‘হোরি হ্যায় হোরি হ্যায়’, আর আবির উড়ছে। দেয়ালে ঝুলোনো থাকত ঢোল, হোরির দু-চারদিন আগে তা নামানো হত। বাবামশায়েরও ছিল একটি সবুজ মখমল দিয়ে মোড়া লালসুতোয় বাঁধা—আগে থেকেই ঢোলে কি সব মাখিয়ে ঢোল তৈরি করে বাবামশায়ের ঢোল যেত বৈঠকখানায়, দরোয়ানদের ঢোল থাকত দেউড়িতেই। হোরির দিন ভোরবেলা থেকে সেই ঢোল গুরুগম্ভীর স্বরে বেজে উঠত; গানও কি সব গাইত, কিন্তু থেকে থেকে ওই ‘হোরি হ্যায় হোরি হ্যায়’ শব্দ উঠত। বেহারাদেরও সেদিন ঢোল বাজত; গান হত ‘খচমচ খচমচ’, যেন চড়াইপাখি কিচির কিচির করছে। আর দরোয়ানদের ছিল মেঘগর্জন; বোঝা যেত যে, হ্যাঁ, রাজপুত-পাহাড়ীদের আভিজাত্য আছে তাতে। নাচও হত দেউড়িতে। কোত্থেকে রাজপুতানী নিয়ে আসত, সে নাচত। বেশ ভদ্ররকমের নাচ। আমরাও দেখতুম। বেহারাদের নাচ হত, পুরুষরাই মেয়ে সেজে নাচত সে কী রকম অদ্ভূত বীভৎস ভঙ্গীর, দু হাত তুলে দু বুড়ো আঙুল দেখিয়ে ধেই ধেই নাচ আর ওই এক খচমচ খচমচ শব্দ। উড়েরাও নাচত সেদিন দক্ষিণের বাগানে লাঠি খেলতে খেলতে। বেশ লাগত। উড়েদের নাচ আরম্ভ হলেই আমরাও ছুটতুম ‘চিতাবাড়ি’ দেখতে। দোতলায় বাবামশায়ের বৈঠকখানায়ও হোলির উৎসব হত। সেখানে যাবার হুকুম ছিল না। উঁকিঝুঁকি মারতুম এদিক ওদিক থেকে। আধ হাত উঁচু আবিরের ফরাস। তার উপরে পাতলা কাপড় বিছানো। তলা থেকে লাল আভা ফুটে বের হচ্ছে। বন্ধুবান্ধব এসেছেন অনেক— অক্ষয়বাবু তানপুরা হাতে বসে, শ্যামসুন্দরও আছেন। ঘরে ফুলের ছড়াছড়ি। বাবামশায়ের সামনে গোলাপজলের পিচকারি, কাচের গড়গড়া, তাতে গোলাপজলে গোলাপের পাপড়ি মেশানো, নলে টান দিলেই জলে পাপড়িগুলো ওঠানামা করে। সেবার এক নাচিয়ে এল। ঘরের মাঝখানে নন্দফরাশ এনে রাখলে মস্ত বড় একটি আলোর ডুমটি। নাচিয়ে ডুমটি ঘুরে ঘুরে নেচে গেল। নাচ শেষ হল; পায়ের তলায় একটি আলপনার পদ্ম আঁকা। নাচের তালে তালে পায়ের আঙুল দিয়ে চাদরের নিচের আবির সরিয়ে সরিয়ে পায়ে পায়ে আলপনা কেটে দিলে। অদ্ভুত সে নাচ। বৈঠকখানা আর দেউড়ির উৎসব, এ দুটাের মধ্যে আমার লাগত ভালো রাজপুত দরোয়ানদের উৎসবটাই। বৈঠকখানায় শখের দোল শৌখিনতার চুড়ন্ত—সেখানে লট্‌কনে ছোপানো গোলাপী চাদর, আতর, গোলাপ, নাচ, গান, আলো, ফুলের ছড়াছড়ি। কিন্তু সত্যি দোল-উৎসব করত দরোয়ানরাই—উদ্দণ্ড উৎসব, সব লাল, চেনবার জো নেই। সিদ্ধি খেয়ে চোখ দুটো পর্যন্ত সবার লাল। দেখলেই মনে হত হোলিখেলা এদেরই। শখের খেলা নয়। যেন যারা রক্তের হোলি খেলতে জানে, এ তাদেরই খেলা। কৃত্রিম কিছু নেই। দেখলে না সেদিন সাঁওতালদের উৎসব? কৃত্রিমতা ঘেঁষতে পায় না সেখানে। তারা মনের আনন্দে উৎসব করে, আনন্দে নাচে গায়, তাতে তারা মেতে যায়। বৈঠকখানার উৎসব ছিল কৃত্রিম, তাই তা ভালো লাগত না আমার। দেউড়ি আর বৈঠকখানায় ছিল এইরকম দোল-উৎসব, আর আমাদের জন্য আসত টিনের পিচকারি। ওইতেই আনন্দ। টিনের পিচকারি বালতিভরা লাল জলে ডুবিয়ে যাকে সামনে পাচ্ছি পিচকারি দিয়ে রঙ ছিটিয়ে দিচ্ছি আর তারা চেঁচামেচি করে উঠছে, দেখে আমাদের ফুর্তি কী। বাড়ির ভিতরে সেদিন কি হত জানিনে, তবে আমাদের বয়েসে খেলেছি দোলের দিনে— আবির নিয়ে এ-বাড়ি ও-বাড়ির অন্দরে ঢুকে বড়দের পায়ে দিতুম, ছোটদের মাথায় মাখাতুম। বড়দের রঙ মাখাবার হুকুম ছিল না, তাঁদের ওই পা পর্যন্ত পৌঁছত আমাদের হাত। এই তো গেল দোলপূর্ণিমার কথা। এখন আর এক কথা শোনো। বাবামশায়ের সমশের কোচোয়ান, আস্তাবলবাড়ির দোতলার নহবতখানায় থাকে। তিনটে বাজলেই সে বেরিয়ে এসে বসে আস্তাবলের ছাদে খাটিয়া পেতে, ফরসি হাতে; ঠিক একটি ফুলদানির মতে ফরসি ছিল তার। আক্কেল সহিস তামাক সেজে ফরসি এনে হাতে দেয়, তবে সে তামাক খায়। সহিসরা ছিল তার চাকর; সব কাজ করে দিত, নিজের হাতে সে কিছু করত না। দূর থেকে দেখছি, সমশের আয়েস করে ফরসি হাতে খাটিয়ায় বসে তামাক খাচ্ছে, আক্কেল সহিস তার বাবরি চুল বাগাচ্ছে, ঘণ্টাখানেক ফাঁপিয়ে ফাঁপিয়ে চুল আঁচড়াবার পর একটি আয়না এনে সামনে ধরলে। সমশের বাদশাহী কায়দায় বাঁ হাতে আয়নাটি ধরে মুখ ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখে গোঁফ মুচড়ে আয়না ফেরত দিয়ে উঠল। ঘরে গিয়ে চুড়িদার জরিদার বুককাটা কাবা প’রে পা বের ক’রে দিতে আর একজন সহিস শুঁড়তোলা দিল্লীর লপেটা তার পায়ে গুঁজে দিল। আর এক সহিস মাথার শামলাটা দু-হাতে এনে সামনে ধরল, সমশের পাগড়িটা মাথার উপর থাবড়ে বসিয়ে হাতিমার্কা তকমার দিকটা হেলিয়ে উঁচু করে দিলে। অন্য সহিস ততক্ষণে লম্বা চাবুকটা নিয়ে এসে দাঁড়িয়েছে। সমশের চাবুক হাতে নিয়ে এবারে দোতলা থেকে নামল মাটির সিঁড়ি দিয়ে। নিচে ঘোড়া ঠিক করে রেখেছে সহিসরা—দুধের মতো সাদা জুড়ি। সেই জুড়িঘোড়া গাড়িতে জোতবার আগে খানিক ছুটিয়ে ঠিক করে নিতে হত। যেখানে রবিকার লালবাড়ি সে জায়গা জোড়া ছিল গোলচক্কর প্রাচীরঘেরা। একপাশে ছোট্ট একটি ফটক। সহিসরা ঘোড়া দুটাে চক্করে ঢুকিয়ে ফটক বন্ধ করে দিল। সমশের লম্বা চাবুক হাতে প্রাচীরের উপর উঠে দাড়িয়ে বাতাসকে চাবুক বসালে—শট্‌। সেই শব্দ পেয়ে ঘোড়া দুটো কান খাড়া করে গোল চক্করে চক্কর দিতে শুরু করলে। একবার করে ঘোড়া ঘুরে আসে আর চাবুকের শব্দ হয় শট্‌ শট্‌। যেন সার্কাস হচ্ছে। এই রকম আধ ঘণ্টা ঘুরিয়ে সমশের কোচোয়ান চাবুক আক্কেল সহিসের হাতে ছেড়ে দিয়ে নামল। আক্কেল গাড়ি বের করলে—ঝকঝক তকতক করছে গাড়ির ঘোড়ার রুপো-পিতলের শিকলি-সাজ। গাড়িতে জুড়ি জোতা হলে পর সমশের কোচবাক্সে উঠে হাত গুটিয়ে দাঁড়াতেই সহিস রাশ তুলে দিলে তার হাতে। রাশ ধরবার কায়দা কি ছিল সমশের কোচোয়ানের, দশ আঙুলের ভিতরে কেমন কায়দা করে ধরত! সেই রাশে একবার একটু টান দিতেই বড় বড় দুটাে ঘোড়া তড়বড় করে এসে গাড়িবারান্দায় ঢুকল। গাড়িবারান্দায় ঢুকতেই যে পুরু কাঠের পাঠা পাতা থাকত সেটা শব্দ দিলে একবার হুড়ুদুম্ যেন জানান দিলে গাড়ি হাজির। বাবামশায় হাওয়া খাবার জন্য তৈরি হয়ে গাড়িতে চাপলেন। গাড়ি চলল গাড়িবারান্দা ছেড়ে। সমশের তখনও দাঁড়িয়ে রাশ হাতে কোচবাক্সে। কাঠখানা চারখানা চাকার চাপে আর দুবার শব্দ দিলে হুড়ুদুম্ হুড়ুদুম্। ধপাস্‌ করে এতক্ষণে সমশের কোচোয়ান কোচবাক্সে জাঁকিয়ে বসল যেন সিংহাসনে বসলেন আর এক লক্ষ্ণৌয়ের নবাব। আমাদের ছিল রামু কোচোয়ান। জাতে হিন্দু, কিন্তু লুঙ্গি পরত সে। কোচোয়ান হলেই লুঙ্গি পরতে হবে, এই সে জানত। ছোট্ট একটি ফিটন গাড়ি, আমরা তাতে চড়ে বিকেলে চক্করে ঘুরে বেড়াতুম—হাওয়া খাওয়া হয়ে যেত। বেশির ভাগ সুনয়নী বিনয়িনী চড়ত সেই গাড়িতে। আস্তাবলে কতরকম দৃশ্য দেখবার ছিল—কত লোকের, এ-বাবুর, ও-বাবুর, গাড়ি-ঘোড়া থাকত সেখানে। বেচারামবাবু আসতেন বঁড়শে বেহালা থেকে বুধবারে বুধবারে দাদাদের ব্রাহ্মধর্ম পড়াতে। তার গাড়িটিও যেমন ঘোড়াটিও ছিল তেমনি ছোট্ট। আমরা বলাবলি করতুম, ‘ওইটুকু গাড়ির ভিতরে বেচারামবাবু ঢোকেন কেমন করে?’ এ ছিল এক বড় সমস্যা আমাদের কাছে। দূর থেকে গাড়ি আসছে দেখেই চিনতুম—ওই আসছেন বেচারামবাবু, ওই যে তাঁর গাড়ি দেখা যায়। তখন জ্যোতিকা মশায় কোত্থেকে পুরোনো একটা মরচে-ধরা বয়লার কিনেছেন, ‘সরোজিনী’ স্টীমারে বসানো হবে। বয়লারটা পড়ে থাকে গোলচক্করে। একদিন বেচারামবাবু এসেছেন; দাদাদের পড়িয়ে বাড়ি ফিরে যাবেন, ঘোড়া আর খুঁজে পান না। ঘোড়া গেল কোথায়, দেখ দেখ! ঘোড়া হারিয়ে গেছে। বেচারামবাবু হতভম্ব। অনেক খোঁজাখুঁজির পর দেখা গেল। ঘোড়া বয়লারের ভিতরে ঢুকে স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে। ঘোড়াটা ঘাস খেতে খেতে কখন বয়লারের ভিতরে ঢুকে গেছে আর বের হতে পারছে না। শেষে সহিস লেজ ধরে তাকে বের করে বয়লারটার ভিতর থেকে। নহবতখানার নিচে ফটকের পাশেই নন্দফরাশের ঘর। ঘরের সামনেই কুয়ো, অনেক কালের পুরোনো, কলের জল হওয়ার আগেকার। কুয়োর পাশে মস্ত শবজিবাগান, খুব নিচু পাঁচিলঘেরা। তার পশ্চিমে ভাগবত মালী আর বেহারাদের ঘর এক সারি। তার উত্তর ধারে গোয়াল, গোয়ালের পুবকোণে মস্ত একটা গাড়িখানা। গাড়িখানার গায়ে পাহাড়ের মতো উচু বিচালির স্তূপ, তার উপরে মেথরদের ছাগলছানাগুলি লাফিয়ে লাফিয়ে বেড়ায়। আমরাও উঠতে চেষ্টা করি মাঝে মাঝে। সেটি থেকে একটু দূরে বাড়ির ঈশান কোণে বিরাট একটা তেঁতুলগাছ, সে যে কত দিনের কেউ বলতে পারে না। দৈত্যের হাতের মত তার মোটা মোটা কালো ডাল। এ-বাড়িতে ও-বাড়িতে যত ছেলেমেয়ে জন্মেছি তাদের সবার নাড়ি পোঁতা ছিল ওই গাছের তলায়। সেই তেঁতুলগাছের ছায়ায় ছিরু মেথরদের ঘর। তাদের তিন পুরুষ ওখানে বসবাস করছে আমাদের সঙ্গে। তাদের ঘরের পিছনে জোড়াসাঁকোর বাড়ির উত্তর দিকের পাঁচিল; তার গায়ে তিনটে বড় বড় বাদামগাছ, যেন শহরের আর সব বাড়ি আড়াল করে মাথা তুলে উত্তর দুয়ার পাহারা দিচ্ছে। চাকররা সেই বাদামগাছ থেকে আমাদের জন্য পাতবাদাম কুড়িয়ে আনে। উত্তর-পশ্চিম দিকটা কথায় বোঝাতে হলে তিন-চারটে পাড়ার নাম করতে হয়— মালীপাড়া, গোয়ালপাড়া, ডোমপাড়া, এমনি, তবে ঠিক ছবিটা বোঝাতে পারি। আস্তাবলে যেমন ছিল সমশের কোচোয়ান কর্তা, একতলায় নন্দফরাশ, মালীপাড়ায় রাধামালী, গোয়ালপাড়ায় রামগয়লা, তেমনি ডোমপাড়ায় ছিরুমেথরের একাধিপত্য। এই এক-এক পাড়ার এক-এক অধিকারীর কথা বলতে গেলে অনেক কথা বলতে হয়। দু-একটা বলি শোনো। নন্দফরাশের দরবারের বর্ণনা তো দিয়েছি। সমশের কোচোয়ানের কথাও তো হল। দরোয়ান-বেহারাদের দোলের কথা, মালীদের চিতাবাড়ি তাও বলেছি। এবারে বলি তবে ছিরুমেথরের চরিত্র। তাদের ঘর খোলা দিয়ে ছাওয়া; বাদামতলায় কাত হয়ে পড়েছে ঝড়ে জলে। সারাদিনমান তেঁতুলগাছের ছায়াতেই ঢাকা সেই কোণটা; রোদ পড়তে দেখিনে। হ্যাংলা কুকুরছানাগুলোর ডাক এসে পৌঁছয় সেদিক থেকে কানে। কুকুরের তাড়া খেয়ে হাঁস মুরগি থেকে থেকে ক্যাঁ-ক্যাঁ চীৎকার ছাড়ে। সেই ছায়ায় অন্ধকারে ছিরুমেথরের ঘরের দাওয়া দেখা যায়। একধারে একটা জলের জালা, আধখানা তার মাটিতে পোঁতা। সেই ঠাণ্ডা জালার জলে কাজের শেষে ছিরুমেথর চান করে দেখি। কালো তার রঙ। ভারি শৌখিন ছিল ছিরুমেথর। কালো হলেও ছিরুর চেহারা ছিল বেশ; কোঁকড়া কোঁকড়া চুল, মুখের কাটকোটও সুন্দর। বিলিতি মদ খাওয়া তার অভ্যেস ছিল। দেশি মদ ছুঁ’ত না। বিলিতি মদ খেলেই তার মুখে ফর্‌ ফর্‌ করে ইংরেজি গরম গরম গালাগালি বের হয়— ড্যাম ইউ রাস্কেল। ইংরেজি বুলি শুনলেই বোঝা যেত লোকটা ‘খেয়েছে’। বাড়ি রাস্তাঘাট পরিপাটি রাখা কাজ ছিল তার। সামনের রাস্তা ঝাঁট দিয়ে চলে গেল যেন ধুলোর উপরে আলপনা এঁকে দিলে ঝাঁটা দিয়ে, জলে ঢেউ খেলিয়ে দিলে। রাস্ত ঝাঁটানোর আর্টিস্ট তাকে বলা যেতে পারে। একদিন হল কি, বাড়িরই কে যেন ডেকেছে ছিরুকে। দরোয়ান গেছে ডাকতে। সে ছিল মউজে; যে মেথরটা হুকুম শুনবে সে তখন তো নেই, ইংরেজি-বুলি-বলা আর একটা মানুষ তার মধ্যে বসে আছে। দরোয়ান যেই না কাছে গিয়ে তাকে ডাক দিয়েছে অমনি ছিরু শুরু করেছে ইংরেজিতে গালাগালি। কিছুতেই আর তাকে থামানো যায় না। তখন দরোয়ানও হিন্দি বুলিতে তেরিমেরি করে যেমন লাঠি তোলা—বাস্‌, সাহেবের অন্তর্ধান। ছিরুমেথরের মধ্যেকার ভেতো বাঙালিটা হঠাৎ ফিরে এসে দরোয়ানজির পায়ে ধরতে চায়, ‘মাপ করে, দরোয়ানজি, ঘাট হয়েছে।’ ‘আরে ছুঁয়ো মৎ, ছুঁয়ো মৎ’ বলে দরোয়ান যত পিছয় ছিরু তত এগিয়ে আসে। শেষে দরোয়ানের ভঙ্গ দিয়ে পলায়ন জাত যাবার ভয়ে। ছিরুর বুদ্ধি দেখে আমরা অবাক। দরোয়ান মেথরে এ প্রহসন প্রায়ই দেখতুম আর হাসতুম। ছিরুর আর এক কীর্তির কথা ছোটপিসেমশায় বলতেন, ‘জানিস? মল্লিকবাড়িতে বিয়ের মজলিসে গেছি। দেখি, শিমলের ধুতিচাদর জুতোমোজা পরে ফিট্‌বাবু সেজে ছিরুটা মজলিসের একদিকে বসে সটকা টানছে, আমাকে দেখেই দে চম্পট।’ বাবুয়ানি কায়দার দোরস্ত ছিল ছোট বড় খানসামা চাকর পর্যন্ত সবাই জোড়াসাঁকোর বাড়ির। ভদ্রলোক কেউ বাড়িতে এলে খাতির করে বসাতে জানত। এখন সে-রকম চাকরবাকর দুর্লভ। নতুন চাকররা পুরানো চাকরদের হাতে কি রকম ভাবে কায়দাকানুন তরিবত শিখত দেখো। বাবামশায়ের ছোট বেয়ারা মাদ্রাজী। নতুন এসে সে একদিন লুকিয়ে বাবামশায়ের গেলাসে বরফজল খেয়েছে। বুদ্ধুর নজরে পড়ে গেছে তার সে বেয়াদবিটি। বাবুর গেলাসে বরফজল খাওয়া, বসাও পঞ্চায়েত, দাও দণ্ড। বেচারা কেঁদেই অস্থির, বসল পঞ্চায়েত বেয়ারাদের মহলে। অনেক রাত পর্যন্ত চলল তক্কাতক্কি। একটা ভোজের টাকা দিয়ে, মাথা নেড়া করে, টিকি রেখে তবে উদ্ধার পায় সে। এই রীতিমত দণ্ডের টাকাটা কার কাছ থেকে এসেছিল বলতে পার? বাবামশায়ের কাছেই ছোঁড়াটা নিজের দোষ স্বীকার করে কেঁদে কেটে এই টাকাটা বার করেছিল। চাকরদের বাবুয়ানি শিক্ষার খরচা বাবুদেরই বহন করতে হত। বুদ্ধুবেয়ারা ভালোমানুষ হলেও বাবুর জিনিসপত্রের বিষয়ে খুব হুঁশিয়ার ছিল। যার রুমালে ল্যাভেণ্ডারের গন্ধ পাবে নিয়ে বাবামশায়ের আলমারিতে তুলে রাখবে। মণিখুড়োর রুমাল নিয়ে একদিন এইরকম তুলে রেখেছে; বলে, ‘এতে বাবুর খোসবো আছে যে।’ মণিখুড়ো বলেন, ‘তা বাবুর কাছ থেকেই চেয়ে নিয়ে খোসবো রুমালে মাখিয়েছিলুম আমি—রুমালটা আমারই। ধোপাবাড়ির নম্বর দেখো।’ বুদ্ধু তখন সেই রুমাল ফিরিয়ে দেয় মণিখুড়োকে। বড় বিশ্বাসী বেয়ারা ছিল, এমন আজকাল আর দেখা যায় না। বাবামশায়ের কোনো জিনিস কখনও এদিক-ওদিক হতে পারত না। কেমন সরল বিশ্বাসী ছিল বুদ্ধু, তা বলছি। একবার বাবামশায় গেছেন ইংরেজি থিয়েটারে; আঙুলে হীরের আংটি—বনস্পতি হীরে, খুব দামী; আর হাতে একটি লাঠি, তার মাথায় কাটগ্লাসের একটি লম্বা এসেন্সের শিশি, শখের লাঠি ছিল সেটি। বাবামশায় ফিরে এসে লাঠি আংটি বুদ্ধুর হাতে দিয়ে শুয়ে পড়েছেন। কয়দিন পর আংটি দপ্তরখানায় পাঠানো হবে, হীরেটি নেই। নেই তো নেই; কতদিন ধরে খোঁজাখুঁজি, কোথায় যে পড়েছে তার পাত্তা পাওয়া গেল না। গরমিকাল এসে গেল। এই সময়ে বাবামশায় যেমন ফি বছর একবার করে আলমারি খালি করেন তেমনি খালি করছেন—বাবামশায় হাতের কাছে জামা কাপড় যা পাচ্ছেন সব টেনে টেনে ফেলছেন, যে যা পাচ্ছে নিয়ে নিচ্ছে। খালি করতে করতে আলমারির বাকি রইল মাত্র কয়েকটি সাদা ধুতি আর পাঞ্জাবি। তার তলা থেকে বের হল সেই হারানো হীরে। বাবামশায় সেটি হাতে নিয়ে বললেন, ‘বুদ্ধু, এই তো সেই হীরে। তুই এখানে রেখে দিয়েছিস, আর এর জন্য কত খোঁজাখুঁজি হচ্ছে। বুদ্ধু বললে, ‘তা আমি কি জানি ওটি হীরে। সকালে ঘরে কুড়িয়ে পেলুম, ভাবলুম ঝাড়ের কাচ। তুলে রেখে দিলুম।’ এইবার শোনো রান্নাবাড়ির গল্প। গলির ভিতরে ছোট্ট ঘর, অমৃতদাসী সেই ঘরে বসে জাঁতায় সোনামুগের ডাল ভাঙে আর বাটনা বাটে। এবারে যখন বাড়ি ভাঙে দেখেই চিনলুম—আরে, এই তো সেই অমৃতদাসীর ঘর। ছেলেবেলায় সেখানে গিয়ে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে নিবিষ্টমনে তার ডাল ভাঙা দেখতুম। সোনার বর্ণ সোনামুগের ডাল জাঁতার চারিদিক দিয়ে সোনার ঝরনার মত ঝরে পড়ত। মাঝে মাঝে অমৃতদাসী একমুঠো ডাল হাতে তুলে দিত, বলত, ‘খাবে খোকা? খাও, এই নাও।’ অল্প অল্প করে সেই ডাল মুখে ফেলে চিবতুম, বেশ লাগত। সেই ঘরটি আর জাঁতাটি, সারাজীবন তাই নিয়েই কেটেছে; তার মিউজিক ছিল জাঁতার ঘড়ঘড়নি। সোনামুগ আর বাটনার হলুদের জল ভেসে যাচ্ছে, কাপড়েও লেগেছে, সোনাতে হলুদে মাখামাখি। এখনও মনে হয় তার কথা; দুঃখিনী একটি বুড়ির ছবি চোখে ভাসে। বাসনমাজানি এল দুপুরে, বাসন মেজে রেখে গেল যার যার দোরে, সোনার মত ঝকঝক করছে। দুধ জ্বাল দেবার দাসী দুধ জ্বাল দিচ্ছে; দুধের ফেনা তুলছে তো তুলছেই। জাল দিয়ে বাটিতে বাটিতে দুধ ভাগ করে রাখছে। তার পর দিব্যঠাকুর হাতা বেড়ি দিয়ে রান্নায় ব্যস্ত। ওদিকটায় আর যেতুম না বড়। রান্নাবাড়ির ঠিক উপরে ঠাকুরঘর। সেখানে ছোটপিসিমা ব’সে, মহিম কথক কথকতা করছেন, সিংহাসনে ঠাকুর অলকাতিলকা পরে মাথায় রুপোর মুকুট দিয়ে। এখনও সে-সবই আছে, কেবল ছোটপিসিমা নেই, মহিম কথক নেই। সেখানে হত পুরাণের গল্প। সেখান থেকে নেমে এসে ছোটপিসিমার ঘরে ছবি দেখতুম। একটু আগে যা শুনে আসতুম উপরে, নিচে তারই ছবি সব চোখে দেখতুম। সেই পুরাণের পুঁথি কিছু এখনও আছে আমার কাছে, ছেলেরা সেদিন কোন্‌ কোণা থেকে বের করলে। দেখেই চিনলুম, এ যে মহিম কথকের পুঁথি, এক-একটি পাতা পড়ে যেতেন কথকঠাকুর আর এক-একটি ছবি যেন চোখের সামনে ভেসে উঠত। লাল বনাত একখানা গায়ে দিয়ে বসতেন পুঁথি পড়তে, হাতে রুপোর আংটি, হাত নেড়ে নেড়ে কথকতা করতেন। রুপোর আংটির ঝক্‌ঝকানি এখনও দেখতে পাই। আঁকতে শিখে সে ছবি একখানা এঁকেওছিলুম। বাবামশায়ের সকালের মজলিস বসত দোতলায় দক্ষিণের বারান্দায়। দক্ষিণের বাগানে ভাগবত মালী কাজ করে বেড়াত। বাবামশায়ের শখের বাগানের মালী, নিজের হাতে তাকে শিখিয়ে পড়িয়ে তৈরি করেছিলেন। যেখানে যত দুর্মূল্য গাছ পাওয়া যায় বাবামশায় তা এনে বাগানে লাগাতেন, বাগান সম্বন্ধে নানারকমের বই পড়ে বাগান করা শিখেছিলেন, ওই ছিল তার প্রধান শখ। কি সুন্দর সাজানো বাগান, গাছের প্রতিটি পাতা যেন ঝকঝক করত। হর্টিকালচারের এক সাহেব বললেন, ‘এদেশে টিউলিপ ফুল ফোটে না, তার অনেক চেষ্টা করে দেখেছেন।’ বাবামশায় বললেন, ‘আচ্ছা, আমি ফোটাব।’ বিলেত থেকে সেই ফুলের গেঁড় আনলেন, নানারকমের সার দিলেন গাছের গোড়ায়; কাচের না কিসের ঢাকা দিলেন উপরে। বাবামশায়ের উদ্ভিদবিদ্যা সম্বন্ধে বড় বড় বই এখনও নিচের তলায় আলমারি ঠাসা। কত বই দেশ বিদেশ থেকে আনিয়ে পড়েছেন। গাছ সম্বন্ধে যে বইটি তিনি সর্বদা পড়তেন, সোনার জলে বাঁধানো, সবুজ চামড়ায় মোড়া, যেন কত মূল্যবান একটি কবিতার বই। বড় হয়ে খুলে দেখি সেটি হারপার কোম্পানির নানারকম ফল ফুল গাছের সচিত্র তালিকা। তা টিউলিপের গেঁড় লাগানো হল, ভাগবত মালীকে শিখিয়ে দিলেন, রোজ তাতে কি করবে, কি করে যত্ন নিতে হবে। তিনিও নিজেও এসে একবার দুবার করে দেখে যান। একদিন সেই ফুল ফুটল—একটি ফুল। ফুল ফুটেছে, ফুল ফুটেছে! ওই একটি ফুলের জন্য বাড়িতে হৈ-চৈ পড়ে গেল। সবাই আসে দেখতে। যে ফুল ফোটে না এই দেশে সেই ফুল ফুটল শেষে। বাবামশায় খুব খুশি । ফুল ফোটাতে শখ হয়েছিল, ফুল ফুটল। হর্টিকালচারের সাহেব খবর শুনে ছুটে এলেন। তিনি অবাক। কত চেষ্টা করেও তাঁরা পারেননি। বললেন, ‘একজিবিশনে দেখাতে হবে।’ শিগগিরই হর্টিকালচারের একজিবিশন হবে। ভাগবত রঙিন চাদর বেঁধে পরিষ্কার ধুতিজামা পরে তৈরি হয়ে এল, তাকে দিয়ে ফুল পাঠানো হল। একজিবিশনে সেই ফুলটির জন্য একটি সোনার মেডেল পেলেন বাবামশায়। সেই সোনার মেডেল আর একটি গাছকাটা কাঁচি ভাগবতকে তিনি বকশিস দিলেন। বললেন, ‘নে মেডেলটা তুইই গলায় ঝোলা।’ মেডেলটা দিয়ে এক সময়ে হয়তো সে ছেলের গয়না গড়িয়ে দিয়েছিল, কিন্তু কাঁচিটি কখনও ছাড়েনি। আমাদের কতবার বলত, ‘বাবুর দেওয়া এই কাঁচি।’ সেদিন বড় মজা লাগল। এই কিছুদিন আগের কথা। জোড়াসাঁকোর বাড়িতে বারান্দায় বসে আছি। ভাগবত মরে গেছে অনেকদিন আগে, তার ছেলে এখন বাগানে কাজ করে। বাগানের কোণায় ছিল করবীগাছ। ছোট ছেলে বাপের হাতের সেই কাঁচি নিয়ে তার ডাল ছাঁটবার চেষ্টা করছে, কিছুতেই আর সামলাতে পারছে না, হাত আগডালে পৌঁছয় না তার। গাছের ডালপাতা হাওয়াতে দুলে দুলে ছেলেটিকে জাপটে ধরছে, কাঁচি হাতে সে তার ভিতরে আটকা প’ড়ে অস্থির। বসে আমি মজা দেখছি আর হাসছি। মোহনলাল শোভনলাল যাচ্ছিল সেখান দিয়ে, তাদের বললুম, ‘ওরে দেখ, মজা দেখ, ভাগবতের ছেলে তার বাপের লাগানো গাছের সঙ্গে কেমন খেলা করছে দেখ। যেন দুষ্টু ছেলের চুল কাটবে নাপিত, ছেলে মাথা ঝাঁকুনি দিয়ে হেলিয়ে দুলিয়ে নাপিতকে নাস্তানাবুদ করে দিচ্ছে। বলে দে ওকে, গাছের ডাল কাটবার দরকার নেই। ও-গাছ অমনি থাকুক।’ বাপের গাছের সঙ্গে ছেলে খেলা করছে দেখে ভারি ভালো লেগেছিল। ছেলেবেলায় বাবামশায়ের শখের বাগানে কেউ আমরা ঢুকতে পেতুম না, ভাগবত মালীর দাপটে। আমরা ছেলেরা কয়জনে মিলে একপাশে নিজেদের বাগান বানিয়ে নিয়েছিলুম। ছোট্ট বাগানটি, বাবামশায়ের দেখাদেখি একটা জায়গায় ইঁট পাথর জড়ো করে এখানে ওখানে ঘাসের চাপড়া বসিয়ে পাহাড়ের অনুকরণ করে, মাঝে মাটি খুড়ে একটা গোল মাটির গামলা বসিয়ে তাতে জল ভরে টিনের হাঁস মাছ ছেড়ে চুম্বক কাঠি দিয়ে টানি—সেই হল আমাদের গোলপুকুর। বিকেলে ইস্কুল থেকে সব ছেলে ফিরে এলে তখন আবার সবাই একসঙ্গে হয়ে খেলাধুলো করি। সারাদিন একলা থাকার পর ওই সময়টুকু বড় আনন্দে কাটত আমার। বিকেল হতেই বাগানে বাবামশায়ের কুরসি ফরসি পড়ে। ভাগবত ফোয়ারা ছেড়ে দেয়; সত্যিকার হাঁস মাছ ফেয়ারার জলে ভেসে বেড়ায়। বাবামশায় নিচে নেমে এসে বসেন বাগানে। পড়শি কালাচাঁদবাবু, মাথায় বুলবুলির ঝুঁটির মত একটু চুল, বুকে একটি ফুল গুঁজে, গলায় চুনটকরা চাদর ঝুলিয়ে, বার্নিশকরা জুতো প’রে, ছিপছিপে ছড়ি ঘোরাতে ঘোরাতে হেলেদুলে আসেন বাগানের মজলিসে। ফি শনিবার আপিস ছুটির পর মতিলালবাবু চলে আসেন বাবামশায়ের কাছে। মাছ ধরার খুব ঝোঁক ছিল তাঁর। বাবামশায় বলতেন, ‘এই যে লালমোতি এসেছ, ছিপটিপ ঠিক আছে তো?’ লালমোতি বলেই ডাকতেন তাঁকে। ওদিককার বড় পুকুরে লালমোতি প্রায়ই মাছ ধরতেন। বাবামশায়ও বসে যেতেন মাছ ধরতে কোনো-কোনোদিন। ওই সেই পুরানো পুকুর যার ওপারে প্রকাণ্ড বটগাছ— রবিকার ‘জীবন-স্মৃতিতে’ আছে লেখা। ছেলেবেলায় যা ভয় পেতুম বটগাছটাকে। গল্প শুনতুম চাকরদাসীর কাছে, জটেবুড়ি ব্রহ্মদত্তি কত কি আছে ওখানে। তা যাক, তখন সেই বিকেলবেলা ওদিকে বাগানে জমত বাবামশায়ের আসর, এদিকে আমাদের হত ইস্কুল-ইস্কুল খেলা। এ-বাড়ি ও-বাড়ির মাঝে যে গলিটুকু কাছারিঘরের সামনে, সেই জায়গাটুকুই আমাদের খেলার জায়গা। কোত্থেকে একটা ভাঙা বেঞ্চি জোগাড় করে তাতে সবকটি ছেলে ঠেসাঠেসি করে বসি, দীপুদা মাস্টার। গলির মোড়ে সেই সময়ে হাঁক দিতে দিতে ভিতরে আসে চিনেবাদাম, গুলাবি রেউড়ি, ঘুগনিদানা, লজেঞ্জুস, কত কি— ‘খায় দায় পাখিটি বনের দিকে আঁখিটি’, বেঞ্চিতে বসে বসে সেই দিকেই নজর আমাদের। কতক্ষণে গুলাবি রেউড়ি চিনেবাদামওয়ালা আসে। দেউড়ির কাছে যেমন তারা এসে দাঁড়ায়, দে ছুট ইস্কুল-ইস্কুল খেলা ছেড়ে। দীপুদা ভাঙা কাঠের চেয়ারে বসে গভীর সুরে বলেন, ‘পড়্‌ সবাই।’ পড়া আর কি, কোলের উপর ঠোঙা রেখে তা থেকে চিনেবাদাম বের করে ভাঙছি আর খাচ্ছি; দীপুদার হাতেও এক ঠোঙা, তিনিও খাচ্ছেন। এই হত আমাদের পড়া-পড়া খেলা। একদিন আবার প্রাইজ ডিস্ট্রিবিউশন হল। কে প্রাইজ দেবে। উপরে বারান্দায় পায়চারি করছেন রবিকা। তিনি আসতেন না বড় আমাদের খেলায় যোগ দিতে। সমান বয়সের ছেলেও তো থাকত এই খেলায়। কিন্তু তিনি ওই তখন থেকেই কেমন একলা একলা থাকতেন, একলা পায়চারি করতেন। সেখান থেকেই মাঝে মাঝে দেখতেন দাঁড়িয়ে, নিচে আমরা খেলা করছি। গিয়ে ধরলুম তাকে, ‘আমাদের ইস্কুলে প্রাইজ ডিস্ট্রিবিউশন হবে, তোমায় আসতে হবে।’ রবিকা একটু হেসে নেমে এলেন, প্রাইজ ডিস্ট্রিবিউশন হল। চিনেবাদাম গুলাবি রেউড়ির ঠোঙা। প্রাইজের পরে আবার তিনি দাঁড়িয়ে বক্তৃতাও দিলেন একটি খুব শুদ্ধভাষায়। আহা, কথাগুলো মনে নেই, নয়তো বড় মজাই পেতে তোমরা। কালে কালে সেই জোড়াসাঁকোর বাড়ির কত বদলই না হল। আমাদের কালেই সেই তোশাখানা হয়ে গেল ড্রামাটিক ক্লাবের নাট্যশালা। ভিস্তিখানায় টেবিল পড়ত, খাওয়াদাওয়া হত। দপ্তরখানা হল গ্রীনরূম। দেউড়ি তো উঠেই গেল, ভেঙেচুরে লম্বা ঘর উঠল। খামখেয়ালির বৈঠক বসত সেখানে। একবার ‘বৈকুণ্ঠের খাতা’ অভিনয় হল, বাড়ির ছেলেদের দিয়ে করিয়েছিলুম, গাড়িবারান্দায় মনোহর সিঙের দোল-উৎসব হত যেখানে, সেইখানে মস্ত স্টেজ তৈরি হল— ঘোড়াসুদ্ধ গাড়ি সোজা এসে ঢুকল স্টেজে। টং টং করে আপিসফেরত অবিনাশবাবু নামলেন এসে। ব্যাপার দেখে অডিয়েন্স একেবারে অবাক। কত অভিনয় কত খেলা ক’রে, কত সুখদুঃখের দিন কাটিয়ে, সেই জোড়াসাঁকোর বাড়ি মাড়োয়ারি ধনীকে বেচে বের হতে হল যেদিন আমার নিজের ছেলেপিলে বউঝি নিয়ে, সেদিন সেই তেঁতুলতলায় মেথরের নাতি নাতনি নাতবউ কেবল তারাই এসে আমায় ঘিরে কান্না জুড়লে। তাদের ওইখানেই জন্ম, ওইখানেই মৃত্যু। দেশ ঘর বলে আর কিছু নেই। বলে, ‘এখন উপায় কি হবে বাবু? আমাদের তুলে দিলে কোথায় যাব?’ আমি বলি, ‘চল্‌ আমার সঙ্গে বরানগরে, সেইখানে তোদের ঘর বেঁধে দেব। তোরা থাকবি, কাজ করবি, যেমন করছিলি এইখানে।’ সেই পুরোনোকালের তেঁতুলতলার মায়া ছাড়তে পারলে না। আজও সেখানে তারা রয়ে গেছে কিনা কে জানে। কি সুখের স্থানই ছিল, কি সুখের হাওয়াই বইত ওইটুকখানি জোড়াসাঁকোর বাড়িতে। ওখানের মায়ায় যে শুধু আমিই পড়েছিলেম তা নয়, চাকরদাসী কর্মচারী ছেলেবুড়ো সবাই। এই একটি কথা বলি, এ থেকেই বুঝে নাও। মনোরঞ্জনবাবু যশোরের কুটুম্ব; কাছারিতে কাজ করেন, বাতে একটি পা পঙ্গু। তেঁতুলতলায় কর্মচারীদের বাসস্থান, তারই একটি ছোট্ট ঘরে তিনি থাকেন। পেনশন হবে হবে, পড়ল বুড়ো নির্ঘাত রোগে। খবর পেয়ে ছুটি দেখতে বুড়োকে—ছোট্ট ঘর, একটি মাত্র দরজা জাল দেওয়া, দেয়ালে আর কোনো পথ নেই যে হাওয়া রোদ আসে। বুঝলুম বুড়োর দিন ফুরোবে সেইখানেই। ‘কেমন আছ? একখানা ভালো ঘরে যেখানে হাওয়া রোদ পাও সেই ঘরে যাও।’ ‘আজ্ঞে, বেশ আছি এখানে। দু-এক দিনের মধ্যেই সেরে উঠে কাছারিতে যাব।’ বলি, ‘বাসাবাড়িটা একবার তদারক করে যাই।’ ঘুরতে ঘুরতে দেখি পায়রার খোপের মত একটিমাত্র ভাঙা দেয়ালের গায়ে জালবদ্ধ দরজার ধারে মনোরঞ্জনবাবু গোটা গোটা অক্ষরে খড়ি দিয়ে লিখে রেখেছেন ‘মনোরঞ্জন কারাগার’। ঘরে এলেম। তার পরদিন শুনি মনোরঞ্জনবাবুর মনোরঞ্জন-কারাগারবাস শেষ হয়ে গেছে। কি বস্তু জোড়াসাঁকোর বাড়ি বুঝে দেখো। কারাগার হলেও সে মনোরঞ্জন। জোড়াসাঁকোর পারে ধরা ‘মনোরঞ্জন কারাগার’।
অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর
০৬. পলতার বাগান অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর পলতার বাগান মনে প’ড়ে দুঃখও পাচ্ছি আনন্দও পাচ্ছি। কতই বা বয়েস তখন আমার। বেশ চলছিল, হঠাৎ একদিন সব বন্ধ হয়ে গেল, ঘরে ঘরে তালা পড়ল। বড়পিসেমশায় ছোটপিসেমশায় আমাদের সবাইকে নিয়ে বোটে রওনা হলেন। দারুণ ঝড়, নৌকো এ-পাশ ও-পাশ টলে, ডোবে বুঝি বা এইবারে। বড়পিসিমা ছোটপিসিমা আমাদের বুকে আঁকড়ে নিয়ে ডাকতে লাগলেন, ‘হে হরি, হে হরি!’ এলুম আবার জোড়াসাঁকোর বাড়িতে। দোতলার নাচঘরে ছিল জ্যেঠামশায়ের বড় একখানি অয়েলপেন্টিং, বসে আছেন সামনের দিকে চেয়ে। ছোটপিসিমা বড়পিসিমা আছড়ে পড়লেন সেই ছবির সামনে, ‘দাদা, এ কী হয়ে গেল আমাদের!’ অদ্ভুত কাণ্ড। যেন চলতে চলতে হঠাৎ সামনে একটা দেয়াল পড়ে গেল; সব কিছু থেমে গেল, ঘড়িটা পর্যন্ত। বড় হয়ে যখন গেলুম পলতার বাগানে, দেখি, বাবার সেই শোবার ঘর ঠিক তেমনি সাজানো আছে, একটু নড়চড় নেই—দেয়ালে ঘড়িটি ঠিক কাঁটায় কাঁটায় স্থির, বাবামশায়ের মৃত্যুর সময়টি তখনও ধরে রেখেছে। ঘরজোড়া মেঝেতে সাদা গালচে, তার নকশাটা যেন পাথরের চাতালে ফুলপাতা হওয়ায় খসে পড়েছে। দেয়ালে বেলোয়ারি কাচে রঙিন সব ফুলের মালা, বাতিনেবা গোলাপি রঙের ফটিকের ঝাড়, দেয়ালগিরি, পর্দা, সবই যেন তখনও একটা মহা আনন্দ-উৎসব হঠাৎ শেষ হয়ে যাওয়ার ম্লান বিশৃঙ্খল রূপ ধরে রয়েছে। মা সেখানকার কোনো জিনিস আনতে দেননি। কিন্তু সেই ঘড়িটি সেবারে আমি নিয়ে আসি, এখনও আছে বেলঘরিয়ার বাড়িতে। আশ্চর্য ঘড়ি—কেমন আপনি বন্ধ হয়ে যায়। সেদিনও বন্ধ হয়ে গেল অলকের মা যেদিন চলে গেলেন, ঠিক জায়গায় কাঁটার দাগ টেনে। অলকরা চাবি ঘোরায় ঘড়ি চলে না। অলককে বললুম, ‘ও ঘড়ি তোরা ছুঁসনে, তোদের হাতে বিগড়ে যাবে। আমার সঙ্গে ওর অনেক কালের ভাব। আমি জানি ওর হাড়হদ্দ; আমার কাছে দে দেখি নামিয়ে।’ ঘড়িটি নামিয়ে এনে দিলে কাছে। আমি তাতে হাত দেবা মাত্র ঘড়ি নতুন করে আবার চলতে লাগল। বহুকালের জিনিস, অনেক মৃত্যুর সময় রেখেছে এ-ঘড়ি। মাসির গল্পে পড়নি এ-ঘড়ির কথা? দিয়েছি গল্পে ঢুকিয়ে। এখন আমার হয়েছে ওই—গল্পের মধ্যে ধরে রাখছি আমার আগের জীবন আর আজকের জীবনেরও কথা। একটি ভাই ছিল আমার—সকলের ছোট, দেখতে রোগা টিংটিঙে, বড় মায়াবী মুখখানি। আমরা ছিলুম তার কাছে পালোয়ান। একটু হুমকি দিলেই ভয়ে কেঁদে ফেলত। বাবামশায় খুব ভালবাসতেন তাকে, আদর করে ডাকতেন ‘র‍্যাট’। তার জন্য আসত আলাদা চকোলেট লজেঞ্জুস বাবামশায় নিজের হাতে তাকে খাওয়াতেন। মা এক-এক সময়ে বলতেন, এত লজেঞ্জুস খাইয়েই এর রোগ সারে না। বাবামশায়ের ‘র‍্যাট’ ছিল তার গোলাপি হরিণেরই সামিল, এত আদরযত্ন। হরিণেরই মত সুন্দর চোখ দুটাে ছিল তার। এখন, সেই ভাই মারা যেতে বাবামশায়ের মন গেল ভেঙে। বললেন, ‘এই জোড়াসাঁকোর বাড়িতে আর থাকব না। পলতায় তখন সবে বাগান কিনেছেন, সবাইকে নিয়ে জোড়াসাঁকোর বাড়ি ছেড়ে উঠলেন গিয়ে সেখানে। চারিদিকে ঝোপঝাড়, মাঝে বিরাট একটা ভাঙা বাড়ি—এ-দেয়াল সে-দেয়াল বেয়ে জল প’ড়ে ছ্যাতলা ধরে গেছে। বড়পিসিমা বললেন, ‘ও গুনু, এ কোথায় নিয়ে এলি? এখানে থাকব কি করে?’ বাবামশায় বললেন, ‘এই দেখোনা দিদি, কদিনেই সব করে ঠিক ফেলছি।’ মাঝে ছিল দুখানি বড় হল, পাশে ছোটবড় নানা আকারের ঘর, ওরই মধ্যে যে কয়টি বাসযোগ্য ঘর পেলেন তাতেই পিসিমারা সব গুছিয়ে নিয়ে বসলেন। এদিকে লোক লেগে গেল চারদিক মেরামত করতে। বাবামশায়ের ইঞ্জিনিয়ার ছিল অক্ষয় সাহা। বাবামশায় নিজের হাতে প্ল্যান করে করে অক্ষয় সাহার হাতে দেন, তিনি আবার প্ল্যান দেখে দেখে তা তৈরি করান। সেই খাতাটি আমি রেখে দিয়েছি, পলতার বাগানের প্ল্যান তাতে ধরা আছে। দেখতে দেখতে সমস্ত বাগানের চেহারা গেল ফিরে ফোয়ারা বসল, ফটক তৈরি হল, লাল রাস্তা এঁকেবেঁকে ছড়িয়ে পড়ল। বন হয়ে উঠল উপবন। পুরনো যে বাড়িটা ছিল সেটা হল বৈঠকখানা। সেখান থেকে হাত পঞ্চাশেক দূরে অন্দরমহল উঠল। বৈঠকখানা থেকে বেরিয়েই একটি তারের গাছঘর—নানারকম গাছ, অরকিড ফুল, তারই মাঝে নানাজাতের পাখি ঝুলছে। সেখান থেকে লাল রাস্তাটি, খানিকটা এগিয়ে ফোয়ারা বসানো হয়েছে মাঝখানে, তা ঘিরে চলে গেছে একেবারে অন্দরমহলে। বাবামশায় বিকেল হলে মাঝে মাঝে এসে বসেন ফোয়ারার ধারে। ফেয়ারাটির মাঝে একটি কচি ছেলের ধাতুমূর্তি আকাশের দিকে হাত তুলে, উঁচু হয়ে ফোয়ারা থেকে জল পড়ছে, আশেপাশে পাখিরা গাইছে, ফুলের সুবাস ভেসে আসছে; তারই মাঝে বাবামশায় বসে। মস্ত বড় একটা বিল তৈরি হল একপাশে। যখন কাটা হত দেখতুম মাঝে মাঝে মাটির স্তম্ভ দাঁড়িয়ে আছে পর পর। শ’য়ে শ’য়ে লোক মাটি কাটছে, ঝুড়িতে করে এনে ফেলছে পাড়ে। সেই ঝিল একদিন ভরে উঠল তলা থেকে ওঠা নতুন জলের লহরে। দলে দলে হাঁস চরে বেড়ায়। ঝিলের এক পারে প্রকাণ্ড একটি বটগাছ, তলায় সারস সারসী, ময়ূর ময়ূরী, রুপোলি সোনালি মরাল দলে দলে খেলা করে। তার ওদিকে হরিণবাগান; পালে পালে হরিণ একদিক থেকে আর একদিকে ছুটে বেড়াচ্ছে। তার ও-দিকে মাঠভরা ভেড়ার পাল; তার পর গেল গোরু, মোষ, ঘোড়া, তার পর হল শাকসবজি তরিতরকারি নানা ফসলের খেত। এই গেল একদিকের কথা। আর একদিকে ফুলের বাগান, বাগানে সুন্দর সুন্দর খাঁচা। সে কি খাঁচা যেন এক-একটি মন্দির; সোনালি রঙ, তাতে নানা জাতের রঙবেরঙের পাখি, দেশবিদেশ থেকে আনানো, বাবামশায়ের বড় শখের। বাগানের পরে খেলার মাঠ। তার পর আম কাঁঠাল লিচু পেয়ারার বন; তার পর আরো কত কি, মনেও নেই সব। বাগান তো নয়, একটা তল্লাট। ফ্রেঞ্চ টেরিটরি থেকে আরম্ভ করে বদ্দিবাটির মিলের ঘাট অবধি ছিল সেই বাগানের দৌড়। সেই তল্লাট দু-মাসের মধ্যেই বাবামশায় সাজিয়ে ফেললেন। অনেক মূর্তির ফরমাশ হল বিলেতে। একটা ব্রোঞ্জের ফোয়ারার অর্ডার দিলেন, পছন্দমত নিজের হাতে এঁকে। পুকুরপাড়ে বোধ হয় বসাবার ইচ্ছে ছিল। ফোয়ারাটি যেন একগোছা ঘাস; তেমনি রঙ, দূর থেকে দেখলে সত্যিকারের ঘাস বলেই ভ্রম হয়। তখনকার দিনে ইণ্ডিয়ান আর্ট বলে তো কিছু ছিল না, বিলিতি আর্টেরই আদর হত সবখানে। পরে আমরা দেখি টি. টমসনের দোকানে বিলেত থেকে তৈরি হয়ে এসেছে সেই ফোয়ারা আর দুটি মানুষপ্রমাণ ক্রীতদাসীর ধাতুমূর্তি বাবামশায়ের ফরমাশি জিনিস। ইন্টারন্যাশন্যাল একজিবিশন হয়, সেখানে তা সাজানো হল। প্রত্যেকটি ঘাসের মুখ দিয়ে ফোয়ারা ছুটছে তালগাছ সমান উঁচু হয়ে। ছ হাজার টাকা শুধু সেই ফোয়ারাটির দাম। সেই একজিবিশন থেকে ফোয়ারাটি মূর্তিটি কোন দেশের এক রাজা কিনে নিলেন। ভালো ভালো ফুলদানি, কাচের ফুলের তোড়া, দেখলে তাক লাগে। জ্যেঠামশায় এলেন পলতার বাগানে; বাবামশায় ঘুরে ঘুরে তাকে সব দেখাতে লাগলেন। দেখতে দেখতে বাবামশায়ের ঘরে এলেন। সেই ঘরে ঢুকে জ্যেঠামশায় বললেন, ‘বাঃ গুনু, তোমার মালী তো চমৎকার তোড়া বেঁধেছে। যাবার সময়ে আমাকে এমনি একটি তোড়া বেঁধে দিতে বোলো।’ বাবামশায় বললেন, ‘এ কাচের ফুল, বড়দা তুমি বুঝতে পারনি?’ জ্যেঠামশায়ের তখন হো-হো করে হাসি, ‘আমি আচ্ছা ঠকেছি তো। একটুও বুঝতে পারিনি।’ বাবামশায় প্রায়ই কলকাতায় যেতেন, নানারকম জিনিসপত্তর কিনে নিয়ে আসতেন। একদিন এলেন, একঝাঁক হাঁস নিয়ে, ঠিক যেন চিনেমাটির খেলনার হাঁস; মুঠোর মধ্যে তা পোরা যায়, সাদা ধবধব করছে। সেই হাঁসগুলি নিয়ে নিয়ে ছেড়ে দেওয়ালেন ঝিলে; খেলা করতে থাকবে, সেইখানেই বাসা বাঁধবে, বাচ্চ পাড়বে জলের কিনারায় ঘাসের ঝোপে। পরদিন ভোরে গেছেন হাঁসগুলিকে খাওয়াতে ; দেখেন একটি হাঁসও বেঁচে নেই, ঝিলের জলে রাশ রাশ সাদা সাদা পালক ছেঁড়া পদ্মের পাপড়ির মত ভাসছে। ছোটপিসিমা বললেন, ‘তোর যেমন কাণ্ড, অতটুকু-টুকু হাঁসগুলোকে এমনি ছেড়ে রাখে? রাতারাতি শেয়ালে সব খেয়ে গেছে।’ আর একবার মনে আছে, বাবামশায় বসে আছেন ফোয়ারার ধারে। অন্দরমহলের সামনে বড় বড় প্যাকিং বাক্স এসেছে, চাকররা খুলছে হাতুড়ি বাটালি দিয়ে। প্রায়ই নানা জায়গা থেকে এইরকম প্যাকিং বাক্স আসে বাবামশায়ের ফরমাশি জিনিসে ভরা। তিনি কাছে বসে চাকরদের দিয়ে তা খোলান; আমার খুব ভালো লাগে দেখতে কী বের হয় বাক্সগুলো থেকে। চাকরদাসীদের এড়িয়ে কখনও কখনও সেখানে গিয়ে দাঁড়াই। তা সেদিন বের হল বাক্স থেকে দুটি কাচের ফুলদানি, একটি গোলাপি ডাটার উপর টিউলিপফুল, ফুলে শিশির পড়ছে ফোঁটা ফোঁটা, দুপাশে দুটি সোনালি পাতা উঠে দু দিকে ছড়িয়ে পড়েছে। মার চুল বাঁধবার গোল একটি আয়না ছিল, পরে মা সেটি অলকের মাকে দিয়ে দেন। তিনি যতদিন ছিলেন তাতেই মুখ দেখেছেন। এখন সেই আয়নার যা দুর্দশা; আমার ঘরে এনে রেখে দিয়েছে, তার সামনে চুল আঁচড়াতে যাই, কেমন করে ওঠে মন। বলি, ‘আর কেন, নিয়ে যা একে এ ঘর থেকে।’ সেই আয়নার সামনে থাকত টিউলিপফুলের ফুলদানিটি, বরাবর দেখেছি তা। মাঝে একবার এক চাকর সেটি বাজারে নিয়ে গেছে বিক্রি করতে। আর-একটি চাকর খোঁজ পেয়ে তাড়াতাড়ি উদ্ধার করে আনে। আমি বললুম ‘ও পারুল, এটা যত্নে তুলে রাখে। এ কি জিনিস, তা তোমরা বুঝবে না, মা চুল বাঁধতে বসতেন, টিউলিপফুলের ছায়া আর মার মুখের ছায়া এই দুটি ছায়া পড়ত আয়নাতে। এখনও যেন দেখতে পাই সেই ছবি। সোনালি পাতা দুটি এখনও তেমনি ঝকঝক করছে। আমার বাল্যস্মৃতিতে এই টিউলিপফুল ও আয়নার কাহিনী আরো স্পষ্ট লেখা আছে। আর অন্য ফুলদানিটি ছিল, ক্র্যাক্ড চায়না, সবুজ রং, তার গায়ে হাতে আঁকা নীল হলুদ দুটি পাখি আর লতাপাতা কয়েকটি। ভারি সুন্দর সেই ফুলদানিটি থাকত বাবামশায়ের আয়নার টেবিলে। সেটি গেল শেষটায় বউবাজারে, কি হল কে জানে! বাবামশায় তো এমনি করে বাগানবাড়ি ঘর সাজাচ্ছেন। আমরা ছোট, কিছু তেমন জানিনে বুঝিনে। থাকতুম অন্দরমহলে। মাঝে মাঝে ঈশ্বরবাবু বেড়াতে নিয়ে যেতেন গঙ্গার ধারে বিকেলের দিকে। রাস্তাঘাট তখন ছিল না তেমন। এখানে ওখানে মড়ার মাথার খুলি। চলতে চলতে থমকে দাড়াই। ঈশ্বরবাবু বলেন, ‘ছুঁয়ো-টুয়োনা, ভাই, ও-সব।’ আমরা একটা ডাল বা কঞ্চি নিয়ে খুলিগুলি ঠেলতে ঠেলতে গঙ্গায় ফেলে দিয়ে বলি, ‘যা, উদ্ধার পেয়ে গেলি।’ ওই ছিল এক খেলা। দু-বেলা হেঁটেই বেড়াতুম। সেই সময়ে পলতার বাগানে একবার ঠিক হয়, দাদা বিলেতে যাবেন। সাজপোশাক সব তৈরি করবার ফরমাশ গেল কলকাতায় সাহেব দরজির দোকানে। বাবামশায় বললেন, ‘মেজদা আছেন বিলেতে, গগন বিলেত যাক। সতীশ আছে জর্মনিতে, সমর সেখানে যাবে।’ আমাকে দেখিয়ে, বড়পিসিমাকে বললেন, ‘ও থাকুক এখানেই। আমার সঙ্গে ঘুরবে, ইণ্ডিয়া দেখবে, জানবে।’ তখন থেকেই সকলে আমার বিদ্যেবুদ্ধির আশা ছেড়ে দিয়েছিলেন। বুঝেছিলেন, ওসব আমার হবে না। বিদেশ তো যাওয়াই হল না, এদেশেও আর বাবামশায়ের সঙ্গে ঘোরা হয়নি। তবে বাবামশায় যে বলেছিলেন ‘ইণ্ডিয়া দেখবে জানবে’, তা হয়েছে। ভারতবর্ষের যা দেখেছি চিনেছি তিনি থাকলে খুশি হতেন দেখে। পলতার বাগানে মাস ছয়েক কেটেছে; বাগান সাজানো হয়েছে। বিনয়িনীর বিয়ের ঠিকঠাক, এবারে জামাইষষ্ঠীর দিন পাত্র দেখা হবে। বাবামশায়ের ইচ্ছে হল বন্ধুবান্ধব সবাইকে বাগানে ডেকে পার্টি দেবেন। আয়োজন শুরু হল, যেখানে যত আত্মীয়স্বজন বন্ধুবান্ধব সাহেবসুবো, কেউই বাদ রইল না। কেবল আসতে পারেননি একজন, বলাই সিংহ, বাবামশায়ের ক্লাসফ্রেণ্ড। শেষ বয়েস অবধি তিনি যখনই আসতেন, দুঃখ করতেন, বলতেন, ‘কেন গেলুম না আমি। শেষ দেখা দেখলুম না।’ যাক সে কথা। এখন বিরাট আয়োজন হল। এত লোক আসবে দু-তিন দিন থাকবে বুঝতেই পার ব্যাপার। দিকে দিকে তাঁবু পড়ল। কেক-মিষ্টান্নে, ফুলে-ফলে, আতর-গোলাপে ভরে গেল চারদিক। নাচগানেরও ব্যবস্থা হয়েছে। আমরা ঘোরাঘুরি করছি অন্দর-মহলে। বাবুর্চি-খানসামা টেবিল ভরে স্যাণ্ডউইচ আইসক্রিম সাজাচ্ছে। ছেলেমানুষ খাবার দেখে লোভ সামলাতে পারিনে। ঘুরে ফিরেই সেখানে যাই। নবীন বাবুর্চি এটা সেটা হাতে তুলে দেয়, বলে, ‘যাও যাও, এখান থেকে সরে পড়।’ চলে আসি, আবার যাই। এমনি করে আমাদের সময় কাটছে। ওদিকে বৈঠকখানায় শুরু হয়েছে পার্টি, নাচ, গান। রবিকা, জ্যেঠামশায় ওঁরাও ছিলেন; রবিকার গান হয়েছিল। প্রথম দিন দেশি রকমের পার্টি হয়ে গেল। দ্বিতীয় দিন হল সাহেবসুবোদের নিয়ে ডিনার পার্টি। আমাদের নীলমাধব ডাক্তারের ছেলে বিলেতফেরত ব্যারিস্টার নন্দ হালদার সাহেব টোস্ট প্রস্তাবের পর গ্লাস শেষ করে বিলিতি কায়দামাফিক পিছন দিকে গ্লাস ছুঁড়ে ফেলে দিলেন। অমনি সকলেই আরম্ভ করে দিলেন গ্লাস ছুঁড়ে ফেলতে। একবার করে গ্লাস শেষ হয় আর তা পিছনে ছুঁড়ে ফেলছেন ঝন্‌ন্‌ন্‌ শব্দে চারদিক মুখরিত করে। মনে আছে, খানসামারা যখন লাইন করে করে সাজাচ্ছিল কাচের গ্লাস—গোলাপি আভা, খুব দামি। পরদিন সকালে যখন ঝাটপাট শুরু হল গোলাপের পাপড়ির সঙ্গে গোলাপি কাচের টুকরো স্তূপাকার হয়ে বাইরে চলে গেল। দু-তিনদিন পরে পার্টি শেষ হল, বাবামশায় নিজে দাঁড়িয়ে সকলের খোঁজখবর নিয়ে সব ব্যবস্থা করে অতিথি-অভ্যাগত আত্মীয়-স্বজন বন্ধুবান্ধব সকলকে হাসিমুখে বিদায় দিলেন। অন্দর-মহলে মা পিসিমা ব্যস্ত আছেন জামাইষষ্টীর তত্ত্ব পাঠাতে। এমন সময়ে খবর হল বাবামশায়ের অসুখ। এত হৈ-চৈ হতে হতে কেমন একটা ভয়ঙ্কর আতঙ্কের ছায়া পড়ল সবার মুখে চোখে চলায় বলায়। পিসেমশাইরা ছুটলেন ওষুধ আনতে, ডাক্তার ডাকতে; নীলমাধববাবু হাঁকছেন, ‘বরফ আন্‌, বরফ আন্‌।’ দাসদাসীরা গুজগুজ ফিসফাস করছে এখানে ওখানে। জ্যৈষ্ঠ মাস, ঝড়ের মেঘ উঠল কালো হয়ে, শোঁ-শোঁ বাতাস বইল। ভোরের বেলা পিসীরা আমাদের ঠেলে তুলে দিলে, ‘যা শেষ দেখা দেখে আয়।’ নিয়ে গেল আমাদের বাবামশায়ের ঘরে। বিছানায় তিনি ছট্‌ফট্‌ করছেন। পাশ থেকে কে একজন বললেন, ‘ছেলেদের দেখতে চেয়েছিলে। ছেলেরা এসেছে দেখ।’ শুনে বাবামশায় ঘাড় একটু তুলে একবার তাকালেন আমাদের দিকে, তারপর মুখ ফিরিয়ে নিলেন। মাথা কাত হয়ে পড়ল বালিশে । বড়পিসিমা ছোটপিসিমা চেঁচিয়ে উঠলেন, ‘এ কি, এ কি হল! কাল-জ্যৈষ্ঠ এল রে কাল-জ্যৈষ্ঠ।’ সেইদিন থেকে ছেলেবেলাটা যেন ফুরিয়ে গেল।
অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর
০৭. তার পর গেল বেশ কিছুকাল অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর তার পর গেল বেশ কিছুকাল। একদিন বিয়ে হয়ে গেল, সঙ্গে সঙ্গে জীবনের ধরনধারণ ওঠাবসা সাজগোজ সব বদলে গেল। এখন উলটাে জামা পরে ধুলো পায়ে ছুটোছুটি করবার দিন চলে গেছে। চাকরবাকররা ‘ছোটবাবু মশায়’ বলে ডাকে, দরোয়ানরা ‘ছোট হুজুর’ বলে সেলাম করে। দু-বেলা কাপড় ছাড়া অভ্যেস করতে হল, শিমলের কোঁচানো ধুতি পরে ফিটফাট হয়ে গাড়ি চড়ে বেড়াতে যেতে হল, একটু আধটু আতর ল্যাভেণ্ডার গোলাপও মাখতে হল, তাকিয়া ঠেস দিয়ে বসতে হল, গুড়গুড়ি টানতে হল, ড্রেসসুট বুট এঁটে থিয়েটার যেতে হল, ডিনার খেতে হল, এককথায় আমাদের বাড়ির ছোটবাবু সাজতে হল। বাল্যকালটাতে শিশুমন কি সংগ্রহ করলে তা তো বলে চুকেছি অনেকবার অনেক জায়গায়, অনেকের কাছে। যৌবনকালের যেটুকু সঞ্চয় মন-ভোমরা করে গেছে তার একটু একটু স্বাদ ধরে দিয়েছি, এখনো দিয়ে চলেছি হাতের আঁকা ছবির পর ছবিতে। এ কি বোঝো না? পদ্মপত্রে জলবিন্দুর মত সে সব সুখের দিন গেল। তার স্বাদ পাওনি কি ওই নামের ছবিতে আমার। প্রসাধনের বেলায় জোড়াসাঁকোর বাড়িতে অন্দরমহলে যে সুন্দর মুখ সব, যে ছবি সব সংগ্রহ করলে মন, আমার ‘কনে সাজানো’ ছবিখানিতে তার অনেকখানি পাবে। সুখের স্বপ্ন ভাঙানো যে দাহ সেও সঞ্চিত ছিল মনে অনেকদিন আগে থেকে। সুখের নীড়ে বাসা করেছিলেম, তবেই তো আঁকতে শিখে সে মনের সঞ্চয় ধরেছি ‘সাজাহানের মৃত্যুশয্যা’ ছবিতে। বাল্যে পুতুল খেলার বয়সের সঞ্চয় এই শেষবয়সের যাত্রাগানে, লেখায়, টুকিটাকি ইঁটকাঠ কুড়িয়ে পুতুল গড়ায় যে ধরে যাচ্ছিনে তা ভেবে না। সেই বাল্যকাল থেকে মন সঞ্চয় করে এসেছে। তখনই যে সে সব সঞ্চয় কাজে লাগাতে পেরেছিলেম তা নয়। ধরা ছিল মনে। কালে কালে সে সঞ্চয় কাজে এল; আমার লেখার কাজে, ছবি আঁকার কাজে, গল্প বলার কাজে, এমনি কত কি কাজে তার ঠিক নেই। এই নিয়মে আমার জীবনযাত্রা চলেছে। আমার সঞ্চয়ী মন। সঞ্চয়ী মনের কাজই এই—সঞ্চয় করে চলা, ভালো মন্দ টুকিটাকি কত কি! কাক যেমন অনেক মূল্যবান জিনিস, ভাঙাচোরা অতি বাজে জিনিসও এক বাসায় ধরে দেয় মন-পাখিটিও আমার ঠিক সেইভাবে সংগ্রহ করে চলে যা-তা। সেই সব সংগ্রহ তুমি হিসেব করে গুছিয়ে লিখতে চাও লেখো, আমি বলে খালাস। রোজ বেলা তিনটে ছিল মেয়েদের চুলবাঁধার বেলা। কবিত্ব করে বলতে হলে বলি, প্রসাধনের বেলা। আমাদের অন্দর ও রান্নাবাড়ির মাঝে লম্বা ঘরটায় বিছিয়ে দিত চাকরানীরা চুলবাঁধার আয়না মাদুর আরও নানা উপকরণ ঠিক সময়ে। মা পিসিমারা নিজের নিজের বউ ঝি নিয়ে বসতেন চুল বাঁধতে। বিবিজি বলে এক গহনাওয়ালী হাজির হত সেই সময়ে—কোন্‌ নতুন বউয়ের কানের মুক্তোর দুল চাই, কোন মেয়ের নাকের নাকছাবি চাই, খোঁপায় সোনারুপোর ফুল চাই, তাই জোগাত। চুড়িওয়ালী এসে ঝুড়ি খুলতেই তুলতুলে হাত সব নিসপিস করত চুড়ি পরতে। ছোট ছোট রাংতা দেওয়া গালার চুড়ি, কাঁচের চুড়ি, কত কৌশলে হাতে পরিয়ে দিয়ে চলে যেত সে পয়সা নিয়ে। চুড়ি বেচবার কৌশলও জানত। চুড়ি পরাবার কৌশলও জানত। কোন্‌ রঙের পর কোন্‌ চুড়ি মানাবে বড় চিত্রকরীর মত বুঝত তার হিসেব সেই চুড়িওয়ালী। বোষ্টমী আসত ঠিক সেই সময়ে ভক্তিতত্ত্বের গান শোনাতে। তোমরা বঙ্কিমবাবুর নভেলে যে সব ছবি পাও সে সব ছবি স্বচক্ষে দেখেছি আমি খুব ছেলেবেলায়। এখনো চুড়ি পরানো ছবি আঁকতে সেই শিশুমনের সংগ্ৰহ কাজ দেয়। হাতের চুড়িগুলি আঁকতে কোন্‌ রঙের পর কোন্‌ রঙের টান দিতে হবে জানি, সেজন্য আর ভাবতে হয় না। তুমি যে সেদিন বললে, সাঁওতালনীদের খোঁপা আপনি কেমন করে ঠিকটি এঁকে দিলেন? খোঁপার কত রকম প্যাঁচ সেই চুল বাঁধার ঘরে বসে শিশুদৃষ্টি শিশুমন ধরেছিল। মা বসে আছেন কাঠের তক্তপোশে, দাসীরা চুল বেঁধে দিচ্ছে ছোট ছোট বউ-মেয়েদের। সে কত রকমের চুল বাঁধার কায়দা খোঁপার ছাঁদ। বোষ্টমী বসে গাইত, ‘কানড়া ছান্দে কবরী বান্ধে।’ সেই কানড়া ছান্দের খোঁপা বাঁধত বসে পাড়াগাঁয়ের দাসীরা। তোমরা খোঁপা তো বাঁধো, জানো সে খোঁপা কেমন? মোচা খোঁপা, কলা খোঁপ, বিবিয়ানা খোঁপা, পৈচে ফাঁস, মনধরা খোঁপার ফাঁস, কত তার বর্ণনা দেব। কত বা এঁকে দেখাব। এইবার আসত ফুলওয়ালী কলাপাতার মোড়কে ফুলমালা হাতে। সেই ফুলমালা নিজের হাতে জড়িয়ে দিতেন মা খোঁপায় খোঁপায়। সন্ধ্যেতারা উঠে যেত, চাঁদ উঠে যেত। সন্ধ্যে হ’লই গোঁপে তা দিয়ে দক্ষিণের বারান্দায় বসে আলসেমি করি—মতিবাবু আসেন, শ্যামসুন্দর আসেন। আমি বসি কোনোদিন ম্যাণ্ডোলিন নিয়ে, কোনোদিন বা এসরাজ নিয়ে। মতিবাবু শিবের বিয়ের পাঁচালি গান— তোরা কেউ যাসনে ওলো ধরতে কুলো কুলবালা, মহেশের ভূতের হাটে এসব ঠাটে সন্ধ্যেবেলা। যেরূপ ধরেছিস তোরা, চিত-উন্মত্ত-করা, চাঁদ যেন ধরায় ধরা, খোঁপায় ঘেরা বকুলমালা। এই রকম বকুলমালা জুইমালায় সাজানো সে-বয়েসের দিনরাতগুলো আনন্দে কাটে। মা রয়েছেন মাথার উপরে, নির্ভাবনায় আছি। ভুবনবাই বলে একটা বুড়ি আসত। মা তাকে বউদের গান শোনাতে বলতেন। সখীসংবাদ, মাথুর, গাইত সে এককালে আমার ছোটদাদামশায়ের আমলে— তোরা যাসনে যাসনে যাসনে, দূতী গেলে কথা কবে না সে নব ভূপতি। যদি যাবি মধুপুরে আমার কথা কোসনে তারে। বৃন্দে, তোর ধরি করে, রাখ এ মিনতি। ফোকলা দাঁতে তোতলা তোতলা সুরে সে এই গান গেয়ে মরেছে। কিন্তু সেই বুড়ি যেটুকখানি ধরে গেছে আমার মনে, সেই বস্তুটুকুও যে আমার কৃষ্ণলীলার কোনো ছবিতে নেই তা মনে কোরো না। নান্‌নীবাই শুনেছি এককালে লক্ষ্ণৌএর খুব নামকরা বাইজি ছিল, রুপোর খাটে শুত, এত ঐশ্বর্য। সর্বস্ব খুইয়ে সে আসে ভিখিরির মতো, পাঁচিলঘেরা গোল চক্করের কাছে বসে গান গায়, এবাড়ি ওবাড়ি থেকে কিছু টাকাপয়সা যা পায় নিয়ে চলে যায়। বুড়োবয়েসেও চমৎকার গলা ছিল তার, এখনকার অনেক ওস্তাদ হার মেনে যায়। শ্রীজানও আসে। সেও বুড়ো হয়ে গেছে। চমৎকার গাইতে পারে। মাকে বললুম, ‘মা, একদিন ওর গান শুনব।’ মা বললেন শ্ৰীজানকে। সে বললে, ‘আর কি এখন তেমন গাইতে পারি। বাবুদের শোনাতুম গান, তখন গাইতে পারতুম। এখন ছেলেদের আসরে কি গাইব?’ মা বললেন, ‘তা হোক, একদিন গাও এসে, ওরা শুনতে চাইছে।’ শ্ৰীজান রাজি হল, একদিন সারারাতব্যাপী শ্ৰীজানের গানের জলসায় বন্ধুবান্ধবদের ডাক দেওয়া গেল। নাটোরও ছিলেন তার মধ্যে। বড় নাচঘরে গানের জলসা বসল। শ্ৰীজান গাইবে চার প্রহরে চারটি গান। শ্ৰীজান আরম্ভ করল গান। দেখতে সে সুন্দর ছিল না মোটেই, কিন্তু কী গলা, কোকিলকণ্ঠ যাকে বলে। এক-একটা গান শুনি আর আমাদের বিস্ময়ে কথা বন্ধ হয়ে যায়। চুপ করে বসে তিনটি গান শুনতে তিন প্রহর রাত্রি। এবারে শেষ প্রহরের গান। বাতিগুলো সব নিবে এসেছে, একটিমাত্র মিটমিট করে জ্বলছে উপরে। ঘরের দরজাগুলি বন্ধ, চারিদিক নিস্তব্ধ, যে যার জায়গায় আমরা স্থির হয়ে বসে। শ্ৰীজান ভোরাই ধরলে। গান শেষ হল, ঘরের শেষ বাতিটি নিবে গেল,—উষার আলো উঁকি দিল নাচঘরের মধ্যে। কানাড়া আর ভৈরবীতে শ্ৰীজান সিদ্ধ ছিল। আর একবার গান শুনেছিলুম। তখন আমি দস্তুরমতো গানের চর্চা করি। কোথায় কে গাইয়ে-বাজিয়ে এল গেল সব খবর আসে আমার কাছে। কাশী থেকে এক বাইজি এসেছে, নাম সরস্বতী, চমৎকার গায়। শুনতে হবে। এক রাত্তিরে ছয়শো টাকা নেবে। শ্যামসুন্দরকে পাঠালুম, ‘যাও, দেখো কত কমে রাজি করাতে পারো।’ শ্যামসুন্দর গিয়ে অনেক বলে কয়ে তিনশো টাকায় রাজি করালে। শু্যামসুন্দর এসে বললে, ‘তিনশো টাকা তার গানের জন্য, আর দুটি বোতল ব্রাণ্ডি দিতে হবে।’ ব্রাণ্ডির নামে ভয় পেলেম, পাছে মার আপত্তি হয়। শ্যামসুন্দর বললে, ‘ব্রাণ্ডি না খেলে সে গাইতেই পারে না।’ তোড়জোড় সব ঠিক। সরস্বতী এল সভায়। স্থূলকায়া, নাকটি বড়িপানা, দেখেই চিত্তির। নাটোর বলেন, ‘অবনদা, করেছ কি। তিনশো টাকা জলে দিলে?’ দুটি গান গাইবে সরস্বতী। নাটোর মৃদঙ্গে সংগত করবেন বলে প্রস্তুত। দশটা বাজল, গান আরম্ভ হল। একটি গানে রাত এগারোটা । নাটোর মৃদঙ্গ কোলে নিয়ে স্থির। সরস্বতীর চমৎকার গলার স্বরে অত বড় নাচঘরটা রমরম করতে থাকল। কি স্বরসাধনাই করেছিল সরস্বতীবাই। আমরা সব কেউ তাকিয়া বুকে, কেউ বুকে হাত দিয়ে স্তব্ধ হয়ে বসে। এক গানেই আসর মাত। গানের রেশে তখনও সবাই মগ্ন। সরস্বতীবাই বললে, ‘আউর কুছ ফরমাইয়ে।’ গান শুনে তাকে ফরমাশ করবার সাহস নেই কারো। এ ওর মুখের দিকে তাকাই। শেষে শ্যামসুন্দরকে বললুম, ‘একটা ভজন গাইতে বলো, কাশীর ভজন শুনেছি বিখ্যাত।’ সে একটি সকলের জানা ভজন গাইলে, ‘আও তো ব্ৰজচন্দ্রলাল।’ সব স্তম্ভিত। আমি তাড়াতাড়ি তার ছবি আঁকলুম, পাশে গানটিও লিখে রাখলুম। গান শেষ হল, সে উঠে পড়ল। দুখানা গানের জন্য তিনশো টাকা দেওয়া যেন সার্থক মনে হল। এমনিতরো নাচও দেখেছিলুম সে আর-একবার। নাটােরের ছেলের বিয়ে, নাচগানের বিরাট আয়োজন। কর্ণাট থেকে নামকরা বাইজি আনিয়েছেন। খুব ওস্তাদ নাচিয়ে মেয়েটি। এসেছে তার দিদিমার সঙ্গে। বুড়ী দিদিমা কালকাবিন্দের শিষ্যা। সভায় বসেছে সবাই। বুড়িটির সঙ্গে নাতনিটিও ঢুকলো; বুড়ি পিছনে বসে রইল, মেয়েটি নাচলে। চমৎকার নাচলে, নাচ শেষ হতে চারদিকে বাহবা রব উঠল। আমার কি খেয়াল হল ওই বুড়িটির নাচ দেখব। নাটোর শুনে বললেন, “অবনদা, তোমার এ কি পছন্দ।’ বললুম, ‘তা হোক, শখ হয়েছে বুড়ির নাচ দেখবার। তুমি তাকে বলো, নিশ্চয়ই এই বুড়ি খুব চমৎকার নাচে।’ নাটোর বুড়িকে বলে পাঠালে। বুড়ি প্রথমটায় আপত্তি করলে, সে বুড়ো হয়ে গেছে, সাজসজ্জাও কিছু আনেনি সঙ্গে। বললুম, কোনো দরকার নেই, তুমি বিনা সাজেই নাচো। বুড়ি নাতনিকে নিয়ে ভিতরে গেল—ওদের নিয়ম, সভায় এক নাচিয়ে উপস্থিত থাকলে আর একজন নাচে না। খানিক পরে বুড়ি নাতনির পাঁয়জোর পরে উড়নিটি গায়ে জড়িয়ে সভায় ঢুকল। একজন সারেঙ্গিতে সুর ধরলে। বুড়ি সারেঙ্গির সঙ্গে নাচ আরম্ভ করলে। বলব কি, সে কি নাচ! এমনভাবে মাটিতে পা ফেলল, মনে হল, যেন কার্পেট ছেড়ে দু-তিন আঙুল উপরে হাওয়াতে পা ভেসে চলেছে তার। অদ্ভুত পায়ে চলার কায়দা; আর কি ধীর গতি। জলের উপর দিয়ে হাঁটল কি হাওয়ার উপর দিয়ে বােঝা দায়। বুড়ির বুড়ো মুখ ভুলে গেলুম, নৃত্যের সৌন্দর্য তাকে সুন্দরী করে দেখালে। আর-একবার ব্লান্ট সাহেব, উডরফ সাহেব, আমরা কয়েকজন দেশী সংগীতের অনুরাগী মিলে মাদ্রাজ থেকে একজন বীনকারকে আনিয়েছিলুম। সপ্তাহে সপ্তাহে রাত নটার পরে আমাদের বাড়িতে সেই বীনকারের বৈঠক বসত। সাহেবসুবাদের জন্য থাকত কমললেবুর শরবত, আইসক্রীম, পান-চুরুটের ব্যবস্থা। রাত্তিরে শহরের গোলমাল যখন থেমে আসত, বাড়ির শিশুরা ঘুমিয়ে পড়ত, চাকরদের কাজকর্ম সারা হত, চারদিক শান্ত, তখন বীণা উঠত বীনকারের হাতে। কাইজারলিঙও একবার এলেন সেই আসরে। বীনকার বীণা বাজিয়ে চলেছে, পাশে কাইজারলিঙ স্থির হয়ে চোখ বুজে ব’সে, চেয়ে দেখি বাজনা শুনতে শুনতে তার কান গাল লাল টকটকে হয়ে উঠল। স্বরের ঠিক রংটি ধরল সাহেবের মনে। ঝাড়া একটি ঘণ্টা পূর্ণচন্দ্রিকা রাগিণীটি বাজিয়ে বীনকার বীন রাখলে। মজলিস ভেঙে আর কারো মুখে কথা নেই, আস্তে আস্তে সব যে যার বাড়ি ফিরে গেলেন।
অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর
০৮. জোড়াসাঁকোর বাড়ির দোতলা অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর জোড়াসাঁকোর বাড়ির দোতলার দক্ষিণের বারান্দা—পুরুষানুক্রমে আমাদের আমদরবার, বসবার জায়গা; প্রকাণ্ড বারান্দা, পুব থেকে পশ্চিমে বাড়িসমান লম্বা দৌড়। তারই এক-এক খাটালে এক-একজনের বসবার চৌকি, সে চৌকি নড়াবার জো ছিল না। ঈশ্বরবাবুর এক, নবীনবাবুর এক, ছোটপিসেমশায়ের এক, বড়পিসেমশায়ের এক, নগেনবাবুর এক, কালাচাঁদবাবুর এক, অক্ষয়বাবুর এক, বৈকুণ্ঠবাবুর এক, বাবামশায়ের এক—এমনি সারি সারি চৌকি দুদিকে। এঁরা সকলেই এক-এক চরিত্র, এঁরা অনেকে বাইরের হয়েও একেবারে জোড়াসাঁকোর ঘরের মত ছিলেন। বাবামশায়ের পোষা কাকাতুয়ার পর্যন্ত একটা খাটাল ছিল, দেয়ালে নিজের স্থান দখল করে বসে থাকত, সেও যেন এক সভাসদ্‌। সকাল-বিকেল আড্ডার জায়গা ছিল ওই বারান্দা, চিরকাল দেখে এসেছি। গুড়গুড়ি ফরসি হুঁকো বৈঠকে সাজিয়ে দিত চাকররা। কাছারির কাজও চলত সেখানে, দেওয়ান আসত, আসত বয়স্য, পারিষদ। গান, খোসগল্প, হাসি কত কী হত। দেখেছি, ঈশ্বরবাবু নবীনবাবু ওঁরা যে যার জায়গায় হুঁকো খাচ্ছেন, বাবামশায় আছেন ইজিচেয়ারে বসে, ড্রইং বোর্ড কোলে প্ল্যান আঁকছেন। বারান্দায় জোড়া জোড়া থাম, তার মাঝে মাঝে বড় বড় খাটাল, পুবধারে একটা বড় খিলেন, পশ্চিমধারে তেমনি আর-একটা সত্তর-আশি ফুট লম্বা, চওড়াও অনেকটা। ঈশ্বরবাবু আসতেন রোজ সকালে লাঠি ঠকাস ঠকাস করতে করতে। হাতে রুমালে বাঁধা কচি আম, কোনোদিন বা আর কিছু, যা নতুন বাজারে উঠেছে। বাজারে যে ঋতুতে যা কিছু নতুন উঠবে এনে দিতে হবে, এই ছিল তার সঙ্গে বাবামশায়ের কথা। নিত্য যাঁরা আসতেন আমদরবারে, তাঁদের কথা তো বলেইছি, অন্যরা কেউ এলে তাঁদেরও বসানো হত ওখানেই। আপিস যাবার আগে পর্যন্ত দক্ষিণের বারান্দায় তাঁদের দরবার বসত। তার পর দক্ষিণের বারান্দা খালি—যে যার বাড়ি চলে গেলেন, বাবামশায় উঠে এলেন, বিশ্বেশ্বর ফরসি গুড়গুড়ি তুলে নিলো। আমরা তখন ঢুকতুম সেখানে; নবীনবাবু হয়তো তখনও বসে আছেন, তাঁকে ধরতুম ফ্যান্সি ফেয়ারে নিয়ে যেতে হবে, ইডেন গার্ডেনে বেড়িয়ে আনতে হবে। বাবামশায়ের দরবারে আমাদের দরখাস্ত পেশ করতে হবে, তিনি হুকুম দেবেন তবে যেতে পারব। আমাদের হয়ে নবীনবাবুই সে কাজটা করতেন। পুজোর সময় দক্ষিণের বারান্দায় কত রকমের ভিড়। চীনেম্যান এল, জুতোর মাপ দিতে হবে। আমাদের ডাক পড়ত তখন দক্ষিণের বারান্দায়। খবরের কাগজ ভাঁজ করে সরু ফিতের মত বানিয়ে চীনেম্যান পায়ের মাপ নিত, এখনও তার আঙুলগুলো দেখতে পাচ্ছি। দরজি এল, ঈশ্বরবাবু হাঁকলেন, ‘ওহে, ওস্তাগর এসেছে, এসো এসো ভাইসব, মাপ দিতে হবে গায়ের।’ ফিতে খুলে দাঁড়িয়ে দরজি, মোটা পেট, গায়ে সাদা জামা, মাথায় গম্বুজের মত টুপি, সে আমাদের পুতুলের মত ঘুরিয়ে ফিরিয়ে মাপ নিয়ে ছেড়ে দিতে ঈশ্বরবাবুও উঠে এগিয়ে এসে দাঁড়ালেন, ‘আমারও গায়ের মাপটা নিয়ে নাও, একটা সদ্‌রী—পুজো আসছে’ বলে বাবামশায়ের দিকে তাকান। বড়বাজারের পাঞ্জাবী শালওয়ালা বসে আছে নানারকম জরির ফুল দেওয়া ছিট, কিংখাবের বস্তা খুলে। বাবামশায়ের পছন্দমত কাপড় কাটা হলে অমনি নবীনবাবু বলতেন, ‘বাবা, আমার নলিনেরও একটা চাপকান হয়ে যাক এই সঙ্গে।’ আতরওয়ালা এসে হাজির, গেব্রিয়েল সাহেব, আমরা বলতুম তাকে গিব্রেল সাহেব—একেবারে খাস ইহুদি—যেন শেক্সপিয়রের মাৰ্চেণ্ট অব ভেনিসের শাইলকের ছবি জ্যান্ত হয়ে নেমে এসেছে জোড়াসাঁকোর দক্ষিণের বারান্দায় ইস্তাম্বুল আতর বেচতে—হুবহু ঠিক তেমনি সাজ, তেমনি চেহারা। গিব্রেল সাহেবের ঢিলে আচকান, হাতকাটা আস্তিন, সরু সরু একসার বোতাম ঝিক ঝিক করছে; ঔরঙ্গজেবের ছবিতে এঁকে দিয়েছি সেরকম। সে আতর বেচতে এলেই ঈশ্বরবাবু অক্ষয়বাবু সবাই একে একে খড়কেতে একটু তুলো জড়িয়ে বলতেন, ‘দেখি দেখি, কেমন আতর’ বলে আতরে ডুবিয়ে কানে গুঁজতেন। পুজোর সময় আমাদের বরাদ্দ ছিল নতুন কাপড়, সিল্কের রুমাল। সেই রুমালে টাকা বেঁধে রমানাথ ঠাকুরের বাড়িতে পুজোর সময় যাত্রাগানে প্যালা দিতুম। বলিনি বুঝি সে গল্প? হবে, সব হবে, সব বলে যাব আস্তে আস্তে। নন্দফরাশের ফরাশখানার মত পুরোনো গুদোমঘর বয়ে বেড়াচ্ছি মনে। কত কালের কত জিনিসে ভরা সে ঘর, ভাঙাচোড়া দামি অদামিতে ঠাসা। যত পারো নিয়ে যাও এবারে—হালকা হতে পারলে আমিও যে বাঁচি। হ্যাঁ, সেই সিল্কের রুমাল গিব্রেল সাহেবই এনে দিত। আর ছিল বরাদ্দ সকলের ছোট ছোট এক-এক শিশি আতর। কতরকম লোক আসত, কত রকম কাণ্ড হত ওই বারান্দায়। একবার মাইক্রসকোপ এসেছে বিলেত থেকে, প্যাকিং বাক্স খোলা হচ্ছে। কি ঘাস দিয়ে যেন তারা প্যাক করে দিয়েছে, বাক্স খোলা মাত্র বারান্দা সুগন্ধে ভরপুর। ‘কি ঘাস, কি ঘাস’, বলে মুঠো মুঠো ঘাস ওখানে যারা ছিলেন সবাই পকেটে পুরলেন, বাড়ির ভিতরেও গেল কিছু, মেয়েদের মাথা ঘষার মসলা হবে। মাইক্রসকোপ রইল পড়ে, ঘাস নিয়েই মাতামাতি, দেখতে দেখতে সব ঘাস গেল উড়ে। আমিও এক ফাঁকে একটু নিলুম, বহুদিন অবধি পকেটে থাকত হাতের মুঠোয় নিয়ে গন্ধ শুঁকতুম। তার পর আর একবার এল ওই বারান্দায় এক রাক্ষস, কাঁচা মাংস খাবে। সকাল থেকে যদু মাস্টার ব্যস্ত, আমাদের ছুটি দিয়ে দিলেন রাক্ষস দেখতে। ‘দেখবি আয়, দেখবি আয়, রাক্ষস এসেছে’ বলে ছেলের দল গিয়ে জুটলুম সেখানে । মা পিসিমারাও দেখছেন আড়ালে থেকে খড়খড়ির ফাঁক দিয়ে। ছেলে বুড়ো সবাই সমান কৌতুহলী। রাবণের গল্প পড়েছি, সেই দেশেরই রাক্ষস, কৌতুহল হচ্ছে দেখতে, আবার ভয়-ভয়ও করছে। ‘এসেছে, এসেছে, আসছে, আসছে’ রব পড়ে গেল। বাবামশায়ের পোষা খরগোস চরে বেড়াচ্ছে বারান্দায়—কেদারদা চেঁচিয়ে উঠলেন, খরগোসগুলিকে নিয়ে যা এখান থেকে, রাক্ষস খেয়ে ফেলবে।’ শুনে আমরা আরো ভীত হচ্ছি, না জানি কি। খানিক পরে রাক্ষস এলো, মানুষ—বিশ্বেশ্বরের মতই দেখতে রোগাপটকা অতি ভালোমানুষ চেহারা—দেখে আমি একেবারে হতাশ। চাকররা একটা বড় গয়েশ্বরী থালাতে গোটা একটা পাঁঠা কেটে টুকরো টুকরো করে নিয়ে এল রান্নাঘর থেকে। সেই মাংসের নৈবেদ্য সামনে দিতেই খানিকটা নুন মেখে লোকটা হাপ্‌ হাপ্‌ করে সব মাংস খেয়ে টাকা নিয়ে চলে গেল। সেই এক রাক্ষস দেখেছিলেম ছেলেবেলায়, কাঁচাখোর। সেকালের লোকদের ছোট বড় সবারই এক-একটা চরিত্র থাকত। অক্ষয়বাবু আসতেন ফিটফাট বাবুটি সেজে। তার কথা তো অনেক বলেছি আগের সব গল্পে। সে সময়ে ফ্যাশান বেরিয়েছে বুকে মড়মড়ে পেলেট দেওয়া চোস্ত ইস্তিরি করা শার্ট, তাই গায়ে দিয়ে এসেছেন অক্ষয়বাবু। কালো রঙ ছিল তার, বাবরি চুল, গোঁফে তা, কড়ে আঙুলে একটা আংটি। গানও গাইতেন মাঝে মাঝে, খুব দরাজ গলা ছিল। গান কিছু বড় মনে নেই, সুরটাই আছে কানে এখনও বড় বড় রাগরাগিণীর—আমি তখন কতটুকুই বা, ছয়-সাত বছর বয়স হবে আমার। এখন, অক্ষয়বাবু তো বসে আছেন চৌকিতে সেই নতুন ফ্যাশানের পেলেট দেওয়া শার্ট গায়ে দিয়ে। আমি কাছে গিয়ে অক্ষয়বাবুর বুকের মড়মড়ে পেলেটে হাত বোলাতে বোলাতে বললুম, “অক্ষয়বাবু এ যে শার্সি খড়খড়ি লাগিয়ে এসেছেন।’ যেমন বলা বারান্দাসুদ্ধ সকলের হো-হো হাসি, ‘শার্সি খড়খড়ি’। হাসি শুনে ভাবলুম কি জানি একটা অপরাধ করে ফেলেছি। চোঁচাঁ দৌড় সেখান থেকে। বিকেলে আবার শুনি, সেই আমার ‘শার্সি খড়খড়ি’ পরার কথা নিয়ে হাসি হচ্ছে সবাইকার। দরজি চীনাম্যান, তারাও এক-একটা টাইপ, তাই চোখের সামনে স্পষ্ট তাদের দেখতে পাই এখনো। ঈশ্বরবাবু শিখিয়ে দিয়েছিলেন চীনে ভাষা, ইরেন দে পাগলা, উড়েন দে পাগলা, কা সে।’ ভাবটা বোধ হয়, জুতো এ পায়েও গলাই ও পায়েও গলাই, দুপায়েই লাগে কষা। চীনাম্যান এলেই আমরা চীনেম্যানকে ঘিরে ঘিরে ওই চীনে ভাষা বলতুম, আর সে হাসত। ঢিলেঢালা পাজামা, কালো চায়নাকোট গায়ে, ঠিক তার মতই টাক-টিকিতে সেজে এক চীনেম্যানরূপে বেরিয়েছিলুম ‘এমন কার্য আর করব না’ প্রহসনে। শ্ৰীকণ্ঠবাবু আসতেন। এই এখানকার রায়পুর থেকে যেতেন মাঝে মাঝে কলকাতায় কর্তামশায়ের কাছে। বুড়োর চেহারা মনে আছে, পাকা আমটির মত গায়ের রঙ, জরির টুপি মাথায়। গাইতেন চৌকিতে বসে ‘ব্রহ্মকৃপাহি কেবলম্’ আর ‘পুণ্যপুঞ্জেন যদি প্রেমধনং কোঽপি লভেৎ’। আমরাও দুহাত তুলে গাইতুম, ‘কোঽপি লভেৎ কোঽপি লভেৎ’। সেদিন শুনলুম ৭ই পৌষে ছাতিম তলায় এই গান। শুনেই মনে হল শ্ৰীকণ্ঠবাবুর মুখে ছেলেবেলায় শেখা গান। ষাট-সত্তর বছর পরে এই গান শুনে মনে পড়ে গেল সেই দক্ষিণের বারান্দায় শ্ৰীকণ্ঠবাবু গাইছেন, আমরা নাচছি। ছোট্ট একটি সেতার থাকত সঙ্গে, সেইটি বাজিয়ে আমাদের নাচাতেন। বড় ভালোবাসতেন তিনি ছোট ছেলেদের। কর্তা মশায়ের সঙ্গে তাঁর খুব ভাব ছিল। তারই বাড়িতে আসতে মাঝপথে তিনি বিশ্রাম নিতেন ওই ছাতিমতলায়। স্টেশন থেকে পালকি করে এসে এইখানে নেমে বিশ্রাম নিয়ে তবে যেতেন রায়পুর সিংহিদের বাড়ি। বড় ভালো লেগেছিল কর্তামশায়ের ছাতিমতলাটি। তাই তিনি এখানে নিজের একটি আশ্রম প্রতিষ্ঠা করবার কল্পনা করেছিলেন। এ সমস্তই ছিল তখন শ্ৰীকণ্ঠবাবুর দখলে। তখনকার দিনে গুরুজনদের মান কি দেখতুম। আমদরবার বসেছে, খবর এল, কালীকৃষ্ণ ঠাকুর পাথুরেঘাটা থেকে দেখা করতে আসছেন। শুনে কি ব্যস্ত সবাই। তোল্‌ তোল্‌ হুঁকো কলকে সব তোল্‌, সরা এখান থেকে এসব। বাবামশায় ঢুকলেন ঘরে, পরিষ্কার জামাকাপড় পরে তৈরি। গুরুজন আসছেন, ভালোমানুষ সেজে সবাই অপেক্ষা করতে লাগলেন। ছোট ছেলেদের মত গুরুজনকে ভয় করতেন তাঁরা; গুরুজনরা এলে সমীহ করা, এটা ছিল। কর্তামশায় এসেছিলেন, বলেছি তো সে গল্প—তাড়াহুড়ো, দেউড়ি থেকে উপর পর্যন্ত ঝাড়পোঁছ, যেন বর আসছেন বাড়িতে। জোড়াসাঁকোর বাড়ির দক্ষিণ বারান্দার আবহাওয়া, এ যে কি জিনিস! সেই আবহাওয়াতেই মানুষ আমরা। এবাড়ির যেমন দক্ষিণের বারান্দা ওবাড়িরও তেমনি দক্ষিণের বারান্দা। পিসিমাদের মুখে শুনতুম ওবাড়ির দক্ষিণের বারান্দায় বিকেলে দাদামশায়ের বৈঠক বসত। যখন-তখন জুঁই আর বেলফুলের সুগন্ধে সমস্ত বাড়ি পাড়া তর্‌ হয়ে যেত। দাদামশায়ের শখ, বসে বসে ব্যাটারি চালাতেন। জলে টাকা ফেলে দিয়ে তুলতে বলতেন। একবার এক কাবুলিকে ঠকিয়েছিলেন এই করে। জলে টাকা ফেলে ব্যাটারি চার্জ করে দিলেন। কাবুলি টাকা তুলতে চায়, হাত ঘুরে এদিকে ওদিকে বেঁকে যায়, টাকা আর ধরতে পারে না কিছুতেই। তার পর জ্যেঠামশায়ের আমলে তিনি বসলেন সেখানে। কৃষ্ণকমল ভট্টাচার্য, বড় বড় পণ্ডিত ফিলজফার আসতেন। স্বপ্নপ্রয়াণ পড়া হবে, এ বারান্দা থেকে ছুটলেন বাবামশায়রা সে বারান্দায়। থেকে থেকে জ্যেঠামশায়ের হাসির ধ্বনি পাড়া মাৎ করে দিত। সে হাসির ধুম আমরাও কানে শুনতুম। তার পর আমাদের আমলে যখন বাড়ির দক্ষিণের বারান্দায় বৈঠক বসবার বয়স হল তখন সেকালের যাঁরা ছিলেন, মতিবাবু, অক্ষয়বাবু, ঈশ্বরবাবু, নবীনবাবু— আর দাদামশায়ের বৈঠকের একটি বুড়ো, কি মুখুজ্যে, নামটা মনে আসছে না, তাঁর ছবি আঁকা আছে, চেহারা গান গলার স্বর সব ধরা আছে মনে, নামটা এরি মধ্যে হারিয়ে গেল, তিনি গাইতেন—দাদামশায়ের বৈঠকখানায়, মাঝে মাঝে আমাদেরও গান শোনাতেন, দাদামশায়ের গল্প বলতেন—এই তিন কালের তিন-চারটি বুড়ো নিয়ে আমরা তিন ভাই বৈঠক জমালেম। সেই দক্ষিণের বারান্দাতেই, ঠিক তেমনি হুঁকো কলকে ফরসি সাজিয়ে বসি। বাবামশায় যেখানে বসতেন সেখানে দাদা বসে ছবি আঁকেন, একটু তফাতে আমি বসি পুবের বড় খিলেনের ধারে, তার পর বসেন সমরদা। আমাদের বৈঠকেও সেইরকম শালওয়ালা আসে, নতুন নতুন বন্ধুবান্ধব আসে। সামনের বাগানে সেই সব গাছ; দাদামশায়ের হাতে পোঁতা নারকেলগাছ, কাঁঠালগাছ, বাবামশায়ের শখের বাগানে সেই ফোয়ারায় জল ছাড়ে, সেই ভাগবত মালী, সব দেখা যায় বারান্দায় বসে। বিকেলে পাথর-বাঁধানো গোল চাতালে বসি, কাঁচের ফরসিতে সেই গোলাপজলে গোলাপপাপড়ি মিশিয়ে তামাক টানি। কাল বদলেও যেন বদলায়নি, তিন পুরুষের আবহাওয়া খানিক খানিক বইছে তখনো দক্ষিণের বারান্দায়। ড্রামাটিক ক্লাবের শ্রাদ্ধ হবে, সেই বারান্দায় লম্বা ভোজের টেবিল পড়ল, লম্বা উর্দি পরে সেই নবীন বাবুর্চি, সেই বিশ্বেশ্বর হুঁকোবরদার দেখা দিল, সেই সব পুরানো ঝাড়লন্ঠনের বাতি জ্বলল, প্লেট গ্লাস সাজানো হল। তিন পুরুষের সেই সব গানের সুর এসে মেশে আবার নতুন নতুন গানের সঙ্গে, রবিকার গানের সঙ্গে, দ্বিজুবাবুর গানের সঙ্গে। আরো হলে আমলে যখন আমরা আর্টিস্ট হয়ে উঠেছি, আর্ট সোসাইটির মেম্বর হয়েছি, বড় বড় সাহেবসুবো জজ ম্যাজিস্ট্রেট লাট আসেন বাড়িতে—কমলালেবুর শরবত, পানতামাক, বেলফুলে ভরে যায় সেই দক্ষিণের বারান্দা। বারান্দার পাশের বড় স্টুডিয়োতেই বীনকারের বীণা গভীর রাত্রে থেমে যায় সবাইকে স্তব্ধ করে দিয়ে। আবার যখন বাড়িতে কারো বিয়ে, লৌকিকতা পাঠাতে হয়, মেয়েরা থালা সাজিয়ে দেয়, সেই সওগাতের থালায় থালায় ভরে যায় সেই লম্বা বারান্দা। তোমরা ভাবো, ঘরের ভিতরে স্টুডিয়োতে বসে ছবি আঁকতুম, তা নয়। বারান্দার এক দিকে আমি আর-একদিকে ছাত্ররা বসে যেত। মুসলমান ছাত্র আমার শমিউজমা একদিকে আসন পেতে বসে সারাদিন ছবি আঁকে, সন্ধ্যে হলে মক্কামুখো হয়ে নমাজ পড়ে নেয় ওই বারান্দাতেই। অবারিত দ্বার দক্ষিণের বারান্দায়, সবাই আসছে, বসছে, ছবি আঁকছি, গান চলছে, গল্পও হচ্ছে। এমনি করেই ছবি এঁকে অভ্যস্ত আমি। অবিনাশ পাগলা সেও আসে, কত রকম বুজরুকি দেখাতে লোক আনে। একদিন একটা লোক ফুঁ দিয়ে গোলাপের গন্ধ বাড়িময় ছড়িয়ে চলে গেল। বারান্দা যেন একটা জীবন্ত মিউজিয়াম। নানা চরিত্রের মানুষ দেখতে রাস্তায় বেরতে হত না, তার আপনিই উঠে আসত সেখানে। পূর্ণ মুখুজ্যে, মাথায় চুল প্রায় ছিল না, চাঁচা ছোলা নাক-মুখের গড়ন। তিনি মারা যাচ্ছেন, মাকে বলে পাঠালেন, ‘মা, আমি গঙ্গাযাত্রা করব।’ মা আমাদের বললেন, ‘বন্দোবস্ত করে দে।’ আমরা বন্দোবস্ত করে দিলুম। মারা গেলে যেভাবে নিয়ে যায় সেইভাবে বাঁশের খাটিয়া এনে তাঁকে তাতে শুইয়ে নিয়ে চলল। তেতলায় থেকে মা’রা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখছেন, দোতলার বারান্দা থেকে আমরাও দেখছি— বুড়ো খাটিয়ায় শুয়ে সজ্ঞানে চারদিকে তাকাতে তাকাতে চলেছে। উপরে মাকে দেখতে পেয়ে দু হাত জুড়ে প্রণাম জানালেন—ঘাড় নেড়ে ইঙ্গিতে আমাদের জানালে, যাচ্ছি, ভাই সব। সরকার বরকার কাঁধে করে নিয়ে গেল তাকে ‘হরি বোল’ দিতে দিতে। এসবই দক্ষিণের বারান্দা থেকে দেখতুম, যেন বক্সে বসে এক-একটি সিন দেখছি। পরেশনাথের মিছিল গেল, বিয়ের শোভাযাত্রা গেল, আবার পূর্ণ মুখুজ্যেও গেল। মতিবাবু, তার ছবি তো দেখছ, দাদা এঁকেছেন—চেয়ারের উপর পা তুলে বসে বুড়ো হুঁকো খাচ্ছেন। হুঁকো খেয়ে খেয়ে গোঁফ হয়ে গিয়েছিল সোনালি রঙের। সকালে হয় আর্টের কাজ, সন্ধ্যেয় আসর জমাই মতিবাবুকে নিয়ে, গানের চর্চা করি। আমি ম্যাণ্ডোলিন বা এসরাজ বাজাই, তিনি পাঁচালি বা শিবের বিয়ে গেয়ে চলেন। বড় সরেশ লোক ছিলেন। ছেলের বিয়েতে আটচালা বাঁধতে হবে, মতিবাবু ছাড়া আর কেউ সে কাজ পারবে না। শহরের কোথায় কোথায় ঘুরে কাকে কাকে ধরে নকশামাফিক আটচালা বাঁধাবেন একপাশে বসে বুড়ো তামাক টানতে টানতে। এই মতিবাবু মরবার পরও দেখা দিয়েছিলেন, সে এক আশ্চর্য গল্প। মতিবাবুর একবার দুরন্ত অসুখ। ছেলে এসে বললে, আর বাঁচবেন না। দেশে নিয়ে গেল। খবরাখবর নেই, ভাবছি কি হল তাঁর। অনেকদিন পরে একদিন ফিরে এলেন, দিব্যি ফিটফাট লাল চেহারা নিয়ে। বললুম, ‘এমন সুন্দর চেহারা হল কি করে? মনেই হয় না যে অসুখে ভুগে উঠেছেন।’ তিনি বললেন, ‘না, এবার তো সেরে ওঠবার কথাই ছিল না। অসুখে ভুগছি, ডাক্তার-কবিরাজের ওষুধ খাচ্ছি। কিছুতেই কিছু না। শেষে একদিন গাঁয়ের এক মৌলবী বললে, ঠাকুর, ও ওষুধপত্রে কিছু হবে না। আমার একটি ওষুধ খাবেন? একটু করে সুরুয়া বানিয়ে এনে দেব রোজ। কতদিন যাবৎ ভুগছি, মৌলবীর কথাতেই রাজি হলেম। সেই সুরুয়া খেতে খেতেই দেখুন চেহারা কি রকম বদলে গেল।’ বললুম, ‘ভালোই তো, তা এখনো একটু একটু সুরুয়া চলুক না, তৈরি করে দেবে বাবুর্চি।’ তিনি বললেন, ‘না, আর দরকার হবে না।’ দিব্যি রইলেন সে যাত্রা। তার পর সত্যিই যেবার ডাক পড়ল সেই যে গেলেন আর এলেন না। সেবারেও তিনি অসুখে পড়লেন। বড় ছেলে এসে নিয়ে গেল তাঁকে দেশে, একরকম জোর করেই। অনেকদিন আর কোনো খবর পাইনে, ভাবছি, এবারও বুঝি আগের মতই হঠাৎ একদিন এসে উপস্থিত হবেন। সকালে বসে আছি বারান্দায়, একটা লোক ধীরে ধীরে এসে বাগানে ঢুকল, দেখি মতিবাবু। চাকরদের বললুম, ‘ওরে দেখ্‌ দেখ্‌, মতিবাবু আসছেন, তামাক টামাক ঠিক রাখ্‌।’ চাকররা ছুটে নেমে গেল নিচে, দেখলে কোথাও কেউ নেই। বললুম, ‘আমি নিজের চোখে স্পষ্ট দেখলুম দিনের বেলা, তিনি বাগান দিয়ে হেঁটে দেউড়িতে আসছেন। নিশ্চয়ই তিনি হবেন, খুঁজে দেখ্‌, যাবেন কোথায় আর।’ কিন্তু তাঁকে আর পাওয়া গেল না খুঁজে। দু-চারদিন বাদে তাঁর ছেলে এসে জানালে মতিবাবুর গঙ্গালাভ হয়েছে। ভাবি, তারও কি এমনি টান ছিল তবে ওই বারান্দার উপর। দক্ষিণের বারান্দার মায়া, কি বুড়ো কি ছেলে, কেউ ছাড়তে পারেনি। ঈশ্বরবাবু আসতেন, ছেলেবেলায় দ্বারকানাথের আমলের জাহাজের মত প্রকাণ্ড একটা কৌচে বসে তাঁর কাছে সন্ধ্যেবেলায় গল্প শুনেছি সেকালের কর্তাদের। ঠিক সেই জায়গায় তাঁর সেই চৌকি থাকবে, একটু নাড়ালে উস্‌খুস করতেন। আমরা কোনো কোনো দিন দুষ্টুমি করে সে জায়গা দখল করলে বলতেন, ‘ভাই, আমার জায়গাতে কেন?’ অন্য কোনও চৌকি তার পছন্দ নয়। নিজের চৌকিতে ‘আঃ’ বলে বসে পড়তেন, সে যে কত আরামের ‘আঃ’। আসতে যেতে বাগানের লম্বা ঘাসে পা পুঁছে আসতেন, সেই ছিল তার পাপোশ। সেই ঈশ্বরবাবু অসুখে পড়লেন। আশি বছরে চোখ কাটালেন, চোখ ভালো হল, খবরের কাগজ পড়লেন। একদিন বললেন, ‘জানো ভাই? আমার একটা কষের দাঁত উঠছে।’ কুষ্টি পেরিয়ে গেছে, ভারি ফুর্তি। নবীনবাবুর বাড়িতে পড়ে আছেন। মাঝে মাঝে যাই, তাঁকে দেখে আসি। তিনি বলেন, ‘ভালো আছি, ভাই, এই কালই গিয়ে বসব তোমাদের বারান্দায়।’ শেষ দিনও বলেছিলেন ‘কালই যাব সেখানে’; আর ঈশ্বরবাবুর আসতে হল না। পূৰ্ণবাবুর মত ঈশ্বরবাবুকে নিয়ে গেল, দেখলুম দক্ষিণের বারান্দায় দাঁড়িয়ে। তাঁর বাশের লাঠিটি আমায় দিয়ে গিয়েছিলেন। পুরানো লাঠি, তার মাথায় একটি নুড়ি বসানো, নিজেই শখ করে লাগিয়ে রেখেছিলেন। ছেলেবেলায় নুড়িটি টেনে খুলতে যেতুম, তিনি বলতেন, ‘খুলো না, ভাই, খুলো না। লাঠির ভিতরে একটি ময়ূর আছে, ছিপি খুললেই বেরিয়ে যাবে।’ মুর্শিদাবাদের গেঁটে বাঁশের দরোয়ানি লাঠি, নাটকে দরোয়ান সাজতে হত তাঁকে, তখন ওই লাঠি কাজে লাগত। সেই তিনিই বলেছিলেন, ‘জানো, ভাই? এবাড়িতে দাড়ির প্রচলন এই আমা হতেই।’ সেই লাঠিটি দিয়ে দাদার একটি ছবিতে ফ্রেম করেছিলুম। নবীনবাবুও ছিলেন বড় মজার লোক। বাজি রেখে চলন্ত মেল-ট্রেন থামিয়ে চাকরি খোয়ালেন। বাতে পঙ্গু হয়ে শুয়ে আছেন; চোর ঘরে ঢুকে সব জিনিসপত্তর নিয়ে গেল চোখের সামনে দিয়ে, নড়বার শক্তি নেই, চেঁচিয়েই সারা। স্ত্রীর সঙ্গে একটু ঝগড়াঝাঁটি হ’লেই চাকর প্রেমলালকে ডাকতেন, ‘আমার ছুরিটা নিয়ে এসো, গলায় দেব। এ প্রাণ আর রাখব না।’ চাকর বেশ শানানো ছুরি এনে হাজির করলে বলতেন, ‘ওটা কেন? আমার সেই আম-কাটা ভোঁতা ছুরি নিয়ে এসো।’ এমন কত মজার মজার ঘটনা সব। তিনিও একদিন চলে গেলেন। মার বড় নাতি, দাদার বড় ছেলে গুপুর বিয়ে হল। দক্ষিণের বারান্দা ঝাড়ে লণ্ঠনে আটচালায় মতিবাবু একেবারে গন্ধৰ্বনগর করে সাজিয়ে দিলেন। নাচে গানে থিয়েটারে জমজমাট হয়ে উঠল বারমহল, অন্দরমহল, নাচঘর, বাগান, দক্ষিণের বারান্দা, সারা জোড়াসাঁকোর বাড়িটাই। তারপর কলকাতার প্লেগ এল, ভূমিকম্প এল। তেতলা বাড়ি ছেড়ে গেলুম চৌরঙ্গীতে। সেইখানে গুপু মেনিন্‌জাইটিস্ রোগে চলে গেল আমার মায়ের কোলে মাথা রেখে। মা তার ছোট্ট বউকে বুকে নিয়ে কেঁদেছিলেন, ‘আমার সব পুরোনো শোক আজ আবার নতুন করে বুকে বাজল রে।’ ফিরে এলুম আবার সেই দক্ষিণের বারান্দাওয়ালা জোড়াসাঁকোর পারের বাড়িতে। মস্ত ঝড়খাওয়া জাহাজ যাত্রী নিয়ে ফিরে এসে লাগলো বন্দরে। মার মন খারাপ। কি করে তাঁদের মন শান্ত হয় সকলেরই এই ভাবনা। মা আবার ভাবছেন, আমরা কি করে সান্ত্বনা পাই। দিন যায় এইভাবে। দীনেশবাবু এলেন সে সময়ে, তিনি একদিন এনে উপস্থিত করলেন ক্ষেত্রনাথ চূড়ামণিকে। ঠিক হল রীতিমত ভাগবত কথা শুনব। মাকে বলে বন্দোবস্ত করা গেল। কথকের বেদী পাতা গেল নাচঘরে। কথকঠাকুর বেদী জমিয়ে বসলেন। ছেলে বুড়ো, চাকর দাসী, কর্মচারী, আত্মীয় বন্ধু সবার কাছে খবর রটে গেল—কথকতা হবে। চললো কথকতা মাসের পর মাস। খুব জমিয়ে তুললেন ক্ষেত্রনাথ কথক। যেন তিলেভাণ্ডেশ্বর মহাদেবটি, নধর কালো দেহ। চিকের আড়ালে মা বসে শোনেন গুপুর বিধবা বউকে কোলের কাছে নিয়ে। ক্ষেত্রনাথ কথকের বলার ধরন চমৎকার, গলাও ছিল সুমিষ্ট। দক্ষিণের বারান্দার গায়ে নাচঘরটা তখন অস্তমিতমহিমা গন্ধৰ্বনগরের মত ম্লান শোভা ধারণ করেছে। তারই মধ্যে ক্ষেত্রনাথ কথক মায়ের মনের অবস্থানু্যায়ী এক-একটি কথা ভাগবত থেকে বলে চলেছেন, এই ভাবে গেল প্রায় এক বছর। তার পর রবিকা একদিন পরগণা থেকে ফিরে এসে বললেন, ‘শিবুৰ্কীর্তনীয়াকে এনে গান শোনাও। ছোটবউঠানের ভালো লাগবে, তোমাদেরও ভালো লাগবে, ওরকম আমি আর শুনিনি।’ রবিকা ডেকে পাঠালেন তাকে, এল শিবুকীর্তনীয়া। সে যা জমালে। কীর্তনীয়া ছিল বটে, কিন্তু সে ছিল সত্যিই আর্টিস্ট। তার ছবি আছে, দাদা এঁকেছিলেন। মোটাসোটা চেহারা, ভাবছি এই চেহারায় কেমন করে সে রাখালবালকদের গোষ্ঠলীলা গাইবে। কিন্তু সে যখন ‘ওহে ওহে’ বলে সুর আরম্ভ ক’রে, ‘আবা আবা’ বলে রাখালবালক হয়ে গান ধরলে, তখন অবাক্‌। অনেকদিন চলেছিল গান, মাথুর থেকে আরম্ভ করে সমস্ত কৃষ্ণলীলা শুনিয়েছিল সে। সেই সময় ক্ষেত্রনাথ কথকের ছুটি হয়ে গেল। তিনি বলে গেলেন, ‘রবিবাবু এসে আমার জমাট আসরটা ভেঙে দিলেন।’ আমার কাছ থেকে একটি ছবি তিনি নিয়েছিলেন চেয়ে। তাঁরই বর্ণনামত এঁকেছি পদ্মফুলের উপরে দাঁড়িয়ে বালক কৃষ্ণ। তিনি বলেছিলেন পুজো করবেন। তাঁর সঙ্গে সেই ছবি কাশীতে গেল। তার পর তিনি মারা যাবার পর সে ছবি হাত ফিরতে ফিরতে কোথায় গেল জানিনে। সেদিন দেখি কোন্‌ এক কাগজে তা ছাপিয়েছে। তার পর একদিন মাও গেলেন। দাদাও গেলেন জোড়াসাঁকোর বাড়ি শূন্য করে। ক্ৰমে ক্রমে আমার দক্ষিণ বারান্দার জলসা বন্ধ হল। লক্ষ্ণৌতে গিয়েছিলুম রবিকার সঙ্গে। গোমতীর উপরে বাদশার আমদরবারের ভগ্ন স্তূপে বসে মনে পড়ত আমার দক্ষিণের বারান্দার আড্ডা। তার পর যখন সত্যিই সেই দক্ষিণের বারান্দা প্রায় ভগ্নস্তুপে পরিণত হয়েছে তখনো মায়া ছাড়তে পারিনি। ভাই বন্ধু সঙ্গী ছাত্র সব চলে গেছে; অতবড় খালি বাড়ির সেই দক্ষিণ বারান্দায় একা বসে আমি পুতুল গড়ি, বৈচিত্র্যহীন জীবনে ওইটুকু বৈচিত্র্য আছে তখনো। এমন সময়ে একদিন ফেলাবতী এসে হাজির। কোথা থেকে উঠে এলো এতটুকুন মেয়েটি, নেড়া ভোলা চেহারা; বললুম, ‘কে তুই?’ ‘আমি ফেলা।’ ‘ও, ফেলা, তা এসো।’ দেখে বড় আনন্দ হল। যখন ফেলে-দেওয়া জিনিস নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করছি, নতুন রূপ দিচ্ছি, তখন এল ফেলাবতী আমার। বললুম, ‘কোত্থেকে আসিস? ঘর কোথায়?’ বললে, ‘এই এখান থেকেই।’ বলে রাস্তার মোড়ের দিকটা দেখালে। ‘কে আছে তোর?’ ‘মা আছে।’ ‘কি নাম?’ ‘কৌমুদী।’ ‘বাপের নাম কি?’ ‘বসন্ত।’ ভাবছি, এ কোন্‌ ফেলা এল। মনে হল না, সে মানুষ। বললুম, ‘কি চাই তোর?’ ‘আমি এখানে বসে খেলা করিনে একটু?’ ‘তা বেশ তো, কর্‌ তুই খেলা। বলি, ফেলা একটা সন্দেশ খাবি?’ ‘তা খাব।’ রাধুকে বলি, ‘রাধু, আমার ফেলার জন্যে সন্দেশ নিয়ে আয় একটা।’ সে মুখ বাঁকিয়ে চলে যায়। একটা সন্দেশ আর মাটির গেলাসে জল এনে দেয়। ফেল সন্দেশ খেয়ে জল খেয়ে গেলাসটি এক কোণায় রেখে দেয়। বলি, ‘কেমন লাগল?’ ফেলা বলে, ‘তোমাদের সন্দেশ কেমন আঠা-আঠা, গলায় লেগে যায়। মা খাওয়ায় কটকটে সন্দেশ, সে আরো ভালো।’ ‘তা বেশ।’ এমনি রোজ আসে সে সন্দেশ খাইয়ে ভাবসাব করি। সে একপাশে বসে খেলে, আমিও খেলি। ভাঙা কাঠকুটো নুড়ি দিই। সে বসে তাই দিয়ে খেলা করে। পাশের একটা টেবিলে পুতুল গড়ে গড়ে রাখি। সে বললে, ‘এগুলোর ধুলো ঝেড়ে রাখি?’ ‘তা রাখো।’ সে ধুলো ঝাড়ে, তাতে হাত বোলায়। ‘বলি, পুতুল নিবি একটা?’ ‘না, পুতুল দিয়ে কি করব? আমায় নুড়িগুলো বরং দাও।’ ‘কি করবি তুই?’ ‘ভাইকে দেব, ঘুঁটি খেলাবে।’ কোনোদিন চায় পুরোনো খবরের কাগজ, বাপকে দেবে, বাপ ঠোঙা করে বাজারে বেচবে। কোনোদিন বা চায় পুরোনো টিনের কৌটা, মাকে দেবে, মা মসলাপাতি রাখবে। এমনি রোজই আসে। হঠাৎ আসে নিঃশব্দে, বুঝতে পারিনে কোথা দিয়ে আসে। বিনিপয়সার খেলুড়ি ফেলা নিঃসঙ্গ দিনের, মানুষের মধ্যেও সে ফেলা, কাঠকুটরো, ছেঁড়া টুকরো কাগজেরই সামিল। যত ফেলা জিনিস কুড়িয়ে বাড়িয়ে এক বুড়ো আর এক মেয়ে খেলা জুড়েছি সেই দক্ষিণের বারান্দায়। একদিন ফেলা বললে, ‘তোমাদের বাড়ির ভিতরটা দেখাবে আমায়?’ ‘দেখবি?’ রাধুকে ডেকে বললুল, ‘নিয়ে যা একে বউমার কাছে, বাড়ির ভিতর দেখতে চায়।’ বউমা আবার তাকে একপেট খাইয়ে দিলে। সে পাকা গিন্নির মত সব ঘুরে ঘুরে দেখে ফিরে এল। বললুম, ‘দেখা হল, ফেলাবতী, বাড়ির ভিতর? বললে, ‘হ্যা।’ ‘তবে এবার তুই বাড়ি যা, আমিও উঠি, নাইতে খেতে হবে।’ দক্ষিণের বারান্দায় সেই শেষ প্রবেশ ফেলাবতী ও আমার। তার পর অসুখে পড়লুম। সেই অবস্থাতেই শুনি দক্ষিণের বারান্দা বিকিয়ে গেছে মাড়োয়ারিদের হাতে। রোগী আমি, একটা মাস মেয়াদ পেয়েছি আর এবাড়িতে থাকবার।
অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর
০৯. মধুর শেষ নেই অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর মধুর তোমার শেষ যে না পাই, প্রহর হল শেষ। এ ‘মধুর শেষ নেই। প্রহর শেষ হয়ে যায়। কত মধুর, আমাদের এমন পাত্র তাতে এর এক ফোঁটা মধুও ধরতে পারিনে। ধুলোতেও মধু, তাই তো বলি, গোরুর গাড়ি রাস্তার বুক চিরে চলেছে আঁকলেম, কিন্তু ধুলো উড়ল কই?’ ধুলো উড়োনো চাই। সেবারে এখানেই এই চেয়ারে এমনিভাবেই বসে বাস দেখতুম, রাস্তার পরে ওই গাছটির উপর দিয়ে লাল ধুলো উড়ে এল, দেখতে দেখতে গাছটি ঢেকে গেল, আবার ধীরে ধীরে গাছটি পরিষ্কার হয়ে ফুটে বের হল, ধুলোর হাওয়া চলে গেল আরো এগিয়ে, মনে হল গাছটির উপরে যেন একপশলা লাল ধুলোর বৃষ্টি হয়ে গেল। সে কি চমৎকার। তা কি আঁকতে পারি? পারিনে। কিন্তু আঁকতে হবে যদি সময় থাকে, এই বৃদ্ধকালেও দেখো মন সঞ্চয় করে রাখছে, কোন্‌ জন্মের জন্য বলতে পারো? একবার কি হল, আমার চোখের চশমার একটা কাঁচের কোণা ভেঙে গেল। তাই চোখে দিয়ে থাকি। বললুম, আরো ভালোই হয়েছে শার্শি ফাঁক হয়ে গেছে, ওর ভিতর দিয়ে রং আসবে। একদিন নন্দলালকে বললুম, দেখো তো আমার এই চশমাটি চোখে দিয়ে। নন্দলাল তা চোখে দিয়ে বললে, এ যে রামধনুকের রং দেখা যায়; অনেকদিন বুঝি পরিষ্কার করেননি কাঁচ। আমি বললুম, না ন, তা নয়। ছবিতে যত রঙ দিই সেই রঙই এই রাস্তায় লেগেছে। আমার হৃদয় তোমার আপন হাতে দোলে দোলাও দোলাও দোলাও। মায়ের দোল স্মরণ হয়। যাবার সময় তো হইছে, যাবই তো, এ ঘাটের ধাপ শেষ হয়ে এসেছে। নদীর ওপরে গিয়ে কি দেখব? আবার কি মিলব সবাই সেখানে? কি জানি। তা যদি জানতে পারা যেত তবে কিন্তু পৃথিবীতে বেঁচে থাকার রস চলে যেত। এইখানেই সব শেষ করে নাও; এখানকার পাত্র এইখানেই ধুয়ে ফেলো। শেষ পেয়ালার ফোঁটা ফোঁটা তলানিটুকু, সেখানেই সব রস জমা হয়ে আছে। যত শেষের দিকে যাবে তত রস। চীনেরা বেশ উপমা দেয় তাদের চায়ের সঙ্গে, বলে, চা তিন রকম। প্রথম জ্বালের চা ঢাললে, ছোট ছেলেরা খাবে, পাতলা চা, সোনার বর্ণ, তাতে একটু দুধ একটু চিনি। দ্বিতীয় জ্বাল, তখনো সেটা ফুটছে রং আগের চেয়ে একটু ঘন হয়ে এসেছে, তা প্রৌঢ়দের জন্য। আর তৃতীয় জ্বাল, তলায় যে চা রয়েছে অল্প জল আর চায়ের ক্বাথ, এই যে শেষ পেয়ালা, এ সবার জন্য নয়। যাদের বয়েস হয়েছে, সুখ-দুঃখ তিক্ত মিষ্টের রস সত্যি উপভোগ করতে পারে এ শুধু তাদের জন্যই। কালি কলম মন লেখে তিনজন। ছবিটি আঁকি তুলিটি জলে ডোবাই, রঙে ডোবাই, মনে ডোবাই, তবে লিখি ছবিটি। সেই ছবিই হয় মাস্টারপিস। অবিশ্যি, সব ছবি আঁকতে যে এভাবে চলি তা নয়। জলে ডুবিয়ে রঙে ডুবিয়ে অনেক ছবির কাজ সেরে দিই, মন পড়ে থাকল বাদ । এমন ছবি একটা একে যদি ছিঁড়ে ফেলতে যাই, তোমরা খপ করে হাত থেকে তা ছিনিয়ে নিয়ে পালাও। ঠকে যাও জেনো। আমি যৌবনে দেশী সংগীতের স্বর ধরতে চেয়েছিলেম, হাতের আঙুলের ডগায় সুর এসেওছিল; কিন্তু মনে তো পৌঁছয়নি। ব্যর্থ হয়ে গেল আমার সকল পরিশ্রম, সকল সংগীতচর্চা, এক-একবার এই মনে করি। কিন্তু চিত্রকর হয়ে চিত্রকর্মে যেদিন প্রথম শিক্ষা শুরু করলেম সেইকালের একটা ঘটনা বুঝিয়ে দিয়েছিল মন আমার সুর সংগ্রহ করতে একেবারেই উদাসীন ছিল না। তখন কলকাতায় ওয়েল্‌স্‌লি পার্কের কাছে মাদ্রাসা কলেজ, সামনে একটা দিঘি, তার পারে ইটালিয়ান আর্টিস্ট গিলার্ডি সাহেবের বাসা। তাঁর কাছে রোজ সকালে যাই, দস্তুরমত দক্ষিণা দিয়ে প্যাস্টেল ড্রইং আর অয়েলপেন্টিং শিখি। বেশ ঘরের লোকের মতই আমার সঙ্গে ব্যবহার করেন সাহেব। স্টুডিয়োর একদিকে আমি বসে ছবি আঁকি; অন্যদিকে তাঁর মেম ছেলেকে দুধ খাওয়াচ্ছেন; দু-একটি আবার স্কুলে যায়, তাদের খাইয়ে দাইয়ে তৈরি করে স্কুলে পাঠাচ্ছেন; কখনো বা আমার গাড়িতে করে বাজারটা ঘুরে আসছেন। সে বাড়ির নিচের তলায় থাকে মান্ধাটা নামে এক বুড়ো ইটালিয়ান মিউজিক মাস্টার আর তার মেয়ে। বুড়ো বাপেতে মেয়েতে থাকে বেশ, রোজ সকালে মেয়ে পিয়ানো বাজায় বাপ বাজায় বেহালা। সুর আসে ভেসে, উপরে বসে আমি সেই বিলিতী সুর শুনি আর ছবি আঁকি। একদিন সকালে রোজকার মত ছবি আঁকছি, নিচে থেকে বেহালার সুর এল কানে, উদাস করে দিলে। হাত বন্ধ করলুম তুলি টানার কাজ থেকে, সুর তো নয় যেন বেহালাটা কাঁদছে। সেদিন সে সুর স্পষ্ট বুঝিয়ে দিলে, বেহালার ছড়ি, বেহালার তার আর যে বাজাচ্ছে তারও মানসতন্ত্র এক হয়ে গেছে। আজ আর পিয়ানো নেই সঙ্গে। গিলার্ডিকে বললুম, ‘সাহেব আজ বেহালা যেন কাদছে মনে হচ্ছে কেন বলো তো? এমন তো শুনিনি কখনো?’ সাহেব বললেন, ‘চুপ চুপ, জানো না বুড়োটির মেয়ে কাল চলে গেছে বাড়ি ছেড়ে?’ সেদিন আর ছবি আঁকা হল না আমার। খানিক বাদে আস্তে আস্তে নেমে এলুম। সিঁড়ির কাছের ঘরটিতে দেখি, বুড়োটি বসে আছে চেয়ারে, কাঁধে বেহালাটি রেখে মাথা হেঁট করে, একমাথা সাদাচুল পাখার হাওয়ায় উড়ছে বুঝেছিলুম সেদিন, মনে ধরল আজ সুরের আগুন। অন্তর বাজে তো যন্তর বাজে। মনের স্পর্শ নইলে গাওয়াও বৃথা, বাজানো বৃথা, ছবি আঁকাও বৃথা, এ কথা জেনে নিলে মন। ছেলেছোকরারা আঁকে দেখবে—দেয়ালি পট, ঝাড়লণ্ঠন, একটু রঙ রেখা, ভুলে গেল তাতেই। তার পর এল রসের প্রৌঢ়তা, যেমন মোগল আমলের আর্টের মধ্যে দেখি; তাদের রঙ, সাজসজ্জা, সে কি বাহার। তার পর সেই বাহার থেকে পৌঁছল গিয়ে রসের আরো উচু ধাপে আর্ট, তবে এল বাইরের-রঙচঙ-ছুট ছবি সমস্ত, যেন মেঘলা দিনের ছায়া, স্নিগ্ধ, গম্ভীর। আর্টের এই কয়টি সোপান মাড়াতে হবে, তবে হয়তো আর্টিস্ট বলতে পারব নিজেকে। একবার কেষ্টনগরের এক পুতুলগড়া কারিগর জ্যোতিকার একটা মূর্তি গড়লে। অমন তো সুন্দর চেহারা তাঁর, যেমন রঙ তেমনি মুখের ডৌল—মূর্তি গড়ে তাতে নানা রঙ দিয়ে এনে যখন সামনে ধরলে সে যা বিশ্ৰী কাণ্ড হল, শিশুমনও তা পছন্দ করবে না। মাটির কেষ্টঠাকুরের পুতুল বরং বেশি ভালো তার চেয়ে। পুতুল গড়া সোজা ব্যাপার নয়। তার গায়ে এখানে ওখানে বুঝে একটু আধটু রঙ দেওয়া, চোখের লাইন টানা, একটু ফোঁটা দিয়ে গয়না বোঝানো, এ বড় কঠিন। সত্যি বলব, আমি তো পুতুল নিয়ে এত নাড়াচাড়া করলুম, এখনো সেই জিনিসটি ধরতে পারিনি। একটু ‘টাচ’ দিয়ে দেয় এখানে ওখানে, বড় শক্ত তা ধরা। সেবার পরগণায় যাচ্ছি বোটে, সঙ্গে মনীষী আছে। কোথায় রইল সে এখন এক-একা পড়ে, কি শিখল না-শিখল একবার লড়তে এলে তো বুঝব। তা সেবারে খাল বেয়ে যেতে যেতে দেখি এক নৌকোবোঝাই পুতুল নিয়ে চলেছে এক কারিগর। বললুম, ‘থামা, থামা বোট, ডাক্‌ ওই পুতুলের নৌকো।’ মাঝিরা বোট থামিয়ে ডাকলে নৌকোর মাঝিকে, নৌকো এসে লাগল আমার বোটের পাশে। নানা রঙবেরঙের খেলনা তার মাঝে দেখি কতকগুলি নীল রঙের মাটির বেড়াল। বড় ভালো লাগল। নীল রঙটা ছাই রঙের জায়গায় ব্যবহার করেছে তারা, ছাই রঙ পায়নি নীলেই কাজ সেরেছে। অনেকগুলো সেই নীল বেড়াল কিনে ছেলেমেয়েদের বিতরণ করলুম। পুতুলের গায়ের ‘টাচ’ বড় চমৎকার। পটও তাই, এই জন্যই আমার পট ভালো লাগে, বড় পাক৷ হাতের লাইন সব তাতে। হ্যাঁ, মনীষীর লড়াইয়ের কথা বলছিলুম। সেই লড়াইয়ের এক সুন্দর গল্প মনে এল। অনেক কাল আগের কথা। একজন লোক, তাঁর পূর্বপুরুষ ভালো মৃদঙ্গ-বাজিয়ে, নিজেও বাজায় ভালো। সে বলেছিল, মৃদঙ্গ বাজিয়ে আমার সুখ হল না। গণেশ আসত, তার সঙ্গে একহাত পাল্লা দিয়ে বাজাতে পারতুম তবে সুখ হত। গণেশের কাছে হার হলেও তার সুখ, সে শুধু সমানে সমানে পাল্লা দিতে চেয়েছিল। কিছুকাল বাদে তার নাতি এল। বলে, ‘খেতে পাচ্ছিনে।’ বললুম, ‘কেন, এতবড় বাজিয়ের নাতি তুমি, খেতে পাচ্ছ না, সে কি কথা। আচ্ছা, কত হলে তুমি থাকবে আমার কাছে?’ অল্পসল্পই চাইলে। রাখলুম তাকে আমার বাড়িতেই। তখন আমার ভয়ানক বাজনার শখ, এসরাজ বাজাই। শ্যামসুন্দরও আছে। ছেলেটি বললে, ‘আমায় কি করতে হবে?’ বললুম, ‘কিছুই না। সন্ধ্যেবেলা তুমি মৃদঙ্গ বাজাবে, আমি শুনব।’ প্রথমদিন সন্ধ্যেবেলা বারান্দায় যেমন বসি এই রকম দেয়ালের কাছে চৌকি টেনে বসেছি, সে মৃদঙ্গ বাজাবে। বললে, ‘গান চাই।’ শ্যামসুন্দরকে বললুম, সে আস্তে আস্তে গান ধরলে, আর ছেলেটি বাজালে। কি বাজাল, যেন মেঘের গুরু গুরু শুনতে থাকলেম। মৃদঙ্গ বাজছে, সত্যি যেন আকাশে দুন্দুভি বাজছে। রবিকা লিখে গেছেন, বাদল মেঘে মাদল বাজে। ঠিক তাই, এ বাদ্যযন্ত্র বাজছে, না মেঘ। সেদিন বুঝলুম, তার ঠাকুরদা যে বলেছিল গণেশের সঙ্গে পাল্লা দেবে, তা কেন বলেছিল। রবিকাও আসতেন কোনো-কোনোদিন, বসে মৃদঙ্গ শুনতেন সন্ধ্যেবেলা। শুনে খুব খুশি। বলতেন, ‘অবন, একে হাতছাড়া কোরো না তুমি।’ তাকে সমাজে কাজ দেবার কথা হয়েছিল। কিন্তু সমাজের কর্তারা বললেন, আর-একজন বাজিয়ে আছে এখানে, তাকে সরিয়ে কি করে একে নিই, ইত্যাদি। এই করতে করতে কিছুদিন বাদে দ্বারভাঙ্গার রাজার নজরে পড়ল। বেশি মাইনে দিয়ে আমার কাছ থেকে তাকে লোপাট করে নিয়ে গেল। রবিকা কোথায় গিয়েছিলেন, ফিরে এসে বললেন, ‘অবন, তোমার সেই বাজিয়ে?’ বললুম, ‘চলে গেল রবিকা।’ গুণীর গুণ কি চাপা থাকে? আগুনকে তো চেপে রাখা যায় না। সেই এক শুনেছিলুম মৃদঙ্গ বাজনা। অনেক খোলওয়ালাকে থামাতে হয় গানের সময়ে। এত জোরে তাল বাজায় যে সে-শব্দে গান চাপ পড়ে যায়, ইচ্ছে হয় ছুটে গিয়ে তার হাত চেপে ধরি। এই দেখো, বাজনার কথায় আর-একটা মজার কথা মনে পড়ে গেল। এক বীনকার, নামধাম বলব না, চিনে ফেলবে, বড় ওস্তাদ, খুব নামডাক হয়েছে; লক্ষ্ণৌর নবাব তখন মুচিখোলায় বন্দী হয়ে আছেন, এবারে যাবে তাঁকে বাজনা শোনাতে। নিজে খুব সেজেছেন, চোগাচাপকান পরেছেন, জরির গোল টুপি মাথায়, নিজের নামের সঙ্গে জুড়ে দিয়েছেন মস্ত একটা হিন্দুস্থানী উপাধি, অমুকজি বীনকার, বীণাটাকেও জড়িয়েছেন নানা রঙের মখমলের গেলাপে। ইচ্ছে, নবাবকে বীণা শুনিয়ে মুগ্ধ করে বেশ কিছু আদায় করবেন। একদিন সকালে বীণা নিয়ে উপস্থিত মুচিখানায়। খবর গেল, ‘কলকাত্তাসে এক বড় বীনকার আয়া—হুজুরকে দরবারমে।’ খবর পাঠিয়ে বসে আছেন দেওয়ানখানায়। নবাব উঠবেন, হাতমুখ ধোবেন, সে কি কম ব্যাপার? নবাব উঠে হাতমুখ ধুয়ে তৈরি হয়ে পান চিবোতে চিবোতে সটকা মুখে মজলিশে এসে বসে হুকুম করলেন, ‘তেরা বীনকারকো বোলাও।’ নবাবের এত্তালা পেয়ে বীনকার উপরে উঠে নবাবকে সেলাম ঠুকে সামনে কায়দা করে বসে বীণার গেলাপ খুলতে লাগলেন এক-এক করে। এখন, নবাবদের কাছে যার বাজাতে যায় তারা আগে থেকে বীণার তার বেঁধে যায়, গিয়েই বাজনা আরম্ভ করে দেয়। আর বীনকার ওখানে বসেই অনেকক্ষণ ধরে তার বেঁধে সুর ঠিক করে, বীণাটি হাতে নিয়ে যেই না দু বার প্রিং প্রিং করেছেন, নবাব বলে উঠলেন, ‘ব্যস্‌ করো।’ নবাবী মেজাজ, তাদের ‘ব্যস্’ বলা কি বোঝ তো? বীনকার তক্ষুনি বীণা গুটিয়ে সরতে নবাব বললেন, ‘দেওয়ান, ইস্‌কো শ’ও রূপেয়া ইনাম দেও। আউর বোলো দোসরা দফে মুচিখানেমে আনেসে উসকো বীন ছিনা জায়েগা।’ নবাব ছেড়ে দাও, আমি নিজেও যে নবাবি করেছি এককালে, নাচ গান বাজনা বাদ রাখিনি কিছু। বলেছি তো সে সব তোমায়। কিন্তু ওদিকটা হল না আমার, তা কি করব। ভিতরে সুর নেই যন্তর বাজিয়ে করব কি? কিন্তু কার হাতে কেমন সুরের পাখি ধরা দেয় কে বলতে পারে। একটি ছোকরা আসত তখন আমার কাছে। সারেঙ্গি বাজাত। প্রফুল্ল ঠাকুরের ছেলের বিয়ে, মহা ধুমধাম বিরাট ব্যাপার, গিয়েছি সেখানে। শুনছি কে এক বাজিয়ে সুরবাহার বাজাবে। খুব বলাবলি হচ্ছে। ভাবছি কে এমন ওস্তাদ বীনকার। সভায় বসেছি, এবারে বাজনা শুরু হবে। দেখি, সেই ছোকরাটি একটি বীণা হাতে এল বাজাতে। চিনতেই পারা যায় না তাকে আর। বললুম, ‘তুমিই বীণা বাজাবে?’ সে বললে, ‘হাঁ হুজুর, একটু একটু শিখেছি।’ বললুম, ‘বেশ, বেশ, বাজাও শুনি।’ মনে পড়ে এতটুকু ছোকরা সারেঙ্গি বাজাত, হঠাৎ দেখি সে এক মস্ত ওস্তাদ, সভায় বাজনা শোনায়। হয়, যে এক কালে কিছুই জানত না, সে একদিন বীণাও বাজাতে পারে। কতই দেখলেম। আরো শোনে। একবার বাংলা থিয়েটারে গেছি, বুড়ো অমৃত বোস, বড়ো ভালো লোক ছিলেন, পাশে বসে আছেন। আর, মিনার্ভা থিয়েটারে ভালো সিন আঁকত, স্টেজ ডেকোরেশন করত, নামটা তার মনে পড়ছে না, আমিই তাকে রেকমেণ্ড করে দিয়েছিলুম, সেও আছে একপাশে বসে। কি একটা অভিনয় হল। অমৃত বোসকে বললুম, ‘দেখুন মশায়, আপনাদের অ্যাক্‌টর অ্যাকট্রেসরা সিংহাসনে বসবে, বসতেই জানে না, গড়গড়ার নলে টান দিতে পারে না। একটা স্টুডিয়ো করুন, যেখানে তারা এইসব শিখবে। উঠতে বসতে যারা জানে না, তার ‘প্লে’ করবে কি আবার?’ তিনি বললেন, ‘তা বলেছেন ভালো; এটা করতে হবে এবারে।’ অন্য আর-এক রাত্তিরে স্টার থিয়েটারে কি এক সিনে আর-এক আর্টিস্ট রাজসভার সিন এঁকে পিছনে ঝুলিয়ে দিয়েছে, বৃহৎ সভা, ঘরের থাম আসবাবপত্র কিছুই বাদ রাখেনি আঁকতে। এখন সেই সিনে রাজার সিংহাসন পড়েছে। রাজা বসলেন এসে সিনের পার্সপেক্‌টিভে যেখানে পাপোশটি রাখা আছে ঠিক সেইখানে একটা চৌকিতে। অতিরিক্ত পার্সপেক্‌টিভের ফল দেখো ছবিতে। রাজার স্থান হল পাপোশের জায়গায়। আর একবার এই রকম পার্সপেক্‌টিভের ধাঁধাঁয় পড়েছিলেম ছাত্রদের নিয়ে। নন্দলালরা তখন ছাত্র। আর্টস্কুলে আমি কাজ করি। রাশিয়া থেকে একটি মেম এল। বললে, ‘বুদ্ধের ছবি আঁকব, ঘর চাই একটা।’ ছবি আঁকবে ঘর চাই, তার কি করি। আর্টস্কুলে এখন তোমার দাদার যেটা ড্রইং রুম সেই ঘরটা ছেড়ে দিলুম। সে ঘরের চাবি চেয়ে নিল, বললে, একলা ঘরের দরজা বন্ধ করে নিশ্চিন্তমনে ছবি আঁকবে। আচ্ছা তাই হোক। মেমটি রোজ আসে, ছবি আঁকে, আমি মাঝে মাঝে যাই। উত্তরদিকের দেয়াল জুড়ে কাগজ সেঁটেছে। কাজের সময় ছাড়া বাদবাকি সময় পরদা টেনে ছবি ঢেকে রাখে। ছাত্রেরা কেউ যেতে পারে না কি হচ্ছে দেখতে। নন্দলাল বললে, ‘কী করে ড্রইং করে দেখতে চাই।’ মেমকে বললুম সে কথা, ‘আমার ছাত্রদের দেখাও একবার, কি করে তুমি ড্রইং কর। সে বললে, ‘আর কয়েকদিন বাদে আমার পেনসিল ড্রইং শেষ হয়ে যাবে, তখন দেখাব।’ কদিন বাদে খবর দিলে, ‘এবারে আসতে পারো।’ নন্দলালদের নিয়ে গেলুম। ছবির পরদা সরিয়ে দিলে। প্রকাণ্ড কাগজে বুদ্ধের সভা আঁকছে—ও মা, পার্সপেক্‌টিভ এমন করেছে, নিচে থেকে উপরে উঠে সেই কোথায় বুদ্ধদেব বসে আছেন নজরে পড়ে না। এ কি ছবি, এ কি পার্সপেক্‌টিভ? মেম বললে, ‘কারেক্ট্‌ পার্সপেক্‌টিভ হয়েছে।’ নন্দলাল বললে, ‘পার্সপেক্‌টিভের চূড়ন্ত হয়েছে, কিন্তু চিত্রের কিছু নেই এতে।’ পরে শুনি সেই ছবিই কোন্‌ এক রাজার কাছে বিক্রি করে অনেক টাকা হাতিয়ে চলে গেছে সে দেশে। কত সুখদুঃখের মান-অপমানের ধাক্কা খেয়ে খেয়ে আর্টিস্টের মন তৈরি হয়। আমরা সব সৃষ্টিছাড়া; প্রকৃতি মায়ের আদুরে, কোলের কাছাকাছি ছেলে; একটা বুনো ভাব আছে। সবার সঙ্গে মেলে না, সত্যিই তাই। সুখদুঃখ আমাদের বেশি করে বাজে, জীবন উপভোগ করবার ক্ষমতাও আমাদের বেশি। প্রকৃতি আমাদের বেশি করে দিয়েছে সবই। একটু আলো দেখি, ছুটে বেরিয়ে পড়ি। সেটিমেণ্টাল?—ঠিক তা নয়। অবিশ্যি এ কথা বলে অনেকেই আমাদের বেলায়। সেবারে কি হয়েছিল—এই ভাবুকতার জন্য কেমন তাড়া খেয়েছিল দুটো ছেলে। রবিকা বেঁচে, এসেছি এখানে। ভোরবেলা সূর্য ওঠবার আগেই খোয়াইর দিকে ছুটতুম। একদিন ছুটছি, ছুটছি, তালগাছ পেরিয়ে গেলুম, খেজুরগাছ দুটোও পেরিয়ে গেলুম, শরগাছের ঝোপগুলির কাছাকাছি এসেছি—দুটো ছেলে, তারাও বুঝি বেড়াতে বেরিয়েছে, বললে, ‘ফিরে দেখুন কি সুন্দর সূর্য উঠেছে।’ আমি তখন হন হন করে হাঁটছি। দিলুম এক তাড়া মেরে, ‘যাঃ যাঃ, কী সুন্দর সূর্য উঠেছে, তোরা দেখ্‌গে, আমি বলে হেঁটে হয়রান।’ ফিরে এলুম; দেখি রবিকা বসে আছেন চা আগলে নিয়ে। তাড়াতাড়ি এসে বসলুম টেবিলে। রবিকা বললেন, ‘কোথায় গিয়েছিলে তুমি। এদিকে আমি চা নিয়ে বসে আছি তোমার জন্যে। নাও, খাও।’ বলে এটা এগিয়ে দেন, ওটা এগিয়ে দেন। রবিকার সামনে বসে খাওয়া, সে কি ব্যাপার জানোই তো। তার পর চায়ের সঙ্গে আমার একটু রুটি চলে শুধু। রবিকা বললেন, ‘একটু গুড় খাও দেখিনি। গুড়টা ভালো জিনিস।’ সকালবেলা গুড়! মহামুশকিল, এদিক ওদিক তাকাই; রবিকা আবার মস্ত একটি কেক এগিয়ে দিলেন, ‘খাও ভালো করে।’ একটা ছুরি দিয়ে একটুকরো কেক কেটে নিয়ে বাকিটা আস্তে আস্তে ঠেলে দিলুম অ্যাণ্ড্রুজের দিকে। অ্যাণ্ড্রুজ দেখি সবটাই শেষ করে দিলেন। বেশ খেতে পারতেন। যাক, সকলের ফাঁড়া তে কাটল। প্রতিমাকে বললুম, ‘প্রতিমা, যে কয়দিন আছি ভোরের চা-টা তোর কাছেই খাইয়ে দিস। কেন আর বারে বারে আমায় সিংহের মুখে ফেলা।’ তার পরদিন থেকে সকালে উঠে তাড়াতাড়ি প্রতিমার কাছে চা খেয়েই বেড়াতে বের হতুম। ফিরে আসতেই রবিকা বলতেন, ‘অবন, চা খেলে না তুমি?’ মাথা চুলকে বলতুম, ‘প্রতিমা খাইয়ে দিয়েছে।’ মুচকে হেসে তিনি বলতেন, ‘ও বুঝেছি।’ তখন ছেলেরা ওই রকম সেন্টিমেণ্টাল ছিল—ওঃ কী চমৎকার সূর্যোদয় এখানে, আহা হা। যেন আর কোথাও নেই এমন জিনিস। এরই আর একটা গল্প শোনো। সেই বারেই কারপ্লেজও আছে এখানে। বিকেলে এই রাস্তার উপরেই টেবিল পড়ে। সবাই বসে চা খাই। চা গেয়ে কারপ্লেজ ও আমি ঘুরে বেড়াই। একদিন বিকেলে রোজকার মত ঘুরে বেড়াচ্ছি আমরা দুই আর্টিস্টে নানা বিষয় নিয়ে নানা আলাপ করছি। ওদিক থেকে একটি হালকা কুয়াশার চাদর ধীরে ধীরে এগিয়ে এসে আশ্রমের শালবনের উপর খানিক স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে আস্তে আস্তে চলে গেল। ঠিক সন্ধ্যে হচ্ছে সেই সময়টিতে। দু বন্ধুতে এই দৃশ্য দেখে মুগ্ধ। দুজনেই বলে উঠলুম, ‘বাঃ কী চমৎকার।’ মুখে আর কথা নেই কোনো। শুধু বিস্ময়ে বাঃ বাঃ করছি দাঁড়িয়ে। পিছন থেকে রথী-ভায়া বলে উঠলেন, ‘ও কিছুই নয়, মেঘও নয় কুয়াশাও নয়। ও হচ্ছে চাল-কলের ধোঁয়া।’ আরে ছোঃ ছোঃ, রথী ভাই, এ তুমি করলে কি? তুমি আমাদের এত ভাবুকতা এত কবিত্ব এমনি করেই মাটি করে দিলে? কারপ্লেজও বললে, ‘এমনি করে আমাদের স্বপ্ন নষ্ট করে দিতে হয়? জানলেই বা তুমি, আমাদের তা বললে কেন?’ দেখো তো কী কাণ্ড। দু আর্টস্টকে এমনি বেকুব করে দিলে। বেশ ছিলুম তখনকার শান্তিনিকেতনে। ভোরে উঠতুম। রবিকা তো অন্ধকার থাকতেই উঠতেন, সেই ওঁর চিরকালের অভ্যেস। দরজা খোলা, বর্ষাকাল, একটু একটু বৃষ্টি হচ্ছে; হাতমুখ ধুতে ধুতে দেখতুম সেখান থেকে, রবিকার ঘরে উপরে একটি তাকে বাতি জ্বলছে, ঠিক যেন শুকতারাটি জ্বল জ্বল করছে; মনে হত, সমস্ত শাস্তিনিকেতনের উপর যেন আকাশপ্রদীপ জ্বলছে; আর আমরা ছেলেপুলেরা নির্ভয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছি। পাল্লা দেবার লোক চাই। সেই লোক আর নেই। গণেশকে পেলুম না, কাঠের গণেশ নিয়েই কারবার করে গেলুম। বড়ো খুশি হয়েছিলুম রবিকা যখন ছবি আঁকতে আরম্ভ করলেন। ভাবলুম, এইবারে এক রাস্তায় চলবার লোক পেলুম; এইবার এল বড় ওস্তাদ আমাদের মাঝখানে। বুড়ো হয়ে গেছি, আর জোর নেই। প্রতিদ্বন্দ্বী এখন না আসাই ভালো। না তা কেন? আসে, তাই তো চাই। ভালোই হবে। কিন্তু দেখছিনে তো কাউকে। এখনো যে অনেক কিছু আছে ভিতরে পড়ে। ভেবেছ নতুন কায়দাতে হার মানব? তা নয়। এক বুড়ো ওস্তাদের ছাত্র দিগ্বিজয়ী কুস্তিগির হয়ে উঠেছে। দেশবিদেশে তার নাম। সবাইকে কুস্তিতে হারিয়ে দেয়, কেউ পারে না তার কাছেই এগতে। একবার তার শখ গেল গুরুর সঙ্গে কুস্তি করে গুরুকে হারিয়ে নাম কিনতে। রাজা শুনে আয়োজন করবার হুকুম দিলেন। পাড়ায় পাড়ায় ঢোল পিটিয়ে দিলেন দিগ্বিজয়ী কুস্তিগির এবারে গুরুর সঙ্গে কুস্তি লড়বে। দিন ঠিক হল। লোকে লোকারণ্য দুজনের কুস্তি দেখতে। বুড়ো পালোয়ানকে রাজা হুকুম করলেন। সে বলে, ‘হুজুর, বুড়া হো গিয়া, তাকদ নেহি, মর্‌ জায়েগা। ও ছোকরা হ্যায়।’ কিন্তু রাজার হুকুম, ‘না’ বলবার উপায় নেই। ওদিকে দিগ্বিজয়ী ছাত্র সভায় ঢুকে পাঁয়তারা করছে, ভাবটা বুড়োকে হারাতে আর কতক্ষণ। বুড়ো কি করে! সেলাম ঠুকে লেংটিটা টেনে প’রে মাটি থেকে একটু ধুলো হাতে মেখে সভায় ঢুকল। কুস্তি আরম্ভ হল। প্রথম কয়েক প্যাঁচ বুড়ো হারলে, দিগ্বিজয়ী সাকরেদ সহজেই তাকে ফেলে দেয়। সবাই ভাবলে বুড়ো হারে বুঝি এইবারে। শেষবার সাকরেদ প্যাঁচ দিতে যেমন এসেছে এগিয়ে, বুড়ো এমন এক প্যাঁচ মারলে চোখের নিমেষে সাকরেদ ছিটকে পড়ে গেল অনেকটা দূরে বার কয়েক ডিগবাজি খেয়ে। সভাসুদ্ধ হৈ হৈ। ওস্তাদ সাকরেদের দিকে চেয়ে বললে, ‘হুয়া?’ সাকরেদ উঠে হাত জোড় করে বললে, ‘ওস্তাদজি, এ প্যাঁচ তে আপ শিখলায়া নেহি।’ বুড়ো বললে, ‘নেহি বেটা, আজকে ওয়াস্তে এ প্যাঁচ রাখ্‌খা থা।’ জানত সাকরেদের শখ হবে একদিন কুস্তি লড়তে; সেইদিনের জন্য ওস্তাদ এই প্যাঁচ রেখে দিয়েছিল। আমার বেলাও হয়েছিল তাই। ঠিক এই কথাই বলেছিল আমায় আমারই এক নামজাদা ছাত্র। আর্ট সোসাইটিতে আমার সেই পাখির সেটগুলি একজিবিট করেছি, সে দেখে বললে, ‘এ কায়দা তো শেখাননি আমাদের।’ বললুম, ‘সবই শিখিয়ে দেব নাকি?’ অনেক প্যাঁচ এখনো শিখি, রেখে দিই, তোমরা লড়তে এলে তখন শেখাব।
অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর
১০. অবন একটা পাগলা অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর রবিকা বলতেন, ‘অবন একটা পাগলা।’ সে কথা সত্যি। আমিও এক-একসময়ে ভাবি, কি জানি কোন্‌দিন হয়তো সত্যিই ক্ষেপে যাব। এতদিনে হয়তো পাগলই হয়ে যেতুম, কেবল এই পুতুল আমাকে বাঁচিয়ে রেখেছে। এই নিয়েই কোনোরকমে ভুলে থাকি। নয় তো কি দশাই হত আমার এতদিনে। একটা বয়স আসে যখন এইসব ভুলে থাকবার জিনিসের দরকার হয়। একবার ভেবেছিলুম লেখাটা আবার ধরব, কিন্তু তাতে মাথার দরকার। এখন আর মাথার কাজ করতে ইচ্ছে যায় না। গল্প বলি, এটা হল মনের কাজ। এই মনের কাজ আর হাতের কাজই এখন আমার ভালো লাগে। তাই পুতুল গড়তেও আমার কষ্ট হয় না। সেখানে হাত চোখ আর মন কাজ করে। অন্য আর কিছু ভাবতেও ইচ্ছে করে না। রবিকা যে বৈকুণ্ঠের খাতায় তিনকড়ির মুখ দিয়ে আমাকে বলিয়েছিলেন ‘জন্মে অবধি আমার জন্যেও কেউ ভাবেনি আমিও কারো জন্য ভাবতে শিখিনি’, এই হচ্ছে আমার সত্যিকারের রূপ। রবিকা আমাকে ঠিক ধরেছিলেন। তাই তো তিনকড়ির পার্ট অমন আশ্চর্য রকম মিলে গিয়েছিল আমার চরিত্রের সঙ্গে। ও সব জিনিস অ্যাকটিং করে হয় না। করুক তো আর কেউ তিনকড়ির পার্ট, আমার মত আর হবে না। ওই তিনকড়িই হচ্ছে আমার আসল রূপ। আমি নিজের মনে নিজে থাকতেই ভালোবাসি। কারো জন্য ভাবতে চাইনে, আমার জন্যও কেউ ভাবে তা পছন্দ করিনে। চিরকালের খ্যাপা আমি। সেই খ্যাপামি আমার গেল না কোনোকালেই। আমার নামই ছিল বোম্বেটে। দুরন্তও ছিলুম, আর যখন যেটা জেদ ধরতুম সেটা করা চাই-ই। তাই সবাই আমার ওই নাম দিয়েছিলেন। রবিকারাও চিরকাল ওই ‘খ্যাপা’ ‘পাগলা” বলে আমাকে ডাকতেন। আমিও যেন তাদের কাছে গেলে ছোট্ট ছেলেটি হয়ে যেতুম। এই সেদিনও রবিকাদের কাছে গেলেই আমার বয়স ভুলে আমি যেন সেই পাগলা খ্যাপা হয়ে যেতুম। তাঁরাও আমায় সেইভাবেই দেখতেন। কিছুকাল আগে যখন সস্ত্রীক শান্তিনিকেতনে এসেছিলেম, রবিকার হুকুমে প্রতিমা ও কারপ্লেজ, ওরা মিলে আমার থাকবার জন্য ঘর সাজিয়েছে যেন একটা বাসরঘর। আমি আবার আস্তে আস্তে সব তুলে রাখি, কি জানি কোন্‌টা ময়লা হয়ে যাবে। নিজের বিছানাপত্র খুলে নিই। সকালে উঠেই আমাকে এই বকুনি, ‘না, ও সব তুমি কি করছ।’ বলে আবার সেইভাবে ঘরদোর সাজিয়ে দেওয়ালেন। জ্যোতিকাকার কাছে রাঁচিতে গেলুম, তখন তো আমি কত বড়, ছেলেপুলে নাতিনাতনি আমার চারদিকে। জ্যোতিকাকামশায় রোজ সকালে টুং টুং করে রিক্‌শ বাজাতে বাজাতে বেড়িয়ে ফিরতেন। কোলের উপর একটি কেকের বাক্স। রিক্‌শ থেকে নেমে কেকের বাক্সটি আমার হাতে দিয়ে বলতেন, ‘অবন, তোমার জন্য এনেছি, তুমি খেয়ো।’ ঘর ভরতি নাতিনাতনি, সে সব ফেলে আমার জন্য নিজের হাতে বাজার থেকে কেক কিনে আনলেন। এনে আমার হাতে দিয়ে বারে বারে বললেন, ‘তুমি খেয়ো কিন্তু, তোমার জন্যই এনেছি।’ আমি মহা অপ্রস্তুতে পড়তুম। বলতুম, ‘আপনি কেন কষ্ট করতে গেলেন, চাকরদের বললে তারাই তো এনে দিতে পারত।’ কিন্তু তা হবে না। ছোট ছেলেকে লজেঞ্জুস খেতে যেমন দেয়, অবন কেক খেতে ভালোবাসে, নিজের হাতে এনে দিতে হবে। এমনিই ছোট্টটি করে দেখতেন ওঁরা আমাকে চিরকাল। এখনো এক-একদিন আমি স্বপ্ন দেখি যেন বাবামশায় ফিরে এসেছেন, আর আমি ছোট্ট বালকটি হয়ে গেছি। একেবারে নিশ্চিন্ত। আনন্দে ভরপুর হয়ে যাই স্বপ্নেতে। এ স্বপ্ন আমি প্রায়ই দেখি। মা পিসিমারা সব বাড়িতে আছেন, আমিও বড় এই রকমই আছি, ছেলেপুলে সব ঘর ভরতি। বাবামশায় যেন কোথায় গিয়েছিলেন, ফিরে এলেন; বাড়ি একেবারে জমজমাট, সবাই ব্যস্ত। আমি আনন্দে উৎফুল্ল হয়ে উঠেছি, যাক, নিশ্চিন্ত হওয়া গেল, বাবামশায় এসেছেন আর কোনো ভাবনা নেই। কিন্তু বাবা যেন দু-দিন বাদেই চলে যাবেন, একটা বৈরাগ্য ভাব। স্বপ্নে ওরই বেদনা বেজে ওঠে বুকে, ঘুম ভেঙে যায়। আমার বাবা ছিলেন অজাতশত্রু; কি তাঁর মন, কি তাঁর ব্যবহার। তাঁর কাছে যে-কেউ আসত তাদের আর দুঃখ বলে কিছু থাকত না। এমনিই আনন্দময় তার সান্নিধ্য ছিল। জ্যেঠামশায়ের একটা কবিতা মনে পড়ল। তার এক লাইনেই আমার বাবামশায় আর জ্যোতিকাকামশায়ের চরিত্র ফুটে উঠেছে। জ্যেঠামশায় লিখেছিলেন— ভাতে যেথা সত্যহেম মাতে যথা বীর গুণজ্যোতি হরে যেথা মনের তিমির। এ অতি সত্যিকথা। তাদের কাছে এলে মনের সব তিমির দূরে চলে যেত। আনন্দময় করে রাখতেন চারদিক। উৎসব, আনন্দ, প্রাণখোলা হো-হো হাসি, সে যে না শুনেছে বুঝবে না। অমন হাসতেই শুনিনে আর কাউকে। বাবামশায় আর জ্যোতিকাকামশায়ের খুব ভাব ছিল। একসঙ্গে তারা আর্ট স্কুলে ভরতি হয়েছিলেন। আমি যখন আর্ট স্কুলে যাই, সে রেকর্ড খুঁজে বের করি। বাবামশায়ের মত বন্ধুভাগ্য এ বাড়ির আর কারো ছিল না। রবিকা বন্ধু পেয়েছেন, কিন্তু অবন্ধুও পেয়েছেন ঢের। বাবামশায় দেশ বেড়াতে খুব ভালোবাসতেন। থেকে থেকেই পশ্চিমের দিকে ঘুরে আসতেন। ওঁর খুব প্রিয় জায়গা ছিল অমৃতসর। অমৃতসরে গোল্ডেন টেম্পলের সামনে অনেকক্ষণ অবধি বসে থাকতেন আর মন্দিরে ভোগ দিতেন। অমৃতসরের মন্দিরের সব লোকেরা বাবামশায়কে চিনত, হোটেলের খানসাম বাবুর্চিরা অবধি। একবার বড়দাদারা অমৃতসর যান, যে হোটেলে বাবামশায় থাকতেন সেই হোটেলেই তাঁরা উঠেছেন। হোটেলের এক বুড়ো বাবুর্চি তাঁদের জিজ্ঞেস করলেন, বাবামশায়ের নাম করে যে সেই বাবু কোথায়? তিনি যখন পশ্চিমে ওই রকম ঘুরে ঘুরে বেড়াতেন আমরা তখন আর কতটুকুই বা, কিন্তু আমাদের কাছে নিয়মমত চিঠি দিতেন। শুধু চিঠি দেওয়া নয় আমাদের চিঠি লেখা শেখাতেন। কি ভাবে লিখতে হবে, কোথায় কি ভুল হল চিঠি লিখে লিখে সব ঠিক করে দিতেন। চিঠি লেখা দস্তুরমত শিক্ষা করতে হয়েছে আমাদের। বাড়িতে এক পণ্ডিত আসত তার কাছেও আমাদের চিঠি লেখার শিক্ষা হত। বাবামশায় আমাদের আবার লিখতেন কার কি চাই জানাতে। একবার তিনি তখন দিল্লি আগ্রার দিকে। সেই হিন্দুমেলাতে যে দিল্লির মিনিয়েচার দেখেছিলুম সেই ছিল আমার মনে। আমি লিখলুম, আমার জন্য আগ্রা দিল্লির ছবি আনতে। বাবামশায় ফিরে এলেন; দাদারা যে যা চেয়েছিলেন, বোধ হয় ভালো ভালো জিনিসই হবে, সবাই সবার ফরমাশমাফিক জিনিস পেলেন। আমার জন্য বের হল একটা কাগজের তাড়া। আমি ভেবেছিলুম যে, হিন্দুমেলায় দিল্লির মিনিয়েচারের মত কিছু একটা হবে। কাগজের তাড়া খুলে দেখি আগ্রা দিল্লির কতকগুলো পট। সাদা কাগজের উপরে যেমন কালিঘাট লক্ষ্ণৌয়ের পট হয় সেই রকম হাতে লেখা আগ্রা দিল্লির ছবি আঁকা। এখন আর সে সব পট পাওয়াই যায় না। সেগুলি থাকলে আজ খুব দামি জিনিস হত। তখন কি আর করি, তা-ই খুলে খুলে দেখলুম, কয়েকদিন বাদে ছিঁড়ে কুটে কোথায় উড়িয়ে দিলুম। জানি কি তখন সে সব জিনিসের মূল্য! বাবামশায় আমার কথা বলতেন, ‘ওকে আর বিদেশে পাঠাব না। ও আমার সঙ্গে ঘুরে ঘুরে ভারতবর্ষ দেখবে, ভারতবর্ষ জানবে। এদেশটাই ওকে দেখাব ভালো করে।’ তাই হল, বাবামশায় মারা গেলেন, আমার আর বিদেশ যাওয়া হল না, এখনও ভারতবর্ষকেই দেখছি, জানছি। বড় হবার পরে যখন ছবি আঁকা নিয়েই মেতে রইলুম, মার মনে বড় ভাবনা হল যে, এই ছেলেটার লেখাপড়াও হল না বিষয়কর্মও শিখল না, কিছুই হল না। তার পর যখন দিল্লির দরবার থেকে সোনার মেডেল এল, আর্টস্কুলের ভাইস প্রিন্সিপাল হলুম, চারদিকে নাম রটতে লাগল, তখন মা বললেন, ‘আমি ভয় পেয়েছিলুম যে কিছুই তোর হল না। এখন মনে হচ্ছে যে কিছু একটা হলি তবুও।’ সুমধুর স্মৃতি তেমন ছিল না জীবনে। তবে কবির সঙ্গ পেয়েছি, সেই ছিল জীবনের একটা মস্ত সম্পদ। মাও বুঝতেন, বলতেন, ‘রবির সঙ্গে আছিস, বড় নিশ্চিন্ত আমি।’
অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর
১১. কর্মজীবন বলে আমার কিছু নেই অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর কর্মজীবন বলে আমার কিছু নেই, অতি নিষ্কর্মা মানুষ আমি। নিজে হতে চেষ্টা ছিল না কখনো কিছু করবার, এখনো নেই। তবে খাটিয়ে নিলে খাটতে পারি, এই পর্যন্ত। তাই করত, আমায় সবাই খাটিয়ে নিত। বাড়িতে কোনো ক্রিয়াকর্ম হলে সহজে হাত লাগাতুম না কিছুতে। কিন্তু যদি কোনো কাজের ভার পড়ত ঘাড়ে নিঁখুত করে সেই কাজ উদ্ধার করে দিতুম। হ্যাভেল সাহেব বসিয়ে দিলেন আর্ট স্কুলে। ছাত্র ধরে দিলেন সামনে, বললেন, ‘আঁকো, আঁকাও।’ তার মধ্যে আর একটা মানেও ছিল। বলতেন অনেক সময়েই যে, ‘ভালো ঘরের ছেলেরা যদি আর্টের দিকে ঝোঁকে পাবলিকের নজর পড়বে এদিকে। দেশের লোক তোমাদের কথায় বেশি আস্থা রাখবে।’ নেহাত মিছে বলতেন না। নয় তো তখনকার আর্ট স্কুল সম্বন্ধে লোকের ধারণাবদলাত না। আর্ট সোসাইটি খুলে উডরফ ব্লান্টও খাটিয়ে নিতেন আমায়। রাজা এলেন, ময়দানে মস্ত প্যাণ্ডেল তৈরি হল, রাজার বসবার মঞ্চ উঠল। উডরফ বললেন, ‘মঞ্চের চারদিকে তোমায় এঁকে দিতে হবে।’ পি. ডাবলিউ. ডির লোকেরাই ফ্রেমে কাপড় লাগিয়ে সব ঠিকঠাক করে এসে ধরলে সামনে। লাগিয়ে দিলুম ছাত্রদের, নিজেও হাত লাগালুম; হয়ে গেল মঞ্চ ডেকোরেশন। রাজার সিম্‌বল্‌ দিয়ে ছবি এঁকে দিয়েছিলুম, খুব ভালো হয়েছিল। হাজার বারোশো টাকাও পাওয়া গিয়েছিল। পরে রাজা চলে গেলে সেই ছবিগুলো বর্ধমানের রাজা কিনে নিলেন ছ-শো টাকা দিয়ে, নিয়ে তাঁর কোন্‌ এক ঘর সাজালেন। আমাদের ভালোই হল। এ-হাতেও টাকা পেলুম ও-হাতেও টাকা পেলুম, সব টাকা ভাগাভাগি করে বেঁটে দিলুম ছাত্রদের। আমাকে দিয়ে খাটিয়ে নিলে কোমর বেঁধেই লাগতুম, কাজও ভালো হত। আসলে ভিতরে তাগাদাও ছিল কিনা একটা। তবে না করিয়ে নিলে ছবিও আমার হত না বোধ হয়। বড় কুঁড়ে স্বভাব আমার ছেলেবেলা থেকেই; কোথাও নড়তে পর্যন্ত ইচ্ছে করে না। অথচ দেখতুম তো চোখের সামনে রবিকাকে; তিনিও তে৷ আর-এক আর্টিস্ট, পৃথিবীর এ-মাথা ও-মাথা ঘুরে বেড়িয়েছেন। বলতেন, ‘অবন, তুমি কী? একটু ঘুরে বেড়িয়ে দেখো চারদিক, কত দেখবার আছে।’ ছেলেবেলায় কল্পনা করতুম বড় হয়ে কত দেশবিদেশ বেড়াব, ইচ্ছেমত এখানে ওখানে যাব। কিন্তু বড় হয়ে যখন বেরোবার বেড়াবার সেই সময়টি এল হাতে তখন বাড়িতেই বসে রইলেম একেবারে ঘোরো বাবুটি বনে, তোমার জন্য ঘরোয়া কথার মালমশলা সংগ্রহ করতে। তবে ঘরে বসেই সারা পৃথিবীর মানুষের আর্ট আমি চর্চা করেছি, এ কথা বিশ্বাস করো। আর্টস্কুলের চৌকিতে বসে থাকতুম; কত দেশবিদেশ থেকে নানারকম ব্যাপারী আসত নানারকম জিনিস নিয়ে। গবর্মেন্টের টাকায় আর্ট গ্যালারির জন্য জিনিস সংগ্রহ করছি, সঙ্গে সঙ্গে দেশের আর্টের সঙ্গে পরিচয়ও ঘটে যাচ্ছে। এই করে আমি চিনেছিলেম দেশের আর্ট। তার উপরে ছিলেন আমার হ্যাভেল গুরু। এ দেশের আর্ট বুঝতে এমন দুটি ছিল না, রোজ দুঘণ্টা নিরিবিলি তাঁর পাশে বসিয়ে দেশের ছবি, মূর্তির সৌন্দর্য, মূল্য, তার ইতিহাস বুঝিয়ে দিতেন। হুকুম ছিল আপিসের চাপরাসিদের উপর ওই দু-ঘণ্টা কেউ যেন না এসে বিরক্ত করে। সদ্‌গুরু পাওয়ে, ভেদ বাতাওয়ে, জ্ঞান করে উপদেশ, তব্‌, কয়লা কি ময়লা ছোটে যব্‌ আগ্‌ করে পরবেশ। ভাবি সেই বিদেশী গুরু আমার হ্যাভেল সাহেব অমন করে আমায় যদি না বোঝাতেন ভারতশিল্পের গুণাগুণ, তবে কয়লা ছিলেম কয়লাই হয়তো থেকে যেতেম, মনের ময়লা ঘুচত না, চোখ ফুটত না দেশের শিল্পসৌন্দর্যের দিকে। ভারতের উত্তর দক্ষিণ পূব পশ্চিম সবদিকে ছিল চর আমাদের। এক তিব্বতী লামা ছিল, মাঝে মাঝে আসত; দামি দামি পাথর, চাইনিজ জেড, তিব্বতী ছবি, নানারকম ধাতুর মূর্তি আনত। সে এলেই আমরা উৎসুক হয়ে থাকতুম দেখতে এবারে কি এনেছে। একবার এল সে বললে, শরীর খারাপ, দেশে যাব কিছুকালের জন্য। বোম্বে যাচ্ছি, কিছু টাকা পড়ে আছে, তুলতে পারি কিনা দেখি। এবারে তাই বেশি কিছু আনতে পারিনি। তবে কিছু কানুরের পুঁথি এনেছি এই দেখুন।’ খুব পুরানো পুঁথি, দুষ্প্রাপ্য জিনিস, কিন্তু আমার তো কোনো কাজে লাগবে না। এ পুঁথি আমি নিয়ে কি করব। ইম্পিরিয়াল লাইব্রেরিতে হরিনাথ দে মস্ত ভাষাবিদ, সব ভাষাই তিনি জানতেন শুধু চীনে ছাড়া; বলতেন, ‘এবারে চীনেভাষাটা আমার শিখতে হবে।’ তার কাছে যেতে বললুম এই পুঁথি নিয়ে। বেশ দাম দিয়েই রাখবেন, দরকারি জিনিস। বললুম, ‘আর কি এনেছ দেখাও।’ সে একটি ছোট্ট পলার গণেশ বের করলে। বেশ গণেশটি; পছন্দ হল। পাঁচ-সাত টাকা চাইলে বোধ হয়, তা দিয়ে গণেশটি আমি পকেটে পুরলুম। বললুম, ‘আর?’ সে এবারে একটি কৌটাে বের করলে, বললে, ‘আর কিছু নেই সঙ্গে এবারে।’ সেটি একটি নাসদান, খোদাই করা স্টীলের উপরে সোনার কাজ, একটা ড্রাগন আঁকা, বড় সুন্দর। রাখবার ইচ্ছে আমার। জিজ্ঞেস করলেম, ‘দাম?’ সে বললে, ‘পঞ্চাশ টাকা।’ আমি বললুম, ‘এ বড় বেশি চাইলে।’ সে বললে,‘ তা এখন ওটা আপনার কাছেই থাক্। কেউ নেয় তো বেচে দেবেন। আমি ফিরতি পথে এসে টাকা নিয়ে যাব।’ ব’লে তাড়াতাড়ি জিনিসপত্তর গুটিয়ে চলে গেল। সে চলে যাবার সঙ্গে সঙ্গেই আমার কি রকম যেন মনে হল, জিনিসটা রাখলুম, দাম দিলুম না, বললে ওর শরীর খারাপ—যদি ও ফিরে না আসে আর? কাজটা কি ভালো হল? যাক, কি আর করা যাবে? বাড়ি এসে অলকের মাকে পলার গণেশটি দিলুম, বললুম, ‘এটি দিয়ে আমার জন্য একটি আংটি করিয়ে দিয়ো।’ সে আংটি আমার আঙুলে অনেকদিন ছিল, পরে হারিয়ে গেল। আর নাসদানিটি তাঁর হাতে দিয়ে বললুম, ‘এটি গচ্ছিত ধনের মত সাবধানে রেখো। ওকে টাকা দেওয়া হয়নি এখনো।’ তার পর এক বছর যায়, দু-বছর যায়, আর সে আসে না। হঠাৎ একদিন সেই লামার একটি ভাই এসে উপস্থিত। বললে, ‘সে সেবারে বোম্বে গিয়ে দু-চারদিন পরেই মারা গেছে। আপনাদের কাছে তার যা পাওনা আছে সেই সব টাকা আমায় দিন।’ আমি জানতুম, এই ভাইয়ের সঙ্গে লামার বনিবনাও ছিল না। বাড়িঘরের সুখদুঃখের কথা প্রায়ই বলত সে। এখন সেই ভাই তার মৃত্যুর পরে কাগজপত্ৰ হাত করে টাকাও আত্মসাৎ করবার চেষ্টায় আছে। আমি তো তখনি তাকে হাঁকিয়ে দিলুম। বললুম, ‘কে তুমি। তোমায় জানিনে, শুনিনে, টাকা দিতে যাব কেন? যদি তোমার ভাইয়ের ছেলেপুলে থাকে বা তার স্ত্রী আসে তবে দেখতে পারি।’ সে তাড়া খেয়ে ভাগল। তার কিছুদিন পরে সেই লামার বুড়ি স্ত্রী এল, পাহাড়ি মেয়ে। আগেও দেখেছি তাকে দু-একবার লামার সঙ্গে। সে এসেই তো খুব দুঃখ করলে তার স্বামীর জন্যে। বেচারা দেখতেও পায়নি শেষ সময়ে। তারও শরীর অসুস্থ ছিল। এতদিন তাই আসতে পারেনি। স্বামী নানা দেশবিদেশে জিনিসপত্তর বিক্রি করত, নানা জায়গায় টাকা পড়ে আছে তার। ‘বললুম, কদিন আগে তার ভাই এসেছিল যে টাকার জন্য। আমি দিইনি।’ সে বললে, ‘তা দাওনি, বেশ করেছ। আমি এসেছি তোমাদের কার কাছে তার কি জিনিসপত্তর আছে সেই খোঁজে। তোমার কাছে তো সে খুব আসত, তুমি জানো, কোথায় কি দিয়ে গেছে শেষবার।’ আমি বললুম, ‘শেষবারে সে কতকগুলি কাঞ্জুরের পুঁথি এনেছিল। আমি তাকে হরিনাথ দের কাছে পাঠিয়েছিলুম। পরে খোঁজ নিয়ে জেনেছিলুম, তিনি সেই পুঁথিগুলি খুব দাম দেবেন বলেই রেখেছিলেন। সেও ফিরে এসে নেবে বলে চলে যায়। তুমি সেখানে গিয়ে খোঁজ করো, পাবে। সে বললে, ‘আমি গিয়েছিলেম সেখানে, কিন্তু তারা কেউ সে পুঁথির সন্ধান দিতে পারেনি। হরিনাথ দে মারা গেছেন। পুঁথি যে কি হল কেউ জানে না।’ বহু পরে আমি সেই পুঁথি দেখি সাহিত্য-পরিষদে। দেখেই চিনেছি—আমার হাত দিয়ে গেছে পুঁথি, আর আমি চিনব না! যাক সে কথা, মেয়েটি তো তার দাম বা সন্ধান কিছুই পেলে না। আমি বললুম, ‘আমাকে দিয়ে গিয়েছিল সেবারে সে এই আংটির পলাটি, এটির দাম আমি তাকে দিয়েছি। আর দিয়েছিল একটি নাসদানি, দাম নেয়নি, ফিরতি পথে নেবে বলেছিল; কিন্তু সে তো আর এল না এ পথে, তুমি সেটা নিয়ে যাও।’ শুনে বুড়িটি অনেকক্ষণ চোখ বুজে চুপ করে রইল। পরে বললে, ‘আমি তো সব জানি। সেই নাসদানিটি একবার দেখতে চাই। দেখাবে?’ বললুম, ‘তা তো এখানে নেই, বিকেলে আমার বাড়িতে এসো তাহলে।’ বাড়ি সে চিনত। বিকেলে এল, আমিও ফিরেছি কাজ সেরে। অলকের মা সিন্দুকে তুলে রেখেছিলেন কৌটােটি, তাঁকে বললুম, ‘বের করে দাও ওটি, এতদিন পরে তার মালিক এসেছে।’ কৌটোটি এনে দিলুম বুড়ির হাতে। বললুম, ‘সে পঞ্চাশ টাকা চেয়েছিল, তখন অত দাম দিতে চাইনি। তা তুমি এখন অভাবে পড়েছ যা চাইবে দেব। নয় তোমার জিনিস তুমি ফিরিয়ে নাও। তাতেও আমি অসন্তুষ্ট নই।’ বুড়ি বললে, ‘হ্যা, এ-জিনিসটি দেখেছি তার কাছে।’ বলে দু হাতে তা নিয়ে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে যত দেখছে আর দু চোখের ধারা বয়ে যাচ্ছে। বেচারার হয়তো স্বামীর কথা মনে পড়েছিল, কি স্মৃতি ছিল তাতে সেই জানে। খানিক দেখে কৌটোটি আমার হাতে ফিরিয়ে দিয়ে বললে, “তিনি তোমায় দিয়ে গেছেন, এটি তোমার কাছেই থাকুক। দাম আমি কিছুই চাইনে।’ বললুম, ‘সে কি কথা। তোমার স্বামী মারা গেছে, তোমার টাকার দরকার, আর তুমি দাম নেবে না, বল কি? সে হবে না।’ বুড়ি ছলছল চোখে বললে, ‘বাবু, ও কথা বোলো না। আমি জানি আমার স্বামী অনেককেই নানা জিনিস বিক্রি করত, অনেকের কাছে টাকা পড়ে থাকত। আমি কলকাতায় এসে কদিন যাদের যাদের ঠিকানা পেয়েছি তাদের কাছে ঘুরেছি, দাম দেওয়া দূরে থাকুক, কেউ স্বীকার পর্যন্ত করলে না যে তারা আমার স্বামীকে চিনত। এক তুমি বললে যে, আমার স্বামীর জিনিস তোমার কাছে আছে। তোমার কাছ থেকে আমি এক পয়সাও চাইনে, এই কৌটাে তোমার কাছেই থাকুক। আর এই চাদরটি তোমার স্ত্রীকে দিয়ো আমার নাম করে।’ বলে থলে থেকে একটা মোটা সুজনির মত চাদর, পাহাড়ি মেয়েরা গায়ে দেয়, তা বের করে হাতে দিলে। জীবনের কর্মের আরম্ভে বড় পুরস্কার পেলুম আমরা দুজনে এক গরিব পাহাড়ি বুড়ির কাছে—একটি গায়ের চাদর, একটি সোনার নাসদান। আর একবার হঠাৎ একটা লোক এসে উপস্থিত আমার কাছে—জাপানী টাইপ, কালো চেহারা, চুল উস্কোখুস্কো, ময়লা কোট পাজামা পরা, অদ্ভুত ধরনের। আর্টস্কুলের আপিসে বসে আছি, চাপরাসি এসে বললে, ‘হুজুর, এক জাপানী কুছ লে আয়া।’ বললুম, ‘আনো তাকে এখানে।’ সে এল ভিতরে, বললুম, ‘আমার কাছে এসেছ? তা কি দরকার তোমার?’ সে এদিক ওদিক তাকিয়ে কোটের বুকপকেট থেকে কালো রঙের চামড়ার একটা ব্যাগ বের করলে, করে তা থেকে দুটি বড় বড় মুক্তো হাতে নিয়ে আমার সামনে ধরলে। দেখি ঠিক যেন দুটি ছোট আমলকী। এত বড় মুক্তো দেখিনি কখনো। এ কোথায় পেল? সে মুক্তো দুটিকে শঙ্খমণি না কি মণি বলে, আর আমার চোখের সামনে নাড়ে। বললুম, ‘বিক্রি করবে?’ দাম চাইলে দুটােতে একশো টাকা। মুক্তো কিনব, তা নিজে তে চিনিনে আসল নকল। বাড়িতে ফোন করে দিলাম জহুরী কিষণচাঁদকে বড়বাজার থেকে খবর দিয়ে যেন আনিয়ে রাখে, আমি আসছি এখনি। ভুল হয়ে গেল গাড়িটার কথা বলতে। বাড়ির গাড়ি আসবে স্কুল ছুটি হলে। . আমার আর ততক্ষণ সবুর সইছে না। একটা ঠিকে গাড়ি করেই রওনা হলুম সেই লোকটিকে নিয়ে। বাড়ি পৌঁছে দেখি কিষণচাঁদও এসে উপস্থিত। কিষণচাঁদকে সেই মণি দুটাে দেখালুম, বললুম, ‘দেখো তো, একশো টাকা দাম চাইছে। বলে শঙ্খমণি, তা আসল কি নকল দেখে দাও, শেষে না ঠকি যেন।’ মনে পড়ল দাদা একবার পাহাড়ে এইরকম বড় মুক্তো কিনে খুব ঠকেছিলেন। মুক্তো কিনে কার কথা শুনে লেবুর রস দিয়ে যেই না ধুয়েছেন মুক্তোর উপরের এনামেল উঠে গিয়ে ভিতরের সাদা কাঁচ বেরিয়ে পড়ল, ঠিক যেন দুটি সাদা মার্বেল। বললুম, ‘দেখো কিষণচাঁদ, আমারও না আবার সেই অবস্থা হয়।’ কিষণচাঁদ অনেকক্ষণ মুক্তো দুটি হাতে নিয়ে নেড়েচেড়ে দেখলে, বললে, ‘ঠিক বুঝতে পারছিনে।’ আমারও মন খুঁত খুঁত করতে লাগল। যে কাজে মনে খুঁত থাকে তা না করাই ভালো। আমি বললুম, ‘থাক্ কিষণচাঁদ, বুঝতে যখন পারছ না তুমি, এ ফেরত দিয়ে দেওয়াই ভালো। দরকার নেই রেখে এ জিনিস।’ মণি দুটাে ফেরত দিয়ে দিলুম, সেই লোকটা চলে গেল। তার কিছুদিন পরে কাগজে দেখি, বিলেতের কোন এক বড়লোকের মেমের একটা নেকলেস হারিয়েছে, বড় বড় মুক্তো ছিল তাতে। পরে বাড়ির ছেলেদের ডেকে বলি, ‘ওরে দেখ্‌ দেখ্‌ না রেখে ভালোই করেছি। কি জানি হয়তো সেই মুক্তোই এনেছিল বিক্রি করতে। শেষে চোরাই মাল রেখে মুশকিলে পড়তে হত হয়তো। লোকটার ঠিক চোর-চোর চেহারাই ছিল।’ আর্টিস্ট হচ্ছে কলেক্টর, সে এটা ওটা থেকে সংগ্রহ করে সারাক্ষণ, সংগ্রহেই তার আনন্দ। রবিকা বলতেন, ‘যখন আমি চুপ করে বসে থাকি তখনই বেশি কাজ করি।’ তার মানে, তখন সংগ্রহের কাজ চলতে থাকে। চেয়ে আছি, ওই সবুজ রঙের মেহেদি-বেড়ার উপর রোদ পড়েছে। মন সংগ্রহ করে রাখল, একদিন হয়তো কোনো কিছুতে ফুটে বের হবে। এই কাঠের টুকরোটি যেতে যেতে পথে পেলুম, তুলে পকেটে পুরলুম। বললে তো ঝুড়ি ঝুড়ি কাঠের টুকরো এনে দিতে পারে রথী ভাই এখখুনি। কিন্তু তাতে সংগ্রহের আনন্দ থাকে না। এমনি কত কিছু সংগ্রহ হয় আর্টিস্টের মনের ভাণ্ডারেও। এই সংগ্রহের বাতিক আমার চিরকালের। যাক সেবার তো মুক্তো ফসকে গেল। কিন্তু কি করে জিনিস হাতে এসে পড়ে দেখো। একখানি পান্না, ইঞ্চিখানেক চওড়া, চৌকো পাথরটি, দেখেই চোখে পড়ে, উপরে খোদাই করা মোগল আমলের। আজকাল এ জিনিস পাবে না কোথাও। বুড়ো রোগা অনন্ত শীল জহুরী, পুরানো পাথর বিক্রি করে। ভালো কিছু হাতে এলেই নিয়ে আসে আমাদের কাছে। একদিন নিয়ে এল কয়েকটা পুরোনো টিনের কৌটোভরা নানারকমের পাথর। তার মধ্যে ওই পান্নাটি দেখেই আমার কেমন লোভ হল। তাড়াতাড়ি হাতে তুলে নিলুম। বললুম, ‘এটি কত হলে দেবে? টাকা পঞ্চাশেক হলে চলবে তো?’ বুড়ো জহুরী ঘাগি লোক; চোখ দেখেই বুঝেছিল, জিনিসটি খুবই পছন্দ হয়েছে আমার। দাম বাড়াবার ইচ্ছে না কি? বললে, ‘তা আমি ঠিক করে এখন বলতে পারছিনে। পরে জানাব।’ এই বলে সেদিন সেটি নিয়ে চলে গেল। মনটা আমার খারাপ হয়ে গেল, বড় সুন্দর পান্নাটি ছিল। লোভও হয়েছিল খুব রাখবার, নিয়ে গেল চোখের সামনে থেকে। তা কি আর করব। গেল তো গেল। বুড়োর আর দেখা নেই। মাস ছয়েক পরে তার ছেলে এল একদিন, নেড়া মাথা। বললে, ‘বাবা চলে গেছেন।’ বললুম, ‘সে কি রে। এই যে সেদিনও এসেছিল পুরোনো পাথর নিয়ে। তা তুই এখন কি করছিস?’ সে বললে, ‘আমিই বাবার দোকান দেখাশুনো করি। আপনারা আমার কাছ থেকে পাথর মণি মুক্তো কিনবেন না কিছু? বরাবর তো বাবাই আপনাদের দিতেন এসে যা চাইতেন। আমার কাছ থেকেও তেমনি নেবেন দয়া করে।’ তাকে বললুম, ‘দেখ্‌, শেষবার তোর বাবা এনেছিলেন একটি পান্না। আমার পছন্দ হয়েছিল, দামও বলেছিলুম পঞ্চাশ টাকা। কয়েকদিন বাদে সে আসবে বলে গেল, আর তো এলো না। সেই পাল্লাটি আমায় এনে দিতে পারিস?’ পুরোনো খদ্দের হাতে রাখবার বাসনা, পরদিন দেখি ছেলেটি ঠিক খুঁজেপেতে নিয়ে এল সেই পান্নাটি একটি মরচে পড়া টিনের কৌটোয় পুরে। বললুম, ‘দাম কত চাস?’ সে বললে, ‘বাবার সঙ্গে যা কথা হয়েছে তাই দেবেন।’ টাকা নিয়ে সেদিন সে চলে তো গেল। ছেলেমানুষ পান্নার মূল্য বোঝেনি হয়তো। কয়েকদিন বাদে কার সঙ্গে কি কথা হয়েছে, সে এসে হাজির। বললে, ‘একটি ভুল হয়ে গেছে।’ বললুম, ‘আর ভুল। দস্তুরমত পান্নাটি কিনেছি আমি। রসিদ দিয়ে তুমি টাকা নিয়েছ। এখন ভুল বললে শুনব কেন? এই পান্নাটি তোমার বাপের কাছে চেয়েছিলুম সেবারে, পেলুম না। হাতছাড়া হয়ে গেল, আশা তো ছেড়েই দিয়েছিলুম আমি। এবারে তোমার কাছ থেকে আমি কিনেছি, আর কি হাতছাড়া করি? সে চলে গেল। তারপর বোম্বের ঠাকুরদাস জহুরী আসতে তাকে পান্নাটি বের করে দেখাই। সে তো হাতে নিয়ে অবাক । বললে, ‘এ জিনিস আপনি পেলেন কোথায়? এ যে অতি দুর্লভ পান্না, বহুমূল্য জিনিস। এইরকম ফুল-খোদাইকরা পান্না মোগল আমলেই ব্যবহার হত শুধু। ঠাকুরদাস বললেন, এর এক রতির দাম পাঁচশো টাকা। পান্নাটির ওজন হল বেশ কয়েক রতি। বললে, ‘আপনি পঞ্চাশ টাকায় কিনেছেন আমি এখনি ছশো টাকা দিতে রাজি আছি এটির জন্য।’ সেই পান্নাটি, আর একটি দুর্লভ মোহর ছিল আমার কাছে, তার একদিকে জাহাঙ্গীর আর একদিকে নূরজাহানের ছবি। রাখালবাবু দিয়েছিলেন আমায়, একশো টাকা দিয়ে কিনেছিলুম। এই মোহর আর পান্নাটি দিয়ে একটি ব্রোচ তৈরি করালুম আমাদের বিশ্বস্ত জহুরীকে দিয়ে। সেই পাল্লাটির চারদিকে ছোট ছোট মুক্তো, আর মোহরটি ঝুলছে পান্নাটির নিচে। ব্রোচটি অলকের মাকে দিলুম। তিনি প্রায়ই কাঁধের উপরে ব্যবহার করতেন সেটি, বেশ লাগত। সেই একবার খুব পান্নার বাতিক হয়েছিল। ভেবেছিলুম খুঁজতে খুঁজতে কোহিনুর-টােহিনুর পেয়ে যাব হয়তো একদিন। পেলুম না। কিন্তু তার চেয়েও বেশি আজকাল আমার এই কাঠকুটো কুটুমকাটাম—কোথায় লাগে এর কাছে কোহিনুর মণি। আমার ফটিকরানী, কোনো কোহিনুর দিয়ে তৈরি হবে না। ভাঙা ঝাড়ের কলমটি নমিতা এনে দিলে। ওডিকোলনের একটা বাক্স, সামনেটায় কাঁচ দেওয়া, তাকে শুইয়ে দিলুম সেই কাঁচের ঘরে, বললুম, ‘এই নাও আমার ফটিকরানী ঘুমোচ্ছে। রেখে দাও যত্ন করে।’ ইচ্ছে ছিল, আর একটি সবুজ রঙের কাঠি পেলে শুইয়ে দিতুম পাশাপাশি, থাকত দুটিতে বেশ। সেই পান্নার বাতিকের সময়ে—আর একটি লোক এল একদিন, জব্বলপুরে পাওয়া যায় নানারকম পাথর, বহু পুরোনো পোকামাকড় গাছপালা পাথর হয়ে গেছে, সেই সব নিয়ে। ভারি সুন্দর সুন্দর পাথর সব। তার মধ্যে একটি ছিল ঠিক গোল নয়, বাদামের মতো গড়নটি দেখতে, রঙটি অতি চমৎকার। পছন্দ হল, কিন্তু দাম বেশি চাইল বলে রাখলুম না। লোকটি তার সব পাথর দেখিয়ে খানিক বাদে চলে গেল। বসে আছি বারান্দায় চুপচাপ। সমরদার ছোট নাতনিটি এসে সেখানে খেলা করতে লাগল। দেখছি সে খেলা করছে আর অনবরত মুখ নাড়ছে। বললুম, ‘দেখি তোর মুখে কি?’ সে সামনে এসে হাঁ করে জিব মেলে ধরলে। দেখি জিবের উপরে সেই পাথরটি। বললুম, ‘কোথায় পেলি তুই এই পাথর। দে শিগগির বের করে। গিলে ফেললে কি কাণ্ড হবে।’ এখন, সেই লোকটি যাবার সময় সব জিনিস তুলেছে, ভুলে সেই পাথরটিই ফেলে গেছে। সমরদার নাতনি সেটি পেয়ে লজেঞ্জুস ভেবে মুখে পুরে বসে আছে। তাড়াতাড়ি তার মুখ থেকে পাথরটি নিয়ে পকেটে পুরলুম। পরদিনই সেটি আমার আংটিতে বসিয়ে একেবারে আঙুলে পরে বসলুম। সুন্দর পাথরটি, তার গায়ে একটি মৌমাছি দুটি ডানা মেলে বসে আছে, পাথর হয়ে গিয়েছিল। মেয়েরা এল ছুটে দেখতে, বললুম, ‘ওরে দেখ্‌, তাজমহল কোথায় লাগে এর কাছে। তাজমহল? যে মরেছিল সে তো ধুলো হয়ে গেছে কবে। আর প্রকৃতি এই মৌমাছিটিকে কি করে রেখেছে যে, আজও এ ঠিক তেমনিই আছে। রঙও বদলায়নি একটু। কবে কোন্‌ লক্ষ লক্ষ বছর আগে বসন্ত এসেছিল এ ধরার বুকে, মৌমাছি ডানা দুটি মেলে খাচ্ছিল ফুলের মধু আকণ্ঠ পুরে, যে রসে ডুবেছিল, সেই রসের কবরে আজও আছে সে তেমনি মগ্ন হয়ে।’ আর্ট স্কুলে মাঝে মাঝে এক সন্ন্যাসী আসত। চাপরাসিরা ধরে নিয়ে আসত গাছতলা থেকে ক্লাসে মডেল করবার জন্য। আসে, মডেল হয়ে বসে, ছেলেরা আঁকে, ক্লাস শেষ হলে পয়সা নিয়ে চলে যায়। মাঝে মাঝে দেখি সন্ধ্যের দিকে বা সকালে সন্ন্যাসী হ্যাভেলের ফ্ল্যাট থেকে বের হয়। ব্যাপার কি। হ্যাভেলের মেম বলেন, ‘আর পারিনে অবনবাবু। কোন্‌ এক সাধু জুটেছে, সাহেব তার কাছে ধ্যান শেখে, যোগ শেখে। সারাক্ষণ কেবল ওই করছে।’ আমি বললুম, ‘এ তে ভালো কথা নয়। যত সব বাজে সাধুসন্ন্যেসীর পাল্লায় পড়ে না ঠকেন শেষ পর্যন্ত।’ একদিন বিকেলে সেই সাধু আমার আপিসঘরে এসে উপস্থিত। বললে, ‘এই নাও পাকা হরীতকী। এটি খেলে যৌবন অক্ষুণ্ণ থাকবে, বয়স বাড়বে না, চুল পাকবে না’—কত কী। বলে লাল বকুলবিচির মত একটা কি হাতে গুঁজে দিলে। সন্ন্যাসী চলে যেতে আমি সেটি পকেটে ফেলে রাখলুম। ভাবলুম খেয়ে শেষে মরি আর কি। খানিক বাদে হ্যাভেল সাহেব এলেন আমার ঘরে, বললেন, ‘সন্ন্যাসী এসেছিল তোমার কাছে? কি দিল তোমায়?’ আমি পকেট থেকে সেটি বের করে বললুম, ‘এইটি।’ সাহেব বললেন, ‘আমায়ও একটা দিয়েছিল। আমি খেয়ে ফেলেছি।’ বললুম, ‘করেছ কি তুমি? না জেনে শুনে তুমি খেলে কি বলে?’ খেয়ে ফেলেছেন, কি আর হবে। মনটা কেমন খারাপ হয়ে গেল। বাড়ি ফেরবার পথে সেই পাকা, হরীতকী পকেট থেকে বের করে রাস্তায় ফেলে দিলুম। কি জানি চিরযৌবনের লোভ যদি বা জাগে সাহেবের মত। এমনি কতরকম চরিত্রের লোক নজরে পড়ত তখন।
অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর
১২. হ্যাভেল সাহেবদের একটা সোসাইটি ছিল অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর হ্যাভেল সাহেবদের একটা সোসাইটি ছিল জনকয়েক সাহেব মেম আর্টিস্ট নিয়ে। সন্ধ্যেবেলা আর্ট স্কুলেই তারা ঘণ্টা দুয়েক কাজ করত; আলোচনা সমালোচনা হত, মাঝে মাঝে খাওয়া-দাওয়াও চলত, অনেকটা আর্ট ক্লাব গোছের। মার্টিন কোম্পানির ইঞ্জিনিয়ার থর্নটন সাহেবই দেখাশোনা করতেন। তাঁর উপরেই ছিল ওই আর্ট ক্লাবের সব কিছুর ভার। চমৎকার আঁকতেও পারতেন তিনি। অমায়িক সৎ লোক ছিলেন, মহৎ প্রাণ ছিল তার। অমন সাহেব দেখা যায় না বড়। আমার সঙ্গে খুব জমত। সেই থেকেই আমার সঙ্গে তার আলাপ। পরে আমাদের সোসাইটির সঙ্গেও তিনি যুক্ত ছিলেন। আমি যখন আর্ট স্কুলে তিনি আসতেন আমার কাছে প্রায়ই; আবার ডেকেও পাঠাতেন কখনও কখনও। চারটের পরে যেতুম তার আপিসে। খুব বিশ্বাস ছিল আমার প্রতি, টেবিলের দেরাজ থেকে তাঁর আঁকা নানারকম স্থাপত্যকর্মের প্ল্যান বের করে আমায় দেখাতেন, পরামর্শ চাইতেন। কোন্‌টা কি রকম হলে আরো ভালো হয় দু বন্ধুতে মিলে বলা কওয়া করতুম। সেই সময়ে দেখেছি তার ড্রইং। ভারি সুন্দর। ভারতবর্ষের নানা জায়গা ঘুরেছেন; উদয়পুর জয়পুরের কতকগুলি স্কেচ্‌ করেছেন, লোভ হত দু-একখানির উপর। অনেক সাহেব এদেশের স্কেচ্‌ করেছে, ছাপিয়েছেও দু-একজন; কিন্তু তাদের স্কেচ্‌গুলিতে কেমন যেন বিদেশের ছাপ থাকত আর থর্নটনের অ্যালবাম যেন ভারতবর্ষের হুবহু ছবি। মাঝে মাঝে তার ফ্ল্যাটেও যেতুম; তেতলার ফ্ল্যাট, গোল সিঁড়ি দিয়ে ঘুরে ঘুরে উপরে উঠে চাপরাসিকে জিজ্ঞেস করতুম, ‘সাহেব আছেন?’ চাপরাসি উত্তর দিতে না দিতেই ওদিক থেকে ঢিলে ঢালা পাজামা পরে সাহেব এসে উপস্থিত হতেন; তারপর দুজনে বসে কত গল্প, কত হাসি, কত মজাই না করতুম। প্রাণ-খোলা হাসি ছিল তার। তাদের আর্ট ক্লাব ভেঙে গেলে পর, ক্লাবের বোর্ড আলমারি আমাকে তিনি দিয়েছিলেন। বললেন, ‘কী হবে আর এসব দিয়ে, তুমিই নিয়ে যাও, কাজে লাগবে।’ আমাদের আর্ট সোসাইটির উনি একজন বড় উৎসাহী সভ্য ছিলেন। শুধু তাই নয়, বড় খদ্দেরও ছিলেন। নন্দলালের অনেক ছবি উনি কিনেছেন। একবার নন্দলালের ‘সতী’ ছবিখানি কিনেছেন। সে সময়ে আমরা ঠিক করি, ভালো ভালো ছবিগুলি ছাপিয়ে বাজারে ছড়িয়ে দেব। করিয়েও ছিলুম কিছু, খুব ভালো হয়েছিল। তা সেই ‘সতী’ ছবিখানি ও আর খানকয়েক ছবি, ভালো করে প্যাক করে জাপানে পাঠানো হল ছাপাবার জন্য। ওকাকুরা, টাইকান, ওঁরা ব্যবস্থা করে দিলেন। ভালো কোম্পানিতে ছবিগুলি ছাপা হয়ে কিছুকাল বাদে তা ফেরত এল। থর্নটনের ‘সতী’ও এল। তিনি ছবির প্যাক খুলে ছবিটি বের করে দেখেন, ছবি আর চিনতেই পারেন না। খবর পাঠালেন, শিগগির এসো, কাণ্ড হয়ে গেছে, সতী কি রকম বদলে গেছে। সেই আগের সতী আর নেই। তাড়াতাড়ি গেলুম। কি ব্যাপার? গিয়ে দেখি তাই তো, মনে হয় আগুনে পুড়ে সতীর গায়ের রঙ যেন ছাই হয়ে গেছে। রুপো পুরানো হয়ে গেলে যেমন হয় তেমনটি। সাহেব বললেন, ‘এ কেমন হল?’ বললুম, ‘রঙ বিগড়ে গেছে। কেন গেছে তা কি করে বলব বল?’ সাহেব বললেন, ‘এ সারানো যাবে না?’ বললুম, ‘না, এ আর সম্ভব নয়।’ সাহেবের মন খারাপ, তাঁর সতীর এমন দশা হয়ে গেল। তখনকার ছবি আমরাই বেশির ভাগ কিনে রাখতুম। সতীটির উপর আমার খুব লোভ ছিল। সাহেব কিনে নিলে, কি আর করি। বললুম, ‘তুমি যদি এই ছবিটি না রাখ তবে আমায় দিয়ে দাও, তার বদলে অন্য ছবি নাও।’ সাহেব বললেন, ‘তবে তোমার ছবি দিতে হবে আমায়।’ বললুম, তা বেশ। পছন্দ কর কোন্‌টি নেবে।’ শেষে সাহেব ঔরঙ্গজেব দারার মুণ্ড দেখছেন যে ছবিটি ও আর-একটি ছবি এই দুখানির বদলে সতীটি আমায় ফেরত দিলেন। বাড়ি নিয়ে এলুম সতীর ছবি। মনে মনে ভাবছি কি উপায় করা যায় এর। ভাবতে ভাবতে মনে পড়ল একটা কোনো বইয়ে পড়েছিলুম খোলা হাওয়া-আলোতে রাখলে কতকগুলো রঙের জলুস ফিরে আসে। ভাবলুম, কি জানি, জিঙ্ক দিয়ে মুড়ে পাঠিয়েছিল ছবি, জিঙ্কের গরমে ও জাহাজের গুমটে মিলে কেমিক্যাল ক্রিয়ায় হয়তো রঙ বদলে গিয়ে থাকবে। বাড়িতে এসে ছবিখানি আমার শোবার ঘরে জানলার পাশটিতে টাঙিয়ে রাখলুম। পুবের আলো এসে পড়ে তাতে রোজ। রইল তো সেখানেই। কিছুদিন বাদে একদিন দেখি, সতীর রঙ ফিরে গেছে, সেই আগের রঙ এসে লেগেছে গায়ে, আলো দিয়ে যেন ধুইয়ে দিয়েছে তার পোড়া রঙ। বাঃ বাং, এ তো বড় মজা। উড্‌রফকে ডেকে এনে দেখাই, থর্নটনকে ডেকে এনে দেখাই। তাঁরাও দেখে অবাক। থর্নটনকে বললুম, ‘কি, লোভ হচ্ছে নাকি? কিন্তু পাবে না আর ফিরে। আমার কাছে এসে সতীদেহের রঙ ফিরে এলো, আর কি দিই তোমার হাতে তুলে?’ সাহেব শুনে হাসেন, বলেন, ‘না, এ তোমারই থাক্। থর্নটনের মত অমন বন্ধ হয়নি আর আমার। তাঁরই চাপরাসিকে দিয়েছিলেন আমার কাছে ছবি আঁকা শিখতে। বলিনি সে গল্প বুঝি? একবার সাহেব যাবেন দেশে, চাপরাসিকে দিয়ে গেলেন আমার কাছে। বললেন, ‘এর ছবি আঁকার হাত আছে, একে তুমি ছবি আঁকা শেখাও; খরচপত্তর যা লাগে তা আমি দেব। সাহেব চলে গেলেন দেশে; পরদিন চাপরাশি এল আমার আর্ট স্কুলে। সাহেবেরই একটা লাল নীল পেনসিল দিয়ে ট্রামগাড়ি, কলকাতার রাস্তা, এই সব আঁকত অবসর সময়ে। বসিয়ে দিলুম তাকে নন্দলালের সঙ্গে। তাদের বললুম, ‘এও একজন ছাত্র, একে যেন অবজ্ঞা কোরো না। এখানে সবার আসন সমান।’ চাপরাসি দাঁড়িয়ে আছে একপাশে; বললুম, ‘বোস তুই এখানে এই বেঞ্চিতে।’ সে কেবলি কাঁচুমাঁচু করে; কিছুতেই বসতে চায় না। তাকে ভালো ভাবে বসাতেই আমার লাগল বেশ কিছুদিন। রোজই সে আসে, ছবি আঁকে। কি আর তেমন আঁকবে এই কয়দিনে, তবু হাত তার ধীরে ধীরে বেশ পাকা হয়ে আসছিল। সাহেব দেশ থেকে ফিরে এলেন, চাপরাসি আবার তার কাজে যোগ দিলে। একদিন সাহেব এসে বললেন ‘তুমি আমার চাপরাসির করেছ কি? ছবি আঁকার কথা ছেড়ে দাও, লোকটা একেবারে বদলে গেছে। তার শিষ্টতা আচারব্যবহার কথাবার্তা আমাকে মুগ্ধ করছে। আগের সেই চাপরাসি আর নেই, তুমি আগাগোড়া লোকটাকে এমন করে বদলে দিলে কি করে?’ বললুম, ‘আর কিছু নয়, আমি শুধু ওকে বসতে শিখিয়েছিলুম।’ সে সময়ে বাংলাদেশের যত জমিদার মিলে একটা সোসাইটি হয়, নাম ল্যাণ্ডহোল্ডার্স অ্যাসোসিয়েশন। সিংহ মশায় সভাপতি। উড্‌রফ আর ব্লান্টও জুটল সে সময়ে। সুরেন কোমর বেঁধে কাজ করে তাতে। সুরেনের মাথায়ই খেলল প্রথমে একটা ছবির একজিবিশন করতে হবে। আমার যা কখানা ছবি ছিল, ওকাকুরা এনেছিলেন সঙ্গে কিছু জাপানী প্রিন্ট, আর এখান-ওখান থেকে কুড়িয়ে বাড়িয়ে জোগাড় করলে আরও কখানা ছবি। তাই নিয়ে সে তৈরি একটা মস্ত বাড়ি ছিল ল্যাণ্ডহোল্ডার্স অ্যাসোসিয়েশনের; নিচের তলায় বিলিয়ার্ড রুম, পড়বার ঘর, উপরে ব্যবস্থা আছে কোন সভ্য দূর থেকে এলে থাকতে পারে সেখানে, সুরেন চাইলে সেই বিলিয়ার্ড-রুমেই একজিবিশন হবে। সিংহ মশায় বললেন, ‘ছবির আমি বুঝিনে কিছুই; তবে চাইছ ঘর একজিবিশন সাজাতে, তা নাও।’ সেই বিলিয়ার্ড-রুমেই ছবি সব সাজানো হল। বেশ লোকজন আসত দেখতে; আমাদেরও ভাল লাগত, ইচ্ছে ছিল আরো কয়েকদিন চলে এমনি। এদিকে ছোকরা ব্যারিস্টার ছিলেন অনেক সেই অ্যাসোসিয়েশনে, নতুন বিলেতফেরত, তাঁরা রোজ সন্ধ্যেয় আসেন, বিলিয়ার্ড খেলেন, ব্রিজ খেলার আড্ডা জমান, তাঁদের হল মহা অসুবিধে। কদিন যেতে না-যেতেই তাঁরা লাগলেন গজগজ করতে, ‘ঘর আটকে রাখা হয়েছে।’ গজগজানি শুনতে পেয়ে তাড়াতাড়ি ছবি-টবি নামিয়ে নিলুম দেয়াল থেকে। সেই একজিবিশনে উড্‌রফ, ব্লান্ট, এঁদের সঙ্গে আলাপ জমল। সেই হল প্রথম আমাদের ছবির একজিবিশন। তার দু-তিন বছর পরে হ্যাভেল চাইলেন তাদের সেই ছোট্ট আর্ট-ক্লাবটা ভালো করে তৈরি করতে। কমিটি গঠন হল, আমরা তাতে যোগ দিলুম। ল্যাণ্ডহোল্ডার্সদেরও কেউ কেউ এলেন। উত্তরপাড়ার রাজা প্যারীমোহনও এলেন। লর্ড কিচনার সভাপতি, আমাকে হ্যাভেল বলেন সম্পাদক হতে। আমি বলি, ‘ওসব হিসেব-নিকেশে আমি নেই। পারিনে কোনোকালে।’ কিছুতেই ছাড়েন না, শেষে যুগ্ম সম্পাদক হই। জানো, বেশ কিছুকাল আমি লর্ড কিচনারের সম্পাদকগিরি করেছি। একবার এক পার্ট দিলেন ফোর্ট উইলিয়ামে। এখানে শান্ত্রী, ওখানে শান্ত্রী, বন্দুক উঁচিয়ে দাঁড়িয়ে। দেখে তো বুক আঁতকে আঁতকে ওঠে। রাস্তাও কি রকমের; গাড়ি ঘুরে ঘুরে পৌঁছল দোতলায় না তেতলায় ঠিক ওঁর ঘরটির সামনে। নানারকম জিনিসের সংগ্রহ ছিল তার। প্রায়ই যেতে হত সেখানে। এখন সেই পার্টিতে এসেছেন অনেকেই নিমন্ত্রিত হয়ে। এক রাজা বন্ধু ধরলেন, ‘আমায় লর্ড কিচনারের সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিতে হবে।’ সাহেব দেখি তখন মেমের সঙ্গে গল্পে মশগুল এক ফুলবাগানে। ভাবভঙ্গী দেখেই মনে হচ্ছে, বেশ জমে উঠেছে। ভাবলুম, দরকার নেই বাপু এখন গিয়ে, কি জানি মিলিটারি মেজাজ, দেবে হয়তো এখনি মাথাটা গুড়িয়ে। রাজ-বন্ধু এদিক থেকে কেবল খোঁচাচ্ছেনই। কি করি, একপায়ে দুপায়ে এগিয়ে গেলুম খানিকটা। সাহেব কথার ফাঁকে একবার পিছনে তাকিয়েছেন কি, রাজাকে ঠেলে দিলুম, বললুম, ‘ইনি হচ্ছেন রাজা অমুক।’ সাহেব হাত ঝাঁকুনি দিয়ে হ্যাণ্ডশেক করে বললেন, ‘Well Tagore, take him upstairs and show him my collection, please.’ রাজাকে নিয়ে চলে গেলুম সেখান থেকে। রাজা তো খুব খুশি ওইটুকু হ্যাণ্ডশেক করতে পেয়েই। যাক সেকথা। এখন এই সোসাইটির নাম কি দেওয়া যায়? কেউ কেউ প্রস্তাব করলেন অরিয়েটাল আর্ট সোসাইটি। আমি বললুম, ‘না, নাম হোক্‌ এর ইণ্ডিয়ান সোসাইটি অব ওরিয়েন্টাল আর্ট। শুধু বাঙালি নয়, দুই সম্প্রদায় মিলল এতে। দাদাও ছিলেন। অনেকে স্থায়ী সভ্য হলেন। পার্ক স্ট্রীটে বাড়ি ভাড়া নেওয়া হল, আর্টিস্টরা কাজ করবে সেখানে; কেউ যদি ইচ্ছে করে থাকতেও পারে, এমন ব্যবস্থা রইল। আর্ট স্কুলের মস্ত হলে দু-তিনটে ছবির একজিবিশন হল। উড্‌রফ তার জাপানি প্রিন্টের কালেক্‌শন দিলেন। Gesiking বলে এক মেম সব ঋতুর ফুল এঁকেছিলেন দেশি ধরনে, তাও একবার দেখান হল। দেখতে দেখতে আমাদের সোসাইটি খুব জমে উঠল। মাৰ্চেণ্ট কমিউনিটি, সিভিলিয়ান কমিউনিটি, লাটবেলাট জজ-ম্যাজিস্ট্রেট রাজারাজড়া সবাই তাতে যোগ দিয়েছেন; সবাই কিছু-না-কিছু করছেন। উড্‌রফ ক্যাটালগ লিখতেন। তখনকার ক্যাটালগ সাহিত্য ছিল বললেই হয়। প্রতি ছবির নিচে গল্প থাকত; আমার ইংরেজি বিদ্যেয় কুলোত না, ভাঙা ভাঙা ইংরেজিতে কোনো রকম করে লিখে দিতুম। উড্‌রফ তা থেকে ভালো করে লিখতেন। দেখাদেখি অন্য আর্টিস্টরা ঠিক করলেন, তাঁরা নিজেরা একটা সোসাইটি করবেন। হরিনারায়ণ বসু ছিলেন আর্ট স্কুলের ভাইস্‌প্রিন্সিপাল, বরদাকান্ত দত্ত সেকেণ্ড মাস্টার, মন্মথ চক্রবর্তী যিনি বউবাজারের আর্ট স্কুল প্রথম শুরু করেন, এই কয়জন মিলে ঠিক করলেন একটা সভা করে সব ব্যবস্থা করতে হবে। কোথায় সভা হবে। আমাকেও তাঁদের দলে টানবার ইচ্ছে; ঠিক হয় আমাদের বাড়িতেই সভা বসবে। সভার সব ঠিক, খাওয়াদাওয়ারও কিছু ব্যবস্থা করা গিয়েছিল। এখন সেই সভার মধ্যেই কে কি কাজ করবে এই নিয়ে মহা তর্কাতর্কি; শেষ পর্যন্ত প্রায় তুমুল ব্যাপার। এ বলেন, ‘আমি কেন প্রেসিডেন্ট হব’, উনি বলেন, ‘অমুক থাকতে ও কাজের ভার আমার উপর কেন’ ইত্যাদি। হল না আর শেষ পর্যন্ত কিছুই, ওখানেই থেমে যেতে হল সবাইকে। আমি বললুম, ‘শুরুতেই যখন এই রকম মারামারি তখন আমি, বাপু, এর মধ্যে নেই।’ গেল ভেঙে সব স্কীম। আমরা যে সোসাইটি করেছিলুম সে ছিল একেবারে অন্যরকমের। আমরা করেছিলুম এমন একটা সোসাইটি যেখানে দেশী বিদেশী নির্বিশেষে একত্র হয়ে আর্টের উন্নতির জন্য ভাববে, শুধু ভারতীয় নয় প্রাচ্য শিল্পের সব জিনিস দেখানো হবে লোকদের। তাতে এমন ব্যবস্থাও ছিল যার যা ব্যক্তিগত শিল্পবস্তুর সংগ্ৰহ ছিল তাও দেখানো হত। মাঝে মাঝে এক-একজনের বাড়িতে পার্টি জমত। সভ্য সবাই আসত; আমোদ-আহ্লাদ, খাওয়াদাওয়া, আর্ট সম্বন্ধে আলোচনা, সবই হত। উড্‌রফ পান পর্যন্ত দিতেন তাঁর বাড়িতে যখন পার্টি হত। পান, ফুলের মালাও চল হয়ে গিয়েছিল সাহেববাড়িতে সেই সময়ে। তা ছাড়া যে-দেশে যা-কিছু সুন্দর পাওয়া যায় এনে সাজিয়ে দিতুম একজিবিশন করে। সেসব একজিবিশনও হত এক বিরাট ব্যাপার। কাঁচের বাসন, কার্পেট, যেখানকার যা কিছু ভালো ভালো পুতুল, গয়না, ছবি, কিছু বাদ পড়ত না। সব বাছাই বাছাই জিনিস, যা-তা হলে আবার হবে না। একবার এমনি এক বিরাট বার্ষিক একজিবিশনের আয়োজন হচ্ছে। উড্‌রফ বললেন, ‘এবারে ভারতবর্ষের সব জায়গার জিনিস জোগাড় করতে হবে।’ তিন মাস আগে থেকে জায়গায় জায়গায় চিঠি লিখে দেওয়া হল; কোথাও আমাদের লোক গেল জিনিস সংগ্রহ করতে; কোথাও বা টাকা পাঠানো হল, পার্সেল করে যেসব জিনিস আসবে তার খরচ বাবদ। কিছুদিন বাদেই নানা জায়গা থেকে ছোট বড় হালকা ভারি প্যাকিং বাক্স আসতে লাগল, সে কি উৎসাহ আমাদের বাক্স খোলার। আমাদের চতুর্দিকে সাজানো প্যাকিং বাক্স ঠাসা, একটা-একটা করে খোলা হচ্ছে। দিল্লি থেকে এসেছে সুন্দর সুন্দর পটারি; কাশ্মীর থেকে নানারকম শাল, হাতের কাজ, তার মধ্যে একটা পুরানো পেপারম্যাসের উপর কাজ করা দোয়াতদানি ছিল বড় সুন্দর, এখনো মনে পড়ে, বড় বড় কার্পেট; কেষ্টনগরের পুতুল; বোম্বে থেকে ভীষণ সব ছবি; লক্ষ্ণৌর তাস, বাদশা-বেগমের মিনিয়েচার আঁকা, বেগম-বাদশারা খেলত; উড়িষ্যার পট; আর গঞ্জাম থেকে এল তিনটি হাতির দাঁতের মূর্তি—একটি কূৰ্ম অবতার, একটি রাধাকৃষ্ণের বিহার, সবাইকে দেখাবার মত নয়, কিন্তু কি চমৎকার মূর্তি, পাকা হাতের কাজ—উড্‌রফ দেখেই বললেন, ‘এই রকম আমার একটি চাই। তুমি যে করেই হোক আমায় এই মূর্তিটি করিয়ে দাও, যত টাকা লাগে ভাবনা নেই।’ ডেকে পাঠালুম আচারী মাস্টারকে, চমৎকার কাঠের কাজ করত সে। তাকে বললুম, ‘ভালো চন্দনকাঠে তুমি এর দুটি নকল করে দাও।’ সে কয়েকদিনের মধ্যেই দুটি মূর্তি কেটে নিয়ে এল, ঠিক হুবহু সেই মূর্তিটি কপি করে ছেড়ে দিয়েছে। তার একটি উড্‌রফকে দিলুম, একটি আমি নিলুম। আর একটি মূর্তি, সেটি কৃষ্ণের। আধহাতমত উঁচু মূর্তিটি, বাঁশিটি ধরে আছেন মুখের কাছে; সে কি ভাব, কি ভঙ্গি, কি বলব তোমায়, মূর্তিটি দেখে আমি অবাক। অদ্ভুত মূর্তি, আইভরির রঙটি পুরানো হয়ে দেখাচ্ছে যেন পাকা সোনা। সেই মূর্তিটি দেখেই কেন জানি না আমার মনে হল, এর নিশ্চয়ই জুড়ি আছে। এমন সুন্দর কৃষ্ণের রাধা না থেকে পারে কখনো? নিশ্চয়ই এই যুগলমূর্তির পূজো হত এককালে। সেই জোড়ভাঙা রাধাকে আমার চাই। গঞ্জাম থেকে যে বন্ধু এই মূর্তিগুলি পাঠিয়েছিলেন তাঁকে লিখলুম। তিনি জানালেন, বহুকালের মূর্তিটি, অনেক খোঁজ করে পেয়েছেন, কিন্তু রাধার সন্ধান জানেন না। যাক, একজিবিশন তো হয়ে গেল। কিন্তু মনের খটকা আর যায় না, যাকে পাই খোঁজ নিই। দিল্লির দরবারেও এই মূর্তি তিনটির একজিবিশন হয়েছিল; ক্যাটালগে ছবি আছে। সবাইকে সেই ছবি দেখাই আর বলি, ‘এর রাধার সন্ধান পেলে আমায় জানাবে।’ গিরিধারী ওড়িয়া কারিগর এল সোসাইটিতে কাজ করতে। তার প্রপিতামহও খুব বড় কারিগর ছিল। তার তৈরি তিনটি কাঠের সখী আছে আমার কাছে, অতি সুন্দর। গিরিধারী বলত, তার প্রপিতামহ নাকি পুতুলে প্রাণ প্রতিষ্ঠা করতে পারত। সে একটা উৎসব-অনুষ্ঠানের ব্যাপার ছিল। গিরিধারীর মুখে শুনেছি, সে তখন ছোট, কাছে যাবার হুকুম ছিল না কিন্তু দেখেছে সেই উৎসবের তোড়জোড়। একবার নাকি পুরীর রাজার শখ হয়, তিনি বলেন, ‘আমি দেখতে চাই পুতুল নিজে নিজে এসে জগন্নাথকে প্রণাম করবে।’ গিরিধারীর প্রপিতামহ সেই পুতুল তৈরি করেছিলেন। পুতুল নিয়ে গেল জগন্নাথের মন্দিরের কাছে, রাজাও এলেন। কারিগর সেখানে পুতুলকে ছেড়ে দিলে, পুতুল টকটক করে সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠে জগন্নাথকে প্রণাম করে ফিরে এল, দেখে সকলে অবাক্‌, রাজা বহু টাকা পুরস্কার দিলেন কারিগরকে।—সেই গিরিধারীকে বলি, যত ডিলার ছিল আমাদের নানা জায়গা থেকে আর্টিস্টিক জিনিস এনে দিত, তাদের বলি—কেউ আর হারানো রাধার সন্ধান দিতে পারে না। মাতাপ্রসাদ নামে আমার আর-একজন লক্ষ্ণৌর ডিলার ছিল; তার কাছে যেটা চাইতুম কি রকম করে হাতে এনে দিত। তাকেও বলে রেখেছিলুম আমার ওই রাধিকা চাই। বহুদিন পর সে একদিন এল নানারকম জিনিসপত্তর নিয়ে। বসে আছি বারান্দায়; থলি থেকে একটি একটি জিনিস বের করে আমার হাতে দিচ্ছে। দেখে কোনোটা রাখব বলে পাশে রাখছি, কোনোটা ফেরত দিচ্ছি। সবশেষে সে বের করলে একটি আইভরির পুরোনো মূর্তি, লক্ষ্ণৌ থেকে এটি সে সংগ্রহ করেছে। বললে, ‘ভাঙা মূর্তি পছন্দ হবে কি না আপনার জানিনে।’ বলে সেটি আমার হাতে দিলে, মূর্তিটি হাতে নিয়ে আমার তো বুক ধড়াস ধড়াস করতে লাগল। এ যে আমার সেই রাধিকা! এতদিন যাকে খুঁজে বেড়াচ্ছি। মুখ দিয়ে আমার আর কথা সরছে না। রাধিকার যে হাতে পদ্ম ধরে আছে সেই হাতটি আছে অন্য হাতটি ভাঙা। হাত ফিরতে ফিরতে হাত ভেঙে গেছে, বা যারা পূজো করত তারাই ফেলে দিয়েছিল হাত ভেঙে যাওয়াতে, কি জানি। ডিলার যা দাম চাইলে তাকে দিয়ে ঘরে উঠে এলুম। তখনি একজন ভালো কাঠের মিস্ত্রি ডাকিয়ে আমার রাধার জন্য একহাত উঁচু একটি মন্দিরের ফরমাশ করলুম। বললুম, এমনভাবে মন্দির তৈরি করবে ভিতরে রাধাকে রেখে, আমি যেন ঘুরিয়ে ফিরিয়ে তাকে দেখতে পারি। মন্দিরের নিচে একটা চাবি থাকবে, সেটা ঘোরালেই আমার রাধা ঘুরে ফিরে দাঁড়াবে।’ সে এনে দিলে চমৎকার একটি কাঠের মন্দির তৈরি করে। তাতে রাধিকাকে প্রতিষ্ঠা করে অলকের মার হাতে দিলুম; বললুম, ‘রেখে দাও একে যত্নে তুলে। তিনি মন্দিরসুদ্ধ রাধাকে অতিযত্নে তুলে রাখলেন তার কাপড়ের আলমারিতে। মাঝে মাঝে শখ হয়, বের করে দেখি, কেউ এলে দেখাই, আবার রেখে দিই। তার পর অনেক বছর কেটে গেছে। বহুদিন রাধাকে দেখিনি, মনেও ছিল না তেমন। সেদিন মিলাডা এসেছে। তার সঙ্গে কথায় কথায় মনে পড়ল আমার রাধিকার কথা। মিলাডা কেবল ভিনাস ভিনাস করে, ভাবলুম দিই একবার তার দর্প চূর্ণ করে। বীরুকে ডেকে বললুম, ‘আন তো বীরু আমার রাধিকাকে একবার।’ বীরু ভিতরে গিয়ে বললে পারুলকে। পারুল খুঁজে পায় না কোথা সেই মন্দিরটি। শুনে আমি নিজে গেলুম ভিতরে; বললুম, ‘সে কি কথা, রাধিকা যাবে কোথায়? আমি নিজের হাতে রেখেছি এই আলমারিতে, দেখ ভালো করে।’ মনে মনে ভয় হল, কেউ নিয়ে যায়নি তো? ভাবতেই বুকটা ধড়ফড় করে উঠল। অলকের মার অসুখ, কথা সব ভুলে যান; তাঁকে জিজ্ঞেস করি। তিনি বলেন, ‘দেখ খুঁজে, ওখানেই তো রেখেছিলুম।’ চাবি নিয়ে পারুল আলমারি খুলে তচনচ করলে; কোথাও নেই মন্দিরটি। পারুল নিচের তাক থেকে বের করলে কাঠের বাক্স থেকে একটি জাভানীজ কাঠের পুতুল। মাদাম টোন একবার এনেছিলেন জাভার নানারকম সব জিনিস, বিচিত্রা হলে তার প্রদর্শনী হয়। তার মধ্যে দুটি পুতুল ছিল; রাজকুমারী আর তার সখী। দাদা কিনলেন রাজকন্যাটি, আমি কিনলুম সখীটি। সেও ভারি সুন্দর; লাল শাড়িটি পরা, খোঁপাটি বাধা, তাতে ফুল গোঁজা। পারুল সেইটি হাতে নিয়ে বললে, ‘এইটেই কি?’ আমি বললুম, ‘আরে না। এ হল রানীর দাসী। রাধিকা হল রানী, তার কেন এমন চেহারা, এমন সাজসজ্জা হবে। খোঁজ, খোঁজ, নামাও সব কাপড়চোপড় জিনিসপত্তর আলমারি থেকে। এখানেই আছে যাবে কোথায়।’ জিনিসপত্র সব নামানো হল। না, কোথাও নেই সেই রাধিকা। হাত দিয়ে হাতড়ে হাতড়ে থাকগুলি সব দেখি। কপাল দিয়ে আমার ঘাম ঝরতে লাগল। শেষে, এক কোণায় একটি বেশ বড় পার্শিয়ান কাঁচের বোল ছিল, সেইটি যেই সরিয়েছি দেখি রাধিকার মন্দির। চেঁচিয়ে উঠলুম, ‘ওরে পেয়েছি রে পেয়েছি। দেখ্‌ দেখ্‌ এই তো আমার রাধিকা ঠিক তেমনি আছে।’ অতি যত্নে রাখতে গিয়ে, আমি কি অলকের মা রেখেছিলুম ওটি কাচের বোলের পিছনে লুকিয়ে,—মনে নেই কারোই। যাক, পাওয়া তো গেল, পারুলকে বললুম, ‘এবারে জেনে রাখে ভালো করে, আর যেন না হারায়।’ তার পর এলুম বারান্দায়। যে চেয়ারে বসে পুতুল গড়তুম দেখেছ তো সেটি? তাতে হেলান দিয়ে বসে মন্দিরটি হাতে নিয়ে বললুম, ‘এবারে ডাকো মিলাডাকে।’ মিলাডা এল। বললুম, ‘কি তুমি ভিনাস ভিনাস কর। দেখ একবার, তোমাদের ভিনাস ঝক্ মেরে যাবে এর কাছে।’ ব’লে এক হাতে ধরে আর হাতে মন্দিরের দরজাটি খুলে দিলুম। মিলাডা দেখে একেবারে থ। আমি মিলাডার মুখের দিকে একবার করে তাকাই আর নিচের চাবি ঘোরাই, সঙ্গে সঙ্গে রাধিকাও ঘুরে ফিরে দাঁড়ায়। তাকে সামনে থেকে দেখালুম, পিছন থেকে দেখালুম। যে হাতে পদ্মটি ধরে আছে সেদিক থেকে দেখালুম, অন্য হাতটিও ঘোরালুম, বললুম, ‘দেখ, সব দেখ। তোমাদের ভিনাসেরও হাত নেই; কোন হাতে কি ছিল কেউ জানলও না কোনোদিন; আর আমারও রাধিকার হাত নেই। তবে এক হাতে পদ্ম আছে এটা তো জানতে পারা যাচ্ছে। এ হল আমার খণ্ডিরাধিকে। পুরীর রাজার যেমন ছিল খণ্ডিরানী, এ তেমনি আমার খণ্ডিরাধিকে।’ খণ্ডিরানীর গল্প জানো? পুরীর রাজাকে বলে চলন্ত বিষ্ণু, রাজ রথে হাত দিলে তবে রথ চলে। বহুকাল আগে একবার রথযাত্রা হবে, জগন্নাথ রথে চড়ে মাসির বাড়ি যাবেন। রাজা চলেছেন রথের আগে আগে, চামর করতে করতে। চারদিক লোকে লোকারণ্য; রথের দড়ি টানবার জন্য তীর্থযাত্রীদের তাড়াহুড়ো ঠেলাঠেলি; কেউ কেউ পড়ে যাচ্ছে ভিড়ের চাপে—দেখেছ রথযাত্রা কখনো? এখন, রথ চলেছে ভিড় ঠেলে। রাজা দেখেন পথের পাশে এক পরমাসুন্দরী ভিখারিনী ব’সে ছেঁড়া ময়লা একখানি শাড়ি পারে। রূপ দেখে রাজা গেলেন মোহিত হয়ে। বাড়ি ফিরে এসে রাজা আনালেন সেই ভিখারিনীকে; আনিয়ে রানী করলেন তাকে। সেই রানীর ছিল এক হাত কাটা, লোকে বলত তাকে খণ্ডিরানী। আমি যখন পুরীতে যাই তখনো সেই খণ্ডিরানী বেঁচে; বুড়ি হয়ে গিয়েছিল। পাশ দিয়ে যেতে পাণ্ডারা দেখাত এই খণ্ডিরানীর বাড়ি। চলন্ত বিষ্ণুর খণ্ডিরানী কালে কালে বুড়ি হয়ে গেল। কিন্তু আমার খণ্ডিরাধা? কালে কালে তার রূপ খুলছেই।
অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর
১৩. ধ্যানধারণা পুজো আর্চা অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর ধ্যানধারণা, পুজো আর্চা, সে আমি কোনোদিন করিনে। বড়দিকে দেখতুম, মুসোরি পাহাড়ে শার্শি বন্ধ করে বসেছেন, কুটনো বাটনা করাচ্ছেন, আর বসে বসে মালা টপকাচ্ছেন; আবার রাস্তা দিয়ে কেউ গেলে ডেকে তার খোঁজখবরও নিচ্ছেন। আমি সক্কাল বেলা উঠে বেড়িয়ে ফিরতুম। কতদিন তিনি আমায় তাড়া লাগাতেন, ‘বসে ভগবানের নাম করবে খানিক, তা নয়, কোথায় ঘুরে বেড়াচ্ছ সকাল থেকে?’ হেসে বলতুম, ‘ও বড়দি, এদিকে যে কত মজার মজার জিনিস সব দেখে এলুম আমি। কেমন সুন্দর পাখিটি ঝোপের ধারে বসে ছিল ঘরে বসে নাম জপলে কি দেখতে পেতুম তা?’ উলটে বড়দি মালা টপকাতে টপকাতেই আরো খানিকটা বকুনি দিয়ে চলতেন। ধ্যানধারণা কেন করিনে জানো? একবার কি হল বলি। এখন আর ডাক্তারদের আমার লিভার ছুঁতে দিইনে। বলি, ‘ও আমার ঠিক আছে। আর যা করতে হয় কর, লিভারে হাত দিতে পারবে না।’ তা সেইবারে কোথাও কিছু না, হঠাৎ লিভারে দারুণ যন্ত্রণা। সে কি যন্ত্রণা। লিভার থেকে বুক অবধি যেন অগ্নিশূল বিঁধছে। সেই অসহ্য যন্ত্রণায় ছটফট করতে করতে শেষটায় বেঁহুশ হয়ে পড়ি। তিন-চারজন ডাক্তার চিকিৎসা করছেন। সকালের দিকে ভালো থাকি, বিকেলে ব্যথা শুরু হয়। ব্যথা শুরু হবে এই ভয়েই আমি আরো অস্থির হয়ে পড়ি বেশি। বিকেল হবার সঙ্গে সঙ্গে আমারও আতঙ্ক আরম্ভ হয়, এই বুঝি উঠল ব্যথা। যেন স্টেশনে জানান দিলে, এবারে ট্রেন আসছে বলে। একদিন সকাল থেকেই ব্যথা শুরু হয়েছে, যন্ত্রণায় অত্যন্ত কাতর হয়ে পড়েছি ছেলেমাহষের মত চীৎকার করছি ‘গেলুম গেলুম।’ করুণা, নেলি, ওরা এসে জড়িয়ে ধরলে, আর বুঝি বাঁচিনে এমন অবস্থা। তিন-তিনটে মরফিয়া ইনজেকশন দিলে ডাক্তাররা; একটা সকালবেলা, একটা দুপুরে, আর একটা রাত দশটায়। ডাক্তারদের বললুম, ‘আর যা হোক একটু ঘুম পাড়িয়ে দিন আমায়, পারছিনে সইতে।’ ডাক্তাররা ভেবে মরেন, একই দিনে তিনটে মরফিয়া ইনজেকশন। তাঁরা বলেন, যে দু ডোজ মরফিয়া দেওয়া হয়েছে তাতে যে হাতিরও ঘুমিয়ে পড়বার কথা। যাই হোক আর একটাও তাঁরা দিলেন।, বললেন, ‘এতেই যা হবার হবে, আর চলবে না।’ এই বলে তারা চলে গেলেন সে-রাত্তিরের মত। আমি ঘর থেকে সবাইকে বের করে দিলুম। বললুম, ‘সবাই চলে যাও এ ঘর ছেড়ে, আমি আজ একলা থাকব।’ রাতও হয়েছিল অনেক, কদিনের উৎকণ্ঠায় ক্লান্তিতে যে যার ঘরে গিয়ে শোবামাত্রই ঘুমিয়ে পড়েছে। সমস্ত বাড়ি নিস্তব্ধ। আমি বিছানায় শুয়ে আছি বড় বড় করে দু-চোখ মেলে—ঘুমই আসছে না তা চোখ বুজব কি? চেয়ে চেয়ে দেখছি, একটু একটু মরফিয়ার ক্রিয়া চলেছে। দেখি কি, আমার চারদিকের মশারিটা কেমন যেন কাঁপতে কাঁপতে সরে গেল,—দেয়ালও তাই। উকুনের উপর দেখ না হাওয়া গরম হয়ে কেমন কাঁপতে থাকে, দুপুরে মাঠের মাঝেও সেই রকম দেখা যায়, মরীচিকা—সেই মরীচিকার মত দেয়ালগুলো কাঁপছে চোখের সামনে। মনে হতে লাগল যেন ইচ্ছে করলেই তার ভিতর দিয়ে গলে যেতে পারি। এই হতে হতে রাত্রি প্রায় ভোর হয়ে এসেছে। চেয়েই আছি হঠাৎ দেখি, একখানি হাত, মার হাতখানি মশারির উপর থেকে নেমে এল। দেখেই চিনেছি, অসাড় হয়ে পড়ে আছি—মনে হল মা যেন বলছেন, ‘কোথায় ব্যথা? এইখানে?’ ব’লে হাতটি এসে টক করে লাগল ঠিক বুকের সেইখানটিতে। সমস্ত শরীরটা যেন চমকে উঠল, ভালো করে চারদিকে তাকালুম, কেউ কোথাও নেই। ব্যথা? নড়ে চড়ে দেখি তাও নেই। অসাড় হয়ে শুয়ে ছিলুম, নড়বার শক্তিটুকুও ছিল না একটু আগে—সেই আমি বিছানায় উঠে বসলুম। কি বলব, নিজের মনেই কেমন অবাক লাগল। বিছানা ছেড়ে ধীরে ধীরে বাইরে এলুম, দিব্যি মানুষ, অসুখের কোনো চিহ্ন নেই। দোরগোড়ায় চাকর শুয়ে ছিল, সে ধড়মড় করে উঠে এগিয়ে এল। বললুম, ‘কাউকে ডাকিসনে। চুপচাপ একটু ঠাণ্ডা জল দে দেখিনি আমার হাতে।’ সে ঠাণ্ডা জল এনে দিলে, আমি তা ভালো করে মুখে মাথায় দিয়ে বেশ ঠাণ্ডা হয়ে চাকরকে বললুম, ‘যা এবারে আমার জন্যে এক পেয়াল চা, পুরু করে মাখন দিয়ে দুখানি পাঁউরুটি টেস্ট তৈরি করে, বাইরে বারান্দায় যেখানে বসে আমি ছবি আঁকি সেখানে এনে দে। আর দেখ্‌, তামাকও সেজে আনবি ভালো করে।’ চাকর নিয়ে এল। গরম গরম চা রুটি খেয়ে গড়গড়ার নলটি মুখে দিয়ে আরাম করে টানতে লাগলুম। তখন পাঁচটা বেজেছে, দাদা তেতলার সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে আমায় বারান্দায় বসে থাকতে দেখে অবাক। বললেন, ‘এ কি, তুমি যে বাইরে এসে বসেছ?’ বললুম, ‘ভালো হয়ে গেছি। দাদা।’ নেলি, করুণা, অলকের মা, তার উঠে দেখে বিছানায় রুগী নেই। গেল কোথায়? এঘরে ওঘরে খোঁজাখুঁজি করে বারান্দায় এসে সকলে চেঁচামেঁচি, ‘কখন তুমি আবার বাইরে উঠে এলে, একটুও জানতে পারিনি।’ বললুম, ‘জানবে কি করে, আমি যে ভালো হয়ে গেছি একেবারে। আর তোমরা ভেবো না মিছে।’ বলতে বলতেই মহেন্দ্রবাবু ডাক্তার এসে উপস্থিত। আমায় বারান্দায় দেখেই থমকে দাঁড়ালেন। বললুম, ‘আর আপনাদের দরকার নেই।’ মহেন্দ্রবাবু হেসে বললেন, ‘ভালো কথা, সেরে উঠেছেন তা হলে? খাওয়াদাওয়া কি করলেন? বেশ বেশ, এবারে সুস্থ মানুষের মত চলাফেরা করুন। দেখুন কি রকম আপনার রোগ তাড়িয়ে দিয়েছি আমরা।’ মহেন্দ্রবাবু থাকতে থাকতেই ডাক্তার ব্রাউন উঠে এলেন খটখট করে সিঁড়ি বেয়ে উপরে। আমাকে কুশলপ্রশ্ন করতেই তার হাত ধরে ঝাঁকুনি দিয়ে হ্যাণ্ডশেক করে বললুম, ‘গুডবাই, ডাক্তার। আর তোমার দরকার নেই, যেতে পারো তুমি।’ সাহেব হাসিমুখে চলে গেলেন। তাঁরা চলে যেতে মনে খটকা লাগল। ডাক্তারদের ফিরিয়ে দিলুম, বললুম, আর দরকার হবে না; কি জানি যদি আবার ব্যথা ওঠে বিকেলের দিকে। মনটা কেমন খুঁতখুঁত করতে লাগল। এমন সময়ে অমরনাথ হোমিয়োপ্যাথ ডাক্তার এসেছেন আমার খবর নিতে, তাঁকে বললুম, একটু হোমিয়োপ্যাথিই আমায় দিয়ে যাও, রেখে দিই। যদি ব্যথা ওঠে তো খাব।’ তিনি বললেন, ‘নিশ্চয়ই, আমি এখনি গিয়ে পাঠিয়ে দিচ্ছি।’ তিনি চলে যেতে এলেন বৃদ্ধ ডি. এন. রায়, তিনিও ডাক্তার, মাকে দেখতেন শুনতেন, প্রায়ই আসতেন, তিনি এসেছেন আমায় দেখতে—খবর রটে গিয়েছিল চারদিকে, আজ রাত কাটে কি না-কাটে, এমন অবস্থা। বৃদ্ধ এসেই বললেন, ‘হবে না লিভারে ব্যথা? এই বয়সে এতগুলি বই লেখা?’ ‘এতগুলি বই আবার কোথায়?’ তিনি বললেন, ‘তা নয় তো কি? বাড়ির মেয়েরা সেদিন পড়ছিল দেখলুম যে আমি।’ সে তো দুখানি মাত্র বই, শকুন্তলা আর ক্ষীরের পুতুল।’ ‘ওই হল। দুখানাই কি কম? এই বয়সে দুখানা বই লিখলে, এত এত ছবি আঁকলে, তোমার লিভার পাকবে না তো পাকবে কার?’ এতখানি বয়সে ছেলেদের জন্য দুখানি মাত্র বই লিখেছি, সেই হয়ে গেল এতগুলি বই লেখা। হেসে বাঁচিনে তাঁর কথা শুনে। যাক সে-যাত্রা তো সেরে উঠলুম। বৃদ্ধ ডি. এন. রায়ও আমায় হোমিয়োপ্যাথি ওষুধ দিয়ে গিয়েছিলেন অনেক সাহস দিয়ে। কিন্তু সেই যে ব্যথা অদৃশ্য হল একেবারেই হল। চলে যাবার পর একটু রেশ থাকে, তাও রইল না, বুঝতেই পারতুম না যে এতখানি যন্ত্রণা পেয়েছি কয়েক ঘণ্টা আগেও। দুদিন বাদেই বেশ চলে ফিরে বেড়াতে লাগলুম, ঠিক আগের মত। তা সেইবারে ভালো হয়ে একদিন আমার মনে হল, ভগবানকে ডাকলুম না একদিনও এই এতখানি বয়সে। প্রায় তো টেঁসেই যাচ্ছিলুম এবারে। পরপারের চিন্তা তো জাগেনি মনে কখনো, ওপারে গিয়ে জবাব দিতুম কি? তাই তো, ভাবনাটা মনে কেবলই ঘোরাফেরা করতে লাগল। অলকের মাকে এসে বললুম, ‘দেখ, একটা কাঠের চৌকি চৌতলার ছাদের উপরে পাঠিয়ে দিয়ো দেখিনি চাকরদের দিয়ে। চৌকিটা ওখানেই থাকবে। কাল থেকে রোজ আমি সময়মত সেখানে নিরিবিলিতে বসে খানিকক্ষণ ভগবানের নাম করব।’ পরদিন সকালবেলা গেলুম চৌতলার ছাতে। তখনো চারদিক ফরসা হয়নি। চৌকিতে বসলুম পুবমুখো হয়ে, চোখ বুজে ডাকতে লাগলুম ভগবানকে। কি আর ডাকব, ভাবব, জানিনে তো কিছুই। মনে মনে ভগবানের একটা রূপ কল্পনা করে নিয়ে বলতে লাগলুম। ‘এতদিন তোমায় ডাকিনি, বড় ভুল হয়েছে—দয়াময় প্রভু, ক্ষমা কর আমায়।’ এমনি সব নানা ছেলেমানুষি কথা। আর চেষ্টা চলছে প্রাণে ভাব জাগিয়ে চোখে দুঁ ফোটা জল যদি আনতে পারি। এমন সময়ে মনে হল কানের কাছে কে যেন বলে উঠল, ‘চোখ বুজে কি দেখছিস, চোখ মেলে দেখ্‌।’ চমকে মুখ তুলে চেয়ে দেখি সামনে আকাশ লাল টকটক করছে, সূর্যোদয় হচ্ছে। সে কি রঙের বাহার, মনে হল যেন সৃষ্টিকর্তার গায়ের জ্যোতি ছড়িয়ে দিয়ে সূর্যদেব উদয় হচ্ছেন। সৃষ্টিকর্তার এই প্রভা চোখ মেলে না দেখে আমি কিনা চোখ বুজে তাকে দেখতে চেষ্টা করছিলুম। সেদিন বুঝলুম আমার রাস্তা এ নয়; চোখ বুজে তাঁকে দেখতে চাওয়া আমার ভুল। শিল্পী আমি, দুচোখ মেলে তাকে দেখে যাব জীবনভোর। বারীন ঘোষকেও তাই বলেছিলুম। একদিন সে এল আমার কাছে,—বললে, ‘ছবি আঁকা শিখব আপনার কাছে।’ বললুম, ‘তা তো শিখবে, কিছু এঁকেছ কি? দেখাও না।’ সে একখানি দুর্গার ছবি দেখালে। বললে ‘এইটি এঁকেছি।’ দুর্গার ছবি যেমন হয় তেমনি এঁকেছে। বললুম, ‘তা দুর্গা যে এঁকেছ, কি করে আঁকলে।’ সে বললে ‘ধ্যানে বসে একটা রূপ ঠিক করে নিয়েছিলুম। পরে তাই আঁকলুম।’ আমি বললুম, ‘তা হবে না, বারীন। ধ্যানে দেখলে চলবে না, চোখ খুলে দেখতে শেখ, তবেই ছবি আঁকতে পারবে। যোগীর ধ্যান ও শিল্পীর ধ্যানে এইখানেই তফাত।’ এই আকাশে মেঘ ভেসে যাচ্ছে; কত রঙ, কত রূপ তার, কত ভাবে ভঙ্গিতে তার চলাচল। সেই যেবারে অসুখে ভুগেছিলুম, হাঁটাহাঁটি বেশি করা বারণ, বেশির ভাগ সময় বারান্দায় ইজিচেয়ারে বসেই কাটিয়ে দিতুম চুপচাপ স্থির হয়ে, সামনে খোলা আকাশ, একমনে দেখতুম তা। সেই সময়ে দেখেছি কত বৈচিত্র্য আকাশের গায়ের মেঘগুলিতে। কত রূপ দেখতে পেতুম তাতে—বাড়িঘর, বনজঙ্গল, পশুপাথি, নদীপাহাড়,—যেন মানস সরোবরের রূপ ভেসে উঠত চোখের সামনে। একবার মনে হয়েছিল এই মেঘেরই এক সেট ছবি আঁকি। কত আলপনা ভেসে যাচ্ছে মেঘের গায়ে গায়ে। সেদিন একটি ছেলেকে দেখি ডিজাইন আঁকবে, তা কাগজ সামনে নিয়ে উপরে কড়িকাঠের দিকে চেয়ে আছে। বললুম, ‘ওরে, উপরে কি দেখছিস। ডিজাইন কি কড়িকাঠে গলায় দড়ি দিয়ে ঝুলছে? বাইরে আকাশের দিকে চেয়ে দেখ্‌, কত ডিজাইনের ছড়াছড়ি সেখানে। তাও না হয়, কাগজের দিকেই চেয়ে থাক্‌। কড়িকাঠে কি পাবি?’ কাগজের দিকে তাকিয়ে থাকলেও অনেক সময়ে নানা জিনিস দেখা যায়। জাপানীরা তো যে কাগজে আঁকবে সেই কাগজটি সামনে নিয়ে বসে বসে দেখে; তার পর তাতে আঁকে। টাইকানকে দেখতুম, ছবি আঁকবে, পাশে রঙ কালি গুলে তুলিটি হাতের কাছে রেখে ছবি আঁকবার কাগজটির সামনে দোজানু হয়ে বসল ভোঁ হয়ে। একদৃষ্টি কাগজটি দেখল খানিক। তার পর এক সময়ে তুলিটি হাতে নিয়ে কালিতে ডুবিয়ে দু-চারটে লাইন টেনে ছেড়ে দিলে, হয়ে গেল একখানি ছবি। কাগজেই ছবিটি দেখতে পেত; দু-একটি লাইনে তা ফুটিয়ে দেবার অপেক্ষা মাত্র থাকত।
অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর
১৪. টাইকান ছিল বড় মজার মানুষ অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর টাইকান ছিল বড় মজার মানুষ। ওকাকুরা শেষবার যখন এসেছিলেন যাবার সময় বলে গিয়েছিলেন, ‘আমি জাপানে গিয়ে আমাদের দু-একটি আর্টিস্ট পাঠিয়ে দেব। তারা এদেশ দেখবে, নিজেরা ছবি এঁকে যাবে, তোমরা দেখতে পাবে তাদের কাজ—তাদেরও উপকার হবে তোমাদেরও কাজে লাগবে।’ তিনি ফিরে গিয়ে দুটি আর্টিস্ট পাঠালেন—টাইকানকে আর হিশিদাকে। ছেলেমানুষ তখন তারা। টাইকানের তবু একটু মুখচোখের কাঠকাঠ গড়ন ছিল, একরকম লাগত বেশ; হিশিদা ছিল একেবারে কচি, ছোট্টখাট্ট ছেলেটি। তার মুখখানি দেখলে কে বলবে যে এ ছেলে; ঠিক যেন একটি জাপানী মেয়ে, ছেলের বেশে, প্যান্টকোট-পরা; আপেলের মত লাল টুকটুক করছে দুটি গাল, কাঁচের মত কালো চোখ, মিষ্টি মুখের ভাবখানি। আমি ঠাট্টা করে তাকে বলতুম, ‘তুমি হলে মিসেস টাইকান।’ শুনে তারা দুজনেই হেসে অস্থির হত। টাইকান আর হিশিদা সুরেনের বাড়িতেই থাকত। এদিকে ওদিকে ঘুরে ঘুরে খুব ছবি আঁকত। অনবরত স্কেচ করে যেত; কত সময়ে দেখতুম, গাড়িতে যাচ্ছি, টাইকান রাস্তার এদিকে ওদিকে তাকাতে তাকাতে বাঁ হাত বের করে তার তেলোতে ডান হাতের আঙুল বুলিয়ে চলেছে। আমি জিজ্ঞেস করতুম, ‘ও কি করছ টাইকান?’ সে বলত, ‘ফর্মটা মনে রাখছি। একবার হাতের উপরে বুলিয়ে নিলুম, লাইন মনে থাকবে বেশ।’ কখনো বা দেখতুম তাড়াতাড়ি জামার আস্তিন টেনে তাতে পেনসিল কলম দিয়ে স্কেচ করছে। নিজের সাজসজ্জার দিকে তার লক্ষ্যই ছিল না তেমন—মস্ত বড় একটা খড়ের হ্যাট মাথায় দিয়ে রোদে রোদে কলকাতার শহর বাজার ঘুরে বেড়াত, খেয়ালই করত না লোকে কি ভাববে তার ওই খ্যাপার মত সাজ দেখে। কিছু বলতে গেলে হাসত, বলত, ‘কি আর হয়েছে তাতে। জানো, এই টুপি রোদ্দুরে বেশ ঠাণ্ডা রাখে মাথা।’ টাইকান আমাদের স্টুডিয়োতে আসত, বসে কাজ করত। সেই সব ছবির আরার একজিবিশন হত, লোকে কিনত। আমরাও অনেক সময়ে ফরমাশ দিয়ে ছবি আঁকাতুম। বিদেশে এসেছে, তাদের খরচ চালাতে হবে তো— ওই ছবির টাকা দিয়েই খরচ চলত। প্রথম যখন টাইকান ছবি আঁকলে সিল্কের উপরে হালকা কালি দিয়ে, চোখেই পড়ে না; আমাদের মোগল পার্শিয়ান ছবির কড়া রঙ দেখে দেখে অভ্যেস; আর এ দেখি, রঙ নেই, কালি, নেই, হালকা একটু ধোঁয়ার মত—এ আবার কি ধরনের ছবি। এত আশা করেছিলুম জাপানী আর্টিস্ট আসবে, তাদের কাজ দেখব, কি করে তারা ছবি আঁকে, রঙ দেয়। আর এ দেখি কোত্থেকে একটু কয়লার টুকরো কুড়িয়ে এনে তাই দিয়ে প্রথমে সিল্কে আঁকলে, তার পর পালক দিয়ে বেশ করে ঝেড়ে তার উপরে একটু হালকা কালি বুলিয়ে দিলে, হয়ে গেল ছবি। মন খারাপ হয়ে গেল। সুরেনকে বললুম, ‘ও সুরেন, ছবি যে দেখতেই পাচ্ছিনে স্পষ্ট। সুরেন বললে, ‘পাবে পাবে, দেখতে পাবে, অভ্যেস হোক আগে।’ সত্যিই তাই। কিছুদিন বাদে দেখি, দেখার অভ্যেস হয়ে গেল; তাদের ছবি ভালোও লাগতে লাগল। অনেক ছবি এঁকেছিল তারা। আমাদের দেবদেবীর ছবি আঁকবে, বর্ণনা দিতে হত শাস্ত্ৰমতে। টাইকান এঁকেছিল সরস্বতী ও কালীর ছবি দুটি; সরলার মা কিনে নিলেন। আমাদের স্টুডিয়োর জন্যে ছবি আঁকার, দেয়ালে ছিল মস্ত বড় একটা বিলিতি অয়েল পেন্টিং—সেটা রাজেন মল্লিককে বিক্রি করে দিলুম। সেই দেয়ালের মাপে টাইকানকে বললুম ছবি এঁকে দিতে। রাসলীলা আঁকবে। বললে, ‘বর্ণনা দাও।’ বর্ণনা দিলুম। এদেশি মেয়েরা কি করে শাড়ি পরে দেখাতে হবে। বাড়ির একটি ছোট মেয়েকে ধরে এনে তাকে মডেল করে দেখালুম, এই করে শাড়ির আঁচলা ঘুরে ঘুরে যায়। শাড়ির ঘোরপেঁচ স্টাডি হল। কোথায় কি গহনা দিতে হবে পুরোনো মূর্তির ছবি ফোটো দেখিয়ে বুঝিয়ে দিলুম। সব হল। এইবার সে মেঝে জুড়ে কাগজ পেতে ছবি আরম্ভ করলে। প্রথমে কয়লা দিয়ে সিল্কে ড্রইং করে তার পর একটা আসন পেতে চেপে বসল ছবির উপরে। রঙ লাগাতে লাগল একধার থেকে। দেখতে দেখতে কদিনের মধ্যেই ছবি শেষ হয়ে এল। আকাশে চাঁদের আলো ফুটল, সবই হল, কিন্তু টাইকান ছবি আর শেষ করছে না কিছুতেই। বালিগঞ্জের দিকে থাকত, সকালেই চলে আসত, এসেই ছবির উপরে ঢাকা দেওয়া কাপড়টি সরিয়ে ছবির দিকে চেয়ে চেয়ে দেখে আর কেবলই এদিকে ওদিকে ঘাড় নাড়ে, কি যেন মনের মত হয়নি এখনো। রোজই দেখি এই ভাব। জিজ্ঞেস করি, ‘কোথায় তোমার আটকাচ্ছে।’ সে বলে, ‘বুঝতে পারছিনে ঠিক, তবে এইটে বুঝছি এতে একটা অভাব রয়ে গেছে।’ এই কথা বলে, ছবি দেখে, আর ঘাড় দোলায়। একদিন হল কি, এসেছে সকালবেলা, স্টুডিয়োতে ঢুকেছে—তখন শিউলি ফুল ফুটতে আরম্ভ করেছে, বাড়ির ভিতর থেকে মেয়েরা থালা ভরে শিউলি ফুল রেখে গেছেন সে-ঘরে, হাওয়াতে তারই কয়েকটা পড়েছে এখানে ওখানে ছড়িয়ে—টাইকান তাই-না দেখে ফুলগুলি একটি একটি করে কুড়িয়ে হাতে জড়ো করলে। আমি বসে বসে দেখছি তার কাণ্ড। ফুলগুলি হাতে নিয়ে ছবির উপরে ঢাকা দেওয়া কাপড়টি একটানে তুলে ছবির সামনের জমিতে হাতের সেই ফুলগুলি ছড়িয়ে দিলে, দিয়ে ভারি খুশি। থালা থেকে আরো ফুল নিয়ে ছবির সারা গায়ে আকাশে মেঘে গাছে সব জায়গায় ছড়িয়ে দিলে। এবারে টাইকানের মুখে হাসি আর ধরে না। একবার করে উঠে দাঁড়ায়, দূর থেকে ছবি দেখে, আর তাতে ফুল ছড়িয়ে দেয়, এই করে করে থালার সব কটি ফুলই ছবিতে সাজিয়ে দিলে। সে যেন এক মজার খেলা। ফুল সাজানো হলে ছবিটি অনেকক্ষণ ধরে দেখে এবারে ফুলগুলি সব আবার তুলে নিয়ে রাখলে থালাতে। শুধু একটি শিউলি ফুল নিলে বাঁ হাতে, আসন চাপালে ছবির উপরে, তার পর সাদা কমলা রং নিয়ে লাগল ছবিতে ফুলকারি করতে। একবার করে বাঁ হাতে ফুলটি ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখে আর ফুল আঁকে। দেখতে দেখতে ছবিটি ফুলে ফুলে সাদা হয়ে গেল—আকাশ থেকে যেন পুষ্পবৃষ্টি হচ্ছে, হাওয়াতে ফুল ভেসে এসে পড়ছে রাসলীলার নাচের মাঝে। রাধার হাতে দিলে একটি কদমফুল, গলায়ও দুলিয়ে দিলে শিউলিফুলের মালা, কৃষ্ণের বাঁশিতেও জড়ালে একগাছি। ফুলের সাদায় জ্যোৎস্না রাত্তির যেন ফুটে উঠল। এইবার টাইকান ছবি শেষ করলে, বললে, ‘এই অভাবটাই মেটাতে পারছিলুম না এতদিন।’ সেই ছবি শেষে একদিন দেয়ালে টাঙানো হল। টাইকান নিজের হাতে বাঁধাই করলে, বালুচরী শাড়ির আঁচলা লাগিয়ে দিলে ফ্রেমের চারদিকে। বন্ধুবান্ধবদের ডেকে পার্টি দেওয়া হল স্টুডিয়োতে, রাসলীলা দেখবার জন্য। বড় মজায় কেটেছে সে সব দিন। টাইকান আমায় লাইন ড্রইং শেখাত, কি করে তুলি টানতে হয়। আমরা তাড়াতাড়ি লাইন টেনে দিই—তার কাছেই শিখলুম একটি লাইন কত ধীরে ধীরে টানে তারা। আমার কাছেও সে শিখত মোগল ছবির নানান টেকনিক। এমন একটা সৌহার্দ ছিল আমাদের মধ্যে—বিদেশী শিল্পী আর দেশী শিল্পীর মধ্যে কোনো তফাত ছিল না। এখন সেইটে বড় দেখতে পাইনে। টাইকান দেখতুম রীতিমত নেচার স্টাডি করত—আমাদের দেশের পাতা ফুল, গাছপালা, মানুষের ভঙ্গি, গহনা, কাপড়-চোপড়, যেখানে যেটি ভালো লেগেছে খাতার পর খাতা ভরে নিয়ে গেছে। বিশেষ করে ভারতবর্ষের লোকদের মুখচোখের ছাঁদ ভারতীয় বৈশিষ্ট্য দস্তুরমত অনুশীলন করেছে। সেই সময়ে টাইকানের ছবি আঁকা দেখে দেখেই একদিন আমার মাথায় এল, জলে কাগজ ভিজিয়ে ছবি আঁকলে হয়। টাইকানকে দেখতুম ছবিতে খুব করে জলের ওয়াশ দিয়ে ভিজিয়ে নিত। আমি আমার ছবি সুদ্ধ কাগজ দিলুম জলে ডুবিয়ে। তুলে দেখি বেশ সুন্দর একটা এফেক্‌ট হয়েছে। সেই থেকে ওয়াশ প্রচলিত হল।  খুব কাজ করত টাইকান। হিশিদা ততটা করত না, সে বেশ এখানে ওখানে ঘুরে বেড়াত। কোথায় একটু কি মাটির টুকরো পেলে, তাই ঘষে রঙ বের করলে; বাগানে সিমগাছ ছিল, ঘুরতে ঘুরতে দু-চারটে পাতা ছিঁড়ে এনে হাতে ঘষে লাগিয়ে দিলে ছবিতে। কুলগাছের ডাল পড়ে আছে কোথায়, তাই এনে একটু পুড়িয়ে কাঠকয়লার কাঠি বানিয়ে ছবি এঁকে ফেললে। বেচারা জাপানে ফিরে গিয়েই মারা গেল। মাস ছয়েক ছিল তারা এদেশে। বলেছিল আবার আসবে, আবার আর-একদল আর্টিস্ট পাঠাবে। তা আর হল না। হিশিদা বেঁচে থাকলে খুব বড় আর্টস্ট হত। একটি ছবি এঁকেছিল—দূরে সমুদ্রে আকাশে মিলে গেছে, সামনে বালুর চর, ছবিতে একটি মাত্র ঢেউ এঁকেছে যেন এসে আছড়ে পড়ছে পারে। সে যে কি সুন্দর কি বলব। পান্নার মত ঢেউয়ের রঙটি, তার গর্জন যেন কানে এসে বাজত স্পষ্ট। বড় লোভ হয়েছিল সেই ছবিটিতে। হিশিদা তো মরে গেল, টাইকান ছিল বেঁচে। খুব ভাব হয়ে গিয়েছিল তাদের সঙ্গে, অন্তরঙ্গ বন্ধুর মত। বরাবর চিঠিপত্র লিখে খোঁজখবর রাখত। রবিকা সেবার জাপানে যাবেন, নন্দলালকে নিয়ে গেলেন সঙ্গে, ওদের দেশে আর্টিস্টদের ভিতরে গিয়ে থেকে দেখে শুনে আসবে। নন্দলালকে বললুম, ‘টাইকানের কাছে যাবে, খালি হাতে যেতে নেই।’ আমার কাছে ছিল একটি খোদাইকরা ব্রোঞ্জ, বহু পুরোনো, নবাবদের আমলের ঘোড়ার বকলসের একটা কোনো জায়গার ডেকোরেশন হবে। সেইটি নন্দলালকে দিয়ে বললুম, ‘এইটি টাইকানকে দিয়ো আমার নাম করে। একদিকে আংটার মত আছে, বেশ ছবি টানাতে পারবে।’ আর তার স্ত্রীর জন্য দিলুম আমাদের দেশের শাড়ি ও জামার কাপড় কিছু। পরে নন্দলাল যখন ফিরে এল তার কাছে শুনি, টাইকান সেই ব্রোঞ্জটি হাতে নিয়ে মহা খুশি, ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখে আর হাসে। ওকাকুরা যখন প্রথমবার আসেন এদেশে, যতদূর মনে পড়ে কলকাতায় সুরেনের বাড়িতেই ছিলেন। সেবার খুব বেশি আলাপ হয়নি তাঁর সঙ্গে। মাঝে মাঝে যেতুম, দেখতুম বসে আছেন তিনি একটা কৌচে। সামনে ব্রোঞ্জের একটি পদ্মফুল, তার ভিতরে সিগারেট গোঁজা; একটি করে তুলছেন আর ধরাচ্ছেন। বেশি কথা তিনি কখনোই বলতেন না। বেঁটেখাটাে মানুষটি, সুন্দর চেহারা, টানা চোখ, ধ্যাননিবিষ্ট গম্ভীর মূর্তি। বসে থাকতেন ঠিক যেন এক মহাপুরুষ। রাজভাব প্রকাশ পেত তার চেহারায়। সুরেনকে খুব পছন্দ করতেন ওকাকুরা। সুরেন সম্বন্ধে বলতেন, He is fit to be a king. দ্বিতীয়বার যখন এলেন দশ বছর পরে, তখন আমি আর্টের লাইনে ঢুকেছি। প্রায়ই আমাদের জোড়াসাঁকোর স্টুডিয়োতে বসে শিল্প সম্বন্ধে আলাপ-আলোচনা হত। নন্দলালদের তিনি আর্টের ট্র্যাডিশন অবসার্ভেশন ও ওরিজিনালিটি বোঝাতেন তিনটি দেশলাইয়ের কাঠি দিয়ে। দেবতার মত ভক্তি করত ওকাকুরাকে জাপানীরা। আমাদের ছিল এক জাপানী মালী। ওকাকুরা এসেছেন শুনে দেখা করবার খুব ইচ্ছে হল তার। স্টুডিয়োতে বসে আছেন ওকাকুরা, নন্দলালের সঙ্গে কথাবার্তা কইছেন, সে এসে দরজার পাশে দূর থেকে উকিঝুঁকি দিতে লাগল। বললুম, ‘এস ভিতরে।’ কিছুতেই আর আসে না, দূরে দাঁড়িয়েই কাঁচুমাচু করে। খানিক বাদে ওকাকুরার নজরে পড়তে তিনি ডান হাতের তর্জনী তুলে ভিতরের দিকে নির্দেশ করলে পর সে হাঁটু-মুড়ে সেখান থেকেই মাথা ঝুঁকতে, ঝুঁকতে ঘরে এল। ওকাকুরাও দু-একটা কথা জিজ্ঞাসাবাদ করলেন। সে আবার সেই ভাবেই হাঁটু মুড়ে বেরিয়ে গেল। যতক্ষণ ঘরে ছিল সোজা হয়ে দাঁড়ায়নি। পরে তাকে জিজ্ঞেস করলুম, ‘তুমি ওভাবে ছিলে কেন?’ সে বললে, ‘বাবা! আমাদের দেশে ওঁর কাছে যাওয়া কি সহজ কথা? আমাদের কাছে উনি যে দেবতার মত।’ সেবার ওকাকুরা ভারতবর্ষ ঘুরে ঘুরে দেখবেন। অনেক জায়গা ঘোরা হয়ে গেছে, আর দু-চার জায়গা দেখা বাকি। বললুম, যাচ্ছ যখন, কোনারকের মন্দিরটা ঘুরে দেখে এস একবার। নয় তো ভারতবর্ষের আসল জিনিসই দেখা হবে না। ওকাকুরা বললেন, ‘পুরীর মন্দিরও দেখবার বড় ইচ্ছে আমার। ব্যবস্থা করে দিতে পার?’ তখন তিনি কঠিন রোগে ভুগছেন, ভাঙা শরীর; তাই নিয়েই এসেছেন বিদেশে বিভুঁয়ে ভারতের শিল্পকীর্তি দেখতে। জগন্নাথের ডাক পড়েছে আমার বিদেশী শিল্পী ভাইকে। কিন্তু জগন্নাথ ডাকেন তো ছড়িদার ছাড়ে না; লাটবেলাটকে পর্যন্ত বাধা দেয় এত বড় ক্ষমতা সে ধরে, তাকে কিভাবে এড়ানো যায়? শিল্পীতে শিল্পীতে মন্ত্রণা বসে গেল। চুপি চুপি পরামর্শটা হল বটে, কিন্তু বন্ধু গেলেন জগবন্ধু দর্শন করতে দিনের আলোতে রাজার মত। দ্বার খুলে গেল, প্রহরী সসম্মানে একপাশ হল, জাপানের শিল্পী দেখে এলেন ভারতের শিল্পীর হাতে গড়া দেবমন্দির, বৈকুণ্ঠ, আনন্দবাজার, মায় দেবতাকে পর্যন্ত। বড় খুশি হয়েছিলেন ওকাকুরা সেবারে কোনারক দেখে। বললেন, ‘কোনারক না দেখলে এবারকার আসাই আমার বৃথা হত। ভারতশিল্পের প্রাণের খবর মিলল আমার ওখানে।’ তাঁর বিদায়ের দিনের শেষ কথা আমার এখনও মনে আছে, ‘ধন্য হলেম, আনন্দের অবধি পেলেম, এইবার পরপারে সুখে যাত্রা করি।’ দেশে ফিরে গিয়ে কিছুকালের মধ্যেই মারা যান ওকাকুরা। সেবারেই তিনি বলেছিলেন নন্দলালদের, ‘দশ বছর আগে যখন আমি এসেছিলাম তখন তোমাদের আজকালকার আর্ট বলে কিছুই দেখিনি। এবারে দেখছি তোমাদের আর্ট হবার দিকে যাচ্ছে। আবার যদি দশ বছর বাদে আসি তখন হয়তো দেখব হয়েছে কিছু।’ তিনিও আর এলেন না, আমিও বসে আছি দেখবার জন্যে—কই, দেখছি না তো। হয়তো আবার আমায় আসতে হবে। পথ আছে কি?
অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর
১৫. ভারতবর্ষকে যাঁরা সত্যিই ভালোবেসেছিলেন অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর ভারতবর্ষকে যাঁরা সত্যিই ভালোবেসেছিলেন তার মধ্যে নিবেদিতার স্থান সবচেয়ে বড়। বাগবাজারের ছোট্ট ঘরটিতে তিনি থাকতেন, আমরা মাঝে মাঝে যেতুম সেখানে। নন্দলালদের কত ভালোবাসতেন, কত উৎসাহ দিতেন। অজন্তায় তো তিনিই পাঠালেন নন্দলালকে। একদিন আমায় নিবেদিতা বললেন, ‘অজন্তায় মিসেস হ্যারিংহাম এসেছে। তুমিও তোমার ছাত্রদের পাঠিয়ে দাও, তার কাজে সাহায্য করবে। দুপক্ষেরই উপকার হবে। আমি চিঠি লিখে সব ঠিক করে দিচ্ছি।’ বললুম, ‘আচ্ছা’ নিবেদিতা তখনি মিসেস হ্যারিংহামকে চিঠি লিখে দিলেন। উত্তরে মিসেস হ্যারিংহাম জানালেন, বোম্বে থেকে তিনি আর্টিস্ট পেয়েছেন তাঁর কাজে সাহায্য করবার। এরা সব নতুন আর্টিস্ট, জানেন না কাউকে, ইত্যাদি ইত্যাদি। নিবেদিতা ছেড়ে দেবার মেয়ে নন। বুঝেছিলেন এতে করে নন্দলালদের উপকার হবে। যে করে হোক পাঠাবেনই তাদের। আবার তাঁকে চিঠি লিখলেন। আমায় বললেন, ‘খরচপত্তর সব দিয়ে এদের পাঠিয়ে দাও অজন্তায়। এ রকম সুযোগ ছেড়ে দেওয়া চলবে না।’ নিবেদিতা যখন বুঝেছেন এতে নন্দলালের ভালো হবে, আমিও তাই মেনে নিয়ে সমস্ত খরচপত্তর দিয়ে নন্দলালদের কয়েকজনকে পাঠিয়ে দিলুম অজন্তায়। পাঠিয়ে দিয়ে তখন আমার ভাবনা। কি জানি, পরের ছেলে, পাহাড়ে জঙ্গলে পাঠিয়ে দিলুম, যদি কিছু হয়। মনে আর শান্তি পাইনে, গেলুম আবার নিবেদিতার কাছে। বললুম, ‘সেখানে ওদের খাওয়াদাওয়াই বা কি হচ্ছে, রান্নার লোক নেই সঙ্গে, ছেলেমানুষ সব।’ নিবেদিতা বললেন, ‘আচ্ছা আমি সব বন্দোবস্ত করে দিচ্ছি।’ বলে গণেন মহারাজকে ডাকিয়ে আনলেন। ডাল চাল তেল নুন ময়দা ঘি আর একজন রাঁধুনি সঙ্গে দিয়ে বিলিব্যবস্থা বলে কয়ে গণেনকে পাঠিয়ে দিলেন নন্দলালদের কাছে। তবে নিশ্চিন্ত হই। নিবেদিতা নইলে নন্দলালদের যাওয়া হত না অজন্তায়। কি চমৎকার মেয়ে ছিলেন তিনি। প্রথম তাঁর সঙ্গে আমার দেখা হয় আমেরিকান কন্‌সলের বাড়িতে। ওকাকুরাকে রিসেপ্‌শন দিয়েছিল, তাতে নিবেদিতাও এসেছিলেন। গলা থেকে পা পর্যন্ত নেমে গেছে সাদা ঘাগরা, গলায় ছোট্ট ছোট্ট রুদ্রাক্ষের এক ছড়া মালা; ঠিক যেন সাদা পাথরের গড়া তপস্বিনীর মূর্তি একটি। যেমন ওকাকুরা একদিকে, তেমনি নিবেদিতা আর একদিকে। মনে হল যেন দুই কেন্দ্র থেকে দুটি তারা এসে মিলেছে। সে যে কি দেখলুম কি করে বোঝাই। আর একবার দেখেছিলুম তাঁকে। আর্ট সোসাইটির এক পার্টি, জাস্টিস হোমউডের বাড়িতে, আমার উপরে ছিল নিমন্ত্রণ করার ভার। নিবেদিতাকেও পাঠিয়েছিলুম নিমন্ত্রণ চিঠি একটি। পার্টি শুরু হয়ে গেছে। একটু দেরি করেই এসেছিলেন তিনি। বড় বড় রাজারাজড়া সাহেব মেম গিসগিস করছে। অভিজাতবংশের বড়ঘরের মেম সব; কত তাদের সাজসজ্জার বাহার, চুল বাঁধিবারই কত কায়দা; নামকরা সুন্দরী অনেক সেখানে। তাদের সৌন্দর্যে ফ্যাশানে চারদিক ঝলমল করছে। হাসি গল্প গানে বাজনায় মাত্‌। সন্ধ্যে হয়ে এল, এমন সময়ে নিবেদিতা এলেন। সেই সাদা সাজ, গলায় রুদ্রাক্ষের মালা, মাথার চুল ঠিক সোনালি নয়, সোনালি রুপোলিতে মেশানো, উঁচু করে বাঁধা। তিনি যখন এসে দাঁড়ালেন সেখানে, কি বলব যেন নক্ষত্রমণ্ডলীর মধ্যে চন্দ্রোদয় হল। সুন্দরী মেমরা তাঁর কাছে যেন এক নিমেষে প্রভাহীন হয়ে গেল। সাহেররা কানাকানি করতে লাগল। উড্‌রফ, ব্লান্ট এসে বললেন, ‘কে এ?’ তাদের সঙ্গে নিবেদিতার আলাপ করিয়ে দিলুম। ‘সুন্দরী সুন্দরী’ কাকে বল তোমরা জানিনে। আমার কাছে সুন্দরীর সেই একটা আদর্শ হয়ে আছে। কাদম্বরীর মহাশ্বেতার বর্ণনা—সেই চন্দ্রমণি দিয়ে গড়া মূর্তি যেন মূর্তিমতী হয়ে উঠল। নিবেদিতা মারা যাবার পর একটি ফোটো গণেন মহারাজকে দিয়ে জোগাড় করেছিলুম, আমার টেবিলের উপর থাকত সেখানি। লর্ড কারমাইকেল, তাঁর মত আর্টিস্টিক নজর বড় কারো ছিল না। আমাদের নজরে নজরে মিল ছিল। আর্টেরই শখ তাঁর। জার্মান-যুদ্ধের ঠিক আগে জাহাজ-বোঝাই তাঁর যা কিছু ভালো ভালো জিনিস ও আমাদের আঁকা একপ্রস্থ ছবি বিলেতে পাঠিয়েছিলেন। সেই জাহাজ গেল ডুবে ভূমধ্যসাগরে। তিনি দুঃখ করেছিলেন, ‘আমার আসবাবপত্র সব যায় যাক কোনো দুঃখ নেই, কিন্তু তোমাদের ছবিগুলো যে গেল এইটেই বড় দুঃখের কথা।’ নন্দলাল যখন এসে দুঃখ করলে তাকে স্তোকবাক্য দিয়েছিলুম, ‘ভালোই হয়েছে, এতে দুঃখ কি। আমি দেখছি জলদেবীরা আমাদের ছবিগুলো বরুণালয়ে টাঙিয়ে আনন্দ করছেন। গেছে যাক, ভেবো না।’ সেই লর্ড কারমাইকেল একদিন আমার টেবিলের উপর নিবেদিতার ফোটােখানি দেখে ঝুঁকে পড়লেন, বললেন, ‘এ কার ছবি?’ বললুম, ‘সিস্টার নিবেদিতার।’ তিনি বললেন, ‘এ-ই সিস্টার নিবেদিতা? আমার একখানি এইরকম ছবি চাই।’ বলেই আর বলাকওয়া না, সেই ছবিখানি বগলদাবা করে চলে গেলেন। ছবিখানি থাকলে বুঝতে পারতে সৌন্দর্যের পরাকাষ্ঠা কাকে বলে। সাজগোজ ছিল না, পাহাড়ের উপর চাঁদের আলো পড়লে যেমন হয় তেমনি ধীর স্থির মূর্তি তাঁর। তাঁর কাছে গিয়ে কথা কইলে মনে বল পাওয়া যেত। বিবেকানন্দকেও দেখেছি। কর্তাদাদামশায়ের কাছে আসতেন। দীপুদার সহপাঠী ছিলেন; ‘কি হে নরেন’ বলে তিনি কথা বলতেন। বিবেকানন্দের বক্তৃতা শোনবার ভাগ্য হয়নি আমার, তার চেহারা দেখেছি; কিন্তু আমার মনে হয় নিবেদিতার কাছে লাগে না। নিবেদিতার কি একটা মহিমা ছিল; কি করে বোঝাই সে কেমন চেহারা। দুটি যে দেখিনে আর, উপমা দেব কি। শিল্পের পথে চলতে চলতে ভালো মন্দ জ্ঞানী মূর্খ অনেকের সংস্পর্শেই এসেছি। সইতে হয়েছে অনেক কিছু। বলি এক ঘটনা। লাটবন্ধুও আসত যেমন, রাজবন্ধুও আসত অনেক। রবিকা জাপান থেকে ‘অন্ধ ভিখিরী’ ছবি আনলেন; নামকরা শিল্পীর আকা, মস্ত সিল্কে। কি ছবির কারুকাজ, প্রতিটি চুলের কি টান, দেখলে অবাক হয়ে যেতে হয়। বিচিত্রা হলে টানানো হল সেই ছবি। এখন এক রাজবন্ধু এসেছেন দেখতে; শিল্পের সমজদার বলে নাম আছে তাঁর। আমার দুর্বুদ্ধি, তাঁকে বোঝাতে গেছি জাপানী শিল্পীর তুলির টানের বাহাদুরি, কি করে একটি টানে একটি চুল এঁকেছে। রাজবন্ধু চোখ বুজে ভাবলেন খানিক, ভেবে বললেন ‘অবনিবাবু, আমি দেখেছি গাড়ির চাকায় যার লাইন টানে তারাও এর চেয়ে সূক্ষ্ম লাইন টানে।’ শুনে আমার একেবারে বাক্‌রোধ। এমন ধাক্কা আমি কখনো খাইনি। দেখেছি ইউরোপীয়ানরা ঢের বেশি ছবি বুঝত, রস পেত, দু-এক কথাতেই বোঝা যেত তা। রাজবন্ধু তো ওই কথা বললেন, অথচ দেখ একটা সামান্য লোকের কথা। ওরিয়েণ্টাল সোসাইটির একজিবিশন হচ্ছে কর্পোরেশন স্ট্রীটের একতলা ঘরে। ভালো ভালো ছবি সব টাঙানো হয়েছে—লাটবেলাট, সাহেবসুবো, বাবুভায়া, কেরানী, ছাত্র, মাস্টার পণ্ডিত সব ঘুরে ঘুরে দেখছেন। আমিও ঘুরছি বন্ধুদের সঙ্গে। কয়েকটি পাঞ্জাবী ট্যাক্সিড্রাইভার রাস্তা থেকে উঠে এসে ঘুরে ঘুরে ছবি দেখতে লাগল। আমাদের ড্রাইভারটাও ছিল সেই সঙ্গে। কৌতুহল হল, দেখি, এরা ছবি সম্বন্ধে কি মন্তব্য করে। জিজ্ঞেস করলুম, ‘কি, কিরকম লাগছে?’ একটি ড্রাইভার একখানি খুব ভালো ছবিই দেখিয়ে বললে, এই ছবিখানি যেমন হয়েছে আর কোনোটা তেমন হয়নি। সেটা কার ছবি এখন মনে নেই। সেদিন বুঝলুম এরাও তো ছবি বোঝে। তার কারণ সহজ চোখে ছবি দেখতে শিখেছে এর। ওইরকম মতিবুড়ো একবার বলেছিলেন আমায়, ‘ছোটবাবু, একটা কথা বলব, রাগ করবেন না?’ বললুম, ‘না রাগ কেন করব, বলুন না?’ ‘দেখুন, ছোটবাবু, আপনার ছাত্র নন্দলাল, সুরেন গাঙুলী, ওরা ছবি আঁকে, দেখে মনে হয় বেশ যত্ন করে ভালো ছবিই এঁকেছে। কিন্তু আপনার ছবি দেখে তো তা মনে হয় না।’ ‘ছবি বলে মনে হয় তো?’ ‘তাও নয়।’ ‘তবে কি মনে হয়? ‘মনে হয়—’ ‘বলেই ফেলুন না, ভয় কি?’ ‘আপনার ছবি দেখলে মনে হয় আঁকা হয়নি মোটেই।’ ‘সে কি কথা! আপনার কাছে বসেই আঁকি আমি, আর বলছেন আঁকা বলেই মনে হয় না।’ ‘না, মনে হয় যেন ওই কাগজের উপরেই ছিল ছবি।’ বড় শক্ত কথা বলেছিলেন তিনি। শক্ত সমালোচক ছিলেন বুড়ো, বড় সার্টিফিটেই দিয়েছিলেন আমায়। একথা ঠিক, এঁকেছি চেষ্টা করেছি, এ সমস্ত ঢাকা দেওয়াই হচ্ছে ছবির পাকা কথা। গান সম্বন্ধেও এই কথাই শাস্ত্রে বলেছে। আকাশের পাখি যখন উড়ে যায়, বাতাসে কোনো গতাগতির চিহ্ন রেখে যায় না। সুরের বেলা যেমন এই কথা, ছবির বেলাও সেই একই কথা।
অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর
১৬. সকাল থেকে ঝির ঝির করে বৃষ্টি অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর সকাল থেকে ঝির ঝির করে বৃষ্টি পড়ছে। বসে থাকতে থাকতে মনে হল গঙ্গার রূপ—বর্ষায় গঙ্গা হয়তো ভরে উঠেছে এতক্ষণে। সেবার এখান থেকে কলকাতায় গিয়ে একবার গেলুম দক্ষিণেশ্বরে গঙ্গাকে দেখতে। কিন্তু সে গঙ্গাকে যেন পেলেম না আর কোথাও। কোথায় গেল তার সেই রূপ। মনে হল কে যেন গঙ্গার আঁচল কেটে সেখানে বিচ্ছিরি একটা ছিটের কাপড় জুড়ে দিয়েছে। চারদিকে খানিক তাকিয়ে তাকিয়ে দেখে ফিরে এলেম বাড়িতে। কিন্তু দেখেছি আমি গঙ্গার সেই রূপ।— ‘বন্দ্য মাতা সুরধুনী পুরাণে মহিমা শুনি পতিত পাবনী পুরাতনী।’ শিশুবোধ পড়তুম, বড় চমৎকার বই, অমন বই আমি আর দেখিনে। এখনকার ছেলেরা পড়ে না সে বই— কুরুবা কুরুবা কুরুবা লিজ্জে কাঠায় কুরুবা কুরুবা লিজ্জে কাঠায় কাঠায় ধুল পরিমাণ দশ বিশ কাঠায় কাঠায় জান। আমার যাত্রায় ছাগলের মুখে এই গান জুড়ে দিয়েছিলুম। কেমন সুন্দর কথা বল দেখিনি, যেন কুর কুর করে ঘাস খাচ্ছে ছাগলছানা। আরো সব নানা গল্প ছিল, দাতা কর্ণের গল্প, প্রহ্লাদের গল্প, সন্দীপনী মুনির পাঠশালায় কেষ্ট বলরাম পড়তে যাচ্ছেন, সন্দীপনী মুনির দ্বারে কেষ্ট বলরাম, আরো কত কি। বড় হয়েও এই সেদিনও পড়েছি আমি বইখানি মোহনলালকে দিয়ে আনিয়ে। তা সেই সুরধনী গঙ্গাকে দেখেছি আমি। ছেলেবেলায় কোন্নগরের বাগানে বসে বসে দেখতুম—দুকূল ছাপিয়ে গঙ্গা ভরে উঠেছে, কুলু কুলু ধ্বনিতে বয়ে চলেছে; সে ধ্বনি সত্যিই শুনতে পেতুম। ঘাটের কাছে বসে আছি, কানে শুনছি তার সুর, কুল্‌ কুল্‌ ঝুপ্‌, কুল্‌ কুল্‌ ঝুপ্‌—আর চোখে দেখছি তার শোভা—সে কী শোভা, সেই ভরা গঙ্গার বুকে ভরা পালে চলেছে জেলে নৌকো, ডিঙি নৌকো। রাত্তিরবেলা সারি সারি নৌকোর নানারকম আলো পড়েছে জলে। জলের আলো ঝিলমিল করতে করতে নৌকোর আলোর সঙ্গে সঙ্গে নেচে চলত। কোনো নৌকোয় নাচগান হচ্ছে, কোনো নৌকোয় রান্নার কালে হাঁড়ি চেপেছে, দূর থেকে দেখা যেত আগুনের শিখা। স্নানযাত্রীদের নৌকো সব চলেছে পর পর। রাতের অন্ধকারে সেও আর এক শোভা গঙ্গার। গঙ্গার সঙ্গে অতি নিকট সম্বন্ধ তেমন ছিল না; চাকররা মাঝে মাঝে গঙ্গাতে স্নান করাতে নিয়ে যেত, ভালো লাগত না, তাদের হাত ধরেই দু-বার জলে ওঠানামা করে ডাঙার জীব ডাঙায় উঠে পালিয়ে বাঁচতুম। কিন্তু দেখেছি, এমন দেখেছি যে দেখার ভিতর দিয়েই গঙ্গাকে অতি কাছে পেয়েছি। তার পর বড় হয়ে আর একবার গঙ্গাকে আর এক মূর্তিতে দেখি। খুব অসুখ থেকে ভুগে উঠেছি নিজে ওঠবার বসবার ক্ষমতা নেই। ভোর ছটায় তখন ফেরি স্টীমার ছাড়ে, জগন্নাথ ঘাট থেকে শিবতলা ঘাট হয়ে ফেরে নটা সাড়ে নটায়। বিকেলেও যায়, আপিসের বাবুদের পৌঁছে দিয়ে আসে। ঘণ্টা দুই-আড়াই লাগে। ডাক্তার বললেন, গঙ্গার হাওয়া খেলে সেরে উঠব তাড়াতাড়ি। নির্মল আমায় ধরে ধরে এনে বসিয়ে দিলে স্টীমারের ডেকে একটা চেয়ারে। মনে হল যেন গঙ্গাযাত্রা করতে চলেছি। এমনি তখন অবস্থা আমার। কিন্তু সাত দিন যেতে না-যেতে গঙ্গার হাওয়ায় এমন সেরে উঠলুম, নির্মলকে বললুম, ‘আর তোমায় আসতে হবে না, আমি একাই যাওয়া-আসা করতে পারব।’ সেই দেখেছি সেবারে গঙ্গার রূপ। গ্রীষ্ম বর্ষ শরৎ হেমন্ত শীত বসন্ত কোনো ঋতুই বাদ দিইনি, সব ঋতুতেই মা গঙ্গাকে দেখেছি। এই বর্ষাকালে দুকূল ছাপিয়ে জল উঠেছে গঙ্গার,—লাল টকটক করছে। জলের রং—তোমরা খোয়াইধোয়া জলের কথা বল ঠিক তেমনি, তার উপরে গোলাপী পাল তোলা ইলিশ মাছের নৌকো এদিকে ওদিকে দুলে দুলে বেড়াচ্ছে, সে কি সুন্দর। তার পর শীতকালে বসে আছি ডেকে গরম চাদর গায়ে জড়িয়ে, উত্তুরে হাওয়া মুখের উপর দিয়ে কানের পাশ ঘেঁষে বয়ে চলেছে হু হু করে। সামনে ঘন কুয়াশা, তাই ভেদ করে স্টীমার চলেছে একটানা। সামনে কিছুই দেখা যায় না। মনে হত যেন পুরাকালের ভিতর দিয়ে নতুন যুগ চলেছে কোন রহস্য উদ্ঘাটন করতে। থেকে থেকে হঠাৎ একটি দুটি নৌকো সেই ঘন কুয়াশার ভিতর থেকে স্বপ্নের মত বেরিয়ে আসত। দেখেছি, গঙ্গার অনেক রূপই দেখেছি। তাই তো বলি, আজকাল ভারতীয় শিল্পী বলে নিজেকে যারা পরিচয় দেয় ভারতীয় তারা কোন্‌খানটায়? ভারতের আসল রূপটি তারা ধরল কই? তাদের শিল্পে ভারত স্থান পায়নি মোটেই। কারণ তারা ভারতকে দেখতে শেখেনি, দেখেনি। এ আমি অতি জোরের সঙ্গেই বলছি। আমি দেখেছি, নানারূপে মা গঙ্গাকে দেখেছি। তাই তো ব্যথা বাজে, যখন দেখি কি জিনিস এরা হারায়। কত ভালো লাগত, কত আনন্দ পেয়েছি গঙ্গার বুকে। একদিনও বাদ দিইনি, আরো দেখবার, ভালো করে দেখবার এত প্রবল ইচ্ছে থাকত প্রাণে। গঙ্গার উপরে সে বয়সে কত হৈচৈই না করতুম। সঙ্গী সাথিও জুটে গেল। গাইয়ে বাজিয়েও ছিল তাতে। ভাবলুম, এ তে মন্দ নয়। গানবাজনা করতে করতে আমাদের গঙ্গা-ভ্রমণ জমবে ভালো। যেই না ভাবা, পরদিন বাঁয়া তবলা হারমোনিয়ম নিয়ে তৈরি হয়ে উঠলুম স্টীমারে। বেশির ভাগ স্টীমারে যারা বেড়াতে যেত তারা ছিল রুগীর দল। ডাক্তারের প্রেসকিপশন গঙ্গার হাওয়া খেতে হবে, কোনোরকমে এসে বসে থাকেন— স্টীমার ঘণ্টা কয়েক চলে ফিরে ঘুরে এসে লাগে ঘাটে, গঙ্গার হাওয়া খেয়ে তারাও ফিরে যায় যে যার বাড়িতে। আর থাকত আপিসের কেরানিবাবুরা, কলকাতার আশপাশ থেকে এসে আপিস করে ফিরে যায় রোজ। সেই একঘেয়েমির মধ্যে আমরা দু-চারজন জুড়ে দিলুম গানবাজনা। কি উৎসাহ আমাদের, দু-দিনেই জমে উঠল খুব। রায়বাহাদুর বৈকুণ্ঠ বোস মশায় বৃদ্ধ ভদ্রলোক, তিনিও আসেন স্টীমারে বেড়াতে। সম্প্রতি অসুখ থেকে উঠেছেন, খুব ভাল বাঁয়া তবলা বাজাতে পারতেন এককালে, তিনিও জুটে পড়লেন আমাদের দলে বাঁয়া তবলা নিয়ে। কানে একদম শুনতে পেতেন না, কিন্তু কি চমৎকার তবলা বাজাতেন। বললুম, ‘কি করে পারেন?’ তিনি বললেন, ‘গাইয়ের মুখ দেখেই বুঝে নিই।’ গানও হত, নিধুবাবুর টপ্পা, গোপাল উড়ের যাত্রা, এই সব। গানবাজনায় হৈ হৈ করতে করতে চলেছি—এদিকে গঙ্গাও দেখছি। এ খেয়ায় ও খেয়ায় স্টীমার থেমে লোক তুলে নিচ্ছে, ফেরি বোটও চলেছে যাত্রী নিয়ে। মাঝে মাঝে গঙ্গার চর—সে চরও আজকাল আর দেখিনে। ঘুষুড়ির চড়া বরাবর দেখেছি, বাবামশায়দের আমলেও তাঁরা যখন পলতার বাগানে যেতেন, ওই চরে থেমে স্নান করে রান্নাবান্নাও হত কখনো কখনো চরে, সেখানেই খাওয়াদাওয়া সেরে আবার বোট ছেড়ে দিতেন। বরাবরের এই ব্যবস্থা ছিল। এবারে ছেলেদের জিজ্ঞেস করলুম, ‘ওরে সেই চর কোথায় গেল? দেখছিনে যে। গঙ্গার কি সবই বদলে গেল? এ যে সেই গঙ্গা বলে আর চেনাই দায়।’ তা সেই তখন একদিন দেখলুম। সে যে কি ভালো লেগেছিল। স্টীমার চলেছে খেয়া থেকে যাত্রী তুলে নিয়ে। সামনে চর যেন—এপার গঙ্গা ওপার গঙ্গা মধ্যিখানে চর তার মাঝে বসে আছে শিবু সদাগর। ওপাশের ঘাটে একটি ডিঙি নৌকো। ছোট্ট গ্রামের ছায়া পড়েছে, ঘাটে ডিঙি নৌকায় ছোট্ট একটি বউ লাল চেলি পরে বসে—শ্বশুরবাড়ি যাবে, কাঁদছে চোখে লাল আঁচলটি দিয়ে, পাশে বুড়ি দাই গায়ে হাত বুলিয়ে সান্তত্বনা দিচ্ছে, নদীর এপার বাপের বাড়ি, ওপার শ্বশুরবাড়ি—ছোট্ট বউ কেঁদেই সারা ওইটুকু রাস্তা পেরতে। সে যে কি সুন্দর দৃশ্য, কি বলব তোমায়। মনের ভিতর আঁকা হয়ে রইল সেদিনের সেই ছবি, আজও আছে ঠিক তেমনটিই। এমনি কত ছবি দেখেছি তখন। গঙ্গার দুদিকে কত বাড়ি ঘর, মিল, ভাঙা ঘাট, কোথাও বা দ্বাদশ মন্দির, চৈতন্যের ঘাট, বটগাছটি গঙ্গার ধারে ঝুঁকে পড়েছে তারই নিচে এসে বসেছিলেন চৈতন্যদেব—গদাধরের পাট, এই সব পেরিয়ে স্টীমার চলত এগিয়ে। গান হৈ-হল্লার ফাঁকে ফাঁকে দেখাও চলত সমানে। এই দেখার জন্য ছেলেবেলার এক বন্ধুকে কেমন একদিন তাড়া লাগিয়েছিলুম। বলাই, ছেলেবেলায় এক সঙ্গে পড়েছি—অসুখে ভোগার পর একদিন দেখি সেও এসেছে স্টীমারে, দেখে খুব খুশি। খানিক কথাবার্তার পর সে পকেট থেকে একটি বই বের করে পাতা খুলে চোখের সামনে ধরলে, দেখি একখানি গীতা। একমনে পড়েই চলল, চোখ আর তোলে না পুথির পাতা থেকে। বললে, ‘মা বলে দিয়েছেন গীতা পড়তে, আমায় বিরক্ত কোরো না।’ বললুম, ‘বলাই, ও বলাই, বইটা রাখ্‌ না। কি হবে ও-বই পড়ে, চেয়ে দেখ্‌ দেখিনি কেমন দুপাতা খোলা রয়েছে সামনে, আকাশ আর জল, এতেই তোর গীতার সব কিছু পাবি। দেখ্‌ না একবারটি চেয়ে দেখ ভাই।’ বলাই মুখ তোলে না। মহামুশকিল। ধম্মকম্ম আমার সয় না। কোনোকালে করিওনি। ওসব দিকই মাড়াইনে। আর তা ছাড়া প্রথম প্রথম যখন আসি স্টীমারে, একদিন পিছনে সেকেণ্ড ক্লাসে বসে কেরানিবাবুরা এ ওর গায়ে ঠেলা মেরে চোখ ইশারা করে বলছে, ‘কে রে, এ কে এল?’ একজন বললে, ‘অবন ঠাকুর ঠাকুরবাড়ির ছেলে।’ আর একজন বললে, ‘ও, তাই, বয়েসকালে অনেক অত্যাচার করেছে এখন এসেছে পরকালের কথা ভেবে গঙ্গায় পুণ্যি করতে।’ শুনেছিলুম আপন মনেই। কিন্তু কথাটা মনে ছিল। অবিনাশ ছিল আমাদের মধ্যে ষণ্ডাগুণ্ডা ধরনের। আমার সঙ্গে আসত গানবাজনার আড্ডা জমাতে। তাকে ঠেলা দিয়ে বললুম, ‘দেখ না অবিনাশ, ওদিকে যে গীতার পাতা থেকে চোখই তুলছে না বলাই আর কোনোদিকে।’ শুনে অবিনাশ তড়াক করে লাফিয়ে উঠে, বলাই বই পড়ছে ঘাড় গুঁজে তার ঘাড়ের কাছে দাঁড়িয়ে হাত বাড়িয়ে বইটি ছোঁ মেরে নিয়ে একেবারে তার পকেটজাত করলে। বলাই চেচিয়ে উঠল, ‘কর কি, কর কি মা বলে দিয়েছেন সকাল-বিকেল গীতা পড়তে।’ আর গীতা! অবিনাশ বললে, ‘বেশি বাড়াবাড়ি কর তো গীতা জলে ফেলে দেব।’ বলাই আর কি করে, সেও শেষে আমাদের গানে বাজনায় যোগ দিলে। কেরানিবাবুরা দেখি উৎসুক হয়ে থাকেন আমাদের গানবাজনার জন্য। যে কেরানিবাবু আমাকে ঠেস দিয়ে সেদিন ওই কথা বলেছিলেন তিনি একদিন স্টীমারে উঠতে গিয়ে পা ফসকে গেলেন জলে পড়ে, আমরা তাড়াতাড়ি সারেঙকে বলে তাকে টেনে তুলি জল থেকে। পরে আমার সঙ্গে তাঁর খুব ভাব হয়ে যায়। তখন যে কেউ আসত আমাদের ওই দলে যোগ না দিয়ে পারত না। একবার এক যাকে বলে ঘোরতর বুড়ো—নাম বলব না—শরীর সারাতে স্টীমারে এসে হাজির হলেন। দেখে তো আমার মুখ শুকিয়ে গেল। অবিনাশকে বললুম, ‘ওহে অবিনাশ, এবারে বুঝি আমাদের গান বন্ধ করে দিতে হয়। টপ্পা খেয়াল তো চলবে না আর ধর্ম-সংগীত ছাড়া।’ সবাই ভাবছি বসে, তাই তো। আমাদের হারমোনিয়ম দেখে তিনি বললেন, ‘তোমাদের গানবাজনা হয় বুঝি। তা চলুক না, চলুক।’ মাথা চুলকে বললুম, ‘সে অন্য ধরনের গান।’ তিনি বললেন, বেশ তো তাই চলুক, চলুক না। ভয়ে ভয়ে গান আরম্ভ হল। দেখি তিনি বেশ খুশি মেজাজেই গান শুনছেন। তাঁর উৎসাহ দেখে আর আমাদের পায় কে—দেখতে দেখতে টপাটপ টপ্পা জমে উঠল। শুধু গানই নয়, নানারকম হৈচৈও করতুম, সমস্ত স্টীমারটি সারেঙ থেকে মাঝিরা অবধি তাতে যোগ দিত। জেলে নৌকো ডেকে ডেকে মাছ কেনা হত—ইলিশ মাছ, তপসে মাছ। একদিন ভাই রাখালি অনেকগুলি তপসে মাছ কিনে বাড়ি নিয়ে গেল। পরদিন জিজ্ঞেস করলুম, ‘কি ভাই কেমন খেলি তপসে মাছ?’ সে বললে, ‘আর বোলো না দাদা, আমায় আচ্ছা ঠকিয়ে দিয়েছে। তপসে নয়, সব ভোলামাছ দিয়ে দিয়েছিল, ভোলামাছ দিয়ে ভুলিয়ে ঠকিয়ে দিলে।’ আমরা সব হেসে বাঁচিনে। সেই রাখালি বলত, ‘অবনদাদা, তুমি যা করলে, দিল্লিতে মেডেল পেলে, খেতাব পেলে, ছবি এঁকে হিস্ট্রিতে তোমার নাম উঠে গেল।’ এতেই ভায়া আমার খুশি। আমাদের স্টীমারযাত্রীদের সেই দলটির নাম দিয়েছিলুম গঙ্গাযাত্রী ক্লাব। এই গঙ্গাযাত্রী ক্লাবের জন্য স্টীমার কোম্পানির আয় পর্যন্ত বেড়ে গিয়েছিল। দস্তুরমত একটি বিরাট আড্ডা হয়ে উঠেছিল। একবার ডারবির লটারির টিকিট কেনা হল ক্লাবের নামে। সকলে এক টাকা করে চাঁদা দিলুম। টাকা পেলে ক্লাবের সবাই সমান ভাগে ভাগ করে নেব। বৈকুণ্ঠবাবু প্রবীণ ব্যক্তি, তাকেই দেওয়া হল টাকাটা তুলে। তিনি ঠিকমত টিকিট কিনে যা যা করবার সব ব্যবস্থা করলেন। ওদিকে রোজই একবার করে সবাই জিজ্ঞেস করি, ‘বৈকুণ্ঠবাবু, টিকিট কিনেছেন তো ঠিক?’ তিনি বলেন, ‘হ্যাঁ, সব ঠিক আছে, ভেবো না। টাকাটা পেলে ঠিকমতই ভাগাভাগি হবে।’ তা তো হবে, কিন্তু মুখে মুখে কথা সব, লেখাপড়া তো হয়নি কিছুই। অবিনাশকে বললুম, ‘অবিনাশ, এই তো ব্যাপার, কি হবে বল তো?’ অবিনাশ ছিল ঠোঁটকাটা লোক, পরদিন বৈকুণ্ঠবাবু স্টীমারে আসতেই সে চেপে ধরলে, ‘বৈকুণ্ঠবাবু, আপনাকে উইল করতে হবে।’ ‘উইল? সে কি, কেন?’ ‘কেন নয়, আপনাকে করতেই হবে।’ বৈকুণ্ঠবাবু দারুণ ঘাবড়ে গেলেন—বুঝতে পারছেন না কিসের উইল। অবিনাশ বললে, ‘টাকাটা পেলে শেষে যদি আপনি আমাদের না দেন বা মরে-টরে যান, টিকিট তো আপনার কাছে। তখন কি হবে? আজই আপনাকে উইল করতে হবে।’ বৈকুণ্ঠবাবু হেসে বললেন, ‘এই কথা? তা বেশ তো, কাগজ কলম আনো।’ তখনি কাগজ কলম জোগাড় করে বসল সবাই গোল হয়ে। কি ভাবে লেখা যায়, উকিল চাই যে উকিল ছিলেন একজন সেখানে—তিনিও গঙ্গাযাত্রী ক্লাবের মেম্বার, ডিসপেপসিয়ায় ভুগে ভুগে কঙ্কালসার দেহ হয়েছে তাঁর। তাঁকেই চেপে ধরা গেল, তিনি মুসাবিদা করলেন—উইল তৈরি হল, গঙ্গাযাত্রী ক্লাবের টিকিটে যে টাকা পাওয়া যাবে তা নিম্নলিখিত ব্যক্তিগণ সমান ভাগে পাবে ও আমার অবর্তমানে আমার ভাগ আমার সহধর্মিণী শ্ৰীমতী অমুক পাবেন ব’লে নিচে বৈকুণ্ঠবাবু নাম সই করলেন। উইল তৈরি। কিছুদিন বাদে ডারবির খেলা শুরু হল। রোজই কাগজ দেখি আর বলি, ‘ও বৈকুণ্ঠবাবু, ঘোড়া উঠল?’ জানি যে কিছুই হবে না তবু রোজই সকলের ওই এক প্রশ্ন। একদিন এইরকম ‘ও বৈকুণ্ঠবাবু, ঘোড়া উঠল’ প্রশ্ন করতেই বৈকুণ্ঠবাবু চেঁচিয়ে উঠলেন, ‘ঘোড়া উঠেছে, ঘোড়া উঠেছে, ওই দেখুন, সামনে।’ চেয়ে দেখি বরানগরের পরামানিক ঘাটের কাছ বরাবর একজোড়া কালো ঘোড়৷ জল থেকে উঠছে। স্নান করাতে জলে নামিয়েছিল তাদের। অমনি রব উঠে গেল, আমাদের ঘোড়া উঠেছে, ঘোড়া উঠেছে। গঙ্গাযাত্রীদের কপালে ঘোড়া ওই জল থেকেই উঠে রইল শেষ পর্যন্ত। কি দুরন্তপনা করেছি তখন মা গঙ্গার বুকে। কত রকমের লোক দেখেছি, কতরকম ক্যারেক্টার সব। একদিন এক সাহেব এসে ঢুকল স্টীমারে। গঙ্গাপারের কোন্‌ মিলের সাহেব, লম্বাচওড়া জোয়ান ছোকরা, হাতে টেনিস ব্যাট, দেখেই মনে হয় সদ্য এসেছে বিলেত থেকে। সাহেব দেখেই তো আমরা যে যার পা ছড়িয়ে গম্ভীর ভাবে বসলুম সবাই, মুখে চুরুট ধরিয়ে। সাহেব ঢুকে এদিক ওদিক তাকাতেই সেই ডিস্‌পেপটিক উকিল তাড়াতাড়ি তাঁর জায়গা ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন। সাহেব বসে পড়ল সেখানে। আড়ে আড়ে দেখলুম, এমন রাগ হল সেই উকিলের উপর। সঙ্গে সঙ্গে সাহেবের চাপরাসিও এসে জায়গার জন্য ঠেলাঠেলি করতে লাগল ফার্স্ট ক্লাসের টিকিট হাতে নিয়ে—টিকিট আছে তো এখানে সে বসবে না কেন? অবিনাশ তো উঠল রুখে, বললে, ‘ফার্স্ট ক্লাসের টিকিট আছে তো নিচে যা, সেখানে কেবিনে বোস গিয়ে—এখানে আমাদের সমান হয়ে বসবি কি?’ বলে জামার হাতা গুটোতে লাগল। দেখি একটা গোলযোগ বাধবার জোগাড়। গোলযোগ শুনে সাহেবও উঠে দাঁড়িয়েছে, বুঝতে পারছে না কিছু। সাহেবকে বললুম, ‘চাপরাসিকে এখানে ঢুকিয়েছ কেন, তাকে পিছনে যেতে বল।’ বিলিতি সাহেব, এদেশের হালচাল জানে না, ব্যাপারটা বুঝে চাপরাসিকে পিছনে পাঠিয়ে দিলে। সাহেবটি লোক ছিল ভালো। খানিক বাদে সে নেমে গেল চাপরাসিকে নিয়ে। উকিলকে বললুম, ‘সাহেব তোমায় কি জিজ্ঞেস করছিল হে?’ সে বললে, ‘সাহেব জানতে চাইলে তুমি কে।’ বললুম, ‘নাম দিয়ে দিলে বুঝি?’ সে বললে, ‘হ্যাঁ।’ বললুম, ‘বেশ করেছ, এত লোক থাকতে তুমি আমারই নাম দিতে গেলে কেন? এবার আমার নামে কেস করলেই মারা পড়েছি।’ চিরকালের ভীতু আমি, ভয় পেয়েছিলুম বই কি একটু। ‘পথে বিপথে’র জাহাজী গল্পগুলি আমি তখনই লিখি। স্টীমারের সেই সব ক্যারেকটারই গেঁথে গেঁথে দিয়েছি তাতে। অনেক দিন বাদে ভাদরের ভরা গঙ্গার ছবি এঁকেছিলুম দু-চারখানি। একজিবিশনে দিয়েছিলুম, কোথায় গেল তা কে জানে। একখানি মনে আছে, রুমানিয়ার রাজা নিলেন, গঙ্গার ছবি রুমানিয়ার রাজা নিয়ে চলে গেলেন, দেশি লোকের নজরই পড়ল না তাতে, অথচ মা গঙ্গা মা গঙ্গা বলে আমরা চেঁচিয়ে আওড়াই খুব—বন্দ মাতা সুরধুনী, পুরাণে মহিমা শুনি, পতিতপাবনী পুরাতনী। আর ডুব দিয়ে দিয়ে উঠি আমাদের সেই ডারবির ঘোড়া ওঠার মতন।
অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর
১৭. ছবি আঁকা শিখতে কদিন লাগে অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর ছবি আঁকা শিখতে কদিন লাগে? বেশি দিন না, ছ-মাস, আমি শিখিয়েছিও তাই। ছ-মাসে আমি আর্টিস্ট তৈরি করে দিয়েছি। এর বেশি সময় লাগা উচিত নয়। এরই মধ্যে যাদের হবার হয়ে যায়—আর যাদের হবে না তাদের বাড়ি ফিরে যাওয়া উচিত; হ্যাঁ, মানি যে ডিম ফুটে বাচ্চা বের হতে একটা নির্ধারিত সময় লাগে—তার পরে, ব্যস, উড়ে যাও, হাঁসের বাচ্চা হও তো, জলে ভাস। ছবি আঁকবে তুমি নিজে, মাস্টারমশায় তার ভুল ঠিক করে দেবেন কি? তুমি যে রকম গাছের ডাল দেখেছ তাই এঁকেছ। মাস্টার মশায়ের মতন ডাল আঁকতে যাবে কেন? তরকারিতে নুন বেশি হয়, ফেলে দিয়ে আবার রান্না কর; পায়েসে মিষ্টি কম হয়, মিষ্টি আরো দাও। ছবিতেও ভুল হয়,—ফেলে দিয়ে আবার নতুন ছবি আঁক। বারে বারে একই বিষয় নিয়ে আঁক। আমি হলে তো তাই করতুম। ছবিতে আবার ভুল শুধরে দিয়ে জোড়াতাড়া দেওয়া, ও কিরকম শেখানো? দরকার হয়, আর একটু নুন দিতে পার। দরকার হয় একটু চিনি, তাও দিতে পার। কিন্তু গাছের ডালটা এমনি হবে, পা-টা এমনি করে আঁকতে হবে, এ রকম করে শেখাবার আমি মোটেই পক্ষপাতী নই। আমি নন্দলালদের অমনি করেই শিখিয়েছি। তবে ছাত্রকে সাহস দিতে হয়। তাদের বলতে হয়, এঁকে যাও, কিছু এদিক ওদিক হয় তো আমি আছি। এই কথাই বলেছিলেন রবিকাকা আমার লেখার বেলায়। একদিন আমায় উনি বললেন, ‘তুমি লেখো না, যেমন করে তুমি মুখে গল্প কর তেমনি করেই লেখো।’ আমি ভাবলুম, বাপ রে লেখা—সে আমার দ্বারা কস্মিন্‌ কালেও হবে না। উনি বললেন, ‘তুমি লেখোই না; ভাষায় কিছু দোষ হয় আমিই তো আছি।’ সেই কথাতেই মনে জোর পেলুম। একদিন সাহস করে বসে গেলুম লিখতে। লিখলাম এক ঝোঁকে একদম শকুন্তলা বইখানা। লিখে নিয়ে গেলুম রবিকাকার কাছে, পড়লেন আগাগোড়া বইখানা, ভালো করেই পড়লেন। শুধু একটি কথা ‘পল্বলের জল’, ওই একটিমাত্র কথা লিখেছিলেম সংস্কৃতে। কথাটা কাটতে গিয়ে ‘না থাক্‌’ বলে রেখে দিলেন। আমি ভাবলুম, যা। সেই প্রথম জানলুম, আমার বাংলা বই লেখবার ক্ষমতা আছে। এত যে অজ্ঞতার ভিতরে ছিলুম, তা থেকে বাইরে বেরিয়ে এলুম। মনে বড় ফূর্তি হল, নিজের উপর মস্ত বিশ্বাস এল। তার পর পটাপট করে লিখে যেতে লাগলুম—ক্ষীরের পুতুল, রাজকাহিনী ইত্যাদি। সেই যে উনি সেদিন বলেছিলেন ‘ভয় কি আমিই তো আছি সেই জোরেই আমার গল্প লেখার দিকটা খুলে গেল। কিন্তু আমার ছবির বেলায় তা হয়নি—বিফলতার পর বিফলতা। তাই তো এদের বলি, শেখা জিনিসটা কি? কিছুই না, কেবলই মনে হবে, কিছুই হল না; আমার সেই দুঃখের কথাটাই বলি। শেখা, ওকি সহজ জিনিস? কি কষ্ট করে যে আমি ছবি আঁকা শিখেছি। তোমাদের মতন নয়, দিব্যি আরামের ঘর, কয়েক ঘণ্টা গিয়ে বসলুম, কিছু করলুম, মাস্টারমশায় এসে ভুলটুল শুধরে দিয়ে গেলেন। আর্টস্ট চিরদিনই শিখছে, আমার এখনো বছরের পর বছর শেখাই চলছে। যদিও ছেলেবেলা থেকেই আমার শিল্পীজীবনের শুরু, কিন্তু কি করে কি ভাবে তা এল আমি নিজেই জানিনে। দাদা সেন্ট জেভিয়ারে রীতিমত ছবি আঁকা শিখতেন, ছবি এঁকে পুরস্কারও পেয়েছিলেন। সত্যদাদা হরিনারায়ণবাবুর কাছে বাড়িতে তেলরঙের ছবি আঁকতেন, দাদাকেও হরিবাবু শেখাতেন। মেজদা, নিরুদা, আমার পিসতুত ভাই, তাঁরও শখ ছিল ঘড়ি মেরামতের আর হাতির দাঁতের উপর কাজ করবার। একতলার ঘরে এসে তিনি হাতির দাঁতে ছবি আঁকতেন; এক দিল্লিওয়ালা আসত তাঁকে শেখাতে। মাঝে মাঝে সেখানে গিয়ে উকিঝুঁকি দিতুম, ভারি ভালো লাগত। হিন্দু মেলায় যে দিল্লির মিনিয়েচার দেখেছিলুম এই লোকটিই দেখিয়েছিল তা। সেও চোখ ভুলিয়েছিল তখন। সেই সময়ে আঁকতে জানতুম না তো সেরকম কিছু, তবে রং নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করতুম; ইচ্ছে করত, আমিও রং তুলি দিয়ে এটা ওটা আঁকি। আঁকার ইচ্ছে ছোটবেলা থেকেই জেগেছিল। এর বহুকাল পরে বড় হয়েছি, বিয়ে হয়েছে, বড় মেয়ে জন্মেছে, সেই সময় একদিন খেয়াল হল ‘স্বপ্নপ্রয়াণ’টা চিত্রিত করা যাক। এর আগে ইস্কুলে পড়তেও কিছু কিছু আঁকা অভ্যেস ছিল। সংস্কৃত কলেজে অনুকূল আমায় লক্ষ্মী সরস্বতী আঁকা শিখিয়েছিল। বলতে গেলে সেই-ই আমার প্রথম শিল্পশিক্ষার মাস্টার, সূত্রপাত করিয়ে দিয়েছিল ছবি আঁকার। তা স্বপ্নপ্রয়াণের ছবি আঁকবার যখন খেয়াল হল, তখন আমি ছবি আঁকায় একটু একটু পেকেছি। কি করে যে পাকলুম মনে নেই, তবে নিজের ক্ষমতা জাহির করার চেষ্টা আরম্ভ হল স্বপ্নপ্রয়াণ থেকে। ‘স্বপন-রমণী আইল অমনি, নিঃশব্দে যেমন সন্ধ্যা করে পদার্পণ’ এমনি সব ছবি, তখন সত্যি যেন ‘খুলে দিল মনোমন্দিরের চাবি’। ছবিখানি ‘সাধনা’ কাগজে বেরিয়েছিল। যাই হোক, স্বপ্নপ্রয়াণটা তো অনেকখানি এঁকে ফেললুম। মেজমা আমাদের উৎসাহ দিতেন। ‘বালক’ কাগজের জন্য লিথোগ্রাফ প্রেস করে দিলেন তাঁর বাড়িতে। যার যা কিছু আঁকার শখ লেখার শখ ছিল, মায় রবিকাসুদ্ধ, সবাই তাঁর কাছে যেতুম। মেজমা আমার স্বপ্নপ্রয়াণের ছবিগুলো দেখে ধরে বসলেন, ‘অবন, তোমাকে রীতিমত ছবি আঁকা শিখতে হবে।’ উনিই ধরে বেঁধে শিল্পকাজে লাগিয়ে দিলেন। আমারও ইচ্ছে হল ছবি আঁকা শিখতে হবে। তখন ইউরোপীয়ান আর্ট ছাড়া গতি ছিল না। ভারতীয় শিল্পের নামও জানত না কেউ। গিলার্ডি আর্ট স্কুলের ভাইসপ্রিন্সিপাল, ইটালিয়ান আর্টিস্ট—মেজমা কুমুদ চৌধুরীকে বললেন, ‘তুমি অবনকে নিয়ে তার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দাও, আর শেখার বন্দোবস্তও কর।’ মাকে জিজ্ঞেস করলুম। মা বললেন, ‘কোনো কাজ তে করছিসনে, স্কুল ছেড়ে দিয়েছিস, তা শেখ্‌ না। একটা কিছু নিয়ে থাকবি ভালোই তো।’ ব্যবস্থা হল, এক-একটা lessonএর জন্যে কুড়ি টাকা দিতে হবে, মাসে তিন-চারটে পাঠ দিতেন তাঁর বাড়িতেই। খুব যত্ন করেই শেখাতেন আমায়। তাঁর কাছে গাছ ডালপাতা এই সব আঁকতে শিখলুম। প্যাস্টেলের কাজও তিনি যত্ন করে শেখালেন। তেলরঙের কাজ, প্রতিকৃতি আঁকা, এই পর্যন্ত উঠলুম সেখানে। ছবি শেখার হাতে খড়ি হল সেই ইটালিয়ান মাস্টারের কাছে। কিছুদিন যায়, দেখি, তাঁর কাছে হাতে খড়ির পর বিদ্যে আর এগোয় না। তেলরঙের কাজ যখন আরম্ভ করলুম, দেখি, ইটালিয়ান ধরনে আর চলে না। বাঁধা গতের মত তুলি দিয়ে ধীরে ধীরে আঁকা, সে আর পোষাল না। আগে গাছপালা আঁকার মধ্যে তবু কিছু আনন্দ পেতুম। কিন্তু ধরে ধরে আর্ট স্কুলের রীতিতে তুলি টানা আর রং মেলানো, তা আর কিছুতেই পেরে উঠলুম না। ছ-মাসের মধ্যেই স্টুডিয়োর সমস্ত শিক্ষা শেষ করে সরে পড়লুম। বিয়ে হয়েছে, রীতিমত ঘরসংসার আরম্ভ করেছি, কিন্তু ছবি আঁকার ঝোঁকটা কিছুতেই গেল না। তখন এই পর্যন্ত আমার বিদ্যে ছিল যে নর্থ লাইট মডেল না হলে ছবি আঁকা যায় না। আর স্টুডিয়ো না হলে আর্টিস্ট ছবি আঁকবে কোথায় বসে? উত্তর দিকের ঘর বেছে বাড়িতেই স্টুডিয়ো সাজালুম। নর্থ লাইট, সাউথ লাইট ঠিক করে নিয়ে পর্দা টানালুম জানালায় দরজায় স্কাই লাইটে। বসলুম পাকাপাকি স্টুডিয়ো ফেঁদে। রবিকা খুব উৎসাহ দিলেন। সেই স্টুডিয়োতেই সেই সময় রবিকা চিত্রাঙ্গদার ছবি আঁকতে আমায় নির্দেশ দিচ্ছেন ফটোতে দেখেছ তো? চিত্রাঙ্গদা তখন সবে লেখা হয়েছে। রবিকা বললেন, ছবি দিতে হবে। আমার তখন একটু সাহসও হয়েছে, বললুম, রাজি আছি। সেই সময় চিত্রাঙ্গদার সমস্ত ছবি নিজ হাতে এঁকেছি, ট্রেস করেছি। চিত্রাঙ্গদা প্রকাশিত হল। এখন অবশ্য সে সব ছবি দেখলে আমার হাসি পায়। কিন্তু এই হল রবিকার সঙ্গে আমার প্রথম আর্ট নিয়ে যোগ। তার পর থেকে এতকাল রবিকার সঙ্গে বহুবার আর্টের ক্ষেত্রে যোগাযোগ হয়েছে, প্রেরণা পেয়েছি তাঁর কাছ থেকে। আজ মনে হচ্ছে আমি যা কিছু করতে পেরেছি তার মূলে ছিল তার প্রেরণা। সেই সময়ে রবিকার চেহারা আমি অনেক এঁকেছি, ভালো করে শিখেছিলুম প্যাস্টেল ড্রইং। নিজের স্টুডিয়োতে যাকে পেতুম ধরে ধরে প্যাস্টেলে অাঁকতুম। অক্ষয়বাবু, মতিবাবু, সবার ছবি করেছি, মহৰ্ষির পর্যন্ত। এই করে করে পোর্টেটে হাত পাকালুম। রবিকাকেও প্যাস্টেলে আঁকলুম, জগদীশবাবু সেটি নিয়ে নিলেন। সেই সময়ে রবিবৰ্মা আমাদের বাড়িতে এসেছিলেন। তখন আমি নতুন আর্টিস্ট—তিনি আমার স্টুডিয়োতে আমার কাজ দেখে খুব খুশি হয়েছিলেন। বলেছিলেন, ছবির দিকে এর ভবিষ্যৎ খুব উজ্জ্বল। আমি কোথায় বেরিয়ে গিয়েছিলুম, বাড়িতে ছিলুম না, ফিরে এসে শুনলুম বাড়ির লোকের মুখে। প্যাস্টেলে হাত পাকল, মনও বেগড়াতে আরম্ভ করল, শুধু প্যাস্টেল আর ভালো লাগে না। ভাবলুম, অয়েলপেন্টিং শিখতে হবে। ধরলুম এক ইংরেজ আর্টিস্টকে। নাম সি. এল. পামার। তাঁর কাছে যাই, পয়সা খরচ করে খাস বিলেতি গোরা মডেল আনি, মানুষ আঁকতে শিখি। একদিন এক গোরাকে নিয়ে এল আমার চাপরাসি স্টুডিয়োতে মডেল হবার জন্য। সে এসেই তড়বড় করে তার গায়ের জামা সব কটা খুলে এবারে প্যান্টও খুলতে যায়। চেঁচিয়ে উঠলুম, ‘হাঁ হাঁ, কর কি। প্যান্ট তোমার আর খুলতে হবে না।’ প্যান্ট খুলবেই সে, বলে, ‘তা নইলে তোমরা আমাকে কম টাকা দেবে।’ পামারকে বললুম, ‘সাহেব, তুমি বুঝিয়ে বল, টাকা ঠিকই দেব। প্যাণ্ট যেন না খুলে ফেলে, ওর খালি গা’ই যথেষ্ট।’ সাহেব শেষে তাকে বুঝিয়ে শান্ত করে। আর একবার এক অ্যাংলোইণ্ডিয়ান মেম এল মডেল হতে, তার পোর্টেট আঁকলুম, মেম তা দেখে টাকার বদলে সেই ছবিখানাই চেয়ে বসলে; বললে, ‘আমি টাকা চাইনে, এই ছবিখানা আমাকে দিতেই হবে, নইলে নড়ব না এখান থেকে।’ আমি তো ভাবনায় পড়লুম, কি করি। সাহেব বললে, ‘তা বই কি, ছবি দিতে পারবে না ওকে।’ বলে দিলেন দুই ধমক লাগিয়ে; মেম তখন সুড় সুড় করে নেমে গেল নিচে। এই রকম আর কিছুদিনের মধ্যেই ওঁদের আর্টের তৈলচিত্রের করণ-কৌশলটা তো শিখলাম। তখন একদিন সাহেব মাস্টার একটা মডেলের কোমর পর্যন্ত আঁকতে দিলেন। বললেন, ‘এক সিটিঙে দু-ঘণ্টার মধ্যে ছবিখানা শেষ করতে হবে।’ দিলুম শেষ করে। সাহেব বললেন, ‘চমৎকার উতরে গেছে—passed with credit।’ আমি বললুম, ‘তা তো হল, এখন আমি করব কি?’ সাহেব বললেন, ‘আমার যা শেখাবার তা আমি তোমায় শিখিয়ে দিয়েছি। এবারে তোমার অ্যানাটমি স্টাডি করা দরকার।’ এই বলে একটি মড়ার মাথা আঁকতে দিলেন। সেটা দেখেই আমার মনে হল যেন কি একটা রোগের বীজ আমার দিকে হাওয়ায় ভেসে আসছে। সাহেবকে বললুম, ‘আমার যেন কি রকম মনে হচ্ছে।’ সাহেব বললেন, ‘No, you must do it—তোমাকে এটা করতেই হবে।’ সারাক্ষণ গা ঘিন ঘিন করতে লাগল। কোনোরকমে শেষ করে দিয়ে যখন ফিরলুম তখন ১০৬° ডিগ্রি জ্বর। সন্ধ্যেবেলা জ্ঞান হতে দেখি ঘরের বাতিগুলো নিবন্ত প্রদীপের মত মিটমিট করছে। মা জিজ্ঞেস করলেন, কি হয়েছিল। মাকে মড়ার মাথার ঘটনা বললুম। মা তখনকার মত ছবি আঁকা আমার বন্ধ করে দিলেন, বললেন, কাজ নেই আর ছবি আঁকায়। তখন আমার কিছুকালের জন্য ছবি আঁকা বন্ধ ছিল। তার পরে একজন ফ্রেঞ্চ পড়াবার মাস্টার এলেন আমাদের জন্য, নাম তার হ্যামারগ্রেন। রামমোহন রায়ের নাম শুনে তাঁর দেশ নরওয়ে থেকে হেঁটে এদেশে উপস্থিত হয়েছিলেন। তাঁর কাছে একটু একটু ফ্রেঞ্চ পড়তুম, তিনি খুব ভাল পড়াতেন। কিন্তু পড়ার সময়ে খাতার মার্জিনে তার নাক মুখের ছবিই আঁকতুম বসে বসে। তাই আর আমার ফ্রেঞ্চ পড়া এগল না। এদেশেই তিনি মারা যান। মারা যাবার পরে আমার খাতার সেই নোটগুলো দেখে পরে তাঁর ছবি আঁকি। বহুদিন পরে সেদিন রবিকাকা বললেন যে নরওয়েতে তাঁর মিউজিয়াম হচ্ছে, যদি তোমার কাছে তাঁর ছবি থাকে তবে তারা চাচ্ছে। তাঁর চেহার কারো কাছে ছিল না। আমি পুরাতন বাক্স খুঁজে সেই ছবি বের করে পাঠাই, তার আত্মীয়-স্বজন খুব খুশি হয়ে আমাকে চিঠি দিয়েছিলেন। ভাগ্যিস তাঁর চেহারা নোট করে রেখেছিলুম। যাক ওকথা। তেলরঙ তো হল। এবার জলরঙের কাজ শেখবার ইচ্ছে। মাকে বলে আবার তাঁর কাছেই ভরতি হলুম। এখন ল্যাণ্ডস্কেপ আর্টিস্ট হয়ে, ঘাড়ে ‘ইজেল’ বগলে রঙের বাক্স নিয়ে ঘুরে বেড়াতে লাগলুম। কিন্তু কতকাল চলবে আর এমনি করে? তবু মুঙ্গেরের ওদিকে ঘুরে ঘুরে অনেকগুলি দৃশ্য এঁকেছিলুম। কিছুদিন তো চলল এমনি করে, মন আর ভরে না। ছবি তো এঁকে যাচ্ছি, কিন্তু মন ভরছে কই? কি করি ভাবছি, রোজই ভাবি কি করা যায়। এদিকে স্টুডিয়ো হয়ে উঠল তামাক খাবার আর দিবানিদ্রার আড্ডা। এমন সময়ে এক ঘটনা। শুনতেম আমার ছোটদাদামশায়ের চেহারা অতি সুন্দর ছিল, কিন্তু আমাদের কাছে তার একখানাও ছবি ছিল না। আমি তাঁর ছবির জন্য খোঁজখবর করছিলুম নানা জায়গায়। তখন বিলেত থেকে এক মেম মিসেস মার্টিনডেল খবর পেয়ে লিখলেন, ‘তুমি তাঁরই নাতি? বড় খুশি হলুম। তাঁর সঙ্গে আমার বড় ভাব ছিল। তোমার বিয়েথাওয়া হয়েছে! তোমার মেয়ের জন্য আমি একটা পুতুল পাঠাচ্ছি।’ বলে প্রকাণ্ড একটা বিলিতি ডল নেলিকে পাঠিয়ে দিলেন। তিনি তখন খুবই বুড়ো হয়ে গিয়েছিলেন, কিন্তু কি রকম আশ্চর্য তাঁর মন ছিল; কোন্‌কালে আমার ছোটদাদামশায়ের সঙ্গে তাঁর ভাব ছিল, সেই সূত্রে আমাকে না দেখেও তিনি নগেন্দ্রনাথ ঠাকুরের নাতি বলেই স্নেহ করতে চাইতেন। তিনি বিলেত থেকে লিখলেন, ‘তোমার আর্টের দিকে ঝোঁক আছে,—আমিও একটু আধটু অাঁকতে পারি। বলো তোমার জন্য আমি কিছু করতে পারি কিনা।’ তিনি আরো লিখলেন, ‘তুমি যদি কিছু দাও তো তার চারদিকে ইলুমিনেট করিয়ে দিতে পারি।’ বইয়ের লেখার চারদিকে নকশা অাঁকা থাকে, খুব পুরোনো আর্ট ওঁদের, তাই একটা এঁকে পাঠাবেন। ভাবলুম, তা মন্দ নয় তো। তিনি বলেছিলেন, ‘আমি গরিব, এজন্য কিছু দিতে হবে।’ পাঠিয়েছিলুম কিছু দশ কি বারো পাউণ্ড মনে নেই ঠিক। আইরিশ মেলডিজের কবিতা ছোটদাদামশায়ের বড় প্রিয় জিনিস ছিল। ভাবলুম, সেটাই যত্ন করে রাখবার বস্তু হয়ে আসুক। কিছুকাল বাদে তিনি পাঠিয়ে দিলেন দশ-বারোখানা বেশ বড় বড় ছবি—সে কি সুন্দর, কি বলব তোমায়। থ হয়ে গেলুম ছবি দেখে। আবার হবি তো হ সেই সময়ে আমার ভগ্নীপতি শেষেন্দ্র, প্রতিমার বাবা, একখানা পার্শিয়ান ছবির বই দিল্লির, আমাকে বকশিশ দিলেন। রবিকাকাও আবার সে সময়ে রবিবর্মার ছবির কতকগুলি ফোটো আমাকে দিলেন। তখন রবিবর্মার ছবিই ছিল কিনা ভারতীয় চিত্রের আদর্শ। যাই হোক তখন সেই আইরিশ মেলডির ছবি ও দিল্লির ইন্দ্রসভার নকশা যেন আমার চোখ খুলে দিলে। একদিকে আমার পুরাতন ইউরোপীয়ান আর্টের নিদর্শন ও আর একদিকে এদেশের পুরাতন চিত্রের নিদর্শন। দুই দিকের দুই পুরাতন চিত্রকলার গোড়াকার কথা একই। সে যে আমার কি আনন্দ, সেই সময়ে সাধনাতে আমার ওই ইন্দ্রসভার বইখানির বর্ণনা দিয়ে ‘দিল্লির চিত্রশালিকা’ ব’লে বলেন্দ্রনাথ ঠাকুর প্রবন্ধ লিখেছিলেন; চারদিকে তখন একটা সাড়া পড়ে গিয়েছিল। যাক, ভারতশিল্পের তো একটা উদ্দিশ পেলুম। এখন শুরু করা যাবে কি করে কাজ? তখন একতলার বড় ঘরটাতে একধারে চলেছে বিলিয়ার্ড খেলার হো হো, একধারে আমি বসেছি রং তুলি নিয়ে আঁকতে। দেশের শিল্পের রাস্তা তো পেয়ে গেছি, এখন আঁকব কি? রবিকাকা আমায় বললেন, বৈষ্ণব পদাবলী পড়ে ছবি আঁকতে। রবিকাকা আমাকে এই পর্যন্ত বাতলে দিলেন যে চণ্ডীদাস বিদ্যাপতির কবিতাকে রূপ দিতে হবে। লেগে গেলুম পদাবলী পড়তে। প্রথম ছবি করি ভারতীয় পদ্ধতিতে চণ্ডীদাসের দু-লাইন কবিতা— পৌখলী রজনী পবন বহে মন্দ চৌদিকে হিমকর, হিম করে ফন্দ। এ ছবিটা এখনো আমার কাছেই বাক্সবন্ধ। সেই আমার প্রথম দেশী ধরনের ছবি ‘শুক্লাভিসার’। কিন্তু দেশী রাধিকা হল না, সে হল যেন মেমসাহেবকে শাড়ি পরিয়ে শীতের রাত্তিরে ছেড়ে দিয়েছি। বড় মুষড়ে গেলুম—নাঃ, ও হবে না, দেশী টেকনিক শিখতে হবে। তখন তারই দিকে ঝোঁক দিলুম। ছবিতে সোনাও লাগাতে হবে। তখনকার দিনে রাজেন্দ্র মল্লিকের বাড়িতে এক মিস্ত্রি ফ্রেমের কাজ করে। লোকটির নাম পবন, আমার নাম অবন। তাকে ডেকে বললুম, ‘ওহে সাঙাত, পবনে অবনে মিলে গেছে, শিখিয়ে দাও এবারে সোনা লাগায় কি করে।’ সে বললে, ‘সে কি বাবু, আপনি ও কাজ শিখে কি করবেন? আমাকে বলবেন আমি করে দেব।’ ‘না হে, আমার ছবিতে সোনা লাগাব; আমাকে শিখিয়ে দাও।’ শিখলাম তার কাছে কি করে সোনা লাগাতে হয়। সবরকম টেকনিক তো শেখ হল, তার পর আমাকে পায় কে? বৈষ্ণব পদাবলীর এক সেট ছবি সোনার রূপোর তবক ধরিয়ে এঁকে ফেললুম। তারপর ‘বেতালপঞ্চবিংশতি’ অাঁকতে শুরু করলুম। সেই পদ্মাবতী পদ্মফুল নিয়ে বসে আছে, রাজপুত্তুর গাছের ফাঁক দিয়ে উঁকি মারছে; আর অন্যগুলিও। যাক রাস্তা পেলুম, চলতেও শিখলুম, এখন হু হু করে এগোতে হবে। তখন এক-একখানি করে বই ধরছি আর কুড়ি-পঁচিশখানা করে ছবি এঁকে যাচ্ছি। তাই যখন হল কিছুকাল গেল এমনি। তখন কি আর ছবির জন্য ভাবি, চোখ বুজলেই ছবি আমি দেখতে পাই—তার রূপ, তার রেখা, মায় প্রত্যেক রঙের শেড পর্যন্ত। তখন যে আমার কি অবস্থা বোঝাব কি তোমায়। ছবিতে আমার তখন মনপ্রাণ ভরপুর, হাত লাগাতেই এক-একখানা ছবি হয়ে যাচ্ছে। হু হু করে ছবি হতে লাগল। কৃষ্ণচরিত্র, বুদ্ধচরিত্র, বেতালপঞ্চবিংশতি ইত্যাদি। নিচের তলার দালানটাতে বসে মশগুল হয়ে ছবি আঁকতুম। আমি যখন কৃষ্ণের ছবি আঁকছি তখন শিশির ঘোষ মশায় ছিলেন পরম বৈষ্ণব। একদিন তিনি এলেন কৃষ্ণের ছবি দেখতে। আমি নিচের তলার ঘরটিতে বসে নিবিষ্টমনে ছবি আঁকছি, মুখ তুলে দেখি দরজার পাশে একটি অচেনা মুখ উঁকিঝুঁকি মারছে। আমি বললাম, ‘কে হে।’ তিনি বললেন, ‘আমি শিশির ঘোষ। তুমি কৃষ্ণের ছবি আঁকছ তাই শুনে দেখতে এলুম।’ আমি তাড়াতাড়ি উঠে ‘আসুন আসুন’ বলে তাঁকে ঘরে এনে ভাল করে বসিয়ে ছবিগুলি সব এক এক করে দেখাতে লাগলুম। তিনি সবগুলি দেখলেন, শেষে হেসে বললেন, “হুঁ, কি এঁকেছ তুমি? এ কি রাধাকৃষ্ণের ছবি? লম্বা লম্বা সরু সরু হাত পা যেন কাটখোট্টাই—এই কি গড়ন? রাধার হাত হবে নিটোল, নধর তাঁর শরীর। জান না তার রূপবর্ণনা?’ এই বলে তিনি চলে গেলেন। আমি খানিকক্ষণ হতভম্ব হয়ে রইলুম কিন্তু তার কথায় মনে কোনো দাগ কাটল না। ছবি করে যেতে লাগলুম। তখন আমি বিলিতি ছবির কাগজ পড়িও না, দেখিও না, ভয় পাছে বিলিতি আর্টের ছোঁয়াচ লাগে। গানবাজনা আর ছবি নিয়ে মেতে ছিলুম। দিনরাত কেবল এসরাজ বাজাই, ছবি আঁকি। সেই সময়ে কলকাতায় লাগল প্লেগ। চারদিকে মহামারী চলছে, ঘরে ঘরে লোক মরে শেষ হয়ে যাচ্ছে। রবিকাকা এবং আমরা এবাড়ির সবাই মিলে চাঁদা তুলে প্লেগ হাসপাতাল খুলেছি, চুন বিলি করছি। রবিকাকা ও সিস্টার নিবেদিতা পাড়ায় পাড়ায় ইন্‌পেক্‌শনে যেতেন। নার্স ডাক্তার সব রাখা হয়েছিল। সেই প্লেগ লাগল আমারও মনে। ছবি আঁকার দিকে না ঘেঁষে আরো গানবাজনায় মন দিলুম। চারদিকে প্লেগ আর আমি বসে বাজনা বাজাই। হবি তো হ, সেই প্লেগ এসে ঢুকল আমারই ঘরে। আমার ছোট্ট মেয়েটাকে নিয়ে গেল। ফুলের মতন মেয়েটি ছিল, বড় আদরের। আমার মা বলতেন, ‘এই মেয়েটিই অবনের সবচেয়ে সুন্দর।’ ন-দশ বছরের মেয়েটি আমার টুক করে চলে গেল; বুকটা ভেঙে গেল। কিছুতে আর মন যায় না। এ বাড়ি ছেড়ে—চৌরঙ্গিতে একটা বাড়িতে আমরা পালিয়ে গেলুম। সেখানে থাকি, একটা টিয়েপাখি কিনলুম, তাকে ছোলা ছাতু খাওয়াই, মেয়ের মাও খাওয়ায়। পাখিটাকে বুলি শেখাই। দুঃখ ভোলাবার সাথি হল পাখির ছানাটা; নাম দিলেম তার চঞ্চু, মায়ের কোলছাড়া টিয়াপাখির ছানা। সে সময়ে ঘুড়ি ওড়াবারও একটা নেশা চেপেছিল। পাশের বাড়ির মিসেস্ হায়ার বলে এক বুড়ি ইহুদী মেমসাহেবের সঙ্গে আলাপ হল। আমাকে খুব যত্ন করতেন, কতরকম রান্না করে খাওয়াতেন। তাঁর সুন্দর একটি বাগান ছিল; ছাগলের জন্য দিব্য বেড়া দিয়ে ঘেরা পাহাড়। খুব বড় ঘরের সেকেলে ইহুদী পরিবার। মায়ের সঙ্গে বুড়ি ইহুদী মেমের কথা হত; মাঝে মাঝে আমার জন্যে ভালো সুগন্ধি তামাকও পাঠাত। সেখানে তো এমনি করে আমার দিন যাচ্ছে। সে সময়ে মেজমার কাছে যাওয়া-আসাতে হ্যাভেল সাহেবের সঙ্গে আলাপ হয়। একদিন মেজমা আমাকে ধরে বসলেন, ‘তোমাকে আর্ট স্কুলে যেতে হবে। হ্যাভেল তোমাকে ভাইসপ্রিন্সিপ্যাল করতে চান।’ আমার তখন কি কাজকর্ম করবার মত অবস্থা? আমি সাহেবকে বললুম সে কথা। তিনি আমার জ্যেষ্ঠের মতন ছিলেন। তিনি আমাকে বললেন, ‘তুমি করছ কি? You do your work—your work is your only medicine, তুমি তোমার কাজ কর, কাজই তোমার ওষুধ।’ তাঁকে চিরকাল গুরু বলে শ্রদ্ধা করেছি, জ্যেষ্ঠের মত ভক্তি করেছি কি সাধে? তিনিও আমাকে collaborator সহকর্মী বলে ডাকতেন আদর করে; কখনো চেলাও বলেছেন। ছোট ভাইয়ের মত ভালোবাসতেন। আমি নন্দলালকে যতখানি ভালোবাসি তার বেশি তিনি আমাকে ভালোবাসতেন। সে তো গেল, কিন্তু আমি চাকরি করব কি? ঠিকসময়ে হাজিরা দিতে হবে; এদিকে দিনে সাতবার করে তামাক খাওয়া আমার অভ্যাস, তার উপরে শরীর তখন খারাপ। মাকে বললুম, ‘সে আমি পারব না মা, তুমি যা হয় বল সাহেবকে।’ সাহেব ইংরেজের বাচ্চা, নাছোড়বান্দা। বলে পাঠালেন মাকে, ‘তোমার ছেলের সব ভার আমার। তার সুখস্বাচ্ছন্দ্যের কোনো অভাব হবে না। দুপুরে আমি তার খাওয়ার ভার নিলাম, তামাক সে যতবার ইচ্ছে খাবে। আমি বলছি আমি তার শরীর ভালো করে দেব।’ কিছুতেই ছাড়ে না, আমাকে রাজি হতেই হল। কিন্তু ভয় হল আমি শেখাব কি? নিজেই বা কি জানি। সাহেব তাতেও বললেন, ‘সে আমি দেখব’খন। তোমার কিছু ভাবতে হবে না। তুমি শুধু নিজের কাজ করে যাবে। তুমি কত টাকা মাসে চাও বল।’ আমি বললুম, ‘সে আর আমি কি বলব সাহেব, সবই তো তুমি জানো, এও তুমিই জানবে। কি দেবে না-দেবে সেও তোমার ইচ্ছা, আমি চাইনে কিছুই।’ সাহেব বললেন, ‘আচ্ছা, তোমাকে আমি ভাইসপ্রিন্সিপাল করে দিলাম। তুমি এখন মাসে তিনশো টাকা করে পাবে।’ যেতে শুরু করে দিলাম সকাল সকাল চারটি ভাত খেয়ে। প্রথম দিন গিয়ে তো আপিসঘরে ঢুকে মুষড়ে গেলুম—আমি তো আপিসের কাজ বলতে কিছুই জানি না। সাহেব বললেন, ‘কে বলে তোমার ওসব কাজ করতে হবে? তার জন্যে হেডমাস্টার, হেডক্লার্ক আছে। তারা সব দেখবে আপিসের কাজ। তুমি তোমার কাজ করে যাও। চল, তোমাকে আর্ট গ্যালারি দেখিয়ে নিয়ে আসি।’ আমাকে নিয়ে গেলেন আর্ট গ্যালারি দেখাতে, আমি আর সাহেব চলেছি, আগে-পিছে চাপরাসি মস্ত হাতপাখা নিয়ে হাওয়া করতে করতে যাচ্ছে, বাদশাহী চালে চলেছি বড়সাহেবের আর্ট গ্যালারি দেখতে। সাহেব চাপরাসিকে বললেন পর্দা সরাতে। ভারি তো আর্ট গ্যালারি, তার আবার পর্দা সরাও—এখন ভাবলে হাসি পায়। দু-তিনখানা মোগল ছবি আর দু-একখানা পার্শিয়ান ছবি, এই খান চার-পাঁচ ছবি নিয়ে তখন আর্ট গ্যালারি। পর্দা তো সরানো হল। একটি বকপাখির ছবি, ছোটই ছবিখান, মন দিয়ে দেখছি, সাহেব পিছনে দাঁড়িয়ে বুকে হাত দিয়ে। আমাকে বললেন, ‘এই নাও এটি দিয়ে দেখ।’ বলে বুকপকেট থেকে একটি আতসী কাঁচ বের করে দিলেন। সেই কাঁচটি পরে আর আমি হাতছাড়া করিনি। বহুকাল সেটি আমার জামার বুকপকেটে ঘুরেছে। আমি নন্দলালদের বলতুম, এটি আমার দিব্যচক্ষু। সেই কাঁচ চোখের কাছে ধরে বকের ছবিটি দেখতে লাগলুম। ওমা কি দেখি, এ তে সামান্য একটুখানি বকের ছবি নয়, এ যে আস্ত একটি জ্যান্ত বক এনে বসিয়ে দিয়েছে। কাঁচের ভিতর দিয়ে দেখি, তার প্রতিটি পালকে কি কাজ। পায়ের কাছে কেমন খসখসে চামড়া, ধারালো নখ, তার গায়ের ছোট্ট ছোট্ট পালক—কি দেখি—আমি অবাক হয়ে গেলুম, মুখে কথাটি নেই। পিছনে সাহেব তেমনি ভাবে বুকে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে, আমার অবস্থা দেখে মুচকি মুচকি হাসছেন, যেন উনি জানতেন যে আমি এমনি হয়ে যাব এ ছবি দেখে। তার পর আর দু-চারখানা ছবি যা ছিল দেখলুম। সবই ওই একই ব্যাপার। মাথা ঘুরে গেল। তবে তো আমাদের আর্টে এমন জিনিসও আছে, মিছে ভেবে মরছিলুম এতকাল। পুরাতন ছবিতে দেখলুম ঐশ্বর্যের ছড়াছড়ি, ঢেলে দিয়েছে সোনা রুপো সব। কিন্তু একটি জায়গায় ফাঁকা, তা হচ্ছে ভাব। সবই দিয়েছে ঐশ্বর্যে ভরে, কোথাও কোনো কার্পণ্য নেই কিন্তু ভাব দিতে পারেনি। মানুষ আঁকতে সবই যেন সাজিয়ে গুজিয়ে পুতুল বসিয়ে রেখেছে। আমি দেখলুম এইবারে আমার পালা। ঐশ্বর্য পেলুম, কি করে তার ব্যবহার তা জানলুম, এবারে ছবিতে ভাব দিতে হবে। বাড়ি এসে বসে গেলুম ছবি আঁকতে। আঁকলুম ‘শাজাহানের মৃত্যু’। এই ছবিটি এত ভালো হয়েছে কি সাধে? মেয়ের মৃত্যুর যত বেদনা বুকে ছিল সব ঢেলে দিয়ে সেই ছবি আঁকলুম। ‘শাজাহানের মৃত্যুপ্রতীক্ষা’তে যত আমার বুকের ব্যথা সব উজাড় করে ঢেলে দিলুম। যখন দিল্লির দরবার হয়, বড় বড় ও পুরাতন আর্টিস্টদের ছবির প্রদর্শনী সেখানে হবে, হ্যাভেল সাহেব আমার এই ছবিখানা আর তাজ নির্মাণের ছবি দিলেন পাঠিয়ে দিল্লি দরবারে। আমাকে দিলে বেশ বড় একটা রুপোর মেডেল, ওজনে ভারি ছিল মন্দ নয়। তার পরে যোগেশ কংগ্রেস ইণ্ডাস্ট্রিয়াল একজিবিশনে সেই ছবি পাঠিয়ে দিল, সেখানে দিল একটা সোনার মেডেল। এইরকম করে তিনচারটে মেডেল পেয়েছি, পরিনি কোনোদিন। শাজাহানের ছবির কথা থাক্‌—সেই পদ্মাবতীর ছবিখানার কথা বলি। হ্যাভেল সাহেব পদ্মাবতী ও বেতালপঞ্চবিংশতির আরো তিন-চারখানি ছবি স্কুলের প্রদর্শনীতে দিলেন। পদ্মাবতী ছবিখানার দাম কত দেওয়া যায়? সাহেব দিলেন আশি টাকা দাম ধরে। লর্ড কার্জন এলেন, পদ্মাবতী দেখে পছন্দ হল তাঁর, বললেন দাম কিছু কমিয়ে দিতে। ষাট টাকার মতন দিতে চাইলেন। আমি বলি, ‘সাহেব, দিয়ে দাও, টাকামাকা চাইনে কিছু। লর্ড কার্জন চেয়েছেন ছবিখানা, সেই তো খুব দাম।’ সাহেব বললেন, ‘তুমি চুপ করে থাকো, যা বলবার বোঝাবার আমি বলব বোঝাব।’ এই বলে তিনি তাকে কি সব বোঝালেন, ছবিখানার দাম কমালেন না, লর্ড কার্জনকেও দিলেন না। আমি শেষে কি করি, পদ্মাবতীর ছবিখানা ও অন্য ছবি যে দু-তিনখানা ছিল তা হ্যাভেলকে ধরে দিয়ে বললুম, ‘এই নাও সাহেব, আমার গুরুদক্ষিণা; এগুলি আমি তোমাকে দিলুম।’ সাহেব তো লুফে নিলেন। কি খুশি হলেন, বললেন, ‘আমি এ ছবি গ্যালারিতে রেখে দেব, যত্নে থাকবে চিরকাল।’ এখন আমার মাস্টারি শুরু করার কথা বলি। সাহেব তো তার স্কুলে আমাকে নিয়ে বসালেন। সুরেন গাঙ্গুলী হল আমার প্রথম ছাত্র। সুরেনকে সাহেব তাঁত শেখাবার জন্য বেনারসে পাঠিয়েছিলেন। তাকে আবার ফিরিয়ে এনে আমাকে বললেন, ‘তুমি তোমার ক্লাস শুরু কর।’ সুরেন ও আর দু-চারটি ছেলেকে নিয়ে কাজ শুরু করে দিলাম। কিছুকাল বাদে সত্যেন বটব্যাল বলে এনগ্রেভিং ক্লাসের এক ছাত্র, একটি ছেলেকে নিয়ে এসে হাজির, বললে, ‘একে আপনার নিতে হবে।’ তখন মাস্টার কিনা, গম্ভীর ভাবে মুখ তুলে তাকালুম, দেখি কালোপানা ছোট একটি ছেলে। বললুম, ‘লেখাপড়া শিখেছ কিছু।’ বললে, ‘ম্যাট্রিক, এফ-এ পর্যন্ত পড়েছি। আমি বললুম, ‘দেখি তোমার হাতের কাজ।’ একটি ছবি দেখালে—একটি মেয়ে, পাশে হরিণ, লতাপাতা গাছগাছড়া; শকুন্তলা এঁকেছিল। এই আজকালকার ছেলেদের মতন একটু জ্যেঠামি ছিল তাতে। বললুম, ‘এ হবে না, কাল একটি সিদ্ধিদাতা গণেশের ছবি এঁকে এনো।’ পরদিন নন্দলাল এল, একটি কাঠিতে ন্যাকড়া জড়ানো, সেই ন্যাকড়ার উপরে সিদ্ধিদাতা গণেশের ছবি। বেশ এঁকেছিল প্রভাতভানুর বর্ণনা দিয়ে। বললুম ‘সাবাস’। সঙ্গে ওর শ্বশুর, দিব্যি চেহারা ছিল ওর শ্বশুরের, বললেন, ‘ছেলেটিকে আপনার হাতে দিলুম।’ আমি তাঁকে বললুম, ‘লেখাপড়া শেখালে বেশি রোজগার করতে পারবে।’ নন্দলাল জবাবে বললে, ‘লেখাপড়া শিখলে তো ত্রিশ টাকার বেশি রোজগার হবে না। এতে আমি তার বেশি রোজগার করতে পারব।’ আমি বললুম, ‘তা হলে আমার আর আপত্তি নেই।’ সেই থেকে নন্দলাল আমার কাছে রয়ে গেল। তখন একদিকে সুরেন গাঙ্গুলী এক দিকে নন্দলাল, মাঝখানে আমি বসে কাজ শুরু করে দিলুম। এখন এক পণ্ডিত এসে জুটে গেলেন—চাকরি চাই। আমি বললুম, ‘বেশ লেগে যান, রোজ আমাদের মহাভারত রামায়ণ পড়ে শোনাবেন। আমাদের বাল্যকালের পণ্ডিত মশায়, নাম রজনী পণ্ডিত। সেই পণ্ডিত রোজ এসে রামায়ণ মহাভারত শোনাতেন। আর তাই থেকে ছবি আঁকতুম। নন্দলাল বললে, ‘কি আঁকব?’ আমি বললুম, ‘আঁকো কর্ণের সূর্যস্তব’। ও বিষয়টা আমি চেষ্টা করেছিলুম, ঠিক হয়নি। নন্দলাল এঁকে নিয়ে এল। আমি তার উপর এই দু-তিনটে ওয়াশ দিয়ে দিলুম ছেড়ে—হাতে ধরে দেখিয়ে দেখিয়ে আমি কখনও ওকে শেখাইনি। ছবি করে নিয়ে আসত, আমি শুধু কয়েকটি ওয়াশ দিয়ে মোলায়েম করে দিতুম, কিংবা একটু আধটু রঙের টাচ্‌ দিয়ে দিতুম, যেমন ফুলের উপর সূর্যের আলো বুলিয়ে দেওয়া—সূর্য নয় ঠিক, আমি তো আর রবি নই, নানা রঙের মাটিরই প্রলেপ দিতেম। তখন আমাদের আঁকার কাজ তেজে চলেছে। নন্দলাল সূর্যের স্তব আঁকল তো সুরেন এদিকে রামচন্দ্রের সমুদ্রশাসন আঁকল, এই তীর ধনুক বাঁকিয়ে রামচন্দ্র উঠে রুখে দাঁড়িয়েছেন। নন্দলাল এঁকে আনল একটি মেয়ের ছবি, বেশ গড়নপিটন, টান টানা চোখ ভুরু। আমি বললুম ‘এ তো হল কৈকেয়ী, পিছনে মন্থরা বুড়ি এঁকে দাও।’ হয়ে গেল কৈকেয়ী-মন্থরা। ছবির পর ছবি বের হতে লাগল। চারদিকে তখন খুব সাড়া পড়ে গেল, ওরিয়েণ্টাল আর্ট সোসাইটি খুলে গেল, হৈ হৈ রৈ রৈ কাণ্ড। ইণ্ডিয়ান আর্ট শব্দ অভিধান ছেড়ে সেই প্রথম লোকের মুখে ফুটল। আমি নিজে যখন ছবি আঁকতুম কাউকে ঘরে ঢুকতে দিতুম না, আপন মনে ছবি আঁকতুম। মাঝে মাঝে হ্যাভেল সাহেব পা টিপে টিপে ঘরে ঢুকতেন পিছন দিক দিয়ে দেখে যেতেন কি করছি। চৌকি ছেড়ে উঠতে গেলে ধমকে দিতেন। আমার ক্লাসেও সেই নিয়ম করেছিলুম। দরজায় লেখা ছিল, ‘তাজিম মাফ’। আমার ছবি আঁকার পদ্ধতি ছিল এমনি। বলতুম, তোমরা একে যাও, যদি লড়াইয়ে ফতে না করতে পার, তবে এই আমি আছি—ভয় কি? কেন বলি, যে আমার আর্টের বেলায় ক্রমাগত ব্যর্থতা? কি দুঃখ যে আমি পেয়েছি আমার ছবির জীবনে। যা ভেবেছি, যা চেয়েছি দিতে, তার কতটুকু আমি আমার ছবিতে দিতে পেরেছি? যে রঙ যে রূপ-রস মনে থাকত, চোখে ভাসত, যখন দেখতুম তার সিকি ভাগও দিতে পারলুম না তখনকার মনের অবস্থা, মনের বেদনা অবর্ণনীয়। চিরটাকাল এই দুঃখের সঙ্গে যুঝে এসেছি। ছবিতে আনন্দ আর কতটুকু পেয়েছি। শুধু দুবার আমার জীবনে আনন্দময় ভাব এসেছিল, দুবার আমি নিজেকে ভুলে বিভোর হয়ে গিয়েছিলুম, ছবিতে ও আমাতে কোনো তফাত ছিল না—আত্মহারা হয়ে ছবি এঁকেছি। একবার হয়েছিল আমার কৃষ্ণচরিত্রের ছবিগুলি যখন আঁকি। সারা মন-প্রাণ আমার কৃষ্ণের ছবিতে ভরে গিয়েছিল। চোখ বুজলেই চারিদিকে ছবি দেখি আর কাগজে হাত ছোঁয়ালেই ফস ফস করে ছবি বেরয়; কিছু ভাবতে হয় না, যা করছি তাই এক-একখানা ছবি হয়ে যাচ্ছে। তখন কৃষ্ণের সব বয়সের সব লীলার ছবি দেখতে পেতুম, প্রত্যেকটির খুঁটিনাটি রঙ সমেত। সেই ভাব আমার আর এল না। আর একবার এসেছিল কিন্তু ক্ষণিকের জন্য। সেবারে হচ্ছে আমার মার আবির্ভাব, মৃত্যুর পর। মার ছবি একটিও ছিল না। মার ছবি কি করে আঁকা যায় একদিন বসে বসে ভাবছি, এমন সময়ে যেন আমি পরিষ্কার আমার চোখের সামনে মাকে দেখতে পেলুম। মার মুখের প্রতিটি লাইন কি পরিষ্কার দেখা যাচ্ছিল, আমি তাড়াতাড়ি কাগজ পেনসিল নিয়ে মার মুখের ড্রইং করতে বসে গেলুম। কপাল থেকে যেই নাকের ওপর ভুরুর খাঁজ টুকতে গেছি—সে কি? মা কোথায় মিলিয়ে গেলেন। হঠাৎ যেন চারদিক অন্ধকার হয়ে গেল। মনে হল কে যেন আলোর সুইচটা বন্ধ করে দিলে—সব অন্ধকার। আমি চমকে বললুম, ‘দাদা, এ কি হল?’ দাদা একটু দূরে বসে ছিলেন, মুখ টিপে হাসলেন, বললেন, ‘বড় তাড়া করতে গিয়েছিলে তুমি।’ মন খারাপ হয়ে গেল। চুপচাপ বসে রইলুম, আর মনে হতে লাগল, তাই তো, এ কি হল! মা এসে এমনি করে চলে গেলেন। কিছুক্ষণ ওভাবে ছিলুম, এক সময়ে দেখি আবার মায়ের আবির্ভাব। এবারে আর তাড়াহুড়ো না—স্থির হয়ে বসে রইলুম। মেঘের ভিতর দিয়ে যেমন অস্তদিনের রং দেখা যায় তেমনিতরো মায়ের মুখখানি ফুটে উঠতে লাগল। দেখলুম মাকে, খুব ভালো করে মন—প্ৰাণ ভরে মাকে দেখে নিলুম। আস্তে আস্তে ছবি মিলিয়ে গেল, কাগজে রয়ে গেল মায়ের মূর্তি। এই যে মার ছবিখানা ওই অমনি করেই আঁকা। এত ভালো মুখের ছবি আমি আর আঁকিনি ৷ আমার মুখের কথায় যদি সংশয় থাকে চাক্ষুষ প্রমাণ দেখলে তো সেদিন। সন্ধ্যের অন্ধকারে রবিকার মুখের ছবি আঁকতে বসলুম, ঝাপসা ঝাপসা অস্পষ্ট লাইন পড়ল কাগজে, তোমরাও দেখতে পাচ্ছিলে না পরিষ্কার চেহারা। আমি কিন্তু দেখলুম সুস্পষ্ট চেহারা পড়ে গেছে কাগজে, আর ভয় নেই। নিৰ্ভয়ে রেখে দিলেম, সে রাতের মত ছবির কাজ বন্ধ। জানলেম ছবি হয়ে গেছে, নির্ভাবনায় ঘরে গেলুম। সকালে উঠে ছবিতে শুধু দু-চারটে রঙের টান দেবার অপেক্ষা রইল। এ রকম হয় শিল্পীর জীবনে, তবে সব ছবির বেলায় নয়। তাই তো বলি ছবির জীবনে দুঃখ অনেক, আমিও চিরকাল সেই দুঃখই পেয়ে এসেছি। প্রাণে কেবলই একটা অতৃপ্তি থেকে যায়। কিছুতেই মনে হয় না যে, এইবারে ঠিক হল যেমনটি চেয়েছিলুম। কিন্তু তাই বলে থেমে গেলে চলবে না নিরুৎসাহ হয়ে পড়লে চলবে না। কাজ করে যাওয়াই হচ্ছে আমাদের কাজ। আবার কিছুকাল যদি ছবি না আসে তা হলেও মন খারাপ কোরো না। ছবি হচ্ছে বসন্তের হাওয়ার মতন। যখন বইবে তখন কোনো কথা শুনবে না। তখন একধার থেকে ছবি হতে শুরু হবে। মন খারাপ কোরো না—আমার নিজের জীবনের অভিজ্ঞতার কথা মনে রেখো। ছাত্রকে তার নিজের ছবি সম্বন্ধে মাস্টারের কিছু বাতলানো—এক-একসময়ে তার বিপদ বড়, আর তাতে মাস্টারেরও কি কম দায়িত্ব? একবার কি হয়েছিল বলি। নন্দলাল একখানা ছবি আঁকল ‘উমার তপস্যা’, বেশ বড় ছবিখানা। পাহাড়ের গায়ে দাঁড়িয়ে উমা শিবের জন্য তপস্যা করছে, পিছনে মাথার উপরে সরু চাঁদের রেখা। ছবিখানিতে রঙ বলতে কিছুই নেই, আগাগোড়া ছবিখানায় গৈরিক রঙের অল্প অল্প আভাস। আমি বললুম, ‘নন্দলাল, ছবিতে একটু রঙ দিলে না? প্রাণটা যেন চড়বড় করে ছবিখানির দিকে তাকালে। আর কিছু না দাও অন্তত উমাকে একটু সাজিয়ে দাও। কপালে একটু চন্দন-টন্দন পরাও, অন্তত একটি জবাফুল।’ বাড়ি এলুম, রাত্রে আর ঘুম হয় না। মাথায় কেবলই ঘুরতে লাগল, ‘আমি কেন নন্দলালকে বলতে গেলুম ও-কথা? আমার মতন করে নন্দলাল হয়তো উমাকে দেখেনি। ও হয়তো দেখেছিল উমার সেই রূপ, পাথরের মত দৃঢ়, তপস্যা করে করে রঙ রস সব চলে গেছে। তাই তো উমার তপস্যা দেখে তো বুক ফেটে যাবারই কথা। তখন আর সে চন্দন পরবে কি?’ ঘুমতে পারলুম না, ছটফট করছি কখন সকাল হবে। সকাল হতেই ছুটলুম নন্দলালের কাছে। ভয় হচ্ছিল পাছে সে রাত্রেই ছবিখানাতে রঙ লাগিয়ে থাকে আমার কথা শুনে। গিয়ে দেখি নন্দলাল ছবিখানাকে সামনে নিয়ে বসে রঙ দেবার আগে আর একবার ভেবে নিচ্ছে। আমি বললুম, ‘কর কি নন্দলাল, থামো থামো, কি ভুলই আমি করতে যাচ্ছিলুম, তোমার উমা ঠিকই আছে। আর হাত লাগিয়ো না।’ নন্দলাল বললে, ‘আপনি বলে গেলেন উমাকে সাজাতে। সারারাত আমিও সে কথা ভেবেছি, এখনো ভাবছিলাম রঙ দেব কি না।’ কি সর্বনাশ করতে যাচ্ছিলুম বল দেখি। আর একটু হলেই অত ভালো ছবিখানা নষ্ট করে দিয়েছিলুম আর কি। সেই থেকে খুব সাবধান হয়ে গেছি। আর এটা জেনেছি যে, ছবি যার যার নিজের নিজের সৃষ্টি, তাতে অন্য কেউ উপদেশ দেবে কি? যখন আমাদের ভারতশিল্পের জোর চর্চা হচ্ছে তখন ভাবলুম যে, শুধু ছবিতে নয়, সব দিকেই এর চর্চা করতে হবে। লাগলুম আসবাবের দিকে, ঘর সাজাতে, আশেপাশে চারদিকে ভারতশিল্পের আবহাওয়া আনতে। ঘরে যত পুরোনো আসবাব ছিল কর্তাদের আমলের, বিদেশ থেকে আমদানি দামী দামী জিনিসপত্তর, সব বিক্রি করে দিলুম। বললুম, ‘সব ঝেড়ে ফেল্‌, যা কিছু আছে বাইরে ফেলে দে।’ মাদ্রাজী মিস্ত্রি ধনকোটি আচারি, তাকে এনে লাগিয়ে দিলুম কাজে। নিজে নমুনা দিই, নকশা দিই, আর তাকে দিয়ে আসবাব করাই। সব সাদাসিধে আসবাব করাই। তাকে দিয়ে ঘর জুড়ে জাপানী গদি করালুম। এই যে আজকাল তোমরা খাটের পায়া দেখছ, এ কোত্থেকে নেওয়া জানো? মাটির প্রদীপের দেল্‌খো থেকে। খেটেছি কম? প্রথম ভারতীয় আসবাবের চলন তো এইখান থেকেই হল। একলা আমি আর দাদা, এই আমাদের সব দিক সামলে চলতে হয়েছে; এখন এরা সবাই একটি ধারা পেয়ে গেছে। এ থেকে একটু আধটু নতুন কিছু এদিক ওদিক করতে পারা সহজ। কিন্তু আমাদের যে তখন গোড়াসুদ্ধ গাছ উপড়ে ফেলে নতুন গাছ লাগাতে হয়েছিল নিজের হাতে। চারা লাগানো থেকে জল ঢালা থেকে সবই আমাদেরই করতে হয়েছে। তাকে বাঁচিয়ে রেখেছি বলেই হয়তো তাতে একদিন ফুল ফোটাতে পারবে।
অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর
১৮. পুরীর পাণ্ডাঠাকুর অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর ছেলেবেলায় পুরীর পাণ্ডাঠাকুর আসত বাড়িতে, বছরে একবার। এলেই জগন্নাথ দেখবার ইচ্ছে জাগত মা পিসিমা ছেলেমেয়ে দাসী পাড়াপড়শি সকলেরই মনে। সে যে কি ঔৎসুক্য জগন্নাথ দেখবার। পাণ্ডাকে ঘিরে বলতে থাকতুম, ‘ও পাণ্ডাঠাকুর, কবে ঠাকুর দেখাবে বল না।’ দাসীরা একজন করে বেরিয়েও পড়ত তার সঙ্গে। তার অনেক কাল পরে, বড় হয়েছি ছেলেপিলে নাতিনাতনি হয়েছে, রবিকা বাড়ি কিনলেন পুরীতে, বলুও কিনল, আমাদেরও বললেন জমি কিনতে। জগন্নাথ দেখবার ইচ্ছে মারও বরাবর। কিছু জমি কিনে নীলকুঠির একটা বাড়ি ভেঙে মশলাপাতি পাওয়া গেল খানিকটা, হাতেও টাকা এসে পড়ল কয়েক হাজার, তাই দিয়ে বাড়ি তৈরি হল পুরীতে, নাম হল ‘পাথারপুরী’। তখনকার দিনে পুরী যাওয়া ছিল যেন মুসলমানের মক্কা যাওয়া। মা বউ ঝি ছেলেপুলে নিয়ে চললুম পুরীতে জগন্নাথ দৰ্শন করতে। কি উৎসাহ সকলের। মা সারারাত রইলেন জেগে বসে। আমরা শুয়ে আছি যে যার বেঞ্চিতে লম্বা হয়ে। কটক না কোন্‌ স্টেশনে উড়ে পালকিবেহারাদের ‘হুম্প হুয়া হুম্পা হুয়া’ কানে আসতেই মা বললেন, ‘ওঠ্‌, ওঠ্‌, এসে পড়েছি এবারে উড়েদের দেশে।’ ধড়মড় করে সব উঠে বসলুম। এমন মজা লাগল সে শব্দ শুনে, মনে হল যেন পুরীর জগন্নাথের সাড়া পাওয়া গেল, জগন্নাথের শব্দদূত। পালকির ‘হুম্পা হুয়া’য় বহুকাল আগে পাণ্ডাঠাকুরের শব্দ জ্যান্ত হয়ে আক্রমণ করলে। ট্রেন চলেছে হু হু করে, ভিতরে আমরা মুখ বাড়িয়ে আছি জানলা দিয়ে, কে আগে মন্দিরের চূড়ো দেখতে পাই। খানিক যেতে না-যেতেই ভোর হয়ে এল, দূরে দেখা দিল জগন্নাথের মন্দিরের চূড়া, দেখে কি আনন্দ। মনে হল এই রকম কি এর চেয়ে বেশি আনন্দই বুঝি পেয়েছিলেন চৈতন্যদেব, যদিও রেলে যাচ্ছি আমি। তার পর আর-এক আনন্দ সমুদ্র দেখার। স্টেশনের কাছেই বাড়ি, বাড়িতে এসেই তাড়াতাড়ি বারান্দায় গেলুম। দেখি কি চমৎকার নীল সেদিকটায়, চোখ জুড়িয়ে যায়, আর কি শব্দ, কি হাওয়া—যেন জগন্নাথের শাঁখ বাজছে। দু-একদিনের মধ্যেই গুছিয়ে বসলুম। মা এক-এক করে সবাইকে পাঠিয়ে দিতে লাগলেন জগন্নাথদর্শনে। বাড়ির ছোট বড় দাসী চাকর কেউ বাদ নেই। আমিও তিন-চারদিন মন্দির ঘুরে দেখে এলুম সবকিছু। কেবল মাই বাকি। যাবার তেমন তাড়াই নেই। বলি, ‘পালকি ঠিক করে দিই, জগন্নাথ দৰ্শন করে আসুন।’ মা সে কথায় কানই দেন না—দিব্যি নিশ্চিন্ত, ভাবখানা যেন জগন্নাথ দর্শন হয়ে গেছে। মাঝে মাঝে পালকি চড়ে সমুদ্রের ধারে খানিক হাওয়া খান, বেশির ভাগ বাড়িতেই বসে বসে ঘর সংসার খাওয়াদাওয়ার তদারক করেন আর সবাইকে ঠেলে ঠেলে মন্দিরে পাঠান। একদিন হঠাৎ মা আমায় বললেন, ‘তুই জগন্নাথকে দেখেছিল?’ ‘জগন্নাথ? না, তা তো দেখিনি।’ মা বললেন, ‘সে কি কথা! মন্দিরে গেলি অথচ বেদির উপরে ঠাকুর দেখলিনে? তোকে তা হলে জগন্নাথ দেখা দেননি, পাপ আছে তোর মনে, তাই।’ তা হবে। কতবার মন্দিরে গেছি—ঘুরে ঘুরে নিখুঁতভাবে সব কারুকাজ দেখেছি, কোথায় জগন্নাথের চন্দন বাটা হচ্ছে, কোথায় মালা গাঁথে, কোথায় ফুলের গয়না তৈরি করে মেয়েরা ব’সে, কোথায় সে সব ফুলের বাগান, কোথায় মাটির তলায় বটকৃষ্ণমূর্তি, সব দেখেছি। কিন্তু মা যখন ওই কথা বললেন তখন খেয়াল হল মন্দিরের ভিতরেও গেছি, অন্ধকারের মধ্যে প্রদীপের আলোতে ভিড় দেখেছি লোকজনের, কিন্তু জগন্নাথকে দেখিনি। আসলে আমি জগন্নাথকে দেখতে যাইনি; যা দেখতে গেছি তাই দেখেছি। যে যা দেখতে চায় তাই তো দেখতে পায়। মার কথা শুনে পরদিন আবার গেলুম মন্দিরে জগন্নাথকে দেখতে পাণ্ডা সঙ্গে নিয়ে, পাণ্ডাকে পাশে দাঁড় করিয়ে একেবারে ভিতরে গিয়ে জগন্নাথকে দেখে তাঁর সোনার চরণ স্পর্শ করে এলুম। তখন মা বললেন, ‘এবারে আমায় দেখিয়ে আনতে পারিস?’ ‘নিশ্চয়ই।’ পালকি ঠিক। পাণ্ডাকে বলে সব ব্যবস্থা করলুম যাতে না ভিড়ে মার কষ্ট হয়, বেশি না হাঁটতে হয়। বকশিশের লোভে সে ভিড় সরিয়ে ফাঁকা রাখল নাটমন্দির কিছুক্ষণের জন্য। তখন আমিই পাণ্ডা, যা বলছি তাই হচ্ছে। মাকে গরুড়স্তম্ভ, আনন্দবাজার, বৈকুণ্ঠ যা যা দেখবার সব এক-এক করে দেখিয়ে নিয়ে গেলুম ঠিক জগন্নাথের সামনে। অন্ধকারে ভয় পান এগতে, পড়ে যান বুঝিবা। বললুম, আমায় ধরুন ভাল করে; জগন্নাথের পা ছুঁয়ে আসবেন। পাণ্ডা পিদিম নিয়ে ‘বাবু উঁচা নিঁচা’ ‘উঁচা নিঁচা’ বলে, আর এক-এক সিঁড়ি নামে। এই করে করে বেদির কাছে গিয়ে দাঁড় করিয়ে দিলুম মাকে। জগন্নাথের পা ছোঁওয়া হল, এবারে প্রদক্ষিণ করতে হবে। প্রদক্ষিণ করা মানে অনেকখানি জায়গা ঘুরে আসা। অন্ধকারে আরসোলাগুলো ফড়ফড় করে উড়ছে, ভয় হতে লাগল মাকে নিয়ে এ কোথায় এলুম। যাক্‌, সব সেরে তো বাইরে এলুম। মা খুব খুশি। বারে বারে আমার মাথায় হাত দিয়ে আশীৰ্বাদ করতে লাগলেন, ‘তোরই জন্য আমার জগন্নাথ দৰ্শন হল।’ উড্‌রফ, ব্লান্টও আসতেন, আমাদের বাড়িতেই উঠতেন এসে, কোনারকের ঝোঁক ছিল তাঁদের। কত মজা করেছি পুরীতে শোভনলাল-মোহনলালদের নিয়ে। সেদিন ওদের জিজ্ঞেস করলুম, ‘সমুদ্র মনে আছে?’ বললে, ‘নেই।’ কি করে বা থাকবে, ওরা তখন কতটুকু-টুকু সব। ওদের নিয়ে সমুদ্রের পারে কাঁকড়া ধরতুম, কাঁকড়ার গর্তে রুটি ফেলে দিতুম। ঝোঁক গেল সমুদ্রে জাহাজ চালাতে হবে। ম্যানেজারকে লিখে খেলনার একটা বড় জাহাজ আনিয়ে তাতে সুতো বেঁধে পারে নাটাই হাতে আমি বসে রইলুম। চাকরকে বললুম জাহাজ নিয়ে জলে ছেড়ে দিতে। ইচ্ছে ছিল জাহাজ ঢেউয়ে ঢেউয়ে ভেসে যাবে, আমিও নাটাইয়ের সুতো খুলে দেব, পরে আবার টেনে তীরে আনব। কিন্তু সমুদ্রের সঙ্গে পরিচয় হতে দেরি হয়েছিল। চাকর হাঁটুজলে জাহাজ নিয়ে ছেড়ে দিলে। ওমা, এক ঢেউয়ে খেলার জাহাজ বালুতে বানচাল হয়ে গেল উলটে পড়ে। সমুদ্রে জাহাজ চালাবার শখ সেখানেই শেষ। একদিন মোহনলাল বললে, ‘দেখ দেখ দাদামশায়, লাল চাঁদ উঠেছে?’ চেয়ে দেখি সূর্যোদয় হচ্ছে। মনে হয় একেবারে মাটি থেকে উঠছে যেন। বলি, ‘হ্যাঁ হ্যাঁ, তাই তো, লাল চাঁদই তো বটে।’ আমারও অবস্থা তার মতই। সেদিন ছেলেমানুষের চোখে আমিও দেখলেম লাল চাঁদ। বুড়ো ছাত্র জুটল এক সেখানে। বেশ তৈরি হয়ে গিয়েছিল কিছুকালের মধ্যেই। পরে পুরীতে আর্টের মাস্টার হয়ে চলে গেল। সাক্ষীগোপালে বাড়ি। একদিন বসে আছি, মাথায় একটা ঝুড়ি নিয়ে বুড়ো ছাত্র এল দুপুর রৌদ্রে। কি? না, ‘আম এনেছি আপনার জন্য।’ পাঁচ বছর উপরি-উপরি পুরীতে গিয়েছিলুম। সমুদ্রের হাওয়া যতদিন বইত, মা থাকতেন। উলটো দিকে হাওয়া বইতে থাকলেই মা চলে আসতেন; বলতেন, আর নয়। একবার জ্যেঠামশায় এলেন পুরীতে, অসুখে ভুগে শরীর সারাতে। বাড়ির কাছেই বাড়ি ঠিক করে দিলেম, সঙ্গে কৃতী ভায়া, হেমলতা বোঠান ও মুনীশ্বর চাকর। জ্যেঠামশায় এসেছেন, গেলুম দেখা করতে। দেখি মুনীশ্বর দোতলার ছাদে একটা তক্তা তুলছে। কি ব্যাপার। জোঠামশায় বললেন, ‘এ কি রকম বাড়ি, আমি ভেবেছিলুম ঠিক সমুদ্রের উপরেই বাড়ি হবে—বসে বসে কেমন সুন্দর দেখব। কিন্তু এ তে তা নয়, কতখানি অবধি বালি, তার পর সমুদ্র।’ বললুম, ‘এইরকমই তো সকলের বাড়ি পুরীর সমুদ্রের ধারে। একেবারে বাড়ির তলা দিয়ে সমুদ্র বয়ে যাবে, তা কি করে হবে এখানে।’ জ্যেঠামশায়ের মন ভরে না বারান্দায় বসে সমুদ্র দেখে। দোতলার চিলঘরের সামনে একটা তক্তার উপরে কৌচ পেতে তার উপরে বসে সমুদ্র দেখে তবে খুশি। হেসে বলেন, ‘তোমাদের ওখান থেকে কি এইরকম দেখতে পাও?’ মাথা চুলকে বলি, ‘তা এইরকমই দেখতে বই কি খানিকটা।’ আত্মভোলা মানুষ ছিলেন জ্যেঠামশায়। একদিন বিকেলে বললেন, ‘চল সতুর বাড়িতে বেড়িয়ে আসি।’ সঙ্গে আমি ও কৃতী। খানিকক্ষণ গল্পসল্প করবার পর চুপচাপ বসে আছি সবাই। কিই বা আর বলবার থাকতে পারে। সন্ধ্যে হয়ে এল। আমরা উসখুস করছি। জ্যেঠামশায় দেখি নিৰ্বিকার হয়ে বসে আছেন, ওঠবার নামও নেই। ক্রমে রাত হয়ে এল, জ্যেঠামহাশয়ের খাবার সময় হল। হঠাৎ একসময়ে ‘মুনীশ্বর মুনীশ্বর’ বলে ডেকে উঠলেন। কৃতী বললে, ‘মুনীশ্বর তো এখানে আসেনি, সে তো বাড়িতে আছে।’ ‘ও, তাই বুঝি। এ বাড়ি তবে কার? আমি আরো ভাবছিলুম মুনীশ্বর আমায় খাবার দিচ্ছে না কেন, রাত হয়ে গেল। আচ্ছা ভুল হয়ে গিয়েছিল তো আমার।’ বলে হো হো করে হাসি। মেজজ্যেঠামশায়ও এসেছিলেন পুরীতে সেবারে। আমরা তিনটে পরিবার পাশাপাশি। সুরেনও ছিল; জয়া, মঞ্জু ছোট ছোট। একদিন যা কাণ্ড। সুরেন চলেছে সমুদ্রের ধার দিয়ে ভিজে বালির উপরে। সঙ্গে জয়া মঞ্জু; সুরেনের সে খেয়াল নেই। এখন এক ঢেউয়ে নিয়েছে ভাসিয়ে জয়াকে। গেল গেল। সুরেন দেখে ঢেউয়ে চুল দেখা যাচ্ছে, টপ করে চুল ধরে টেনে তুললে মেয়েকে। কি সর্বনাশই হত আর একটু হলে। কত বলব সেদেশের ঘটনা। পর পর কত কিছুই না মনে পড়ে—সে বিস্তর কথা। একবার আমি হারিয়ে গিয়েছিলুম সেও এক কাণ্ড। পুরীতে অনেক দিন আছি, ভেবেছি সব আমার নখদর্পণে। একদিন হাঁটতে হাঁটতে চক্ৰতীর্থ পেরিয়ে গেছি সমুদ্রের ধার দিয়ে, রাস্তা ছাড়িয়ে বালির উপর ধপাস ধপাস করে চলেইছি। কত দূর এসে পড়েছি কে জানে। হঠাৎ চটকা ভাঙল, দেখি সূর্যাস্ত হচ্ছে। যেদিকে চাই চতুর্দিকে ধু ধু বালি। না নজরে পড়ে জগন্নাথের মন্দির, না রাস্তা, না কিছু। শুধু শব্দ পাচ্ছি সমুদ্রের। কোন্‌ দিকে যাব ঘোর লেগে গেছে। তারা ধরে চলব, তারও তো কোনো জ্ঞান নেই। একেবারে স্তম্ভিত। শেষে সমুদ্রের শব্দ শুনে সেইদিকে চলতে লাগলুম। খানিক বাদে দেখি এক বুড়ি চলেছে লাঠি হাতে বললে, ‘কোথায় যাচ্ছ?’ বললুম, ‘চক্রতীর্থে।’ ভাবলুম চক্রতীর্থে পৌঁছতে পারলেই এখন যথেষ্ট। বুড়ি বললে, ‘তা যেদিকে যাচ্ছ সেদিকে সমুদ্র। আমার সঙ্গে এস, আমি যাচ্ছি চক্রতীর্থে।’ বুড়ির সঙ্গে চক্রতীর্থে ফিরে হাঁফ ছেড়ে বাঁচি। নয়তো সারারাত সেদিন ঘুরে বেড়ালেও কিছু খুঁজে পেতুম না। ‘ভূতপত্রী’তে আছে এই বর্ণনা। অন্ধকারে সমুদ্রের ধারে বালির উপর হাঁটতে কেমন ভুতুড়ে মনে হয়—মনসাগাছগুলিও কেমন যেন। সেইবারেই আমি ভূত দেখি। সত্যিই। উড্‌রফ, ব্লাণ্ট কোনারক দেখে এসে বললেন, ‘যাও, দেখে এস আগে সে মন্দির।’ একদিন রওনা হলুম কোনারকে, চারখানা পালকিতে লাঠি লণ্ঠন লোকজন স্ত্রীপুত্রকন্যা সব সঙ্গে নিয়ে। ‘পথে বিপথে’ বইয়ে আছে এই বর্ণনা। কুড়ি মাইল পথ বালির উপর দিয়ে। যাচ্ছি তো যাচ্ছি, সারারাত। পান তামাক খাবার জলের কুঁজো পালকির ভিতরে তাকে ঠিক ধরা, মিষ্টান্নের ভাঁড়ও একটি, পাশে লাঠিখানা। পালকি চলেছে হুম্পাহুয়া। পুরী ছাড়িয়ে সারারাত চলেছি—ভয়ও হচ্ছে, কি জানি যদি বালির মাঝে পালকি ছেড়ে পালায় বেহারারা। আমার আগে আগে চলেছে তিনখানা পালকি; মাঝে মাঝে হাঁক দিচ্ছি, ‘ঠিক আছিস সবাই?’ সুনসান বালি, কোথায় যে আছি বাতাসে না পৃথিবীতে কিছু বোঝবার উপায় নেই। থেকে থেকে ধপাস ধপাস শব্দ, বেহারাদের আট-দশটা পা পড়ছে বালিতে। এক জায়গায় শুনি বাপ ঝপ ঝপ ঝপ শব্দ। ‘কি হল রে?’ ‘বাবু, নিয়াখিয়া নদী আসি গেলাম।’ ‘ও, আচ্ছা বেশ।’ নিয়াখিয়া নদী পেরিয়ে এলুম। শেষ রাত, চাঁদ অস্ত গেল, আবছা অন্ধকার, সকাল হতে আরো খানিকক্ষণ বাকি। সারারাত ভয়ে জেগে কাটিয়ে এলুম, এবারে একটু ঘুমও পাচ্ছে। সে সময়ে ভূতের ভয়ও একবার জেগেছিল মনে। সামনের পালকিগুলো আর দেখা যাচ্ছে না, বেহারাদের ডেকে বলি, ‘ও বেহারা, সব ঠিক আছে তো?’ ‘সব ঠিক আছে বাবু, সব ঠিক আছে।’ এমন সময় দেখি, একটা লোক, একহাতে লাঠি একহাতে লণ্ঠন, চলেছে আমার পালকির খোলা দরজার পাশে পাশে। বলি, ‘ও বেহারা, এ কে রে?’ ‘আঃ বাবু, ওদিকে দেখো না, ওসব দেউতা আছে।’ বলে ওদিকের দরজা বন্ধ করে দিলে। দেউতা বলে ওরা ভূতকে। বলি, ‘ওকি, লণ্ঠন হাতে দেউতা কি রে।’ খানিক বাদে দেখি ঘোড়ায় চড়ে একটা সাহেব টুপি মাথায় পাশ কাটিয়ে গেল। ‘বাবু, তুমি শুয়ে পড়।’ বলে শুধু বেহারারা। শুনেছিলুম কোন্‌ এক মিলিটারিকে ওখানে মেরে ফেলেছিল, ভূত হয়ে সে ফেরে, অনেকেই দেখে। রাত্তিরবেলা লণ্ঠন হাতে লোকটাকে দেখে আমার বরং ভালোই লেগেছিল। যাক, এই করতে করতে এসে পৌঁছলুম সমুদ্রের ধারে কি একটা মন্দিরের কাছে, মেয়েরা সব নেমে দেখতে গেল। ছোট্ট একটি পাহাড়ের মতো, তার উপরে ছোট্ট মন্দিরটি। মণিলাল ছিল সঙ্গে, তাকে বললুম, ‘ঠিক আছ তো সবাই। এইবার তবে আমি একটু পাশ মোড় দিয়ে নিই।’ তারপর আমার পালকি পড়ল গিয়ে একেবারে কোনারকের ধারে। সিন্ধুতটে চলেছে পালকি হু হু করে। দরজা খুলে দেখলুম ঢেউগুলো পাড়ে এসে পড়ছে, আবার চলে যাচ্ছে পালকির নিচে দিয়ে। জলে ফসফরাস, ঢেউ আসে যায়, যেন একটা আলো চলে যায়। মনে হয় সমুদ্রের উপর দিয়ে ভেসে চলেছি, দানবরা কাঁধে করে নিয়ে চলেছে আমায়। এইভাবে চলবার পর আবার একটা পালকি হু হু করে চলে গেল সামনে দিয়ে কোনারকের মন্দিরের দিকে, সঙ্গে আবার লণ্ঠন। ও কি, পালকি ওদিকে কোথায় গেল। নেমে দেখলুম আমাদের চারটে পালকি ঠিকই আছে। তবে ওটা কি? বেহারারা ওই এক কথাই বলে, ‘দেখো না বাবু, তুমি শুয়ে পড়। কি দেখলুম তা হলে ওটা? মরীচিকা না কি কে জানে, তবে দেখেছিলুম ঠিকই। সকাল হয়ে গেছে, ভয় নেই। মণিলালদের জিজ্ঞেস করলুম, ‘দেখেছ কিছু?’ বললে, ‘না।’ ভূতুড়ে কাণ্ড দেখে কোনারকের মন্দিরে পৌছলুম। মেয়েরা নেমেই মন্দির দেখবে বলে ছুটল। কোনারকের মত অমন সুন্দর সমুদ্র পুরীর নয়। গেলুম ধারে, আহা, যেন আছোঁয়া বালি সাদা জাজিমের মত বিছানো, তার কিনারায় নীল গভীর সমুদ্র। মানুষকে কাছে যেতে দেয় না। যেন বিরাট সভা, মানুষ সেখানে প্রবেশ করতে পারে না সহজে। তার ওদিকে সোনার ঘটের মত সূর্য উঠছে, সামনে সূর্যমন্দির। সূর্যোদয়ের আলোটা পড়ে এমন ভাবে, যেন সূর্যদেব উঠে এসে রথের শূন্য বেদি পূর্ণ করে বসবেন। সব তৈরি, এবার রথ চললেই হয়। বুঝেই ঠিক জায়গায় ঠিক রথটি নির্মাণ করেছিলেন শিল্পীরা। মন্দিরও বড় ভালো লেগেছিল। কি তার কারুকাজ। ওই দেখেই তো বলেছিলেম ওকাকুরাকে, ‘যাও, সূর্যমন্দির দেখে এসো।’ মন্দিরের সামনে বালির উপরে পড়ে আছে একটি মূর্তি, আধখানা বালির নিচে পোঁতা—যেন পাষাণী অহল্যা পড়ে আছে মন্দিরের দুয়ারে। অহল্যা আঁকতে হলে ওই মূর্তিটি এঁকো। সারাদিন কোনারকের মন্দির দেখে ডাকবাংলোতে থেকে বেলা কাটিয়ে বিকেল তিনটের সময় পালকি ছাড়লুম। আসছি আসছি। ফিরতি পথের শোভা, দূরে মৃগযূথ সব চলেছে—থেকে থেকে এক একবার দাঁড়ায় শিং তুলে, ঘাড় ফিরিয়ে। সে ছবি এঁকেছি। এই রকম চলতে চলতে আবার নিয়াখিয়া নদী পার হয়ে এলুম। সন্ধ্যে হয়ে এল, দেখলুম জগন্নাথের মন্দিরের ঠিক পিছনদিকে সূর্য অস্ত যাচ্ছে। ঝপ করে পালকি নামিয়ে দিয়ে বেয়ারার জগন্নাথের মন্দির ছাড়িয়ে অনেক দূরে চূড়োর উপরে প্রকাশ পাচ্ছে যে সূর্য তারই দিকে তাকিয়ে দু-হাত জুড়ে প্রণাম করে বললে, ‘জয় মহাপ্রভু! জয় মহাপ্ৰভু!’ কিন্তু সত্যি বলব, এত সুন্দর সুন্দর মূর্তিগুলো দেখে লোভ হত। মনে হত রাবণের মত কোলে করে ঘরে নিয়ে যাই তাদের। সেই যে বালুর চরে আধখানা পোঁতা নায়িকা শুয়ে আছে আকাশের দিকে চেয়ে, দানবের শক্তি পেলে তুলে নিয়ে আসতুম। একবার সত্যি সত্যিই মূর্তি চুরি করতে গিয়েওছিলুম। সংগ্রহের বাতিক চিরকালেরই তা তো জানো? সমুদ্রের ধারে পাথর পড়ে থাকে, যেতে আসতে দেখি, খেয়াল করিনে তেমন। একদিন নুলিয়াদের দিয়ে পাথরখানা ঘরে নিয়ে এলুম, দেখি তাতে ভৈরবী কাটা। মা বললেন, ‘এ ভালো নয়, কোনো ঠাকুর-টাকুর হবে। পুরীর মাটিও ঘরে নিয়ে যাওয়া দোষ। ও তুই ফিরিয়ে দে যেখানকার জিনিস সেখানে।’ পরে এক সাহেব নিয়ে গেল তা, আমার ভাগ্যে হল না। কি আর করি? মূর্তি ভাগ্যে নেই, নুড়িটুড়ি সংগ্রহ করে বেড়াই। জগন্নাথের মন্দিরেও ঘুরি রোজ। নাটমন্দিরের ধারে ছোট্ট একটি ঘর, ছোট্ট দরজা, বন্ধই থাকে বেশির ভাগ। পাণ্ডা বললে, ভোগমূর্তি থাকে এখানে। জগন্নাথের বড় মূর্তি সব সময়ে নাড়াচাড়া করা যায় না, ওই মূর্তি দিয়েই কাজ চালায়। সে ঠিক ঘর নয়, একটি কুঠরি বললেই হয়। বললুম, ‘দেখতে চাই আমি।’ পাণ্ডা দরজা খুলে দিলে। দেখি চমৎকার চমৎকার ছোট্ট ছোট্ট মূর্তি সব। দেখেই লোভ হল। ছোট আছে, নিয়ে যাবারও সুবিধে। পাণ্ডাকে জিজ্ঞেস করলুম। সে বললে, ‘হবে না, ও হবে না বাবু।’ ফুসলে ফাসলে কিছু যখন হল না, দেখি তা হলে হাতানো যায় কিনা কিছু। ঘুরে ঘুরে সব জেনে শুনে সাহসও বেড়ে গেছে। তখন স্নানযাত্রা। জগন্নাথকে নিয়ে রথ চলেছে, সবাই সেখানে, মন্দির খালি। আমার মন পড়ে আছে ছোট ছোট মূর্তিগুলোর উপর। আমি চুপি চুপি মন্দিরে ঢুকে সোজা উপস্থিত সেই পুতুলঠাসা কুঠরির কাছে, দেখি দরজা খোলা, ভিতর অন্ধকার। মস্ত সুবিধে, এবার চৌকাঠ পেরলেই হয়। আর দেরি নয়। দরজার কাছে গিয়ে উঁকি দিয়েছি কি অন্ধকার থেকে এক মূর্তি বলে উঠল, ‘কি বাবু, আপনি? আজ তো এখানে কিছু নেই, সব স্নানযাত্রায় চলে গেছে ।’ কি রকম থমকে গেলুম। ভিতরে যে কেউ বসে আছে একটুও টের পাইনি। যাক, বাড়ি ফিরে এলুম ভাঙা মনে। সে রাত্রে স্বপ্ন দেখি, আমি যেন সেই কুঠরিতে ঢুকে একটা মূর্তি তুলে আনব ভেবে যেই তাতে হাত দিয়েছি মূর্তি হাত আর ছাড়ে না। চীৎকার করছি, ‘ওমা দেখ দেখ, হাত তুলে আনতে পারছিনে।’ দম বন্ধ হয়ে আসে স্বপ্নে। সকালে উঠে মাকে বললুম সব। মা বললেন, ‘খবরদার, কিছুতে হাত দিসনে, তবে সত্যিই হাত আটকে যাবে। সাবধান, ঠাকুরদেবতা নিয়ে কথা, আর কিছু নয়।’ কিন্তু কি বলব—এমন সুন্দর মূর্তি, তাকে চুরি করারও লোভ জাগায়। তার পর আর-একদিন আর-একটা মূর্তি দেখলুম। নরেন্দ্রসরোবরের ধারে অনেক মূর্তি আছে, পাণ্ডারা ঘুরে ঘুরে দেখালে। তেমন কিছু নয়, পয়সা ফেলে ফেলে যাচ্ছি। একপাশে ছোট্ট একটা মন্দির, ভাঙা দরজা। বললুম, ‘এটাতে কি আছে দেখাও।’ পাণ্ডা বললে, ‘ওতে কিছু নেই, বাবু। ওটা এক বুড়ির মন্দির।’ বুড়িকে বললুম, ‘দেখা না বুড়ি তোর মন্দির।’ সে বললে, ‘দেখবে এসো।’ দরজাটি খুলে দেখাতেই একটি কালো কষ্টিপাথরের বংশীধারী মূর্তি, মানুষপ্রমাণ উঁচু, একটি হাত ভাঙা, যাকে বলে চিকনকালা বংশীধারী। কি তার সূক্ষ্ম কাজ, কি তার ভঙ্গি! কোথাও এমন দেখিনি। বুড়িকে বলেছিলুম, ‘মন্দির গড়িয়ে দেব, নতুন মূর্তি তৈরি করিয়ে দেব, এটি আমায় দে।’ রাজি হল না। নন্দলালদের বলেছিলুম, ‘যদি যাও, ভালো মূর্তি দেখতে চাও, সেটি দেখে এসো।’ এখনো সেই বুড়ি আছে কিনা, মূর্তি আছে কিনা কে জানে। পাণ্ডারা আমল দেয় না। বোধ হয় ভাঙা বলে ফেলে দিয়েছিল, বুড়ি তাকে পূজো করত। প্রাণ ঠাণ্ডা হয়ে গেল, কিন্তু ঘরে আনতে পারলেম না এই দুঃখ রইল। তোমরা ‘ভারতশিল্প’‘ভারতশিল্প’ কর, দরদ কি আছে কারো? না পুরীর রাজার, না ম্যানেজারের, না পাণ্ডাদের, দরদ কারো নেই। প্রমাণ দিই। জগন্নাথের মাসির বাড়ি মেরামত হবে। পাণ্ড খবর দিলে, ‘বাবু, দুটো হরিণ যদি কিনতে চাও মাসির বাড়ির, বিক্রি হবে।’ বললুম, ‘সে কি রে? পোষা হরিণ সেখানে বড় হয়েছে। আমার দরকার নেই সে হরিণের। ভাঙা মূর্তি থাকে তো বল্‌। পাণ্ডা বললে, ‘সে কত চাই বাবু, বলুন। অনেক মিলবে।’ বললুম, ‘আজই চল্‌ তবে সেখানে দেখি গিয়ে।’ গেলুম, তখন সন্ধ্যেবেলা। সে গিয়ে যা দেখি। মাসির বাড়ি যেন ভূমিকম্পে উলটে পালটে গেছে। চুড়োর সিংহ পড়েছে ভুঁয়ে, পাতালের মধ্যে যে ভিত শিকড় গেড়ে দাঁড়িয়ে ছিল এতকাল সে শুয়ে পড়েছে মাটির উপরে, সব তছনছ। বড় বড় সিংহ নিয়ে কি করব? ছোটখাটাে মূর্তি পেলে নিয়ে আসা সহজ। ভিতরে গেলুম। সেখানেও তাই। এখানকার জিনিস ওখানে। কেমন একটা ত্রাস উপস্থিত হল। পাণ্ডাকে শুধালেম, এই পাথরের কাজ ঝেড়ে ঝুড়ে পরিষ্কার করে যেমন ছিল তেমনি করে তুলে দেওয়া হবে তো মেরামতের সময়? তার কথার ভাবে বুঝলেম এই সব জগদ্দল পাথর ওঠায় যেখানকার সেখানে, এমন লোক নেই। বুঝলেম এ সংস্কার নয়, সৎকার। ভাঙা মন্দিরে মানুষের গলার আওয়াজ পেয়ে একজোড়া প্রকাণ্ড নীল হরিণ চার চোখে প্রকাণ্ড একটা বিস্ময় নিয়ে আমার কাছে এগিয়ে এল। কতকালের পোষা হরিণ, এই মন্দিরের বাগানে জন্ম নিয়ে এতটুকু থেকে এত বড়টি হয়েছে—আজ এদের বিক্রি করা হবে। আর, এদের সঙ্গে সঙ্গে যে বাগান বড় হতে হতে প্রায় বন হয়ে উঠেছে, বনস্পতি যেখানে গভীর ছায়া দিচ্ছে, পাথি যেখানে গাইছে, হরিণ যেখানে খেলছে, সেই বনফুলের পরিমলে ভরা পুরোনো বাগানটা চষে ফেলে যাত্রীদের জন্য রন্ধনশালা বসানো হবে। আমার যন্ত্রণাভোগের তখনও শেষ হয়নি। তাই ঘুরতে ঘুরতে একটা ডবল তালা দেওয়া ঘর দেখিয়ে বললেম, ‘এটাতে কি? পাণ্ডা আস্তে আস্তে ঘরটা খুললে, দেখলেম, মিণ্টন আর বর্‌ন্‌ কোম্পানির টালি দিয়ে অতবড় ঘরখানা ঠাসা। ‘এত টালি কেন?’ ‘মাসির বাড়ি ছাওয়া হবে।’ আঃ সর্বনাশ, এরি নাম বুঝি মেরামত? ভাঙার মধ্যে, ধ্বংসের স্তূপে, রস আর রহস্য, নীল দুটি হরিণের মত বাসা বেঁধে ছিল। সেই যে শোভা, সেই শান্তি মনে ধরল না; ভালো ঠেকল দুখানা চকচকে রাঙা মাটির টালি! ভাবলুম, এ ঠেকাতে হবে যে করেই হোক। সময় নেই, পরদিনই চলে আসছি কলকাতায়। বাড়ি ফিরে মণিলালের সঙ্গে পরামর্শ করে পুরীর কমিশনারের কাছে চিঠি লিখলুম।—‘আমি দেখে এসেছি এই কাণ্ড, ভ্যাণ্ডালিজ্‌মএর চূড়ান্ত। যে করে পারো তুমি থামিয়ো।’ ইংরেজ-বাচ্চা, যেমন চিঠি পাওয়া মাসির বাড়িতে নিজে গিয়ে হাজির। তখনি যেখানে যে পাথরটি ছিল তেমনি তুলিয়ে দিয়ে মেরামত করলে নিজে দাঁড়িয়ে থেকে। কথা রাখলে সে। এই একটা পুণ্যকার্য করে এসেছি পুরীতে বলতে পার। জগন্নাথের মাসির বাড়ির শোভা নষ্ট হতে বসেছিল আর একটু হলেই। সেবারেই নাচ দেখেছিলুম মন্দিরে দেবদাসীর। নাচ দেখা হয়নি, এ না দেখে যাওয়া হতে পারে না। নাচ আগে দেখি, পরে খাতায় সই দেব। পাণ্ডা কিছুতে ঘাড় পাতে না, বলে, ‘অনেক টাকা লাগবে।’ বললুম, ‘তা দেওয়া যাবে, সেজন্য আটকাবে না। দেবতার সামনে নাচ দেখব।’ সইয়ের লোভ, টাকার লোভ; পাণ্ডা রাজি হল অনেক গাঁইগুঁই করার পর। বললে, ‘কাল তবে খুব ভোরে এসে আপনাকে নিয়ে যাব। তৈরি থাকবেন।’ ভোরে আমি একলাই গেলুম তার সঙ্গে। তখনো মন্দিরে লোকজনের ভিড় হয়নি, অন্ধকারে দু-একটি মাথা দেখা যায় এখানে ওখানে, বোধ হয় পাণ্ডাদেরই। পাণ্ডা আমাকে নিয়ে নাটমন্দিরে বসিয়ে দিলে। একপাশে একটি মাদল বাজছে, একটি মশাল জ্বলছে, একটি দেবদাসী নাচছে। দেবদাসী নাচের সঙ্গে ঘুরছে ফিরছে, সঙ্গে সঙ্গে মশালও সেইদিকে ঘুরছে, আলো পড়ছে তার গায়, যেন জগন্নাথ দেখছেন তাকে আর কোণায় বসে দেখছি আমি। কত ভাব জানাচ্ছে দেবতার কাছে। অভিনয়ে নটীর পূজা দেখে ছবি আঁকো তোমরা। আমি সত্যিসত্যিই দেবমন্দিরের ভিতরে গিয়ে দেবদাসীর নৃত্য দেখেছি। চমৎকার ব্যাপার সে। সেইবারেই ফিরে এসে দেবদাসীর ছবিখানি আঁকি। আর আঁকি কাজরী ছবিখানি। তাও দেখেছিলুম পুরীতেই কমিশনারের বাড়িতে। বাগানে পার্টি, মেঘলা আকাশ, টিপ টপ করে দু-একফোঁটা বৃষ্টি পড়ছে, কয়েকটা বড় ফুলের গাছ, তার পাশে নাচছিল কয়েকটি ওড়িয়া মেয়ে। কাজরী ছবিখানি পরে তা থেকেই হল।
অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর
১৯. আরো কত যে দেখেছি অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর আরো কত যে দেখেছি, কত ছবি এঁকেছি, তার কি হিসেব আছে? না, আমিই তার হিসেব রেখেছি? আর, কি ভাবে কি থেকে যে ছবি এঁকেছি তা জানলে হিসেব চাইতে না আমার কাছে। পুরীতে বসে সমুদ্র দেখেছি, নাচ দেখেছি; সেখানে আঁকিনি। বহুকাল পরে কলকাতায় বসে আঁকলুম সে সব ছবি। মুসৌরিতে দেখেছি, ঘুরেছি। অনেককাল বাদে বের হল পাখির ছবিগুলি। সেখানে থাকতে ছবি আঁকিনি; ঘুরে ঘুরে দেখেছি, পাখির গান শুনেছি। পাখির গান সত্যিই আমায় আকর্ষণ করেছিল। শহরের পাখিগুলো গান গায় না, চেঁচায়—খাবার জন্যে চেঁচায়, বাসার জন্যে চেঁচায়, মারামারি করে চেঁচায়। বলব কি মুসৌরি পাহাড়ের পাখিদের গানের কথা। উষাকাল, সূর্যোদয় দেখবার আশায় বসে আছি, কম্বল মুড়ি দিয়ে কান ঢেকে চুরুটটি ধরিয়ে খোলা পাথরের চাতালে ইজিচেয়ারে—সেই সময়ে আরম্ভ হল পাখিদের উষাকালের বৈতালিক। দূরের পাহাড়ে একটি পাখি একটু সুর ধরলে, সেখান থেকে আর-এক পাহাড়ে আর-একটি পাখি সে সুর ধরে নিলে। এমনি করতে করতে সমস্ত পাহাড়ে প্রভাতবন্দনা শুরু হয়ে গেল। তখনো সূর্যোদয় হয়নি। ধীরে ধীরে সামনের বরফের পাহাড়ের পিছনে সূর্য উঠছেন। সাদা বরফের চূড়ো দেখাচ্ছে ঘন নীল, যেন নীলমণির পাহাড়। পাখিদের বৈতালিক গান চলেছে তখনো। শেষ নেই—এ-পাহাড়ে, ও-পাহাড়ে, কত পাহাড়ে। যেমন সূর্য উদয় হলেন বৈতালিক গান থেমে গেল। সারাদিন আর গান শুনতেম না। মানুষ জাগল। রিকশ চলল ঘণ্টা বাজিয়ে। টংটঙিয়ে কাজে চলল সবাই। দূরে মিশনরি স্কুলে ঘণ্টা বাজল, আকাশে ধ্বনি পাঠাতে লাগল টং টং টং টং। কাজের সুরে ভরে গেল অতবড় পাহাড়। এমনি সারাদিনের পর বেলাশেষে ছুটির ঘণ্টা বেজে উঠল স্কুলবাড়িতে, গির্জের ঘড়ি থামল প্রহর বাজিয়ে। সূর্য অস্ত গেলেন সমস্ত পাহাড়ের উপর ফাগের রঙ ছড়িয়ে দিয়ে। রাতের আকাশ ঘন নীল হয়ে এল—সন্ধ্যেতারা উঁকি দিলে কেলুগাছটার পাতার ফাঁকে। সেই সময়ে ধরলে দূর পাহাড়ে আবার বৈকালিক সুর, আরম্ভ হল পাখিদের গান আবার এ-পাহাড়ে ও-পাহাড়ে। একটি একটি করে সুর যেন ছুঁড়ে দিচ্ছে, লুফে লুফে নিচ্ছে পরস্পর। এমনি চলল কতক্ষণ। নীল আকাশের সীমা শুভ্র আলোয় ধুয়ে দিয়ে চন্দ্রও উঠলেন, পাখিরাও বন্ধ করলে তাদের বৈকালিক। সে যেন কিন্নরীদের গান, শুনে এসেছি রোজ দুবেলা। গান তো নয়, যেন চন্দ্রসূর্যকে বন্দনা করত তারা। কোথায় লাগে তোমাদের সংগীত, সভার ওস্তাদি সংগীত। মন টলিয়েছিল কিন্নরীর দল। তাই বহুদিন পরে কলকাতায় তারাই সব এক-এক করে ফুটে বের হল আমার এক রাশ পাখির ছবিতে। দেখে নিয়ো, তার ভিতরে সুর আছে কিছু কিছু, যদিও মাটির রঙে সব সুর ধরা পড়েনি। সে কত পাখি, সব চোখেও দেখিনি, কানে শুনেছি তাদের গান। মন কত ভাবে কত কি সংগ্রহ করে রাখে। সব যে বের হয় তাও নয় মনে হয়, হয়তো পূর্বজন্মেরও স্মৃতি থাকে কিছু। তাই তো ভাবি এক-একবার, লোকে যখন বলে পূর্বজন্মের কথা, উড়িয়ে দিতে পারিনে। নয়তো সারনাথে আমার ঘর খুঁজে পেলেম কি করে? দেখেই মনে হল এ আমার ঘর, এইখানে আমি থাকতুম, পুতুল গড়তুম, বেচতুম। সে একবার পুরানো সারনাথ দেখতে গেছি। শুধু স্তূপটি আছে, মাটির নিচের শহর একটু একটু খুঁড়ে বের করছে সবে। তখন সন্ধ্যে হচ্ছে। বরুণা নদী, একটি সাদা বক ওপার থেকে এপারে ফিরে এল। বড় শান্তিপূর্ণ জায়গা। ঘুরে ঘুরে দেখছি। মাটির উপর ছোট একটি ঘর, আরো ছোট তার দরজা। দরজার চৌকাঠের উপর দুটি হাস আঁকা। চৌমাথা, কুয়ো সামনে একটি, যেন রাস্তার ধারের ঘরখানি। দেখেই মনে হল যেন আমার নিজের ঘর, কোনোকালে ছিলুম। এত তো দেখলুম, কোথাও এমন মনে হয়নি। ঠিক যেন নিজের বাড়ি বলে মনে হল। জোড়াসাঁকোর বাড়িতে ঢুকলে যেমন মনে হয়, ওই ঘরটির সামনে গিয়ে আমার হল তাই। নেলিকে বললুম, ‘ওরে দেখ্‌, দেখ্‌। এইখানে বসে আমি পুতুল গড়তুম; তারই দু-চারটে ওই যে পড়ে আছে এখনো।’ অলকের মা শুনে বললেন, ‘ও আবার কি সব বলছ, চল চল এখান থেকে।’ সব ছেড়ে ওই ঘরটার সামনে মন আমার থমকে দাঁড়াল, যেন মনের পরিচিত। অন্য সব চোখের উপর দিয়ে ভেসে গেল। তাই বলি, পূর্বজন্মের স্মৃতি থাকে হয়তো। লোকে বলে, যে তারাকে দেখি চোখে সে তারা লোপ পেয়ে গেছে বহুযুগ আগে। তার আলোর কম্পনটুকুই দেখছি আমরা আজ তারারূপে। আমার মনও কি তাই। প্রাণের সেই বহুযুগ আগে লোপ পেয়ে যাওয়া কম্পন ধরে দিচ্ছে আজকের ছবিতে লোক-চোখের সামনে। আর্টিস্টের মনের হিসেব আর কাজের হিসেব ধরতে চাওয়া ভুল। ‘শাজাহানের মৃত্যুশয্যা,’ লোকে কেন বলে এত ঠিক হল কি করে? আমিও ভেবে পাইনে। কি জানি, কোনোকালে কি ছিলুম সেখানে। বুঝতে পারিনে। যেখানে থাকি, যার সঙ্গে উঠি বসি, বাস করি, তার ছবি আঁকা সহজ। কিন্তু যেখানে যাইনি, যা দেখিনি, সেখানকার এমন সঠিক ছবি আঁকতে কি করে পারলুম? এমনি হাজার ছবি, হাজার মুখ, মন ধরে রেখে দেয়। অনেক সময়ে আঁকি, বুঝতে পারিনে আমি আঁকছি কি আর কেউ আঁকাচ্ছে। এখানে ঘুরে ফিরে সেই কথাই আসে— কালি কলম মন লেখে তিন জন। এই তিন নইলে ছবি হয় না। ওরে বাপু— আঁখি যত জনে হেরে সবারে কি মনে ধরে? চোখ যত জিনিস দেখছে সে বড় কম নয়। কিন্তু সব কি আর মনে ধরছে। তা নয়। মনের মত যা তাই ধরছে, সেইগুলিই কাজে আসছে আমাদের ছবিতে। কত লোকজন, কত মুখ, অনেক সময় তারা চোখের উপর দিয়েই ভেসে যায়। সেইজন্যই বলে— মনেরে না বুঝাইয়ে নয়নেরে দোষো কেন? চোখে মনে ঝগড়া।—মন বলে, ‘চোখ, তুমি ধরে রাখতে পারো না।’ চোখ বলে, ‘নিজের মনকে না বুঝে আমায় দোষো কেন।’ মন ধরে রাখে, দরকারমত বের করে নেয়। তাই তো বলি, শেষ ছবি আমার এখনো আঁকা হয়নি। আমারও কৌতুহল হয়, কি ছবি হবে সেটা। আঁকতে হবে, তার মানে মন ধাক্কা দিচ্ছে। আঁকা হলে বলব, এই হল সেই ছবি। তার পর বন্ধ। মন এখন দুয়োর খুলছে, দু-একটা বের করে দিচ্ছে। শুধু কি ছবি? দেখ, ছবি আছে, লেখা আছে, বাজনা ছিল, গলাও ছিল সাধা হয়নি। কিন্তু এই যে তিনটে চারটে আর্ট নিয়ে মনটা খেলা করছে, এখনো তার মধ্যে ছবিটা বেশি খেলা করছে। তবে দেখছি প্রত্যেকবার মন যেটা ধরে শেষ পর্যন্ত রস নিংড়ে তবে ছাড়ে, অক্টোপাসের মত। মন বড় ভয়ানক জানোয়ার। ওই অসুখের পর ডি. এন. রায় ডাক্তার বললেন আমায়, সব কাজ বন্ধ কর।’ মহামুশকিল। নিয়ে পড়লুম অণুবীক্ষণযন্ত্র। বসে বসে সব কিছু দেখি তা দিয়ে। বই পড়লুম, পোকামাকড় ঘাঁটলুম, নিজের হাতে প্লেট তৈরি করলুম, কত জানলুম। মন ধরলে আর ছাড়তে চায় না। মোহনলালদের নিয়ে বসে দেখাতুম, তাদের পড়াতুম। সেই সময়ে এক আশ্চর্য ব্যাপার দেখেছিলেম। ছোট্ট ছোট্ট এই এতটুকু সব কাঁকড়া পুষেছিলুম বিস্কুটের বাক্সে, সমুদ্রের জল-বালিও দিয়েছিলুম। কাঁকড়ারা নিজেরাই তাতে গর্ত করে বাসা তৈরি করে নিলে। রোজ সকালে সমুদ্রের ধারে কাঁকড়াদের যেমন রুটি খাওয়াই তেমনি তাদেরও খাওয়াই। একদিন একটু জ্যাম দিয়ে এক ফোঁটা রুটি ফেলে দিয়েছি কাঁকড়ার বাক্সে। কোত্থেকে একটা মাছি এরোপ্লেনের মত শোঁ করে বসল এসে জ্যাম-মাখানো রুটির টুকরোটির উপর। যেমন বসা, মাছিটার সমান হবে একটা কাঁকড়া দৌড়ে এসে আক্রমণ করলে মাছিটাকে। আমার হাতে অণুবীক্ষণযন্ত্র। দেখি মাছিতে কাঁকড়াতে ধ্বস্তাধস্তি লড়াই, যেন রাক্ষসে দানবে যুদ্ধ। কেউ কাউকে ছাড়ছে না। তখন বুঝলুম কি শক্তি ধরে দিয়েছে প্রকৃতি ওইটুকুরই মধ্যে। জার্মান-রাশিয়ান যুদ্ধের চেয়ে কম নয়। শেষে হার হল মাছিটারই। মনও ওই রকম, চোখে দেখিনে তাকে, কিন্তু ওই কাঁকড়ার মত ধরলে আর ছাড়বে না। দেখলুম আর আঁকলুম, আমার ধাতে তা হয় না। অনেকদিন ধরে মনের ভিতরে যা তৈরি হল, তাই ছবিতে বের হল। মন ছিপ ফেলে বসে আছে চুপচাপ। আর সবই কি ঠিকঠাক বের হয়? মুসৌরি পাহাড়ের একটি সন্ধ্যের পাখি আঁকলুম, কি ভাবে সে ছবিটা এল? সন্ধ্যে হচ্ছে, বসে আছি বারান্দায়, বাংলাদেশে সেদিন বিজয়া। হঠাৎ দেখি চেয়ে একটা লাল আলো পর পর পাহাড়গুলির উপর দিয়ে চলে গেল। সেই আলোয় পাহাড়ের উপরে ঘাসপাতা ঝিলমিল করে উঠল। মনে হল যেন ভগবতী আজ ফিরে গেলেন কৈলাসে, আঁচল থেকে খসা সোনার কুচি সব দিকে দিকে ছড়াতে ছড়াতে। রঙ, আলোর ঝিলমিল, তার সঙ্গে একটু ভাব—উমা ফিরে আসছেন কৈলাসে। তখনি ধরে রাখল মন। কলকাতায় এসে এই ছবি আঁকতে বসলুম। ঠিকঠাক সেইভাবেই কি বের হল ছবি? তা তো নয়, মনের কোণ থেকে বেরিয়ে এল সোনালি রূপোলি রং নিয়ে সুন্দরী একটি সন্ধ্যের পাখি—সে বাসায় ফিরছে। মনের এ কারখানা বুঝতে পারিনে। এত আলো, এত ভাব, সব তলিয়ে গিয়ে বের হল একটি পাখি, একটি কালে পাহাড়ের খণ্ড, আর তার গায়ে একগোছা সোনালি ঘাস। অনেক ছবিই আমার তাই—মনের তলা থেকে উঠে আসা বস্তু। কবিকঙ্কণে এঁকেছি সব শেষের ছবি—দুই পাহাড়ের মাঝখান দিয়ে ঘট হাতে আসছে একটি মেয়ে। মুসৌরি পাহাড়ে বিজয়ার দিন ওই অমনি ছবির খসড়াই লিখেছিল মন, এও বুঝি তাই। সেই মুসৌরী পাহাড়ের কথা কতকাল বাদে বের হল কবিকঙ্কণে পটের ছবিতে। ওইরকম কত ছবির তুমি হিসেব ধরবে? সব উলটাে পালটা। যেমন পুতুল গড়ি আর কি। আছে মানুষ, ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখে তাতে একদিন ঠোঁট বসিয়ে দিই, হয়ে যায় পাখি। তাই বলি চোখ আর মন এক জিনিস ধরে না সব সময়ে। মনই এখানে প্রবল। ইচ্ছে করলে চড়ুইপাখিকে স্বর্গের পাখি বানিয়ে দিতে পারে। লেখাতেও তাই। চোখ দেখে ভায়োলেট ফুল, বাকিটা আসে কোত্থেকে? মন দেয় জোগান, চোখ ধরে পাত্রটা, মন ঢেলে দেয় তাতে মধু। তখন সে আর-এক জিনিস হয়ে যায়। তখনই হয় সোনার ময়ূর, সোনার হরিণ। যাক আর্টের এসব তত্ত্বকথায় মাথা ঘামিয়ে কাজ নেই। এঁকে যাও, মন যোগ দেয় ভালো, নয়তো চোখের দেখাই যথেষ্ট। চোখের দেখা দেখে আসি— প্রাণের অধিক যারে ভালোবাসি। প্রাণের অধিক ভালোবাসে বলেই তো চোখের দেখার এত দরকার।
অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর
২০. থেমেই তো গিয়েছিল সব অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর থেমেই তো গিয়েছিল সব। দশ-এগারো বছর ছবি আঁকিনি। আরব্য উপন্যাসের ছবির সেট আঁকা হলে ছেলেদের বললুম, ‘এই ধরে দিয়ে গেলুম। আমার জীবনের সব কিছু অভিজ্ঞতা এতেই পাবে।’ ব্যস্‌, তার পর থেকেই ছবি আঁকা বন্ধ। কি জানি, কেন মন বসত না ছবি আঁকতে। নতুন নতুন যাত্রার পালা লিখতুম; ছেলেদের নিয়ে যাত্রা করতুম, তাদের সাজাতুম, নিজে অধিকারী সাজতুম, ফুটাে ঢোল বাজাতুম, স্টেজ সাজাতুম। বেশ দিন যায়। রবিকা বললেন, “অবন, তোমার হল কি? ছবি আঁকা ছাড়লে কেন? বললুম, “কি জানো রবিকা, এখন যা ইচ্ছে করি তাই এঁকে ফেলতে পারি। সেজন্যই চিত্রকর্মে আর মন বসে না। নতুন খেলার জন্যে মন ব্যস্ত।’ এবার আবার এতকাল বাদে ছবি আঁকতে বসলুম। এ যেন নতুন সঙ্গী জুটিয়ে আর একবার পিছিয়ে গিয়ে পুরোনো রাস্তা মাড়ানোর মজা পাওয়া। সবারই একটি করে জন্মতারা থাকে, আমারও আছে। সেই আমার জন্মতারার রশ্মি পৃথিবীর বুকে অন্ধকারে ছায়াপথ বেয়ে নেমে এসে পড়েছে অগাধ জলে। সেই দিন থেকে তার চলা শুরু হয়েছে। তার পর একদিন চলতে চলতে, ঝিক ঝিক করতে করতে যখন এসে ঘাটে পৌঁছল, পৃথিবীর মাটিতে ম্লান আলো ঠেকল, সেখানে কি হল? না, সেখানে সেই আলো একটি নাম-রূপ পেলে, সেই আমি। জন্মতারার আলো জীবননদী বেয়ে এসে তীরে ঠেকল। ওই ঘাটের ধারে দাড়িয়ে অবনীন্দ্রনাথ দেখলে—‘কোত্থেকে এলুম, এবারে কোথায় চলতে হবে।’ ঘাটে এসে ঠেকলুম, এবার চলা শুরু করতে হবে। মালবাহী গাধার মত, উদরের বোঝা পৃষ্ঠের বোঝা সব বোঝা নিয়ে জীবনের মুটে তখন চলেছে পথে, অতি ভীত ভাবে—কিছু দেখলেই ভয়ে পিছু হটে, তাকেও যে দেখে ভয়ে ছুটে পালায়। ঘাট ছেড়ে বেরিয়ে পড়ল নানা জিনিস সংগ্রহ করতে হাটে, খানিকটা খেলার মত। অনেকদিন ধরে খেলার আয়োজন চলল। যেন সে একটি হারুয়া ছেলের মন, সে বাসায় ঢুকতে চাচ্ছে, গাছে চড়তে চাচ্ছে, ঠিক করতে পারছে না, চাঁদের মত উঁকিঝুঁকি মারছে গাছের আড়াল থেকে। ঘরের বুড়ি দাসী কোলে করে গায়— ওই এক চাঁদ, এই এক চাঁদ চাঁদে চাঁদে মেশামেশি। এবারে খোঁজাখুজির পালা। কি নিয়ে খেলব? সঙ্গে আছে কে? ঘরের মানুষ বুড়ি দাসী। তার থেকেও জীবন রস টানছে। বাইরে থেকেও টানছে, ঘর থেকেও টানছে। যেমন ঘরের দাসী তেমনি পোষা পশুপাখি এরাও। আস্তে আস্তে এল আশেপাশের সঙ্গে যোগাযোগ। বুনো ছাগল, খেলতে চাই তার সঙ্গে, সে চোখ রাঙিয়ে শিঙ বাগিয়ে তেড়ে আসে, অথচ মনকে টানে। ফুলের ডাল দেখে মন চায় চড়ুইপাখি হয়ে তাতে ঝুলতে। হাঁস উড়ে আসছে, এবারে মন আরো খানিকটা এগিয়ে গিয়ে জানতে চায়। যেন মেঘদূতের যক্ষের মত পড়ে আছে একজন; সুদূরের আকাশ হতে সংবাদ নিয়ে এসে সামনে দিয়ে উড়ে গেল হাঁস। এইকালে কল্পনা এল। গোল চাঁদ বেরিয়ে আসছে বনের ভিতর থেকে। মেঘ তাকে ঢেকে দিচ্ছে বারে বারে। ঘন বনে অদ্ভুত এক পাথি ডাকতে ডাকতে ঘুরে বেড়াচ্ছে। তার পর কত রকম সংগ্রহ, নানা ঘাটে ভিড়তে ভিড়তে চলেছে। কোথাও ফুল, কোথাও ছেলেমেয়ে কোথাও গাছ, কত কি! ঘাটে ঘাটে ঠেকেছে আর সংগ্রহ করেছে। বড় শৌখিন কাল সেটা। সে হচ্ছে রোমান্সের যুগ। স্ফূর্তি ক’রে, খেলায় মেতে, সময় কাটিয়ে শখের জিনিস সব সংগ্রহ করলে। তার পর সংসার যেমনি চোখ রাঙালে, মহাকালের রক্তচক্ষু বললে, ‘কোথায় চলেছিস আনন্দে বয়ে? থাম্ এবারে।’ সেই মহাকালের ধমক খেয়ে মন চমকে উঠল। তখন আর খেলা-খেলনাতে মন বসে না। পুরোনো খেলনার বোঝা পিঠে বয়ে আর-এক ঘাটে চলল। ধমক খেয়ে এখন কোথায় যায়, কি করে, কি খেলে, এই ভাবনা। জীবনতরু জল না পেলে বাঁচে না। পাথরের থেকেও রস নিতে চায়, যে পাষণের মঞ্চে সে বাঁধা থাকে তা থেকে। তখন কে এল? তখন প্রভু এলেন তাকে বাঁচাবার জন্যে। বললেন, ‘সেই দিকে শিকড় পাঠা যেখান থেকে সে চিরদিন রস পাবে, বনবাসের আনন্দ পাবে।’ জোড়াগাছের স্মৃতি ঝাপসা হয়ে গেছে, ক্রমেই মিলিয়ে যাচ্ছে। অন্য গাছটিতে পড়েছে অস্তরবির আলে, তাপ দিয়ে বাঁচাতে চাচ্ছে। সবুজ মরে গিয়ে গৈরিক রঙের শোভা প্রকাশ পেল। সেখানে শুরু হল বনের ইতিহাস। অন্ধকার রাত্রে আর-এক সুর বাজল মনে। বনদেবীদের দেওয়া সেই স্বর। সোনার স্বপ্ন যেন আর-একবার ধরা দেবে দেবে করলে, যেখানে সোনার হরিণ থাকে। অলকার রঙছুট ময়ূরী এল। সে-জগতে সে রঙের অপেক্ষ রাখে না। সেই যে কুঞ্জে নূপুর বাজে সেখানে রঙছুট ময়ূরী খেলা করে। বিরহের গভীর সুর বাজে। মনময়ূরী একলা। শক্ত পাথরে মন-পাখি বাধছে বাসা। রঙছুট ছবি। ধীরে ধীরে ঝাপসা হয়ে এল সবুজ রঙ। সেখানে ভোরের পাখি শীতের সকালে গান গেয়ে বলে, ‘বেরিয়ে আয় না আমার কাছে, রঙিন জগতে।’ স্মৃতি জাগায় বহুকাল আগের। মন চায় বাড়ি ফিরতে, বোঝা বাঁধাছাঁদা করে। স্বপ্নে দেখে বহুকাল আগের ছেড়ে-আসা বাড়ি ঘর ঘাট মাঠ গাছ। তার পর সব শেষে প্রকৃতিমাতা দেখা দেন নিশাপরীর মত। নীল ডানায় ঢাকা আকাশ, ঘরের সন্ধ্যাপ্রদীপ ধরে একটুখানি আলো। এই হল শিল্পীর জীবনের ধারার একটু ইতিহাস। শুধুই উজানভাটির খেলা। উজানের সময় সব কিছু সংগ্রহ করে চলতে চলতে ভাঁটার সময়ে ধীরে ধীরে তা ছড়িয়ে দিয়ে যাওয়া। বসন্তে যখন জোয়ার আসে ফুল ফুটিয়ে ভরে দেয় দিকবিদিক, আবার ভাঁটার সময়ে তা ঝরিয়ে দিয়ে যায়। আমারও যাবার সময়ে যা দুধারে ছড়িয়ে দিয়ে গেলুম তোমরা তা থেকে দেখতে পাবে, জানতে পাবে, কত ঘাটে ঠেকেছি, কত পথে চলেছি, কি সংগ্রহ করেছি ও সংগ্রহের শেষে নিজে কি বকশিশ পেয়ে গেছি। এতকাল চলার পরে বকশিশ পেলুম আমি তিন রঙের তিন ফোটা মধু।
অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর
অন্তর বাহির অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর অন্তর বাহির ফটোগ্রাফের সঙ্গে ফটোকর্তার যোগ পুরো নয়—পাহাড় দেখলেম ক্যামেরা খুল্লেম ছবি উঠলো ফটোকর্তার অন্তরের সঙ্গে পাহাড়ের যোগাযোগই হল না। এইজন্যে আর্টিষ্টের লেখা পাহাড় যেমন মনে গিয়ে পৌঁছয়, ফটোতে লেখা পাহাড় ঠিক তেমন ভাবে মানুষকে স্পর্শ করতে পারে না—শুধু চোখের উপর দিয়েই ভেসে যায় বায়স্কোপের ছবি, মনের মধ্যে তলিয়ে যায় না। খবরের কাগজ খবর দিয়েই চল্লো অনবরত, আজ পড়লেম দুদিন পরে ভুল্লেম। কবি গান গেয়ে গেলেন, শিল্পী রচনা করে গেলেন, চোখ কাণের রাস্তা ধরে’ মর্মে গিয়ে পৌঁছোল গান ও ছবি। ক্যামেরার মতে চোখ খুল্লেম বন্ধ করলেম, একই বস্তু একই ভাবে বারম্বার এল কাছে,—এ হ’ল অত্যন্ত সাধারণ দেখা। শিল্পীর মতো চোখ মেল্লেম বস্তু জগতের দিকে, রূপ চোখে পড়লো এবং সঙ্গে সঙ্গে মনের মধ্যে রূপাতীত রসের উদয় হ’ল। ফটোগ্রাফ বস্তু জগতের এক চুল ওলট-পালট করতে অক্ষম, কিন্তু শিল্পীর কল্পনা যে বরফের হাওয়া পেলে—ফটোগ্রাফের মধ্যে যতটা বস্তু তার সমস্তটা পালাই পালাই করে—সেই বরফের চূড়ায় হর-গৌরীকে বসিয়ে দিলে বিনা তর্কে। চোখের দেখা ও মনের দেখা দিয়ে শিল্পী যখন মিল্লেন চোখের সামনে বিদ্যমান যা এবং চোখের বাইরে অবিদ্যমান যা তার সঙ্গে, তখন নিয়তির নিয়ম উল্টে গেল অনেকখানি—দেবতা সমস্ত এসে সামনে দাঁড়ালো ঠিক মানুষের মতই দুই পায়ে কিন্তু অসংখ্য হাত অসংখ্য মাথা নিয়ে, নিচের দিকে রইলো বাস্তব উপরে রইলো অবাস্তব, সম্ভবমতো হ’ল দুই পা, অসম্ভব রকম হ’ল হাত ও মাথা, সৃষ্টির নিয়ম মিল্লো গিয়ে অনাসৃষ্টির অনিয়মে। ফটোগ্রাফের যে কৌশল তা বস্তুর বাইরেটার সঙ্গেই যুক্ত আর শিল্পীর যে যোগ তা শিল্পীর নিজের অন্তর-বাহিরের সঙ্গে বস্তুজগতের অন্তর-বাহিরের যোগ এবং সেই যোগের পন্থা হ’ল কল্পনা এবং বাস্তব ঘটনা দুয়ের সমন্বয় করার সাধনাটি। নির্ভুলে ব্যাকরণ ও পরিভাষা ইত্যাদি দিয়ে যেমনটি-তাই ঘটনাকে বলে’ যাওয়া হ’লেই যে বলা হ’ল তা নয়, তা যদি হ’ত তো সাহিত্য খবরের কাগজেই বদ্ধ থাকতো। তেমনি যা-তা এঁকে চলা মানে শিল্পের দিক থেকে বেঁকে ফটোগ্রাফের দিকে যাওয়া, সুর ছেড়ে হরিবোলার বুলি বলা। অবিদ্যমানকে ছেড়ে বিদ্যমানে বর্তে’ নেই একদণ্ড এই সৃষ্টি এবং কল্পনাকে ছেড়ে শুধু ঘটনার মধ্যে বর্তে’ থাকতে পারে না মানুষের রচনা, ঘটনার সঙ্গে কল্পনার মিলন হ’ল তবে হ’ল একটা শিল্প রচনা। গাছ দাঁড়িয়ে রইলো কিন্তু ফুল পাতা এরা দুল্লো, কখনো আলোর দিকে মুখ ফেরালে কখনো অন্ধকারের দিকে হাত বাড়ালে। মানুষ বাঁধা রইলো মাটির সঙ্গে কিন্তু মন তার বিদ্যমান অবিদ্যমান দুই ডানা মেলে উড়লো, মানুষের শিল্প তার মনের পাখীর গতিবিধির চিহ্ন রেখে গেল কালে কালে—পাথরে, কাগজে, মাটিতে, সোণায়, কাঁসায়, কাঠে, কয়লায়। ইতর জীব তার বর্তমানটুকুর ঘেরে বাঁধাই রয়েছে, বিদ্যমানের প্রাচীর ছাড়িয়ে যাওয়া শুধু মানুষেরই সাধ্য হয়েছে—ঘোড়া সে কোনকালে পক্ষিরাজ হবার কল্পনাই করতে পারলে না কিন্তু মানুষ অতিমানুষের কল্পনা অমানুষি সমস্ত রচনার স্বপ্ন দেখলে, বিদ্যমানের মধ্যে মানুষ আপনাকে ইতর জীবের মতো নিঃশেষে ফুরিয়ে দিতে পারলে না; সে কল্পনা ও স্মৃতি এই দুই টানা-পোড়েনে প্রস্তুত করে’ চল্লো বিশ্বজোড়া মায়াজাল। সে ঘুমিয়ে স্বপন দেখলে, জেগে স্বপন দেখলে, বিদ্যমান থেকে অবিদ্যমান পর্যন্ত তার মন এল গেল—অবিদ্যমানকে আনলে, অনাবিষ্কৃতকে করলে আবিষ্কার। পাখীরা যে সুর পেলে সেই সুরেই গেয়ে গেল, অনাহত সুরের সন্ধান তারা পেলে না; দেওয়া সুরে গাইলে কোকিল, দেওয়া সুরেই ডাকলে ময়ূর, কিন্তু মানুষের গলায় অবিদ্যমানের সুর পৌঁছোলো—অনাহত তারের অপ্রকাশিত সুর, তাই শুনে বিশ্বজগৎ হরিণের মতো কাণ খাড়া করে’ স্তব্ধ হয়ে রইলো, অগোচর রূপ সাগরের জল মানুষ ছুঁয়ে এল, তার হাতের পরশে ফুটলো বিচিত্র ছবি বিচিত্র শিল্পকলা, আর একটি নতুন সৃষ্টি—পলে পলে কালে কালে যা নতুন থেকে নতুনতর রাজত্বে চলেছে তো চলেছেই! বিদ্যমান এবং অবিদ্যমান এই দুই ডানার উত্থানপতনের গতি ধরে’, চলেছে মানুষের মনের সঙ্গে মানুষের মানস-কল্পনার প্রকাশগুলি। অবিদ্যমানকে বিদ্যমানের মধ্যে ধরে’ দিচ্ছে মানুষ, অন্তরকে আনছে বাইরে, বাইরেকে নিয়ে চলেছে অন্তরে,—এই হ’ল শিল্প-রচনার মূলের কথা। শিল্প এলো সামনে, পিছনে লুকিয়ে রইলো শিল্পী,—এই হ’ল শিল্পের সঠিক লক্ষণ। ময়ূর শিল্পী নয় কেননা সে তার চালচিত্র আড়াল করে’ নিজেকে সামনে ধরে’ দেয়। রচনাকে ঠেলে বেরিয়ে এলো সুচতুর রচয়িতা এটা একটা মস্ত দোষ, ছবিটাকে আড়াল করে’ ছবি-লিখিয়ে তাড়াতাড়ি তোড় জোড় নিয়ে যদি সামনে দাঁড়ায়, ছবির কোণের নামটা এবং তুলির টানটাই দেখবার বিষয় বলে, তবে সে লোককে কি সওয়া যায় চিত্রবিদ্ বলে’? অবিদ্যমানের দিকে, কল্পনার দিকে, অগোচরের দিকে যে চিরন্তন টান রয়েছে সমস্ত শিল্পের সমস্ত শিল্পীর, এটা যে না বোঝে চিত্রের বিচিত্র রহস্য সে বোঝে না, তার কাছে বাস্তব ও কাল্পনিক দুয়েরই অর্থ অজ্ঞাত থেকে যায়, দাঁড়ে বাঁধা পাখীর মতো শিল্প শাস্ত্রের বুলিই সে আউড়ে চলে অনর্গল; যথা—“সশ্বাস ইব যচ্চিত্রং তচ্চিত্ৰং” কিম্বা “তরঙ্গাগ্নিশিখাধূমং বৈজয়ন্ত্যম্বরাদিকং। বায়ুগত্যা লিখেৎ যস্তু বিজ্ঞেয়ঃ স তু চিত্রবিৎ॥” অথবা “সুপ্তং চেতনাযুক্তং মৃতং চৈতন্যবর্জ্জিতং। নিম্নোন্নতবিভাগঞ্চ যঃ করোতি স চিত্রবিৎ॥” যে ওস্তাদ বোল সৃষ্টি করে সে বোঝে বোলের মর্ম কিন্তু খোল সে বোল বলে মাত্র, বলে কিন্তু বোঝে না বোলের সার্থকতা অথবা প্রয়োগের কৌশল। মানুষের লেথা পুঁথিগত শিল্পের চেহারা এক, আর মানুষের মনোমত করে’ রচা শিল্পের রূপ অন্য। শাস্ত্রকার চাইলেন শিল্পী আঁকুক ঠিক ঠিক তরঙ্গ অগ্নিশিখা ধূম নিম্ন উন্নত সুপ্ত মৃত জীবিত এক কথায় সশ্বাস ইব চলন্ত বলন্ত ইংরাজীতে যাকে বলি life-like ছবি—কিন্তু ভারতবর্ষ থেকে আরম্ভ করে’ পূর্ব পশ্চিমের বিস্তার ছাড়িয়ে যে শিল্পলোক এবং কল্পনার রাজ্য তার যে অধিবাসী তারা এঁকে চল্লো এর ঠিক বিপরীত, শুধু নকলনবিশেরাই ধরে’ রইলো সামনে বিদ্যমান শাস্ত্রের বচন ও বস্তুজগৎ।—“Do not imitate; do not follow others—you will be always behind them”—Corot. আসল মেঘ চলে’ যায় পলে পলে রূপ বদলাতে বদলাতে, নকল মেঘের বদল নাই, এটা শাস্ত্রকার পণ্ডিতের ঢের আগে শিল্পী আবিষ্কার ক’রে গেছে, তাই সে বলেছে—অনুসরণ, অনুকরণ, অনুবাদ এ সব করলে পিছিয়ে পড়বে, পটের ‘সশ্বাস ইব’ অবস্থায় স-শে-মি-রা হয়ে হবে পুঁথির ও পরের তল্পিদার মাত্র, শিল্পী হবে না শিল্পকে পাবে না—“Nothing is so tiring as a constant close imitation of life one comes back inevitably to imaginative work”—Weertz. “তরঙ্গাগ্নিশিখাধূমং বৈজয়ন্ত্যম্বরাদিকং বায়ুগত্যা লিখেৎ যস্তু বিজ্ঞেয়ঃ স তু চিত্রবিৎ,” অথবা “সুপ্তবৎ চেতনাযুক্তং মৃতং চৈতন্যবর্জ্জিতং নিমোন্নতবিভাগঞ্চ যঃ করোতি স চিত্রবিৎ”—এ হ’ল শিল্পে বাস্তবপন্থীর কথা—যেন ঢেউ উঠছে পড়ছে, যেন আগুন জ্বলছে, নিশান লট্‌পট্ করছে, আঁচল উড়ছে বাতাসে, যেন ঘুমন্ত যেন জীবন্ত যেন মৃত যেন নিম্নোন্নত,—এক কথায় ‘সশ্বাস ইব’ হ’ল চরম কথা। কিন্তু এই মতের অনুসরণে গিয়ে কি মানুষ অনুকরণেই ঠেকে রইল না শিল্পী সে ছবি লিখে চল্লো বায়ুর চেয়ে গতিমান কল্পনার সাহায্যে নিজের বর্ণ ও রেখা সমস্তকে কখন তরঙ্গায়িত, শিখায়িত, ধূমায়িত ক’রে দিয়ে—এমন মেঘ এমন আগুন, এমন সমুদ্রের এমন ঢেউ যা বাস্তব জগতে দেখেনি কেউ! শিল্পের জয়পতাকা কল্পনার বাতাসে উড়ে’ অচেতন রেখা চেতন হয়, সচেতন রং ঘুমিয়ে পড়ে কল্পনার সোনার কাঠির স্পর্শে, শয়ন ছেড়ে জেগে ওঠে মনের মধ্যেকার সুপ্ত ভাব, স্থির বিদ্যুল্লেখার মতো শোভা পায় স্বপ্নপুরের অলক্ষ্য রূপরেখা! কল্পনার যেখানে প্রসার নেই সেখানে রেখা শুধু দপ্তরীর রুলটানা, আলো-ছায়া, আনাটমি পারস্‌পেক্‌টিভ ইত্যাদির ঘূর্ণাবর্ত, শুধু কুস্তির মারপেঁচ, ভূষণ সেখানে বারাঙ্গনার সাজের মতো অপদার্থ এবং বর্ণ সেখানে বহুরূপীর রং চং করা সং মাত্র, তা সে শাস্ত্রমতো অনুলোম পদ্ধতিতেই আঁকা হোক বা প্রতিলোম পদ্ধতিতেই টানা হোক। “To make a thing which is obviously stone, wood or glass speak is a greater triumph than to produce wax-works or peep-shows—Rodin. শিল্পী কতখানি প্রকাণ্ড কল্পনা নিয়ে বাস্তব জগৎ থেকে সরে’ দাঁড়ালো যখন সে কাঠ পাথর কাগজকে কথা বলাতে চাইলে! শিল্পের প্রাণ হচ্ছে কল্পনা, অবিদ্যমানের নিশ্বাস। চৌরঙ্গীর মার্কেটে যে মোমের পুতুলগুলো বিক্রী হচ্ছে তারা একেবারে ‘সশ্বাস ইব’, চোখ নাড়ে ঘাড় ফেরায় হাসে কাঁদে “পাপা” “মামা” বলেও ডাকে কিন্তু ‘ইব’ পর্যন্তই তার দৌড়! কোন শিল্পী যদি শিল্পশাস্ত্র লিখতে চায় তবে এই ‘ইব’ কথাটি তার চিত্রশব্দ-কল্পদ্রুম থেকে বাদ দিয়ে তাকে লিখতে হবে ‘সশ্বাস ইব’ নয় ‘সশ্বাসং যচ্চিত্রং তচ্চিত্রং’। শিল্পীর মানস কল্পনা যে কল্পলোকের দিব্য নিশ্বাসে প্রাণবন্ত হয় সে হাওয়া কি এই বাতাস যা ঐ লাট প্রাসাদের নিশান দুলিয়ে গড়ের মাঠের ধূলোয় কলের ধূলোয় মলিন হ’য়ে আমাদের নাকে মুখে দিবারাত্রি যাওয়া আসা করছে? আর্টিষ্টদের মনোরথ যে বাতাস কেটে চলে সে বাতাস হচ্ছে এমন এক তরল হাওয়া যার উপর পালকের ভার সয় না অথচ বিশ্বরচনার ভার সে ধরে’ আছে! শিল্পশাস্ত্র খুবই গভীর, তার একটা লাইনের অর্থ হাজার রকম, কিন্তু তার চেয়ে গভীর জিনিষ হ’ল শিল্প, যার একটা লাইনের মর্ম ঝুড়ি ঝুড়ি শিল্পশাস্ত্রেও কুলোয় না, আবার শিল্পের চেয়ে গভীর হ’ল শিল্পীর মন যার মধ্যে বহির্জগৎ তলিয়ে রইলো—স্মৃতির শুক্তিতে ধরামুক্তি, নূতন জগৎ সৃষ্টি হল জলের মাঝে বড়বানল। এই যে শিল্পীর মন এর কাজই হল বাইরে গিয়ে আবিষ্কার এবং ভিতরে থেকেও আবিষ্কার, আবির্ভূত যে জগৎ এই গাছ-পালা জীবজন্তু আকাশ আলো এর সামনে এসে শিল্পীর মন থমকে দাঁড়িয়ে শুধু নকল নিয়ে খুসী হয় না সে খুঁজে খুঁজে ফেরে অনাবিষ্কৃত রয়েছে যা তাকে! শিল্পীর মন দেহপিঞ্জরের অন্তঃপুরে যাদুঘরের মরা পাখীর মতো দিন রাত সুখে দুঃখে সমভাবে থাকে না—সে বোধ করে স্বপন দেখে স্বপন রচনা করে’ চলে অসংখ্য অদ্ভুত অতি বিচিত্র! নিছক ঘটনা আর নিছক কল্পনা এ দু’য়েরই কথা শাস্ত্রকার লিখলেন। এক দিকে বলা হ’ল “সশ্বাস ইব যচ্চিত্রং তচ্চিত্ৰং শুভলক্ষণম্”, দর্পণে যে প্রতিবিম্ব পড়ে তার চেয়ে সচল সশ্বাস,—রূপে প্রমাণে ভাবে লাবণ্যে সাদৃশ্যে বর্ণিকাভঙ্গে সম্পূর্ণ চিত্র আর কিছুই হ’তে পারে না। কিন্তু সবাই তো এ বিষয়ে এক মত হ’তে পারলে না; এর ঠিক উল্টো রাস্তা ধরে’ একদল শাস্ত্রকার বল্লেন—“অপি শ্রেয়স্করং নৃণাং দেববিম্বমলক্ষণম্। সলক্ষণং সত্যবিম্বং ন হি শ্রেয়স্করং সদা॥” কিছুর প্রতিকৃতি সম্বন্ধে স্পষ্ট কথা বলা হ’ল—“মানবাদীনামস্বর্গ্যাণ্যশুভানি চ।” শাস্ত্র পড়ে’ শিল্পী হ’তে চল্লে এই দোটানা সমস্যায় পড়ে’ হাবুডুবু খেতে হবে; নানা মুনির নানা মত! মানুষের শিল্প যে নানা রাস্তা ধরে’ চলেছে তার অন্ধি সন্ধি এত যে তার শেষ নেই, বিদ্যমান এবং অবিদ্যমান ঘটনা এবং অঘটন কল্পনা এই দুই খাত রেখে চলেছে শিল্পের ধারা—কিন্তু এই দুয়েরই গতি কোন্ দিকে—রসসমুদ্রের দিকে, এ দুয়েরই উৎপত্তি কোন্ খানে–রসের উৎসে, সুতরাং ভারত শিল্পই বল আর যে শিল্পই বল রসের সংস্পর্শ নিয়ে তাদের বিচার। শিল্পে বাস্তবিকতা কিম্বা অবাস্তবিকতা কোন্‌টা প্রয়োজনীয় একথার উত্তর শাস্ত্রকার তো দিতে পারে না! শাস্ত্ৰ হ’ল নানা মুনির নানা মতের সমষ্টি এবং নানা শিল্পের নানা পথে পদক্ষেপের হিসাবের খাতা মাত্র, কাজেই শাস্ত্র পড়ে’ শিল্পের স্বরূপ কেমন করে’ ধরা যাবে? সমুদ্র ঘাঁটলে মাছ ওঠে নুন ওঠে মুক্তাও ওঠে কিন্তু হীরক ওঠে না, সেখানে মাটি ঘাঁটতে হয় যে মাটিতে শিল্পী জন্মেছে ও গড়েছে। শাস্ত্র ঘাঁটলে শাস্ত্রের বচন পাই শাস্ত্রজ্ঞান পাই, শিল্পীর রচনা-রহস্য ও শিল্পজ্ঞান শিল্পের মধ্যেই গোপন রয়ে’ যায়। শাস্ত্রকার যখন ছিল না এমন দিনও তো পৃথিবীতে একদিন এসেছিল, সে সময়কার শিল্পী শাস্ত্র না পড়েও শিল্পজ্ঞান লাভ করে গেছে—জগতের সমস্ত আদিম অধিবাসীদের শিল্পকলা এর সাক্ষ্য দিচ্ছে—এই অাদিম শিল্পচর্চা করে’ দেখি মানুষ জলের রেখা, ফলের ডৌল, পাখীর পালক, মাছের আঁষ এমনি নানা জিনিষের স্মৃতি কল্পনার সঙ্গে মিলিয়ে সাজাচ্ছে ঘাটি-বাটি কাপড়-চোপড় অস্ত্ৰ-শস্ত্র সমস্ত জিনিষের উপরে এমন কি মানুষের নিজের গায়ের চামড়ায় পর্যন্ত স্মৃতি ও কল্পনার জাল পড়েছে! মানুষের চিরসহচরী এই কল্পনা ও স্মৃতি, শিল্পের দুই পার্শ্বদেবতা! বিদ্যমান জগৎ বাঁধা জগৎ, আর কল্পনার জগৎ সে অবিদ্যমান, কাজেই বাঁধা জগতের মতো সসীম নয়। অনন্ত প্রসার মানুষের কল্পনার,—তেপান্তর-মাঠের ক্ষীর-সমুদ্রের ইন্দ্রলোক-চন্দ্রলোকের। বিদ্যমান জগৎ নির্দিষ্ট রূপ পেয়ে আমাদের চারিদিকে স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে গেছে—তাল, বট, তেঁতুল, কোকিল, ময়ূর, কাক, গরু, বাছুর, মানুষ, হয়, হস্তী, সিংহ, ব্যাঘ্র এরা কালের পর কাল একই রূপ একই ভঙ্গি একই সুর নিয়ে খালি আসা যাওয়া করছে। পৃথিবীটা খুব বড় এবং এখনো মানুষের কাছ থেকে আপনার অনেক রহস্য সে লুকিয়ে রেখেছে, তাই এখনো মানুষ উত্তরমেরু ধবলগিরি অতিক্রম করার কল্পনা করছে, দুদিন পরে যখন এ দুটো জায়গাই মানুষের জানা জগতের মধ্যে ধরা পড়বে তখন মানুষের চাঁদ ধরার কল্পনা সত্য হয়ে উঠবার দিকে যাবে! এমনি বাস্তব এবং কল্পনা, কল্পনা ও বাস্তব এই দুটি পদচিহ্ন রেখে চলেছে ও চলবে মানুষ সত্য ত্রেতা দ্বাপর কলি এবং তার পরেও নতুন যুগে যে সব যুগ এখনো মানুষের কল্পনার মধ্যেই রয়েছে! অঘটিত ঘটনা অবিদ্যমান সমস্ত কল্পনা আজ যেগুলো মানুষের মনোরাজ্যের জিনিষ সেগুলো কালে সম্ভব হয়ে উঠবার প্রতীক্ষা করছে না, জোর করে’ একথা কে বলতে পারে? এক যুগের খেয়ালী যা কল্পনা করলে আর এক যুগে সেটা বাস্তব হয়ে উঠলো, এর প্রমাণ মানুষের ইতিহাসে বড় অল্প নেই, কতযুগ ধরে পাখীদের দেখাদেখি মানুষ শূন্যে ওড়ার কল্পনা করে এল, এতদিনে সেটা সত্যি হয়ে উঠলো কিন্তু এতেও মানুষের কল্পনা শেষ হ’ল না, ওড়ার নানা ফন্দি ডানায় বিনা ডানায়, এমনি নানা কল্পনায় মানুষের মন বিদ্যমানকে ছেড়ে চল্লো অবিদ্যমানের দিকে। হঠযোগ থেকে গরুর গাড়ি, ঘোড়ার গাড়ি, ইষ্টিম গাড়ি, দুচাকার গাড়ি, শেষে হাওয়া গাড়ি এবং উড়োজাহাজে কল্পনা এসে ঠেকেছে কিন্তু ওড়ার কল্পনা এখনো শেষ হয় নি, রাবণের পুষ্পক রথে গিয়ে ঠেকলেও মানুষ আরো অসম্ভব অদ্ভুত রথের কল্পনা করবে না তা কে বলতে পারে? দেশলাইয়ের কল্পনা চকমকি থেকে এখন মেঘের কোলের বিদ্যুতে গিয়ে ঠেকেছে কিন্তু এখনো নিম্প্রভ আলো তাপহীন আগুন এ সমস্তই অবিদ্যমানের কোলে দুলছে একদিন বিদ্যমান হবার প্রতীক্ষায়। অবিদ্যমান হচ্ছে বিদ্যমান সমস্তের জননী, অজানা প্রসব করছে জানা জগৎ, অসম্ভব চলেছে সম্ভব হ’তে কল্পনার সোপান বেয়ে। “অন্ধকারের দ্বারা অন্ধকার আবৃত ছিল, সমস্তই চিহ্নবর্জিত ছিল, অবিদ্যমান বস্তুর দ্বারায় সর্বব্যাপী আচ্ছন্ন ছিলেন, বুদ্ধিমানগণ বুদ্ধিদ্বারা আপন হৃদয়ে পর্যালোচনাপূর্বক অবিদ্যমান বস্তুতে বিদ্যমান বস্তুর উৎপত্তিস্থানে নিরূপণ করিলেন।” আগে সৃষ্টির কল্পনা তবে তো সৃষ্টি! ইউরোপের স্বরগ্রামে শুনেছি আগে নিখাদ স্বরটা একেবারে অজ্ঞাত ছিল হঠাৎ এক খেয়ালী সেই অজানা সুরের কল্পনা ধরে বসলে এবং তারি সন্ধানে মরীচিকালুব্ধের মতো ছুটলো অবিদ্যমান যে সুর তাকে বিদ্যমান করতে চেয়ে! সঙ্গীত তখন ইউরোপে পাদ্রীদের হাতে ধর্মের সেবায় বাঁধা রয়েছে, ছয় সুরের বেশী আর একটা সুরের কল্পনা পাদ্রী সঙ্গীতবেত্তার কাছে অমার্জনীয় ছিল, খেয়ালী লোকটার নির্বাসনদণ্ড ব্যবস্থা হয়ে গেল, সে একটা কাল্পনিক সুরের জন্যে ঘর ছাড়লে, দেশ ছাড়লে, নির্যাতন সইলে, তারপর যে সুর কল্পনায় ছিল তাকে বিদিত হ’ল সে নিজে এবং বিদিত করে’ গেল বিদ্যমান জগতে। এমনি একটার পর একটা সুরের পাখী ধরে গেছে কল্পনার জালে মানুষ, অনাহতকে ধরে গেছে আহতের মধ্যে। মানুষের সমস্ত কাজে, কর্মে, শিল্পে, সাহিত্যে, জ্ঞানে-বিজ্ঞানে কল্পনাটা প্রথম তারপর বাস্তব,—এই হ’ল রচনার ধারা ও রীতি। কল্পনাটা মানুষের মধ্যে প্রবল শক্তিতে কাজ করে; এই শক্তি সৃষ্টি করার দিকে মানুষের দৈহিক ও মানসিক আর সমস্ত শক্তিকে উদগ্র করে’ দেয়। মাতাল ও পাগলের দেহ বিকল হয়ে গেল, উৎকট কল্পনা তাদের বিকট মূর্তিতে বিদ্যমান হ’ল; কিন্তু যে সুস্থ সাধনের দ্বারায় বিরাট কল্পনা সমস্তকে স্মরণের মধ্যে ধারণ করতে সমর্থ হল সেই বীর হল রূপ ও অরূপ দুই রাজ্যের রাজা, সে হ’ল বীর, সে হ’ল কবি, সে হ’ল শিল্পী, সে হ’ল ঋষি, আবিষ্কর্তা, গুণী, রচয়িতা। কল্পনাপ্রবণতা হ’ল মানুষের পক্ষে স্বাভাবিক অবস্থা, কেননা দেখি কল্পনা তার আশৈশব সহচরী । খেয়াল জিনিষটা বিশ্বসংসারকে পুরোনো হতে দিচ্ছে না মানুষের কাছে, একই আকাশের তলায় একই ঋতু-পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে একটা পৃথিবীতেই চলি-বলি খাই-দাই ঘুমোই, কিন্তু কল্পনায় গড়ে চলি খেলা করি বিচরণ করি আমরা নতুন নতুন জগতে চিরযৌবন, চিরবসন্তের স্বপ্ন নিয়ে। বস্তুজগতের এইটুকু ঘটনার স্মৃতিগুলো বড় হয়ে ওঠে কল্পনায়। মানুষের এত বড় ঐশ্বর্য এই কল্পনা একে হারালে তার মতো দীন ও অধম কে? কোন দিকে অগ্রসর হবার রাস্তা তার বন্ধ হ’ল, কায়ার মায়াহীন প্রাচীরের সুদৃঢ় বন্ধনে সে বন্দী রইলে৷ “সশ্বাস ইব” কিন্তু সশ্বাস মোটেই নয়। কাব্যে পুনরুক্তি একটা মহৎ দোষ; পুনঃ পুনঃ কেবল পুনরুক্তি সেইখানেই চলে যেখানে উক্তকে সমর্থন করতে হয় একটা কথা বারবার বলে। যে ছবি হয়ে গেছে তাকে আবার এঁকে কি লাভ, জানালা দিয়ে দিনরাত চোখে পড়ছে যে আকাশ ও মাঠ ঘর বাড়ি সেটার সঠিক প্রতিচ্ছবি কি দরকার মানুষের, যদি না সে স্মৃতির সঙ্গে কল্পনাকে এক করে দেখায়। কল্পিত থেকে বঞ্চিত বাস্তবটা হ’ল মানুষের কাটা হাত পায়ের মতো বিশ্ৰী জিনিষ, মৃতদেহ সেও স্মৃতি জাগায় কল্পনা জাগায় কিন্তু আসলের নকল কিম্বা আসলের থেকে বিচ্ছিন্ন যেটা সেটা প্রাণে বাজে না, বিশ্রী রকমে কানে বাজে চোখে বাজে। বিদ্যমান বস্তুর প্রতিকৃতি প্রতিবিম্ব সঠিক নকল ইত্যাদির মধ্যেই যারা আর্টকে বন্ধ করে স্মৃতি ও কল্পনার থেকে বিচ্ছিন্ন করে নিতে চায় কিম্বা অবিদ্যমানকে বিদ্যমানের সম্পর্ক থেকে ছিনিয়ে নিয়ে উন্মত্তকে অবাধ্যতা দিয়ে ছেড়ে দিতে চায় অনির্দিষ্ট পথে তারা শাস্ত্রকার হ’লেও তাদের কথা শোনায় বিপদ আছে। এমনে লোক আছে যার নেশায় চোখ এমন বুঁদ হয়ে গেছে যে দিন কি রাত, উত্তম কি অধম, বস্তু কি অবস্তু সব জ্ঞান তার লোপ পেয়েছে—টলে’ পড়ার দিকেই যার ঝোঁক; আবার এমনো লোক আছে যার চোখে রঙ্গ রসের নেশা একেবারেই লাগলো না, সে গট্‌ হয়ে বসে আছে সাদা চোখে সাদা-সিধে লোকটি, একজন বকে’ চলেছে প্ৰলাপবাক্য আর একজন কিছুই বলছে না বা বলছে সাদা কথা, —শিল্পজগতে এই দু’জনের জন্যই স্থানাভাষ। নাটকের মধ্যে যেখানে মাতলামি দেখাতে হয় সেখানে একটা সত্যিকার মাতাল এনে ছেড়ে দিলে সে কুকাণ্ড বাধায়, অন্যদিকে আবার যার কোন কিছুতে মত্ততার লেশ নেই তাকে এনে রঙ্গমঞ্চে ছেড়ে দিলেও সেই বিপদ, দুই পক্ষই যাত্রা মাটি করে’ বসে’ থাকে। মাতলামির রং যার চোখে ইচ্ছা মতো আসে যায়, নেশা যার চোখের আলো মনের গতিকে নিস্তেজ করে’ বাস্তব অবাস্তব দুয়ের বিষয়ে অন্ধ ও আতুর করে দেয় না, সেই হয় আর্টিষ্ট, মনকে মনের দিকে কল্পনাকে বাস্তবের স্মৃতির দিকে অবিদ্যমানকে বিদ্যমানের দিকে অভিনয়ন করেন আর্টিষ্ট ‘সশ্বাস ইব’ স-শে-মি-রা অবস্থায় নয়, মোহগ্ৰস্ত বা জীবন্মৃত নয় কিন্তু রসের দ্বারায় সঞ্জীবিত প্রস্ফুটিত। শিল্পশাস্ত্র ঘাঁটতেই যদি হয় তবে গোড়াতেই আমাদের দুটো বিষয়ে সজাগ থাকতে হবে- কোনটা মত এবং কোনটা মন্ত্র এ দুয়ের সম্বন্ধে পরিষ্কার ধারণাটি নিয়ে কাজ করতে হবে। মত জিনিষটা একজনের, দশজনে সেটা মানতে পারে নাও মানতে পারে, একের কাছে যেটা ঠিক অন্যের কাছে সেটা ভুল, নানা মুনির নানা মত। মন্ত্রগুলি সম্পূর্ণ আলাদা জিনিষ। মত একটা লোকের অভিমতকে ধরে প্রচারিত হল আর মন্ত্র প্রকাশ করলে আপনাকে সব দিক দিয়ে যেটা সত্য সেইটে ধরে। শিল্পশাস্ত্রে মত এবং মন্ত্র দুটোই স্থান পেয়েছে, মতকে ইচ্ছা করলে শিল্পী বর্জন করতে পারেন কিন্তু মন্ত্রকে ঠেলে ফেলা চলে না। “যথা সুমেরুঃ প্রবরো নগানাং যথাণ্ডজানাং গরুড়ঃ প্রধানঃ। যথা নরাণাং প্রবরঃ ক্ষিতীশ স্তথা কলানামিহ চিত্রকল্পঃ॥” খণ্ড খণ্ড অনেকগুলো সত্য দিয়ে এটা বলা হ’লেও সমস্ত শ্লোকটা কলাবিদ্যার সম্বন্ধে একটা প্রকাণ্ড অহমিকা নিয়ে মত আকারে প্রকাশ পাচ্ছে। যে রাজভক্ত তার কাছে ক্ষিতীশচন্দ্র হলেন শ্রেষ্ঠ কিন্তু এমন অনেক ফটিকচাঁদ আছে রাজাও যার পায়ে মাথা লোটায়। এ ছাড়া চিত্রকলাই সকল কলার শ্রেষ্ঠ কলা একথা একেবারেই অসত্য কেননা গীতকলা কাব্যকলা নাট্যকলা এরা কেউ কমে যায় না! মতের মধ্যে এই একটা মস্ত ফাঁক আছে, মন্ত্রে কিন্তু তা নেই দেখ—শরীরেন্দ্রিয় বর্গস্য বিকারাণাং বিধায়কা ভাবাঃ বিভাবজনিতশ্চিত্তবৃত্তয় ঈরিতাঃ—এ সত্যের দ্বারায় পরখ করা জিনিষ, এ মন্ত্র-শিল্পীকে সুমন্ত্রণ দিচ্ছে ভাব ও তার আবির্ভাব সম্বন্ধে, অতএব এতে কারু দুইমত হবার কথা নয় কিন্তু “দৌর্বল্যং স্থূলরেখত্বং অবিভক্তত্বমেব চ। বর্ণানাং সঙ্করশ্চাত্র চিত্রদোষা প্রকীৰ্ত্তিতাঃ॥” এটা একটা লোকের মত, মন্ত্রের মতো খুব সাচ্চা জিনিষ নয়, এর মধ্যে অনেকখানি সত্য এবং মিথ্যাও লুকিয়ে আছে, দৌর্বল্য, স্থূলরেখত্ব অবিভক্তত্ব বর্ণসঙ্করত্ব হ’ল চিত্রদোষ কিন্তু কিসের দৌর্বল্য কিসের অবিভক্তত্ব টীকা না হলে বোঝা দুষ্কর, তা ছাড়া এসব দোষ যে চিত্রে কোন কাযে আসে না তা নয় এ সবই চাই চিত্রে, বর্ণসঙ্কর না হ’লে মেঘলা আকাশ সূর্যোদয় এমন কি কোন কিছুই আঁকা চলে না, অমিশ্র বর্ণ সে এক ছবি দেয়। মিশ্রবর্ণ সে অন্য ছবি দেয়, ফুলের বোঁটার টান দুর্বল গাছের গুঁড়ির টান সবল দুর্বল স্থূল, সূক্ষ্ম সব রেখা সব বর্ণ ভাব ভঙ্গি মান পরিমাণ সুর এমন কি বেসুর তা তো অনেক সময় দোষ না হয়ে গুণই হয়ে ওঠে গুণীর যাদুমন্ত্রে। এইবার শিল্পের একটা মন্ত্র দেখ, পরিষ্কার সত্য কথা—“রূপভেদা: প্রমাণানি ভাবলাবণ্যযোজনম্‌॥ সাদৃশ্যং বর্ণিকাভঙ্গ ইতি চিত্ৰং ষড়ঙ্গকম॥” ভারতবর্ষ থেকে ওদিকে আমেরিকা কোন দেশের কোন চিত্রবিদ এর উল্টো মানে বুঝে, ভুল করবে না, কেননা চিত্রকরের কারবারই হল এই ছটার কোনটা কিম্বা এর কোন কোনটাকে নিয়ে। একটা চিত্রে পুরোমাত্রায় এ ছয়টা পাবো না নিশ্চয় কিন্তু দুটো চারটে চিত্র ওল্টালেই বুঝবো কেউ রূপ-প্রধান কেউ প্রমাণ-সর্বস্ব, কেউ ভাবলাবণ্য-যুক্ত, কেউ বর্ণ ও বর্ণিকাভঙ্গে মনোহর, কেউ যড়ঙ্গের দুটো নিয়ে চিত্র, কেউ পাঁচটা নিয়ে হয়েছে ছবি। মত অপেক্ষা রাখে সমর্থনের, মন্ত্র যা তা নিজেই সমর্থ—প্রত্যক্ষ প্রমাণ ও সত্যের দ্বারায় বলীয়ান। ধর্মের যেমন-তেমন শিল্পকলাতেও মানুষ মতও চালিয়েছে মন্ত্রও দিয়েছে। তার মধ্যে মত গুলো দেখি কোনটা চলেছে, কোনটা চলেনি এবং মত ধরে কোন শিল্প ম’রলে, কোনটা আধমরা হয়ে রইলে, কিন্তু শিল্পের মূল মন্ত্রগুলো সেই পৃথিবীর আদিমতম এবং নতুনতম শিল্পে সমানভাবে কায করে চল্লো। মত, খণ্ডন হ’ল মহাকলরবের মধ্যে কিন্তু মন্ত্রের সাধন করে চল্লো মানুষ নীরবে, মানবের ইতিহাসে এটা নিত্য ঘটনা, মানুষের গড়া শিল্পের ইতিহাসেও এর প্রমাণ যথেষ্ট রয়েছে। সাদা মানুষ, সে কালে মানুষ সম্বন্ধে শক্ত মত নিয়ে এগোয় কিন্তু কালো মানুষ পদে পদে সেই মতের সমর্থন করে চলে না কিন্তু মানুষ যেখানে মানুষের কাছে মন্ত্র নিয়ে এগোয়—মানুষে মানুষে অভেদমন্ত্র দয়ার মন্ত্র প্রেমের মন্ত্র— সেখানে মতভেদ হয় না সাদায় কালোয়, তেমনি শিল্পের বাস্তব ও কল্পনা মানুষি ও মানসী, প্রতিকৃতি ও প্রকৃতি, reality ও ideality এই সব নানাদিকে যে সব মতগুলো আছে তা নিয়ে এর সঙ্গে ওর বিবাদ কিন্তু কলাবিদ শিল্প সাধক বাস্তব জগতের এবং কল্পনা জগতের মধ্য থেকে শিল্পের যে সব মন্ত্র আবিষ্কার করেছে সেগুলো গ্রহণ সম্বন্ধে বিচার বিতর্ক অথবা মতামতের কথা কোন দলের কেউ তোলে না। বৌদ্ধযুগ থেকে আরম্ভ করে মোগল এবং ব্রিটিশ আমল পর্যন্ত আমাদের কলাবিদ্যা সমস্ত এমন কি কলাবিদদের আকৃতি প্রকৃতি পর্যন্ত নানামতের চাপনে রকম রকম লক্ষণে চিহ্নিত হয়েছে। এই যে আমাদের নানা কলাবিদ্যার নানা আকৃতি ও প্রকৃতির বিভিন্নতা এগুলো কোন এক কালের শাস্ত্রমত বা লোকমত বা ব্যক্তিবিশেষের মতের সঙ্গে মেলালে দেখবো নিখুঁৎ মিলছে না—অজন্তার অতুলনীয় চিত্র সে হয়ে যাচ্ছে চিত্রাভাষ, মোগল শিল্প হয়ে যাচ্ছে যবন-দোষ-দুষ্ট এবং তার পরের শিল্প হয়ে দাঁড়াচ্ছে সকল দোষের আধার। চীন দোষ, জাপান দোষ, ব্রিটন দোষ, জার্মাণ দোষ,—দোষের অন্ত নেই মতের কাছে। কিন্তু শিল্পশাস্ত্রের মধ্য থেকে শিল্পের মন্ত্রগুলো বেছে নাও এবং সেই সকল মন্ত্র দিয়ে পরখ কর, এক ভারত শিল্পের অসংখ্য অবতারণা ঠিক ধরা যাবে-—ভারত শিল্পের সেই সত্যরূপ যেটি নিয়ে ভারত শিল্প বিশ্বের শিল্পের সঙ্গে এক এবং পৃথক। কোন শিল্পের স্বরূপ শাস্ত্রমতের মধ্যে ধরা থাকে না সেটা শিল্পের নিজের মধ্যেই ধরা থাকে। ভারত শিল্পের কেন সব শিল্পের প্রাণের খোঁজে যে শিক্ষার্থীরা চলবেন তাঁদের এই মত ও মন্ত্রের পার্থক্য প্রথমেই হৃদয়ঙ্গম করা চাই মতকে মন্ত্র বলে ভুল করলে চলবে না। যুদ্ধের সময় দুপক্ষের সেনাপতি মত দেন, কোন পথে কি ভাবে ফৌজ চলবে, ব্যুহ রচনা করবে এবং সেই মতো ম্যাপ প্রস্তুত করে’ নিয়ে ফৌজের চালনা হয়। শিল্পশাস্ত্রকারের মতগুলো এই ম্যাপ, দেশের শিল্প কখন কি মূর্তি ধরেছিল তার প্রথা ও প্রণালীর সুস্পষ্ট ইতিহাস শাস্ত্র থেকে পাওয়া যায় বলে তার মধ্যে কোন একটা পথে যদি আজ আমরা শিল্পকে চালাতে চাই তো এই সব প্রাচীন মত শিল্পে পেটেণ্ট নেওয়ার বেলা খুব কাজে আসবে, দেশের প্রাচীন artএর ইতিহাস লিখতে কাজে আসবে, গত artএর নূতন থিসিস লিখতে কাজে আসবে, এমন কি artist না হলেও art সম্বন্ধে original research লেখার পক্ষেও এই সব মত যথেষ্ট রকম ব্যবহারে লাগবে কেননা এদের copyright বহুদিন শেষ হয়েছে,–কিন্তু শিল্পকে যারা চায় তাদের কাছে এই সব মত বেশী কাজে আসবে না। শিল্পশাস্ত্রের মধ্যে এমন কি বৈদ্যশাস্ত্রের বৈষ্ণব শাস্ত্রের এক কথায় নিখিল শাস্ত্রের অপার সমুদ্রের তলায় ও শিল্পেরই মধ্যে যে সব মন্ত্রগুলো এখানে ওখানে লুকিয়ে আছে সেগুলো উপকারে লাগবে। যে জানতে চায় শিল্পকে তাকে মত ও মন্ত্র দুই উদ্ধার করে করে চলতে হয়। শুধু যুদ্ধক্ষেত্রের ম্যাপ ধরে চল্লেই যুদ্ধে জিৎ হয় না, এটা পাকা সেনাপতি পাকা সেপাই দু’জনেই বোঝে, ম্যাপের সীমানার পরে যে অনির্দিষ্ট সীমানা তার কল্পনা সেনাপতিও ধরে থাকে সিপাহীও ধরে থাকে এবং বীরত্বের যে একটি মন্ত্র দুঃসাহস তাকে মনে পোষণ করে অগ্রসর হয়, জিতলে পুরস্কার হারলে তিরস্কার!” নূতনকে জয়ের কল্পনা তাদের মনকে দোলায়, ম্যাপে দাগা মতামতের উল্টোপথে অনেক সময়ে তারা চলে মন্ত্রের সাধনে শরীর পাতনে, হঠাৎ বেরিয়ে পড়ে তারা মন্ত্রণা করে সেনা ও সেনাপতি, অন্ধকারের মধ্য দিয়ে পথ বিপথ অতিক্রম করে গিয়ে দেয় হানা অজানা পুরীর দরজায়, হঠাৎ দখল হয়ে যায় একটা রাজত্ব যেন মন্ত্রবলে! শিল্পকে পেলে তো কথাই নেই, শিল্পের মন্ত্রগুলো পেলে শিল্প পেতে দেরী হয় না, কিন্তু মতগুলোতে পেয়ে বসলে শাস্ত্রমতে যাকে পাওয়া বলে তাকেই পায় মানুষ, শিল্প রচনাকে পায় না মনোমত মনোগত এ সবের কল্পনাকেও পায় না।
অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর
দৃষ্টি ও সৃষ্টি অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর দৃষ্টি ও সৃষ্টি “Those organs which guide an animal are under man’s guidance and control.” –Goethe লক্ষ্য করবার জন্যেই হল চোখ, শব্দ ধরবার জন্যেই হল কান, হাত পা রসনা সব কটাই হল রূপ রস শব্দ স্পর্শ গন্ধ ধরে’ বিশ্বের চারিদিককে বুঝে নেবার জন্যে। সজীব সব মানুষেরই বুদ্ধির চারিদিকে ইন্দ্রিয় সকল নানা শক্তিশেল নিয়ে খবরদারি কাযে দিনরাত ব্যস্ত রইলো, এই হল স্বাভাবিক ব্যাপার; অথচ অর্জুনের লক্ষ্যভেদ, কিম্বা দশরথের শব্দভেদ এমনি নানা রকম ভেদবিদ্যার কৌশল শিক্‌রে পাখী থেকে আরম্ভ করে শিকারী মানুষে যখন লাভ করলো, দেখলাম তখন সেই জীব অথবা মানুষ নিজের চোখ কান হাত পা ইত্যাদিকে অস্বাভাবিক রকমে অসাধারণ শক্তিমান করে তুল্লে;—এই কথাই বলতে হয় আমাদের। ছেলেকে অক্ষর চিনতে শেখালে, বই পড়তে শেখালে তবে সে আস্তে আস্তে চোখে দেখতে পায় কি লেখা আছে, বুঝতে পারে পড়াগুলো, এবং ক্রমে নিজেই রচনা করার শক্তি পায় একদিন হয়তো-বা। যে মানুষ কেবল অক্ষর পরিচয় করে চল্লো, আর যে অক্ষরগুলোর মধ্যে মানে দেখতে লাগল, আবার যে রচনার নির্মাণ-কৌশল ও রস পর্যন্ত ধরতে লাগলো এদের তিন জনের দেখা শোনার মধ্যে অনেকখানি করে পার্থক্য যে আছে তা কে না বলবে! কাযেই দেখি—শিল্পই বল আর যাই বল কোন কিছুতে কুশল হয় না চোক হাত কান ইত্যাদি, যতক্ষণ এদের স্বাভাবিক কার্যকরী চেষ্টাকে নতুন করে সুশিক্ষিত করে তোলা না যায় বিশেষ বিশেষ দিকে—বিশেষ বিশেষ উপায় আর শিক্ষার রাস্তা ধরে। এই শিক্ষার তারতম্য নিয়ে আমাদের সচরাচর মোটামুটি দর্শন স্পর্শন শ্রবণ ইত্যাদির সঙ্গে শিল্পীর ও গুণীর দেখাশোনার পার্থক্য ঘটে। ছবি কবিতা সুর-সার প্রভৃতি অনেক সময়ে যে আমাদের কাছে হেঁয়ালীর মতো ঠেকে তা দুই দলের মধ্যে এই পরখ ও পরশের পার্থক্য বশতঃই হয়। কথাই আছে—‘কবিতারসমাধুর্য্যম্ কবির্বেত্তি’; ঠিক সুরে সুর মেলা চাই, না হলে যন্ত্র বল্লে ‘গা’, কণ্ঠ বলে উঠলো ‘ধা’। জেগে দেখার দৃষ্টি ধ্যানে দেখার দৃষ্টির সঙ্গে মিলতে তো পারে না, যতক্ষণ না ধ্যানশক্তি লাভ করাই নিজেকে। এই জন্যেই কবিতা সঙ্গীত ছবি এ সবকে বুঝতে হলে আমাদের চোখ কানের সাধারণ দেখাশোনার চালচলনের বিপর্যয় কতকটা অভ্যাস ও শিক্ষার দ্বারায় ঘটাতে হয়, না হলে উপায় নেই। মানুষের সৃষ্টি বুঝতে যদি এই নিয়ম হল তবে সৃষ্টিকর্তার রচনাকে পুরো রকম বুঝে-সুঝে উপভোগ করার ক্ষমতা অনেকখানি সাধনার যে অপেক্ষা রাখে তা বলাই বাহুল্য। “The scene which the light brings before our eyes is inexpressively great, but our seeing has not been as great as the scene presented to us; we have not fully seen! We have seen mere happenings, but not the deeper truth which is measureless joy”—Rabindranath মোটামুটি দৃষ্টি,—তীক্ষ্ণদৃষ্টি, অন্তর্দৃষ্টি, দিব্যদৃষ্টি—এর মধ্যে মোটামুটি রকমের কার্যকরী দর্শন স্পর্শন শ্রবণ ইত্যাদি সমস্ত জীবেরই থাকে; তার উপরে উঠতে হলেই শিক্ষা ও অভ্যাস দিয়ে চক্ষুকর্ণের সাধারণ দেখা শোনার মধ্যে অদল-বদল কিছু না কিছু ঘটাতেই হয়। শিক্‌রে পাখী কতবার তার শিকার হারায় তবে তার চোখ এবং ঠোঁট আর আঙ্গুলের নখরগুলো সুশিক্ষিত হয়ে ওঠে মেঘের উপর থেকে লক্ষ্যভেদ করতে,—একেই বলে ধরার কায়দা, দেখার কায়দা। এই কায়দা ইন্দ্রিয়সকল লাভ করে অনেক দিনের শিক্ষা ও অভ্যাসে। চা খাবার সময় রুটির টুকরো যখন ফেলে দেওয়া যায়, তখন দেখি কাকগুলো সবাই একই কায়দায় সেগুলো এসে ধরে—মাটিতে রুটি পড়েছে যখন, তখন পায়ে পায়ে এগিয়ে এসে ঠোঁটে করে সেটা টপ্ করে তুলে নেওয়াই দেখি সব কাকেরই দস্তুর; কিন্তু চিলগুলো সাঁ করে উড়ে এসে মাটিতে রুটি পৌঁছতে না পৌঁছতে লুফে নিয়ে পালায়। এই নতুন কায়দা আমার সাম্‌নে একটা কাককে দিনে দিনে অভ্যাস করে নিতে এই সেদিন দেখলেম এবং লক্ষ্যভেদ বিদ্যার দখলের সঙ্গে সঙ্গে সাধারণ কাকের দেখাশোনা চালচলন সমস্তই উল্টে-পাল্টে গেল তাও দেখলেম। শুধু ঐ একটুখানি শিক্ষা আর অভ্যাসের দরুণ কাকের মোটা দৃষ্টি বা স্বাভাবিক দৃষ্টি ও চালচলনের ওলট-পালট যদি কাকটা না ঘটাতো, তবে সব কাকদের মধ্যে সে অর্জুন হয়ে উঠতে পারতো না, কিম্বা সময়ে সময়ে চিলটিকেও সে হারিয়ে দিতে পারতো না রুটির লক্ষ্যভেদের সভায় আন্দাজের পরীক্ষায়। কুরু-পাণ্ডবে মিলে একশো পাঁচ ভাই, দ্রোণাচার্য যখন তাদের আন্দাজের পরীক্ষা নিলেন তখন দেখা গেল একশো চার ভায়ের শুধু চোখই আছে,—দৃষ্টি আছে কেবল একমাত্র অর্জুনের! দ্রৌপদীর স্বয়ম্বরের দিন লক্ষ্যভেদের সময় অর্জুনের এই দৃষ্টিরহস্যের হিসেব আরো পরিষ্কাররূপে পরীক্ষা হয়েছিল। পৃথিবীর ধনুর্ধর একত্র হল স্বয়ম্বরে—কৃপ কৰ্ণ নানা বীর, কিন্তু লক্ষ্যভেদের বেলায় কারো চোখ দ্রৌপদীর রূপের প্রভা দেখলে, কারো দৃষ্টি নিজের গলার মণিহারের চমক্ লক্ষ্য করলে, কিন্তু লক্ষ্যভেদের যা আসল সামগ্রী সেটা জলের তলায় ঘূর্ণ্যমান সুদৰ্শন চক্রের প্রতিবিম্বের আড়ালে একটি বিন্দুর আকারে প্রকাশ পাচ্ছিল। সেটার বিষয়ে একেবারেই রাজারা অন্ধ রইলেন, এক অর্জুনের দৃষ্টি সেটা লক্ষ্য করলে ও বিঁধলে। অস্থির হয়ে ভ্রমণ করছে এই দুটি মাত্র আমাদের চোখের দৃষ্টি, একটু অন্ধকারে ঝাপসা দেখে, বেশী আলো পেলেও ঝলসে যাবার মতো হয়, দূরবীণ না হলে খুব দূরের জিনিষ দেখাই হয় না আমাদের! আবার যখন তিলকে দেখি তখন তালকে দেখি না, তাল দেখতে গেলে তিল বাদ পড়ে যায়। তা ছাড়া দৃষ্টি আমাদের সামনেই চলে, পিঠের দিকে যা ঘটছে একেবারেই দেখা সম্ভব হয় না যে চোখ এখন আছে তার দ্বারা। ঘড়ি যেমন শুধু ঘণ্টা প্রহর গুণে গুণে আমাদের জানিয়ে দেওয়া ছাড়া আর কিছু করতে পারে না, গ্রীষ্মের দিন কি শীতের, অথবা দিন দুই প্রহর কি রাত দুই প্রহর, এটা জানাবার সাধ্যই হয়না যেমন ঘড়ির—যতক্ষণ না ঘড়ির মধ্যে কোন একটা বিপর্যয় শক্তি সঞ্চার করে দেওয়া হচ্ছে, তেমনি এই চোখের দৃষ্টির মধ্যে একটু অদল-বদল না ঘটাতে পারলে চোখ আমাদের ওঠা-বসা চলা-ফেরা এমনি কতকগুলো নির্দিষ্ট কাযের সহায় হয়ে যান্ত্রিক ভাবে খবরদারী করতেই নিযুক্ত থাকে। নিত্য চলাচলের পক্ষে যতখানি দরকার শুধু ততটুকু দেখাই, দিনরাতের মধ্যে বস্তু ও ঘটনাগুলোর মোটামুটি খবর পৌঁছে দেওয়াই হয় এদের কায; এই লোক অমুক, ও অমুক, নকিবের মতো এইটুকু ফুকরে যায় চোখ—অমুকের সম্বন্ধে তন্ন তন্ন খবর নেবার অথবা দেবার সময় নেই। একটা গাড়ি এল, চোখ কান চট্‌ করে সেটা ধরলে—মোটামুটি গাড়ির শব্দ, আর একটা আবছায়া, খুঁটিয়ে দেখার সময় নেই। গলির মোড়ে একটা ভিড় জমেছে—তার মাঝে পাহারাওলার লাল পাগড়ীর লাল রংএর ঝাঁজটা মাত্র লক্ষ্য করেই চোখ—মায় যার চোখ তাকে নিয়ে—কোন্ গলি ঘুঁজি দিয়ে কেমন করে যে একেবারে গড়ের মাঠে হাজির হয় তার কোন হিসেব দিতে পারে না! খুব বাঁধা ও খুব প্রয়োজনীয় কাযের ভার নিয়ে দরওয়ান ব্যস্ত থাকে; অভ্যাগত লোককে দেউড়ি ছেড়ে দেবার সময় শুধু মানুষটা চেনা কি অচেনা, ছোকরা কি বুড়ো এমনি মোটামুটিভাবেই দেখে নিয়েই তার কায শেষ। ঘুমোচ্ছি এমন সময় ঘরে খট্ করে শব্দ হল, কি গায়ে কিছু স্পর্শ করলে, অমনি কান হাত পা ইত্যাদি চট্‌ করে বুদ্ধিকে গিয়ে খবর দিলে—যন্ত্রের মতো সময় অসময় জ্ঞান নেই! ঘড়ির কাঁটার সঙ্গে নিমেষে নিমেষে চোখ দেউড়ির ঝাঁপ খুলে বাইরেটা উঁকি দিয়ে দেখে নিচ্ছে আর নোট্ দিচ্ছে মানুষকে—এ হল তা হল, এ গেল সে গেল, এটা দেখা যাচ্ছে, ওটার খবর এখনো আসেনি! নিত্য নৈমিত্তিক কাযের অনেকখানি এই রকম মোটামুটি যান্ত্রিক রকমের দৃষ্টি দিয়েই চোখ আমাদের সম্পন্ন করে যাচ্ছে, এ ছাড়া অনেকখানি কায একেবারে চোখে না দেখে হাত পা ও গায়ের পরশ এবং পরখ দিয়ে একটু, আর সব ইন্দ্রিয়ের পরখের অনেকখানি মিলিয়ে করে চলেছি আমরা। জুতো পরায় জামা পরায়, চোখের পরখের চেয়ে গায়ের পরশ বেশি সাহায্য করে—কোন্‌টা আমার জুতো বা জামা চিনিয়ে দিতে। মানুষের নিত্য জীবন যাত্রার মধ্যে নিবিষ্টভাবে রয়ে-বসে দেখা এত অস্বাভাবিক আর বিরল যে কাযের মধ্যে হঠাৎ থম্‌কে দাঁড়ানো, নয়নভরে কিছু দেখে নেওয়া, স্থির হয়ে কিছু উপভোগ করার সময় পায় না বল্লেই হয় সাড়ে পনেরো আনা লোকের দর্শন স্পৰ্শন শ্রবণ ইত্যাদি,—এটা অত্যন্ত অদ্ভূত কিন্তু অত্যন্ত সত্য ঘটনা। এমন ছাত্র নেই যে প্রতি সন্ধ্যায় গোলদীঘির ধারে জমায়েৎ হয়ে দুচার ঘণ্টা না কাটায়, কিন্তু তাদের প্রশ্ন কর—গোলদীঘিটা গোল না চৌকা? হঠাৎ কেউ উত্তর দিতে পারবে না, গোলদীঘির লোহার রেলিং ত্ৰিশূলের আকার না বর্শার ধরণ? একশ’র মধ্যে একজন ছাত্র চট্ করে বলতে পারে কি না সন্দেহ। একটা রেলিং আছে এইটুকুই টুকে আসছে চোখ মনের নোট্ বইখানায় যন্ত্রের মতন, রেলিংএর কারুকার্য গড়ন পেটন নিবিষ্ট হয়ে দেখার প্রয়োজন এবং অবসরের দরকারই বোধ করেনি চোখ। খুব ছোট থেকে খুব বড় বয়সেও আমাদের বুদ্ধির কোঠায় দর্শন স্পর্শন শ্রবণ এরা অহোরাত্র খবর পাঠাচ্ছে; বাইরের ঘটনা বাইরের বস্তুর পরিষ্কার একটি-একটি চুম্বক রিপোর্ট চট্‌পট্‌ বুদ্ধির ঘরে টেলিগ্রাম করাই এদের সাধারণ কায। রাত পোহালো চোখ ঝাঁপ খুলেই দেখলে আলো হয়েছে, অমনি সঙ্গে সঙ্গে তার গেল বুদ্ধির কাছে—“রাতি পোহাইল, উঠ প্রিয় ধন, কাক ডাকিতেছে কররে শ্রবণ”। সকাল, এই বুদ্ধি অমনি জাগল মানুষের, দ্বিপ্রহরের রোদ চন্‌চনে হয়ে উঠলো অমনি স্পৰ্শন বুদ্ধির কাছে তার পাঠালে “ভানুতাপে তাপিত ধরণী”, মধ্যাহ্ন, বুদ্ধি উদয় হল মানুষের। এমনি অষ্টপ্রহর বুদ্ধির তাঁবেদারি করতেই কাট্‌ছে দিন দর্শনের স্পর্শনের শ্রবণের! একেবারে ঘড়িধরা এদের কায একটু এদিক ওদিক হলেই মুস্কিল—কুয়াশা বেশি হলে, বাদলা ঘন হলে এই প্রহরীরা অনেক সময়ে ঠিক ঠাউরে উঠতে পারে না সকাল কি সন্ধ্যে, টেলিগ্রাফে ভুল থেকে যায়, বিছানা ছাড়তে বেলা হয়, ভাত চড়তে তিনটে বাজে, এমনি নানা বিশৃঙ্খলা উপস্থিত হয় নিত্য কাযে। তখন বার বার ঘড়ির দিকে চেয়ে দেখতে হয়, নয় তো জানলা খুলে বাইরে উঁকি দিতে হয় ক্রমান্বয়ে। শুনে দেখি, চেয়ে দেখি অথবা পরশ করেই দেখি, সাধারণ মানুষের জীবনে এই তিন দেখার সম্পর্ক হচ্ছে বস্তু-জগতের যেগুলো সচরাচর ঘটনা এবং বাইরের যে মোটামুটি খবর তারি সঙ্গে। প্রহরীর কায খবরদারীর কায; এর বেশি কায এদের দেওয়ার দরকারই হয় না জীবনে ইতর জীব থেকে মানুষ পর্যন্ত কারু, অতএব বলতেই হ’ল চোখ কান হাত এমনি সবার স্বাভাবিক কায ও অবস্থা হয় চট্‌পট্‌ দেখা শোনা ছোঁয়া ও জানা যান্ত্রিকভাবে। চোখে দেখলেম বাইরের পদার্থ তার রূপ রং ইত্যাদি, পাঁচ আঙ্গুলে পরশ করে দেখলেম সেগুলো; শুনে দেখলেম বাইরের খবরাখবর, এই ভাবে জগতের বস্তু ও ঘটনার বুদ্ধিটা বেড়ে চল্লো মানুষ থেকে ইতর জীব তাবতেরই। মুখ চোখ কান হাত পা সব দিয়ে জীব যেন পড়ে চল্লো বিশ্ববিদ্যালয়ে এসে বিদ্যাসাগরের বর্ণপরিচয় প্রথম ভাগ—বড় গাছ, লাল ফুল, ছোট পাতা, কিম্বা জল পড়ে, হাত নাড়ে, খেলা করে, অথবা নূতন বটী, পুরাণ বাটী, কাল পাথর, সাদা কাপড়—শুধু চোখের পড়া; কিম্বা যেমন মেঘ ডাকে, অথবা কাক ডাকিতেছে, বাঁশী বাজিতেছে, বেড়াল কাঁদিতেছে, মা বকিতেছে—শুধু শোনার পড়া; অথবা যেমন—শীতল জল, তপ্ত দুধ, নরম গদি, শক্ত লোহা—শুধু পরশ করার পাঠ। ইন্দ্ৰিয়সকলের সাহায্যে এই উপায়ে সবাই পড়ে চলেছে শিশুশিক্ষা থেকে বোধোদয় পর্যন্ত, এর বেশি পড়া সাড়ে পনেরো অানা মানুষ দরকারই বোধ করে না সারা জীবনে। বস্তু ও ঘটনার মোটামুটি বুদ্ধি হলেই চলে যায় সুখে স্বচ্ছন্দে প্রায় সকলেরই সাধারণ জীবনযাত্রা এবং এই মোটামুটি বুদ্ধির উদ্রেক করে দেওয়ার কাযে লেগে থাকতে থাকতে দর্শন স্পর্শন ও শ্রবণের শক্তিও এমন ভোঁতা হয়ে যায় যে কোন কিছুর সূক্ষ্ম দিকে বা গভীর দিকে যেতেই চায় না তারা। শিল্পকার্য সঙ্গীত, এবং কোন বিষয়ে পটুতা হয় না হ’তে পারে না ততক্ষণ, যতক্ষণ নানা ইন্দ্রিয়ের নিত্য এবং স্বাভাবিক ক্রিয়ার কতকটা অদল-বদল ঘটিয়ে না তোলা যায়। এমন কল সব আজকাল তৈরী হয়েছে যা চোখ যেমন করে দেখে ঠিক তেমনি করেই দেখে ও ধরে নেয় সৃষ্টির সামগ্রী চট্‌ করে নিমেষ ফেলতে! স্পর্শ করে কল, স্পর্শ ক’রে শিউরে উঠে, দুলে ওঠে গরম ঠাণ্ডার ওজন-মাপে এবং পরশের তন্ন তন্ন হিসেব লিখে চলে; বাদলা হবে কি ঝড় উঠবে তা বাতাসের পরশ পেয়েই বলে দেয় কল; উত্তর মেরুতে ভূমিকম্প হলে তার হিসেব রাখে দক্ষিণ সাগরের পরপারে বসে কল; আবার কল সে শুনছে, যা শুনছে তা লিখছে, যা লিখছে তা শুনিয়ে দিচ্ছে সুর করে বক্তৃতা দিয়ে আবৃত্তি অভিনয় করে পর্যন্ত। কাপড় কাচ্ছে কল, কাপড় ভাঁজ করে কাঁথা সেলাই করছে কল, দ্রুত দৌড়চ্ছে কল, আকাশে উড়ছে কল! এতে করে মনে হয় এই সমস্ত কল মিলিয়ে একটা কলের পুতুল যদি কোন দিন ছবি মূর্তি গান ইত্যাদি নানা জিনিষের সমালোচনা করতে এসে উপস্থিত হয় আমাদের মধ্যে তবে খুবই অদ্ভূত হবে সে ঘটনা, কিন্তু আরো অদ্ভূত হবে কলের পুতুলের ছবি মূর্তি গান কবিতা ইত্যাদির সমালোচনা। বস্তুতন্ত্রতা সেই কলের পুতুলে এত অভ্রান্ত রকমে থাকবে যে ছবি যদি প্রতিচ্ছবি, মূর্তি যদি প্রতিমূর্তি, গান যদি হরবোলার বুলি না হয় তো সে তখনি তার নিন্দা ও কঠিন সমালোচনা করে বসবে, কবিতা কল্পনা এ সবকে সে বলবে পাগলামি এবং ঠিক এখন সাধারণ মানুষ আমরা যেমন শিল্পশালায়, সঙ্গীতশালায় বা অভিনয়-ক্ষেত্রে ব্যবহার করি, অর্থাৎ বাস্তবের সঙ্গে শিল্পকার্য যতটা মেলে ততটা তার বাহবা দিই, একটু বাস্তবিকতার ভ্রান্তি উৎপাদনের ব্যাঘাত হলে বলে বসি ‘দূর ছাই’, কলের পুতুলটিও ঠিক সেই ব্যবহারই করবে। সাধারণতঃ শরীর-যন্ত্রগুলো আমাদের প্রবল বস্তু-পরায়ণতা নিয়ে দেখতে শুনতে পরশ এবং পরখ করতেই পাকা হয়ে উঠছে দিনের পর দিন। সারাজীবন বারে বারে একই জিনিষ দেখে শুনে, পরশ করে পরখ করতে করতে কাজের দক্ষতা এমন বেড়ে যায় হাত পা চোখ কানের, যে মেকি টাকা, ভেজাল ঘী, পাকা ও কাঁচা, সরেস ও নিরেস ছোঁয়া মাত্র দেখা মাত্র শোনা মাত্রই তারা ধরে দিতে পারে; কিন্তু এটুকু হয় শুধু আশপাশের বস্তুগুলোর সঙ্গে অনেক দিনের পরিচয়বশতঃ। শরীর-যন্ত্র, নিত্য ব্যবহারের নিত্য কাযের বস্তু ও ঘটনাগুলোর সম্বন্ধে এই অভ্রান্ত বস্তু-পরিচয়ের পাঠ সাঙ্গ করেই থেমে রইলো, এই হলো সাধারণ মানুষ হিসাবে আমরা দর্শন স্পর্শন শ্রবণ দিয়ে যতটা এগোতে পারি তার চরম পরিণতি। মানুষের দেখা শোনা ছোঁয়া সমস্তই কায ও বস্তু এবং বাস্তবিকতার সঙ্গে লিপ্ত হয়ে রইলো, নিখুঁত করে চিনে নিতে পারলে, অভ্রান্তভাবে ধরতে পারলে বাইরের এটা ওটা সেটা, এ ও তা, এমন তেমন ইত্যাদি বস্তু ও ঘটনা এই যে জ্ঞান একে বলা যেতে পারে বস্তু-বুদ্ধি বা বাস্তব-বুদ্ধি—কিন্তু কিছুতেই একে বলা চলে না বস্তুর রসবোধ শিল্পবোধ সৌন্দর্যবোধ অথবা অর্থবোধ। মানুষের এই বস্তুগত দৃষ্টি চিরদিন তার স্বার্থ-বুদ্ধির সঙ্গেই জড়ানো থাকে। নিত্য জীবনযাত্রার সঙ্গে আশপাশ থেকে যারা এসে মিলছে তাদেরই খবর আমরা দিন রাত অভ্রান্তভাবে নিয়ে চল্লেম এই বস্তুগত দৃষ্টি দিয়ে। ময়রা যেন চমৎকার মিঠাই গড়ে চল্লো মিঠাইয়ের রসবোধ করার কোন অপেক্ষা না রেখেও! কিম্বা জহুরী রত্ন-পরীক্ষায় এমন পাকা হয়ে উঠলো যে হাতে নিয়েই বলতে পারলে সামগ্ৰীটা কাচ কি হীরে, সরেস কি নিরেস; অথবা শব্দে কান এত পরিষ্কার হল যে কোথা কোমল কোথা বা অতি-কোমল পর্দ্দায় ঘা পড়ছে তা শোনামাত্র ধরে দিলে মানুষ। কিন্তু এই হলেই ময়রার জহুরীর ও কালোয়াতের রসবোধ সৌন্দর্য ও সুষমাবোধ সম্পূর্ণ হয়েছে তা জোর করে বলা চলে না। বস্তু-জগতের সঙ্গে পরিচয় বুদ্ধির দিক দিয়ে ঘটিয়ে দর্শন স্পৰ্শন শ্রবণ মানুষকে খুব দক্ষতা, চাতুর্য, বুদ্ধির পরিচ্ছন্নতা দিয়ে পাকা মানুষ কাযের মানুষ করে দেয় এটা যেমন সত্যি, আবার শুধু গুণগুলি নিয়েই মানুষ গুণী, কবি ও শিল্পী হয় না এটাও তেমনি সত্যি। সুরে কান হলেই যে মানুষ গান রচনা করতে পারে তা নয়, জহরৎ চিনলেই যে সবাই চমৎকার অলঙ্কার রচনা করতে পারে অথবা ভাল রসকরা গড়ে চল্লেই সে যে সৃষ্টির রসের রসিক হয়ে ওঠে তাও নয়। বহির্বাটির রাস্তা ঘাট নিয়ম-কানুন সমস্তই যেমন অন্দরমহলের সঙ্গে স্বতন্ত্র তেমনি বুদ্ধির প্রেরণা আর রসবত্তা বিকাশের পথ সম্পূর্ণ আলাদা। সদর দুয়ার দিয়ে বুদ্ধির কাছে পৌঁছচ্চে সৃষ্টির খবরাখবর, চলাচল কোলাহল করে, অবিরাম অস্থিরগতিতে সমস্তই সেখানে যাচ্ছে আসছে—কারো সঙ্গে দুদণ্ড রসালাপ করার সময় সেখানে অল্পই মেলে! নিত্য দেখা শোনা দ্বারায় ভাল করে মুখচেনা ঘটলেও কিছুর সঙ্গে অবসর মতো রয়ে-বসে রসের সম্পর্ক পাতানো সদর রাস্তা এবং সদর বাড়ীতে ক্বচিৎ সম্ভব হয়; এই কারণেই মানুষের ঘর, কাছারি ঘর, খাবার ঘর, শোবার ঘর, বৈঠকখানা, আফিস ঘর এমনি নানা কুঠরিতে ভাগ করা থাকে। অন্দরে অথবা বৈঠকখানার গানের ও নাচের মজলিসে প্রবেশ করতে হলে যেমন আফিসের চোগা চাপকান ছেড়ে উপস্থিত হতে হয়, কাযের দৃষ্টি কাযের কথা মায় কাযকে পর্যন্ত কড়া পাহারায় বাইরে আটকে, তেমনি রসবোধের রাজত্বে ঢোকবার কালে নিত্যকার দর্শন স্পর্শন শ্রবণের অনেকখানি পরিবর্তন করে চলে মানুষ—এটা কেবল মানুষেই পারে, ইতর জীব পারে না। কাযের সংস্পর্শ থেকে কিছুকে বিচ্ছিন্ন করে নিয়ে চেয়ে-দেখা, শুনে-দেখা, ছুঁয়ে-দেখার অভ্যাস চোখ কান ও সমস্ত ইন্দ্রিয়কে দেওয়ার ক্ষমতা অনেকখানি সাধনার অপেক্ষা রাখে, তবে মানুষের শিল্পজ্ঞান রসবোধ জন্মায়। মানুষ অন্তর্দৃষ্টি লাভ করে কখন? প্রাণের সঙ্গে বাক্যকে, চক্ষুর সঙ্গে মনকে, স্তোত্রের সঙ্গে আত্মাকে যখন সে মিলিত করে। মানুষের শরীর-যন্ত্রটাকে জীবনযাত্রার পথে নানা বিঘ্নবিপত্তি থেকে রক্ষা করে স্বচ্ছন্দে চালিয়ে নেবার কাযেই দক্ষ হয়ে উঠলো মানুষের ইন্দ্রিয় কটা নিজের নিজের পরিপূর্ণ শক্তি অনুসারে; দেখা শোনা ছোঁয়া ইত্যাদি নানা উপায়ে এইটুকুই হল। আর কাযভোলা দৃষ্টি সে হল অনন্যসাধারণ অস্বাভাবিক দৃষ্টি, শিশুকালের তরুণ দৃষ্টি কবির দৃষ্টি শিল্পীর দৃষ্টি। নিত্য কাযের ব্যাপার সরিয়ে একটা জিনিষে গিয়ে মানুষের দর্শন স্পর্শন শ্রবণ নিবিষ্ট হল নিবিড়ভাবে যখন, তখনই মন পড়ল জিনিষে, এবং মনে ধরা না ধরার কথা তখনই উঠলো। চোখ কান সমস্তকে কেবলি—পাতা পড়ে, জল নড়ে ইত্যাদি কাযের পড়া থেকে ছুটি দিয়ে সৃষ্টির জিনিষের ও ঘটনার দিকে ছেড়ে দেওয়া গেল, এতে মানুষের পরশ ও পরখ করার একটা কৌতূহল দেখা দিলে। কাযের জগতের বাঁধাবাঁধি নিয়মে দেখা শোনা করতে অপটু থাকে শিশুকালে সব মানুষ স্বভাবতঃই, বাপ মাকে তারা কাজে খাটায় নিজের ইন্দ্রিয়গুলোর চেয়ে, কাযেই সামান্য সামান্য জিনিষকেও বড় মানুষের চেয়ে বেশি কৌতূহলের সঙ্গে শিশুরা দেখবার শোনবার অবসর পায়, মন তাদের আকৃষ্ট হয় বস্তুর উপর ঘটনার দিকে অনেকখানি এবং মন তাদের খেলেও অনেকখানি অনেক জিনিষের সঙ্গে অনেকক্ষণ ধরে অগাধ কৌতূহলে। শিশুকালের এই কৌতূহল দৃষ্টির কিছু কিছু রেশ্ মানুষের বয়সকালেও নানা জিনিষ ও ঘটনার সঙ্গে জড়িয়ে আছে দেখা যায়—চন্দ্রোদয় সূর্যোদয় শুকতারা ফোটাফুল মেঘের ঘটা বিদ্যুৎ কিম্বা এক টুকরো হীরে অদ্ভুত গড়নের ঢেলা অথবা বিচিত্র গড়নের অলঙ্কার কি কিছু অথবা অদ্ভুত একটা সমুদ্রের ঝিনুক ইত্যাদি নানা টুকিটাকি নিয়ে খুব বয়সেও মানুষ অনেক সময়ে নাড়াচাড়া করছে কৌতূহলের বশে দেখা যায়। দক্ষিণাবর্ত শাঁখকে লক্ষ্মীকে ধরে রাখতে খুব কাযের জিনিষ বলে দেখা আর কৌতূহলের সঙ্গে লক্ষ্মীপেঁচার একটা পালকের চিত্র বিচিত্র নক্সা দেখা অথবা লক্ষ্মীর ঝাঁপিটা বোনা কিম্বা ঘড়ির ঘণ্টা শোনা ও নূপুরের ধ্বনি শোনায় প্রভেদ হচ্ছে ঐ কৌতূহলটি নিয়ে। তরুণ দৃষ্টিতে সৃষ্টির সামগ্ৰী কৌতুকে রহস্যে ভরা দেখায়, কাযের সংস্পর্শে বড় হতে হতে মানুষ যতই এগোতে থাকে ততই এই দৃষ্টির তারুণ্য সে হারাতে থাকে এবং শেষে এই সমস্ত বিশ্ব তারি সংসারের কাযে লাগবার জন্যে রয়েছে এমনো একটা বিশ্বাস সে করে ফেলে, বিশ্বে যেটাকে কাযের জিনিস বলে সে নিজে বোধ করে না সেটাকে ধর্তব্যের মধ্যেই আনতে চায় না, আর ছবি কবিতা প্রায় সবই বাজের কোঠায় ফেলে দিয়ে চলে মানুষ! স্ত্রী-পুত্র পরিবার পাড়াপ্রতিবেশী এমন কি টেবিল চেয়ারগুলোকেও খালি প্রয়োজনের দেখা প্রয়োজনের সম্পর্ক নিয়ে উপভোগ করে চলেছে এমন শক্ত মানুষ বড় অল্প নেই একথা সহজে কেউ বিশ্বাস করতে চাইবে না, কিন্তু সকালে খবরের কাগজ পড়ার সময় কানের কাছে ছেলেগুলো শুধু-শুধু হৈ চৈ বাধিয়ে দিলে, কিম্বা ডিক্‌সনারির পাতাটা ছিঁড়ে নৌকা বানিয়ে বর্ষার দিনে জলে ভাসালে, অথবা দস্তুর মাফিক সাড়ে দশটায় ঘড়ির কাঁটা পৌঁছলেই ছেলে ইস্কুলের জন্যে তৈরি না হয়ে বিছানায় গিয়ে সটান শুয়ে পড়লে, ছেলে কাযের ব্যাঘাত করলে অকেজো হয়ে রইলো কাযের জিনিষ নষ্ট করলে এমনি শিশুচরিত্রকে কাযের চশমা দিয়ে উল্টো বুঝে নিজের চোখ কান লাল করে না তোলে এমন মানুষ কমই দেখি। কাযের জগতে চলাচল করতে করতে এই অত্যন্ত কাযের পরকলা এত শক্ত হয়ে আমাদের চোখে-দেখা, শুনে-দেখা ছুঁয়ে-দেখার উপরে বসে যায় যে মনে হয় চিরদিন এই ভাবে দেখে চলাই বুঝি সব মানুষেরই কায; কিন্তু অত্যন্ত ছেলে মানুষ যারা তারা আমাদের এই ধারণা উল্টে দিয়ে যায়, কবিরা উল্টে দিয়ে যায়, শিল্পীরা উল্টে দিয়ে যায়, আর ঠিক সেই মানুষগুলিকেই আমরা বালক পাগল নিৰ্বুদ্ধি বলে উড়িয়ে দিয়ে নিজেদের বুদ্ধিমত্তার দাবি সপ্রমাণ করে করে চলি। কিন্তু সৌন্দর্যে ভরা, রসে ভরা, রংএ ভরা, রূপে ভরা, ভাব লাবণ্য সব দিয়ে অনিন্দ্যসুন্দর করে রচনা করা এই সৃষ্টির মাঝে মানুষ কেবল বুদ্ধিমত্তার সত্তা নিয়ে বর্তে থাকবে নয়ন ভরে কিছু দেখে নিতে চাইবে না, প্রাণভরে মন দিয়ে কিছু শুনে যেতে চাইবে না, পরশ করে পুলকিত হতে চাইবে না, মানুষ সমস্ত বিশ্বের রস, এ যিনি মানুষকে মন দিয়ে সৃষ্টি করলেন তাঁর ইচ্ছে কখনও হতে পারে না। এবং এই কথাই সপ্রমাণ করতে প্রথমেই এল কায-ভোলা কায-ভোলানো শিশু খুব কাযের জগতে অফুরন্ত কৌতূহল অকারণ হাসি কান্না ইত্যাদি নিয়ে। সেই শিশু, দিন রাত কাযে কর্মে ভরা মানুষের ঘরের মধ্যে এসে তার কৌতুক কৌতূহল যারা জাগালো—মাটির ঢেলা, কাঠের টুকরো—তাদের নিয়ে নিরিবিলি আপনার খেলাঘর বাঁধলে—কল্পনা পক্ষিরাজের অতি অপূর্ব আস্তানা, সেখানে কায হয়ে গেল একেবারে খেলা, খেলাই হয়ে উঠলো মস্ত কায! কিন্তু কাযের জগৎ সেই শিশুর উপরে তীক্ষ্ণদৃষ্টিতে চেয়ে রইলো, শিশুকাল যেমন শেষ হতে থাকলো অমনি কাযও কোন কোন শিশুকে আস্তে আস্তে আপনার ঘরের দিকে টেনে নিতে লাগলো, একটু একটু করে খেলাঘর ভেঙ্গে গেল এবং কচি ছেলেকে কাযের যন্ত্রতন্ত্রগুলো দাঁতে চিবিয়ে ছোবড়া বানিয়ে ছেড়ে দিলে। আবার কোন ছেলেকে কায তেমন করে জোরে ধরতে পারলে না, কিম্বা কোন ছেলেটা কাযে পড়েও বাজের সাধনা অনেকখানি করে চল্লো, তারাই কাযের চাবুক এড়িয়ে গিয়ে কিম্বা সরে গিয়ে হয়ে উঠলো ভাবুক, অদ্ভুত কৌশলে তারা তাদের চোখে-দেখা, শুনে-দেখা, ছুঁয়ে-দেখা ইত্যাদি যে অত্যন্ত কাযের অফিস যোড়া তাদের পিঠে পক্ষিরাজের ডানা যুড়ে দিয়ে কায বাজাতে না গিয়ে, বাঁশি বাজাতে বেরিয়ে পড়লো জগতে। শিশুকালের হারানো চমৎকারি কাচ অনেক কষ্টে খুঁজে খুঁজে সেইটে বার করে সাদাসিধে কাযের চোখে-দেখা, শুনে-দেখা, ছুঁয়ে-দেখার উপরে যেমনি বেশ করে এঁটে দিলে মানুষ, অমনি স্বৰ্গ মর্ত পাতাল আবার তার কাছে তরুণ হয়ে দেখা দিলে, কৌতুকে কৌতূহলে ভরে উঠলো সৃষ্টির সামগ্ৰী! যে সব ইন্দ্রিয় কেবলি হিসেবের কাযে, পাহারার কাযে লেগেছিলো তারা হয়ে উঠলো কৌতূহলপরায়ণ এবং সন্ধানী, দিনের পর দিন বস্তুকে নিয়ে ঘটনাকে নিয়ে উল্টে-পাল্টে খেলতে আর দেখতে অথবা শুনতে লেগে গেল; শুধু ‘জল নড়ে ফল পড়ে’ এ পড়ায় আর রুচি হল না, কেমন করে জল চলচে, কেমন করে ফুল ফুটছে ঝরছে, কিবা সুরে পাখী গাইছে, আকাশের তারা কেমন করে চাইছে ইত্যাদি কেমন তা জানার আগ্রহ এবং চেষ্টা জেগে উঠলো। সাদাসিধে রকমের বুদ্ধির চাষ করে চলাতেই চোখে-দেখা, শুনে-দেখা ছুঁয়ে-দেখা বদ্ধ রইলো না। চঞ্চল দৃষ্টি এ-ফুলে ও-ফুলে এখনো উড়ে পড়তে লাগলো বটে, কিন্তু হঠাৎ দৃষ্টির চঞ্চলতার মধ্যে এক একটা সম্ আর ফাঁক পড়তে লাগলো, প্রজাপতি যেন হঠাৎ ডানা দুখানা স্থির করে আলোর পরশ, ফুলের পাপড়ির রং এবং ফুলের ভিতরকার কথা ধরবার চেষ্টা করতে থাকলো! দর্শন স্পর্শন শ্রবণের যান্ত্রিকতা কতকটা দূর হয়ে তাদের মধ্যে আন্তরিকতা একটু যেন বিকশিত হল। যে সব শরীর-যন্ত্রের কাযই ছিল বুদ্ধির সঙ্গে যুক্ত হয়ে বাইরের প্রেরণায় চট্‌পট্‌ সাড়া দেওয়া নির্বিচারে, অন্তরের সঙ্গে মানুষ যেমনি তাদের মুক্ত করে দিলে অমনি ভিতরকার প্রেরণায় তারা ধীরে সুস্থে একটুখানি যত্নের সঙ্গে একটু কৌতূহল নিয়ে যেন আত্মীয়তা পাতাতে চল্লো বাইরের এটা ওটা সেটার সঙ্গে, একটু দরদ পৌঁছল দেখা শোনা ছোঁয়ার মধ্যে। এ একটা মস্ত ওলট-পালট ঘটলো হাত পা চক্ষু কর্ণের কাযের স্বাভাবিক ও যান্ত্রিক ধারার—উজান টান ধরলো যমুনায়। ফুলের পাতার সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম সাড়া ধরার জন্য আচার্য জগদীশচন্দ্রের যে যন্ত্রটা, সেটা থেকে থেকে আনমনে যদি ফুলের এবং পাতার শোভা নিরীক্ষণ করতে আরম্ভ করে কায ভুলে, তবে নিশ্চয়ই সবাই বলবে যন্ত্রটা বিগড়েছে—যে ভাবে দেখা যে ভাবে শোনা যন্ত্রটার উচিত ছিল তা করছে না। কিন্তু যন্ত্রের ঐরূপ ব্যবহার দেখে একটা অত্যন্ত বিস্ময়কর বিপর্যয় শক্তি যে যন্ত্রটা লাভ করেছে তা কারু অগোচর থাকবে না। তেমনি ইন্দ্ৰিয়সকলের সাধারণ ক্রিয়ার মধ্যে নিরূপণ-ইচ্ছা নিবিষ্ট হবার চেষ্টা যারা ঘটায় অভ্যাস শিক্ষা ও সাধনার দ্বারায়, বলতেই হবে সেই সব মানুষের দেখা শোনা সমস্তই অনন্যসাধারণ বা অসামান্য রকমের একটা শক্তি পেয়েছে। এই যে কৌতূহল-প্রবণতা, দরদ দিয়ে সব জিনিষ দেখার অভ্যাস, কাযের দেখার প্রায় বিপরীত উপায়ে সৃষ্টির জিনিষকে আলিঙ্গন করে পরখ করা, ছেলেবেলাকার হারিয়ে-যাওয়া খেলাঘরের কাজ-ভোলা দৃষ্টি,—একে ফিরে পাওয়া দরকার কি না, এ নিয়ে মানুষে মানুষে মতভেদ দেখা যায় কিন্তু একদিনও মানুষ একটিবার সেই ছেলেবেলার দেখা শোনা খেলা ধূলোর মধ্যে ফিরে যেতে ইচ্ছা করলে না এমন ঘটনা মানুষে বিরল। চেষ্টা করলেই ছেলেবেলার সেই কাজ-ভোলা হারানো দৃষ্টি যে ফিরে পাওয়া যায় তা নয়। নাসার ডগায় দৃষ্টি স্থির করলেও, চাঁদ তারা মেঘ অথবা সূর্যের দিকে উদয়াস্ত হাঁ করে চেয়ে থাকলেও অথবা খাঁচায় কোকিল পুষে তার গান দিন রাত শুনে এবং দক্ষিণ বাতাসকে চাদর উড়িয়ে ছুঁয়েও যোগীর এবং ভাবুকের দৃষ্টি পাচ্ছে না কত যে লোক তার ঠিকানা নেই। সখ করে’ নানা সৌখীন জিনিষের সাজসজ্জার দিকে অথবা বিচিত্রা এই বিশ্ব প্রকৃতির শোভা সৌন্দর্যের দিকে চাওয়া হল বিলাসীর চাওয়া। বেতাল পঁচিশের ভোজনবিলাসী শয্যাবিলাসী এরা সাতপুরু গদির তলায় একগাছি চুল, রাজভোগ চালে শবগন্ধ অতি সহজেই ধরতে পারতো, কিন্তু বিলাসীর দেখা প্রকাণ্ড রকম স্বাৰ্থ নিয়ে দেখা, অত্যধিক মাত্রায় কাযের দেখা এ দৃষ্টি ভাবুকের দৃষ্টি কিম্বা কায-ভোলা শিশুর সরল দৃষ্টি একেবারেই নয়, অতিমাত্রায় বস্তুগত দৃষ্টিই এটা! এই ইন্দ্রিয়পরায়ণ দৃষ্টি নিয়ে শয়নবিলাসী, ভোজনবিলাসী দুটোতে মিলে বাসকসজ্জার কবিতা লিখতে চেষ্টা করলে যা হতো তা এই— সুন্দরীর সহচরী ভাল জানে চর্য্যা। রতন মন্দিরে করে মনোহর শয্যা॥ দুই দুই তাকিয়া খাটের দুই ধারি। ডৌল ভাঙ্গি টাঙ্গাইল চিকন মশারি॥ ভক্ষ্য দ্রব্য নানা জাতি মণ্ডা মনোহরা। সরভাজা নিখতি বাতাসা রসকরা॥ অপূর্ব্ব সন্দেশ নামে এলাইচ্ দানা। ফুল চিনি লুচি দধি দুগ্ধ ক্ষীর ছানা॥ চিনির পানা কর্পূর চন্দন কালাগুরু বিছানা-বালিস লেপ-তোষক ইত্যাদি দিয়ে যে ত্রিপদী চৌপদী, সে গুলো কবিতা কিম্বা ভাবের তিন পায়া চার পায়া টেবিল চৌকি বল্লেও বলা চলে। বিলাসীর দৃষ্টির সঙ্গে ভাবুকের দৃষ্টির কোনখানে যে তফাৎ তা স্পষ্ট ধরা যাবে দুই ভাবুকের লেখা বাসকসজ্জার বর্ণন দিয়ে; যথা— অপরূপ রাইক রচিত। নিভৃত নিকুঞ্জ মাঝে, ধনী সাজয়ে পুনঃ পুনঃ উঠয়ে চকিত॥ ধুয়োতেই, ভাব-সচকিত চাহনি নিভৃত নিকুঞ্জের অপরূপ শোভা মনকে দুলিয়ে দিলে; আবার যেমন— আজ রচয়ে বাসক শেজ, মুনিগণ চিত হেরি মুরছিত কন্দর্পের ভাঙ্গে তেজ। ফুলের অচির, ফুলের প্রাচীর ফুলেতে ছাইল ঘর, ফুলের বালিস আলিস কারণ প্রতি ফুলে ফুলশর। বিলাসীর দৃষ্টিতে ধরা পড়লো ভাল ভাল কাযের সাজ সরঞ্জাম যা টপ করে গিলে খেতে ইচ্ছে হয় তাই, আর ভাবুকের দৃষ্টিতে ধরা গেল সেইগুলো যাদের দিকে নয়ন ভরে দুদণ্ড চেয়ে দেখতে সাধ হয়। বিলাসীর দৃষ্টি স্বার্থের সঙ্গে নিবিড়ভাবে জড়িয়ে থেকে সৃষ্টির যথার্থ শোভা সৌন্দর্য ও রসের বিষয়ে মানুষটাকে বাস্তবিকই অন্ধ করে রাখে অনেকখানি, আর ভাবুকের দৃষ্টি কায-ভোলা ছেলেবেলার দৃষ্টি সৃষ্টির অপরূপ রহস্যের খুব গভীর দিকটায় নিয়ে চলে মানুষকে। কাযেই ভাবুকের শোনা-দেখা বলা-কওয়ার মধ্যে শিশুসুলভ এমনতরো সরলতা ও কল্পনার প্রসার থাকে। ভাবুকদৃষ্টি এত অপরূপ অসাধারণভাবে দেখে-শোনে, দেখায়-শোনায় যে কাযের মানুষের দেখা-শোনা ইত্যাদির সঙ্গে তুলনা করে দেখলে ভাবুকের চোখে দেখা ছবি কবিতা সমস্তই হেঁয়ালী বা ছেলেমান্‌ষির মতই লাগে। কাযের দৃষ্টি নিয়ে মানুষের মন কোন্‌খানে কি ভাবেই বা খেলা করছে, আর ভাবুকের দৃষ্টি নিয়েই বা মন কোথায় কি খেলছে কেমন করে, দেখলেই দুয়ের তফাৎ স্পষ্ট হয়ে উঠবে। প্রথমে কাযের কাজির দেখা দিয়ে লেখা মনের খেলা ঘরের দৃশ্য— মন খেলাওরে দাণ্ডা গুলি আমি তোমা বিনা নাহি খেলি॥ এড়ি বেড়ি তেড়ি চাইল, চম্পাকলী ধুলা ধুলী। এইবার ভাবুকের দৃষ্টি কবির মনটিকে কোন কায-ভোলা জগতের খেলাঘরের ছুটির মাঝে ছেড়ে দিয়ে গেল তারি ছুটি গান— “আকাশে আজ কোন চরণের আসা-যাওয়া, বাতাসে আজ কোন পরশের লাগে হাওয়া, অনেক দিনের বিদায় বেলার ব্যাকুল-বাণী, আজ উদাসীর বাঁশীর সুরে কে দেয় আনি, বনের ছায়ায় তরুণ চোখের করুণ চাওয়া। কোন ফাগুনে যে ফুল ফোটা হল সারা, মৌমাছিদের পাখায় পাখায় কাঁদে তারা, বকুল তলায় কায-ভোলা সেই কোন্ দুপুরে, যে সব কথা ভাসিয়েছিলেম গানের সুরে, ব্যথায় ভরে ফিরে আসে সে গান গাওয়া।” কাযের তীক্ষ্ণ দৃষ্টির মাঝে মনের মরুভূমির উপরে যেন হঠাৎ আকাশ থেকে শ্যামল ছায় নাম্‌লো, জল ভরে এলো চোখের কোণে, কান শুনলে বাঁশীর সুর উন্মনা হয়ে, কায-ভোলা মন বকুল তলার নিবিড় ছায়ায় খুঁজতে লাগলো ছেলেবেলার হারানো খেলার সাথীকে, আর গাইতে লাগলো ক্ষণে ক্ষণে— “শূন্য করে ভরে দেওয়া যাহার খেলা তারি লাগি রইনু বসে সকল বেলা।” এমনিতরো ভাবুক দৃষ্টি দিয়ে সব মানুষের শিশুকাল সৃষ্টির যা কিছু—আকাশের তারা থেকে মাটির ঢেলাটাকে পর্যন্ত—একদিন দেখে চলেছিল, কিন্তু অবোলা শিশুকাল আমাদের কেমন দেখলে কেমন শুনলে সেটা খুলে বলতে পারলে না, এঁকে দেখাতে পারলে না। কবিতা ছবি ইত্যাদি লেখার কৌশল, ভাষার খুঁটিনাটি, ছন্দের হিসেব না জানার দরুণ শিশুকাল আমাদের কবির ভাষায় ছবির ভাষায় আপনাকে ব্যক্ত করতে পারলে না। শিশুর তরুণ দৃষ্টির মধ্যে সৃষ্টির সামগ্রীকে সখীভাবে খেলাবার সাথী বলে চেয়ে দেখবার শুনে দেখবার ছুঁয়ে দেখবার একটা আগ্রহ থাকে, সেই একাগ্রতা দিয়ে দেখা শোনা ছোঁয়ার রসটা ছেলেমেয়েরা উপভোগ করে মহানন্দে, কিন্তু সে আনন্দ ব্যক্ত করে কেবল অভিনয় ছাড়া আর কিছু দিয়ে এমন সাধ্য শিশুর পুঁজি নিয়ে হয় না। শিশু যখন একটা কিছু বর্ণনা করে তখন তার মুখ চোখ হাত পা সমস্তই যেন ঘটনাটাকে মূর্তি দিয়ে বাইরে হাজির করবার জন্যে আকুলি ব্যাকুলি করছে দেখা যায়, যেটা বড় হয়ে আমরা কবিতায় অথবা ছবিতে ব্যক্ত করি সেটা অভিনয় ক’রে ব্যক্ত করা ছাড়া শিশুকাল আর কিছুই করতে পারে না; এমন বিচিত্র ভঙ্গিতে হেসে কেঁদে নেচে, কখন গলা জড়িয়ে, কখন ধূলায় লুটিয়ে, আধ আধ কথায় অতি মনোহর অতি চমৎকারী একটা নিজের অদ্ভুত রকমে সৃষ্টি করা ভাষায় শিশু আপনার দেখা শোনা সমস্তই ব্যক্ত করে চলে যে, বড় হয়ে যারা আপনাদের দৃষ্টি শ্রবণ স্পর্শনের উপরে অত্যন্ত কাযের চশমা এঁটে দিয়েছে তাদের বোঝাই মুস্কিল হয় শিশুকাল অনাসৃষ্টি কি দেখছে, কিবা দেখাতে চাচ্ছে, কি শুনছে কিবা শোনাচ্ছে! শিশুর হৃদয় যে ভাবে গিয়ে স্পর্শ এবং পরখ করে নেয় বিশ্বচরাচরকে, একমাত্র ভাবুক মানুষই সেই ভাবে বিশ্বের হৃদয়ে আপনার হৃদয় লাগিয়ে দেখতে পারেন শুনতে পারেন, এবং অবোলা শিশু যেটা বলে যেতে পারলে না সেইটেই বলে যান ভাবুক কবিতায় ছবিতে,—রেখার ছন্দে লেখার ছন্দে সুরের ছন্দে অবোলা শিশুর বোল, হারানো দিনগুলির ছবি। অফুরন্ত আনন্দ আর খেলা দিয়ে ভরা শিশুকালের দিন-রাতগুলোর জন্যে সব মানুষেরই মনে যে একটা বেদনা আছে, সেই বেদনা ভরা রাজত্বে ফিরিয়ে নিয়ে চলেন মানুষের মনকে থেকে থেকে কবি এবং ভাবুক—যাঁরা শিশুর মতো তরুণ চোখ ফিরে পেয়েছেন। খুব খানিকটা ন্যাকামোর ভিতর দিয়ে নিজেকে এবং নিজের বলা কওয়া গুলোকে চালিয়ে নিয়ে গেলেই আমাদের সৃষ্টির ও দৃষ্টির মধ্যে তারুণ্য ফিরে পাওয়া সহজেই যাবে এটা অত্যন্ত ভুল ধারণা—শিশুকাল ন্যাকামি দিয়ে আপনাকে ব্যক্ত করে না, সে যথার্থই ভাবুক এবং আপনার চারিদিককে সে সত্যই হৃদয় দিয়ে ধরতে চায় বুঝতে চায় এবং বোঝাতে চায় ও ধরে দিতে চায়। শুধু সে যা দেখে শোনে সেটা ব্যক্ত করার সম্বল তার এত অল্প যে, সে খানিকটা বোঝায় নানা ভঙ্গি দিয়ে, খানিক বোঝাতে চায় নানা আঁচড় পোঁচড় নয় তো ভাঙ্গা ভাঙ্গা রেখা লেখা ও কথা দিয়ে,—এইখানে কবির সঙ্গে ভাবুকের সঙ্গে পাকা অভিনেতার সঙ্গে শিশুর তফাৎ। দৃষ্টি দুজনেরই তরুণ কেবল একজন সৃষ্টি করার কৌশল একেবারেই শেখেনি, আর একজন সৃষ্টির কৌশলে এমন সুপটু যে কি কৌশলে যে তাঁরা কবিতা ও ছবির মধ্যে শিশুর তরুণ দৃষ্টি আর অস্ফুট ভাষাকে ফুটিয়ে তোলেন তা পর্যন্ত ধরা যায় না। ন্যাকামো দিয়ে শিশুর আবোল তাবোল আধ-ভাঙ্গা কতকগুলো বুলি সংগ্রহ করে, অথবা শিশুর হাতের অপরিপক্ব ভাঙ্গাচোরা টানটোন আঁচড় পোঁচড় চুরি করে বসে বসে কেবলি শিশু-কবিতা শিশু-ছবি লিখে চল্লেই মানুষ কবি শিল্পী ভাবুক বলতে পারে নিজেকে এবং কাজগুলোও তার মন-ভোলানো হয়, এ ভুল যারা করে চলে তারা হয়তো নিজেকে ভোলাতে পারে কিন্তু শিশুকেও ভোলায় না, শিশুর বাপ-মাকেও নয়। ছেলে-ভুলানো ছড়া একেবারেই ছেলেমান্‌ষি নয়, তরুণ দৃষ্টিতে দেখা শোনার ছবি ও ছাপ সেগুলি— “ও পারেতে কাল রং, বৃষ্টি পড়ে ঝম্ ঝম্‌ এ পারেতে লঙ্কা গাছ রাঙ্গা টুক্ টুক্‌ করে গুণবতী ভাই আমার মন কেমন করে!” অজানা কবির গান ছেলেমান্‌ষি মোটেই নয়, এতে ছেলে বুড়ো সবার মন ভুলিয়ে নেয়। আমাদের খুব জানা কবি এই সুরেই সুর মিলিয়ে বাঁধলেন এরি মত সরল সুন্দর ভাষায় ও ছন্দে আপনার কথা— “ওই যে রাতের তারা জানিস্ কি মা কারা? সারাটি-খন ঘুম না জানে চেয়ে থাকে মাটির পানে যেন কেমন ধারা। অামার যেমন নেইক ডানা আকাশেতে উড়তে মানা, মনটা কেমন করে, তেমনি ওদের পা নেই বলে পারে না যে আসতে চলে এই পৃথিবীর পরে।” আমাদের তরুণ-চোখের নয়নতারা একদিন আকাশের তারার দিকে চেয়ে সে সব কথা ভেবেছিল, কিন্তু যে ভাবনা ব্যক্ত করতে পারেনি আমাদের শিশুকাল, এতকাল পরে সেই ভাবনা ফুটে উঠলো কবির ভাষায়। কাযের চশমা পরানো দৃষ্টি যেটা বড় হয়ে অবধি মানুষ দর্শন স্পর্শন শ্রবণের উপরে লাগিয়ে চলাফেরা করছে, সেটার মধ্যে দিয়ে উঁকি দিয়ে চল্লে তারাগুলো মিট্‌মিটে আলোর কিম্বা খুব মস্ত মস্ত পৃথিবীর মতও দেখায়, কিন্তু আকাশের তারার মাটিতে নেমে আসা দেখা অথবা আকাশে বসে তারাগুলো যে কথা ভাবছে সেটা শুনিয়ে দেওয়া একেবারেই সম্ভব হয় না উক্ত চশমা দিয়ে দেখে। ভাবুক যাঁরা, সচরাচর যান্ত্রিক দৃষ্টি যাঁদের নয়, তাঁদেরই পক্ষে সহজ হয় শিশুদের মতো হৃদয় দিয়ে আত্মীয়ভাবে বিশ্বচরাচরের সঙ্গে পরিচয় করে নিয়ে বিশ্বের গোপন কথা বলা, আর গদ্যময় কাযের সাধারণ চশমা দিয়েই দেখলেম অথচ দেখতে চাইলেম ভাবুকের মতো গাঁথতে চাইলেম পদ্য—কিন্তু পদ্য কেন, ভাল একটা গদ্যও রচা গেল না সেই যান্ত্রিক দৃষ্টি নিয়ে—কল্পনা ভাবুকতা এ সবের বদলে সাধারণ কথা এবং কাযের কথাই সেখানে বিকট ছাঁদে আমাদের সামনে হাজির হল; যথা— “মন্ত্রী রূপে চারিদিকে যত তারাগণ ঘেরিয়াছে নলিনীরে শৈবাল যেমন। শশী আর তারাবৃন্দ গগনে শোভিত দেখিলেই মনোপথ হয় প্রফুল্লিত॥” চাঁদকে ঘিরে তারাগুলো যখন সারারাত কি যেন মন্ত্রণা করছিল, নিশ্চয়ই এই কবিতার কবি সেই সময় লেপ মুড়ি দিয়ে ঘুম দিচ্ছিলেন, নয় তো খুব কাযের চশমা পরে মকদ্দমার নথি পড়ছিলেন। সুতরাং ‘মনোপথ’ যাতে ‘প্রফুল্লিত’ হয় এমন একটা সামগ্ৰী তিনি দিয়ে যেতে পারলেন না, কিন্তু ধরতেও পারলেন না চোখ কান হাত পা কিছু দিয়েই। “ভোলা” “বাঁকা” হিন্দুস্থানীতে এ দুটোর অর্থ সুশ্রী, আবার কুব্‌জাও বাঁকা শ্যামও বাঁকা, একজন সুন্দর বাঁকা একজন যৎকুচ্ছিত বাঁকা; তেমনি একথা যদি কেউ বোঝেন যে সব জিনিষকে সোজাসুজি সাধারণ দৃষ্টি দিয়ে না দেখে বাঁকা রকম করে দেখলেই কিম্বা উল্টো পাল্টা করে দেখালেই নিজের দৃষ্টির মধ্যে এবং নিজের বলা কওয়া লেখা ইত্যাদির মধ্যে ভাবুকতা রস সৌন্দর্য প্রভৃতি ভরে উঠবে কানায় কানায়, তবে তার মত ভুল আর কিছু হবে না। ভাবুকের কায-ভোলা দৃষ্টি অত্যন্ত কাযের সামগ্রী। ধানক্ষেতটা ঠিক কাযের মানুষ হিসেবে না দেখলেও ক্ষেত ও মাঠের সৌন্দর্য যে নির্ভুল ও নিখুঁতভাবে তার কাছে ধরা পড়ে এবং সেই দৃষ্টি দিয়ে দেখা মাঠের বর্ণনা ও ছবি খুব কাযের চশমা দিয়ে দেখা ও দেখানো মাঠের রূপটার চেয়ে মনোরম পরিষ্কার হয়ে যে ফুটে ওঠে ভাবুকের লেখায় বণে বর্ণে, তা এই কাযের চশমা আর ভাবের চশমা দিয়ে দেখা ক্ষেত আর মাঠের দুটি বর্ণনা থেকে পরিষ্কার ধরা যাবে। প্রথম কাযের চশমা দিয়ে দেখা মাঠ বর্ণন, মাষ্টার মশায় যেন উপদেশ দিলেন শিশুকে—যে মাঠে ছুটাছুটিই করতে চায় তাকে— “হে বালক! মাঠে গিয়ে দেখে এস তুমি কত কষ্টে চাষা লোক চষিতেছে ভূমি॥ পরিপাটি করে মাটি হ’য়ে সাবধান তবে তায় শস্য হয়—ছোলা মুগ ধান৷” এই কাযের দৃষ্টি দিয়ে মাঠকে তো দেখাই গেল না, শস্য কেমন করে হয়, মাটি পরিপাটি হয় কিসে, তাও দেখলেম না; মাটি পরিপাটিরূপে বর্ণন ও দর্শন কি করে হয় তা জানতে কাযেই ভাবুকের কাছে দৌড়োতেই হল আমাদের। সেখানে গিয়ে শস্যক্ষেত্রের এক অপরূপ রূপ দেখলেম— নবপ্রবালোদ্গমশস্যরম্যঃ প্রফুল্ললোধ্রঃ পরিপক্বশালিঃ বিলীনপদ্মঃ প্ৰপতত্তুষারঃ কিম্বা যেমন— পরিণত-বহুশালি-ব্যাকুল-গ্রাম-সীমা সততমতিমানজ্ঞক্রৌঞ্চনাদোপগীতঃ॥ নিছক কাযের দৃষ্টি দিয়ে কাযের মানুষের কাছে মাঠখানা কৃষিতত্ত্বের ও নীতিশাস্ত্রের বইয়ের পাতার মতোই দেখালো, মাঠের সবুজ প্রসার কেমন করে গ্রামের কোন্ পর্যন্ত বিস্তৃত হয়েছে তা দেখলে ভাবুক। কাযের দৃষ্টি দেখলে মুগ মুসুরী ছোলা কলা ধান ফলানো হচ্ছে মাঠের পাট করে, কিন্তু ধান পেকে কোথায় সোনার মতো ঝক্‌ছে, লোধ্র গাছ গ্রামের ধারে কোথায় ফুল ফুটিয়েছে, রাঙ্গা, সবুজ, নানা বর্ণের শস্য, শিশিরে নুয়ে পড়া পদ্মফুল এসব কিছু ধরতে পারলে না অত্যন্ত কাযের কাজি দৃষ্টিটা, অথচ মাঠের ছবি যথার্থ যদি দিতে হয় কি দেখতে হয় মাঠ কেমন করে চষা হয় এটা দেখানোর চেয়ে মাঠে কোথায় কি রং লেগেছে কি ফুল ফুটেছে ইত্যাদি নানা হিসেব না নিলে তো চলে না, সে হিসেবে ভাবুক দৃষ্টি ঠিক দেখার মতো দেখাই দেখলে বলতে হবে। কাযের দৃষ্টি মানুষের স্বার্থের সঙ্গে দৃষ্টির জিনিষকে জড়িয়ে দেখে, আর ভাবুকের দৃষ্টি অনেকটা নিঃস্বাৰ্থ ভাবে সৃষ্টির সামগ্ৰী স্পর্শ করে। কাযের মানুষ দেখে কেম্বিসটা পর্দা কি ব্যাগ অথবা জাহাজের পাল প্রস্তুতের বেশ উপযুক্ত, কিন্তু ভাবুক অমন মজবুত কাপড়টা একটা ছবি দিয়ে ভরে দেবারই ঠিক উপযোগী ঠাউরে নেয়। সাদা পাথর, কাযের দৃষ্টি বলে সেটা পুড়িয়ে চুণ করে ফেল, ভাবুক দৃষ্টি বলে সেটাতে মূর্তি বানিয়ে নেওয়াই ঠিক। নির্মম স্বাৰ্থদৃষ্টি, কাযের চোখ নিয়েই সাধারণ মানুষ নিজের মুঠোয় ফুটন্ত ফুলগুলোর গলা চেপে ধরে বলির পাঁঠার মতো, সেগুলোকে বাগানের বুক থেকে ছিঁড়ে নিয়ে পূজোর ঘরের দিকে চলে, আর ভাবুক যে দৃষ্টি নিয়ে ফুলের দিকে চায় তাতে স্বার্থের ভার এত অল্প যে প্রজাপতি কি মৌমাছির পাতলা ডানার অত্যন্ত লঘু অতি কোমল পরশও তার কাছে হার মানে। অতি মাত্রায় সাধারণ অত্যন্ত কাযের দৃষ্টি সেটা ফুলের গুচ্ছকে পরকালের পথ পরিষ্কারের ঝাঁটা বলেই দেখছে, ছেলেবেলার কৌতূহল-দৃষ্টি সেটা রাঙ্গা ফুলের দিকে লুব্ধ দৃষ্টি নিয়ে ডাকাতের মতো বাগান থেকে বাগানের শোভাকে লুটে নিয়ে খেলতে চাচ্ছে। কিম্বা বিলাসের দৃষ্টি যেটা ফুলগুলোর বুকে সূঁচ বিঁধে বিঁধে ফুলের ফুলশয্যা রচনা করে তার উপরে লুণ্ঠন বিলুণ্ঠন করে ফুলের শোভা মলিন করে দিয়ে যাচ্ছে। এদের চেয়ে ভাবুকের দৃষ্টি কতখানি নিঃস্বার্থ নির্মল অথচ আশ্চর্যরকম ঘনিষ্ঠভাবে ফুলকে দেখলে, ভাবুকের লেখাতেই ধরা রয়েছে— “চল চলরে ভঁবরা কঁবল পাস তেরা কঁবল গাবৈ অতি উদাস। খোঁজ করত বহ বার বার তন বন ফুল্যৌ ভার ভার॥” —কবীর কবি কালিদাস এই দৃষ্টি দিয়েই দুষ্মন্ত রাজাকে দেখালেন শকুন্তলার রূপ— অনাঘ্ৰাতং পুষ্পং কিসলয়মলূনং কররুহৈ……মধুনবমনাস্বাদিতরসম্! কিন্তু রাজার বিদূষকের ইন্দ্রিয়পরায়ণ দৃষ্টি অত্যন্ত মোটা পেটের মতই মোটা ছিল, কাযেই রাজার কাছে শকুন্তলার বর্ণন শুনে সে পিণ্ডি খেজুর আর তেঁতুলের উপমা রাজাকে শোনাতে বসে গেল। রাজা বিদূষককে ধমকে বলেন— অনবাপ্তচক্ষুঃফলোঽসি, যেন ত্বয়া দ্রষ্টব্যানাং পরং ন দৃষ্টম্॥ তুমি দর্শনীয় বস্তুর যেটি দেখবার যোগ্য সেইটি যখন দেখতে পেলে না তখন তুমি বিফলই চক্ষু পেয়েছো। রাবণটার চেয়ে-দেখা, শুনে-দেখা, ছুঁয়ে-দেখা সমস্তই রামের দেখার চেয়ে দশগুণ বেশি ছিল— “কুড়ি হাত কুড়ি চক্ষু দশটা বদন রাক্ষসের রাজা সেই লঙ্কার রাবণ। ত্ৰিভুবন তাঁহার ভয়েতে কম্পবান মনুষ্য রামেরে সেটা করে কীটজ্ঞান।” রাবণের দশটা মাথার মধ্যে কি ভয়ঙ্কর রকম বস্তুগত বুদ্ধিই দিনরাত প্রবেশ করতো তার দশ দিকে বিস্তৃত দর্শন স্পর্শন শ্রবণ ইত্যাদির রাস্তা ধরে, ভাবলেও অবাক হতে হয়। কিন্তু সীতার পণ ভাঙ্গা সুসাধ্য হল বালক রামের—কুড়ি-হাত রাবণের নয়। কেননা ধনুকভঙ্গের সময় রামের মনটি রামের হাতের পরশে গিয়ে যুক্ত হয়েছিল, আর রাবণের মন নিশ্চয়ই সীতার দিকে লোলুপ দৃষ্টিতে চেয়েছিল, ধনুক তোলা ধনুক ভাঙ্গা যে ক’টা আঙ্গুলে হতে পারে তাদের ডগাতেও পৌঁছোয়নি সময়মতো। দিনরাতের মধ্যে যে সব ঘটনা হঠাৎ ঘটে কিম্বা আকস্মিকভাবে উপস্থিত হয় প্রতিদিনের বাঁধা চালের মধ্যে সেগুলোকে মানুষ খুব কাযে ব্যস্ত থাকলেও অন্ততঃ এক পলের জন্যেও মন দিয়ে না দেখে থাকতে পারে না। হঠাৎ পূব কি পশ্চিম আকাশ রঙ্গে রাঙ্গা হয়ে উঠলো; দৃষ্টির সঙ্গে মন তখনি যুক্ত হয়ে দেখে কি হল; পাড়ায় ট্রামের ঘন্টার টুং টাং এর উপরে হঠাৎ কোন সকালে বাঁশীর সুর বাজলে মন বলে ওঠে, কি শুনি? হঠাৎ দক্ষিণ বাতাস ঘরের ঝাপটা নাড়িয়ে দিলে, মন যেন ঘুম ভেঙ্গে চমকে বলে, শীত গেল নাকি দেখি! পাড়ার যে ছেলেটা প্রতিদিন বাড়ির সামনে দিয়ে ইস্কুলে যায় তাকে দু’একদিনেই চিনে নিয়ে চোখ ছেলেটার দিকে ফেরা থেকে ক্ষান্ত থাকে; কিন্তু সেই ছেলেটা হঠাৎ বাঁশী বাজিয়ে বর সেজে দুয়োর গোড়া দিয়ে শোভাযাত্রা করে যখন চলে তখন নয়ন মন শ্রবণ সবাই দৌড়ে দেখতে চলে—আর সেই দেখাটাই মনের মধ্যে লুকোনো রস জাগিয়ে দেয় হঠাৎ। তাং রাঘবং দৃষ্টিভিরাপিবন্তো, নার্য্যোন জগ্মুর্ব্বিষয়ান্তরাণি তথাপি শেষেন্দ্রিয়বৃত্তিরাসাং সর্ব্বাত্মনা চক্ষুরৈব প্রবিষ্টা। —যা হঠাৎ এল তার দিকে, সমস্ত ইন্দ্রিয়-ব্যাপারের আকৃষ্ট হবার একটা চেষ্টা থেকে থেকে জাগে আমাদের সকলেরই। কিন্তু বাইরে থেকে প্রেরণাসাপেক্ষ চোখ কান ইত্যাদির এই কৌতূহল সব সময়ে জাগিয়ে রাখতে পারেন কেবল ভাবুকেরাই—বিশ্ব-জগৎ একটা নিত্য উৎসবের মধ্যে দিয়ে নতুন নতুন রসের সরঞ্জাম নিয়ে ভাবুকের কাছে দেখা দেয় এবং সেই দেখা ধরা থাকে ভাবুকের রেখার টানে, লেখার ছাঁদে, বর্ণে ও বর্ণনে, কাযেই বলা চলে বুদ্ধির নাকে চড়ানো চলতি চশমার ঠিক উল্টো এবং তার চেয়ে ঢের শক্তিমান চশমা হল মনের সঙ্গে যুক্ত ভাবের চশমাখানি। এমন মানুষ নেই যার শ্রবণের সঙ্গে ছুটির ঘণ্টা আর কাযে যাবার ঘণ্টার ছেলেবেলা থেকেই বিশেষ যোগাযোগ আছে; কিন্তু সচরাচর এত কাযের ভিড়ে মানুষকে ঘিরে থাকে যে ভাবুক, মন দিয়ে এই ঘণ্টা শুনে যতক্ষণ না বলে দেন ঘণ্টা দুটো কি বলে ততক্ষণ ঘণ্টাটা শোনাই আমাদের হয় নি—যথার্থভাবে একথা বলা যায়। সবারই কানে আসে সন্ধ্যা পূজোর শঙ্খধ্বনি, সন্ধ্যায় আঁধার-করা ছবি চোখে পড়ে সবারই, কিন্তু সেই শঙ্খধ্বনি সন্ধ্যারাগের সঙ্গে মিলিয়ে সুর দিয়ে ছন্দ দিয়ে একটি অপরূপ রূপ ধরিয়ে যখন ভাবুক মানুষ আমাদের শুনিয়ে দিলেন দেখিয়ে দিলেন কেবল তখনই তো সন্ধ্যা, সন্ধ্যাপূজা এমন কি সন্ধ্যাকালের এই পৃথিবীকে যথার্থভাবে দেখতে শুনতে পেলেম আমরা— “সন্ধ্যা হল গো— ওমা সন্ধ্যা হল বুকে ধর অতল কালে৷ স্নেহের মাঝে ডুবিয়ে আমায় স্নিগ্ধ কর॥ ফিরিয়ে নে, মা, ফিরিয়ে নে গো সব যে কোথায় হারিয়েছে গো ছড়ানো এই জীবন, তোমার আঁধার মাঝে হোক্ না জড়॥ আর আমারে বাইরে তোমার কোথাও যেন না যায় দেখা তোমার রাতে মিলাক আমার জীবন-সাঁঝের রশ্মিরেখা॥ আমায় ঘিরি’ আমায় চুমি’ কেবল তুমি, কেবল তুমি! আমার বলে যাহা আছে, মা তোমার করে সকল হর॥” বুক সন্ধ্যার বুকের স্পন্দন অনুভব করলে, নয়নের দৃষ্টি অতল কালোর স্নেহভরা পরশ নিবিড় করে উপভোগ করলে, ফিরে এলো নতুন করে তরুণ দৃষ্টির করুণ চাহনি, নতুন করে জাগালো প্রাণভরে শুনে নেবার, গেয়ে ওঠবার ইচ্ছা, সারা সংসারে ছড়ানো জীবনের দিনগুলো সাঁঝের আঁধারের মধ্যে দিয়ে মিল্লো এসে একেবারে। সন্ধ্যা তারার কোলের কাছটিতে রহস্য নিকেতনে, আলো আর কালোর ছন্দে প্রাণকে দুলিয়ে দিলে, রাতের সুরে গিয়ে মিল্লো দিনের সুর, আঁধারে গিয়ে মিশলো—আলো। একেবারে ঢেলে দেওয়া গেল সব স্বার্থে জলাঞ্জলি দিয়ে নিজকে গভীর রিক্ততার প্রশান্ত আলিঙ্গনে। সন্ধ্যা, কতদিন ধরে যার সঙ্গে দেখা-শোনা হয়ে আসছে তাকে এমন করে দেখা ক’জন দেখলে? নিত্য সন্ধ্যার হাওয়াটা গড়ের মাঠে গিয়ে খেয়ে এসে এবং পূজো-বাড়িতে গিয়ে শাঁখঘণ্টা শুনে এসে আমরা পুঁথিগত ত্রিসন্ধ্যার মন্ত্রগুলোর চেয়ে একটুও অধিক দেখতে শুনতে পেলেম না। কিন্তু কবীর দুছত্রে সমস্ত সন্ধ্যার প্রাণটি একমুহূর্তে টেনে আনলেন আমাদের দিকে— “সাঁঝ পড়ে দিন বীতরে চকরী দীন্‌হা রোয়। চল চকরা বা দেশকো জঁহা রৈন ন হোয়॥” এ কোন্ অগম্য দেশের খবর এসে পৌঁছল! রাত্রির পরপারে যুগল তারার রাজত্বে যাবার সকরুণ ডাক, ভীরু-পাখীর গলার সুর ধরে’ এ কোন্ চির-মিলনের বাণী অন্ধকারের মধ্যে দিয়ে এসে পৌঁছল যারা দেখেও দেখছে না, শুনেও শুনছে না, ধরেও ধরতে পারছে না তাদের কাছে! যে চোখের দেখায় সন্ধ্যার অন্ধকার রাত্রির কালিমা শুধু আমাদের শঙ্কা আর সংশয়-বুদ্ধিই জাগিয়ে তোলে, ভাবুকের দেখা কি সেই চলতি চোখ দিয়ে দেখা, না তেমন শোনা দিয়ে, তেমন পরখ দিয়ে চেয়ে-দেখা, শুনে-দেখা, ছুঁয়ে-দেখা? এ সে ভাবুকের কবির শিল্পীর সেই দিব্য দৃষ্টি, যা অন্ধকারে আলো দেখলে, দুঃখের পরশেও আনন্দ পেল, অসীম স্তব্ধতার ভিতরে সন্ধান পেয়ে গেল সুরের— “তিঁবির সাঁঝকা গহিরা আবৈ ছাবৈ প্রেম মন অসেঁ পশ্চিম দিগকী খিড়কী খোলো ডুবহু প্রেম গগন মেঁ। চেত-সংবল-দল রস পিয়োরে লহর লেহ যা তনমেঁ॥ সংখ ঘণ্টা সহ নাই বাজে শোভা-সিন্ধু মহল মেঁ॥” সন্ধ্যা ঘনিয়ে এল, আঁধারের প্রেম তনু মনকে আবৃত করলে, আলো যে দিকে অস্ত যাচ্ছে সেই দুয়ার খোলো, এই সন্ধ্যাকাশের মত বিস্তৃত অন্ধকারের প্রেমে নিমগ্ন হও, চিত্ত-শতদল পান করুক রাত্রির রস, মনে লাগুক, মনে ধরুক অতল কালোর প্রেম-লহরী, সীমাহীন গভীরে বাজ্‌তে থাকুক আরতির শঙ্খঘণ্টা, মিলনের বাঁশি,—আঁধার-সমুদ্রে ফুটে উঠুক অপরূপ রূপ। এ যে হৃদয়ে এসে মিলতে চাইলো নূতনতরো দেখা শোনা ছোঁয়া দিয়ে বিশ্বচরাচরের সঙ্গে। আগে আসছিল মানুষের বাইরেটা তার বুদ্ধির গোচরে ইন্দ্রিয়ের সহায়তায় যন্ত্রে ধরা, এখন চল্লো মানুষের অন্তরটা বাইরের সঙ্গে মিলতে হাতে হাতে চোখে চোখে গলায় গলায়—বাইরের আসা এবং বেরিয়ে যাওয়া এরি ছন্দ আবিষ্কৃত হ’ল ভাবুক মানুষের জীবনে। অভিনিবেশ করে বস্তুতে ঘটনাতে নিবিষ্ট হবার শিক্ষা ও সাধনায় আপনার কার্যকরী ইন্দ্রিয়-শক্তি সকলকে নতুনতরো শক্তিমান করে তুল্লেন যে মুহূর্তে ভাবুক—সৌন্দর্যে অর্থে সম্পদে সৃষ্টির জিনিষ ভরে উঠলো, জগৎ এক অপরূপ বেশে সেজে দাঁড়ালো মানুষের মনের দুয়ারে; বারমহল ছেড়ে অভ্যাগত এল যেন অন্দরের ভিতর ভালবাসার রাজত্বে। রসের স্বাদ অনুভব করলে মানুষ, যেটা সে কিছুতে পেতে পারতো না যদি সে ইন্দ্রিয় সমস্তকে কেবলি প্রহরী ও মন্ত্রীর কায দিয়ে বসিয়ে রাখতো বুদ্ধির কোঠার দেউড়িতে। এই নতুন শিক্ষা, নতুন সাধনা যখন মানুষের ইন্দ্রিয়গুলো লাভ করলে, তখন মানুষের কণ্ঠ শুধু বলা-কওয়া হাঁক-ডাক করেই বসে রইলো না; সে গেয়ে উঠলো। হাতের আঙ্গুলগুলো নানা জিনিষ স্পর্শ করে নরম গরম কঠিন কি মৃদু ইত্যাদির পরখ করেই ক্ষান্ত হল না, তারা সংযত হয়ে তুলি বাটালি সূঁচ হাতুড়ি এমনি নানা জিনিষকে চালাতে শিখে নিলে, বীণা-যন্ত্রের উপরে সুর ধরতে লাগলো হাত আঙ্গুলের আগা, শুধু লোহার তারকে তার মাত্র জেনেই ক্ষান্ত হল না, সুরের তার পেয়ে যন্ত্রের পর্দায় পর্দায় বিচরণ করতে থাকলো আঙ্গুলের পরশ গুন্ গুন্ স্বরে ফুলের উপরে ভ্রমরের মতো, কোলের বীণার সঙ্গে যেন প্রেম করে চল্লো হাত, কাণ শুনতে লাগলো প্রেমিকের মতো কোলের বীণার প্রেমালাপ। সরু সূঁচের, সোনার সূতোর, রংএ ভরা তুলির সজীব ছন্দ ধরে তালে তালে চল্লো আঙ্গুল, হাতুড়ি বাটালির ওঠা-পড়ার সঙ্গে সঙ্গে তাণ্ডব নৃত্য করতে শিক্ষা নিলে শিল্পীর হাত—কাযের ভিড় থেকে মানুষের চোখ ও হাত, সেই সঙ্গে মনও ছুটি পেয়ে খেলাবার ও ডানা মেলবার অবসর পেয়ে গেল। সমস্ত ইন্দ্রিয় দিয়ে সৃষ্টির দিকে এই অভিনিবিষ্ট দৃষ্টি—এইটুকুই ভাবুকের সাধনার চরম হল তা তো নয়, সৃষ্টির বাইরে যা তাকেও ধরবার জন্যে ভাবুক আরো এক নতুন নেত্র খুল্লেন—খুবই প্রখর দৃষ্টি যার এমন যে দূরবীক্ষণ-যন্ত্র তাকেও হার মানালে মানুষের এই মানস-নেত্র, চোখের দৃষ্টি যেখানে চলে না,—দূরবীক্ষণের দূরদৃষ্টিরও অগম্য যে স্থান। মানুষ এই আর এক নতুন দৃষ্টির সাধনায় বলীয়ান্ হয়ে নিজের মনের দেখা নিয়ে বিশ্বরাজ্যের পরপারেও সন্ধানে বেরিয়ে গেল—সেই রাজত্বে যেখানে সৃষ্টির অবগুণ্ঠনে নিজকে আবৃত করে স্রষ্টা রয়েছেন গোপনে— “যথাদর্শে তথাত্মনি যথাপ্‌স্যুৎপরিব তথা গন্ধর্ব্বলোকে ছায়াতপয়োরিব ব্রহ্মলোকে৷” এই ব্ৰহ্মলোক যেখানে ছায়া-তপে সমস্ত প্রকাশ পাচ্ছে, গন্ধৰ্বলোক যেখানে রূপ ও সুর উভয়ে জলের উপরে যেন তরঙ্গিত হচ্ছে, এবং আত্মার মধ্যে যেখানে নিখিলের সমস্তই দর্পণের মতো প্রতিবিম্বিত দেখা যাচ্ছে, সমস্তই দিব্য দৃষ্টিতে পরশ ও পরখ করে নিলে মানুষ। দর্শকের ও শ্রোতার জায়গায় বসে মানুষ দেখবার মতো করে দেখলে, শোনবার মত করে শুনে নিলে নিখিলের এই রূপের লীলা সুরের খেলা, এবং এরও ওপরে যে লীলাময় মানুষকে সমস্ত পদার্থ সমস্ত বস্তুর সঙ্গে একসূত্রে বেঁধে একই নাট্যশালায় নাচিয়ে গাইয়ে চলেছেন তাঁকে পর্যন্ত ছুঁয়ে এল মানুষ নেপথ্য সরিয়ে। দেখা শোনা পরশ করার চরম হয়ে গেল, তারপর এল দেখানোর পালা। মানুষ এবারে আর এক নতুন অদ্ভুত অনিয়ন্ত্রিত অভূতপূর্ব সৃষ্টি সাধন করে গুণী শিল্পী হয়ে বসলো। এই দৃষ্টিবলে আপনার কল্পনালোকের মনোরাজ্যের গোপনতা থেকে মানুষ নতুন নতুন সৃষ্টি বার করে আনতে লাগলো। যে এতদিন দর্শক ছিল সে হল প্রদর্শক, দ্রষ্টা হয়ে বসলো দ্বিতীয় স্রষ্টা। অরূপকে রূপ দিয়ে, অসুন্দরকে সুন্দর করে, অবোলাকে সুর দিয়ে, ছবিকে প্রাণ, রঙ্গহীনকে রং দিয়ে চল্লো মানুষ— “প্রেমের করুণ কোমলতা ফুটিল তা’ সৌন্দর্যের পুষ্পপুঞ্জে প্রশান্ত পাষাণে॥”
অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর
মত ও মন্ত্র অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর মত ও মন্ত্র শিল্পকে পাওয়া আর বাস্তব শিল্পকে পাওয়ার মানেতে তফাৎ আছে—“There is true and false realisation, there is a realisation which seeks to impress the vital Essence of the subject and there is a realisation which bases its success upon its power to present a deceptive illusion.” —R. G. Hatton. বহির্জগতের কাল্পনিক প্রতিলিপিই চিত্র, মনোজগতে ধরা নানা বস্তুর যে স্মৃতি তার আলেখ্যই চিত্র,—এ দুটোই মত, মন্ত্র নয়। বাইরে যা দেখছি খুঁটে খুঁটে তার কাপি নেওয়া কিম্বা চোখ উল্টে ভিতরের দিকে বাইরেরই যে সব স্মৃতি রয়েছে জমা তার হুবহু ছাপ তোলায় তফাৎ একটুও নেই, দুটোই একজাতির চিত্র-–এও ছাপ সেও ছাপ, কাপি ছবি নয়। ফটো যন্ত্র বাইরের গাছপালার ছাপ নেয়, আর আচার্য জগদীশচন্দ্রের কল গাছের ভিতরকার ব্যাপারের রেকর্ড তোলে, দুটোই কিন্তু কল, artist নয় ; ধর, কোন উপায়ে যদি কল দুটোই বেঁচে উঠে কাজে লেগে যায় তা হ’লেও তারা কি artist, একথা বলাতে পারবে আপনাদের? চোখের সামনে সূর্যোদয় আর অতীত সমস্ত সূর্যোদয়ের স্মৃতিচিত্র (memory picture) দুয়ের মধ্যেও না হয় রং চংএর তফাৎ হ’ল, কিন্তু তাই বলে একটা আর্ট আর অন্যটা আর্ট নয়, স্মৃতির যথাযথ প্রতিলিপিই আর্ট, সামনের যথাযথটা আর্ট নয়, কিম্বা সামনেরটাই আর্ট আর মনেরটা ঠিক তার উল্টো জিনিষ, এ তর্ক উঠতেই পারে না, কেননা যথাযথ প্রতিলিপি, তা সে এ-পিঠেরই হোক বা ও-পিঠেরই হোক, সে কাপি, এবং যারা তা করছে তারা নকলই করছে, কেউ আসল গড়ছে না। মুখস্থ আউড়ে গেল পাখী একটু না হয় ভুল করে তার পাঠ, বলে গেল ছেলে পরিষ্কার বইখানার পাতা খুলে—দু’জনেই পুনরুক্তি করলে, অন্যের কথার প্রতিধ্বনি দিলে, বানিয়ে দুটাে রূপকথা বল্লে না, ছড়া কাটলে না, কেননা কল্পনা নেই দুজনেরই, কাজেই রচনা করলে না তারা কেউ, সুতরাং আর্টিষ্ট হবার দিকেও গেল না এরা, নকলনবিশ হয়েই রইল। কল্পনাশূন্য চোখের দেখা বা ওই ভাবে চোখে দেখার স্মৃতি শিল্প-শব্দকল্পদ্রুম লিখতে হ’লে এর মানে দিতে হবে গাছের জড় বা শিকড় ; জড় সে জগৎকে আঁকড়ে রয়েছে, খুব কাজের জিনিষ কল্পনা এবং রচনার রস যেমনি শিকড়ে লাগলে আমনি ডাল পাল বিস্তার না করে সে থাকতে পারলে না। নিশ্চল মাটির তলায় অন্ধকার ছেড়ে সে প্রকাশিত হ’ল আলোর জগতে, ভাবের বাতাস লাগলো তার দেহে, ফুটলো পাতা হ’য়ে ফুল হ’য়ে ফল হ’য়ে, হাওয়ায় দুল্লো রূপের ডালি, রসের রচনা বীজের মধ্যে যতটা বস্তু এবং শিকড়ের মধ্যে যতটা সঞ্চয় ছিল তাই নিয়ে! বাইরেটা এবং বাইরের স্মৃতিটা শিল্পীর ভাণ্ডার, শিল্পীর কল্পনালক্ষ্মী সেখান থেকে এটা ওটা সেটা নিয়ে নানা সামগ্ৰী বানিয়ে পরিবেশন করেন। মূর্খেরাই কেবল এই ভাণ্ডারকে হোটেল এবং দোকান বলে’ ভ্রম করে যেখানে ready-made সমস্ত পাওয়া যায়— “People regard Nature as a store-house of ready-made ornaments instead of a book of reference for ideas and principles to be thought out with diligence and applied with care. Ready-made ornaments are too often like ready-made clothes badly fitting and ill-suited to the subject.–Frank Jackson. যে গড়ছে বা আঁকছে তার মনের কল্পনার সংস্পৰ্শ-শূন্য ছবি কলে এঁকেছে মানুষ, হাতেও গড়েছে কেষ্টনগরের পুতুল,—ঘটনার যথাযথ প্রতিরূপ। শিল্পের যতগুলো কৌশল, রূপ, প্রমাণ, ভাবলাবণ্য, সাদৃশ্য, বর্ণিকাভঙ্গ, anatomy, perspective, shade-and-light, depth, space, movement ইত্যাদির নিয়মাবলী নির্ভুল ও সম্পূর্ণভাবে মেনে চল্লো কেষ্টনগরের কারিগরের গড়নটি কিন্তু এই বাস্তবের নিয়ম মেনে চলার ফলে একটা গ্রীক প্রস্তরমূর্তির সঙ্গে কি ঘুরণী পাড়ার মাটির পুতুলটিকে সমান করে তুলতে পারলে, না এইটেই প্রমাণ করলে যে মানুষ চেষ্টা করলে কলের চেয়ে নির্ভুল ও পরিপূর্ণ নকল নিতে পাকা হয়ে উঠতে পারে? বাস্তবের দিকে যেমন দেখা গেল, কল্পনাশূন্য বাস্তব ছবি নেওয়া চল্লো বহির্জগতের, তেমনি অন্তর্জগতের বাস্তবম্পৰ্শ-শূন্য নিছক কল্পনার একটা কিছু ধরবার চেষ্টা করা যাক। কিন্তু কোথায় তেমন জিনিষ ? সত্যপীরের মাটির ঘোড়া, কালীঘাটের পট, নতুন বাঙলার আমাদের ছবি, পুরোণো বাংলার দশভুজা এর একটাও নিছক কাল্পনিক জিনিষ নয়, এরা সবাই বাস্তবকে ধরে তবে তো প্রকাশ হ’ল? মন যে বাস্তবকে স্পর্শ করেই আছে, নানা বস্তুর নানা ভাবের স্মৃতি জমা হচ্ছে মনে। নিছক কল্পনা সে মনেই উঠতো মনেই থাকতো যদি না বাস্তব-জগতের ভাব ও রূপের সংস্পর্শে সে আসতো। অসীমের কল্পনা তাও সীমার সঙ্গে যুক্ত হয়ে প্রকাশ পায়, সমুদ্রের অসীম বিস্তার ডাঙার সীমারেখাতে এসে না মিল্লে ছবি হয় না, নকল যা তার সঙ্গে কল্পনার একটুও যোগ নেই কিন্তু বাস্তব জিনিষের সঙ্গে আমার স্মৃতির সঙ্গে কল্পনার যোগ সসীম থেকে আরম্ভ করে’ অসীমের মধ্যে ওতপ্রোত ভাবে দেখা যাচ্ছে। এই চোখের সামনে যে বিদ্যমান সৃষ্টি এটার মূলে দেখি সৃষ্টির কল্পনা রয়েছে, তাই এ এত বিচিত্র ও মনোহর—একটা গাছ আর একটার, একটি ফুল আর একটির, এক জীব আর এক জীবের, এক দিন আর এক দিনের মতো নয়; নীল আকাশ একই চন্দ্র-সূর্যকে নিয়ে পলে পলে আলো-অন্ধকারে নতুন থেকে নতুন স্বপ্ন রচনা করে চলেছে চিরকাল ধরে, পুরোণো আর হতে চাচ্ছে না এই পৃথিবী, শুধু এর পিছনে রচয়িতার কল্পনা এবং দর্শকের কল্পনা কাজ করছে বলেই। বহির্জগৎ যেমন সৃষ্টি, তেমনি ঐ সত্যপীরের ঘোড়া, সেটা ঘোড়া নয় অথচ ঘোড়া, কালীঘাটের পট যেটা প্রকৃতির নয় কিন্তু নানা রূপ ধরেছে এটার ওটার সেটার রেখা নানা রঙ্গের নানা তাক বাকের সাহায্যে, এরাও সৃষ্টি; দেখতে কেউ বড় সৃষ্টি, কেউ ছোট সৃষ্টি, কেউ ভাল সৃষ্টি, কেউ হয় তো বা অনাসৃষ্টি, কিন্তু সৃষ্টি, নকলের মতো প্রতিবিম্ব নয়। যে শিল্পজগৎ সত্য কল্পনার দ্বারা সজীব নয় সে বুদ্বুদের উপরে প্রতিবিম্বিত জগৎ-চিত্রটির মতো মিথ্যা ও ভঙ্গুর; দর্পণের উপরেই তার সমস্তখানি কিন্তু দর্পণের কাচ ও পারার এবং বুদ্বুদের জলবিন্দুটির যতটুকু সত্তা—তাও তার নেই। রচনা যেখানে রচয়িতার স্মৃতি ও কল্পনার কাছে ঋণী সেইখানেই সে আর্ট, যেখানে সে অন্যের রচনা ও কল্পনার কাছে ঋণী সেখানে সে আর্ট নয়, আসলের নকল মাত্র। হোমার, মিল্টন দুজনেই অন্ধ ও কবি কিন্তু বিদ্যমান ও অবিদ্যমানের দুয়েরই ঋণ বিষয়ে তাঁরা অন্ধ ছিলেন না তাঁরা বাস্তব কল্পনা করে’ গেছেন অন্ধ কল্পনা করেননি। কালিদাস, ভবভূতি চক্ষুষ্মান কবি কিন্তু তাঁরাও কল্পনা বাদে বাস্তব কিম্বা বাস্তব বাদে কল্পনার ছবি রেখে যান নি। গানের সুর সম্পূর্ণ কাল্পনিক জিনিষ কিন্তু এই বাস্তব জগতের বায়ুতরঙ্গের উপর তার প্রতিষ্ঠা হ’ল, কথার ছবির সঙ্গে সে আপনাকে মেলালে তবে সে সঙ্গীত হয়ে উঠলে,—অনাহত আপনাকে করলে আহত বাতাস ধরে, কিন্তু হরবোলার বুলি বাস্তব জগতের সঠিক শব্দগুলোর প্রতিধ্বনি দিলে সেইজন্য সে সঙ্গীত হওয়া দূরের কথা খুব নিকৃষ্ট যে টপ্পা তাও হ’ল না। বাস্তবকে কল্পনা থেকে কতখানি সরালে কিম্বা কল্পনাকে বাস্তব থেকে কতটা হঠিয়ে নিলে art হয় এ তর্কের মীমাংসা হওয়া শক্ত, কিন্তু কল্পনার সঙ্গে বাস্তব, চোখে-দেখা জগতের সঙ্গে মনে-ভাবা জগতের মিলন না হলে যে art হবার জো নেই এটা দেখাই যাচ্ছে। “One of the hardest thing in the world is to determine how much realism is allowable to any particular picture.” —Burn Jones. এই হ’ল ইংলণ্ডের প্রসিদ্ধ চিত্রকর Burn Jonesএর কথা। অনেক দিন ধরে চিত্র এঁকে যে জ্ঞান লাভ করলেন শিল্পী তারি ফলে বুঝলেন যে বস্তুতন্ত্রতা ছবিতে কতখানি সয় তা ঠিক করা মুস্কিল। ইংরেজ শিল্পী এখানে কোন মত দিলেন না, ছবি আঁকতে গেলে সবারই যে প্রশ্ন সামনে উদয় হয় তাই লিখলেন, কিন্তু আমাদের দেশে মত দেওয়া যেমন সুলভ, মত ধরে চলাও তেমনি সাধারণ—কে চিত্রবিদ তার সম্বন্ধে পরিস্কার মত, কি চিত্র তারও বিষয়ে পাকা শেষ মত প্রচারিত হ’ল এবং সেই সব মতের চশমা পরে’ ভারতবর্ষের চিত্রকলার অাদর্শগুলোর দিকে চেয়ে দেখে’ অজন্তার শিল্পও আমাদের শ্রদ্ধেয় অক্ষয়চন্দ্র মৈত্র মহাশয়ের চোখে কি ভাবে পড়লে তার পরিষ্কার ছবি কার্তিক সংখ্যার প্রবাসীর কষ্টিপাথর থেকে তুলে দিলেম—“যাহা ছিল তাহা নাই। যাহা আছে সেই অজন্তাগুহার চিত্রাবলী, তাহাতে যাহা আছে, তাহা কিন্তু চিত্র নহে চিত্রাভাস। তাহা পুরাতন ভারতচিত্রের অসম্যক্ নিদর্শন, চিত্র-সাহিত্যদর্পণের দোষ-পরিচ্ছেদের অনায়াসলভ্য উদাহরণ। তাহা কেবল বিলাসব্যসনমুক্ত যোগযুক্ত অনাসক্ত সন্ন্যাসী সম্প্রদায়ের নিভৃত নিবাসের ভিত্তি বিলেপন…ভারতচিত্রোচিত প্রশংসা লাভের অনুপযুক্ত। তাহা এক শ্রেণীর পূর্ত কর্ম …তাহাতে যাহা কিছু চিত্রগুণের পরিচয় পাওয়া যায় তাহা অযত্নসম্ভূত আকস্মিক,…চিত্র-গুণের এবং চিত্র-দোষের যথাযথ পর্যবেক্ষণে যাঁহাদের চক্ষু অভ্যস্ত, তাঁহাদের নিকট অজন্তা-গুহা চিত্রাবলী ভারত চিত্রের অনিন্দ্যসুন্দর নিদর্শন বলিয়া মর্যাদা লাভ করিতে অসমর্থ। যাঁহাদের তুলিকাসম্পাতে এই সকল ভিত্তি-চিত্র অঙ্কিত হইয়াছিল, তাঁহারাও পুরাতন ভারতবর্ষে ‘চিত্রবিৎ’ বলিয়া কথিত হইতে পারিতেন না। তাঁহারা নমস্য; কিন্তু চিত্রে নহে, চরিত্রে। তাঁহাদের ভিত্তি-চিত্রও প্রশংসার্হ; কিন্তু কলা-লালিত্যে নহে, বিষয়-মাহাত্ম্যে।” (শ্রীঅক্ষয়কুমার মৈত্র, ভারত চিত্র চর্চ্চা)। মতের চশমা দিয়ে দেখলে অজন্তার ছবিতে কেন চাঁদের মধ্যেও অপরিণতি ও কলঙ্ক দেখা যায় এবং সেই দোষ ধরে বিশ্বকর্মাকেও বোকা বলে’ উড়িয়ে দেওয়া চলে, কিন্তু সৃষ্টির প্রকাশ হ’ল স্রষ্টার অভিমতে, শিল্পের প্রকাশ হ’ল শিল্পীর অভিমতটি ধরে’, ব্যক্তিবিশেষের বা শাস্ত্রমতবিশেষের সঙ্গে না মেলাই তার ধর্ম, কাযেই কলঙ্ক ও অপরিণতি যেমন হয় চাঁদের পক্ষে শোভার কারণ, শিল্পের পক্ষেও ঠিক ঐ কথাটাই খাটে। চিত্র-ষড়ঙ্গের কতখানি পরিপূর্ণতা পেলে চিত্র চিত্র হবে চিত্রাভাস হবে না, মডেল ড্রয়িং কতখানি সঠিক হ’লে তবে অজন্তার ছবিকে বলব চিত্র আর কতখানি কাঁচা থাকলে অজন্তার চিত্রাবলী হবে “চিত্র সাহিত্যদর্পণের দোষ-পরিচ্ছেদের অনায়াসলভ্য উদাহরণ” তা বলা কঠিন, তবে পাকা ড্রয়িং হলেই যে সুন্দর চিত্র হয় না এটা বিখ্যাত ফরাসি শিল্পী রোঁদা বলেছেন—“It is a false idea that drawing in itself can be beautiful. It is only beautiful through the truths and the feeling that it translates….There does not exist a single work of art which owes its charm only to balance of line and tone and which makes appeal to the eye alone.” —Rodin. আদর্শ জিনিষটি নিছক অবিদ্যমান জিনিষ, বস্তুতঃ তার সঙ্গে পুরোপুরি মিলন অসম্ভব, ধর্মে-কর্মে, শিল্পে সমাজে, ইতিহাসে, কোন দিক দিয়ে কেউ মেলেনি, না মেলাই হ’ল নিয়ম। সৃষ্টিকর্তার নিরাকার আদর্শ যা আমরা কল্পনা করি তার সঙ্গে সৃষ্ট বস্তুগুলো এক হ’য়ে মিল্লে সৃষ্টিতে প্রলয় আসে, তেমনি শাস্ত্রের আদর্শ গিয়ে শিল্পে মিল্পে শিল্প লোপ পায়—থাকে শুধু শাস্ত্রের পাতায় লেখা ভারত-শিল্পের ছ’ছত্ৰ শ্লোক মাত্র। দাঁড়ি পাল্লা বাটখারা ইত্যাদি নিয়ে চাল ডাল ওজন করা চলে, ছবির চারিদিকের গিল্টির ফ্রেমখানাও ওজন করা যায়, ছবির কাগজটা—মায় রংএর ডেলা, রংএর বাক্স, তুলি এমন কি শিল্পীকে পর্যন্ত সঠিক মেপে নেওয়া চলে, কিন্তু শিল্পরস যে অপরিমেয় অনির্বচনীয় জিনিষ, শাস্ত্রের বচন দিয়ে তার পরিমাণ করবে কে? তাই শাস্ত্রকারদের মধ্যে যিনি রসিক ছিলেন, শিল্প সম্বন্ধে লেখবার বেলায় মতের আকারে মনোভাব প্রকাশ করলেন না তিনি; শিল্পের একটি স্তোত্র রচনা করে অলঙ্কারশাস্ত্রের গোড়া পত্তন করলেন, যথা—“নিয়তিকৃতনিয়মরহিতাং হ্লাদৈকময়ীমনন্তপরতন্ত্রাং। নবরসরুচিরাং নিৰ্ম্মিতিমাদধীতি ভারতী কবের্জয়তি॥” নিয়তিকৃতনিয়মরহিতা আনন্দের সঙ্গে একীভূত অনন্তপরতন্ত্র নবরসরুচির নির্মিতিধারিণী যে কবি ভারতী তাঁর জয়। শুধু ভারতশিল্পের জন্য নয়, কাব্যচিত্র ভাস্কর্য সঙ্গীত নাট্য নৃত্য সব দেশের সব শিল্পের সবার জন্য এই মন্ত্রপূত সোণার পঞ্চপ্রদীপ ভারতবর্ষ ছেড়ে যে মানুষ একদিনও যায়নি সে জ্বালিয়ে গেছে। মতের ফুৎকারে এ কোন দিন নেভ্‌বার নয়, কেননা রস এবং সত্য এই দুই একে অমৃতে সিঞ্চিত করেছে। সূর্যের মতে দীপ্যমান এই মন্ত্র, এর আলোয় সমস্ত শিল্পেরই ভূত, ভবিষ্যৎ, বৰ্ত্তমান, কল্পনারাজ্য ও বাস্তবজগৎ যেমন পরিষ্কার করে দেখা যায় এমন আর কিছুতে নয়। মতগুলো আলেয়ার মত বেশ চক্‌মকে ঝকঝকে কিন্তু আলো দেয় যেটুকু তার পিছনে অন্ধকার এত বেশী যে, সেই আলেয়ার পিছনে চলতে বিপদ পদে পদে। শিল্প সম্বন্ধে বা যে কোন বিষয়ে যখন মানুষ মত প্রচার করতে চায় তখন একটা সৃষ্টিছাড়া আদর্শ আঁকড়ে না ধরলে মতটা জোর পায় না; “খোঁটার জোরে মেড়া লড়ে”। শিল্প বিষয়ে মত যাঁরা দিলেন তাঁদের কাছে আদর্শই হ’ল মুখ্য বিষয়, আর শিল্পটা হ’ল গৌণ; শিল্পের মন্ত্রগুলো তা নয়, শিল্পকেই মুখ্য রেখে তারা উচ্চারিত হ’ল। এই মত থেকে দেখি ভারত-শিল্প মিশর-শিল্প চীন-শিল্প পাশ্চাত্য-শিল্প প্রাচ্য-শিল্প—এখানে শিল্পে শিল্পে ভিন্ন, শিল্পীতে শিল্পীতে ভিন্ন, “ভাই ভাই ঠাঁই ঠাঁই, কারু মতে বেরাল-চোখ কারু মতে পদ্ম-আঁখি; কারু মতে সাদা কারু মতে কালো হ’ল ভাল, কিন্তু রসের ও সৌন্দর্যের যে মন্ত্র স্তন্যধারার মতো বিভিন্ন শিল্পকে এক করেছে সেটি প্রাণের রাস্তা ধরে’ চলেছে, মতের এতটুকু নালা বেয়ে নয়, কাজেই সে ধার দিয়ে শিল্পের বড় দিকটাতেই আমাদের নজর পড়ে। শিল্পের আপনার একটা যে জগৎজোড়া আদর্শ রয়েছে তাকেই লক্ষ্য করে চলেছে এ যাবৎ সব শিল্পী ও সব শিল্প তাই রক্ষে, না হ’লে শাস্ত্রের মতের পেষণে শিল্পকে ফেল্লে এক দিনে শিল্প ছাতু হ’য়ে যেতো। ভারতীয় মতে বিশুদ্ধ ছাতু কিম্বা ইউরোপীয় মতে পরিষ্কার ধবধবে বিস্কুটের গুঁড়োর পুনরাবির্ভাবের জন্য শিল্পার্থীরা প্রাণপাত করতে উদ্যত হয়েছে, এ দৃশ্য অতি মনোরম এটা বেদব্যাস বল্লেও আমি বলব নহি নহি, এভাবে শিল্পকে পাওয়া না পাওয়াই। যা এক কালে হ’য়ে গেছে তা সম্ভব হবে না কোন দিন—“Efforts to revive the art principles of the past will at best produce an art that is still-born. It is impossible for us to live and feel, as did the ancient Greeks. In the same way those who strive to follow the Greck methods in sculpture achieve only a similarity of form, the work remaining soulless for all the time. Such imitation is mere aping.” –Kandinsky. যে সমস্ত শিল্প সম্ভূত হয়ে গেছে তাদের আজকের দিনে আবার সম্ভব করে তোলবার চেষ্টা—যে একবার জন্মেছে তাকে পুনরায় জন্মগ্রহণ করাবার চেষ্টার মতোই পাগলামি। বিদ্যমান ছবি যা বাতাসের মধ্যে আলোর মধ্যে সৃষ্টিকর্তার বিরাট কল্পনার প্রেরণায় অত্যাশ্চর্য রূপ পেয়ে এসেছে তাকে চারকোণা এতটুকু কেম্বিসে তেল-জলের সাহায্যে দ্বিতীয় বার জন্ম দিতে চায় কোন পাগল? অগ্নিশিখাকে যতই সঠিক নকল কর সে আলো দেবে না তাপও দেবে না ; শুধু ভ্রান্ত একটা সাদৃশ্য দেবে ‘ইব’তে গিয়ে যার শেষ। বায়ুগতিতে পতাকার বিচলন দেখাতে পারলেই যদি মানুষ শাস্ত্রমতে চিত্রবিদ হ’ত—তবে ছবি যারা আঁকে এবং ছবি যারা দেখে সবাইকে বায়স্কোপের কর্তার পায়ের তলায় মাথা নোয়াতে হত। শিল্পীর কল্পনায় শিল্পের জিনিষ আগুন হয়ে জ্বলে, বাতাস হয়ে বয়, জল হ’য়ে চলে, উড়ে আসে মনের দিকে সোনার ডানা মেলে, নিয়ে চলে বিদ্যমান ছাড়িয়ে অবিদ্যমান কল্পনা ও রসের রাজত্বে দর্শক ও শ্রোতার মন—এই জন্যেই শিল্পের গৌরব করে মানুষ। বায়স্কোপের চলন্ত বলন্ত ভয়ঙ্কর রকমের বিদ্যমানের পুনরুক্তিকে মানুষ ‘সশ্বাস ইব’ অতএব চিত্র বলে তখনি মত প্রকাশ করে যখন তার বায়ু বিষম কুপিত হয়েছে। এখনকার ভারত-শিল্পের সাধনা অনাগত অজ্ঞাত যা তারি সাধন না হয়ে যদি পূর্বগত প্রাচীন ও আগত আধুনিক এবং সম্ভূত শিল্পের আরাধনাই হয় সবার মতে, তবে কলাদেবীর মন্দিরে ঘন্টাধ্বনি যথেষ্ট উঠবে কিন্তু এক লহমার জন্যেও শিল্পদেবতা সেখানে দেখা দেবেন না; “যস্যামতঃ তস্য মতং যস্য ন বেদ সঃ’। বিদ্যমান যে জগৎ তাকে প্রতিচ্ছবি দ্বারা বিদ্যমান করা মানে পুনরুক্তি দোষে নিজের আর্টকে দুষ্ট করা। বিদ্যমান জগৎ বিদ্যমানই তো রয়েছে, তাকে পুনঃ পুনঃ ছবিতে আবৃত্তি করে ড্রয়িং না হয় মানুষ পেলে, রূপকে চিনতে শিখলে, রংকে ধরতে শিখলে—কিন্তু এতো প্রথম পাঠ। এইখানেই যে ছেলে পড়া শেষ করলে সে কি শিল্পের সবখানি পেলে? অথবা মানুষের চেষ্টা তার কল্পনাতেই রয়ে গেল, অবিদ্যমান অবস্থাতেই মূকের স্বপ্ন দর্শনের মতো হ’ল ছেলেটির দশা! অন্ধের রূপকল্পনার মতো অবিদ্যমানকে বিদ্যমানের মধ্যে ধরতে সক্ষম রইলো সে নির্বাক ও চক্ষুহারা? একে রইলো বাইরে বাঁধা, অন্যে রইলো ভিতরে বাঁধা। শিল্পকে জানতে হ’লে যেখান থেকে কেবল মতই বার হ’চ্ছে সেই টোলে গেলে আমাদের চলবে না। ঋষি ও কবি এবং যাঁরা মন্ত্রদ্রষ্টা তাঁদের কাছে যেতে হবে চিত্রবিদ্‌কে। এর উত্তর কবীর দিয়েছেন চমৎকার— “জিন বহ চিত্র বনাইয়া সাঁচা সূত্ৰধারি কহহী কবীর তে জন ভলে চিত্র বংত লেহি বিচারি।” যিনি এই চিত্রের রচয়িতা তিনি সত্য সূত্রধর; সেইজন শ্রেষ্ঠ, যে চিত্রের সহিত চিত্রকরকেও নিলো বিচার করে’। “বিদ্যমান এই যে জগৎ-চিত্র এর উৎপত্তিস্থান অবিদ্যমানের মধ্যে”,—চিত্রের রহস্য এক কথায় প্রকাশ করলেন ঋষিরা। ঘটনের মূলে রচনের মূলে শিল্পের মূলে শিল্পী না শাস্ত্র-এ বিষয়ে পরিষ্কার কথা বল্লেন ঋষি—“সর্বে নিমেষা জজ্ঞিরে বিদ্যুতঃ পুরুষাদধি” কল্পনাতীত প্রদীপ্ত পুরুষ, নিমেষে নিমেষে ঘটনা সমস্তের জাতা তিনি।  অমুক শর্মার না বিশ্বকর্মার অভ্রান্ত শিল্পের প্রসাদ পেতে হবে মানুষ শিল্পীকে? সে সম্বন্ধে ঋষিদের আশীর্বচন উচ্চারিত হ’ল, “হংসাঃ শুক্লীকৃতা যেন শুকাশ্চ হরিতীকৃতাঃ। ময়ূরাশ্চিত্রিতা যেন স দেবত্ত্বাং প্ৰসীদতু”। হংস এল সাদা হয়ে, শুক এল সবুজ হয়ে, ময়ূর এল বিচিত্র হয়ে, তারা সেই ভাবেই জগৎচিত্রের মধ্যে গত হয়েই রইল, অবিদ্যমানকে জানতে পারলে না। রচনাও করতে পারলে না কল্পনাও করতে চাইলে না। মানুষ মনের মধ্যে ডুব দিয়ে অবিদ্যমানের মধ্যে বিদ্যমানকে ধরলে, —সে হ’ল শিল্পী, সে রচনা করলে, চিহ্ণবর্জিত যা ছিল তাকে চিহ্ণিত করলে, পাথরের রেখায় রঙ্গের টানে সুরের মীড়ে গলার স্বরে। বর্ষার মেঘ নীল পায়রার রং ধরে এল, শরতের মেঘ সাদা হাঁসের হাল্কা পালকের সাজে সেজে দেখা দিলে, কচি পাতা সবুজ ওড়না উড়িয়ে এল বসন্তে, নীল আকাশের চাঁদ রূপের নূপুর বাজিয়ে এল জলের উপর দিয়ে, কিন্তু এদের এই অপরূপ সাজ দেখবে যে সেই মানুষ এল নিরাভরণ নিরাবরণ, শীত তাকে পীড়া দেয়, রৌদ্র তাকে দগ্ধ করে, বাস্তব জগৎ তার উপরে অত্যাচার করে বিশ্বচরাচরে রহস্যের দুর্লঙ্ঘ্য প্রাচীরের মধ্যে তাকে বন্দী করতে চায়—এই মানুষ স্বপন দেখলে অগোচরের অবাস্তবের অসম্ভবের অজানার, সেই দেখার মধ্য দিয়ে দৃষ্টি বদল করে’ নিলে সৃষ্টির বাইরে এবং সৃষ্টির অন্তরে যে তার সঙ্গে অদ্বিতীয় শিল্পীর অপরাজিত প্রতিনিধি মানুষ মনোজগতের অধিকারী বহির্জগতের প্রভু।
অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর
শিল্প ও দেহতত্ত্ব অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর শিল্প ও দেহতত্ত্ব কিছুর নোটিস যে দিচ্ছে, ঘটনা যেমন ঘটেছে তার সঠিক রূপটির প্রতিচ্ছায়া দেওয়া ছাড়া সে বেচারা অনন্যগতি; সে যদি ভাবে সে একটা কিছু রচনা করছে তো সেটা তার মস্ত ভ্রম। ডুবুরি সমুদ্রের তল ঘেঁটে মুক্তার শুক্তি তুলে আনে, খুবই সুচতুর সুতীক্ষ্ণ দৃষ্টি তার, কিন্তু সে কি বলাতে পারে আপনাকে মুক্তাহারের রচয়িতা, না, যে পাহাড় পর্বত দেশে বিদেশে ঘুরে’ ফটোগ্রাফ তুলে আনছে সে নিজেকে চিত্রকর বলে’ চালিয়ে দিতে পারে আর্টিষ্ট মহলে? একটুখানি বুদ্ধি থাকলেই আর্টের ইতিহাস লেখা চলে, কিন্তু যে জিনিষগুলো নিয়ে আর্টের ইতিহাস তার রচয়িতা ইতিহাসবেত্তা নয় রসবেত্তা—নেপোলিয়ান বীর রসের অার্টিষ্ট, তাঁর হাতে ইউরোপের ইতিহাস সৃষ্ট হল, সীজার আর্টিষ্ট গ’ড়লে রোমের ইতিহাস। যে ডুবে’ তোলে সে তোলে মাত্র বুদ্ধিবলে; আর যে গড়ে’ তোলে সে ভাঙাকে জোড়া লাগায় না শুধু, সে বেজোড় সামগ্ৰীও রচনা করে’ চলে মন থেকে। ইতিহাসের ঘটনাগুলো পাথরের মতো সুনির্দিষ্ট শক্ত জিনিষ, এক চুল তার চেহারার অদল বদল করার স্বাধীনতা নেই ঐতিহাসিকের, আর ঔপন্যাসিক কবি শিল্পী এঁদের হাতে পাষাণও রসের দ্বারা সিক্ত হয়ে কাদার মতে নরম হয়ে যায়, রচয়িত তাকে যথা ইচ্ছা রূপ দিয়ে ছেড়ে দেন। ঘটনার অপলাপ ঐতিহাসিকের কাছে দুর্ঘটনা, কিন্তু আর্টিষ্টের কাছে সেটা বড়ই সুঘটন বা সুগঠনের পক্ষে মস্ত সুযোগ উপস্থিত করে দেয়। ঠিকে যদি ভুল হয়ে যায় তবে সব অঙ্কটাই ভুল হয়; অঙ্কনের বেলাতেও ঠিক ওই কথা। কিন্তু পাটিগণিতের ঠিক আর খাঁটি গুণীদের ঠিকের প্রথা স্বতন্ত্র স্বতন্ত্র;—নামতা ঠিক রইলো তে অঙ্ককর্তা বল্লেন, ঠিক হয়েছে, কিন্তু নামেই ছবিটা ঠিক মানুষ হলো কি গরু গাধা বা আর কিছু হলো, রসের ঠিকানা হলো না ছবির মধ্যে, অঙ্কনকর্তা বলে’ বসলেন, ভুল! ঐতিহাসিকের কারবার নিছক ঘটনাটি নিয়ে, ডাক্তারের কারবার নিখুঁত হাড়মাসের anatomy নিয়ে, আর আর্টিষ্টদের কারবার অনির্বচনীয় অখণ্ড রসটি নিয়ে। আর্টিষ্টের কাছে ঘটনার ছাঁচ পায় না রস, রসের ছাঁদ পেয়ে বদলে যায় ঘটনা, হাড়মাসের ছাঁচ পায় না শিল্পীর মানস কিন্তু মানসের ছাঁদ অনুসারে গড়ে’ ওঠে সমস্ত ছবিটার হাড় হদ্দ, ভিতর বাহির। একটা গাছের বীজ, সে তার নিজের আকৃতি ও প্রকৃতি যেমনটি পেয়েছে সেই ভাবেই যখন হাতে পড়লো, তখন সে গোলাকার কি চেপ্টা ইত্যাদি, কিন্তু সে থলি থেকে মাটিতে পড়েই রসের সঞ্চার নিজের মধ্যে যেমনি অনুভব করলে অমনি বদলে চল্লো নিজেই নিজের আকৃতি প্রকৃতি সমস্তই; যার বাহু ছিল না চোখ ছিল না, যে লুকিয়ে ছিল মাটির তলায় নীরস কঠিন বীজকোষে বদ্ধ হ’য়ে, সে উঠলে মাটি ঠেলে, মেলিয়ে দিলে হাজার হাজার চোখ আর হাত আলোর দিকে আকাশের দিকে বাতাসের উপরে, নতুন শরীর নতুন ভঙ্গি লাভ করলে সে রসের প্রেরণায়, গোলাকার বীজ ছত্রাকার গাছ হয়ে শোভা পেলে, বীজের anatomy লুকিয়ে পড়লো ফুলের রেণুতে পাকা ফলের শোভার আড়ালে। বীজের হাড় হদ্দ ভেঙে তার anatomy চুরমার করে’ বেরিয়ে এল গাছের ছবি বীজকে ছাড়িয়ে। গাছ যে রচলে তার রচনায় ছাঁদ ও anatomyর দোষ দেবার সাহস কারু হল না, উল্টে বরং কোন কোন মানুষ তারই রচনা চুরি করে’ গাছপালা আঁকতে বসে গেল—বীজতত্ত্বের বইখানার মধ্যে ফেলে রেখে দিলে যে অস্থি-পঞ্জরের মতো শক্ত পিঞ্জরে বদ্ধ ছিল বীজের প্রাণ তার প্রকৃত anatomyর হিসেব। বীজের anatomy দিয়ে গাছের anatomyর বিচার করতে যাওয়া, আর মানুষী মূর্তির anatomy দিয়ে মানস মূর্তির anatomyর দোষ ধরতে যাওয়া সমান মূৰ্খতা। Anatomyর একটা অচল দিক আছে, যেটা নিয়ে এক রূপের সঙ্গে আর রূপের সুনির্দিষ্ট ভেদ, কিন্তু anatomyর একটা সচল দিকও আছে সেটা নিয়ে মানুষে মানুষে বা একই জাতের গাছে গাছে ও জীবে জীবে বাঁধা পার্থক্য একটুখানি ভাঙে—কোন মানুষ হয় তাল গাছের মতো, কেউ হয় ভাঁটার মতো, কোন গাছ ছড়ায় ময়ূরের মতো পাখা, কেউ বাড়ায় ভূতের মতো হাত! প্রকৃতি-বিজ্ঞানের বইখানাতে দেখবে মেঘের সুনির্দিষ্ট গোটাকতক গড়নের ছবি দেওয়া আছে—বৃষ্টির মেঘ, ঝড়ের মেঘ—সবার বাঁধা গঠন কিন্তু মেঘে যখন বাতাস লাগলো রস ভরলো তখন শাস্ত্র-ছাড়া সৃষ্টি-ছাড়া মূর্তি সব ফুটতে থাকলো, মেঘে মেঘে রং লাগলো অদ্ভুত অদ্ভুত, সাদা ধোঁয়া ধুমধাম করে সেজে এল লাল নীল হলদে সবুজ বিচিত্র সাজে, দশ অবতারের রং ও মূর্তিকে ছাড়িয়ে দশ সহস্র অবতার! সচিত্র প্রকৃতি-বিজ্ঞানের পুঁথি খুলে সে সময় কোন্ রসিক চেয়ে দেখে মেঘের রূপগুলোর দিকে? এই যে মেঘের গতিবিধির মতো সচল সজল anatomy, একেই বলা হয় artistic anatomy, যার দ্বারায় রচয়িতা রসের আধারকে রসের উপযুক্ত মান পরিমাণ দিয়ে থাকেন। মানুষের তৃষ্ণা ভাঙতে যতটুকু জল দরকার তার পরিমাণ বুঝে জলের ঘটি এক রকম হ’ল, মানুষের স্নান করে’ শীতল হ’তে যতটা জল দরকার তার হিসেবে প্রস্তুত হ’ল ঘড়া জালা ইত্যাদি; সুতরাং রসের বশে হ’ল আধারের মান পরিমাণ আকৃতি পর্যন্ত। যার কোন রসজ্ঞান নেই সেই শুধু দেখে পানীয় জলের ঠিক আধারটি হচ্ছে চৌকোনা পুকুর, ফটিকের গেলাস নয়, সোণার ঘটিও নয়। গোয়ালের গরু হয়তো দেখে পুকুরকে তার পানীয় জলের ঠিক আধার, কিন্তু সে যদি মানুষকে এসে বলে, ‘তোমার গঠন সম্বন্ধে মোটেই জ্ঞান নেই, কেন না জলাধার তুমি এমন ভুল রকমে গড়েছ যে পুকুরের সঙ্গে মিলছেই না’, তবে মানুষ কি জবাব দেয়? ঐতিহাসিকের মাপকাঠি ঘটনামূলক, ডাক্তারের মাপকাঠি কায়ামূলক, আর রচয়িতা যারা তাদের মাপকাঠি অঘটন-ঘটন-পটীয়সী মায়ামূলক। ঐতিহাসিককে রচনা করতে হয় না, তাই তার মাপকাঠি ঘটনাকে চুল চিরে’ ভাগ করে দেখিয়ে দেয়, ডাক্তারকেও জীবন্ত মানুষ রচনা করতে হয় না, কাযেই জীবন্মৃত ও মৃত মানুষের শবচ্ছেদ করার কাযের জন্য চলে তার মাপকাঠি, আর রচয়িতাকে অনেক সময় অবস্তুকে বস্তুজগতে, স্বপ্নকে জাগরণের মধ্যে টেনে আনতে হয়, রূপকে রসে, রসকে রূপে পরিণত করতে হয়, কাযেই তার হাতের মাপকাঠি সম্পূর্ণ আলাদা ধরণের, রূপকথার সোণার রূপোর কাটির মতো অদ্ভুত শক্তিমান। ঘটনা যাকে কুড়িয়ে ও খুঁড়ে তুলতে হয়, ঠিক ঠিক খোন্তা হল তার পক্ষে মহাস্ত্র, মানুষের ভৌতিক শরীরটার কারখানা নিয়ে যখন কারবার, ঠিক ঠিক মাংসপেশী অস্থিপঞ্জর ইত্যাদির ব্যবচ্ছেদ করার শূল ও শলাকা ইত্যাদি হ’ল তখন মৃত্যুবাণ, কিন্তু রচনা প্রকাশ হবার আগেই এমন একটি জায়গার সৃষ্টি হয়ে বসে যে সেখানে কোদাল, কুড়ুল, শূল, শাল কিছু চলে না, রচয়িতার নিজের অস্থিপঞ্জর এবং ঘটাকাশের ঘটনা সমস্ত থেকে অনেক দূরে রচয়িতার সেই মনোজগৎ বা পটাকাশ, যেখানে ছবি ঘনিয়ে আসে মেঘের মতো, রস ফেনিয়ে ওঠে, রং ছাপিয়ে পড়ে আপনা আপনি। সেই সমস্ত রসের ও রূপের ছিটেফোঁটা যথোপযুক্ত পাত্র বানিয়ে ধরে’ দেয় রচয়িতা আমাদের জন্যে। এখন রচয়িতা রস বুঝে’ রসের পাত্র নির্বাচন করে’ যখন দিচ্ছে তখন রসের সঙ্গে রসের পাত্রটাও স্বীকার না করে’ যদি নিজের মনোমত পাত্রে রসটা ঢেলে নিতে যাই তবে কি ফল হবে? ধর রৌদ্ররসকে একটা নবতাল বা দশতাল মূর্তির আধার গড়ে’ ধরে’ আনলেন রচয়িতা, পাত্র ও তার অন্তর্নিহিত রসের চমৎকার সামঞ্জস্য দিয়ে, এখন সেই রচয়িতার আধারকে ভেঙে রৌদ্ররস যদি মুঠোম হাত পরিমিত anatomy-দোরস্ত আমার একটা ফটোগ্রাফের মধ্যে ধরবার ইচ্ছে করি তো রৌদ্র হয় করুণ নয় হাস্যরসে পরিণত না হয়ে যাবে না; কিম্বা ছোট মাপের পাত্রে না ঢুকে রসটা মাটি হবে মাটিতে পড়ে’। হারমোনিয়ামের anatomy, বীণার anatomy, বাঁশীর anatomy রকম রকম বলেই সুরও ধরে রকম রকম; তেমনি আকারের বিচিত্ৰতা দিয়েই রসের বিচিত্ৰতা বাহিত হয় আর্টের জগতে, আকারের মধ্যে নির্দিষ্টতা সেখানে কিছুই নেই। হাড়ের পঞ্জরের মধ্যে মাংসপেশী দিয়ে বাঁধা আমাদের এতটুকু বুক, প্রকাণ্ড সুখ প্রকাণ্ড দুঃখ প্রকাণ্ড ভয় এতটুকু পাত্রে ধরা মুস্কিল। হঠাৎ এক-এক সময়ে বুকটা অতিরিক্ত রসের ধাক্কায় ফেটে যায়; রসটা চাইলে বুককে অপরিমিত রকমে বাড়িয়ে দিতে, কিম্বা দমিয়ে দিতে, আমাদের ছোট পিঁজ্‌রে হাড়ে আর তাঁতে নিরেট করে বাঁধা স্থিতি-স্থাপকতা কিম্বা সচলতা তার নেই, অতিরিক্ত ষ্টিম্ পেয়ে বয়লারের মতো ফেটে চৌচির হয়ে গেল। রস বুকের মধ্যে এসে পাত্রটায় যে প্রসারণ বা আকুঞ্চন চাইলে, প্রকৃত মানুষের anatomy সেটা দিতে পারলে না; কাজেই আর্টিষ্ট যে, সে রসের ছাঁদে কমে বাড়ে ছন্দিত হয় এমন একটা সচল তরল anatomy সৃষ্টি করে’ নিলে যা অন্তর এবং বাইরে সুসঙ্গত ও সুসংহত। রসকে ধরবার উপযুক্ত জিনিষ বিচিত্র রং ও রেখা সমস্ত গাছের ডালের মতো, ফুলের বোঁটার মতো, পাতার ঝিলিমিলির মতো তারা জীবনরসে প্রাণবন্ত ও গতিশীল। ফটোগ্রাফারের ওখানে ছবি ওঠে—সীসের টাইপ থেকে যেমন ছাপ ওঠে—ছবি ফোটে না। পারিজাতের মতো বাতাসে দাঁড়িয়ে আকাশে ফুল ফোটানো আর্টিষ্টের কায, সুতরাং তার মন্ত্র মানুষের শরীর-যন্ত্রের হিসেবের খাতার লেখার সঙ্গে এমন কি বাস্তব জগতের হাড়হদ্দের খবরের সঙ্গে মেলানো মুস্কিল। অভ্র-বিজ্ঞানের পুঁথিতে আবর্ত সম্বর্ত ইত্যাদি নাম-রূপ দিয়ে মেঘগুলো ধরা হয়েছে—কিন্তু কবিতা কি গান রচনার বেলা ঐ সব পেঁচালো নামগুলো কি বেশী কাযে আসে? মেঘের ছবি আঁকার বেলাতেও ঠিক পুঁথিগত ঘোরপেঁচ এমন কি মেঘের নিজমূর্তিগুলোর হুবহু ফটোগ্রাফও কাযে আসে না। রচিত যা তার মধ্যে বসবাস করলেও রচয়িতা চায় নিজের রচনাকে। সোণার খাঁচার মধ্যে থাকলেও বনের পাখী সে যেমন চায় নিজের রচিত বাসাটি দেখতে, রচয়িতাও ঠিক তেমনি দেখতে চায় নিজের মনোগতটি গিয়ে বসলো নিজের মনোমত করে’ রচা রং রেখা ছন্দোবন্ধ ঘেরা সুন্দর বাসায়। কোকিল সে পরের বাসায় ডিম পাড়ে–নামজাদা মস্ত পাখী। কিন্তু বাবুই সে যে রচয়িতা, দেখতে এতটুকু কিন্তু বাসা বাঁধে বাতাসের কোলে—মস্ত বাসা। আমাদের সঙ্গীতে বাঁধা অনেকগুলো ঠাট আছে, যে লোকটা সেই ঠাটের মধ্যেই সুরকে বেঁধে রাখলে সে গানের রচয়িতা হল না, সে নামে রাজার মতো পূর্ব্বপুরুষের রচিত রাজগীর ঠাটটা মাত্র বজায় রেখে চল্লো ভীরু, কিন্তু যে রাজত্ব পেয়েও রাজত্ব হারাবার ভয় রাখলে না, নতুন রাজত্ব জিতে নিতে চল্লো সেই সাহসীই হল রাজ্যের রচয়িতা বা রাজা এবং এই স্বাধীনচেতারাই হয় সুরের ওস্তাদ। সুর লাগাতে পারে তারাই যারা সুরের ঠাট মাত্র ধরে’ থাকে না, বেসুরকেও সুরে ফেলে। মানুষের anatomyতেই যদি মানুষ বদ্ধ থাকতো, দেবতাগুলোকে ডাকতে যেতে পারতো কে? কার জন্যে আসতো নেমে স্বর্গ থেকে ইন্দ্ররথ, পুষ্পক রথে চড়িয়ে লঙ্কা থেকে কে আনতো সীতাকে অযোধ্যায়? ভূমিষ্ঠ হয়েই শিশু আপনার anatomy ভাঙতে সুরু করলে, বানরের মতো পিঠের সোজা শিরদাঁড়াকে বাঁকিয়ে সে উঠে দাঁড়ালো—দুই পায়ে ভর দিয়ে গাছে গাছে ঝুল্‌তে থাক্‌লো না। প্রথমেই যুদ্ধ হল মানুষের নিজের anatomyর সঙ্গে, সে তাকে আস্তে আস্তে বদলে’ নিলে আপনার চলনবলনের উপযুক্ত করে। বীজের anatomy নাশ করে যেমন বার হ’ল গাছ, তেমনি বানরের anatomy পরিত্যাগ করে’ মানুষের anatomy নিয়ে এল মানুষ; ঠিক এই ভাবেই medical anatomy নাশ করে আর্টিষ্ট আবিষ্কার করলে artistic anatomy, যা রসের বশে কমে বাড়ে, আঁকে বাঁকে, প্রকৃতির সব জিনিষের মতো—গাছের ডালের মতো, বৃন্তের মতো, পাপড়ির মতো, মেঘের ঘটার মতো, জলের ধারার মতো। রসের বাধা জন্মায় যাতে এমন সব বস্তু কবিরা টেনে ফেলে দেন,–নিরঙ্কুশাঃ কবয়ঃ। লয়ে লয়ে না মিল্লে কবিতা হ’ল না, এ কথা যার একটু কবিত্ব আছে সে বলবে না; তেমনি আকারে আকারে না মিল্লে ফটোগ্রাফ হল না বলতে পারি, কিন্তু ছবি হল না একথা বলা চলে না। ‘মহাভারতের কথা অমৃত সমান’ শুনতে বেশ লাগলো, ‘ছেলেটি কার্তিকের মতো’ দেখতে বেশ লাগলো, কিন্তু কবিতা লিখলেই কি কাশীদাসী সুর ধরতে হবে, না ছেলে আঁকতে হলেই পাড়ার আদুরে ছেলের anatomy কাপি করলেই হবে? গণেশের মূর্তিটিতে আমাদের ঘরের ও পরের ছেলের anatomy যেমন করে ভাঙা হয়েছে তেমন আর কিছুতে নয়। হাতী ও মানুষের সমস্তখানি রূপ ও রেখার সামঞ্জস্যের মধ্য দিয়ে একটা নতুন anatomy পেয়ে এল, কাযেই সেটা আমাদের চক্ষে পীড়া দিচ্ছে না, কেন না সেটা ঘটনা নয়, রচনা। আরব্য-উপন্যাসের উড়ন্ত সতরঞ্চির কল্পনা বাস্তবজগতে উড়োজাহাজ দিয়ে সপ্রমাণিত না হওয়া পর্যন্ত কি আমাদের কাছে নগণ্য হয়েছিল, না, অবাধ কল্পনার সঙ্গে গল্পের ঠাট মিলছে কিন্তু বিশ্বরচনার সঙ্গে মিলছে না দেখে’ গালগল্প রচনার বাদশাকে কেউ আমরা দুষেছি? প্রত্যেক রচনা তার নিজের anatomy নিয়ে প্রকাশ হয়; ঠাট বদলায় যেমন প্রত্যেক রাগরাগিণীর, তেমনি ছাঁদ বদলায় প্রত্যেক ছবির কবিতার রচনার বেলায়। ধর যদি এমন নিয়ম করা যায় যে কাশীদাসী ছন্দ ছাড়া কবিরা কোনো ছন্দে লিখতে পারবে না—যেমন আমরা চাচ্ছি ডাক্তারি anatomy ছাড়া ছবিতে আর কিছু চলবে না—তবে কাব্যজগতে ভাবের ও ছন্দের কি ভয়ানক দুর্ভিক্ষ উপস্থিত হয়,—সুরের বদলে থাকে শুধু দেশজোড়া কাশী আর রচয়িতার বদলে থাকে কতকগুলি দাস। কাযেই কবিদের ছাড়পত্র দেওয়া হয়েছে ‘কবয়ঃ নিরঙ্কুশাঃ’ বলে’, কিন্তু বাস্তবজগৎ থেকে ছাড়া পেয়ে কবির মন উড়তে পারবে যথাসুখে যথাতথা, আর ছবি আট্‌কে থাকবে ফটোগ্রাফারের বাক্সর মধ্যে—জালার মধ্যে বাঁধা আরব্য-উপন্যাসের জিন্-পরীর মতো সুলেমানের সিলমোহর আঁটা চিরকালই, এ কোন্‌দেশী কথা? ইউরোপ, যে চিরকাল বাস্তবের মধ্যে আর্টকে বাঁধতে চেয়েছে সে এখন সিলমোহর মায় জালা পর্যন্ত ভেঙে কি সঙ্গীতে, কি চিত্রে, ভাস্কর্যে, কবিতায়, সাহিত্যে, বাঁধনের মুক্তি কামনা করছে; আর আমাদের আর্ট যেটা চিরকাল মুক্ত ছিল তাকে ধরে ডানা কেটে পিঁজ্‌রের মধ্যে ঠেসে পুরতে চাচ্ছি আমরা। বড় পা’কে ছোট জুতোর মধ্যে ঢুকিয়ে চীনের রাজকন্যার যা ভোগ ভুগতে হয়েছে সেটা কসা জুতোর একটু চাপ পেলেই আমরা অনুভব করি—পা বেরিয়ে পড়তে চায় চট্‌ করে’ জুতো ছেড়ে, কিন্তু হায়! ছবি—সে কিনা আমাদের কাছে শুধু কাগজ, সুর—সে কিনা শুধু খানিক গলার শব্দ, কবিতা—সে শুধু কিনা ফর্মা বাঁধা বই; তাই তাদের মুচড়ে মুচড়ে ভেঙে চুরে চামড়ার থলিতে ভরে দিতে কষ্টও পাইনে ভয়ও পাইনে। অন্যথা-বৃত্তি হল আর্টের এবং রচনার পক্ষে মস্ত জিনিষ, এই অন্যথা-বৃত্তি দিয়েই কালিদাসের মেঘদূতের গোড়া পত্তন হল, অন্যথা-বৃত্তি কবির চিত্ত মানুষের রূপকে দিলে মেঘের সচলতা এবং মেঘের বিস্তারকে দিলে মানুষের বাচালতা। এই অসম্ভব ঘটিয়ে কবি সাফাই গাইলেন যথা—“ধূমজ্যোতিসলিলমরুতাং সন্নিপাতঃ ক্ব মেঘঃ, সন্দেশার্থাঃ ক্ব পটুকরণৈঃ প্রাণিভিঃ প্রাপণীয়াঃ”। ধূম আলো আর জল-বাতাস যার শরীর, তাকে শরীর দাও মানুষের, তবে তো সে প্রিয়ার কাণে প্রাণের কথা পৌঁছে দেবে? বিবেক ও বুদ্ধি মাফিক মেঘকে মেঘ রেখে কিছু রচনা করা কালিদাসও করেন নি, কোন কবিই করেন না। যখন রচনার অনুকূল মেঘের ঠাট কবি তখন মেঘকে হয়তো মেঘই রাখলেন কিন্তু যখন রচনার প্রতিকূল ধূম জ্যোতি জল বাতাস তখন নানা বস্তুতে শক্ত করে, বেঁধে নিলেন কবি। এই অন্যথা-বৃত্তি কবিতার সর্ব্বস্ব, তখনো যেমন এখনো তেমন, রসের বশে ভাবের খাতিরে রূপের অন্যথা হচ্ছে— “শ্রাবণ মেঘের আধেক দুয়ার ঐ খোলা, আড়াল থেকে দেয় দেখা কোন পথভোলা ঐ যে পূরব গগন জুড়ে, উত্তরী তার যায় রে উড়ে সজল হাওয়ার হিন্দোলাতে দেয় দোলা! লুকাবে কি প্রকাশ পাবে কেই জানে, আকাশে কি ধরায় বাসা কোন্ খানে, নানা বেশে ক্ষণে ক্ষণে, ঐ ত আমার লাগায় মনে, পরশখানি নানা সুরের ঢেউ তোলা।” ভাব ও রসের অন্যান্য বৃত্তি পেয়ে মেঘ এখানে নতুন সচল anatomyতে রূপান্তরিত হল। এখন বলতে পারো মেঘকে তার স্বরূপে রেখে কবিতা লেখা যায় কি না? আমি বলি যায়, কিন্তু অভ্র-বিজ্ঞানের হিসেব মেঘের রূপকে যেমন ছন্দ থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেখায়, সে ভাবে লিখলে কবিতা হয় না, রংএর ছন্দ বা ছাঁদ, সুরের ছাঁদ, কথার ছাঁদ দিয়ে মেঘের নিজস্ব ও প্রত্যক্ষ ছাঁদ না বদলালে কবিতা হ’তে পারে না, যেমন— “আজি বর্ষা রাতের শেষে সজল মেঘের কোমল কালোয় অরুণ অালো মেশে। বেণু বনের মাথায় মাথায় রং লেগেছে পাতায় পাতায়, রঙের ধরায় হৃদয় হারায় কোথা যে যায় ভেসে।” মনে হবে অপ্রাকৃত কিছু নেই এখানে, কিন্তু কালো শুধু বলা চল্লো না, কোমল কালো না হ’লে ভেসে চলতে পারলো না আকাশে বাতাসে রংএর স্রোত বেয়ে কবির মানসকমল থেকে খসে-পড়া সুর-বোঝাই পাপড়িগুলি সেই দেশের খবর আনতে যে দেশের বাদল বাউল একতারা বাজাচ্ছে সারা বেলা। সকালের প্রকৃত মূর্তিটা হল মেঘের কালোয় একটু আলো কিন্তু টান-টোনের কোমলতা পাতার হিলিমিলি নানা রংএর ঝিলিমিলির মধ্যে তাকে কবি হারিয়ে দিলেন; মেঘের শরীর আলোর কম্পন পেলে, ফটোগ্রাফের মেঘের মতো চোখের সামনে স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো না। বর্ষার শেষ-রাত্রে সত্যিকার মেঘ যে ভাবে দেখতে দেখতে হারিয়ে যায়, সকালের মধ্যে মিলিয়ে দেয় তার বাঁধারূপ, ঠিক সেই ভাবের একটি গতি পেলে কবির রচনা। সকালে মেঘে একটু আলো পড়েছে এই ফটোগ্রাফটি দিলে না কবিতা; আলো, মেঘ, লতা-পাতার গতিমান ছন্দে ধরা পড়লো শেষ বর্ষার চিরন্তন রস এবং মেঘলোকের লীলা-হিল্লোল। রচনার মধ্যে এই যে রূপের রসের চলাচল গতাগতি, এই নিয়ে হল তফাৎ ঘটনার নোটিসের সঙ্গে রচনার প্রকৃতির। নোটিস সে নির্দেশ করেই থামলো, রচনা চলে গেল গাইতে গাইতে হাসতে হাসতে নাচতে নাচতে মনের থেকে মনের দিকে এক কাল থেকে আর এক কালে বিচিত্র ভাবে। কবিতায় বা ছবিতে এই ভাবে চলায়মান রং রেখা রূপ ও ভাব দিয়ে যে রচনা তাকে আলঙ্কারিকেরা গতিচিত্র বলেন—অর্থাৎ গতিচিত্রে রূপ বা ভাব কোন বস্তুবিশেষের অঙ্গবিন্যাস বা রূপসংস্থানকে অবলম্বন করে’ দাঁড়িয়ে থাকে না কিন্তু রেখার রংএর ও ভাবের গতাগতি দিয়ে রসের সজীবতা প্রাপ্ত হ’য়ে আসা-যাওয়া করে। বীণার দুই দিকে বাঁধা টানা তারগুলি সোজা লাইনের মতো অবিচিত্র নির্জীব আছে—বলছেও না চলছেও না। সুর এই টানা তারের মধ্যে গতাগতি আরম্ভ করলে অমনি নিশ্চল তার চঞ্চল হ’ল গীতের ছন্দে, ভাবের দ্বারা সজীব হ’ল, গান গাইতে লাগলো, নাচতে থাকলো তালে তালে। পর্দায় পর্দায় খুলে গেল সুরের অসংখ্য পাপড়ি, সোজা anatomyর টানা পাঁচিল ভেঙ্গে বার হ’ল সুরের সুরধুনী-ধারা, নানা ভঙ্গিতে গতিমান। আকাশ এবং মাটি এরি দুই টানের মধ্যে স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে আছে মানুষের anatomy-দোরস্ত শরীর। দুই খোঁটায় বাঁধা তারের মতো, এই হল ডাক্তারি anatomyর সঠিক রূপ। আর বাতাসের স্পর্শে আলোর আঘাতে গাছ-ফুল-পাতা-লতা এরা লতিয়ে যাচ্ছে ছড়িয়ে যাচ্ছে শাখা প্রশাখার আঁকা বাঁকা নানা ছন্দের ধারায়; এই হচ্ছে artistic anatomyর সঠিক চেহারা । আর্টিষ্ট রসের সম্পদ নিয়ে ঐশ্বর্যবান, কাযেই রস বণ্টনের বেলায় রসপাত্রের জন্য তাকে খুঁজে বেড়াতে হয় না কুমোরটুলি, সে রসের সঙ্গে রসপাত্রটাও সৃষ্টি করে’ ধরে দেয় ছোট বড় নানা আকারে ইচ্ছা মতো। এই পাত্রসমস্যা শুধু যে ছবি লিখছে তাকেই যে পূরণ করতে হয় তা নয়, রসের পাত্রপাত্রীর anatomy নিয়ে গণ্ডগোল রঙ্গমঞ্চে খুব বেশী রকম উপস্থিত হয়। নানা পৌরাণিক ও কাল্পনিক সমস্ত দেবতা উপদেবতা পশুপক্ষী যা রয়েছে তার anatomy ও model বাস্তবজগৎ থেকে নিলে তো চলে না। হরেরামপুরের সত্যি রাজার anatomy রাজশরীর হলেও রঙ্গমঞ্চের রাজা হবার কাযে যে লাগে তা নয়, একটা মুটের মধ্যে হয়তো রাম রাজার রসটি ফোটাবার উপযুক্ত anatomy খুঁজে পাওয়া যায়। নারীর anatomy হয়তো সীতা সাজবার কালে লাগলো না, একজন ছেলের anatomy দিয়ে দৃশ্যটার মধ্যে উপযুক্ত রসের উপযুক্ত পাত্রটি ধরে দেওয়া গেল। পাখীর কি বানরের কি নারদের ও দেবদেবীর ভাব ভঙ্গি চলন বলন প্রভৃতির পক্ষে যে রকম শরীরগঠন উপযুক্ত বোধ হল অধিকারী সেই হিসেবে পাত্র পাত্রী নির্বাচন বা সজ্জিত করে’ নিলে—যেখানে আসল মানুষের উচ্চতা রচয়িতার ভাবনার সঙ্গে পাল্লা দিতে পারলে না সেখানে রণ্‌পা দিয়ে anatomical মাপ বাড়িয়ে নিতে হ’লো, যেখানে আসল দুহাতের মানুষ কাজে এল না সেখানে গড়া হাত গড়া ডানা ইত্যাদি নানা খুঁটিনাটি ভাঙ্গাচোরা দিয়ে নানা রসের পাত্র-পাত্রী সৃষ্টি করতে হল বেশ-কারকে,—রচয়িতার কল্পনার সঙ্গে অভিনেতার রূপের সামঞ্জস্য এইভাবে লাভ করতে হল নাটকে! কল্পনামূলক যা তাকে প্রকৃত ঘটনার নিয়মে গাঁথা চলে না, আর ঘটনামূলক নাটক সেখানেও একেবারে পাত্র-পাত্রীর সঠিক চেহারাটি নিয়ে কায চলে না, কেননা যে ভাব যে রস ধরতে চেয়েছেন রচয়িতা, তা রচয়িতার কল্পিত পাত্র-পাত্রীর চেহারার সঙ্গে যতটা পারা যায় মেলাতে হয় বেশ-কারকে। এক-একজন বেশ সুঠাম সুশ্রী, পাঠও করতে পারলে বেশ, কিন্তু তবু নাটকের নায়ক-বিশেষের পার্ট তাকে দেওয়া গেল না, কেননা সেখানে নাটক রচয়িতার কল্পিতের সঙ্গে বিশ্ব-রচয়িতার কল্পিত মানুষটির anatomy গঠন ইত্যাদি মিল্লো না। ছবিতেও তেমনি কবিতাতেও তেমনি, ভাবের ছাঁদ অনেক সময়ে মানুষের কি আর কিছুর বাস্তব ও বাঁধা ছাঁদ দিয়ে পুরোপুরি ভাবে প্রকাশ করা যায় না, অদল-বদল ঘটাতেই হয়, কতখানি অদল-বদল সয় তা আর্টিষ্ট যে রসমূর্তি রচনা করছে সেই ভাল বুঝবে আর কেউ তো নয়। চোখে দেখছি যে মানুষ যে সব গাছপালা নদ-নদী পাহাড়-পর্বত আকাশ—এরি উপরে আলো-আঁধার ভাব-ভঙ্গি দিয়ে বিচিত্র রস সৃজন করে’ চল্লেন যাঁর আমরা রচনা তিনি, আর এই যে নানা রেখা নানা রং নানা ছন্দ নানা সুর এদেরই উপরে প্রতিষ্ঠিত করলে মানুষ নিজের কল্পিতটি। মানুষ বিশ্বের আকৃতির প্রতিকৃতি নিজের রচনায় বর্জন করলে বটে, কিন্তু প্রকৃতিটি ধরলে অপূর্ব কৌশলে যার দ্বারা রচনা দ্বিতীয় একটা সৃষ্টির সমান হয়ে উঠলো। এই যে অপূর্ব কৌশল যার দ্বারা মানুষের রচনা মুক্তিলাভ করে ঘটিত জগতের ঘটনা সমস্ত থেকে, এটা কিছুতে লাভ করতে পারে না সেই মানুষ যে এই বিশ্বজোড়া রূপের মূর্ত দিকটার খবরই নিয়ে চলেছে, রসের অমূর্ততা মূর্তকে যেখানে মুক্ত করছে সেখানের কোন সন্ধান নিচ্ছে না, শুধু ফটোযন্ত্রের মতো আকার ধরেই রয়েছে, ছবি ওঠাচ্ছে মাত্র ছবি ফোটাচ্ছে না। মানুষের মধ্যে কতক আছে মায়াবাদী কতক কায়াবাদী; এদের মধ্যে বাদ বিসম্বাদ লেগেই আছে। একজন বলছে, কায়ার উপযুক্ত পরিমাণ হোক ছায়ামায়া সমস্তই, আর একজন বলছে তা কেন, কায়া যখন ছায়া ফেলে সেটা কি খাপে খাপে মেলে শরীরটার সঙ্গে, না নীল আকাশ রংএর মায়ায় যখন ভরপুর হয় তখন সে থাকে নীল, বনের শিয়রে যখন চাঁদনী মায়াজাল বিস্তার করলে তখন বনের হাড়হদ্দ সব উড়ে গিয়ে শুধু যে দেখ ছায়া, তার কি জবাব দেবে? মায়াকে ধরে রয়েছে কায়া, কায়াকে ঘিরে রয়েছে মায়া; কায়া অতিক্রম করছে মায়া দিয়ে আপনার বাঁধা রূপ, মায়া সে নিরূপিত করছে উপযুক্ত কায়া দ্বারা নিজকে। জাগতিক ব্যাপারে এটা নিত্য ঘটছে প্রতি মুহূর্তে। জগৎ শুধু মায়া কি শুধু কায়া নিয়ে চলছে না, এই দুইয়ের সমন্বয় চলেছে; তাই বিশ্বের ছবি এমন চমৎকার ভাবে আর্টিষ্টের মনটির সঙ্গে যুক্ত হতে পারছে! এই যে সমন্বয়ের সূত্রে গাঁথা কায়া-মায়া ফুল আর তার রংএর মতো শোভা পাচ্ছে—anatomyর artistic ও inartistic সব রহস্য এরি মধ্যে লুকোনো আছে৷ রূপ পাচ্ছে রসের দ্বারা অনির্বচনীয়তা, রস হচ্ছে অনির্বচনীয় যথোপযুক্ত রূপ পেয়ে, রূপ পাচ্ছে প্রসার রসের, রস পাচ্ছে প্রসার রূপের, এই একে একে মিলনে হচ্ছে দ্বিতীয় সৃজন আর্টে, তারপর সুর, ছন্দ, বর্ণিকা, ভঙ্গ ইত্যাদি তৃতীয় এসে তাকে করে’ তুলেছে বিচিত্র ও গতিমান। ওদিকে এক রচয়িতা এদিকে এক রচয়িতা, মাঝে রয়েছে নানা রকমের বাঁধা রূপ; সেগুলো দুদিকের রঙ্গ-রসের পাত্র-পাত্রী হয়ে চলেছে–বেশ বদলে’ বদলে’ ঠাট বদলে’ বদলে’—অভিনয় করছে নাচছে গাইছে হাসছে কাঁদছে চলাফেরা করছে! রচকের অধিকার অাছে রূপকে ভাঙতে রসের ছাঁদে। কেননা রসের খাতিরে রূপের পরিবর্ত্তন প্রকৃতির একটা সাধারণ নিয়ম, দিন চলেছে, রাত চলেছে, জগৎ চলেছে রূপান্তরিত হ’তে হ’তে, ঋতুতে ঋতুতে রসের প্রেরণাটি চলেছে গাছের গোড়া থেকে আগা পর্যন্ত রূপের নিয়ম বদলাতে বদলাতে পাতায় পাতায় ফুলে ফলে ডালে ডালে! শুধু এই নয়, যখন রস ভরে’ উঠলো তখন এতখানি বিস্তীর্ণ পাত্রেও রস ধরলো না—গন্ধ হয়ে বাতাসে ছড়িয়ে পড়লো রস, রংএ রংএ ভরে’ দিলে চোখ, উথলে পড়লো রস মধুকরের ভিক্ষাপাত্রে, এই যে রসজ্ঞানের দাবী এ সত্য দাবী, সৃষ্টি কর্ত্তার সঙ্গে স্পর্দ্ধার দাবী নয়, সত্যাগ্রহীর দাবী। ডাক্তারের দাবী ঐতিহাসিকের দাবী সাধারণ মানুষের দাবী নিয়ে একে তো অমান্য করা চলে না। আর্টিষ্ট যখন কিছুকে যা থেকে তা’তে রূপান্তরিত কর্‌লে তখন সে যা-তা কর্‌লে তা নয়, সে প্রকৃতির নিয়মকে অতিক্রম করলে না, উল্টে বরং বিশ্বপ্রকৃতিতে রূপমুক্তির নিয়মকে স্বীকার করলে, প্রমাণ করে চল্লো হাতে কলমে, আর যে মাটিতেই হোক বা তেল রংএতেই হোক রূপের ঠিক ঠিক নকল করে চল্লো। সে আঙ্গুরই গড়ুক বা আমই গড়ুক ভ্রান্তি ছাড়া আর কিছু সে দিয়ে যেতে পারলে না, সে অভিশপ্ত হল, কেননা সে বিশ্বের চলাচলের নিয়মকে স্বীকার করলে না প্রমাণও করলে না কোন কিছু দিয়ে, অলঙ্কারশাস্ত্রমতো তার কায পুনরাবৃত্তি এবং ভ্রান্তিমৎ দোষে দুষ্ট হল। রক্ত চলাচলের খাদ্য চলাচলের পক্ষে যে ভৌতিক শরীরগঠন অস্থিসংস্থান তার মধ্যে রসাধার আর একটি জিনিষ আছে যার anatomy ডাক্তার খুঁজে পায়নি এ পর্যন্ত। বাইরের শরীর আমাদের বাঁধা ছাঁচে ঢালা আর অন্তর্দেহটি ছাঁচে ঢালা একেবারেই নয় সুতরাং সে স্বাধীনভাবে রসের সম্পর্কে আসে, এ যেন এতটুকু খাঁচায় ধরা এমন একটি পাখী যার রসমূর্তি বিরাটের সীমাকেও ছাড়িয়ে গেছে, বচনাতীত সুর বর্ণনাতীত বর্ণ তার। এই পাখীর মালিক হয়ে এসেছে কেবল মানুষ আর কোন জীব নয়। বাস্তব জগৎ যেখানে সীমা টানলে রূপের লীলা শেষ করলে সুর থামালে আপনার, সেইখানে মানুষের খাঁচায় ধরা এই মানস পাখী সুর ধরলে, নতুন রূপে ধরে’ আনলে অরূপের রূপ—জগৎ সংসার নতুন দিকে পা বাড়ালে তবেই মুক্তির আনন্দে। মানুষ তার স্বপ্ন দিয়ে নিজেকেই যে শুধু মুক্তি দিচ্ছে তা নয় যাকে দর্শন করছে যাকে বর্ণন করছে তার জন্যে মুক্তি আনছে। আটঘাট বাঁধা বীণা আপনাকে ছাড়িয়ে চলেছে এই স্বপ্নে, সুরের মধ্যে গিয়ে বাঁশী তার গাঁঠে গাঁঠে বাঁধা ঠাট ছাড়িয়ে বার হচ্ছে, এই স্বপ্নের দুয়ার দিয়ে ছবি অতিক্রম করেছে ছাপকে, এই পথে বিশ্বের হৃদয় দিয়ে মিলছে বিশ্বরূপের হৃদয়ে, এই স্বপ্নের পথ। বীণার সেই anatomyটাই বীণার সত্য anatomy, এ সত্য আর্টিষ্টমাত্রকেই গ্রহণ করতে হয় আর্টের জগতে ঢোকার আগেই, না হ’লে সচরাচরকে ছাড়িয়ে সে উঠতে ভয় পায়। পড়া পাখী যা শুন্‌লে তারই পুনরাবৃত্তি করতে থাক্‌লো, রচয়িতার দাবী সে গ্রহণ করতে পারলে কি? মানুষ যা দেখলে তাই এঁকে চল্লো রচয়িতার দাবী নিতে পারলে কি সে? নিয়তির নিয়মে যারা ফুল পাতার সাজে সেজে এল, রঙ্গীন ডানা মেলে’ নেচে চল্লো গেয়ে চল্লো, তারা কেউ এই বিশ্বসংসারে রচয়িতার দাবী নিতে পারলে না, এক যারা স্বপন দেখলে স্বপন ধরলে সেই অাটিষ্টরা ছাড়া। পাখী পারলে না রচয়িতার দাবী নিতে কিন্তু আকাশের পাখীকে ধরার ফাঁদ যে মানুষ রচনা করলে মাটিতে বসে’ সে এ দাবী গ্রহণ করলে, নিয়তিকৃত নিয়ম রহিতের নিয়ম যারা পদে পদে প্রমাণ করে চল্লো নিজেদের সমস্ত রচনায়, তারাই দাবী দিতে পারলে রচয়িতার। কবীর তাই বল্লেন—“ভরম জঞ্জাল দুখ ধন্দ ভারি”—ভ্রান্তির জঞ্জাল দূর কর, তাতে দুঃখ ও দীনতা আর ঘোর সংশয়; “সত্ত দাবী গহো আপ নির্ভয় রহো”—তোমার যে সত্য দাবী তাই গ্রহণ কর নির্ভয় হও। যে মানুয রচয়িতার সত্য দাবী নেয়নি কিন্তু স্বপন দেখলে ওড়বার, সে নিজের কাঁধে পাখীর ডানা লাগিয়ে উড়তে গেল, পরীর মতো দেখতে হ’ল বটে সে, কিন্তু পরচুলো তার বাতাস কাট্‌লে না, ঝুপ করে পড়ে ম’রলো সে; কিন্তু যে রচয়িতার সত্য দাবী গ্রহণ করলে তার রচনা মাধ্যাকর্ষণের টান ছাড়িয়ে উড়লো তাকে নিয়ে লোহার ডানা বিস্তার করে’ আকাশে। মানুষ জলে হাঁটবার স্বপন দেখলে রচয়িতার দাবী গ্রহণ করলে না—ডুবে’ ম’রলো দু’পা না যেতে, রচয়িতার রচনা পায়ের মতো একেবারেই দেখতে হল না কিন্তু গুরুভাবের দ্বারা সে জলের লঘুতাকে জয় করে’ স্রোতের বাধাকে তুচ্ছ করে’ চলে গেল সে সাত সমুদ্র পার। মানুষ নিমেষে তেপান্তর মাঠ পার হবার স্বপন দেখলে রচয়িতার দাবী নিতে পারলে না, খানিক পথে দৌড়ে দৌড়ে ক্লান্ত হ’ল তার anatomy-দোরস্ত শরীর, তৃষ্ণায় বুক ফেটে ম’রলো সে হরিণের মতো, ঘোড়াও দৌড় অবলম্বন করে’ যতটা যেতে চায় নির্বিঘ্নে তা পারলে না, রণক্ষেত্রে ঘোড়া মায় সওয়ার পড়ে’ ম’রলো! রচয়িতা নিয়ে এল লোহার পক্ষিরাজ ঘোড়া—যেটা ঘোড়ার মতো একেবারেই নয় হাড়হদ্দ কোন দিক দিয়ে,—সৃজন করে’ উঠে বসলো, আপন পর সবাইকে নিয়ে নিমেষে ঘুরে এল যোজন বিস্তীর্ণ পৃথিবী নিৰ্ভয়ে! যা নিয়তির নিয়মে কোথাও নেই তাই হ’ল, জলে শিলা ভাসলো আকাশে মানুষ উড়লো, ঘুমোতে ঘুমোতে পৃথিবী ঘুরে’ এল রচনায় চড়ে’ মানুষ! প্রকৃতির নিয়মের বিপরীত আচরণে দোষ এখানে তো আমাদের চোখে পড়ে না। মানুষ যখন আয়নার সামনে বসে’ চুল ছাঁটে, টেরি বাগায়, ছিটের সার্টে বাংলা anatomyর সৌন্দর্য ঢেকে সাহেবি ঢঙে ভেঙে নেয় নিজের দেহ, কাজল টেনে চোখের টান বাড়িয়ে প্রেয়সী দেখা দিলে বলে বাহবা,—চুলের খোঁপার ঘোরপেঁচ দেখে’ বাঁধা পড়ে—নিজের কোন সমালোচনা যে মানে না তার কাছে, তখন সে ছবির সামনে এসে anatomyর কথা পাড়ে কেন সে আমার কাছে এক প্রকাণ্ড রহস্য। ইজিপ্টের লোক এককালে সত্যিই বিশ্বাস করতো যে, জীবন কায়া ছেড়ে চলে যায় আবার কিছুদিন পরে সন্ধান করে’ করে’ নিজের ছেড়ে ফেলা কামিজের মতো কায়াতেই এসে ঢোকে। এইজন্যে কায়ার মায়া তারা কিছুতে ছাড়তে পারেনি, ভৌতিক শরীরকে ধরে’ রাখার উপায় সমস্ত আবিষ্কার করেছিল, একদল কারিগরই তৈরি হয়েছিল ইজিপ্টে, যারা ‘কা’ প্রস্তুত করতো; তাদের কাযই ছিল যেমন মানুষ ঠিক সেই গড়নে পুত্তলিকা প্রস্তুত করা, গোরের মধ্যে ধরে’ রাখার জন্য; ঠিক এই সব ‘কা’-নির্মাতাদের পাশে বসে’ ইজিপ্টের একদল রচয়িতা artistic anatomyর বৃহত্ত ও অন্যথা-বৃত্ত দিয়ে পুত্তলিকা বা ‘কা’-নির্মাতাদের ঠিক বিপরীত রাস্তা ধরে’ গড়েছিল কত কি তার ঠিক নেই, দেবতা মানুষ পশু পক্ষী সবার anatomy ভেঙে চুরে তারা নতুন মূর্তি দিয়ে অমরত্বের সিংহাসনে বসিয়ে গেল। ইজিপ্টের এই ঘটনা হাজার হাজার বৎসর অাগে ঘটেছিল; কায়া-নির্মাতা কারিগর ও ছায়া-মায়ার যাদুকর দুই দলই গড়লে কিন্তু একজনের ভাগ্যে পড়লো মূর্ত—যা কিছু তাই, আর এক জনের পাত্রে ঝরলো অমূর্ত রস স্বর্গ থেকে,—এ নিয়মের ব্যতিক্রম কোন যুগের আর্টের ইতিহাসে হয়নি হবার নয়। ইজিপ্ট তো দূরে, পাঁচ হাজার দশ হাজার বছর আরো দূরে, এই আজকের আমাদের মধ্যে যা ঘটছে, তাই দেখ না কেন; যারা ছাপ নিয়ে চলেছে মর্ত্য জগতের রূপ সমস্তের, তারা মূর্ত জিনিষ এত পাচ্ছে দেখে’ সময়ে সময়ে আমারও লোভ হয়,—টাকা পাচ্ছে হাততালি পাচ্ছে অহংকে খুব বেশী করে পাচ্ছে। আর এরূপ যারা করছে না তারা শুধু আঁকা বাঁকা ছন্দের আনন্দটুকু, ঝিলিমিলি রঙ্গের সুরটুকু বুকের মধ্যে জমা করছে, লোহার সিন্দুক কিন্তু রয়েছে খালি; বুদ্ধিমান মানুষ মাত্রেই কালে কালে খুব আদর করে’ আর্টিষ্টদের যা সম্ভাষণ করেছে তা উর্দ্দূতে বলতে গেলে বলতে হয়—খেয়ালী, হিন্দীতে—বাউর বা বাউল, আর সব চেয়ে মিষ্টি হ’ল বাংলা—পাগল। কিন্তু এই পাগল তো জগতে একটি নেই, উপস্থিত দশবিশ লক্ষ কিম্বা তারও চেয়ে হয়তো বেশী এবং অনুপস্থিত ভবিষ্যতের সব পাগলের সর্দার হ’য়ে যে রাজত্ব করছে, উল্কার মতো জ্যোতির্ময় সৃষ্টি রচনা সমস্ত সে ছড়িয়ে দিয়ে চলেছে পথে-বিপথে সৃজনের উৎসব করতে করতে। এমন যে খেয়ালের বাউল, জগতের আগত অনাগত সমস্ত খেয়ালী বা আর্টিষ্ট হ’ল তার চেলা, তার পথ চলতে ঢেলাই হোক মাণিকই হোক যাই কুড়িয়ে পেলে অমনি সেটাকে যে খুব বুদ্ধিমানের মতো ঝুলিতে লুকিয়ে রাতারাতি আলো আঁধারের ভ্রান্তি ধরে’ চোখে ধূলো দিয়ে বাজারে বেচে এল তা নয়—মাটির ঢেলাকে এমন করে’ ছেড়ে দিলে যে সেটা উড়ে এসে যখন হাতে পড়লো তখন দেখি সোণার চেয়ে সেটা মূল্যবান, আসল ফুলের চেয়ে হ’য়ে গেছে সুন্দর! বাঙলায় আমাদের মনে আর্টের মধ্যে অস্থিবিদ্যার কোন্‌খানে স্থান, এই প্রশ্নটা ওঠবার কয়েক শত বৎসর আগে এই পাগলের দলের একজন আর্টিষ্ট এসেছিল। সে জেগে বসে’ স্বপন দেখলে—যত মেয়ে শ্বশুর ঘরে রয়েছে আসতে পারছে না বাপের বাড়ী, একটা মূর্তিতে সেই সবারই রূপ ফুটিয়ে যাবে! আর্টিষ্ট সে বসে গেল কাদা মাটি খড় বাঁশ রং তুলি নিয়ে, দেখতে দেখতে মাটির প্রতিমা সোণার কমল হয়ে ফুটে’ উঠলো দশ দিকে সোণার পাপড়ি মেলে! এ মূর্তি বাঙলার ঘরে ঘরে দেখবে দুদিন পরে, কিন্তু এরও উপরে ডাক্তারি শাস্ত্রের হাত কিছু কিছু পড়তে আরম্ভ হয়েছে সহরে। বাঙলার কোন অজ্ঞাত পল্লীতে এই মূর্তির মূল ছাঁচ যদি খোঁজ তো দেখবে—তার সমস্তটা artistic anatomyর নিয়মের দ্বারায় নিয়তির নিয়ম অতিক্রম করে’ শোভা পাচ্ছে ব্যতিক্রম ও অতিক্রমের সিংহাসনে।
অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর
শিল্প ও ভাষা অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর শিল্প ও ভাষা “বীণাপুস্তকরঞ্জিতহস্তে ভগবতি ভারতি দেবি নমস্তে॥” বাঙ্গলা ভাষা যে বোঝে সেই এ শ্লোকটা শুনলেই বলবে—‘বুঝলেম’, কিন্তু ‘ভারতী’ কাগজের মলাটের নিচে থেকে টেনে বার ক’রে আজকালের একখানা ছবি সবার সামনে যদি ধরে দিই, সাড়ে পনেরো আনার চেয়ে বেশি লোক বলবে, ‘বুঝলেম না মশায়!’ এই শেষের ঘটনা ঘটতে পারে, হয় যে ছবিটা লিখেছে সেই আর্টিষ্টের ছবির ভাষায় বিশেষ জ্ঞান না থাকায়, অথবা যে ছবি দেখেছে চিত্রের ভাষার দৃষ্টিটা তার যদি মোটেই না থাকে। ভারতীর বন্দনাটা যে ভাষায় লেখা সেই ভাষাটা আমাদের সুপরিচিত আর ‘ভারতী’র ছবিখানা যে ভাষায় রচা সে ভাষাটা একেবারেই আমাদের অপরিচিত; সেই জন্য চিত্র-পরিচয় পড়েও ওটা বুঝলেম না এমনটা হতে বাধা কোন্‌খানে? চীনেম্যানের কানের কাছে খুব চেঁচিয়ে সরস্বতীর স্তোত্র পাঠ করলেও সে বুঝবে না, কিন্তু ছবির ভাষার বেলায় সে অনেকখানি বুঝবে, কেননা ছবির ভাষা অনেকটা সার্বজনীন ভাষা। ‘আবর্’ কথাটা ফরাসীকে বল্লে সে গাছ বুঝবে, আবার ‘আবর্’ শব্দ হিন্দুস্থানীর কাছে মেঘরূপে দেখা দেবে, ইংরেজ সে শব্দটার কোনরূপ অর্থ আবিষ্কার করতে পারবে না, কিন্তু আঁকার ভাষায় ‘আবর্’ হয় গাছ নয় অভ্র স্বরূপ হয়ে দেখা দেয়; কথিত ভাষার মতো কৃত্রিম উপায়ে জোর ক’রে চাপিয়ে দেওয়া রূপ নিয়ে নয়। সুতরাং ছবির ভাষার মধ্যে, বলতেই হয়, অপরিচয়ের প্রাচীর এত কম উঁচু যে সবাই এমন কি ছেলেতেও সেটা উল্লঙ্ঘন সহজেই করতে পারে, কিন্তু ঐ একটু চেষ্টা যার নেই তার কাছে ঐ এক হাত প্রাচীর দেখায় একশো হাত দুর্গপ্রাকার,—ছবি ঠেকে সমস্যা। কবির ভাষা চলেছে শব্দ চলাচলের পথ কানের রাস্তা ধরে’ মনের দিকে, ছবির ভাষা অভিনেতার ভাষা এরা চলেছে রূপ চলাচলের পথ আর চোখের দেখা অবলম্বন ক’রে ইঙ্গিত করতে করতে, আবার এই কথিত ভাষা যেটা আসলে কানের বিষয় এখন সেটা ছাপার অক্ষরের মূর্তিতে চোখ দিয়েই যাচ্ছে সোজা মনের মধ্যে; ‘নবঘনশ্যাম’ এই কথাটা—ছাপা দেখলেই রূপ ও রং দুটোর উদ্রেক করে দিচ্ছে সঙ্গে সঙ্গে! নাটক যখন পড়া হয় কিম্বা গ্রামোফোনের মধ্য দিয়ে শুনি তখন কান শোনে আর মন সঙ্গে সঙ্গেই নটনটীদের অঙ্গভঙ্গি ইত্যাদি মায় দৃশ্যপটগুলো পর্যন্ত চোখের কোন সাহায্য না নিয়েই কল্পনায় দেখে চলে, ছবির বেলায় এর বিপরীত কাণ্ড ঘটে,—চোখ দেখলে রূপের ছাপগুলো, মন শুনে চল্লো কানের শোনার অপেক্ষা না রেখে ছবি যা বলছে তা; বায়স্কোপের ধরা ছবি, চোখে দেখি শুধু তার চলা ফেরা, ছবি কিন্তু যা বল্লে সেটা মন শুনে নেয়। কবির মাতৃভাষা যদি বাঙ্গলা হয় তবে বাঙ্গলা খুব ভাল ক’রে না শিখলে ইংরেজ সেটি বোঝে না; তেমনি ছবির ভাষা অভিনয়ের ভাষা এসবেও দ্রষ্টার চোখ দোরস্ত না হলে মুস্কিল। মুখের কথা একটা না একটা রূপ ধরে আসে, কাগ্ বগ্ বল্লেই কালো সাদা দুটো পাখী সঙ্গে সঙ্গে এসে হাজির! শব্দের সঙ্গে রূপকে জড়িয়ে নিয়ে বাক্য যদি হল উচ্চারিত ছবি, তবে ছবি হল রূপের রেখার রংএর সঙ্গে কথাকে জড়িয়ে নিয়ে—রূপ-কথা, অভিনেতার ভাষাকেও তেমনি বলতে পারো রূপের চলা বলা নিয়ে চলন্তি ভাষা! কবিতার ছবির অভিনয়ের ভাষার মতো সুর আর রূপ দিয়ে বাক্যসমূহকে যথোপযুক্ত স্থান কাল পাত্র ভেদে অভিনেতা ও অভিনেত্রীর মতো সাজিয়ে গুজিয়ে শিখিয়ে পড়িয়ে ছেড়ে দিলে তবেই যাত্রা সুরু ক’রে দিলে বাক্যগুলো, চল্লো ছন্দ ধরে, যথা— “করিবর—রাজহংস-গতি-গামিনী চললিহুঁ সঙ্গেত—গেহা অমল তড়িত দণ্ড হেম মঞ্জরী জিনি অপরূপ সুন্দর দেহা॥” কিন্তু বাক্যগুলোকে ভাষার সূত্রে নটনটী সূত্ৰধার এদের মতো বাঁধা হ’ল না, তখন কেবলি বাক্য সকল শব্দ করলে—ও, এ, হে, হৈ, ঐ কিম্বা খানিক নেচে চল্লো পুতুলের মতো কিন্তু কোন দৃশ্য দেখালে না বা কিছু কথাও বল্লে না, কোলাহল চলাচল হ’ল খানিক, বলাবলি হল না, যেমন— “হল ছিন্ন বিচ্ছিন্ন বিভিন্ন মতি হয় শান্ত কি ক্ষান্ত কৃতান্ত গতি করি গঞ্জিত গুঞ্জিত ভৃঙ্গ সবে ত্যজি মৃত্যু কি চিত্ত কি নিত্য রবে?” শোলোক্‌টা কি যেন বলতে চাইলে কিন্তু খাপছাড়া ভাবে, এ যেন কেউ তুরকী আরবী পড়ে ফরাশি মিশালে! কিন্তু কথাকে কবি কথা বলালেন ভাষা দিয়ে, চালিয়ে দিলেন ছন্দ দিয়ে, কথাগুলো তবে সজাগ সজীব অভিনেতার মতো নেচে গেয়ে বাঁশি বাজিয়ে চল্লো পরিষ্কার। “‘চলিগো, চলিগো, যাইগো চলে’। পথের প্রদীপ জ্বলে গো গগনতলে। বাজিয়ে চলি পথের বাঁশি ছড়িয়ে চলি চলার হাসি রঙীন বসন উড়িয়ে চলি জলে স্থলে।” ছবির বেলাতেও এমনি, সুর সার কথাবার্তা এসবের সূত্রে রূপকে না বেঁধে, আঁকা রূপগুলো অমনি যদি ছেড়ে দেওয়া যায় পটের উপরে, তবে তারা একটা একটা বিশেষ্যের মতো নিজের নিজের রূপের তালিকা দ্রষ্টার চোখের সামনে ধরে চুপ ক’রে দাঁড়িয়ে থাকে, বলে না চলে না—পিদুম, ফুল, ফুলদানি, বাবু, রাজা, পণ্ডিত, সাহেব কিম্বা অমুক অমুক অমুক এর বেশি নয়; কিন্তু প্রদীপ আঁকলেম, তার কাছে ফেলে দিলেম পোড়া সল্‌তে, ঢেলে দিলেম তেলটা পটের উপর—ছবি কথা ক’য়ে উঠলো,—“নির্ব্বাণদীপে কিমু তৈলদানম্”। ছবিকে ইঙ্গিতের ভাষা দিয়ে বলানো গেল, চলানো গেল। নাট্যকলা প্রধানতঃ ইঙ্গিতেরই ভাষা বটে কিন্তু তার সঙ্গেও কথিত ভাষার সঙ্কেত অনেকখানি না জুড়লে নাটকাভিনয় করা চলে না—এই ‘লেকচার’ লিখছি সামনে এতটুকু ‘টোটো’ ছেলেটা বোবা নটের মতো নানারকম অঙ্গভঙ্গি করে চল্লো, ভেবেই পাইনে তার অর্থ! হঠাৎ অঙ্গভঙ্গির সঙ্গে শিশু নট বাক্য আর সুর জুড়ে দিলে অং অং ভুস্ ভুস্, বোঁ বন্, বন সোঁ শন্ শন্, হিং টিং ছট্ ফট্, আয় চট্ পট্‌, লাগ লাগ ভোজবাজি, চোর বেটাদের কারসাজি, ঠিক দুপুরে রদ্দুরে, তাল পুকুরে উত্তুরে, কার আজ্ঞে? না, কথিত ভাষার আজ্ঞে পেয়ে বোবা ইঙ্গিত যাদু-মন্ত্র কথা ক’য়ে ফেল্পে, যেন ঘুড়ি উড়িয়ে চল্লো ঘুরে ফিরে। ছবির ভাষা, কথার ভাষা, অভিনয়ের ভাষা ও সঙ্গীতের ভাষা এই রকম নানা ভাষা এ পর্যন্ত মানুষ কাযে খাটিয়ে আসছে। এর মধ্যে সঙ্গীত শুধু যা বলতে চায়, কিম্বা যখন কাঁদাতে চায় বা হাসাতে চায়, কাকুতি মিনতি জানাতে চায় তখন ছবির ভাষা ও কথার ভাষাকে অবলম্বন না করেও নিজের স্বতন্ত্র ভাষার মীড় মূৰ্ছনা ইত্যাদি দিয়ে সুব্যক্ত হয়ে উঠতে পারে। রং এর ভাষারও এই ক্ষমতা ও স্বাধীনতা আছে—আকাশের রূপ নেই কিন্তু রংএর আভাস দিয়ে সে কথা বলে। কিন্তু আর সব ভাষা কথিত চিত্রিত অভিনীত সমস্তই এ ওর আশ্রয় অপেক্ষা করে। সুর আর রূপ, বলা ও দেখা, এরা সব কেমন মিলে জুলে কায করে দু একটা উদাহরণ দিলেই বোঝা যাবে। মধুর বাক্যগুলো কানের জিনিষ হলেও মাধবীলতার মতো চোখের দেখা সহকারকে আশ্রয় না করে পারে না। দৃশ্য বা ছবিকে আশ্রয় না করে কিছু বলা কওয়া একেবারেই চলে না তা নয়, যেমন— “কাহারে কহিব দুঃখ কে জানে অন্তর যাহারে মরমী কহি সে বাসয়ে পর। আপনা বলিতে বুঝি নাহিক সংসারে এতদিনে বুঝিনু সে ভাবিয়া অন্তরে।” এখানে মনোভাব বাচন হল, কোন রূপ কোন ভঙ্গি, ছবি বা অভিনয়ের সাহায্য না নিয়েও। বাচনের বেলায় বাক্য স্বাধীন কিন্তু বর্ণনের বেলায় একেবারে পরাধীন, যেমন— ‘একে কাল হৈল মোর নয়লি যৌবন আর কাল হৈল মোর বাস বৃন্দাবন।’ নব যৌবন আর বৃন্দাবনের বসন্ত শোভার ছবি বাক্যগুলোর মধ্যে মধ্যে বিদ্যুতের মতো চমকাচ্ছে! ‘অার কাল হৈল মোর কদম্বের তল আর কাল হৈল মোর যমুনার জল।’ বেশ স্পষ্ট হয়ে উঠলো কালো যমুনা তার ধারে কদমতলা, তার ছায়ায় সহচরী সহিত রাধিকা— ‘আর কাল হৈল মোর রতন ভূষণ আর কাল হৈল মোর গিরি গোবর্দ্ধন।’ রাধিকার রত্ন অলঙ্কারের ঝিকমিকি থেকে দূরের কালো পাহাড়ের ছবি দিয়ে Landscapeটা সম্পূর্ণ হল, ছবি মিলে গেল কথার সঙ্গে, কান চোখ দুয়ের রাস্তা একত্র হয়ে সোজা চল্লো মনোরাজ্যে! এর পর আর ছবি নেই বর্ণনা নেই শুধু কথা দিয়ে বাচন— ‘এত কাল সনে অামি থাকি একাকিনী এমন ব্যথিত নাহি শুনএ কাহিনী।’ এ বারে কথিত ভাষার ছবির সাক্ষাদ্দর্শন— ‘জলদ বরণ কানু, দলিত অঞ্জন জনু উদয় হয়েছে সুধাময়— নয়ন চকোর মোর, পিতে করে উতরোল নিমিষে নিমিখ নাহি রয়। সই দেখিনু শ্যামের রূপ যাইতে জলে!’ একেবারে নির্নিমেষ দৃষ্টিতে ছবি-দেখা কথার ভাষা দিয়ে! এইবার অঙ্গভঙ্গি আর চলার সঙ্গে কথার যোগাযোগ পরিষ্কার দেখাবো— ‘চলিতে না পারে রসের ভরে আলস নয়ানে অলস ঝরে ঘন ঘন সে যে বাহিরে যায় আন ছলে কত কথা বুঝায়।’ চোখের সামনে চলাফেরা সুরু ক’রে দিলে কথার ভাষা অভিনয় করে নানা ভঙ্গিতে। চিত্রিত ভাষা কথিত ভাষা অভিনীত ভাষা এসব যদি এ ওর কাছে লেনা দেনা করে চল্লো তবে কথিত ভাষার ব্যাকরণ অলঙ্কারের সূত্র আইন কানুন ইত্যাদির সঙ্গে আর দুটো ভাষার ব্যাকরণাদির মিল থাকতে বাধ্য। কথার ব্যাকরণে যাকে বলে ‘ধাতু’, ছবির ব্যাকরণে তার নাম ‘কাঠামো’ (form)। ধারণ করে রাখে বলেই তাকে বলি ধাতু। ধাতু ও প্রত্যয় একত্র না হ’লে কথিত ভাষার শব্দরূপ পাই না, ছবির ভাষাতেও ঠিক ঐ নিয়ম—মাথা হাত পা ইত্যাদি রেখে দিয়ে একটা কাঠামো বা ফর্মা বাঁধা গেল। কিন্তু সেটা বানর না নর এ প্রত্যয় বা বিশ্বাস কিসে হবে যদি না ছবিতে নর বানরের বিশেষ প্রত্যয় দিই! শুধু এই নয়, বিভক্তি যিনি ভাগ করেন ভঙ্গি দেন, তাঁর চিহ্ন ইত্যাদি নানা ভঙ্গিতে কাঠামোয় জুড়ে দেওয়া চাই। বর্ণে বর্ণে রূপে রূপে নানা বস্তুর সঙ্গে নানা বস্তুতে সন্ধি সমাস করার সূত্র আছে, ছবির ব্যাকরণে, বচন ক্রিয়া বিশেষ্য বিশেষণ সর্বনাম অব্যয় এমন কি মুগ্ধবোধের সবখানি অলঙ্কারশাস্ত্রের সবখানির সঙ্গে মিলিয়ে দেওয়া চলে ছবির ব্যাকরণ আর অলঙ্কারের ধারাগুলো। কথিত ভাষার বেলায় ‘ভৃ’ ধাতু গক্ প্রত্যয় করে যেমন ‘ভৃঙ্গ’, ছবির ভাষায় কালো ফোঁটার উপরে দুটো রেফ্ যোগ করলেই হয় ‘দ্বিরেফ্ ভৃঙ্গ’ আবার ভৃঙ্গের কালো ফোঁটায় রেফ্ না দিয়ে শুণ্ড প্রত্যয় দিলে হয় ‘ভৃঙ্গার’ যেমন ‘ভৃ’ ধাতুতে ‘গিক’ প্রত্যয় জুড়লে হয় ‘ভৃঙ্গি’। ছবি লেখার উৎসাহ নেই কিন্তু ছবির ব্যাকরণ লেখার আম্বা আছে এমন ছাত্র যদি পাই তো চিত্ৰকরে আর বৈয়াকরণে মিলে এই ভাবে আমরা ছবি দেওয়া একটা ব্যাকরণ রচনা করতে পারি, কিন্তু এ কাজে নামতে আমার সাহস নেই কেননা ব্যাকরণ বলে জিনিষটা আমার সঙ্গে কি কথিত ভাষা কি চিত্রিত ভাষা দুয়ের দিক দিয়েই চিরকাল ঝগড়া করে বসে আছে। সংকীর্তিত ভাষা যেমন, তেমনি সংচিত্রিত ভাষাও একটা ভাষা, ব্যাকরণের প্রত্যক্ষ প্রমাণ দিয়ে এইটে যদি সাব্যস্ত হল তবে এও ঠিক হ’ল যে ছবি দেখা শুধু চোখ নিয়ে চলে না ভাষা-জ্ঞানও থাকা চাই দ্রষ্টার, ছবি-স্রষ্টার পক্ষেও ঐ একই কথা। ‘রসগোল্লা খেতে মিষ্টি, টাপুর টুপুর পড়ে বৃষ্টি’, এটা বুঝতে পারে না পাঠশালায় না গিয়েও এমন ছেলে কমই আছে, কিন্তু শিশুবোধের পাঠ থেকে ভাষা-জ্ঞান বেশ একটু না এগোলে— ‘মধুর মধুর ধ্বনি বাজে হৃদয়-কমল-বন মাঝে!’ এটা বোঝা সম্ভব হয় না চট্‌ ক’রে বালকের। শুধু অক্ষর কিম্বা কথা অথবা পদ কিম্বা ছত্রের পর ছত্র লিখতে পারলে অথবা চিনে চিনে পড়তে পারলেই সুন্দর ভাষায় গল্প কবিতা ইত্যাদির লেখক বা পাঠক হয়ে ওঠা যায় একথা কেউ বলে না, ছবি অভিনয় নর্তন গান ইত্যাদির বেলায় তবে সে কথা খাটবে কেন! যেমন চিঠি লিখতে পারে অনেকে তেমনি ছবিও লিখতে পারে একটু শিখলে প্রায় সবাই, কিন্তু লেখার মতো লেখার ভাষা, আঁকার মতো আঁকার ভাষার উপর দখল ক’জনে পায়? কাযেই বলি যে ভাষাই হোক তাতে স্রষ্টাও যেমন অল্প তেমনি দ্রষ্টাও ক্বচিৎ মেলে। ভাষাজ্ঞানের অভাব বশতঃ ফুলকে দেখারূপে আঁকা এক ফুলের ভাষা শুনে নিজের ভাষায় ফুলকে বর্ণনা করায় তফাৎ আছে কে না বলবে! বাঙ্গলা দেশে অপ্রচলিত সংস্কৃত ভাষা, কিন্তু সেই অপ্রচলিত ভাষা চলিত বাঙ্গলার সঙ্গে মিলিয়ে একটা অদ্ভুত ভাষা হয়ে প্রচলিত যেমনি হ’ল, অমনি বাঙ্গলার পণ্ডিত সমাজে খুব চলন হল সেই ভাষার, সবাই লিখলে কইলে বুঝলে বুঝালে সেই মিশ্র ভাষায়, চলিত বাঙ্গলায় খাঁটি বাঙ্গলায় লেখা অপ্রচলিত হয়ে পড়লো, ফল হ’ল—এক কালের চলতি ভাষা সহজ কথা সমস্তই দুর্বোধ্য হয়ে পড়লো, এমন কি কথার অক্ষর মূর্তিটা চোখে স্পষ্ট দেখলেও কথাটার ভাব-অর্থ ইত্যাদি বোঝা শক্ত হয়ে পড়ল। বাঙ্গলা অথচ অপ্রচলিত কথাগুলোর বেলায় যদি এটা খাটে তবে ছবির ভাষার বেলায় সেটা খাটবে না কেন? ছবির মূর্তির অপ্রচলনের সঙ্গে সঙ্গে তাদের ভাষা বোঝাও দুঃসাধ্য হয়ে যে পড়ে তার প্রমাণ দেশের ইতিহাসে ধরা থাকে, আর সেইগুলোর নাম হয় অন্ধযুগ, এই অন্ধতার মধ্য দিয়ে আমাদের মতো পৃথিবীর অনেকেই চলেছে সময় সময়! চোখে দেখা মাত্রই সবখানি বোঝা না গেল সে ছবি ছবিই নয় একথা না হয় শিল্পীর উপরে জবরদস্তিতে চালানো গেল, কিন্তু আমাদের নিজ বাঙ্গলার মুখের কথা আমরা অনেক সময়ে নিজেরাই বুঝিনে বোঝাতেও পারিনে ভাষাতে পণ্ডিতেরা না বুঝিয়ে দিলে, তবে কি বলবো বাঙ্গলা ভাষা বলে বস্তুটা বস্তুই নয়?—‘ছীয়াল’, ‘ছিমনী’, ‘ছোলঙ্গ’ এই তিনটেই বাংলা কথা, কিন্তু বুঝলে কিছু? ফরিদপুরের ছেলে ‘ছোলঙ্গ’ বলতেই বোঝে, বহরমপুরের লোক বোঝে না, বাঙ্গলা শব্দকোষ না আয়ত্ত হ’লে ওয়েবষ্টার জ্ঞান নিয়েও বুঝতে পারে না ‘ছোলঙ্গ’ হচ্ছে বাতাবি লেবু, লারঙ্গ ছোলঙ্গ টাবা কমলা বীজপুর। ‘ছিয়াল’, ‘ছিমনী’ এ দুটোও বাঙ্গলা কিন্তু বাঙ্গলার সাধুভাষা বলে কৃত্রিম ভাষা নিয়ে যারা ঘরকন্না করছেন তাঁরা এর একটাকে শৃগালের অপভ্রংশ আর একটাকে ইংরাজি চিম্‌নি কথার বাঙ্গলা বলেই ধরবেন কিন্তু এ দুটোই তা নয়—ছীয়াল মানে শ্ৰীল বা শ্ৰীমান ও শ্ৰীমতী, আর ছিম্‌নী মানে পাথর-কাটা ‘ছেনী’, শৃগালও নয় চিমনিও নয়। দুশো বছর আগে যে ভাষা চলিত ভাষা ছিল, পট ও পাটার ভাষার সঙ্গে সঙ্গে সেই প্রাচীন বাঙ্গলা পুঁথির ভাষাও অপ্রচলিত হয়ে গেছে; সুতরাং যে শোলোক্‌টা এবারে বলবো তা বাঙ্গলা হলেও আমাদের কাছে চীনে ভাষারই মতো দুর্বোধ্য— “ঘাত বাত হাত ঘর জোহি অয়লাহু ন ভেতল চোলে অারে সবে অকলাহু।’ পরিচিত বাংলায় আন্দাজে আন্দাজে এর যতটা ধরা গেল তার তর্জমা করলেম, তবে অনেকটা বোধগম্য হল ভাবার্থটা— ঘাট বাট হাট ঘর করিনু সন্ধান চোরে না পাইরা মোরা হইনু হয়রান। দুই তিন শত বছরের আগেকার বাঙ্গালী যে চলিত ভাষায় কথা কইতো তাই দিয়েই উপরের কবিতাটা লেখা, আজকের আমরা সে ভাষা দখল করিনি অথবা ভুলে গেছি, কবিতা দুর্বোধ হল সেইজন্য, ভাষার দোষেও নয় কবির দোষেও নয়। কথিত ভাষার হিসেব পণ্ডিতেরা এইরূপ দিয়েছেন—সংস্কৃত, প্রাকৃত, অপভ্রংশ, মিশ্র অথবা সংস্কৃত, ভাষা আর বিভাষা। আর্টের ভাষাতেও এই ভাগ, যথা–শাস্ত্রীয় শিল্প Academic art, লোকশিল্প Folk art, পরশিল্প Foreign art, মিশ্রশিল্প Adapted art. লোকশিল্পের ভাষা হল—পটপাটা গহনাগাটি ঘটিবাটি কাপড়চোপড় এমনি যে সব art শাস্ত্রের লক্ষণের সঙ্গে না মিল্লেও মন হরণ করে। শাস্ত্র ব্যাকরণ ইত্যাদি ‘পণ্ডিতানাম্ মতম্’ যে art এর সঙ্গে যোগ দেয়নি কিন্তু ‘যত্র লগ্নং হি হৃৎ’ হৃদয় যার সঙ্গে যুক্ত আছে, শুক্রাচার্যের মতে তাই হল লোকশিল্পের ভাষার রূপ। আর যা ‘পণ্ডিতানাম্ মতম্’ যেমন দেবমূর্তি-রচনা শিল্প শাস্ত্রের লক্ষণাক্রান্ত অথবা রাজা বা পণ্ডিতগণের অভিমত শিল্প সেই হল শিল্পের সংস্কৃত ভাষা—কোথাও লোকশিল্পের চলিত ভাষাকে মেজে ঘষে সেটা প্রস্তুত, কোথাও প্রাচীন লুপ্ত ভাষাকে চলিতের সঙ্গে মিলিয়ে নব কলেবর দিয়েও সাধুভাষারূপে সেটা প্রস্তুত করা হয়। পরশিল্প হ’ল যেমন গান্ধারের শিল্প, একালের অয়েল পেণ্টিং। মিশ্রশিল্প চীনের বৌদ্ধশিল্প, জাপানের নারা মন্দিরের শিল্প, এসিয়ার ছাঁচে ঢালা এখনকার ইয়োরোপীয় শিল্প, গ্রীসের ছাঁচে ঢালা স্থানবিশেষের বৌদ্ধশিল্প এবং এখনকার বাঙ্গলার নবচিত্রকলা পদ্ধতি! সুতরাং সব ছেড়ে দিয়ে বাঙ্গলার নব চিত্রকলাকেই ধ’রে দেখা যাক—ছবিগুলো সমস্যা হয়ে উঠলে তো বড় বিপদ! ছবির ছবিত্ব চুলোয় গেল, সেগুলো হয়ে উঠলো ব্যাকরণ ও ভাষাতত্ত্ব এবং বর-ঠকানো কূট প্রশ্ন! নব চিত্রকলার এ ঘটনা যে ঘটেনি তা অস্বীকার করবার যে নেই যখন সবাই বলছে, কিন্তু ছবিটা যে সমস্যার মতো ঠেকে সেটা ছবির বা ছবি লিখিয়ের দোষে অথবা ছবি দেখিয়ের দোষে সেটা তো বিচার করা চাই! “বায়বা যাহি দর্শতে মে সোমা অরং কৃতাঃ, তেষাং পাহি শ্রুবী হবং!” সব অন্ধকার ছবির সমস্যার চেয়ে ঘোরতর সমস্যা আমাদের মতো অজ্ঞানের কাছে, কিন্তু বেদের পণ্ডিতের কাছে এটা একেবারেই সমস্যা নয়! ছবি যেমন তেমনি রাজাও রাষ্ট্রনীতি, যুদ্ধ-বিগ্রহ, সৈন্য-সামন্ত, ধূম-ধাম, হাঁক-ডাক, দ্বারপাল, দুর্গ ইত্যাদির দুর্গমতা নিয়ে একটা মস্ত সমস্যার মত ঠেকেন প্রজার কাছে, কিন্তু উপযুক্ত মানুষ বলে রাজার একটা স্বতন্ত্র সত্তা আছে—সেখানে রাজা হন রাজামহাশয়—দুর্গম সমস্যা নয়, তেমনি ছবি মূর্তির সত্তা হ’ল সুন্দর ছবি বা সুন্দরমূর্তি বা শুধু ছবি শুধু মূর্তিতে। রাজাকে উপযুক্ত মানুষের সত্তার দিক দিয়ে দেখার পক্ষেও যেমন দুর্গদ্বার ইত্যাদির বাধা আছে এবং কারো কারো কাছে নেইও বটে, ছবি মূর্তির সত্তার বোধের বেলাতেও ঠিক একই কথা। ছবিকে মূর্তিকে শুধু ছবি মূর্তির দিক দিয়ে বুঝতে পারলে আর সব দিক সহজ হয়ে যায় কিন্তু এ কাজটাও যে সবাই সহজে দখল করতে পারে—হঠাৎ ছবি মূর্তি দেখেই তাদের সত্তার দিক দিয়ে তাদের ধরা চট্‌ করে যে হয়—তা নয়, সেই ঘুরে ফিরে আসে পরিচয়ের কথা। সুরের ভাষা যে না বোঝে সঙ্গীত তার কাছে প্রকাণ্ড প্রহেলিকা, দুর্বোধ শব্দ মাত্র! সুতরাং এটা ঠিক যে মানুষ কথা কয়েই বলুক অথবা সুর গেয়ে বা ছবি রচে’ কিম্বা হাতপায়ের ইসারা দিয়েই বলুক সেটা বুঝতে হলে যে বোঝাতে চলেছে তারও তেমন ভাষা ইত্যাদির জটিলতা ভেদ করা চাই। কথায় যেমন ছবি ইত্যাদিতেও তেমনি যখন কিছু বাচন করা হ’ল তখন সবাই সেটা সহজে বুঝলে, না হলে বাচন ব্যর্থ হ’ল। ‘হুঁকো নিয়ে এস’, এটা ব্যাকরণ আড়ম্বর অলঙ্কার ইত্যাদি না দিয়ে বল্লেম, তবে হুকোবরদার বুঝলে পরিষ্কার, দরজার দিকে আঙ্গুল হেলিয়ে বল্লেম, “যাও”, বেরিয়ে গেল হুকোবরদার, একটা মটর-কারের ছবি এঁকে দোকানের দরজার উপর ঝুলিয়ে দিলে সবাই বুঝলে এখানে মটর-কার পাওয়া যায় কিন্তু বর্ণনের বেলায় ভাষা, ছন্দ, ব্যাকরণ, অলঙ্কার ইত্যাদির অবগুণ্ঠন আর আবরণ দিয়ে ছেড়ে দেওয়া গেল কথা ছবি সুর সার সমস্ত, কেমন করে সে বোঝে ভাষার গতিবিধির সঙ্গে যার মোটেই পরিচয় হয় নি! দেবমাতা অদিতি তিনি স্বর্গেই থাকেন সুতরাং দেবভাষাতেই তাঁর অধিকার হল। একদিন তিনি শুনলেন জল সব চলেছে কি যেন বলতে বলতে! দেবমাতা বামদেবকে শুধালেন, “ঋষি! অ-ল-লা এইরূপ শব্দ করিতে করিতে জলবতী নদীগণ আনন্দ-ধ্বনি করতঃ গমন করিতেছে, তুমি উহাদের জিজ্ঞাসা কর, উহারা কি বলিতেছে?” অদিতির মতো, ঋষিরও যদি জলের ভাষাজ্ঞান জলের মতো না হতো, তবে তিনিও শুধু অ-ল-লাই শুন্‌তেন, কিন্তু ঋষি আপনার প্রকাণ্ড জিজ্ঞাসা নিয়ে বিশ্বের ভাষা বুঝে নিয়েছিলেন, জল কি বলে, মেঘ কি বলে, নদী সমুদ্র কি বলে, সমস্তই তিনি অবগত ছিলেন, কাজেই মেঘ থেকে ঝ’রে-পড়া জলের সেদিনের কথাটি দেবভাষাতে তর্জমা করে অদিতিকে জানানো তাঁর সুসাধ্য হল, যথা—‘জলবতী নদীগণ ইহাই বলিতেছে, মেঘসকলকে ভেদ করে জলসমূহের এমন শক্তি কোথায়? ইন্দ্র মেঘকে বিনাশ করতঃ জলসমূহ মুক্ত করেন, মেঘের আবরণ ইন্দ্রই ভেদ করেন।’ অ-র-ণ্য এই কটা অক্ষর জুড়ে দিলেই মূর্তিমান অরণ্যটা আমাদের চোখ দিয়ে সাঁ করে গিয়ে আজকাল প্রবেশ করে মনে, কিন্তু ভাষা যখন অক্ষরমূর্তি ধরেনি, শব্দমূর্তি দৃশ্যমূর্তিতে চলেছে তখন দেখি শুধু অরণ্য এইটে বাচন মাত্র করে দিয়েই ঋষির ভাষা স্তব্ধ হচ্ছে না, কিন্তু ছন্দে সুরে, অরণ্যের ভাষা শব্দ আর নানা রহস্য ধরে ধরে তবে অরণ্যের সত্তা আবিষ্কার কর্‌তে কর্‌তে চলেছে ঋষির ভাষা জিজ্ঞাসা আর বিস্ময়ের ভিতর দিয়ে—“অরণ্যান্যরণ্যান্যসৌ যা প্রেব নশ্যসি, কথা গ্রামং ন পৃচ্ছসি নত্বা ভীরিব বিদন্তি॥ বৃষারাবায় বদতে যদুপাবতি চিচ্চিকঃ। আঘাটিভিরিব ধাবয়ন্নরণ্যানির্মহীয়তে॥ উতগাব ইবাদন্তুত বেশ্মেব দৃশ্যতে। উতো অরণ্যানিঃ সায়ং শকটীরিব সর্জতি॥ গামং গৈষ আ-হুয়তি দার্বং গৈষো অপাবধীৎ। বসন্নরণ্যান্যাং সায়মক্রুক্ষাদিতি মন্যতে॥ ন বা অরণ্যানিহংত্যন্যশ্চেন্নাভি গচ্ছতি। স্বাদো ফলস্য জগ্ধায় যথাকামং নি পদ্যতে॥ আঞ্জনগন্ধিং সুরভিং বহুন্নাসকৃষিবলাং। প্রাহং মৃগানাং মাতরমরণ্যানি মশংসিষং॥” ১৪৬ দেবমুনি ঋক্‌দেব॥ “হে অরণ্যানি! হে অরণ্যানি! তুমি যেন দেখিতে দেখিতে লুপ্ত হও (কত দূরেই তুমি চলিয়াছ)! অরণ্যানি, তুমি গ্রামের বার্ত্তাই লও না, তোমার ভয় নাই এমনি ভাবে একাকী আছ। “জন্তুরা বৃষের ধ্বনিতে কি যেন বলিতেছে, উত্তর সাধক পক্ষীরা চিচ্চিক স্বরে যেন তাহার প্রত্যুত্তর দিতেছে। এ যেন বীণার ঘাটে ঘাটে ঝনৎকার দিয়া কাহারা অরণ্যানীর মহিমা কীর্ত্তন করিতেছে। বোধ হয় অরণ্যানীর মধ্যে কোথাও যেন গাভী সকল বিচরণ করিতেছে, কোথাও অট্টালিকার মত কি দৃশ্যমান, ছায়ালোকে মণ্ডিত সায়ংকালের অরণ্য যেন কত শত শকট ওখান হইতে বাহির করিয়া দিতেছে! কে ও! গাভী সকলকে ফিরিয়া ডাকিতেছে, ও কে! কাষ্ঠ ছেদন করিতেছে, অরণ্যের মধ্যে যে লোক বাস করে সেই লোক বোধ করে সন্ধ্যাকালে যেন কোথায় কে চীৎকার করিয়া উঠিল! বাস্তবিক কিছু অরণ্যানী কাহারো প্রাণবধ করে না, অন্যান্য শ্বাপদ জন্তু না আসিলে ওখানে কোন আশঙ্কা নাই। নানা স্বাদু ফল আহার করিয়া অরণ্যে সুখে দিন যাপন করা যায়, মৃগনাভি গন্ধে সুরভিত অরণ্য সেখানে কৃষিগণ নাই, অথচ বিনা কর্ষণেই প্রচুর খাদ্য উৎপন্ন হয়। মৃগগণের জননীস্বরূপা এমন যে অরণ্যানী তাঁহাকে এইরূপে আমি বর্ণন করিলাম।” এখন উপরের এই অরণ্য বর্ণনার একটা তর্জমা বাঙ্গলায় না করে ছবির ভাষায় করলে অনেকের পক্ষে বোঝা সহজ হতো সবাই বল্‌বে। ভাল কথা—বর্ণনাটা ছবিতে ধরতে আর্ট স্কুলের পরীক্ষার দিনে কাঁচা আধপাকা পাকা সব আর্টিষ্টদের হাতে দেওয়া গেল, ফল কি হল দেখ। কচি আর্টিষ্ট যে ছবি দিয়ে শুধু বাচন করতেই জানে সে অরণ্যানী এইটুকু মাত্র একটা বনের দৃশ্যে বাচন মাত্র করে হাত গুটিয়ে বসলো—আর তো বাচন করবার কিছু পায় না। পক্ষীর চিক্‌ চিক্‌ বৃষের রব বীণার ঝনৎকার এ সবতো ছবিতে ধরা যায় না, বাকি সমস্তটা মরীচিকার মতো এই দেখতে এই নেই। এদের স্থিরতা দিয়ে ছবিতে ধরলে সমস্তটা মাটি। কিন্তু আধপাকা আর্টিষ্ট little learning বা স্বল্প শিক্ষা যাকে ভীষণ সমস্ত পরীক্ষায় ভুলিয়ে নিয়ে চলে, সে ‘অরণ্য’ কথাটি মাত্র ছবিতে বাচন করে খুসি হলো না; সে নির্বাচন করতে বসে গেল—যেন যা হচ্ছে, যেন যা দেখা যাচ্ছে এমনি নব ছায়ারূপ মায় কস্তুরীগন্ধী সোনার মৃগটাকে পর্যন্ত রং রেখার ফাঁদে ধরতে চল্লো মহা উৎসাহে। প্রজাপতিকে যেমন ছেলেরা কুঁড়োজালিতে ধরে সেই ভাবে সব ধরলে ছবিতে চিত্রভাষায় নীতিপরিপক্ব আর্টিষ্ট, কিন্তু দেখা গেল ধরা মাত্র সব চিত্র পুত্তলিকার মত কাঠ হয়ে রইলো, ঋষির গতিশীল বর্ণনা দুৰ্গতিগ্রস্ত হয়ে গিলটির ফ্রেমের ফাঁস গলায় দিয়ে অপঘাত মৃত্যু লাভ করলে। তারপর এল পাকা শিল্পীর পালা। সে ঋক্‌বেদের সূক্তটা হাতে পেয়েই তার সমস্ত রসটা মন দিয়ে পান করে ফেল্লে, তারপর ছবির শাদা কাগজে মোটা মোটা করে লিখলে—ছবি মানে Book illustration নয়, একমাত্র stage craft এই বর্ণনার illustration চিত্র শব্দ আলো ছায়া এবং নানা গতিবিধি ইত্যাদি দিয়ে ফুটিয়ে দিতে পারে নিখুঁতভাবে, আমি stage manager নই, সুতরাং আমাকে ক্ষমা করবেন। কথাগুলো অরণ্যের সত্তাকে একদিক দিয়ে বোঝালে, ছবির ভাষা অন্যদিক দিয়ে তাকে বোঝাবে এই জানি, illustration চান্, না ছবি চান্ সেটা জান্‌লে এই পরীক্ষায় অগ্রসর হব ইতি— পুঃ—ঋষিরা এক জায়গায় বলেছেন ‘অন্যের রচনার সাহায্যে তোমরা স্তুতি করিও না,’ সুতরাং আমার নিজের মনোমতো রচনা দিয়ে আমি ঘরে গিয়ে অরণ্যের স্তুতি ছবি দিয়ে লিখে পাঠাবো মনে করেছি; বিদায়—। যে ছেলেটা সব চেয়ে জ্যেঠা, পরীক্ষক যদি পাকা হন তো জ্যেঠা হিসেবে তাকেই দেবেন ফুল মার্ক, আর কাঁচা যার পক্ষে ignorance bliss তাকে দেবেন পাস্ মার্ক, আর মাঝামাঝি ছেলেটিকে দেবেন শূন্য, এটা নিশ্চয়ই বলতে পারি। ছবি, কথা, ইঙ্গিত, সুর সার ইত্যাদি যদিও এরা ভাষা—কিন্তু ব্যক্ত করার উপায় ও ক্ষেত্র এদের সবারই একটু একটু বিভিন্ন, এরা মেলেও বটে, না মেলেও বটে, এরা একই ভাষা-পরিবারভুক্ত কিন্তু একই নয়—“Language is a system of signs, of Ideas and of relation between Ideas. These signs may be spoken sounds as in ordinary speech or purely visual (নাট্যচিত্র) or as the Egyptian Hieroglyphs (অক্ষর মূর্তি বা নিরূপিত বাক্য) or as construction of movements as in the finger language used by deaf mutes (ইঙ্গিত)”—(F. Ryland) মানুষের ভাষা সব প্রথম শব্দকে ধরে’ আরম্ভ হল কি বিচিত্র রূপকে ধরে’ তা বলা শক্ত, তবে স্বভাবের নিয়মে দেখি জন্মাবধি শিশু শব্দ শোনা, শব্দ করা, আলো ছায়া এবং নানা পদার্থের রূপ রং ইত্যাদি দুটোই এক সঙ্গে ধরে বুঝতে এবং বোঝাতে চলেছে! ভূমিষ্ঠ হওয়া মাত্র মানুষ যে ‘মা’ শব্দ উচ্চারণ করেছে এবং যে চোখের তারা ফিরিয়েছে বা যে হাত বাড়িয়েছে মায়ের দিকে, তারি থেকে কথিত চিত্রিত ও ইঙ্গিতের ভাষার একই দিনে সৃষ্টি হয়েছে বল্লে ভুল হবে না। পুরাকালেরও প্রাক্কালে মানুষ যে সব শব্দ করে’ এ ওকে ডাক্‌তো, সে তাকে আদর করে’ কিছু শোনাতো কি জানাতো, যে বাক্য তারা বল্‌তো তার সুর সার ইঙ্গিত আভাষ কোন্ কালের আকাশে মিলিয়ে গেছে, কিন্তু সেই সব দিনের মানুষের চিত্রিত যে বাক্য-সকল তা এখনো যে গুহায় তারা থাক্‌তো তার দেওয়ালে বিচিত্র বর্ণ আর মূর্তি নিয়ে বর্তমান আছে; ইউরোপে এসিয়ার নানাস্থানে কত কি যে ছবি তার ঠিকানা নাই—গরু, মহিষ, শৃগাল, হস্তী, অশ্ব, মৃগ-যূথ, দলে দলে জলের মাছ, যুদ্ধ-বিগ্রহ, অস্ত্ৰ-শস্ত্র, কত কি! চিত্রের ভাষা দিয়ে তারা কি বোঝাতে চেয়েছিল তা এখনো ধর্‌তে পাচ্ছি—দিনের খবর, রাতের খবর, জলের খবর, বনের পশুর খবর, এমন কি হরিণের চোখটা কেমন তার খবরটা পর্যন্ত! সেই সব ইতিহাসের বাইরে ও-যুগের মানুষ এবং সাধক পুরুষেরা নিজেদের তপস্যালব্ধ চিত্রভাষার সাহায্যে মনোভাবগুলো লিখে গেছে, সুতরাং ছবিকেও খুব আদিকালে ভাষা হিসেবেই মানুষ যে দেখেছে তাতে সন্দেহ নেই। শব্দের দ্বারায় বাক্যের দ্বারায় যেমন, আঁকা ও উৎকীর্ণ রূপের দ্বারাও তেমনি, পরিচিত সব জিনিষকে চিহ্নিত নিরূপিত নির্বাচিত করে’ চলেছে মানুষ—এই হ’ল গোড়ার কথা। যারা জীবন্ত কিম্বা যারা গতিশীল কেবল তাদেরই আদি যুগের মানুষেরা চিত্রের ভাষায় ধরতে চেয়েছে গাছ, পাথর, আকাশ যারা স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে, শব্দ করে না, চলে না, বলেও না, আলোতে অরণ্যানীর মতো হঠাৎ দেখা দেয় আবার অন্ধকারে হঠাৎ মিলিয়ে যায়, ছবির ভাষায় তাদের ধরা তখন সম্ভব বোধ করেনি মানুষ, হয়তো বা কথিত ভাষাতেও এ সব বর্ণন করে নি তখনকার মানুষ, কেন যে তা এক প্রকাণ্ড রহস্য! ধরতে গেলে, বিদ্যুৎগতিতে দৌড়েছে যে হরিণ কি মাছ তাদের ছবিতে ধরার চেয়ে, পাথর গাছ কি ফুল যারা স্থির রয়েছে চিরকাল ধরে’, আঁকা দিয়ে তাদেরই ধরা সহজ ছিল, কিন্তু তা হয়নি। গাছ, পালা, পাহাড়, পর্বত, এরা বাদ পড়ে গেল, আর যাদের শব্দ অঙ্গভঙ্গি এই সব আছে—এক কথায় যাদের ভাষা আছে—পুরাতন মানুষের ছবির ভাষা আগে গিয়ে মিল্লো তাদেরই সঙ্গে! এ যেন মানুষের সঙ্গে চারিদিকের যারা এসে কথা কইল তাদেরই পরিচয় আগে লিখ্‌তে বস্‌লো মানুষ; জলকে মানুষ জিজ্ঞাসা কর্‌লে—জল, তুমি কেমন করে চল? জল স্রোতের রেখা ও গতি-ভঙ্গি দিয়ে এঁকে ইঙ্গিত করে’ শব্দ করে’ যেন জানিয়ে দিলে—এমনি করে ঢেউ খেলিয়ে এঁকে বেঁকে চলি। হরিণ, তুমি কেমন করে দৌড়ে যাও?—হরিণ সেটা স্পষ্ট দেখিয়ে গেল। কিন্তু গাছকে পাথরকে শুধিয়ে মানুষ পরিষ্কার সাড়া পেলে না। গাছ, তুমি নড় কেন? এর উত্তর গাছ মর্মর ধ্বনি করে’ দিলে—এই এমনিই নড়ি থেকে থেকে, জানিনে কেন! গাছের কথাই বোঝা গেল না, ছবিতেও তার রূপ ধরলে না মানুষ। পাহাড়, দাঁড়িয়ে কেন? আকাশ দিয়ে মানুষের জিজ্ঞাসার প্রতিধ্বনি ফিরে এল, কেন! ছবির ভাষায় এদের কথা লেখা হলই না, শুধু এদের বোঝাতে মানুষ গাছ বল্‌তে গোটাকতক দাঁড়ি কসি, পাহাড় বল্‌তে একটা ত্রিকোণ-চিহ্ণ দিয়ে গেল কখন কখন কতকটা চীনে অক্ষরের মতো,—রূপাভাষ, কিন্তু পুরো রূপচিত্র নয়। ব্রতধারী মানুষ কামনা ব্যক্ত করবার সময় পুরাকাল থেকে আজ পর্যন্ত যে কথা, ছবি, সুর, নাট্য ইত্যাদি মিশ্রিত ভাষা প্রয়োগ করে চলেছে তার রীতি আমাদের এখনো ধরে থাক্‌তে হয়েছে,—শুধু এক কালের অস্ফুট শিশুভাষ স্ফুটতর হয়ে উঠেছে, পুরাকালের ব্রতধারীর ভাষার সঙ্গে এখনকার ভাষার। যে মানুষ ছবি কথা কিম্বা কিছু দিয়েই এককালে জননী পৃথিবীকে ধারণার মধ্যে আনতে পারেনি, স্ফুট ভাষার সাহায্যে সেই মানুষ আস্তে আস্তে একদিন পৃথিবীকে নিরূপিত করলে—আলপনার পদ্মপত্রের উপরে একটি বুদ্বুদের আকারে; স্তোত্রের উদাত্ত অনুদাত্ত সুরে ধরা পড়লো বসুন্ধরা—’হে বিচিত্র গমনশালিনী পৃথিবী! স্তোতৃবর্গ গমনশীল স্তোত্র দ্বারায় তোমার স্তব করেন।’ জীবন্ত হরিণ যে দ্রুত চলেছে তাকে ব্যক্ত করতে হল যেমন গমনশীল রেখা, তেমনি গমনশীল বাক্য ও সুর বর্ণনা করে চল্লো আকাশে ভ্ৰাম্যমাণা পৃথিবীকে। স্বরবর্ণ ব্যঞ্জনবর্ণ, অকার থেকে ক্ষ ইত্যাদি শব্দ এই মিলিয়ে হল কথিত ভাষা, আর আকার থেকে আরম্ভ করে চন্দ্রাকার ও তার বিন্দুটি পর্যন্ত নানা রেখা বর্ণ ও চিহ্ণ মিলিয়ে হল চিত্র বিচিত্র ছবির ভাষা, এবং হাতপায়ের নানা সংকেত ও ভঙ্গি নিয়ে হল অঙ্কের পর অঙ্ক ধরে’ গতিশীল নাটকের চলতি ভাষা। এই হল ভাষার আদি ত্রিমূর্তি এর পার্শ্ব-দেবতা হল দুটি—‘বাচন’ ও ‘বর্ণন’, এই মূর্তি নিয়ে ভাষা এগোলেন মানুষের কাছে। ঋষি বলেছেন—“হে বৃহস্পতি! বালকেরা সর্ব্বপ্রথম বস্তুর নামমাত্র বাচন করিতে পারে, তাহাই তাহাদিগের ভাষা শিক্ষার প্রথম সোপান—নামরূপ হল গোড়ার পাঠ।” এর পরে এল বন্দনা থেকে আরম্ভ করে বর্ণনা পর্যন্ত, আবৃত্তি থেকে সুরু করে বিবৃতি পর্যন্ত—“বালকদিগের যাহা কিছু উৎকৃষ্ট ও নির্দোষ জ্ঞান হৃদয়ের নিগূঢ় স্থানে সঞ্চিত ছিল তাহা বাগ্দেবীর করুণায় ক্রমে ক্রমে প্রকাশ পাইল।”—ভাষা, বোধোদয় বস্তুপরিচয় ইত্যাদি ছাড়িয়ে অনেকখানি এগোলো। তারপর এলো ভাষার মহিমা সৌন্দৰ্য ইত্যাদি—“যেমন চালনীর দ্বারায় শক্তুকে পরিষ্কার করা হয় সেইভাবে বুদ্ধিমান বুদ্ধিবলে পরিষ্কৃত ভাষা প্রস্তুত করিয়াছেন। (সেই ভাষাকে প্রাপ্ত হইলে পর) যাহাদিগের চক্ষু আছে কর্ণ অাছে এরূপ বন্ধুগণ মনের ভাব প্রকটন বিষয়ে অসাধারণ হইয়া উঠিলেন……সেই ভাষাতে বন্ধুগণ বন্ধুত্ব অর্থাৎ বিস্তর উপকার লাভ করেন,…ঋষিদিগের বচন রচনাতে অতি চমৎকার লক্ষ্মী স্থাপিত আছেন…বুদ্ধিমানগণ যজ্ঞ দ্বারা ভাষার পথ প্রাপ্ত হয়েন…ঋষিদিগের অন্তঃকরণের মধ্যে যে ভাষা সংস্থাপিত ছিল তাহা তাঁহারা প্রাপ্ত হইলেন, সেই ভাষা আহরণপূর্বক তাঁহারা নানাস্থানে বিস্তার করিলেন, সপ্ত ছন্দ সেই ভাষাতেই স্তব করে…।” বিশ্বরাজ্যের প্রকট রূপ রস শব্দ গন্ধ স্পর্শ সমস্তই পাচ্ছিল মানুষ ভাষাকে পাবার আগে থেকে, কিন্তু মনের মধ্যে তবুও মানুষের একটা বেদনা জাগছিল—মনের কথাকে খুলে বলবার বেদনা, মানসকে সুন্দররূপে প্রকট করার বাসনা, সুপরিষ্কৃত ভাষাকে পাবার জন্যে বেদনা মনে জাগছিল। মানুষের সব চেয়ে যে প্রাচীন ভাষা তাই দিয়ে রচা বেদ এই বেদনের সুরে ছত্ৰে ছত্রে পদে পদে ভরা দেখি; “আমার কর্ণ, আমার হৃদয় আমার চক্ষুর্নিহিত জ্যোতি সমস্তই তোমাকে নিরূপণ করিতে অবগত হইতে ধাবিত হইতেছে…দূরস্থবিষয়ক চিন্তাব্যাপৃত আমার হৃদয় ধাবিত হইতেছে…আমি এই বৈশ্বানর স্বরূপকে কিরূপে বর্ণন করি কিরূপই বা হৃদয়ে ধারণ করি!” কিম্বা যেমন—“কিরূপ সুন্দর স্তুতি ইন্দ্রকে আমাদের অভিমুখে আনয়ন করিবে।” হৃদয়ের বেদনার অন্ত নেই, দেখতে চেয়ে শুন্‌তে চেয়ে প্রাণ ব্যথিত হচ্ছে, ধাবিত হচ্ছে। অতি মহৎ জিজ্ঞাসার উত্তর পাচ্ছে মানুষ অতি বৃহৎ পরম সুন্দর, কিন্তু তার প্রত্যুত্তরের মতো মহাসুন্দর ভাষা খুঁজে পাচ্ছে না!—“যজ্ঞের সময় দেবতারা আমাদিগের স্তব শুনিয়া থাকেন, সেই বিশ্বদেবতাসকলের মধ্যে কাহার স্তব কি উপায়ে উত্তমরূপে রচনা করি!” মনের নিবেদন সুন্দর করে উত্তম করে জানাবার জন্য বেদনা আর প্রার্থনা। কোন রকমে খবরটা বাৎলে দিয়ে খুসি হচ্ছে না মানুষের মন, সুন্দর উপায় সকল উত্তম উত্তম সুর সার কথা গাথা ইঙ্গিতাদি খুঁজছে মানুষ এবং তারি জন্যে সাধ্য সাধনা চলেছে—“হে বৃহস্পতি! আমাদিগের মুখে এমন একটি উজ্জ্বল স্তব তুলিয়া দাও, যাহা অস্পষ্টতাদোষে দূষিত না হয় এবং উত্তমরূপে স্ফূরিত হয়।” ছবি দিয়ে যে কিছু রচনা করতে চায় সেও এই প্রার্থনাই করে—রং রেখা ভাব লাবণ্য অভিপ্রায় সমস্তই যেন উজ্জ্বল এবং সুন্দর হয়ে ফোটে। ধরিত্রীকে বর্ণন করতে ঋষি গতিশীল স্তোত্র আর ভাষা চাইলেন। ভাষার পথে গতি পৌঁছয় কোথা থেকে? মানুষের মনের গতির সঙ্গে ভাষাও বদলে যাচ্ছে দেখতে পাচ্ছি—বাঙ্গলার পক্ষে সংস্কৃতমূলক সাধুভাষা হল অচল ভাষা, কেননা সে শব্দকোষ ব্যাকরণ ইত্যাদির মধ্যে একেবারে বাঁধা, মনের চেয়ে পুঁথির সঙ্গে তার যোগ বেশি! বাঙ্গালীর মন বাঙ্গলায় জুড়ে আছে, সুতরাং চলতি বাঙ্গলা চলেছে ও চলবে চিরকাল বাঙ্গালীর মনের গতির সঙ্গে নানা দিক থেকে নানা জিনিষে যুক্ত হতে হতে, ঠিক জলের ধারা যেমন চলে দেশ বিদেশের মধ্যে দিয়ে। ছবির দিক দিয়েও এই বাঙ্গলার একটা চলতি ভাষা সৃষ্ট হয়ে ওঠা চাই, না হলে কোন্ কালের অজন্তার ছবির ভাষায় কি মোগলের ভাষায় অথবা খালি বিদেশের ভাষায় আটকে থাকা চলবে না। ঋষিরা ভাষাকে বৃষ্টিধারার সঙ্গে তুলনা করেছেন—“হে ইন্দ্র, হে অগ্নি! মেঘ হইতে বৃষ্টির ন্যায় এই স্তোতা হইতে প্রধান স্তুতি উৎপন্ন হইল।” বৃষ্টির জল ঝরণা দিয়ে নদী হয়ে বহমান হল, তবেই সে কাজের হল, আর জল আঁট হয়ে হিমালয়ের চূড়োয় বসে রইলো—গল্লোও না চল্লোও না, গলালেও না চালালেও না, জলের থাকা না থাকা সমান হল। বাঁধা বস্তুর বা styleএর মধ্যে এক এক সময়ে একটা একটা ভাষা ধরা পড়ে যায়। কথিত ভাষা চিত্রিত বা ইঙ্গিত করার ভাষা সবারি এই গতিক! যেমনি style বেঁধে গেলো অমনি সেটা জনে জনে কালে কালে একই ভাবে বর্তমান রয়ে গেল—নদী যেন বাঁধা পড়লো নিজের টেনে আনা বালির বাঁধে! নতুন কবি নতুন আর্টিষ্ট এঁরা এসে নিজের মনের গতি ভাষার স্রোতে যখন মিলিয়ে দেন তখন style উল্টে পাল্টে ভাষা আবার চলতি রাস্তায় চলতে থাকে। এ যদি না হতো তবে বেদের ভাষাই এখনো বলতেম, অজন্তার বা মোগলের ছবি এখনো লিখতেম এবং যাত্রা করেই বসে থাকতেম সবাই! ভাষা সকল গোলক ধাঁধার মধ্যেই ঘুরে বেড়াতো অথচ দেখে মনে হতো ভাষা যেন কতই চলেছে!
অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর
শিল্পশাস্ত্রের ক্রিয়াকাণ্ড অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর শিল্পশাস্ত্রের ক্রিয়াকাণ্ড মানব-শিল্পের শৈশবটা কাটলো মানুষের ঘরের এবং বাইরের খুব দরকারী কায করতে। পাথর ঘসে’ তীরের ফলা তৈরি করা, হাঁড়িকুঁড়ি গড়া, কাপড় বোনা, হাড়ের মালা গাঁথা, লোহার বালা গড়া, শীতের কম্বল বসবার আসন—এমনি নানা জিনিষের উপরে শিল্পের ছাপ পড়লো। নানা জিনিষ প্রস্তুতের নানা প্রক্রিয়া আস্তে আস্তে দখল হয় মানুষের। মানুষ সভ্যতার দিকে যখন এগোলো তখন কতক শিল্পকলা রইলো ধর্মের সঙ্গে জড়িয়ে, কতক রইলো রাজসভার সঙ্গে জড়িয়ে। প্রধানতঃ এই দুই রাস্তা ধরে শিল্পের ক্রিয়াকাণ্ড চল্লো সব দেশেই। পূজোর জন্য যে সব মন্দির প্রতিমা ইত্যাদি তাদের প্রস্তুত করার নানা প্রকরণ এবং প্রাসাদ নির্মাণ, হাট বসানো, কূয়ো খোঁড়া ইত্যাদির নানা কথা সংগ্রহ হয়ে পণ্ডিতদের দ্বারা শিল্পশাস্ত্রে ধরা হ’ল, নানা শিল্প বিষয়ে নানা কথা নানা অধ্যায়ে বিভক্ত হয়ে শাস্ত্রের মধ্যগত রইলো—এই হ’ল শিল্পশাস্ত্রের গঠনের মোটামুটি হিসেব। তারপর ধর্ম অর্থ কাম মোক্ষ এই চার শাস্ত্রের মধ্যে মধ্যে আনুষঙ্গিকভাবে নানা শিল্পকলার কথাও বলা হ’ল এবং আংশিকভাবে নানা পুরাণেও প্রসঙ্গক্রমে শিল্পের এবং নানা কলাবিদ্যার কথা লেখা রইলো। শিল্পশাস্ত্রের মূল গ্রন্থ সব যা ছিল বলেই শুনি, সেই সব প্রাচীন শাস্ত্রের সারসংগ্রহ বলে’ যে সব পুঁথি নানা কালে এ-দেবতা ও-ঋষি বা অমুক তমুকের কথিত বলে’ লেখা হ’ল—রাজরাজড়ার পুস্তকাগারে ধরার জন্য সেইগুলোই কতক কতক এখন পাওয়া যাচ্ছে। তা থেকে দেখা যায় যে, ধর্মের সেবায় শিল্পের যে সব দিক জড়িয়ে ছিল তারি বিস্তারিত বিবরণ লিপিবদ্ধ হ’ল কিন্তু অন্যান্য কলা যা সৌখিন রাজরাজড়ার সেবায় লাগতো তাদের বিস্তারিত বিবরণ লেখাই গেল না। পূজার প্রতিমা কেমন করে’ করতে হবে তার ঠিকঠাক নিয়ম লক্ষণ সমস্তই পাই, কিন্তু কাপড়-চোপড় নানা গন্ধতৈল নানা মূল্যবান তৈজসপত্র এদের প্রস্তুতের প্রকরণ শিল্পশাস্ত্রে দেখি ক্বচিৎ ধরা হ’ল। এ ধরণের সামগ্রীর মধ্যে এক বজ্রপ্রলেপের কথা লেখা আছে দেখি সব শিল্পশাস্ত্রে, কিন্তু বজ্রমণির বেলায় তার ধারণের কি গুণাগুণ তার বর্ণ ও মূল্যাদির হিসেব হ’ল ধরা কিন্তু বজ্রমণিটা বিদ্ধ করা যায় কি প্রক্রিয়ায় এবং কত রকম গহনা হয়, কত নাম তাদের,— এ সব কিছু নেই শিল্পশাস্ত্রের মধ্যে। প্রতিমা-লক্ষণ, প্রাসাদ-নিৰ্মাণ, কূপ-খনন, ইত্যাদি ইত্যাদি নানা কথা শিল্পশাস্ত্রে যেমন নানা অধ্যায়ে ভাগ করে লেখা রইলো, তেমন করে ভূষণ-শিল্প যেটা একটা খুব বড় art প্রাচ্য জগতের— তার হিসেব ধরা দরকারী বোধ হল না। এই যে সমস্ত সৌখিন শিল্প, তার উদ্ভাবনা ও গঠনের প্রক্রিয়া সমস্ত শিল্পীদের ঘরে অলিখিত অবস্থায় পিতা থেকে পুত্রে অর্সাতে চল্লো। এই সব বিচিত্র শিল্পের নানা আদর্শ বর্তমান রইলো কিন্তু তাদের প্রস্তুত করণের প্রক্রিয়া সমস্ত কত যে লোপ পেয়ে গেল তার ঠিক নেই। এই কারণে বলতেই হয় আমাদের শিল্পশাস্ত্র, শিল্পশাস্ত্র বলতে যা বোঝায় তা নয়, তাতে অঙ্গবিদ্যা হিসেবে আংশিকভাবে প্রসঙ্গক্রমে কোন কোন কলাবিদ্যার কথা বলা হয়েছে, ভারতশিল্পের প্রায় সাড়ে পনেরো আনা অংশের কথাই পাড়া হয়নি তাতে। এখন ধর্মের সঙ্গে শিল্পের আগেকার যোগ বিচ্ছিন্ন হতেই চল্লো, শিল্পের যে অনাদৃত দিক বিচিত্র দিক যা নিয়ে মানুষের জীবনযাত্রা সুন্দর হয়ে উঠলো মধুময় হয়ে উঠলো সেই দিকে মানুষের নজর পড়লো; ঘরের শিল্প আবার ঘরেই ফিরেছে পরের কাজ চুকিয়ে। শিল্পকে ধর্মের সঙ্গে জড়িয়ে না দেখে’ শিল্পের দিক দিয়ে দেখা খুব অল্প দিন হ’ল ইউরোপে চলিত হয়েছে। প্রাচীনকালেও ভারতবর্ষে এই ভাবে শিল্পরসের দিক দিয়ে কলা সমস্তকে দেখা আলিঙ্কারিকগণ প্রচলিত করে গেছেন। শুধু কাব্যকলার সঙ্গে জড়িয়ে রাখলে অলঙ্কারশাস্ত্র রস-শাস্ত্র ইত্যাদি খুব কাজে আসবে না, অলঙ্কার-শাস্ত্রের বিচারপ্রণালী ধরে শিল্পবিদ্যা বুঝতে চল্লে ঢের বেশী ফল পাব আমরা। শিল্পের পুরাতত্ত্ব হিসেবে শিল্পশাস্ত্র কাযে লাগবে, প্রাচীনের সঙ্গে শিল্পশাস্ত্রের দিক দিয়ে এখনকার শিল্পীদের আংশিকভাবে যোগ ছাড়া বেশী কিছু হবে না; আমরা হাজার বছর আগে কত বড় শিল্পী ছিলেম এই ভাবের একটা ভূয়ো গর্বও লাভ হ’তে পারে—কিন্তু সে শুধু পড়ে যাওয়া বিদ্যা হবে শিল্পবোধ তাতে হবে না। রসের ও ভাবের প্রক্রিয়া ধরে’ কবিতা ছবি মূর্তি এমন কি খেলনাটারও পরিচয় হ’ল ঠিক পরিচয়। বিদেশীয় রসিকেরা এই পথে কায করে চলেছেন অনেকেই।  শিল্পী ও শিল্পরসিক কেমন করে’ হয় তা ঠিক করে বলা কঠিন। হঠাৎ দেখি কেউ রস পেয়ে গেলো কেউ বা সারা বছর অলঙ্কার-শাস্ত্র পড়ে’ পড়ে চোখই ক্ষরিয়ে ফেল্লে। কবি কেমন করে’ হয় কাব্য-প্রকাশে লেখা আছে দু’চরণ শ্লোকে। কলাশাস্ত্রের গোড়ায় ঠিক এই কথা লেখা হ’লে মানায়—প’ড়ে পাই বিদ্যা, না পড়ে’ পাই কলা-বিদ্যা। কিন্তু না পড়ে’ পেলেও কলাবিদ্যাকে পড়ে পাওয়া শক্ত। হাতে কলমে কাজ করা হ’ল শিল্পের নানা প্রকরণ, সহজে দখল করার সহজ উপায়। রং রেখা এদের টেনে দেখলে এদের রহস্য সহজ হয়ে আসে। পড়ার দ্বারা নয় ক্রিয়ার দ্বারা শিল্পকর্মে দক্ষতা হয় যদি এই কথাই হ’ল তবে এমন অনেক মানুষ রয়েছে যারা পড়াশুনো করছে না অথচ artistও হয়ে উঠছে না। তারা কেউ চাষা হচ্ছে কেউ দোকানি-পসারি মুটে-মজুর হচ্ছে। অবশ্য এদের অনেকের কাজই শিল্পশাস্ত্রের চৌষট্টি কলার কোনটা না কোনটার মধ্যে পড়ে’ যায়, কিন্তু হ’লে কি হয়! আমরা নিজেদের সব দিক দিয়ে যতই cultured বোধ করি না কেন চাষাকে artist ভাবা মজুরকে artist বলা শক্ত হয়েছে; যারা গাধাবোট টেনেই চলেছে তাদের কেউ এখন artist বলে না কিন্তু যে ছেলেরা বাচ খেলায় মজবুত হল তাদের বলি artist! অাজকে আমাদের পক্ষে “philosopher জ্ঞানী লোক, cultivator চাষা”, এবং artist তারাই যারা নিত্য জীবনযাত্রার থেকে স্বতন্ত্র অতিরিক্ত কিছু নিয়ে রয়েছে। আগে কিন্তু এ ভাবটা ছিল না, তখন সহরের লোক দেখি চোরের সিঁদ কাটার নানা কায়দা দেখে পুলিশ ডাকার কথা ভুলে ফুটো দেওয়ালের সামনে দাঁড়িয়ে কেমন সিঁদটা কাটা হয়েছে এই নিয়ে art lecture আরম্ভ করে’ দিয়েছে। হয়তে বা চোর সে নিজের কাটা সিঁদের বাহার দেখে’ খুসিতে রয়েছে এমন সময় পুলিশ এসে গ্রেপ্তার করলে artistকে। বর্ষাকালে দেখি ক্ষেতের দিকে চেয়ে চাষার গান চল্লো– “গগন ঘটা ঘহরাণী সধো গগন ঘটা ঘহরাণী পূরব দিস্সে উঠিহৈ বদরিয়া রিম ঝিম বরষত পানী। আপন আপন মেড়ঁ সম্হারো বহ্যো জাত য়হ পানী সুরত নিরত কা বেল নহায়ন করৈ খেত নির্ব্বাণী।” —কবীর ঘনঘটা ঘনিয়ে এল পূবে বাদল উঠলো রিমঝিম বরিষ নামলো, সামাল ভাই ক্ষেতের আল, ঐ যে জল বয়ে চল্লো। দুটি লতা—অনুরাগের বিরাগের—তাদের আজ এই রসের বৃষ্টিধারায় ভিজিয়ে নাও, এমন ক্ষেত লাগাও যেখানে অবাধ মুক্তির ফসল ফলে, ক্ষেতের ফসল কেটে ঘরে তুলতে পারে, তাকেই তো বলি কুশল কিষাণ। সেকালে তাঁরা art কিসে নেই বা কিসে আছে এটা সুনিশ্চিত করে দিতে অথবা নানা রকম কলাবিদ্যার সংখ্যা নির্ধারণ করে’ চৌষট্টির মধ্যেই artকে ধরে রাখতে চান নি; এই জন্যই শাস্ত্রে বলা হ’ল: “বিদ্যা হ্যনন্তাশ্চ কলাঃ সংখ্যাতুং নৈব শক্যতে। বিদ্যা মুখ্যাশ্চ দ্বাত্রিংশচ্চতুঃষষ্টিঃ কলাঃ স্মৃতাঃ॥” (শুক্রনীতিসার) এইভাবে বিদ্যা এবং কলা দুয়ের প্রভেদটা মাত্র মোটামুটি রকমে শাস্ত্রে ধরা হ’ল: “যদ্‌যত্‌ স্যাদ্‌ বাচিকং সম্যক্ কর্ম্মবিদ্যাভিসংজ্ঞকম্। শক্তো মূকোপি যৎ কর্ত্তুং কলাসংজ্ঞন্তু তৎস্মৃতম্॥” (শুক্রনীতিসার) আমরা এখন artকে fine, industrial—নানাভাগে ভাগ করে’ নিয়েছি। আগেও এই রকম ভাগ ছিল শিল্পে—কর্মাশ্রয়া দ্যুতাশ্রয়া উপচারিকা ইত্যাদি হিসেব। সেকালের চৌষট্টি কলার ফর্দটার মধ্যে যাকে বলি fine art, যাকে বলি industrial art এবং যাকে বলি science, সবই এক কোঠায় রাখা গেছে। সেকালের হিসেবে ধরলে আজকালের Football, Billiards ইত্যাদি খেলা artএর মধ্যে এসে পড়ে; সন্তান-পালন একটা artএর মধ্যে ছিল আগে, এখন ওটা আমরা Medical scienceএর মধ্যে ফেলে দিয়েছি। এমন কি ছেলেদের খেলার পুতুল গড়া ও কেষ্টনগরের পুতুল গড়া এবং গড়ের মাঠের ধাতুমূর্তি গড়া—তিনটেকে সম্পূর্ণ আলাদা জাতের শিল্প বলে ধরে নিয়েছি। মানুষের উন্নত ও সুন্দর এবং সুকুমার বৃত্তিসমূহ যে শিল্পকাযের দ্বারা উদ্বুদ্ধ হয় তাকে বলি fine art, মানুষের প্রতিদিনের জীবনের নানা সাজ সরঞ্জাম যাতে করে’ শুধু কাযের নয় সঙ্গে সঙ্গে সুদর্শন হয়ে ওঠে তাকে বলি industrial art; এমনি artএর মোটমাট জাতিবিভাগ সৃষ্টি হয়ে গেছে মানুষের নিজের মধ্যে সমাজ-বন্ধনের সময়ে নানা বর্ণ-বিভাগের প্রথায়; artistদের কাছে কিন্তু এ রকম একটা বিভাগ নিয়ে artএর উপভোগের তারতম্য ধরা একেবারেই নেই, সেখানে art এক কোঠায় না art অন্য কোঠায়, ইতর বিশেষ, মাঝামাঝি, চলনসই—এ সব কথা নেই, art কি art নয় এই বিচার। শিল্পশাস্ত্র আমাদের যা রয়েছে তাতে ভাস্কর্যের একটা দিক, স্থাপত্যের খানিকটা—যেটা পূজন ও যজন-যাজনের সঙ্গে জোড়া, তারি উপরে বিশেষভাবে মতামতের জোর দেওয়া হয়েছে দেখা যায়। তা ছাড়া এটাও দেখি যে শিল্পশাস্ত্রের সংগ্ৰহকার্যে ভারি একটা ত্বরা রয়েছে— কোন রকমে একটা প্রাচীনত্বের ছাপ মেরে জিনিষটাকে সাধারণে প্রচার করার ত্বরা–একটা ধর্মবিপ্লবে এবং সেই সময়ের ত্বরা—শিল্পকে নিয়ে টানাটানি এ সবই লক্ষ্য করি শিল্পশাস্ত্রের সংগ্রহের ধরণ থেকে। Artএর মধ্যে একটা অনির্বচনীয়তা আছে যেটা artistএর অনুভূতির বিষয় এবং অসাধারণ বলেই artএর অনির্বচনীয় রস যে কি ব্যাপার তা সবাইকে বুঝিয়ে ওঠা কঠিন। রস পেলে তো পেলে, না পেলে তো পেলে না, এসব কথা শিল্পশাস্ত্রকার বিচার করবার সময় পাননি, এসব চিন্ত আলঙ্কারিকদের, রসের দিক দিয়ে তার বিচার করে দেখেন যে সেদিক দিয়ে এতটুকু বা এত বড় নেই সরস বা নীরস নিয়ে কথা। মাটির খেলনা সরস হ’ল তো মগধের নাড়ুর চেয়ে বড় জিনিষ হ’ল এবং মগধ উড়িষ্যা সব শিল্পের বড় বড় ব্রহ্মা বিষ্ণু মহেশ ও গণেশের সমতুল্য হয়ে উঠলো একটি সুন্দর আরতিপ্রদীপ। আর্টের জগৎ শিল্প কি শিল্প নয় এই নিয়ে,- উচ্চনীচ ভালমন্দ ভেদাভেদ, দেবতা কি মানুষ কি বানর এ নিয়ে দেখা নয়,—art কি art নয় এই নিয়ে সব জিনিষকে পরীক্ষা করা হ’ল অকাট্য নিয়ম। Art for art এই কথাই হ’ল artistএর, art ধর্মের জন্য কি জাতীয় গৌরবের ধ্বজা সাজাবার জন্য কি natureএর সম্মুখে mirror ধরার জন্য অথবা বিপশ্চিতাম মতম্‌-কে বলবৎ রাখার জন্য, এ তর্ক আর্টের জগতে উঠতেই পারে না। Artist যে উদ্দেশ্যেই কায করুক artএর দিকে চেয়ে করাই হ’ল তার প্রধান কায। ময়ূর নিজের আনন্দে তার চিত্র-বিচিত্র কলাপ বিস্তার করে, বাগানের শোভা কি বনের শোভা কি খাঁচার শোভা তাতে হ’ল কি না হ’ল ময়ূরের মনে একথা উদয়ও হ’ল না; এতটা স্বাধীনতা মানুষ শিল্পে চায় কিন্তু পেলে কই?—ধৰ্ম বল্লে তুমি আমার কাজে লাগো, দেশ বল্লে আমার, এমনি নানাদিক দিয়ে শিকল পড়ে গেল শিল্পের হাতে পায়ে, তারপর একদিন চিরকালের ছাড়া পাখী তার মনিবের পোষ মানলে, ইসারাতে পুচ্ছ ওঠালে নামালে যে শুধু তাই নয়, জলযন্ত্র ঘোরালে ঘটিযন্ত্র চালালে কামান দাগলে নিয়ম মতো! “অপি শ্রেয়স্করং নৃণাম্‌ দেববিম্বমলক্ষণম্। সলক্ষণং মর্ত্ত্যবিম্বম্ নহি শ্রেয়স্করং সদা।।” এই হুকুমে এককালে আমাদের শিল্পীরা বাঁধা পড়ে’ ছিল। পুঁথিকার দেবতা সমস্তের ধ্যান দিলে শিল্পে, সেই ধ্যান মতো গড়ে চল্লো— এই ঘটনাই যদি পুরোপুরি ঘটতো তবে আমাদের art কেবলমাত্র ধ্যানমালার illustration হয়ে যেতো কিন্তু এর চেয়ে যে বড় জিনিষ হয়ে উঠলো বুদ্ধ নটরাজ প্রভৃতি নানা দেবমূর্তি সেটা ধ্যানমালার লিখিত ধ্যানের অতিরিক্ত এবং শিল্পশাস্ত্রের মান-পরিমাণ লক্ষণাদির বাঁধা নিয়মের থেকে স্বতন্ত্র আর কিছু নিয়ে। প্রাচীন দেবমূর্তিগুলি আমাদের বাঙলার কার্তিকের মতো সম্পূর্ণ কাপ্তেনবাবু বা কলে কাটাছাঁটা মরা জিনিষ হয়ে পড়েনি শুধু শিল্পের শিল্প-ক্রিয়৷ তাদের অমরত্ব দিলে বলে’ এবং শুধু সেইটুকুর জন্য artএর জগতে এইসব দেবতার স্থান হ’ল। শাস্ত্র বল্লে শিল্পকে ঘাড়ে ধরে’, দেবলোকটাই অাছে তোমার কাছে, মর্ত্যলোক নেই, যদি বা থাকে তো সেদিকে দৃক্পা‌ত করবে না— তা হ’লে অন্ধ হবে । কিন্তু artist এর পথ স্বতন্ত্র কেননা art সে অনন্যপরতন্ত্রা, শিল্পীর কাছে দেবলোকের স্বপ্ন সেও যেমন প্রত্যক্ষ ও সুন্দর, মর্ত্যলোকের ছবি সেও তেমনি অভাবনীয় সুন্দর ও প্রত্যক্ষ ব্যাপার, দুটোই তুল্য-মূল্য, যদি art হ’ল এবং রসের স্বাদ দিলে। শাস্ত্রী চাইলেন মর্ত্যকে ছেড়ে শাস্ত্রীয় স্বর্গ, ইহলোককে মুছে দিয়ে পুঁথির পরলোক। কিন্তু শিল্পীর শিল্পবৃত্তি তাকে অন্য পথ দেখালে; মর্ত্যলোকের মাটির দেহে সবখানি সুন্দর হতে সুন্দরতর হয়ে উঠল, শাস্ত্র যে সৃষ্টিছাড়া কাণ্ড চেয়েছিল তা হতেই পারলে না, অনেকখানি সৃষ্টিরহস্য শিল্পীর মনে ক্রিয়া করে’ পাগলামির অনাসৃষ্টি থেকে বাঁচিয়ে দিলে এ দেশের প্রতিমা-শিল্পকে। শিল্পশাস্ত্রের দেবলোক ও তার অধিবাসী তাঁরা একেবারেই তেত্রিশ কোটি গণ্ডীর মধ্যে ঘেরা, নিখুত মান-পরিমাণ লক্ষণ দিয়ে সম্পূর্ণভাবে বাঁধা শাস্ত্রীয় দেবলোক ও দেবতা হওয়া ছাড়া সেখানে উপায় নেই, শিল্পীর মনের দেবতা এবং শাস্ত্রের দেবলোকের সঙ্গে শিল্পীর শিল্পলোকের কল্পনায় তফাৎ থাকতে পারে এই ভয় করেই শাস্ত্রকার কসে’ বেঁধেছেন আপনার নিয়ম জায়গায় জায়গায়—নান্যেন মার্গেণ প্রত্যক্ষেণাপি বা খলু; পূজার জন্য যে প্রতিমা তা শাস্ত্রমতো না গড়লে তো চলে না সুতরাং শিল্পীর ওপরে কড়া হুকুম জারি করতেই হল নানা ভয় দিয়ে—“হীনাঙ্গী স্বামিনং হন্তি হ্যধিকাঙ্গীচ শিল্পিনম্।” এক চুল এদিক ওদিক হ’লে একেবারে মৃত্যুদণ্ড; বেতের ভয় নয়—“কৃশা দুভিক্ষদা নিত্যং স্থূলা রোগপ্রদা সদা”, অন্ধতা বংশলোপ ইত্যাদি নানা ভয় দিয়ে শিল্পীকে ও শাস্ত্রীয় মূর্তিকে কঠিন নিয়মে বাঁধার চেষ্টা হ’ল, কিন্তু এতে যে কাজ ঠিক চল্লো তা নয়, এদিক ওদিক হতেই থাকলো মাপজোখ ইত্যাদিতে, শিল্পী মানুষ তো কল নয়, সে ক্রিয়াশীল ক্রীড়াশীল দুইই, সুতরাং একটু ঢিলে দিতে হল নিয়মের কসনে। “লেখ্যা লেপ্যা সৈকতী চ মৃণ্ময়ী পৈষ্টিকী তথা। এতাসাং লক্ষণাভাবে ন কশ্চিৎ দোষ ঈরিতঃ॥ বাণলিঙ্গে স্বয়ম্ভূতে চন্দ্রকান্তসমুদ্ভবে। রত্নজে গণ্ডকোদ্ভূতে মানদোষো ন সৰ্ব্বথা॥” ছবি modelling, plaster cast এমনি অনেক জিনিষ এবং স্ফটিক ও নানা রত্নভূষা এবং ছোটখাটো শিল্পদ্রব্য সমস্তই বাঁধনের বাইরে পড়লে, কেবল পাষাণ ও ধাতুজ পূজার জন্য যে মূর্তি তাই রইলো শাস্ত্রের মধ্যে বাঁধা কিন্তু এখানেও গোল বাধলো ঠিক ঠিক শাস্ত্রমতো গড়ন কে জানে কেন শিল্পীর হাতে এল না, এদিক ওদিক হতেই থাকলো কিছু কিছু—দেশভেদে কালভেদে শিল্পীর কল্পনাভেদে পূজকের অন্তর্দৃষ্টিভেদে, তখন সম্পূর্ণ ছাড়পত্র দেওয়া হ’ল— “প্রতিমায়াশ্চ যে দোষা হ্যর্চকস্য তপোবলাৎ। সৰ্ব্বত্রেশ্বরচিত্তস্য নাশং যান্তি ক্ষণাৎ কিল॥” এই ফাঁক পেয়ে দেশের শিল্প হাঁফ ছেড়ে বাঁচলো, বিচিত্র হয়ে উঠলো মন্দিরে মঠে। সেকালে শাস্ত্রের নিয়মমতো গড়ার যে সব ব্যাঘাত পরে পরে এসেছিল, একালেও যদি শিল্পশাস্ত্রের অনুশাসনে আমরা শিল্পীদের বাঁধতে চলি তবে ঠিক সেকালের ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি হবেই হবে। অনেকে বলেন ইতিহাসের না হয় পুনরাবৃত্তি হ’লই, তাতে করে যদি তখনকার art ফিরে পাই তো মন্দ কি! এ হবার জো নেই, যা গেছে তা আর ফেরে না; তার নকল হ’তে পারে, ছোট ছেলে ঠাকুরদাদার হুবহু নকল দেখিয়ে চল্লে যেমন হাস্যকর অশোভন ব্যাপার হয় তাই হবে, গোলদীঘির অজন্তা বিহার হবে, গড়ের মাঠের খেলনা তাজমহল হবে। কুঁড়ে ঘর আর বদলালো না কেননা সে এমন সুন্দর করে সৃষ্টি করা যে তখনো যেমন এখনো তেমনি তাতে স্বচ্ছন্দে বাস চল্লো। কিন্তু সেকালের প্রাসাদে একালে আমাদের বাস অসম্ভব, আলো বাতাস বিনা হাঁপিয়ে মারা যাবো পাথর চাপা পড়ে’। পুরাকালে আমাদের যাঁরা শিল্প ও শিল্পরসিক ছিলেন তাঁরা ক্ষুদ্রচেতা ছিলেন না। তাঁরা নিয়ম করতেন নিয়ম ভাঙ্তে‌ন তাঁদের মধ্যে শিল্পী ও শিল্প দুই ছিল, কাযেই তাঁদের ভয় ছিল না। এখন আমাদের সেই সেকালের কোন কিছুতে একটু আধটুও অদল বদল করতে ভয় হয় কেননা নিজের বলে আমাদের কিছুই নেই, সেকালের উপরে আগাছার মতে আমরা ঝুলছি মাত্র, সেকালই আমাদের সর্বস্ব! কিন্তু পৃথিবীর ইতিহাসে এক আফ্রিকার মূর্তিশিল্প যেমন ছিল তেমনি নিষ্ক্রিয় অবস্থাতেই আছে, সেকালকে সে ছাড়াতে একেবারেই পারেনি। সেকাল ছেড়ে কোন শিল্প নেই এটা ঠিক, কিন্তু একাল ছেড়েও কোন শিল্প থাকতে পারে না বেঁচে এটা একেবারেই ঠিক। গাছের আগায় নতুন মুকুল গাছের গোড়ায় অতীতের অন্ধকারে তার প্রথম বীজটর সঙ্গে যে ভাবে যুক্ত রয়েছে সেভাবে থাকাই হ’ল ঠিক ভাবে থাকা; আমের নতুন মঞ্জরীর সঙ্গে পুরাতন বীজটার চেহারার সাদৃশ্য মোটেই নেই কিন্তু মঞ্জরীর গর্ভে লুকানো রয়েছে সেই পুরাতন বীজ যার মধ্যে সেই একই ক্রিয়া একই শক্তি ধরা রয়েছে নতুন আবহাওয়াতেও যেটা ঠিকঠাক আম গাছই প্রসব করবে বৰ্ত্তমানকালে; এই স্বাভাবিক গতি ধরে’ চলেছে শিল্প, এর উল্টো পাল্টা হবার জো নেই। আমাদের দেশের শিল্পমূর্তিকে যে কারণেই হোক এই স্বাভাবিক গতি থেকে বঞ্চিত করে দেওয়া হ’ল এক সময়ে, দেবমূর্তির বাহুল্যের চাপন পেয়ে কিছুদিন গাছ আমাদের মনোমত পথ ধরে’ প্রায় কল্পতরু হবার জোগাড় করলে কিন্তু কালের নিয়মে হঠাৎ পশ্চিমের হাওয়া বইলো চাপন পাথর একটুখানি নড়ে’ গেল, অমনি গাছ আবার স্বাভাবিক রাস্তা ধরে’ মন্দিরের ছাদ তুলসীমঞ্চের গাঁথনি ফাটিয়ে নানাদিকে আলো বাতাস চেয়ে গতিবিধি সুরু করলে, পশ্চিমে ঝুঁকলো কতক ডাল, পূবে বাড়লো কতক ডাল, এইভাবে আলো বাতাসের গতি ধরে’ বেড়ে চল্লো গাছ। শুধু ভারতবর্ষ নয়, সব দেশ এই ভাবে শিল্পের দিকে বেড়ে চলেছে। মঞ্চে বাঁধা গাছ দেখতে মন্দ নয় কিন্তু দিকে বিদিকে নানা শাখা-প্রশাখা বিস্তার করে’ আছে যে বনস্পতি তার মতো সে শক্তিমানও নয় ছায়াশীলও নয় সুন্দরও নয়। আমাদের প্রাচীন শিল্প ও শাস্ত্র সমস্তই বোধিবৃক্ষের কলমের চারার সঙ্গে সোনার গামলায় নীত হয়েছিল দেশ থেকে বিদেশে, কিন্তু সেই সব যবন-দেশের হাওয়া আলো নিয়ে তাদের বেড়ে উঠতে অনেকখানি স্বাধীনতা দেওয়া হয়েছিল, ভিক্ষু শিল্পীদের দ্বারা তাদের সহজগতি ব্যাহত হয়নি; তবেই তো এককালের ভারতীয় উপনিবেশের অভারতীয় অন্তরের মধ্যে চলে গিয়েছিল ভারতীয় ভাব ও রস। ভারত শিল্প যদি কেবলি টবের গাছ হ’ত তো কোন কালে সেটা মরে যেত ঠিক নেই, খালি টব থাকতো আর তাতে সিঁদূর দিয়ে পুজো লাগাতো দেখতেম আজও পুত্র-কামনায় নিষ্ক্রিয়দেশের শিল্পহীন অপুত্ৰক হতভাগারা। সেকালের শাস্ত্রমতে ক্রিয়া করে’ চল্লে এখনো আমরা সেকালের মতোই সবদিকে বিস্তার লাভ করতে পারি, কিন্তু একালকে বাদ দিয়ে ক্রিয়া করা চলবে না কেননা বর্তমানকাল এবং বর্তমানের উপযোগী অনুপযোগী ক্রিয়া বলে’ কতকগুলো পদার্থ রয়েছে যে গুলোকে মেনে চলতেই হবে আমাদের, না হ’লে সেকালটা ভূতের উপদ্রব ছাড়া আর কিছুই দেবে না আমাদের এবং তাবৎ শিল্পজগতের অধিবাসীকে। দাশরথি রায়ের পাঁচালী আমরা অনেকেই পড়ি কতক কতক ভালও লাগে কিন্তু পাঁচালীর ছাঁদে যদি কবিতা ঢালাই করার কড়া আইন করে’ দেওয়া যায় হঠাৎ তবে বর্তমানের কোন কবি তাতে ঘাড় পাতবে না, কিম্বা আমি যদি আজ বলি আমার ছাঁদেই বাংলার চিত্রকর যারা এসেছে ও আসছে তাদের ছবি লিখতে হবে এবং গভর্ণমেণ্টের সাহায্যে এটা হঠাৎ একটা আইনে পরিণত করে নিই তবে কেউ সেটা মানবে না, উল্টে বরং শিল্পীর স্বাধীনতায় বিষম ব্যাঘাত দেওয়া হ’ল বলে’ আমাকে শুদ্ধ তোপে উড়িয়ে দিতে চেষ্টা করবে। আমাদের শিল্পশাস্ত্রকারদের কড়া মাষ্টার এবং পাহারাওলা হিসেবে দেখলে সত্যই আমাদের সেকালের প্রতি অবিচার করা হবে। পূর্বেকার তাঁরা তখনকার কালের যা উপযোগী বা নিয়ম তারই কথা ভেবে গেছেন, একালে আমাদের কি করা না করা, শাস্ত্রের কোন্‌ আইন মানা না মানা সমস্তই একালের উপরে ছেড়ে দিয়ে গেছেন তাঁরা, শাস্ত্রকে অস্ত্রের মতো এ কালের উপরে নিক্ষেপ করার জন্য তাঁরা প্রস্তুত করে যার নি! তখনকার তাঁরা নানা শিল্পের রীতিনীতি ক্রিয়াকলাপ সংগ্রহ করে’ গেছেন নানা শাস্ত্রের আকারে— “স্বয়ম্ভূৰ্ভগবান্‌ লোকহিতার্থ সংগ্ৰহেণ বৈ, তৎসারন্তু বশিষ্টাদৈরস্মাভিবৃদ্ধিহেতবে॥” (শুক্রনীতিসার)। শুক্রাচার্য্য কেন যে নানা শিল্প নানা সামাজিক রীতিনীতি সংগ্রহ করে’ শুক্রনীতিসার বলে’ পুঁথিখানা লিখলেন তা নিজেই বলে গেলেন— “অল্পায়ুর্ভূভৃদাদর্থং সঙ্ক্ষিপ্তং তৰ্কবিস্তৃতম্ ক্রিয়ৈকদেশবোধিনি শাস্ত্রাণ্যন্যানি সন্তি হি। সৰ্ব্বোপজীবকম্‌ লোকস্থিতিকৃন্নীতিশাস্ত্রকম্ ধৰ্ম্মার্থকামমূলং হি স্মৃতং মোক্ষপ্রদং যতঃ॥” মুক্তি দেবার জন্য শাস্ত্র, অল্পের মধ্যে অল্পায়ুধকে অনেকখানি বোঝাবার জন্য শাস্ত্র, রক্ষার জন্য শাস্ত্র,—হননের জন্য নয়! পৃথিবীর সেকালের ভিত্তির উপরে একালের প্রতিষ্ঠা হল স্বাভাবিক প্রতিষ্ঠা, সেকাল একালের ঘাড় চেপে পড়লো—বাড়ীর ভিত উঠে এল ছাতের উপরে, এ বড় বিষম প্রতিষ্ঠা! সেকালের বস্তুশিল্প হিসেবেও এটা ভয়ঙ্কর ব্যাপার। প্রত্নতত্ত্ব-বিদ্যা তার মাল মসলার জন্য সম্পূর্ণভাবে সেকালের উপর নির্ভর করে’ চলতে বাধ্য,— নতুন প্রথায় কিন্তু প্রত্নতত্ত্ব চর্চা চল্লো। শিল্পও তেমনি সেকাল, একাল ও ভবিষ্যকালের যোগাযোগে বর্ধিত হয়ে চল্লো, কোনো এককালের ক্রিয়া কলাপের মধ্যে তাকে ধরে’ রাখবার উপায় রইলো না। প্রাচীন ভারতের শিল্প শুধু নয়—তখনকার আচার ব্যবহার সমুদয় কি ছিল কেমন ছিল তা প্রাচীন পুঁথির মধ্যে ধরা রইলো বলেই শাস্ত্র পুরাণ ইত্যাদি পড়া। কিন্তু পড়ে’ জানা হ’ল একরকম শিল্পকে না জানাই। অজন্তা চিত্র কেমন এবং তার বর্ণ দেবার, লাইন টানার মাপজোখের হিসেবের ফর্দ পড়ে’ গেলে ছবিটা দেখার কাজ হয় না। প্রাচীন ভারতের শিল্পের যে দিকটা প্রত্যক্ষ হচ্ছে বর্তমানে—মন্দির মঠ মূৰ্তি ছবি কাপড়-চোপড় তৈজসপত্র ইত্যাদিতে তা থেকেই বেশী শিক্ষা পায় শিল্পী। এ হিসেবে একটা প্রাচীন মূর্তির ফটোগ্রাফও বেশী কাযের হ’ল শিল্পকে বোঝাতে, আসল মূর্তিটা চোখে দেখলে তো কথাই নেই। ব্রজমণ্ডলে কি কি আছে ও ছিল, সেটা ব্ৰজপরিক্রমা পড়ে’ গেলেও ব্রজমণ্ডল দেখা হ’ল না, জানা হ’ল না—যতক্ষণ না তার ফটো দেখছি বা সেখানে তীর্থ দর্শনে যাচ্ছি। না দেখা ব্রজভূমি যেটা সম্পূর্ণ কল্পনার জিনিস তার মূল্য বড় কম নয় art এর দিক দিয়ে। কিন্তু শাস্ত্রমতো ব্ৰজভূমির একটা বর্ণনা বা symbol দু’খানা হরিচরণ যদি হয়, তবে সেটা দেখে কি বুঝবো ব্রজের শোভা? নিছক প্রতীক নিয়ে তন্ত্রসাধন চলে,—শিল্প সাধনা তার চেয়ে বেশী কিছু চায়। সাধকের হিতার্থে শাস্ত্রমতো রূপ কল্পনা হ’ল অরূপের, যখন তখন একখণ্ড শিলা একটা যন্ত্ৰ হ’লেই কায চলে গেল। কিন্তু শিল্প এমন নিছক প্রতীকমাত্র হয়ে বসে থাকতে পারে না। অনেকখানি চোখের দেখার মধ্যে না ধরলে দেবতাকে দেখানই সম্ভব হয় না। অথচ দেবতাকে মনুষ্যত্বের কিছু বাহুল্য না দিলেও চলে না। এই কারণে নানা মূর্তির নানা মুদ্রা হাত মাথা ইত্যাদির প্রাচুর্য দরকার হ’য়ে পড়লো। শিল্পশাস্ত্র নিখুঁত করে’ তার হিসেব দিলেন। কিন্তু এতেও পাথর দেবতা হয়ে না উঠে মনুষ্যেতর কিছু হবার ভয় গেল না,——তখন শিল্পীর শিল্পজ্ঞান যেটা তার নিজস্ব, তার উপর নির্ভর করা ছাড়া উপায় রইলো না। এই যে শিল্পজ্ঞান, এ কোথা থেকে আসে শিল্পীর মধ্যে তা কে জানে? তবে শুধু শাস্ত্রকে মেনে চলে’ কিম্বা শাস্ত্র পড়ে’ সেটা আসে না এটা ঠিক। এইখানে শিল্পীর প্রতিভাকে স্বীকার করা ছাড়া উপায় রইলো না—কেননা দেখা গেল শাস্ত্রমতো মান পরিমাণ নিখুঁত করেও—“সৰ্ব্বাঙ্গৈঃ সৰ্ব্বরম্যোহি কশ্চিলক্ষে প্রজায়তে”–লাখে একটা মেলে সৰ্ব্বাঙ্গসুন্দর। অতএব ধরে’ নেওয়া গেল “শাস্ত্রমানেন যো রম্যঃ স রম্যো নান্য এব হি”। এতে করে’ শাস্ত্রের মান বাড়লো বটে, কিন্তু শিল্পক্রিয়া খর্ব হ’ল। তাই এক সময়ে একদল বল্লে—“ত রম্যং লগ্নং যত্ৰ চ যস্য হৃৎ।” অমনি শাস্ত্রের দিক দিয়ে এর উত্তর এল—“শাস্ত্রমানবিহীনং যৎ সরম্যং তৎ বিপশ্চিতাম্।।” পণ্ডিতের মান বজায় করে শাস্ত্রকার ক্ষান্ত হলেন। কিন্তু এতে করে’ আমাদের দেশের শিল্পীরা শিল্পক্রিয়াতে প্রায় বারো অানা যে অপণ্ডিত থেকে যাবে, সেকথা শাস্ত্রকার না ভাবলেও তখনকার শিল্পীরা যে ভাবেনি তা নয়। প্রতিমা-শিল্প সেই এক ছাঁচ ধরে’ চল্লো। কিন্তু অন্যান্য শিল্প সমস্ত নতুন নতুন উদ্ভাবনার পথ ধরে’ নানা কালের ক্রিয়া প্রক্রিয়ার বৈচিত্র্য ধরে’ অফুরন্ত সৌন্দৰ্য-ধারা বইয়ে চল্লো দেশে। চিত্রকলার ইতিহাস এদেশে যেমন বিচিত্র তেমন মূর্তি গড়ার ইতিহাস নয়। বাস্তুবিদ্যা তাও নানা নতুন ক্রিয়া প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে চলে’ অব্যাহত ধারায় বইলো নতুন থেকে নতুনতর সমস্তকে ধরে’। কিন্তু ঠাকুরঘরের মধ্যে সেই পুরোনো দেবতা বারবার পুনরাবৃত্ত হ’তে হ’তে দেবতার একটা মুখোসমাত্রে পর্যবসিত হ’তে চল্লো। শাস্ত্রমতো ক্রিয়া করে’ দেবমূর্তি গড়া প্রায় উঠেই গেছে এখন। ধ্যানগুলো বাহনগুলো কার কি এই নিয়েই কায চলেছে ভাস্করপাড়ায় কতদিন থেকে যে তার ঠিকানা নেই। দেবশিল্প বলে’ যদি কোন সামগ্রী হয়ে থাকে এককালে দেশে তো সে বহুযুগ আগে। তারপর থেকে সে শিল্পের অধঃপতনই হয়েছে বেশী বাঁধাবাঁধির ফলে। ঘরে যে শিল্প এই বাঁধনে পড়ে’ মরতে বসলো, বাইরে গিয়ে সেই শিল্প বাঁধন শিথিল পেয়ে দিব্বি বেঁচে গেল দেখতে পাই। নতুন নতুন প্রক্রিয়া নিয়ে পরীক্ষার স্বাধীনতা শিল্পীর থাকলো তবেই শিল্পক্রিয়া চল্লো, না হ’লে শিল্পের দুর্দশার সূত্রপাত হ’ল—শাস্ত্রের দ্বারায় সে বিপদ ঠেকানো গেল না। শিল্পশাস্ত্রে আমাদের দেশে এখানে ওখানে যা ছড়ানো রয়েছে তা থেকে সব শিল্পের তালিকা এবং বাস্তু মন্দির মঠ নির্মাণ, নগর-স্থাপন, বিচার-পদ্ধতি, নাগরিকের চাল-চোলের সম্বন্ধে নানা কথা এবং এই রকম নানা ব্যাপারের মধ্যে পূজার অঙ্গ হিসেবে প্রতিমা-নিৰ্মাণ, তার বাহন ব্যবস্থা ইত্যাদিরই খুঁটিনাটি মাপজোখের কথা পাই। চিত্র বিষয়ে দু’একখানা পুঁথিও পাওয়া যায়। কিন্তু এই সব পুঁথিতে কোন কোন শিল্পকে অঙ্গবিদ্যা হিসেবে দেখে আংশিকভাবে সেই সম্বন্ধে উপদেশ দেওয়া হয়েছে। Artএর পাঠ্য পুস্তক হিসেবে এগুলো বেশী কাজের হবে না, এই আমার বিশ্বাস। চিত্র যদি শিখতে চাই তবে চিত্রশালাতে যেতেই হবে আমাদের। প্রাচীন চিত্রে কেমন করে’ রেখাপাত, কেমন করে’ বর্ণপ্রলেপ, কেমন করে’ নানা অলঙ্কার বর্ধনা ইত্যাদি দেওয়া হ’ত—তার প্রক্রিয়া ছবি দেখেই আমাদের শিখে নিতে হবে। কোনো শিল্পশাস্ত্রে এ সমস্ত প্রক্রিয়া নিখুঁতভাবে ধরা নেই। কেমন কাগজে ছবি খেলা হ’ত, কি কি বর্ণ সংযোগ হ’ত, কোথায় কোথায় কেমন ধারা পালিস দেওয়া হ’ত ছবিতে, কত রকম তুলির টান, কত রকম রংএর খেলা, কত বিচিত্র ভাবভঙ্গি রেখার ও লেখার—এ সমস্ত এক একখানি ছবি দেখে’ শেখা ছাড়া উপায় নেই। শাস্ত্রে কুলোয় না এত বিচিত্র প্রক্রিয়ার রহস্য সমস্ত হয়েছে ছবির মধ্যে ধরা মোগল বাদসাদের আমল পর্যন্ত, তারপর এসেছে ইয়োরোপ জাপান চীন থেকে নতুন নতুন প্রক্রিয়ায় রচনা করা ছবি। এর চেয়ে প্রকাণ্ড পরিষ্কার সুন্দর শিল্প ব্যাখ্যানের পুঁথি যার পাতায় পাতায় ছবি পাতায় পাতায় উপদেশ এমন আর কি হতে পারে! এই পুথির একখানি পাতা সংগ্রহ করে’ নিয়ে চলেছে বিদেশের তারা কত অর্থব্যয়ে নিজেদের শিল্পজ্ঞান জাগিয়ে তুলতে। আর আমরা টাকার অভাবে একটা ছোটখাটো চিত্রশালাও রাখতে পারছিনে দেশে। পাথরগুলো মন্দিরগুলো ভেঙে নেবার উপায় নেই— না হ’লে ভাস্কর্যশিল্পের নিদর্শন দেখে আর আমাদের কিছু শেখার উপায় বিদেশীরা রাখতো না। ভাবতে পারো original ছবির মূর্তি নাই হ’ল, reproduction দেখেই আমরা শিল্প কাযে পাকা হ’য়ে উঠবো, পুঁথি পড়ে’ পাকা হয়ে যাবো,—এ মতের বিরুদ্ধে আমার কিছু বলবার নেই। কেননা আফ্রিকার অধিবাসী যারা, কোথায় তাদের art gallery কোথায় বা তাদের শিল্পশাস্ত্র। ছবির দিক দিয়ে মূর্তির দিক দিয়ে দেশটা উজাড় হ’লে ক্ষতি এমন কিছু নয়। শুধু মরুভূমিকে চষে আমাদেরই আবার সবুজ করে’ তুলতে হবে, পূর্বপুরুষদের সঞ্চয় ও ঐশ্বর্য অন্যে ভোগ করে’ বড় হ’তে থাকবে? দেশের স্থাপত্য রক্ষার আইন তাড়াতাড়ি না হ’লেও ও-জিনিষ সহজে দেশ থেকে নড়তো না, সময় লাগতো। কিন্তু এই সব ছোটখাটো শিল্প সামগ্ৰী,—চমৎকার কাঁথা, চমৎকার সাড়ী, মন-ভোলানো খেলনা, চোখ-ঠিকরানো গহনাগাটি ঘটিবাটি অস্ত্রশস্ত্র এবং রামধনুকের প্রতিদ্বন্দ্বী চিত্রশালা উড়ে’ চলেছে বিদেশে। যদি এখন থেকে দেশে এদের রাখার চেষ্টা আইনের দ্বারা হ’ক পয়সার দ্বারা হ’ক না করা হয় তবে শীঘ্রই শিল্পক্রিয়া আমাদের মধ্যে বন্ধ হ’য়ে যাবে। থাকবে শুধু বিদেশ যেটুকু ভিক্ষা দেবে,—বিনা রোজগারে বিনা খাটুনির পাওনাটা। শিল্পী হ’ল ক্রিয়াশীল, শিল্প চাইতো ক্রিয়া করা চাই। তার প্রথম ক্রিয়া দেশেরটাকে দেশে ধরে’ রাখা, দ্বিতীয় ক্রিয়া বিদেশেরটাকে নিজের করে’ নেওয়া, তৃতীয় ক্রিয়া শিল্প সম্বন্ধে বক্তৃতা নয়,—করে’ চলা ছবি মূর্তি নাচ গান অভিনয় এমনি নানা ক্রিয়া। বিশ্ববিদ্যালয়ে যেটা একেবারেই করা নয় সেইটেই আগে সুরু করতে হ’ল—বক্তৃতা দিতে হ’ল। যেগুলো দরকারী প্রথম শিক্ষার পক্ষে—ছবির মূর্তির একটা যথাসম্ভব সংগ্রহ, তা হ’ল না এ পর্যন্ত। ছবি সম্বন্ধে বই যা শেখাবে, বক্তৃতা যা বোঝাবে, তার চেয়ে ঢের পরিষ্কার ঢের সহজ করে’ বোঝাবে সত্যিকার ছবি—এটা কবে বোঝাতে পারবো লোককে তা জানিনে। আমাদের ছবি মূর্তি ইত্যাদির একটা মস্ত সংগ্ৰহ চৌরঙ্গীতে রয়েছে। কিন্তু সেটার নাম আমরা দিয়েছি যাদুঘর। কোন্‌ দিন সেটা ফুঁয়ে উড়ে যাবে পূব থেকে পশ্চিমে তার ঠিক নেই। তখন আমাদের ঘর শূন্য। এই ভেবেই ছবি মূর্তি সাধ্যাতীত ব্যয় করেও ধরে রাখলেম, দুচার জন শিল্পী তা দেখে শিখলে, কাযে এল দুচার দিন, তারপর এল দুঃসময়, চল্লো সব উড়ে বিদেশে—রূপো সোনার কাঠির স্পর্শে। এ আমি দেখতে পাচ্ছি—রইলো না, দেশের শিল্প দেশে রইলো না। বিদেশী এলো, চোখে ধূলো দিয়ে নিয়ে গেল রাতারাতি ভাণ্ডার লুঠ করে’। সকালে দেখি আমাদের ঘর শূন্য ভাণ্ডার খালি শুধু শিল্পী বসে’ একটা ভূয়ো কৌলীন্য মর্যাদা নিয়ে অথর্ব। আমরা বসে’ রয়েছি বাইরের দিকে চেয়ে! বাইরেটাও যে কত সুন্দর তার নীল আকাশ সবুজ বন আলো-আঁধার পশু-পক্ষী কীট-পতঙ্গ ফুল-ফল নিয়ে, তাও বুঝতে পারছিনে। মন ভাবছে না, হাত পা চলছে না, নিষ্ক্রিয় অবস্থায় হাত পেতেই বসে আছি। হঠাৎ কোন একটা সুযোগ যদি এসে পড়ে এই আশায়। এই হ’ল জাতীয় জীবনের সব দিক দিয়ে আতি ভয়ঙ্কর পক্ষাঘাতের প্রথম লক্ষণ—বাইরেটা রইলো ঠিক কিন্তু ভিতরটা নিঃসার শিল্পের দিক দিয়ে। এই মানসিক এবং বাইরেও হাত পায়ের পক্ষাঘাত নিবারণ কেবল শিল্পক্রিয়ার দ্বারা হ’তে পারে, বহুকাল ধরে’ হ’য়েও এসেছে। রাজ্য গেল রাজা গেল এমন কি ধর্মও অনেকখানি গেল যখন, তখন বাঁচবার রাস্তা হ’ল মানুষের পক্ষে শিল্প৷ ‘আপৎকালে শিল্পের উপর নির্ভর এটা শাস্ত্রের কথা। কেননা শাস্ত্রকাররা জানতেন ক্রিয়াশীলতা এবং ক্রীড়াশীলতা দুটোই শিল্পের এবং জীবনেরও লক্ষণ তাই ক্রিয়া-ভেদে তাঁরা কলা-ভেদ নির্ণয় করে গেলেন। “পৃথক্‌ পৃথক্ ক্রিয়াভিহি কলাভেদস্তু জায়তে”।– ( শুক্রনীতিসার )
অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর
শিল্পে অধিকার অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর শিল্পে অধিকার শিল্প লাভের পক্ষে আয়োজন কতটা দরকার, কেমন আয়োজনই বা দরকার, তার একটা আন্দাজ করে দেখা যাক্। রোমের তুলনায় গ্রীস এতটুকু; শিল্পের দিক দিয়েও গ্রীস রোমের চেয়ে খুব যে বড় করে আয়োজন করেছিল তাও নয়; শুধু গ্রীসের যতটুকু আয়োজন, সবটাই প্রায় শিল্পলাভের অনুকূল, আর রোমক শিল্পের জন্য যে প্রকাণ্ড আয়োজনটা করা হয়েছিল তা অনেকটা আজকালের আমাদের আয়োজনের মতো—বিরাটভাবে শিল্পলাভের প্রতিকূল। গ্রীস রোমের কথা ছেড়েই দিই, আজকালের ইউরোপও কি আয়োজন করে বসেছে তাও দেখার দরকার নেই, আমাদের দেশেই যে এতবড় শিল্প এককালে ছিল, এখনও তার কিছু কিছু চর্চা অবশিষ্ট আছে, সেখানে কি আয়োজন নিয়ে কাজ চলেছে দেখবো। এ দেশে প্রায় সব তীর্থস্থানগুলোর লাগাও রকম রকম কারিগরের এক-একটা পাড়া আছে। এই সহরের মধ্যেই এখনো তেমন সব পাড়া খুঁজলে পাওয়া যায়—কাঁসারিপাড়া, পোটোতলা, কুমরটুলি, বাক্সপটি ইত্যাদি। এই সব জায়গায় শিল্পী, কারিগর দুরকমেরই লোক আছে, যারা ওস্তাদ এক-এক বিষয়ে। ওস্তাদরা ঘরে বসে কাজ করছে, চেলারা যাচ্ছে সেখানে কাজ শিখতে—ঐ সব পাড়ার ছোট বড় নানা ছেলে! সেখানে ক্লাসরুম, টেবেল, চেয়ার, লাইব্রেরি, লেকচার হল কিছুই নেই, অথচ দেখা যায় সেখান থেকে পাকা-পাকা কারিগর বেরিয়ে আসছে—পুরুষানুক্রমে আজ পর্যন্ত! ছোটবেলা থেকে ছেলেগুলো সেখানে দেখেছি কেউ পাথর, কেউ রংতুলি, কেউ বাটালি, কেউ হাতুড়ি এমনি সব জিনিষ নিয়ে কেমন নিজেদের অজ্ঞাতসারে খেলতে খেলতে artist, artisan কারিগর শিল্পী হয়ে উঠেছে যেন মন্ত্রবলে। খেলতে খেলতে শিল্পের সঙ্গে পরিচয়, ক্রমে তার সঙ্গে পরিণয়—এই তো ঠিক্! পড়তে-পড়তে খাটতে-খাটতে ভাবতে-ভাবতে যেটা হয় সেটা নীরস জ্ঞান,—শুধু শিল্পের ইতিহাস, তত্ত্ব, প্রবন্ধ কিম্বা পোষ্টার ও পোষ্টেজ দেবার কাজে আসে। এই যে এক ভাবের শিল্পজ্ঞান একে লাভ করতে হলে নিশ্চয়ই তোড়জোড় ঢের দরকার। লেকচার হল থেকে লেকচারের ম্যাজিক লণ্ঠনটা পর্যন্ত না হলে চলবে না সেখানে। কিন্তু শিল্পজ্ঞান তো শুধু এই বহিরঙ্গীন চর্চা ও প্রয়োগ বিদ্যার দখল নয়; রস, রসের স্ফূর্তি—এসবের আয়োজন যে স্বতন্ত্র। ‘অনন্যপরতন্ত্রা’ শিল্প পাখীপড়ানর খাঁচা, কসরতের আখড়ার দিকেও তো সে এগোয় না, রসপরতন্ত্রতাই হলো তাকে আকর্ষণের প্রধান আয়োজন আর একমাত্র আয়োজন। শুধু এই নয়। স্বতন্ত্র স্বতন্ত্র মানুষ, মনও তাদের রকম-রকম। রসও বিচিত্র ধরণের। আয়োজনও হলো প্রত্যেকের জন্যে স্বতন্ত্র প্রকারের। একজনের individuality, personality যে আয়োজন করলে, আর একজন সেই আয়োজনের অনুকরণে চল্লেই যে অন্যপরতন্ত্রা এসে তাকে ধরা দেবেন, তা নয়; তাঁর নিজের জন্যে তাঁকে স্বতন্ত্র প্রকারের আয়োজন করতে হবে। জাপানের শিল্প আয়োজন, আমাদের শিল্প আয়োজন, ইউরোপের শিল্প আয়োজন সবগুলো দিয়ে খিঁচুড়ি রাঁধলে এ রকম রস সৃষ্টি হতে পারে কিন্তু সেটাতে শিল্পরসের আশা করাই ভুল। প্রত্যেকে স্বতন্ত্রভাবে মনের পাত্রে শিল্পরসকে ধরবার যে আয়োজন করে নিলে সেইটেই হল ঠিক আয়োজন, তাতেই ঠিক জিনিষটি পাওয়া যায়; এ ছাড়া অনেকের জন্য একই প্রকারের বিরাট আয়োজন করে পাওয়া যায় সুকৌশলে প্রস্তুত করা সামগ্রী বা প্রকাণ্ড ছাঁচে ঢালাই-করা কোনো একটা আসল জিনিষের নকল মাত্র। Artistএর অন্তর্নিহিত অপরিমিতি (বা infinity) Artist এর স্বতন্ত্রতা (individuality)—এই সমস্তর নির্মিতি নিয়ে যেটি এলো সেইটেই Art, অন্যের নির্মিতির ছাপ, এমন কি বিধাতারও নির্মিতির ছাঁচে ঢালাই হয়ে যা বার হলো তা আসলের নকল বই আর তো কিছুই হলো না। ভাল, মন্দ, অদ্ভুত বা অত্যাশ্চর্য এক রসের সৃষ্টি তো সেটি হলো না। এইটুকুই যথার্থ পার্থক্য Artএ ও না-Artএ। কিন্তু এ যে ভয়ানক পার্থক্য—স্বর্গের সঙ্গে রসাতলের, আলোর সঙ্গে না-আলোর চেয়ে বেশি পার্থক্য। স্বর্গের ঐশ্বর্য আছে, রসাতলের গাম্ভীর্য আছে, রহস্য আছে, আলোর তেজ, অন্ধকারের স্নিগ্ধতা আছে কিন্তু Artএ ও না-Artএ তফাৎ হচ্ছে—একটায় সব রস সব প্রাণ রয়েছে, আর একটায় কিছুই নেই! Art এর একটা লক্ষণ আড়ম্বরশূন্যতা—Simplicity। অনাবশ্যক রং-তুলি, কলকারখানা, দোয়াত-কলম, বাজনা-বাদ্যি সে মোটেই সয় না। এক তুলি, এক কাগজ, একটু জল, একটি কাজললতা—এই আয়োজন করেই পূবের বড় বড় চিত্রকর অমর হয়ে গেলেন। কবীর এর চেয়ে কমে চলে গেলেন। কাগজ আর কলম, কিম্বা তাও নয়—একতারা কি বাঁশী, অথবা তাও যাক্—শুধু গলার সুর। সহজকে ধরার সহজ ফাঁদ, এই ফাঁদ নিয়েই সবাই তাঁরা চল্লেন—কেউ সোণার মৃগ, কেউ সোণার পদ্মের সন্ধানে। এ যেন রূপকথার রাজপুত্রের যাত্রা—স্বপ্নপুরীর রাজকুমারীর দিকে; সাজ নেই, সরঞ্জাম নেই, সাথী সহচর কেউ নেই। একা গিয়ে দাঁড়ালেম অপরিমিত রস-সাগরের ধারে, মনের পাল সুবাতাসে ভরে উঠলো তো ঠিকানা পেয়ে গেলেম! রূপকথার সব রাজপুত্রের ইতিহাস চর্চা কর তো দেখবে—কেউ তাজি ঘোড়ায় চড়ে সন্ধানে বার হয়নি, এই যেমন-তেমন একটা ঘোড়া হলেই তারা খুসি। এও তো এক আশ্চর্য ব্যাপার শিল্পের—এই যেমন-তেমনের উপরে সওয়ার হয়ে যেমনটি জগতে নেই, তাই গিয়ে আবিষ্কার করা! মাটির ঢেলা, পাথরের টুকরো, সিঁদূর, কাজল—এরাই হয়ে উঠ্‌লো অসীম রস আর রহস্যের আধার! রসের তৃষ্ণা শিল্পের ইচ্ছা যার জাগবে, সে তো কোনো আয়োজনের অপেক্ষা করবে না;—যেমন করে হোক সে নিজের উপায় নিজে করে নেবে; এ ছাড়া অন্য কথা নেই। একদিন কবীর দেখলেন একটা লোক কেবলই নদী থেকে জল আমদানি করছে সহরের মধ্যে চামড়ার থলি ভরে-ভরে। সে লোকটার ভয় হয়েছে নদী কোন দিক্ দিয়ে শুকিয়ে যাবে! মস্ত বড় এই পৃথিবী নীরস হয়ে উঠেছে, তাই সে রস বেলাবার মতলব করছে। কবীর লোকটাকে কাছে ডেকে উপদেশ দিলেন— “পানি পিয়াওত ক্যা ফিরো ঘর ঘর সায়র বারি। তৃষ্ণাবংত যো হোয়গা পীবৈগা ঝকমারি।” এ আয়োজন কেন, ঘরে ঘরে যখন রসের সাগর রয়েছে? তেষ্টা জাগুক, ওর আপনিই সেটা মেটাবার উপায় করে নেবে দায়ে ঠেকে। মূলকথা হচ্ছে রসের তৃষ্ণা; শিল্পের ইচ্ছা হলো কি না, উপযুক্ত আয়োজন হলো কিনা—শিল্পের জন্যে বা রসের তৃষ্ণা মেটাবার জন্যে—এটা একেবারেই ভাববার বিষয় নয়। বিশ্ব জুড়ে তৃষ্ণা মেটাবার শিল্পকার্য, তার প্রয়োগবিদ্যা, তার খুঁটিনাটি উপদেশ আইন-কানুন সমস্তই এমন অপর্যাপ্তভাবে প্রস্তুত রয়েছে যে কোন মানুষের সাধ্য নেই তেমন আয়োজন করে তোলে। শিল্পকে, রসকে পাওয়ার জন্যে আয়োজনের এতটুকু অভাব যে আছে তা খুব একেবারে আদিম অবস্থাতে—আর সব দিক দিয়ে অসহায় অবস্থাতেও—মানুষ বলেনি; উল্টে বরং প্রয়োজন হলে আয়োজনের অভাব ঘটে না কোনদিন—এইটেই তারা, হরিণের শিং, মাছের কাঁটার বাটালি, একটুখানি পাথরের ছুরি, এক টুকরো গেরি মাটি, এই সব দিয়ে নানা কারুকার্য নানা শিল্প রচনা করে দিয়ে সপ্রমাণ করে গেছে। এ না হলে হবে না, ও না হলে চলে না—শিল্পের দিক দিয়ে এ কথা বলে শুধু সে, যার শিল্প না হলেও জীবনটা চলছে কোন রকমে। আদিম শিল্পীর সামনে শুধু তো বিশ্বজোড়া এই রস-ভাণ্ডার খোলা ছিল, চেয়ারও ছিল না, টেবিলও ছিল না, ডিগ্ৰীও নয়, ডিপ্লোমাও নয়, এমন কি তার জাতীয় শিল্পের গ্যালারী পর্যন্ত নয়—কি উপায়ে তবে সে শিল্পকে অধিকার করলে? আমি অঙ্কন করছি, আমার নাতিটি পাশের ঘরে বসে অঙ্ক কসছে—এইভাবে চলছে, হঠাৎ একদিন নাতি এসে বল্লেন—দাদামশায়, বেরাল না থাকলে তোমার মুস্কিল হতো, বেরালের রোঁয়ার তুলি হতো না তোমার ছবিও হতো না। তর্ক সুরু হলো। ঘোড়ার লেজ কেটে তুলি হতো। ঘোড়া যদি না থাকতো? পাখীর পালক ছিঁড়ে নিতেম। পাখী না পেলে? নিজের মাথার চুল ছিঁড়তেম। টাক পড়ে গেছে? নাতির গালে আঙ্গুলের ডগার খোঁচা দিয়ে বল্লেম—দশটা আঙ্গুলের এই একটা নিয়ে। নাতি রাবণ বধের উপক্রম করেন দেখে বল্লেম—তা হয় না, দেখছো এই ভোঁতা তুলি! বলে আমিও ঘুঁসি ওঠালেম। দাদামশায়ের আয়োজন দেখে নাতি হার মেনে সরে পড়লেন। কাজের ঘানিতে জোতা রয়েছি, ঘানি পিষছি, কিন্তু স্নেহরস যা বার করছি, এক ফোঁটাও তো আমার কাছে আসছে না। রসালাপের অবসরটুকু নেই, রসের তৃষ্ণা মেটানো, শিল্পলাভ—এ সব তো পরের কথা। কাজের জগতের মোটা-মোটা লোহার শিক দেওয়া ভয়ঙ্কর অথচ সত্যিকার এই বেড়াজাল শুধু আমাদের ধরে চাপন দিচ্ছে না, সব মানুষই এতে বাঁধা। আখের ছড় বলে এর শিকগুলোতে ভুল করে দাঁত বসানো তো চলে না। কাজের মধ্যে যদি ধরা না দিই তো সংসার চলে না, আবার কাজেই গা ঢেলে দি তো রস পাওয়া থাকে দূরে। এর উপায় কিছু আছে? রস পেতে চাই,—তবে কি রসের মধ্যে নিজেকে, নিজের সঙ্গে কাজকর্ম সংসারটা ভাসিয়ে দেবো? ফুলের গন্ধে মাতোয়ারা মন, তবে কি ফুলের বাগিচায় গিয়ে বাস করবো?—ধানের ক্ষেত, ধনের চিন্তা সব ছেড়ে? কবীর বল্লেন, পাগল নাকি! “বাগো না জায়ে নাজা, তেরে কায়া মে গুলজার॥” ‘ও বাগে যেওনা বন্ধু, পুষ্পবন তোমার অন্তরেই বিদ্যমান!’ কায়ার মধ্যে প্রাণ যে ধরা রয়েছে, বাইরে থাক্‌ না কাজের জঞ্জাল। খাঁচার মধ্যে থেকেই পাখী কি গান গায় না? তাকে কি ফুলের বনে যেতে হয় গান গাইতে? যে ওস্তাদ সে ঘানি চলার তালে তালেই গায়, নাই হলো আর কোনো সংগত-সুযোগ। “মৃগা পাশ কস্তুরী বাস আপন খোজৈ খোজৈ ঘাস।” কিন্তু কস্তুরীর ব্যবসা করতে গিয়ে দানা পানির উপায় ছাড়লে জীবনটা যখন শুকিয়ে যাবে তখন কি করা যাবে? কোথায় থাকবে তখন রস, কোথায় থাকবে তখন শিল্প? রস না থাক, জীবনটা তে৷ রয়েছে অনেকখানি। আগে জীবন—সব রসের মূল যেটা, সেটা তো রক্ষা করা চাই। এর উপর আর কথা চলে না। কিন্তু এই কালে সহরের বুকে দাঁড়িয়ে ঐ ফুটপাতের পাথরের চাপনে বাঁধা পড়ে শিরীষ গাছ, সেও যদি ফুল ফোটাতে পারে, তো মানুষ পারবে না তেমন করে ফুটতে—এও কি কখনো সম্ভব? চেরি ফুল যখন ফোটে তখন সারা জাপানের লোকের মন—সেও ফুটে উঠে, ছুটি নিয়ে ছুট্ দেয় সেদিকে সব কাজ ফেলে। কই তাতে তো কেউ তাদের অকেজো বলতে সাহস করছে না? পেটও তো তাদের যথেষ্ট ভরছে। আমাদেরও তো আগে বারো মাসে তেরো পার্বণ ছিল, সে জন্যে সেকালে কাজেরও কামাই হয়নি, জীবনেরও কমতি ছিল না,—শিল্পেরও নয়, শিল্পীরও নয়, রসেরও নয়, রসিকেরও নয়। “অলসস্‌স কুতো শিপ্পং?” নিশ্চয় আমাদের এখনকার জীবন যাত্রায় কোথাও একটা কল বিগড়েছে যাতে করে জীবনটা বিশ্রী রকম খুঁড়িয়ে চলছে, শরীর খেটে মরছে কিন্তু মনটা পড়ে আছে অবশ, অলস! ম্যালেরিয়ার মশার সঙ্গে লক্ষ্মী পেঁচার ঝাঁক এসে যদি আমাদের ঘরে বাসা বাঁধতো, তবে শিল্পী হওয়া আমাদের পক্ষে সহজ হতো কি না এ প্রশ্ন নিয়ে নাড়াচাড়া করা আমার শোভা পায় না—পেঁচার পালকের গদীর উপর বসে। কিন্তু ইতিহাসের সাক্ষ্য তো মানতে হয়। শিল্পী ‘যা ছুঁয়ে দেয় তাই সোণা হয়ে যায়’ অথচ সোণা দিয়ে বেচারা ছেলে মেয়ের গা কোনদিন ভরে দিতে পারলে না! তাজের পাথর যারা পালিস করলে—আয়নার মতো ঝকঝকে, দুধের মতো সাদা করে, মুক্তোর চেয়েও লাবণ্য দিয়ে তার গম্বুজটা গড়ে গেল যারা, দেওয়ালের গায়ে অমর দেশের পারিজাত লতা চড়িয়ে দিয়ে গেল যে নিপুণ সব মালি, তারা রোজ-মজুরী কত পেয়েছিল? তা ছাড়া পুরো খেতে পায়নি বলে তাদের শিল্প কোথায় ম্লান হয়েছিল বল্‌তে পারো? দশ-এগার বছর লেগেছিলো তাজটা শেষ করতে; সবচেয়ে বেশী মাইনা যা দেওয়া হয়েছিল ওস্তাদদের, তা মাসে হাজার টাকার বেশী নয়; এই থেকে বাদসাহি আমলের উপরওয়ালাদের পেট ভরিয়ে কারিগরেরা রোজ পেয়েছিল কত, কষে দেখলেই ধরা পড়বে শিল্পীর সঙ্গে ও শিল্পের সঙ্গে সম্পদের যোগাযোগটা। শিল্পী হওয়া না হওয়ার সঙ্গে ম্যালেরিয়া হওয়ার বেশী যোগ, চাকরী হওয়া না হওয়ার চেয়ে—আমি এইটেই দেখতে পাচ্ছি। জীবন রক্ষা করতে যেটা দরকার, জীবন সেটা ঘাড় ধরে আমাদের করিয়ে নেবেই, ছাড়বে না,—নিদারুণ তার পেষণ-পীড়ন। অতএব আফিস আদালত ছেড়ে সকলে রূপ ও রসের রাজত্বের দিকে সন্ন্যাস নিয়ে চট্‌পট্‌ বেরিয়ে পড়ার কুপরামর্শ তো কাউকে দেওয়া চলে না; অথচ দেখি এই কলে-পড়া জীবন যাত্রার মধ্যে একটুখানি রস একটু শিল্প সৌন্দর্য না ঢোকাতে পারলেও তো বাঁচিনে। শুধু যে প্রাণ যায় তা নয়, শিল্পী বলে ভারতবাসীর যে মান ছিল তাও যায়। শিল্পী নীচ জাত হলেও সে শিল্পের পাণিগ্রহণ করেছে, সেই কারণে সকল সময়ে শিল্পী বিশুদ্ধ এই কথা ভারতবর্ষের ঋষিরা বলে গেছেন; কিন্তু যেখানে এই শিল্পী আজকালের কলের মানুষ আমাদের পরশ পাচ্ছে সেইখানেই সে মলিন হচ্ছে—ফুল যেমন চটকে যায় বেরসিকের হাতে পড়ে। এর উপায় কি? রসের সঙ্গে কাজের বন্দীর পরিচয় পরিণয় ঘটাবার কি আশা নেই? কেন থাকবে না? কাজকর্ম আমাদেরই বেঁধে পীড়া দিচ্ছে এবং কবি, শিল্পী, রসিক—এঁরা সব এই কাজের জগতের বাইরে একটা কোন নতুন জগতে এসে বিচরণ করছেন তা তো নয়? কিম্বা জীবন যাত্রার আখ্‌মাড়া কলটার কাছ থেকে চট্‌পট্‌ পালাবার উৎসাহ তো কবি শিল্পী এঁদের কারু বড় একটা দেখা যাচ্ছে না! তাঁরা তবে কি করে বেঁচে রয়েছেন? কবীরের কাজ ছিল সারাদিন তাঁত-বোনা, আফিসে বসে কলম পেশার কিম্বা পাঠশালে বসে পড়া মুখস্তর সঙ্গে তার কমই তফাৎ। তাঁত-বোনা মাকু-ঠেলার কাজ ছাড়লে কবীরের পেট চলা দায় হতো। অামাদের সংসার চালাতে হচ্ছে কলম ঠেলে। রসের সম্পর্ক মাকু-ঠেলার সঙ্গে যত, কলম-ঠেলার সঙ্গেও তত, শুধু কবীর স্বাধীন জীবিকার দ্বারা অর্জন করতেন টাকা, ইচ্ছাসুখে ঠেলতেন মাকু, আনন্দের সঙ্গে কাজ বাজিয়ে চলতেন, আর এখনকার আমরা কাজ বাজিয়ে বাজিয়ে কুঁজো হয়ে পড়লেম তবু কাজি বলছে ঘাড়ে ধরে বাজা, বাজা, আরো কাজ বাজা, না হলে বরখাস্ত। কবীরের তাঁত কবীরকে ‘বরখাস্ত’ এ কথা বলতে পারেনি। ঐ যে কবীরের ইচ্ছাসুখে তাঁত-বোনার রাস্তা তারি ধারে তাঁর কল্পবৃক্ষ ফুল ফুটিয়েছিল। এই ইচ্ছাসুখটুকুর মুক্তি কবি, শিল্পী, গাইয়ে, গুণী সবাইকে বাঁচিয়ে রাখে—পয়সার সুখ নয়, কিম্বা কাজ ছেড়ে ভরপুর আরামও নয়। কাজের-কলের বন্দী আমাদের সব দিক দিয়ে এই ইচ্ছাসুখের পথে যেখানে বাধা সেখানে নরক যন্ত্রণা ভোগ করি, উপায় কি? কিন্তু মন—সে তো এ বাধা মানবার পাত্রই নয়। জেলখানার দরজা মন্ত্র-বলে খুলে সে তো বেরিয়ে যেতে পারে একেবারে নীল আকাশের ওপারে! সে তো মৃত্যুর কবলে পড়েও রচনা করতে পারে অমৃতলোক! তবে কোথায় নিরাশা, কোথায় বাধা? বিক্রমাদিত্যের দরবারে কবি কালিদাসকেও নিয়মিত হাজ্‌রে লেখাতে হতো, কিন্তু এতে করে মেঘরাজ্যের তপোবনে তাঁর বিচরণের কোন বাধাই তো হয় নি! কবি, শিল্পী কেউ কাজের জগৎ ছেড়ে রসকলির তিলক টেনে অথবা জটাজুটে ছাই-ভস্মে একেবারে রসগঙ্গাধর সেজে কেবলি বৃন্দাবন আর গঙ্গাসাগরের দিকে পালিয়ে চলেছেন, তা তো কোনো ইতিহাস বলে না। মৃত্যু দিয়ে গড়া এই আমি-রসের পেয়ালা, শুকনো চামড়ার কার্বা, যার মধ্যে ধরা হয়েছে গোলাপজল, কাজের সূতোয় গাঁথা পারিজাত ফুল—এইগুলোকে তাঁরা জীবনে অস্বীকার করে চলতে চেষ্ট৷ করেন নি, উল্টে বরং যারা কাজে নারাজ হয়ে একেবারেই বয়ে যাবার জন্য বেশী আগ্রহ দেখিয়েছে তাদের ধমক দিয়ে বলেছেন, ‘জ্যোঁ কা ত্যোঁ ঠহরো’—আরে অবুঝ, ঠিক্ যেমন আছ তেমনি স্থির থাক। কথাই রয়েছে—কারুকার্য। কাজের জটিলতার শ্রম, শ্রান্তি সমস্তই মেনে নিলে তবে তো সে শিল্পী। এই সহরের মধ্যে দাঁড়িয়েই কি আমরা বলতে পারি, রস কোথায়—তাকে খুঁজে পাচ্ছিনে, শিল্প কোথায়—তাকে দেখতে পাচ্ছিনে? ইন্দ্রনীল মণির ঢাকনা দিয়ে ঢাকা এই প্রকাণ্ড রসের পেয়ালা, কালো-সাদা, বাঁকা-সোজা, রং-বেরং কারুকার্য দিয়ে নিবিড় করে সাজানো, এটি ধরা রয়েছে—তোমারো সামনে, তারও সামনে, অামারো সামনে, ওরও সামনে—বিশেষ ক’রে কারু জন্যে তো এটা নয়—জায়গা বুঝেও তো এটা রাখা হয়নি—তবে দুঃখ কোনখানে? ঢাকা খোলার বাধা কি? কত শক্ত শক্ত কাজে আমরা এগিয়ে যাই, এই কাজটাই কি খুব কঠিন আর দুঃসাধ্য হলো? ঢাকা খোলার অবসর পেলাম না, এইটেই হলো কি আসল কথা? ধর, অবসর পেলেম—পূর্বপুরুষ খেটে খুটে টাকা জমিয়ে গেল, পেটের ভাবনাও ভাবতে হলো ন,—মেয়ের বিয়েও নয়, চাকরিও নয়, কিম্বা আফিস আদালত ইস্কুলগুলোর সঙ্গে একদম আড়ি ঘোষণা করে লম্বা ছুটি পাওয়া গেল—রসের পেয়ালাটার তলানি পর্যন্ত গিয়ে পৌঁছবার। কিন্তু এতে করে হলো কি? লাড্‌ডুর খদ্দের এত বেড়ে চল্লো যে দিল্লীর বাদশার মেঠাইওয়ালাও ফতুর হবার জোগাড় হলো। অতএব বলতেই হয়, অবসর ও অর্থের মাত্রার তারতম্যে রস পাওয়া-না-পাওয়ার কম-বেশ ঘটছে না, অামার ইচ্ছে না-ইচ্ছে, কি ইচ্ছে, কেমন ইচ্ছে—এরই উপরে সব নির্ভর করছে, এই ইচ্ছেটাই যা পেতে চাই তাই পাওয়ায়, পথ দেখায় এই ইচ্ছে। নজর বিগড়ে গেছে আমাদের, না হলে শিল্পের আগাগোড়া—তার পাবার শুলুক-সন্ধান সমস্তই চোখে পড়তো আমাদের। কি চোখে চাইলেম, কিসের পানে চাইলেম, চোখ কি দেখ্‌লে এবং মন কি চাইলে, চোখ কেমন করে দেখ্‌লে, মন কেমন ভাবে চাইলে, চোখ দেখলেই কি না, মন চাইলেই কি না—এরি উপরে পাওয়া-না-পাওয়া, কি পাওয়া, কেমন পাওয়া, সবই নির্ভর করছে। কাজের উপরে জাতক্রোধ রক্তচক্ষু নিয়ে নয়, সহজ চোখ, সহজ দৃষ্টি—এবং সেটি নিজের,—সহজ ইচ্ছা এবং আন্তরিক ইচ্ছা—এই নিয়ে ‘নিয়তিকৃত-নিয়মরহিতা’, হ্লাদৈকময়ী, অনন্যপরতন্ত্রা, নবরসরুচিরা যিনি, তাঁর সঙ্গে শুভ দৃষ্টি করতে হয় সহজে। রসের পেয়ালার যদি নাগাল পাওয়া গেল তখন আর কিসের অপেক্ষা? যতটুকু অবসর হোক না কেন তাই ভরিয়ে নিলেম রসে, যেমনি কাজ হোক না কেন তাই করে গেলেম—সুন্দর করে’ আনন্দের সঙ্গে; যা বল্লেম, কইলেম, লিখলেম, পড়লেম, শুনলেম, শোনালেম—সবার মধ্যে রস এলো, সৌরভ এলো, সুষমা দেখা দিলে;—শিল্প ও রস শুকশারীর মতো বক্ষ-পিঞ্জরে চিরকালের মতো এসে বাসা বাঁধলো। কি কবি, কি শিল্পী, কিবা তুমি, কিবা আমি এই বিরাট সৃষ্টির মধ্যে যেদিন অতিথি হলেম, রসের পূর্ণপাত্র তো কারু সঙ্গে ছিল না; একেবারে খালি পাত্রই নিয়ে এলেম, এলো কেবল সঙ্গের সাথী হয়ে একটুখানি পিপাসা। আমরা না জানতে মাতৃস্নেহে ভরে গেল আসবাব পত্ৰ—সেই এতটুকু পেয়ালা আমাদের, তারপর থেকে সেই আমাদের ছোট পেয়ালা—তাকে ভরে দিতে কালে-কালে, পলে-পলে দিনে-রাতে, এক ঋতু থেকে আর এক ঋতু রসের ধারা ঝরেই চল্লো, তার তো বিরাম দেখা গেল না;—শুধু কেউ ভরিয়ে নিয়ে বসে রইলেম নিজের পেয়ালা বেশ কাজের সামগ্ৰী দিয়ে নিরেট করে, কেউ বা ভরলেম পরে সেটা নব-নব রসে প্রত্যেক বারেই পেয়ালাটাকে খালি করে-করে। এই কারণে আমরা মনে করি সৃষ্টিকর্তা কোন মানুষকে করে পাঠালেন রসের সম্পূর্ণ অধিকারী, কাউকে পাঠালেন একেবারে নিঃস্ব করে। একি কখন হতে পারে? “রসো বৈ সঃ” বলে যাঁকে ঋষিরা ডাকলেন, তিনি কি বঞ্চক? রাজার মতো কাউকে দিলেন ক্ষমতা, কাউকে রাখলেন অক্ষম করে, শিল্পীর সেরা যিনি তাঁর কি এমন অনাসৃষ্টি কারখানা হবে? কেউ পাবে সৃষ্টির রস, সৃষ্টির শিল্পের অধিকার, আর একজন কিছুই পাবে না? এত বড় ভুল কেবল সেই মানুষই করে যে নিজের দোবে নিজে বঞ্চিত হয়ে বিধাতাকে দেয় গঞ্জনা। সেইজন্য কবীরের কাছে যখন একজন গিয়ে বল্লে—প্রাণ গেল রস পাচ্ছিনে, কোথা যাই? কি করি? কোন্ দিকের আকাশে সূর্য আলো দেয় সব চেয়ে বেশি, কোন্ সাগরের জল সব চেয়ে নীল পরিষ্কার অনিন্দ্যসুন্দর—সে কোন্ বনে বাসা বেঁধেছে, রস কোন্ পাতালে লুকিয়ে আছে, বলে দিন—কি উপায় করি? কবীর অবাক্ হয়ে বল্লেন— “পানী বিচ মীন পিয়াসী মোহিঁ সুন সুন আওত হাঁসি।” এক একবার ঘরের মধ্যে থেকেও হঠাৎ ঘুমের ঘোরে মনে হয় দরজাটা কোথায় হারিয়ে গেছে—উত্তরে কি দক্ষিণে কোথাও ঠিক পাওয়া যাচ্ছে না। রসের মধ্যে ডুবে থাকে আমাদের রসের সন্ধান, আর শিল্পের হাটে ব’সে শিল্পলাভের উপায় নির্ধারণ, এও কতকটা ঐরূপ। পাথরের রেখায় বাঁধা রূপ, ছবির রঙে বাঁধা রেখা, ছন্দে বাঁধা বাণী, সুরে বাঁধা কথা, শিল্পের এ সবই তো যে রস ঝরছে দিনরাত তারি নির্মিতি ধরে প্রকাশ পাচ্ছে; অখণ্ড রসের খণ্ড খণ্ড টুকরো তো এরা—একটি আলো থেকে জ্বালানো হাজার প্রদীপ, এক শিল্পের বিচিত্র প্রকাশ! এর অধিকার পাওয়ার জন্য কোন আয়োজন, কোন শাস্ত্রচর্চাই দরকার করে না। কাজের জগতের মাঝেই রস ঝর্‌ছে—আনন্দের ঝরণা, আলোর ঝোরা; তার গতি ছন্দ সুর রূপ রং ভাব অনন্ত; আর কোথায় যাবো—শিল্প শিখতে শিল্পকে জানতে? নীল আর সবুজ এমনি সাত রঙের সাতখানি পাতা তারি মধ্যে ধরা রয়েছে রসশাস্ত্র, শিল্পশাস্ত্র, সঙ্গীত, কবিতা—সমস্তেরই মূলসূত্র ব্যাখ্যা সমস্তই! এমন চিত্রশালা যার ছবির শেষ নেই, এমন বাণী মন্দির যেখানে কবিতার অবিশ্রান্ত পাগলাঝোরা ঝরছেই, এমন সঙ্গীতশালা যেখানে সুরের নদী সমুদ্র বয়ে চলেছে অবিরাম, এর উপরে রসকে পাবার, শিল্পকে লাভ করবার, আর কি আয়োজন মাটির দেওয়ালের ঘরে করতে পারি? এর উপরে কিবা অভাব আমাদের জানাতে পারি? Artistএর সেরা, সেরা কারিগরের সেরা—বিশ্বকৰ্মার এই অযাচিত দান, এই নিয়েই তো বসে থাকা চলে,—দেখ আর লেখ, শোন আর বসে থাক। আর তো কিছুর জন্যে চেষ্টা হয় না, ইচ্ছেও হয় না। এই অপ্রার্থিত অপর্যাপ্ত সৃষ্টি আর রস—একেই বুক পেতে নিয়ে সৃষ্টির যা কিছু—মানুষ থেকে সবাই—চুপচাপ বসে রইলো ঘাড় হেঁট করে রসের মধ্যে ডুবে, সেরা শিল্পীর এই কি হলো রচনার পরিপূর্ণতা—মুখবন্ধেই হলো রচনার শেষ? শিল্পীর রাজা যিনি শুধু একটা জগৎ-জোড়া চলায়মান বায়স্কোপের রচনা করেই খুসি হলেন, জীবজগৎটাকে সোনালী রূপালী মাছের মতো একটা আশ্চর্য গোলকের মধ্যে ছেড়ে দেওয়াতেই তাঁর শিল্প ইচ্ছার শেষ হয়ে গেল? চিত্রকর মানুষ তার টানা রূপগুলির টানে টানে যেমন চিত্রকরের ঋণ স্বীকার করে চলার সঙ্গে সঙ্গেই চিত্রকরকেই আনন্দ দিতে দিতে আপনাদের সমস্ত ঋণ শোধ করে চলে, তেমনি ভাবেই তো এই বিরাট শিল্পরচনার সৃষ্টি হলো, তাইতো এর নাম হল অনাসৃষ্টি নয়,—সৃষ্টি। সৃষ্ট যা, সৃষ্টিকর্তার কাছে ঋণী হয়ে বসে রইলো না, এইখানেই সেরা শিল্পীর গুণপনা—মহাশিল্পের মহিমা—প্রকাশ পেলে। শিল্পী দিলেন সৃষ্টিকে রূপ; সৃষ্টি দিয়ে চল্লো এদিকের সুর ওদিকে, অপূর্ব এক ছন্দ উঠ্‌লো জগৎ জুড়ে! আমাদের এই শুকনো পৃথিবী সৃষ্টির প্রথম বর্ষার প্লাবন বুক পেতে নিয়ে আকাশের দিকে চেয়ে বল্লে—রসিক, সবই তোমার কাছ থেকে আসবে, আমার কাছ থেকে তোমার দিকে কি কিছুই যাবে না? সবুজ শোভার ঢেউ একেবারে আকাশের বুকে গিয়ে ঠেকলো; ফুলের পরিমল, ভিজে মাটির সৌরভ বাতাসকে মাতাল করে ছেড়ে দিলে; পাতার ঘরের এতটুকু পাখী, সকাল-সন্ধ্যা আলোর দিকে চেয়ে সেও বল্লে—আলো পেলেম তোমার, সুর নাও আমার—নতুন নতুন আলোর ফুল্‌কি দিকে-দিকে সকলে যুগ-যুগান্তর আগে থেকে এই কথা বলে চল্লো,—তারপর একদিন মানুষ এলো; সে বল্লে—কেবলই নেবো, কিছু দেবো না? দেবো এমন জিনিষ যা নিয়তির নিয়মেরও বাইরের সামগ্ৰী; তোমার রস আমার শিল্প এই দুই ফুলে গাঁথা নবরসের নির্মিত নির্মাল্য ধর, এই বলে’ মানুষ নিয়মের বাইরে যে, তার পাশে দাঁড়িয়ে শিল্পের জয়ঘোষণা করলে,— “নিয়তিকৃতনিয়মরহিতাং হ্লাদৈকময়ীমনন্যপরতন্ত্রাম্। নবরসরুচিরাং নির্মিতিমাদধাতি ভারতীকবের্জয়তি॥” নিয়মের মধ্যে ধরা মানুষের চেষ্টা, নতুন বর্ণে, নতুন নতুন ছন্দে বয়ে চল্লো নিয়মের সীমা ছাড়িয়ে ঠিক-ঠিকানার বাইরে। পৃথিবীতে মানুষ যা কিছু দিতে পেরেছে সে তার এই নির্মিতি—যেটা পরিমিতির মধ্যে ধরা ছিল তাকে অপরিমিতি দিয়ে ছেড়ে দিলে অপরিমিত রসের তরঙ্গে।
অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর
শিল্পে অনধিকার অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর ভূমিকা পূজ্যপাদ স্যর আশুতোষের প্রযত্নে ও খয়রার কুমার গুরুপ্রসাদ সিংহের বদান্যতায় ১৯২১ খ্রীষ্টাব্দে কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে যে পাঁচটি নূতন অধ্যাপক-পদের সৃষ্টি হয়, ভারতীয় শিল্পকলার অধ্যাপনা-সম্পর্কে ‘রাণী বাগেশ্বরী অধ্যাপক’-পদ তন্মধ্যে একটি। মনে পড়িতেছে, ইহার অব্যবহিত কাল পূর্ব্বে, শিল্পাচার্য্য অবনীন্দ্রনাথ ‘ভারতী’ পত্রিকায় ‘রসের কথা’ নামে এক প্রবন্ধের একস্থানে বলিয়াছিলেন, “এ দেশের অলঙ্কারের সূত্রগুলো যে ছত্রে-ছত্রে Art-এর ব্যাখ্যা ক’রে চলেছে, সেটা কোন পণ্ডিতকে তো এ পর্য্যন্ত বলতে শুন্‌লেম না।” কিন্তু দরদীর মন লইয়া এ কথা বলিবার—Art-এর প্রকৃত ব্যাখ্যা করিবার—অবনীন্দ্রনাথই যে যোগ্যতম পণ্ডিত, ইহা স্যর আশুতোষ বুঝিয়াছিলেন। ইহা বুঝিয়াই সেই সময়ে তিনি অবনীন্দ্রনাথকেই ‘রাণী বাগেশ্বরী অধ্যাপকের’ পদে বরণ করেন। ১৯২১ খ্রীষ্টাব্দ হইতে আরম্ভ করিয়া ১৯২৯ খ্রীষ্টাব্দ পর্য্যন্ত এই পদে অধিষ্ঠিত থাকিয়া তিনি প্রায় ত্রিশটি বক্তৃতা দিয়াছিলেন। সেই সকল বক্তৃতা তখনকার দিনে ‘বঙ্গবাণী’ ও ‘প্রবাসী’ পত্রিকাদ্বয়ে প্রকাশিত হইয়াছিল। ইহার পর প্রায় এক যুগ অতীত হইয়াছে। শিল্প-চর্চ্চার আদর দেশে দিন দিন বৃদ্ধি পাইতেছে। প্রবেশিকা পরীক্ষার বিষয়-তালিকায় ‘শিল্পরসবোধ’ পাঠ্যরূপে নির্দ্দিষ্ট হইয়াছে; সুতরাং এ সময়ে অবনীন্দ্রনাথের উক্ত বক্তৃতাসমূহ পুনঃ-প্রচারিত হইলে অনেকের উপকার হইবে বিবেচনায় সেগুলি ‘বাগেশ্বরী শিল্প-প্রবন্ধাবলী’ নামে গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হইল। ———- ০১. শিল্পে অনধিকার আজ থেকে প্রায় ১৫ বৎসর আগে আমার গুরু আর আমি দুজনে মিলে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের এক কোণে শিল্পের একটা খেলাঘর কল্পনা করেছিলেম। আজ এইখানে যাঁরা আমার গুরুজন ও নমস্য এবং যাঁরা আমার সুহৃদ্ এবং আদরণীয়, তাঁরা মিলে আমার কল্পনার জিনিষকে রূপ দিয়ে যথার্থই অামায় চিরদিনের মতো কৃতজ্ঞতার ঋণে আবদ্ধ করেছেন। আমার কতকালের স্বপ্ন সত্য হয়ে উঠেছে—আজ সন্ধ্যায়। কেবল সেদিনের কল্পনার সঙ্গে আজকের সত্যিকার জিনিষটার মধ্যে একটি বিষয়ে অমিল দেখ্‌ছি—সেটা এই সভায় আমার স্থান নিয়ে। সেদিন ছিলেম আমি দর্শকের মধ্যে,—প্রদর্শক কিম্বা বক্তার আসনে নয়। তাই এক-একবার মনে হচ্ছে আজকেরটাই বুঝি দরিদ্রের স্বপ্নের মতো একটা ঘটনা—হঠাৎ মিলিয়ে যেতেও পারে। কিন্তু স্বপ্নই হোক্ আর সত্যই হোক্, এরি আনন্দ আমাকে নূতন উৎসাহে দিনের পর দিন কাজ করতে চালিয়ে নেবে—যতক্ষণ আমার কাজ করার এবং বক্তৃতা দেবার শক্তি থাকবে। যোগ সাধন করতে হয় শুনেছি চোখ বুজে, শ্বাসপ্রশ্বাস দমন করে; কিন্তু শিল্প-সাধনার প্রকার অন্য প্রকার—চোখ খুলেই রাখতে হয়, প্রাণকে জাগ্রত রাখতে হয়, মনকে পিঞ্জর-খোলা পাখীর মতো মুক্তি দিতে হয়—কল্পনা-লোকে ও বাস্তব-জগতে সুখে বিচরণ কর্‌তে। প্রত্যেক শিল্পীকে স্বপ্ন-ধরার জাল নিজের মতো করে বুনে নিতে হয় প্রথমে, তারপর বসে থাকা—বিশ্বের চলাচলের পথের ধারে নিজের আসন নিজে বিছিয়ে, চুপটি করে নয়—সজাগ হয়ে। এই সজাগ সাধনার গোড়ায় শ্রান্তিকে বরণ করতে হয়—Art is not a pleasure trip, it is a battle, a mill that grinds. (Millet). Art has been pursuing the chimera attempting to reconcile two opposites, the most slavish fidelity to nature and the most absolute independence, so absolute that the work of art may claim to be a creation. (Bracquemont). আমাদেরও পণ্ডিতেরা artকে ‘নিয়তিকৃত নিয়মরহিতা’ বলেছেন; সুতরাং এই artকে পাঁচ বছরের মধ্যে বিশ্ববিদ্যালয়ের চারখানা দেওয়ালের মধ্যে যে ধরে দিয়ে যাব, এমন আশা আমি করিনে এবং আমাকে যিনি এখানে ডেকেছেন, তিনিও করেন না। আমি ক-বছর নির্বিবাদে art-সম্বন্ধে যা খুসি, যখন খুসি, যেমন করে খুসি, যা-তা—অবিশ্যি যা জানি তা—বকে যেতে পারবো এই ভরসা পেয়েছি। আমার পক্ষে সেইটুকুই যথেষ্ট। কিন্তু আমার যথেষ্ট হলেই তো হল না, আরো পাঁচজন রয়েছেন—দেশের ও দশের কি হল? এ প্রশ্ন তো উঠবে একদিন, তাই আমি এই কাজের দিকে দু পা এগোই, দশ পা পিছোই, আর ভাবি এই যে এতকাল ধরে নানা ছবি আঁকলেম, ছবি আঁকতে শিখিয়ে চল্লেম, স্কুল বসালেম এবং বারো-তেরো বছর ধরে কত Exhibitionই দেখালেম লোকসমাজে, এই যে নবচিত্রকলাপদ্ধতি বলে একটা অদ্ভুত জিনিষ, এই যে প্রাচীন ভারতচিত্র বলে একটা গুপ্তধনের সন্ধান দেওয়া গেল, আর আগেকার সাদা মাসিকপত্রগুলোকে সচিত্র করে, ছেলেদের বইগুলোকে রঙিন ছবিতে ভরিয়ে সমালোচকদের হাতে “ন ভূত ন ভবিষ্যতি” সমালোচনা গড়বার মহাস্ত্র আরও একটা বাড়িয়ে তোলা হল—এগুলো বিনা পারিশ্রমিকে দেওয়া বলেই কি যথেষ্ট হল না? বিনামূল্যে, আনন্দে একটু দেওয়া, সেই তো ভাল দেওয়া। মূল্য নিয়ে ওজন করে যা দেওয়া, সেটা দোকানদারের ফাঁকি দিয়ে ভরা হলেই যে যথেষ্ট ভাল হয় তাতো নয়! তাই বলি—আমি বলে যাব, তোমরা শুনে যাবে; আমি ছবি লিখে যাব, তোমরা দেখে আনন্দ করবে অথবা সমালোচনা করবে; কিম্বা তোমরা লিখবে বলবে, আমি দেখব শুনব আনন্দ করবো—আর যদি সমালোচনা করি তো মনে-মনে; এর চেয়ে বেশী আপাতত নাই হলো। শিল্পের একটা মূলমন্ত্রই হচ্চে ‘নালমতিবিস্তরেণ’। অতি-বিস্তরে যে অপর্য্যাপ্ত রস থাকে, তা নয়। অমৃত হয় একটি ফোঁটা, তৃপ্তি দেয় অফুরন্ত! আর ঐ অমৃতি জিলাবির বিস্তার মস্ত, কিন্তু খেলে পেটটা মস্ত হয়ে ওঠে আর বুক চেপে ধরে বিষম রকম। শিল্পরসের উপর অধিকারের দাবি আমার যে কত অল্প, তা আমি যেমন জানি, এমন তো কেউ নয়। কারণ অমৃত-বণ্টনের ভার নিতে আমি একেবারেই নারাজ। আমার সাধ্য যা, তাই দেবার হুকুম পেয়েছি। দিতে হবে যা আছে আমার সংগ্রহ করা,—শিল্পের ভাবনা-চিন্তা কাজ-কর্ম্ম সমস্তই—যা আমার মনোমত ও মনোগত। কারো মনোমত করে গড়া নয়, নিজের অভিমত জিনিষ গড়তেই আমি শিখেছি,—আর শিখেছি সেটাকে জোর করে কারু ঘাড়ে চাপাবার না চেষ্টা করতে। ‘আদানে ক্ষিপ্রকারিতা প্রতিদানে চিরায়ুতা’—শিল্পীর উপরে শাস্ত্রকারের এই হুকুমটার একটা মানে হচ্ছে সব জিনিষের কৌশল আর রস চট্‌পট্‌ আদায় করতে হবে; কিন্তু সেটা পরিবেষণ করবার বেলায় ভেবে-চিন্তে চল্‌বে। কেউ কেউ ভয় করছেন, সুযোগ পেয়ে এইবার আমি নিজের এবং নিজের দলের শিল্পের একচোট বিজ্ঞাপন বিলি করে নেব। সেটা আমি বলছি মিথ্যে ভয়। শিল্পলোকে যাত্রীদের জন্য একটা গাইড্‌বুক পর্য্যন্ত রচনা করার অভিসন্ধি আমার নেই, কেন না আমিও একজন যাত্রী—যে চলেছে আপনার পথ আপনি খুঁজতে খুঁজতে। এই খোঁজাতেই শিল্পীর মজা। এই মজা থেকে কাউকে বঞ্চিত করার ইচ্ছে আমার একেবারেই নেই। শুধু যাঁরা এই শিল্পের পথে আমার অগ্রগামী, তাঁদেরই উপদেশ আমি সবাইকে স্মরণে রেখে চল্‌তে বলি—“ধীরে ধীরে পথ ধরো মুসাফির, সীড়ী হৈ অধবনী!”—দুর্গম সোপান, হে যাত্রী, ধীরে পা রাখ। এ ছাড়া বিজ্ঞাপনের কথা যা শুনছি, তার উত্তরে আমি বলি—ফুল যেমন তার বিজ্ঞাপন দিচ্ছে নানা বর্ণে সাজিয়ে, বসন্তঋতু লট্‌কে দিচ্ছে তার বিজ্ঞাপন আকাশ বাতাস পৃথিবী ছেয়ে, তেমনি করে বিজ্ঞাপন দিচ্ছেন সব কবি, শিল্পীই; আর তাই দেখে ও শুনে কেউ করছে উহু, কেউ উঁহু, কেউ আহা, কেউ বাহা! এটা তো প্রতি পলেই দেখছি, সুতরাং শিল্পের বিজ্ঞাপন দেব আমি আজকালের নূতন প্রথায় কেন? মনের ফুল বনের ফুলের সাথী হয়ে ফুটলো,—এর বেশিও তো শিল্পীর দিক থেকে চাওয়ার প্রয়োজন নেই; তবে কেন অধম শিল্পী হলেও আমি ছুটে মরবো যথা-তথা হ্যাণ্ডবিল বিলিয়ে? এ আশঙ্কার কারণ তো আমি বুঝিনে। মধুকর মধু নিয়ে তৃপ্ত হন; এতে ফুলের যতটুকু আনন্দ, তার চেয়ে শিল্পীর সজীব আত্মা সমজদার পেলে আর একটুখানি আনন্দ বেশি পায় সত্য, কিন্তু সেটা তার উপরি-পাওনা— হলেও হয়, না হলেও চলে। শিল্পীর যথার্থ আনন্দ হচ্ছে ফোটার গৌরবে। গোলাপ সৌরভ ছড়িয়ে রাঙা হয়ে ফুটলো, শিমুলও ফুটলো রাঙা হয়ে—খালি তুলোর বীজ ছড়াতে, কিন্তু রসিক যে, সে তো সেই দুই ফুলেরই ফোটার গৌরব দেখে খুসি হয়। এই ফোটার গৌরব দিয়ে ওস্তাদ যাঁরা, তাঁরা শিল্পীর কাজের তুলনা করে থাকেন—“দিবস চারকে সুরংগ ফুল, ওহি লখ মনমে লাগল্ শূল!”—দু দণ্ডের জীবন ফুটলো, রসিকের এই দেখেই মন বলে—মরি মরি! এইখানেই শিল্পীতে আর কারিগরে তফাৎ; শিল্পের মধ্যে শিল্পীর মন ফুটন্ত হয়ে দেখা দিলে, আর কারিগরের গড়া অতি আশ্চর্য্য কাগজের ফুল ফুটন্ত ফুলকেও হার মানালে, কিন্তু মনের রস সেটাকে সজীব করে দিলে না। জগতে কারিগরেরই বাহবা বেশি শিল্পীর চেয়ে, কেন না কারিগর বাহবা পেতেই গড়ে, শিল্পী গড়ে চলে নিজের কাজের সঙ্গে নিজকে ফুটতে বোধ করতে-করতে। এই কারণেই শিল্পচর্চ্চার গোড়ার পাঠ হচ্ছে শিল্পবোধ, যেমন শিশুশিক্ষার গোড়াতে হচ্ছে শিশুবোধ। রসবোধই নেই রস-শাস্ত্র পড়তে চলায় যে ফল, শিল্পবোধ না নিয়ে শিল্পচর্চ্চায় প্রায় ততটা ফলই পাওয়া যায়। এর উল্টোটা যদি হতো, তবে সব কটা অলঙ্কার-শাস্ত্রের পায়েস প্রস্তুত করে পান করলেই ল্যাটা চুকে যেত। মৌচাকের গোপনতার মধ্যে কি উপায়ে ফুলের পরিমল গিয়ে পৌঁছচ্ছে তা দেখতে পাওয়া যায়; কিন্তু মধুর সৃষ্টি হচ্ছে একটা প্রকাণ্ড রহস্যের আড়ালে। তেমনি মানুষের রসবোধ কি উপায়ে হয়, কেমন করে, অলঙ্কার-শাস্ত্রে রস-শাস্ত্রে তারি জল্পনা যেমন দেখি, তেমনি এও তো দেখি যে রস-শাস্ত্র নিংড়ে পান করেও কমই রসিক দেখা দিচ্ছে। এই যে আলো-মাখা রামধনুকের রঙে বিচিত্র বিশ্বচরাচরের অফুরন্ত রস, এ তো মাটি থেকে প্রস্তুত রঙের বাক্সয় ধরা পড়ে না, কালীর দোয়াতেও নয়, বীণার খোলটার মধ্যেও নয়। এ বাঁধা পড়ে মনে; এই হলো সমস্ত রস-শাস্ত্রের প্রথম ও শেষ পাঠ। মৌচাক আর বোলতার চাক—সমান কৌশলে আশ্চর্যভাবে দুটোই গড়া। গড়নের জন্যে বোলতায় আর মৌমাছিতে পার্থক্য করা হয় না; কিম্বা মৌমাছিকে মধুকরও নাম দেওয়া হয় না—অতি চমৎকার তার চাকটার জন্যে। মৌচাকের আদর, তাতে মধু ধরা থাকে বলেই তো! তেমনি শিল্পী আর কারিগর দুয়েরই গড়া সামগ্রী, নিপুণতার হিসেবে কারিগরেরটা হয়ত বা বেশি চমৎকার হলো কিন্তু রসিক দেখেন শুধু তো গড়নটা নয়, গড়নের মধ্যে রস ধরা পড়লো কি না। এই বিচারেই তাঁরা জয়মাল্য দেন শিল্পীকে, বাহবা দেন কারিগরকে। শিল্পীর কাজকে এইজন্যে বলা হয় নির্মিতি অর্থাৎ রসের দিক দিয়ে যেটি মিত হলেও অপরিমিত। আর কারিগরের কাজকে বলা হয় নির্মাণ অর্থাৎ নিঃশেষভাবে পরিমাণের মধ্যে সেটি ধরা। একটা নির্মাণের মতো ঠিক, আর একটি নির্মাণ-সম্ভব কিন্তু শিল্পীর নির্মিতিকে কৌশলের কলে ফেলে বাইরের ধাঁচাটা নকল করে নিলেও ভিতরের রসের অভাব কিম্বা তারের বৈষম্য থাকবেই। এইজন্যেই শিল্পীর শিল্পকে বলা হয়েছে “অনন্যপরতন্ত্রা”। আমার শিল্প এক, আর তোমার শিল্প আর-এক, আমার দেশের শিল্প এক, তোমার দেশের অন্য,—এ না হলে মানুষের শিল্পে বিচিত্রতা থাকতো না; জগতে এক শিল্পী একটা-কিছু গড়তো, একটা-কিছু বলত বা গাইত আর সবাই তার নকলই নিয়ে চলত। রোমক শিল্প নকল নিয়েই চলেছিল—গ্রীকদেবতার মূর্ত্তিগুলির কারিগরিটার। রোম ভেবেছিল গ্রীক শিল্পের সঙ্গে সমান হয়ে উঠবে এই সোজা রাস্তা ধরে, কিন্তু যেদিন একটি গ্রীক শিল্পীর নির্মিতি মানুষের চোখে পড়লো, সেই দিনই ধরা পড়ে গেল অত বড় রোমক শিল্পের ভিতরকার সমস্ত শুষ্কতা ও অসারতা। সপ্তম সর্গ, অষ্টম সর্গ, সাত কাণ্ড, অষ্টাদশ পর্বগুলোর ছাঁচের মধ্যে নিজের লেখাকে ঢেলে ফেলতে পারলেই কিম্বা নিজের কারিগরি কি কারদানিটাকে হিন্দু বা মোগল অথবা ইউরোপীয় এমনি কোনো একটা যুগের ও জাতির ছাঁচের মধ্যে ধরে ফেলতে পারলেই আমাদের ঘরে শিল্প পুনর্জীবন লাভ করে কলাবৌটি সেজে ঘুর্‌ঘুর্ করে ঘুরে বেড়াবে এই যে ধারণা এইটেই হচ্ছে সব শিল্পীর যাত্রাপথের আরম্ভে একটুখানি অথচ অতি ভয়ানক, অতি পুরাতন চোরাবালি। এর মধ্যে একটা চমৎকার, চক্‌চকে সাধুভাষায় যাকে বলে, লোষ্ট্র পড়ে আছে, যার নাম Tradition বা প্রথা। অনন্তকালের সঞ্চিত ধনের মতো এর মোহ; একে অতিক্রম করে যাবার কৌশল জানা হলে তবে শিল্পলোকের হাওয়া এসে মনের পাল ভরে তোলে, ডোববার আর ভয় থাকে না। শিল্পলোকের যাত্রাপথে এই যে একটা মোহপাশ রয়েছে—চিরাগত প্রথার অনুসরণপ্রিয়তা, সেটাকে কাটিয়ে যাবার শিল্প-শাস্ত্র বৈদিক ঋষিরা আমাদের দিয়ে গিয়েছেন—‘মানুষের নির্মিত এই সমস্ত খেলানার সামগ্রী, এই হস্তী, কাংস, বস্ত্র, হিরণ্য, অশ্বতরীযুক্ত রথ প্রভৃতি যে শিল্প সমস্তই দেবশিল্পের অনুকরণমাত্র—একে শিল্প বলা চলে না, এ তো দেব-শিল্পীর দ্বারায় করা হয়ে গেছে, মানুষের কৃতিত্ব এর মধ্যে কোথায়? এ তো শুধু প্রতিকৃতি (নকল) করা হলো মাত্র! হে যজমান শিল্পী, দেব-শিল্পীর পরে এলেম আমরা, সুতরাং আমাদের করাটা নামে মাত্র অনুকৃতি বলে ধরা যায়, কিন্তু আমাদের কাজে সৃষ্টির কৃতিত্ব যেখানে, সেখানে মানুষের শিল্পের সঙ্গে দেবশিল্পের রচনার উপায়ের মধ্যে পার্থক্য কোথাও নেই; শুধু সেটি পরে করা হয়েছে—অনুকৃত হয়েছে মাত্র—এই রহস্য জানো! এ যে জানে সকল শিল্পই তার অধিকারে আসে, শিল্প তার আত্মার সংস্কার সাধন করে, এই যে শিল্প এমন যে শিল্প-শাস্ত্র, কেবল তারি দ্বারায় যজমান নিজের আত্মাকে ছন্দোময় করে যথার্থ যে সংস্কৃতি তাই লাভ করে এবং প্রাণের সঙ্গে বাক্যকে, চক্ষুর সহিত মনকে, শ্রোত্রের সহিত আত্মাকে মিলিত করে।’ যতদিন মানুষ জানেনি তার নিজের মধ্যে কি চমৎকারিণী শক্তি রয়েছে সৃষ্টি করবার, ততদিন সে তার চারিদিকের অরণ্যানীকে ভয় করে চলছিল, পর্ব্বতশিখরকে ভাবছিলো দুরারোহ, ভীষণ; বিশ্বরাজ্যের উপরে কোনো প্রভুত্বই সে আশা করতে পারছিল না; তার কাছে সমস্তই বিরাট রহস্যের মত ঠেকছিল; সে চুপচাপ বসে ছিল। কিন্তু যেদিন শিল্পকে সে জানলে, সেই মুহূর্ত্তেই তার মন ছন্দোময় বেদময় হয়ে উঠলো, রহস্যের দ্বারে গিয়ে সে ধাক্কা দিলে—সবলে। শুধু এই নয়, ভয় দূরে যাওয়ার সঙ্গে-সঙ্গে মানুষ তার এই দুদিনের খেলাঘরে অতি আশ্চর্য্য খেলা—কাণ্ডকারখানা আরম্ভ করে দিলে। আগুনকে সে বরণ করে নিয়ে এলো নিজের ঘরে ঘুমন্ত দেশের রাজ-কন্যার মতো সোনার কাঠির স্পর্শে জাগিয়ে তুলে! অমনি সঙ্গে-সঙ্গে তার ঘরে বেজে উঠ্‌লো লোহার তার আশ্চর্য্য সুরে, মাটির প্রদীপ জ্বেলে দিলে নূতনতর তারার মালা; মানুষ সমস্ত জড়তার মধ্যে ডানা দিয়ে ছেড়ে দিলে;—আকাশ দিয়ে বাতাস কেটে উড়ে চল্লো, সমুদ্রের পরপারে পাড়ি দিয়ে চল্লো—মানুষের মনোরথ, মনতরী—তার স্বপ্ন তার সৃষ্টির পসরা বয়ে। এই শিল্পকে জানা, মানুষের সব-চেয়ে যে বড় শক্তি—সৃষ্টি-করার কৃতিত্ব, তাকেই জানা। এই বিরাট সৃষ্টির মধ্যে এতটুকু মানুষ কেমন করে বেঁচে থাকতো যদি এই শিল্পকে সে লাভ না করত! শিল্পই তো তার অভেদ্য বর্ম, এই তো তার সমস্ত নগ্নতার উপরে অপূর্ব রাজবেশ! আত্মার গৌরবে আপনি সেজে নিজের প্রস্তুত-করা পথে সে চল্লো—স্বরচিত রচনার অর্ঘ্য বয়ে—মানুষ নিজেই যাঁর রচনা তাঁর দিকে! মানুষের গড়া আনন্দ সব তো এতেই শেষ! সে জানাতে পারলে আমি তোমার কৃতী সন্তান! শিল্পের সাধনা মানুষ করেই চল্লো পৃথিবীতে এসে অবধি, তবেই তো সে নানা কৌশলে নানা যন্ত্রপাতি আবিষ্কার করলে; সাত-সমুদ্র তের-নদী, এমন কি চন্দ্রলোক সূর্যলোকের ঊর্ধেও তার শরীর ও মনের গতি, চলার সব বাধাকে অতিক্রম করে, কতক সমাধা হলো, কতক বা সমাধা হবার মতো হলো। সূর্যের মধ্যে ঝড় বইল, মানুষের গড়া যন্ত্রে তার খবর সঙ্গে-সঙ্গে এসে পৌঁছলো, নীহারিকার কোলে একটি নতুন তারা জন্ম নিলে ঘরে বসে মানুষ সেটা চোখে দেখলে! এর চেয়ে অদ্ভুত সৃষ্টি হলো—মানুষ তার আত্মাকে রূপ, রঙ, ছন্দ, সুর, গতি, মুক্তি সব দিয়ে ছড়িয়ে দিলে বিশ্বরাজ্যে। এমন যে শিল্প, এত বড় যে শিল্প, তারই অধিকার ঋষিরা বলেছেন নাও; আর আমরা বলছি না, না, ও পাগলামি-খেয়াল থাক, চাকরীর চেষ্টা করা যাক্। ওইটুকু হলেই আমরা খুসী। ঋষির বল্লেন—একি, একি তুচ্ছ চাওয়া? —নাল্পে সুখমস্তি! আমরা বল্লুম—অল্পেই আমি খুসি। কিন্তু আমাদের পূর্ব্বতন যাঁরা, তাঁদের চাওয়া তো আমাদের মতো যা-তা যেমন-তেমন নয়। শিল্পলক্ষ্মীর কাছে তাঁদের চাওয়া বাদসার মতো চাওয়া—একেবারে ঢাকাই মস্‌লিন, তাজমহলের ফরমাস; জগতের মধ্যে দুর্লভ যা, তারই আবদার! বৌদ্ধ-ভিক্ষু, তাঁরা থাকবেন; শুধু পাহাড়ের গুহা মনঃপূত হলো না, তাদের জন্য রচনা হয়ে গেল অজন্তাবিহার—শিল্পের এক অদ্ভুত সৃষ্টি—ভিক্ষুরা যেখানে জন্তুর মতো গুহাবাস করবেন না, নরদেবের মতো বিহার করবেন! রমণীর শিরোমণি তাজ, দুনিয়ার মালিক সাহাজাহান তার স্বামী, সোহাগ-সম্পদ সে কি না পেয়েছিল, কিন্তু তাতেও তো সে তৃপ্ত হলো না, সাহাজাহানের অন্তরে ছিল যে শিল্প, তারই শেষ-দান সে চেয়ে নিলে—দুজনের জন্যে একটি মাত্র কবর, যার মধ্যে দুজনে বেঁচে থাকবে, এমন কবর যার জোড়া ত্রিভুবনে নেই। একেই বলে চাওয়ার মতো চাওয়া, দেওয়ার মতো দেওয়া। কোনো শিল্প নেই, কোনো রস নেই—এটা সেকালের লোক কল্পনা করতে পারেনি, তাদের শিল্পসামগ্রীগুলোই তার প্রমাণ। কিন্তু আজকালের-আমরা কি পেরেছি, এখনও পারছি, আমাদের ঘর-বার চারিদিক তার সাক্ষ্য দিচ্ছে। শিল্পে অধিকার আমরা কি মুখের বক্তৃতায় পাব? মনের মধ্যে যে রয়েছে আমাদের—যেন-তেন-প্রকারেণ পয়সা, কোনো-রকমে যা-তা করে লীলা সাঙ্গ করা! এ ভাবে চল্লে হাতের মুঠোয় কেউ শিল্পকে ধরে দিলেও তো আমরা সেটা পাব না। খোঁজই নেই শিল্পের জন্যে, কোথা থেকে পাব সেটা! কি দিয়ে ঘর সাজালেম, কি ভাবেই বা নিজে সাজলেম, আমোদই বা হলো কেমন, পঞ্চাশ-ষাট-সত্তর বছরের জীবনটা কাটলই বা কেমন করে—এ খোঁজের তো প্রয়োজনই আছে বলে মনে করি না; মনের মধ্যে যে লুকিয়ে রয়েছে যেমন-তেমন ভাব,—অল্পেই মন ভরে গেল যেমন-তেমনে! শুধু অল্প হলে তো কথা ছিল না; সেটা বিশ্রী হবে কেন? মাসে বার-পঁচিশ বায়স্কোপ-রঙ্গমঞ্চের রঙ্গ এবং ফুটবলের ভিড়, ঘোড়দৌড়ের জুয়ো এবং দু’চারটে স্মৃতি-সভার বার্ষিক অধিবেশন ও যতটা পারা যায় বক্তৃতা—এই হলেই কি চুকে গেল সব ক্ষুধা, সব তৃষ্ণা? ধর ক্ষুধা মেটানো গেল—সোনালী গিল্টি-করা মার্ব্বেল-মোড়া বৈদ্যুতিক আলোতে ঝক্‌মক্‌ হোটেলের খানা-কামরায়, এবং তৃষ্ণাও মেটালেম মদের বোতলে; কিন্তু তারপর কি? মনের খোরাক যে মধু, মনকে তা দেওয়া হল না—পেয়ালা ভরে। মন রইলো উপবাসে। দিনে-দিনে মন হতবল, হতশ্রী হলো, স্ফূর্তি হারালে। তারপর একদিন দেখলেম, আনন্দময়ের দান আনন্দ দেবার ক্ষমতা, আনন্দ পাবার ইচ্ছা—সবই হারিয়েছি; সৌন্দর্যবোধ, আনন্দবোধ—সবই আমাদের চলে গেছে। বাতাস যে কি বলছে তা বুঝতে পারছি নে, ফুলন্ত পৃথিবী কি সাজে যে সেজে দাঁড়াচ্ছে ঘরের সামনে তাও দেখতে পাচ্ছিনে। আকাশে আলো নেই, অন্তরে তেজ নেই, আশা নেই, আনন্দ নেই, শুকনো জীবন ঝুঁকে রয়েছে রসাতলের দিকে! এটা যে আমি কেবল অযথা বাক্‌জাল বিস্তার করে ভয় দেখাচ্ছি তা নয়; এই ভয় সত্যিই আমাদের মধ্যে এসে উপস্থিত হয়েছে। এই ভয় থেকে পরিত্রাণের উপায় করতেই হবে,—শিল্পীর অধিকার আমাদের পেতেই হবে, না হলে কিছুই পাব না আমরা। ভারতবর্ষের প্রাচীন জ্ঞানভাণ্ডার, শিল্পভাণ্ডার অতুল ঐশ্বর্যে কালে-কালে ভর্তি হলো সত্যি, কিন্তু আজকের আমাদের হাল-চাল দেখে কেউ কি বলবে আমরাই সেই অফুরন্ত ভাণ্ডারের যথার্থ উত্তরাধিকারী? এই হতশ্রী, নিরানন্দ, অত্যন্ত অশোভন ভাবে নিঃস্ব, কেবলি হাত-পাতা আর হাত-জোড় ছাড়া হাতের সমস্ত কাজ যারা ভুলে বসেছি, সূর্যের কণা দিয়ে গড়া কোণার্ক মন্দির, প্রেমের স্বপন দিয়ে ধরা তাজ—এগুলো কি আমাদেরই? ভারতবাসী বলেই কি এগুলো আমাদের হলো? তাতো হতে পারে না। এই সব শিল্পের নির্মিতি, এদের নিজের বলবার অধিকার অর্জন করবো শুধু সেই দিন, যেদিন শিল্পকে আমরা লাভ করবো, তার পূর্বে তো নয়। শিল্প যেদিন আমাদের হবে, সেদিন জগৎ বলবে এ সবই তো তোমাদের!—আমাদের শিল্পও তোমাদের। আমাদের দেশের রসিকরা বলেছেন শিল্পকে ‘অনন্যপরতন্ত্রা’। শিল্পের সাধনা যে করে, কি দেশের কি বিদেশের প্রাচীন নতুন সব শিল্পের ভোগ তারই কপালে ঘটে। আমার দেশ বলে ডাক দিলে দেশটা হয়তো বা আমার হতেও পারে কিন্তু দেশের শিল্পের উপরে আমার দাবি যে গ্রাহ্য হবে না, সেটা ঠিক। তা যদি হতো তবে কালাপাহাড় থাক্‌লে, সেও আজ আমাদের সঙ্গে ভারতশিল্পের চূড়া থেকে প্রত্যেক পাথরটির উপরে সমান দাবি দিতে পারতো; কেন না কালাপাহাড় ছিল ভারতবাসী এবং আমাদেরই মত ভাঙ্‌তে পটু, গড়তে একেবারেই অক্ষম; শুধু কালাপাহাড় ভেঙ্গে গেছে রাগে আর আমরা ভাঙছি বিরাগে—এই মাত্র তফাৎ। কাব্যকলা, শিল্পকলা, গীতকলা,—এ সবাইকে ‘রস-রুচিরা’ বলে কবিরা বর্ণন করেছেন এবং তিনি হ্লাদৈকময়ী—আনন্দের সঙ্গে ওতপ্রোত হয়ে আছেন; আর তিনি অনন্যপরতন্ত্রা—যেমন-তেমন যার-তার কাছে ত তিনি বাঁধা পড়েন না; রসিক, কবি—এদেরই তিনি বরণ করেন এবং এদেরই তিনি সহচরী সঙ্গিনী সবই। আমরা যারা এক আফিসের কাজ এবং সেয়ারের কাজ ও তথাকথিত দেশের কাজ প্রভৃতি ছাড়া আর কিছুতেই আনন্দ পাইনে, রস পাইনে, পাবার চেষ্টাও করিনে, তাদের কাছ থেকে শিল্প দূরে থাকবেন, এতে আশ্চর্য কি? “অলসস্‌স কুতো শিল্পং অসিপ্পস্‌স কুতোধনং!” নিজের শিল্প থেকে ভারতবাসী হলেও আমরা কতখানি দূরে সরে পড়েছি এবং বিদেশী হলেও তারা এই ভারতশিল্পের রত্নবেদীর কতখানি নিকটে পৌঁছে গেছে তার দুটো-একটা উদাহরণ দিচ্ছি। জাপানের শ্রীমৎ ওকাকুরা শেষ বার এদেশে এলেন, শঙ্কট রোগে শরীর ভগ্ন কিন্তু শিল্পচর্চা, রসালাপের তাঁর বিরাম নেই। সেই বিদেশী ভারতবর্ষের একটি তীর্থ দেখতে এসেছেন—দূর প্রবাস থেকে নিজের ঘরের মৃত্যুশয্যায় আশ্রয় নেবার পূর্বে একবার জগন্নাথের মন্দিরের ভিতরটা কেমন শিল্পকার্য দিয়ে সাজানো দেখে যাবেন এই তাঁর ইচ্ছা, আর সেই কোণার্ক মন্দির যার প্রত্যেক পাথর শিল্পীর মনের আনন্দ আর আলো পেয়ে জীবন্ত হয়ে উঠেছে, সেটাও ঐ সঙ্গে দেখে নেবার তাঁর অত্যন্ত আগ্রহ দেখলেম। জগন্নাথের ডাক পড়েছে আমার বিদেশী শিল্পীভাইকে; কিন্তু জগন্নাথ ডাকেন তো ছড়িবরদার ছাড়ে না, ভারতের বড়লাটকে পর্যন্ত বাধা দেয় এত বড় ক্ষমতা সে ধরে! তাকে কি ভাবে এড়ানো যায়? শিল্পীতে-শিল্পীতে মন্ত্রণা বসে গেল। চুপি চুপি পরামর্শটা হলো বটে কিন্তু বন্ধু গেলেন জগবন্ধু দর্শন করতে দিনের আলোতে রাজার মতো। এইটেই ছিল বিশ্বশিল্পীর মনোগত;—শিল্পী বিদেশী হলেও তার যেন গতিরোধ না হয় দর্শনের দিনে। দ্বার খুলে গেল, প্রহরী সসম্মানে একপাশ হলো, জাপানের শিল্পী দেখে এলেন ভারতের শিল্পীর হাতে-গড়া দেবমন্দির, বৈকুণ্ঠ, আনন্দবাজার, মায় দেবতাকে পর্যন্ত। এই পরমানন্দের প্রসাদ পেয়ে বন্ধু দেশে চল্লেন অক্ষত শরীরে। তাঁর বিদায়ের দিনের শেষ-কথা আমার এখনও মনে আছে—ধন্য হলেম, আনন্দের অবধি পেলেম, এইবার পরপারে সুখে যাত্রা করি। এইতো গেল শিল্পের যথার্থ অনুরাগী অথচ বিদেশীর ইতিহাস। এইবার স্বদেশী অথচ বিরাগীর কথাটা বলি। ঐ জগন্নাথের মাসির বাড়ীর জীর্ণ সংস্কার করতে হবে। একটা কমিটি করে খানিকটা টাকা তোলা হয়েছে; এস্‌টিমেট্ বক্তৃতা ইত্যাদি হয়ে ঠিক হয়েছে—অনেক কালের পুরোনো বনগাঁবাসী মাসির ঘরের বেশ কারুকার্য-করা পাথরের বড় বারাণ্ডা, কাল যেটাতে বেশ একটুখানি চমৎকার গাঢ় বর্ণের প্রলেপ দিয়েছে, আর যার নানা ফাটলের শূন্যতাগুলো মনোরম হয়ে উঠেছে বনলতার সবুজে আর সোনায়, সেই পুরোনোটাকে আরো পুরোনো—আরো মনোরম হতে না দিয়ে তাড়াতাড়ি সেটার এবং সেই সঙ্গে মন্দিরের মধ্যেকার কতকালের লেখা শঙ্খলতার পাড়, হংসমিথুনের ছবি ইত্যাদি নানা আল্‌পনা নক্সাখোদকারী কারিগরি দেওয়াল হতে কড়ি বরগার যত দাগা ও আঁটা ছিল সবগুলোর একসঙ্গে গঙ্গাযাত্রা করা। গুপ্তচরের মুখে সংবাদ পেলেম মন্দির সংস্কার হচ্ছে, মাসির বাড়ীতে প্রাচীন মূর্তির শিলাবৃষ্টি হয়ে গেছে, হরির লুটের বাতাসার মতো যত পার কুড়িয়ে নিলেই হয়। সন্ধ্যার অন্ধকারে চুপি চুপি সেখানে গিয়ে দেখি একটা যেন ভূমিকম্প হয়ে গেছে, চূড়োর সিংহি উল্টে পড়েছে ভূঁয়ে, পাতালের মধ্যে যে ভিৎ শিকড় গেড়ে দাঁড়িয়েছিল এতকাল, সে শুয়ে পড়েছে মাটির উপরে; সব ওলট-পালট, তছনছ! কেমন একটা ত্রাস উপস্থিত হলো। চরকে শুধালেম—এই সব পাথরের কাজ ঝেড়ে-ঝুড়ে পরিষ্কার করে যেমন ছিল তেমনি করে তুলে দেওয়া হবে তো সংস্কারের সময়? চরের কথার ভাবে বুঝলেম এই সব জগদ্দল পাথর ওঠায় যেখানকার সেখানে—এমন লোক নেই। বুঝলেম এ সংস্কার নয়, সৎকার। ভাঙ্গা মন্দিরে মানুষের গলার আওয়াজ পেয়ে একজোড়া প্রকাণ্ড নীল হরিণ চার চোখে প্রকাণ্ড একটা বিস্ময় নিয়ে আমার কাছে এগিয়ে এলো। কতকালের পোষা হরিণ, এই মন্দিরের বাগানে জন্ম নিয়ে এতটুকু থেকে এত বড়টি হয়েছে,—এদের কি হবে? শুধিয়ে জানলেম এদের বিক্রী করা হবে, আর এদের সঙ্গে-সঙ্গে যে বাগিচা বড় হতে-হতে প্রায় বন হয়ে উঠেছে—বনস্পতি যেখানে গভীর ছায়া দিচ্ছে, পাখী যেখানে গাইছে, হরিণ যেখানে খেলছে, সেই বনফুলের পরিমলে ভরা পুরোনো বাগিচাটী চষে ফেলে যাত্রীদের জন্য রন্ধনশালা বসানো হবে। আমার যন্ত্রণা-ভোগের তখনও শেষ হয়নি—তাই ডবল তালা-দেওয়া ঘর দেখিয়ে বল্লেম—এটাতে কি? পাণ্ডা আস্তে আস্তে ঘরটা খুল্লে, দেখলেম মিণ্টন আর বরণ কোম্পানির টালি দিয়ে অত বড় ঘরখানা বোঝাই করা। ভাঙার মধ্যে—ধ্বংসের স্তূপে, রস আর রহস্য, নীল দুটি হরিণের মতো বাসা বেঁধে ছিল,—সেই যে শোভা, সেই শান্তি মনে ধরল না আমাদের। ভাল ঠেকল দু’খানা চকচকে রাঙা মাটির টালি। শিল্পে অধিকার জন্মালো না, চুপ করে বসে থাকা গেল—ঘেঁটে ঘুঁটে যা পেলাম তাই নিয়ে, সে ভাল। কিন্তু হঠাৎ মনে হলো শিল্প-সংস্কার করতে হবে, কিম্বা দ্বিতীয় একটা অজন্তা-বিহার কিম্বা তাজমহলেরই একটা inspiration-এর চোটে অম্বলশূলের বেদনার মতো বুকের ভিতরটা জ্বলে উঠ্‌লো, অমনি লাটিমের মতো ঘুরতে লেগে গেলাম বোঁ-বোঁ-শব্দে—শিল্প-সংস্কার, শিল্পের foundation stone স্থাপনের কাজে—এ হলেই মুস্কিল! যে ঘোরে তার ততটা নয়, কিন্তু শিল্প যেটা অনাদরে পড়ে রয়েছে এবং মানুষ যারা চুপচাপ রয়েছে নিজের ঘরে, তাদেরই ভয় আর মুস্কিল তখন! Inspiration অমন হঠাৎ আসে না! মনাগুনের জ্বালায়, অম্বলশূলের জ্বালায় ভেদ আছে। শিল্প-জ্ঞানের প্রদীপ হঠাৎ inspiration পেয়ে অমন রোগের জ্বালার মতো জ্বলে না, কাউকে জ্বালায়ও না, আগুন ধরিয়ে দিতে হয় সাবধানে—স্নেহভরা প্রদীপে, তবেই আলো হয় দপ্ করে। একেই বলে inspiration. Inspiration কি অমনি আসে? অর্জন করলেম না, শিল্প-inspiration আপনি এলো ভিক্ষুকের কাছে রাজত্বের স্বপ্নের মতো, এ হবার যো নেই। আমাকে প্রত্যয় না হয় তো এখনকার ইউরোপের মহাশিল্পী রোঁদাঁ কি বলেছেন দেখ— “Inscription! ah! that is a romantic old idea void of all sense. Inspiration will, it is supposed, enable a boy of twenty to carve a statue straight out of the marble block in the delirium of his imagination; it will drive him one night to make a masterpiece straight off because it is generally at night that these things occur. I do not know why….Craftsmanship is everything; craftsmanship shows thoughtful work; all that does not sound as well as inspiration, it is less effective, it is nevertheless the whole basis of art!” কিন্তু অর্জন নেই, inspiration এলো—গড়তে গেলেম তাজ, হয়ে উঠ্‌লো গম্বুজ; গড়তে গেলেম মন্দির, হয়ে পড়ল ইষ্টিসান বা সৃষ্টিছাড়া বেয়াড়া বেখাপ্পা কিছু! Inspiration এর খেয়াল ছোট বয়সে শোভা পায় আর শোভা পায় পাগলে। শিল্পের অধিকার নিজেকে অর্জন করতে হয়। পুরুষানুক্রমে সঞ্চিত ধন যে আইনে আমাদের হয় তেমন করে শিল্প আমাদের হয় না। কেননা শিল্প হলো ‘নিয়তিকৃতনিয়মরহিতা’; বিধাতার নিয়মের মধ্যেও ধরা দিতে চায় না সে। নিজের নিয়মে সে নিজে চলে, শিল্পীকেও চালায়, দায়ভাগের দোহাই তো তার কাছে খাটবে না। চুলোয় যাক্‌গে inspiration! সাধনা, অর্জনা ওসবে কি দরকার? টাকা ঢাললে বাঘের দুধও মেলে, শিল্প মিলবে না? কেনো ছবি, মূর্তি, বসাও মিউজিয়াম; খুলে দাও জাতীয় শিল্পের চেয়ার; সেখান থেকে তাপমান-যন্ত্রে প্রত্যেকের রসের উত্তাপের ডিগ্রি মেপে দেওয়া হোক্‌ ডিপ্লোমা; Library হোক রসশাস্ত্রের; স্কুল হোক্—সেখানে বসুক ছেলেরা চিত্রকারি, খোদকারি, নানা কারিগরি শিখতে; লিখতে লেগে যাক্ বড় বড় ‘থিসিস’ শিল্পের উপরে; ছাপা হয়ে চলে যাক্ সেগুলো ইংরাজীতে বিদেশে। আকাশের চাঁদকে পর্যন্ত ধরা যায় এমন বিরাট আয়োজন করে বসা যাক্, শিল্প সুড়্ সুড়্ করে আপনি আসবে। হায়, যে শিল্প বাতাসের ফাঁদ পেতে আকাশের চাঁদকে সত্যিই ধরে এনে খেলতে দিচ্ছে মানুষকে, তাকে তলব দেবো এমনি করে? হুজুরের তলব মজুরের উপরে? আর সে এসে হাজির হবে দুয়োরের বাহিরে জুতো রেখে দুহাতে সেলাম ঠুক্‌তে ঠুক্‌তে? আমেরিকা তার কুবের ভাণ্ডার খুলে দিয়ে পৃথিবীর শিল্প সামগ্রী নূতন পুরাতন সমস্তই আরব্য উপন্যাসের দৈত্যের মতো উড়িয়ে নিয়ে গেলো নিজের বাসায়। সেখানে সংগ্রহের বিরাট আয়োজন, চর্চারও বিরাট বিরাট বন্দোবস্ত, হাঁকডাকও বিরাট; কিন্তু সেখানে কল হলো, কারখানা হলো, আকাশ-প্রমাণ সব বাড়ী, যোজন-প্রমাণ সব সেতু আর বাঁধ উঠে বেঁধে ফেল্লে নায়াগ্রা নির্ঝর; কিন্তু সেই আয়োজনের পাহাড় এত উঁচু যে তার ওপারে কোথাও যে শিল্পীর আনন্দের নির্ঝর ঝরছে তা জানাই মুস্কিল হয়েছে তাদের—যারা আয়োজন করলে এত করে শিল্পকে জানতে! একথা আমার এক আমেরিকান বন্ধু জানিয়ে গেছেন—আমি বলছিনে। আমি যখন আমার মনকে শুধোই—এই এত আয়োজন, এই ছবি, মূর্তির সংগ্রহ, এই লেক্‌চার হল, শেখবার studio, পড়বার লাইব্রেরি, এর প্রয়োজন কোন্ খানটায়? কেনই বা এসব? মন আমার এক উত্তরই দেয়—হয়তো কোথাও একটি আর্টিষ্ট পরমানন্দের একটি কণা নিয়ে আমাদের মধ্যে বসে আছে, অথবা আসছে, কি আসবে কোনদিন—সুন্দর যে ভাবে এসে অতিথি হয় বিচিত্র রস, বিচিত্র রূপ আর গান নিয়ে, ষড়্ ঋতুর মধ্য দিয়ে—তারি জন্যে এই আয়োজন, এত চেষ্টা। যুগের পর যুগ ধরে আকাশ ঘনঘটার আয়োজন করেই চল্লো— কবে মেঘের কবি আসবেন তারই অাশায়। শতাব্দীর পর শতাব্দী লণ্ডন সহরের উপরে কুহেলিকার মায়াজাল জমা হতেই রইলো—কবে এক হুইস্‌লার এসে তার মধ্য থেকে আনন্দ পাবেন বলে। পাথর জমা হয়ে রইলো পাহাড়ে পাহাড়ে—এক ফিডিয়াস্, এক মাইলোস্, এক রোঁদাঁ, এক মেণ্ট্রোডিফ ব্রেজেস্কা এমনি জানা এবং দেশের বিদেশের অজানা artistদের জন্য। মোগলবাদশার রত্ন ভাণ্ডারে তিন পুরুষ ধরে জমা হতে লাগলো মণিমাণিক্য সোনারূপা—এক রাজশিল্পীর ময়ূর-সিংহাসন আর তাজের স্বপ্নকে নির্মিতি দেবে বলে। তেমনি যে আমরাও আয়োজন করছি, চেষ্টা করছি, শিল্পের পাঠশালা, শিল্পের হাট, কারুছত্র, কলাভবন—এটা-ওটা বসাচ্ছি সব সেই একটি আর্টিষ্টের একটি রসিকের জন্য—সে হয় তো এসেছে কিম্বা হয়তো আসবে।
অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর
শিল্পের সচলতা ও অচলতা অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর শিল্পের সচলতা ও অচলতা ছবি কবিতা অভিনয় যাই বল সেটা চল্লো কি না এই নিয়ে কথা। যে বীজের মধ্যে মাটি ঠেলে ওঠবার শক্তি না পৌঁছল সে বীজ ফল থেকে বেড়ে চলতে চলতে গাছ হতে চল্লো না, কবির ভাষা, ছবির ভাষা, গায়ক নর্তক অভিনেতা এদের ভাষার পক্ষেও ঐ কথা। যে ভাষা প্রয়োগ করছে সেই দেখছে মন দিয়ে লেখা তীরের মত সোজাসুজি চলে, কিন্তু অভিধান ইত্যাদি দিয়ে লেখা যতই ভারি করা যায়, শক্ত করা যায় ততই সে কচ্ছপের মতো আস্তে আস্তে চলে। অন্তরের শক্তি বীজকে ঠেলে নিয়ে চলে আলোর অভিমুখে রসাতল ভেদ করে’, ভাষাকেও গতি দেয় পরিপুষ্টতার দিকে মানুষের অন্তর বা মনের গুণ। দু’একটা উদাহরণ দিয়ে বোঝাচ্ছি, মনের গুণ ভাষাতে গিয়ে পৌঁছয় এবং কাযও করে কতকটা—মনে যেখানে ছবি কি ছাপ পরিষ্কার নেই সেখানে ছবির রেখাপাত বর্ণবিন্যাস সমস্তের মধ্যে একটা আবল্য আলস্য অস্ফুটতা আমরা দেখতে পাই, কবিতার বেলায়ও এটা দেখি কথার মধ্যে যেন ঝোঁক নেই ঝিমিয়ে আছে আবল তাবল বকে চলেছে ভাষা—প্রথম উদাহরণ— “ছার রিপু ছলেতে নাশ গো শীঘ্র শিবা ছাওয়ালেরে ছেড়ে দেহ কর মাগো কিবা। ছল ছল চক্ষু ছাড়ি ফাটেগো বন্ধনে ছট ফট করে প্রাণ ছাড়িবে কেমনে৷” ভাষায় ত্বরা নেই ঝিমিয়ে চলেছে কেননা কবির মন এখানে ‘ছ’ অক্ষরের ফাঁকিটা লিখতে ছ-প্রমুখ বাক্যগুলোকে পটের সেপাইয়ের মতো খালি প্রতি ছত্রের গোড়াতে স্থির ভাবে দাঁড়াতে হুকুম করলেন, কাযেই কথাগুলো নড়াচড়া কিছুই করলে না, কাঠের সেপাই কাঠ হয়ে ভাষার চলার পথ আগলে রইলো। খুব খানিক ঝোঁক দিয়ে এটা পড়ে যেতে চেষ্টা করলেই বুঝবে কতটা অচল এটা। অত্যাশ্চর্য অদ্ভুত রসের দেবতা হলেন ব্রহ্মা, তাঁর পুরী বর্ণন হচ্ছে— “কিবা মনোহর দেখিতে সুন্দর শোভে ব্রহ্মপুর সবার উপর। কনক রচিত মৃত্তিকা শোভিত পীযূষ পূরিত স্থির সরোবর॥ কল্পতরু তায় কিবা শোভা পায় ফল ধরে যায় ধর্ম মোক্ষ আদি। পত্র পুষ্প তার ভক্তি তত্ত্ব সার কেহ নাহি আর তাহাতে বিবাদি॥” মনের সমস্ত স্পর্শ ও সুরের সঙ্গে বিবাদ করে যেখানে বিবাদ বিসম্বাদ নেই এমন ব্রহ্মলোক বর্ণন হল—যেন সাত পুকুরের বাগান বাড়ীর ফটােগ্রাফ, তাও আবার অনেক খানি ঝাপ্‌সা, একটু অদ্ভুত রস পাওয়া যায় শুধু যেখানে কল্পবৃক্ষ গাছের ডালে ধর্ম মোক্ষ আর ভক্তিতত্ত্বের আম কাঁঠাল পেকে পেকে ঝুলছে! ভাষা চোস্ত হলে কি হয়, কথাগুলোকে তীরের মতে চালিয়ে দেবে যে গুণ তারি পরশ ঘটলো না মোটেই কবিতাটায়। খালি চোস্ত ভাষার দু একটা রূপ বর্ণন শুনিয়ে দিই, দেখ দেখি মনে গিয়ে পৌঁছয় কিনা— “ভবজ অনুজরথ, তা তলে বিনতা সুত কোরে কুমুদ বন্ধু সাজে হরি হরি সন্নিধানে অলি রস পূরে বাণে রমণী মুনির মন বান্ধে। খগেন্দ্র নিকটে বসি রাজেন্দ্র বাজায় বাঁশি যোগীন্দ্র মুনীন্দ্র মূরছায় কুন্তীর নন্দন মূলে কশ্যপ নন্দন দোলে মনমথ মনমথ তায়—’ মনে গিয়ে বাজলো না? আচ্ছা দেখ দেখি একটু মন দিয়ে— “কিশোর বয়স মণি কাঞ্চনে আভরণ ভালে চূড়া চিকন বনান হেরইতে রূপ, সায়রে মন ডুবল, বহু ভাগ্যে রহল পরাণ।” মনে ধরেও ধরছে না? শব্দভেদী বাণে কিছু হল না, ব্ৰহ্মাস্ত্রেও নয়, আচ্ছা এইবার উপরো-উপরি গোটা তিনেক শক্তি-শেল ছাড়ি, দেখি মনে পৌঁছয় কি না? “জিমুনা গো মুঞি জিমুনা—” মন যে হরিণের মতো এগিয়ে আসছে! তাহলে সুর সন্ধান করা যাক্ মন দিয়ে এইবারে— “মনের মরম কথা, তোমারে কহিয়ে এথা শুণ শুণ পরাণের সই। স্বপনে দেখিকু যে শ্যামল বরণ দে তাহা বিনু আর কারু নই৷” এইবার মন কি বলছে শুনতে পাচ্ছ কি? “রূপ লাগি আঁখি ঝুরে গুণে ঘন ভোর প্রতি অঙ্গ লাগি কাঁদে প্রতি অঙ্গ মোর হিয়ার পরশ লাগি হিয়া মোর কান্দে।” এইবার নিজের মনকে ফিরে ডাক, এই উত্তর পাও কি না বল— “রূপের পাথারে আঁখি ডুবি সে রহিল যউবনের বনে মন হারাইয়া গেল। ঘরে যাইতে পথ মোর হৈল অফুরান অন্তরে বিদরে হিয়া কি জানি করে প্রাণ।” মুখে বলে’ যাওয়া আর মনের সঙ্গে বলে যাওয়া কথায় লেখায় চলায় ফেরায় অনেকখানি ধরণ ধারণ সমস্ত দিক দিয়েই যে তফাৎ হয় তা কে না বলবে! মন যে রচনাকে ফাঁকি দিয়ে গেল, তাকে খুব সব জমকালো বাক্য মন্ত্র মধ্যম তার স্বর অথবা বং চং ঢং ঢাং শব্দকোষ অলঙ্কার ব্যাকরণ ইত্যাদির কৃত্রিম উপায়গুলো দিয়ে খানিক চালানো যেতে পারে না যে তা নয়, কিন্তু রঙীণ কাগজে প্রস্তুত খেলানা প্রজাপতির মত খানিক উড়েই ঝুপ করে পড়ে’ যায়। এই যে কবিতাটা হচ্ছে ‘করুণাময়ীর গালবাদ্য’, নাম শুনেই মনে হয় এতে অনেকখানি সুর তাল ইত্যাদি পাওয়া যাবে; কবিতাটা আরম্ভ হলো ঐ ভাবে—‘গালবাদ্য ঘন ঘন’ কিন্তু এইটুকু বলেই কবি আন্-মন হলেন, বাক্যশক্তি হারালেন, সুরের তার যেন পটাং করে ছিঁড়ে গেল, শোন,—“গালবাদ্য ঘন ঘন সজল-লোচন।” কোথায় বাদ্য কোথায় কান্না অকারণে! তারপর পতন ভূমিতে হঠাৎ—‘গালবাদ্য ঘন ঘন, সজল লোচন, প্রণাম যেমন বিধি’,—এমন গালবাদ্য কবিতা এইভাবে মনের সঙ্গে বিযুক্ত, শুধু কথার মারপেঁচ অভিধান অলঙ্কার নিয়ে কতটা কৃত্রিমভাবে গড়ে উঠলো দেখ— “গালবাদ্য ঘন ঘন সজল লোচন প্রণাম যেমন বিধি অর্দ্ধচন্দ্রাকৃতি প্ৰসীদ শঙ্কর বেদবিদাম্বর কৃপাময় গুণনিধি!” এইবাব সব ছেড়ে মনকে দিলেন কবি খালি শব্দ দিয়ে কিছু রচনা করতে, চমৎকার শব্দ দিলে ভাষা— “মহারুদ্ররূপে মহাদেব সাজে ভবম্ভম্ ভবম্ভম্ শিঙ্গা ঘোর বাজে লটাপট জটাজুট সংঘট্ট গঙ্গা ছলচ্ছল টলট্টল কলকলতরঙ্গা।” মনকে কবি চলতি ভাষার বাহনে চড়িয়ে ছেড়ে দিলেন, ভাষা ঝড় বইয়ে চল্লো এবারেও— “দশদিক অন্ধকার করিল মেঘগণ দুনো হয়ে বহে উনোপঞ্চাশ পবন।” পঞ্চাশ এই শব্দটা বাতাস ধূলো কাঁকর আর বৃষ্টির একটা ঝাপটা দিয়ে গেল, উনো দুনো শব্দ দুটো থেকে থেকে বাতাসের সুর শুনিয়ে গেল, তারপরে একে একে ঝম্ ঝম্ বৃষ্টি নাম্‌লো চেপে— “ঝনঝনার ঝনঝনি বিদ্যুৎ চকমকি হড়মড়ি মেঘের ভেকের মকমকি ঝড় ঝড়ি ঝড়ের জলের ঝরঝরি।” যদি আর্টিষ্টের মনের হাতে পড়ে, চলতি ভাষাও সাধু ভাষার বিনা সাহায্যেই এমন সুন্দর ভাবে চলতে পারে, তবে কালীঘাটের পটের ভাষাকে চলতি বলে তুচ্ছ করা তো যায় না। আর্টিষ্টের হাতে এই পটের ভাষা যে সুন্দর হয়ে উঠতে পারে না, তা কেমন করে বলা যায়! জাপানের প্রসিদ্ধ চিত্রকর হকুসাই এই পটের ভাষাতে যে চমৎকার চিত্র সব লিখে গেছেন তা আজকের ইউরোপ দেখে অবাক্ হচ্ছে। তাই বলি যে ভাষাই ব্যবহার করি না কেন, মনের হাতে তার লাগাম না তুলে দিয়ে তাকে চালিয়ে যাওয়া শক্ত। শব্দ সুর ছন্দ বাক্য রূপ ইঙ্গিত-ভঙ্গি—এরা ভাষাকে চালাবার মনকে বেঁধবার মহাস্ত্র বটে কিন্তু মনের হাতে এগুলো তুলে দেওয়া তো চাই। ধর ক্ষুরধার ছেনি ও গুরুভার হাতুড়ি নিয়ে বসা গেল পাষাণের অক্ষরে লিখতে, কিন্তু তার পূর্বে মন এঁচে নেয়নি কিছুই—বাটালি তেজে চল্লো, হাতুড়ি মহাশব্দে দিলে আঘাত; ফল হল, একটু পরে পাথর চূর্ণ-বিচূর্ণ হলো, নয় তো পাথর থেকে বেরিয়ে এল মনের অনির্দিষ্টতা ও শূন্যতা! বায়ু, যাঁর রূপ একেবারেই নেই ধ্বনি আছে, পদ নেই কিন্তু পদক্ষেপের চিহ্ন যিনি রেখে যান, অঙ্গ যাঁর দেখি না কিন্তু স্পর্শ করেন যিনি শীতল বা উষ্ণ, এই বায়ুকে রূপ দিয়ে নিরূপিত করা অন্যমনস্ক ভাবে তো যায় না। খালি ক্রিয়াপদ দিয়ে কখন পদ্য লেখা যায় না। কিন্তু এই ক্রিয়াপদ ছবিতে মূর্তিতে অভিনয়ে ঢের বেশি কাজ করে, কিন্তু এর সদ্ব্যবহার খুব পাকা আর্টিষ্টের দ্বারাই সম্ভব। রাফেল-প্রমুখ পুরাণো ইতালীর আর্টিষ্টরা ছবিতে বায়ু বইছে দেখাতে হলে আগে আগে ছবির আকাশপটে গোটাকতক গালফুলো ছেলে ফুঁ দিয়ে ঝাঁটার মতো খানিক ঝড় কি দক্ষিণ হাওয়া বইয়ে দিচ্ছে এইটে আঁকতো, কিন্তু বায়ুর যথার্থ রূপ এমন চালাকি দিয়ে ধরা না ধরা সমান, ওটা ছেলেমান্‌ষি ছাড়া আর কিছুই নয়। ভারত-শিল্পের বায়ু দেবতার মূর্তি—তাও আমাদের ইন্দ্র চন্দ্র বরুণের মতোই ছেলেমান্‌ষি পুতুল মাত্র। একই মূর্তি, একই হাবভাব, ভাবনার তারতম্য নেই। দেবমূর্তিগুলো তেত্ৰিশ কোটি হলেও একই ছাঁচে একই ভঙ্গিতে প্রায়শঃ গড়া, তারতম্য হচ্ছে শুধু বাহন মুদ্রা ইত্যাদির। একই বিষ্ণু যখন গরুড়ের উপরে তখন হলেন বিষ্ণু, সাতটা ঘোড়া জুড়ে দিয়ে হলেন সূর্য! একই দেবীমূর্তি, মকরে চড়া হলেই হলেন তিনি গঙ্গা, কচ্ছপে বসে’ হলেন যমুনা! বেদের ইন্দ্র চন্দ্র বায়ু বরুণের রূপকল্পনার মধ্যে যে রকম রকম ভাবনার ও মহিমার পার্থক্য, গ্রীকমূর্তি আপোলো, ভিনাস, জুপিটার, জুনো ইত্যাদির মূর্তির মধ্যে যে ভাবনাগত তারতম্য তা ভারতের লক্ষণাক্রান্ত মূৰ্তিসমূহে অল্পই দেখা যায়। একই মূর্তিকে একটু আসবাব রং চং আসন বাহন বদলে’ রকম রকম দেবতার রূপ দেওয়া হয়ে থাকে। বায়ু আর বরুণ, জল আর বাতাস দুটো এক নয়, দুয়ের ভাষা ও ভাবনা এক হতে পারে না। এ পর্যন্ত একজন গ্ৰীক ভাস্কর ছাড়া আর কেউ বায়ুকে সুন্দর করে, পাথরের রেখায় ধরেছে বলে আমার জানা নেই। এ মূর্তির একটা ছাঁচ আচার্য জগদীশচন্দ্রের ওখানে দেখেছি—গ্রীকদেবীর পাথরের কাপড়ের ভাঁজে ভাঁজে ভূমধ্য সাগরের বাতাস খেলছে চলছে শব্দ করছে—ছবি দেখে বুঝবে না, মূর্তিটা স্বচক্ষে দেখে এসো। এই যাঁর রূপ নেই অথচ ক্রিয়া আছে কথার ভাষায় সেই বায়ুকে দেবতাকে ক্রিয়া দিয়ে রূপ দিতে চেয়ে ঋষির মন যেমনি উদ্যত হলো বুক ফুলিয়ে, বাতাসের দুর্দমনীয় গতি পৌঁছলো অমনি ভাষায়; সে কতখানি তা ঋষির ভাষার অত্যন্ত বিশ্রী তর্জমাতেও ধরা পড়ে—“রথের ন্যায় যে বায়ু বেগে ধাবিত হন তাঁহাকে আমি বর্ণন করি, বজ্রধ্বনির ন্যায় ইঁহার ধ্বনি আবার ইনি বৃক্ষসমূহ ভগ্ন করিতে আসেন, ইনি দিক্ বিদিক্ রক্তবর্ণ করিতে করিতে শূন্যপথে গমনাগমন করেন, ধরণীর ধূলি বিকীর্ণ করিতে করিতে চলিয়া যান, পর্বতাদি যে কিছু স্থির পদার্থ তাহারা বায়ুর গতিবশে কম্পমান হইতে থাকে এবং ঘোটকীরা যেমন যুদ্ধে যায় তদ্রূপ এই বায়ুর প্রতি অভিগমন করে।” যুদ্ধের ঘোড়ার গতি নিয়ে কালিদাসেরও মনের ভাষা বার হয়েছিল বর্ষা-বৰ্ণনে— “সসীকরাম্ভোধরমত্তকুঞ্জরস্তড়িৎপতাকোঽশনিশব্দমদলঃ।” সমাগতো রাজবদুদ্ধতদ্যুতি র্ঘনাগমঃ কামিজনপ্রিয়ঃ প্রিয়ে॥ এই মনের উদ্দামগতি বাংলা ভাষাকেও তেজে চালিয়ে নিলে— “ঐ আসে ঐ অতি ভৈরব হরষে, জলসিঞ্চিত ক্ষিতিসৌরভ-রভসে, ঘনগৌরবে নবযৌবনা বরষা, শ্যামগম্ভীর সরসা॥” সারথির মানস রাশের মধ্য দিয়ে যেমন ঘোড়াতে গিয়ে পৌঁছয় তেমনি মনের ভাবনার সামান্য ইঙ্গিতও ভাষার মধ্যে দিয়ে চলাচল করে, তা সে ছবির ভাষা কবির ভাষা বা অভিনেতার কি গায়কের বা নর্তকের ভাষা, যে ভাষাই হোক। “The art of painting (নিরূপণ ও বর্ণনা-শিল্প সমস্তই) is perhaps the most indiscreet of all arts”—বাচন করা চলে ঢেকে ঢুকে আসল মনোভাব গোপন রেখে, কিন্তু বর্ণন করা চলে না সে ভাবে, যেমন, মেয়েটি কালো কিন্তু তার ঘটকালীটারও লোভ আছে বলে’ কন্যাকে ‘শ্যামাঙ্গী’ বলে’ বাচন করা গেল, কিন্তু তুলনায় বর্ণন করতে হলে মনের ভাব গোপন থাকা শক্ত, ধরা পড়ে যায় ঘটক। কথার যেটুকু বা বাচন করবার ফাঁক আছে ছবির তাও নেই; হুবহু বর্ণন, নয় মিথ্যা বর্ণন, দুই রাস্তা ছাড়া ছবির গতি নেই। ফটোগ্রাফ মেয়ের কালো রংটার বেলায় ফাঁকি দিয়ে চলে যেতে পারে, ছবি কিন্তু পারে না। সত্যি বলতেই হয় মনকে ছবিতে ধরবার বেলায়, এই জন্যই বলা হলো—“It is an unimpeachable witness to the moral state of the painter at the moment when he held the brush (শতং বদ মা লিখ) all the shades of his nature even to the lapses of his sensibility all this is told by the painter’s work as clearly as if he were telling it in our ears.”—Fromentin হাওয়া যেখানে নেই সেখানে শব্দ হয় না, জ্বালালেও আগুন ধরে ন, আলো যেখানে নেই রূপ সেখানে থেকেও নেই, তেমনি মন যেখানে নেই কথা সেখানে থেকেও নেই, মনে বেদন এল, নিবেদন হ’ল তবে ছবিতে কবিতায় নাট্যে৷ মন কার নেই? কিন্তু মনের কথা গুছিয়ে বলার ক্ষমতা যার তার নেই এটা ঠিক। ছাত্র পরীক্ষার দিনে খুব মনের আবেগ ও মনঃসংযোগ দিয়ে লিখছে; সে মন এক, আর সেই ছাত্রই দেশে গিয়ে যাত্রা জুড়েছে, কি মাঠে বসে মন দিয়ে বাঁশী বাজাচ্ছে, সে মন অন্য প্রকার। তেমনই সাধারণ মন আর রসায়িত মন, কবির মন আর্টিষ্টের মন আর তাদের হুঁকোবরদারের মন ও মনের আবেগে তফাৎ আছে। খুব খানিক মনের আবেগ নিয়ে লিখে কিম্বা বলে কয়ে চল্লেই কবি চিত্রকর অভিনেতা হয় তা নয়। অভিনেতা যদি মনের আবেগে কাণ্ডাকাণ্ডজ্ঞানহীনের মতো রুদ্রমূর্তিতে বেরিয়ে সত্যই দ্বিতীয় অভিনেত্রীর গলা কেটে বসে, তবে তাকে নট বলবে, না পাগল, মুর্খ এসব সম্বোধন করবে দর্শকরা! কিম্বা রঙ্গমঞ্চের নাচে দর্শকদের মধ্যে কেউ যদি মনের আবেগে মুগ্ধ হয়ে হঠাৎ কোমর বেঁধে নানা অঙ্গভঙ্গি সুরু করে দেয় তবে তাকে নটরাজ বলে’ ডাকে কেউ! অভিনেত্রী বেশ তাল লয় সুর দিয়ে কেঁদে চলেছে, হঠাৎ উপরের বক্স থেকে আবেগভরে ছেলে-কাঁদা ও ঘুম-পাড়ানো সুরু হলো, তার বেলায় শ্রোতারা ধমকে ওঠে কেন ছেলেকে ও ছেলের মাকে? মনের আবেগ তো যথেষ্ট সেখানে ভাষায় প্রকাশ হচ্ছিল কিন্তু বলে তো চল্লো না সেটা! তবেই দেখ শিল্পের অনুকূল আর তার প্রতিকূল এই দুই রকম মনের পরশ রয়েছে। মালি যেমন বেছে বেছে ফুল নেয়, ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে ফুলের তোড়া ফুলের হার গাঁথে, শিল্পীর মনের পরশ ঠিক সেইভাবে কায করে যায় বাক্য রং রেখা ভঙ্গি ইত্যাদিকে ভাবের সূত্রে ধরে’ ধরে’। নিছক আবেগের উচ্ছৃঙ্খলতা আছে, সংযম নির্বাচন এসব নেই। ছেলে কাঁদার ঠিক উল্টো যে পাকা নটীর কান্নার সুর কৃত্রিম সুরে হলেও সেটা মনোরম হয় শিল্পীর বর্ণন ভঙ্গি নির্বাচন ইত্যাদি নিয়ে। বাষ্পের মতো শুধু খানিক আবেগের সঞ্চয় নিয়ে ছবি বল আর লেখাই বল শিল্প বলে’ যে চলে না তার নমুনা এই— “কত আর সুখে মুখ দেখিবে দর্পণে, এ মুখের পরিণাম বারেক না ভাব মনে! শ্যাম কেশ পক্ব হবে, ক্রমে সব দন্ত যাবে, গলিত কপোল কণ্ঠ হবে কিছুদিনে; লোল চর্ম্ম কদাকার কফ কাশ দুর্নিবার, হস্ত পদ শিরঃকম্প ভ্রান্তি ক্ষণে ক্ষণে।” এর জুড়ি মূর্তি কতকটা সেই গান্ধারের কঙ্কালসার বুদ্ধ। জীবনকে কুশ্রী আর দীনতা দিয়ে যে শিল্পী নয় কবিও নয় তার ভাবা বিকট রকমে বীভৎসরূপে দেখালো। যাকে বলে inartistic reality তাই, এইবার যিনি কবি তিনি কি সুন্দর করে বল্লেন ঐ কথাটাই দেখ, এও reality কিন্তু কুশ্রী নয়, artistic reality যাকে বলে তাই— “মন তুমি কি রঙ্গে আছ, ভোলা মন, রঙ্গে আছ রঙ্গে আছ, তোমার ক্ষণে ক্ষণে ঘোরা ফেরা, দুঃখে রোদন সুখে নাচ। রংএর বেলা রংএর কড়ি, সোণার দরে তাও কিনেছ দুখের বেলা রতন মাণিক মাটির দরে তাও বেচেছ। সুখের ঘরে রূপের বাসা, সে রূপে মন মজে অাছ যখন সে রূপ হইবে বিরূপ, সে রূপের কি রূপ ভেবেছ!” “…There is true and false realisation, there is a realisation which seeks to impress the vital essence of the subject and there is a realisation which bases its success upon its power to present a deceptive illusion.”—(R. G. Hatton) কাঁচা অভিনেতা realismএর পথে গিয়ে নাটকের বিষয়টাকে তর্জন গর্জন করে’ যেন দর্শকের নাকের উপরে ছুঁড়ে ফেলে দিতে চলে, আর পাকা অভিনেতা শিল্পীর সংযম নিয়ে সেই বিষয়টাই দিয়ে যায় অথচ ফল হয় তাতে বেশি দর্শকের উপরে। এইজন্যই ঋষিরা বলেছেন, বাক্যকে মনের সঙ্গে যুক্ত কর—‘কায়েন মনসা বাচা’ ছবি লেখ কথা বল অভিনয় কর, সাফল্যলাভ করতে বিলম্ব হবে না। কথা তো বলতে পারে সবাই, চলেও সবাই রঙ্গে ভঙ্গে, ছবিও লেখে অনেকে, কিন্তু ভাষাকে পায় না সবাই—“যেমন প্রেম-পরিপূর্ণা সুন্দর-পরিচ্ছদধারিণী ভাৰ্যা আপন স্বামীর নিকট নিজ দেহ প্রকাশ করেন তদ্রূপ বাগ্দেবী কোন কোন ব্যক্তির নিকট প্রকাশিত হয়েন।” বাগ্দেবীর দেহ মন অতি বিচিত্র ভাষা সমস্ত নিয়ে যার কাছে অপ্রকাশিত রইল হাজারখানা nude studyতে তার কি ফল হবে? লজ্জার আবরণ ছেড়ে দিয়ে আধুনিক nude ছবির যে ভাষা, আর পাথরের অন্তঃপুর ছেড়ে নিরাবরণ নিরাভরণ বেরিয়ে এসেছিল গ্রীক ও ভারত শিল্পীর যে দেবীর মতো অনবগুণ্ঠিতা সুন্দরী তার যে ভাষা, দুয়ের কতখানি তফাৎ রয়েছে reality আর ideality নিয়ে বুঝে দেখ। ছবিকে কেবলি দেখা ও ভোগ করার রাজত্ব থেকে কথা ও ভাষার কোঠায় টেনে আনার সম্বন্ধে সবার মত হবে না। তাঁরা বলেন—কথা বল কবিতা বল উপকথা বল তার তো স্বতন্ত্র রাস্তা; আর্ট বর্ণমালার পুস্তক, নীতিশাস্ত্র কিম্বা কথামালা হতে বাধ্য নয়, একে সৌন্দর্য ও তার অনুভূতির রাস্তাতে চালানই ঠিক! একথা মানতেম যদি রূপের জগতে এমন বিশেষ পদার্থ একটা থাকতো যে নির্বাক নিশ্চল। বিন্দু, সে বলে আমি চোখের জল, শিশির-ফোঁটা, কত কি! মৃত্যু, সেও বলে আমি চলেছি আর ফিরবো না, গভীর সান্ত্বনা আমি, নিদারুণ আমি, সকরুণ আমি। ফুলের সঙ্গে ফুলদানীটাও যদি কথা না কইতো তবে কি তারা মানুষের মনে ধরতো? নির্বাক যে সেও ইঙ্গিতে বলে—আমি বলতে পারছিনে মন কি করছে! অবোধ যারা তারাই কেবল বাক্য থেকে বিচ্ছিন্ন এক অদ্ভূত আর্টের কল্পনাজাল বুনে বুনে নিজেকে ও নিজের শিল্পকে গুটির মধ্যে গুটিপোকার মতো বদ্ধ করে রাখতে চায়। শিল্প যে আনন্দ দেয় সেই আনন্দই তার ভাষা—আনন্দ-কাকলী আনন্দের দোলা— “কি আনন্দ, কি আনন্দ, কি আনন্দ! দিবারাত্রি নাচে মুক্তি নাচে বন্ধ।” মহাশূন্য, তার নিজের বাক্য দিয়ে সেও পরিপূর্ণ রয়েছে! বাক্যকে ছেড়ে চলতে পারে কি! বেদের বাগ্দেবীর উক্তি কি মহিমা নিয়ে অভ্রভেদী একটি মূর্তির মতো আপনাকে প্রকাশ করেছে দেখ—“আদিত্যগণ বিশ্বদেবতাগণ রুদ্রগণ এবং বসুগণের সহিত আমি বিচরণ করিতেছি। মিত্রাবরুণ, ইন্দ্র ও অগ্নি এবং অশ্বীদ্বয়কে আমি ধারণ করি। প্রস্তরাঘাত হইতে উৎপন্ন যে সোমরস তাহাকে তষ্টাকে পুষণকে ভাগকে আমি ধারণ করি……যজ্ঞোপযোগী উপকরণ-সমূহের মধ্যে প্রথমা আমি।…এতাদৃশা আমাকে দেবতারা নানাস্থানে সন্নিবেশিত করিয়াছেন, অপরিমেয় আমার আশ্রয়স্থানে তাবৎ প্রাণিগণের মধ্যে আমি আবিষ্ট আছি।……যিনি দর্শন করেন প্রাণ ধারণ করেন কথা শ্রবণ করেন তিনি আমারই সহায়তাতে সেই সকল কার্য করেন……আমি দ্যুলোকে ও ভূলোকে আবিষ্ট হইয়া আছি……আমি আকাশকে প্রসব করিয়াছি…সমুদ্রের জলের মধ্যে আমার স্থান, সেই স্থান হইতে সকল ভুবনে বিস্তারিত হই; আপনার উন্নত দেহ দ্বারা এই দ্যুলোককে আমি স্পর্শ করি। আমিই তাবৎ ভুবন নির্মাণ করিতে করিতে বায়ুর ন্যায় বহমান হই। আমার মহিমা বৃহৎ হইয়া দ্যুলোককেও অতিক্রম করিয়াছে পৃথিবীকেও অতিক্রম করিয়াছে…॥” বিরাট এই বিশ্বচরাচর, যার প্রাণী বিশাল, অতি বৃহৎ যার রূপ, তার এই মূর্তি! অতি পুরাতন ঈজিপ্টের ভাস্কর কঠিন প্রস্তরে যে বিরাটত্ব আর বিশালত্ব দিয়ে আপনার দেবদেবীর মহিমা কীর্তন করেছে তারি তুল্য-মূল্য শিল্প এই স্তোত্র-রচনার ভাস্কর ভাষা দিয়ে ধরে রেখেছে। এর পাশে রঙীণ রাংতা জড়ানো পাকাটির বীণা হাতে আমাদের এখনকার খেলার সরস্বতীর মূর্তিটি ধরে দেখ কিম্বা একটা তুলসী-মঞ্চের উপরে সাজানো শ্বেত পাথরের এতটুকু ভিনাস মূর্তিকেও ধরে দেখ, মূর্তি-শিল্পের ভাষা হিমালয়ের ঊর্ধ্ব থেকে উইঢিবিতে এসে পড়ে কি না! চটক এবং চাকচিক্যময় ক্ষণিক পদার্থটার উপভোগের অনিত্যতার উপরে, কিম্বা ক্ষণিক শ্রুতিসুখ দৃষ্টিসুখ ইত্যাদির উপরে শিল্পরচনার ভাষাকে প্রতিষ্ঠা করলে বাণীকে নামিয়ে দেওয়া হয় আকাশ থেকে রসাতলে, যেমন— “… রূপ নিরুপম সোহিনী শারদ পার্ব্বণ—বিধুবরানন, পঙ্কজ কানন মোদিনী। কুঞ্জর-গামিনী-কুঞ্জ-বিলাসিনী, লোচন খঞ্জন-গঞ্জিনী। কোকিল নাদিনী, গীঃ পরিবাদিনী, হ্রীঃ পরিবাদ-বিধায়িনী। ভারত-মানস মানস-সরস, বাস বিনোদ বিধায়িনী।” এর থেকে আর একটুখানি নামলেই কেবল সুর সার বাক্য রেখা রং ইত্যাদি দিয়ে মনের চোখে কানে সুড়সুড়ি দেওয়া— “নাহি তালবোধ ভাল, নিত্য ধ্বংস কারক। চিত্ত মর্ম্ম, ধর্ম্মকর্ম্ম, মর্ম্ম বোধ জারক।” চতুরশীতি লক্ষ জন্মের তপস্যালব্ধ জীবনটা নিয়েই মানুষ যখন ছিনিমিনি খেলে বেড়াচ্ছে, তখন যুগযুগান্তরের তপস্যা দিয়ে কত মহৎ জীবনের ব্যর্থতার দুঃখ থেকে সার্থকতার আনন্দ দিয়ে লাভ করা ভাষাসমূহকে নিয়ে মানুষ যে নয়-ছয় করে খেলা করবে তার বাধা কি? শিল্পরূপিণী সুন্দরী ভাষাকে পেতে তপস্যার দুঃখ আছে—“art interprets the mightier speech of nature. It is a poetical language for it is an utterance of the imaginated addressed to the imaginated and to rouse emotion”—(Gilbert) অনাহতের ধ্বনি ব্যক্ত করে যে ভাষা, অরূপের ইঙ্গিত ও রূপ দর্শন করার যে ভাষা, নিশ্চল নির্বাক পাষাণকে চলায় বলায় যে ভাষা, তাকে বিনা সাধনায় মনে করলেই কি কেউ পেয়ে থাকে! ভাষা যখন তপোবনের ঋষিদের তপস্যার সামগ্ৰী, তখন তারা যে কোন দুর্ভেদ্যতার দুর্গ থেকে বাণীকে জয় করে’ এনেছিলেন তা তাঁরা জানিয়ে গেছেন—“সোমরস নিপীড়ন করিতে করিতে এই প্রস্তর সকল কথা কহুক, আমরাও কথা কহি, ইহারা কথা বলিতেছে, ইহাদের কথায় কথা কও…ইহারা শব্দ করিতেছে……ইহাদের শব্দে পৃথিবী ধ্বনিত হইতেছে…ইহাদের শব্দ শুনিয়া জ্ঞান হয় যেন পক্ষীরা আকাশে কলরব করিতেছে……তৃণভূমিতে কৃষ্ণসার হরিণেরা যেন চলাচল করিয়া নৃত্য করিতেছে……সোমরস নিপীড়ন-কালে প্রস্তরেরা শব্দ করিতেছে, যেন ক্রীড়াভূমিতে ক্রীড়াসক্ত শিশুরা জননীকে ঠেলিয়া ঠেলিয়া কোলাহল করিতেছে।” ভাষার তপস্যায় বলীয়ান্ মানুষ পাথরের কারাগার থেকে বার করে’ নিয়ে এলো যে ভাষাকে, চিরসুধাময়ী রসের নির্ঝরিণী তারি চতুঃষষ্টি ধারা হ’ল—কথা, ছবি, মূর্তি, নাটক, সঙ্গীত, নৃত্য ইত্যাদি কলাবিদ্যা।
অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর
সন্ধ্যার উৎসব অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর সন্ধ্যার উৎসব “আশ্বিনে অম্বিকা পূজা বলি পড়ে পাঁঠা, কাৰ্ত্তিকে কালিকা পূজা ভাই-দ্বিতীয়ার ফোঁটা। অঘ্রাণে নবান্ন দেয় নতুন ধান কেটে, পৌষ মাসে বাউনী বাঁধে ঘরে ঘরে পিঠে। মাঘ মাসে শ্রীপঞ্চমী ছেলের হাতে খড়ি, ফাগুন মাসে দোলযাত্রা ফাগ ছড়াছড়ি। চৈত্র মাসে চড়ক সন্ন্যাস গাজনে বাঁধে ভারা, বৈশাখ মাসে তুলসী গাছে দেয় বসুধারা। জ্যৈষ্ঠ মাসে ষষ্ঠীবাটা জামাই আনতে দড়, আষাঢ় মাসে রথযাত্রা যাত্রী হয় জড়। শ্রাবণ মাসে ঢেলা ফেলা ঘি আর মুড়ি, ভাদ্র মাসে পচা পান্তা খায় মনসা বুড়ি।” এই তো আছে বার মাসই। এর উপর ফাঁকে ফাঁকে আরো উৎসব এখন ঢুকেছে। যেমন শোক-সভার উৎসব, স্মৃতি-সভার উৎসব,—এ-যে সভার সাম্বৎসরিক উৎসব। এর উপরে জেলে যাবার উৎসব, হরতালের উৎসব তাও আছে ঘরে বাইরে। যে দেশে এত উৎসব সে দেশের ছেলেরা, বুড়োরা, যুবোরা—আনন্দ সাগরের কুলে গিয়ে ওঠার কথা তো তাদের এতদিন। কিন্তু আনন্দের বদরিকাশ্রম দূরের কথা—এই অফুরন্ত আনন্দের মাঝে একটু চড়া পড়ে গেছে বলেও তো মনে হচ্ছে না। এ এক রকম আনন্দের ভাসান—ভাঙ্গা নৌকার কাঠ ঠিক এই ভাবে চলে স্রোতে গা ভাসিয়ে, কোথায় যায় সে তা নিজেই জানে না। একই তালে চলে সে দুলতে দুলতে, চলার তার বৈচিত্র্য নেই লক্ষ্য নেই কেবলি জোয়ারে খানিক এগিয়ে চলা ভাঁটায় আবার দ্বিগুণ বেগে ফিরে আসা যেখানকার সেখানে। জীবন্ত জিনিষের উৎসব করে চলার মধ্যে বৈচিত্র্য থাকে। ঋতু-চলাচলের সঙ্গে কালের চলাচলের সঙ্গে গাছ পালারা তাল মিলিয়ে চলে। গাছের পাখী আকাশের মেঘ, সকাল-সন্ধ্যার গ্রহ-তারা তাল মিলিয়ে চলে। না হলে হয় বেতালা—বেতালে উৎসব মাটি হয়। কালভেদে দেশভেদে বিভিন্ন রকমে উৎসব করে’ চলার রহস্যটি পেয়েছে মানুষ এই পৃথিবীতে এসে—গাছেদের কাছ থেকে আকাশের কাছ থেকে এবং যে মাটিতে সে ভূমিষ্ঠ হয়েছে তার কাছ থেকে। মাটির বুকের তালে তাল রেখে যে চলতে পারে না, সে খুঁড়িয়ে চলে কিম্বা পড়ে যায় ধুপ্‌ করে মাটিতে। বাতাসের তালে তাল দিয়ে চলতে যে পাখীর ডানা না চায় সে উঁচুতে উড়তে পারেই না। ডানা ঝট্‌পট্‌ করে’ হয় মরে’ যায়, নয় তো পাখী থাকে না, খাঁচায় বাঁধা পড়ে। খায় দায় আর বনের দিকে চায়—“খায় দায় পাখীটি বনের দিকে আঁখিটি”। এই ভাবে অবিচিত্র দিনের অনুৎসবের অনুৎসাহের মধ্য দিয়ে যেতে যেতে হঠাৎ একদিন তার পক্ষিলীলা সাঙ্গ হয়ে যায়। জীয়ন্তে মরা থেকে মুক্তি পেয়ে সে শেষে হাঁফ ছেড়ে বাঁচে। খাঁচার পাখী পড়তে বল্লে পড়ে, শিষ দিলে গান গায়; কিন্তু তাতে বলতে পারিনে পাখী উৎসব করেছে। তেমনি হুকুম মতো হয় হস্‌টেল বল আর হস্‌টেলের বাইরেই বল আমাদের উৎসব—এইবার পড়, এইবার গাও, এইবার খাও, এইবার সভার রিপোর্ট দাও, এইবার শোক প্রকাশ কর, এইবার স্মৃতি রক্ষা কর— এইভাবে দেশযোড়া একটা খাঁচার মধ্যে আমাদের নিয়ে কে যে খেলাচ্ছে তা বুঝিনে। শুধু বুঝি সুর লাগছে না, তালে ঠিক পা পড়ছে না, কোন রকমে চলেছি—হুকুমে উঠে’-বসে’ পড়ে’-শুনে’ হেসে’-খেলে’। আমাদের ছেলে-বুড়োর শিক্ষা-দীক্ষা উন্নতি অবনতি নিয়ে কত বিষয়ে কতদিকে লোক কত মাথা ঘামাচ্ছে এবং তাতে তারা আনন্দও পাচ্ছে। পাখী পড়িয়ে আনন্দ, পাখীকে শিষ দিয়ে ডেকে গাইয়ে আনন্দ, খাইয়ে আনন্দ, শুইয়ে ঘুম পাড়িয়ে আনন্দ, কিন্তু পাখীর কিসে আনন্দ তা তো দেখে না কেউ। দাঁড়ের পাখীর কোন আনন্দ নেই শিকল কাটার আনন্দটুকু ছাড়া, এটা তো কর্তারা বোঝে না—বড় বড় রিপোর্ট লিখে চলে খাঁচার পাখীর সু ও কু ব্যবহার সম্বন্ধে এবং তাতেই তারা আনন্দ পায়। বারোমাস বেঁধে মার দিয়ে পাঁজিপুঁথি দেখে ছুটি নেওয়া গেল উৎসব করতে। এ যে আজকের নিয়ম হয়েছে তা নয়; এ নিয়ম এ দেশে বরাবরই চলে আসছে। বসন্তের হাওয়া না লাগলেও বাসন্তী পূজো পাঁজির ঠিক দিন ক্ষণ দেখে আসছে দেশে বছরের পর বছর কত যুগ ধরে’ তার ঠিক নেই। যদি বল বসন্তের ঋতু সেও তো ঠিক মাস ধরে’ আসে। আসে বটে, কিন্তু পাঁজির গণনা কিম্বা ঘড়ির কাঁটা ধরে’ আসে না। বরাবর দেখি গাছের পাতাগুলো হঠাৎ সবুজ হয়ে ওঠে, হঠাৎ কোকিল পাপিয়া দূরদেশ থেকে এসে গান ধরে। উত্তর থেকে বাতাস ফিরে যায় দক্ষিণে হঠাৎ, আবার চলেও যায় হঠাৎ, বসন্তকালের আসর ভেঙ্গে যায়, ফুলের ডালা নুয়ে পড়ে, রোদ ঝাঁ ঝাঁ করতে থাকে, নদী শুকিয়ে ওঠে, আকাশে আগুন লেগে যায় দেখতে দেখতে। দিন যেন আর কাটে না। যখন তখন হঠাৎ আকাশ ঢেকে মেঘ আসে ঝড় আসে বাতাস বয় ঢল নামে নদীতে। আনন্দের বন্যা ছোটে বর্ষা নামে জল ঝরে জল-ঝড়ে। তারপর আকাশ হঠাৎ নীল চোখ মেলে চায় পৃথিবীর দিকে। সোনায় লেখা সবুজ সাড়ি পরে পৃথিবী চলে দিগন্তে উৎসব করতে, তারপর শিশির ঝরে পাতায় পাতায়, হিমের পরশ লাগে, শিউরে ওঠে বাতাসের মন অচেনা হাতের ছোঁয়া পেয়ে, কোকিল গান ধরে—উহু উহু। এই উৎসব তো হচ্ছে ফিরে ফিরে কতকাল কিন্তু এ তো তবু পুরোনো হয় না অবিচিত্র হয় না, বেসুরো বেতালা হয় না আমাদের বারো মাসে তেরো এবং তার চেয়ে বেশি পাৰ্ব্বণের উৎসবের মতো। এ যে প্রকৃতির উৎসব বা প্রকৃত উৎসব, এ নিত্যকাল ধরে চলেছে, চলবে ঋতু চক্রের চিহ্ন ধরে। সে কেন নতুন নতুন কবিকে নতুন নতুন শিল্পীকে নতুন শোভা নতুন রস দিয়ে মুগ্ধ করে, চলে—তার কারণ সন্ধান করে দেখি যে, উৎসব যা হ’চ্ছে তা স্বাভাবিক। তার মধ্যে নিয়ম একটা আছে কিন্তু বিচিত্রতায় সেটা ঢাকা। সেই নিয়মের ঠাট এমন ভাবে লুকানো থাকে যে বোঝাই যায় না। উৎসবের ধারার হিসেব আজ যেটা নিলেম সেটা কাল আবার তেমনি ভাবে থাকবে কি না, কিম্বা আমি যেমন হিসেবটা দেখলেম অন্যের চোখে উৎসবটার হিসেব সেই ভাবে পড়বে কি না তা বলা যায় না। এই হ’ল স্বভাবের নিয়মে উৎসবের রহস্য। কিন্তু মানুষের উৎসবের আমরা যে ভাবে নিয়ম বেঁধে দিয়েছি, তাতে করে’ ঐ অম্বিকা পূজা থেকে মনসা পূজার আনন্দ যেমন আজকের আমাদের কাছে পুরোনো হয়ে পড়ছে, আমাদের এখনকার উৎসবগুলোও ঠিক সেই দশা পাবে, পেয়ে বসে’ আছে। দপ্তরীর বাড়ির রুলটানা খাতার শোভা খাতার প্রথম পাতা দেখলেই বোঝা গেল, আর দেখতে হয় না নিরেনব্বই খানা পাতায় কি আছে। কিন্তু ভাল গল্পের বই, তারও সোজা ফর্মাবাঁধা হিসেবমতো চেহারা, কিন্তু বিচিত্রভাব বিচিত্র রস এসে তার প্রত্যেক পৃষ্ঠা রহস্যপূর্ণ ও বিচিত্র করে’ দেয়, কোন বই এক পাতা উল্টেই ফেলে দিই কোনটা বা শেষ হয়ে গেলেও ভাবি আরো হ’লে হ’ত। ভাল গানেও এই, বার বার শুনলেও মন চায় আবার শুনি, ভাল ছবি, তার বেলাতেও এই; এবং সব প্রকৃত জিনিষের মধ্যে এই গুণটি আছে। এবং এই জন্য বাঙলার ইতিহাসের চেয়ে ভাল বাঙলা উপন্যাস ছেলে মেয়েরা কিনে পড়ে জলখাবারের পয়সা বাঁচিয়ে। হস্‌টেলের কেউ ভাল নভেল কিনলে কিছুদিন ধরে’ সন্ধ্যেবেলা একটা যেন উৎসব পড়ে’ যায় সেখানে। আবার নভেল পড়া এবং উৎসব করা দুই যখন বাতিকে দাঁড়ায় তখন আর ভালমন্দ কাণ্ডাকাণ্ড জ্ঞান থাকে না—একটা কিছু হ’লেই হ’ল এই ভাব দাঁড়ায় তখন। আমাদের সমস্ত কাণ্ড-কারখানা আমোদ-আহ্নাদ যেমন-তেমন হ’চ্ছে, যেমনটি হওয়া উচিত তেমনিটি হচ্ছে না; তার কারণ উৎসবের বাতিক চেগেছে এমন বিষম রকম—দেশে যে উৎসবের বাতি কেমন জ্বল্লো সেদিকে নজর দেবার সময়ই নেই। সময়ে সময়ে দেশে মরার ও জেলে গিয়ে পচবার উৎসব পড়ে যায়। সঙ্গে সঙ্গে বাতিক চাগে আমাদেরও মরালোকের শ্রাদ্ধ বাসর সাজাবার এবং জেলের মধ্যে দুগ্‌গোপূজো লাগাবার। উৎসাহটাই যে উৎসবের জনয়িতা তা তো নয়, রক্ত যখন অতিরিক্ত রকম উৎসাহে চলাচল করছে মস্তিষ্কে— তখন বুঝতে হবে জ্বর এল বলে’, নয় জ্বরের চেয়ে ভয়ঙ্কর কিছু ঘটলো বলে’৷ হঠাৎ খেয়াল হ’ল একটা সাম্বৎসরিক কি সম্মিলনী কি আরকিছু খুব ধূমধামে করতে হবে, তখনি ছুটোছুটি পড়ে গেল বক্তা ধরতে ষ্টেজ বাঁধতে, বাদ্যি জোগাড় করতে। এ তে স্বাভাবিক অবস্থার কায নয়। স্বভাবের নিয়মে বসন্ত কালের উৎসব মনে হয় বটে হঠাৎ সুরু হ’ল, কিন্তু এটা ভুল্লে চলবে না যে কোকিলকে এই উৎসবে আসতে হবে বলে’ ফাল্গুন মাস আসবার দশ এগারো মাস আগে থেকে সে গলা সাধছিল এমন গোপনে যে বাতাসও টের পায়নি। গাছগুলো লুকিয়ে লুকিয়ে শীতকাল ভোর পাতা ফুল কত কি জোগাড় করে’ রেখেছে। উৎসবের ঢের আগে বসে’ যায় বোধন, তাই সুন্দর হয় উৎসব এবং তার রেশ চলে অনেক দিন ধরে’ বাতাসের মধ্যে ঝরা বাসি ফুলের সৌরভের মতো। এই স্বাভাবিক ছন্দে যে উৎসব হয় সেই উৎসব ঠিক উৎসব, শিক্ষা-দীক্ষা সমস্তই স্বাভাবিক অবস্থা না পেলে দেশে উৎসবের বাঁশি বাজবে না বাজবে না’ তা যতই কেন ফুলুটে ফুঁ দাও না, যতই কেন হারমোনিয়মের হাপর জোরে টিপে সুরের আগুন জ্বালাতে চাও না। বাঁশী বলবে না বাতি জ্বলবে না। সন্ধ্যার উৎসব আরতিটা এমনতরো হঠাৎ আয়োজন তো নয়, সেখানে সারাবেলার আয়োজন মেলে গিয়ে সারা রাতের আয়োজনের সঙ্গে। আকাশে তাই তো অতখানি রং লাগে, বাতাসে অতটা সুর ভরে— দিনে রাতে মিলিয়ে দেওয়ার গান রংএ রংএ ওই আকাশে লুকিয়ে ভাসে বাতাস ব’য়ে সেই তো আসে, বাঁশী ডাকে দেয় সে ধরা সুরে সুরে। এই বাতাস এ লুকিয়ে রাখে বেণু বনের তলায় তলায় আলো ছায়ায় মিলিয়ে দেওয়া গান, বাঁশী তারে ধরে সুরের ফাঁসে এই বাতাসে।
অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর
সৌন্দর্যের সন্ধান অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর সৌন্দর্যের সন্ধান সুন্দরের সঙ্গে তাবৎ জীবেরই মনে ধরার সম্পর্ক, আর অসুন্দরের সঙ্গে হ’ল মনে না ধরার ঝগড়া। ইমারতে ঘেরা বন্দিশালার মতো এই যে সহরের মধ্যে এখানে ওখানে একটুখানি বাগান, অনেকখানিই যার মরা এবং শ্রীহীন, এদের পাখী প্রজাপতির মনে ধরেছে তবেই না এরা এই সব বাগানে বাসা বেঁধে এই ধূলোমাখা রোদে সকাল সন্ধ্যে ডানা মেলে সুরে ছন্দে ভরে’ তুলছে সহরের বুকের আবদ্ধ অফুলন্ত স্থানটুকু! আর এই সব বাগানের ধারেই রাস্তায় বসে’ খেলছে ছেলেরা—শিশুপ্রাণ তাদের মনে ধরেছে বাগানের ফুলকে ছেড়ে রাস্তার ধূলো মাটি, তাই তো খেলছে ওরা ধুলোকে নিয়ে ধূলোখেলা! রথের দিনে রথো সামগ্ৰী—সোলার ফুল পাতার বাঁশি—তার সুর আর রং আর পরিমল ছড়িয়ে পড়েছে বাদলার দিনে—রথতলার আর খেলাঘরের ছেলে বুড়োর মেলায়, তাই না আজ দেখছি নিজেদের ঘর সাজাচ্ছে মানুষ সোলার ফুলে মাটির খেলনায়! তেমনি সে আমার নিজের কোণটি, দেওয়ালের ফাঁকে ভাঙ্গা কাচের মতো এক খণ্ড আকাশ—ময়লা ঝাপ্‌সা প্রাচীরে ঘেরা চারটিখানি ঘাস চোর-কাঁটা আর দোপাটি ফুলের খেলাঘর, সবই মনে ধরেছে আমার, তাই না কোণের দিকে মন থেকে থেকে দৌড় দিচ্ছে, চোর-কাঁটার বনে লুকোচুরি খেলছে, নয় তো দোপাটি ফুলের রংএর ছাপ নিয়ে লিখছে ছবি, স্বপন দেখছে রকম রকম, আর থেকে থেকে ঠিক নাকের সামনে মাড়োয়ারিদের আকাশ বাতাস আড়াল করা তেতলা পাঁচতলা বাড়ীগুলোর সঙ্গে আড়ি দিয়ে বলে’ চলেছে বিশ্ৰী বিশ্ৰী বিশ্ৰী! মাড়োয়ারি গৃহস্থরা কিন্তু ওদের পায়রার খোপগুলোকে সুন্দর বাসা বলেই বোধ করছে এবং তাদের নাকের সামনে আমাদের সেকেলে বাড়ী আর ভাঙ্গাচোরা বাগানকে অসুন্দর বলছে! কাযেই বলতে হবে আয়নাতে যেমন নিজের নিজের চেহারা তেমনি মনের দর্পণেও আমরা প্রত্যেকে নিজের নিজের মনোমতকে সুন্দরই দেখি। কারু কাছ থেকে ধার করা আয়না এনে যে আমরা সুন্দরকে দেখতে পাবো তার উপায় নেই। সুন্দরকে ধরবার জন্যে নানা মুনি নানা মতো আরসী আমাদের জন্যে সৃজন করে গেছেন, সেগুলো দিয়ে সুন্দরকে দেখার যদি একটুও সুবিধে হতো তো মানুষ কোন্ কালে এই সব আয়নার কাচ গালিয়ে মস্ত একটা আতসী কাচের চশমা বানিয়ে চোখে পরে’ বসে’ থাকতো, সুন্দরের খোঁজে কেউ চলতো না; কিন্তু সুন্দরকে নিয়ে আমাদের প্রত্যেকেরই স্বতন্ত্র স্বতন্ত্র ঘরকন্না তাই, সেখানে অন্যের মনোমতকে নিয়ে থাকাই চলে না, খুঁজে পেতে আনতে হয় নিজের মনোমতটি। জীবের মনস্তত্ত্ব যেমন জটিল যেমন অপার, সুন্দরও তেমনি বিচিত্র তেমনি অপরিমেয়। কেউ কাযকে দেখছে সুন্দর সে দিন-রাত কাযের ধন্ধায় ছুটছে, কেউ দেখছে অকাযকে সুন্দর সে সেই দিকেই চলেছে, কিন্তু মনে রয়েছে দুজনেরই সুন্দর কায অথবা সুন্দর রকমের অকায! ধনী খুঁজে ফিরছে তার সর্বস্ব আগ্‌লাবার সুন্দর চাবি-কাটি, বিশ্ৰী তালা-চাবি কেউ খোঁজে না—আর দেখ চোর সে খুঁজে বেড়াচ্ছে সন্ধি কাটবার সুন্দর সিঁদ! ভক্ত খুঁজছেন ভক্তিকে, শাক্ত খুঁজছেন শক্তিকে আর নর খোঁজে গাড়ী জুড়ি বি-এ পাশের পরেই বিয়েতে সোনার ঘড়ি এবং তার কিছু পরেই চাকরী এবং এমন সুন্দর একটি বাসাবাড়ী যেখানে সব জিনিষ সুন্দর করে’ উপভোগ করা যায়। হাহুতাশ কচ্ছেন কবি কল্পনালক্ষ্মীর জন্যে এবং ছবি-লিখিয়ের হাহুতাশ হচ্ছে কলালক্ষ্মীর জন্যে, ধরতে গেলে সব হাহুতাশ যা চাই সেটা সুন্দরভাবে পাই এই জন্যে, অসুন্দরের জন্যে একেবারেই নয়। সুন্দরের রূপ ও তার লক্ষণাদি সম্বন্ধে জনে জনে মতভেদ কিন্তু সুন্দরের আকর্ষণ যে প্রকাণ্ড আকর্ষণ এবং তা আমাদের প্রত্যেকের জীবনের সঙ্গে নিগূঢ়ভাবে জড়ানো সে বিষয়ে দুই মত নেই। যে ভাবেই হোক যা কিছু বা যারই সঙ্গে আমরা পরিচিত হচ্ছি তার দুটো দিক আছে—একটা মনে ধরার দিক যেটাকে বলা যায় বস্তুর ও ভাবের সুন্দর দিক, আর একটা মনে না ধরার দিক যেটাকে বলা চলে অসুন্দর দিক, আমাদের জনে জনে মনেরও ঐ দুরকম দৃষ্টি—যাকে বলা যায় শুভ আর অশুভ বা সু আর কু দৃষ্টি। কাযেই দেখি, যে দেখছে তার মন আর যাকে দেখছে তার মন—এই দুই মন ভিতরে ভিতরে মিল্লো তো সুন্দরের স্বাদ পাওয়া গেল, না হলেই গোল। রাধিকা কৃষ্ণকে সুরূপ শ্যামসুন্দর দেখেছিলেন, তারপর অনঙ্গভীমদেব এবং তারপর থেকে আমাদের সবার কাছে রূপকসুন্দর ভাবে কৃষ্ণ এলেন, এই দুই মূর্তিই আমাদের শিল্পে ধরা হয়েছে, এখন কোন্ সমালোচকের সৌন্দর্য সমালোচনার উপর নির্ভর করে’ এই দুই মূর্তির বিচার করবো? আ-কা-শ এই তিনটে অক্ষরে আকাশ জ্ঞানটাই রূপকের দল বলবে ভাল, কিন্তু রূপের সেবক তারা বলবে ‘নব-নীরদ-শ্যাম’ যা দেখে চোখ ভুল্লো মন ঝুরলো, যার মোহন ছায়া তমাল গাছে যমুনার জলে এসে পড়লো সেই সুন্দর। সুন্দর অসুন্দর সম্বন্ধে শেষ কথা যদি কেউ বলতে পারে তো আমাদের নিজের নিজের মন। পণ্ডিতের কাযই হচ্ছে বিচার করা এবং বিচার করে দেখতে হলেই বিষয়কে বিশ্লেষ করে দেখতে হয়, সুতরাং সুন্দরকেও নানা মুনি নানা ভাবে বিশ্লেষ করে দেখেছেন, তার ফলে তিল তিল সৌন্দর্য নিয়ে তিলোত্তমা গড়ে’ তোলবার একটা পরীক্ষা আমাদের দেশে এবং গ্রীসে হয়ে গেছে, কিন্তু মানুষের মন সেই প্রথাকে সুন্দর বলে’ স্বীকার করেনি এবং সেই প্রথায় গড়া মূর্তিকেই সৌন্দৰ্য-সৃষ্টির শেষ বলেও গ্রাহ্য করেনি। বিশেষ বিশেষ আর্টের পক্ষপাতী পণ্ডিতেরা ছাড়া কোন আর্টিষ্ট বলেনি অন্য সুন্দর নেই, ঐটেই সুন্দর। আমাদের দেশ যখন বল্লে—সুন্দর গড়ো কিন্তু সুন্দর মানুষ গড়ো’ না, সুন্দর করে’ দেবমূর্তি গড়ো সেই ভাল, ঠিক সেই সময় গ্রীস বল্লে—না, মানুষকে করে’ তোল সুন্দর দেবতার প্রায় কিম্বা দেবতাকে করে’ তোল প্রায় মানুষ! আবার চীন বল্লে—খবরদার, দেবভাবাপন্ন মানুষকে গড়ো তো দৈহিক এবং ঐহিক সৌন্দর্যকে একটুও প্রশ্রয় দিও না চিত্রে বা মূর্তিতে। নিগ্রোদের আর্ট, যার আদর এখন ইউরোপের প্রত্যেক আর্টিষ্ট করছে তার মধ্যে আশ্চর্য রং রেখার খেলা এবং ভাস্কর্য দিয়ে আমরা যাকে বলি বেঢপ বেয়াড়া তাকেই সুন্দরভাবে দেখানো হচ্ছে। সুতরাং সুন্দরের স্বতন্ত্র স্বতন্ত্র আদর্শ আর্টিষ্টের নিজের নিজের মনে ছাড়া বাইরে নেই, কোন কালে ছিল না, কোন কালে থাকবেও না এটা একেবারে নিশ্চয় করে’ বলা যেতে পারে। সুন্দর যদি খিচুড়ি হ’তো তবে এতদিনে সৌন্দর্যের তিল ও তাল মিলিয়ে কোন এক বেরসিক পরম সুন্দর করে সেটা প্রস্তুত করে’ যেতো তথাকথিত কলারসিকদের জন্য, কিন্তু একমাত্র যাঁকে মানুষ বল্লে ‘রসো বৈ সঃ’ তিনিও সুন্দরের পরিপূর্ণ আদর্শ জনে জনে মনে মনে ছাড়া আপনার সৃষ্টিতে একত্র ও সম্পূর্ণভাবে কোথাও রাখেননি। তাঁর সৃষ্টি, এটি সুন্দর অসুন্দর দুইই, এবং সব দিক দিয়ে অপূর্ণও নয় পরিপূর্ণও নয় এই কথাই তিনি স্পষ্ট করে’ যে জানতে চায় তাকেই জানিয়েছেন। শান্তিতে-অশান্তিতে সুখে-দুঃখে সুন্দরে-অসুন্দরে মিলিয়ে হ’ল ছোট এই নীড়, তারি মধ্যে এসে মানুষের জীবনকণা পরম সুন্দরের আলো পেয়ে ক্ষণিকের শিশির-বিন্দুর মতো নতুন নতুন সুন্দর প্রভা সুন্দর স্বপ্ন রচনা করে চল্লো। এই হ’ল প্রথম শিল্পীর মানস কল্পনা ও এই বিশ্বরচনার নিয়ম, এ নিয়ম অতিক্রম করে’ কোন কিছুতে পরিপূর্ণতাকে প্রত্যক্ষরূপ দিতে পারে এমন আর্টও নেই আর্টিষ্টও নেই। যা বিশ্বের মানুষের মনে বিচিত্র পদার্থের মধ্য দিয়ে বিচিত্র হয়ে ফুটতে চাচ্ছে সেই পরম সুন্দরের স্পৃহা জেগেই রইলো, মিটলো না। যদি পরম সুন্দরের প্রত্যক্ষ উপমান পেয়ে সত্যই কোন দিন মিটে যায় মানুষের এই স্পৃহা, তবে ফুলের ফুটে’ ওঠার, নদীর ভরে’ ওঠার, পাতার ঘন সবুজ হয়ে ওঠার, আগুনের জ্বলে’ ওঠার চেষ্টার সঙ্গে সঙ্গে মানুষেরও ছবি আঁকা মূর্তি গড়া কবিতা লেখা গান গাওয়া ইত্যাদির স্পৃহা আর থাকে না। চাঁদ একটুখানি চাঁচ্‌নী থেকে আরম্ভ করে’ পূর্ণ সুন্দর হয়ে ওঠবার দিকে গেলেও যেমন শেষে একটুখানি অপরিণতি তার গোলটার মধ্যে থেকেই যায়, তেমনি মানুষের আর্টও কোথাও কখনো পূর্ণ সুন্দর হয়ে ওঠে না। মানুষ জানে সে নিজে অপূর্ণ, তাই পরিপূর্ণতার দিকে যাওয়ার ইচ্ছা তার এতখানি। গ্রীস ভারত চীন ঈজিপ্ট সবাই দেখি পরম সুন্দরের দিকে চলেছে, কিন্তু সৌন্দর্যের পরিপূর্ণতা কেউ পায়নি, কেবল পেতে চাওয়ার দিকেই চলেছে। আজ যেখানে মনে হল আর্ট দিয়ে বুঝি যতটা সুন্দর হ’তে পারে তাই হ’ল, কাল দেখি সেইখানেই এক শিল্পী দাঁড়িয়ে বলছে, হয়নি, আরো এগোতে হবে কিম্বা পিছিয়ে অন্য পন্থা ধরতে হবে। পরম সুন্দরের দিকে মামুষের মন ও সঙ্গে সঙ্গে তার আর্টের গতি ঠিক এই ভাবেই চলেছে—গতি থেকে গতিতে পৌঁছচ্ছে আর্ট, এবং একটা গতি আর একটা গতি সৃষ্টি করছে, ঢেউ উঠলো ঠেলে, মনে করলে বুঝি চরম উন্নতিকে পেয়েছি অমনি আর এক ঢেউ তাকে ধাক্কা দিয়ে বল্লে, চল, আরো বাকি আছে। এইভাবে সামনে আশেপাশে নানা দিক থেকে পরম সুন্দরের টান মানুষের মনকে টানছে বিচিত্র ছন্দে বিচিত্রতার মধ্য দিয়ে, তাই মানুষের সৌন্দর্যের অনুভূতি তার আর্ট দিয়ে এমন বিচিত্র রূপ ধরে আসছে—চিরযৌবনের দেশে ফুল ফুটেই চলেছে নতুন নতুন। মানুষ আয়নায় নিজের প্রতিবিম্ব দেখে মনে মনে ভাবে, সুন্দর! ঠিক সেই সময় অার একটি সুন্দর মুখের ছায়া আয়নায় পড়ে; যে ভাবছিলো সে অবাক হয়ে বলে, তুমি যে আমার চেয়ে সুন্দর, অমনি স্বপ্নের মতো সুন্দর ছায়া হেসে বলে, আমার চোখে তুমি সুন্দর! এই ভাবে এক আর্টে আর এক আর্টে, এক সুন্দরে অার এক সুন্দরে পরিচয়ের খেলা চলেছে, জগৎ জুড়ে সুন্দর মনের সুন্দরের সঙ্গে মনে মনে খেলা। পরিপূর্ণ সৌন্দর্যকে আর্ট দিয়ে ধরতে পারলে এ খেলা কোন্ কালে শেষ হয়ে যেতো। যে মাছ ধরে তার ছিপে যদি মৎস্য-অবতার উঠে আসতো তবে সে মানুষ কোন দিন আর মাছ ধরাধরি খেলা করতো না, সে তখনি অত্যন্ত গম্ভীর হয়ে কলম হাতে মাছ বিক্রির হিসেব পরীক্ষা করতে বসতো, আর যদি তখনও খেলার আশা তার কিছু থাকতো তো এমন জায়গায় গিয়ে বসতো যেখানে ছিপে মাছ ধরাই দিতে আসে না, ধরি ধরি করতে করতে পালায়! পরম সুন্দর যিনি তিনি লুকোচুরি খেলতে জানেন, তাই নিজে লুকিয়ে থেকে বাতাসের মধ্য দিয়ে তাঁর একটু রূপের পরিমল, আলোর মধ্য দিয়ে চকিতের মতো দেখা ইত্যাদি ইঙ্গিত দিয়ে তিনি আর্টিষ্টদের খেলিয়ে নিয়ে বেড়ান, আর্টিষ্টের মনও সেইজন্যে এই খেলাতে সাড়া দেয়, খেলা চলেও সেইজন্যে। এক একটা ছেলে আছে খেলতে জানে না খেলার আরম্ভেই হঠাৎ কোণ ছেড়ে বেরিয়ে এসে ধরা পড়ে’ রস-ভঙ্গ করে’ দেয় আর সব ছেলেগুলো তার সঙ্গে আড়ি দিয়ে বসে। তেমনি পরম সুন্দরও যদি আর্টিষ্টদের সামনে হঠাৎ বেরিয়ে এসে রস-ভঙ্গ করতে বসেন তবে আর্টিষ্টরা তাঁকে নিয়ে বড় গোলে পড়ে যায় নিশ্চয়ই। আর্টিষ্টরা, ভক্তেরা, কবিরা—পরম সুন্দরের সঙ্গে সুন্দর সুন্দর খেলা খেলেন কিন্তু পণ্ডিতেরা পরম সুন্দরকে অনুবীক্ষণের উপরে চড়িয়ে তাঁর হাড় হদ্দের সঠিক হিসেব নিতে বসেন। কাযেই দেখি যারা খেলে আর যারা খেলে না সৌন্দর্য সম্বন্ধে এ দুয়ের ধারণা এবং উক্তি সম্পূর্ণ বিভিন্ন ধরণের। পণ্ডিতেরা সৌন্দর্য সম্বন্ধে বেশ স্পষ্ট স্পষ্ট কথা লিখে ছাপিয়ে গেছেন, সেগুলো পড়ে’ নেওয়া সহজ কিন্তু পড়ে’ তার মধ্য থেকে সৌন্দর্যের আবিষ্কার করাই শক্ত। আর্টিষ্ট তারা সুন্দরকে নিয়ে খেলা করে সুন্দরকে ধরে আনে চোখের সামনে মনের সামনে অথচ সৌন্দর্য সম্বন্ধে বলতে গেলে সব আগেই তাদের মুখ বন্ধ হয়ে যায় দেখতে পাই। ‘সুন্দর কাকে বল’ এই প্রশ্নের জবাবে আর্টিষ্ট ড্রুরার বল্লেন, ‘আমি ও সব জানিনে বাপু’ অথচ তাঁর তুলির আগায় সুন্দর বাসা বেঁধেছিল! লিয়োনার্ডো দ্য ভিন্‌চি যাঁর তীক্ষ্ণ দৃষ্টি আর্ট থেকে আরম্ভ করে বিচিত্র জিনিষ নিয়ে নাড়াচাড়া করে গেছে, তিনি বলেছেন—পরম সুন্দর ও চমৎকার অসুন্দর দুইই দুর্লভ, পাঁচ-পাঁচিই জগতে প্রচুর। এক সময়ে আর্টিষ্টদের মনে জায়গা জায়গা থেকে তিল তিল করে বস্তুর খণ্ড খণ্ড সুন্দর অংশ নিয়ে একটা পরিপূর্ণ সুন্দর মূর্তি রচনা করার মতলব জেগেছিল। গ্রীসে এক কারিগর এইভাবে হেলেনের চিত্র পাঁচজন গ্ৰীক সুন্দরীর পঞ্চাশ টুকরো থেকে রচনা করে সমস্ত গ্ৰীসকে চম্‌কে দিয়েছিল। কিছুদিন ধরে ঐ মূর্তিরই জল্পনা চল্লো বটে কিন্তু চিরদিন নয়, শেষে এমনও দিন এল যে ঐ ভাবে তিলোত্তমা গড়ার চেষ্টা ভারি মূর্খতা একথাও আর্টিষ্টরা বলে’ বসলো! আমাদের দেশেও ঐ একই ঘটনা—শাস্ত্রসম্মত মূর্তিকেই রম্য বলে পণ্ডিতেরা মত প্রকাশ করলেন, সে শাস্ত্র আর কিছু নয় কতকগুলো মাপ-জোঁক এবং পদ্ম-আঁখি, খঞ্জন-নয়ন, তিলফুল, শুকচঞ্চু, কদলীকাণ্ড, কুক্কুটাণ্ড, নিম্বপত্র এই সব মিলিয়ে সৌন্দর্যের এবং আধ্যাত্মিকতার একটা পেটেণ্ট খাদ্যসামগ্ৰী! মনের খোরাক এভাবে প্রস্তুত হয় না, কাযেই আমাদের শাস্ত্রসম্মত সুতরাং বিশুদ্ধ আধ্যাত্মিক যে artificiality তা ধর্ম-প্রচারের কাযে লাগলেও সেখানেই আর্ট শেষ হলো একথা খাটলো না। একেষাং মতম্ বলে একটা জিনিয সে বলে’ উঠলো ’তদ্ রম্যং যত্র লগ্নং হি যস্য হৃৎ’, মনে যার যা ধরলো সেই হ’ল সুন্দর। এখন তর্ক ওঠে—মনে ধরা না ধরার উপরে সুন্দর অসুন্দরের বিচার যদি ছেড়ে দেওয়া যায় তবে কিছু সুন্দর কিছুই অসুন্দর থাকে না সবই সুন্দর সবই অসুন্দর প্রতিপন্ন হয়ে যায়, কোন কিছুর একটা অাদর্শ থাকে না। ভক্ত বলেন ভক্তিরসই সুন্দর আর সব অসুন্দর, যেমন শ্রীচৈতন্য বল্লেন— “ন ধনং ন জনং ন সুন্দরীং কবিতাম্বা জগদীশ কাময়ে। মম জন্মনি জন্মনীশ্বরে ভবতাদ্ ভক্তিরহৈতুকী ত্বয়ি॥” আর্টিষ্ট বল্লেন,—কাব্যং যশসে অর্থকৃতে ব্যবহারবিদে শিবেতরক্ষতয়ে ইত্যাদি। যার মন যেটাতে টানলো তার কাছে সেইটেই হল সুন্দর অন্য সবার চেয়ে। এখন সহজেই আমাদের মনে এই দ্বিধা উপস্থিত হয়—কোন্ দিকে যাই, ভক্তের ফুলের সাজিতে গিয়ে উঠি, না আর্টিষ্টের বাঁশিতে গিয়ে বাজি? কিন্তু একটু ভেবে দেখলেই দেখা যায়, ঘোরতর বৈরাগী এবং ঘোরতর অনুরাগী দুইজনেই চাইছেন একই জিনিষ—ভক্ত ধন চাইছেন না কিন্তু সব ধনের যা সার তাই চাইছেন, জন চাইছেন না কিন্তু সবার যে আপনজন তাকেই চাইছেন, সুন্দরী চান না কিন্তু চান ভক্তি, কবিতা নয় কিন্তু যিনি কবি যিনি স্রষ্টা—সুন্দরের যিনি সুন্দর—তাঁর প্রতি অচলা যে সুন্দরী ভক্তি তার কামনা করেন। আর্টিষ্ট ও ভক্ত উভয়ে শেষে গিয়ে মিলেছেন যা চান সেটা সুন্দর করে পেতে চান এই কথাই বলে’। মুখে সুন্দরী চাইনে বল্লে হবে কেন, মন টান্‌ছে বৈরাগীর ও অনুরাগীর মতোই সমান তেজে যেটা সুন্দর সেটার দিকে। মানুষের অন্তর বাহির দুয়ের উপরেই সুন্দরের যে বিপুল আকর্ষণ রয়েছে তা সহজেই ধরা যাচ্ছে—শুন্‌তে চাই আমরা সুন্দর, বলতে চাই সুন্দর, উঠ্‌তে চাই, বস্‌তে চাই, চল্‌তে চাই সুন্দর, সুন্দরের কথা প্রত্যেক পদে পদে আমরা স্মরণ করে চলেছি। পাই না পাই, পারি না পারি, সুন্দর বৌ ঘরে আনবার ইচ্ছা নেই এমন লোক কম আছে। যা কিছু ভাল তারি সঙ্গে সুন্দরকে জড়িয়ে দেখা হচ্ছে সাধারণ নিয়ম। আমরা কথায় কথায় বলি—গাড়ীখানি সুন্দর চলেছে, বাড়ীখানি সুন্দর বানিয়েছে, ওষুধ সুন্দর কায করছে; এমন কি পরীক্ষার প্রশ্ন আর উত্তরগুলো সুন্দর হয়েছে একথাও বলি। এমনি সব ভালর সঙ্গে সুন্দরকে জড়িয়ে থাকতে যখন আমরা দেখছি তখন এটা ধরে নেওয়া স্বাভাবিক যে সুন্দরের আকর্ষণ আমাদের মনকে ভালোর দিকেই নিয়ে চলে, আর বাকে বলি অসুন্দর তারও তো একটা আকর্ষণ আছে, সেও তো যার মন টানে আমার কাছে অসুন্দর হয়েও তার কাছে সুন্দর বলেই ঠেকে, তবে মনে ধরা এবং মন টানার দিক থেকে সুন্দরে অসুন্দরে ভেদ করি কেমন করে’? কাযেই সুন্দর অসুন্দর দুই মিলে চুম্বক পাথরের মত শক্তিমান একটি জিনিষ বলেই আমার কাছে ঠেকছে। সুন্দরের দিকটা হ’ল মনকে টেনে নিয়ে চলার দিক এবং অসুন্দরের দিকও হ’ল মনকে টেনে নিয়ে চলার দিক। এখন এটা ধরে নেওয়া স্বাভাবিক যে চুম্বক যেমন ঘড়ির কাঁটাকে দক্ষিণ থেকে পরে পরে সম্পূর্ণ উত্তরে নিয়ে যায় তেমনি সুন্দরের টান মানুষের মনকে ক্ষণিক ঐহিক নৈতিক এমনি নানা সৌন্দর্যের মধ্য দিয়ে মহাসুন্দরের দিকেই নিয়ে চলে, আর অসুন্দরের প্রভাব সেও মানুষের মনকে আর এক ভাবে টানতে টানতে নিয়ে চলে কদৰ্যতার দিকেই। কিন্তু সত্যিকার একটা কাঁটা আর চুম্বক নিয়ে যদি এই সত্যটা পরীক্ষা করতে বসা যায় তবে দেখবো সুন্দরের একটা চিহ্ন দিয়ে তারি কাছে যদি চুম্বকের টানের মুখ রাখা যায় তবে কাঁটা সোজা সুন্দরে গিয়ে ঠেকবে নিজের ঘর থেকে, আবার ঐ চুম্বকের মুখ যদি অসুন্দর চিহ্ন দিয়ে সেখানে রাখা যায় তবে ও কাঁটা উল্টো রাস্তা ধরেই ঠিক অসুন্দরে গিয়ে না ঠেকে পারে না। কিন্তু এমন তো হয় যে, আমি যদি মনে করি তবে অসুন্দরের গ্রাস থেকেও কাঁটাকে আরো খানিক টেনে সুন্দরের কাছে পৌঁছে দিতে পারি কিম্বা সুন্দরের দিক থেকে অসুন্দরে নামিয়ে দিতে পারি! সুতরাং সুন্দর অসুন্দরের মধ্যে কোন্‌টাতে আমাদের দৃষ্টি ও সৃষ্টি সমুদয় গিয়ে দাঁড়াবে তার নির্দেশ কর্তা হচ্ছে আমাদের মন ও মনের ইচ্ছা। মনে হ’ল তো সুন্দরে গিয়ে লাগলেম, মনে হ’লতো অসুন্দরে গিয়ে পড়লেম কিম্বা সুন্দর থেকে অসুন্দর অসুন্দর থেকে সুন্দরে দৌড় দিলেম, মন ও মনের শক্তি হল এ বিষয়ে নিয়ন্তা। টানে ধরলে যে চুম্বক ধরেছে তার মনের ইচ্ছা অনিচ্ছার প্রয়োজন না রেখেই কাঁটা আপনিই তার চরম গতি পায়, কিন্তু এই গতিকে সংযত করে’ অধোগতি থেকে ঊর্ধ্ব বা ঊর্ধ্ব থেকে অধোভাবের দিকে আনতে হলে আমাদের মনের একটা ইচ্ছাশক্তি একান্ত দরকার। বিল্বমঙ্গল বারবনিতার প্রেমোন্মাদ থেকে বিভুর প্রেমোন্মাদে গিয়ে যে ঠেকলেন সে শুধু তাঁর মনটি শক্তিমান ছিল বলেই। নিকৃষ্ট থেকে উৎকৃষ্টে, অসুন্দর থেকে সুন্দরে যেতে সেই পারে যার মন উৎকৃষ্ট ও সুন্দর, যার মন অসুন্দর সেও এই ভাবে চলে ভাল থেকে মন্দে। অার্টিষ্ট কবি ভক্ত এঁদের মন এমনিই শক্তিমান যে অসুন্দরের মধ্য দিয়ে সুন্দরের আবিষ্কার তাঁদের পক্ষে সহজ। ভক্ত কবি আর্টিষ্ট সবাই এক ধরণের মানুষ; সবাই আর্টিষ্ট, আর্টিষ্টের কাছে ভেদ নেই পণ্ডিতের কাছে যেমন সেটা আছে। আর্টিষ্টের কাছে রসের ভেদ আছে, মনের অবস্থাভেদে সু হয় কু, কু হয় সু এও আছে, তাছাড়া রূপভেদও আছে; কিন্তু সু কু এর যে নির্দিষ্ট সীমা পণ্ডিত থেকে আরম্ভ করে অপণ্ডিত পর্যন্ত টেনে দিচ্ছে, এ রূপ সে রূপের মাঝে সেই পাকাপোক্ত পাঁচিল নেই আর্টিষ্টের কাছে। নীরসেরও স্বাদ পেয়ে আর্টিষ্টের মন রসায়িত হয়, এইটুকুই তফাৎ আর্টিষ্টের আর সাধারণের মনে। তুমি আমি যখন খরার দিনে পাখা আর বরফ বলে’ হাঁক দিচ্ছি আর্টিষ্ট তখন সুন্দর করে’ খরার দিন মনে ধরে’ কবিতা লিখলে—‘কাল বৈশাখী আগুন ঝরে, কাল বৈশাখী রোদে পোড়ে! গঙ্গা শুকু শুকু আকাশে ছাই!’ রসের প্রেরণা সুন্দর অসুন্দরের ধারণাকে মুক্তি দিলে, আর্টিষ্টের মধ্যে সুন্দর অসুন্দরে মিলিয়ে এক রসরূপ সে দেখে চল্লো। আর্টিষ্ট রূপমাত্রকে নির্বিচারে গ্রহণ করলে—কেন সুন্দর কেন অসুন্দর এ প্রশ্ন আর্টিষ্ট করলে না, শুধু রসরূপে যখন বস্তুটিকে দেখলে তখন সে সাধারণ মানুষের মত আহা ওহো বলে’ ক্ষান্ত থাকলো না, দেখার সঙ্গে আর্টিষ্টের মন আপনার সৌন্দর্যের অনুভূতিটা প্রত্যক্ষ করবার জন্য সুন্দর উপায় নির্বাচন করতে লাগলো। সুন্দর রং চং সুন্দর ছন্দোবন্ধ এমনি নানা সরঞ্জাম নিয়ে আর্টিষ্টের সমস্ত মানসিক বৃত্তি ধাবিত হল সুন্দরের স্মৃতিটিকে একটা বাহ্যিক রূপ দিতে, কিম্বা সুন্দরের স্মৃতিটিকে নতুন নতুন কল্পনার মধ্যে মিশিয়ে নতুন রচনা প্রকাশ করতে। সুন্দর বা তথাকথিত অসুন্দর দুয়েরই যেমন মনকে আকর্ষণ করবার শক্তি আছে, তেমনি মনের মধ্যে গভীর ভাবে নিজের স্মৃতিটি মুদ্রিত করবারও শক্তি আছে—সুতরাং সুন্দরে অসুন্দরে এখানেও এক। সুন্দরকেও যেমন ভোলবার জো নেই অসুন্দরকেও তেমনি টেনে ফেলবার উপায় নেই। দুই স্মৃতির মধ্যে শুধু তফাৎ এই, সুন্দরের স্মৃতিতে আনন্দ, অসুন্দরের স্পর্শে মন ব্যথিত হয়, সুখও যেমন দুঃখও তেমনি মনের একস্থানে গিয়ে সঞ্চিত হয়, শুধু দুঃখকে মানুষ ভোলবারই চেষ্টা করে আর সুখের স্মৃতিকে লতার মত মানুষের মন জড়িয়ে জড়িয়ে ধরতেই চায় দিন রাত। সাধারণ মানুষের মনেও যেমন, আর্টিষ্ট মানুষের মনেও তেমনি সহজ ভাবেই সুন্দর অসুন্দরের ক্রিয়া হয়, শুধু সাধারণ মানুষের সঙ্গে আর্টিষ্টের তফাৎ হচ্ছে মনের অনুভূতিকে প্রকাশের ক্ষমতা বা অক্ষমতা নিয়ে। দুঃখ পেলে সাধারণ মানুষ বেজায় রকম কান্নাকাটি সুরু করে, আর্টিষ্টও যে কাঁদে না তা নয়, কিন্তু তার মনের কাঁদন আর্টের মধ্য দিয়ে একটি অপরূপ সুন্দর ছন্দে বেরিয়ে আসে। অসুন্দরের মধ্যে, অ-সুখের মধ্যে আর্টিষ্টের কাছ থেকে রস আসে বলেই আর্ট মাত্রকে সুন্দরের প্রকাশ বলে গণ্য করা হয়, এবং সেই কারণে আর্টের চর্চায় ক্রমে সুন্দরের অনুভূতি আমাদের যেমন বৃদ্ধি পায় তেমন সৌন্দর্য সম্বন্ধে তর্ক বিতর্ক পড়ে’ কিম্বা শুনে হয় না। আসলে যা সুন্দর তা কখনও বলে না, আমি এই জন্যে সুন্দর; আমাদের মনেও ঠিক সেই জন্যে সুন্দরকে গ্রহণ করবার বেলায় এ প্রশ্ন ওঠে না যে, কেন এ সুন্দর! আসলে যে সুন্দর নয় সেই কেবল আমাদের সামনে রং মেখে অলঙ্কার পরে’ হাব ভাব করে’ এসে বলে আমি এই কারণে সুন্দর, মনও আমাদের তখনি বিচার করে বুঝে নেয় এ রংএর দ্বারা অথবা অলঙ্কারে বা আর কিছুর দ্বারায় সুন্দর দেখাচ্ছে কি না! আসলে যা সুন্দর তাকে নিয়ে আর্টিষ্ট কিম্বা সাধারণ মানুষের মন বিচার করতে বসে না, সবাই বলে—সুন্দর ঠেক্‌ছে, কেন তা জানি না। কিন্তু সুন্দরের সাজে যে অসুন্দর আসে তাকে নিয়ে সাধারণ মানুষ এবং আর্টিষ্টের মনে তর্কের উদয় হয়। কিন্তু পণ্ডিতের মন দার্শনিকের মনের ঠিক বিপরীত উপায়ে চলে, অসুন্দরের বিচার সেখানে নাই, সব বিচার বিতর্ক সুন্দরকে নিয়ে। যা সুন্দর আমরা দেখেছি তা নিজের সুন্দরতা প্রমাণের কোন দলিল নিয়ে এল না কিন্তু আমাদের মন সহজেই তাতে রত হল, কিন্তু পণ্ডিতের সামনে এসে সুন্দর দায়গ্ৰস্ত হ’ল—প্রশ্নের পর প্রশ্ন উঠলো সুন্দরকে নিয়ে—তুমি কেন সুন্দর, কিসে সুন্দর ইত্যাদি ইত্যাদি! সুন্দর, সে সুন্দর বলেই সুন্দর, মনে ধরলো বলেই সুন্দর, এ সহজ কথা সেখানে খাটলো না। পণ্ডিত সেই সুন্দরকে বিশ্লেষণ করে দেখবার চেষ্টা করছেন—কি নিয়ে সুন্দরের সৌন্দর্য? সেই বিশ্লেষণের একটা মোটামুটি হিসেব করলে এই দাঁড়ায়—(১) সুখদ বলেই ইনি সুন্দর, (২) কাযের বলেই সুন্দর, (৩) উদ্দেশ্য এবং উপায় দুয়ের সঙ্গতি দেন বলেই সুন্দর, (৪) অপরিমিত বলেই সুন্দর, (৫) সুশৃঙ্খল বলেই সুন্দর, (৬) সুসংহত বলেই সুন্দর (৭) বিচিত্র অবিচিত্র সম বিষম দুই দিয়ে ইনি সুন্দর।—এই সব প্রাচীন এবং আধুনিক পণ্ডিতগণের মতামত নিয়ে সৌন্দর্যের সার ধরবার জন্যে সুন্দর একটি জাল বুনে নেওয়া যে চলে না তা নয়, কিন্তু তাতে করে’ সুন্দরকে ঠিক যে ধরা যায় তার আশা আমি দিতে সাহস করি না; তবে আমি এই টুকু বলি—অন্যের কাছে সুন্দর কি বলে’ আপনাকে সপ্রমাণিত করছে তা আমাদের দেখায় লাভ কি? আমাদের নিজের নিজের কাছে সুন্দর কি বলে’ আসছে তাই আমি দেখবো। আমি জানি সুন্দর সব সময়ে সুখও দেয় না কাযও দেয় না—বিদ্যুৎ-শিখার মত বিশৃঙ্খল অসংযত উদেশ্যহীন বিদ্রুত বিষম এবং বিচিত্র আবির্ভাব সুন্দরের! সুন্দর, এই কথাই তো বলছে আমাদের—আমি এ নই তা নই, এজন্যে সুন্দর ওজন্যে সুন্দর নই, আমি সুন্দর তাই আমি সুন্দর। আর্টের মধ্যে রীতিনীতি, চক্ষু-জোড়ানো মন-ওড়ানো প্রাণ-ভোলানো ও কাঁদানো গুণ, কিম্বা এর যে কোন একটা যেমন আর্ট নয়, আর্ট বলেই যেমন সে আর্ট, সুন্দরও তেমনি সুন্দর বলেই সুন্দর। সুন্দর নিত্য ও অমূর্ত, নানা বস্তু নানা ভাবের মধ্যে তার অধিষ্ঠান ও আরোপ হলে তবে মনোরসনা তার স্বাদ অনুভব করে—এমন সুন্দর তেমন সুন্দর সুখদ সুন্দর সুপরিমিত সুন্দর সুশৃঙ্খলিত সুন্দর! আমাদের জিব যেমন চাখে মেঠাই সন্দেশ সরবৎ ইত্যাদি পৃথক পৃথক জিনিষের মধ্য দিয়ে মিষ্টতাকে—ঠিক সেই ভাবেই জীব বা জীবাত্মা মনোরসনার সাহায্যে আপনার মধ্যে সুন্দরের জন্য যে প্রকাণ্ড পিপাসা রয়েছে সেটা নানা বস্তু ধরে’ মেটাতে চলে। অতএব বলতে হয়, মন যার যেমনটা চায় সেইভাবে সুন্দরকে পাওয়াই হ’ল পাওয়া, আর কারু কথা মতো কিম্বা অন্য কারু মনের মতো সুন্দরকে পাওয়ার মানে—না পাওয়াই। মা-বাপের মনের মতো হলেই বৌ সুন্দর হল একথা যে ছেলের একটু মাত্র সৌন্দর্য জ্ঞান হয়েছে সে মনে করে না। বৌ কাযের, বৌ সংসারী, বৌ বেশ সংস্থানসম্পন্না, এবং হয়তো বা ডাক-সাইটে সুন্দরীও হতে পারে অন্য সবার কাছে, কিন্তু ছেলের নিজের মনের মধ্যে কায কর্ম সংসার সুরূপ কুরূপ ইত্যাদির একটা যে ধারণা তার সঙ্গে অন্যের পছন্দ করা বৌ মিল্লো তো গোল নেই, না হলেই মুস্কিল। হিন্দিতে প্রবাদ আছে ‘আপ্ রুচি খানা—পর রুচি পহেরনা’, খাবারের স্বাদ আমাদের প্রত্যেকেরই স্বতন্ত্র ভাবে নিতে হয় সুতরাং সেখানে আমাদের স্বরাজ, কিন্তু পরণের বেলায় পরে যেটা দেখে’ সুন্দর বলে সেইটেই মেনে চলতে হয়, না হলে নিন্দে; সুতরাং সেখানে কেউ জোর ক’রে বলতে পারে না এইটেই পরি পাঁচজনে যা বলে বলুক, আমরা নিজের বুদ্ধিকেও সেখানে প্রাধান্য দিতে পারিনে, দেশ কাল যে সুন্দর পরিচ্ছদের সম্মান করে তাকেই মেনে নিতে হয়। একটা কথা কিন্তু মনে রাখা চাই, সাজ গোজ পোষাক পরিচ্ছদ ইত্যাদির সম্বন্ধে কিছু ওলট পালট সময়ে সময়ে যে হয়ে আসছে তা ঐ ব্যক্তিগত স্বাধীন রুচি থেকেই আসছে। সুতরাং সব দিক দিয়ে সুন্দর অসুন্দরের বোঝা-পড়া আমাদের ব্যক্তিগত রুচির উপরেই নির্ভর করছে। যদি সত্যই এই জগৎ অসুন্দরের সঙ্গে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন, নিছক সুন্দর জিনিষ দিয়ে গড়া পরিপূর্ণ সুখদ সুশৃঙ্খল ও সর্বগুণান্বিত একটা কিছু হতো তবে এর মধ্যে এসে সুন্দর অসুন্দরের কোন প্রশ্নই আমাদের মনে উদয় হতে না। আমরা এই জগৎ সংসার চিরসুন্দরের প্রকাশ ইত্যাদি কথা মুখে বল্লেও চোখে তা দেখিনে অনেক সময় মনেও সেটা ধরতে পারিনে, কাজেই অতৃপ্ত মন সুন্দরের বাসনায় নানা দিকে ধাবিত হয় এবং সুন্দরের একটা সাক্ষাৎ আদর্শ খাড়া করে, দেখার চেষ্টা করে এবং সুন্দরকে অসুন্দর থেকে বিচ্ছিন্ন করে’ দেখলে আমাদের সৌন্দর্যজগৎ যে খণ্ড ও খর্ব হয়ে পড়ে তা আর মনেই থাকে না। সুরূপ কুরূপ দুয়ে মিলে সুন্দরের অখণ্ড মূর্তির ধারণা করা শক্ত কিন্তু একেবারে যে অসম্ভব মানুষের পক্ষে তা বলা যায় না। ভক্ত কবি এবং আর্টিষ্ট এদের কাছে সুন্দর অসুন্দর বলে দুটো জিনিষ নেই, সব জিনিষের ও ভাবের মধ্যে যে নিত্য বস্তুটি সেটিই সুন্দর বলে’ তাঁরা ধরেন। ইন্দ্রিয়-গ্রাহ্য যা কিছু তা অনিত্য, তার সুখ শৃঙ্খলা মান পরিমাণ সমস্তই অনিত্য, সুতরাং সুন্দর যা নিত্য, সাক্ষাৎ সম্বন্ধে তার সঙ্গে মেলা মানুষের পক্ষে একেবারেই অসম্ভব বলা যেতে পারে। আমাদের মনই কেবল গ্রহণ করতে পারে সুন্দরের আস্বাদ—সুতরাং মনোরসনা রোগ বা পক্ষাঘাতগ্রস্ত হওয়ার মতো ভীষণ বিপত্তি মানুষের হতে পারে না। আর্টের দিক দিয়ে যৌবনই সুন্দর বার্ধক্য সুন্দর নয়, আলোই সুন্দর অন্ধকার নয়, সুখই সুন্দর দুঃখ নয়, পরিষ্কার দিন বাদলা নয়, বর্ষার নদী শরতের নয়, পূর্ণচন্দ্রই চন্দ্রকলা নয়—কেউ একথা বলতে পাবে না। যে একেবারেই আর্টিষ্ট নয় শুধু তারি পক্ষে বিচ্ছিন্ন ও খণ্ডভাবের একটা আদর্শ সৌন্দর্যকে কল্পনা করে নেওয়া সম্ভব। কবীর ছিলেন আর্টিষ্ট তাই তিনি বলেছিলেন—“সবহি মূরত বীচ অমূরত, মূরতকী বলিহারী”। যে সেরা আর্টিষ্ট তারি গড়া যা কিছু তারি মধ্যে এইটে লক্ষ্য করছি—ভালমন্দ সব মূর্তির মধ্যে অমূর্তি বিরাজ করছেন! “ঐসা লো নহিঁ তৈসা লো, মৈঁ কেহি বিধি কথৌঁ গম্ভীরা লো”—সুন্দর যে অসুন্দরের মধ্যেও আছে এ গভীর কথা বুঝিয়ে বলা শক্ত তাই কবীর এক কথায় সব তর্ক শেষ করিলেন “বিছুড়ি নহিঁ মিলিহো”—বিচ্ছিন্নভাবে তাকে খুঁজে পাবে না। কিন্তু এই যে সুন্দরের অখণ্ড ধারণা কবীর পেলেন তার মূলে কি ভাবের সাধনা ছিল জানতে মন সহজেই উৎসুক হয়; এর উত্তর কবীর যা দিয়েছিলেন তার সঙ্গে সব আর্টিষ্টের এক ছাড়া দুই মত নেই দেখা যায়—“সংতো সহজ সমাধ ভলী, সাঁঈসে মিলন ভয়ো জা দিনতে সুরত ন অন্তি চলি॥ আঁখ ন মুদুঁ কান ন রূংধু, কায়া কষ্ট ন ধারূঁ। খুলে নয়ন মৈ হঁস হঁস দেখুঁ সুন্দর রূপ নিহারূঁ॥” সহজ সমাধিই ভাল, হেসে চাও দেখবে সব সুন্দর, যার মনে হাসি নেই তার চোখে সুন্দরও নেই। যার প্রাণে সুর আছে বিশ্বের সুর বেসুর বিবাদী সম্বাদী সবই সুন্দর গান হয়ে মেলে তারি মনে। আর যার কাছে শুধু পুঁথির সুর-সপ্তক স্বরলিপি ও তাল বেতালের বোল মাত্রই আছে, তার বুকের কাছে বিশ্বের সুর এসে তুলোট কাগজের খড়মড়ে শব্দে হঠাৎ পরিণত হয়। এখন মানুষের ব্যক্তিগত রুচির উপরে সুন্দর অসুন্দরের বিচারের শেষ নিষ্পত্তিটা যদি ছেড়ে দেওয়া যায় তবে সুন্দর অসুন্দরের যাচাই করবার আদর্শ কোন্‌খানে পাওয়া যাবে এই আশঙ্কা সবারই মনে উদয় হয়। সুন্দরকে বাহ্যিক উপমান ধরে’ যাচাই করে নেবার জন্যে এ ব্যস্ততার কারণ আমি খুঁজে পাইনে। ধর, সুন্দরের একটা বাঁধাবাঁধি প্রত্যক্ষ আদর্শ রইলো না, প্রত্যেকে আমরা নিজের নিজের মনের কষ্টিপাথরেই বিশ্বটাকে পরীক্ষা করে চল্লেম—খুব আদিকালে মানুষ আর্টিষ্ট যে ভাবে সুন্দরকে দেখে চলেছিল—এতে করে’ মানুষের সৌন্দর্য উপভোগ সৌন্দর্য সৃষ্টির ধারা কি একদিনের জন্য বন্ধ হ’ল জগতে? বরং আর্টের ইতিহাসে এইটেই দেখতে পাই যে যেমনি কোন জাতি বা দল আর্টের দিক দিয়ে কিছুকে আদর্শ করে’ নিয়ে ধরে’ বসলো পুরুষ-পরম্পরায় অমনি সেখানে রসের ব্যাঘাত হতে আরম্ভ হ’ল, আর্টও ক্রমে অধঃ থেকে অধোগতি পেতে থাকলো। আমাদের সঙ্গীতে সেই তানসেন ও আকব্বরি চাল, ছবিতে দিল্লীর চাল বা বিলাতী চাল যে কুকাণ্ড ঘটাতে পারে, এবং সেই আদর্শকে উল্টে ফেলে চল্লেও যা হতে পারে, তার প্রত্যক্ষ প্রমাণ সমস্ত আমাদের সামনেই ধরা রয়েছে, সুতরাং আমার মনে হয় সুন্দরের একটা আদর্শের অভাব হ’লে তত ভাবনা নেই, যত ভাবনা আদর্শটা বড় হয়ে আমাদের সৌন্দর্যজ্ঞান ও অনুভবশক্তির বিলুপ্তি যদি ঘটায়। কালিদাসের আমলে ‘তম্বী শ্যামা শিখরদশনা’ ছিল সুন্দরীর আদর্শ। অজন্তার এবং তার পূর্বের যুগ থেকেও হয়তো এই আদর্শই চলে আসছিল, মোগলানী এসে এবং অবশেষে আরমাণি থেকে আরম্ভ করে ফিরিঙ্গিনী পর্যন্ত এসে সে আদর্শ উল্টে দিলে এবং হয়তো কোন দিন বা চীনই এসে সেটা আবার উল্টে দেয় তারও ঠিক নেই। আদর্শটা এমনিই অস্থায়ী জিনিষ যে তাকে নিয়ে চিরকাল কারবার করা মুস্কিল। রুচি বদলায় আদর্শও বদলায়, যেটা ছিল এককালের চাল সেটা হয় অন্যকালের বেচাল, ছিল টিকি এল টাই, ছিল খড়ম এল বুট, এমনি কত কি! গাছগুলো অনেককাল ধরে’ এক অবস্থায় রয়েছে—সেই জন্যে এই গুলোকেই আদর্শ গাছ ইত্যাদি বলে’ আমাদের মনে হয় কিন্তু পৃথিবীর পুরাকালের গাছ পাতা ফল ফুলের আদর্শ ছিল সম্পূর্ণ আলাদা—অথচ তারাও তো ছিল সুন্দর!—সুতরাং পরিবর্তনশীল বাইরেটার মধ্যে সুন্দর আদর্শভাবে থাকে না। শিশু গাছ, বড় গাছ এবং বুড়ো গাছ প্রত্যেকেরই মধ্যে যে সুন্দরের ধারা চলছে, পরম সুন্দর হয়ে দেখা দেবার নিত্য এবং বিচিত্র চেষ্টা সেই প্রাণের স্রোত নিয়ে হচ্ছে গাছ সুন্দর। এমনি আমাদের মনে বা বস্তু ও ভাবের অন্তরে যে নিত্য এবং সুন্দর প্ৰাণের স্রোত গোপনে চলেছে তাকেই সুন্দরের আদর্শ বলে’ ধরতে পারি, আর কিছুকে নয়, এবং সেই আদর্শই সুন্দরকে যাচাই করার যে নিত্য আদর্শ নয় তা জোর করে কে বলতে পারে! সমস্ত পদার্থের সৌন্দর্যের পরিমাপ হল তাদের মধ্যে, অনিত্য রস যা তা নিয়ে বাইরের রং রূপ বদলে’ চলে কিন্তু নিত্য যা তার অদল বদল নাই। সব শিল্পকে যাচাই করে’ নেবার জন্যে আমাদের প্রত্যেকের মনে নিত্য সুন্দরের যে একটি আদর্শ ধরা আছে—তার চেয়ে বড় আদর্শ কোথায় আর পাবো? যে ভাবেই হোক যে বস্তুই হোক যখন সে নিত্য তার আস্বাদ দিয়ে আমাদের মনে পরমসুন্দরের স্বল্পাধিক স্পর্শ অনুভব করিয়ে গেল সে সুন্দর বলে’ আমাদের কাছে নিজেকে প্রমাণ করলে। আমার কাছে কতকগুলো জিনিষ কতকগুলো ভাব সুন্দর ঠেকে কতক ঠেকে অসুন্দর, এই ঠেকলো সুন্দর এই অসুন্দর, তোমার কাছেও তাই, আমার মনের সঙ্গে মেলে না তোমারটি তোমার সঙ্গে মেলে না অামারটি। সুন্দরের অসুন্দরের অবিচলিত অাদর্শ চলায়মান জীবনে কোথাও নেই, সুতরাং যেদিক দিয়েই চল সুন্দর অসুন্দর সম্বন্ধে বিতর্ক মেটবার নয়, কাযেই এই অতৃপ্তিকেই—এই সুখ-দুঃখে আলো-আঁধারে সুন্দর, অসুন্দরে মেলা খণ্ড-বিখণ্ড সত্য সুন্দর এবং মঙ্গলকে—সম্পূর্ণভাবে মেনে নিয়ে যে চলতে পারে, সেই সুন্দরকে এক ও বিচিত্রভাবে অনুভব করবার সুবিধে পায়। জগৎ যার কাছে তার ছোট লোহার সিন্দুকটিতেই ধরা আর জগৎ যার কাছে লোহার সিন্দুকের বাইরেও অনেকখানি বিস্তৃত ধূলোর মধ্যে কাদার মধ্যে আকাশের মধ্যে বাতাসের মধ্যে, তাদের দু’জনের কাছে সুন্দর ছোট বড় হয়ে দেখা যে দেয় তার সন্দেহ নেই! সিন্দুক খালি হ’লে যার সিন্দুক তার কাছে কিছুই আর সুন্দর ঠেকে না, কিন্তু যার মন সিন্দুকের বাইরের জগৎকে যথার্থভাবে বরণ করলে তার চোখে সুন্দরের দিকে চলবার অশেষ রাস্তা খুলে গেল, চলে গেল সে সোজা নির্বিচারে নির্ভয়ে। যখন দেখি নৌকা চলেছে ভয়ে ভয়ে, পদে পদে নোঙ্গর আর খোঁটার আদর্শে ঠেকতে ঠেকতে, তখন বলি, নৌকা সুন্দর চল্লো না, আর যখন দেখলেম নৌকা উল্টো স্রোতের বাধা উল্টো বাতাসের ঠেলাকে স্বীকার করেও গন্তব্য পথে সোজা বেরিয়ে গেল ঘাটের ধারের খোঁটা ছেড়ে নোঙ্গর তুলে নিয়ে, তখন বলি, সুন্দর চলে গেল! সুন্দর অসুন্দর–জীবন-নদীর এই দুই টান—একে মেনে নিয়ে যে চল্লো সেই সুন্দর চল্লো আর যে এটা মেনে নিতে পারলে না সে রইলো যে কোনো একটা খোঁটায় বাঁধা। ঘাটের ধারে বাঁশের খোঁটা, তাকে অতিক্রম করে চলে’ যায় নদীর স্রোত নানা ছন্দে এঁকে বেঁকে,—আর্টের স্রোতও চলেছে চিরকাল ঠিক এই ভাবেই চিরসুন্দরের দিকে। সুন্দর করে’ বাঁধা আদর্শের খোঁটাগুলো আর্টের ধাক্কায় এদিক ওদিক দোলে, তারপর একদিন যখন বান ডাকে খোঁটা সেদিন নিজে এবং নিজের সঙ্গে বাঁধা নৌকাটাকেও নিয়ে ভেসে যায়। আর্ট এবং আর্টিষ্ট এদের মনের গতি এমনি করে’ পণ্ডিতদের বাঁধা এবং মূর্খদের আঁকড়ে ধরা তথাকথিত দড়ি খোঁটা অতিক্রম করে’ উপড়ে’ ফেলে’ চলে’ যায়। বড় আর্টিষ্টরা সুন্দরের আদর্শ গড়তে আসেন না, যেগুলো কালে কালে সুন্দরের বাঁধাবাঁধি আদর্শ হয়ে দাঁড়াবার জোগাড় করে, সেইগুলোকেই ভেঙে দিতে আসেন, ভাসিয়ে দিতে আসেন সুন্দর অসুন্দরের মিলে যে চলন্ত নদী তারি স্রোতে। যে পারে সে ভেসে চলে মনোমত স্থানে মনতরী ভেড়াতে ভেড়াতে সুন্দর সূর্যাস্তের মুখে, আর সেটা যে পারে না সে পরের মনোমত সুন্দর করে’ বাঁধা ঘাটে আটকা থেকে আদর্শ খোঁটায় মাথা ঠুকে ঠুকেই মরে, সুন্দর অসুন্দরের জোয়ার ভাঁটা তাকে বৃথাই দুলিয়ে যায় সকাল সন্ধ্যে! বাঁধা নৌকা সে এক ভাবে সুন্দর, ছাড়া নৌকা সে আর এক ভাবে সুন্দর; তেমনি কোন একটা কিছু সকরুণ সুন্দর, কেউ নিষ্করুণ সুন্দর, কেউ ভীষণ সুন্দর, আবার কেউ বা এত বড় সুন্দর কি এতটুকু সুন্দর—আর্টিষ্টের চোখে এইভাবে বিশ্বজগৎ সুন্দরের বিচিত্র সমাবেশ বলেই ঠেকে; আর্টিষ্টের কাছে শুধু তর্ক জিনিষটাই অসুন্দর, কিন্তু তর্কের সভায় যখন ঘাড় নড়ছে হাত নড়ছে ঝড় বইছে তার বীভৎস ছন্দটা সুন্দর। সুতরাং যে আলোয় দোলে অন্ধকারে দোলে কথায় দোলে সুরে দোলে ফুলে দোলে ফলে দোলে বাতাসে দোলে পাতায় দোলে—সে শুকনোই হ’ক তাজাই হ’ক সুন্দর হ’ক অসুন্দর হ’ক সে যদি মন দোলালো তো সুন্দর হ’ল এইটেই বোধ হয় চরম কথা সুন্দর অসুন্দরের সম্বন্ধে যা আর্টিষ্ট বলতে পারেন নিঃসঙ্কোচে। আদর্শকে ভাঙতে বড় বড় আর্টিষ্টরা যা আজ রচনা করে’ গেলেন, আস্তে আস্তে মানুষ সেইগুলোকেই যে আদর্শ ঠাউরে নেয় তার কারণ আর কিছু নয়, আমাদের সবার মন সত্যিই যে সুন্দর তার স্বাদ পেতে ব্যাকুল থাকে—যে রচনার মধ্যে যে জীবনের মধ্যে তার আস্বাদ পায় তাকেই অন্য সবার চেয়ে বড় করে’ না বোধ করে’ সে থাকতে পারে না। এইভাবে একজন, ক্রমে দশজন। এবং এমনো হয়, সৌন্দর্য সম্বন্ধে স্বাধীন মতামত নেই অথচ চেষ্টা রয়েছে সুন্দরকে কাছাকাছি চারিদিকে পেতে, সে, অথবা সুন্দরের কোন ধারণা সম্ভব নয় শুধু সৌন্দর্যবোধের ভাণ করছে, সেও, আর্ট বিশেষকে আস্তে আস্তে আদর্শ হবার দিকে ঠেলে তুলে’ ধরে,—ঠিক যে ভাবে বিশেষ বিশেষ জাতি আপনার আপনার এক একটা জাতীয় পতাকা ধরে’ তারি নীচে সমবেত হয়; সে পতাকা তখনকার মতো সুন্দর হলেও একদিন তার জায়গায় নতুন মানুষ তোলে নতুন সজ্জায় সাজানো নিজের Standard বা সৌন্দৰ্য-বোধের চিহ্ণ। এইভাবে একের পর আর এসে নতুন নতুন ভাবে সুন্দরের আদর্শ ভাঙ্গাগড়া হ’তে হ’তে চলেছে পরিপূর্ণতার দিকে, কিন্তু পূর্ণ সুন্দর বলে’ নিজেকে বলাতে পারছে না কেউ। আর্টিষ্টের সৌন্দর্যের ধারণা পাকা ফলের পরিণতির রেখাটির মতো সুডৌল ও সুগোল কিন্তু জ্যামিতির গোলের মতো একেবারে নিশ্চল গোল নয়, সচল ঢলঢলে গোল যার একটু খুঁৎ আছে, পূর্ণচন্দ্রের মতো প্রায় পরিপূর্ণ কিন্তু সম্পূর্ণ নয়; সেই কারণে অনেক সময় বড় আর্টিষ্টের রচনা সাধারণের কাছে ঠেকে যাচ্ছেতাই—কেন না সাধারণ মন জ্যামিতিক গোলের মতো আদর্শ একটা না একটা ধরে’ থাকেই, কাযেই সে সত্য কথাই বলে যখন বলে যাচ্ছেতাই, অর্থাৎ তার ইচ্ছের সঙ্গে মিলছে না আর্টিষ্টের ইচ্ছে। কিন্তু যাচ্ছেতাই শব্দটি বড় চমৎকার, এটিতে বোঝায়—যা ইচ্ছে তাই, সাধুভাষায় বল্পে বলি, যত্র লগ্নং হি যস্য হৃৎ বা যথাভিরুচি, এই যা ইচ্ছে তাই—যা মন চাচ্ছে তাই, সুতরাং রসিক ও আর্টিষ্ট এই শব্দটির যথার্থ অর্থ সুন্দর অর্থ ধরেই চিরকাল চলেছে। মনের স্বাধীনতা সম্পূর্ণ বজায় রেখে সুন্দরকে মনের টানের উপরে ছেড়ে যা ইচ্ছে তাই বলে’ পণ্ডিতানাম্ মতম্-এর বাইরে বেরিয়ে পড়েছে; খোঁটা-ছাড়া নৌকা বাঁধনমুক্ত-প্রাণ! তাই দেখছি সুন্দর অসুন্দরের বাছ-বিচার পরিত্যাগ করে’ তারি সঙ্গে গিয়ে লাগবার স্বাধীনতা আর্টিষ্টের মনকে বড় কম প্রসার দেয় না। বড় মন বড় সুন্দরকে ধরতে চাইছে যখন, বড় স্বাধীনতার মুক্তি তার একান্ত প্রয়োজন, কিন্তু মন যেখানে ছোট সেখানে আর্টের দিক দিয়ে এই বড় স্বাধীনতা দেওয়ার মানে ছেলের হাতে আগুনের মশালটা ধরে’ দেওয়া,—সে লঙ্কাকাণ্ড করে’ বসবেই, নিজের সঙ্গে আর্টের মুখ পুড়িয়ে কিম্বা ভরাডুবি করে’ স্রোতের মাঝে। বড় মন সে জানে বড় সুন্দরকে পেতে হ’লে কতটা সংযম আর বাঁধাবাঁধির মধ্য দিয়ে নিজেকে ও নিজের আর্টকে চালিয়ে নিতে হয়। ছোট সে তো বোঝেনা যে পরের অনুসরণে সুন্দরের দিকে চলাতেও আলো থেকে আলোতেই গিয়ে পৌঁছয় মন; আর নিজের ইচ্ছামত চলতে চলতে ভুলে’ হঠাৎ সে অসুন্দরের নেশা ও টানে পড়ে’ যায়, তখন তার কোন কারিগরিই তাকে সুন্দরের বিষয়ে প্রকাণ্ড অন্ধতা এবং আর্ট বিষয়ে সংসারজোড়া সর্বনাশ থেকে ফিরিয়ে আনতে পারবে না। পণ্ডিতরা আর কিছু না হোন পণ্ডিত তো বটে, সৌন্দর্যের এবং আর্টের লক্ষণ নিয়ম ইত্যাদি বেঁধে দিতে তাঁরা যে চেয়েছেন তা এই ছোট মনের উৎপাত থেকে আর্টকে এবং সেই সঙ্গে আর্টিষ্টকেও বাঁচাতে। যত্র লগ্নং হি যস্য হৃৎ—একথা যাঁরা শিল্প বিষয়ে পণ্ডিত তাঁরা স্বীকার করে’ নিলেও এই যা-ইচ্ছে-তাই শিল্পের উপরে খুব জোর দিয়ে কিছু বল্লেন না। কেন না তাঁরা জানতেন হৃদয় সবার সমান নয় মহৎ নয় সুন্দর নয়, হৃদয়ে যা ধরে তারও ভেদাভেদ আছে, হৃদয় আমাদের অনেক জিনিষে গিয়ে লগ্ন হয় যা অসুন্দর এবং একেবারেই আর্ট নয়, এবং এও দেখা যায় পরম সুন্দর এবং অপূর্ব আর্ট তাতেও গিয়ে হৃদয় লাগলো না, মধুকরের মতো উড়ে’ পড়লো না ফুলের দিকে, কাদাখোঁচার মতো নদীর ধারে ধারেই খোঁচা দিয়ে বেড়াতে লাগলো পাঁকে। যখন দেখতে পাওয়া যাচ্ছে ব্যক্তিবিশেষের হৃদয় গিয়ে লগ্ন হচ্ছে কুব্জার লাবণ্যে, আর একে পড়েছে চন্দ্রাবলীর প্রেমে অন্যে রাধে রাধে বলেই পাগল, তখন এই তিনে মিলে ঝগড়া চলবেই। এই সব তর্কের ঘূর্ণাজলে আর্টকে না ফেলে সৌন্দর্য ও আর্টের ধারাকে যদি সুনিয়ন্ত্রিত রকমে চালাতে হয় পুরুষ-পরম্পরায়, তবে পণ্ডিত ও রসিকদের কথিত সমস্ত রসের রূপের ধারার সাহায্য না নিলে কেমন করে’ খণ্ড-বিখণ্ডতা থেকে আর্টে একত্ব দেওয়া যাবে। আমার নিজের মুখে কি ভাল লাগল না লাগল তা নিয়ে দু’চার সমরুচি বন্ধুকে নিমন্ত্রণ করা চলে কিন্তু বিশ্বজোড়া উৎসবের মধ্যে শিল্পের স্থান দিতে হ’লে নিজের মধ্যে যে ছোট সুন্দর বা অসুন্দর তাকে বড় করে’ সবার করে’ দেবার উপায় নিছক নিজত্বটুকু নয়; সেখানে individualityকে universality দিয়ে যদি না ভাঙতে পারা যায়, তবে বীণার প্রত্যেক ঘাট তার পুরো সুরেই তান মারতে থাকলে কিম্বা অন্য সুরের সঙ্গে মিলতে চেয়ে মন্দ্র মধ্যম হওয়াকে অস্বীকার ক’রলে সঙ্গীতে যে কাণ্ড ঘটে, artএও সৌন্দর্য সম্বন্ধে সেই যথেচ্ছাচার উপস্থিত হয় যদি সুন্দর অসুন্দর সম্বন্ধে একটা কিছু মীমাংসায় না উপস্থিত হওয়া যায় আর্টিষ্ট ও রসিকদের দিক দিয়ে। ধারা ভেঙে নদী যদি চলে শতমুখী ছোট ছোট তরঙ্গের লীলা-খেলা শোভা-সৌন্দর্য নিয়ে তবে সে বড় নদী হয়ে উঠতে পারে না। এইজন্যে শিল্পে পূর্বতন ধারার সঙ্গে নতুন ধারাকে মিলিয়ে নতুন নতুন সৌন্দর্য সৃষ্টির মুখে অগ্রসর হতে হয় আর্টের জগতে। সত্যই যে শক্তিমান্ সে পুরাতন প্রথাকে ঠেলে চলে, আর যে অশক্ত সে এই বাঁধাস্রোত বেয়ে আস্তে আস্তে বড় শিল্প রচনার ধারা ও সুরে সুর মিলিয়ে নিজের ক্ষুদ্রতা অতিক্রম করে’ চলে। বাইরে রেখায় রেখায় বর্ণে বর্ণে, ভিতরে ভাবে ভাবে এবং সব শেষে রূপে ও ভাবে সুসঙ্গতি নিয়ে আর্টে সৌন্দর্য বিকাশ লাভ করেছে। যে ছবি লিখেছে, গান গেয়েছে, নৃত্য করেছে সে যেমন এটা সহজে বুঝতে পারবে, তেমন যারা শুধু সৌন্দর্য সম্বন্ধে পড়েছে, কি বক্তৃতা করেছে বা বক্তৃতা শুনেছে তারা তা পারবে না। সৌন্দর্যলোকের সিংহদ্বারের ভিতর দিকে চাবি, নিজের ভিতর দিক থেকে সিংহদ্বার খুল্লো তো বাইরের সৌন্দর্য এসে পৌঁছল মন্দিরে এবং ভিতরের খবর বয়ে চল্লো বাইরে অবাধ স্রোতে—সুন্দর অসুন্দরকে বোঝবার উৎকৃষ্ট উপায় প্রত্যেককে নিজে খুঁজে নিতে হয়।
অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর
আমতলি অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর রিদয় বলে ছেলেটা নামেই হৃদয়, দয়ামায়া একটুও ছিল না। পাখির বাসায় ইঁদুর, গরুর গোয়ালে বোলতা, ইঁদুরের গর্তে জল, বোলতার বাসায় ছুঁচোবাজি, কাকের ছানা ধরে তার নাকে তার দিয়ে নথ পরিয়ে দেওয়া, কুকুর-ছানা বেরাল-ছানার ল্যাজে কাঁকড়া ধরিয়ে দেওয়া, ঘুমন্ত গুরুমহাশয়ের টিকিতে বিচুটি লাগিয়ে আসা, বাবার চাদরে চোরকাঁটা বিঁধিয়ে রাখা, মায়ের ভাঁড়ার-ঘরে আমসির হাঁড়িতে আরশোলা ভরে দেওয়া— এমনি নানা উৎপাতে সে মানুষ, পশুপাখি, কীটপতঙ্গ, সবাইকে এমন জ্বালাতন করেছিল যে কেউ তাকে দু’চক্ষে দেখতে পারত না। রিদয়ের মা-বাপ ছিল আমতলি গাঁয়ের প্রজা। দুজনেই বুড়ো হয়েছে। রিদয় তাদের এক ছেলে, বয়স হল প্রায় বারো বছর; অথচ ছেলেটা না শিখলে লেখাপড়া, না শিখলে চাষবাসের কাজ; কেবল নষ্টামি করেই বেড়াতে লাগল। শেষে এমন হল যে তার বাপ-মা বাইরে হাটে-মাঠে যাবার সময় রিদয়কে ঘরে তালা বন্ধ কয়েদ করে রেখে যেত। তখন শীত গিয়ে গরম পড়তে আরম্ভ হয়েছে। গাছে-গাছে আমের বোল আর কাঁচা-আমের গুটি ধরেছে, পানাপুকুরের চারধার আমরুলীশাকের সবুজ পাতায় ছেয়ে গিয়েছে; আলের ধারে-ধারে নতুন দুর্বো, আকন্দফুল সবে দেখা দিয়েছে; দূরে শাল-পিয়ালের তেঁতুল-তমালের বনে নতুন পাতা লেগেছে, আর দেখতে-দেখতে সমস্ত বন যেন পুরন্ত বাড়ন্ত হয়ে উঠছে; রোদ পাতায়-পাতায় কাঁচা-সোনার রঙ ধরিয়ে দিয়েছে; কুয়াশা আর মেঘ সরে গিয়ে মনে হচ্ছে যেন নীল আকাশের কপাট হঠাৎ খুলে গেছে আর আলো আর বাতাস ছুটে বেরিয়ে এসেছে—বাইরে! রিদয়ের কুলুপ-দেওয়া ঘরেও আজ দরমার ঝাঁপগুলোর ফাঁক দিয়ে রোদ উঁকি দিচ্ছে, বাতাস সরু সুরে বাঁশি দিয়ে ঢুকছে। রিদয় কিন্তু এসব দেখছে না, শুনছেও না। সে চুপটি করে নষ্টামির ফন্দি আঁটছে। কিন্তু গর্ত ফেলে ইঁদুর যে আজ নতুন বসন্তে শুকনো পাতায় ছাওয়া বাদামতলায় রোদ পোহাতে বেরিয়ে গেছে, বেরাল-ছানাটা কাঁঠালতলায় কাঠবেরালির সঙ্গে ভাব করতে দৌড়েছে, গোয়াল ঘরের কপ্‌লে গাই তার নেয়াল বাছুরটাকে নিয়ে ল্যাজ তুলে ঢেঁকির মতো লাফাতে-লাফাতে মাঠের দিকে দৌড় দিলে, ঘুলঘুলি দিয়ে সেটা হৃদয় স্পষ্ট দেখলে। ঘুলঘুলিটার বাইরে একটা ডালিম গাছ। ডালিমের উপরে ময়ূরের মতো রঙ একটা ছোট কি পাখি এসে শিস দিতে লাগল—রিদয়ের নাগালের ঠিক বাইরেটিতে বসে —“ও হিরিদয়! ও হিরিদয়!” রিদয় ঘুলঘুলির ফাঁক দিয়ে কাঁধ পর্যন্ত বাড়িয়ে দিয়েও মাঝের আঙুলের ডগাটি দিয়ে ডালিমটিতে ছোঁয়া ছাড়া আর কিছু করতে পারলে না। পাখি ডালিমের আর এক ডালে সরে বসে এমন খিট্‌খিট্‌ খিট্‌খিট্‌ করে হেসে উঠল যে রিদয় একেবারে লজ্জায় মাটি! সে পাখিটাকে ছুঁড়ে মারবার জন্য একটা কিছু খুঁজতে চারদিকে চাইছে, এমন সময় ঘরের কোণে মস্ত দুটো মরচে-পড়া তালা-আঁটা সুঁদ্‌রি কাঠের উপরে পিতলের পাৎ আর পেরেকের নক্সা-কাটা বহুকালের সিন্দুকটার দিকে তার নজর পড়ল। যে কুলুঙ্গিতে ইঁদুরে-চড়া লাল-মাটির গণেশ ছোট ঢোলক বাজাচ্ছেন, ঠিক তারি নিচে, ঘরের একদিকের দেয়াল জুড়ে সিন্দুকটা রয়েছে। এতবড় যে মনে হচ্ছে যেন একটা রত্নবেদী! এই সিন্দুকে কি যে আছে, তা রিদয় এ পর্যন্ত দেখেনি; কিন্তু সে জানে তার ঠাকুরদাদা, তার দাদা, তার দাদা, তার আবার দাদার দাদা—এমনি কত পুরুষের বাসন, গয়না আর যা-কিছু ভালো দামী আশ্চর্য সামগ্রী এই সিন্দুকটায় জমা আছে। লক্ষ্মীপুজোর দিন রিদয়ের মা এই সিন্দুককে সিঁদুরের ফোঁটা, ধানের শীষ দিয়ে সাজিয়ে পুজো করে, ঢিপঢিপ প্রণাম করে কতবার রিদয়কে বলেছেন—“দেখিস, সিন্দুকে পা ঠেকাসনে, ওতে লক্ষ্মী আছেন।” সিন্দুকটা রিদয়ের বাপ-মা এক-একদিন ভাদ্দর মাসে ঠেলাঠেলি করে খুলে, তার থেকে ভারি-ভারি রূপোর গয়না, বেনারসী শাড়ি, কাঁসার বাসন বার করে, ঝেড়ে-পুঁছে যেখানকার যা গুছিয়ে রাখতেন; কিন্তু সিন্দুকের মধ্যেটায় যে কি, রিদয় এ পর্যন্ত একদিনও দেখতে পেলে না। সে দু’পায়ের বুড়ো-আঙুলে ভর দিয়ে খুব চেষ্টা করে মরচে-ধরা তালা দুটোর ফুটোয় চোখ দিতে পারত; তার উপর তার মাথা উঠত না। তালার ফুটোর মধ্যে অন্ধকারে একটা-কি চকচক করছে দেখা যায়, কিন্তু সেটাকে আঙুল দিয়ে টেনে বার করবার অনেক চেষ্টা করেও রিদয় পেরে ওঠেনি। তালা-দুটোকে যদি ভেঙে ফেলা যেত, তবে তালার মধ্যের জিনিস, সেই সঙ্গে সিন্দুকের মধ্যেটাও সে দেখে নিতে পারত। তালাটা কি করে ভাঙা যায় ভাবতে-ভাবতে রিদয়ের হাই উঠতে লাগল, আর চোখও ঢুলে এল। সেই সময় কুলুঙ্গি থেকে গণেশের ইঁদুরটা জ্যান্ত হয়ে ঝুপ করে সিন্দুকের ডালায় লাফিয়ে পড়ে ল্যাজ উঠিয়ে ছুটোছুটি আরম্ভ করলে। রিদয় পষ্ট দেখতে পেলে গনেশ মোটা-পেটটি নিয়ে শুঁড় দোলাতে-দোলাতে সিংহাসন থেকে নেমে কুলুঙ্গির ধারে পা-ঝুলিয়ে বসে ঢোল বাজাতে লাগলেন আর ইঁদুরটা তালে-তালে ল্যাজ নেড়ে গলার ঘুঙুরের ঝুমঝুম শব্দ করে-করে নাচতে থাকল। রিদয় ইঁদুর অনেক দেখেছে, গণেশের গল্পও অনেক শুনেছে, কিন্তু জ্যান্ত গণেশ সে কখনো দেখেনি! এই বুড়ো-আঙুল যতটুকু, গণেশটি ঠিক ততটুকু! পেটটি বিলিতি-বেগুনের মতো রাঙা চিকিচিকে, মাথাটি শাদা, শুঁড়টি ছোট-একটা কেঁচোর মতো পেটের উপর গুটিয়ে রয়েছে; কানদুটি যেন ছোট দুখানি কুলো, তাতে সোনার মাকড়ি দুলছে; গলায় একগাছি রূপোর তারের পৈতে ঝোলানো; পরনে লাল-পেড়ে পাঁচ-আঙুল একটি হলদে ধুতি, গলায় তার চেয়ে ছোট একখানি কোঁচানো চাদর; মোটা-সোটা এতটুকু দুটি পায়ে আংটির মতো ছোট-ছোট ঘুঙুর, গোল-গাল চারটি হাতে বালা, বাজু, তাড়; গলা থেকে লাল সুতোয় বাঁধা ছিটমোড়া ছোট্টো ঢোলকটি ঝুলছে। কথকঠাকুর সম্‌স্‌কৃতে গণেশ-বন্দনা করতেন: গণেশায় নমঃ নমঃ আদিব্রহ্ম নিরুপম পরম পরাৎপর। খর্ব্ব-স্থূলকলেবর গজমুখ লম্বোদর মহাযোগী পরমসুন্দর॥ হেলে শুণ্ড বাড়াইয়া সংসার সমুদ্র পিয়া খেলাছলে করহ প্রলয়। ফুৎকারে করিয়া বৃষ্টি পুনঃ কর বিশ্বসৃষ্টি ভালো খেলা খেল দয়াময়॥ এই বন্দনা শুনে সে গনেশকে মনে করেছিল না-জানি কতই বড়! একেবারে পদভরে মেদিনী কম্পমানা! মেঘ গর্জনের মতো ঢোল বাজিয়ে—তালগাছের গুঁড়ির মতো মোটা শুঁড় দোলাতে-দোলাতে, কানের বাতাসে ঝড় বইয়ে গণেশ নেচে বেড়াচ্ছেন! আসলে গনেশ যে গণেশদাদা পেটটি নাদা, গলায় একটি ঢোলক বাঁধা—পিটুলির পুতুলটির মতো একেবারে ছোট, ঢোলকটি মাদুলীর চেয়ে বড় নয়, আর তিনি নিজে তাঁর ইঁদুরটির চেয়ে একটু ছোট, এটা রিদয় এই প্রথম দেখলে। রিদয়ের এক-খাঁচা বিলিতি-ইঁদুর ছিল। না খেতে পেয়ে সেগুলো মরেছে! এখন গণেশের সঙ্গে ইঁদুরটিকে ধরবার ফন্দি সে মনে-মনে আঁটতে লাগল। ঘরের মধ্যে নানা জিনিস ছিল, কোনটা গনেশ-ধরার কাজে লাগে, তাই রিদয় দেখতে লাগল। তার এমন সাহস ছিল না যে গনেশকে গিয়ে চেপে ধরে—যদি দাঁত ফুটিয়ে দেয়! বাটনা-বাটা নোড়াটা হাতের কাছে পড়েছিল কিন্তু সেটা ছুঁড়ে মারলে গণেশ এত ছোট যে চেপ্টে যাবার ভয় আছে; পিতলের বোকনোটা চাপা দেওয়া যায় কিন্তু গণেশকে তা থেকে বার করে খাঁচায় পোরা মুশকিল; আটাকাঠিটা পেলে ঠিক হত কিন্তু রিদয়ের বাবা সেটা চালের মটকায় তুলে রেখেছেন; লক্ষ্মীর ঝাঁপিটা কাজে লাগতে পারে কিন্তু গণেশ তো তার মধ্যে ইচ্ছে করে না সেঁধোলে জোর করে ঢোকানো যায় না! চারদিক দেখতে-দেখতে কোণে ঠেসানো চিংড়ি-মাছ-ধরা কুঁড়োজালিটার দিকে রিদয়ের চোখ পড়ল । তখন গণেশ সিন্দুকের উপরে নেমে, উপরের দুহাতে তুড়ি দিয়ে, নিচের দু’হাতে ঢোলে চাঁটি মেরে, ইঁদুরের সঙ্গে-সঙ্গে ঢোল বাজিয়ে নৃত্য করছেন। রিদয় সাঁ-করে কুঁড়োজালি যেমন চাপা দেওয়া অমনি গণেশ তার মধ্যে আটকা পড়ে যাওয়া! ইঁদুরটা টপ করে লাফিয়ে কুলুঙ্গির উপরে একেবারে সিংহাসনের তলায় যেমন ঢুকেছে, অমনি মাটির সিংহাসন দুম করে উল্টে চুরমার হয়ে গেল। ইঁদুর ভয় পেয়ে ল্যাজ তুলে কোথায় যে দৌড় দিলে তার ঠিক নেই! গণেশ জালের মধ্যে মাথা নিচু করে দু-পা আকাশে ছুঁড়তে লাগলেন আর বলতে থাকলেন—“ছেড়ে দে, ছেড়ে দে বলছি!” কিন্তু দাঁতে-শুঁড়ে-ঢোলকে-জালে এমনি জড়িয়ে গেছেন যে গণেশের নড়বার সাধ্যি নেই। তালের নুটির মতো জালের মধ্যে আটকা পড়ে গণেশ হাঁপাতে-হাঁপাতে মা-দুর্গাকে স্মরণ করতে লাগলেন; সেই সময় ইঁদুর অন্ধকারে আস্তে-আস্তে এসে কটাস-করে রিদয়ের পায়ে এমনি দাঁত বসিয়ে দিলে যে যন্ত্রণায় সে ছটফট করতে লাগল । রিদয় জাল ফেলে পায়ে হাত বুলোচ্ছে, এমন সময় গণেশ শুঁড়ে-দাঁতে জাল কেটে বেরিয়ে নিজমূর্তি ধরলেন : মার-মার ঘের-ঘার হান-হান হাঁকিছে, হুপ-হাপ দুপ-দাপ আশ-পাশ ঝাঁকিছে ! অট্ট-অট্ট ঘট্ট-ঘট্ট ঘোর হাস হাসিছে, হুম-হাম খুম-খাম ভীম শব্দ ভাষিছে ! উর্ধ্ববাহু যেন রাহু চন্দ্র সূর্য পাড়িছে, লম্ফ-ঝম্ফ ভূমিকম্প নাগ-দন্ত লাড়িছে ! পাদ-ঘায় ঠায়-ঠায় জোড়া লাথি ছুটিছে, খণ্ড-খণ্ড লণ্ড-ভণ্ড বিস্ফুলিঙ্গ উঠিছে ! হুল-থুল কুল-কুল ব্রহ্মডিম্ব ফুটিছে, ভস্মশেষ হৈল দেশ রেণু-রেণু উড়িছে ! দেখতে-দেখতে চালে গিয়ে গণেশের মাথা ঠেকল। তিনি দাঁত কড়-মড় করে বললেন—“এতবড় আস্পর্ধা!—ব্রাহ্মণ আমি, আমার গায়ে চিংড়ি-মাছের জাল ছোঁয়ানো! যেমন ছোটলোক তুই, তেমনি ছোট বুড়ো-আংলা যক্‌ হয়ে থাক!” বলেই গণেশ শুঁড়ের ঝাপটায় রিদয়কে সাত-হাত দূরে ঠেলে ফেলে ভুস করে চণ্ডীমণ্ডপের চাল ফুঁড়ে অন্তর্ধান হলেন। রিদয় একদিকের দেয়ালে মাথা ঠুকে ঘুরে পড়ল আর দেখতে-দেখতে তার কপাল ফুলে বেল হল। সে বিষম ভয় পেয়ে তাড়াতাড়ি মাথায় হাত বুলোতে-বুলোতে উঠে দেখলে—কেউ কোথাও নেই, মেঝেতে ভাঙা-গণেশের একরাশ রাঙা-মাটি ছড়ানো রয়েছে! গণেশ ভেঙেছে দেখলে বাবা আর তাকে আস্ত রাখবেন না ভেবে রিদয় মাটিগুলো কুড়িয়ে সিন্দুকের পাশে লুকিয়ে রাখতে গিয়ে দেখে সিন্দুকটা এত বড় হয়ে গেছে আর সে এত ছোট হয়ে গেছে যে অনায়াসে সিন্দুকের তলায় সে গলে গেল! মাথার উপর কড়িকাঠের মতো সিন্দুকের তলাকার তক্তাগুলো, তার থেকে আরশোলা ঝুলছে। একটা আরশোলা শুঁড় উঁচিয়ে তাকে তেড়ে এল। রিদয় ভাবছে তখনো সে বড়ই আছে; যেমন আরশোলাকে মারতে যাবে, অমনি সেটা উড়ে এসে এক ডানার ঝাপটায় তাকে উল্টে ফেলে বললে—“ফের চালাকি করবি তো কামড়ে দেব! এখন তুই ছোট হয়ে গেছিস মনে নেই? আগের মতো আর বাহাদুরি চলবে না বলছি!” রিদয় ভয়ে তাড়াতাড়ি সিন্দুকের তলা থেকে বেরিয়ে নিজের তক্তায় উঠতে গিয়ে দেখে তক্তার খুরোটা তার মাথার থেকে অনেক উঁচুতে উঠে গেছে। তখন রিদয় বুঝলে গণেশের শাপে সে বুড়ো-আঙুলের মতো ভয়ানক ছোট হয়ে একেবারে বুড়ো-আংলা হয়ে পড়েছে। রিদয় প্রথমটা ভাবলে সে স্বপন দেখছে, কিন্তু তিন-চার বার চোখ বুজে, খুলে, নিজের গায়ে চিমটি কেটে যখন সে বুঝলে সব সত্যি—একটুও স্বপ্ন নয়, তখন রিদয় মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়ে ভাবতে লাগল—কি করা যায় এখন? গণেশ তো শাপ দিয়ে গেলেন—যক্‌ হয়ে থাক! কিন্তু যক্‌ বলে কাকে? এই বুড়ো আঙুলটির মতো ছোট থাকা? না, আর-কিছু ভয়ানক হবে? অন্য ছেলে হলে ভয়ে-ভাবনায় একেবারে হতবুদ্ধি হয়ে বসে থাকত, কিন্তু রিদয় ছিল নির্ভয়। সে যক্ কাকে বলে কারো কাছে জানবার জন্যে এদিক-ওদিক চাইতে লাগল। ছোট হবার সঙ্গে রিদয়ের দুষ্টুবুদ্ধিও ছোট হয়ে গেছে, কাজেই সে মাটিতে মাথা ঠুকে গণেশকে মনে-মনে প্রণাম করতে লাগল আর বলতে থাকল—“ঠাকুর, এবারকার মতো মাফ কর। আর আমি এমন কাজ করব না। ঘাট হয়েছে। যক্ কাকে বলে বলে দাও।” কিন্তু গণেশ কোনো সাড়া-শব্দ দিলেন না। গণেশের ইঁদুর রিদয়ের উপর ভারি চটেছিল, এতক্ষণ তার ভয়ে সে মটকা থেকে নামতে পারেনি, রিদয় ছোট আর ভালোমানুষ হয়ে গেছে দেখে সে গোঁফ-ফুলিয়ে কাছে এসে বললে—“কেমন! যেমন কর্ম তেমনি ফল! এখন থাকগে পাতালে যক্ হয়ে অন্ধকারে বসে! আর আলোতেও আসতে পাবে না, বাপ-মাকেও দেখা হবে না।” বাপ-মায়ের উপর রিদয়ের বড়-একটা টান ছিল না, কিন্তু পাতালে চুপটি করে থাকা কিছুতেই সে পারবে না। সে ইঁদুরকে শুধোলে—“ভাই, যক্ কি রকম?” ইঁদুর উত্তর করলে—“সেকালে লোকে ছেলে-পিলে না হলে বুড়ো হয়ে মরবার সময় যক্ বসাত—জোঁক বসানো নয়, যক্ বসানো! আগে সব বাড়িতে একটা করে চোর-কুটরী ছিল, ডাকাত পড়লে সেই ঘরে মেয়ে-ছেলেদের নিয়ে গেরস্তরা গিয়ে লুকিয়ে থাকত। এই চোর-কুটরীর নিচে অন্ধকার সিঁড়ি দিয়ে নেমে পাতালের মধ্যে একটা কুয়োর মতো অন্ধকার জায়গায় লোক কখনো-কখনো যক্ বসাত। ছেলেধরা দিয়ে খুঁজে খুঁজে তোমার মতো নিডর দুষ্টু ছেলে তারা ধরে এনে, তাকে ভালো কাপড়, সিঁদুরের টিপ দিয়ে বলির পাঁঠা যেমন করে সাজায় তেমনি করে সেই অন্ধকার পাতাল-পুরীতে এক থালা খাবার, এক ভাঁড় জল দিয়ে, নিজে না-খেয়ে, দানধ্যান না করে যে-সব ধন-দৌলত জমা করেছে তারই কাছে বসিয়ে দিয়ে, একটি পিদিম জ্বালিয়ে তারই নিচে একটা গোখরো সাপের হাঁড়ি রেখে বলত—‘এই যকের ধন তুমি আগলে থাক। যে এখানে ঢুকবে, তাকে যেন সাপে খায়।’ হ্রিং টিং ফট এই মন্তর বলে বুড়ো গর্তের মুখে একটা মস্ত পাথর চাপা দিয়ে বেরিয়ে আসত।” রিদয় বিষম ভয় পেয়ে বলে উঠল—“তারপর?” “তারপর আর কি? দু’চার দিনে থালার খাবার, ভাঁড়ের জল ফুরিয়ে গেলে ছেলেটা রোগা হয়ে শুকিয়ে-শুকিয়ে মরে যেত! পিদিমটাও তেল ফুরিয়ে নিভে গেলে অন্ধকারে ডাঁশ-পোকা সব বেরিয়ে তার গায়ের মাংস ছিঁড়ে খেয়ে ফেলত। সেই সময় গোখরো সাপ ডাঁশের লোভে হাঁড়ি ভেঙে বেরিয়ে এসে মরা ছেলের ফাঁপা-মাথার খুলিটার মধ্যে বাসা বেঁধে ধন-দৌলত আগলাত। আর ছেলেটা যক্ হয়ে সেই অন্ধকারে খিদের জ্বালায় কেবলি কাঁদত আর…” এই পর্যন্ত শুনেই রিদয়ের এমন ভয় হল যে সে ভাবলে যেন তার চারদিকে অন্ধকারে ডাঁশ-পোকাগুলো বেরিয়েছে, আর যেন লক্ষ্মীর ঝাঁপিটার মধ্যে থেকে গোখরো সাপ ফোঁসলাচ্ছে! ইঁদুর রিদয়কে ভয় দেখিয়ে বললে—“শুনলে তো? এখন ছেলে-ধরা তোমাকে দেখেছে কি ধরে যকে বসিয়েছে! পালাও এইবেলা, মানুষের কাছে আর এগিয়ো না, ধরা পড়লে মুশকিল!” বলেই ইঁদুর কুলুঙ্গিতে উঠে বসল। রিদয় কেঁদে বললে—“আর কি আমি মানুষ হব না?” ইঁদুর হেসে বললে—“গণেশঠাকুরের দয়া না হলে আর মানুষ হওয়া হচ্ছে না।” রিদয় আরও ভয় পেয়ে শোধালে—“গণেশ গেলেন কোথা? তাঁর দেখা পেলে যে আমি পায়ে ধরে মাপ চাই। এবার যদি তিনি আমায় মানুষ করে দেন, তবে নিশ্চয় বলছি কোনো দিন সন্দেশ চুরি করে খাব না, খেয়ে আর মিছে কথা বলব না, পড়বার সময় আর মিছি-মিছি মাথা ধরবে না, তেষ্টাও পাবে না; গুরুমশায়কে দেখে আর হাসব না, বাপ-মায়ের কথা শুনব; রোজ তোমার চন্নামেত্তো খাব, একশো দুর্গানাম লিখব। এবার থেকে বামুনের দোকানে পাউরুটি আর হাঁসের ডিম ছাড়া অন্য কিছু ছুঁই তো গঙ্গাস্নান করব।” এমনি ভালোমানুষ হবার যত-কিছু প্রতিজ্ঞা কোনোটা করতে রিদয় বাকি রাখলে না! কিন্তু এতেও গণেশ খুশি হয়ে তাকে মানুষ করে দিতে ঘরে এলেন না দেখে বাইরেটায় সে একবার গণেশকে খুঁজে দেখবার মতলবে দরজার ফাঁক দিয়ে গলে বেরুল। পাড়াগাঁয়ের সব বাড়ি যেমন, রিদয়দের বাড়িও তেমনি ছিল—‘পুবে হাঁস, পশ্চিমে বাঁশ, উত্তর বেড়ে, দক্ষিণ ছেড়ে।’ ঘরের দাওয়া থেকে নেমেই একহাত-অন্তর একখানা চৌকো টালি পাতা রয়েছে। এমনি নানা দিকে সোজা-বাঁকা, ভাঙা-আস্ত টালিগুলো মাটির উপরে পেতে রাস্তা হয়েছে—পুকুর-পাড়ে যাবার, গোয়ালে যাবার, হেঁসেলে ঢোকবার। বর্ষার সময় যখন জলে সব ডুবে যায়, তখন এই টালির উপর পা ফেলে চালে যাও, একটুও পায়ে জল লাগবে না। আবার যেখানে জল যাবার নালা, তার উপরে এপার-ওপার করবার জন্যে দু’টুকরো নারকোল-গাছের গুঁড়ি পাটাতন করে পাতা, পুলের মতো তার উপর দিয়ে সোজা চলে যাও । রিদয় এখনো থেকে-থেকে ভুলে যাচ্ছে যে সে আর বড় নেই, ঘরের দাওয়া থেকে আগেকার মতো লাফিয়ে নামতে গেছে, আর অমনি চিৎপাত! মনে হল যেন একতলার উপর থেকে পড়েছে! ভাগ্যি এক-আঁটি খড়ের উপরে পড়েছিল, না হলে রিদয় সেদিন টের পেতেন বেরাল-ছানাকে দাওয়া থেকে হঠাৎ ঠেলে ফেললে, কতটা তার লাগে। গোটাকতক ছাতারে-পাখি বাঁশঝাড়ের তলায় শুকনো পাতা উল্টে-উল্টে ফড়িং খেয়ে বেড়াচ্ছিল, বুড়ো-আংলা ডিগবাজি-খেয়ে পড়ে যেতে দেখে বলে উঠল—“ছি-ছি! ও হিরিদয় হল কি? ছি-ছি!” অমনি কুবোপাখি বাঁশের ডগা থেকে বলে উঠল—“দুয়ো, বেশ হয়েছে, দুয়ো!” আর অমনি চারদিক থেকে হাঁস, হাঁসের ছানা, মুরগি, মুরগির ছানা, কাদাখোঁচা, পানকৌড়ি এমনি সব ঘরের আশপাশের পোষা-পাখি বুনো-পাখি, মজা দেখতে ছুটে এসে রিদয়কে ঘিরে চেঁচাতে লাগল, হাসতে থাকল—“ছি-ছি, ছ্যা-ছ্যা, দেখ-দেখ! ঠিক হয়েছে! বেশ হয়েছে! বুড়ো-বুড়ো-বুড়ো-বুড়ো-আংলা! ও হিরিদয় হল কি?” কুঁকড়ো ঘাড় ফুলিয়ে বললে—“কি হল।” চড়াই ল্যাজ নেড়ে বললে—“এ কি, যক্ নাকি?” রিদয় যখন মানুষ ছিল, তখন পাখিদের কিম্বা জানোয়ারদের কথা একটুও বুঝত না, কিন্তু যক্ হয়ে পরিষ্কার বুঝতে পারছে। কুঁকড়ো বলছে—“কেমন, আর আমার ঝুঁটি ধরে টানবে?” মুরগি অমনি বললে—“যেমন দুষ্টুমি, তেমনি শাস্তি হয়েছে! চুরি কর আমার ছানা! এইবারে এক ঠোকরে মাথা ফুটো করে দেব।” বলে মুরগিটা রিদয়কে ঠোঁট বাড়িয়ে তেড়ে গেল। পাতি-হাঁস অমনি বলে উঠল—“থাক, থাক, এবার মাপ কর!” কুঁকড়ো মাথা নেড়ে বলল—“তোর এমন দশা করলে কে?” রাজহাঁস অমনি নাক-তুলে শুধোলে—“এ্যাঁঃ?” রিদয় পাখিদের কথা বুঝতে পারছে জেনে মনে-মনে খুশি হল বটে, কিন্তু মুরগি, হাঁস—যারা একদিন তাকে দেখলে ভয়ে দৌড় দিত, এখন তারা মুখের সামনে দাঁড়িয়ে হাসবে, এটা রিদয় সইতে না পেরে, এক ঢিল ছুঁড়ে ধমকে উঠল—“প্যাঁক-প্যাঁক করিসনে বলছি—পালা!” রিদয় যে এখন এতটুকু হয়ে গেছে! পাখিরা তাকে ভয় করবে কেন? সব পাখি একসঙ্গে খ্যাঁক-খ্যাঁক করে তেড়ে উঠল—“দূর হ, দূর হ! পালা।” ধাড়ি-বাচ্ছা সব পাখি চারদিকে ঘিরে এমনি চেঁচামেচি করতে থাকল যে রিদয়ের কানে তালা ধরবার যোগাড়! বেচারা কোথায় পালাবে ঠিক পাচ্ছে না, এমন সময় আঁস্তাকুড় থেকে ছাই-পাঁশ মেখে বাঘের মতো ডোরা-টানা এক বেরাল, চান সেরে সেইদিকে আসতে লাগল—“কিও-কিও” বলতে-বলতে! বেরালের সাড়া পেয়েই পাখিরা যেন কত ভালোমানুষের মতো, মাটিতে যেন পোকাই খুঁজছে, এই ভাবে পায়ে-পায়ে রিদয়ের কাছ থেকে সরে পড়ল। বেরাল ষষ্ঠীর বাহন, ইঁদুরের সঙ্গে গণেশ কোথায় লুকিয়ে আছেন নিশ্চয়ই সে জানে, ভেবে রিদয় দৌড়ে গিয়ে বেরালকে গণেশের কথা শুধোলে। বেরাল অমনি ল্যাজ গুড়িয়ে, সামনে দুই থাবা রেখে, গম্ভীর হয়ে বসে চোখ পিট-পিট করতে-করতে যেন রিদয়ের কথা শুনেও শুনলে না—এইভাবে পায়ের আঙুল থেকে ল্যাজের ডগাটি পর্যন্ত রোদে বসে চেটে-চেটে সাফ করতে লাগল। রিদয় একবার পাখিদের রাগিয়ে জব্দ হয়েছে; সে বেরালকে খুব মিষ্টি করে আবার শুধোলে—“বল না মেনি, গণেশঠাকুর কোনদিকে গেলেন?” মেনি বললে—“গণেশঠাকুর কাছেই এক-জায়গায় আছেন, কিন্তু তোমাকে বলছিনে বাপু!” রিদয় আরো নরম হয়ে বললে—“লক্ষ্মীটি, বল, কোথায়? তিনি আমার কি দশা করেছেন দেখছ!” বেরাল যেন অবাক হয়ে সবুজ চোখ-দুটো বড় করে রিদয়ের দিকে চাইলে; তারপর গোঁফ ফুলিয়ে ফ্যাঁচ করে দাঁত-মুখ খিঁচিয়ে বললে—“তোমায় দেখে দুঃখু হবে না? আমার ল্যাজে কত কাঁকড়া ধরিয়েছ তুমি! তোমাকে গণেশের খবর দেব না তো দেব কাকে? হুঁঃ!” বলে বেরাল একবার গা ঝাড়া দিলে। রিদয় আর রাগ সামলাতে না পেরে “দেখবি ল্যাজ ধরে টানি কি না” বলে যেমন বেরালের দিকে এগিয়ে গেছে অমনি বেরাল বাঘের মতো ফুলে উঠল! তার রোঁয়াগুলো সজারুর কাঁটার মতো সোজা হয়ে উঠেছে, পিঠ ধনুকের মত বেঁকেছে। ল্যাজ ফুলিয়ে কানদুটো সটান করে কটমট করে চেয়ে বেরাল নখে মাটি আঁচড়াতে লাগল। রিদয় বেরাল দেখে ভয় পাবার ছেলে নয়। যেমন সে তেড়ে বেরালকে ধরতে গেছে, অমনি বেরাল ফ্যাঁচ করে হেঁচে এক থাপ্পড়ে রিদয়কে উল্টে ফেলে তার বুকে দুই পা দিয়ে চেপে বসে দাঁত-খিঁচিয়ে বললে—“আবার বজ্জাতি! এখনো বুঝি শিক্ষা হয়নি? বুড়ো আংলা কোথাকার! জানিস, এখন নেংটি ইঁদুরের মতো তোকে ঘাড়-মটকে খেয়ে ফেলতে পারি!” বেরাল যে ইচ্ছে করলে এখনি নখ দিয়ে তার বুকটা চিরে, দাঁত দিয়ে তার কান দুটি কেটে নিতে পারে, তা বাঘের মতো বেরালের নিজ-মূর্তি দেখে রিদয় আজ বেশ বুঝলে। সে নিজে যে আজ কত ছোট হয়ে গেছে, তাই ভেবে রিদয়ের চোখে জল এল। চোখে জল দেখে বেরাল রিদয়কে ছেড়ে দিয়ে বললে—“ব্যাস! আজ এইটুকু শাস্তি দিয়ে ছেড়ে দিলুম—তোর মায়ের অনেক নিমক খেয়েছি! আজ দেখিয়ে দিলুম তোর জোর বেশি, না আমার জোর বেশি! আর কখনো পশুপাখির সঙ্গে লাগতে যাসনে—যাঃ!” বাঘের মাসি বেরাল চারপায়ে দাঁড়িয়ে একবার গা-ঝাড়া দিয়ে ল্যাজটা বুড়োআঙুলের মতো দুবার রিদয়ের মুখের সামনে নেড়ে আবার ভালোমানুষটির মতো আস্তে-আস্তে হেঁসেলের দিকে চলে গেল। রিদয় লজ্জায় মাথা হেঁট করে আস্তে-আস্তে গোয়াল-বাড়িতে গণেশকে খুঁজতে চলল। ধলা গাই, কপ্‌লে গাই, কালো গাই—তিন গাই গোয়ালে বাঁধা। রিদয় কাছে আসতেই এই তিন গাই এমনি দাপাদাপি হামাহামি শুরু করে দিলে যে মনে হল তিরিশটা ষাঁড় সেখানে হুটোপাটি লাগিয়েছে! রিদয় শুনলে ধলা বলছে—“হবে না? মাথার উপর ধর্ম আছেন। হুঁ হুঁ!” কপ্‌লে গাই বললে—“আমার কানে বোলতা ছাড়া? হুঁ হুঁ!” এই সময় রিদয়কে গোয়ালের দুয়োরে দেখে কালো গাই লাথি ছুঁড়ে বললে—“খবরদার! দেখেছ, এক লাথিতে মাথার খুলি ফাটিয়ে দেব।” ধলা বললে—“আয় না, এইবার শিং ধরে নাড়া দিবি!” কপ্‌লে বললে—“একবার বোলতা নিয়ে কাছে এস না, মজাটা টের পাইয়ে দিচ্ছি!” কালো—সে সব-চেয়ে বুড়ি, সব-চেয়ে জোরালো গাই, সে বললে—“বড় যে আমাকে ঢিল মারা হত। আবার সেদিন আমাকে জুতো ছুঁড়ে মারা হয়েছিল! আয়, একবার আমার খুরের ঘা খেয়ে যা! রোজ দুধ-দুইবার সময় দুধের কেঁড়ে উল্টে দিয়ে মাকে নাস্তানাবুদ করে তবে ছাড়তিস। আহা, এমন দিন নেই যে তিনি তোর জন্য না কেঁদেছেন। আয়, আজ একবার তার শোধ তুলব। বাপরে বাপ, কি দুষ্টু ছেলে গো! গণেশঠাকুর—তাঁর সঙ্গে লাগা!” রিদয় গরুদের সঙ্গে ভাব করে বলতে চাইছিল—যদি তারা গণেশঠাকুরকে দেখিয়ে দেয়, তবে কোনোদিন আর সে কারো কাছে কোনো অপরাধ করবে না; কিন্তু গাই তিনটে এমনি ঝাঁপাঝাঁপি আরম্ভ করলে যে রিদয়ের ভয় হল যদি দড়ি ছিঁড়ে এরা বেরোয়, তবে আর রক্ষে রাখবে না! সে আস্তে-আস্তে গোয়াল ছেড়ে সরে পড়ল। পশু-পাখি কেউ তাকে তো দয়া করলে না! গণেশের দেখা যদিই বা পাওয়া যায়, তবে তিনিও যে এদেরই মতো তাকে খেদিয়ে দেবেন না, তারই বা ঠিক কি! সবার কাছে তাড়া খেয়ে বেচারা রিদয় বেড়ার ধারে মুখ-চুন-করে এসে বসল। এ-জন্মে আর সে মানুষ হবে, এমন আশা নেই। মা-বাপ হাট থেকে যখন এসে দেখবেন ছেলেটি যক্‌ হয়ে গেছে, তখন তাঁদের দুঃখের আর সীমা থাকবে না! সে তো জানা কথা। কিন্তু পাড়ার লোক, এমন কি ভিন্‌-গাঁ থেকে ছেলে-বুড়ো সবাই বুড়ো-আংলা দেখতে দলে-দলে এসে তাকে ঘেরাও করবে। হয়তো কাগজওয়ালারা তার ছবি তুলে ছাপিয়ে দেবে নিচে বড়-বড় করে লিখে—“আমতলিতে এই অবতারটি নষ্টামির ফল পেয়েছেন—ইনি দ্বিতীয়কালাপাহাড়, হিন্দুকুলকলঙ্ক!” হয়তো বা কোনদিন আলিপুরের চিড়িয়াখানায় নতুন জানোয়ার বলে টিকিট-মারা খাঁচায়, নয়তো তেলে ভেজে যাদুঘরের কাঁচের সিন্দুকে চাবি দেওয়া হবে! রিদয় আর ভাবতে পারলে না, দুই হাতে মুখ ঢেকে কাঁদতে লাগল! আর সে মানুষের ছেলেদের সঙ্গে খেলতে পাবে না, সবাই তাকে দেখলে যক্‌ বলে সরে যাবে, কেউ তার সঙ্গে মেয়ের বিয়ে দেবে না, আর এই ঘর-বাড়ি—রিদয় তাদের বাড়ির দিকে চেয়ে দেখলে। খড়ের চাল ছোট-ছোট তিনখানি থাকবার ঘর; তার চেয়ে ছোট রান্না-ঘরখানি; তার চেয়ে ছোট গোয়াল-ঘর; ঢেঁকিশাল, ধানের মরাই, আর এতটুকু সেই পুকুর; তার চারদিকে চারটিখানি শাক-সবজী। রিদয়দের বাড়ি নেহাত সামান্য-রকমের, কিন্তু তা হলেও এই সামান্য জমিটুকু—ক’খানি ঘর, হাঁসপুকুর, বাঁশঝাড়, তেঁতুল-গাছটি নিয়ে, কি সুন্দরই ঠেকল! যেন একখানি ছবি! অথচ এই বাড়ি ছেড়ে কতবার রিদয় মনে করেছে পালাবে; আজ কিন্তু সেই বাড়ির দিক থেকে তার চোখ আর ফিরতে চায় না! দিনটি আজ আমতলি গ্রামখানির উপর, তাদের এই ঘর ক’খানির উপর কি আলোই ফেলেছে! চারদিক ঝকঝক করছে, ঝুরঝুর করছে! পাখি গাইছে, ভোমরা উড়ছে; বাতাস ছুটেছে, নদী চলেছে—কল-কল, কুল-কুল, ফুর্‌ফুর্‌! চারদিক আজ উল্‌সে উঠেছে, কেবল মাঝে বসে রয়েছে রিদয়—একলাটি মুখ-চুন করে। সে ভাবছে, কোথায় যাবে—কি করবে? সে যক্‌ হয়েছে, মানুষের সঙ্গে তার সম্পর্ক উঠে গেছে। গণেশের অভিশাপে এখন অন্ধকার পাতালপুরীতে সাপের সঙ্গে যক্‌ হয়ে থাকা ছাড়া আর কি উপায় আছে? গণেশের সন্ধান করে শিবের বাড়ি কৈলাস-পর্বত পর্যন্ত যদি তাকে হেঁটে যেতে হয়, তাও স্বীকার, কিন্তু পাতালপুরীতে সে কিছুতে যেতে পারবে না! এই প্রতিজ্ঞা করে রিদয় কোমর-বেঁধে উঠে দাঁড়াল! এই সময় সেওলায়-পিছল রাস্তা দিয়ে গুগলী আস্তে আস্তে চলেছে। রিদয়কে গুগলী শুধোলে—“কোথায় যাওয়া হচ্ছে এত তাড়াতাড়ি?” রিদয় পাখিদের কাছে, পশুদের কাছে দাবড়ি খেয়ে ঢিট হয়ে গিয়েছিল, এবারে সে খুব ভদ্রতা করে উত্তর দিলে—আজ্ঞে, আমি কৈলাস-পর্বতে শ্রীশ্রীগণেশঠাকুরের ছি-চরণে কিছু নিবেদন করতে যাচ্ছি। আপনি কোথায় যাচ্ছেন?” গুগলী উত্তর করলে—“আমি গঙ্গাসাগরে ছান কত্তি যেতেছি।” রিদয় মুচকে হেসে শুধোলে—“কতদিনে সেখানে পৌঁছবেন?” “যে কয়দিনে পারি।” বলে গুগলী রিদয়কে শুধোলে—“কৈলাস-পর্বতে তুমি কহন পৌঁছাবে?” “বোধ হয় দুচারদিনে।” বলে রিদয় আস্তে-আস্তে গুগলীর সঙ্গে চলল। গুগলী খানিক চুপ করে থেকে বললে—“আমি বোধকরি দ্যেড় দিনট্যেকের মধ্যেই গঙ্গাসাগরে পৌঁচে যাব, কি বল?” রিদয় এবার ঘাড়-নেড়ে বললে—“তা কেমন করে হবে? যে গুটিগুটি আপনি চলেছেন, তাতে ঐ হাঁসপুকুরে পৌঁছতেই তো আপনার একদিন লাগবে।” গুগলী বললে—“ওহান থিকে না হয় বড় জোর একটা দিন লাগুক। পুকুরের ওপারটাতেই তো সুমুদ্দুর!” রিদয় হেসে বললে—“তবেই হয়েছে! পুকুরের ওধারে পুকুরের পাড়, তারপরে সবজী-ক্ষেত, তার ওধারে তেপান্তর মাঠ, মাঠের ওধারে সব গ্রাম। গ্রামের পর বন, বনের পর নদী, নদীর ওপারে নগর, নগরের পরে উপনগর, তার পরে উপবন, উপবনের পরে উপদ্বীপ, তারপর উপসাগরের উপকূল, তারপর উপসাগর—যেখানে গঙ্গার স্রোত গিয়ে পড়েছে। দেড়-দিন কি, দেড়-বছরে সেখানে পৌঁছতে পারেন কি না সন্দেহ। কেন মিছে হাঁটছেন? নিজের ঘরে ফিরে যান!” গুগলী ভাবলে রিদয় তার সঙ্গে মস্কারা করছে। সে আকাশে নাক তুলে বললে—“আর তুমি ভাবছ দিন চারেকে কৈলাস-পর্বতে যাবা—এই পিঁপড়ার মতো সরু–সরু ঠ্যাং চালিয়ে? যদি দিন রাত চলি যাতি পার, তথাপি চার-বছরে তুমি সেহানে পৌঁছতি পার কিনা সন্দেহ। এই আমতলি, ইহার পর জামতলি, তেঁতুলতলি, বটতলি—অমনি পর-পর কত যে গ্রাম তার ঠিকানা মেলে না। তারপরে নদীর ধারে এ-নগর, সে-নগর; উপনদীর ধারে সকল উপনগর; তৎপরে এ-ঘাট, ও-ঘাট, সে-ঘাট; এ-মাঠ, ও-মাঠ, সে-মাঠ; এ-বন, ও-বন, সে-বন; তাহার পর উপত্যকা, উপত্যকা বাদ পাহাড়তলী, তৎপরে চিত্রকূট, ত্রিকূট, পরেশনাথ, চন্দ্রনাথের পাহাড়-পর্বত; তাহার পর বিন্ধ্যাচল, তাহার পর সীমাচল তবে হিমাচল! তৎপরে রামগিরি, তাহার পরে ধবলগিরি, তৎপরে মানস-সরোবর, উহার ওধারে তিব্বত, আরো ওধারে কৈলাস–পর্বত। এই নদ-নদী পাহাড়-জঙ্গল ভাংতি-ভাংতি সেহানে যাওয়া গঙ্গা-ফড়িংটির-প্রায়—তোমার কর্ম! পক্ষীরাজ-ঘোড়া যে, সেও সেহানে যাতি পারে না চারি হপ্তায়, তুমি তো তুমি! ঘরের ছেলে ঘরে গিয়া বৈসা থাহ; কৈলাসের আশা ছাড়ি দ্যেও।” রিদয় বললে—“আমি যেখানে যাব বলে বেরিয়েছি, সেখানে যাবই!” গুগলীও বললে—“আমিও যেহ্যনে যাত্রা করি বাইরেচি, এই বেদ্ধোকালে, সেহ্যেনে গঙ্গাসাগরে না যাইয়া আমি ছাড়মুনি।” ঠিক সেই সময় খোঁড়া-হাঁস পুকুর থেকে ছপ-ছপ করে উঠে এসে টুপ করে গুগলীটিকে খেয়ে মাঠের দিকে চলল। রিদয় তাকে শুধোলে—“কোথায় যাওয়া হচ্ছে?” “মানস-সরোবরে!” বলে হাঁস হেলতে-দুলতে আগুয়ান হল। রিদয় দেখলে বড় সুবিধে, মানস-সরোবর পর্যন্ত হাঁসের সঙ্গে যাওয়া যাবে; তারপর তিব্বত, তার পরেই কৈলাস। সে আর কোনো কথা না বলে তার মা সুবচনী-ব্রত করতে যে খোঁড়া-হাঁস পুষেছিলেন, তারি সঙ্গে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে পড়ল।
অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর
আসামী বুরুঞ্জি অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর উত্তর থেকে বড়নদী দেখানে ব্রহ্মপুত্রের জলে এসে মিলেছে ঠিক সেই বাঁকের মুখেই কতকালের পুরানো ডিমরুয়ার আসামী রাজা আড়িমাওয়ের নাটবাড়ি। নাটবাড়ির নিচেই নদী মজে গিয়ে মস্ত চর পড়েছে। এত কাল থেকে হাড়গিলে পাখিরা এই চর দখল করে আছে যে, ক্রমে চরটার নামই হয়ে গেছে হাড়গিলার চর। এই চরের ওপারেই দেওয়ানগিরি মস্ত একটা বুড়ো আঙুলের মতো আকাশের দিকে ঠেলে উঠেচে। এই দেওয়ানগিরি হল যত ফরিয়াদি পাখির আড্ডা। একপারে রইল আসামী মাছেদের রাজা আড়িমাওয়ের নাটবাড়ি আর এক পারে দেওয়ানী ফরিয়াদির আড্ডা দেওয়ানগিরি, মাঝখানে বসে রয়েছেন হাড়গিলে। আসামী ফরিয়াদিতে লড়াই মোকদ্দমা প্রায়ই হয়, তাতে দুই দলই মাঝে-মাঝে মারা পড়ে। হাড়গিলের খাম্বাজং রাজা দুই দলের মধ্যে আরামে বসে দুই দলেরই হাড়-মাস খেয়ে সুখে আছেন, এমন সময় চর মুখে খবর পৌঁছল বুড়ো-আংলা আসছেন। হাড়গিলের রাজা খাম্বাজং লম্বা-লম্বা পা ফেলে জলের ধারে তাঁর কাশবাগিচায় বেড়িয়ে বেড়াচ্ছেন। ‘চুপিম-পা’ আর ‘চোরম-পা’ দুই সেনাপতি পায়ে-পায়ে হাড়গিলে রাজের কাছে হুকুম নিতে এলেন—রিদয়-হংপালকে এপথে আসতে দেওয়া কি না! খাম্বাজং হাড়গিলে অনেকক্ষণ আকাশের দিকে ঠোঁট উঁচিয়ে ভেবে বললেন—“আসতে দিতে পার।” হঠাৎ দেশের মধ্যে মানুষ আসতে দিতে হাড়গিলেচরের প্রজারা রাজী ছিল না। দুই সেনাপতি একটু ইতস্তত করছে দেখে খাম্বাজং সভাপণ্ডিত চুহুংমুংকে ডেকে বললেন—“দেখ তো বুরুঞ্জি পুঁথিতে কলির কত হাজার বছরে এখানে মানুষের আগমন লিখছে?” চুহুংমুং মুখ গম্ভীর করে বুরুঞ্জির পাতা উল্টে-পাল্টে মাটিতে খানিক আঁক-জোঁক কেটে বললেন—“আগামী ভূতচতুর্দশীতে এখানে সিদ্ধিদাতা গণেশের শাপভ্রষ্ট একজন উপস্থিত হবেন, বারো বৎসর এগারো দিন একদণ্ড তিনপল উনপঞ্চাশ বিপল বয়সে বুরুঞ্জিতে লেখে—সুন্দরবনস্থ আমতলি গ্রামের কাশ্যপ গোত্রের অঙ্গুষ্ঠপ্রমাণ এই মহাপুরুষ, তাঁর আগমনে দেশে সুখসৌভাগ্য সঙ্গে-সঙ্গে মূষিক ও মশক বৃদ্ধি, হেঁড়েল বংশ ধ্বংস ও চুয়াদিগের নাটবাড়ি আক্রমণ এবং হাড়গিলা প্রভৃতির প্রচুর ভোগ ঐশ্বর্য এবং সর্ব-সিদ্ধি যোগ। গণেশ চতুর্থীতে এই কলির বামন অবতার হংসরথে গৃহত্যাগ করবেন এবং ভূতচতুর্দশীতে উনপঞ্চাশ পবনে ভর দিয়ে কল্পব্দ উনশত উনপঞ্চাশে সূর্যাস্তের দিক হতে উদয় হয়ে ক্রমে সূর্যোদয়ের দিকে অভ্যুত্থান করবেন। শ্যামবৰ্ণ সুন্দর বপুঃ বুড়োরষ্ট বৃষস্কন্ধ শালপ্রাংশু মহাভূজ” বলে চুহুংমুং বুরুঞ্জি বন্ধ করলেন। সেইদিন থেকে হাড়গিলের রাজা খাম্বাজং ভাঙাচোরা পুরানো নাটবাড়ির চুড়োয় গিয়ে একপায়ে দাঁড়িয়ে পশ্চিমমুখো হয়ে ঘাড় তুলে রইলেন—হংপাল কখন আসেন দেখতে, ওদিকে কাকচিরাতে কাকেদের রাজা যোম কাকের কাছে চাঁদপুরী শেয়াল খবর দিয়ে গেল—টিকটিকির মতো এক মানুষ এসে ভেড়াদের বিদ্রোহী করে তুলে হেঁড়েল বংশ ধ্বংস করলে, এবারে কাকেদের আর এঁটো-কাঁটা হাড়-গোড় কিছু পাবার উপায় থাকবে না। মাংসখোর সব মারা গেল, কেইবা আর ভেড়া মারবে, ছাগল ধরবে। কাকচিরাতে কাকের ঘোঁট বসে গেল, কি করলে মানুষটাকে সরানো যায় দেশ থেকে, আর ভেড়া গরু ছাগল এদের আরো বেশি করে উপযুক্ত শিক্ষা দিয়ে ছেড়ে দেওয়া যায়—যাতে কোনো দিন তারা ফেরুপাল বা সনাতন স্বধর্মের ভুঁড়ো-শেয়ালেদের বিরুদ্ধে শিং চালাতে না পারে। নদী মাঠ আর জঙ্গল এই তেমাথার মধ্যে রয়েছে কাকচিরার না জঙ্গল, না মাঠ, না পাহাড়, না বালুচর—দূরে থেকে দেখলে বোধ হবে জমিটাতে ঘাসও যেমন গাছও তেমন, পাহাড়ও রয়েছে, নদীও বইছে কিন্তু কাছে গিয়ে দেখ কেবল চোরকাঁটা, শেওড়া আর বড়-বড় নোড়ানুড়ি, কাঁকর, বালি। তার মধ্যে এখানে-ওখানে কাদাজল নালা নর্দমা! কোনকালে ফেনচুগঞ্জের এক নীলকর সাহেব এখানে এক মস্ত কুঠি বানিয়েছিল। সেই বাংলা-ঘরখানা এখনো রয়েছে, কিন্তু মানুষ কেউ নেই। কুঠিবাড়ির বাগানে চোরকাঁটার সঙ্গে গোটাকতক দোপাটি ফুলের গাছ, ঘরের সমস্ত সার্সি দরজা বন্ধ, জিনিসপত্র যেখানকার সেখানে গোছানো, অথচ কেউ নেই এখানে। দরজায় চাবি দিয়ে বাড়িওয়ালা যেন দুদিনের মধ্যে আসবে বলে গেল, যেখানে সার্সিটা ভাঙা ছিল সেখানে কাগজ মেরে ঘরগুলি গুছিয়ে রেখে চোরের ভয়ে তালা বন্ধ করে সব ঠিকঠাক রেখে গেল, কিন্তু কোনো দিন এসে আর চাবি খুলে কেউ ঘরে ঢুকল না। বর্ষা এসে সার্সির ফাঁকে আঁটা পুরানো খবরের কাগজটা গলিয়ে দিলে, কাকচিরার একটা কাক কোন সময়ে একদিন ঠোঁটে করে সেই কাগজখানা ঠেলে ফেলে ঘরের ভিতরে যাবার আসবার একটা পথ করে রেখে দিলে। তারপর একদিন বোশেখ মাসে ডিম পাড়বার সময় দলে-দলে কাক এসে কাকচিরায় চিরকাল যেমন বাসা বেঁধে আসছে তেমনি ঘরকন্না পেতে জায়গাটা দখল করে বসল। সকাল না হতে দূর-দূর গ্রামে তারা চরতে যায়, এটোঁ-কাঁটার সন্ধানে। কিন্তু সন্ধ্যার আগেই দলে-দলে এই আপন রাজত্বে তারা ফিরে আসে, রাঙা আকাশ কালো করে। আমাদের মধ্যে যেমন ডোম চাঁড়াল তেলি মালি যুগি কায়েত বামুন এমনি নানা জাত, কিন্তু দেখতে চেহারায় মানুষ, তেমনি কাকেদের মধ্যেও দেখতে কাক কিন্তু জাত হরেক রকমের রয়েছে—যেমন ডোমকাক বা যোমকাক, ধাড়িকাক বা দাঁড়কাক বা দাঁড়াকাক, ধোড়াকাক, ঝোড়োকাক, ঢোঁড়াকাক, পাণিকাক বা পাতিকাক, শ্বেতকাক বা ছিটেকাক, ভুষোকাক বা ভুষুণ্ডেকাক! সব কাকেরই চালচলন এক ভাবা ভুল, এদের মধ্যে কোনো দল তারা ভদ্দর সভ্য-ভব্য কাক, ছোলাকলা চিংড়িমাছটা আঁসটা আর বামুনের মতো মরা জানোয়ারের শ্রাদ্ধের ফলার খেয়ে দিন কাটায়, আর একদল কাক তারা যা তা খায় বাচবিচার নেই, পাখির ছানা খরগোস ছানা খেয়েই এরা সুখ পায়। কোনো দলের পেশাই হল লুটতরাজ চুরি চামারি খুনখারাবি। এদের জ্বালায় পাখির বাসায় ডিম থাকবার যো নেই, বাইরে কিছু চকচকে জিনিস রাখবার উপায় নেই। আমসত্ত্ব শুকোতে দিলে এরা খেয়ে যায়, কাপড় শুকোতে দিলেও টেনে ছেঁড়ে, ছেলের হাতের মোয়া কেড়ে খায়, বুড়োর পাকা মাথায় ঠোকর বসায়, চালের খড় টেনে ফেলে, ভাতের থালায় ছোঁ দেয়, এমনি নানা উৎপাত করে বেড়ানোই এদের কাজ। কাকেদের ডাক নাম শুনলেই বোঝা যায় কোন দল কেমন—যেমন যোমকাকের বংশ তারা হল ডোমকাক, এদের সবাই ভয় করে। মড়া জানোয়ার নিয়ে ছেঁড়াছেঁড়ি মারামারিই এদের কাজ। তারপর ধাড়িকাক বা দাঁড়কাক—এরা পুরোনো চালের, কাক যখন কোকিলের মতো গাইতে পারত তখন লোকে এদের পুষে দাঁড়ে বসিয়ে-বলিয়ে ছোলা খাওয়াত। সেই থেকে এরা নানা বিদ্যেতে কৌশলে কারিগরীতে মজবুদ বলে সব কাকই দায়ে পড়লে এদের পরামর্শ মতো চলে। তারপর, ঝোড়োকাক—এরা এককালে সব চেয়ে সাহসী বড়ই নামজাদা রাজবংশ ছিল, এখন বিষ হারিয়ে ঢোঁড়াকাক হয়ে পড়েছে কাজেই চুপচাপ থাকে সন্ন্যাসীর মতো। পাতিকাক হল পাণিকাকের বংশ, এরা সব দলেই আছে কিন্তু কোনো দলেই এদের পোঁছে না, পুকুর পাড়ে এরা গুগলি শামুক এটোঁ-কাঁটা খেয়েই দিন চালায়। শ্বেতকাক—এরা আসলে দিশি কালো কাকেরই বংশ কিন্তু রঙ বদলে শাদা বিলিতি কাক হতে যাচ্ছে—এদের কারু গলা শাদা, কারু ডানা শাদা, কারু মাথা শাদা, এখনো দোরঙা আছে বলে এদের নাম ছিটেকাক হয়েছে। পৃথিবীর আদি কাক হল ভুষুণ্ডিকাক, তারি বংশ ভুষুণ্ডে বা ভুষো, দেখতে কালিঝুলি, সত্য, ত্রেতা, দ্বাপর, কলি, এই কাকের বংশ চলে আসছে—এদেরই পূর্বপুরুষ রামের সঙ্গে লড়ায়ে একচোখ হারিয়েছিল, সেই থেকে এদের নাম-ডাক ছড়িয়ে পড়েছে, এমন কি এদের নকল করে অনেক কাক একচোখো সেজে নিজেদের বলাতে চাচ্ছে এদেরই একজন, আসলে হয়তো সে পাতিকাক, কিন্তু লেখবার বেলায় লিখছে পাতি অব্‌ ভুষুণ্ডি! এই সব নানা ধরনের কাকেদের মধ্যে যখন যে দলপতি হয় তখন কাক সমাজকে সে নিজের মতো ভালো-মন্দ নরম-গরম ভাবে চালায়, এই হল কাক সমাজের নিয়ম। যে কাকটা নীলকর সাহেবের ঘরের সার্সিতে মস্ত ফাঁকটা আবিষ্কার করেছিল, সে বহুকালের পুরোনো রাজবংশী ঢোঁড়াকাক। যতদিন এই ঢোঁড়াকাক দলপতি ছিল ততদিন কাক সমাজ ভদ্ররকম ছিল, কোনো পাখিই তাদের কোনো দোষ কোনো খুঁত ধরতে পারেনি। কিন্তু কাক সমাজে ক্রমে প্রজা বৃদ্ধি হয়ে নানারকম কাক তাতে এসে যখন সেঁধোল তখন চাল-চোলও ক্রমে বদলাতে আরম্ভ করলে। শেষে একদিন সবাই মিলে ঢোঁড়াকাককে সিংহাসন থেকে তাড়িয়ে ডোমকাককে সর্দার করে এমন লুটতরাজ মারামারি আরম্ভ করে দিলে যে, পায়রা, সিকরে, গেরোবাজ এমন কি পেঁচারা পর্যন্ত অস্থির হয়ে কাকচিরে ছেড়ে পালাতে পথ পেলে না। পুরোনো দলপতি ধোড়াকাক সিংহাসন ছেড়ে মনের দুঃখে ঝোড়োকাকের মতো হয়ে ডানা ঝুলিয়ে চুপচাপ শেওড়াগাছের ডালে দিন কাটায়, কেউ তাকে কোনো কথা শুধোয় না, সবাই মিলে বলতে লাগল ওটা বিষ হারিয়ে ঢোঁড়া হয়েছে, বুড়ো হয়ে বুদ্ধি-সুদ্ধি লোপ পেয়েছে। নতুন দলপতি ডোমকাক তামাশা করে তার নাম রাখলে ডরা-কাক, দেশের লোক তাকে বললে ঢোঁড়াকাক! একেবারে কাজের বার ভেবে সবাই তাকে তুচ্ছ করছে দেখে ঢোঁড়াকাক মনে-মনে একটুখানি হেসে আপনার কোণটিতে চুপচাপ রইল। নতুন রাজা ডোম জাঁক দেখাবার জন্যে প্রায়ই ঢোঁড়াকে রাজবাড়িতে নিমন্ত্রণ দিত। কোনো দিন বা নিজের বীরত্ব আর বাহাদুরি দেখাতে শিকারের সময় প্রায়ই সঙ্গে নিত। ঢোঁড়া সব বুঝত কিন্তু বুঝেও বোবা হয়ে থাকত। ফেনচুগঞ্জের নীলকর সাহেব যদিও অনেক কাল হল কুঠিবাড়ি ছেড়ে গেছে, কিন্তু এখনো কোনো কাকের এমন সাহস হয় না যে সে দিকে যায়, কিন্তু ডরাকাক বলে ডোমকাকের দল যাকে তুচ্ছ করছে সেই কাকটি গিয়ে একদিন কুঠি-বাড়ির মধ্যে যাবার একটি রাস্তা করে এল নিজের বুদ্ধি খাটিয়ে একলা গিয়ে, কিন্তু খবরটা সে কাউকে জানায়নি! একে মানুষ তাতে গোরা, তার ঘরে সুড়ঙ্গ কাটা, বাঘের ঘরে ঘোগের বাসার চেয়েও অসমসাহসের কাজ, কোনো কাক এ পর্যন্ত যা পারেনি ঢোঁড়া সেই কাজটা করেছে—অথচ মুখে তার কথাটি নেই, অন্য কাক হলে চীৎকারের চোটে কাকচিরে মাত করত। নতুন দলপতি ডোমকাকটা দিনের বেলায় এই বুকে পাটকিলে ডোরা টানা ধোড়াকাককে ভয় করে খাতির করে চলত, ধোড়ার বুকের লাল ডোর দেখে তার মনে হত যেন কতকালের মহাযুদ্ধের রক্তের দাগ রাজটিকের মতো এখনো এর বুকে দাগ রয়েছে। কিন্তু রাতে অন্ধকারে যখন লাল-কালো সব এক হয়ে গেছে তখন ডোমকাক ধোড়াকে জ্বালাতন করতে ছাড়ত না—একদিন প্রায় মেরেই ফেলেছিল। সেইদিন থেকে ধোড়া বা ঢোঁড়াকাক শেওড়া গাছে আর ঘুমোতে যেত না, সেই সার্সি দিয়ে চুপিচুপি ঘরের মধ্যে গিয়ে দেওয়ালের গায়ে বেলা আড়াইটা বেজে বন্ধ হওয়া একটা ঘড়ির পিছনে বসে রাত কাটাতে আরম্ভ করলে। রিদয় যে ঝড়ে পড়ে যোগী-গোফার আশ্রয় নিয়েছিল সেই ঝড়ে কাকচিরার বহুকালের পুরোনো শেওড়া গাছটা গোড়া সুদ্ধু উপড়ে রাজ্যের ডোমকাকের বাসা ডিম ছানা-পোনা নিয়ে উল্টে পড়ল ঠিক বেলা আড়াইটাতে। বাসা গেল, ডিম ভাঙল, তাতে কাগেদের বড় একটা দুঃখ হল না, কিন্তু গাছের গোড়াটা যেখানে উল্টে পড়ে বড় একটা গর্ত দেখা দিয়েছে, সেই গর্তটায় কি আছে না আছে খুঁজে দেখবার জন্যে দলে-দলে কাক আকাশের দিকে পা করা গাছের মোটা-মোটা শিকড়গুলা নিয়ে টানাটানি চেঁচামেচি বাধিয়ে দিলে। ডোমকাক, ঢোঁড়াকাক পাতিকাক দু’জনকে নিয়ে একেবারে ডোবাটার মধ্যে উড়ে পড়ে এদিক-ওদিক তদারক করে ইট পাটকেল উল্টে-পাল্টে দেখতে লাগল! হঠাৎ এত বড় গর্তটা কেন এখানে আসে, ঠোকর দিয়ে সন্ধান করতে-করতে গর্তের একদিকে খানিক কাঁকর মাটি ঝরঝর করে খসে পড়ল, আর দেখা গেল ইটে-গাঁথা একটা চোর-কুঠুরী, তার মধ্যে তালা দেওয়া ছোট একটা পেটরার সামনে একটা মড়ার মাথা, কতকালের কলঙ্ক-ধরা একটা পিদুম আর গোখরো সাপের একটা খোলস! মড়ার মাথা সাপের খোলস দুটোই সব কাকের দেখা ছিল, পিদুম নিয়েও অনেকবার তারা পালিয়েছে, কিন্তু পেঁটরাটার মধ্যে কি আছে কোনো কাকই তা জানে না, কাজেই এদিকে-ওদিকে ঠোকর দিয়ে তালাটা ধরে নাড়া দিয়ে দেখছে, এমন সময় গর্তের উপর থেকে খেঁকশেয়াল আস্তে-আস্তে বললে—“হচ্ছে কি? ওটা নিয়ে নাড়াচাড়া কর না, ওতে সাত রাজার ধন আছে, যদি খুলতে চাও তো একজন যক্ ধরে আনো, যকের ধন যক্‌ না হলে কেউ খুলতে পারবে না।” সাত রাজার ধন আছে শুনে কাকদের চক্ষু স্থির! চকচকে পয়সা মোহর ভালোবাসতে তাদের মতো দুটি নেই, ডোমকাক পাতিকাক ভূষোকাক ছিটেকাক দাঁড়কাক সব কাক এসে শেয়ালকে ঘিরে—ক্যা-ক্যা-ক্যা কও-কও-কও রব করে গণ্ডগোল বাধিয়ে দিলে। ডোমকাক সবাইকে ধমকে চুপ করিয়ে শেয়ালকে শুধোলে—“যক্‌ এখন কেমন করে পাওয়া যায়?” শেয়াল ডাঁওর করে মাথা চুলকে নাক রগড়ে যেন কতই ভেবে বললে—“আমি জানি এক যকের সন্ধান, সে ছুঁলেই এই বাক্স খুলে যাবে!” কাকেরা অমনি চীৎকার করে উঠল—“কই-কই”—বলে এগিয়ে গর্তের মধ্যে ঝাঁপিয়ে পড়ল। ডোমকাক তাড়াতাড়ি পেঁটরার উপরে চেপে বললে—“রও-রও”। তারপর শেয়াল এগিয়ে এসে বললে—“আমি সেই যকের সন্ধান তোমাদের দিতে পারি, যদি তোমরা এই সিন্দুক খুলিয়ে নিয়ে যক্‌টিকে আমার পেট ভরাবার জন্যে দিতে রাজী হও।” কাকেরা শেয়ালের কথায় রাজী হলে শেয়াল তাদের রিদয়ের খবর জানিয়ে দিলে। তিনকুড়ি কাক সঙ্গে ডোমরাজা ঢোঁড়াকাককে সঙ্গে নিয়ে যক্ ধরতে চলল পাহাড়-জঙ্গলের উপর দিয়ে। হাড়গিলের রাজা খাম্বাজং যখন চৌষট্টিখানা নাটবাড়ির নহবতখানার চূড়োয় পশ্চিমমুখো হয়ে রিদয়ের আশায় রয়েছেন, আর কাকদের রাজা ডোম রিদয়কে ধরবার জন্যে বনে-জঙ্গলে সন্ধান করে বেড়াচ্ছে, সেই সময় গণেশের নেংটি ইঁদুরদের সঙ্গে পাহাড়ি চুয়োদের যুদ্ধ বেধে গেল। ব্রহ্মপুত্র আর বড়নদীর মোহনার পুরোনো নাটবাড়িটা ইঁদুরদের দখলে কতকাল থেকে আছে তার ঠিকানা নেই। দেওয়ানগিরির উপরে কেল্লার মতো আড়িমাও রাজাদের নাটবাড়ি, প্রকাণ্ড কারখানা, এত বড় নাটবাড়ি যে সেখানে রাজাদের আমলে যে-সব হাতি-ঘোড়া সেপাই-শান্ত্রী থাকত সেগুলোকে দূর থেকে মনে হতো যেন ছোট পুতুল চলে বেড়াচ্ছে। দশ-বারো-হাত চওড়া এক-একখানা পাথরের ইঁটে গাঁথা বাড়ির দেওয়ালগুলো, এক-একটা থাম যেন এক-একটা তালগাছ! সাততলা বাড়ি কিন্তু তার নিচের পাঁচতলা নিরেট দেওয়ালে ভরাট করা, তার মাঝে পাহাড়ের গহ্বরের মতো অন্ধকার একটা সিংগি দরজা, আশে-পাশে বাক্‌সর মতো চোরকুঠুরী। সেগুলোতে দেওয়ালই সব, থাকবার জায়গা অল্পই, তাও আবার এখানে-ওখানে লোহার গরাদ দিয়ে বন্ধ, কত কালের অস্ত্র-শস্ত্র, রাজাদের আসবাব-পত্র, চাল-ডাল, ঘি-ময়দা, ধন-দৌলত দিয়ে ঠাসা! যেমন সোঁতা তেমনি অন্ধকার, সে-সব ঘরে একবার ঢুকলে রাস্ত হারিয়ে চিরকাল গোলকধাঁধার মতো ঘুরে বেড়াতে হয়, আর বাইরে আসবার উপায় নেই, এমনি প্যাঁচাও রকমে সে-সব ঘর সাজানো। ছ-তলার উপরে রাজসভা, সেখানে কতকটা আলো-বাতাস আসবার জন্যে সারি-সারি জানলা-বারাণ্ডা, সাততলায় অন্দর মহল, সেখানে জানলা সব খাঁচার মতো পাথরের জাল দিয়ে বন্ধ, পোষা-পাখির মতো রানীদের ধরে রাখার জন্যে ছোট-ছোট কুলুঙ্গি দেওয়া দরজায় শিকল-আঁটা সব শয়ন-মন্দির। অন্ধকূপ এই নাটবাড়িতে আড়িমাও রাজাদের বংশ ভালো আলো-বাতাস না পেয়ে গুষ্ঠিসুদ্ধ লোকলস্কর সমেত অল্পদিনের মধ্যেই মরে ভূত হয়ে গেল, রইল কেবল বাড়ির চুড়োয় মস্ত একটা পাথরের আলসের উপরে খড়-কুটো দিয়ে বাসা বানিয়ে এক ঠেঙে—সে হাড়গিলের রাজা খাম্বাজং। রানীর শয়ন-ঘরের কুলুঙ্গিগুলোতে গোটাকতক লক্ষ্মী-পেঁচা কালো-পেঁচা ভুতুম-পেঁচা, রাজসভার কার্নিশে-কার্নিশে ঝুলে দলে-দলে বাদুড়, রন্ধনশালায় একটা কালো বেরাল, আর ঘি-ময়দা চাল-ডাল শাল-দোশালা ধন-দৌলতে ঠাসা নিচেকার ভাঁড়ার ঘরগুলোতে গড়বন্দি পালে-পালে গণেশের নেংটি ইঁদুর। হাড়গিলে পেঁচা বেরাল এরা সবাই ইঁদুরের শক্র হলেও গণেশের ইঁদুরকে তারা খাতির করে চলত, পৃথিবীর যেখানে যত গণেশ আছে, সবার জন্যে এই নাটবাড়ি থেকে ইঁদুর যায়, এদের কেউ কিছু বলবার যো নেই, কাজেই নেংটি ইঁদুরের দল দেশ জুড়ে নানা উৎপাত আর রাজত্ব করছিল, এই সময় কোথা থেকে তাতারি-চুয়ো এসে হানা দিয়ে, যেখানে-সেখানে গণেশ উল্টে ফেলে নেংটি বংশ ধ্বংস করতে শুরু করে দিলে। গোলাবাড়ি, ঠাকুর-বাড়ি, গোয়ালঘর, রান্নাঘর, কাচারিঘর, হেঁসেলঘর, শোবারঘর, বসবারঘর, তোষখানা, বৈঠকখানা, দেশের সব জায়গা থেকে তাড়া খেয়ে নেংটি সরে পড়তে লাগল, লড়ায়ে হারতে থাকল, না খেয়ে মরতে লাগল; শেষে এমন হল যে, এক পুরোনো নাটবাড়ি ছাড়া গণেশের ইঁদুর আর কোথাও রইল না। গণেশের সিংহাসন টলমল করতে থাকল, মানুষে নেংটি ইঁদুর মারত বটে কিন্তু গণেশ তাতে টলেননি, কেন না এত ইঁদুর বাইরে-বাইরে জন্মাত যে, মানুষ জন্ম-জন্ম মেরেও তাদের বংশ লোপ করতে পারত না। কিন্তু নেংটিরই বড় জাত যে চুয়ো, তারা যখন এসে হানা দিয়ে পড়ল, তখন গণেশ ভেবে অস্থির হলেন। এই চুয়োরা একেবারে চোয়াড়, যা-তা খায়, দেবতা-ব্রাহ্মণে ভক্তি মোটেই নেই, একেবারে গোঁয়ার-গোবিন্দ, দুটি-একটি করে যেন ভালোমানুষের মতো প্রথমে নদী নালার ধারে-ধারে নৌকোর খোলে এসে বাসা বাঁধলে, দেবতার মন্দিরে কিম্বা মানুষের ভাঙা ঘরের উপরে, গ্রাম-নগরের দিকেই ঘেঁষতো না—নেংটি ইঁদুরগুলো যে সব পোড়ো-বাড়ি, পতিত জমি ছেড়ে গেছে সেই জায়গাগুলোয় এসে রইল, নেংটিদের ফেলে-দেওয়া যা কিছু কুড়িয়ে খেয়ে বড় হতে লাগল। ক্রমে তারা বড় হতে-হতে শেষে নেংটিদের মাটির কেল্লাগুলো দখল করে জমিদারী ফাঁদলে, সেখান থেকে এ জমিদারী সে জমিদারী, এ পরগনা সে পরগনা, এদেশ-সেদেশ, করে সারা দেশ তারা দখল করলে। মাটির নিচেটা দখল করে মাটির উপরে চুয়োর দল লড়াই দিতে যখন বার হল, তখন নেংটিরা বুঝলে দাঁড়াবার স্থান গেছে, নিরুপায় হয়ে তারা যে ক’টা পারে তাদের পুরোনো নাটবাড়ির কেল্লায় এসে ঢুকে প্রাণ বাঁচাবার চেষ্টা করতে লাগল। নাটবাড়ির দেওয়াল মোটা, কাজেই নেংটিরা কতকটা নিৰ্ভয়ে রইল, কিন্তু চুয়োরাও ছাড়বার পাত্র নয়; তারা বছরের পর বছর যুদ্ধ চালিয়ে শেষে একদিন নাটবাড়ির উঠোনটা দখল করতে বারোজন তাতারি সওয়ার পাঠিয়ে দিলে! যুদ্ধং দেহি বলে শত্রুদল চারদিক ঘিরে লেজ আপসে লাফালাফি শুরু করে দিয়েছে, চারদিকে সাজ রে সাজ পড়ে গেছে— পায় দল কলবল ভূতল টলমল সাজল দলবল অটল তাতারি। দামিনি তক-তক জামকী ধক-ধক ঝকমক চমকত খরতর বারি। ধূধূ-ধূধূধূ নৌবত বাজে, ঘন ভোরঙ্গ ভম্‌-ভম্‌, দামামা দদদম্ ঝনন্ন ঝম-ঝম ঝাঁজে— ধা-ধা গুড়-গুড় বাজে। নিশান ফরফর নিনাদ ধর-ধর তাতারি গর-গর গাজে। ধূধূ ধম-ধম ঝাঁ-ঝাঁ ঝম্‌-ঝম্‌ দামামা দম-দম বাজে। রণজয় ভেরী বাজে রে ঝাঁগড়-ঝাঁগড় ঝাঁ-ঝাঁ ঝাঁজে রে মুচড়িয়া গোঁফে চলে লাফে-লাফে খেলে উড়ো পাকে থাকে-থাকে-থাকে ঝাঁপে রে বাজে রণ ভেরী বাজে রে। ভয় পেয়ে মরে নেংটি হাজার-হাজার তল গেল মান মত্তা ইঁদুর রাজার ঘাসের বোঝায় বসি ইন্দুরানী কাঁদে ইন্দুরায় এতদিনে পড়িয়াছে ফাঁদে কান্দি কহে ইন্দুরানী গণেশ গোঁসাই এমন বিপাকে কভু আর ঠেকি নাই। এই ভাবে ইঁদুর রানী কাঁদছেন, এদিকে একশো বছরের ইঁদুরের রাজা তাতারিদের ভয়ে থরথরি কম্পমান, রানীর আঁচল ধরে মন্ত্র পড়ছেন, খট্‌ ভৈরবী—দ্রুত ত্রিতালি—আর কেঁদে বলছেন সুর করে: চল-চল যাই নীলাচলে। (রে অরে যাই) ঘটালে বিধি ভাগ্যফলে মহাপ্রভু জগন্নাথ সুভদ্রা বলাই সাথ দেখিব অক্ষয় বটতলে, খাইয়া প্রসাদ ভাত মাথায় মুছিব হাত নাচি বেড়াই কুতূহলে ভবসিন্ধু বিন্দু জানি পার হইনু হেন মানি সাঁতার খেলিব সিন্ধুজলে॥ নেংটির রাজা যখন কেল্লা ছেড়ে রানীকে নিয়ে পাছ-দুয়োর দিয়ে গঙ্গাসাগরের দিকে পলায়নের মতলব করছেন—লড়াই না দিয়ে, সেই সময় হাঁসের দল রিদয়কে নিয়ে দেওয়ানগিরির তলায় এসে উড়ে বসল। একদিকে নাটবাড়ির পাথরের পাঁচিল, আর একদিকে হাড়গিলের চর, এরি মাঝে জলের ধারে শুশনি কলমি শাক খেয়ে হাঁসের দল চরে বেড়াচ্ছে, এমন সময় আণ্ডামানি হাঁসের সঙ্গে দেখা, ছোট দল বড় দল দুই দলে অমনি কথাবার্তা চলল, সাঁতার খেলা আরম্ভ হল। যোগীগোফাতে ভেড়াদের নিয়ে যে কাণ্ড হয়েছে শুনে আণ্ডামানি বললে—“তা হলে শেয়াল লোভ সহজে ছাড়বে না, নিশ্চয়ই আমাদের পিছু নেবে, আর এখন দুদিন উড়ে কাজ নেই, এইখানেই থাকা যাক, আর ব্ৰহ্মপুত্রের বাঁক ধরে মানস সাগরেও গিয়ে কাজ নেই। এইখান থেকে বাঁহাতি মোড় নিয়ে একেবারে পাহাড়ের পাশ দিয়ে সোজা উত্তরে চলাই ভালো।” চকা বললে—“অজানা রাস্তা কেমন করে যাব।” আণ্ডামানি অমনি জবাব দিলে—“অজানা নয়, উত্তর সমুদ্রের ধারে রুষ দেশে যে সব পাখিরা থাকে তারা পাহাড়ের এই গলি পথটা দিয়ে সোজা হিমালয়ের ওপারে চলে যায়। আজ ক’দিন ধরে দলে-দলে সারস বক কাদাখোঁচা জলপীপী এরা দেখি এই পথ দিয়ে যাওয়া-আসা করছে। ” বুড়ো চকা ঘাড় নেড়ে বললে—“ওহে রাস্তা তো আছে জেনেছ, রাস্তার কোথায়, কেমন দানাপানির ব্যবস্থা তার খবর নিয়েছ কি?” আণ্ডামানি লালসেরা মাথা নেড়ে বললে—“সে খবরও নিতে বাকি রাখিনি। এই দেওয়ানগিরি থেকে বড়নদীর রাস্তা বেয়ে সোজা উত্তরে গেলে তাস্‌গং, তাউয়াং, দুটো বড়-বড় বস্তি, তার পরই চুখাংএর জলা। সেখানে এক রাত্তির কাটিয়ে তার পরদিন সন্ধ্যায় চোনা হ্রদ পাওয়া যাবে, তারপর একদিনে নারায়ুম হ্রদ, সেখান থেকে একবেলার পথ, ‘তিগুৎসো’। সেখান থেকে পশ্চিমে গেলে পেমো চাং, বাসাং সো, চোলু, খাম্বাজং গোঁসাইথান হয়ে ধবলাগিরি, আর উত্তর-পুবে গেলে যামদক্ষা নগরের ধারে প্রকাণ্ড পালতি হ্রদ, তার পরে ‘তামলং কঙ্কজং’ হয়ে আবার ব্ৰহ্মপুত্রের রাস্তায় পড়া যেতে পারে, অনেক পাখিই এই রাস্তা দিয়ে চলেছে, সেথোর অভাব হবে না। তাছাড়া কঙ্কজাংএর রাজা কঙ্ক-পাখির সঙ্গে যখন তোমাদের পরিচয় আগেই হয়ে গেছে, তখন সেখানেও কিছুদিন জিরিয়ে যাওয়া যেতে পারে।” চকা ঘাড় নেড়ে বললে—“সে সব ভালো, কিন্তু ওদিকের আকাশটা যেন কেমন ঘোলাটে ঠেকছে, দেওয়ানগিরির উত্তর গা-টাতে মেঘের ছাওয়াটাও দেখতে পাচ্ছি; হঠাৎ ওদিকে যাওয়া নয়, দু-একদিন দেখা যাক৷″ হাঁসদের মধ্যে এই সব পরামর্শ চলেছে এদিকে রিদয় একটা ডোবায় পা ডুবিয়ে আড়িমাও রাজার পুরানো নাটবাড়িটার পাঁচিলের দিকে চেয়ে রয়েছে, এমন সময় দেখলে সন্ধ্যের অন্ধকারে পাঁচিলের ধারে রাশ-রাশ নুড়িগুলো যেন নড়তে-চড়তে আরম্ভ করলে, তারপর সার বেঁধে সব নুড়িগুলো কেল্লার দিকে এগোতে লাগল! রিদয় চেঁচিয়ে উঠল—“দেখ-দেখ!” অমনি সব হাঁস সেদিকে চেয়ে দেখলে দলে-দলে চুয়া রাস্তা ঢেকে চলেছে। রিদয় যখন বড় ছিল তখন একবার ইঁদুরের কামড় কেমন টের পেয়েছে, এখন এই বুড়ো-আংলা অবস্থায় ইঁদুরের পাল্লায় পড়লে যে কি হবে তাই ভেবে সে কাঠ হয়ে দাড়িয়ে রইল! হাঁসেরাও রিদয়ের মতো ইঁদুরের গন্ধ মোটেই সইতে পারত না, যতক্ষণ সেদিক দিয়ে ইঁদুরগুলো গেল ততক্ষণ সবাই চুপচাপ মুখ বন্ধ করে রইল। তারপর ‘ছি-ছি’ বলে যেন কেবলি ডানা ঝাড় দিতে শুরু করে দিলে। চুয়োর দল ছোট-বড় নুড়ির ঝরনার মতে গড়াতে-গড়াতে পাথরের পাঁচিলের গোড়া বেয়ে নাটবাড়ির সিংগি দরজার দিকে চলে গেল, ঠিক সেই সময় আকাশে দুই পা লটপট করতে-করতে হাড়গিলে-রাজ খাম্বাজং ঝুপ করে হাঁসদের মধ্যে এসে পড়লেন। রিদয় এমনতরো পাখি কোনোদিন দেখেনি, এঁর মাথা, গলা আর পিঠ শাদা রাজহাঁসের মতো, ডানা দু’খানা কালো দাঁড়কাকের মতো, তেলে পাকানো গেঁটে-বাঁশের ছড়ির মতো লাল দুখানা সরু ঠ্যাং, আর বারে হাত কাঁকুড়ের তেরো হাত বীচের মতো এতটুকু মাথায় এত বড় এক লম্বা ঠোঁট—এক আঙুল কলমের যেন দশ আঙুল নিব, তার ভারে মাথাটা ঝুঁকেই আছে, মুখের দুপাশে বোয়াল মাছের মতো দুটো চোখ বসানো! রিদয়ের বোধ হল, পাখি মাছ কাঁকুড় কলম বাঁশ সব মিলিয়ে যেন এই পক্ষীরাজ সৃষ্টি হয়েছে! হাড়গিলেকে দেখে চকা তাড়াতাড়ি ডানার পালক ঝেড়েঝুড়ে সামনে এগিয়ে এসে দণ্ডবৎ হয়ে দু-তিন বার প্রণাম করে দাঁড়িয়ে ভাবতে লাগল হঠাৎ খাম্বাজং কি কাজে এলেন! নাটবাড়ির চুড়োয় হাড়গিলের বাসা চকা জানে আর ফাল্গুন মাসের গোড়াতেই হাড়গিলেকে আনবার পূর্বে খাম্বাজং বাসাটা একবার তদারক করতে প্রতি বছরে এখানে এসে থাকেন সেটাও জানা কথা। কিন্তু হাড়গিলেরা তো হাঁসদের সঙ্গে প্রায়ই আলাপ-সালাপ রাখে না, হঠাৎ আজ হাঁসের দলে রাজার আগমন হল কেন, এটা চকা ভেবে না পেয়ে একবার ঘাড় চুলকে বললে—“জং বাহাদুরের বাসার খবর ভালো তো, গেল ঝড় বৃষ্টিতে কোনো লোকসান হয়নি তো?” হাড়গিলেরা সবাই তোতলা, সহজে কথা কওয়া তাদের মুশকিল, খাম্বাজং অনেকক্ষণ ঠোট কাঁপিয়ে এ-চোখ বুজে ও-চোখ খুলে ভাঙা গলায় কাঁদুনি শুরু করলেন—“বুড়োবয়সে বাসাটা ঝড়ে পড়ে গেছে, একে উঁচু নাটবাড়ি, তায় আবার চুড়ো, গিন্নি দেখে-দেখে সেখানেই বাসা বাঁধলেন, টিকবে কেন! এই বুড়োবয়সে জল-ঝড়ের মধ্যে ঐ গোটা কতক ভাঙা কাঠির বাসায় তো আমার টেকা দায় হয়েছে! এদিকে আবার মানুষগুলো সমস্ত জলা আর খাল-বিল ভরাট করে তার উপর দিয়ে রেলগাড়ি চালাবার বন্দোবস্ত করচে, দু-একটা সাপ ব্যাঙ যে ধরে খাব তারও রাস্তা বন্ধ! শুনেছি না কি আবার এই নাটবাড়িটাতে ইষ্টিশান বসাবে, তাহলে তো আমাকে এদেশ ছাড়তে হয় দেখি!” চকা খুব দুঃখ জানিয়ে বললে—“আপনি তো তবু এতকাল এই নাটবাড়িতেই কাটালেন, ইচ্ছে করলে পরেও আপনি ইষ্টিশানের চূড়োটায় বাসা বাধতে পারেন। মানুষে কোনোদিন আপনার উপরে গুলিও চালাবে না। আর বাসা থেকে আপনার আণ্ডাবাচ্চা চুরি করে ভেজেও খাবে না, আপনার তো কোনো পরোয়া নেই। বড় জোর এখন চুড়োয় আছেন, না হয় চরে নেমে বসবেন; কিন্তু আমাদের দশা দেখুন দেখি— ভোজনং যত্র তত্র শয়নং হট্টমন্দিরে মরণং গোমতী তীরে অপরম্বা কিং ভবিষ্যতি। “এই ভাবেই সারা জীবন কাটাতে হবে। আপনার তো যাহোক একটা দাঁড়াবার স্থান আছে, আমাদের দশাটা ভাবুন তো। ভবঘুরের মতে— যেখানে-সেখানে শোও আর খাও পৃথিবীটা ঘিরে চক্কর দাও শেষ একদিন অকস্মাৎ! বিনি মেঘে বজ্রাঘাৎ! “তাগে পেলেই মানুষ গুলি চালাচ্ছে আমাদের দিকে!” হাড়গিলে গলার পালকের দাড়ি দুলিয়ে বললেন—“কথাটি তো বলেছ ঠিক, কিন্তু নাটবাড়ি হয়ে পর্যন্ত ঐ চুড়োটায় বাস করে আসছি সাতপুরুষ ধরে, আজ হঠাৎ চুড়ো থেকে চরে নেমে বসা কি কম কষ্টের কথা, আর ঐ হাড়গিলের চরটাও শুনেছি মানুষের চেঁচে ফেলে ওখান দিয়ে বড়-বড় মালের জাহাজ চালাবে!” চকা এবারে আমতা-আমতা করে বললে—“তা হলে তো মুশকিল দেখছি, মানুষের সঙ্গে তো আমরা পেরে উঠব না, এবিষয়ে আপনি—” এবারে হাড়গিলে ঠোঁট বাজিয়ে বলে উঠলেন—“আঃ, সে মানুষের কথা, যখন তারা আসবে তখন ভাবা যাবে। এখন একটা কথা শুধোই, এদিক দিয়ে চুয়োদের পল্টন যেতে দেখেছ কি?” হাজার-হাজার চুয়ো এইমাত্র এইদিক দিয়ে গেছে শুনে হাড়গিলে আকাশে চোখ তুলে বললে —”এতদিনে বুঝি গণেশের ইঁদুরের দফা রফা, আজ রাতের মধ্যেই চুয়োরা নাটবাড়ি দখল করবে।” চকা ভয় পেয়ে বললে—“কি বলেন লড়াই বাধবে নাকি?” হাড়গিলে বলে উঠলেন—“বাধবে আর কি, বিনা যুদ্ধে চুয়োরা আজ কেল্লা মেরে নেবে, রাজা গঙ্গাসাগরের দিকে রানীকে নিয়ে দৌড় দিয়েছেন। বামুন গেল ঘর তো লাঙ্গল তুলে ধর, কেল্লায় যারা ছিল তারা মানস সরোবরের ধারে আসছে পূর্ণিমায় পঙ্কিরদলের বারোয়ারীর নাচ দেখতে ছুটেছে, ঠিক ঝোপ বুঝেই চুয়োর দল কোপ দিতে চলেছে। কেল্লায় গোটাকতক অকৰ্মণ্য বুড়ো নেংটি ছাড়া আর তো কেউ নেই, এতকাল নেংটিদের সঙ্গে এই নাটবাড়িতে কাটালেম, এখন বুড়ো বয়সে আর শিং ভেঙে বাছুরের দলে যাওয়ার মতো চুয়োর দলে ভিড়তে আমার ইচ্ছে যায় না, তাই ভাবচি থাকি কি যাই।” হাড়গিলে যে ইঁদুরদের বিপদের খবরটা না দিয়ে হাঁসের দলে এসে কাঁদুনী শুরু করেছে এটা চকার মোটেই ভালো লাগল না। সে একটু এগিয়ে গিয়ে হাড়গিলেকে বললে—“গণেশের ইঁদুরদের আপনি ও-খবরটা পাঠাননি এখনো?” হাড়গিলে গলার থলি দুলিয়ে বললে—“খবর দিয়ে লাভ? তারা আসবার আগেই সে কেল্লা দখল হয়ে যাবে।” চকা এবারে চটে বললে—“হয়ে যাবে বললেই হয়ে গেল, এমন অঘটন হতে দেব না আমি বলছি!” যে চকার ঠোঁট একেবারে ভোঁতা, নেই বললেই হয় আর যার পায়ের নখও ততোধিক ধারাল, সন্ধ্যে না হলেই যার ঘুম আসে, তিনি লড়তে চান চিরুনিদাঁত চুয়োদের সঙ্গে! হাড়গিলে হেসেই অস্থির। ঘাড় নেড়ে চকাকে বললেন—“বুরুঞ্জিতে লেখা আছে এই ঘটবে, কারো সাধ্য নেই তা রদ করা, আমি পণ্ডিতদের দিয়ে গণিয়ে দেখেছি কোনো উপায় নেই, না হলে আমি চুপ করে বসে আছি!” চকা হাড়গিলের কথায় কান না দিয়ে ডাক দিলে—“পাঁপড়া নান্‌কৌড়ি, নেড়োল কাটচাল, লালসেরা, আণ্ডামানি, চোকধলা ডানকানি, পাটাবুক হাস্‌ন্ত্রি, মারাগুই চাপড়া, তীরশুলি আকাবর, তোমরা যাও মানস সরোবরের পথে যত নেংটি দেখবে সবাইকে খবর দাও লড়াই বাধবে।” অমনি সাতটা বুনো হাঁস অন্ধকারে ডানা ছড়িয়ে উড়ে পড়ল। চকা আবার বাঙলাদেশের হাঁসদের ডাক দিলে—“সন্ধীপের বাঙ্গাল, ধনমাণিকের কাওয়াজী, রায়মংলার ঘেংরাবল, চব্বিশ পরগনার সরাল!” অমনি তেল চুকচুকে মোটাপেট পাঁচজন উপস্থিত হল হেলতে-দুলতে, চকা তাদের বললে—“চট করে যাও গঙ্গাসাগরের দিকে, নেংটিদের রাজা পলাতক ইন্দুরায় আর ইন্দুরানীকে ফিরিয়ে আনে৷।” কিন্তু এবারের দল অত চটপট উড়ে পড়ল না, বাঙাল মাথা চুলকে বললে—“এ-কাজটা কি সমীচীন হবে, ইদুরের যুদ্ধে হাঁসেদের যোগ দেওয়া কি সঙ্গত, তা ছাড়া এই অন্ধকার রাত্রে আপনাকে একলা এই শক্রদের মাঝে—” চকা ধমকে উঠল: “বড় দেরি করছ তোমরা!” বাঙলার হাঁসরা পটাস-পটাস করে ডানা ঝাপটে দক্ষিণ মুখে আস্তে-আস্তে উড়ে চলল। চকা তাদের দিকে খানিক কটমট করে চেয়ে থেকে সুবচনীর হাঁসকে বললে—“তুমি গিয়ে হাড়গিলে চরে চুপচাপ বসে থাক, আমি কেবল হংপাল বুড়ো-আংলাকে পিঠে নিয়ে নাটবাড়িতে যাব, যদি কেউ চুয়োদের তাড়াতে পারে তো এই ছোকরা।” বলে চকা হাড়গিলের সঙ্গে রিদয়ের আলাপ করে দিলে। টিকটিকির মতো বুড়ো-আংলাকে দেখে হাড়গিলে একবার গলার থলি ফুলিয়ে খানিক হেলে-দুলে হেসে নিলেন। তারপরে ঝপ করে ঠোঁটে করে রিদয়কে আকাশে ছুঁড়ে-ছুঁড়ে লোফালুফি শুরু করে দিলেন, রিদয় ভয়ে চীৎকার করতে লাগল। চকা তাড়াতাড়ি ছুটে এসে বললে—“জং বাহাদুর করেন কি! ওটা মানুষ—ব্যাঙ নয়, ওকে ছাড়ুন, গেল যে!” “মানুষ!” বলেই হাড়গিলে মাটিতে রিদয়কে নামিয়ে দিয়ে দু-চারবার ডানা আপসে নৃত্য করে বললেন—“বুরুঞ্জিতে ঠিক তো লিখেছে, অঙ্গুষ্ঠ প্রমাণ এই মহাপুরুষ এসেছেন ঠিক ভূতচতুর্দশীতেই, আর ভয় নেই, আমি এখনি গিয়ে নাটবাড়ির সকলকে এ-খবর দিচ্ছি। জয় গণেশের জয়”—বলে হাড়গিলে নাটবাড়ির দিকে উড়ে গেল। হাড়গিলের ব্যবহারে রিদয় ভারি চটে ছিল, সে গোঁ হয়ে চকার পিঠে উঠে বসল। নাটবাড়ির চুড়োয় একখানা যাঁতার মতো পাথর, তার মাঝখানটায় রাজাদের ধ্বজি গাড়বার একটা গর্ত, সেই গর্তে খান দুই পুরোনো হোগলা পাতার মাদুর বিছানো, তার উপরে কাটকুটো আর পালকের তোশক, একপাশে কোন কালের রানীদের ছেঁড়া কাপড়ের এক টুকরো জরির আঁচল মাদুর-ছেঁড়ার মধ্যে ঝিকমিক করছে, কতকালের মরচে-ধরা একটা খিল-ভাঙা তালা, একটা কলঙ্ক-পড়া রূপোর চুষিকাঠি, ভোঁতা একটা শরের কলম, ছেঁড়া একপাটি জরির লপেটা জুতো, আধখানা পরকোল৷ লাগানো শিংএর চশমা একটা, গেল বছরের ফাটা চিনের পেয়ালার মতো গোটাকতক ডিমের খোলা, পেটটা ফুটো-করা একটা আধমরা ব্যাঙ, এমনি সব নানা সাজ-সরঞ্জাম দিয়ে বাসাটা ভর্তি। কতকালের সে বাসা তার ঠিক নেই, তার গায়ে ছোট-বড় ঘাস-পাতা গজিয়ে গেছে, এমন কি গোটাবারো লতাওয়ালা একটা বটগাছ পর্যন্ত, তাতে আবার ফল ধরেছে। চকার সঙ্গে রিদয় এসে দেখলে নাটবাড়ির সবাই এসে আজ বাসায় হাড়গিলেকে ঘিরে কি সব পরামর্শ করছে, এই বুড়ো ভুতুম পেঁচা একদিকে বসে গোল দুই চোখ বার করে কেবলি হুঁ হুঁ সায় দিচ্ছে, কালো বেরালটা লেজ নাড়ছে আর মিউমিউ করে কি যে বকছে তার ঠিক নেই, হাড়গিলে মাঝে বসে কেবলি গলার থলি ঝাড়ছেন আর পাঁচ গণ্ডা বুড়ো নেংটি ইদুর শুকনো মুখে একধারে চুপটি করে বসে এদিক-ওদিক কান ঘোরাচ্ছে। ইদুর বেরাল পেঁচা হাড়গিলে একখানে জমা হয়েছে দেখেই রিদয় বুঝলে নাটবাড়িতে আজ বিষম গণ্ডগোল। চকা আর রিদয়ের দিকে কেউ আজ চেয়েও দেখলে না, সবাই চেয়ে রয়েছে হাঁ করে যেদিক দিয়ে দলে-দলে চুয়ো সার বেঁধে মাঠের উপর দিয়ে আসছে! ভুতুম পেঁচা খানিক ভূতের মতো নাকিসুরে চুয়োদের বিষম উৎপাতের কথা বর্ণনা করে চলল। বেরাল মিউমিউ করে খানিক কাঁদুনি গাইলে—“এই বুড়ো বয়সে শেষে কি চুয়োর পেটে যেতে হবে নাকি, আণ্ডাবাচ্ছা কাউকেই তারা রেহাই দেবে না!” হাড়গিলে ইদুরদের ধমকে বললেন—“এই দুঃসময়ে তোমাদের চাঁইদের বারোয়ারিতে যেতে দিয়ে যত মুখ্যুমি করেছ, লড়াই দেবার জন্যে একটা লোক পর্যন্ত রইল না কেল্লায়! আমি কি এই বুড়ো বয়সে চুয়ো মেরে ঠোঁটে গন্ধ করতে পারি, ছি-ছি! এমন করে কেল্লা ফাঁক রেখে সব নেংটির চলে যাওয়াটা ভারি অন্যায় হয়েছে!” ইদুরগুলো কেবল হতভম্ব হয়ে বেরালের দিকে চাইতে লাগল। বেরাল ফোগলা দাঁত খিঁচিয়ে বললে—“আমার দিকে দেখছ কি ? তোমরা নিজেদের ঘর সামলাতে না পার নিজেরাই মরবে। আমার কি, আমি ষষ্ঠীর দুয়োরে গিয়ে ধন্না দেব। সেখানে পেসাদের কিছু না পাই দুধ তো আছে।” ইঁদুরেরা হাড়গিলের দিকে চাইতে তিনি গম্ভীর হয়ে বললেন—“আমি আর কি করতে পারি বল? এই অঙ্গুষ্ঠ প্রমাণ টিকটিকির মতে মানুষটিকে তোমাদের এনে দিলেম, এর সঙ্গে পরামর্শ করে যা ভালো হয় কর। আমার যথাসাধ্য তো তোমাদের জন্যে করলেম, এখন যা করেন গণেশ ঠাকুর। আঃ, আর পারিনে!” বলে হাড়গিলে পা মোড়া দিয়ে আকাশের দিকে ঠোঁট তুলে চোখ বুজলেন। ইদুর বেরাল পেঁচা একবার রিদয়ের মুখের দিকে চাইলে তারপর আস্তে-আস্তে সভা ছেড়ে যে যার বাসায় যাবার উদ্যোগ করলে। এদের রকম দেখে চকার এমনি রাগ হচ্ছিল যে সব কটাকে ঠেলে সে চুয়োদের মুখে ফেলে দেয়, বিশেষ ওই একঠেঙ্গে হাড়গিলেটাকে এক ধাক্কায় নাটবাড়ির চুড়ো থেকে একেবারে নিচে ফেলে দেবার জন্যে চকা নিসপিস করতে লাগল। রিদয় তাকে চোখ টিপে বললে—“চুয়োদের জব্দ করা শক্ত নয়, যদি নাটবাড়ির ঠাকুরঘরের লক্ষ্মী পেঁচা আমাকে এখনি একবার ঠাকুরঘরে যে দুয়োরের উপরে কুলুঙ্গীতে গণেশ বসে আছেন তাঁর কাছে নিয়ে যান!” ভুতুম অমনি তাড়াতাড়ি লক্ষ্মী পেঁচাকে ডেকে আনলে। রিদয় লক্ষ্মী পেঁচাকে গণেশের কথা শুধোতে সে বললে—“ঠাকুর তো এখন শয়ন করেছেন, ঠাকুরঘরের দরজা বন্ধ!” রিদয় চকার সঙ্গে চুপিচুপি দু-একটা কথা বলাবলি করে পেঁচাকে বললে—“পুরোনো দরজা খুলে নিতে কতক্ষণ? চল, পথ দেখাও!” লক্ষ্মী পেঁচা আগে পথ দেখিয়ে চলল, সঙ্গে রিদয়। চকা বললে—“এই ভূতচতুর্দশীর রাত্রে পোড়ো বাড়িতে একা তোমার সঙ্গে যেতে দিতে মন সরছে না—যদি পেঁচোয় পায়, আমাকেও সঙ্গে যেতে হল।” হাড়গিলে অমনি তাড়াতাড়ি বলে উঠলেন—“না-না, সে হতে পারে না, তুমি গেলে গোল হবে, বুরুঞ্জিতে লিখছে এই ভূতচতুর্দশীতে একা এই অঙ্গুলি প্রমাণ মানুষটি এসে নাটবাড়িতে মূষিকদের পুনঃপ্রতিষ্ঠা করে হাড়গিলে বংশের সুখসৌভাগ্য বৃদ্ধি করবেন। তুমি গেলে শাস্ত্রের কথা মিথ্যা হয়ে যায়। এই নাও শনিবার অমাবস্যাতে তোলা এই মানকচুর শিকড় সঙ্গে রাখ, ভূত পালাবে।” বলে রিদয়ের হাতে হাড়গিলে তার বাসার ছেঁড়া মাদুর একটু ভেঙে দিয়ে তার কানে মন্তর দিলেন। রিদয় ঝাঁকড়া চুলের মধ্যে কচুর শিকড় গুঁজে চিলের ছাতের গোল সিঁড়ি বেয়ে পেঁচার সঙ্গে নেমে চলল, মনে-মনে ভূতের মন্তর আওড়াতে-আওড়াতে—হং সং বং লং হাঃ ফুঃ! ভূতচতুর্দশীর রাত্রি এমন অন্ধকার যে, ভূতকে পর্যন্ত দেখা যায় না। রিদয় সেই অন্ধকারে পেঁচার সঙ্গে চিলের ছাতের ঘুরোনো সিঁড়ি দিয়ে ক্রমাগত নেমে চলেছে। দুদিকে পিছল পাথরের দেওয়াল, তার মাঝে-মাঝে এক-একটা ঘুলঘুলি, সেইখান দিয়ে একটু যা আলো আর বাতাস আসতে পায়! রিদয় দেওয়ালের গা ঘেঁষে টিকটিকির মতে পায়ে-পায়ে নামছে, অন্ধকারে পেঁচা যে কোনদিকে চলেছে সেই জানে, কেবল সে এক-একবার হাঁকছে—“উচা-নিচা!” আর সেই ডাক শুনে রিদয় চলেছে, ইস্ক্রুপের প্যাঁচের মতো পাক-দেওয়া সিড়ি পার হয়ে অন্ধকারে! একটা কিসের গায়ে হাত পড়তেই সেটা ক্যেঁ বলে ঝটপট করে উঠল, এক জায়গায় জল পড়ে ডোবা মতো হয়েছে হঠাৎ ঠাণ্ডা জলে পা রেখেই রিদয় থমকে দাঁড়াল, পেঁচা অমনি বলে উঠল—“বাঁয়ে ঘেঁষে!” কখনো বাঁয়ে কখনো ডাইনে কখনো উঁচায় কখনো নিচায় এইভাবে রিদয় চলেছে! চোখে কিছু দেখছে না, কানে শুনছে খালি যেন এখানে কি একটা ঝটপট করে উঠল, ওখানে মাথার উপর থেকে কি ঠিক-ঠিক করে ডাক দিলে, কখনো শুনলে পাথরের গায়ে কে নখ আঁচড়াচ্ছে, ওদিকে কারা যেন দুদ্দাড় করে পালিয়ে গেল, পায়ের কাছে কি একটা পাশমোড়া দিলে, হঠাৎ গালে যেন কে একটা চিমটি কেটে গেল, কানের কাছে চট করে একটা কে ‘টু’ দিয়ে পালাল! এর উপরে রিদয় নানা বিভীষিকা দেখছে—হঠাৎ এক জায়গায় গোটাকতক চোখ আলেয়ার মতো জ্বলেই আবার নিভে গেল। যেন ইলিশ মাছের জাল নাকের সামনে কে একবার ঝেড়ে দিয়েই সরে পড়ল, হঠাৎ একটা গরম হাওয়া মুখে লাগল, তার পরেই বরফের মতো বাতাস এসে কাঁপিয়ে দিলে! রিদয়ের মনে হচ্ছে এইবার সিঁড়ি শেষ হল কিন্তু খানিক গিয়ে আবার সিঁড়ি, আবার চাতাল, আবার ধাপ, আবার দেওয়াল, এমনি ক্রমাগত ওঠানামা করতে-করতে চলা—এর যেন আর শেষ নেই। আঁধি ধাদি ভূত পেত্নি ব্রহ্মদৈত্য ঝাম ঝামড়ি কন্ধকাটা শাঁকচুন্নি ডাকিনী যোগিনী ভ্যাল ভেলকি, পেটকামড়ি সবই আজ ভূতচতুর্দশীতে জটলা করতে বেরিয়েছে, আঁদাড়ে-পাঁদাড়ে রিদয়কে দেখে কেউ ঝমঝম করে নাচতে লাগল, কেউ ফিকফিক করে হাসতে লাগল। খুল-খাস খিট-খাট আওয়াজ করে ভূতেরা কেউ খড়ম পায়ে, কেউ হাড় মড়-মড় করে, কেউ বা ঘণ্টা বাজিয়ে, কেউবা চটি চটপট করে তার সঙ্গে সিঁড়ি বেয়ে নামছে। ভয়ে রিদয়ের হাত-পা অবশ হয়ে এসেছে, ঠিক সেই সময় সরু গলির শেষে মস্ত একটা চাতালের উপরে এসে পেঁচা “ঠাকুরবাড়ি” বলেই অন্ধকারে কোথায় মিলিয়ে গেল! অনেকক্ষণ ধরে কারুর সাড়াশব্দ নেই, রিদয় অন্ধকারে হাতড়ে দেখলে চারদিকে দেওয়াল, দরজাও নেই, কিছুই নেই! রিদয় ভয়ে কাঠ হয়ে দাড়িয়ে আছে, একটা কে তার পায়ে এসে সুড়সুড়ি দিয়ে তাকে আস্তে-আস্তে দেওয়ালের কাছে টেনে নিয়ে গেল, তারপর কিচ করে যেন চাবি খোলার শব্দ হল! একটা মস্ত দরজা হড়হড় করে গড়িয়ে আপনি যেন খুলে যাচ্ছে, পায়ের নিচে পাথরের মেঝেটা তারি ভারে কাঁপছে! ঠিক সেই সময় বিকট শব্দে মাথার উপরে ঘটং-ঘং ঘটং-ঘং করে রাত বারোটার ঘড়ি পড়ল। অমনি দপ-দপ করে চারদিকে আলোয়-আলো এসে দেওয়ালীর পিদুম জালিয়ে দিলে, আর ঘণ্টা নাড়তে-নাড়তে ভয়ঙ্কর এক কাপালিক ব্রহ্মদৈত্য মড়ার মাথার খুলিতে ঘিয়ের সলতে জ্বালিয়ে উপস্থিত— গলে দোলে ভীষণ রুদ্রাক্ষ মালা পিঙ্গল নয়নে যেন মহেশের কোপানল জালা! রিদয় দেখলে ঘরের মধ্যে কালো পাথরের প্রকাণ্ড এক মূর্তি, তাতে কতকালের রক্ত চন্দনের ছিটে, ভৈরবটির জিব লকলক করছে আর গায়ে সোনা-রুপো হীরে-জহরৎ আর মুণ্ডুমালা ঝুলছে! ব্রহ্মদৈত্য আরতি আরম্ভ করলেন: রম্-ঝম্ রম্ ঝম্ শব্দ উঠে ভূত প্রেত পিশাচ দাঁড়ায় সবে জোড় করপুটে। তাধিয়া-তাধিয়া বাজায় তাল তাতা থেই-থেই বলে বেতাল ববম-ববম বাজায়ে গাল ডিমি-ডিমি বাজে ডমরু ভাল ভবম-ভবম বাজায়ে শিঙ্গা মৃদঙ্গ বাজায় তাধিঙ্গা ধিঙ্গা ধেই-ধেই নাচে পিশাচ দানা। রিদয় হাঁ করে ভূতের কাণ্ড দেখছে এমন সময় পেঁচা কানের কাছে ফিসফিস করে বললে, “এখানে নয়, পাশের কুঠরীতে গণেশ ঠাকুরের সভা।” হোমের ধোঁয়ায় আলোগুলো ক্রমে ঘোলাটে হয়ে এল; সেই সময় রিদয় পেঁচার সঙ্গে আস্তে-আস্তে পাশ কাটিয়ে গণেশ মহালের গলিতে সেঁধোল। দেউড়িতে একটা মোটাপেট হিন্দুস্থানী দরোয়ান সিদ্ধি খেয়ে খালি গায়ে ভোঁ হয়ে ঢোলক পিটছে, অন্ধকারে রিদয় তাকেই গণেশ ভেবে ঢিপ করে একটা পেন্নাম দিয়ে হাত জোড় করে দাঁড়াল। দরোয়ানজী ভারি গলায় বললে, “কৌন হোঃ?” রিদয় কিছুই বুঝলে না, তবু ঘাড় নেড়ে বললে—“আজ্ঞে আমি রিদয়, নেংটি ইঁদুরেরা বড় বিপদে পড়েছে তাই—“ “ক্যা বক্‌-বক্‌ লাগায়া”—বলে দরোয়ান আবার ঢোল পিটতে লাগল। রিদয় ভাবলে গণেশ বকের কথা শুধোচ্ছেন; সে তাড়াতাড়ি বললে— “আজ্ঞে বকের সঙ্গে আমার আলাপ আছে, কিন্তু আজ আমি ইঁদুরদের হয়ে লড়াই করতে চাই, সেইজন্যে আপনার ঐ জয় ঢাকটি আমি চাই।” বলে রিদয় যেমন ঢোলকে হাত দিয়েছে, অমনি গণেশের দরোয়ান ধমকে উঠল—“ধেৎ তেরি!” রিদয় ভয়ে দশহাত পিছিয়ে পড়ল—সেই সময় পেঁচা এসে তার কানে-কানে বললেন—“করছ কি? উনি গণেশ নন, ভিতরে চল!” তারপর দরোয়ানের সঙ্গে পেঁচা গিয়ে কি খানিক বকাবকি করলে, তখন দরোয়ান দুয়োর ছেড়ে দিয়ে বললে—“আইয়ে বাবু!” মহলের মধ্যে গণেশের পরিচয় চৌষষ্টি ভাগ কলাবৌ, কেউ রঙ-তুলি নিয়ে আলপনা দিচ্ছিল, কেউ সেতার বাজিয়ে গান-বাজনা করছিল, কেউ মালা গাঁথছিল, কাঁথা বুনছিল, এমনি চৌষষ্টি খাম্বা ঘরের মধ্যে সবাই এক-এক কাজে, হঠাৎ রিদয়কে দেখে সবাই মাথায় ঘোমটা টেনে জুজুবুড়িটি হয়ে বসল। পেঁচা সেখান থেকে রিদয়কে নিয়ে আর একটা হাতিশুঁড়ো গজদন্তের খিলেনের মধ্যে দিয়ে গণপতি গণেশের বৈঠকখানায় এনে হাজির করে দিলে। রিদয় দেখলে ঘরের উত্তর গায়ে মস্ত একটা তক্তাপোষে গের্দা হেলান দিয়ে থান ধুতি পরে মেরজাই পরে এক ভদ্রলোক বসে আছেন, তার গজদাঁতও নেই শুঁড়ও নেই, মোটা পেটও নয়, দিব্যি দেবতার মতো চেহারা! পেঁচা রিদয়ের কানে-কানে বললে—“ইনিই রাজা গণেশ, এঁকে যা দরবার করতে হয় কর।” রিদয়ের মুখে কথা নেই, ইনিই গণেশ! ভয়ে-ভয়ে সে এগিয়ে বললে—“মশায়ের নাম?” উত্তর হল—“আমি গণপতি, কি চাই?” রিদয় খুব নরম হয়ে বললে—“যে ইঁদুরগুলিতে চড়ে মশায় বেড়িয়ে বেড়ান সেগুলির বড় বিপদ উপস্থিত!” গণেশ ভুরু কুঁচকে বললেন—“ইঁদুর! আমি তো কোনো দিন ইঁদুরে চড়িনে!” রিদয় বললে—“আজ্ঞে, ভুলে যাচ্ছেন আপনি, হস্তী-বেশ ধরে যখন হাওয়া খেতে বেরোন, সেই সময় যে ইঁদুর আপনার গাড়ি—” গণেশ হোঃ-হোঃ করে হেসে বললেন—“তুমি পাগল নাকি আমাকে শুদ্ধ গাড়ি টেনে চলতে পারে যে ইঁদুর তাকে তুমি কোথায় দেখলে? ছেলেবেলায় আমি দু-একটা ইঁদুর পুষেছিলেম কিন্তু সবগুলোর বাচ্চা হয়ে আমার ঘরে এমনি উৎপাত লাগালে যে, সব ক’টাকে আমি ইঁদুর-কলে ধরে বিদায় করেছি। তুমি ভুল খবর শুনেছ, ইঁদুরে আমি চড়িনে, হস্তীবেশেও সঙ সেজে আমি হাওয়া খেতে যাইনে, নিশ্চয়ই কেউ তোমায় ঠকিয়েছে!” রিদয় অবাক হয়ে বললে—“সে কি মশায়, ঘরে-ঘরে ইঁদুরে-চড়া আপনার ছবি, তাছাড়া আমি নিজের চোখে দেখেছি আপনি ঢোল বাজিয়ে ইঁদুর নাচ করছেন আমাকে শাপ পর্যন্ত দিয়ে এলেন, এখন বলছেন উল্টো, আমাকে ছলনা করছেন!” গণেশ গম্ভীর হয়ে বললেন—“বাপু আমি যাই করি, এটুকু জেনো আমি ছলনাও করিনি শাপও দিইনি! ইঁদুরেও চড়িনি কোনোদিন, ঢোলও পিটিনি। ওই আমার দরোয়ানগুলো মাঝে-মাঝে হোলিতে দেওয়ালিতে ঢোল পিটিয়ে আমার কান ঝালাপাল করে, ওদের গিয়ে শুধোও। যদি আর কোনো গণেশ থাকেন তো বলতে পারিনে ৷” রিদয় চোখ মুছে বললে—“মশায় যে আমাকে শাপ দিলেন, এখন শাপান্ত না করে দিলে তো আমি মারা যাই!” গণপতি চোক পাকিয়ে বললেন—“কোনো সাপের ওঝাকে শুধোওগে বলে দেবে, কে তোমায় শাপ দিয়েছে আর কেমন করে শাপান্ত হবে—যাও, আমাকে বিরক্ত কর না!” রিদয় মুখ কাঁচুমাঁচু করে বললে—“মশায়, আমি গরীব!” গণেশ বিরক্ত হয়ে মুখ ফেরালেন। রিদয় জানত স্তুতি করলেই দেবতারা খুশি হন তাই সে একেবারে গলায় বস্তর দিয়ে গণেশের রূপ বর্ণনা করে গণেশ বন্দনা শুরু করে দিলে: খর্বস্থল কলেবর গজমুখ লম্বোদর বিঘ্ন নাশ কর বিঘ্নরাজ, পূজা হোম যোগে যাগে তোমার অর্চনা আগে তব নামে সিদ্ধ সর্ব কাজ। শুণ্ডে তুলি খৈ মোয়া দন্তে খাও চিবাইয়া ইঁদুর বাহন গণপতি, আপনি আসরে উর রিদয়ের আশা পুর নিবেদিতু করিয়া প্ৰণতি। গণেশ কানে হাত দিয়ে বললেন—“আরে রাম রাম কি বাজে বকছ, তুমি তো ভালো বিপদে ফেললে দেখি, রোসো আমি একবার বাড়ির মধ্যে থেকে আসছি, বিশেষ কাজ আছে।” বলে গণেশ উঠে গেলেন। এতক্ষণ গণেশের চৌষষ্টি কলাবৌ ঘরে কি হচ্ছে দরজার পাশ দিয়ে উঁকি দিয়ে দেখছিলেন, কর্তা উঠে যেতেই গণেশ-দাসীকে দিয়ে রিদয়কে ডেকে তাঁরা শুধোলেন—“হ্যাঁগা তুমি কর্তার কাছে কি নালিশ করছিলে?” রিদয়ের মুখে ইঁদুরের খবর শুনে তাঁরা বলে উঠলেন—“ওমা, এই দরবার করতে এসেছ তা বলতে হয়, ওই আমাদের কুমোর-বৌ কর্তার যে মূর্তিগুলো গড়ে-গড়ে ভটচায্যি মশায়ের হাতে দিয়ে লোকের ঘরেঘরে বিক্রি করতে পাঠায়, সেই গণেশের তুমি বুঝি সন্ধান করছ? ওই দরোয়ানজীকে বল সে তোমাকে সেই গণেশের দোকান দেখিয়ে দেবে।” রিদয় কলাবৌদের পেন্নাম করে আবার দেউড়িতে এসে দরোয়ানজীর সঙ্গে আর একটা ঘুপসী ঘরে গিয়ে দেখলে, দোকানঘরের এক-এক কুলুঙ্গীতে এক-এক রকম গণেশ—গোবর-গণেশ তিনি কলম হাতে পুঁথি লিখছেন, সিদ্ধিদাতা-গণেশ তিনি এক ধামা দিল্লীর লাড্ডু নিয়ে বসেছেন, মাড়োয়ারি-পটির টঙ্ক-গণেশ বসে-বসে খালি আকাশে আঁকশি দিচ্ছেন, হেড়ম্ব-গণেশ তিনি খুব আড়ম্বর করে ঢোল পিটছেন। রিদয় ঢিপ করে তাঁকে নমস্কার করে বললে—“গণেশদাদা, চিন্তে পারেন?” হেড়ম্ব রিদয়ের কথার জবাব দিলেন সমস্কৃত দেবভাষায়—“বুং।” রিদয় ভাবলে এ তো মুশকিল, যদি বা কত কষ্টে এসে ধরলেম, এখন কথা না বুঝলে উপায়? সে একবার ইঁদুরের দিকে, একবার ঢোলকের দিকে, একবার নিজের দিকে আঙুল নেড়ে ইশারায় বোঝালে ঢোলকটা চাই। গণেশ ঢোলকটা রিদয়কে দিয়ে এদিক-ওদিক শুঁড় নেড়ে কি বললেন বোঝা গেল না। রিদয় শুধু শুনলে—“বুং চটাপট্ ত্বং কং করং বাদনং পুনস্তম্ ব্যস্তম্ নাদম্ কুণ্ডমকুলম পৌউন্‌ড্রবর্দ্ধনম্ গণ্ডস্থলম্ আগচ্ছতু।” রিদয় গণেশের মুখ দেখে বুঝলে তিনি খুব খুশি হয়েছেন। সে অমনি আচার্যি পুরুতকে দুর্গোপুজোয় শ্রাদ্ধে শান্তিতে যেমন করে সব মন্তর আওড়াতে শুনেছিল ঠিক তারি নকলে বললে—“হুঁং ভূত স্বাহা, কুরু-কুরু কুণ্ডলিনী নমোঃ আসিতো দেবল গৃহ্যং কুরু তুভ্যং হং যংছট ফট ব্রহ্মবিদ্যা হবিষে স্বাহা অহঃ চিটপটাং হুং শান্তি ভূশান্তিং ভ্যূতরশান্তি অযুধেঃশান্তি ছহরি ছিহরি ছিহরি হরিবোল হরিবোল হরিবোল সূর্য প্রণাম।” গণেশ খুশি হয়ে দুবার ঘাড় নেড়ে “তথাস্তু” বলে চোখ বুজলেন। রিদয় আস্তে-আস্তে ঢোলক নিয়ে বেরিয়ে এল। দরোয়ান ঘরের দুয়োরেই দাঁড়িয়ে ছিল, সে অমনি বখশিশের জন্যে হাত পাতল, রিদয় এদিক-ওদিক দেখে আস্তে-আস্তে মান-কচুর শিকড়টি বার করে বললে—“দরোয়ানজী আর তো সঙ্গে কিছু নেই, এইটে নাও।” দরোয়ান “হাৎ-তেরি,” বলে হাত ঝাড়া দিলে। শিকড় যেমন মাটিতে পড়া অমনি পেচা রিদয়কে ছোঁ দিয়ে একেবারে ঘুরোনো সিঁড়ি বেয়ে ছাতে এসে উপস্থিত। সঙ্গে-সঙ্গে পেঁচো এসে রিদয়কে পেয়ে বসল—রিদয় অজ্ঞান হয়ে পড়ল আর বহুরূপীর চামড়ার মতো তার গায়ের রঙ লাল, নীল, হলদে, রকম-রকম বদলাতে আরম্ভ করলে। হাড়গিলে অমনি তাড়াতাড়ি ছুটে এসে মন্তর পড়ে পেঁচো ঝাড়তে বসে গেলেন: স্কন্ধাপসার শকুনী অন্ধ পুতনা শীত পুতনা মুখমণ্ডিকা নৈগমেষ প্রসীদতু ক্লীং চর্চ্চ হুং হুং ঝংশা ওঁলং শ্ৰীং কপালিকং জং জং তিষ্ঠতি মূষিকং চং চং চৰ্ব্বশং হংসঃ হুং ফট্‌ স্বাহা। মন্তরের চোটে রিদয় হাঁ করলে, যেন খেতে এল, অমনি চট করে হাড়গিলে ধুনোপড়া বেড়ি পেঁচোর মুখবন্ধন করে দিলেন: ধুল-ধুল স্বর্গের ধুল মর্তের মাটি লাগ-লাগ পেঁচোর দন্ত-কপাটি হাঁ করে নাড়িস তুণ্ড খা পেঁচির মুণ্ড যাঃ ফুঃ কার আজ্ঞে হাড়িপ বাবার আজ্ঞে হাঁড় মড়-মড় হাড়গিলের আজ্ঞে শিগ্‌রি যাঃ শিগ্‌রি যাঃ। পেঁচো রিদয়কে ছেড়ে পালাতেই রিদয় ধড়মড়িয়ে উঠে বসল। চকা রিদয়ের কানে-কানে শুধোলে—“গণেশ কি বললেন?” রিদয় বললে—“তা তো সবটা বুঝলুম না, কেবল আসবার সময় তিনি বললেন—তথাস্তু।” চকা হেসে বললে—“তবে আর কি, কেল্লা মার দিয়া! আর তোমার ভয় নেই। একদিন সকালে উঠে দেখবে, যে রিদয় সেই রিদয় হয়ে গেছ। চল এখন যুদ্ধং দেহি করা যাক গে।” এদিকে কেল্লা খালি পেয়ে চুয়োর দল এ-ওর পিঠে চড়ে একটা ঘুলঘুলি দিয়ে কেল্লার মধ্যে ঝাঁপিয়ে পড়ে একটার পর একটা নেংটি ইঁদুরের গড়-ভাণ্ডার সব দখল করে লুঠের চেষ্টায় দলে-দলে পিলপিল করে অন্ধকার সিঁড়ি বেয়ে তেতলায় চৌতলায় পাঁচতলায় উঠে ছতলায় রাজসভায় ঠাকুরবাড়িতে, এমন কি অন্দরমহলে পর্যন্ত ঢোকবার যোগাড়, দু-একটা চুয়ো ছাতেও উঠে হাড়গিলের বাসাটা পর্যন্ত প্রায় এগিয়েছে। এমন সময় উত্তর দক্ষিণ থেকে নেংটি ইঁদুরের দলকে খবর দিয়ে চকার বাকি হাঁসেরা ফিরে এল। ঠিক সেই সময় গণেশের ঢোলকে রিদয় চাটি বসালে—ধিক-ধিক-ধিক ধাঁকুড়-ধাঁকুড়। ঢোলের শব্দে চুয়োর দল লেজ উঁচু করে শিউরে উঠে যে যেখানে ছিল থির হয়ে দাঁড়িয়ে গেল, তারপর তালে-তালে লেজ দোলাতে-দোলাতে দলে-দলে সিঁড়ি বেয়ে উঠতে আরম্ভ করলে। চুয়োতে-চুয়োতে কেল্লার প্রকাণ্ড ছাত ভরে গেল, রিদয় চূড়োয় বসে ঢোল বাজাচ্ছে— চুয়ো, হাততালি দুয়ো নেংটি ধিং নিগিরি টিং ধাতিং তিং নাতিং থিং চুয়ো, হাততালি দুয়ো। আর সব চুয়ো লেজে-লেজে জড়াজড়ি করে নৃত্য করছে, পেঁচা পালক ফাঁপিয়ে, বেরাল লেজ ফুলিয়ে, হাড়গিলে গলার থলি দুলিয়ে সঙ্গে-সঙ্গে তাল দিচ্ছে! সব চুয়ো যখন ছাতে এসে জড়ো হল, তখন রিদয় চকার পিঠে চড়ে ঢোল বাজাতে-বাজাতে আকাশে উড়তে আরম্ভ করলে, চুয়োগুলো নাচতে-নাচতে লাফাতে থাকল। আনন্দে তারা মনে করলে যেন সবার ডানা গজিয়েছে, তারা প্রথমে ছাতের পাঁচিল, তারপর ছাতের আলসে, শেষে একেবারে আকাশে ঝম্প দিয়ে ডিগবাজী খেতে-খেতে মাটিতে এসে পড়ে জোড়া-জোড়া হাঁ করে আকাশের পানে চার পা তুলে চেয়ে রইল। চুয়োগুলো নাটবাড়ির লীলাখেলা সাঙ্গ করে সরে পড়েছে অনেকক্ষণ। হাড়গিলে, বেরাল, পেঁচা পর্যন্ত ঢোলের আওয়াজে এমনি মশগুল হয়ে গেছে যে পায়ে-পায়ে কখন সবাই একেবারে ছাতের প্রায় কিনারায় এসে পড়েছে টেরই পায়নি, হঠাৎ রাত একটার ঘণ্টা পড়ল অমনি রিদয় ঢোল বন্ধ করলে, সবাই চটকা ভেঙে দেখলে কেল্লা খালি, আকাশে অমাবস্যার চাঁদ দেখা দিয়েছে, চুয়ো আর একটাও নেই। রিদয়কে নিয়ে চকা উড়ে চলেছে। হাড়গিলে, পেঁচা চটকা ভেঙেই দেখলে বেরাল আলসে থেকে আকাশে একটা পা বাড়িয়ে চুয়োদের মতো ঝাঁপ দিয়ে গড়িয়ে পড়ে আর কি! হাড়গিলে তার লেজ ধরে এক টান দিয়ে বললে—“কর কি, পড়ে মরবে যে!” বেরাল ফ্যেল-ফ্যেল করে খানিক চেয়ে থেকে—“ইকি”—বলেই ফ্যেঁচ করে হেঁচে আস্তে-আস্তে পেছিয়ে এল। ওদিকে নেংটির দল আস্তে-আস্তে কেল্লায় এসে যে যার ঘরে ঢুকে ধান ভানতে বসে গেল। চুয়ো তাড়াবার জন্যে হেড়ম্ব-গণেশের ঢোলককে ছাড়া আর কাউকে যে ধন্যবাদ দেওয়া দরকার সেটা তাদের মনেই এল না! রাতের মধ্যে পেঁচার দল প্রায় বারোআনা মরা চুয়ো খেয়ে সাফ করে দিলে, বাকি যা রইল সেগুলোর উপরে সকালবেলায় কাক চিল এসে পড়ল। বেলা আটটার মধ্যে সব সাঙ্গ হয়ে গেল। আজ অমাবস্যা তিথি, রাত্তিরটা হিমালয়ের এপারটায় কাটিয়ে কাল থেকে হাঁসেরা পাহাড়ের ওপারে নিজের-নিজের দেশের দিকে রওনা হবে, দেশের কথা ছাড়া আজ আর কারু মুখে অন্য কথা নেই। আকাশে মেঘ করেছে, বিষ্টি নেই, কেবল ঠাণ্ডা হাওয়া আর শীতালু বাতাস। মাথার উপর দিয়ে দলে-দলে পাখি হুহু করে উত্তরমুখে চলেছে—সবাই দেশে যেতে ব্যস্ত, তার ওপর এ-বছর পাখিদের বারোয়ারি পড়েছে। কুঁচেবক কুঁচিবক তারা বারোয়ারির নেমন্তন্ন করতে বেরিয়েছে, যার সঙ্গে দেখা হচ্ছে চেঁচিয়ে জানাচ্ছে পুর্ণিমার দিনে বারোয়ারিতে যেতে হবে, ভারি জলসা। চকা নিমন্ত্রণ পেয়ে ভারি খুশি, রিদয়কে বললে—“তোমাদের দুজনের কপাল ভালো, বারো বছর অন্তর কৈলাস-পর্বতের ধারে মানস-সরোবরে এই বারোয়ারির মজলিস হয়, সেখানে সারসের নাচ, হরিণ-দৌড়, আর্গিনপাখির কনসার্ট, গাঙ-শালিকের গীত, ছুঁচোর কেত্তন, শেয়ালের যুক্তি, মেড়ার লড়াই, ভালুক-নাচ, সাপ-বাজি, মাছের চান, এমনি আরো কত কি হবে তার ঠিকানা নেই! ব্রহ্মার হাঁস কর্মকর্তা, স্বয়ং পশুপতি হবেন সভাপতি, পৃথিবীর পশুপক্ষী সেখানে হাজির হবে। মানুষের কপালে এমন আশ্চর্য কারখানা দেখা এ-পর্যন্ত ঘটেনি, কোথায় লাগে তোমাদের হরিদ্বারের কুম্ভমেলা! আর পাহাড়ের ওধারে আমাদের দেশটা কি চমৎকার তোমায় কি বলব, পালতি জলা—যেটা ব্ৰহ্মার হাঁস আর পৃথিবীর জলচর পাখি, কি পোষা কি বুনো সবাইকার আড্ডা, সেটা যে কত বড় তা কেউ জানে না, উত্তরের সমস্ত নদী সমস্ত পাহাড় এসে সেইখানেই শেষ হয়ে আবার সব নতুন-নতুন নাম নিয়ে দক্ষিণ দিকে নেমে এসেছে। এই পালতির উত্তর গায়ে ঢোলা পর্বত, সেই ঢোল পর্বতের ওপারে পাঁচিলে ঘেরা চীন মুল্লুক, তারো ওধারে বরফের দেশের ধারে ‘তন্দ্রা’ বলে একটা দেশ। বছরে প্রায় দশ মাস সেখানে বরফের চাদর মুড়ি দিয়ে ফুল পাতা নদ নদী সবই ঘুমিয়ে থাকে, কেবল বসন্তের মাস দুই সেখানে সূর্য দেখা দেন, আর অমনি সারা দেশ ফুলে-ফলে পাতায়-ঘাসে দেখতে-দেখতে সবুজ হয়ে ওঠে, আর আমরা সব পাখিরা মিলে সেখানে গিয়ে বাসা বেঁধে ডিমে তা দিয়ে বাচ্ছা ফুটিয়ে চলে আসি। বসন্তের শেষে পালতি জলায় বাচ্ছারা বড় হবার জন্যে আপনারাই উড়ে আসে, আমরা সারা বছর দেশে-বিদেশে ঘুরে আবার বছরের এই সময়টিতে গিয়ে দেখি আমাদের ছেলে-পিলেরা কেউ বড় হয়েছে, কেউ বড় হয়ে নিজের পথ দেখে নিতে বিদেশে চলেছে, কোনো-কোনো বাচ্ছা বা মরে গেছে, কেউ-কেউ বা এরি মধ্যে বিয়ে-থাওয়া করে ঘরকন্না পাতবার চেষ্টায় আছে, কোনো বাচ্ছা বা সন্ন্যাসী হয়ে দেশ ছেড়ে বেরিয়ে গেছে, কাউকে ধরে মানুষে খেয়ে ফেলেছে, কাউকে মানুষে গুলি করে মেরে ফেলেছে আর কাউকে বা তারা জেলখানার মতো খাঁচায় ভরেছে, আর কাউকে বা ডানা কেটে পোষ মানিয়ে ছেড়ে দিয়েছে। বছরের এই সময়টিতে আমরা একবার করে নিজেদের জন্মস্থানে আর পুরোনো বাসায় ফিরে আসতে পাই, নিজের ছেলেমেয়ের দেখা পাই, সুখ-দুঃখের দুটো কথা কয়ে নিই, তারপর আবার চলি এদেশ-সেদেশ করে।” রিদয় বলে উঠল—“আমারো তো দেশ আছে কিন্তু আমার তো সেখানে ফিরতে একটুও ইচ্ছে হয় না।” চকা বললে—“সে কি! তোমার বাপ-মা কেউ নেই নাকি? যখন বড় হবে, বৌ হবে সংসার হবে, ছেলে-পুলে নাতি-পুতি হবে তখন বুঝবে সারা বছরের পরে দেশে ফিরতে কি আনন্দ। তখন দেশের ডাক যখন এসে পৌঁছবে তখন দেখবে মন অমনি উধাও হয়ে ছুটেছে আর কিছুতে মন বসছে না, প্রাণ নীল আকাশে প্রজাপতির মতো সোনার পাখনা মেলে দিয়ে উড়ে পড়তে চাচ্ছে, তখন দেশের কথাই কইতে থাকবে। এর সঙ্গে তার সঙ্গে, দিন নেই রাত নেই কি সকাল কি সন্ধ্যে কেবল বঁধুর মুখ মধুর হাসিই মনে জাগবে তখন।” চকার কথা শুনতে-শুনতে রিদয় কেমন আনমনা হয়ে গেল। সারাদিন ধরে আজ তার কেবলি মনে পড়তে লাগল—আমতলির সেই ঘর ক’খানি, সেই তেঁতুলতলার ঘাট, তেপান্তর মাঠ, হাঁস-পুকুরের কাদা জল, তাতে শালুক ফুল, বাড়ির ধারে ঝুমকো-লতার মাচা তার উপরে দুগ্‌গা টুনটুনি পাখিটি, উঠোনের কোণে তুলসীমঞ্চটি, কালো মাটি-লেপা ঘরের দেওয়াল তার উপরে মায়ের হাতে লেখা লক্ষ্মীপুজোর আলপনা, দড়ির আলনায় বাপের কোঁচানো চাদর, পুরোনো শোবার তক্তা তার উপরে শীতলপাটি আর লাল ঝালর দেওয়া তালপাতার পাখাখানি। সব আজ পরিষ্কার যেন রিদয় চোখে দেখতে লাগল, আর থেকে-থেকে মন তার ঘরে যেতে আকুলি-বিকুলি করতে থাকল—সকাল কেটে দুপুর হয়েছে, তখনো রিদয় আকাশের দিকে চেয়ে ঘরের কথা ভাবছে—দলে-দলে কত পাখির ঝাঁক দেশমুখে চলে গেল—“চল-চল চলরে চল” বলতে-বলতে। নাটবাড়ির জলায় যত পাখি— কাদাখোঁচা জলপিপি কামি কোড়া কঙ্ক পালতির কুঁচেবক আর মৎস্য বঙ্ক। ডাহুকা ডাহুকি আর খঞ্জনী খঞ্জন সারস সারসী যত বক বকীগণ। তিত্তির তিত্তরা পানিকাক পানিকাকি কুরবী কুরল চক্রবাক চক্রবাকি। সবাই দলে দলে দেশমুখে উড়ে পড়ছে! রিদয় দেখলে মাথার উপর দিয়ে কত পাখির ঝাঁক দেশ-বিদেশ থেকে, কেউ বন ছেড়ে, কেউ খাঁচা ভেঙে হুহু করে দেশে চলেছে— ময়না শালিকা টিয়া তোতা কাকাতুয়া চাতক চকোর নুরী তুরী রাঙ্গচুয়া। ময়ূর ময়ূরী সারিশুক আদি খগ কোকিল কোকিলা আদি মরাল বিহগ। সীকরী বহরী বাসা বাজ তুরমুতী কাহা-কুহি লগড় ঝগড় জোড়া ধুতি। শকুনী গৃধিনী হাড়গিলা মেটেচিল শঙ্খচিল নীলকণ্ঠ শ্বেত রক্ত নীল। ঠেটি ভেটি ভাটা হরিতাল গুড়-গুড়— বাকচা হারিত পারাবৎ পাকরাল হাতারিয়া করকটে ফিঙ্গা দহিয়াল। চড়ুই মুনিয়া পাবদুয়া টুনটুনি বুলবুল ফুলঝুটি ভিংরাজ রঙে-রঙে সবুজে-লালে সোনালীতে-রূপোলীতে আকাশ রাঙিয়ে চলেছে যে যার দেশে বাতাসে ডানা ছড়িয়ে। রিদয় কেবলি বসে-বসে দেখতে লাগল আর মনে-মনে বলতে লাগল—“যদি ডানা পেতুম!” পাখিদের দেখাদেখি ভীমরুল ডাঁশ মশা দলে-দলে উড়তে আরম্ভ করেছে, চকার দলের হাঁসেরা আর স্থির থাকতে পারছে না, এখনো সারারাত এখানে কাটাতে হবে ভেবে তারা কেবলি উসু-খুসু করছে আর ডানা ঝাড়া দিচ্ছে! চকা একবার রিদয়ের কানের কাছে বলে গেল, যা কিছু নেবার আছে সঙ্গে, এইবেলা বেঁধে-ছেদে রাখ, কাল ভোরেই রওনা হতে হবে। রিদয়ের দেশের জন্যে মনটা আনচান করছে কিন্তু বেড়াবার শখ এখনো মেটেনি। সে পথের মাঝে নিজের আর খোঁড়ার জন্যে গোটাকতক গুগলী টোপাপানা এটা-ওটা সেটা নিয়ে উলুখড়ের একটি গেঁজে বুনতে বসে গেল। থলেটা তৈরি হতে প্রায় সন্ধ্যে হয়ে এল। হাঁসেরা তাড়াতাড়ি খেয়ে নিয়ে চোখ বুজে রাতটা কোনো রকমে কাটিয়ে দেবার যোগাড় করছে এমন সময় চকা এসে রিদয়কে শুধালো—“খোঁড়াকে দেখেছ কি ? তাকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না।” রিদয় তাড়াতাড়ি থলে ফেলে উঠে দাড়িয়ে বললে—“সে কি, গেল কোথায়, শেয়ালে নিলে না তো?” চকা শুকনো মুখে বললে—“এই তো এখানে একটু আগেই ছিল, হঠাৎ গেল কোথা !” রিদয় বিষম ভয় পেয়ে এদিক-ওদিক ছুটোছুটি খোঁজাখুজি করতে লাগল। একে সন্ধ্যা হয়ে গেল, যেখানে পাখির ডাক শোনে সেইদিকেই রিদয় ছুটে যায়, ঝোপ-ঝাড় নেড়ে দেখে, নাম ধরে ডাক দেয়, এমনি সারারাত রিদয় ছুটোছুটি করতে লাগল অন্ধকারে জল কাদা ভেঙে! নাটবাড়ির উঠোনটা পর্যন্ত রিদয় খুঁজে এল, কিন্তু সুবচনীর খোঁড়া হাঁস কোথাও নেই! এদিকে সকাল হয়ে এল, চকা বললে—“সে নিশ্চয়ই অন্য দলে মিশে এগিয়ে গেছে, আর মিছে খোঁজা, চল আমরা বেরিয়ে পড়ি, সময় উৎরে যাচ্ছে!” রিদয় ঘাড় নেড়ে বললে—“তাকে না নিয়ে আমি এখান থেকে নড়ছিনে, তোমরা যেতে চাও যাও।” চকা মুশকিলে পড়ল! রিদয় নড়তে চায় না, এদিকে সব হাঁসেরই দেশে যাবার টান রয়েছে, তবু খোঁড়ার জন্যে চকা আরো এক ঘণ্টা দেরি করলে, তাতেও যখন খোঁড়ার সন্ধান পাওয়া গেল না তখন তারা রিদয়কে একলা রেখে চট করে দেশ থেকে ঘুরে আসবার জন্যে উত্তরমুখে উড়ে পড়ল—আসি-আসি বলতে-বলতে। চকার দল চলে যেতে রিদয়ের চারদিক যেন শূন্য বোধ হতে লাগল! সে আস্তে-আস্তে নাটবাড়ির ভাঙা পাঁচিলটা আর একবার সন্ধান করতে চলেছে, এমন সময় দূর থেকে দেখলে খোঁড়া কিরাশ-কলমীর ডাঁটা মুখে নিয়ে খোঁড়াতে-খোঁড়াতে পাঁচিলের গায়ে একরাশ ভাঙাচোরা পাথরের মধ্যে গিয়ে সেঁধোলে। এমনি খোঁড়াকে শেওলাগুলি নিয়ে সেখানটায় আনাগোনা করতে দেখে রিদয় লুকিয়ে-লুকিয়ে পাঁচিলে উঠে দেখলে—জড়োকরা পাথরের মধ্যে চমৎকার ছাই রঙের একটি বালিহাঁস শুয়ে আছে, খোঁড়া তার মুখে খাবার তুলে-তুলে দিচ্ছে আর দুজনে কথা হচ্ছে—“আজ কেমন আছ? তেমনিই? ডানার বেথাটা যায়নি?” “না, এখনো নাড়তে গেলে বুকটায় বেদনা করে।” “মানুষগুলো কি নিষ্ঠুর! ভাগ্যি গুলিটা বুকে লাগেনি।” “লাগলে আর কি হত, না হয় মরে যেতুম!” “ছি-ছি অমন কথা বল না, আমার ভারি দুঃখ হয়।” “আমি তোমার কে যে আমার জন্যে দুঃখু হবে; আজ এই দেখা শোনা এত ভাব এত যত্ন, কাল হয়তো তুমি চলে যাবে, দুদিন পরে মনেও থাকবে না, কে বালি কোথাকার বালি!” খোঁড়া ঘাড় নেড়ে বললে—“অমন কথা বল না, যতদিন বাঁচব তোমায় ভুলব না, জলার মধ্যে এই দিনটি মনে থাকবে!” বালিহাঁস একটু ঘাড় হেলিয়ে খোঁড়ার গা ঘেঁষে বললে—“আমি দল ছাড়া হয়ে পড়লুম, কতদিনে সারবো তার ঠিক নেই।” খোঁড়া বুক ফুলিয়ে বললে—“ভয় কি আমি তোমার কাছে রইলুম, এখন একটু ঘুমোও আমি একবার ঘুরে আসি।” খোঁড়া চলে গেলে রিদয় আস্তে-আস্তে গর্তর মধ্যে ঢুকে দেখলে এমন সুন্দরী হাঁস সে কোনোদিন দেখেনি, এতটুকু তার মুখটি, পালকগুলি নরম যেন তুলো, সাটিনের মতো, ঝকঝক করছে, চোখদুটিও কাজলটানা যেন ঢলঢল করছে! রিদয়কে হঠাৎ দেখে বালিহাঁস ভয় পেয়ে পালাবার চেষ্টা করতে লাগল কিন্তু বেচারার ডানায় বেদনা, উড়তে পারে না, বালি চআঁ করে কাঁদতে লাগল। রিদয় তাড়াতাড়ি বললে—“আমি হংপাল হাঁসেদের বন্ধু, খোঁড়া হাঁসের সেঙাত, আমায় দেখে ভয় কি?” বালিহাঁস রিদয়ের কথায় সাহস পেয়ে ঘাড়টি একটু নিচু করে বললে—“তাঁর মুখে আপনার নাম শুনেছি, আপনি অতি মহাশয় লোক।” এমনি ভাবে এই কথাগুলি বালি বললে যে, রিদয়ের মনে হল কোনো রাজকন্যে যেন তার সঙ্গে আলাপ করছেন! রিদয় বললে—“দেখি, আপনার কোথায় হাড়টা ভেঙেছে সোজা করে দিই।” আস্তে-আস্তে বালিহাঁসের ডানার তলায় হাত দিয়ে রিদয় মচকানো হাড়টা ধরে খুট করে যেমন সরিয়ে দেওয়া, অমনি বালিহাঁসটি “মাগো!” বলে অজ্ঞান হয়ে পড়ল। রিদয় কখনো ডাক্তারি করেনি, পাখিটি মরে গেল ভেবে সে তাড়াতাড়ি পাছে খোঁড়া এসে দেখে সেই ভয়ে লম্ফ দিয়ে চোচা চম্পট। খোঁড়া বেশি দূর যায়নি, দু-ঢোক জল খেয়েই ফিরে আসছে, পথের মধ্যে রিদয়ের সঙ্গে দেখা! রিদয় তাড়াতাড়ি খোঁড়াকে বললে—“কোথায় ছিলে সবাই যে চলে গেল, সারারাত তোমাকে খোঁজাখুঁজি করেছি, চল আর দেরি নয়, এই বেলা গিয়ে তাদের ধরি, বেশি দূরে এখনো যায়নি!” খোঁড়া আমতা-আমতা করে বললে—“রোসো, এখনি যেতে হবে? এত শিগ্‌রি কি না গেলেই নয়?” রিদয়ের ভয় হল পাছে খোঁড়া গিয়ে দেখে বালিহাঁস মরে গেছে। সে তাড়াতাড়ি খোঁড়ার পিঠে চেপে তাকে ওড়াবার চেষ্টা করতে লাগল! খোঁড়া ঘাড় নেড়ে বললে—“দেখ ভাই আমার এক বন্ধু বড় বিপদে পড়েছে, তাকে একলা ছেড়ে যাওয়া তো হতে পারে না, বেচারার ডানাটি জখম হয়েছে নড়তে পারে না, আমি গেলে তাকে কেবা খাওয়ায় আর কেই বা যত্ন করে!” রিদয়ের ইচ্ছে হাঁস সেদিকে না যায়, সে কেবলি তাকে ফেরাতে চেষ্টা করতে লাগল, কিন্তু খোঁড়ার মন পড়ে আছে সেই রূপকথার রাজকন্যের মতো সুন্দরী বালিহাঁসের দিকে, সে রিদয়কে নিয়ে একবার উত্তরমুখে উড়ল, কিন্তু খানিক পথ গিয়েই বললে—“ভাই, বড় মন কেমন করছে, মানস-সরোবরের এই নাটবাড়ির চালায় দু-চারদিন কাটিয়ে চল বাড়িমুখো হওয়া যাক, দেশে যাবার জন্যে মন টেনেছে আর ঘুরে বেড়াতে ভালো লাগছে না।” রিদয়েরও মনটা সকাল থেকে দেশের দিকেই টানছিল, সে কোনো কথা কইলে না। খোঁড়া হাঁস আস্তে-আস্তে উড়ে এসে আবার নাটবাড়ির ধারে নামল ঠিক বেছে বেছে সেইখানটিতে, যেখানে তার বালিহাঁস রয়েছে। খোঁড়া রিদয়কে পিঠে থেকে নামিয়ে গলা উঁচু করে দুবার ডাক দিলে—“বালি ও বালি!” কোনো উত্তর এল না, তারপর ছুটে গিয়ে দেখলে পাথরের মধ্যে শুকনো ঘাস পাতা বিছানো তাদের দুদিনের বাসাটি খালি হা-হা করছে, কেউ কোথাও নেই। রিদয় চুপ করে রইল, ভাঙা গলায় খোঁড়া হাঁস আবার ডাক দিলে—“বালি কোথায় বালি!” রিদয় ভাবছে নিশ্চয় শেয়াল এসে মরা হাঁসটা টেনে নিয়ে গেছে, ঠিক সেই সময় জলার ধারে বেনা-বনের সবুজ পাতাগুলো নড়ে উঠল, তার পরেই মিঠে সুরে—“এই যে আমি, একটু গা ধুয়ে নিচ্ছি” বলে বালি আস্তে-আস্তে জলা থাকে উঠে এল! তার ঝকঝকে পালকে শিশিরের মতো জলের ফোঁটাগুলি আলো পেয়ে হীরের মতো ঝকঝক করছে, রিদয়ের মনে হল যেন জলদেবী জল থেকে উঠে এলেন। খোঁড়া হেলতে-দুলতে বালির কাছে গিয়ে আস্তে-আস্তে তার গলা চুলকে দিয়ে বললে—“বেদনা আছে কি?” বালি ঘাড় নেড়ে বললে—“একটুও না, তোমার বন্ধুর কৃপায় আর তোমার যত্নে আমি ভালো হয়ে গেছি।” তারপর দুজনে জলে গিয়ে সাঁতার আরম্ভ করলে, রিদয় জলের ধারে বসে একটা বেনার শিষ চিবোতে থাকল। বালিহাঁসকে সঙ্গে নিয়ে খোঁড়া এর মধ্যে একদিন চুপিচুপি পদ্মবনে পদ্ম-ফুলের সোনালী রেণু এ-ওর গায়ে ছড়িয়ে দিয়ে নিজেরাই নিজেদের গায়ে হলুদ মেখে, মাছরাঙা পাখিদের বৌ-ভাতে মাছ খাইয়ে, বিয়ে-থাওয়া খাওয়া-দাওয়া চুকিয়ে জলার ধারে বাসা বাঁধবার যোগাড়ে আছে, দেশে ফেরার কিম্বা বিদেশে উড়ে চলার আর নামটি করে না। রিদয় শুধোলে বলে—“আমরা দুটিতে যেখানে থাকি সেইখানেই আমাদের দেশ।” রিদয় বলে—“আমার তো দেশ আছে, আমাকে তো সেখানে যেতে হবে বিয়ে-থাওয়াও করতে হবে। এই জলার মধ্যে না পাওয়া যায় ভালো খাবার, না আছে ভালো শোবার জায়গা, এখানে বাসা বাধলে তো আমার চলবে না।” বালিহাঁস বললে—“তা বেশ তো, এই জলার ওপারেই একটা গয়লাপাড়া আছে, চলুন আপনাকে তাদের গোয়ালে রেখে আসি। একটি বুড়ি গাই তাদের আছে এক ছটাক করে দুধ দেয়, দুধ ভাত সবই সেখানে পাবেন।” রিদয় শুধালে—“আর তোমরা?” বালিহাঁস লজ্জায় মুখটি নিচু করে রইল। খোঁড়া চুপি-চুপি রিদয়ের কানে-কানে বললে—“ভাই, ওর ডিম পাড়বার সময় হয়েছে, দুটো মাস অপেক্ষা কর, তারপরে সবাই এক সঙ্গে বাড়ি ফেরা যাবে, এই কটা দিন তুমি কোনো রকমে গৌহাটিতে কাটাও।” হাঁসের বাচ্ছা হবে শুনে রিদয় ভারি খুশি, সে একখানা শালপাতার নৌকোতে ভর দিয়ে গয়লাপাড়ার ঘাটে গিয়ে উঠল। গয়লাপাড়ার নামেই পাড়া, একঘর বই গয়লা নেই, তাও আবার গয়লা-বুড়ো অনেককাল হল মরেছে, আছে কেবল এক বুড়ি গাই আর এক বুড়ি গয়লানী! গয়লাবাড়ির উঠোনে ঢুকে রিদয় এদিক-ওদিক চাইতে লাগল, ঘুটঘুটে আঁধার রাতটা, বাড়ির কোথাও একটি আলো নেই, কোনদিকে গোয়াল কোনদিকে ঢেঁকিশাল কোথায় বা হেঁসেল কিছুই দেখবার যো নেই, একটা কেবল বেল গাছ ভূতের মতো এঁকে-বেঁকে টেরা-বাঁকা মোচড়ানো-দোমড়ানো শুকনো ডাল নিয়ে উঠোনের মাঝে দাড়িয়ে আছে, আর তার উপরে বসে একটা কালো পেঁচা কেবলি চেঁচাচ্ছে—“যো-মেঁ-র বাড়ি-যাঃ, মাথা খাঃ!” ঝড় উঠল, তার সঙ্গে টিপটিপ বিষ্টি নামল, আরো দুটি পথিক নেউল আর খটাস তাড়াতাড়ি উঠোনে ঢুকে এদিক-ওদিক চাইতে-চাইতে রিদয়কে দেখে শুধোলে—“এটা কি গৌহাটির চটি, রাতে থাকবার ঘর পাওয়া যাবে কি এখানে?” রিদয় বললে—“আমি তো গয়লাবাড়ি বলে এখানে ঢুকেছি কিন্তু অন্ধকারে কিছুই দেখছিনে। এটা গোয়াল কি চটি কি ধর্মশালা বা পাঠশালা কিছুই বোঝা যাচ্ছে না, কারু শাড়াশব্দ পাচ্ছিনে, কেবল একটা পেঁচা ডাকছিল একটু আগেই শুনেছি।” খটাস বললে—“তবে নিশ্চয় এটা গঙ্গাযাত্রীর ঘর!” নেউল বলে উঠল—“মাঠের মধ্যে কখনো মড়া পোড়াবার ঘাট হয়? বাড়িই বটে, তবে এটা কলুর বাড়ি কি গয়লাবাড়ি কিম্বা পুলিশের খাদাবাড়ি তা বোঝা যাচ্ছে না!” খটাস বললে—“সেটা বোঝবার সহজ উপায় আছে।” রিদয় শুধোলে—“কোনো বাড়ি সহজে চেনবার উপায়টা কি প্রকাশ কর!” খটাস খানিক ভেবে বললে—“মানুষেরা নানা কাজের জন্যে নানারকম বাড়ি-ঘর বাঁধে তা তো জানো—উত্তরমুখো, দক্ষিণমুখো, পুবমুখো, পশ্চিমমুখো। গয়লা বাঁধবে একরকম, তেলি বাঁধবে অন্যরকম, মালি বাঁধবে একরকম, কুমোর বাঁধবে একরকম। আর্ট বোঝো না? কে কি রকম বাঁধবে তার হিসাবটা জানলেই কোনটা কি বাড়ি বোঝা যাবে।” নেউল বললে—“হিসেবটা কেমন শুনি?” “শোনো তবে, প্রথমে মালির বাড়ি কেমন তা বলি শোনো,” বলে খটাস খনার বচন আরম্ভ করলে: চৌদিকে প্রাচীর উচা কাছে নাই গলি কুচা পুষ্প বনে ঢাকে রবি শশি নানা জাতি ফোটে ফুল উড়ি বৈসে অলি কুল কোকিল কুহুরে দিবা নিশি। মন্দ-মন্দ সমীরণ বহে সেথা অনুক্ষণ বসন্ত না ছাড়ে এক তিল! রিদয় বলে উঠল—“এখানে তো ফুলের গন্ধ মোটেই পাচ্ছিনে! তবে এটা মালির ঘর নয়।” “আচ্ছা, গন্ধে-গন্ধে বোঝো এটা তেলির বাড়ি কিনা,” বলেই খটাস আবার শুরু করলে: সরষের ঝাঁঝে তেলি হাঁচে ফ্যেঁচ-ফ্যেঁচ বলদেতে ঘানি টানে ঘ্যেঁচ-ঘ্যেঁচ ভ্যেঁচ। নেউল বাতাসে নাক উঁচিয়ে বললে—“কই হাঁচি তো পাচ্ছে না! তবে এটা তেলির বাড়ি নয়, মালির বাড়িও নয়।” “কুমোর বাড়ি কিনা দেখ তো,” বলে খটাস শোলক আওড়ালে: হাঁড়ি পাতিল ঠুকুর ঠাকুর কলসীর কাঁধা পাতখোলার সোঁদা গন্ধ কুমোর বাড়ি বাঁধা। রিদয় এদিক-ওদিক নাক ঘুরিয়ে বললে—“নাঃ, কোনো গন্ধই পাচ্ছিনে!” “আচ্ছা দেখ দেখি গয়লাবাড়ি কিনা”: গোয়াল ঘরে দিচ্ছে হামা নেহাল বাছুর ঘোল মউনি বলছে ঘরে গাবুর গুবুর ভালো দুধ টোকো দই দিচ্ছে সেথা বাস মোষ দিচ্ছে নাক ঝাড়া গরু চিবায় ঘাস। রিদয় পুবদিকে নাক তুলে বললে—“এসব কিছুই নেই এখানে!” নেউল পশ্চিম দিকে শুঁকে-শুঁকে বললে—“যেন ভিজে ঘাসের গন্ধ পাচ্ছি!” খটাস উত্তর-দক্ষিণ পুর্ব-পশ্চিম চারদিকে কান পেতে নাক ঘুরিয়ে বললে—“এটা গয়লাবাড়ি বটে, কিন্তু তেমন গোঁড়া গয়লা নয়, শব্দ আর গন্ধগুলো কেমন ফিকে-ফিকে ঠেকছে, বিচিলী আছে, ঘাসও কিছু আছে, গরুও একটা যেন আছে বোধ হচ্ছে।” ঠিক সেই সময় বুদিগাই “ওমঃ” বলে একবার ডাক দিলে! তিন পথিক তাড়াতাড়ি সেই দিকে গিয়ে দেখলে—কত কালের পুরোনো চালাখানা তার ঠিক নেই, বিষ্টির জলে মাটির দেওয়াল গলে গিয়ে বুড়ো মানুষের পাঁজরের হাড়গুলোর মতো ভিতরের চাঁচ আর খোঁটাখুঁটি বেরিয়ে পড়েছে, দরজায় একটা ঝাঁপ খুলে মাটিতে শুয়ে পড়েছে, আর একটা পচা দড়ি ধরে পড়ো-পড়ো হয়ে এখনো ঝুলে রয়েছে! চালের খড় এখানে-ওখানে উড়ে গিয়ে ভিতর থেকে ঘুণ-ধরা বাঁশের আড়া দু-চারটে ফোগলা দাঁতের মতো দেখা যাচ্ছে! তিন পথিকের পায়ের শব্দ পেয়ে গোয়ালের মধ্যে থেকে বুদি ভাবলে গয়লাবুড়ি তার জাব নিয়ে এল—সে দরজা থেকে মুখটা বাড়িয়ে এদিক-ওদিক দেখে বললে—“মাগোঃ মাঃ, রাত হল আজ কি খেতে দিবিনে!” খটাস, রিদয় আর নেউল বুদির কথার উত্তর দিলে—“তিন পথিক মোরা, রাতের মতো জায়গা মিলবে কি?” বুদি মাথা হেলিয়ে কেবলি শুধাতে লাগল—“কেগাঃ কে?” রিদয় বললে—“আমি আমতলির তাঁতির পুত্তুর শাপভ্রষ্ট বুড়ো-আংলা দেশভ্রমণে বেরিয়েছি।” বুদি নেউলের দিকে শিং হেলিয়ে বললে—“ইনি?” “নেউল পুত্তর ইনিও বেরিয়েছেন মৃগয়া করতে।” খটাসের দিকে চোখ ফিরিয়ে বুদি রিদয়কে শুধালে—“আর ইনি কে?” “ইনি হচ্ছেন খটাসের পুত্তুর, দিগ্বিজয়ে বেরিয়েছেন।” বুদি গোয়ালের দুয়োর ছেড়ে একপাশ হল, তিন বন্ধুতে বাদলার রাতে গোয়ালে আশ্রয় নিয়ে রাত কাটাবার যোগাড় করতে চলেছেন, বুদিগাই লেজ নেড়ে বললে—“আর জন্মে কত তপিস্যি করেছি, তাই কাঙালিনীর ঘরে রাজপুত্তুর, পাত্তরের পুত্তুর আর কোটালের পুত্তুরের পা পড়ল!” রিদয় খুশি হয়ে বুদির ঘাড়টা একটু চুলকে দিলে, তারপর খড়ের গাদায় শুয়ে তিন বন্ধুতে চোখ বুজলে। এদিকে বুদিগাই সারাদিন জাব পায়নি, সে পেটের জ্বালায় কেবলি উসখুস করছে—“ওমঃ মাগোঃ, কোথায় গেলে আজ কি আর খাব না? ও ভাই রাজপুত্তর মাচানের উপর থেকে এক বোঝা খড় নামিয়ে দিতে পার, বড় খিদে লেগেছে!” রিদয় দেখলে চালের বাতায় মস্ত এক বোঝা খড় চাপানো রয়েছে বটে, কিন্তু সেটা টেনে নামানো রিদয়ের সাধ্যি নয়, একটা আঁটি কোনো রকমে টেনে রিদয় বুদির মুখের কাছে ধরে দিলে। গাই খড়গুলো মুখে নিয়ে জাবর কাটতে লাগল। রিদয়ের একটু তন্দ্রা এসেছে, এমন সময় বুদি আবার বলে উঠল—“ওমা গো, ভাই পাত্তরের পুত্তুর একটুখানি জল এনে দিতে পার?” নেউল ঘুমের ঘোরে বললে—“এত রাতে জল পাই কোথা!” বুদি বিনয় করে বললে—“বাইরেই বিষ্টির জল জমা হয়েছে, উঃ বড় তেষ্টা, আমার গলার দড়িটা যদি খুলে দাও তো ওখানে গিয়ে একটু জল খেয়ে বাঁচি!” নেউল বুদির গলার দড়িটা দাঁতে কেটে দিয়ে বললে—“যাও তবে!” বুদি দু-পা গিয়ে বললে—“ইস ভারি অন্ধকার, ভাই কোটালের পুত্তুর।” খটাস আধবোজা চোখ মেলে বললে—“কি?” বুদি একে রাতকানা তাতে আবার কানে কালা হয়েছে, খটাস কি বললে—শুনতেই পেলে না। আবার ডাকলে—“ও ভাই কোটালের পুত্তুর আমি রাতকানা, যদি গলার দড়িটি ধরে একটুখানি এগিয়ে দিয়ে এস তো ভালো হয়!” “ভালো বিপদেই পড়া গেল,” বলে খটাস দড়িটা ধরে বুদিগাইকে উঠানের মাঝে টেনে নিয়ে অন্ধকারে দাঁড় করিয়ে সরে পড়ল! রাত তখন বারোটা, খড়ের গাদায় তিন বন্ধুতে আরামে নিদ্রা যাচ্ছে, এমন সময় বুদিগাই এসে সবার কানে কানে বললে—“বড় বিপদ, বুড়িটা মরে গেছে!” রিদয় তাড়াতাড়ি চোখ মুছে বললে—“সেকি ! মরলো কেমন করে?” বুদি নিশ্বেস ফেলে বললে—“দুঃখের কথা কইব কি, এই সন্ধ্যেবেলা সে আমার গলাটি ধরে বলে গেল—“বুদি শুনেছিস এই নাটবাড়ির জলায় রাজা এবার ধান বোনবার হুকুম দিয়েছেন, এতকালে জমি সব আবাদ হবে; আমাদেরও দুঃখু ঘুচবে।’ আমি বললেম—‘মা, তোমার আর দুঃখু ঘুচবে কি, তোমার ছেলেপুলে ক’টাই বিদেশে গিয়ে সংসার ফেঁদে কাজ-কারবার করতে বসে গেল, বুড়ি মাকে তো তারা একটিবার মনেও করলে না!’ মা বললে—‘বুদি লো বুদি, তাদের দুষিসনে, ঘরের ভাত পেলে কি তারা আমাকে একলা ফেলে বিদেশে যায়, না পরের চাকরি করে? এইবার তাদের চিঠি দেব দেখিস কেমন না তারা আসে। আমার মরবার সময় সব ছেলেরা এসে আমায় ঘিরে দাঁড়াবে আর আমি ডঙ্কা মেরে স্বর্গে চলে যাব এই সাধটি আমার কি পূর্ণ হবে বুদি!’ এই বলে মা ঘরের মধ্যে চিঠি লিখতে গেল, গোয়াল-ঘরে আর জাবও দিতে এল না, পিদুমও জ্বাললে না! সন্ধ্যেবেলা মাকে যেন কেমন-কেমন দেখনু, তাই বলি একবার যাই দেখে আসি। ওমা, ঘরে উঁকি দিয়ে দেখি যেখানকার যেটি সব তেমনি গোছানো রয়েছে—পিদুমটি জ্বলছে বিছানা পাতা রয়েছে কিন্তু মা আমার চিঠিটুকু হাতে নিয়ে আলুথালু হয়ে দরজার ধারে পড়ে রয়েছেন, ছেলেরা আসবে ছেলেরা আসবে করেই বুড়ি মলো গো!” “আহা! এই গয়লা-বোয়ের দশা কি এমন ছিল। এই বাড়িতে দেখেছি ছেলে-মেয়ে চাকর-বাকর গিসগিস করছে—ঐ নাটবাড়ির সমস্ত জলাটা ওদের জমিতে পড়েছে, আজ এখনো কত জমি যে বেখবর পড়ে আছে তার ঠিক নেই। কর্তা যতদিন ছিলেন যেমন বোলবোলা তেমনি লক্ষিরছিরি। আহা, ওই গয়লা-বৌ তখন দুবেলা সেজেগুজে পাঁচজন গয়লানী সঙ্গে গাই দোহাতে আসত, নূপুরের শব্দ শুনলে গাই-গরু সব চারদিক থেকে হামা দিয়ে ছুটে আসত গো। এমন লক্ষী বৌ কচি-কাচা নিয়ে বিধবা হল গো! তখন এক-একদিন সে আমার গলা ধরে কানতো আর বলত—‘বুদি, আর পারিনে যন্ত্রণা সইতে।’ আমি বলি, ‘মা এই শরীর তোমার, একা সবদিক দেখা কি তোমার কর্ম, দু-চারটে দাস-দাসী নায়েব-গোমস্তা বেশি রাখলে হয় না?’ কিন্তু সে বড় কর্মিষ্টি, নিজের হাতে ছেলে-মানুষ ধান-বোনা রান্না-করা গাই-দোয়া সব করবে! আমি বলি—‘মা, শরীর যে ক্ষেয় হল!’ কিন্তু বৌ কেবলি বলে—‘ভালো দিন আসছে বুদি আসছে!’ আর ভালো দিন! ছেলেগুলো বড় হয়ে চাকরির চেষ্টায় বিভুঁয়ে বিদেশে টো-টো করে ঘুরতে লাগল, কেউ বিদেশ গিয়ে সংসার পাতলে, ছেলেপুলে হল কিন্তু বুড়িকে আর কেউ দেখলে না। জমিজমা গহনা-গাঁটি বেচে ছেলে-মেয়ে নাতি-পুতি এমনি তিনপুরুষ ধরে সবাইকে বিয়ে দিয়ে চাকরি নিয়ে বিদেশে পাঠাতে-পাঠাতে বুড়ি ক্রমে সর্বস্বান্ত হয়ে না খেয়ে মরবার দাখিল হল! ছেলে-মেয়ে কত যে জন্মাল, মানুষ হল, বড় হয়ে বুড়িকে একলা রেখে চলে গেল, এই গয়লাবাড়িতে ক’পুরুষ ধরে কত কারখানাই দেখলুম যে, তা কি বলি! “এদানি বুড়ি আর দুঃখু করত না, ছেলেদের কথা হলে বলত—‘বুদি এখানে এলে তাদের তো কষ্ট বই আরাম হবে না, তবে কেন আর তাদের ডেকে পাঠাই; এই তো ভাঙাবাড়ি, এখানে জায়গা কোথায় তাদের বসবার শোবার খাবার! ওই বাপ-মা-হারা আমার শিবরাত্রির সলতে ওই ছোট নাতিটি বেঁচে থাক, মরবার সময় তবু মুখে একটু জল দেবার একজন তো রইল—কি বলিস!” কিন্তু এ নাতিও বড় হয়ে যেদিন কুলির সর্দারি করতে বিদেশে গেল সেদিন থেকে বুড়ির আর চোখের জল থামল না। সে দিন-দিন কুঁজো হয়ে পড়ল, হাল-গরু জোত-জমা সমস্ত পাঁচ ভূতে লুঠে পালাল, বুড়ি দেখেও দেখলে না—শেষে এখানে আর কেউ রইল না—এই বুদি আর ওই বুড়ি ছাড়া। বুড়ি খেতে পায় না দেখে আমি একদিন বললুম–‘মাগো, কসায়ের কাছে আমাকে বেচলে তো পয়সা পাও, তা কর না কেন!’ বুড়ি আমার গলা ধরে বললে—‘বুদি সব ছেলে-মেয়ে তোর দুধ খেয়ে মানুষ হল তোকে আমি কি ছাড়তে পারি!’ আহা সেই আমার সেঙাতনী মনিবনী, গিন্নি মা-জননী আজ নিজেই চলে গেল গোঃ, ওমা”—বলে সে অঝোরে কাঁদতে লাগল। রিদয় অনেকক্ষণ চুপ করে থেকেই বললে—“আহা বুদি, আমতলিতে মাকে আমি এমনি করে ফেলে এসেছি যে!” বুদি বলে উঠল—“যাও কালই ফিরে যাও, না হলে হয়তো এই বুড়ির মতো ছেলে-ছেলে করে শেষে সেও মরবে। তোমার তো এখনো গিয়ে মাকে দেখবার সময় আছে কিন্তু এই বুড়ির ছেলেরা কি পোড়াকপাল নিয়েই জন্মেছিল, কখনো দেশেও এল না, মা মরে গেল তাকেও দেখতে পেলে না!” সকাল বেলায় মিউনিসিপালের মুর্দোফরাসগুলো এসে বুড়িকে পোড়াতে নিয়ে গেল, খটাস চলে গেল দিগ্বিজয়ে, নেউল চলে গেল মৃগয়াতে, রিদয় বুড়ির ঘর থেকে তার ছেলেদের নামের চিঠিখানি ডাকে ফেলে দিয়ে বুদিকে মাঠে রেখে খোঁড়ার কাছে ফিরে চলল। পাতি-জলার কাছ বরাবর এসে রিদয় দেখলে খোঁড়া হাঁস সকালে উঠে জলের মাঝে একটা মাটির ঢিপিতে দাঁড়িয়ে ডানা ঝাড়ছে, বালি হাঁস তখনো ঝোপের মধ্যে ঘুমিয়ে আছে। রিদয় সারারাত কিছু খায়নি, হাঁসের কাছে না গিয়ে সে বরাবর বুদিগাইটার পিছনে-পিছনে জঙ্গলে গিয়ে ঢুকল। দু-একটা পাত-বাদামের চেষ্টায় রিদয় একটা শিরিষ গাছের উঁচুডালে কাঠবেরালিদের ঘরে ভিক্ষে করতে চলেছে। মস্ত শিরিষ গাছ, তার সব উপরের ডালে কাঠবেরালিদের খোপ বসতি, ঝোপ বসতি। এমনি এপাড়া-ওপাড়ায় রিদয় “জয় রাম” বলে গান গেয়ে দাঁড়াচ্ছে আর কেউ এসে তাকে দুটো শুকনো ছোলা, কেউ একটা বাদাম, এমনি টুকি-টাকি ভিক্ষে দিচ্ছে। রামের দোহাই দিলে কাঠবেরালিদের ভিক্ষে দিতেই হয়, কিন্তু এক-এক কাঠবেরালি গিন্নি ভারি কিপটে, রিদয়কে দূর থেকে দেখেই বলছে—“ওগো ঘরে কিছু নেই, কর্তা হাটে গেছেন, ওবেলা এস—এখন কিছু হবে না।” রিদয় পাকা ভিখিরী, সহজে ছাড়বে কেন, গান শুরু করলে: বাসনা করায় মন পাই কুবেরের ধন সদা করি বিতরণ তুমি যত আশ না আস নাই আরো চাই ইন্দ্রের ঐশ্বর্য পাই ক্ষুধা মাত্র সুধা খাই মরি-মরি ফাঁস না ফাঁসনা কেবল রৈল বাসনা পূরণ নৈল লাভে হতে লাভ হৈল লোকে মিথ্যা ভাসনা! কাঠবেরালি গিন্নি এতেও সাড়া দেয় না, রিদয় এবারে হিন্দি গান ধরলে: ধুম বড়া ধুম কিয়া খানে জোনে নাহি দিয়া চহুঁয়ার ঘেরলিয়া ফোজ কি গিতাপয়া! আরে চহুঁয়ার, আরে চহুঁয়ার। এক থোকা শিরীষ-ফুলের তলায় দাঁড়িয়ে বুড়ো-আংলা পেট বাজিয়ে গাইছে, এমন সময় মনে হল তার কোমরের কাপড় ধরে কে টান দিচ্ছে, রিদয় ফিরে দেখতেই একটা কাক ‘খাও’ বলে তার ঠোঁট আর ডান হাতটা চেপে ধরলে, অমনি আর একটা কাক, তারপর আর একটা আর একটা এসে রিদয়কে ছোঁ দিয়ে উড়িয়ে নিয়ে চলল। ডোম-কাকের দল রিদয়কে চোখে-মুখে কিছু দেখতে দিচ্ছে না—“যক-যকা” বলে এর মুখ থেকে ও, তার মুখ থেকে সে, এমনি রিদয়কে ফুটবলের মতো ছুঁড়ে দিতে-দিতে দল বেঁধে গোলমাল করতে-করতে চলছে দেখে বুদি গাই “ওমা-ওমা” করে চেঁচাতে-চেঁচাতে লেজ তুলে ছুটোছুটি করতে লাগল। ইচ্ছেটা কাকগুলোকে শিং দিয়ে গোঁতায়, কিন্তু তারা আকাশে সে বেচারা মাটিতে—বুদি কেবল ধুলো উড়িয়ে মাঠে ছুটোছুটি করতে লাগল! খোঁড়া হাঁসও আকাশে কাক দেখে—“ক্যা-ক্যা” বলে একবার ডাক দিলে, কিন্তু দেখতে-দেখতে কাকের দল অদৃশ্য হয়ে গেল। রিদয় চটকা ভেঙে যখন চেয়ে দেখলে, তখন কাকেরা পাতি-জলা পেরিয়ে নাটবাড়ি ছাড়িয়ে কাকচিরের দিকে চলেছে। হাঁসের পিঠে আরামে উড়ে চলা এক, আর কাকের ঠোঁটে ঝুলতে-ঝুলতে চলা অন্য একরকম। রিদয় দেখলে জলা-জমি যেন একখানা ফাটা-ফুটো গালচের উল্টো পিঠের মতে পায়ের তলায় বিছানো রয়েছে, সবুজ লাল কালা কত রকমের যেন সুয়োঁ-ওঠা পশমে বোনা, বাঙলাদেশের পরিষ্কার ছক-কাটা জমির মতো মোটেই নয়, জলগুলো দেখাচ্ছে যেন মাঝে-মাঝে ছোট বড় আয়না ভাঙা। দেখতে-দেখতে সূর্যি উঠল, আলো পেয়ে মাটি যেন সোনা রুপো আর নানা রঙের উলে-বোনা কাশ্মীরী শালের মতো দেখাতে লাগল। তারপরে জলা পার হয়ে বন-জঙ্গল মাঠ-ঘাটের উপর দিয়ে কাকেরা রিদয়কে নিয়ে উড়ে চলল! কাকেরা তাকে ধরে নিয়ে কোথায় চলেছে, কোথা রইল খোঁড়া হাঁস, কোথায় বা চকার দল, কোথা বুদি, কোথা বালি! রিদয় ভয় পেয়ে চারদিক চাইছে এমন সময় ডোমকাকে ডাক দিলে—“খবরদার” অমনি সব কাক রিদয়কে নিয়ে জঙ্গলের তলায় নেমে পড়ল। চোরকাঁটার বনে রিদয়কে ঠেলে ফেলে গোটা পঞ্চাশেক কাক সঙিনের মতো ঠোঁট উঠিয়ে তার চারদিকে পাহারা দিতে দাঁড়িয়ে গেল। রিদয় গা ঝাড়া দিয়ে উঠে বললে—“তোরা যে আমাকে বড় ধরে আনলি!” ডোমরাজা দৌড়ে এসে বললে—“চুপ, কথা কবি তো চোখ ঠুকরে নেব!” . রিদয় বুঝলে এবার সহজে ছাড়ান নেই, এরা সব ডাকাতে-পাখি! গোলযোগ করলে হয়তো মাথাটাই ফাটিয়ে দেবে। সে কি করে, শুকনো মুখে কাকগুলোর দিকে চেয়ে রইল। কাকগুলোও তাকে ঘিরে ধারাল ঠোঁট বাড়িয়ে একচোখে তাগ করে দাঁড়িয়ে থাকল। দূর থেকে দেখে রিদয় ভাবত কাকগুলো বেশ কালো চিকচিকে, যেন কালো আলপাকার চায়না-কোট পরা নতুন উকিল কৌঁছিলের মতো, চালাক চতুর চটপটে। কিন্তু কাছ থেকে কাকগুলোকে রিদয় দেখলে কদাকার কালো কুচ্ছিত যতদূর হতে হয়, পালকগুলো রুখো মড়মড়ে যেন কালিতে ছুপোনো তালপাতা, পাগুলো গেঁটে-গেঁটে কাদামাখা খরখরে, ঠোঁটের কোণে এঁটো ঝোলঝাল মাখানো; একটা চোখ যেন ছানি পড়া আর একটা যেন ময়লা পয়সার মতো তামাটে কালো! কোথায় শাদা ধপধপে সুবচনীর হাঁস আর কোথায় এই কালো কুচ্ছিত কাগের ছা সব! রিদয় এই কথা ভাবছে এমন সময় মাথার উপরে অনেক দূর থেকে হাঁসের ডাক এল—“কোথায়—কোথায়?” রিদয় গলা শুনে বুঝলে খোঁড়া তার সন্ধানে চলেছে, সেই সঙ্গে-সঙ্গে বালি হাঁসও ডাক দিয়ে গেল “সেঙাত-সেঙাত!” বনের ওধারটায় বুদিও একবার হাক দিলে—“ওগোঃ ওগোঃ!” রিদয় বুঝলে তিনজনেই এসেছে, সে অমনি হাত নেড়ে হেথায় বলে চেঁচাতে যাবে আর ডোমরাজা ছুটে এসে ধমকে বললে—“কিও! আয় দিই চোখ দুটাে খুবলে!” রিদয় অমনি মুখ বুজে গোঁ হয়ে বসল। হাঁসেরা চলে গেল বুদি গাইও ডেকে-ডেকে থামল, তখন ডোমকাক হুকুম দিলে—“উঠাও!” দুটো কাক তাকে আবার ঠোঁটে ঝুলিয়ে নিয়ে ওড়বার চেষ্টায় আছে দেখে রিদয় বললে—“বাপু তোমাদের মধ্যে কেউ পালোয়ান কাক থাকে তো আমাকে পিঠে করে নিয়ে চল, অমন ঝোলাখুলি করলে আমার হাত পায়ের জোড় সব খুলে যাবে যে!” ডোমকাক ধমকে বললে—“চল-চল, অত বাবুগিরিতে কাজ নেই। কাগে চড়বেন এত সুখ তোর কপালে—আমরা কি ঘোড়া যে তোকে পিঠে নেব।” এবারে ঝোড়োকাগ এগিয়ে এসে বললে—“মহারাজ, মানুষটাকে হাড়গোড় ভেঙ্গে দ করে নিয়ে গেলে তো ওটা আমাদের কোনো কাজে আসবে না, আমি বরং ওকে পিঠে নিই, কি বলেন?” ডোমকাক মুখ সিঁটকে বললে—“তোমার ইচ্ছে হয় তো ওর পালকি-বেহারার কাজ করতে পার, কিন্তু দেখ পালায় না যেন!” রিদয় দেখলে ঢোঁড়াকাগটা ওর মধ্যে দেখতে-শুনতে ভদ্দর রকম, সে আস্তে-আস্তে তার পিঠে চড়ে বসল। কাকের দল ক্রমাগত দক্ষিণ মুখেই উড়ে চলেছে। পরিষ্কার দিনটি খটখট করছে, চারদিকে যেন বাতাস আর আলো ছড়িয়ে পড়েছে, বনের শিয়র দিয়ে রিদয়কে নিয়ে কাকরা উড়ে চলল। রিদয় দেখলে বৌ-কথা-কও পাখি বকুল গাছের আগডালে বসে বৌকে শুনিয়ে কেবলি গাইছে—“কথা কও বৌ কথা কও, মাথা খাও বৌ কথা কও!” রিদয় অমনি বলে উঠল—“কথা কইবে কি ছলে, কথা শুনলে গা জ্বলে!” “কে রে?” বলে হলদী পাখি আকাশের দিকে ঘাড় তুলতেই, রিদয় তাকে শুনিয়ে বললে—“কাকে-ধরা যক্‌! কাকে-ধরা যক্!” ডোমকাক অমনি ধমকে উঠল—“আবার কথা!” আরো দক্ষিণ-মুখো গিয়ে রিদয় দেখলে আমবাগানের মাথায় ঘুঘু বসে তার বৌকে গান গেয়ে ঘুম ভাঙাচ্ছে আর গলা ফুলিয়ে আদর করে ডাকছে—“বুবু ওঠো দেখি মম্।” রিদয় অমনি বলে উঠল—“আদর দেখ উহুঃ।” ঘুঘু গলা তুলে বললে—“কে রে কে রে?” রিদয় তাকেও শুনিয়ে দিলে—“কাকে ধরা যক্‌!” এবার ডোমকাক রেগে রিদয়কে ডানার থাপ্পড় দিয়ে বললে—“ফের বকচিস, চুপ!” ঢোঁড়াকাক বলে উঠল—“বকুক না যত পারে, পাখিগুলো ভাবচে আমরাও ঠাট্টা-তামাশা শিখেছি।” ডোমকাক আর উচ্চবাচ্য করলে না। রিদয় ঘাঁটিতে-ঘাঁটিতে সব পাখিকে জানিয়ে দিতে-দিতে চলল—তাকে কাকে ধরেছে! এমনি বন ছাড়িয়ে তারা একটা নগরের উপরে এসে পড়ল। নদীর ধারে মস্ত শিব-মন্দির, তারি চূড়োয় ত্ৰিশূলের ডগায় বসে শালিক তার বৌকে শুনিয়ে রাগরাগিনীতে গলা সাধছে; বৌ তার পঞ্চবটির বাসায় ডিমে তা দিচ্ছে আর কর্তার গান শুনছে—“সা রে গা মা পা—চারটে ডিমে তা, ধা নি সা—দুই জোড়া ছা!” রিদয় অমনি আকাশ থেকে বলে উঠল—“কাগে খাবে গা!” শালিক “কেও?” বলে মুখ ফেরাতেই রিদয় শুনিয়ে দিলে—“কাগে ধরা যক্‌।” যতই দক্ষিণ দিকে এরা এগোতে থাকল ততই বড়-বড় নদী খাল-বিল ক্ষেত মাঠ-ঘাট গ্রাম-নগর দেখা দিতে থাকল। একটা মস্ত বিলের ধারে একটা হাঁস আর একটা হাঁসের সামনে দাঁড়িয়ে কেবলি ঘাড় নাড়ছে আর বলছে, “চেয়ে দেখ্‌ আমি তোরি চিরদিন আমি তোরি।” রিদয়ের মনে হল যেন খোঁড়া আর বালি দুজনে কথা কইছে; সে অমনি তাদের শুনিয়ে বলে উঠল—“এসা দিন রহে থোড়ি রহে থোড়ি!” “কেও—কেও?” বলে হাস মুখ ফেরাতেই রিদয় শুনিয়ে দিলে—“কাগে ধরা যক্‌!” এমনি যাকে দেখে, তাকেই নিজের খবর শুনিয়ে দিতে-দিতে রিদয় চলেছে! বেলা দুপুর, কাকের ঝাঁক এক মঠের জমিতে নেবে সড়া পেসাদ খেতে আরম্ভ করলে। রিদয় খেলে কিনা সে দিকে কারু লক্ষ্য নেই। ডোমকাক রিদয়কে আগলে বসে আছে, এমন সময় ঢোঁড়াকাক একটা ডালিম এনে ডোমকাককে বললে—“মহারাজ দুটাে ফল খেতে আজ্ঞে হোক্‌!” ডালিম ভাঙা কাকের কর্ম নয়, তা ঢোঁড়াকাক জানত—ডোম-রাজা নাক তুলে বললে—“ওই শুকনো ফল আমি খাব, থুঃ!” ঢোঁড়া অমনি সেটা রিদয়ের পায়ের কাছে ফেলে তাড়াতাড়ি রাজার জন্যে যেন ভালো ফল আনতেই যাচ্ছে এইভাবে ছুটে পালাল। রিদয় বুঝলে ঢোঁড়া তার জন্যেই ডালিমটা এনেছে; সে অমনি সেটা দাঁতে চিবিয়ে ছালসুদ্ধ খেয়ে ফেললে। ভাত খেয়ে ডোমরাজ মঠের চুড়োর উপরেতে গেলেন, অন্য সব কাক খেয়ে-দেয়ে পেট ভরিয়ে রিদয়কে ঘিরে গান গল্প শুরু করলে। পাতিকাক দাঁড়কাককে শুধোলেন—“দাদা চুপচাপ ভাবছ কি শুনি!” দাঁড়কাক গলা খাঁকনি দিয়ে বললে—“ভাবছিলেম এই তল্লাটে এক মিয়া সাহেব একটি মুরগি পুষেছিল, মুরগি ঐ মোছলমানের বিবিকে এতো ভালোবাসতো যে তাকে খাওয়াবার জন্যে লুকিয়ে বিবির পানের ডাবরে গিয়ে চারটে করে ডিম পেড়ে আসত। মিয়া ডিম খুঁজে-খুঁজে হয়রান, তখন কিন্তু আমাদের মধ্যে কে একটা চালাক কাক সেই লুকানো ডিম খুঁজে বার করেছিল, না? তার নামটা কি মনে পড়ছে না। সে কি তুমি না আমি, না ওই ডোম না এই ঝোঁড়োকাক?” পাতিকাক বলে উঠল—“ওঃ! বুঝেছি, আচ্ছা শোনো দেখি বলি, বোষ্টম-বাড়ির সেই কালো বেরালটাকে মনে আছে তো? সেই যেটা বোষ্টম বোয়ের হেঁসেলের মাছ রোজ নিয়ে পালাত, কোথায় সে লুকিয়ে মাছটা রাখত তা বোষ্টম না বোষ্টমী না কালো কেউ টের পেত না, সেই মাছের সন্ধান কে-কে পেয়েছিল দাদা, তুমি না আমি, রাজা না মন্ত্রী?” সব কাক অমনি এগিয়ে এসে নিজের-নিজের বড়াই করতে আরম্ভ করলে। কেউ বললে—“মাছ চুরি আবার একটা কাজের মধ্যে, আমি একবার একটা খরগোসের লেজ ঠুকরে দিয়েছিলেম; আর একটু হলেই সেটাকে নিয়ে চিলের মতো ছোঁ দিয়ে উড়েছি আর কি, এমন সময় সেটা তার গর্তে সেঁধিয়ে গেল!” আর এক কাগ বলে উঠল—“আরে বাবা খরগোসছানা বেরালছানা এদের নিয়ে খেলা করছ—মানুষের কাছে কখন এগিয়েছ? আমি একবার ফিরিঙ্গির বাড়িতে গিয়ে তাদের টেবিলের রূপোর কাঁটা চামচে চুরি করে সাফ বেরিয়ে এসেছি, একটি পালকে পর্যন্ত আঁচড় লাগেনি!” রিদয় থেকে-থেকে বলে উঠল—“এই বিদ্যের আবার এত বড়াই, এই বেলা ওসব চুরিচামারি ছাড়, না হলে মানুষ বিরক্ত হয়ে একদিন এমন গুলি চালাতে আরম্ভ করবে যে কাকবংশ ধ্বংস করে তবে ছাড়বে!” “কি বলিস?” বলে সব কাক রিদয়কে তেড়ে এল, মনে হল এখনি তাকে ছিঁড়ে খাবে। ঢোঁড়াকাক তাড়াতাড়ি সবাইকে ঠাণ্ডা করে বললে—“ছেলেমানুষ কি বলতে কি বলেছে। থাম হে ওকে মেরো না, রাজা তাহলে ভারি দুঃখিত হবেন! মনে নেই সেই যকের ধনটা বার করা চাই। ছোঁড়াটা না হলে সে কাজটা করে কে? তাছাড়া এটা মানুষ, একে মারলে পুলিশ হাঙ্গামা হতে পারে।” কাকেরা রিদয়কে আর কিছু না বলে ঢোঁড়াকেই ধমকাতে লাগল—“হাঃ মানুষ, ভারি তো উনি বড়লোক যে ভয় করতে হবে, ঢের-ঢের অমন মানুষ দেখেছি—” এই সময় ডোমকাক উপর থেকে হাঁক দিলে—“চালাও!” এবারে কাকের দল রিদয়কে নিয়ে কাকচিরার পতিত জমির দিকে চলেছে—গ্রাম নগর আর দেখা যাচ্ছে না, কেবল ধূ-ধূ বালি আর কাঁটাগাছ। মানুষ নেই, গরু নেই, পাখি নেই—কেবল আগুনের মতে রাঙা সূর্যটা পশ্চিম দিকে ডুবছে—সমস্ত আকাশে যেন আগুন ধরিয়ে দিয়ে। ভর সন্ধ্যাবেলা ডোমকাক রিদয়কে ধরে নিয়ে কাকচিরার জঙ্গলে এসে নামল। ডোমকাক দূত হয়ে আগে গিয়ে সবার বাসায় খবর দিলে রাজা এলেন, অমনি সব কাকিনী “বা-বা-বা তোবা-তোবা” বলে বাসা ছেড়ে তামাশা দেখতে ছুটল। শেয়ালের দল আহ্লাদে লেজ ফুলিয়ে হাঁক দিলে—“হুয়া—কয়েদ হুয়া, তোফা হুয়া!” চারদিকে হৈ-চৈ—ক্কা-ক্কা-হুয়া শব্দ উঠেছে, তারি মধ্যে ঢোঁড়া রিদয়ের কানে-কানে বললে—“আমি তোমার দিকে আছি, দেখ খবরদার ওদের কথা শুনে কোনো কাজ কর না। কাজ করিয়ে নিয়েই তোমায় মেরে ফেলবে, সাবধান।” ডোমকাক এসে রিদয়কে টানতে-টানতে সেওড়াগাছের গোড়ায় গর্তটার মধ্যে নামিয়ে দিলে, রিদয় যেন জেরবার হয়ে পড়েছে এমনিভাবে আধমরার মতো গর্তের মধ্যে শুয়ে পড়ল। ডোম রাজা ডাকলে—“ওঠ, যা বলি তা কর।” রিদয় যেন শুনতেই পেলে না, চোখ বুজে রইল। ডোম তাকে ধরে যকের পেঁটরার কাছে টেনে হিঁচড়ে নিয়ে গিয়ে বললে—“খোল্‌ এটা।” রিদয় ধাক্কা দিয়ে ডোমকে সরিয়ে বললে—“খিদেয় পেট জ্বলছে এখন আমি কাজ করব? আজ রাত্তিরটা না ঘুমিয়ে নিলে আমি কিছু কাজ পারব না, গা-হাত-পা টাটিয়ে গেছে।” “খোলো আভি!” বলে ডোম রিদয়কে ঝাপটা মেরে পেঁটরার গায়ে ঠেলে দিলে; রিদয় গোঁ হয়ে পেঁটরা ধরে নেড়ে বললে—“বাবা, যে মরচে-ধরা তালা, এ তো খোলা সহজ নয়, আজ খেয়ে-দেয়ে গায়ে জোর হোক, কাল তখন দেখা যাবে!” ডোম রেগে রিদয়ের গায়ে এক ঠোকর বসিয়ে বললে—“খোল্‌ বলছি!” রিদয় এবারে আর রাগ সামলাতে পারলে না, ডোমকে এক থাপ্পড় কসিয়ে কোমর থেকে ছুরি বার করে বললে—“ফের বজ্জাতি, পাজি কোথাকার!” ডোমকাক রাগে আর চোখে দেখতে পাচ্ছে না—“তবে রে” বলে সে রিদয়ের উপরে যেমন ঝাঁপিয়ে পড়ল, অমনি রিদয় ছুরিটা তার চোখে বসিয়ে দিলে। ডোমকাক দু’বার ডানা ঝটপট করেই অক্কা পেলে। “হত্যা হুয়া, হত্যা হুয়া,” বলে শেয়াল চেঁচাতে লাগল, “ক্যা-ক্যা” বলে কাকরা গোলমাল করে তেড়ে এল। ঢোঁড়া বোকা সেজে কেবলি রিদয়কে আড়াল করে-করে ডানা ঝাপটাতে লাগল, যেন কতই রেগেছে এইভাবে। রিদয় বিপদ গুণে পেঁটরাটা জোরে টেনে খুলে তার মধ্যে লুকোবার চেষ্টা করতে লাগল। পেঁটরাটা কিন্তু টাকায় পয়সায় ঠাসা, তার মধ্যে জায়গা নেই দেখে দু-চার মুঠো পয়সা বাইরে ছড়িয়ে ফেললে! এতক্ষণ কাকরা হট্টগোল করছিল যেন কাঙালী বিদেয়ের ভিড় লাগিয়েছে। পয়সা পড়তে সবাই ছোঁ দিয়ে এক-একটা তুলে বাসার দিকে দৌড়—চকচকে পয়সা পেয়ে তারা রাজা, রাজহত্যা সব কথাই ভুলে গেল। সব কাক যে-যার ঘরে গেছে, তখন ঢোঁড়াকাক এসে রিদয়কে বললে—“তুমি জানো না আমার কি উপকার করেছ। এস আমার পিঠে চড়ো আমি তোমাকে এমন জায়গায় রেখে আসব যেখানে শেয়ালের বাবাও আর ধরতে পারবে না।” এত হুটোপাটির পর রিদয়ের ঘুম পাচ্ছিল, সে কাকের পিঠে চড়ে ঢুলে-ঢুলে পড়তে লাগল! ঘুমের ঘোরে তার যেন মনে হল অন্ধকারে কাকের চেহারাটা গণেশের ইঁদুরের মতো হয়ে যাচ্ছে—কাক বগ হাঁস শেয়াল সব এক সঙ্গে তার মাথার ভিতরে ঘুরছে। এমন সময় আকাশ থেকে যেন বোধ হল চকার দল হাঁকলে—“কোথায়?” “হেথায়” বলে যেমন রিদয় চেয়েচে অমনি দেখলে কোঁ করে দরজা খুলে গণেশের মতো মোটা পেট নিয়ে তার বাপ ঘরে ঢুকে বললেন—“কিছু ভাঙিসনি তো?” রিদয় ভয়ে-ভয়ে একবার কুলুঙ্গিটার দিকে চেয়ে দেখলে যেখানকার গণেশ সেইখানেই রয়েছে—দুবার মাথা চুলকে রিদয় এক দৌড়ে বাড়ির উঠোনে এসে দেখলে খোড়াহাঁস পুকুর পাড়ে একটা বুনো হাঁসের সঙ্গে ভাব করছে—আর একটা ঝোড়োকাক চালে বসে “কা-কা” করে ডাকছে—গোয়ালঘর থেকে কপলে গাই ডাকদিলে “ওমঃ”, ঠিক সেই সময় একটা গুগলী পুকুর ঘাট বেয়ে আস্তে-আস্তে জলে নেমে গেল। রিদয় পুকুর পাড়ে হাঁ করে কি ভাবছে দেখে রিদয়ের মা কাছে এসে বললে—“কি হল তোর?” রিদয় মাথা চুলকে বললে—“মা, আমি কি সত্যিই বড় হয়ে গেছি?” বলে আপনার মাথায় হাত বুলোতে লাগল! সেই সময় ডালিমগাছে টুনটুনি পাখি বলে উঠল—“ওকি রিদয় হল কি!” “মাখা আর মুণ্ডু হল!” বলে রিদয় পুকুরের জলে ঝাঁপিয়ে সাঁতার আরম্ভ করলে। রিদয়ের মা চেঁচিয়ে বললে—“এত বড়টি হলি তবু তোর ছেলেমানষি গেল না। উঠে আয়, পাঠশালায় যাঃ।”
অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর
চকা-নিকোবর অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর সুবচনীর খোঁড়া হাঁস এই সব বুনো-হাঁসদের দলে ভিড়ে উড়তে, আর এ-গ্রামের সে-গ্রামের সব সরাল, ঘেংরালদের দেখে হাসি-মস্করা করতে পেয়ে, ভারি খুশি হয়েছে। সে ভুলে গেছে যে নিজেই সে এত-কাল পালা-হাঁসই ছিল—ঐ সরাল-ঘেংরালের মতো ঘর আর পুকুর করে কাটিয়েছে। তার উপর সে আজন্ম-খোঁড়া, সবে আজ নূতন উড়ছে। বুনো হাঁসের সঙ্গে সমানে পাল্লা দিয়ে চলা তার কর্ম নয়! খোঁড়ার ডানার তেজ ক্রমেই কমছে আর দমও ক্রমে ফুরিয়ে আসছে, সে হাঁপাতে-হাঁপাতে তাড়াতাড়ি ডানা ঝাপটেও আর পেরে উঠছে না মধ্যে থেকে এক-এক-করে প্রায় আটহাঁস পিছিয়ে পড়েছে। সেথো হাঁসরা যখন দেখলে খোঁড়া পিছিয়ে পড়ে, আর পারে না, তখন পাণ্ডা-হাঁসকে ডাক দিয়ে জানালে—“চকা-নিকোবর, চকা-নিকোবর!” চকা উড়তে-উড়তেই শুধোলে—“ক্যেঁন্-ক্যেঁন্ কও ক্যেঁন্ ?” সেথোরা বললে—“পিছিয়ে পোলো খোঁড়া-ঠ্যাং!” আগের মতো সোঁ-সোঁ করে চলতে-চলতেই চকা বলে উঠল— জোরে চলায় নাই কোনো দায়, আস্তে গেলেই হাঁপ লেগে যায়! অমনি সব হাঁস একসঙ্গে বলে উঠল—“চলে চল, চলে চল, ভাই, চলে চল।” চকার কথা-মাফিক খোঁড়া হাঁস জোরে চলতে চেষ্টা করতে দুগুণ হাঁপিয়ে পড়ল; আর সে আস্তে-আস্তে ক্রমে মাঠের ধারে-ধারে নারকোল গাছের প্রায় মাথা পর্যন্ত নেমে পড়বার মতো হল। তখন সেথো হাঁসরা আবার ডাক দিলে—“চকা-নিকোবর—চকা-চকা-চকা!” এবার চকা গরম হয়ে বললে—“ক্যেঁন্ কর ভ্যেঁন ভ্যেঁন?” সেথোরা বলে উঠল—“খোঁড়া হাঁস তলিয়ে যায়!” চকা একবার চেয়েও দেখলে না, যেমন বেগে চলেছিল তেমনি পুরো দমে যেতে-যেতে বললে—“বল ওকে হাল্কা হাওয়ায় উঠে আসতে।” নিচের বাতাস ঠেলা মুশকিল, ডানা নেড়ে-নেড়ে লাগে ঘাড়ে খিল। উপর বাতাস পাতলা ভারি, এক ঝাপটে বিশ হাত মারি। খোঁড়া হাঁস চকার কথায় উপরে ওঠবার চেষ্টা করতে লাগল; কিন্তু এবার বাতাস ঠেলে উঠতে বেচারার দম নিকলে যাবার যোগাড় হল । আবার সেথোরা ডাক দিলে—“চকা! চকা!” “কেনে ? চলতে দিবে না নাকি!”—বলে চকা গোঁ হয়ে উড়ে চলল। সেথোরা বললে—“খোঁড়া-বেচারার প্রাণসংশয়!” চকা রেগে উত্তর দিলে— উড়তে না পারে ঘরে যাক, খাক-দাক বসে থাক। কে বলেছে উড়তে ওরে, ভিড়তে দলে রঙ্গ করে? খোঁড়া হাঁসের জানতে বাকি রইল না যে বুনো হাঁসরা কেবল তামাশা দেখবার জন্যে তাকে এতটা সঙ্গে এনেছে—মানস-সরোবরে নিয়ে যেতে নয়। আঃ কি আপশোষ! ডানা যে তার আর চলছে না! না হলে খোঁড়া হাঁসও যে উড়তে পারে, সেটা একবার বুনো হাঁসদের সে দেখিয়ে দিত। তা ছাড়া এই চকা-নিকোবর—এমন হাঁস নেই যে একে জানে না; এই একশো বছরের বুড়ো হাঁস, যার সঙ্গে পয়লানম্বর হাঁসও উড়ে পেরে ওঠে না, পড়বি তো পড় তারি পাল্লায়! যে চকা পোষা হাঁসকে হাঁসের মধ্যেই ধরে না, লজ্জা পেতে হল কিনা তারি সামনে! এ দুঃখু সে রাখবে কোথায়! খোঁড়া সবার পিছনে ভাবতে-ভাবতে চলল—বাড়ি ফিরবে, কি, প্রাণ যায় তবু সমানে বুনো হাঁসের সঙ্গে চলে সে দেখিয়ে দেবে যে সেও জানে উড়তে! রিদয় এই সময় খোঁড়াকে বললে—“সুবচনীর কৃপায় এতদূর এসেছ, আর কেন ? এইবার ফের। এদের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে চলতে গিয়ে শেষে দম-ফেটে মরবে নাকি! আমি তো ওদের মতলব ভালো বুঝছিনে!” রিদয় কিছু না বললে, হয়তো খোঁড়া আপনা-হতেই বাড়ি-মুখো হত; কিন্তু এই বুড়ো-আংলা, এও ভাবছে তাকে কমজোর! খোঁড়া বিষম রেগে ধমকে উঠল—“ফের কথা কইলে মাটিতে ঝেড়ে-ফেলে চলে যাব।” বলেই রেগে ডানা আপসে খোড়া এমনি তেজে উড়ে চলল যে বুনো হাঁসরাও একেবারে অবাক হয়ে গেল। রাগের মুখে গোঁ-ভরে যেমন তেজে খোঁড়া চলেছিল, রাগ পড়লে সে তেজ থাকত কিনা সন্দেহ। কিন্তু ঠিক সেই সময় সূর্য পাটে বসতে চললেন। দেখতে-দেখতে বেলা পড়ে এল। অমনি হাঁসরা সবাই জমি-মুখো হয়ে ঝুপ-ঝাপ আকাশ থেকে চাঁদপুরের সামনে মেঘনার মাঝে বাগদী চরে নেমে পড়ল। চরে উড়ে বসতেই রিদয় হাঁসের পিঠ থেকে লাফিয়ে পড়ল। তখন চরের উপর থেকে সবেমাত্র জল সরে গেছে, ভিজে কাদা তখনো কালো প্যাচ-প্যাচ করছে—মাঝে-মাঝে ডোবায় এখনো জল বেধে আছে। এবড়ো-খেবড়ো ভাঙা-চোরা পিছল চর; খানা, ডোবা, নালা, এখানে-ওখানে, এরি উপরে সন্ধ্যের হিম হাওয়া বইছে। রিদয়ের গা কাঁটা দিয়ে উঠল শীতে। নদীর কিনারায় যেদিকে হাঁসরা নেমেছে, সেদিকে খানিক জঙ্গল অন্ধকারে কালো দেখাচ্ছে। জঙ্গল ছাড়িয়ে খোলা মাঠ, সেদিকে মানুষ কি গরু কিছুই নেই। চারদিক সুনসান! মেঘনার মাঝে লাল ফানুসের মতো রাঙা সুয্যি পশ্চিম-আকাশে রামধনুকের রঙ টেনে দিয়ে আস্তে-আস্তে জলে ডুবছে। রিদয়ের মনে হল সে যেন কোথায় কতদূরে মানুষের বসতি ছেড়ে পৃথিবীর শেষে এসে পড়ছে! বেচারা সমস্ত-দিন খেতে পায়নি। তার কেবলি কান্না আসতে লাগল। এই একলা চরে কেউ কোথাও নেই—কোথায় খায়, কোথায় যায়? আর যদি বাঘ আসে, কে তাকে বাঁচায়? আর যদি বিষ্টি আসে, কোথায় সে মাথা গুঁজবে? কোথা রইলেন বাপ-মা, কোথা রইল ঘর-বাড়ি! সূর্য লুকিয়ে গেছেন; জল থেকে উঠছে কুয়াশা; আকাশ থেকে নামছে অন্ধকার; চারদিকে ঘনিয়ে আসছে ভয়! ওধারে বনের তলাটা যেন নিঝুম হয়ে আসছে! ঝিমঝিম সেখানে ঝিঁঝিঁ ডাকছে, আর লতায়-পাতায় খুসখাস শব্দ উঠছে। রিদয়ের মনে আকাশে উঠে যে ফুর্তিটা হয়েছিল, এখানে নেমে সেটুকু একবারে নিভে গেল। এখন এই হাঁসগুলো ছাড়া সঙ্গী আর কেউ নেই। রিদয় দেখলে সুবচনীর হাঁস একেবারে কাবু হয়ে পড়েছে। বেচারা মাটিতে পা দিয়েই শুয়ে পড়েছে! কাদার উপর গলা বাড়িয়ে দুই-চোখ বুজে সে কেবলি জোরে-জোরে শ্বাস টানছে—যেন আধ-মরা! রিদয় তার সঙ্গের সাথী খোঁড়া হাঁসকে বললে—“একটু জল খেয়ে নাও —এই তো দু’পা গেলেই নদী!” কিন্তু খোঁড়া সাড়া-শব্দ দিলে না। রিদয় আর এখন দুষ্টু নেই। এই খোঁড়া হাঁস এখন আর শুধু হাঁস নয়—তার বন্ধু, সাথী সবই। সে আস্তে-আস্তে তার গলাটি ধরে উঠিয়ে জলের ধারে নিয়ে চলল। রিদয় ছোট, হাঁস বড়; কিন্তু প্রাণপণে সে হাঁসকে টেনে নিয়ে জলের কাছে নামিয়ে দিলে। হাঁস জলে কাদায় খানিক মুখ ডুবিয়ে চুক-চুক-করে জল খেয়ে নিয়ে গা-ঝাড়া দিয়ে জলে নেমে শর-বেণার ঝাড় ঠেলে সাঁতরে-সাঁতরে খাবারের সন্ধান করতে লাগল। বুনো হাঁসগুলো নেমেই জলে গিয়ে পড়েছিল; খোঁড়া হাঁসের কোনো খবরই নেয়নি; দিব্যি চান করে ডানা ঝেড়ে গুগলী-শামুক শাক-পাত খেয়ে বেড়াচ্ছে। রিদয়ের হাঁস জলে নেমেই সুবচনীর কৃপায় একটা পাঁকালমাছ পেয়ে গেল। সে সেইটে মুখে নিয়ে ডাঙায় এসে রিদয়ের কাছে ফেলে দিয়ে বললে—“এই নাও, মাছটা তোমায় দিলুম। আমার যে উপকার করেছ, তা চিরদিন মনে থাকবে। খেয়ে নাও মাছটা।” হাঁসের কাছে দুটো মিষ্টি কথা পেয়ে রিদয় একেবারে গলে গেল। তার মনে হল সেই খোঁড়া-হাঁসের গলা ধরে তার দু’ঠোঁটে দুটো চুমু খায়। রিদয় কাদা থেকে মাছটি তুলে একবার ভাবলে—রাঁধি কিসে? অমনি মনে পড়ল—সে যে এখন আর মানুষ নেই, যক্ হয়েছে; হয়তো কাঁচা মাছ খেতে পারবে। রিদয়ের ট্যাঁকে এটা-ওটা কাটতে একটা ছুরি থাকত; সে সেইটে টেনে বার করে মাছটা কুটতে বসল। ছুরিটা এখন একটা খড়কে-কাঠির মতো ছোটো হয়ে গেছে, কিন্তু তাতেই কাজ চলে গেল। মাছটা ছোট-ছোট করে বানিয়ে কতক-কতক হাঁসকে খাইয়ে দিয়ে, নিজে খেতে বসল। তার যকের মুখে কাঁচা মাছ নেহাত মন্দ লাগল না। রিদয়ের খাওয়া হলে খোঁড়া তাকে চুপি-চুপি বললে যে চক-নিকোবরের দল পোষা হাঁসকে হাঁসের মধ্যে গণ্য করে না। রিদয় চুপি-চুপি বললে—“তা তো দেখতে পাচ্ছি ।” খোঁড়া হাঁস গলা-ফুলিয়ে বললে—“মজা হয়, যদি একবার এদের সঙ্গে সমানে আমিও মানস-সরোবর পর্যন্ত উড়ে যেতে পারি। পোষা হাঁস কি করতে পারে তবে ওরা টের পায়।” “তা তো বটেই!” বলে রিদয় চুপ করলে। খোঁড়া বলে চলল—“আমার মনে হয় একলা আমি অতটা যেতে পারি কি না! কিন্তু তুমি যদি সঙ্গে চল, তবে আমি সাহস করি।” রিদয় ভেবেছিল এখান থেকেই সে বাড়ি ফিরবে। কিন্তু হাঁসের ইচ্ছে শুনে সে একটু তা-না-না করে বললে—“দ্যাখো, আমার সঙ্গে তোমার বনবে কি? আমি তোমাকে আগে কত জালাতন করেচি।” কিন্তু রিদয় দেখলে হাঁস আগের কথা ভুলে গেছে, রিদয় যে তার প্রাণ বাচিয়েছে—জল খাইয়ে যত্ন করে, সেই কথাই সে খোঁড়া হাঁস মনে রেখেছে। একবার বাপ-মায়ের কথা তুলে রিদয় হাঁসকে বাড়ি ফেরাবার চেষ্টা করলে, কিন্তু হাঁস বললে—“কোনো ভাবনা নেই, আসছে-শীতে তোমায় আমি ঠিক বাড়িতে পৌছে দেব। তোমাকে ঘরের দরজায় নামিয়ে দিয়ে তবে আমার ছুটি। তার মধ্যে তোমায় একলা ছেড়ে আমি কোথাও নড়ব না—প্রতিজ্ঞা করছি!” রিদয় ভাবছে—মন্দ না ! এই যক্ হয়ে মা-বাপের কাছে এখন না যাওয়াই ভালো! কি জানি, মানস-সরোবর থেকে হয়তো কৈলাসেও গণেশের সন্ধান করা যেতে পারবে। এই ভেবে রিদয় খোঁড়া হাঁসকে জবাব দেবে এমন সময় পিছনে অনেকগুলা ডানার ঝটাপট শোনা গেল। এককুড়ি বুনো হাঁস একসঙ্গে জল ছেড়ে ডাঙায় উঠে গায়ের জল ঝাড়ছে। তারপরে মাঝে চকা-নিকোবরকে রেখে সারিবন্দী সব হাঁস তাদের দিকে এগিয়ে আস্তে লাগল। খোঁড়া হাঁস বুনো হাঁসদের চেহারা দেখে একটু ভয় খেলে। সে ভেবেছিল হাঁস-মাত্রে পোষা হাঁসের মতো দেখতে; আর ধরন-ধারণও সেই রকম। কিন্তু এখন দেখলে বুনো হাঁসগুলো বেঁটে-খাটো গাঁট্টা-গোঁট্টা-কাটখোট্টা-গোছের। এদের রঙ তার মতো শাদা নয়, কিন্তু ধুলো-বালির মতো ময়লা, পালক এখানে খয়েরী, ওখানে খাকির ছোপ। আর তাদের চোখ দেখলে ভয় হয়—হলুদবর্ণ—যেন গুলের আগুন জ্বলছে! খোঁড়া বরাবর দেখে এসেছে হাঁস চলে হেলতে-দুলতে—পায়ে-পায়ে; কিন্তু এরা চলছে খটমট চটপট-যেন ছুটে বেড়াচ্ছে। আর এদের পাগুলো বিশ্রী—চ্যাটালো, কেটো-কেটো, ফটা-চটা—হতকুৎসিত! দেখলেই বোঝা যায় যেখানে-সেখানে শুধু-পায়ে এরা ছুটে বেড়ায়—জল কাদা কিছুই বাছে না। তাদের ডানার পালক, গাঁয়ের পালক, ল্যাজের পালকগুলো পরিষ্কার ঝকঝক করছে বটে কিন্তু ধরণ-ধারণ দেখলে বোঝা যায় এগুলো একেবারে বুনো আর জংলি! খোঁড়া তাড়াতাড়ি রিদয়কে সাবধান করে দিলে—যেন সে কে, কি বৃত্তান্ত, এসব কথা বুনো হাঁসদের না বলে। তার পর সে খোঁড়াতে-খোঁড়াতে এগিয়ে গেল। চকা-নিকোবর, খোঁড়াহাঁস আর বুনোহাঁসদের মধ্যে খানিক্ষণ ঘাড়-নেড়ে নমস্কার প্রতি-নমস্কার চলল। তারপর চকা শুধোলে—“এখন বল তো, তোমরা কে? কোন জাতের পাখি?” খোঁড়া আস্তে-আস্তে বললে—“কি আর পরিচয় দেব? গেল-বছর ফাগুন মাসে হরিংঘাটায় আমি ডিম-ভেঙে বার হই। জন্মাবধি পা-টি খোঁড়া। এই শীতে আমতলির হাটে আমি বিকোতে আসি; সেখান থেকে রিদয়ের বাপ আমায় সাত-সিকেতে কিনে আনে; তারপর তোমাদের দলে ভিড়েছি।” চকা-নিকোবর নাক তুলে বললে—“তুমি তবে নেহাত সাধারণ-হাঁস দেখছি! খেতাব, মানসন্ত্রম, বোল্‌বোলা—কিছুই নেই! কোন সাহসে আমাদের দলে আসতে চাও শুনি?” খোঁড়া হাঁস খোঁড়া পাটি নাচিয়ে বললে—“আমি দেখাতে চাই যে সাধারণ হাঁসও কাজের হতে পারে।” চকা হেসে বললে—“সত্যি নাকি? কই, দেখাও দেখি কেমন কাজের কাজী তুমি?” এক হাঁস অমনি বললে—“ওড়ার কাজে কেমন যে তুমি মজবুত তাতো দেখিয়েচ!” অন্যে বললে—“হয়তো তুমি সাঁতারে পাকা।” খোঁড়া ঘাড়-নেড়ে বললে—“না, আমি সাঁতারু মোটেই নয়। আমি বর্ষার সময় নালাগুলো এপার-ওপার করতে পারি, তার বেশি নয়।” খোঁড়া হাস ভাবছিল, চকা তো তাকে আমতলিতে ফিরে পাঠাবেই স্থির করেছে, তবে কেন মিছে-কথা বলা? পষ্ট জবাব দেওয়াই ভালো—যা থাকে কপালে! চকা শুধোলে—“সাতার জানো না, তবে দৌড়তে মজবুত বোধ হয়?” বলেই চকা একবার তার খোঁড়া পায়ের দিকে চেয়ে চোখ মটকালে। খোঁড়া হাস গম্ভীর হয়ে বললে—“রাজহাঁস কোনো দিন ছুটে চলে না, তাই ছোটা আমার অভ্যেসই হয়নি।” বলে সে খোঁড়া-পা আরো খুঁড়িয়ে রাজহাঁস কেমন চলে একবার দেখিয়ে দিলে। তার মনে হচ্ছিল এইবার চকা বললে বুঝি—“তোমায় আমাদের দরকার নেই, ঘরে যাও।” কিন্তু ঠিক তার উল্টোটা হল। চক-নিকোবর দু’চারবার ঘাড়-নেড়ে বলল— “তুমি তো বেশ সাফ-সাফ জবাব দিলে—একটুও ভয় না করে! ভালো, ভালো, তোমার সাহস আছে—সময়ে লায়েক হতে পারবে—‘বুকের পাটা শক্ত, সকল কাজে পোক্ত’। দু’দিন এদলে থাক, দেখি তোমার হিম্মৎ কতটা, তারপর যা হয় বিবেচনা করা যাবে। কি বল?” খোঁড়া হাঁস মাথা নেড়ে বললে—“আমি তো তাই চাই। এতেই আমি খুশি!” এইবার চকা-নিকোবর বুড়ো-আংলা রিদয়ের দিকে ঠোঁট বাড়িয়ে বললে—“একি, এ কোন জানোয়ার? ভারি তো অদ্ভুত।” খোঁড়া হাঁস তাড়াতাড়ি বললে—“এটি আমার দেশের লোক, হাঁস চরাবার কাজ করে, সঙ্গে থাকলে কাজে লাগতে পারে।” চকা নাক তুলে উত্তর করলে—“বুনো হাঁসের কোনে কাজে লাগবে না।—পোষা হাঁসের কাজে লাগবে বটে! ওর নাম কি?” মানুষের নাম বললে পাছে বুনো হাঁসরা ভয় খায়, সেইজন্যে খোঁড়া হাঁস অনেক ভেবে বললে—“ওর নাম অনেকগুলো। আমরা ওকে ডাকি বুড়ো-আংলা বলে। আঃ, বড় ঘুম পাচ্ছে।” বলেই খোঁড়া দুবার হাই তুলে চোখ বুজলে; পাছে চকা আর-কিছু প্রশ্ন করে তাই খোঁড়া আগে থাকতেই সাবধান হচ্ছে—“মাগো, চোখ আপনা-হতেই ঢুলে আসছে! চল্‌রে বুড়ো-আংলা, ঘুমোবি চল।” চকা-নিকোবর বড় পাকা হাঁস; বুড়ো হয়ে তার মাথা থেকে ল্যাজের পালক পর্যন্ত রুপোর মতো শাদা হয়ে গেছে; মাথাটা যেন চূনের হাঁড়ি; পা-দুটো যেন চ্যালা-কাঠ—বাঁকা, ফাটা-চটা; ডানা-দুটো যেন দুখানা ঝরঝরে বাঁশের কুলো; ঠোট ভোঁতা; গলা ছিনে-পড়,; কিন্তু চোখ এখনো জোয়ান-হাঁসের চেয়েও ঝকঝকে—যেন আগুন ঠিকরে পড়ছে! চকা দেখলে খোঁড়া পাশ-কাটাবার চেষ্টায় আছে, সে এগিয়ে এসে বুক-ফুলিয়ে খোঁড়াকে বললে—“আমি কে, জানো তো? আমার নাম—চকা-নিকোবর! আর এই আমার ডাইনের হাঁস দেখেছ, ইনি আমার ডান-হাত বললেও চলে, এঁর নাম পাঁপড়া নান্‌কৌড়ি! আর এই আমার বাঁ-হাত, এঁর নাম নেড়োল-কাটচাল। তারপর ডাইনে হলেন লালসেরা আণ্ডামানি; বাঁয়ে হলেন—চোক-ধলা ডানকানি। তারপরে পাটাবুকো হামস্ত্রি, মারগুই চাপড়া, তিরশুলী আকায়ব, সনদ্বীপের বাঙাল, ধনমানিকের কাওয়াজি, রাবণাবাদের রাজহাঁস, রায়-মঙ্গলার ঘেংরাল, চব্বিশ-পরগনার সরাল। আরো ডাইনে-বাঁয়ে দেখ—লুসাই, তিব্বতি, তাতারি—এমনি সব বড়-বড় খেতাবি হাঁস—কেতাবে যাদের নাম উঠেছে! আমরা কি যার-তার সঙ্গে আলাপ করি, না যাকে-তাকে দলে ভিড়তে দিই? আমাদের সঙ্গে যদি ওঠা-বসা করতে চাও তো পষ্ট করে ওই বুড়ো-আংলাটির গাঁই-গোত্তর পদবী-উপাধি বল, নয় তো নিজের পথ দেখ!” চকার দেমাক দেখে রিদয় আর চুপ করে থাকতে পারলে না; সে বুক-ফুলিয়ে এগিয়ে এসে বললে—“আমার নাম ছিল—ছিযুক্ত রিদয়নাথ পুততুণ্ড, ফুলুরী গাঁই, কাশ্যপ গোত্র—পুষ্যিপুত্র; ডিহি বাখরগঞ্জ, মোকাম আমতলি—হাসপুকুর, তেঁতুলতলা। জাতে আমি মানুষ ছিলেম, সকলে এখন—” আর বলতে হল না; মানুষ শুনেই চকা-নিকোবরের দল দশহাত পিছিয়ে গিয়ে গলা বাড়িয়ে খ্যাঁক-খ্যাঁক্ করে বললে—“যা ভেবেছি তাই! সরে পড়। মানুষ আমরা দলে নিইনে। ভারি বজ্জাত তারা!” খোঁড়া হাঁস আমতা-আমতা-করে বললে—“এইটুকু মানুষ, ওকে আবার ভয় কি? কাল ওতো আপনিই বাড়ি চলে যাবে; আজ রাতটা এখানে থাক না! এইটুকু টিকটিকির মতো ওকে এই অন্ধকারে শেয়াল-কুকুরের মুখে ছেড়ে দেওয়া তো চলে না। তা ছাড়া ও আর এখন মানুষ নেই—যক হয়ে গেছে!” চকা ‘যক্‌’ শুনে সাহস পেয়ে এগিয়ে এলে বললে—“বাপু, মানুষ-জাত খারাপ, বরাবর দেখে এসেছি। ওদের বিশ্বাস নেই। তবে তুমি যদি জামিন থাক, তবে রাতের মতো ওকে আমরা থাকতে দিই। এই হিমে চড়ায় শুয়ে ঘুমিয়ে ও যদি অসুখে পড়ে, তার দায়ী আমরা হব না—এইবেলা বুঝে দেখ!” খোঁড়া হাঁস পিছবার পাত্র নয় ; সে বললে—“সে ভয় নেই। চড়ায় এক রাত কেন, সাত রাত কাটালেও ওর কিছু হবে না। এমন সৎসঙ্গ, ভালো জায়গা বনে আর পাবে কোথা? ওর বড় জোর-কপাল যে চকা-নিকোবরের সঙ্গে এক-চরে শুতে পেয়েছে চকার বাছা বাগদী-চর; এতে শুয়ে আরাম কর।” বলে খোঁড়া রিদয়কে চোখ টিপলে। চকা খোশমোদে খুশি হয়ে বললে—“তাহলে কাল কিন্তু ওর বাড়ি ফের চাই—কেমন ?” খোঁড়া বললে—“ওর সঙ্গে তাহলে আমাকেও ফিরতে হয়। আমি যে প্রতিজ্ঞা করেছি—ওকে ছাড়ব না!” চকা-নিকোবর উত্তর দিলে—“তুমি যেমন বোঝো। ইচ্ছে হয় আমাদের সঙ্গে থাকতে পার, ইচ্ছে হয় ফিরতে পার।” এই বলে চকা চরের মধ্যিখানে উড়ে বসল। একে-একে বুনো হাঁস চরে গিয়ে ডানায় মুখ গুজে শুয়ে পড়েছে। খোঁড়া হাঁস রিদয়ের কানে-কানে বললে—“চরে বড় হিম; যত পার শুকনো ঘাস কুড়িয়ে নিয়ে আমার সঙ্গে এস।” রিদয় দু বোঝা শুকনো কুটো-কাটা হাঁসের পিঠে দিয়ে চেপে বসল। হাঁস তাকে চরের একটা গর্তে নামিয়ে বললে—“ঘাসগুলো বালির উপর বিছিয়ে দাও; আমি ওর উপর বসি, তুমি আমার ডানার মধ্যে ঢুকে পড়, আর ঠাণ্ডা লাগবে না।” রিদয়কে ডানার মধ্যে নিয়ে সুবচনীর খোঁড়া হাঁস—“এই আমায় তুমি আরামে রাখ, আমি তোমায় গরমে রাখি”—বলে খড়ের উপরে আরামে বসে ঘুম দিতে লাগল। রিদয়ের মনে হল যেন সে পালকের তোশকে শুয়েছে। সেও একটিবার হাই তুলেই চোখ বুজলে।
অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর
চলন বিল অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর মানুষ যেমন, গুগলীও তেমনি হাঁটা-পথে চলে, কাজেই কৈলাস যাবার হাঁটা-পথের খবরই গুগলী রাখত। কিন্তু মাটির উপর দিয়ে হাঁটা-পথ যেমন, তেমনি আকাশের উপর দিয়ে জলের নিচে দিয়ে সব পথ আছে, সেই রাস্তায় পাখিরা মাছেরা দূর-দূর দেশে যাতায়াত করে। মানুষ, গরু, গুগলী, শামুক—এরা সব পাহাড়-জঙ্গল ভেঙে, নদী পেরিয়ে চলে, কাজেই কোথাও যেতে এদের অনেক দিন লাগে। মাছেরা এঁকে-বেঁকে এ-নদী সে-নদী করে যায়, তাদের ডাঙায় উঠতে হয় না, কাজেই তারা আরো অল্পদিনে ঠিকানায় পৌঁছয়। আর পাখিরা নদী-ডাঙা দুয়েরই উপর দিয়ে সহজে উড়ে চলে—সব চেয়ে আগে চলে তারা! কিন্তু তাই বলে পাখিরাও যে পথের কষ্ট একেবারেই পায় না, এমন নয়। আকাশের নানাদিকে নানা-রকম নরম-গরম হাওয়া নদীর স্রোতের মতো বইছে—এই সব স্রোত বুঝে পাখিদের যাতায়াত করতে হয় । এ ছাড়া বড় পাখিরা যে রাস্তায় চলে, ছোট পাখিরা সে সব রাস্তায় গেলে, তাদের বিপদে পড়তে হয়—হয়তো ঝোড়ো হাওয়াতে কোথায় যেতে কোথায় গিয়ে পড়ল তার ঠিক নেই! আবার বড় পাখিদের যে-পথে কম বাতাস, সে-পথে গেলে ওড়াই মুশকিল—ডানা নাড়তে-নাড়তে কাঁধ ব্যাথা হয়ে যায়! বাতাসের এক-একটা পথ এমন ঠাণ্ডা যে সেখনে খুব শক্ত পাখিরা ছাড়া কেউ যেতে পারে না—শীতে জমে যাবে। কোনো রাস্তায় এমন গরম বাতাসের স্রোত চলেছে যে সেখানে আগুনের ঝলকে পাখা পুড়ে যায়। এ ছাড়া জোয়ার-ভাটার মতো অনুকূল-প্রতিকূল দু’রকম হাওয়া বইছে—সেটা বুঝেও পাখিদের যাওয়া-আসা করতে হয়। সব পাখি আবার রাতে উড়তে পারে না, সেজন্য যে-দিক দিয়ে গেলে বন পাবে, নদী পাবে, আকাশ থেকে নেমে দু’দণ্ড বসে জিরোতে পাবে—এমন সব যাবার রাস্তা তারা বেছে নেয়। এর উপরে আকাশ দিয়ে মেঘ চলাচল করছে; জলে-ধোঁয়ায়-ঝাপসা এই সব মেঘের রাস্তা কাটিয়ে পাখিদের চলতে হয়; না হলে ডানা ভিজে ভারি হয়ে, কুয়াশায়, ধোঁয়ায় দিক ভুল হয়ে, একদিকে যেতে আর-এক-দিকে গিয়ে পড়বে। এমনি সব নানা ঝনঝট বাতাসের পথে আছে; কাজেই পাখিদের মধ্যে পাকা মাঝির মতো সব দলপতি-পাখি থাকে। পাণ্ডারা যেমন দলে-দলে যাত্রী নিয়ে তীর্থ করাতে চলে, তেমনি এরাও ভালো-ভালো রাস্তার খবর নিয়ে দলে-দলে নানা পাখি নিয়ে আনাগোনা করে—উত্তর থেকে দক্ষিণে, দক্ষিণ থেকে উত্তরে, পুব থেকে পশ্চিমে, পশ্চিম থেকে পুবে, সমুদ্র থেকে পাহাড়ের দিকে, পাহাড় থেকে সমুদ্রের দিকে, পৃথিবীর একধার থেকে আর-একধারে নানা-দেশে নানা-স্থানে । মানুষ যখন একদেশ থেকে আর-একদেশে চলে, সে নিজের সঙ্গে খাবার, জিনিস-পত্তর গুছিয়ে নিয়ে চলে। খুব যে গরীব, এমন কি সন্ন্যাসী সেও এক লোটা, এক কম্বল, খানিক ছাতু, ছোলা, আটা, দুটো মোয়া, নয়তো দুমুঠো মুড়িও সঙ্গে নেয়; কিন্তু পাখিদের এখান থেকে কিছু খেয়ে নিয়ে, সেখানে নেমে, সেখানে কিছু খেয়ে নিয়ে—এমনি খানিক পথ উড়ে, খানিক আবার ডাঙায় কিম্বা জলায়, কোথাও বা চরে, ঘাটে-ঘাটে জিরিয়ে খেয়ে-দেয়ে না নিলে চলবার উপায় নেই। বাচ্ছাদের জন্যে দূর থেকে পাখিরা মুখে করে, গলার থলিতে ভরে খাবার আনে; আর টিয়ে পাখি ঠোঁটে ধানের শিষ, হাঁস পদ্মফুলের ডাঁটা নিয়ে সময়-সময় এদিকে-ওদিকে উড়ে চলে বটে, কিন্তু দল-বেঁধে যখন তারা পাণ্ডার সঙ্গে দূর-দূর-দেশে যাত্রা করে বেরোয় তখন কুটোটি পর্যন্ত সঙ্গে রাখে না—একেবারে ঝাড়া-ঝাপটা হাল্কা হয়ে উড়ে যায়। রেলগাড়ি যেমন দেশ-বিদেশের মধ্য দিয়ে বাঁশি দিতে-দিতে স্টেশনে-স্টেশনে নতুন-নতুন লোক ওঠাতে-ওঠাতে চলে, এই পাখির দলও তেমনি আকাশ দিয়ে ডাক দিতে-দিতে চলে; আর এ-গ্রাম সে-গ্রাম এ-দেশ সে-দেশ এ-বন ও-বন থেকে যাত্রী-পাখি সব উড়ে গিয়ে ঝাঁকে মিশে আনন্দে মস্ত-এক দল বেঁধে চলতে থাকে। আকাশ দিয়ে একটার পর একটা ডাকগাড়ির মতো সারাদিন এমনি দলে-দলে যাতায়াত করে ডাক-হাঁক দিতে-দিতে—হাঁস, বক, সারস, পায়রা, টিয়া, শালিক, ময়না, ডাহুক-ডাহুকী—ছোট বড় নানা পাখি! খোঁড়া হাঁসের সঙ্গে মানস-সরোবরে যাবার জন্যে রিদয় ঘর ছেড়ে মাঠে এসে দেখলে নীল আকাশ দিয়ে দলে-দলে বক, সারস, বুনোহাঁস, পাতিহাঁস, বালুহাঁস, রাজহাঁস সারি দিয়ে চলেছে। এই সব পাখির দল পুবে সন্‌দ্বীপ থেকে ছেড়ে আমতলির উপর দিয়ে দুভাগ হয়ে, এক ভাগ চলেছে—গঙ্গাসাগরের মোহানা ধরে গঙ্গা-যমুনার ধারে-ধারে হরিদ্বারের পথ দিয়ে হিমালয় পেরিয়ে মানস সরোবরে; আর-একদল চলেছে—মেঘনানদীর মোহানা হয়ে আমতলি, হরিংঘাটা, গঙ্গাসাগর বাঁয়ে ফেলে, আসামের জঙ্গল, গারো-পাহাড় খাসিয়া-পাহাড় ডাইনে রেখে, ব্রহ্মপুত্র নদের বাঁকে-বাঁকে ঘুরতে-ঘুরতে হিমালয় পেরিয়ে তিব্বতের উপর দিয়ে কাঞ্চনজঙ্ঘা ধবলাগিরির উত্তর-গা ঘেঁষে সিধে পশ্চিম-মুখে মানস-সরোবরে। সমুদ্রের দিক থেকে গঙ্গাসাগরের পথ পশ্চিম-উত্তর হয়ে হিমালয় পেরিয়ে পুবে ঘুরে পড়েছে মানস-সরোবরে; আর ব্রহ্মপুত্রের পথ উত্তর-পুব হয়ে পশ্চিম ঘুরে শেষ হয়েছে মানস-সরোবরে—যেন বেড়ির দুই মুখ এক জায়গায় গিয়ে মিলেছে। এই বেড়ির মিলের কাছে রয়েছে সুন্দর-বন আর আমতলি; মাঝখানে অন্নপূর্ণার অন্নপাত্র সুজলা সুফলা সোনার বাঙলা-দেশ; ডাইনে আসাম; বাঁয়ে বেহার অঞ্চল। সুবচনীর খোঁড়া হাঁস রিদয়ের সঙ্গে মাঠে বেরিয়ে প্যাঁক-প্যাঁক করে আপনার মনেই বকতে-বকতে চলল—“উঃ বাবারে! আর যে চলতে পারিনে! পা ছিঁড়ে পড়ছে! কেন এলুম গো, মরতে ঘর থেকে বেরিয়ে ছিলুম! এতদূরে মানস-সরোবর কে জানে গো—এ্যঁঃ!” খোঁড়া হাঁস হাঁপাচ্ছে আর চলছে আর বকছে। বাতে বেচারার পা-টি পঙ্গু। সে অনেক কষ্টে খাল-ধারে—যেখানে গোটাকতক বক, গোটাকতক পাতি-হাঁস চরছিল, সেই পর্যন্ত এসে উলুঘাসের উপরে খোঁড়া পা রেখে জিরোতে বসল। রিদয় কি করে? একটা কচু-পাতার নিচে বসে আকাশের দিকে চেয়ে দেখতে লাগল—দলে-দলে হাঁস উত্তর-মুখে উড়ে চলেছে—নানা কথা বলাবলি করতে-করতে! রিদয় শুনলে হাঁসেরা বাজে বকছে না; কাজের কথাই বলতে-বলতে পথ চলেছে। সেথো হাঁসেরা বললে—“থাকে-থাকে ফুলের গন্ধ লাগছে নাকে!” অমনি পাণ্ডাহাঁস যে সব আগে চলেছে, জবাব দিলে—“ছুটলে খোসবো বাদলা রাখে।” সেথোরা বললে—“নিচে-বাগে নামল তাল-চড়াই!” পাণ্ডা উত্তর করলে—“উপরে বড়ই ঠাণ্ডা ভাই!” সেখোরা বললে—“জাল টেনে মাকড় দিল চম্পট!” পাণ্ডার জবাব হল—“এল বলে বৃষ্টি—চল চটপট!” সেথোরা বললে—“সব দিল ঘোমটা টেনে।” পাণ্ডা বললে—“এল বিষ্টি এল হেনে!” “ছুঁচোয় গড়েছে মাটির ঢিপি।” “বিষ্টি পড়বে টিপিটিপি।” “সাগরের পাখি ডাঙায় গেল।” “ঝড়-জল বুঝি এবার এল” “কাক যে বাসায় একলা বড়!” “গতিক খারাপ; নেমে পড়, নেমে পড়।” অমনি সব হাঁস ঝুপ-ঝুপ করে খালে-বিলে নেমে পড়ে আপনার-আপনার পিঠের পালকগুলো জল দিয়ে বেশ করে ভিজিয়ে নিলে, পাছে পালকগুলো শুকনো থাকলে বিষ্টির জল বেশি করে চুষে নেয়। দেখতে-দেখতে ঝড়ো-বাতাস ধুলোয়-ধুলোয় চারদিক অন্ধকার করে দিয়ে বড়-বড় গাছের আগ দুলিয়ে শুকনো ডাল-পাতা উড়িয়ে হুহু করে বেরিয়ে গেল। তারপরই একপশলা বৃষ্টি হয়ে গেল—খাল-বিল ভর্তি করে দিয়ে। একটু পরে বিষ্টি থেমে আবার রোদ উঠল; তখন দলে-দলে হাঁস, বক, সারস আবার চলল—আকাশ পথে আগের মতো বলাবলি করতে-করতে— “মাকড় আবার জাল পেতেছে।” “আর ভয় নেই—রোদ এসেছে।” “মৌচাক ছেড়ে মাছিরা ছোটে।” “বাদলের ভয় নাইকো মোটে।” “বনে-বনে ওঠে পাখির সুর।” “উড়ে চল, পার যতদূর।” “আকাশ জুড়িল রামধনুকে!” “চল—গেয়ে চল মনেরি সুখে।” আগে-আগে পাণ্ডা-হাঁস চলেছে, পিছে-পিছে তীরের ফলার মতো দু’সারি হাঁস ডাক দিতে-দিতে উড়ে যাচ্ছে। অনেক উপর দিয়ে একদল ডাক দিয়ে গেল—“পাহাড়তলি কে যাবে? পাহাড়তলি!” বুনো হাঁসের ডাক শুনে পোষা-পালা খালের বিলের হাঁস, তারা ঘাড় তুলে যে যেখানে ছিল জবাব দিলে—“যে যায় যাক, আমরা নয়।” মাটির উপরে যারা, তারা মুখে বলেছে—“যাব না” কিন্তু আকাশ এমনি নীল, বাতাস এমনি পরিস্কার যে মন তাদের চাচ্ছে উড়ে চলি—ঐ আলো-মাখা হাওয়ার ডানা ছড়িয়ে হুহু-করে! যেমন এক-এক দল বুনোহাঁস মাথার উপর দিয়ে ডাক দিয়ে যাচ্ছে, আর অমনি যত পালা-হাঁস তারা চঞ্চল হয়ে পালাই-পালাই করছে। দু’চারটে বা ডানা ঝটপট করে এক-একবার উড়ে পড়তে চেষ্টা করলে, অমনি বুড়ি হাঁস ঘাড় নেড়ে বলে উঠল—“এমন কাজ কর না। আকাশ-পথে চলার কষ্ট ভারি, পাহাড় দেশে শীত বিষম, কিছু মেলে না গো, কিছু মেলে না!” বুনো-হাঁসের ডাক শুনে সুবচনীর খোঁড়া হাঁস উড়ে পড়তে আনচান করতে লাগল। সে বকতে লাগল—“এইবার একদল হাঁস এলে হয়, ঝপ করে উড়ে পড়ব! আর পারিনে বাপু মাটিতে খুঁড়িয়ে চলতে!” সন্‌দ্বীপ থেকে বালু-হাঁসের দল হিমালয় পেরিয়ে একেবারে মানস-সরোবর পর্যন্ত যাবার জন্য তৈরি হয়ে বেরিয়েছে; এবারে সেই দূর-দূরের যাত্রীরা আমতলির ঠিক উপর দিয়ে চলতে-চলতে ডাক দিতে থাকল টানা সুরে—“মানস-সরোবর! ধৌলাগিরি!” খোঁড়া হাঁস অমনি উলু ঘাসের ঝোপ ছেড়ে গলা তুলে ডাক দিলে— “আসছি, একটু রও, একটু রয়ে ভাই, একটু রয়ে চল!” তারপর সে তার শাদা দু’খানা ডানা মেলে বাতাসে গা ভাসিয়ে দু-চার-হাত গিয়ে আবার ঝুপ করে মাটিতে পড়ল—বেচারা কতদিন ওড়েনি, ওড়া প্রায় ভুলে গেছে! খোঁড়া হাঁসের ডাক বালু-হাঁসেরা শুনেছিল বোধ হয়, তাই মাথার উপরে ঘুরে-ঘুরে তারা দেখতে লাগলো যাত্রী আসছে কি না! সুবচনীর হাঁস আবার চেঁচিয়ে বললে—“রও ভাই, একটু রয়ে!” তারপর যেমন সে উড়তে যাবে, অমনি রিদয় লাফ দিয়ে তার গলা জড়িয়ে—“আমিও যাব” বলে ঝুলে পড়ল! খোঁড়া হাঁস তখন বাতাসে ডানা ছড়িয়ে উড়তে ব্যস্ত, রিদয়কে নামিয়ে দেবার সময় হল না, দু’জনেই মাটি ছেড়ে আকাশে উঠল। রিদয়কে নিয়ে খোঁড়া হাঁস বাতাস কেটে উপরে উঠছে—এমনি বেগে যে, মনে হল ডগায় ঝোলানো একটা টিকটিকি নিয়ে হাউই চলেছে। হঠাৎ সেই খোঁড়া হাঁস এমন তেজে মাটি ছেড়ে এত উপরে উঠে পড়বে, এটা হাঁসটা নিজেও ভাবেনি; রিদয় তো মনেই আনতে পারেনি—এমনটা হবে। এখন আর নামবার উপায় নেই—পায়ের তলায় মাটি কতদূরে পড়ে আছে তার ঠিক নেই, ডানার বাতাস ক্রমাগত তাকে ঝাপটা দিচ্চে। রিদয় হাঁফাতে-হাঁফাতে অতি-কষ্টে গাছে—চড়ার মতো হাঁসের গলা ধরে আস্তে-আস্তে তার পিঠে চেপে বসল। কিন্তু এমনি গড়ানো হাঁসের পিঠ যে সেখানেও ঠিক বসে থাকা দায়—রিদয় ক্রমেই পিছনে পড়তে যাচ্ছে! দুখানা শাদা ডানার ওঠা-পড়ার মধ্যে বসে তার মনে হতে লাগল যেন শাদা দুটো সমুদ্রের ঢেউয়ের মাঝে সে দুলতে-দুলতে চলেছে। প্রাণপণে খোঁড়া হাঁসের পিঠের পালক দুই মুঠোয় ধরে, দুপায়ে গলা জড়িয়ে রিদয় স্থির হয়ে বসবার চেষ্টা করতে লাগল। মাটির উপর দিয়ে খোঁড়া হাঁসের সঙ্গে পায়ে হেঁটে যাওয়া এক, আর এক-কুড়ি-একটা উড়ন্ত হাঁসের হাঁক-ডাক, চলন্ত ডানার ঝাপটার মধ্যে বসে ঝড়ের মতো শূন্যে উড়ে চলা আর এক! বাতাস তোলপাড় করে চলেছে হাঁসের দল! কুড়ি-জোড়া দাঁড়ের মতো ঝপাঝপ উঠছে-পড়ছে জোরাল ডানা! রিদয় দেখছে কেবল হাঁস আর পালক বিজবিজ করছে! শুনছে কেবল বাতাসের ঝপঝপ, সোঁ-সোঁ, আর থেকে-থেকে হাঁসেদের হাঁক-ডাক! উপর-আকাশ দিয়ে যাচ্ছে, না মেঘের মধ্যে দিয়ে চলেছে, কি মাটির কাছ দিয়ে উড়ছে, রিদয় কিছুই বুঝতে পারছে না! উপর-আকাশে এমন পাতলা বাতাস যে হঠাৎ উঠে গেলে দম নিতে কষ্ট বোধ হয়, কাজেই নতুন-সেথো—খোঁড়া-হাঁসকে একটু সামলে নেবার জন্যে বালু-হাঁসের দল নিচেকার ঘন হাওয়ার মধ্যে দিয়ে বরং আস্তেই চলেছে, এতেই রিদয়ের মনে হচ্ছে যেন পাশাপাশি দুটো রেল-গাড়ি পুরোদমে ছুটেছে আর তারি মাঝে এতটুকু-সে দুলতে-দুলতে চলেছে! ওড়ার প্রথম চোটটা কমে এলে রিদয়ের হাঁস ক্রমে টাল সামলে সোজা তালে-তালে ডানা ফেলে চলতে শুরু করলে। তখন রিদয় মাটির দিকে চেয়ে দেখবার সময় পেলে। হাসের দল তখন সুন্দরবন ছাড়িয়ে বাঙলাদেশের বুকের উপর দিয়ে উড়ে চলেছে। রিদয় আকাশ থেকে দেখছে যেন সবুজ-হলদে-রাঙা-মেটে-নীল এমনি পাঁচ-রঙের ছক-কাটা চমৎকার একখানি কাঁথা রোদে পাতা রয়েছে। রিদয় ভাবছে এ কোনখানে এলেম? সেই সময় বাখরগঞ্জের ধানখেতের উপর দিয়ে হাঁসেরা চলল। রিদয় দেশটা দেখে ভাবলে প্রকাণ্ড একটা যেন সতরঞ্জ-খেলার ছক নিচের জমিতে পাতা রয়েছে। রিদয় ভাবছে—“বাস রে! এত বড় খেলার ছক, রাবণের দাবা খেলে নাকি?” অমনি যেন তার কথার উত্তর দিয়ে হাঁসেরা হাঁক দিলে—“খেত আর মাঠ, খেত আর মাঠ—বাখরগন্‌জো!” তখন রিদয়ের চোখ ফুটল। সে বুঝলে সবুজ ছকগুলো ধান-খেত—নতুন শিষে ভরে রয়েছে! হলদে ছকগুলো সরষে-খেত—সোনার ফুলে ভরে গিয়েছে! মেটে ছকগুলো খালি জমি—এখনো সেখানে ফসল গজায়নি। রাঙা ছকগুলো শোন আর পাট । সবুজ পাড়-দেওয়া মেটে-মেটে ছকগুলো খালি জমির ধারে-ধারে গাছের সার। মাঝে-মাঝে বড়-বড় সবুজ দাগগুলো সব বন। কোথাও সোনালী, কোথাও লাল, কোথাও ফিকে নীলের ধারে ঘন সবুজ ছককাটা ডোরাটানা জায়গাগুলো নদীর ধারে গ্রামগুলি—ঘর-ঘর পাড়া-পাড়া ভাগ করা রয়েছে। কতকগুলো ছকের মাঝে ঘন সবুজ, ধারে-ধারে খয়েরী রঙ—সেগুলো হচ্ছে আম-কাঁটালের বাগান—মাটির পাঁচিলেঘেরা। নদী, নালা, খালগুলো রিদয় দেখলে যেন রুপোলী ডোরার নক্সা—আলোতে ঝিকঝিক করছে। নতুন ফল, নতুন পাতা যেন সবুজ মখমলের উপরে এখানে-ওখানে কারচোপের কাজ!—যতদূর চোখ চলে এমনি! আকাশ থেকে মাটি যেন সতরঞ্চি হয়ে গেছে দেখে রিদয় মজা পেয়েছে ; সে হাততালি দিয়ে যেমন বলছে—“বাঃ, কি তামাশা!” অমনি হাঁসেরা যেন তাকে ধমকে বলে উঠল—“সেরা দেশ—সোনার দেশ—সবুজ দেশ—ফলন্ত-ফুলন্ত বাঙলাদেশ!” রিদয় একবার গণেশকে নিয়ে হাসি-তামাশা করতে গিয়ে বিপদে পড়েছে, হাঁসের ধমক শুনে মুখ বুজে গম্ভীর ভালোমানুষটির মতে পিটপিট করে চারদিকে চাইতে লাগল আর মিটমিট করে একটু-একটু হাসতেও থাকল—খুব ঠোঁট চেপে। দলে-দলে কত পাখি—কেউ চলেছে দক্ষিণ থেকে উত্তরে, কেউ উত্তর থেকে দক্ষিণে, পুব থেকে পশ্চিমে, পশ্চিম থেকে পুবে; আর পথের মাঝে দেখা হলেই এদল ওদলকে শুধাচ্ছে—এদিকের খবর, ওদিকের খবর—খবর কি ভাই, খবর কি ? অমনি বলাবলি চলল— “ওধারে জল হচ্ছে।” “এধারে রোদে পুড়ছে।” “সেধারে ফল ফলেছে।” “এধারে বউল ধরেছে।” রিদয়কে নিয়ে চলতি হাঁসেরা পাহাড় থেকে একদল ফিরতি হাঁসকে শুধিয়ে জানলে—ওধারে এখনো কুয়াশা কাটেনি; শিল পড়ছে; জল হিম; গাছে এখনো ফল ধরেনি! অমনি তারা ঢিমে চালে চলতে আরম্ভ করলে। তাড়াতাড়ি পাহাড়-অঞ্চলে গিয়ে লাভ কি, বলে তারা এগ্রাম-সেগ্রাম, নদীর এপার-ওপার করতে-করতে ধীরে-সুস্থে এগোতে থাকল। গ্রামে-গ্রামে ঘরের মটকায় কুঁকড়ো সব পাহারা দিচ্ছে। ঘাটিতে-ঘাটিতে চলন্ত পাখিরা তাদের কাছে খবর পাচ্ছে। “কোন গ্রাম?” “তেঁতুলিয়া, সাবেক তেঁতুলিয়া—হাল তেঁতুলিয়া।” “কোন শহর?” “নোয়াখালি—খটখটে।” “কোন মাঠ?” “তিরপুরণীর মাঠ—জলে থৈথৈ।” “কোন ঘাট?” “সাঁকের ঘাট—গুগলী ভরা।” “কোন হাট?” “উলোর হাট—খড়ের ধুম।” “কোন নদী?” “বিষনন্দী—ঘোলা জল।” “কোন নগর?” “গোপাল নগর—গয়লা ঢের।” “কোন আবাদ?” “নসীরাবাদ—তামুক ভালো।” “কোন গঞ্জ?” “বামুনগঞ্জ—মাছ মেলা দায়।” “কোন বাজার?” “হালতার বাজার—পলতা মেলে।” “কোন বন্দর?” “বাগাবন্দর—হুক্কাহুয়া।” “কোন জেলা?” “রুরুলী জেলা—সিঁদুরে মাটি।” “কোন বিল?” “চলন বিল—জল নেই।” “কোন পুকুর?” “বাধা পুকুর— কেবল কাদা।” “কোন দীঘি?” “রায় দীঘি—পানায় ঢাকা।” “কোন খাল?” “বালির খাল—কেবল চড়া।” “কোন ঝিল?” “হীরা ঝিল—তীরে জেলে।” “কোন পরগনা?” “পাতলে দ—পাতলা হ।” “কোন ডিহি?” “রাজসাই—খাসা ভাই!” “কোন পুর?” “পেসাদপুর—পিপড়ে কাঁদে।” “কার বাড়ি?” “ঠাকুর বাড়ি।” “কোন ঠাকুর?” “ওবিন ঠাকুর—ছবি লেখে।” “কার কাচারি?” “নাম কর না, ফাটবে হাড়ি!” এমনি দেশের নাম, লোকের নাম, বাড়ির নাম, আর নামের সঙ্গে একটা করে বিশেষণ দিয়ে কুঁকড়ো, সব যেমন-যেমন প্রশ্ন হচ্ছে, সঙ্গে-সঙ্গে তার উত্তর দিয়ে যাচ্ছে। যাত্রীরাও বুঝে নিচ্ছে কোন জায়গায় কি পাওয়া যায়, কোথায় নামলে বিপদ, কোথায় নিরাপদ—কোথায় কি খাওয়া পাওয়া যায় তা পর্যন্ত! মানুষে হয়তো দিয়েছে গ্রামের নাম ‘ভদ্রপুর’ কিন্তু সেখানে না আছে ফলের বাগান, চরবার খাল, বিল, মাঠ; লোকগুলোও চোয়াড়; পাখির ভাষায় সে গ্রামের নাম হল—‘নরককুণ্ড’। কোনো দুদে জমিদার প্রজার সর্বনাশ করে তেতলা বাড়ি ফেদে তার নাম দিয়েছে ‘অলকাপুরী’ ; কিন্তু সেখানে কোনোদিন কারু পাত পড়ে না; শেয়ালকুকুর কেঁদে যায়; পাখিরা মিলে সে বাড়ির নাম দিলে ‘পোড়াবাড়ি’। হয়তো একটা পাড়া—সেখানে ভণ্ড বৈরাগীর আড্ডা; তারা দিনে মালা জপে, রাতে বাড়ি-বাড়ি সিঁদ দিয়ে আসে ; সে জায়গাটার নাম মানুষ দিলে ‘বৈরিগি পাড়া’; কিন্তু পাখিরা তাকে বললে নিগিরিটিং—ভাবটা যে কেবল এদের খঞ্জনীই সার! হয়তো এক ভালো পরগনার ভালো জমিদার কিন্তু পরগনার নাম মানুষে বলছে ‘খোলা মুচি’; কিন্তু পাখিরা দেখচে সেখানে ধান খুব, ফল ভালো; ভালো জমিদার; বন্দুক-হাতে শিকারে বেরোয় না; আমনি সে পরগনার নাম তারা হাকলে—‘রাজভোগ—সাবেক রাজভোগ—হাল রাজভোগ।’ হয়তে ‘রাজভোগ’ যেমন, তেমনি কোনো ভালো পরগনা নষ্ট জমিদারের হাতে পড়ে উচ্ছন্ন গেল—সেখানে না মেলে ঘাস, না আছে ভালো জল, না আছে বাগান, থাকবার মধ্যে মাতাল জমিদারের বন্দুকের গুলী, দুঁদে নায়েবের লাঠি-সোটা; মানুষ সে পরগনার নাম ‘লক্ষ্মীপুর’ দিলেও পাখিরা তাকে বললে ‘মশাল-চুলি’। কোনো-কোনো জায়গায় সাতপুরুষ ধরে ভালো মানুষ, ভালো আবহাওয়া, ভালো খাওয়া-দাওয়া, খালবিল হাটবাজার গুলজার; সেখানকার কুঁকড়ো বুক-ফুলিয়ে হাকলে—“মনোহর নগর—সাবেক মনোহর নগর —হালে মনোহর।” এমনি যেখানে পাখিদের সুখ, সে সব জায়গার নাম এক-এক কুঁকড়ো হেঁকে দিচ্ছে—যেমন-যেমন হাসের দল, সারসের দল, মাথার উপর দিয়ে উড়ে যাচ্ছে—“সোহাগদার, দৌলতপুর, সুনামগঞ্জ!” যেখানে ফলফুলুরী ফসল ঢের, সে সব জায়গার কুঁকড়োর হাঁকছে—“দানাসিরি, লাঙ্গলবাধ, উলুর হাট, আমতাজুড়ি, জাঙ্গিপুর!” হাঁস–পদ্মনাল এমনি সব খেতে পছন্দ করে, যেখানে খালে-বিলে এসব জন্মেছে, সেখানকার কুঁকড়ো হাঁকছে—“সাতনল, নলচিটে, পাতের হাট, বেতগাঁ, বেতাজী, সোলাভাঙা, শাকের হাট।” যেখানে খাবার নেই, তার কুঁকড়ো হাঁকলে—“ঝালকাটি, কাটিপাড়া, আশাশূন্যি, সন্ন্যাসীহাট।” যেখানে ছায়াকরা বন অনেক, সেখানকার নাম হাঁকলে কুঁকড়ো—“কমলাবাড়ি, ফুলঝুরি, ডাকেটিয়া, শিরিশদিয়া, কোকিলামুখ।” যেখানে ছোট-বড় নদী, ছোট-বড় মাছ, কুঁকড়ো হাঁকলে—“চাঁদাপুর, ইলশেঘাট, ব্যাঙধুই, বোয়ালিয়া, বোয়ালমারি।” রিদয় দেখলে হাঁসেরা সোজা যে উত্তর-মুখো চলেছে, তা নয়। তারা এ-গ্রাম সে-গ্রাম, এ-খেত ও-খেত, এ-বিল ও-বিল, করে হরিংঘাট, মেঘনা—এই দুই নদীর মাঝে যা কিছু আছে সব যেন দেখতে-দেখতে চলেছে—বাঙলাদেশের সুন্দরবন, ধানখেত, পদ্মদীঘি বালুচর, খালবিল ছাড়তে যেন তাদের মন উঠছে না। বাখরগঞ্জ, বরিশাল, খুলনা, যশোহর, ফরিদপুর হয়ে ধলেশ্বরী নদী পেরিয়ে ক্রমে হাঁসের দল চাঁদপুরের দিকে চলল—পুবমুখে। হাঁসের মধ্যে ঘেংরাল আর সরাল দু-জাতের হাঁস—এরা কোনোদিন কোথাও যেতেও চায় না, নড়তেও চায় না—ভারি কুনো! বুনো হাঁস এদের দেখলেই তামাশা করতে ছাড়চে না। তারা উপর-আকাশ থেকে একের পর একে ডেকে চলল—“পাহাড়তলি, কামরূপ, ধৌলাগিরি, মানসসরোবর—চলেছি, চলেছি!” অমনি সরাল, ঘেংরাল এরা উত্তর দিচ্ছে—“যেও না যেও না, বড় শীত। যেও পরে, যেও পরে।” বুনো হাঁসের দল আরো নিচে নেমে একসঙ্গে বলে উঠল—“ভারি মজা, উড়তে মজা—শীতে মজা-পাহাড়ে মজা। উড়তে শেখাব; চলে এস না!” সরাল, ঘেংরাল কোথাও উড়ে যাবে না; যেখানকার সেখানে থাকবে, অথচ উড়তে পারে না বললে তারা ভারি চটবে; এবারে বুনো হাঁসের কথায় তারা জবাবই দিলে না। তখন বালু-হাঁসের দল একবারে মাটির কাছে নেমে এসে বলে উঠল—“ওরে হাঁস নয় রে—ভেড়া!” তারপর হাঃ-হাঃ করে হাসতে-হাসতে ডানায় তালি দিতে-দিতে আবার আকাশে উঠল। নিচে থেকে ঘোরো-হাঁস তারা গলা চিরে গালাগালি শুরু করলে—“মর, মর! গুলি খেয়ে মর, শীল পড়ে মর, বাতে ধরে মর, বাজ পড়ে মর, বিদেশে মর, বিভূঁয়ে মর!” এমনি হাসি-তামাশার মধ্যে রিদয় আনন্দে চলেছে। কিন্তু তবু নিজের দুরবস্থা ভেবে—সে যে মা-বাপ ঘর-বাড়ি ছেড়ে কোথায় নির্বাসনে চলেছে, সে কথা মনে করে—এক-একবার তার চোখে জলও আসছে। কিন্তু তবু এই আকাশ দিয়ে একেবারে হুহু করে উড়ে চলায় কি মজা, কত আনন্দ! বাতাসে কোথাও ভিজে মাটির গন্ধ, কোথাও ফোটা-ফুলের খোসবো, কোথাও পাকা ফলের কি মিঠে বাসই আসছে! পৃথিবীর গায়ের বাতাস যে এমন সুগন্ধে ভরা রিদয় আগে তো জানেনি! মেঘের উপর দিয়ে জলের চেয়ে পরিষ্কার বাতাসের উপর দিয়ে ভেসে চলতে-চলতে রিদয়ের মনে হতে লাগল যেন সব দুঃখ, সব কষ্ট, পৃথিবীর যত কিছু জ্বালা-যন্ত্রণা ছেড়ে সে সত্যি উঠে এসেছে সেইখানে, যেখানে ধুলো নেই, বালি নেই, ভয় নেই, ভাবনা নেই, রোগ নেই, শোক নেই—কেবলি আনন্দে উড়ে চলা দিন-রাত!
অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর
টুং-সোন্নাটা-ঘুম অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর সুরেশ্বর ছেড়ে বৃষ্টি আরম্ভ হল। এতদিন রোদে কাঠ ফাটছিল। সকালে যখন হাঁসের দল যাত্রা করে বার হল তখন আকাশ বেশ পরিষ্কার কিন্তু ব্ৰহ্মপুত্র-নদের রাস্তা ধরে যতই তারা উত্তর-মুখে এগিয়ে চলল, ততই মেঘ আর কুয়াশা আর সঙ্গে-সঙ্গে বৃষ্টি দেখা দিলে! হাঁসের ডানায় পাহাড়ের হাওয়া লেগেছে, তারা মেঘ কাটিয়ে হু-হু করে চলেছে; মাটির পাখিদের সঙ্গে রঙ-তামাশা করে বকতে-বকতে চলবার আর সময় নেই, তারা কেবলি টানা স্বরে ডেকে চলেছে—“কোথায়, হেথায়, কোথায়, হেথায়।” হাঁসের দলের সাড়া পেয়ে ব্রহ্মপুত্রের দুপারের কুঁকড়ো ঘাঁটিতে-ঘাঁটিতে জানান দিতে শুরু করলে। পুব পারের কুঁকড়ো হাঁকলে—“সাতনল, চন্দনপুর, কোমিল্লা, আগরতলার রাজবাড়ি, টিপারা, হীলটিপারা!” পশ্চিম পারের কুঁকড়ো হাঁকলে—“মীরকদম, নারাণগঞ্জ, ঢাকার নবাববাড়ি, মুড়াপাড়া।” পুবে হাঁকলে—“ভেংচার চর, পশ্চিমে হাঁকলে—“চর ভিন-দোর।” হাঁসেরা তেজে চলেছে, এবার ছোট-ছোট গ্রাম, নদীর আর নাম শোনা যাচ্ছে না, বড়-বড় জায়গার কুঁকড়ো হাঁকছে—“পাবনা, রামপুরবোয়ালিয়া, বোগরা, রাজসাহি, দিনাজপুর, রংপুর, কুচবেহার, জলপাইগুড়ি, শিলিগুড়ি!” পুবের কুঁকড়ো অমনি ডেকে বললে—“খাসিয়া-পাহাড়, গারো-পাহাড়, জৈঁতিয়া-পর্বত, কামরূপ।” বুনো-হাঁসের দল পাহাড়-পর্বত অনেক দেখেছে, শিলিগুড়ি থেকে হিমালয় ডিঙ্গিয়ে মানস-সরোবরে চট করে গিয়ে পড়া গেলেও তারা শিলিগুড়ি থেকে ডাইনে ফিরে, ফুলচারি, হাড়গিলের-চর, ধুবড়ি, শিলং, গৌহাটি, দিব্রুগড়, কামরূপ হয়ে যাবার মতলবই করলে, কেননা, দার্জিলিঙ হয়ে যাওয়া মানে ঝড়-ঝাপটা, বরফের উপর দিয়ে যাওয়া, আর কামরূপের পথে গেলে ব্ৰহ্মপুত্ৰ-নদের দুধারে নগরে গ্রামে চরে জিরিয়ে যাওয়া চলে। রিদয় কিন্তু বেঁকে বসল, এত কাছে এসে দার্জিলিঙ যদি দেখা না হল তো হল কি? খোঁড়া হাঁসের যদিও পায়ে বাত তবু রিদয়ের কথাতেই সে সায় দিয়ে বসল! ঠিক সেই সময় শিলিগুড়ি থেকে ছোট রেল বাঁশি দিয়ে পাহাড়ে উঠতে আরম্ভ করলে, রিদয় আকাশের উপর থেকে দেখলে, যেন শাদা-কালো একটি গুটিপোকা একে-বেঁকে পাহাড়ের গা বেয়ে চলেছে—হাঁসে চড়া রিদয়ের অভ্যেস, রেল এত ঢিমে চলছে দেখে ভেবেছিল, গুগলীর মতো কত বছরই লাগবে ওটার দাৰ্জিলিঙ পৌছতে! রিদয় চকাকে শুধোলে, “ওটা কতদিনে দাৰ্জিলিঙ পৌছবে ?” চকা উত্তর দিলে—“এই সকাল আটটায় ছাড়ল, বেলা তিনটে-চারটেতে পৌঁছে যাবে!” “আর আমরা কতক্ষণে সেখানে যেতে পারি”—রিদয় শুধোলে। চকা উত্তর করলে—“যদি রাস্তায় কুয়াশা, হিম না পাই, তবে বড় জোর এক-ঘণ্টায় ‘ঘুম-লেকে’ গিয়ে নামতে পারি, সেখান থেকে কিছু খেয়ে নিয়ে সিঞ্চল, কালিম্পং, লিবং, সন্দকফু থেকে কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখে কার্সিয়ং, টুং-সোনাদা হয়ে আবার ঘুমেতে নেমে একটু জল খেয়ে একচোট ঘুমিয়ে নিয়ে বেলা সাড়ে-এগারোটা নাগাদ দাৰ্জিলিঙ-ক্যালকাটা রোডের ধারে আলুবাড়ির গুম্পার কাছটায় তোমায় নামিয়ে দিতে পারি। আমরা তিব্বতের হাঁস তার ওদিকে আর আমাদের যাবার যো নেই—গেলেই গোরারা গুলি চালাবে!” এত সহজে দাৰ্জিলিঙ দেখা যাবে জেনে খোঁড়া হাঁস পর্যন্ত নেচে উঠল। চকা তখন বললে—“এতবড়ো দল নিয়ে তো পাহাড়ে চলা দায়, ছোট রেলের মতো আমাদেরও দল ছোট করে ফেলা যাক। বড়-দলটা নিয়ে আণ্ডামানি কামরূপে হাড়গিলে-চরে গিয়ে অপেক্ষা করুক; আর আমি, খোঁড়া, হংপাল, কাটচাল, নানকৌড়ি, চল দার্জিলিঙ দেখে আসি।” শিলিগুড়ি থেকে হাঁসের দল দুই ভাগ হয়ে চলল, ঠিক সেই সময় গুঁড়ি-গুঁড়ি বৃষ্টি নামল। কাঠ-ফাটা রোদের পরে নতুন বৃষ্টি পেয়ে মাটি ভিজে উঠেছে, পাতা গজিয়ে উঠছে, বনের পাখিরা আনন্দে উলু-উলু দিয়ে কেবলি বলতে লেগেছে, বৃষ্টির গান: বিষ্টি পড়ে টাপুর-টুপুর বাজছে বাদল গামুর-গুমুর ডাল-চাল আর মক্কা-মসুর ফোঁটায়-ফোঁটায় নামে— আকাশ থেকে নামে— জলের সাথে নামে— ঘরে-ঘরে নামে— টাপুর-টুপুর গামুর-গুমুর গামুর-গুমুর টাপুর-টুপুর। ‘তিষ্টা’ নদীর কাছে এলে হাসেরা শুনলে, নদীর দুপারে সবাই বলছে: মেঘ লেগেছে কালা-ধলা বইছে বাতাস জলা-জলা বরফ-গলা পাগলা-ঝোড়া শুকনা ধুয়ে আসে তিষ্টা নদীর পাশে— ঝাপুর-ঝুপুর ছাপুর-ছুপুর ছাপুর-ছুপুর ঝাপুর-ঝুপুর। নতুন জল-বাতাস পেয়ে পৃথিবী জুড়ে সবাই রোল তুলেছে, আকাশের হাঁসেরাই বা চুপ করে থাকে কেমন করে, তারা পাহাড়ের গায়ে সিঁড়ির মতো ধাপে-ধাপে আলু, পেঁয়াজ, শাক, সব্জী খেতগুলোর ধার দিয়ে ডাকতে-ডাকতে চলল—“রসা জমি ধ্বসে পড় না, বসে থেক না, ফসল ধরাও, ফল ধরাও, নতুন বীচে ফল ধরাও!” পাগলা-ঝোড়ার কাছ-বরাবর এসে একখানা প্রকাগু মেঘ হাঁসেদের সঙ্গ নিয়ে উত্তর-মুখে উড়ে চলল। কলকাতার এক বাবু পাহাড়ে রাস্তায় রবারের জুতো রবারের ওয়াটারপ্রফ পরে বিষ্টির ভয়ে নাকে-কানে গলাবন্ধ জড়িয়ে মোটা এক চুরুট টানতে-টানতে ছাতা খুলে হাঁফাতে-হাঁফাতে চড়াই ভেঙে তাড়াতাড়ি বাড়ি-মুখো হয়েছেন দেখে হাঁসেরা রঙ্গ জুড়লে: জল চাও না, চাও কিন্তু খাসা পাঁউরুটি হয় না তো সিটি ! জলের ভয়ে তাড়াতাড়ি খুললে কেন ছাতা! জল না হলে গাছে-গাছে ফলে পেপে আতা? জল না হলে কোথায় পেতে আলু পটোল চা! হত নাকো রবার-গাছ কিসে ঢাকতে পা ? বিষ্টি নইলে ছিষ্টি নষ্ট, সেটা মনে রেখ— মেঘ দেখলে নাক তোলো তো উপোস করে থেক! সকালে পাবে না চা দুপুরেতে ভাত— বিকেলে পাবে না ফল, রাতে জলবে আঁত না পাবে নদীতে মাছ খেতেতে ফসল— ফোঁটা-ফোঁটা ঝরবে তখন তোমার চোখে জল । বাবু একবার ছাতার মধ্যে থেকে আকাশে চেয়ে দেখলেন, রিদয় টুপ করে তার নাকের উপর একটা শিল ফেলে হাত তালি দিতে-দিতে হাঁসের পিঠে উড়ে চলল। মেঘখানা শিল বর্ষাতে-বর্ষাতে হাঁসের দলের পিছনে-পিছনে আসছে, আর হাঁসেরা সারি দিয়ে আগে-আগে যেন মেঘখানাকে টেনে নিয়ে চলেছে—আকাশ দিয়ে পুষ্পকরথের মতো! তিন-দরিয়ার অনেক উপরে দুই পাহাড়ের দেয়াল যেন কেল্লার বুরুজের মতো সোজা আকাশ ঠেলে উঠেছে একেবারে মেঘের কাছে, তারি গায়ে পাগলা-ঝোড়া ঝরনা শাদা পৈতের মতো পাহাড়ের গা বেয়ে গাছ-পালার মধ্যে দিয়ে ঝুলে পড়েছে—এই পাহাড়ের দেওয়াল ডিঙিয়ে হাঁসেরা কার্সিয়ংয়ের মুখে চলল—পাংখাবাড়ি থেকে কারসিয়ং দুধারে ঝরনা আর চা বাগান সবজী-খেত, থাকে-থাকে পাহাড়ের গায়ে পাহাড়ি বস্তি, সাহেবদের কুঠি, কার্সিয়ং শহরটা যেন আর একটা ঝরনার মতো দেখা যাচ্ছে—পাহাড়ি গোলাপ গেঁদা গাছা-আগাছার কুঁড়ি ধরেছে। বাঁ-ধারে দূরে কালে-কালো পাহাড়ের শিখরে বরফের পাহাড় যেন দুধের ফেনার মতে উথলে পড়েছে। একদল বাঙালী বৌ ছেলে-পুলে নিয়ে কার্সিয়ংয়ের ইষ্টিসনের উপরের রাস্তায় হাওয়া খেতে বেরিয়েছে—গিন্নি সবে অসুখ থেকে উঠেছেন, তিনি ছাতি মাথায় দাণ্ডি চেপে চলেছেন, কর্তা লাঠি ধরে সঙ্গে, পিছনে চার মেয়ে, ছোট-বড় তিন ছেলে, এক বৌ, দুই জামাই, একপাল নাতি-পুতি হাসি-খুশি লুটো-পাটি করে চলেছে! কেউ পাহাড় থেকে ফুল তুলছে, কেউ রাস্তা থেকে নুড়ি কুড়োচ্ছে, একটা ছেলের হাতে প্রজাপতির কুড়োজাল দেখে রিদয় চেঁচিয়ে বললে—“ধর না ধর না, যক্ হবে।” হাঁসেরা বলে চলল—“ফুল যত চাও তোল, গোলাপ ফুটল বলে, গাঁদা ওই ফুটেছে, চেরি ফুলে রঙ ধরেছে, আমরা এনেছি, নাও কলাই-শুটি নাও, ফুলকপি নাও, আপেল নাও, নাসপাতি যত পার খাও নাও দাও থোও, প্রজাপতি ধরা ছেড়ে দাও, ছেড়ে দাও!” দেখতে-দেখতে মেঘে কার্সিয়ং ঢেকে গেল, ছেলে-বুড়ো ঘর-বাড়ি বাজার-ইষ্টিশান মায় ছোট রেল গিদা পাহাড় ডাউনহিল সব কুয়াশায় চাপা পড়লো, দূরে সিঞ্চল মেঘের উপরে মাথা তুলে দেখা দিল। এইবার রিদয়ের শীত আরম্ভ হল। খোঁড়া হাস ডানা ছড়িয়ে উড়ে চলেছে, পালকের মধ্যে ঢোকবার যো নেই, জলে-শীতে থরথর করে বেচারা কাপতে লাগল, খোঁড়াও বাঙলাদেশের মানুষ, পাহাড়ের শীতে তারও ডানার পালকগুলো কাটা দিয়ে উঠল, সে ডাক দিলে—“শীত-শীত হংপাল শীতে গেল!” চকা হাঁকলে—“নেমে পড় কার্সিয়ং!” হাঁসরা অমনি মেঘের মধ্যে দিয়ে নামতে শুরু করলে। রিদয় দেখলে, মেঘের মধ্যেটায় খোলা আকাশের চেয়ে কম ঠাণ্ডা, যেন পাতলা তুলোর বালাপোষ গায়ে দিয়েছে। হাঁসেরা নামতে-নামতে একটা বাড়ির ছাতে এসে বসল। বাড়ির বাইরে কেউ নেই, কুয়াশার ভয়ে সবাই ঘরে কাঁচ বন্ধ করে বসেছে, বাইরে কেবল গালফুলো একটুখানি একটা পাহাড়ি ছোঁড়া আগুন জ্বেলে কচি ছেলের একজোড়া পশমের মোজা তাতিয়ে নিচ্ছে, আর সেই সঙ্গে নিজের হাত-পাগুলোও একটু সেঁকে নিচ্ছে, এমন সময় ঘর থেকে বাড়ির গিন্নি ডাক দিলেন—“টুকনী!” ছেলেটা তাড়াতাড়ি হাতের মোজা জোড়া মাটিতে ফেলে দৌড় দিলে, চকা অমনি ছোঁ দিয়ে মোজাটা নিয়ে রিদয়কে দিয়ে বললে—“পরে ফেল উলের জামা।” রিদয় মোজাটা মাথায় গলিয়ে ছেঁড়া মোজার তিনটে ছেঁদা দিয়ে হাত আর মাথা বার করে ফিট হয়ে যেন সোয়েটার পরে দাঁড়াল। হাঁসের দল তাকে পিঠে নিয়ে আকাশে উঠল—টুকনী ছোঁড়াটা নিচে দাড়িয়ে চেঁচাতে লাগল—“আরে-আরে হাঁস মোজা লেকে ভাগা !” রিদয় শুনলে গিন্নি চেঁচাচ্ছেন—“হাঁসে কখনো মোজা নেয়? নিশ্চয় মোজাটা পুড়িয়ে রেখে মিছে কথা বলছে! ফের ঝুটবাত বোলতা!” টুকনীর মোজা-পোড়ানোর মামলার শেষ কি হল দেখবার আর সময় হল না! মেঘ তখন মুষল ধারায় জল ঢালতে আরম্ভ করেছে, হাঁসেরা তাড়াতাড়ি মেঘ ছাড়িয়ে উঠতে চেষ্টা করতে লাগল আর বন-জঙ্গলকে ডেকে বলতে লাগল—“কত জল আর চাই বল, তেষ্টা যে মেটে না দেখি, মেটে না দেখি!” কিন্তু দেখতে-দেখতে আকাশ নীল মেঘে ছেয়ে গেল, সূর্য কোথায় কোনদিকে তার ঠিক নেই, হাঁসেদের ডানার উপরে বিষ্টি ক্রমাগত চাবুকের মতো পড়ছে, ডানার পালক ভিজে তাদের বুকের পালকে পর্যন্ত জল সেঁধিয়েছে, পাহাড়-পর্বত চড়াই-নাবাই গাছ-পালা ঘন কুয়াশায় ঝাপসা হয়ে মিলিয়ে গেছে—দু’হাত আগে নজর চলে না। পাখিদের গান থেমে গেছে। হাঁসেরা চলেছে, ধীরে-ধীরে পথ খুঁজে-খুঁজে; রিদয় কেবলি শীতে কাঁপছে আর ভাবছে, চুরি করার এই শাস্তি। এই মেঘ আর কুয়াশার মধ্যে দিয়ে চকা-নিকোবর যখন তাদের কটিকে নিয়ে সিংচল পাহাড়ের সিংএ একটা ঝাউতলায় এসে বলল, তখন যেন রিদয় হাঁফ ছেড়ে বাঁচল! পাহাড়ের চূড়োয় কেবল সোনালী ঘাসের বন আর এক-একটা ছাতের মতো প্রকাগু-প্রকাও পাথর বরফ পড়ে শাদা হয়ে রয়েছে—কোথাও-কোথাও নালা দিয়ে বরফ-জল বয়ে চলেছে, পাতায়-পাতায় টিপটপ করে বিষ্টি লাগছে কিন্তু শীত হলেও হাওয়া এখানে এমন পরিষ্কার যে রিদয় আনন্দে এদিকে-ওদিকে ছুটে বেড়াতে লাগল! বুনো টেঁপারি সোনালী পাতা রুপোলী পাতা সোনা-ঘাস রুপো-ঘাস তুলে-তুলে রিদয় বোঝা বাঁধছে দেখে চকা হেসে বললে—“এগুলো হবে কি?” রিদয় অমনি বলে উঠল—“দেশে গিয়ে দেখাব !” খোঁড়া হাস ভয় পেয়ে বললে—“ওই মস্ত বোঝা নিয়ে ওড়া আমার কর্ম নয়, তুমি তবে রেলে করে বাড়ি যাও!” চকা রিদয়কে ডেকে বললে—“খুব-কাজের জিনিস ছাড়া একটি বাজে জিনিস সঙ্গে নেওয়া আমাদের নিয়ম নয়, পেট ভরে টেঁপারি খাও তাতে আপত্তি নেই, ঘাস দু’কানে দুটো গুঁজতে পার তার বেশি নয়!” রিদয় দু’কানে দুটো ঘাস গুঁজে টেঁপারি খেয়ে বেড়াচ্ছে এমন সময় ভালুকের সঙ্গে দেখা! রিদয় ভালুক নাচ অনেক দেখেছে কিন্তু এত-বড় এমন রোঁয়াওয়ালা কালো মিস ভালুক সে কোনোদিন দেখেনি, ভালুক তাকে দেখে দু’পা তুলে থপথপ করে এগিয়ে এসে বললে—“এখানে মানুষ হয়ে কি করতে এসেছ? পালাও, না হলে শীতে মরে যাবে, বড় খারাপ জায়গা। গোরাগুলো পর্যন্ত এখানে টিঁকতে পারেনি, কত লোক যে এখানে ঠাণ্ডা আর রাতের বেলায় ভূতের ভয়ে কেঁপে মরেছে তার ঠিক নেই। এখানে এককালে গোরা-বারিক ছিল কাণ্ডেল জাঁদরেল সব এখানে থাকত, এখন আর কেউ নেই! কোথায় গেছে তাদের বাগ-বাগিচা বাজার-শহর, কেবল দেখ চারদিকে আগুন-জ্বালাবার চুলোগুলো পড়ে আছে, শীতে সব গোরা ভুত বেরিয়ে এই-সব ভাঙাচুলির ধারে বসে আগুন পোহায় আর মদ খায়, হুক্কা-হুয়া গান গায়।” ঠিক এই সময় শেয়াল-ডাকের মতো গান শোনা গেল, আর মেম সঙ্গে একটা গোরা বোতোল হাতে টলতে-টলতে আসছে দেখা গেল। ভালুককে দূর থেকে দেখেই গোরা যেমন বন্দুক উঁচিয়েছে, অমনি ভালুক চট করে গাছের তলার অন্ধকারে কালোয়-কালো মিশিয়ে গেছে! রিদয়ের গায়ে টকটকে মোজা—মেম তাকে ভাবলে কার পোষা ছোট বাঁদর, সে অমনি “মাংকি-মাংকি” বলে রিদয়কে ধরতে ছুটল! রিদয় তাড়াতাড়ি যেমন পালাতে যাবে অমনি পাহাড় থেকে গড়াতে-গড়াতে একেবারে কার্ট রোডে মাল-বোঝাই ছোট রেলের ছাতে এসে চিৎপাত! রেলটা ঝরনা থেকে হোঁস-ফোঁস করে খানিক জল ইঞ্জিনে ভরে নিয়ে ঘুম জোড়বাংলার দিকে এগিয়ে চলল ভকভক করে বকতে-বকতে। এদিকে ভালুকের কাছে খবর পেয়ে হাঁসেরা উড়েছে ঠিক রেলের সঙ্গে-সঙ্গে—তারা দেখছে, রিদয় মালগাড়ির উপরটায় যেন একটি লাল নিশেনের মতো লটপট করছে। ঘুম বস্তিতে এসে রেল থামল। হাঁসেরা অমনি হাঁক দিলে—“ঘুম লেক যাও তো নেমে পড়!” কিন্তু তখন গাড়ির ঝাঁকানিতে রিদয়ের ঘুম এসেছে, সে হাত নেড়ে জানালে—“দার্জিলিঙ যাব!” এই সময় গাড়ির মধ্যে থেকে একপাল ছেলে চেঁচিয়ে উঠল—“টু সোনাদা ঘুম!” রিদয় চমকে উঠে দেখলে গাড়ি ছেড়েছে। ঘুমের পরেই ‘বাতাসীয়া’ নতুন লাইন খুলেছে—এক-একটা পাহাড় কেটে সেগুলো কেল্লার বুরুজের মতো পাথরের টালি দিয়ে পাহাড়ি মিস্ত্রি সব গেঁথে তুলেছে। রিদয়ের মনে হল, ঠিক যেন কেল্লার মধ্যে ঢুকেছি! ঠিক সেই সময় হাঁসের দল ডাক দিলে—“বাতাসীয়া বাতাস-জোর, ধরে বস!” কিন্তু গুছিয়ে বসবার আগেই রিদয়ের বাতাসে লালা ছাতার মতো উড়ে একেবারে পথের মাঝে এসে বসল। সোঁ-সোঁ করে বাঁশি দিয়ে রেল দার্জিলিঙের দিকে বেরিয়ে গেল। পাহাড়ের ম‌োড়টা সুনসান, লোক নেই, দূর থেকে একটা মোষের গাড়ি আসছে। রিদয় আস্তে-আস্তে সেই মোষের গাড়ি ধরে ঝুলতে-ঝুলতে দার্জিলিঙের বাজারে হাজির। হাঁসেরা মাথার উপরে ডাক দিয়ে গেল—“আলুবাড়ি গুম্ফা মনে রেখ, সেখানে আমরা রইব।” রিদয় আলুবাড়ি-আলুবাড়ি নাম মুখস্থ করতে-করতে বাজার দেখতে চলল। তখন সন্ধ্যা হয়ে এসেছে—অন্ধকারে রিদয় ভিড়ের মধ্যে মিশে চলেছে। বাজারের ওধারে কাঞ্চনজঙ্ঘা পাহাড়ে বরফের উপর সন্ধ্যার আলো যেন সোনার মতো ঝলক দিয়ে উঠল। তারপর গোলাপী, গোলাপী থেকে বেগুনী হয়ে আবার যে শাদা সেই শাদা বরফ দেখা দিলে। সেই সময় চৌরাস্তায় গোরার বাদ্যি শুরু হল, আর দলে-দলে লোক সেইদিকে ছুটল। রাস্তার দুধারে জুতো, খাবার, বাসন, গহনার দোকান—এখানে-ওখানে ভুটিয়া লামারা মড়ার মাথার খুলি নিয়ে ঘন্টা-ডমরু বাজিয়ে নন্দি-ভৃঙ্গির মতো ঘুরে বেড়াচ্ছে। পাহাড়ের রাস্তা কখনো রিদয় ভাঙেনি, দু-এক চড়াই উঠেই বেচারা হাঁপিয়ে পড়ল। কোথায় বসে জিরোয় ভাবছে, এমন সময় একটা খেলনার দোকানে নজর পড়ল, সেখানে লাল উলের মোজা পরানো ঠিক তারি মতো অনেকগুলো পুতুল সার্শির গায়ে কাগজের বাক্সোতে দাঁড়-করান রয়েছে! রিদয় চুপি-চুপি দোকানে ঢুকে একটা খালি বাক্স দেখে তারি মধ্যে শুয়ে রইল। সার্শিমোড়া দোকানের মধ্যে বেশ গরম, এক খোট্টা বাবু বসে বিড়ি টানছেন আর একটা ভুটিয়া মেয়ে দরজা ধরে দাঁড়িয়ে আছে। দোকানর মধ্যে ফুটবল পোস্টকার্ড নানা পুতুল লজঞ্চুস মার্বেল এমনি সব সাজানো, দরজার উপরটায় একটা বিভীষণের মুখোশ হাঁ করে চোখ পাকিয়ে চেয়ে রয়েছে! রিদয় মুখোশটার দিকে অবাক হয়ে চেয়ে আছে এমন সময় এক বাবু দোকানে ঢুকেই বলে উঠলেন—“ওহে মার্কণ্ড, ছোট-খাটো দুটো পুতুল দাও দেখি, টুনু আর সুরূপার জন্যে!” মার্কণ্ড তাড়াতাড়ি রিদয় যে বাক্সে ছিল সেই বাক্সে আর একটা বিবি পুতুল দিয়ে কাগজে মুড়ে বাবুর হাতে দিলে। বাবু সেটাকে আলখাল্লার পকেটে ফেলে চুরুট ধরিয়ে পাহাড়ের রাস্তায় ঠকঠক লাঠি ঠুকতে-ঠুকতে বাড়ি-মুখো হলেন। পকেটের মধ্যে গরম পেয়ে রিদয় বিবি পুতুলটির পাশে ঘুমিয়ে পড়ল, আবার যখন চোখ মেলে চাইলে তখন দেখলে বাক্সর ডালাটা খুলে গেছে। একটা কাঁচ-মোড়া বারাণ্ডায় গোটাকতক তুলি, এক বাক্স রঙ, একটা গদী-মোড়া চৌকি, তারি উপরে একটা এতটুকু কালো কুকুর বাক্স থেকে তাকে টানাটানি করে খেলবার চেষ্টা করছে! কুকুরটা যদি কামড়ে দেয়—! রিদয় ভাবছে, এমন সময় ওঘর থেকে ডাক এল “টমা-টমা-টমাসে!” কুকুরটা দৌড়ে ওঘরে গেল সেই ফাঁকে রিদয় বাক্স থেকে চোঁচা দৌড়। বাড়ির বাইরে থেকে সার্শিতে মুখ লাগিয়ে দেখলে একটা লাল কম্বল-পাতা খাটে ছেলে মেয়ে একদল বসে তাদের বড় ভাইটির কাছে গল্প শুনছে আর একটা ছোট ছেলে লাল ভুটিয়ার কাপড় পরে যে গল্প বলছে তার গলা জড়িয়ে ডাকছে—“পাখম দাদা, পাখম দাদা!” শীতের রাতে আগুন জ্বালা ঘরখানি—এই ছেলের দল, এই হাসি-খুশি গল্প দেখে রিদয়ের চোখে জল আসতে লাগল। তারও ঘর আছে তারও দাদা আছে, দিদি আছে, অথচ সব থেকেও নেই! কোথায় রইল তাদের আমতলি, কোথায় সেই মাটির দেওয়াল ঘরগুলি! রিদয়ের প্রাণ চাইছে এই ছেলেদের সঙ্গে একসঙ্গে খেলে, কিন্তু হায়, সে বুড়ো-আংলা যক্ হয়ে গেছে আর কি মানুষের ঘরে তার স্থান হবে! বুড়ো-আংলা জানালার বাইরে শীতে বসে অঝোরে কাঁদতে লাগল। সেই সময় বাবু ওধারে হুকুম দিলেন—“এ রবতেন কাল আলুবাড়ি যানে হোগা, ডাণ্ডি রাখ যাও!” রবতেন ডাণ্ডিখানা জানলার ধারে বারাণ্ডায় রেখে চলে গেল। রিদয় সে রাত ডাণ্ডির ছৈটার মধ্যে কাটিয়ে বাবুর সঙ্গে লুকিয়ে যেমন এসেছিল, তেমনি ডাণ্ডিতে লুকিয়ে রওনা হল। পুতুলের মধ্যে টুনুর পুতুলটাই পাওয়া গেল, সুরূপার পুতুলটা নিশ্চয় টমা মুখে করে কোথায় ফেলেচে বলে অনেক খোঁজাখুঁজি করেও তার সন্ধান হল না! সুরূপা টমার পিঠে দুই থাবড়া বসিয়ে পাহাড়ের উপর পা ছডিয়ে কাঁদতে লাগল। আলুবাড়ি থেকে রিদয়কে পিঠে নিয়ে জালা-পাহাড় কাট-পাহাড় পেরিয়ে হাঁসেরা এমন মেঘ আর শিলা-বিষ্টি পেলে যে কাঞ্চনজঙ্ঘার দিকেই এগোতে পারলে না, তাড়াতাড়ি ঘুরে ঝুপ-ঝাপ ঘুম-লেকে গিয়ে পড়ল। ভয়ঙ্কর শিল পড়েছে, লেকেৱ জলের উপরে বরফের সর পড়ে গেছে, পাহাড়ের গা বরফে শাদা হয়ে গেছে, খোঁড়া হাঁসের পায়ের বাত কটকট করে উঠল। সে বললে—“কাজ নেই বাপু এখানে থেকে, ফিরে চল, আর একবার আসা যাবে।” কিন্তু চল বললেই বলা চলা যায় না—পাহাড় দেশে মেঘ ভালো হওয়ার গতিক বুঝে তবে চলাচল করতে হয়। কোনো রকমে পাঁপড়া পানকৌড়ি ঘুম-রকে চড়ে আকাশের ভাবটা জেনে আসতে চলল; অমনি রিদয় বললে—“আমি যাবো ঘুম-রকে।” খোঁড়া বললে—“আমিও।” অমনি সবাই একসঙ্গে—“আমিও-আমিও” বলতে-বলতে উড়ে গিয়ে রকের উপরে বসল। মানুষের বাড়িতে যেমন কোনো জায়গা রাঁধবার, কোনটা বৈঠকখানা, কোনটা বা শোবার-খাবার জায়গা, হিমালয়েতেও তেমনি এক-একটা জায়গা এক-এক কাজের জন্যে আছে। মানুষের বাড়িেত যেমন দালান থাকে বারাণ্ডা থাকে রক থাকে, হিমালয়েতেও তাই। ঘুম-রকটা হল ঘুম দেবার স্থান, জলাপাহাড় হল জল খাবার কিম্বা জলো হাওয়া খাবার জায়গা, রংটং হল ধোবিখানা, কাপড় রঙাবার জায়গা, টুং হল ঘড়ির ঘর, এমনি সব নানা রক নানা দালান চাতাল গুহা এক-এক কাজের জন্যে রয়েছে। ঘুম-রকে দিনে বড় কেউ আসে না, দু’চার পথিক পাখি কি জানোয়ার কখনো-কখনো জিরোতে বসে, না হলে জায়গাটা সারাদিন ফাঁকা থাকে দেখে বুড়ো রামছাগল মাস্টার এখানে ছানা পড়াবার জন্যে একটা ইস্কুল খুলেছেন। পাখির-ছানা শেয়াল-ছানা শুয়োর-ছানা ভালুক-ছানারা ঘুম-রকে বড়-বড় পাথরের বেঞ্চিতে কেউ পা ঝুলিয়ে কেউ বা বেঞ্চিতে দাঁড়িয়ে সারাদিন ঝিমোচ্ছে আর রাম-ছাগল শিংয়ের খোঁচায় তাদের জাগিয়ে দিয়ে কেবলি পড়াচ্ছেন, ক, খ, গ, ঐ ব্যে স্যে! একে ঘুম-রক তাতে আজ বড় বাদলা, শিংয়ের খোঁচা খেয়েও চুনে-চুনে পড়ছে দেখে রামছাগলও কম্বল মুড়ি দিয়ে ঘুমের যোগাড় করছেন এমন সময় রিদয়কে নিয়ে হাঁসেরা উপস্থিত। অচেনা লোক দেখে মাস্টারমশায় তাড়াতাড়ি গা ঝাড়া দিয়ে মস্ত ম্যাপ আঁকা প্রকাণ্ড কালো সেলেটখানায় শিং বুলিয়ে-বুলিয়ে ছেলেদের জিওগ্রাফির লেকচার শুরু করলেন: জলের জন্তুরা চোখ ফুটেই দেখে জল আকাশ, ডাঙ্গার জীব তারা দেখে বন-জঙ্গল মাঠ, আর পাহাড়ের ছেলেমেয়ে তারা দেখে আকাশের উপরে বরফে ঢাকা ওই হিমালয়ের চুড়ো ক’টা। হিম-আলয় সন্ধি করে হয়েছে হিমালয় অর্থাৎ কিনা হিমালয় মানে হিমের বাড়ি, পাহাড়ি ভাষায় বলে হিমাল, সমস্‌কৃতোতে বলবে হিমাচলম্‌, ইংরেজ তারা ভালো রকম উচ্চারণ করতেই পারে না, ‘র’ বলতে ‘ল’ বলে ফেলে—তারা হিমালয়কে বলে ইমালোইয়াস্‌! হিমালয়ের মতো উঁচু আর বড় পর্বত জগতে নেই। সব দেশের সব পর্বত আমাদের হিমালয়ের চূড়োর কাছে হার মেনেছে। ধলা চামড়া জানোয়ারেরা ধরাকে সরা জ্ঞান করে, আমাদের বলে কালো, কিন্তু তাদের সব চেয়ে বড় পাহাড় মোটে ষোলো হাজার ফুট আর আমাদের এই বাড়ির চূড়োগুলো কত উঁচু তা জানো? এর চল্লিশটা শিখর হচ্ছে চব্বিশ হাজার ফিট করে এক-একটি। ঐ কাঞ্চনঞ্জঙ্ঘা যেটা সকালে-সন্ধ্যায় সোনা আর দিনে-রাতে রুপো, ওটা হচ্ছে আটাশ হাজার ফুট, ওরও আরো হাজার ফুট উপরে ধবলগিরির সব উঁচু চূড়ো ঊনত্রিশ হাজার ফুট। এর পাশে ধলা চামড়াদের জেতো পাহাড়—ফুঃ, রাজহস্তীর পাশে খরগোস! মানুষের কথা দূরে থাক পাখিরাও এই হিমালয়ের চূড়োয় চড়তে পারে না, এখানে না ঘাস না গাছ! মেঘ পর্যন্ত ভয় পায় সেখানে উঠতে, শুধু ধপধপ করছে আছোঁয়া শাদা বরফ। এই হিমালয়ের চূড়ো থেকে বরফ গলে বারোটা মহানদী ছিষ্টি হয়ে পুব-পশ্চিমে দুই মহাসাগরে গিয়ে পড়েছে, কত দেশ কত বনের মধ্যে দিয়ে তার ঠিক নেই। এ-সব নদীর ধারে কত নগর কত গ্রাম কত মাঠ-ঘাট জমি-জমা রাজ্য পেতে কত রকমের মানুষরা রয়েছে তা গোনা যায় না। এই হিমের বাড়ির চূড়োটা থেকে ধাপে-ধাপে পৃথিবীর দিকে নেমে গেছে প্রকাণ্ড-প্রকাণ্ড পর্বত-প্রমাণ সিঁড়ি, এক-এক ধাপে রকম-রকম গাছ-পালা পশু-পাখি! এ রকে সে রকে পাথরের কাজাল এমন চওড়া যে সেখানে কতকালের পুরোনো পাথরের মেঝেতে বড়-বড় গাছের বন হয়ে রয়েছে, ঝরনা দিয়ে বর্ষার জল বরফের জল সব গড়িয়ে চলেছে। কোনো রকের উপর দিয়ে মানুষেরা রেল চালিয়ে দিয়েছে, বড়-বড় শহর বসিয়ে বাজার বসিয়ে রাজত্ব করছে। জীব-জন্তুর অগম্য স্থান ধবলাগিরি, সেখানে কেবলই বরফ। এই সিঁড়ির রক, যাতে আমরা বাস করছি, এরি সব উপরের রকে শুধু বরফ আর শেওলা, একমাত্র চমরী গাই পাহাড়ি ছাগল আর ভেড়া, তার পরের ধাপে মানুষ-সমান ঘাস আর দেবদারু বন, সেখানে শেয়াল ভালুক হেঁড়েল এরাই যেতে পারে, তার পরের রকে নানা ফুল ফলের বাগান, সেখানে প্রজাপতি পাখি খরগোস কুকুর বেড়াল ভোঁদড় ভাম বাঁদর হনুমান এরাই থাকে, সবশেষের ধাপে বেতবন বাঁশবন অন্ধকার ঘন জঙ্গল, সেখানে হরিণ মোষ বাঘ সাপ ব্যাঙ্‌ তার পরে চাটালো জমি যার উপর দিয়ে সহস্রধারা নদী সব বয়ে চলেছে, এরি পরে অগাধ সমুদ্র, নীল জল, শেষ দেখা যায় না, এই সমুদ্রের ওধারে যে কি, তা কেউ জানে না! চকা আমনি বলে উঠল—“আমি জানি। নীল সমুদ্রের মাঝে পাহাড় আছে, টাপু আছে, তার পরে পৃথিবীর শেষ বরফের দেশ, সেখানে বারোমাস বরফ, জমি যেন শাদা চাদরে ঢাকা আর সেখানে ছ’মাস রাত্রি ছ’মাস দিন; সেখানে পেঙ্গু পাখিরা বরফের বাসায় ডিম পাড়ে, ধলা ভালুক আছে, ধলা শেয়াল সিন্ধুঘোটক আছে, সব সেখানে শাদা, কালো কিছু নেই, দিন রাত সমান আলো, ঘুটঘুটে আঁধার মোটেই নেই, আমি সেখানে পাঁচবার গেছি!” চকার কথায় রামছাগল শিং বেঁকিয়ে বল্লে—“এত বুড়ো হলেম এমন আজগুবি কথা তো শুনিনি।” রিদয় এবার এগিয়ে এসে বললে—“যে হিমালয়ের চূড়ো এখান থেকে দেখতে পাওয়া যাচ্ছে বরফে ঢাকা, ঐ হিমের বাড়ি গড়া নিয়ে কি কাণ্ড হয়ে গেছে এককালে, তার খবর চকা তো জানে না, রামছাগলও জানে না, মানুষেরা ধ্যান করে ওই নিচের তলাকার বনে বসে। ওই ধবলগিরির উপরের খবর যা শাস্তরে লিখে গেছে—তাই বলছি, শোনো। বড় চমৎকার কথা!” সবাই অমনি রিদয়কে ঘিরে বসল কথা শুনতে, মেঘলা দিন ভিজে স্যাঁৎস্যাঁত করছে, ভালুকের গা ঘেঁষে ছাগল, ছাগলের গা ঘেঁষে হাঁস, হাঁসের গা ঘেঁষে শেয়াল। রিদয় গল্প শুরু করলে: হিমালয় কেমন, তা শুনলে! হিমালয়ের উপরে কি নিচে কি সমুদ্রের এপারে কি ওপারে কি সবই তো শুনলে, কিন্তু এগুলো তৈরি করলে কে, তার খবর রাখ? প্রথমে সেইটে বলি, শোনো—একদিন বিশ্বকর্মা গোলার মতো একতাল কাদা পাকিয়ে নতুন পৃথিবী গড়তে বসলেন। চন্দ্র সূর্য গড়া হয়েছে এইবার সসাগরা আমাদের এই ধরা তিনি গড়তে আরম্ভ করলেন। সেদিনটাও এমনি আঁধার-আঁধার ছিল। বিশ্বকর্মার আর কাজে মনই যাচ্ছে না, তিনি কাদা নিয়ে কেবলি পৃথিবীটার উপরে বুড়ো আঙুলের টিপ দিয়ে এদেশ-সেদেশ গড়ে চললেন, সব দেশ মিলিয়ে দেশ-বিদেশগুলোর চেহারাটা হল ঠিক যেন হাড্ডিসার—এখানে-ওখানে মাটি-ঝরা শিক-বারকরা বাঁকা-চোরা টোল-খাওয়া দোমড়ানো চোপসানো গরু, ঘাড় ঝুঁকিয়ে সমুদ্রের জল খাচ্ছে আর ঠিক তারি সামনে একটা গরুড় পক্ষীর ছানা সেও যেন গো-ডিম থেকে সবে বার হয়ে মাছ ধরবার জন্যে সমুদ্রের দিকে গলা বাড়িয়েছে! বিশ্বকর্মার পাশে বিশ্বামিত্র বসেছিলেন; তাঁর বিশ্বাস, বিশ্বকর্মার চেয়ে গড়ন-পিটন করতে তিনি পাকা। বিশ্বকর্মার সঙ্গে বাজি রেখে প্রায়ই বিশ্বামিত্র এটা-ওটা গড়তেন, প্রত্যেক বারে বাজিও হারতেন কিন্তু তবু তাঁর বিশ্বাস গেল না যে বিশ্বকর্মার চেয়ে তিনি পাকা কারিগর! বিশ্বকর্মার ছিষ্টি মিষ্টি আতা খেয়ে বিশ্বামিত্র এক আতা গড়লেন, দেখতে বিশ্বকর্মার আতার চেয়েও ভালো কিন্তু সমুদ্রের জল দিয়ে গড়বার কাদা ছানার দরুন বিশ্বামিত্রের আতা এমনি নোনা হয়ে গেল যে মুখে দেবার যো নেই! ডিম ফুটে পাখি বেরোচ্ছে বিশ্বকর্মা ছিষ্টি করলেন, পাখিদের মা-বাপ— তাদের ডিম, ডিমের মধ্যে বাচ্চা—বিশ্বামিত্র বললেন, ‘ও কি হল? এ কি আবার একটা ছিষ্টি! আমি গাছে পাখি ফলাব।’ বিশ্বামিত্র অনেক মাথা ঘামিয়ে অনেক আঁক-জোক কষে স্থির করলেন—ডিমে তা দেওয়া চাই কিন্তু পাখি তা দিলে তো চলবে না—তিনি এমন নারকোল গাছ সুপুরি গাছ তাল গাছ ছিষ্টি করলেন যাতে দিন ভোর রোদ পায়, কিন্তু বেশি রোদ পেলে ডিম একেবারে সিদ্ধ হয়ে যাবে, আবার রাতে হিম পেলেও নষ্ট হবে, জল পেলে পচে যাবে! সব ভেবে-চিন্তে বিশ্বামিত্র বড়-বড় পাখির পালকের মতো পাতা গাছের আগায় বেঁধে দিয়ে সেই পাতার গোড়ায় দশটা বারোটা কুড়িটা পঁচিশটা করে ছোট-বড় নানা রকম ডিম ঝুলিয়ে অপেক্ষা করতে লাগলেন কখন পাখি বার হয়, কিন্তু পাছে কাগে চিলে ঠুকরে ডিমগুলো ভেঙে দেয় সেজন্যে বিশ্বামিত্র ডিমের খোলাগুলো এমনি শক্ত করে বানিয়েছেন যে বাচ্চা পাখি সেই পুরু নারকোল মালা নারকোল ছোবড়া তালের খোলা সুপুরির ছাল ভেঙে বার হতেই পারলে না। কোনোটা রোদে পক্ক কোনোটা অর্ধপক্ক কোনোটা অপক্কই রয়ে গেল। ডিম হল, তার শাঁস জল হল, তা দেওয়া হল, সবই হল, কিন্তু তা থেকে পাখি হল না! এতেও বিশ্বামিত্রের চৈতন্য হল না। বিশ্বকর্মাকে গোরূপা পৃথিবী গড়তে দেখে তাঁরও গড়বার সাধ হল। তখন বিশ্বকর্মা গোরূপা পৃথিবীর বাঁটের মতো এই ভারতবর্ষটি অতি যত্ন করে গড়ছেন, সব তখনো গড়া হয়নি কিন্তু এতেই মনে হচ্ছে এই দেশটি হবে চমৎকার, একেবারে কামধনুর বাঁটের মতো দেশটি—যা চাই যত চাই এখানে পাওয়া যাবে। বিশ্বামিত্র তাড়াতাড়ি একটু কাদা নিয়ে বসে বললেন, ‘দাদা তুমি খানিক এই দেশটার গড়, আমিও খানিক গড়ি—দেখা যাক কার ভালো হয়।’ বিশ্বকর্মা ভারতবর্ষের আদড়াটা প্রায় শেষ করেছিলেন কাজেই বিশ্বামিত্র খারাপ করে দিলেও দেশটা একেবারে মাটি হয়ে যাবে না জেনে দেশটার উপরে বিশ্বামিত্রকে গড়া পেটা করতে দিতে বিশ্বকর্মা আপত্তি করলেন না। তাঁকে সমস্ত উত্তর দিকটা গড়তে ছেড়ে দিয়ে নিজে বাঙলাদেশটা গড়তে বসে গেলেন। বাঙলাদেশটা সুন্দর করে নদী গ্রাম ধানখেত সুন্দর বন আম কাঁঠালের বাগান খড়ের চাল দেওয়া ছোট-ছোট কুঁড়ে ঘর দিয়ে চমৎকার করে সাজিয়ে তুলতে বিশ্বকর্মার বেশি দেরি লাগল না, বুড়ো আঙুলের দু’চার টিপ দিয়ে মাঠগুলো আর আঙুলের দাগ দিয়ে নদী-নালা বানিয়ে তিনি কাজ শেষ করে বসে বিশ্বামিত্রের দিকে চাইলেন। বিশ্বামিত্র অমনি বলে উঠলেন,—‘আমার কাজ অনেকক্ষণ শেষ হয়েছে, দেখবে এস।’ বিশ্বকর্মার ছিষ্টি বাঙালাদেশ দেখে বিশ্বামিত্র এবারে নিন্দা করতে পারলেন না, চমৎকার! সুজলা সুফলা—বীজ ছড়ালেই ফসল, কোথাও উঁচু-নিচু এবড়ো-খেবড়ো পাহাড়-পর্বত নেই বললেই হয়, যতদূর চোখ চলে সবুজ খেত আর জলা। বিশ্বামিত্র দাড়ি নেড়ে বললেন—‘হ্যাঁ, এবারের ছিষ্টিটা হয়েছে মন্দ নয়, কিন্তু আমার দেশটা আরো ভাল হয়েছে দেখসে’ বলে বিশ্বামিত্র বিশ্বকর্মাকে উত্তর-ভারতবর্ষটা কেমন হয়েছে দেখতে বললেন। বিশ্বকর্মার আদড়া উল্‌টে-পাল্‌টে বিশ্বামিত্র গড়েছেন। পাঞ্জাবে টেনেছেন পাঁচটা নদীর খাত, কিন্তু সেখানকার জমিতে সার মাটি না দিয়ে তিনি দিয়েছেন বালি আর কাঁকর, ধানও হবে না, মানুষগুলো কেবল যেন জল খেয়েই থাকবে! তারপর পাহাড় অঞ্চলে দুজনে উপস্থিত—বিশ্বকর্মা বিশ্বামিত্রের কীর্তি দেখে অবাক! সেখানে যা পেয়েছেন পাথর সবগুলো জড়ো করে এক হিমালয় পাহাড়ের ছিষ্টি করে বসেছেন বিশ্বামিত্র। তাঁর চিরকাল মাথায় আছে সূর্যের তাপ—গাছপালা মানুষ গরু সব জিনিসের পক্ষে ভালো, কাজেই তাঁর ছিষ্টি-করা পাহাড় দেশ তিনি যতটা পারেন সূর্যের কাছে ঠেলে তুলেছেন আর সেই সব পাথরের গায়ে এখানে-ওখানে দু’চার মুঠো মাটি ছড়িয়ে দু’একটা ঘাসের চাপড়া লাগিয়ে দিয়ে হাত গুটিয়ে বসেছেন! বিশ্বামিত্র একগাল হেসে যেমন বলেছেন, ‘কেমন দাদা, ভালো হয়নি?’ অমনি ঝুপঝুপ করে এক পশলা বিষ্টি নামল আর পাহাড়ের সব মাটি ঘাস ধুয়ে গিয়ে খালি পাথর আর নুড়ি বেরিয়ে পড়ল। এদিকে পাহাড়ের এখানে-ওখানে উপরে নিচেয় এত বিষ্টির জল জমা হল যে তাতে সারা পৃথিবীর নদীতে জল দেওয়া চলে! বিশ্বকৰ্মা বলে উঠলেন—‘করেছ কি, সব উল্‌টো-পাল্‌টা! যেখানে মাটি চাই, সেখানে দিয়েছ কাঁকর, যেখানে জল দরকার সেখানে দিয়েছ বালি, আর যেখানে জল মোটেই দরকার নেই সেখানে জমা করেছ রাজ্যের জলাশয়, তোমার মৎলব তো কিছু বোঝা গেল না!’ বিশ্বামিত্র দাড়ি মোচড়াতে-মোচড়াতে বললেন—‘শীতে যাতে লোক কষ্ট না পায় তাই দেশটা যতটা পারি সূর্যের কাছে দিয়েছি, এতে দোষটা হল কি!’ বিশ্বকৰ্মা বললেন—‘উঁচু জমিতে দিনে যেমন গরম রাতে তেমনি ঠাণ্ডা, এটা তো তোমার মনে রাখা উচিত ছিল, এত উঁচুতে তো কিছু গাছপালা গজানো শক্ত, গরমে জ্বলে যাবে বরফে সব জমে যাবে। এত পরিশ্রম তোমার সব মাটি হল, দেখছি!’ বিশ্বামিত্র মাথা চুলকে বললেন—‘আমি সব এখানকার উপযুক্ত মানুষ ছিষ্টি করে দিই। তারা দেখবে এই পাহাড়কে ভূস্বর্গ করে তুলবে!’ বিশ্বকর্মা বললেন—‘আর তোমার ছিষ্টি করে কাজ নেই, মানুষ গড়তে শেষে বাঁদর গড়ে বসবে!’ ‘কোনো ভয় নেই, আবার আমি খুব সাবধানে গড়ছি। দেখ এবারে ঠিক হবে’—বলে বিশ্বামিত্র একরাশ প্রজাপতির ডানা গড়ে রেখে বিশ্বকর্মাকে ডেকে বললেন—‘দেখসে মজা!’ বিশ্বকর্মা ভেবেই পান না, এত ডানা নিয়ে বিশ্বামিত্র কি করবেন! তিনি শুধোলেন—‘এগুলো কি হবে ভাই?’ বিশ্বামিত্র খানিক কপালে আঙুল বুলিয়ে চিন্তা করে বললেন—‘পাহাড়দের সব ডানা দিয়ে দিতে চাই, তারা যেখানে খুশি—শীতের সময় গরমদেশে, গরমের সময় শীতদেশে, উড়ে-উড়ে বিচরণ করতে পারবে, তা হলে এখানে যারা বাস করবে তাদের আর কোনো অসুবিধে হবে না!’ বিশ্বকৰ্মা ভয় পেয়ে বলে উঠলেন—‘সর্বনাশ, পাহাড় যেখানে-সেখানে উড়ে বসতে আরম্ভ করলে যে-সব দেশে পাহাড়-পর্বত গিয়ে পড়বে, সে-সব দেশের দশা হবে কি? লোকগুলো-সুদ্ধ সারা-দেশ যে গুঁড়িয়ে ধুলো হয়ে যাবে!’ বিশ্বামিত্র বলে উঠলেন—‘তা কেন! লোকেরা সব ধন-দৌলত খাবার-দাবার নিয়ে পাহাড়ে চড়ে বসবে, তা হলেই কোনো গোল নেই!’ বিশ্বকর্মা বললেন—‘সবাই পাহাড়ে চড়ে ঘুরে বেড়ালে আমার জমিতে হাল দেয় কে, রাজত্বই বা করে কে, ঘর-বাড়িই বা বেঁধে থাকে কে!’ ‘তা আমি কি জানি’—বলে বিশ্বামিত্র হিমালয়ের ডানা দিতে যান, এমন সময় বিশ্বকর্মা তার হাত চেপে ধরে বললেন—‘আগে হিমালয়ের বাচ্ছা এই ছোট-খাটো মন্দর পর্বতটাকে ডানা দিয়ে দেখো, কি কাণ্ড হয়, পরে বড়টাকে নিয়ে পরীক্ষা কর।’ বিশ্বামিত্র মন্দর পর্বতে ডানা দিয়ে যেমন ছেড়ে দেওয়া, সে অমনি উড়তে-উড়তে বাঙলাদেশের দক্ষিণ ধারে যে-সব দেশ গড়া হয়েছিল সেইখানে উড়ে বসল! যেমন বসা অমনি সারাদেশ রসাতলে তলিয়ে গেল; মাটি যেখানে ছিল সেখানে একটা উপসাগর হয়ে গেছে দেখা গেল। মানুষ যারা ছিল তাদের চিহ্ন রইল না, কেবল মাছগুলো জলে কিল-বিল করতে লাগল, আর মন্দর পর্বতটা সমুদ্র তোলপাড় করে এমনি সাঁতার কাটতে আরম্ভ করলে যে, জল-প্লাবনে বিশ্বকৰ্মার ছিষ্টি মাটি ধুয়ে যাবার যোগাড়! বিশ্বকর্মা তাড়াতাড়ি সমুদ্রের ধারে-ধারে বালির বাঁধ দিয়ে জল ঠেকিয়ে কপালের ঘাম মুছে বললেন—‘আমার হাতের কাজে তোমায় আর হাত দিতে দিচ্ছিনে। এই পৃথিবীর উত্তর শিয়র আর দক্ষিণ শিয়রে কিছু নেই, কিছু ছিষ্টি করতে হয় সেই দু’জায়গায় করগে। যে ভুলগুলো করেছ সেগুলো আমাকে শুধরে নিতে দাও এখন।’ বিশ্বামিত্রের হাত থেকে বিশ্বকর্মা গড়বার যন্তর-তন্তর কেড়ে নিয়ে পাহাড়ে যত জল জমা হয়েছিল, সমস্ত নালা কেটে ঝরনা দিয়ে সমুদ্রের দিকে বইয়ে দিলেন। বিশ্বকর্মার ছিষ্টিতে কিছু বাজে থাকবার যো নেই, নষ্টও হবার যো নেই—পাহাড়ের জল সমুদ্রে পড়ে, সেখান থেকে সূর্যের তাপে মেঘ হয়ে আকাশ দিয়ে দেশবিদেশে বিষ্টি দিয়ে খেতে-খেতে ফসল গজাতে চলল! বিশ্বকর্মা ইন্দ্রকে বললেন—‘বাজ দিয়ে মন্দর পর্বতের ডানা কেটে দাও!’ ডানা কাটা গেল, মন্দর সমুদ্রেই ডুবে রইল আর তার ডানার কুচিগুলো এখানে-ওখানে সমুদ্রের মাঝে টাপুর মতো ভাসতে লাগল। বিশ্বকর্মা সেগুলোর উপরে মাটি ছড়িয়ে দিলেন, বসতি বসিয়ে দিলেন। তারপর বিশ্বামিত্র যত ডানা গড়ে রেখেছিলেন সেগুলো দিয়ে বিশ্বকর্মা প্রজাপতি ভোমরা মৌমাছি সব গড়ে ছেড়ে দিলেন। তারা দেশ-বিদেশ থেকে ফুলের রেণু ফুলের মধু এনে পাহাড়ে-পাহাড়ে বাগান বসাতে শুরু করে দিলে। দেখতে-দেখতে পাথরের গায়ে সব ফুল গজাল ফল ফলল। সব ঠিক করে বিশ্বকর্মা প্রকাণ্ড দুই ডানা দিয়ে দক্ষ প্রজাপতি ছিষ্টি করে হাত-পা ধুয়ে ভাত খেতে গেলেন, শাস্তরের ছিষ্টিতত্ত্ব তো এই হল, তারপর দক্ষ প্রজাপতির কথা পুরাণে লিখেছে যেমন, বলি, শোনো— বিধির মানস সুত দক্ষমুনি মজবুত প্রসূতি তাহার ধর্ম-জায়া। তার গর্ভে সতীনাম অশেষ মঙ্গলধাম জনম লভিলা মহামায়া। নারদ ঘটক হয়ে নানামতে বলে কয়ে শিবেরে বিবাহ দিল সতী। নারদ তো ঘটকালি নিয়ে সরে পড়লেন, এদিকে শিব ষাঁড়ে চড়ে ভুটিয়ার দলের সঙ্গে ডমরু বাজিয়ে জটায় সাপ জড়িয়ে হাড়মালা গলায় ঝুলিয়ে নাচতে-নাচতে হাজির। দক্ষ প্রজাপতি বরের চেহারা দেখেই চটে লাল— শিবের বিকট সাজ দেখি দক্ষ ঋষিরাজ বামদেবে হৈল বাম-মতি। সেই থেকে জামাই শ্বশুরের মুখ দেখেন না। দক্ষ প্রজাপতিও শিবনিন্দে না করে জল খান না। এই সময়ে দক্ষ শিবহীন যজ্ঞ করলেন; সব দেবতা নেমন্তন্ন পেলেন। সতীর বোনেরা গয়না-গাটি পরে পালকি চড়ে শিবের বাড়ির সামনে দিয়ে ঝমর-ঝমর করতে-করতে বাপের বাড়ি মাছের মুড়ো খেতে চলল দেখে সতীর চোখে জল এল। দুঃখী বলে বাবা তাঁদের নেমস্তন্ন পাঠাননি! সতী বোনেদের পালকির কাছে গিয়ে দিদির গলা ধরে কেঁদে বললেন: অশ্বিনীদিদি! আমারে দুখিনী দেখিয়া পিতে অবজ্ঞা করিয়া যজ্ঞে আজ্ঞা না করিলেন যেতে, নিজ বাপ নহে অন্য শুনে হৃদে এই ক্ষুণ্ণ আমা ভিন্ন নেমন্তন্ন করেছেন এই ত্ৰিজগতে । অশ্বিনীদিদি আঁচলে সতীর চোখের জল মুছিয়ে বললেন—‘তুই চল না। বাপের বাড়ি যাবি তার আবার নেমন্তন্ন কিসের? আয় আমার এই পালকিতে!’ সতী ঘাড় নেড়ে বললেন—‘না ভাই—তিনি রাগ করবেন!’ ‘তবে তুই তাকে বুঝিয়ে-সুঝিয়ে পরে আয়’—বলে সতীর দিদিরা— চতুর্দোলে সবে চড়ি চলিলেন হরষে হেথায় শঙ্করী ধেয়ে করপুটে দাণ্ডাইয়ে চরণে প্রণতি হয়ে কহিলেন গিরিশে আমি বাপের বাড়ি যাব! শিব বললেন— সতী তুমি যেতে চাচ্ছ বটে, পাঠাইতে না হয় ইচ্ছা দক্ষের নিকটে। আমাদের শ্বশুর জামায়ে কেমন ভাব, শোনো— আমাদের ভাব কেমন জামাই শ্বশুরে, যেমন দেবতা আর অসুরে, যেমন রাবণ আর রামে, যেমন কংস আর শ্যামে, যেমন স্রোতে আর বাঁধে, যেমন রাহু আর চাঁদে, যেমন জল আর আগুনে, যেমন তেল আর বেগুনে, যেমন পক্ষী আর সাত নলা, যেমন আদা আর কাঁচকলা, যেমন ঋষি আর জপে, যেমন নেউল আর সাপে, যেমন ব্যাঘ্র আর নরে, যেমন গোমস্তা আর চোরে, যেমন কাক আর পেচক, যেমন ভীম আর কীচক। দক্ষ যখন অমান্য করে বারণ করেছেন নিমন্ত্রণ, কেমন করে সেখানে তোমার যাওয়া হয়!’ সতী কিন্তু শোনেন না শিবের কথা, তিনি সেজেগুজে নন্দীকে সঙ্গে নিয়ে মহাদেবের ষাঁড়ে চড়ে বাপের বাড়ি চললেন দুঃখিনী বেশে। কুবের দেখে বাক্স-ভরা এ-কালের সে-কালের গহনা এনে বললে—‘মা, এমন বেশে কি যেতে আছে! বাপের বাড়ির লোকে বলবে কি—ওমা, একখানা গয়নাও দেয়নি জামাই!’ সতী কুবেরের দেওয়া গহনা পরে সাজলেন; কিন্তু দক্ষ প্রজাপতির কন্যা সতী এমন সুন্দরী যে সোনা হীরে তাঁর সোনার অঙ্গের আলোর কাছে টিম-টিম করতে লাগল। ‘দূর ছাই’ বলে সতী সেগুলো ফেলে দিয়ে পাহাড়ি ফুলের সাজে সেজে বার হলেন। ত্রিলোক সতীর চমৎকার বেশ দেখে ধন্য-ধন্য করতে-করতে সঙ্গে চলল। এদিকে ছোট মেয়ে সতী এল না, কাজের বাড়ি শূন্য ঠেকছে, সতীর মা কেবলি আঁচলে চোখ মুচছেন এমন সময় দাসীরা এসে প্রসূতিকে খবর দিলে—‘ওমা তোর সতী এলো ঐ!’ এই শুনে— রানী উন্মাদিনী-প্রায় কৈ সতী বলিয়া অতি বেগে তথা ধায়। অম্বিকারে দৃষ্টি করি বাহিরেতে এসে আয় মা বলে লইয়া কোলে নয়ন জলে ভাসে! সতী মায়ের কাছে বলে একটু দুধ সন্দেশ খেয়ে সভা দেখতে চললেন। ইন্দ্র চন্দ্র সব বসেছেন, বিশ্বামিত্র বশিষ্ঠ সব বসেছেন দক্ষ প্রজাপতিকে ঘিরে, আর কালোয়াত সব গান-বাজনা করছে— ধির্‌ কুট্‌ কুট্‌ তানা নানা তাদিম তা, তা দিয়ানা ঝেন্না ঝেন্না নাদেরে দানি তাদেরে দানি, ওদেরে তানা দেরে তানা তাদিম তারয়ে তারয়ে দানি । দেতারে তারে দানি ধেতেনে দেতেনে নারে দানট। বেশ গান-বাজনা চলেছে—এমন সময় সভাতে সতীকে আসতে দেখেই দক্ষ শিব নিন্দে শুরু করলেন। দক্ষ প্রজাপতি : কেবল এ গ্রহ আনি নারুদে ঘটালে, কনিষ্ঠা কন্যাটা আমি দিলাম জলে ফেলে; বস্ত্রবিনা বাঘছাল করে পরিধান, দেবের মধ্যে দুঃখী নাই শিবের সমান। ভূত সঙ্গে শ্মশানে-মশানে করে বাস, মাথার খুলি বাবাজীর জল খাবার গেলাস! যায় বলদে বসে গলদেশে মালাগুলো সব অস্থি, সিদ্ধি ঘোঁটার সদাই ঘটা বুদ্ধি সেটার নাস্তি; অদ্ভুত সঙ্গেতে ভূত গলায় সাপের পৈতে, তারে আনিলে ডেকে হাসিবে লোকে—তাই হবে কি সইতে ! পাগলে সম্ভাষা করা কোন প্রয়োজন, সাগরে ফেলেছি কন্যা বলে বুঝাই মন। দক্ষের শিব-নিন্দা শুনে সতী আর সইতে পারলেন না। পতি-নিন্দা শুনি সতী জীবনে নৈরাশ, ঘন-ঘন চক্ষে ধারা সঘনে নিশ্বাস; পিতারে কুপিতা হইয়া অঙ্গ অবসান, ধরা শয্যা করি ‘তারা’ ত্যেজিলেন প্রাণ! সতী শিব-নিন্দা শুনে প্রাণত্যাগ করলেন, চারদিকে হাহাকার উঠল। সতীর সাতাশ বোন আকাশের তারা সব কাঁদতে লাগল, নন্দী কাঁদতে লাগল, ভৃঙ্গী কাঁদতে লাগল, দেবতারা কাঁদতে লাগলেন, মানুষেরা কাঁদতে লাগল— ফিরে চাও মা বাঁচাও পরাণী, ধূলাতে পতিত কেন পতিত-পাবনী; দুটি নয়ন-তারা মুদিয়া তারা— অধরা কেন ধরাসনে ! নন্দী গিয়ে কৈলাসে মহাদেবকে খবর দিলে—‘মা আর নেই।’ তখন শিব ক্রোধে হুহুঙ্কার ছাড়লেন, অমনি শিবদাস সব দক্ষযজ্ঞ নাশ করতে আগুয়ান হল। মহাদেব যুদ্ধে চললেন, পৃথিবী কাঁপতে থাকল, মেঘ সব গর্জন করে উঠল, আকাশে বিদ্যুৎ বাজ ছুটোছুটি করতে থাকল কড়মড় করে, শিব ত্রিশূল হাতে সাজলেন— মহারুদ্র রূপে মহাদেব সাজে, ভবম্বব ভবম্ভম সিঙ্গা ঘোর বাজে; ফণাফণ ফণাফণ ফণী ফন্ন গাজে মহারুদ্ররূপে মহাদেব সাজে; ধকধ্বক ধকধ্বক জ্বলে বহ্ণি ভালে, ববম্বম ববম্বম মহাশব্দ গালে; ধিয়াতা ধিয়াতা ধিয়া ভূত নাচে উলঙ্গী উলঙ্গে পিশাচী পিশাচে। চলে ভৈরবা ভৈরবী নন্দী ভৃঙ্গী মহাকাল বেতাল তাল ত্রিশৃঙ্গী, চলে ডাকিনী যোগিনী ঘোর বেশে চলে শাঁখিনী পেতিনী মুক্ত কেশে। ভূত-প্রেত নিয়ে শিব এসে উপস্থিত। ভয়ে কারু মুখে কথা নেই, মহাদেব হুকুম দিলেন ভূতিয়া ফৌজকে—যজ্ঞনাশ কর। অমনি— রুদ্রদূত ধায় ভূত নন্দি ভৃঙ্গি সঙ্গিয়া ঘোরবেশ মুক্ত কেশ যুদ্ধ রঙ্গ রঙ্গিয়া, যক্ষ রক্ষ লক্ষ লক্ষ অট্ট অট্ট হাসিছে যজ্ঞগেহ ভাঙ্গি কেহ হব্যগব্য খাইছে, প্রেতভাগ সানুরাগ ঝম্প ঝম্প ঝাঁপিছে, ঘোররোল গণ্ডগোল চৌদ্দলোক কাঁপিছে ; ভূত ভাগ পায় লাগ লাথি কিল মারিছে বিপ্র সর্ব দেখি খর্ব ভোজ্য বস্ত্র সারিছে ভার্গবের সৌষ্ঠবের দাড়ি গোঁফ ছিণ্ডিল পুষণের ভূষণে দন্ত পাঁতি পড়িল, ছাড়ি মন্ত্র ফেলি তন্ত্র মুক্ত কেশ ধায় রে, হায় হায় প্রাণ যায় পাপ দক্ষ দায় রে! নৈবিদ্যির থালা ফেলে বিশ্বামিত্র দৌড়—বশিষ্ঠ চম্পট, সবার দাড়ি গোঁফ ছিঁড়ে কিলিয়ে দাঁত ভেঙে ভূতেরা লম্ফ-ঝম্প করতে লাগল— মৌনী তুণ্ড হেঁট মুণ্ড দক্ষ মৃত্যু জানিছে মৈল দক্ষ, ভূত যক্ষ সিংহনাদ ছাড়িছে। দক্ষ-নিপাত দেখে সতীর মা কেঁদে শিবকে বললেন— সতীর জননী আমি, শাশুড়ী তোমার, তথাপি বিধবা দশা হইল আমার? প্রসূতির বাক্যে শিব সলজ্জ হইল, রাজ্যসহ দক্ষরাজে বাঁচাইয়া দিল। ধড়ে মুণ্ড নাহি দক্ষ দেখিতে না পায়, উঠে পড়ে ফিরে ঘুরে কবন্ধের প্রায়— কন্দ-কাটা দক্ষের দুর্গতি দেখে ভূতেরা সব হাসতে লাগল, তখন শিবের হাতের কাছে ছিল পাহাড়ি একটা রামছাগল দড়ি দিয়ে হাড়-কাঠে বাঁধা। তিনি সেইটে নন্দীকে দেখিয়ে দিলেন। নন্দী তার মুড়োটা কেটে দক্ষের কাঁধে জুড়ে দিয়ে দক্ষ প্রজাপতির ডানা দুটো কেটে নিয়ে চলে গেল, শিব সতীদেহ নিয়ে কাঁদতে-কাঁদতে কৈলাসে গেলেন! এর পরে আরও কথা আছে, কিন্তু এইখানেই দক্ষযজ্ঞ শেষ—হরি হরি বল সবে পালা হৈল সায়—বলে রিদয় চুপ করলে। রামছাগল ফ্যাল-ফ্যাল করে তাকালে, খানিক চেয়ে থেকে বললে— “ফুঃ, এমন আজগুবি কথা তো কখনো শুনিনি। বুড়ো হয়ে শিং ক্ষয়ে গেল, এমন কথা তো কোনোদিন শুনলেম না যে প্রজাপতির মাথা হয় রামছাগলের মতো আর পাহাড়গুলোর গজায় ডানা!” রামছাগল ছেলেদের বললেন: ওসব বাজে কথায় বিশ্বাস কর না, বড় হয়ে মধুর সন্ধানে পেটের দায়ে তোমরা জানি দেশ-বিদেশে যাবে, এমন অনেক বাজে গল্পও তোমাদের এই দেশের পাহাড়-পর্বত নদ-নদীর নামে শুনতে পাবে। কেউ বলবে তোমার দেশ মন্দ, কেউ বলবে মন্দ নয়, কিন্তু মনে রাখ, এই হিমালয়ের জলে বাতাসে তোমরা মানুষ, ভগবান তোমাদের জন্যে সব চেয়ে ভালো, সব চেয়ে উঁচু, সব চেয়ে চমৎকার বাড়ি দিয়েছেন। এই কথাটি সর্বদা মনে রেখ, কোনোদিন ভুলো না যে পৃথিবীর সেরা হচ্ছে এই হিমালয়, আর সেইটে ভগবান দিয়েছেন তাঁর কালো ছেলেদের। এই পাথরের সিঁড়ি এতকালের পুরোনো যে তার ঠিক-ঠিকানা নেই। আগে এটা, তারপর গাছ পালা, জন্তু-জানোয়ার সৃষ্টি হয়েছে। পাখির ছানাগুলো জন্মাবার আগে যেমন তাদের বাসা তৈরি হয়ে থাকে, মানুষদের, জানোয়ারদের জন্মাবার আগে তেমনি জগৎমাতা আর বিশ্বপিতা তাদের জন্যে এই চমৎকার হিমালয় আর সমুদ্র পর্যন্ত গেছে যে পাঁচ ধাপ পাথরের সিঁড়ি, তা প্রস্তুত করিয়েছিলেন। জীব-জন্তুরা জন্মে যাতে আরামে থাকে, কষ্ট না পায় সেই জন্যে চমৎকার করে পাথর দিয়ে দালান রক এমনি সব নানা ঘর নানা বাড়ি তাঁরা সুন্দর করে বাঁধিয়ে দিলেন! কিন্তু কত কালের এই বাড়ি, একে পরিষ্কার রাখা, মেরামতে রাখা, যারা জন্মাতে লাগল তাদের তো সাধ্য হল না, এককালের নতুন বাড়ি পাথরের সিঁড়ি সব ভেঙে ফেটে পড়তে লাগল, বর্ষায় এখানে-ওখানে সোঁতা লাগল, শেওলা গজাল, হাওয়াতে ধুলো-মাটি এসে ধাপগুলোতে জমা হতে থাকল, ঝড়ে ভূমিকম্পে বড়-বড় পাথর খসে-খসে এখানে-ওখানে পড়ল, এখানটা ধ্বসে গেল, সেখানটা বসে গেল, ওটা ভেঙে পড়ল, সেটা বেঁকে রইল, এইভাবে কালে-কালে ধাপগুলোর উপরের তলার মাটি তাকে ধুয়ে নিচের তলায় নামতে লাগল; আর ধাপে-ধাপে সেখানে যেমন মাটি পেলে নানা জাতের গাছপালা বন-জঙ্গল দেখা দিলে। উপর-তলার মাটি ধুয়ে গেছে সেখানে কাঁকর আর নুড়িই বেশি, তার পরের ধাপে অল্প মাটি আছে সেখানে অল্পসল্প চাষবাস চলেছে দেখ, খুব ছোট-ছোট খেত, ছোট গ্রাম। মাঝের ধাপে অনেকটা মাটি জমা হয়েছে। সেখানে দেখ দর্জ্জিলিঙ শহর বাড়ি-ঘর বাজার চা-বাগান। কোম্পানীর বাগান সব বসে গেছে, উপর-তলার মতো অতটা ঠাণ্ডাও নয়, কাজেই সেখানে নানা গাছ ঝাউ বাদাম আখরোট পিচ পদম সব তেজ করেছে। নানা ফুলও সেখানে! কিন্তু হিমালয়ের সব নিচের ধাপে যত কিছু ভালো মাটি এসে জমা হয়েছে জলে ধুয়ে একেবারে সমুদ্রের ধার পর্যন্ত, সেখানে ফল-ফুলের বাগান খেতের আর অন্ত নেই, মাটিতে সেখানে এত তেজ যে, যা দাও ফলবে, আর সেখানে শীতও বেশি নয় বরফও পড়ে না, সেখানে গাছ এক-একটা যেন একখানা গ্রাম জুড়ে রয়েছে, আর চারিদিকে আম-কাঁঠালের বন! পাহাড়ে বরফ পড়লে আমি ইস্কুল বন্ধ করে সেখানে চরতে যাই, নিজের চোখে দেখে এসেছি যা, তাই বলছি। ঋষিদের মতো চোখ বুজে ধ্যান করে গল্প বলবার জন্যে আমি ইস্কুল-মাস্টারি করতে আসিনি। ছাত্রগণ! চোখ দিয়ে দেখাই হল আসল দেখা, ঠিক দেখা, আর চোখ বুজে ধ্যান করে দেখবার মানে খেয়াল দেখা বা স্বপন দেখা। খেয়ালীদের বিশ্বাস কর না, তা তাঁরা ঋষিই হন, কবিই হন, যা দুই চোখে দেখছি তাই সত্যি, তাছাড়া সব মিছা, সব কল্পনা, গল্পকথা, খেয়াল! রামছাগল দাড়ি নেড়ে শিং বেঁকিয়ে কটমট করে তাদের দিকে তাকাচ্ছে দেখে সুবচনীর খোঁড়া হাঁস হেলতে-দুলতে এগিয়ে এসে বললে—“ছাত্রগণ, তোমাদের মাস্টার যা বললেন, ঠিক, চোখে না দেখলে কোনো জিনিস বিশ্বাস করা শক্ত। কিন্তু এই পাহাড় পর্বত কুয়াশায় যখন দেখা যায় না, তখন কি বলতে হবে কুয়াশার মধ্যে কিছু নেই? না বলতে হবে, সূর্য চন্দ্র আকাশ ছেড়ে পালিয়েছেন। ঠিক জিনিস সব সময়ে চোখে পড়ে না, সেই জন্য এই দুই চোখের উপরে নির্ভর করে থাকি বলে আমরা কোনোদিন মানুষের সমান হতে পারব না। মানুষের মধ্যে যাঁরা ঋষি, যাঁরা কবি, তাঁরা শুধু দুই চোখে দেখলেন না, তাঁরা ধ্যানের চোখে যা দেখতে পেয়েছেন সেইগুলো ধ্যান করে কেতাবে লিখেছেন, তা পড়লে তোমরা জানতে পারবে—এই হিমালয় প্রথমে সমুদ্রের তলায় ছিল। হঠাৎ একসময় পৃথিবীর মধ্যেকার তেজ মহাবেগে জল ঠেলে আকাশের দিকে ছুটে বার হল আর তাতেই হল সব পর্বত! যে সময় পাহাড় হয়েছিল সে সময় কেউ দেখেনি কেমন করে কি হল, কিন্তু মানুষ ধ্যান করে অনুসন্ধান করে এই পাহাড়ের জন্ম যেন চোখে দেখে কেতাব লিখেছে।” “মাস্টার মশায়ের কথায় কি কেতাবগুলো অবিশ্বাস করবে!” বলে খোঁড়া একটি সমুদ্রের শাঁখ পাহাড়ের উপর থেকে তুলে নিয়ে রামছাগলকে দেখিয়ে বললে—“হিমালয় তো এককালে সমুদ্রের গর্ভে ছিল, এই শাঁখই তার প্রমাণ!” রামছাগল ঘাড় নেড়ে বললে—“ওকথা আমি বিশ্বাসই করিনে। নিশ্চয় কোনো পাখিতে এনে ওটাকে ফেলেছে।” খোঁড়া বললে—“তা হয় না। সমুদ্রের একেবারে নিচেয় থাকে এই শামুক, পাখি সেখানে যেতে পারে না।” রামছাগল তর্ক তুললে—“তবে মাছে খেয়েছে, সেই মাছ মরে ভেসে এসেছে সমুদ্রের ধারে, সেখানে পাখি তাকে খেয়ে শাঁখটা মুখে নিয়ে হিমালয়ে এনে ফেলেছে!” খোঁড়া ঘাড় নেড়ে বললে—“তাও হয় না। সমুদ্রে যেখানে এই শাঁখ থাকত, সেখানে মাছ কেন, মানুষ পর্যন্ত যেতে পারা শক্ত!” রামছাগল অমনি দাড়ি চুমড়ে বললে—“তবে মানুষ জানল কেমন করে এ শাঁখ সমুদ্রের তলাকার, পাহাড়ের উপরকার নয়।” সুবচনী পাছে তর্কে হেরে যায় রিদয় তাই তাড়াতাড়ি বলে ঊঠল—“জানো না, মানুষ ডুবুরি নামিয়ে মুক্তো তোলবার সময় এই সব শাঁখ কুড়িয়ে এনেছিল ঝুড়ি-ঝুড়ি!” রামছাগল শিং নেড়ে বললে—“ঝুড়ি থেকে তারি গোটাকতক শাঁখ হয়তো মাটিতে পড়ে গিয়েছিল।” হঠাৎ সুবচনী বললে—“তা নয়”—সুবচনী আরও কী বলতে যাচ্ছে অমনি ছাগল রেগে বললে—“তা যদি নয়তো নিশ্চয় আগে শাঁখের সব ডানা ছিল, উড়ে এসেছে হাঁসেদের মতো এই পাহাড়ে”। রিদয় অমনি বলে উঠল—“শাঁখের যদি ডানা থাকতে পারে তবে পাহাড়গুলোরও ডানা ছিল একথাই বা কেন বিশ্বাস করবে না?” সুবচনী অমনি বলে উঠল—“আর প্রজাপতির মাথায় রামছাগলের মুখই বা না হবে কেন, তা বল!” ভালুকে-শেয়ালে হাঁসে-ছাগলে তর্ক বেধে গেল, দেশের জানোয়ার সেই তর্কে যোগ দিয়ে চেঁচামেচি হট্টগোল বাধিয়ে দিলে। শিকরা বহরী বাসা বাজ তুরমুতি কাহা কুহী লগড় ঝগড় জোড়াথুতি ঠোঁট ভেটি ভাটা হরিতাল গুড়গুড় নানাজাতি কাক পেঁচা বাবুই বাদুড়। সবাই মিলে তর্ক লাগিয়েছে—“যাও-যাও হুঁদি খাও!” এমন সময় গণ্ডগোল শুনে পাহাড়ের গুহা থেকে বুড়ো লামা-ছাগল বেরিয়ে এলেন— অতি দীর্ঘকক্ষ লোম পড়ে উরু পর নাভি ঢাকে দাড়ি গোঁফে বিশদ চামর। ববম-বম ববম-বম বলতে-বলতে লামাকে আসতে দেখে সবাই তটস্থ, ভালোমানুষ হয়ে বসল। লামা বললেন—“তোমরা সব কি বৃথা তর্ক করছ? দেখ তর্ক কি ভয়ানক ব্যাপার, কোথায় তোমরা পড়া পড়বে, না, হাতা—হাতি বাধিয়েছ ভায়ে-ভায়ে—” অভেদ হইল ভেদ এ বড় বিরোধ কি জানি কাহারে আজি কার হয় ক্রোধ! ভ্রান্তজীব অন্ত না বুঝিয়ে কর দ্বন্দ্ব, কারো কিছু ঠিক নাই কেবল কহ মন্দ; উভয়ের মন তোরে মন্ত্রণা আমি কই, তর্কে নাহি মেলে কিছু গন্ডগোল বই; শুন বাক্য গুরুবাক্য করেছে প্রামাণ্য; একে পঞ্চ পঞ্চে এক, নাই কিচ্ছু অন্য! লামা-ছাগল লেকচার শেষ করলেন অমনি বোকা ছাগলের দল জাতীয় সঙ্গীত শুরু করে দিলে— জটজালিনী ক্ষুরশালিনী, শিংঅধারিণী গো— ঘনঘোষিণি ঘাস-খাদিনি, গৃহ-পোষিণি গো। চ্যেঁ ভ্যেঁ প্যেঁ পোঁ। সেই সময় ভূমিকম্পে পাহাড় টলমল করে উঠল, অমনি হাঁসেরা রিদয়কে নিয়ে আকাশে উড়ে পড়ল। সব জানোয়ার ভয়ে লেজ গুটিয়ে চুপ হয়ে রইল। লামা-ছাগল মাঝে দাঁড়িয়ে দুলতে থাকলেন আর বলতে থাকলেন, “একি দোলায় যে, এ্যঁ কি ভয়ানক বিয়াপার!” রামছাগল লামার গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে বললেন—“পর্বতটা পার্বতী-পাঠশালা-সমেত উড়বে না কি-এ্যঁঃ!”
অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর
যোগী-গোফা অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর রংপো নদীটি খুব বড় নদীও নয় ম্যাপেতেও তার নাম ওঠেনি। ঘুম আর বাতাসিয়া দুই পাহাড়ের বাঁকের মধ্যে ছোট একটি ঝরণা থেকে বেরিয়ে নদীটি পাহাড়ের গা বেয়ে দু-ধারের বনের মাঝ দিয়ে নুড়ি পাথর ঠেলে আস্তে-আস্তে তরাইয়ের জঙ্গলে নেমে গেছে, নদীর দু-পার করঞ্চা টেঁপারি তেলাকুচো বৈচী ডুমুর জাম এমনি সব নানা ফল নানা ফুল গাছে একেবারে হাওয়া করা, মাথার উপরে আকাশ সবুজ পাতার ছাউনীতে ঢাকা, তলায় সরু নদীটি ঝি-ঝি করে বয়ে চলেছে! এই পাখির গানে ভোমরার গুনগুনে ফুল-ফলের গন্ধে জলের কুলকুল শব্দে ভরা অজানা এই নদীর গলি পথ দিয়ে হাঁসেরা নেমে চলেছে আবার সিলিগুড়ির দিকে। উপরে মেঘ করেছে, বনের তলা অন্ধকার। শেওলা জড়ানো একটা গাছের ডাল এক থোকা লাল ফুল নিয়ে একেবারে নদীর জলে ঝুঁকে পড়েছে, তারি উপরে লাল টুপি নীল গলাবন্ধ সবুজ কোর্তা পরে-পরে মাছরাঙা নদীতে মাছ ধরতে বসেছে বাদলার দিনে। নদীর মাঝে একরাশ পাথর ছড়ানো; তারি কাছাকাছি এসে চকা হাঁক দিলে—“জির্‌ওবো, জির্‌ওবো।” অমনি মাছরাঙা সাড়া দিলে—“জিরোও-জিরোও।” আস্তে-আস্তে হাঁসের দল ঝরনার স্রোতে পিছল পাথরগুলোর উপর একে-একে উড়ে বসল। এমনি জায়গায়-জায়গায় জিরিয়ে-জিরিয়ে চলতে-চলতে সন্ধ্যা হয়ে এল, নিচের অন্ধকার পাহাড়ের চূড়োর দিকে আস্তে-আস্তে উঠতে আরম্ভ করলে, মনে হচ্ছে কে যেন বেগুনী কম্বলে ঘেরাটোপ দিয়ে একটার পর একটা পর্বত মুড়ে রাখছে, দেখতে-দেখতে আকাশ কালো হয়ে গেল, তারি মাঝে গোলাপী এক-টুকরো ধোঁয়ার মতো দূরের বরফের চুড়ো রাত্রের রঙের সঙ্গে ক্রমে মিলিয়ে গেল। পাহাড়ের গলিতে অন্ধকার যে কি ভয়ানক কালো, রিদয় আজ টের পেলে, নিজেকে নিজে দেখা যায় না, কোনদিক উপর কোনদিক নিচে চেনা যায় না। কিন্তু এই অন্ধকারেও ঘাঁটিতে-ঘাঁটিতে রাতের পাখিরা পাহারা দিচ্ছে। এ পাহাড়ে এক পাখি হাঁকলে—“হুহু বাতাস হুহু,” ও পাহাড়ের পাখি তারি প্রতিধ্বনি দিয়ে বলে উঠল—“ঘুটঘুট আঁধার ঘুটঘুট।” দুই পাখি থামল, আবার খানিক পরে দুই পাখি আরম্ভ করলে-“জল পিটপিট তারা মিটমিট।” বোঝা গেল এখনো বিষ্টি পড়ছে, দু-একটি তারা কেবল দেখা দিয়েছে। ভালুক-ভালুকী ঝরণার পথে জল খেতে নেমেছে, তাদের চেহারা দেখা যাচ্ছে না, কেবল বলাবলি করছে শোনা যাচ্ছে—“সেঁৎ-সেঁৎ।” একটা হরিণ কিম্বা কি বোঝা গেল না হঠাৎ বলে উঠল—“পিছল।” তারপরেই পাহাড়ের গা দিয়ে একরাশ নুড়ি গড়িয়ে পড়ল। রাতে যে এত জানোয়ার চারদিকে ঘোরাঘুরি হাঁকাহাঁকি করে বেড়ায়, তা রিদয়ের জ্ঞান ছিল না। আঁধারের মধ্যে কত কি উসখুস করছে, খুসখাস করছে, চলছে, বলছে—কত সুরে কত রকম গলায় তার ঠিক নেই। রিদয়ের মনে হল বাতাসটা পর্যন্ত যেন বনের সঙ্গে ফুসফাস করে এক-একবার বলাবলি করে যাচ্ছে। তখন রাত গভীর ঝিঁঝিঁ পোকা বলে চলেছে ঝিমঝিম, ঝরণা বলছে ঘুম-ঘুম, রিদয়ের চোখ ঢুলে আসতে লাগল। সেই সময় দূরে শোনা গেল—“ইয়া-হু ইয়া-হু” তারপরে একবারে রিদয়ের যেন কানের কাছেই ডেকে উঠল বিকট গলার কি এক জানোয়ার—“তোফা- হুয়া তোফা-হুয়া।” রিদয় চমকে উঠে শুনলে, কখনো এ-পাহাড়ে কখনো ও-পাহাড়ে দূরে-কাছে আগে-পাছে উপরে-নিচে যেন দলে-দলে কারা চীৎকার লাগিয়েছে—“ইয়াহু-ইয়াহু তোফা-হুয়া তোফা-হুয়া।” ভয়ে রিদয়ের গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠল। সে চকার গা ঘেঁষে শুধোলে—“একি ব্যাপার?” চকা অমনি বললে—“চুপ-চুপ কথা কয়ো না, ডালকুত্তা শিকারে বেরিয়েছে”—বলতে-বলতে ছায়ার মতো একটা হরিণ ওপার দিয়ে দৌড়ে জলের ধারে এসে থরথর করে কাঁপতে লাগল। ঠিক সেই সময় নদীর দুই পারে শব্দ উঠল—যেন একশো কুত্তা এক সঙ্গে ডাকছে—“হুয়া-হু হুয়া-হু হুয়া-হু!” ঝপাং করে জলে একটা ছায়া লাফিয়ে পড়ল, তারপর পিছল পাথরের উপর খুরের আঁচড় বসিয়ে ভিজে গায়ে হরিণ এসে রিদয়ের পাশে দাঁড়িয়ে জোরে-জোরে শ্বাস টানতে-টানতে কেবলি ঘাড় ফিরিয়ে চারদিকে চাইতে লাগল। চকা হরিণের ভয় দেখে বললে—“ডালকুত্তা রইল কোন পাহাড়ে তুমি এখানে ভয়ে কাঁপছ দেখি!” রিদয় বললে—“সে কি এই পাহাড়েই তো এখনি ডাকছিল কুকুরগুলো!” চকা হেসে বললে—“কুকুরগুলো নয়, একটা কুকুর ডাকছিল, তাও খুব দূরে। ডালকুত্তার ডাকের মজাই এই, একটা ডাকলে মনে হবে যেন দশটা ডাকছে—দূরে কাছে চারদিকে—ভয়ে কোনদিকে যাব ভেবে পাওয়া যায় না, বুদ্ধি লোপ পেয়ে যায়। ডালকুত্তার ডাক শুনে ভয় পেয়ে ছুটাছুটি করেছ কি মরেছ। ঠিক পায়ের শব্দ শুনে কুত্তা এসে তোমায় ধরেছে, যেখানে আছ সেইখানে বসে থাক চুপটি করে, তোমার সন্ধানও পাবে না ডালকুত্তা।” হরিণ চকার কথায় কতকটা সাহস পেলে বটে কিন্তু তখনো ভয়ে তার কান দুটো কেঁপে-কেঁপে উঠছে, এমন সময় পিছনে অন্ধকারে খেঁকশেয়াল খেঁক করে হেসে উঠল, হরিণছানাটা একলাফ দিয়ে একেবারে নদী টপকে উপরের পাহাড়ে দৌড় দিলে। চকা বলে উঠল—“কে ও খেঁকশেয়াল নাকি?” এই পাহাড়ে যে চাঁদপুরের শেয়াল এসে উপস্থিত হবে তা চকা ভাবেনি, আর খেঁকশেয়ালও মনে করেনি হাঁসেদের দেখা পাবে সে এখানে। শেয়াল আনন্দে চিংকার আরম্ভ করলে—“হুয়া-হুয়া হুয়া-উয়া বাহোয়া ওয়া-ওয়া!” চকা শেয়ালকে ধমকে বললে—“চুপ অত গোল করো না, এখনি ডালকুত্তা এসে পড়বে, তখন তুমিও মরবে আমরাও মরব।” শেয়াল একগাল হেসে বললে—“এবার আমি বাগে পেয়েছি ডালকুত্তা লেলিয়ে দিয়ে তবে ছাড়ব। সেদিন বড় যে হাঁসবাজি দেখানো হয়ে ছিল, এইবার শেয়ালবাজিটা দেখে নাও।” বলেই শেয়াল ডাকতে লাগল—“হুয়া-উহা হুয়া-উহা—তোদের জন্যে আমার আর দেশে মুখ দেখাবার যো নেই!” চকা নরম হয়ে বললে—“অত চেঁচাও কেন, তুমি আগে আমাদের সঙ্গে লেগেছিলে। আমাদের দলের লুসাই আর বুড়ো-আংলা দুজনকে খেতে চেয়েছিলে, তবে না আমরা তোমায় জব্দ করেছি, আমরা তো মিছিমিছি তোমার সঙ্গে লাগতে যাইনি।” শেয়াল দাঁত কড়মড় করে বললে—“ওসব আমি বুঝিনে, বিচার আমার কাছে নেই। বুড়ো-আংলাটিকে আমার দু-পাটি দাঁতের মধ্যে যদি হাজির করে দাও তো এবার ছাড়া পাবে, না হলে ডালকুত্তা এল বলে!” চকা মুখে সাহস দেখিয়ে বললে—“আসুক না কুত্তা, এই ঝরনার মধ্যে পাথরের উপরে আর আসতে হয় না—জলে নেমেছে কি কুটোর মতো কোথায় তলিয়ে যাবে তার ঠিক নেই। রিদয়কে আমরা কিছুতে ছেড়ে দেব না শেয়ালের মুখে, মরি সেও ভালো।” চকা খুব তেজের সঙ্গে এই কথা বললে বটে কিন্তু রিদয় দেখলে ভয়ে তার লেজের ডগাটি পর্যন্ত কাঁপছে। চকা চুপি-চুপি তাদের সবাইকে বললে—“সাবধান, বড় গোল এবারে, যে অন্ধকার উড়ে পড়বার যো নেই, ডালকুত্তা পাকা সাঁতারু, বিষম জোরালো, ঝরনা মানবে না সাঁৎরে উঠবে। সে জলের কুমির, ডাঙ্গার বাঘ বললেই হয়। সব সাবধান, যে যার সামলে, দেখতে না পায় পাথরের সঙ্গে মিশিয়ে বস!” হাঁস অমনি ডানায় মুখ ঢেকে গুটিসুটি হয়ে এক-এক পাথরের মতো এখানে-সেখানে চেপে বসল, কালো বুনো হাঁসের ডানার রঙে পাথরের রঙে এমন এক হয়ে গেল যে, দু-হাত তফাৎ থেকে চেনা যায় না, হাঁস কি পাথর। কিন্তু সুবচনীর হাঁস—তার শাদা রঙ অন্ধকারেও ঢাকা গেল না, সে রিদয়কে বুকের কাছে নিয়ে বললে—“দেখ ভাই এবার তোমার হাতে মরণ-বাঁচন।” রিদয় নিজের টেঁক থেকে নরুনের মতো পাতলা ছুরিটি বার করে বললে—“দেখছ তো আমার অস্তর!” হাঁস বললে—“অস্তরে ভালো করে শান দিয়ে রাখ ভাই।” ঠিক সেই সময় উপর থেকে একবার ডাক এল—“ইয়াহু!” তারপরেই ঝপাং করে জলে পড়ে ডালকুত্তা হাঁসের দিকে সাঁৎরে আসছে দেখা গেল। শেয়ালটা ঝোপের আড়াল থেকে চেঁচিয়ে উঠল—“হুয়া-হুয়া হত্যা হুয়া!” শেয়াল দেখলে, কুত্তা জল থেকে একটা বাঁকা-নখওয়ালা লাল থাবা শাদা হাঁসটির দিকে বাড়িয়ে দিলে। হাঁসটা কখন ক্যেঁক করে ওঠে শেয়াল ভাবছে ঠিক সে সময় ডালকুত্তা “উঁয়াহুঃ” বলে ডিগবাজি খেয়ে জলে পড়ে হাবুডুবু খেতে-খেতে হাঁচড়ে-পাঁচড়ে ওপারে উঠল, আর ডানা ঝটপট করে হাঁসের দল অন্ধকার দিয়ে একদিকে উড়ে পালাল। শেয়ালের ইচ্ছে হাঁসের পিছনে তাড়া করে চলে, কিন্তু ব্যাপারটা হল কি সেটা জানতে তার লোভ হচ্ছে, সে ওপর থেকে ডালকুত্তাকে ডাক দিয়ে শুধোলে—“ক্যায়াহুয়া ক্যোয়া-হুয়া?” রিদয়ের নরুনের ঘায়ে তখন ডালকুত্তা অস্থির! সে রেগে বললে—“চোপরাও যাও-যাও!” শেয়াল বললে—“কি দাদা হাত ফসকে গেল নাকি?” কুত্তা গা ঝাড় দিয়ে বললে—“শাদা হাঁসটাকে টেনে নিয়েছিলুম আর কি, কি জানি সেই সময় টিকটিকির মতো একটা কি জানোয়ার হাতে এমন দাঁত বসিয়ে দিলে যে, চোখে আমি সরষে-ফুল দেখলুম!” কুত্তা তার থাবা চাটতে বসে গেল। শেয়াল “হাঃ-গিয়া হাঃ-গিয়া” বলে কাঁদতে-কাঁদতে হাঁসেদের সঙ্গে আবার দৌড়ল। হাঁসের রিদয়কে নিয়ে দুই পাহাড়ের গলির মধ্যে দিয়ে কেবল কুলকুল জলের শব্দটি ধরে এঁকে-বেঁকে উড়ে চলেছে অজানা জায়গায়, কোথায় গিয়ে বসে ঠিক পাচ্ছে না, এমন সময় মেঘ কেটে আকাশে চাঁদ উঠল, তখন আর চকাকে পায় কে, ঝকঝকে সরু সাপের মতো নদীর ধারাটির উপরে চোখ রেখে চকা হাঁসের দলকে নিয়ে সোজা নিচ মুখে নেমে চলল। সিনিবালি চা-বাগানের উপরটায় এসে নদী একটা বড় পাথর ঘুরে ঝরনা দিয়ে একেবারে দুশো হাত নিচে পড়েছে, চাতালের মতো সেই পাথরে এসে চকা দলবল নিয়ে বাকি রাতটা কাটাতে বসল। ঝরনার একদিকে ধাপে-ধাপে চা-বাগান পাহাড়ের চুড়ো পর্যন্ত সিঁড়ির মতো উঠে গেছে, আর একদিকে বনের ধারে চা-বাগানের মালিকের ঘরবাড়ি, সেখান থেকে পাকদণ্ডি নেমেছে ঝরনা পর্যন্ত। হাঁসেরা রাতে এখানে-ওখানে উড়ে হাঁপিয়ে পড়েছিল, সবাই তারা ঘুমিয়ে পড়ল, রিদয় কেবল জেগে পাহারা দিতে লাগল। খানিক রাতে বনের মধ্যে একটা ঝটাপট শব্দ শোনা গেল, তারপরেই রিদয় দেখলে ডালকুত্তার সঙ্গে শেয়াল কি ফুসফাস করতে-করতে পাকদণ্ডি দিয়ে নামছে, অন্ধকারে দুজনের চোখ আগুনের মতো জ্বলছে। রিদয় তাগ করে একটা পাথর কুচি ছুঁড়ে শেয়ালটাকে মারতে যাবে ঠিক সেই সময় একটা পাহাড়ি সাপের গায়ে তার হাত পড়ল, ঠাণ্ডা যেন বরফ! রিদয় একেবারে হাঁসের পিঠে লাফিয়ে উঠে বললে—“পালাও-পালাও, শেয়ালটা এবারে আমাদের সাপে খাওয়াবার মৎলব করেছে।” হাঁসেরা একেবারে ডানা মেলে আকাশে যেমন লাফিয়ে উঠল, ঠিক সেই সময় পাথরের হাতুড়ির মতো পাহাড়ি সাপের মাথাটা সোঁ করে তাদের পায়ের নিচে দিয়ে ছুটে এসে পাথরে ছোবল দিলে। চকা শিয়ালের উপর ভারি চটেছে, নদীর উপর দিয়ে গেলে শেয়ালটা সহজে তার সঙ্গ ছাড়বে না বুঝে চকা এবারে একেবারে উপর দিয়ে উড়ে চলল, সোজা সিলিগুড়ির স্টেশনের টিনের ছাতের দিকে। দাৰ্জিলিঙ মেল আসতে এখনো তিন ঘণ্টা। স্টেশনে লোকজন নেই, হোটেলগুলোর টিনের ছাত বিষ্টিতে ভিজে চাঁদের আলোয় ঝকঝক করছে। পাহাড়ের অন্ধকার ছেড়ে হঠাৎ ফাঁকায় পড়ে রিদয়ের ধাঁধা লেগে গেল। আকাশ থেকে সে টিনের ছাতগুলোকে দেখছে যেন ছোট-ছোট পাহাড়ের চুড়ো শাদা বরফে ঢাকা! হাঁসেরা সেই দিকে নেমে চলল দেখে রিদয় চেঁচিয়ে বললে—“কর কি, ওখানে যে খালি বরফ, বসবার জায়গা কোথা!” কিন্তু হাঁসেরা তার কথায় কান না দিয়ে নেমেই চলল! রিদয় দেখলে পাহাড়ের মধ্যে দাঁড়িয়ে আকাশে দুই হাত ছড়িয়ে একটা যেন দৈত্য লাল সবুজ দুটো চোখ নিয়ে কটমট করে তার দিকে চেয়ে রয়েছে! রিদয়ের আরো ভয় হল। সে দুই পা গুটিয়ে হাঁসের পিঠের পালকে লুকোবার চেষ্টা করছে এমন সময় হাঁসেরা ঝুপঝাপ করে স্টেশনের টিনের ছাতে নেমে পড়ল। তখন রিদয়ের ভুল ভাঙল, সে দেখলে রাস্তার আলোগুলোকে ভেবেছিল সব তারা, টিনের ছাদগুলোকে পাহাড়ের চুড়ো—আর লাল সবুজ লণ্ঠন দেওয়া সিগনেল পোস্টটাকে একটা দৈত্য। রিদয় স্টেশন কখনো দেখেনি, টিনের ছাতে ছুটোছুটি করে এদিক-ওদিক দেখতে আরম্ভ করলে, স্টেশনের সব উঁচু চুড়োর দুটো কাঁটা উত্তর দক্ষিণ কোনদিকে বাতাস বইছে দেখবার জন্যে কেবলি ঘুরছে, তারি উপরে একটি গোলা, সেই গোলায় এক-পা রেখে আকাশে চিমটের মতো দুই ঠোঁট উঠিয়ে কঙ্ক-পাখি আরামে ঘুম দিচ্ছেন। রিদয়কে টিনের উপর ছুটোছুটি করতে শুনে কঙ্ক-পাখি গোলার উপর থেকে ধমকে উঠলেন—“গোল করে কে?” রিদয়ের দুষ্টুমি গেছে কিন্তু ফষ্টিনষ্টি করবার বাতিক এখনো খুব আছে। সে অমনি বলে উঠল—“গোল আর করবে কে, গোলের মাঝে বসে আছ তুমি, তোমারি এ কাজ!” “ভালো রে ভালো বলেছিস” বলে কঙ্ক-পাখি চিমটের মতো ঠোঁটে গিরগিটির মতো রিদয়কে ধরে বার কতক আকাশে ছুঁড়ে দিয়ে আবার লুফে নিয়ে আদর করে বললে—“দেখ ছোকরা, এত রাত্রে ছাতে খুটখাট করলে এখনি স্টেশন-মিস্ট্রেস মেমের ঘুম ভেঙে যাবে আর স্টেশন-মাস্টার এসে আমাদের উপরে গুলি চালাবে। যদি স্টেশন দেখতে চাও তো ওই জলের পাইপটা ধরে নেমে যাও কিন্তু খবরদার স্টেশনের জল খেও না, তাহলেই ম্যালেরিয়া হয়ে যুধিষ্ঠিরের চার ভাই যেমন একবার মরেছিলেন তেমনি তুমিও মরবে।” রিদয় বললে—“সে কেমন কথা?” কঙ্ক বললেন—“শোনো তবে বলি!” কথার নাম শুনেই চারদিক থেকে হাঁস পাখি যে-যেখানে ঘুমিয়ে ছিল চাঁদের আলোতে টিনের ছাতে বুড়ো কঙ্ক-পাখিকে ঘিরে বসল। চাঁদটাও যেন গল্প শুনতে কঙ্কের ঠিক পিঠের দিকে টিনের ছাদের কার্নিসে এসে বসল। কঙ্ক গলা খাঁকানি দিয়ে শুরু করলেন: আমাদের কঙ্ক বংশের শেষ অঙ্কের যে আমি, আমার স্বর্গীয় প্রপিতামহ ছোট-কঙ্ক, তার প্রস্বর্গীয় মধ্যম প্রপিতামহ মেঝো-কঙ্ক মহাশয়ের অতিবৃদ্ধ প্রপিতামহ ধর্মাবতার বড়-কঙ্ক—তিনি কাম্য বনে এক রম্য সরোবরে বাস করছেন, এদিকে একদিন হয়েছে কি, না ধর্মপুত্র যুধিষ্ঠিরের তৃষ্ণা পেয়েছে। বনের মধ্যে তেষ্টা পেয়েছে, খুঁজে-খাঁজে জল খেয়ে নিলেই হত, না হুকুম করলেন—‘ওরে ভীম জল নিয়ে আয়।’ ভীম চললেন—‘জল খুঁজে খুঁজে তাঁরও তেষ্টা পেয়ে গেল। সেই সময় আমাদের ধর্মাবতার বড়-কঙ্ক সে পুকুরে পাহারা দিচ্ছিলেন। সেই কতকালের পানা পুকুরটার দিকে ভীমের নজর পড়ল, জল দেখে ভীমের তেষ্টা যুধিষ্ঠিরের চেয়ে দুগুণ বেড়ে গেল। ভীম তাড়াতাড়ি পুকুরে নামলেন, অঞ্জলি ভরে বৃকোদর প্রায় পুকুরের অর্ধেক জল তুলে নিলেন দেখে আমার স্বৰ্গীয় প্রপিতামহের পিতামহের অতিবৃদ্ধ প্রপিতামহ বলে উঠলেন—‘অঞ্জলি করিয়া জল না করিহ পান, সমস্যা পু্রণ করি কর জল পান—নতুবা তোমার মৃত্যু।’ সমস্যা দিয়ে জল ফিলটার করে খাবার দেরি সইল না, বৃকোদর আমাদের ধর্মাবতারের পানা-পুকুরের পচাজল চকচক করে খেয়ে ফেললেন। যেমন খাওয়া, অমনি কম্পজ্বর সঙ্গে-সঙ্গে মৃত্যু। তার পর অর্জুন এলেন, নকুল সহদেব এলেন, দ্রৌপদী এলেন, সবার সেই দশা, কেউ সমস্যা দিয়ে জল শোধন করে নিতে চাইলেন না। শেষে যুধিষ্ঠির এসে ধর্মাবতার কঙ্কের কথা মতো চারবার সমস্যা দিয়ে জল শোধন করে তবে বেঁচে গেলেন; আর সেই শোধন করা শান্তি জল দিয়ে চার ভাই আর দ্রৌপদীকেও বঁচিয়ে দিলেন। রিদয় শুধোলে—“বারি শোধন করার সমস্যা কোথায় পাওয়া যায়, তার দাম কত?” কঙ্ক হেসে বললে—“সমস্যা কি জলের কুঁজো যে, বাজারে পাবে? সমস্‌কৃততে সমস্যা লেখা হয় মন্তরের মতো, সেইটে পাঠ করে বাঁ-হাতের বুড়ো আঙুলে এক নাক টিপে নাকের মধ্যে জল টেনে নিতে হয়, আর বলতে হয়, আদি গঙ্গা সাত সমুদ্র তেরো নদী বান্ধিলাম, দশঘড়ায় বান্ধিলাম, জিহ্বার উপর বান্ধিলাম, সরস্বতী যমুনা বন্ধ, মাতা গঙ্গাভাগিরথী ফুঃ ফুঃ ফুঃ। মন্তর যদি শিখতে চাও তো কামরূপ কামিখ্যেয় আমার হাড়গিলেদাদার কাছে যাও। সাপের মন্তর বাঘের মন্তর শেয়ালের মন্তর সব মন্তর তিনি জানেন, আর কোনো ভাবনা থাকবে না নিৰ্ভয়ে যেখানে খুশি বেড়িয়ে বেড়াতে পারবে।” চকা বলে উঠল—“এ পরামর্শ মন্দ নয়। খেঁকশেয়ালটা যে রকম সঙ্গে লেগেছে তাতে একটা শেয়ালের মন্তর রিদয়কে না শিখিয়ে নিলে তো আর চলছে না। সেই কৈলাস পর্যন্ত যেতে হবে, এর মধ্যে কত বিপদ-আপদ আছে—চল কিছুদিন কামরূপে থেকে গোটাকতক মন্তর নিয়ে যাওয়া যাক।” কঙ্ক বললেন—“চল, দাদার কাছে আমারো গোটাকতক মন্তর নেবার আছে।” চকাকে কঙ্ক শুধোলেন—“তোমরা কোন পথে কামরূপ যেতে চাও? ব্রহ্মপুত্রের পথে গেলে অনেক ঘুরে যেতে হবে, আর আমার সঙ্গে যদি সিধে রাস্তায় যেতে চাও তো এখান থেকে তরসা নদী একবেলা, সেখান থেকে জলপাইগুড়ি বক্সাও কুচবেহার হয়ে জয়িন্তী আর একবেলা, সেখানে রাত কাটিয়ে মোচু নদীতে জল খেয়ে গোয়ালপাড়া দশটার মধ্যে, সেখানে থেকে বেলা পাঁচটায় মানস নদী, ছটা নাগাদ কামরূপ কামাখ্যার মন্দির—সেখানে ব্রহ্মপুত্রের মধ্যে হাড়গিলের চরে আমার দাদা থাকেন।” চকা কঙ্ক-পাখির কথায় সায় দিয়ে তরসার পথেই বাঁয়ে হিমালয় পাহাড় রেখে সোজা পুবমুখী কামরূপে রওনা হল। খানিক উড়েই চকা বুঝলে কঙ্ক-পাখির সঙ্গে বেরিয়ে ভালো করেনি। তার নাম যেমন কঙ্ক চলাও তেমনি বঙ্ক, মোটেই সোজা নয়। সে সিলিগুড়ি ছেড়েই দক্ষিণমুখো চলল, মহানদীর ধার দিয়ে জলপাইগুড়ি স্টেশন হয়ে তিতলিয়া পর্যন্ত, সেখান থেকে উত্তরপুবে বেঁকে কুচবেহার ঘেঁষে বাৰ্ণিশ-ঘাট, তারপর তিস্তানদীর উপর দিয়ে এঁকতে-বেঁকতে উত্তর মুখে রামসাই হাট হয়ে বোগরা কুঠি, একেবারে পাহাড়তলীতে উপস্থিত, এখান থেকে সেখান থেকে পাহাড়ের বাঁকে-বাঁকে পুবে মাদারী পর্যন্ত। সেখান থেকে তরসা নদীর স্রোত ধরে দক্ষিণে এসে একেবারে কুচবেহারের রাজবাড়ির উপরে এসে পড়া, সেখান থেকে আবার উত্তর আলিপুর বক্সাও জয়িন্তী একেবারে জলপাইগুড়ি পরগনার পুব মোহড়ায় মোচু নদীতে হাজির। এর পরেই গোয়ালপাড়া আরম্ভ। এইভাবে এদিক-ওদিক একোণ-ওকোণ এপাড়া-ওপাড়া যেন কি খুঁজতে-খুঁজতে কঙ্ক-পাখি তীরবেগে চলেছে। তার সঙ্গে উড়ে চলা হাঁসদের সম্ভব নয়, কাজেই চকা নিজের পথ দেখে হাঁক দিতে-দিতে চলল—“তরসা—তরসা।” ওদিকে যেমন কুঁকড়ো, এদিকে তেমনি উত্তর থেকে দক্ষিণমুখো যে সব নদী চলেছে, তারি ঘাটে-ঘাটে কাদাখোঁচা দলপীপী ঘাটিয়াল হাঁক দিচ্ছে—“তরসা পশ্চিমকুল মাদারি!” মাদারি হয়ে তরসার উপর দিয়ে হাঁসেরা পাড়ি দিতে লাগল, দূরে ডাইনে কুচবেহারের রাজবাড়ি, তরসার পুবপারে রাজাদের জলকরে পানিকাক হাঁকলে—“বক্সাও।” আরও দূরে জলপাইগুড়ির সীমানায় তিতিরে হাঁকলে—“জয়িন্তি।” জলপাইগুড়ি ছাড়িয়ে গোয়ালপাড়ার মোচু নদীর কাছ বরাবর এসে হাঁসেরা আকাশ মেঘে অন্ধকার দেখলে, জোর বাতাস তাদের ক্রমেই উত্তরে পাহাড়ের গায়ে ঠেলে নিয়ে চলল। হাঁসেরা এঁকে-বেঁকে কখনো উত্তর ঘেঁষে একেবারে হিমালয়ের দেওয়ালের ধার দিয়ে কখনো দক্ষিণে ফাঁকা মাঠের উপর দিয়ে উড়ে চলল, সারাদিন। গোয়ালপাড়া ছাড়িয়ে কামরূপ মানস নদীর কাছ বরাবর এসেছে, এমন সময় পশ্চিম দিকে বোঁ-বোঁ সোঁ-সোঁ শব্দ উঠল যেন হাজার-হাজার পাখি উড়ে আসছে। পায়ের তলার মানস নদীর জল হঠাৎ কালো ঘোরাল হয়ে উঠল, দমকা হাওয়ার একটা ঝাপটা এসে হাঁসেদের ডানার পালকগুলো উস্কোখুস্কো করে দিলে। চকা ঝপ করে ডানা বন্ধ করে পলকের মতো চমকে যেন আকাশে স্থির হয়ে দাঁড়াল তারপরে তীরের মতে মানস নদীর দিকে নেমে চলল, ডাক দিতে-দিতে—“সামাল জমি লাও জমি লাও।” কিন্তু জমি নেবার আগেই ঝড় একেবারে ধুলো বালি শুকনো পাতা ছোট-ছোট পাখিদের ঠেলতে-ঠেলতে তরতর করে এসে পড়ল। বাতাসে জোরে মাঝ-দরিয়ার দিকে চকা নিকোবরের দলকে ঠেলে নিতে লাগল, জমি নেবার উপায় নেই। মানস নদীর পশ্চিম কূলে বিজলী-গাঁয়ের উপর দিয়ে ঠেলতে-ঠেলতে বাতাস হাঁসের দলকে দেখতে-দেখতে মাঝ-দরিয়ায় নিয়ে আসছে, সামনে মানস নদীর ওপারের ভাঙন-জমি পাহাড়ের মতে উঁচু, সেখানে হাওয়া যদি আছড়ে ফেলে, তবে একটি হাঁসও বাঁচবে না। ঘোরবারও উপায় নেই, ওদিকে মাঝনদীতে তুফান উঠেছে, ঝড়ের মুখে উড়ে গিয়ে সামনের ভাঙনে আছড়ে পড়লে মৃত্যু নিশ্চয়, তার চেয়ে জলে পড়ে বরং সাঁতরে বাঁচবার উপায় আছে স্থির করে সব হাঁস ঝুপঝাপ নদীতে নেমে পড়ল, শাদা-শাদা ফেনা নিয়ে চারদিকে সাপের ফনার মতো ঢেউ উঠছে-পড়ছে, একটার পিছে তেড়ে আসছে আর একটা, মাথার উপর ঝড় ডাকছে সোঁ-সোঁ, চারদিকে জল ডাকছে গোঁ-গোঁ, নদীতে একখানি নৌকা নেই, একটি ডিঙ্গিও নেই, কেবল মাঝনদীতে ঢেউয়ের উপরে-উপরে স্রোতের মুখে ভেসে চলেছে মোচার মতো হাঁস কটি। জলে পড়ে হাঁসেদের কোনো কষ্ট নেই। স্রোতে গা ভাসিয়ে একগাছ ছেঁড়া মালার মতো, ঢেউয়ের সঙ্গে উঠে পড়ে চলেছে। কেবল চকার ভয় হচ্ছে পাছে দলটা ছড়িভঙ্গ হয়ে পড়ে। তাই সে থেকে-থেকে ডাক দিচ্ছে—“কোথায়!” অমনি বাকি হাঁসের উত্তর দিচ্ছে—“হেথায়-হেথায়।” চকা একবার রিদয়কে ডাক দিচ্ছে—“হংপাল-হংপাল।” রিদয় অমনি উত্তর দিচ্ছে—“ভাসান-ভাসান।” আকাশ দিয়ে স্থলচর পাখিরা ঝড়ে লুটোপুটি হয়ে চলেছে। হাঁসের দিব্বি আছে দেখে তারা বলতে-বলতে উড়ে চলল—“সাঁতার-সাঁতার উ-উ-উ গেছি-গেছি-গেছি, মরি-মরি-মরি!” কিন্তু ঢেউয়ের উপর দিয়ে দড়ি ছেঁড়া নৌকার মতো দুলতে-দুলতে চলাতেও বিপদ আছে। চকা দেখলে হাঁসেরা ডানায় মুখ গুঁজে ঘুমিয়ে পড়বার যোগাড় করছে, সে অমনি সবাইকে সাবধান করতে লাগল—“ঘুমেসারা দলছাড়া, দলছাড়া, গেছ-মারা, চোক খোল চোখ মেল।” চকা বলছে বটে চোখ খোল কিন্তু নিজেরও তার চোখ ঢুলে এসেছে, অন্য হাঁসগুলো তো একঘুম ঘুমিয়েই নিচ্চে। ঠিক সেই সময় সামনের একটা ঢেউয়ের মাথায় পোড়া কাঠের মতো একটা কি ভেসে উঠল! চকার অমনি চটকা ভেঙে গেল—সে কুমির-কুমির বলেই দুই ডানার ঝাপট মেরে সোজা আকাশে উড়ে পড়ল, খোঁড়া হাঁস রিদয়কে নিয়ে যেমন জল ছেড়েছে আর কুমির জল থেকে ঝম্প দিয়ে তার খোঁড়াপায়ে একটা দাঁতের আঁচড় বসিয়ে ডুব মারলে। খোঁড়া ইস বলে এক লাফে আর পাঁচ হাত উপরে উড়ে পড়ল। কুমিরটা আর একবার জল থেকে নাটা-চোখ পাকিয়ে নাকটা তুলে এদিক-ওদিক করে ভুস করে ডুব মারলে। হাঁসের দল উড়তে-উড়তে খানিক গিয়ে আবার জলে পড়ল, কিন্তু সেখানেও আবার কুমির, আবার ওড়া, আবার গিয়ে জলে পড়া—এই ভাবে সারাদিন কাটল। কত ছোটপাখি যে এই ঝড়ে মারা পড়ল, পথ হারিয়ে একদিকে যেতে আর একদিকে গিয়ে পড়ল, না খেয়ে জলে ভিজে নদীতে পড়ে পাহাড়ে আছাড় খেয়ে কত যে পাখি মরে ঝরে গেল তার ঠিক-ঠিকানা নেই। চকার দল হাঁফিয়ে পড়েছে, এদিকে অজানা নদী, ওদিকে অচেনা ডাঙ্গা। পাহাড় থেকে জল বরফের মতো ঠাণ্ডা হয়ে গড়িয়ে চলেছে—ঝড়ে ভাঙা বড়-বড় গাছের ডাল ভেসে চলেছে, চকা দলবল নিয়ে একবার গাছের ডালে ভর দিয়ে জিরোবার চেষ্টা করলে কিন্তু ভিজে ডাল একেই পিছল তার উপরে আবার স্রোতে গড়িয়ে-গড়িয়ে চলেছে। বাতাস ক্রমাগত তাদের জলে ঠেলে ফেলতে লাগল, ওদিকে সন্ধ্যার আঁধার ঘনিয়ে এল, জলে থাকা আর চলে না, হাঁসেরা উড়ে পড়ল। আকাশে চাঁদ নেই, তারা নেই, কেবল কালো মেঘ আর বিদ্যুৎ, আর হুহু বাতাস, থেকে-থেকে পাখিরা ভয়ে চীৎকার করে উঠছে, জলের ধারে ঝুপঝাপ পাড় ভেঙে নদীতে পড়ছে, বজ্রাঘাতে বড়-বড় গাছ মড়মড় করে মুচড়ে পড়ছে, এরি মাঝ দিয়ে চকা তার দল নিয়ে ডাঙ্গায় আশ্রয় নিতে চলেছে। হঠাৎ এক সময় সামনে একটা গুনগুন আওয়াজ শোনা গেল, তারপরেই রিদয় দেখল হাওয়ার মতো একটা পাহাড়ের দেওয়াল নদী থেকে আকাশে উঠেছে আর তারি তলায় নদীর জল তুফান তুলে ঝপাঝপ পড়ছে। চকা সোজা পাহাড়ের দিকে চলেছে! রিদয় ভাবলে—এইবার শেষ, আর রক্ষে নেই, সে বিষ্টিতে কুয়াশায় ঝাপসা পাহাড়ের দিকে চেয়ে রয়েছে এমন সময় চকা ডাক দিলে—“বাঁয়ে ঘেঁষে।” দেখতে-দেখতে পাহাড়ের গায়ে প্রকাণ্ড খিলেনের মতো একটা গুহা দেখা গেল, চকা হাঁসের দল নিয়ে তারি মধ্যে সোজা ঢুকে পড়ল—সেখানে বিষ্টি নেই, জল নেই, বাতাসও আস্তে-আস্তে আসছে সোঁ-সোঁ করে। ডাঙ্গায় পা দিয়েই চকা দেখতে লাগল সেথো সবাই আছে কিনা। সবাইকে পাওয়া গেল, কেবল কঙ্ক-পাখি, যে তাদের পথ দেখিয়ে আনছিল তার কোনো খোঁজই হল না! গুহাটার মধ্যে শুকনো বালি কাঁকর আর ঘাস। হাঁসেরা তারি উপরে বসে ভিজে পালক ঝেড়ে-ঝুড়ে নিচ্ছে, চকা রিদয়কে নিয়ে গুহাটা তদারক করতে চলল। মস্ত গুহা, মুখের কাছটায় আলো পড়েছে, ভিতর দিকটা অন্ধকার, দু-ধারে দেওয়ালের গায় রেলগাড়ির বেঞ্চির মতো থাকে-থাকে পাথর সাজানো—একপাশে একটি ডোবা, তাতে পরিষ্কার বিষ্টির জল ধরা রয়েছে। রিদয় বলে উঠল—“বাঃ ঠিক যেন ধর্মশালাটি।” অমনি গুহার ওধারে অন্ধকার থেকে কারা বলে উঠল—“ধর্মশালাই বটে!” রিদয় ভয়ে কাঠের পুতুলের মতো দাঁড়িয়ে গেল। চকা এদিক-ওদিক ঘাড় ফিরিয়ে দেখলে অন্ধকারে এ-কোণে ও-কোণে জোড়া-জোড়া সবুজ চোখ পিটপিট করছে। “ওই রে বাঘ!” বলেই চকা রিদয়কে মুখে করে তুলে দৌড়! রিদয় চেঁচাচ্ছে—“বাঘ বাঘ!” সেই সময় অন্ধকরে থেকে জবাব হল—“ভ্যে-ভ্যে ভ্যেড়া!” এবার রিদয়ের সাহস দেখে কে, সে বুক ফুলিয়ে ভেড়াদের সর্দার দুম্বার কাছে গিয়ে শুধোলে—“এখানে যে তোমরা বড় এলে? এটা আমাদের ঘর, যাও!” দুম্বা তার কানের দু-পাশে গুগলী পেঁচ দুই শিং পাথরে ঘষে বললে— “এখানে আমরা ইচ্ছে সুখে এসে ধরা পড়ে কামিখ্যের ভেড়া বনে গেছি, যাব কোথায়, যাবার স্থান নেই।” রিদয় অবাক হয়ে বললে—“কি বল এই কামরূপ কামিখ্যের মন্দির? এইখানে মানুষকে তার ভেড়া ছাগল বানিয়ে রাখে!” হাঁও বটে নাও বটে, এই ভাবে ঘাড় নেড়ে দুম্বা বললে—“এটা কি গোয়াল না এটা আমাদের বাড়ি—এটা একটা যাদুঘর। এখানে যা দেখছ সব ইন্দ্রজাল, ভৌতিক ব্যাপার। এদিক দিয়ে পাখিরা পর্যন্ত উড়ে চলতে ভয় পায়, তোমরা কার পরামর্শে এখানে এলে শুনি? মহাভারতের ধর্মাবতার কঙ্ক তার কোনো পুরুষের কেউ নয়, সেই বকাধাৰ্মিক কঙ্কপাখির সঙ্গে তোমাদের পথে দেখা হয়নি তো?” কঙ্ক-পাখির পাল্লায় পড়েই তারা এদিকে এসেছে শুনে দুম্বা হা-হুতাশ করে বললে—“এমন কাজও করে, বকাধার্মিকের কাজই হচ্ছে নানা ছলে লোককে ভুলিয়ে এই কামরূপে এনে মানুষকে ভেড়া, ভেড়াকে ছাগল বানিয়ে দেওয়া, এটা বুঝলে না—কি আপশোষ!” রিদয় ভয় পেয়ে বলে উঠল—“এখন উপায়!” দুম্বা খানিক ভেবে বললে—“উপায় আর কি, এক উপায় যদি বকধাৰ্মিক এই ঝড়ে রাস্তা ভুলে অন্যদিকে গিয়ে পড়ে থাকে তবেই তোমরা এবারের মতো বেঁচে গেলে।” চকা শুধোলে—“আর সে যদি এসে পড়ে তো কি হবে?” দুম্বা উত্তর করলে—“সে এসে ঠোঁট দিয়ে তোমাদের মাথা ফুটো করে যা কিছু বুদ্ধি আছে মগজের সঙ্গে সবটুকু বার করে নেবে; আর তোমরা কেউ বোকা ছাগল, কেউ মেড়া কেউ ভেড়া হয়ে আ—আ করে তাকেই তোমাদের ভেড়া বানিয়ে দেবার জন্যে বাহবা ধন্যবাদ দিতে থাকবে।” রিদয় রেগে বলে উঠল—“মাথা ফুটো করতে দিলে তবে তো? যেমন দেখব সে আসছে, অমনি আমরা সরে পড়ব না?” দুম্বা শিং নেড়ে বললে—“তা হবার যো নেই, সে ধুলোপড়া দিয়ে সবার চোখে ধুলো দিয়ে কখন যে কাজ উদ্ধার করে যাবে তোমরা টেরও পাবে না। মনে হবে, কে তোমাদের মাথা চুলকে দিচ্ছে, তোমরা ঘুমিয়ে পড়বে আরামে। তারপর চোখ খুলে দেখবে ভেড়া হয়ে গেছ।” চকা এগিয়ে এসে শুধোলে—“এত বোকা ছাগল বোকা মেড়ায় তার কি দরকার বলতে পার?” দুম্বা থানিক চোখ বুজে বললে—“ঠিক জানিনে, তবে শুনেছি নাকি”—বলেই দুম্বা হঠাৎ চুপ করে এদিক-ওদিক চাইতে লাগল। রিদয় ব্যস্ত হয়ে শুধালে—“কি শুনেছ বলেই ফেল না।” দুম্বা আরো ব্যস্ত হয়ে বললে—“চুপ-চুপ অত চেঁচিও না, কাজ কি বাবু ওসব কথায়, শেষে কি ফ্যেঁসাদে পড়ব? কে কোন দিকে শুনবে, শেষে আমাকে নিয়ে টানাটানি। যাক ও কথা, কুবরী-কুবরী”—বলে দুম্বা চোখ বুজল। রিদয় অনেক পেড়াপীড়ি করেও কুবরী ছাড়া আর একটি কথাও বোকাছাগলের মুখ দিয়ে বার করতে পারলে না। চকা চুপিচুপি রিদয়কে বললে—“তুমিও যেমন, বোকামেড়া ও, ওর কথার আবার মূল্য আছে? নিশ্চয় ওটার মাথার গোল আছে, এস এখন খেয়ে-দেয়ে একটু বিশ্রাম করা যাক, সকালে উঠে নিজের পথ নিজে দেখা যাবে।” তারপর দুম্বার দিকে চেয়ে বললে—“মশায় যদি জানতেন আমরা আজ সারা রাস্তাটা কি কষ্টে কাটিয়ে এখানে এসেছি, তবে এই রাতে আমাদের মিছে ভয় দেখিয়ে তাড়াবার চেষ্টা না করে বরং কিছু অতিথি সৎকারের বন্দোবস্ত করে দিতেন। আমরা নিতান্ত দায়ে পড়েই এখানটায় আশ্রয় নিয়েছি, এখন উচিত হয় আপনার আর কালবিলম্ব না করে আমাদের জন্যে জলযোগ এবং তারপরে সুনিদ্রার ব্যবস্থা করে দেওয়া।” এবারে দুম্বা অন্ধকার কোণ থেকে বেরিয়ে এসে বললে—“আপনারা আমার কথায় বিশ্বাস করছেন না, আচ্ছা আমি আপনাদের খাবার ব্যবস্থা করছি; দেখুন কি কাণ্ড হয়, তখন কিন্তু আমায় দোষ দিতে পারবেন না।” চকা এবার সত্যিই ভয় পেলে, কোনদিক থেকে কি বিপদ আসে ভেবে চারিদিক চাইতে লাগল। দুম্বা ডাকলে—“আসুন আহার প্রস্তুত কিন্তু দেখবেন চটপট আহার সেরে উঠবেন, না হলে ব্যাঘাত হতে পারে। আপনার আসন গ্রহণ করুন আমি এখানে দাড়িয়ে আসন-বন্ধন মন্ত্রটি পাঠ করছি।” রিদয় আর হাঁসের খেতে বসে গেল। দুম্বা মন্ত্র পাঠ করতে লাগল— মেষ চর্মের আসন তোরে করিরে পেন্‌নাম আমার এই কার্যে তুই হ রে সাবধান। কামিখ্যার বরে তোরে করিলাম বন্ধন এ কার্যে যেন তুই না হোস লঙ্ঘন।। হাঁসেদের অর্ধেক খাওয়া হয়েছে এমন সময় দূরে ফেউ ডাকল। দুম্বা মন্তর জপতে-জপতে বললে—“ওই শুনছেন তো এঁরা আসছেন, এরি মধ্যে খবর হয়ে গেছে। ব্যাঘাৎ হল চটপট খেয়ে নিন” বলেই দুম্বা তাড়াতাড়ি মন্তর পড়তে লাগল: লাগ-লাগ ফেরুপালের দন্তের কপাটি কোনো ভূতে করিতে নারিবে আমার ক্ষতি শীঘ্রি লাগ শীঘ্রি লাগ। মন্তরের চোটে কেউ ঘরে ঢুকতে সাহস পেলে না বটে কিন্তু বাইরে চারদিকে ফেরুপাল চিৎকার করে কানে তালা ধরিয়ে দিতে লাগল—“হুয়া-হুয়া, খাওয়া হুয়া, হুয়া খাওয়া, হুয়া খাওয়া।” রিদয় বললে—“এত গোল করে কে?” রিদয়ের কথা তখন আর কে শোনে? তখন দুম্বা “ব্যেঘাৎ-ব্যেঘাৎ” বলে চেঁচাচ্ছে আর ঘরের মাঝে ছুটোছুটি করে বেড়াচ্ছে, যেন সর্বনাশ হচ্ছে। রিদয় দুম্বার রকম দেখে চেঁচিয়ে বললে—“আরে মশায়, ব্যাপারটা কি খুলে বলুন না, অত বুক চাপড়ে ছুটোছুটি করচেন কেন?” দুম্বার তখন ভয়ে মাথা ঘুলিয়ে গেছে সে কাঁপতে-কাঁপিতে বললে—“সর্বনাশ হল, হায়-হায় কি উপায়, কি উপায়!” রিদয় আরো চটে বললে—“আরে মশায় হয়েছে কি তাই বলুন না?” দুম্বা তখন একটু স্থির হয়ে বললে—“ওই খেঁকি-খেঁক-খেঁকি খেঁকশেয়ালী ওই তিন ফেরুপাল ওঁরা যদি আমাদের দেওয়া মুড়ো কিম্বা ভেড়ার মাংস না খেতে চান তো কি হবে এখন।” রিদয় হেসে বললে—“এই জন্যে এতো ভয়, তা ওঁরা যদি আপনাদের মুড়ো মাংস না খান তো আপনাদেরই তো লাভ, এতে আপনার দুঃখুই বা কি, ভয়ই বা কি?” দুম্বা শিং নেড়ে বললে—“আহা আপনি বুঝেন না, ওঁদের মুড়ো মাংস খাওয়ানো যে ভেড়াবংশের সনাতন প্রথা, সেটা বন্ধ হলে যে আমাদের জাত যাবে, আমরা একঘরে হয়ে যাব, তার করলেন কি?” রিদয় গম্ভীর হয়ে বললে—“আগে আপনি কি করতে চান শুনি!” দুম্বা কেঁদে বললে—“আমি এ প্রাণ আর রাখব না—আমি সমাজদ্রোহী, আমি নরকে যাব স্থির করেছি, আমি অতি হতভাগ্য।” রিদয় দুম্বার শিংএ হাত বুলিয়ে বললে—“ওদের ঠাণ্ডা করবার কি আর কোনো উপায় নেই!” দুম্বা ঘাড় নেড়ে বললে—“আর এক উপায়—তুষানলে জ্বলে পুড়ে মরা, কিন্তু তার চেয়ে নরককুণ্ডে ঝাঁপিয়ে পড়াই সহজ!” রিদয় বলে উঠল—“কাজ আরো সহজ হয় ওই তিনটে কুকুরকে নরকে পাঠিয়ে দেওয়া!” দুম্বা দুই চোখ পাকল্‌ করে অবাক হয়ে বললে—“একি সম্ভব!” রিদয় বললে—“দেখি তোমার শিং, খুব সম্ভব এক ঢুঁয়ে তিনটেকে একেবারে নরকে চালান করে দেওয়া যায় যদি তুমি তাল ঠুকে লাগ!” দুম্বা বলল—“তাল ঠুকে ঢুঁ লাগাতে আমি মজবুত কিন্তু ওদের দেখলেই যে আমাদের বুদ্ধি লোপ পায়, তার কি?” রিদয় দুম্বার পিঠ চাপড়ে বললে—“তোমরা চোখ বুজে থেক—আমি যেমন বলব ‘শিং টিং চট্‌’ অমনি একসঙ্গে সবাই ঢুঁ বসিয়ে দিও, দেখি ওরা কি করে!” এবারে অন্য-অন্য ভেড়া তুলাড়ু ঝাঁকাড়ু, তারা এগিয়ে এসে বললে—“আমরা দু-একটা কথা বলতে চাই, আমরা ঢুঁসোতে রাজী কিন্তু তার আগে ভেবে দেখা কর্তব্য যে ফেরুপালদের সরিয়ে দিয়ে কি আমরা চলতে পারব? তারা হলেন আমাদের ধোপা নাপিত এবং চরাবার কর্তা, ধরতে গেলে মেষবংশের মাথা। রাজদ্বারে শ্মশানে চ ওঁরা আমাদের বান্ধব, আত্মীয়, কুটুম্ব বললেই হয়। ওঁরা মাঝে-মাঝে আমাদের চিরুণী দাঁতে টেনে, নখে আঁচড়ে, রোঁয়া ছেঁটে, চাম ছাড়িয়ে, চেটে-পুটে সাফ না করে দিলে—কে মড়মড়ায় কে পড়পড়ায় কে ভাঙে খড়ি? আমাদের গা-শুদ্ধি হবারই যো নেই যদি না পাল-পার্বণে তাঁদের মাঝে-মাঝে মেষ চর্মের আসনে বসিয়ে মেষমাংসে না আমরা মুখশুদ্ধি করিয়ে দিতে পারি, এছাড়া আমরা খাঁড়া আর হাড়িকাট সামনে রেখে হাড়িপ-বাবা আর হাঁড়ি-ঝী মাতাজীর কাছে প্রতিজ্ঞা করেছি—তুমি খণ্ডা দ্বিখণ্ডা সুমুক্তি বাহার গরল ভাবহং মানুরিক্ত ঘুমাইয়া আছি স্মটিকের মুণ্ডি! আমাদের এ মাথায় কোনো কাজ করতে গেলেই গুরুর কোপে পড়তে হবে, প্রতিজ্ঞাভঙ্গ পাপে লিপ্ত হয়ে নরকেও যেতে হবে, এর জবাব আপনি কি দেন?” রিদয়কে আর কোনো জবাব দিতে হল না—খেঁকি-খেঁক-খেঁকি খেঁকখেকানি তিনটে হেঁড়েল হঠাৎ এসে তিন মেড়ার লেজ ধরে টেনে নিয়ে চলল, হাঁসেরা ডানা ঝটাপট করে গুহার মধ্যে অন্ধকারে উড়ে বেড়াতে লাগল, রিদয় তাড়াতাড়ি দুম্বার পিট চাপড়ে দুই হাতে তার ঘাড় বেঁকিয়ে ধরে হুকুম দিলে—“শিং টিং চট্‌, দে ঢুঁসিয়ে চটপট।” দুম্বা আর ভাবতে সময় পেলে না, অন্ধকারে সামনে আর ডাইনে-বাঁয়ে তিন ঢুঁ বসিয়ে দিলে। খটাশ-খটাশ করে তিনটে হাঁড়িমুখো হাড়খেগো হেঁড়েলের মাথার খুলি ফেটে চৌচির হয়ে গেল! ঠিক সেই সময় বাইরে দুদ্দাড় করে ঝড়বৃষ্টি নামল— শিল পড়ে তড়বড় ঝড় বহে ঝড়ঝড় হড়মড় কড়মড় বাজে—ঘন-ঘন ঘন-ঘন গাজে! ঝঞ্ঝনার ঝঞ্ঝণী বিদ্যুৎ চকচকি হড়মড়ি মেঘের ভেকের মকমকি ঝড়ঝড়ি ঝড়ের জল ঝরঝরি তড়তড়ি শিলার জলের তরতরি ঘুটঘুট আঁধার বজ্রের কড়মড়ি সাঁই-সাঁই বাতাস শীতের থরথরী। ভেড়াগুলো কুরবী-কুরবী বলতে-বলতে এ ওর মুখের দিকে ফ্যেলফ্যেল করে চেয়ে আছে, এমন সময় ঝড়ে একখানা পাথর খসে গুহার মুখটা একেবারে দরাজ হয়ে কত বড় যে হয়ে গেল তার ঠিক নেই! ঝড় থামলে সেই খোলা পথে সকালের আলো এসে গুহার মধ্যে সবাইকে জাগিয়ে দিলে। চকা সেই আলোতে ডানা মেলে রিদয় আর খোঁড়া আর কাটচাল আর নানকৌড়িকে নিয়ে হাড়গিলের চরে যেখানে আণ্ডামানি লালসেরা হাঁসদের বড় দলটা নিয়ে অপেক্ষা করছে, সেই দিকে চলল। ভেড়ার দল হঠাৎ কতকালের অন্ধকার গুহার মধ্যে দিনের আলো পেয়ে প্রথমটা অনেকক্ষণ ধরে হতভম্বের মতো আকাশের দিকে চেয়ে রইল, তারপর আস্তে-আস্তে পাহাড়ের উপর বুনো ভেড়ার দলে মিশে দিব্বি চরে বেড়াতে লাগল। রাতের কথা, রিদয়ের কথা, হাঁসদের কথা কোনো কথাই তাদের মনে রইল না। তারা যেন চিরকালই বুনো ভেড়া এইভাবে সহজে খোলা আকাশের নিচে পাহাড়ের চাতালে-চাতালে ঘাস খেয়ে পাতা-লতা খেয়ে মনের সুখে দিন কাটাতে লাগল! ভেড়াদের মধ্যে দুম্বাই কেবল মনে রাখতে পারলে রিদয় কেমন করে, তাদের নরককুণ্ডের মুখের কাছ থেকে পাহাড়ের উপরকার এই খোলা জায়গায় পৌছে দিয়ে গেছে, সেখানে স্বচ্ছন্দে চরে বেড়াতে কোনো বাধা নেই! দলের ভেড়ারা সন্ধ্যেবেলায় অভ্যেস মতো যখন তাদের পুরোনো ঘর গুহাটার দিকে চলল তখন দুম্বা তাদের এক-এক ঢুঁ মেরে বনের দিকে ফিরিয়ে দিলে।
অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর
শৃগাল অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর মেঘনার মোহানায় চর যে কখন কোথায় পড়ে, তার ঠিক-ঠিকানা নেই। আজ যেখানে জল, কাল সেখানে দেখা গেল চড়া পড়ে বালি ধূ-ধূ করছে; কাল যেখানে দেখেছি চরে উলু-ঘাস, বালু-হাঁস; বছর ফিরতে সেখানে দেখলেম চরও নেই, হাঁসও নেই—অগাধ জল থৈথৈ করছে! এক-রাতের মধ্যে হয়তো নদীর স্রোত ফিরে গেল—জলের জায়গায় উঠল বালি, বালির জায়গায় চলল জল। বাগদী-চরে হাঁসেরা যখন উড়ে বসল, তখন চরের চারদিকে জল—ডাঙা থেকে না সাঁতরে চরে আসা মুশকিল। অপার মেঘনার বুকে একটুকরো ময়লা গামছার মতো ভাসছিল চরটি, কিন্তু রাত হতেই জল ক্রমে সরতে লাগল, আর দেখতে-দেখতে সরু এক-টুকরো চড়া, ডাঙা থেকে বাগদীচর পর্যন্ত, একটি সাঁকোর মতো দেখা দিলে। চাঁদপুরের জঙ্গলে বসে খেঁকশেয়ালী হাঁসের দলের উপরে নজর রেখেছিল; কিন্তু চকা-নিকোবরকে সে চেনে; এমনি বেছে-বেছে নিরাপদ জায়গায় চকা তার দল নিয়ে রাত কাটাত যে এপর্যন্ত তার দলের একটি হাঁস শিয়ালে ধরতে পারেনি। মেঘনার পুব-তীরের জঙ্গল ভেঙে রাতের বেলায় খেঁকশেয়ালী শিকারে বেরিয়েছে, এমন সময় জলের বুকে কুমীরের পিঠের মতো সরু সেই চরটির দিকে চোখ পড়ল। এক লাফ দিয়ে সে চর ডিঙিয়ে পায়ে-পায়ে অগ্রসর হল। খেঁকশেয়ালী প্রায় হাঁসের দলে এসে পড়েছে, এমন সময় ছপ-করে একটা ডোবার জলে তার পা পড়ল; আমনি চকা চমকে উঠে ডাক দিলে—“কেও?” আর সব হাঁস ডানা ঝেড়ে উড়ে পড়তে আরম্ভ করলে; সেই অবসরে তীরের মতো ছুটে গিয়ে শেয়াল লুসাই-হাঁসের ডানা কামড়ে ধরে হিড়-হিড় করে সেটাকে ডাঙার দিকে নিয়ে চলল। সব হাঁসের সঙ্গে ভয় পেয়ে খোড়া হাঁসও ডানা ছাড়িয়ে আকাশে উঠল; কেবল রিদয় হাঁসের ডানা থেকে ঝুপ-করে মাটিতে পড়ে চোখ-রগড়ে চেয়ে দেখলে অন্ধকারে সে একা, আর দূরে একটা কুকুর হাঁস ধরে পালাচ্ছে। অমনি রিদয় হাঁসটা কেড়ে নিতে শেয়ালের সঙ্গে ছুটল। মাথার উপর থেকে খোঁড়া হাঁস একবার হাক দিলে—“দেখে চল!” কিন্তু রিদয় তখন হৈ-হৈ করে ছুটেছে। রিদয়ের গলা পেয়ে লুসাই কতকটা সাহস পেলে, কিন্তু বুড়ো-অঙুলের মতো ছেলে কেমন করে শেয়ালের মুখ থেকে তাকে বাঁচাবে, এটা তার বুদ্ধিতে এল না। এত দুঃখেও লুসায়ের হাসি এল। সে প্যাঁক-প্যাঁক করে হাসতে-হাসতে চলল। মাথার উপরে খোঁড়া হাঁস রিদয়ের সঙ্গে-সঙ্গে চলেছে; তার ভয়—পাছে রিদয় খানায়-ডোবায় পড়ে হাত-পা ভাঙে। কিন্তু যক্ হয়ে অবধি খুব অন্ধকার রাতেও যকের মতো রিদয় দেখতে পাচ্ছে। খানা-খন্দ লাফিয়ে দিনের বেলার মতো রিদয় সহজে ছুটেছে আর চেঁচাচ্ছে—“ছেড়ে দে বলছি, না হলে এক ইট মেরে পা খোঁড়া করে দেব!” কে তার কথা শোনে? শেয়াল এক লাফে চড়া ছেড়ে পারে উঠে দৌড়ে চলল। রিদয়ও চলেছে হাঁকতে-হাঁকতে—“মড়াখেকো-কুকুর কোথাকার! ছাড় বলছি, না হলে মজা দেখাব।” চাঁদপুরের খেঁকশেয়াল যার নাম, আসামের জঙ্গলে হেন পাখি নেই যে তাকে জানে না। সে শহরে গিয়ে কতবার মুরগি, হাঁস ধরে এনেছে। ‘তাকে মড়াখেকো-কুকুর’ বলে এমন সাহস কার ? শেয়াল একটু থেমে যেমন ঘাড় ফিরিয়ে দেখেছে, অমনি রিদয় গিয়ে তার ল্যাজ চেপে পিঠে একটা কিল বসিয়ে দিলে। মানুষটি বুড়ো-আংলা, তার কিলটি কত বড়ই বা? শেয়ালের পিঠে একটা যেন বেদানা-বিচি পড়ল! কিন্তু মানুষের মতো গলার স্বর শুনে শেয়াল সত্যি ভয় পেলে; সে ল্যাজ তুলে বনের মধ্য দিয়ে পালিয়ে চলল; আর রিদয় তার ল্যাজ ধরে টিকটিকির মতো ঝুলতে-ঝুলতে চলল—উলু-ঘাসের মধ্যে দিয়ে গা-ঘেঁষড়ে। কাঁকড়ার মতো ল্যাজে কি কামড়ে রয়েছে, সেটা দেখবার শেয়ালের অবসর ছিল না, সে একেবারে নিজের গর্তর কাছে এসে দাড়িয়ে, মুখ থেকে হাঁসটা নামিয়ে, সেটার বুকে পা দিয়ে দাড়াল, তখন তার চোখ পড়ল ল্যাজে-গাঁথা বুড়ো-আংলার দিকে! এই টিকটিকির মতো ছেলেটা-ইনি চাঁদপুরী শেয়ালকে জব্দ করবেন, ভেবে শেয়াল ফ্যাক করে মুখ-ভেংচে হেসে বলল—“এইবার তোমার মনিবকে খবর দাওগে চাঁদপুরের শেয়াল হাঁস খেয়েছে।” ছুঁচোলো-মুখ, নাটা-চোখ দেখে এতক্ষণে রিদয় বুঝলে এটা শেয়াল। কিন্তু শেয়াল তাকে ভেংচেছে, এর শোধ সে দেবেই-দেবে! রিদয় আরো শক্ত করে তার ল্যাজ চেপে, দুই পায়ে একটা গাছ আঁকড়ে, যেমন শেয়াল হাঁ করে হাঁসটার গলা কাটতে গেছে অমনি পিছনে এক টান দিয়ে, হাঁস থেকে শেয়ালকে দু-হাত তফাতে টেনে নিয়েছে! আর সেই ফাঁকে লুসাই হাঁসও ভাঙা ডানা ঝাপটাতে-ঝাপটাতে উড়ে পালিয়েছে। “হাঁস যাক, আজ তোকে খাব!”—বলে থেঁকশেয়ালী দাঁত-খিচিয়ে রিদয়কে ধরবার জন্যে কেবলি নিজের ল্যাজটার সঙ্গে ঘুরতে লাগল। রিদয়ও ল্যাজ আঁকড়ে চরকি-বাজির মতো শেয়ালের সঙ্গে ঘুরতে থাকল, আর বলতে লাগল—“ধর দেখি মড়াখেকো কুকুর!” বনের মধ্যে শেয়ালে-মানুষে চড়ক-বাজি এমনতর কেউ কোনোদিন দেখেনি। প্যাঁচা, চামচিকে, এমন কি দিনের পাখিরাও তামাশা দেখতে বার হল। কিন্তু রিদয় দেখলে তামাশা ক্রমে শক্ত হয়ে উঠছে—সে নিজে শেয়ালের ল্যাজ ছাড়তে চাইলেও, শেয়াল তাকে সহজে ছাড়ে কি না সন্দেহ! খেঁকশেয়ালী পাকা শিকারী; তার গায়ের শক্তিও যেমন, বুদ্ধিও তেমনি, সাহসও কম নয়। রিদয় বুঝলে ঘুরে-ঘুরে সে নিজে যেমনি হাঁপিয়ে পড়বে অমনি টুপ-করে তাকে ধরবে শেয়াল! রিদয় একবার চারদিক চেয়ে দেখলে, হাতের কাছে কোনে বড় গাছ আছে কি না। কাছেই একটা সরু ঝাউ-গাছ বন ঠেলে আকাশে সোজা উঠেছে, ঘুরতে-ঘুরতে রিদয় সেইদিকে এগিয়ে গেল, তারপর হঠাৎ একসময় শেয়ালের ল্যাজ ছেড়ে একেবারে ঝাউ-গাছটার আগ-ডালে উঠে পড়ল। শেয়াল তখনো নিজের ল্যাজ কামড়াতে বো-বো লাঠিমের মতো ঘুরছে। রিদয় গাছের উপর থেকে চেচিয়ে বললে : তাকুড়-তাকুড় তাকা! যাচ্ছে শেয়াল ঢাকা! থাকে-থাকে-থাকে হুক্কাহুয়া ডাকে! চাঁদপুরের কাঁকড়া-বুড়ি কামড়েছে তার নাকে! শেয়াল দেখলে শিকার তাকে ঠকিয়ে পালাল! সে গাছের তলায় হাঁ-করে বসে রিদয়ের দিকে চেয়ে বললে—“রইলুম এইখানে বসে, কতক্ষণে নেমে আসিস দেখি! তোকে না খেয়ে নড়ছিনে!” এক-ঘণ্টা গেল, দু-ঘণ্টা গেল, শেয়াল আর নড়ে না। ঝাউ-গাছের সরু ডালে পা ঝুলিয়ে শীতের রাতে জেগে বসে থাকা যে কি কষ্ট আজ রিদয় বুঝলে। শীতে তার হাত-পা অসাড় হয়ে গেছে, চোখ ঢুলে পড়ছে, কিন্তু ঘুমোবার যে নেই—পড়ে যাবার ভয়ে। আর বনের মধ্যে অন্ধকারই বা কত! দুহাত তফাতে নজর চলে না—মিশ কালো ঘুটঘুটে চারদিক! মনে হল যেন গাছ-পালা সব শীতে কালো পাথরের মতো পাষাণ হয়ে গেছে! একটি পাখি ডাকছে না, একটি পাতা নড়ছে না—সব নিথর নিঝুম! রিদয়ের মনে হচ্ছে রাত যেন ফুরোতে চায় না!—রিদয় আর না ঘুমিয়ে থাকতে পারে না! এই সময় ভোরের কনকনে বাতাস বইল, আর দেখতে-দেখতে ভুসো-কালির মতো রাতের রঙ ক্রমে ফিকে হতে-হতে মিশি থেকে রাঙা, রাঙা থেকে রুপোলী, রুপোলী থেকে সোনালী হয়ে উঠল। তারপর বনের ওপারে সূর্য উঠলেন। বেলায় উঠত, কাজেই সূর্যকে চিরকাল রিদয় দেখে এসেছে কাঁচা-সোনার মতো হলুদ-বৰ্ণ; সূর্য যে ক্ষেপা মোষের চোখের মতো এমন লাল টকটকে, তা তার জ্ঞান ছিল না; তার ঠিক মনে হল কে যেন রাত্তিরের কাণ্ডকারখানা শুনে রেগে তার দিকে চাচ্ছেন! তারপর গাছের ফাঁকে-ফাঁকে সকালের আলো উঁকি মারতে লাগল—বনের গাছ-পালা, জীব-জন্তু রাতের আড়ালে আবডালে অন্ধকারে বসে কি কাণ্ড করেছে, তারি খোঁজ নিতে লাগল। বনের তলাকার চোরকাঁটা, শেয়াল-কাঁটা, কাটি-কুটি, কাঁটা-খোঁচা, যা-কিছু সব যেন আলোর ধমকে লজ্জায় রাঙা হয়ে উঠল। ক্রমে মেঘে-মেঘে আলো পড়ল-রঙ ধরল; গাছের পাতা, ঘাসের শিষ, ফোটা-ফুলের পাপড়ি, তার উপরে শিশিরের ফোঁটা—সবই আলোতে ঝলক দিতে থাকল! যেন সবাই সিঁদুর পরে স্যাটিনের কাপড়ে সেজেছে! ক্রমে চারদিক আলোতে আলোময় হয়ে উঠল; অন্ধকারের ভয় দেখতে-দেখতে কোথায় পালাল; আর অমনি কত পাখি, কত জীব-জন্তুই না বনে ছুটোছুটি আরম্ভ করলে! লাল-টুপি-মাথায় কাঠঠোকরা ঠকাস-ঠকাস গাছের ডালে ঘা দিতে বসে গেল, কাঠবেরালি অমনি খোপ ছেড়ে গাছের তলায় বসে কুটুস-কুটুস বাদাম ছাড়াতে লেগে গেল ; গাং শালিক, গো-শালিক, ছাতারে, গাছের তলায় নেমে শুকনো পাতা উল্টে-উল্টে কিড়িং ফড়িং ধরে-ধরে বেড়াতে লাগল; আগ-ডালে বসে শ্যামা-দোয়েল শিস দিতে আরম্ভ করলে। রিদয়ের মনে হল সূর্য যেন সব পশু-পাখি কীট-পতঙ্গদের জাগিয়ে দিয়ে অভয় দিতে থাকলেন—রাত পালিয়েছে, তোরা ঘর ছেড়ে বার হ, আমি এসেছি, ভয় নেই! রিদয় শুনলে মেঘনার চরে হাঁসেরা ডাকাডাকি, হাঁকাহাঁকি লাগিয়েছে, দল একত্র হচ্ছে। চকা-নিকোবর হাঁকলে—“মানস-সরোবর! ধৌলাগিরি! আও আও আও!” তারপর রিদয় দেখলে তার মাথার উপর দিয়ে নিকোবরের পুরো দল উড়ে চলল—খোড়া হাঁসটি সুদ্ধ! রিদয় তাদের একবার ডাক দিলে, কিন্তু এত উপর দিয়ে হাঁসেরা চলেছে যে তার ডাক শুনলে কি-না বোঝা গেল না—উড়তে-উড়তে আকাশে মিলিয়ে গেল । রিদয় স্থির করলে হাঁসেরা নিশ্চয়ই দেখেছে শেয়ালে তাকে খেয়েছে। সে হতাশ হয়ে আকাশে চেয়ে রইল। কিন্তু এত দুঃখেও সকালের আলো আর বাতাস, সে যেখানটিতে বসে আছে সেই ডালটি সোনার রঙে রাঙিয়ে ঝাউ-পাতার মধ্যে দিয়ে চুপিচুপি তাকে এসে বলতে থাকল—“ভয় কি? দিন হয়েছে—সূর্য উঠেছেন, আমরা থাকতে কিসের ভয়!” ঠিক সেই সময় কমলা-লেবুর রঙের সাজ পরে হলুদবর্ণ যে সূর্য আমতলির মাঠে রোজ-রোজ রিদয়কে দেখা দিতেন, তিনি চাঁদপুরের জঙ্গলের উপরে দেখা দিলেন। বেলা প্রায় এক প্রহর। রিদয় গাছের উপরে, শেয়াল নিচে বসে আছে, হাঁসের দলেরও কোনো খবর নেই, যে-যার খাবার সন্ধানে বেরিয়ে গেছে। ঠিক যখন বেলা ন’টা, তখন দেখা গেল, বনের মধ্যে দিয়ে একটিমাত্র হাঁস, যেন উড়তেই পারছে না, এই ভাবে আস্তে-আস্তে চলেছে। খেঁকশেয়ালী অমনি কান খাড়া করে হাঁসের দিকে নাক উঠিয়ে পায়ে-পায়ে এগিয়ে চলল। হাঁসটা শেয়ালকে দেখেও দেখলে না, তার নাকের সামনে দিয়েই উড়ে চলল। হাঁসটাকে ধরবার জন্যে শেয়াল একবার ঝম্ফ দিলে, হাঁস অমনি ফিক করে হেসে, উড়ে গিয়ে চড়ায় বসল। এর পরেই আর-এক হাঁস ঠিক তেমনি করে আরো-একটু মাটির কাছ দিয়ে উড়ে চলল; শেয়ালটা লাফ দিলে; তার কানের রোঁয়াগুলো হাঁসের পায়ে ঠেকল, কিন্তু ধরতে পারলে না—হাওয়ার মতো হাঁস উড়তে-উড়তে চড়ার দিকে চলে গেল। একটু পরে আর-এক হাঁস—এটা যেন উড়তেই পারছে না—একেবারে মাটির কাছ দিয়ে ঝাউগাছের গা-ঘেঁষে উড়ে চলল। এবারে প্রাণপণে শেয়াল ঝম্ফ দিলে। ধরেছে, এমন সময় হাঁস সোঁ-করে তার দাঁতে পালক বুলিয়ে দিয়ে একেবারে মুখের মধ্যে থেকে পালিয়ে গেল। এবার যে এল, সে এমনি বেকায়দায় লটপট করে উড়ে আসছে যে খেঁকশেয়াল ভাবলে—একে তো ধরেছি! কিন্তু বারবার তিনবার ঠকে শেয়াল বিরক্ত হয়ে উঠেছে, সে হাঁসের দিক থেকে মুখটা ফিরিয়ে গোঁ হয়ে রইল। যে-পথে আগের তিনটে হাঁস গেছে, এটাও সেই-পথ ধরে ঝাউ-তলায় এসে শেয়ালের এত কাছ দিয়ে চলল যে শেয়াল আর থির থাকতে না পেরে দিয়েছে লাফ এমন জোরে যে তার ল্যাজটা ঠেকল হাঁসের পিঠে। কিন্তু হাঁসও পাকা; সে সাঁ-করে শেয়ালের পেটের নিচে দিয়ে গলে তার ঝাঁটার মতো ল্যাজে ডানার এক থাপ্পড় বসিয়ে হাসতে হাসতে চম্পট দিলে। শেয়ালের আর দম নেবার সময় হল না, ঝপ-ঝপ করে আরো গোটা-পাঁচেক হাঁস নাকের সামনে দিয়ে বেরিয়ে গেল, একটাকেও সে ধরতে পারলে না—লাফানি-ঝাপানি সার হল! এবারে পর-পর আবার পাঁচটা হাঁস একে একে শেয়ালকে লোভ দেখিয়ে সজোরে তার পিঠে ডানার বাতাস দিয়ে হোঃ-হোঃ করে হাসতে-হাসতে একেবারে তার রগ-ঘেঁষে চলে গেল; কিন্তু শেয়াল না-রাম, না-গঙ্গা—চুপ করে বসে রইল। সে বুঝেছে চকা-নিকোবরের দল কাল রাতে হাঁস নিয়ে যাওয়ার শোধ তুলতে মস্করা লাগিয়েছে। অনেকক্ষণ আর হাঁসেদের দেখা নেই, শেয়াল ভাবচে তারা গেছে, এমন সময় চকা-নিকোবর দেখা দিলেন। তার সেই পাকা পালক, ছিনে গলা দেখেই শেয়াল তাকে চিনে নিলে। একটা ডানা বেঁকিয়ে খোঁড়াতে-খোঁড়াতে এক-কাৎ হয়ে সে উড়ে এল—একেবারে যেন চলতেই পারে না, এই ভাবে। শেয়াল এবারে লাফ দিয়ে নদীর ধার পর্যন্ত হাঁসটাকে তাড়িয়ে গেল; কিন্তু হাঁস যেন ধরা দিয়েও ধরা দিলে না; সোজা গিয়ে চরে বসে প্যাঁক-প্যাঁক করে হেসে উঠল। শেয়াল একেবারে লজ্জায় লাল হয়ে জঙ্গলের দিকে ফিরে দেখলে—এবারে চমৎকার ধবধবে মোটা-সোটা রাজহাঁস তার দিকে উড়ে আসছে। বনের অন্ধকারে তার শাদা ডানাদুখানা যেন রুপোর মতো ঝকঝক করছে। এবারে শেয়ালের নোলা সকসক করে উঠল। সে এমন লাফ দিলে যে, ঝাউ-গাছের পাতাগুলো তার গায়ে খোঁচা মারলে, কিন্তু খোড়া রাজহাঁস ধরা পড়ল না—সোজা ঝাউ-গাছ ঘুরে চড়ায় গিয়ে উঠল। এর পরে আর হাঁসের সাড়া-শব্দ নেই; সব চুপচাপ। শেয়াল ঝাউগাছের দিকে চেয়ে দেখলে, ছেলেটাও সেখান থেকে সরে পড়েছে। শেয়াল ফ্যালফ্যাল করে চারদিকে চাইছে এমন সময় চড়ার দিক থেকে একে-একে হাঁস সব আগেকার মতো তাকে লোভ দেখিয়ে উড়ে চলল। কিন্তু শেয়ালের তখন মাথার ঠিক নেই; সে পাগলের মতো কেবল ঝাপাঝাপি-লাফালাফি করতে থাকল আর কেবলি হাঁস তার নাকের সামনে দিয়ে যেতে থাকল—এক, দুই, তিন, চার, পাঁচ, দশ, পোনেরো, কুড়ি, বাইশ! শেয়াল তাদের একটি পালক পর্যন্ত ছিঁড়ে নিতে পারলে না। শেয়াল এমন নাকাল কখনো হয়নি। চাঁদপুরের শেয়াল সে, কতবার গুলির মুখ থেকে মুরগি-হাঁস শিকার করেছে তার ঠিক নেই; শেয়ালের রাজা বললেই হয় ; কিন্তু এই শীতকালে হাঁস-শিকার করতে আজ তার ঘাম ছুটে গেল! সারাদিন ধরে মোটা-সোটা চিকচিকে হাঁস দলে-দলে তার নাকের উপর দিয়ে যাওয়া-আসা করছে, অথচ একটাকেও সে ধরে খিদে মেটাতে পারছে না! সব চেয়ে তার লজ্জা—মানুষটাও তাকে ফাঁকি দিয়ে পালিয়েছে! আর তার দুর্দশার কথা সেই পোষা রাজহাঁসটাও জেনে গেল! দেশে-দেশে নিশ্চয়ই তারা চাঁদপুরের খেঁকশেয়ালের কীর্তি-কাহিনী রাষ্ট্র করে দেবেই-দেবে। ভোরে এই শেয়ালের গা চিকচিকে, ল্যাজ মোটা, রোঁয়াগুলো কেমন যেন সাটিনের মতো খয়েরি-কালো-শাদা ঝকঝক করছিল; কিন্তু বিকেলে তার পেটের চামড়া ঝুলে পড়েছে, গা ধুলোয়-ঘামে কাদা হয়ে গেছে, চোখ ঝিমিয়ে পড়েছে, জিভ চার-আঙুল বেরিয়ে পড়ে মুখে গোটানাল ভাঙছে। তাকে দেখে কে বলবে সকালের সেই দুরন্ত শেয়াল! সারাদিন ধরে কেবলি উড়ে-উড়ে হাঁসের দল তাকে এমনি নাকাল করেছে যে, বেচারা শেয়াল একেবারে হয়রান হয়ে পড়েছে; তার মাথার আর ঠিক নেই; কেবলি দেখছে যেন চোখের সামনে হাঁস ঘুরছে। সে গাছের তলায় সূর্যের আলো দেখে ভাবছে হাঁস; প্রজাপতি উড়লে হাঁস বলে লাফিয়ে ধরতে যাচ্ছে! যতক্ষণ দিনের আলো রইল চকা-নিকোবরের দল কিছু দয়া-মায়া না করে শেয়ালকে হয়রান করেই চলল। শেয়ালের তখন আর নড়বার শক্তি নেই, সে কেবল মাটির উপরে হাঁসের ছায়াগুলো থাবা দিয়ে-দিয়ে আঁচড়াতে থাকল। হাঁসেরা যখন দেখলে শেয়ালটা মড়ার মতো শুকনো পাতার উপরে শুয়ে পড়ে হাঁপাতে লেগেছে, তখন তারা—“কেমন! কেমন! হাঁস ধরবে!” বলতে-বলতে চাঁদপুরের জঙ্গল ছেড়ে নালমুড়ির চরের দিকে চলে গেল।
অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর
হং পাল অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর ঝাউ-গাছের উপর থেকে খোঁড়া হাস ঠোঁটে-করে রিদয়কে বাগদী-চরের থেকে একটু দূরে নালমুড়ির চরে নামিয়ে দিয়ে সারাদিন বুনো হাঁসের দলের সঙ্গে শেয়ালকে নিয়ে ঝপ্পটি আর দাঁতকপাটি খেলে বেড়াচ্ছে। ক্রমে সন্ধ্যে হয়ে এল দেখে রিদয় ভাবছে, নিশ্চয়ই হাঁসেরা রাগ করে তাকে ফেলে গেছে, এখন কেমন করে সে বাড়ি যায়? আর কেমন করেই বা ঐ বুড়ো-আংলা চেহারা নিয়ে বাপ-মায়ের সঙ্গে দেখা করে? ঠিক এই সময় মাথার উপর ডাক দিয়ে হাঁসের দল উড়ে এসে নালমুড়িতে ঝুপঝাপ পড়েই জলে নেমে গেল। চরে মেলাই কাছিমের ডিম, রিদয় তারি একটা ওবেলা, একটা এবেলা খেয়ে পেট ভরিয়ে চুপচাপ শুয়ে পড়ল। এমনি সে-রাত কাটল। ভোর না হতে হাঁসের দল রিদয়কে নিয়ে আবার চলল। রিদয় দেখলে হাঁসেরা তাকে বাড়ি যাবার কথা বললে না। সেও সে-কথা চেপে গিয়ে চুপচাপ খোঁড়া হাঁসের পিঠে চুপটি করে উঠে বসল। লুসাই হাঁসের ডানাটা শেয়ালের কামড়ে একটু জখম হয়েছে, কাজেই বুনো হাঁসের দল আজ আর বেশি দূরে উড়ে গেল না। গোবর-তলির মাটির কেল্লা ‘নুড়িয়া ক্যাসেলের’ উপরটায় এসে দেখতে লাগল, সেখানে মানুষ আছে কিনা। সেখানে শিকে-গাঁথা ফাটা-চটা কতকগুলো মাটির সঙ, পরী, সেপাই—এমনি সব। বাগানে মালি নেই, মালিকও নেই, কেবল একটা ভাঙা ফটকের মার্বেল-পাথরে কালি-দিয়ে-দাগা সাইন বোর্ডে লেখা রয়েছে—“পালদিং অফ্‌ নুড়িয়া।” ঠিক তারি নিচে একটা ভাঙা পিপের মধ্যে বসে একটা রোগা, কানা দেশী কুকুর পোড়ো কেল্লায় পাহারা দিচ্ছে। বুনো হাঁসেরা আকাশ থেকে শুধোলে—“ছপ্পড়টা কার? ছপ্পড়টা কার?” কুকুরটা অমনি আকাশে নাক তুলে চেচিয়ে উঠল, ভেউ-ভেউ করে বললে—“ছপ্পড় কি? দেখছ না এটা নুড়িয়ার কেল্লা—পাথরে গাঁথা! দেখছ না কেল্লার বুরুজ, তার উপরে ওই গোল-ঘর—সেখানে কামান-বসাবার ঘুলঘুলি, নিশেন ওড়াবার দাণ্ডা। গবাক্ষ, বাতায়ন, দরশন-দরওজা । এ-সব দেখছ না!” হাঁসের কিছুই দেখতে পেলে না—না কামান, না ঘুলঘুলি, না গবাক্ষ, না বাতায়ন। কেবল একটা চিলের ছাদে একটা আকাশ-পিদিম দেবার বাঁশ দেখা গেল, তাতেও এক-টুকরো গামছা-ছেঁড়া লটপট করছে! হাঁসেরা হো-হো করে হেসে বললে—“কই? কই?” কুকুরটা আরো রেগে বললে—“দেখছ না, কেল্লার ময়দান যেন গড়ের মাঠ! দেখছ না, কেলিকুঞ্জ—সেখানে রানী থাকেন। দেখ ওই হাম্মাম, সেখানে গোলাপজলের ফোয়ারা। দেখতে পাচ্ছ না বাগ-বাগিচা, আম-খাস, দেওয়ান-খাস?” হাঁসেরা দেখলে, পানা-পুকুর, লাউ-কুমড়োর মাচা—এমনি সব, আর কিছু নেই। কুকুর আবার চেঁচিয়ে বললে—“ঐ দেখ ওদিকে গাছ-ঘর, মালির ঘর; আর এই সব সুরকি-পাতা রাস্তার ধারে-ধারে পাথরের পরী, গ্যাস-লাইটের থাম, বাঁধা ঘাট, বারো-দোয়ারি নাটমন্দির। এসব কি চোখে পড়ছে না! যে বলছ ছপ্পড় কার? ছপ্পড়ে কখনো কেলিকানন, পুষ্পকানন, কামিনীকুঞ্জ থাকে? না, পাথরের পরী, ঘাটের সিঁড়ি থাকে? ঐ দেখ রাজার কাচারি, ঐ হাতিশাল, ঘোড়াশাল, তোষাখানা। এসব কি ছপ্পড়ে থাকে? না ছপ্পড় কখনো দেখেছ? ছপ্পড় দেখতে হয়তো ওপাড়ার ওই জমিদার-গুলোর বাড়ি দেখে এস। আমার মনিব কি জমিদার ? এরা মুর্ধাভিষিক্ত। লেখাপড়ার ধার দিয়েও যায় না। ঘোড়া-রোগে এদের সবাই মরেছে। সেকালে এরা চীনের রাজা ছিল। এখনো দেখছ না ফটকে লেখা—‘পাল্‌দিং অফ মুড়িয়া!” এই ছপ্পড়ের নহবতখানার চুড়ো দশক্রোশ থেকে দেখা যায়—এমনি ছপ্পড় এটা!” কানা কুকুরটা ঘেউ-ঘেউ করে থামলে হাঁসেরা হাসতে-হাসতে বললে—“আরে মুখ্যু, আমরা কি তোর রাজার কথা, না রাজ-বাড়ির কথা, না মাটির কেল্লার কথা শুধোচ্ছি? ওই ভাঙা ফটকের ধারে পোড়ো বাগানে ভাঙা মদের পিপেটা কার, তাই বল না!” এমনি রঙ-তামাশা করতে-করতে হাঁসেরা নুড়িয়া ছাড়িয়ে সুরেশ্বরে—যেখানে প্রকাণ্ড ঠাকুর-বাড়ির ধারে সত্যিকার বাগ-বাগিচা, দীঘি-পুষ্করিণী, ঘাট-মাঠ রয়েছে, সেইখানে কুশ-ঘাসের গোড়া খেতে নামল। ওদিকে মেঘনা, এদিকে পদ্মা—এই দুই নদী যেখানে মিলেছে, সেই কোণটিতে হলো সুরেশ্বর-মঠ। চারদিকে আম-বাগান, জাম-বাগান, ঠাকুর-বাড়ি, অতিথশালা, ভোগ-মন্দির, দোলমঞ্চ, আনন্দবাজার, রথতলা, নাট-মন্দির, রন্ধনশালা, ফুল-বাগান, গোহাল-গোষ্ঠ, পঞ্চবটী, তুলসীমঞ্চ, রাসমঞ্চ, রামকুণ্ডু, সীতাকুণ্ড, গোলকধাম, দেবদেবী-স্থান—এমনি একটা পরগনা জুড়ে প্রকাণ্ড ব্যাপার! এরি এক-কোণে বন আর মাঠ। সেইখানে হাঁসেদের সঙ্গে রিদয় নেমেছে। কেন যে এত বেলা থাকতে এখানে হাঁসেরা এসে আড্ডা গেড়ে বসল, রিদয় তা বুঝলে না, ভেবেও দেখলে না, নিজের মনে বনে-বনে ঘুরে পাত-বাদাম আর শাক-পাতা কুড়িয়ে ছায়ায়-ছায়ায় খেলে বেড়াতে লাগল। লুসাই হাঁসের ডানা ভালো হওয়া পর্যন্ত হাঁসেরা সেখানে অপেক্ষা করবার মতলব করেছে। একদিন খোঁড়া হাঁস দুটো শোল-মাছের ছানা এনে রিদয়কে দিয়ে বললে—“খেয়ে ফেল। মাছ না খেলে রোগা হবে।” রিদয় এবারে টপ-করে হাঁসের মতো সে-দুটো গিলে ফেললে। তারপর খোঁড়া হাঁসের পিঠে চড়ে নানা-রকম খেলা চলল। কোনো দিন জলে বুনো হাঁসদের সঙ্গে সাঁতার-খেলা, কোনো দিন দৌড়াদৌড়ি, লুকোচুরি, হাঁসের লড়াই—এমনি সারাদিন ছুটোছুটি চেঁচামেচি! এমন আনন্দে রিদয় জন্মে কাটায়নি। পড়াশুনো সব বন্ধ, একেবারে কৈলাস পর্যন্ত লম্বা ছুটি আর ছুট! খেলা শেষ হলে দুতিন-ঘণ্টা দুপুর-বেলায় ধলেশ্বরীর ভাঙনের উপরে বসে জিরোনো; বিকালে আবার খেলা; আবার চান; সন্ধ্যাবেলা খেয়ে নিয়েই ঘুম। রিদয়ের খাবার ভাবনা গেছে, শোবারও কষ্ট মোটেই নেই। খোঁড়া হাঁসের ডানায় এখন বেশ ভালো পালকের গদী পেতে সে বিছানা করে নিয়েছে, ঘুম পেলেই সেখানে ঢোকে। কেবল রাত হলেই তার ভয় আসে, বুঝি কাল সকালে বাড়ি ফিরতে হয়! কিন্তু হাঁসেরা তার ফেরবার কথাই আর তোলে না। একদিন, দুদিন, তিনদিন হাঁসেরা সুরেশ্বরেই রইল; কোনো দিকে যাবার নামটি করলে না। রিদয়ও মনে ভরসা পেয়ে সুরেশ্বরের মন্দির, মঠ লুকিয়ে দেখে নিতে লাগল—চারদিক ঘুরে। চারদিনের দিন চকা-নিকোবরকে কাছে আসতে দেখেই রিদয় ভাবলে—এইবার যেতে হল ফিরে! চকা গম্ভীর হয়ে তাকে শুধোলে—“এখানে খাওয়া-দাওয়া চলছে কেমন?” রিদয় একটু হেসে বললে—“চলছে মন্দ নয়। তবে শীতকাল, ফল বড় একটা নেই।” চকা তাকে সঙ্গে নিয়ে এক-ঝাড় কাঁচা বেত দেখিয়ে বললে—“বেত খেয়ে দেখ দেখি, কেমন মিষ্টি!” রিদয় বেত অনেকবার খেয়েছিল, আরো খাবার তার মোটেই ইচ্ছে নেই; কিন্তু চকার হুকুমে খেতে হল। খেয়ে দেখে মিষ্টি গুড়! ঠিক যেন আক চিবোচ্ছে! চকা বললে—“কেমন, ভালো লাগল কি? গুরুমশায় খাওয়ান শুকনো বেত, তাই লাগে বিশ্ৰী। যাহোক, এখন বলি শোনো। এই বাগানে, বনে যে তুমি আজকাল একলাটি ঘুরে বেড়াতে আরম্ভ করেছ, এটা ভালো হচ্ছে না।” রিদয় ভাবলে, এইবার যেতে হল রে! চকা বলে চলল—“এই বনে তোমার কত শক্র রয়েছে, তা জানো? প্রথম হচ্ছে শেয়াল, সে তোমার গন্ধে-গন্ধে ফিরছে, সুবিধে পেলেই ধরবে। তারপর ভোঁদড়, ভাম দুজনে আছে—যেখানে-সেখানে গাছের কোটরে ঢুকতে গেলে বিপদে পড়বে কোনদিন! জলের ধারে উদ্‌বেরাল আছে—একলা চান করবার সময় সাবধান! যেখানে-সেখানে জড়ো-করা পাথরের উপরে বসতে যেও না, তার মধ্যে বেঁজি লুকিয়ে থাকতে পারে। শুকনো-পাতা-বেছানো জায়গা দেখলেই সেখানে শুতে যেয়ো না; পাতাগুলো নেড়ে, তলায় সাপ কি বিছে আছে কিনা, দেখা ভালো। মাঠ দিয়ে যখন চল, তখন আকাশের দিকে কি একবার চেয়ে দেখ—সেখানে বাজ-পাখি, চিল, কাক, শকুনি আছে কিনা? সেটা একবার-একবার দেখে চলা মন্দ নয়। ফস-করে ঝোপে-ঝাড়ে উঠতে যেয়ো না; গেরো-বাজগুলো অনেক সময় সেখানে শিকার ধরতে লুকিয়ে থাকে। সন্ধ্যা হলে কান পেতে শুনবে, কোনো দিকে পেঁচা ডাকল কিনা। পেঁচারা এমন নিঃশব্দে উড়ে আসে যে টের পাবে না কখন ঘাড়ে পড়ল!” তার এত শক্র আছে শুনে রিদয় ভাবলে, বাঁচা তো তাহলে শক্ত দেখছি। সে চকাকে বললে—“মরতে ভয় নেই। তবে শেয়াল-কুকুরের কিম্বা শকুনের খাবার হতে আমি রাজী নই। এদের হাত থেকে বাচবার উপায় কিছু আছে বলতে পার?” চকা একটু ভেবে বললে—“বনের যত ছোট পাখি আর জন্তু এদের সঙ্গে ভাব করে ফেলবার চেষ্টা কর; তাহলে কাঠঠোকরা, ইঁদুর, কাঠবেরালি, খরগোস, তালচড়াই, বুলবুলি, টুনটুনি, শ্যামা, দোয়েল, এরা তোমায় সময়-মতো সাবধান করে দেবে; লুকোবার জায়গাও দেখিয়ে দেবে। আর দরকার হয় তো এই সব ছোট জানোয়ারেরা তোমার জন্যে প্রাণও দিতে পারে।” চকার কথা-মতো সেই দিনই রিদয় এক কাঠবেরালির সামনে উপস্থিত—ভাব করতে। যেমন দৌড়ে রিদয় সেদিকে যাওয়া, অমনি কাঠবেরালির গিয়ে গাছে ওঠা; আর ল্যাজ-ফুলিয়ে কিচ-কিচ করে গালাগালি শুরু করা—“অত ভাবে আর কাজ নেই! তোমাকে চিনিনে? তুমি তো সেই আমতলির রিদয়! কত পাখির বাসা ভেঙেচ, কত পাখির ছানা টিপে মেরেছ। ফাঁদ পেতে, ধামা চাপা দিয়ে কত কাঠবেরালি ধরে খাঁচায় পুরেছ, মনে নেই ? এখন আমরা তোমায় বিপদ থেকে বাঁচাব? এই ঢের যে বন থেকে আমরা এখনো তোমায় তাড়িয়ে মানুষের মধ্যে পাঠিয়ে দিচ্ছিনে! যাও, আমাদের দ্বারা কিছু হবে না। সরে পড় বাসার কাছ থেকে।” অন্য সময় হলে রিদয় কাঠবেরালিকে মজা দেখিয়ে দিত! কিন্তু এখন সে ভালোমানুষ হয়ে গেছে; আস্তে-আস্তে হাঁসকে এসে সব খবর জানালে। খোঁড়া হাঁস বললে—“অত দৌড়ে কাঠবেরালের কাছে যাওয়াটা ভালো হয়নি। হঠাৎ কিছু-একটা এসে পড়লে সব জানোয়ারই ভয় পায়, রাগ করে। যখন জানোয়ারদের কাছে যাবে—সহজে, আস্তে, ভদ্রভাবে যাবে। হুটোপাটি করে কিম্বা চুপিচুপি চোরের মতো গেলেই তাড়া খাবে। তোমার স্বভাব একটু ভালো হয়ে এসেছে; এমনি আর দিনকতক ভালোমানুষটি থাকলেই, ওরা আপনিই তোমার সঙ্গে ভাব করবে। তুমি যদি তাদের উপকার কর, তবে তারাও তোমার সহায় হবে—বনের এই নিয়ম জেনে রাখ।” রিদয় সারাদিন ভাবছে, কেমন করে সে বনের পশু-পাখিদের কাজে লাগতে পারবে, এমন সময় খবর হল, বেতগায়ের একটা চাষা কাঠবেরালের বৌকে ধরে খাচায় বন্ধ করেছে; আর সে-বেচারার আটদিনের বাচ্চাগুলি না খেয়ে মরবার দাখিল! খোড়া হাস রিদয়কে বললে—“দেখ, যদি কাঠবেরালির উপকার করতে চাও তো এই ঠিক সময়।” রিদয় অমনি কোমর-বেঁধে সন্ধানে বেরুল৷ লক্ষ্মীবার পিঠে-পার্বণের দিন কাঠবেরালের বৌ-চুরি হল সুরেশ্বরে, আর শনিবার বাগবাজারে ছাপার কাগজে বার হল সেই খবর। কাগজওয়ালা-ছোঁড়াগুলো গলিতে-গলিতে হেঁকে চলল— সুরেশ্বরে মজা ভারি—কাঠবেরালের বৌ চুরি! বুড়ো-আংলা মানুষ এল, দুটো বাচ্ছা দিয়ে গেল। মহন্ত ঠাকুর বড় দয়াল! খাঁচা খুলে, ছেড়ে দিলে বাচ্ছা-সমেত কাঠ-বেরাল। মজার খবর এক পয়সা—পড়ে দেখ এক পয়সা! কাণ্ডটা হয়েছিল এই : কাঠবেরালের বৌটি ছিল একেবারে শাদা ধপধপধপে; তার একটা রোঁয়াও কালো ছিল না! চোখ-দুটি মানিকের মতো লাল টুকটুকে, পাগুলি গোলাপী, এমন কাঠবেরালি আলিপুরেও নেই! এ এক নতুনতর ছিষ্টি! গাঁয়ের ছেলে-বুড়ো, রেল-কোম্পানীর সায়েব-সুবো তাকে ধরতে কত ফাঁদই পেতেছে, কিন্তু এ-পর্যন্ত কাঠবেরালি ধরা দেয়নি। পোষ-পার্বণের দিন বাদামতলী দিয়ে আসতে-আসতে এক চাষা এই কাঠবেরালিকে টোকা চাপা দিয়ে হঠাৎ কেমন করে পাকড়াও করে ঘরে এনে একটা বিলিতি-ইঁদুরের খাচায় বন্ধ করলে। পাড়ার লোক—ছেলে-বুড়ো, এই আশ্চর্য কাঠবেরালি দেখতে দলে-দলে ছুটে এল। এক ডোম তার জন্যে এক চমৎকার খাঁচা-কল তৈরি করে এনে দিলে। খাচার মধ্যে শোবার খাট, দোলবার দোলনা, দুধের বাটি, খাবার খৈ রাখবার ঝাঁপি, বসবার চৌকি—এমনি সব ঘর-কন্নার ছোট-ছোট সামিগ্রী দিয়ে সাজানো। সবাই ভাবলে, এমন খাঁচায় কাঠবেরালি সুখে থাকবে—খেলে বেড়াবে সারাদিন, দোলনায় দুলবে আর খৈ-দুধ খেয়ে মোটা হবে! কিন্তু কাঠবেরালি-বৌ চুপটি করে মুখ লুকিয়ে খাঁচার কোণে বসে রইল আর থেকে-থেকে কিচ-কিচ করে কাঁদতে থাকল। সারাদিন সে কিছু মুখে দিলে না, দোলনাতেও দুললে না, চৌকিতেও বসল না, খাটেও শুল না; কেবলি ছটফট করতে লাগল আর কাঁদতে থাকল। সুরেশ্বরের পুজো দেবার জন্যে চাষার বৌ সেদিন মালপো ভাজছিল আর সব পাড়ার মেয়েরা পিঠে-পার্বণের পিঠে গড়ছিল। রান্নাঘরে ভারি ধুম লেগে গেছে! উনুন জ্বলেছে; ছেলে-মেয়েরা পিঠে ভাজার ছ্যাঁকছ্যাঁক শব্দ পেয়ে সেদিকে দৌড়েছে। চাষার বৌ ঠাকুরের ভোগ মালপোগুলো কেবলি পুড়ে যাচ্ছে কেন, সেই ভাবনাতেই রয়েছে। ওদিকে উঠোনের বাইরে বেড়ার গায়ে কাঠবেরালির খাঁচাটার দিকে কি হচ্ছে, কেউ দেখছে না। চাষার দিদিমা বুড়ি, সে আর নড়তে পারে না, দাওয়ায় মাদুর পেতে বসে সেই কেবল দেখছে—রান্নাঘরের আলো গিয়ে ঠিক কাঠবেরালির খাঁচার কাছটিতে পড়েছে, আর সারা-সন্ধ্যে কাঠবেরালিটা খাঁচার মধ্যে খুটখাট ছটফট করে বেড়াচ্ছে। এই খাঁচার পাশেই গোয়াল, তার কাছেই সদর দরজা—খোলা। বুড়ি পষ্ট দেখলে বুড়ো-আঙুলের মতো একটি মানুষ উঠোনে ঢুকল। যক্‌ দেখলে ধনদৌলত বাড়ে, বুড়ি সেটা জানে, কাজেই বুড়ো-আংলাকে দেখে সে একটুও ভয় পেলে না। বুড়ো-আংলা বাড়িতে ঢুকেই কাঠবেরালির খাঁচাটার দিকে ছুটে গেল; কিন্তু খাঁচাটা উঁচুতে ঝুলছে; কাছে একটা পাঁকাটি ছিল, বুড়ো-আংলা সেইটে টেনে খাঁচায় লাগিয়ে সিঁড়ির মতো সোজা কাটি-বেয়ে খাঁচায় চড়ে খাঁচার দরজা ধরে খোলবার চেষ্টা করতে লাগল। বুড়ি জানে খাঁচায় তালা বন্ধ, সে কাউকে না ডেকে চুপ করে দেখতে লাগল—কি হয়! কাঠবেরালি বুড়ো-আংলার কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিস করে কি যেন বললে ; তারপর বুড়ো-আংলা কাটি-বেয়ে নিচে নেমে চোঁচা দৌড় দিলে বনের দিকে। বুড়ি ভাবছে যক্ আর আসে কিনা, এমন সময় দেখলে বুড়ো-আংলা ছুটতে-ছুটতে আবার খাঁচার কাছে দৌড়ে গেল—হাতে তার দুটো কি রয়েছে। বুড়ি তা দেখতে পেলে না, কিন্তু এটুকু সে পষ্ট দেখলে যে বুড়ো-আংলা একটা পোঁটলা মাটিতে রেখে, আর-একটা নিয়ে খাঁচার কাছে উঠল; তারপর এক হাতে খাঁচার কাটি ফাঁক করে জিনিসটা খাচার মধ্যে গলিয়ে দিয়ে, মাটি থেকে অন্য জিনিসটা নিয়ে আবার তেমনি করে খাঁচায় দিয়ে দৌড়ে বেরিয়ে গেল । বুড়ি আর চুপ করে বসে থাকতে পারলে না, সে ভাবলে, যক্ বোধ হয় তার জন্যে সাত-রাজার ধন মানিক-জোড় রেখে পালাল। খাঁচাটা খুঁজে দেখতে বুড়ি উঠল। বুড়ির কালো-বেড়ালও এতক্ষণ খাঁচার দিকে নজর দিচ্ছিল, সেও উঠে অন্ধকারে গা-ঢাকা হয়ে দাঁড়াল কি হয় দেখতে। বুড়ি পৌষমাসের হিমে উঠোন দিয়ে চলেছে, এমন সময় আবার পায়ের শব্দ, আবার বুড়ো-আংলা হাতে দুটো কি নিয়ে! এবারে বুড়ো-আংলার হাতের জিনিস কিচ—কিচ করে ডেকে উঠল। বুড়ি বুঝলে যক্‌ কাঠবেরালির ছানাগুলিকে দিতে এসেছে—তাদের মায়ের কাছে। দিদিমা উঠোনে দাঁড়িয়ে দেখলেন, যক্‌ আগের মতো খাঁচার কাছে গেল, কিন্তু বেড়ালের চোখ অন্ধকারে জ্বলছে দেখে, সে যেখানকার সেইখানেই দাঁড়িয়ে চারিদিক দেখতে লাগল—ছানা দুটি বুকে নিয়ে। উঠোনে বুড়িকে দেখে ছুটে এসে তার হাতে একটি ছানা দিয়ে বুড়ো-আংলা আগের মতো কাটি-বেয়ে একটির পর একটি ছানাকে খাঁচায় পুরে দিয়ে বুড়িকে পেন্নাম করে চলে গেল। বুড়ি ঘরে এসে সবার কাছে এই গল্প করলে, কিন্তু কেউ সেটা বিশ্বাস করতে চাইলে না—দিদিমা স্বপন দেখেছে বলে উড়িয়ে দিলে। কিন্তু বুড়ি বলতে লাগল—“ওরে তোরা দেখে আয় না!” সকালে সত্যি দেখা গেল চারটে ছানাকে নিয়ে কাঠবেরালি দুধ খাওয়াচ্ছে। এমন ঘটনা কেউ দেখেনি ! সুরেশ্বরের মোহন্ত পর্যন্ত এই আশ্চর্য ঘটনা দেখতে হাতি চড়ে চাষার বাড়ি উপস্থিত ! ওদিকে চাষার বৌ যত পিঠে সিদ্ধ করে, সবই পুড়ে ছাই হয়ে যায়, সুরেশ্বরের মালপো ভোগও হয় না, তখন মোহন্ত পরামর্শ দিলেন—“ওই কাঠবেরালি নিশ্চয় সুরেশ্বরী, নয় আর-কোনো দেবী, ওকে ছোনা-পোনা সুদ্ধ বন্ধ করেছ, হয়তো সুরেশ্বর তাই রাগ করেছেন। না হলে মালপো-ভোগ পিঠে-ভোগ হঠাৎ পুড়েই বা যায় কেন? যাও, এখনি ওঁদের যেখানে বাসা, সেইখানে দিয়ে এস। না হলে আরো বিপদ ঘটতে পারে!” চাষা তো ভয়ে অস্থির! গ্রামসুদ্ধ কেউ আর খাঁচায় হাত দিতে সাহস পায় না। তখন সবাই মিলে দিদিমাকে সেই খাঁচা নিয়ে বনে কাঠবেরালির বাসায় পাঠিয়ে দিলে। বুড়ি যেখানকার জিনিস সেখানে রেখে, আসবার সময় রাস্তার মাঝে একটা মোহর পেয়ে গেল। ‘যতো ধর্ম স্ততো জয়’ বলে খবরের কাগজের সম্পাদক খবরটা শেষ করলেন। এই বুড়ো-আংলাটি কিনি—লোকে তাই নিয়ে মাথা ঘামাতে লাগল সুরেশ্বরে, বাগবাজারে, ফরিদপুরে, যশোরে, ময়মনসিংহে, আগরতলায়, আসামে, কাছাড়ে! এই ঘটনার দুদিন পরে আর-এক কাণ্ড! গঙ্গা আর ব্রহ্মপুত্র যেখানে এক হয়েছে, সেইখানে আড়ালিয়ার চর। বুনোহাঁসের সঙ্গে রিদয়কে নিয়ে খোঁড়া হাঁস সেই চরে চরতে নামল। চরটা কেবল বালি, মাঝে-মাঝে ছোটছোট ঝাউ, আর এখানে-ওখানে শুকনো ঘাস। চরের একদিকে আড়ালিয়া গ্রাম। হাঁসরা চরছে, এমন সময় চরের উপরে কতকগুলো জেলের ছেলে খেলতে এল। মানুষ দেখেই চকা হাঁক দিলে, আর অমনি সব বুনো হাস ডানা-মেলে উড়ে পড়ল। কিন্তু খোঁড়া হাঁস ছেলে দেখে একটুও ভয় পেলে না ; বরং গলা চড়িয়ে বুনো হাঁসদের বললে—“ছেলে দেখে ভয় কি ?” রিদয় হাঁসের পিঠ থেকে নেমে একটা ঝাউতলায় বসে ঝাউফুল কুড়িয়ে মার্বেল খেলছে, ছেলেগুলো কাছে আসতেই সে একবার শিস দিয়ে খোঁড়াকে সাবধান করে একটা ঘাস-বনে লুকিয়ে পড়ল। কিন্তু খোঁড়ার আজ কি যে হল, সে যেমন চরছিল তেমনি চরে বেড়াতে লাগল। ছেলেদুটো একটা বালির টিপি ঘুরে একেবারে দুদিক থেকে হাঁসকে তাড়া করলে। কেমন করে যে তারা এত কাছে হঠাৎ এলে পড়ল, ভেবে না পেয়ে খোঁড়া একেবারে হতভম্ব! উড়তে যে জানে তা মনেই এল না। সে ক্রমাগত দৌড়ে পালাবার চেষ্টা করতে লাগল। তারপর একটা ডোবার কাছে গিয়ে খোঁড়া ধরা পড়ে গেল। রিদয়ের প্রথমে মনে এল যে ছুটে গিয়ে ছেলে-দুটোকে থাবড়া মেরে হাঁসটা কেড়ে নেয়, কিন্তু তখনি মনে পড়ল, সে ছোট হয়ে গেছে! তখন সে রেগে বসে-বসে কেবলি বালি খুঁড়তে লাগল। এদিকে খোঁড়া ডাকছে—“বুড়ো-আংলা ভাই, এস লক্ষ্মীটি, আমায় বাঁচাও!” “ধরা পড়ে এখন বাঁচাও !”—বলে রিদয় ছেলে-দুটোর সঙ্গে দৌড়ল। ছেলে-দুটো হাঁস নিয়ে একটা নালা পেরিয়ে চর ছেড়ে গ্রামে ঢুকল। রিদয় আর তাদের দেখতে পেলে না। নালায় অনেক জল। রিদয় অনেকটা ঘুরে তবে একটা শুকনো-গাছের ডাল বেয়ে ওপারে উঠে, হাঁসকে খুঁজতে মাটির উপর ছেলেদের পায়ের চিহ্ন ধরে এগিয়ে চলল। একটা চৌমাথায় দেখা গেল, ছেলে-দুটো দুদিকে গেছে। কোন পথে যাওয়া যায়, রিদয় ভাবছে, এমন সময় বাঁকের রাস্তায় একটা হাঁসের পালক রয়েছে দেখে রিদয় বুঝলে, হাঁস এই পথে গেছে—পালক ফেলতে-ফেলতে, যাতে সে সন্ধান পায় সেই জন্যে। রিদয় পালকের চিহ্ন ধরে দুটো মাঠ পেরিয়ে গ্রামের একটা সরু গলি পেলে। গলির মোড়ে একটা মন্দির। হাঁস কোথায় দেখা নেই, মন্দিরের খিলেনের উপরে লেখা—“হংসেশ্বরী !” আর তারি উপরে মাটির গড়া এক হাঁস। রিদয় রাস্তার মাঝে দাঁড়িয়ে সেই দিকে চেয়ে আছে, এদিকে পিছনে প্রায় একশো লোক জমা হয়েছে—নাকে তিলক, কপালে ফোঁটা, নেড়া-মাথা বৈরিগীর দল ! রিদয় যেমনি ফিরেছে অমনি সবাই মাটিতে দণ্ডবৎ হয়ে প্রণাম করে বললে—“জয় প্রভু বামনদেব, ঠাকুর, কৃপা কর !” বামন কে, রিদয় তা জানত না, কিন্তু প্ৰণামের ঘটা দেখে সে বুঝলে, সবাই তাকে দেবতা ভেবেছে। রিদয় অমনি গম্ভীর হয়ে বললে—“তোমরা আমার হাঁস চুরি করেছ, এখনি এনে দাও। না হলে হংসেশ্বরীর কোপে পড়ে যাবে।” সবাই মুখ-চাওয়াচাওয়ি করতে লাগল। তখন হংসেশ্বরীর পাণ্ডা গলবস্তর হয়ে বললে—“ঠাকুর, হাঁস কোথায় আছে বলে দিন, এখনি এনে দিচ্ছি !” রিদয় রেগে বলে উঠল—“কোথায় জানলে কি তোমাদের আনতে বলি ? এই গ্রামের দুটো ছেলে তাকে নিয়ে এসেছে—এই দিকে।” এই কথা হচ্ছে এমন সময় মন্দিরের পিছন দিকে হাঁসের ডাক শোনা গেল। বেচারা প্রাণপণে চেঁচাচ্ছে ! রিদয় দৌড়ে সেদিকে গিয়ে দেখে একটা ঘরের উঠোনে এক বুড়ি খোঁড়া হাঁসকে দুই হাঁটুতে চেপে ধরে ডানা কেটে দেবার উদ্যোগ করছে—দুটো পালক কেটেছে, আর দুটো মুঠিয়ে ধরে কাটবার চেষ্টায় আছে। হঠাৎ বুড়ো-আংলা-রিদয়কে দেখে বুড়ি একেবারে হাঁ হয়ে গেল! সেই সময়ে যত নেড়ানেড়ির দল ছুটে এসে হৈ-হৈ করে বুড়ির হাত থেকে খোঁড়া হাঁস ছাড়িয়ে নিলে। রিদয় হাঁসের উপরে চড়ে বসল আর অমনি রাজহাঁস তাকে নিয়ে আকাশে মিলিয়ে গেল। বৈরিগীর দল সেই হাঁসের পালক হংসেশ্বরীর পরমহংস-বাবাজীর কাছে হাজির করে দিলে। তিনি পালক-কটি একটা হাঁড়িতে রেখে খবরের কাগজে বিজ্ঞাপন দিলেন—“অভূতপূর্ব ঘটনা ! হংসেশ্বরীর রাজহংস স্বশরীরে বামনদেবকে নিয়ে উপস্থিত হয়ে দুটি পালক রক্ষা করে গেছেন। সে জন্য একটি সোনার কৌটার প্রয়োজন। হিন্দুমাত্রেরই এই বিষয়ে মুক্তহস্ত হওয়া উচিত। চাঁদা আমার কাছে মঃ অঃ করিয়া পাঠাইবেন। ইতি—সুরেশ্বরের পরমহংস বাবাজী।” মানুষদের মধ্যে যেমন খবরের কাগজ, পাখিদের মধ্যে তেমনি খবর রটাবার জন্য পাখি আছে। কোথাও কিছু নতুন কাণ্ড হলেই সেই জায়গাটার উপরে প্রথমে কাক-চিল জড়ো হয়, তারপর তাদের মুখে এ-পাখি, এপাখির মুখে ও-পাখি—এমনি এ-বন, সে-বন, এ-দেশ, সে-দেশে দেখতে দেখতে খবর রটে যায়। কাঠবেরালির কথা আর খোঁড়া হাঁস উদ্ধারের কথা রিদয় ফিরে আসার পূর্বে হাঁসের দলে, বনে-জঙ্গলে, জলে-স্থলে কোনো জানোয়ারের জানতে আর বাকি রইল না। গাছে-গাছে তাল-চড়াই, গাং-শালিক—এরা সুরেতালে রিদমের কীর্তি-কথা ঢেঁড়া-পিটিয়ে বলে বেড়াতে লাগল: শুন এবে অবধান পশুপক্ষিগণ। বুড়ো-আংলা মহাকাব্য করি বিবরণ॥ কাঠবেরালি রামদাস তাহারে উদ্ধরি। বীরদাপে চলে যথা রাজহংসেশ্বরী॥ হাঁসের পালক দুটা কেটে নিল বুড়ি। যাহে লেখা যায় মহাকাব্য ঝুড়ি-ঝুড়ি॥ হাঁসের দুর্দশা দেখি আংলা বুড়ো ধায়। হংসেশ্বরী ছাড়ি বুড়ি পালাল ঢাকায়॥ মোহন্ত তুলিয়া নিল হংসের কলম। সোনা চাই বলি তাহে লেখে বিজ্ঞাপন॥ তালচটক তাল ধরে গানশালিকে কয়। সুবচনী হাঁস নিয়ে চলিল রিদয়॥ খোঁড়া হাঁসেরে লইয়া, খোঁড়া হাঁসেরে লইয়া রচিলাম মহাকাব্য যতন করিয়া। আংলা বিজয় নামে কাব্য চমৎকার। গোটা দুই শ্লোক তারি দিনু উপহার॥ সকলে শুনহ আর শুনাহ অন্যকে। ক্ষীর হতে নীর পিয়ে ধন্য হোক লোকে॥ ইতি আংলা বিজয় মহাকাব্যে প্রথম সর্গঃ। আজ চকা-নিকোবর ভারি খুশি। সে রিদয়কে কুর্নিস করে বললে—“একবার নয়, বার-বার তিনবার তুমি দেখিয়েছ যে পশু-পাখিদের তুমি পরমবন্ধু! প্রথমে শেয়ালের মুখ থেকে বুনো হাঁস ‘লুসাইকে’ উদ্ধার, তার পরে কাঠবেরালির উপকার, সব-শেষে পোষা হাঁসকে বাঁচানো। তোমার ভালোবাসায় আমরা কেনা হয়ে রইলেম। আর তোমায় আমরা ফেরাতে চাইনে। তোমার যদি মানুষ হতে ইচ্ছে হয় তো বল আমি নিজে গণেশঠাকুরকে তোমার জন্যে ‘রেকমেণ্ডেসন’ পাঠিয়ে দিচ্ছি।” রিদয়ের আর মোটেই মানুষ হতে ইচ্ছে ছিল না। হাঁসেদের সঙ্গে দেশ-বিদেশ দেখতে-দেখতে বড় মজাতেই সে দিন কাটাচ্ছে, তবু মানুষ-হবার রেকমেণ্ডেসনখানা না নিলে চকা পাছে কিছু মনে করে, সেই ভয়ে বললে—“মানুষ হবার সময় হলে আমি তোমাকে জানাব। এখন কিছুদিন তোমাদের সঙ্গে থাকতে আমি ইচ্ছে করেছি।” চকা ঘাড় নেড়ে বললে—“সেই ভালো; যখন ইচ্ছে হবে বল, আমি সাট্টিফিকিট দিয়ে তোমাকে গণেশের কাছে পাঠাব। এখন হাঁসের দলে হংসপাল হয়ে থাক।” বলে চকা রিদয়ের মাথাটা ঠোঁট দিয়ে চুলকে দিলে। অমনি চারদিকে বুনো হাঁস রিদয়ের নতুন উপাধি ফুকরে উঠল—“হংপাল! হংপাল!” বনের পাখিরা প্রতিধ্বনি করলে—“হি-রি-দ-য় হংসপাল !”
ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর
বর্গপরিচয় দ্বিতীয় ভাগ ঈশ্বরচন্দ্র বিষ্ঠাস।গর সংযুক্ত বর্ণ য ফলা য ্য ক য ক্য ঐক্য, বাক্য, অনৈক্য। খ য খ্য অসংখ্য, অখ্যাতি, উপাখ্যান। গ য গ্য ভাগ্য, আরোগ্য, সৌভাগ্য। চ য চ্য বাচ্য, বিবেচ্য, পদচ্যুত। জ য জ্য ত্যাজ্য, রাজ্য, জ্যোতি। ট য ট্য নাট্য, কাপট্য, নৈকট্য। ড য ড্য জাড্য। ঢ য ঢ্য আঢ্য, ধনাঢ্য। ণ য ণ্য পুণ্য, অরণ্য, লাবণ্য। ত য ত্য নিত্য, সত্য, হত্যা, মৃত্যু। থ য থ্য পথ্য, মিথ্যা। দ য দ্য অদ্য, বাদ্য, বিদ্যা, বিদ্যুৎ। ন য ন্য অন্য, ধন্য, মান্য, শূন্য, অন্যায়। প য প্য রৌপ্য, আপ্যায়িত। ভ য ভ্য লভ্য, সভ্য, অভ্যাস। ম য ম্য রম্য, অগম্য, বৈষম্য। য য য্য আতিশয্য, শয্যা। ল য ল্য বাল্য, তুল্য, মূল্য, কল্যাণ। ব য ব্য নব্য, দিব্য, ব্যয়, তালব্য। শ য শ্য অবশ্য, আবশ্যক, শ্যামল। ষ য ষ্য দূষ্য, পোষ্য, শিষ্য। স য স্য নস্য, শস্য, আলস্য, ঔদাস্য। হ য হ্য সহ্য, বাহ্য, লেহ্য। ১ম পাঠ। ১। কখনও কাহাকেও কুবাক্য বলিও না। কুবাক্য বলা বড় দোষ। যে কুবাক্য বলে, কেহ তাহাকে দেখিতে পারে না। ২। সদা সত্য কথা বলিবে। যে সত্য কথা বলে, সকলে তাহাকে ভাল বাসে। যে মিথ্য কথা বলে, কেহ তাহাকে ভাল বাসে না, সকলেই তাহাকে ঘৃণা করে। তুমি কদাচ মিথ্যা কথা বলিও না। ৩। বাল্যকালে, মন দিয়া, লেখা পড়া শিখিবে। লেখা পড়া শিখিলে, সকলে তোমায় ভাল বাসিবে। যে লেখা পড়ায় আলস্য করে, কেহ তাহাকে ভাল বাসে না। তুমি, কখনও লেখা পড়ায় আলস্য করিও না। ৪। নিত্য যাহা পড়িবে, নিত্য তাহা অভ্যাস করিবে। কল্য অভ্যাস করিব বলিয়া, রাখিয়া দিবে না। যাহা রাখিয়া দিবে, আর তাহা অভ্যাস করিতে পারিবে না। ৫। কদাচ পিতা মাতার অবাধ্য হইও না। তাঁহারা যখন যাহা বলিবেন, তাহা করিবে; কদাচ তাহার অন্যথা করিও না। পিতা মাতার কথা না শুনিলে, তাঁহারা তোমায় ভাল বাসিবেন না। ৬। অবোধ বালকেরা সারা দিন খেলিয়া বেড়ায়, লেখা পড়ায় মন দেয় না। এজন্য তাহারা চির কাল দুঃখ পায়। যাহারা মন দিয়া লেখা পড়া শিখে, তাহারা চিরকাল সুখে থাকে। র ফলা। র ্র ক র ক্র বক্র, বিক্রয়, ক্রূর, ক্রোধ। গ র গ্র অগ্র, গ্রহণ, গ্রাম, অগ্রিম। ঘ র ঘ্র শীঘ্র, ঘ্রাণ, আঘ্রাণ। জ র জ্র বজ্র, বজ্রাঘাত। ত র ত্র গাত্র, মিত্র, ত্রাস, কৃত্রিম। দ র দ্র রৌদ্র, নিদ্রা, হরিদ্রা। ধ র ধ্র গৃধ্র, ধ্রুব। প র প্র প্রণয়, প্রাণ প্রীতি, প্রেরণ। ভ র ভ্র শুভ্র, ভ্রমণ, ভ্রাতা, ভ্রুকুটি। ম র ম্র আম্র, তাম্র, নম্র। ব র ব্র ব্রণ, ব্রত। শ র শ্র শ্রম, বিশ্রাম, আশ্রিত, শ্রীমান্। স র স্র সহস্র, সংস্রব, স্রোত। হ র হ্র হ্রদ, হ্রাস। ২য় পাঠ। ১। শ্রম না করিলে, লেখা পড়া হয় না। যে বালক শ্রম করে, সেই লেখা পড়া শিখিতে পারে। শ্রম কর, তুমিও লেখা পড়া শিখিতে পারিবে। ২। যে বালক প্রত্যহ, মন দিয়া, লেখা পড়া শিখে, সে সকলের প্রিয় হয়। যদি তুমি প্রতিদিন মন দিয়া, লেখা পড়া শিখ, সকলে তোমায় ভাল বাসিবে। ৩। যখন পড়িতে বসিবে, অন্য দিকে মন দিবে না। অন্য দিকে মন দিলে, শীঘ্র অভ্যাস করিতে পারিবে না; অধিক দিন মনে থাকিবে না; পড়া বলিবার সময়, ভাল বলিতে পারিবে না। ৪। কখনও কাহারও সহিত কলহ করিও না। কলহ করা বড় দোষ। যে সতত সকলের সহিত কলহ করে, তাহার সহিত কাহারও প্রণয় থাকে না। সকলেই তাহার শত্রু হয়। ৫। পরের দ্রব্যে হাত দিও না। না বলিয়া পরের দ্রব্য লইলে চুরি করা হয়। চুরি করা বড় দোষ। যে চুরি করে, চোর বলিয়া তাহাকে সকলে ঘৃণা করে। চোরকে কেহ কখনও প্রত্যয় করে না। ৬। যে চুরি করে, মিথ্যা কথা বলে, ঝগড়া করে, গালাগালি দেয়, মারামারি করে, তাহাকে অভদ্র বলে। তুমি কদাচ অভদ্র হইও না; অভদ্র বালকের সংস্রবে থাকিও না। যদি তুমি অভদ্র হও, কিংবা অভদ্র বালকের সংস্রবে থাক, কেহ তোমাকে কাছে বসিতে দিবে না, তোমার সহিত কথা কহিবে না, সকলেই তোমায় ঘৃণা করিবে। ল ফলা ল ল ক ল ক্ল শুক্ল, ক্লীব, ক্লেশ। গ ল গ্ল গ্লানি। প ল প্ল বিপ্লব, প্লাবন, প্লীহা। ম ল ম্ল অম্ল, ম্লান, অম্লান। ল ল ল্ল প্রফুল্ল, উল্লাস, ভল্লুক। শ ল শ্ল শ্লাঘা, অশ্লীল, শ্লোক। হ ল হ্ল আহ্লাদ, আহ্লাদিত। ব ফলা। ব ক ব ক্ব পরিপক্ব। জ ব জ্ব জ্বর, জ্বালা। ট ব ট্ব খট্বা। ত ব ত্ব ত্বরা, সত্বর, মমত্ব, রাজত্ব। দ ব দ্ব দ্বার, দ্বিজ, দ্বীপ, দ্বেষ। ধ ব ধ্ব ধ্বনি, ধ্বংস। ন ব ন্ব অন্বেষণ। ল ব ল্ব বিল্ব। শ ব শ্ব অশ্ব, নিশ্বাস, আশ্বিন, শ্বেত। স ব স্ব স্বভাব, আস্বাদ, তেজস্বী। হ ব হ্ব জিহ্বা, আহ্বান। ৩ পাঠ। সুশীল বালক। ১। সুশীল বালক পিতা মাতাকে অতিশয় ভাল বাসে। তাঁহারা যে উপদেশ দেন, তাহা মনে করিয়া রাখে, কখনও ভুলিয়া যায় না। তাঁহারা যখন যে কাজ করিতে বলেন, তাহা করে, যে কাজ করিতে নিষেধ করেন, কদাচ তাহা করে না। ২। সে মন দিয়া লেখা পড়া করে, কখনও অবহেলা করে না। সে সতত এই ভাবে, লেখা পড়া না শিখিলে, চির কাল দুঃখ পাইব। ৩। সে আপন ভ্রাতা ও ভগিনীদিগকে বড় ভাল বাসে, কদাচ তাহাদের সহিত ঝগড়া করে না, তাহাদের গায়ে হাত তুলে না, খাবার দ্রব্য পাইলে, তাহাদিগকে না দিয়া, একাকী খায় না। ৪। সে কখনও মিথ্যা কথা বলে না। সে জানে, যাহারা মিথ্যা কথা বলে, কেহ তাহাদিগকে ভাল বাসে না, কেহ তাহাদের কথায় বিশ্বাস করে না, সকলেই তাহাদিগকে ঘৃণা করে। ৫। সে কখনও অন্যায় কাজ করে না। যদি দৈবাৎ করে, তাহার পিতা মাতা ধমকাইলে, সে রাগ করে না। সে এই মনে করে, অন্যায় কাজ করিয়াছিলাম, এজন্য পিতা মাতা ধমকাইলেন, আর কখনও এমন কাজ করিব না। ৬। সে কখনও কাহাকেও কটু বাক্য বলে না, কুকথা মুখে আনে না, কাহারও সহিত ঝগড়া ও মারামারি করে না, যাহাতে কাহারও মনে ক্লেশ হয়, কদাচ এমন কাজ করে না। ৭। সে কখনও পরের দ্রব্যে হাত দেয় না। জানে, না বলিয়া পরের দ্রব্য লইলে, চুরি করা হয়। চুরি করা বড় দোষ, যাহারা চুরি করে, সকলে তাহাদিগকে ঘৃণা করে। ৮। সে কখনও আলস্যে কাল কাটায় না। যে সময়ের যে কাজ, মন দিয়া তাহা করে। সে লেখা পড়ার সময়, লেখা পড়া না করিয়া, খেলা করিয়া বেড়ায় না। ৯। সে কখনও দুঃশীল বালকদিগের সহিত বেড়ায় না, তাহাদের সহিত খেলা করে না। সে মনে করে, দুঃশীলদিগের সহিত বেড়াইলে ও খেলা করিলে আমিও দুঃশীল হইয়া যাইব। ১০। সে যখন বিদ্যালয়ে থাকে, গুরু মহাশ্নয় যে সময়ে যাহা করিতে বলেন, প্রফুল্লু মনে তা করে, কদাচ তাহার অন্যথা করে না। সে কখনও তাঁহার কথার অবাধ্য হয় না, এজন্য তিনি তাহাকে ভাল বাসেন। ণ ফলা ণ ণ ণ ণ ণ্ণ বিষণ্ণ, ষণ্ণবতি। ষ ণ ষ্ণ কৃষ্ণ, তৃষ্ণা, সহিষ্ণু। হ ণ হ্ণ পরাহ্ণ, অপরাহ্ণ। ন ফলা। ন ন গ ন গ্ন ভগ্ন, মগ্ন, অগ্নি, আগ্নেয়। ঘ ন ঘ্ন বিঘ্ন, কৃতঘ্ন, বিষঘ্ন। ত ন ত্ন যত্ন, রত্ন, রত্নাকর। ন ন ন্ন অন্ন, ভিন্ন, অবসন্ন, সন্নিধান। ম ন ম্ন নিম্ন। স ন স্ন স্নান, স্নেহ। হ ন হ্ন চিহ্ন, জাহ্নবী, আহ্নিক। ম ফলা। ম ম ক ম ক্ম রুক্ম, রুক্মিণী। গ ম গ্ম যুগ্ম, বাগ্মী। ঙ ম ঙ্ম বাঙ্ময়, পরাঙ্মুখ। ণ ম ণ্ম হিরণ্ময়। ত ম ত্ম দুরাত্মা, আত্মীয়। দ ম দ্ম পদ্ম, ছদ্মবেশ। ন ম ন্ম জন্ম, উন্মাদ, উম্মূলিত। ম ম ম্ম সম্মত, সম্মান, সম্মুখ। ল ম ল্ম গুল্ম, শাল্মলী। শ ম শ্ম শ্মশান, রশ্মি। ষ ম ষ্ম উষ্ম। স ম স্ম ভস্ম, স্মরণ, অকস্মাৎ, বিস্মৃত। হ ম হ্ম জিহ্ম, জিহ্মগ, জিহ্মিত। ৪র্থ পাঠ। যাদব। যাদব নামে একটি বালক ছিল, তাহার বয়স আট বৎসর। যাদবের পিতা, প্রতিদিন তাহাকে বিদ্যালয়ে পাঠাইয়া দিতেন। লেখা পড়ায় যাদবের যত্ন। সে, এক দিনও, বিদ্যালয়ে যাইত না; প্রতিদিন পথে পথে খেলা করিয়া বেড়াইত। বিদ্যালয়ের ছুটী হইলে, সকল বালক যখন বাড়ী যাইত, যাদবও সেই সময়ে বাড়ী যাইত। তাহার বাপ মা মনে করিতেন, যাদব পাঠশালায় লেখা পড়া শিখিয়া আসিল। এই রূপে, প্রতি দিন সে বাপ মাকে ফাঁকি দিত। এক দিন যাদব দেখিল, ভুবন নামে একটি বালক পড়িতে যাইতেছে। সে তাহাকে কহিল, ভুবন, আজ তুমি পাঠশালায় যাইও না। এস, দুজনে মিলিয়া খেলা করি। পাঠশালার ছুটী হইলে, যখন সকলে বাড়ী যাইবে, আমরাও সেই সময়ে বাড়ী যাইব। ভুবন কহিল, না ভাই, আমি খেলা করিব না। সারাদিন খেলা করিলে, পড়া হবে না। কাল পাঠশালায় গেলে, গুরু মহাশয় ধমকাইবেন, বাবা শুনিলে রাগ করিবেন। আমি আর দেরি করিব না, পাঠশালায় যাই। এই বলিযা ভুবন চলিয়া গেল। আর একদিন, যাদব দেখিল, অভয় নামে একটি বালক পড়িতে যাইতেছে। সে তাহাকে বলিল, অভয় আজ পড়িতে যাইও না। এস, দুজনে খেলা করি। অভয় বলিল, না ভাই, তুমি বড় খারাপ ছোকরা; তুমি এক দিনও পড়িতে যাও না। তোমার সহিত খেলা করিলে আমিও তোমার মত খারাপ হইয়া যাইব। তোমার মত পথে পথে খেলিয়া বেড়াইলে লেখা পড়া কিছু হবে না। কাল গুরু মহাশয় বলিয়াছেন, ছেলেবেলায়, মন দিয়া লেখা পড়া না করিলে, চিরকাল দুঃখ পাইতে হয়। এই বলিয়া অভয় চলিয়া যায়। যাদব টানাটানি করিতে লাগিল। অভয় তাহার হাত ছাড়াইয়া, চলিয়া গেল। চলিয়া যাইবার সময় সে বলিল, আজ আমি তোমার সব কথা গুরু মহাশয়কে বলিয়া দিব। অভয়, বিদ্যালয়ে গিয়া গুরু মহাশয়কে་ যাদবের কথা বলিয়া দিল। গুরু মহাশয় যাদবের পিতার নিকট বলিয়া পাঠাইলেন, তোমার ছেলে, এক দিনও পড়িতে আইসে না। প্রত্যহ পথে পথে খেলিয়া বেড়ায়। আপনিও পড়িতে আইসে না, এবং অন্য অন্য বালককেও আসিতে দেয় না। যাদবের পিতা শুনিয়া অতিশয় ক্রোধ করিলেন, তাহাকে অনেক ধমকাইলেন; বই, কাগজ, কলম, যা কিছু দিয়াছিলেন, সব কাড়িয়া লইলেন। সেই অবধি, তিনি যাদবকে ভাল বাসিতেন না, কাছে আসিতে দিতেন না, সম্মুখে আসিলে, দূর দূর করিয়া তাড়াইয়া দিতেন। র রেফ কর্কশ শর্করা মুর্খ মূর্খতা। ছর্গম, নির্গত, বিসর্গ। দীর্ঘ, মহার্ঘ, নির্ঘাত | দুর্জন, নির্জন, নিজীব | ঝর্ঝর, নির্ঝর | কর্ণ, বর্ণ, নির্ণয়। অর্থ, সমর্থ, সার্থক | নির্দয়, ভুর্দব, নির্দোষ। নির্ধন, নির্ধূম। ছুর্নাম, ছুনিবার | সর্প কার্পাস, অপিত, কপূর। দুর্বল, দুর্বোধ । নির্ভয়, নির্ভর, দুর্ভাবনা। ৫ম পাঠ। নবীন। নবীন নামে একটী বালক ছিল। তাহার বয়ঃক্রম নয় বৎসর। সে খেলা করিতে এত ভাল বাসিত যে, সারা দিন, পথে পথে খেলিয়া বেড়াইত, এক বারও লেখা পড়াষ মন দিত না। এজন্য সে কিছুই শিখিতে পারিত না। গুরু মহাশয় প্রতিদিন তাহাকে ধমকাইতেন। ধমকের ভয়ে, সে আর বিদ্যালয়ে যাইত না। এক দিন, নবীন ফেখিল, একটি বালক বিদ্যালয়ে অধ্যয়ন করিতে যাইতেছে। সে তাহা কে বলিল, ভাই, এস, দুজনে খানিক খেলা করি। সে বলিল, আমি পড়িতে যাইতেছি, এখন খেলিতে পারিব না। পড়িবার সময় খেলা করিলে, লেখা পড়া শিখিতে পারিব না। বাবা আমাকে পড়িবার সময় পড়িতে ও খেলিবার সময় খেলিতে, বলিয়া দিয়াছেন। আমি যে সময়ের যে কাজ, সে সময়ে সে কাজ করি। এজন্য বাবা আমাকে ভাল বসেন। আমি তাঁর কাছে যখন যা চাই, তাই দেন। যদি এখন আমি পড়িতে না গিয়া তোমার সহিত খেলা করি, বাবা আমাকে আর ভাল বাসিবেন না। তিনি বলিয়াছেন, লেখা পড়ায় অবহেলা করিয়া, সারাদিন খেলিয়া বেড়াইলে, চিরকাল ছুঃখ পাইতে হয়। অতএব, আমি চলিলাম। এই বলিয়া সে সত্বর চলিয়া গেল। নবীন খানিক দূর গিয়া দেখিল, একটি বালক চলিয়া যাইতেছে। তাহাকে বলিল, ভাই, তুমি কোথায় যাইতেছ। সে বলিল, বাবা আমাকে এক জিনিস আনিতে পাঁঠাইয়াছেন। তখন নবীন বলিল, তুমি খানিক পূরে জিনিস আনিতে যাইবে। এখন এস, দুজনে মিলিয়। খানিক খেলা করি। ঐ বালক বলিল, না ভাই, এখন আমি খেলিতে পারিব না। বাবা যে কাজ করিতে বলিয়াছেন, আগে তাহা করিব। বাবা বলিয়াছেন, কাজে অযত্ব করা ভাল নয়। আমি কাজের সময় কাজ করি, খেলার সময় খেলা করি। কাজের সময়, কাজ না করিয়া, খেলিয়া বেড়াইলে, চিরকাল দুঃখ পাইব। আমি কখনও কাজে অমনোযোগ করি না। যে সময়ের যে কাজ, সে সময়ে সে কাজ করি। আমি, তোমার কথা শুনিয়া, কাজে অবহেলা করিব না। এই কথা শুনিয়া, নবীন সেখান হইতে চলিয়া গেল। খানিক গিয়া, এক রাখালকে দেখিয়া সে বলিল, আয় না ভাই, দুজনে মিলিয়া খেলা করি। রাখাল বলিল, আমি গরু চরাইতে যাইতেছি, এখন খেলা করিতে পারিব না। খেলা করিলে, গরু চরান হইবে না। প্রভু রাগ করিবেন, গালাগালি দিবেন। আমি কাজে অযত্ন করিব না। কাজের সময় কাজ করিব, খেলার সময় খেলা করিব। বাবা এক দিন বলিয়াছিলেন কাজের সময় কাজ না করিয়া, সারাদিন খেলিয়া বেড়াইলে, চির কাল দুঃখ পাইতে হয়। তুমি যাও, এখন আমি খেলা করিতে পারিব না। এই রূপে, ক্রমে ক্রমে, তিন জনের কথা শুনিয়া, নবীন মনে মনে ভাবিতে লাগিল, সকলেই কাজের সময় কাজ করে। এক জনও, কাজে অবহেলা করিয়া, সারাদিন খেলিয়া বেড়ায় না। কেবল আমিই, সারা দিন, খেলা করিয়া বেড়াই। সকলেই বলিল, কাজের সময় কাজ না করিয়া খেলিয়া বেড়াইলে, চির কাল দুঃখ পাইতে হয়। এজন্য তারা, সারা দিন, খেলা করিয়া বেড়ায় না। আমি যদি, লেখা পড়ার সময়, লেখা পড়া না করিয়া, কেবল খেলিয়া বেড়াই, তা হলে, আমি চির কাল দুঃখ পাইব। বাবা জানিতে পারিলে আর আমায় ভাল বাসিবেন না, মারিবেন, গালাগালি দিবেন, কখন কিছু চাহিলে দিবেন না; আমি আর লেখা পড়ায় অবহেলা করিব না। আজ অবধি, লেখা পড়ার সময়, লেখা পড়া করিব। এই ভাবিয়া, সেই দিন অবধি, নবীন লেখা পড়ায় মনোযোগ করিল। তার মন আর সারা দিন খেলা করিয়া বেড়াইত না। কিছু দিনের মধ্যেই, নবীন অনেক শিখিয়া ফেলিল। তাহা দেখিয়া সকলে নবীনের প্রশংসা করিতে লাগিল। এইরূপে, লেখা পড়ায় যত্ন হওয়াতে, ক্রমে ক্রমে, অনেক বিদ্যা শিখিয়াছিল। মিশ্র সংযোগ—দুই অক্ষরে চিক্কণ, ধিক্কার, কুক্কুট। রক্ত, শক্ত, বক্তা, ভক্তি। ভক্ষণ, লক্ষণ, পরীক্ষা, রক্ষিত। দগ্ধ, ভুদ্ধ, মুগ্ধ। অঙ্ক, শঙ্কা, অঙ্কুর, সংকেত। শঙ্খ, শৃঙ্খলা, বিশৃঙ্খল। অঙ্গ, অঙ্গার, সঙ্গীত, অঙ্গুলি। লঙ্ঘন, জঙ্ঘা। উচ্চ, উচ্চারণ। তুচ্ছ, আচ্ছাদন। লজ্জা, সজ্জিত বিজ্ঞ, আজ্ঞা, অজ্ঞান | অঞ্চল, সঞ্চার, বঞ্চিত লাঞ্চনা, বাঞ্ছা, লাঞ্ছিত অঞ্জলি, পঞ্জিকা। চট্ট, ভট্ট, অট্টালিকা। খড়্গ কণ্টক, বণ্টন, ঘণ্টা। কণ্ঠ, উৎকণ্ঠা, কুষ্ঠিত | খণ্ড, চণ্ডাল, পুত, গণ্ডুষ। উত্তম, উত্তাপ, আবৃত্তি | উত্থান, উত্থাপন, উত্থিত। মুদ্গর উদ্ঘাটন, উদ্ঘাটিত। উদ্দেশ। বৃদ্ধ, উদ্ধার, বুদ্ধি। সন্ভাব, উদ্ভিদ, উদ্ভূত | দত্ত, চিন্তা, জন্তু, কিন্ত, সন্তোষ।' মন্থন, পন্থা। আনন্দ, মন্দির, সন্দেহ। অন্ধ , সন্ধা বন্ধু। তপ্ত, লিগ তৃন্ত, দীপ্তি। অব্জ, কুব্জ। শব্দ, শকাবন্দা, শাব্দিক। লব্ধ, লুব্ধ, আরন্ধ। হস্ত, নিস্তারঃ বস্ত, নিশ্তেজশ স্থান, অস্থি, স্থুল। স্থ স্থলন, স্বীলিতম ৬ষ্ঠ পাঠ। মাধব নামে একটি বালক ছিল। তাহার বয়স দশ বৎসর। তাহার পিতা তাহাকে বিদ্যালয়ে শিক্ষা করিতে দিয়াছিলেন। সে প্রতিদিন বিদ্যালয়ে যাইত, এবং মন দিয়া লেখা পড়া শিখিত; কখনও, কাহারও সহিত ঝগড়া বা মারামারি করিত না; এজন্য, সকলেই তাহাকে ভালবাসিত। এ সকল গুণ থাকিলে কি হয়, মাধবের একটা মহৎ দোষ ছিল। সে, পরের দ্রব্য লইতে, বড় ভাল বাসিত। সুযোগ পাইলেই, কোনও দিন কোনও বালকের পুস্তক লইত, কোনও দিন কোনও বালকের কলম লইত, কোনও দিন কোনও বালকের কাগজ লইত, কোনও দিন কোনও বালকের ছুরি লইত। এইরূপে, প্রায় প্রতিদিন, সে এক এক বালকের এক এক দ্রব্য অপহরণ করিত। মাধব যে বালকের কোনও দ্রব্য লইত, সে শিক্ষক মহাশয়ের নিকটে গিয়া বলিত, মহাশয়, আমার অমুক দ্রব্য কে লইয়াছে। মাধব, চুরি করিয়া এমন লুকাইয়া রাখিত যে, শিক্ষক মহাশয়, অনেক চেষ্টা করিযাও, তাহার সন্ধান করিতে পারিতেন না। কে চুরি করিয়াছে, স্থির করিতে না পারিয়া, তিনি সকল বালককেই তিরস্কার করিতেন। প্রত্যহ গালাগালি খাইয়া, কটিপয় বালক পরামর্শ করিল, আজ অবধি আমরা সতর্ক থাকিব। দেখিব, কে চুরি করে। দুই তিন দিনের মধ্যেই তাহারা মাধবকে চোর বলিয়া ধরিয়া দিল। মাধব, সে দিন, এক বালকের এক খানি পুস্তক লইয়াছিল। শিক্ষক মহাশয়, চোর বলিয়া, তাহাকে গালাগালি দিতে লাগিলেন। তখন মাধব বলিল, আমি চুরি করি নাই, ভুলিয়া লইয়াছিলাম। শিক্ষক মহাশয়, সে দিন তাহাকে ক্ষমা করিলেন, বলিয়া দিলেন, তুমি, আর কখনও, কাহারও দ্রব্যে হস্তার্পণ করিও না। মাধব বলিল, আমি, আর কখনও কাহারও কোন দ্রব্যে হাত দিব না। দুই তিন দিন, কাহারও কোনও দ্রব্য, হারাইল না। পরে, পুনরায়, বিদ্যালয়ের বালকদিগের দ্রব্য হারাইতে লাগিল। মাধব, পুনরায়, চোর বলিয়া ধরা পড়িল। সে বারেও, শিক্ষক মহাশয়, তাহাকে ক্ষমা করিলেন, এবং অনেক বুঝাইয়া বলিয়া দিলেন, যদি তুমি পুনরায় চুরি কর, তোমাকে বিদ্যালয় হইতে বহিষ্কৃত করিয়া দিব। সে বলিল, আমি আর কখনও চুরি করিব না। আর চুরি করিব না বলিয়া, সে শিক্ষক মহাশয়ের নিকট প্রতিজ্ঞা করিল বটে, কিন্তু কয়েক দিন পরে, পুনরায় চুরি করিল, এবং চোর বলিয়া ধরা পড়িল। এই রূপে বারংবার চুরি করাতে, শিক্ষক মহাশয়, তাহাকে বিদ্যালয় হইতে বহিস্কৃত করিয়া দিলেন। তাহার পিতা, এই সকল বৃত্তান্ত জানিতে পারিয়া, যথেষ্ট তিরস্কার ও বিলক্ষণ প্রহার করিলেন। কিছু দিন পরে, তিনি তাহাকে আর এক বিদ্যালয়ে পাঠাইলেন। সে সেখানেও চুরি করিতে লাগিল। সে বিদ্যালয়ের শিক্ষক মহাশয়, অতিশয় তিরস্কার ও প্রহার করিয়া তাহাকে তাড়াইয়া দিলেন। এই সকল দেখিয়া শুনিয়া, তাহার পিতার মনে অত্যন্ত ঘৃণা জন্মিল। তিনি ক্রুদ্ধ হইয়া, তাহাকে বাটী হইতে বহিষ্কৃত করিয়া দিলেন। বাল্যকাল হইতে চুরি অভ্যাস করিয়া, মাধব আর সে অভ্যাস ছাড়িতে পারিল না। ক্রমে ক্রমে যত বড় হইতে লগিল, ততই তাহার এ প্রবৃত্তি বাড়িতে লাগিল। সে সুযোগ পাইলেই, কাহারও বাটীতে প্রবেশ করিয়া, চুরি করিত। এজন্য যে দেখিত, সেই তাহাকে ঘৃণা করিত। কেহ তাহাকে বিশ্বাস করিত না। কাহারও বাটীতে গেলে, সে তাহাকে দূর দূর করিয়া তাড়াইয়া দিত। মাধবের দুঃখের সীমা ছিল না। সে খাইতে না পাইয়া, পেটের জ্বালায় ব্যাকুল হইয়া, দ্বারে দ্বারে কাঁদিয়া বেড়াইত, তথাপি তাহার প্রতি, কাহারও স্নেহ বা দয়া হইত না। মিশ্র সংযোগ—তিন অক্ষরে। মম সুন্গম, লক্ষ্মী। জব উজ্জ্বল। পুত্র, ছত্র, ছাত্র। স্ব তপ্ত মহন্ত। দৌরাত্য, মাহাত্ম্য | তর তস্ত, মন্ত্র যত, মন্ত্রী। ক্র চন্দ্র, তন্দ্রা, ইন্দ্রিয়। বিন্ধ্য, বন্ধ্যা, সন্ধ্যা। উপার্জন, বঞ্চিত। নির্দেশ। নির্ধারিত। ৭ম পাঠ। রাম। রাম বড় সুবোধ। সে কদাচ পিতা মাতার কথার অবাধ্য হয়না। তাঁহারা রামকে যখন যাহা করিতে বলেন, সে তৎক্ষণাৎ তাহা করে, কদাচ তাহার অন্যথা করে না। তাঁহারা যাহা করিতে একবার নিষেধ করেন, সে আর কখনও তাহা করে না। এজন্য তাহার পিতা মাতা তাহাকে অতিশয় ভালবসেন। রাম আপন ভাই ভগিনী গুলির উপর অতিশয় সদয়। বড়ভাই ও বড় ভগিনীদিগের কথা শুনে, কখনও তাঁহাদের অনাদর করে না, ছোট ভাই ও ছোটি ভগিনীদিগকে অতিশয় ভাল বাসে, কখনও তাঁহাদিকে বিরক্ত করে না, তাহাদের গায়ে হাত তুলে না। রাম সকল সমবয়স্ক বালাকদিগের সঙ্গ খেলা করে, তাহাদের সকলকেই আপন ভ্রাতার ন্যায় ভাল বাসে, কদাচ তাহাদের সহিত ঝগড়া বা মারামারি করে না। যাহাতে তাহারা সন্তুষ্ট হয়, সে সর্বদা সেইরূপ কর্ম করে; যাহাতে তাহারা অসন্তুষ্ট হয়, কদাচ সেরূপ কর্ম করে না। এজন্য, তাহারা সকলেই রামকে অতিশয় ভাল বাসে। রামকে দেখিলে, তাহাদের বড় আহ্লাদ হয়। লেখা পড়ায় রামের বড় যত্ন। সে কখনও, সে বিষয়ে উপেক্ষা করে না। মে আপন শিক্ষকদিগকে অতিশয় ভক্তি করে। তাঁহারা যখন ষে উপদেশ দেন, সে তাহা মন দিয়া শুনে, কদাচ তাহা বিস্মৃত হয় না। রাম কখনও কোনও মন্দ কর্ম করে না। দৈবাৎ যদি করে, একবার বারণ করিলে, আর কখনও সেরূপ করে না। যদি তাহার পিতা মাতা, অথবা শিক্ষক বলেন, রাম, তুমি বড় মন্দ কর্ম করিয়াছ; সে বলে, আমি না বুঝিয়া করিয়াছি, আর কখনও এমন কর্ম করিব না, এবার আমায় ক্ষমা করুন। তার পর, রাম আর কদাচ তেমন কর্ম করে না। যাহা শুনিলে, লোকের মনে ক্লেশ হয, রাম কখনও কাছাকেও সেরূপ কথা বলে না। সে কখনও কাণাকে কাণা, বা খোঁড়াকে খোঁড়া বলিয়। ডাকে না। কাণাকে কাণা, বা খোঁড়াকে খোঁড়া বলিলে, তাঁহারা বড় দুঃখিত হয়। এজন্য কাহারও ওরূপ বলা উচিত নয়। রামের মুখে কেহ কখনও কটু, অপ্রিয়, বা অশ্লীল কথা শুনিতে পায় না। ৮ম পাঠ। পিতা মাতা। দেখ বালকগণ, পৃথিবীতে পিতা মাতা অপেক্ষা বড় কেহই নাই। তাহারা, কত যত্বে, কত কষ্ট, তোমাদের লালন পালন করিয়াছেন। তাঁহারা সেরূপ যত্ন ও সেরূপ কষ্ট না করিলে, কিছুতেই তোমাদের প্রাণরক্ষা হইত না। তাঁহারা তোমাদিগকে যেরূপ ভাল বাসেন, পৃথিবীতে আর কেহ তোমাদিগকে সেরূপ ভাল বসেন না। কিসে তোমাদের সুখ ও আহলাদ হয়, তাঁহারা সর্বদা সে চেষ্টা করেন। তোমাদের সুখ ও আহলাদ দেখিলে, তাহাদের যেরূপ সুখ ও আহলাদ হয়, আর কাহারও সেরূপ হয় না। তাঁহারা তোমাদের উপর যত সদয়, আর কেহ সেরূপ নহেন। যাহাতে তোমাদের মঙ্গল হয়, সে বিষয়ে তাঁহারা সতত কত যত্ব করেন। তোমাদের বিদ্যা হইলে, চির কাল সুখে থাকিতে পারিবে, এজন্য, তোমাদিগকে বিদ্যালয়ে পাঠাইয়াছেন। তোমরা মন দিয়া লেখা পড়া শিখিলে, তাহাদের কত আহ্লাদ হয়। তাঁহারা, দয়া করিয়া তোমাদিগকে খাওয়া পরা না দিলে, তোমাদের ক্লেশের সীমা থাকিত না। উপাদেয় বস্তু পাইলে, আপনারা না খাইয়া, তোমাদিগকে দেন। ভাল বস্ত্র পরিলে, তোমরা আহলাদিত হও, এজন্য তোঁমাদিগকে ভাল ভাল বস্ত্র কিনিয়া দেন | তোমাদের পীড়া হইলে, তাঁহাদের মনে কত কষ্ট ও কত দুর্ভাবনা হয়। তোমাদের পীড়া-শান্তির নিমিত্ত কত চেষ্টা ও কত যত্ন করেন। যাবৎ তোমরা সুস্থ হইয়া না উঠ, তাবৎ তাঁহারা স্থির ও নিশ্চিন্ত হইতে পারেন না। তোমরা সুস্থ হইয়া উঠিলে, তাহাদের আহ্লাদের সীমা থাকে না। অতএব, তোমরা কদাচ পিতা মাতার অবাধ্য হইবে ন। তাঁহারা যাহা বলেন, তাহা করিবে। যাহা করিতে নিষেধ করেন, তাহা কখনও করিবে না। যাহাতে তাহারা সন্তুষ্ট হন, সর্বদা সে চেষ্টা করিবে। যাহাতে তাঁহারা অসন্তুষ্ট হন, কদাচ তাহা করিবে না। যাহারা এইরূপে চলে, তাহাদিগকে সুসন্তান বলে। সুসন্তান হইলে পিতা মাতার সুখের ও আহ্লাদের সীমা থাকে না। ৯ম পাঠ। সুরেন্দ্র। সুরেন্দ্র, আমার কাছে এস; তোমায় কিছু জিজ্ঞাসা করিব। এই কথা শুনিয়া, সুরেন্দ্র তৎক্ষণাৎ শিক্ষকের নিকট উপস্থিত হইল। তিনি বলিলেন, আমি শুনিলাম, তুমি, পুষ্করিণীর পাড়ে দাঁড়াইয়া, ডেলা ছুড়িতেছিলে; ইহাতে আমি অতিশয় দুঃখিত ও অসন্তুষ্ট হইয়াছি। এক্ষণে তোমায় জিজ্ঞাসা করি, এ কথা যথার্থ কি না। সুরেন্দ্র বলিল, হাঁ মহাশয়, যাহা শুনিয়াছেন, তাহা সত্য; আমি ডেলা ছুঁড়িয়াছিলাম। ডেলা ছুড়িলে যে কোন দোষ হয়, আমি তাহা মনে করি নাই। গাছের ডালে একটী পাখী বসিয়া ছিল; তাহাকে মারিবার জন্য, ডেলা ছুড়িয়াছিলাম। এই কথা শুনিয়া, শিক্ষক বলিলেন, সুরেন্দ্র, অতি অন্যায় কর্ম করিয়াছ। পাখী তোমার কোন ক্ষতি করে নাই; কি জন্য তাহাকে ডেল৷ মারিতে গেলে? যদি তাহার গায়ে ডেলালাগিয়া থাকে, সে কত কষ্ট পাইয়াছে। যদি আর কেহ ডেলা ছুড়ে আর এ ডেলা তোমার গায়ে লাগে, তোমার কত কষ্ট হয়। তোমায় বারণ করিতেছি, তুমি পাখী বা আর কোনও জন্তুকে কখনও ডেলা মারিও না। সুরেন্দ্র শুনিয়া অতিশয় লজ্জিত হইল; এবং বলিল, মহাশয়, আমি আর কখনও কোনও জন্তকে ডেলা মারিব না। অনেক বালক এরূপ করে; তাহা দেখিয়া আমিও এরূপ করিয়াছিলাম। এখন বুঝিতে পারিলাম, ডেলা ছোড়া ভাল নয়। তখন শিক্ষক বলিলেন, তোমার এই কথা শুনিয়া সন্তষ্ট হইলাম। কিন্তু তুমি, যে পাখীকে লক্ষ্য করিয়া, ডেলা ছুড়িয়াছিলে, উহার গায়ে এ ডেলা লাগে নাই। নিকটে একটি বালক দাড়াইয়া ছিল; ডেলা তাহার মাথায় লাগিয়া রক্তপাত হইয়াছে। চক্ষুতে লাগিলে, সে এ জন্মের মত, কাণা হইয়া যেত। বালকটি কাতর হইয়া কত রোদন করিতেছে। অতএব দেখ, ডেলা ছোড়ায় কত দোষ। সুরেন্দ্র শুনিরা অতিশয় দুঃখিত হইল; এবং আমি বড় দুষ্কর্ম করিয়াছি, এই বলিয়া রোদন করিতে লাগিল। কিঞ্চিৎ পরে, সে বলিল, মহাশয়, না বুঝিয়া, আমি এই দুষ্কর্ম করিয়াছি | আপনার সমক্ষে বলিতেছি, আর কখনও এমন কর্ম্ম করিব না। এবার আপনি আমায় ক্ষমা করুন। শিক্ষক শুনিয়া অতিশয় সন্তুষ্ট হইলেন; এবং বলিলেন, সুরেন্দ্র, তুমি যে দোষ করিয়া, স্বীকার করিলে, ইহাতে আমি অতিশয় সন্তুষ্ট হইলাম। দেখিও, ডেলা ছোঁড়া ভাল নয়, এ কথা যেন ভুলিয়া না যাও। ১০ম পাঠ। চুরি করা কদাচ উচিত নয়। না বলিয়া পরের দ্রব্য লইলে চুরি করা হয়। চুরি করা বড় দোষ। যে চুরি করে, তাহাকে চোর বলে। চোরকে কেহ বিশ্বাস করে না। চুরি করিয়া ধরা পড়িলে, চোরের দুর্গতির সীমা থাকে না। বালকগণের উচিত, কখনও চুরি না করে। পিতা মাতা প্রভৃতির কর্তব্য, পুত্র প্রভৃতিকে কাহারও কোনও দ্রব্য চুরি করিতে দেখিলে, তাহাদের শাসন করেন; এবং ছরি করিলে কি দোষ হয়, তাহাদিগকে ভাল করিয়া বুঝাইয়া দেন। একদা, একটি বালক বিদ্যালয় হইতে, অন্য এক বালকের এক খানি পুস্তক চুরি করিয়া আনিয়াছিল। অতি শৈশব কালে, ঐ বালকের পিতা মাতার মৃত্যু হয়। তাহার মাসী লালন-পালন করিয়াছিলেন। তিনি, তাহার হস্তে ঐ পুস্তক খানি দেখিয়া, জিজ্ঞাসা করিলেন, ভূবন, তুমি এই পুস্তক কোথায় পাইলে। সে বলিল, বিদ্যালয়ের এক বালকের পুস্তক। তিনি বুঝিতে পারিলেন, ভূবন এই পুস্তক খানি চুরি করিয়া আনিয়াছে। কিন্ত তিনি পুস্তক ফিরিয়া দিতে বলিলেন না। এবং ভূুবনের শাসন, বা ভুবনকে চুরি করিতে নিষেধ করিলেন না। ইহাতে ভূবনের সাহস বাড়িয়া গেল। সে যত দিন বিদ্যালয়ে ছিল, সুযোগ পাইলেই চুরি করিত। এইরূপে ক্রমে ক্রমে, সে বিলক্ষণ চোর হইয়া উঠিল। সকলেই জানিতে পারিল, ভুবন বড় চোর হইয়াছে। কাহারও কোনও দ্রব্য হারাইলে, সকলে তাহাকেই চোর বলিয়া সন্দেহ করিত। যদি ভুবন অন্য লোকের বাটাতে যাইত, পাছে সে কিছু চুরি করে, এই ভয়ে তাহারা অতিশয় সতর্ক হইত; এবং, যথোচিত তিরস্কার ও প্রহার পর্যন্ত্য করিয়া, তাহাকে তাড়াইয়া দিত। কিছু কাল পরে, ভুবন চোর বলিয়া ধরা পড়িল। সে বহু কাল চোর হইয়াছে, এবং অনেকের অনেক দ্রব্য চুরি করিয়াছে, তাহা সপ্রমাণ হইল। বিচারকর্তা ভুবনের ফাঁসির আজ্ঞা দিলেন। তখন ভূবনের চৈতন্য হইল। যে স্থানে অপরাধীদিগের ফাঁসি হয়, তথায় লইয়া গেলে পর, ভূবন রাজপুরুষদিগকে বলিল, তোমরা দয়া করিয়া, এ জন্মের মত, এক বার আমার মাসীর সঙ্গে দেখা করাও। ভুবনের মাসী এ স্থানে আনীত হইলেন; এবং ভুবনকে দেখিয়। উচ্চৈঃস্বরে কাঁদিতে, কাঁদিতে, তাহার নিকটে গেলেন। ভুবন বলিল, মাসি, এখন আর কাঁদিলে কি হইবে। নিকটে এস, কানে কানে তোমায় একটি কথা বলিব। মাসী নিকটে গেলে পর, ভুবন তাঁহার কানের নিকটে মুখ লইয়া গেল; এবং জোরে কামড়াইয়া, দাঁত দিয়া তাঁহার একটি কান কাটিয়া লইল; পরে সে ভর্ৎসনা করিয়া বলিল, মাসি, তুমিই আমার এ ফাঁসির কারণ। যখন আমি প্রথম চুরি করিয়াছিলাম, তুমি জানিতে পারিয়াছিলে। সে সময়ে যদি তুমি শাসন ও নিবারণ করিতে, তাহা হইলে, আমার এ দশা ঘটিত না। তাহা কর নাই, এজন্য, তোমার এই পুরস্কার।
উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী
কাজির বিচার উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী রামকানাই ভাল মানুষ-নেহাত গোবেচারা। কিন্তু ঝুটারাম লোকটি বেজায় ফন্দিবাজ। দুইজনে দেখা-শোনা আলাপ-সালাপ হল। ঝুটরাম বললে, ‘ভাই দুজনেই বোঝা বয়ে কামকা কষ্ট পাই কেন? এই নাও, আমার পুঁটলিটাও তোমায় দিই-এখন তুমি সব বয়ে নাও। ফিরবার সময় আমি বইব। ‘রামকানাই ভালমানুষের মত দুজনের বোঝা ঘাড়ে বয়ে চলল। গ্রামের কাছে এসে তাদের খুব খিদে পেয়েছে। রামকানাই বলল, ‘এখন খাওয়া যাক-কী বল?’ ঝুটারাম বলল, ‘বেশ ত, এক কাজ করো, খাবারের হাঁড়ি দুটোই খুলে কাজ নেই মিছামিছি দুটোই নষ্ট হবে কেন? এখন তোমারটা থেকে খাওয়া যাক। ফিরবার সময় আমার খাবারটা খাওয়া যাবে। রামকানাই তাই করল। ঝুটরাম বলল, ‘ভাই তোমার বাড়ি কে কে আছে?’ রামকানাই তার বাবা, মা, ভাই, বোন, স্ত্রী ছেলেপিলে সকলের কথা বলতে লাগল-তার মেয়ে কত বড় হয়েছে-তার ছেলে কি করে-সব কথা বলল। রামকানাই যত কথা বলে, ঝুটারাম ততই আরো প্রশ্ন করে, আর গপাগপ ভাত মুখে দেয়। রামকানাই গল্পেই মত্ত, তার যখন হুঁশ হল- ততক্ষণে খাবার প্রায় শেষ হয়ে এসেছে। ঝুটারাম খাওয়া দাওয়া শেষ করে গম্ভীরভাবে ধুয়ে বলল, ‘ভাই একটি কথা। তুমি যে আমায় খাওয়ালে, সে এমন বিশ্রী রান্না, যে কি বলব! তুমি এমন খারাপ লোক, তা আমি জানতাম না। নেহাত তুমি বন্ধু লোক, তোমায় আর বেশি কি বলব, কিন্তু এরপর আর তোমার সঙ্গে আমার ভাব রাখা চলে না। আমি চললাম।’ এই বলে সে ভরা হাঁড়ি কাঁধে নিয়ে হন হন করে চলে গেল। সন্ধ্যার সময় পেটে খিদে নিয়ে এতখানি পথে হেঁটে কি করে সে বাড়ি ফিরবে-তাই ভেবে কাঁদতে লাগল। এমন সময় কাজির পেয়াদা সেখান দিয়ে যাচ্ছিল। সে রামকানাইকে বললে, ‘কাঁদ কেন?’ রামকানাই তাকে সব কাথা বলল। পেয়াদা বলল, ‘এই কথা। চলো দেখি বাজি সাহেবের কাছে। তিনি এর বিচার করেন।’ কাজির কাছে হাজির হতেই হুজুর বললেন, ‘কি চাও?’ রামকানাই তাঁকেও সব শোনাল। কাজি শুনে বললেন, ‘হাঃ-হাঃ-হাঃ-হাঃ-হাঃ-হাঃ! এমন মজা ত কখনো শুনি নি! আরে, তোকে দিয়ে জিনিস বইয়ে, আবার তোরই ভাত খেতে গেল? তোর আক্কেল ছিল কোথায়? হাঃ-হাঃ-হাঃ- বোলাও ঝুটারামকো!’ পেয়াদা ছুটল-তিন মিনেটের মধ্যে ঝুটারামের ঝুঁটি ধরে কাজির সামনে দাঁড় করাল। কাজি বললেন, ‘আরে দাঁড়াও দাঁড়াও। মোড়লকে ডাকো, শেঠজীকে ডাকো, কোটাল বদ্যি গুরুমশাই – ঢাক পিটিয়ে সবাইকে ডাকো, এমন মজার কথাটা সবাই এসে শুনে যাক।’ দেখতে দেখতে ঘর ভরিয়ে ভিড় জমিয়ে লোকের দল হাজির হল। তখন কাজি বললেন, ‘বাবা ঝুটারাম, এবার তুমি বলো দেখি, তোমাতে আর এতে কি হয়েছিল? ঝুটারাম ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে বললে, ‘দোহাই হুজুর, আমি কিছুই জানি না। ঐ হতভাগা আমায় ভুলিয়ে খানিকটা খাবার খাইয়েছিল-সেই থেকে আমার মাথা ঘুরছে আর গা কেমন করছে।’ এই কথা শুনে রেগে চিৎকার করে কাজি বললেন, ‘পাজি, আমার মজার গল্পটা মাটি করলি। খাবার খেলি আর মাথা ঘুরল, এ কি একটা কথা হল? পেয়াদা, দেখ ত ওর কাছে কি আছে। সব কেড়ে রাখ। ব্যাটার গল্পের মধ্যে যদি একটু রস থাকে। ও-সব ঐ রামকানাইকে দিয়ে দে। ও যা বলছে সত্যি হোক, মিথ্যা হোক, তার মধ্যে মজা আছে। আরে-হাঃ-হাঃ- হাঃ-হোঃ-হোঃ-হোঃ।’
উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী
কুঁজো আর ভূত উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী কানাই বলে একটি লোক ছিল, তার পিঠে তার পিঠে ছিল ভয়ঙ্কর একটা কৃঁজ। বেচারা বড্ড ভালমানুষ ছিল, লোকের অসুখ-বিসুখে ওষুধপত্র দিয়ে তাদের কত উপকার করত। কিন্তু কুঁজো বলে তাকে কেউ ভালবাসত না। কানাইয়ের ঝুড়ির দোকান লোক ছিল। আর কোনো ঝুড়িওয়ালা তার মত ঝুড়ি বুনতে পারত না। তারা তাকে ভারি হিংসা করত, আর তার নামে যা-তা বলে বেড়াত। তা শুনে লোকে ভাবত, কানাই বড় দুষ্টু লোক। তাকে দেখতে পেলে সকলে মুখ ফিরিয়ে থাকত। বেচারার দুঃখের সীমাই ছিল না। এত বড় কুঁজ নিয়ে মাথা গুঁজে চলতে কানাইয়ের বড়ই কষ্ট হত। একদিন সে একটু দূরে এক জায়গায় ঝুড়ি বেচতে গেল, আর দিন থাকতে ঘরে ফিরতে পারল না। পথে একটা পুরনো বাড়ির কাছে এসে এমনি অন্ধকার হল, আর তার এতই কাহিল বোধ হল যে, আর চলা অসম্ভব। সে জায়গাটা ভারি বিশ্রী; লোকে প্রাণান্তেও সে পথে আসতে চায় না। বলে, ওটা ভূদের বাড়ি। কিন্তু কানাইয়ের বড্ডই পরিশ্রম হয়েছে, চলবার আর সাধ্য নেই। কাজেই সে সেখানে পথের পাশে একটু না বসে আর কি করি? কতত্ষণ সে এভাবে বসে ছিল তার কিন্তু ঠিক নেই। বসে থাকতে থাকতে তার মনে হল, যেন সেই পুরনো বাড়িটার ভিতর থেকে আওয়াজ আসছে অনেকগুলো গলা মেলে। আহা, কি সুন্দর সুরেই গাইছে। শুনে কানাইয়ের প্রাণ জুড়িয়ে গেল। সে অবাক হয়ে খালি শুনতেই লাগল। গানের সুরটি অতি আশ্চর্য, কিন্তু কথা কালি এইটুকুঃ ‘লুন হ্যায়,তেল হ্যায়, ইম্‌লী হ্যায়, হিং হ্যায়!’ শুনতে শুনতে কানাই একেবারে মেতে গেল। সে ভাবল যে তারও গানটা না গাইলেই চলছে না। কাজেই সেও খুব করে গলা ছেড়ে সঙ্গে সঙ্গে ধরলঃ ‘লুন হ্যায়, তেল হ্যায়, ইম্‌লী হ্যায়, হিং হ্যায়!’ এইটুকুই গেয়েই ঝাঁ করে তার বুদ্ধি খুলে গেল, সে আরো উঁচু সুরে গাইল ‘লসুন হ্যায়, মরীচ হ্যায়, চ্যাং ব্যাং শুঁটকি হ্যায়।’ কানাই এই কথাগুলো খুব গলা ছেড়েই গেয়েছিল। সে গলার আওয়াজ যে সেই বাড়ির ভিতরের গাইয়েদের কানে গিয়ে পৌঁছিয়েছিল, তাতে আর কোন ভুল নেই। সে গাইয়েগুলো ছিল অবশ্য ভূত। তারা সেই নূতন কথাগুলো শুনে এতই খুশি হল যে, তখনই ছুটে কানাইয়ের কাছে না এসে আর থাকতে পারল না। তারা এসে কানাইকে কোলে করে নাচতে নাচতে সেই বাড়ির ভিতরে বেয়ে গেল, আর যে আদরটা করল! মিঠাই যে তাকে কত খাওয়াল, তার অন্ত নেই। তারপর সকলে মেলে নেচে নেচে ঘুরে ঘুরে গাইতে লাগলঃ ‘লুন হ্যায়, তেল হ্যায়, ইম্‌লী হ্যায়, হিং হ্যায়!’ ‘লসুন হ্যায়, মরীচ হ্যায়, চ্যাং ব্যাং শুঁটকি হ্যায়।’ কানাইকেও তাদের সঙ্গে নেচে নেচে গানটি গাইতে হল। তখন তার মনে হল, ‘কি আশ্চর্য, আমি কুঁজ নিয়ে চলতে পারি না, আমি আবার নাচলুম কি করে?’ বলতে বলতেই তার হাতখানি পিঠের দিকে গেল-এ কি? তার সে কুঁজ যে আর নেই! একজন ভূত বলল, ‘কি, দেখছিস বাপ? ওটা আর ওখানে নেই। ঐ দেখ, তোর পাশে পড়ে আছে।’ সত্যি সত্যে সে কুঁজ আর কানাইয়ের পিঠে ছিল না, তখন তার পাশে পড়ে ছিল। আহা! কানাইয়ের তখন কি অনন্দই হল। আর হালকা আর আরাম বোধ হল এমনি যে, সে তখনই সেইখানে মেঝেতে শুয়ে ঘুমিয়ে পড়ল। তারপর যখন পরদিন সকালে তার ঘুম ভাঙল, তখন সে দেখল যে সেই বাড়ির বাইরে রাস্তার ধারে শুয়ে আছে। ভূতেরা তাকে একটি চমৎকার নূতন পোশাক পরিয়ে সেখানে এনে রেখে গিয়েছে। তখন সে তাড়াতাড়ি উঠে, মনের সুখে বাড়ি চলে এল। সেখানকার লোকেরা তার মুখের পানে ফ্যাল ফ্যাল করে তাকায়, কেউ তাকে চিনতে পারে না। সে যে তাদের সেই কুঁজো কানাই, ভূতেরা তার কুঁজ ফেলে তার এমনি সুন্দর চেহারা করে দিয়েছে, এ কথা তাদের বোঝাতে তার অনেকক্ষণ লেগেছিল। তারপর দেখতে দেখতে কানাইয়ের কুঁজের গল্প দেশময় ছড়িয়ে পড়ল। যে শুনল, সেই ভাবল যে, এমন আশ্চর্য কথা আর কখনো শোনে নি। এখন আর লোকে তাকে দেখে মুখ ফিরিয়ে থাকে না; তারা হাসতে হাসতে ছুটে এসে তার সঙ্গে কথা কয়, আর বাড়ির লোককে তার এই আশ্চর্য খবর শোনাবার জন্য তাকে নিমন্ত্রণ করে নিয়ে যায়। কত লোকে শুধু সেই গল্প শোনাবার জন্যই তার ঝুড়ি কিনতে আসে। ঝুড়ি বেচে সে বড়লোক হয়ে গেল। এমনি করি দিন যাচ্ছে। তারপর একদিন কানাই তার ঘরের দাওয়ায় বসে ঝুড়ি বুনছে, এমন সময় একটি বুড়ি সেই পথে এসে তাকে জিজ্ঞাসা করল, ‘হ্যাগো, কেবলহাটি যাব কোন পথে? কানাই বললে, ‘এই ত কেবলহাটি। তুমি কি চাও?’ বুড়ি বলল, ‘তোমাদের গ্রামে নাকি কানাই বলে কে আছে, ভুতেরা তার কুঁজ সারিয়ে দিয়েছিল। তার মন্তরটা তার কাছ থেকে শিখে নিতে পারলে আমাদের মানিকের কুঁজটাও সারিয়ে নিতুম।’ কানাই বলল, ‘আমি ত সেই কানাই ভূতেরা আমারই কুঁজ সারিয়ে দিয়েছিল। এর ত মন্তর-টন্তর কিছু নেই, তারা রাত জেগে গাইছিল, আমি পথের ধারে শুয়ে শুয়ে তাদের গানে নতুন কথা জুড়ে দিয়েছিলাম। তাইতে তারা খুশি হয়ে আমার কুঁজ সারিয়ে, নূতন পোশাক পরিয়ে দিয়েছিল।’ বুড়ি তখন খুঁটে খুঁটে সব কানাইয়ের কাছ থেকে জেনে নিয়ে তাকে অনেক আশীর্বাদ করে সেখান থেকে চলে গেল। সেই বুড়ির ছেলে যে মানিক, তার পিঠে ছিল কানাইয়ের কুঁজের চেয়েও ঢের বড় একটা কুঁজ। লোকটা এমনি দুষ্ট আর হিংসুটে ছিল যে পাড়ার লোকে তার জ্বালায় অস্থির থাকত। সেই মানিকের কুঁজ সারাবার জন্য তার বাড়ির লোকেরা একদিন রাত্রে তাকে গাড়ি করে এরে ভূতের বাড়ির কাছে রেখে গেল। সেখানে পড়ে পড়ে মানিক ভাবছে, ভূতেরা কখন গান ধরবে, আর তাতে সে কথা জুড়ে দেবে, আর তার কুঁজ সেরে গাবে। তারপর যেই ভূতেরা বলেছেঃ ‘লুন হ্যায়, তেল হ্যায় , ইম্‌লী হ্যায়,’ অমনি মানিক আর তাদের শেষ করতে না দিয়ে চেঁচিয়ে বলল, ‘গুরুচরণ ময়রার দোকানের কাঁচা গোল্লা হ্যায়।’ তখন গানের তাল ভেঙে ত গেলই, কাঁচাগোল্লার নাম শুনে অনেক ভূতের বমি পর্যন্ত হতে লাগল। ভূতেরা এ সব জিনিসকে বড্ড ঘৃণা করে, এর নাম অবধি শুনতে পারে না। কাজেই তারা তাতে বেজায় চটে দাঁত খিঁচুতে খিচুতে এসে বললম ‘কে রে তুই অসভ্য বেতালা বেটা, আমাদের গান মাটি করে দিলি? দাঁড়া তোকে দিখাচ্ছি!’ এই বলে তারা কানাইয়ের সেই কুঁজটা এনে মানিকের কুঁজের উপর বসিয়ে এমনি করে জুড়ে দিল যে আর কিছুতেই তাকে তাকে তুলবার জো নেই। পরদিন মানিকের বাড়ির লোকেরা এসে তাকে দেখে অবশ্য খুবই আশ্চর্য আর দুঃখিত হল। কিন্তু গ্রামের লোকেরা বলল, ‘বেটা যেমন দুষ্টু, তেমনি সাজা হয়েছে।’
উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী
খুঁত ধরা ছেলে উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী বিলাতে চারিটি ভাই একদিন এক জায়গায় বসিয়া কথাবার্তা কহিতেছিলেন। তাহাদের আলাপের বিষয়, কে কি করিবে। সকলেরই মনে ইচ্ছা, একটা কিছু হওয়া চাই। সকলের ‘একটা কিছু’ত আর একরকম হয় না। তাই চার ভাই চাররকম কথা বলিল। একজন বলিল-‘আমি ইঁটের কারবার করিব। তাহাতে টাকা হইবে, আর ইঁট দিয়া আমার একখানা বাড়ি করিব।’ আর-একজন বলিল-‘দূর হ, তোর নেহাত ছোট নজর। আমি তোর চাইতে বেশি একটা কিছু হ’ব-আমি ইঞ্জিনিয়ার হ’ব। কত লোক আমার কাছে ঘরবাড়ির নক্সা করিয়ে নিতে আসিবে, কত লোকের বাড়ি-ঘর বাঁধিয়া দিব। আমি একটা “দশজনের একজন” হইব। বলিস্‌ কি; আমার নামে একটা স্ট্রীট যদি না হয়, তখন দেখিস্‌।’ তৃতীয় ভ্রাতা-‘বিল্‌ডার, কন্ট্রাক্টর, ইঞ্জিনিয়ার সব বাজে লোক, তোরা হ’বি চিনির বলদ। আমি কি করিব জানিস্‌। আমি অন্যের কাজ নিয়ে ছুটোছুটি করিতে যাইব কেন। সব কাজে আমার নিজের বুদ্ধি খাটিবে। সব নূতন ফ্যাসানে বাড়ি-ঘর করিব। আমার সব এমন হইবে, যাহা কেহ কখন দেখে নাই।’ শেষ ব্যক্তি উঠিয়া বলল-‘তোরা যাহাই করিস্‌ ভাই এমন কিছু করিতে পারিবি না, যাহার উপর আমার বক্তৃতা না চলিবে। উত্তম হইল; দেখ্‌ দেখি। তোরা যাহা করিবি, আমি তাহার দোষ ধরিব। আমার কাজের আর অভাব কি? চারি ভায়ের পরামর্শ ঠিক হইল। একজন ইঁটের কাজ করিয়া কিছু টাকা করিল। ইঁট দিয়া তাহার একটি বাড়ি হইল। তাছাড়া এক দুঃখিনী বুড়িকে ঐ ইঁট দিয়া আর একটি ঘর করিয়া দিল। কন্ট্রাক্টর ইত্যাদি মহাশয়ও কথামত কাজ করিলেন। মিউনিসিপ্যালটিকে খোঁচাইয়া নিজের নামে একটি স্ট্রীট পর্যন্ত কেমন করিয়া লইয়াছেন। তিনিও একটা কিছু হইয়াছেন। তৃতীয় বেচারা নূতন ধরনে বাড়ি করিতে দিয়া চাপা পড়িয়া মরিল। খুঁতধরা মহাশয়ের ত কথাই নাই। তাহার কাজ ফুরায়ই না। মরিবার সময় পর্যন্ত সে সন্তোষজনক রূপে, প্রশংসার সহিত কর্তব্য-কাজ করিয়া গেল। একদিন স্বর্গের দরজায় দারোয়ান-দেবতা বসিয়া রহিয়াছেন। সে প্রকাণ্ড দরজা। বিশ্বকর্মার হাতের তৈরি। বুঝিতেই ত পার, স্বয়ং বিশ্বকর্মা ঠাকুর যাহা করিয়াছেন সে কেমন সুন্দর। এত সুন্দর যে আর কি বলিব! দরজায় প্রকাণ্ড দুখানা কাচ লাগান। তাহার ভিতর দিয়া দরোয়ান-ঠাকুর কে আসিল দেখিতে পান। কিন্তু সম্প্রতি তিনি তাহা করিতেছিলে না। অনেক কাল হইল স্বর্গে লোক আসে না,। তাই আজ-কালের ব্যস্ততা কিছু কম।দেবতা দরজা খুলিবার হীরার হ্যান্ডেলে হাত ঝুলাইয়া সোনার টুলে বসিয়া ঝিমাইতেছেন। এমন সময় কড়াৎ কড়াৎ করিয়া দরজার ঘা মারিবার শব্দ হইল। বাহির হইতে একজন লোক বলিতেছেন- ‘অনুগ্রহ করুন মহাশয়, আমি ভিতরে আসিতে প্রার্থনা করিতে পারি? দরজাগুলি ত মন্দ নয়। কিন্তু স্বর্গের দ্বার বন্ধ থাকিবে কেন? দরজাগুলি আরো বড় হওয়া উচিত।’ ‘তুই কেরে, পৃথিবীর লোক, ক্যাচ্‌ ক্যাচ্‌ করিয়া কথা কহিতেছিস্‌?’ ‘অত মোটা সুরে বলিতেছেন কেন?- আমি স্বর্গে যাইতে চাই।’ ‘বটে? তুই করিয়াছিস কে?’ ‘আমি খুঁত-ধরা কাজ করিয়াছি। আমার তিন ভাই যে কাজ করিয়াছে, তাহার সমস্ত দোষ আমার নোট বহিতে লিখিয়া আনিয়াছি। যে ইঁট পোড়াইয়াছিল, সে আর দুই মণ কয়লা কম খরচ করিলে সুরকিওয়ালা সহজেই খোয়া করিতে পারিতে। যার নামে স্ট্রীট হইয়াছে, সে এত রোগা যে অত বড় স্ট্রীট তাহার দরকার নাই। যে চাপা পড়িয়া মরিয়াছে- ’ ‘আরে থাম্‌ থাম। ও-সব কি কাজ? তুই নিজের হাতে কি করিয়াছিস্‌? ‘এই-সব নোট লিখিয়াছি।’ ‘দূর হ ব্যাটা, তুই কি আর কোন কাজই করিস্‌ নাই? কেবল দোষ ধরা কাজই করিয়াছিস্‌?’ ‘আর স্মৃতি পুস্তিকায় তাহা লিখিয়াছি।’ ‘যা, যা! তোর এখানে আসিবার হুকুম নাই।’ ‘আউ পচারিব কাঙ্কু, জগনাথঙ্কু,-‘ বলিয়া দারোয়ান দেবতা গান ধরিলেন। আমাদের সমালোচক দেখিলেন যে এত পথ খরচ, রেলভাড়া, গাড়িভাড়া করিয়া আসিয়াও কোন ফল পাইলেন না। বিরক্ত হইয়া মনে করিলেন যে, কাগজে লেখা উচিত ‘স্বর্গে ভালো অভ্যর্থনার বন্দোবস্ত নাই।’ গাড়ি পাইতে অনেক দেরি, সুতরাং ইত্যবসরে দরজার দোষগুলি টুকিয়া রাখিতে লাগিলেন। দরজার কথা শেষ হইলে, সাহেব দ্বারী-ঠাকুরের গানের এক মজার বর্ণনা লিখিতেছেন, এমন সময় দেখিলেন যে, যে বুড়িকে তাহার ভাই ঘর করিয়া দিয়াছিল, সে আসিতেছে। তিনি আশ্চর্য হইয়া জিজ্ঞাসা করিলেন- ‘ও বুড়ি! তুই কেমন করিয়া আসিলি?’ ‘তাই ত বাপু, আমি ত কিছু জানি না। আমি দুঃখিনী বুড়ি, এমন ত কিছু করি নাই, যাহাতে এখানে আসিতে পারি।’ ‘তুই কি কোন কাজ করিস্‌ নাই? আমি ত সমালোচনা করিয়াছি।’ ‘আমার আর ত কিছুই মনে হয় না। তবে একদিন আমার বাড়ির কাছে পুকুরে জমা বরফের উপরে পাড়ার সকলে খেলা করিতে গিয়াছিল। যাইবার সময় আমাকে সকলেই দেখিয়া মিষ্টি কথা কহিয়া গেল। আমি ভয়ানক কাতর ছিলাম। কিছুকাল পরে দেখি, আকাশে একরকম মেঘ দেখা দিয়াছে। ওরূপ মেঘ আমার জন্মে আমি আর একবার দেখিছিয়ালাম। তখন দুই মিনিটে মধ্যে সমুদয় বরফ ফাটিয়া গিয়াছিল। আমার মনে বড় ভয় হইল। এখনই এতগুলি লোক ডুবিয়া মরিবে ভাবিয়া আমার চক্ষে জল পড়িতে লাগিল। আমি কি করি? রোগে মরি, উঠিবার শক্তি নাই, ডাকিলেও কেউ আমার কথা শুনিবে না। তখন আমি আস্তে আস্তে অনেক কষ্টে বাহিরে আসিয়া আপনার(নিজের) ঘরে আগুণ লাগাইয়া দিলাম। সকল লোক বুড়ি পুড়িয়া মরিল মনে করিয়া দৌড়িয়া আসিল। আমি তারপর কি হইল বিশেষ জানি না। কেবলমাত্র একবার জিজ্ঞাসা করিলাম, ‘কার কিছু হয় নি ত?’একজন লোক বলিল, ‘না, আমরাও আসিয়াছি আর বরফও ভাঙ্গিয়া গিয়াছে।’ তারপর আর কিছু জানি না। কে যেন আমাকে এখানে আনিয়াছে।’ বুড়ির কথা শুনিয়া দরোয়ান-দেবতা স্বর্গে খবর দিলেন। আর দলে দলে দেবতারা আসিয়া ‘এসো এসো’ বলিয়া আদর করিয়া বুড়িকে স্বর্গের ভিতরে লইয়া চলিলেন। কিন্তু বুড়ি সমালোচকের দিকে চাহিয়া কাঁদিতে লাগিল। বলিল-‘ওর ভাই আমাকে বাড়ি করিয়া দিয়াছিল, আমার থাকিবার জায়গা ছিল না। ও মুখ কাল করিয়া ফিরিয়া যাইবে, আর আমি কোন প্রাণে তোমাদের সঙ্গে যাইব? আমার মনে বড় লাগে। আমাকে তোমরা স্বর্গে নিও না। এ বেচারা তাহা হইলে বড় কষ্ট পাইবে।’ তখন দেবতারা সমালোচককে-‘অলস! অপদার্থ! যা! বুড়ির জন্য তোকে স্বর্গে নিয়া যাওয়া হইল। তুই জীবনটা কেবল সমালোচনা করিয়াই কাটাইলি, ভাল কাজ কিছুই করিলি না। তোর মতন লোক আর এর পূর্বে স্বর্গে যায় নাই। দেবতারা তারপর বুড়ির সঙ্গে সমালোচককেও টানিয়া স্বর্গে নিয়া চলিলেন। সমালোচক হতবুদ্ধি হইয়া রহিল। একবার মাত্র বলিল,‘টানিয়া লওয়া বুঝি তোমাদের অভ্যাস নাই? ভাল করিয়া টানা হইতেছে না। এমনি বুঝি টানে।’ ঢেঁকি যেখানে থাক্‌, তার ধান ভানা কাজ ঘোচে না। আমাদের সমালোচক ভায়া স্বর্গে গিয়াও খুঁত ধরিতে ব্যস্ত, আর কিইবা করে, একটা কাজ ত চাই? কতকগুলি ছেলে আছে, তাহারা কেবলই খুঁত ধরে; পরের দোষ দেখিয়া তাহার নিন্দা করার চেয়ে নিজের শোধরাইয়া পরের গুণ দেখা ভাল।
উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী
গল্প নয় সত্য ঘটনা উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী জন্তুওয়ালা অনেক জন্তু লইয়া শহরে একটি ঘর ভাড়া করিয়াছে। মনে করিয়াছে, আজ হাটের দিন বিন্তর লোক আসিবে, আর তামাশা দেখিয়া পয়সা দিবে। হাটে লোকের কম নাই, কিন্তু জন্তুওয়ালার ঘরের আধখানাও ভরিল না। জন্তুগুলারও যেন ফুর্তি নাই। লোক কম দেখিয়া তাহারাও কেমন হাল ছাড়িয়া দিয়াছে। ভাল তামাশা হইতেছে না দেখিয়া যে দু-চার জন দর্শক উপস্থিত, তাহারাও হাসি- ঠাট্রা করিতেছে। এমন সময়ে বাঘটার যেন কি হইল। সে এতক্ষণ খাঁচার এক কোণে শুইয়া ঝিমাইমেছিল। কথা নাই, বার্তা নাই, হঠাৎ লাফাইয়া উঠিয়া, খাঁচার শিক ধারিয়া দাঁড়াইয়া ভয়ানক গর্জন! সেই গর্জন শুনিয়া দর্শকেরা হাসি ঠাট্রা ফেলিয়া, দুই লাফে দূরে সরিয়া গেল। ব্যাপারখানা কি? এত রাগের ত কোনো কারণই দেখা যায় না- তবে ঐ যে গাঁট্রাগোট্রা, লাল-গোঁপওয়ালা জাহাজের মাল্লাটা, নীল কোট পরিয়া থেঁতলো টুপি মাথায় দিয়া, এইমাত্র তামাশা দেখিবার জন্য ঘরের ভিতরে আসিয়াছে। তাহাকে দেখিয়া যদি বাঘ মহাশয়ের ক্রোধ হইয়া থাকে। মাল্লা বাঘের খাঁচার দিকে চাহিল, বাঘটাকেও খানিকক্ষণ ধরিয়া মনোযোগ করিয়া দেখিল, তারপর অমনি একেবারে বাঘের কাছে গিয়া উপস্থিত! বাঘ তাহাকে কাছে পাইয়া আরো গর্জন করিয়া উঠিল। দর্শকেরা ভারি আশ্চর্য হইয়া গেল, আর তাহাদের বড় ভয়ও হইল। মাল্লা কিন্তু ততক্ষণে খাঁচার ভিতর হাত ঢুকাইয়া দিয়া, দিব্যি বাঘের মাথা চাপড়াইতে আরম্ভ করিয়াছে- সেটাকে যেন সে বিড়াল ছনা পাইয়াছে। মাল্লা বলিল- কি রে বিল্লি, কেমন আছিস ভাই? লোকগুলি ভয়ে শিহরিয়া উঠিল্‌ যে- ভয়ংকর দাঁত, এক কামড়েই ত মাল্লার হাতখানাকে একেবারে ছিঁড়িয়া ফেলিবে। বাঘ কিন্তু তেমন কিছুই করিল না। সে তাহার প্রকাণ্ড মাথাটা আনিয়া, আদর করিয়া জ্যাকের (মাল্লার নাম) হাত ঘষিতে লাগিল, আর আদর পাইলে বিড়ালের গলায় যেমন গুড়গুড় শব্দ হয়, তেমনি শব্দ করিতে লাগিল। মূহুর্তের মধ্যে বাহিরের লোকে ইহার খবর পাইয়া দৌড়িয়া ঘরে আসিতে লাগিল, ঘরে আর লোক ধরে না। কত লোক দরজার এক পয়সার জায়গায় সিকি দুআনি ফেলিয়া দিয়া আর বাকি পয়সার জন্য দাঁড়ায় নাই, তাড়াতাড়ি ঘরে ঢুকিতে পারিলেই ঢের মনে করিয়াছে। জন্তুওয়ালার এখন আর দুঃখ করিবার কোনো কারণ নাই। তাহার বাক্স বোঝাই হইয়া গিয়াছে। মাল্লা ততক্ষণে জন্তুদের একজন প্রহরীর হাত ধরিয়া বলিল, ‘বিল্লির খাঁচাটা একবার খোলো না ভাই। ও আমার পুরনো বন্ধু। একবার ভেতরে গিয়ে ওর সঙ্গে পুরনো কালের দুটো গল্প করে নিই।’ প্রহরি বেচারা একটু মুশকিলে পড়িল, আর তা হওয়ারই কথাল বাঘকে বিশ্বাস কি? চোখের সামনে একটা লোককে চিবাইয়া খাইবে, এরূপ দেখিতে তাহার একেবারেই ইচ্ছা ছিল না। আর খাঁচা খুলিলে জ্যাক ঘরে যাইবেন, অথচ বাঘ বাহিরে আসিবেন না, এরূপ করাও ত সহজ ব্যাপার নয়। বাঘ যদি একবার বাহিরে আসিয়া হাই তোলেন, তবে তামাশাটা কি রকমের হইবে! প্রহরী আমতা আমাতা করিয়া জিজ্ঞাসা করিল, ‘তুমি সত্যি বলছ নাকি?’ জ্যাক একটু চটিয়া বলিল, ‘সত্যি বলছি না ত কি? এ কোথাকার বোকা! দেখতে পাচ্ছ না, ও আমাকে চিনতে পেরেছে?’ বাঘ সেই সময় আর- এক হাঁক দিয়েছে, যেন বলিতেছে- ‘হ্যাঁ হে হ্যাঁ।’ প্রহরী অনেক ইতস্তত করিয়া একহাতে দরজা খুলিল, আর- এক হাতে একখানা লোহার রুল বাগাইয়া ধরিল। জন্তুগুলি কথা না শুনিলে ঐ রুল দিয়া সে তাহাদের শাসন করে। যেই দরজা খুলিল, অমনি দর্শকেরা তাড়াতাড়ি সরিয়া দাঁড়াইল- পাছে বাঘমহাশয়ের হঠাৎ জলযোগের খেয়াল হয়, আর বাহিরে আসিয়া দু- একটিকে ধরিয়া মুখে দেয়! কিন্তু বিল্লি তাহার বন্ধুকে লইয়া ব্যস্ত ছিল, অন্য লোকের কোনো খবর নেয় নাই। বাঘ অনেকবার মাল্লার চারিদিকে ঘুরিয়া অত্যন্ত স্নেহের সহিত তাহার গায়ে মাথা ঘষিতে লাগিল। তারপর দুই পায়ে দাঁড়াইয়া, হাত দুখানি জ্যাকের কাঁধে তুলিয়া দিল, জ্যাকও তাহার টুপিটা লইয়া বাঘের মাথায় পরাইয়া দিল। টুপি পরিয়া বাঘকে নেহাত মন্দ দেখিতে হইল না- দর্শাকেরা খুবই হাসিয়াছিল। কিন্তু তারপর আরো মজা হইয়াছিল। টুপিটি ফিরাইয়া লইয়া মাল্লা বলিল, ‘বিল্লি, যা শিখিয়েছিলাম, মনে আছে ত? দেখি- লাফা।’ মাল্লা হাত খুব বাড়াইয়া ধলিল, আর বাঘ তাহার ঐ প্রকাণ্ড শরীরটা লইয়া পরিষ্কার তাহার উপর দিয়া লাফাইয়া গেল। ‘আচ্ছা, ফিরে এসো।’ বাঘ অমনি আবার লাফাইয়া ফিরিয়া আসিল। ভারি বাধ্য ছাত্র! প্রহরী ভারি আশ্চর্য হইয়া গেল। সে কত চেষ্টা করিয়াও সেই বাঘকে দিয়া এত কাজ করাইতে পারে নাই। তাই সে জিজ্ঞাসা করিল, ‘ভাই,এত কথা ওকে কি করে শেখালে?’ জ্যাক হাসিয়া বলিল, ‘জাহাজে থাকতে ওকে খাওয়ানোর ভারটা আমার হাতেই ছিল। সেটা দেখছি আজও সে ভোলে নি, কেমন রে বিল্লি?’ বাঘ একটু ঘোঁত করিল, যেন বলিল ‘আরে,না।’ মাল্লা বলিল, ‘আচ্ছা বিল্লি, বোসো ত’। অমনি বাঘ মাটিতে বিড়ালের মতন করিয়া বসিয়া পড়িল। মাল্লা তাহার গায়ে ঠেসান দিয়া বসিয়া এক হাতে তাহার থাবা চুলকাইয়া দিতে লাগিল। তারপর গান ধরিল। বাঘ গানের সঙ্গে সঙ্গে ধুপধাপ করিয়া খাঁচার মেঝে চাপড়াইতে লাগিল। খাঁচাখানা কাঁপিতে লাগিল। মাল্লা যখন খুব জোরে গাহিতে লাগিল, তখন বাঘ ‘এয়াও’ করিয়া তাহার সঙ্গে তান ধরিল। সেই তানের চোটে ঘরের জানলাগুলি খট খট করিয়া উঠিল। আরো তামাশা হইত,কিন্তু জ্যাক এই সময়ে জানালার ভিতর দিয়া গির্জার ঘড়ি দেখিতে পাইল। তাহাকে রেলে অনেক দূর যাইতে হইবে, আর দেরি করিলে চলিতেছে না। সুতরাং সে বিল্লির কাছে বিদায় লইল। বিল্লি কিন্তু তাহাকে অত তাড়াতাড়ি ছাড়িতে রাজি নহে। জ্যাকের সঙ্গে সঙ্গে সেও খাঁচার দরজায় আসিয়া দাঁড়াইল। প্রহরী দরজা খুলিলে সেও জ্যাকের সঙ্গে যাইবে! প্রহরী দরজা খুলিতেছিল, বাঘের কাণ্ড দেখিয়া আর খুলিল না। জ্যাক তিনবার চুপচাপ সরিয়া পড়িতে চেষ্টা করিল, বাঘ তাহার কোটের কোণ কামড়াইয়া ধরিয়া তিনবার ফিরাইল। জ্যাক মুশকিলে পড়িয়া বলিল, ‘এ ত বড় মুশকিল রে বাবু। আমি ত থাকতে আসি নি, আমি শুধু দেখতে এসেছিলাম।’ কিন্তু প্রহরীর মুখ ততক্ষণে গম্ভীর হইয়া উঠিয়াছে। মাল্লা যতই যাইতে চাহিতেছে, বাঘ ততই বিরক্ত হইতেছে। শেষে চটিয়া গিয়া এক থাপ্পড় বসাইয়া দিলেই ত মাল্লার দফা নিকাশ হইয়া যায়! এই সময়ে এক বুদ্ধি জুটিল। খাঁচাটাতে দুই কামরা। বাহিরটাতে বাঘ সকল লোকের সামনে তামাশা দেখায়, ভিতরেরটাতে বসিয়া সে আহার করে। মাঝখানে দরজা আছে, বাহির হইতেই তাহা খোলা ও বন্ধ করা যায়। এই ভিতরের কামরায় বড় এক টকুরো মাংস ঢুকাইয়া দেওয়া হইল, আর বাঘ অমনি বন্ধুকে ভুলিয়া খাইবার ঘরে ঢুকিল। চতুর প্রহরী তৎক্ষণাৎ মাঝকানের দরজা বন্ধ করিয়া দিল। জ্যাকও সুযোগ বুঝিয়া তাহার পথ ধরিল।
উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী
গল্প-সল্প উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী ১ যদু যেমন ষণ্ডা ছিল, সে খেতেও পারত তেমনি। যখন সে খুব ছোট সে খুব ছিল, একদিন সে গেল এক বড়লোকের বাড়ি নিমন্ত্রণ খেতে। ভারি ভারি খাইয়ে সব সেখানে খেতে বসেছে, লুচি কোরমার ধুম লেগে গেছে। খাইয়েরা খুব খেতে পারাটাকে বড়ই বাহাদুরি মনে করে। তাই খাওয়া শেষে হবার সময় তারা বললে, ‘আচ্ছা, আজ কে সকলের চেয়ে বেশি খেয়েছে?’ এ কথায় কেউ বলছে, ‘আমি!’ আর কেই বলছে, ‘না আমি! ত শুনে যারা পরিবেশেন করছিল তাদের এ‌কজন বলল, ‘আজ্ঞে না; সকলের চেয়ে বেশি খেয়েছে এ ছেলেটি (মানে, যদু)।’ সে ‘এতগুলো’ লুচি আর ‘এত টুকরো’ কোরমা খেয়েছে। সকলে তাতে ভারি আশ্চর্য হয়ে যদুকে জিজ্ঞেসা করল, ‘হ্যাঁ রে, সত্যি নাকি তুই এত খেয়েছিস?’ যদু বলল, ‘খেয়েছি বৈকি। আরো খেতে পারি!’ তা শুনে সবাই বলল, ‘বটে? আচ্ছা আন্‌ দেখি লুচি কোরমা, দেখি ও আর কত খেতে পারে।’ শুনেছি তখন নাকি যদু আরো এক দিস্তা (চব্বিশখানা) লুচি আর আঠার টকুরো কোরমা খেয়েছিল। সত্যি মিথ্যে ভগবান জানেন, আমার তখন জন্ম হয় নি। এত খেয়েও যে যদুর পেট ভার হয়েছিল তা মনে করো না। সে তখনি সুপারির ডালের ঘোড়া হাঁকিয়ে বাড়ি এল, এসে কালোজাম গাছে উঠে আরো অনেকগুলো কালোজাম খেল। ২ এ হল বহুকালের কথা। তখন ‘খাইয়ে’ বললে ভারি একটা গৌরবের কথা হত। সে সময় এক ব্রাহ্মণ এই বাহাদুরির লোভে মারাই গিয়াছিলেন। কোন বড়লোকের বাড়িতে তাঁকে মাঝে মাঝে নিমন্ত্রণ করে, তাঁর যা ইচ্ছা, যত খুশি খেতে দেওয়া হত। একদিন সেখানে খেতে বসে বললেন, ‘আজ আমি শুধু ছানা আর চিনি খাব।’ তাই তাকে এনে দেওয়া হল। তিনি তখন সাতসের ছানা চেঁছেপুছে শেষ করে, বিস্তর বাহদুরি পেয়ে, বাড়ি এসে সেই রাত্রেই পেট ফেঁপে মরা গেলেন। আর-একটি ভটচাজ্জি মশায়েরও বিষয়ে খুব নাম ছিল। সকলে যখন তাঁর খাওয়া দেখে আশ্চর্য হত, তখন তিনি নিজের কপালে টোকা দিয়ে বলতেন, ‘দেখছ কি? এই টুকু নিরেট, আর সব পেট।’ ৩ একটি ছেলের মনটি বড় ভাল, কিন্তু স্বভাবটি একটু পাগলাটে গোছের। সে একদিন রাত্রে এক জায়গায় গিয়েছিল-পূজা দেখতে। ঢুকবার সময় তার বুট জোড়াটি বাইরে রেখে গিয়েছিল, ফিরে এসে দেখে, কে তা নিয়ে গেছে। ছেলেটি ত তাতে হেসেই অস্থির। সে বলল, “বেটা ভারি ঠকেছে, পুরনো জুতো চুরি করেছে, দু মাসও পায়ে দিতে পারবে না।” যা হোক এখন বাড়ি ফিরে ত যেতে হবে, কাজেই শুধু পায়ে হেঁটে, ট্রাম ধরবার জন্য হেদোর ধারে এসে উপস্থিত হল। সেখান থেকে তার বাড়ি পঁচিশ মিনিটের পথ-পটলডাঙ্গায়। সে হেদোয় এসেই ট্রাম পেয়েছিল, কিন্তু তখন সে ভাবল, এখান থেকে উঠে কেন নাহক ঠকি! সেই ছ’পয়সাই ত দিতে হবে,-আমি শ্যামবাজারে গিয়ে ট্রাম ধরে পয়সা আদায় করে নেব। বলে সে ত সেই শুধু পায়ে হেঁটে হেঁটে গিয়ে শ্যামবাজারে আড্ডায় উপস্থিত হয়েছে। সেখানে দিয়ে সে শুনল যে সেদিন আর ট্রাম পাওয়া যাবে না। হেদোর ধারে যেখানা সে পেয়েছিল, সেই ছিল শেষ গাড়ি! সেদিন সে বাড়ি ফিরে এলে পর তার হাসির চোটে বাড়িসুদ্ধ লোকের ঘুম ভেঙে গিয়েছিল। ৪ বাংলা অক্ষরে, যেমন অন্য-সব ভাষায় সকল কথা লেখা যায়-যেমন ‘আই গো আপ’, কিংবা কোন নাম যেমন ‘লর্ড কারমাইকেল’, ‘জেমস ওয়াট’, সেরকম কিন্তু সব ভাষায় চলে না। চীনা ভাষায় এক একটি অক্ষরের এক একটি কথা। একজন বাঙালি বাবু একজন চীনা ভদ্রলোককে বললেন, ‘আপনি আপনাদের ভাষার অক্ষরে আমার নাম লিখুন ত। আমার নাম ‘ধ্রুব’। চীনা ভদ্রলোকটি অনেকক্ষণ ভেবেচিন্তে কতকগুলি হিজিবিজি কি যেন লিখলেন। সেই লেখা অন্য একজন চীনা ভদ্রলোককে পড়তে দেওয়া হল। সে বলল, ‘এতে লেখা রয়েছে- দু-লুফা।’ একজন জাপানী ভদ্রলোক ট্রাফালগারের সম্বন্ধে জাপানীভাষায় কি যেন লিখছিলেন। তাঁর লেখার মধ্যে যেখানে ট্রাফালগার কথাটা আছে, সেটা তিনি ইংরেজীতেই লিখছিলেন। একজন তাঁকে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘আপনি ও কথাটা ইংরেজীতে লিখলেন যে?’ জাপানী ভদ্রলোক বললেন, ‘আমাদের ভাষার অক্ষর দিয়ে ট্রাফালগার লেখা যায় না, সবচেয়ে কাছাকাছি যা লেখা যায়, তার উচ্চারণ হচ্ছে- ত্রা-ফারু-গারু’। ৫ এক সাহেবের বড় বাংলা শেখবার শখ হল। তিনি এক পণ্ডিত রেখে খুব উৎসাহের সঙ্গে পড়তে আরম্ভ করলেন। গোড়ায় কয়েকদিন বেশ উৎসাহের সঙ্গে পড়া চলল; কিন্তু যখন যুক্ত অক্ষর পড়া আরম্ভ হল, তখনি ত সাহেবের যত গোল বাধল। তিনি যুক্ত অক্ষর দেখে ত চটেই অস্থির, ‘কি! একটা অক্ষরের ঘাড়ে আর একটা অক্ষর। এমন আজগুবি ভাষাও ত দেখি নি। এমন ভাষাও আবার ভদ্রলোকে পড়ে! মানুষের ঘাড়ে মানুষ, আর অক্ষরের ঘাড়ে অক্ষর, এ কেবল তোমাদের দেশেই সম্ভব। ৬ এক চাষার একটু বুদ্ধি কম ছিল। চাষা মাঠে যাবে কাজ-করতে, সারাদিন ত সেখানে থাকতে হবে, তাই তার স্ত্রী বিকালে জলখাবারের জন্য তার কাপড়ে দশখানা চাপাটি বেঁধে দিল। চাষা ভারি পেটুক ছিল। সে মাঠে যেতে না যেতেই ভাবল, ‘উঃ! আমার দেখছি, এক্ষুনি বড্ড খিদে পেয়েছে, চাপাটি খাব নাকি! না, তা হলে বিকালে খাব কি?’ খানিক বাদে সে ভাবল, ‘উঃ। বড্ড খিদে পেয়েছে, একখানা চাপাটি খাই, বাকি বিকালে খাব।’ ভাবল ‘আর একখানা খাই।’ যত খায, ততই তার খিদে যেন বেড়ে যায়। একখানা দুখানা করে সে আটখানা খেয়ে ফেলল, তবুও তার পেট ভরল না। শেষে বাকি দুখানও বার করে খেতে হল, তার তাতে তার পেটও ভরে গেল। তখন চাষা ভাবল, ‘আটটা খেলাম, তাতে কিছু হল না, আর এ দুটো খেতে না খেতেই পেট ভরে গেল। আহা! এ দুখানা কেন আগে খেলুম না, ত হলে ত গোড়াতেই পেট ভরত, আর আমার কোঁড়ে আটখানা চাপাটি থেকে যেত। তাইত, আমি কি বোকা!’ ৭ এক ভদ্রলোকের বাড়িতে ভোজ হচ্ছে। একদল গুলিখোর তাই শুনে সেখানে নিমন্ত্রণ খেতে চলল। যেতে যেতে তাদের একজন বলল, ‘আরে, তোরা যে যাবি, ফটক শুনেছি বড্ড নিচু-ঢুকবি কি করে?’ তা শুনে আরেকজন বলল, ‘কেন? এমনি করে ঢুকব!’ বলেই সে হামাগুড়ি দিয়ে চলতে আরম্ভ করল। তা দেখে আর সবকটাও তেমনি করে হামাগুড়ি দিতে লাগল। এইভাবে ত তারা গিয়ে ভোজের বাড়িতে উপস্থিত হয়েছে, আর অমনি যমদূতের মতন চারটে দারোয়ান এসে তাদের ঘাড়ে চেপে ধরেছে। তখন সেই প্রথম গুলিখোরটা ভারি গম্ভীর হয়ে মোটা গলায় বলল, ‘এখন দেখ্‌ দেখিনি? আমি বলেই ছিলাম, যে, ফটক নিচু, আটকাবে!’ ৮ একটি মাসে দশটি টাকার কমে একটি স্কুলের ছেলের খাওয়া চলে না। আমাদের ছেলেবেলায় আমার চাকরকে দু’পয়সা করে দিয়েছি। তাতেই সে আমাদের দুবেলা খেতে দিয়েছে। আমি কিন্তু হিসাব-কিতাবের কথা বলতে যাচ্ছি না, আমি সেই চাকরটির কথা বলছি। তার নাম-আমরা তার সাক্ষাতে বলতাম ‘কালী’, অসাক্ষাতে বলতাম ‘কেলে’। দুপয়সায় দুবেলা মাছ, তরকারি, ডাল, ভাত পেট ভরে খেতে দিতে হবে। কেলে তা ত দিতই, আবার তার উপরে ঢের লাভ করে নিতেও ছাড়ত না। তার লাভের চোটে আমাদের পেট চোঁ চোঁ করত। বাজারে যতরকমেরই মাছ উঠুক, কেলে আনে শুধু বাটা। ছ-আঙুল লম্বা একটি মাছ, তাকেই দুভাগ করে একজনকে দেয় ল্যাজা, আর-একজনকে দেয় মুড়ো। যে ল্যাজা পায়, তার তবু দুগ্রাস খাওয়া চলে। কিন্তু যে মুড়া পায়, সে বেচারার খালি চোষাই সব। মাছ পাতে পড়তেই ছেলেরা একজন আর একজনকে ডেকে খবর নেয়, কার ভাগে কি জুটেছে, কিন্তু সে কথা কেউ বাংলাতে বলতে ভরসা পায়না। কেলের মেজাজটা বেজায় বেয়াড়া আর মুখটা অতি অসভ্য। ছেলেরা তাই ইংরেজীতে বলে ‘কি হে, হেড না টেইল?’ একদিন একজনের পাতে পড়েছে ‘ল্যাজা, সে ভুলে বলে ফেলেছে ‘হেড’। অমনি কেলে বিষম দাঁত খিঁচিয়ে বলল, ‘কি? তোমাকে দিলাম টেইল, আর তুমি যে বললে হেড?’ সেদিন খাওয়া দাওয়ার পর ছেলেরা ঘরে এসে বলতে লাগল, ‘নাঃ, বেটাকে জব্দ করতে না পারলে আর চলছে না। ইংরেজিতে কথা বলব, তাও দুদিন শুনেই বুঝে নেবে, একি সহ্য হয়?’ তখন এই যুক্তি হল যে, তরকারি যতই কম হোক, সবাই মিলে কষে ভাত খেয়ে কেলেকে নাকাল করবে। বারজনের রান্না হয়, সেদিন রাত্রে পাঁচজনেই তার সব চেঁছেপুছে খেয়ে বসে আছে, আবার বলছে ‘আরও দাও’! হাড়ি পানে চেয়ে কেলের মুখ শুকিয়ে গেছে, কিন্তু আর উপায় কি? পেট ভরে খেতে দিতেই হবে। সে বেলার কাজ শেষে দই চিড়ে এনে চালাতে হয়েছিল। কাজেই লাভ যা হয়েছিল, তা উলটা বাগে। তার পরদিন কেলে আগে ভাগেই সাবধান হয়ে ঢের বেশি ভাত রেঁধেছিল। কিন্তু সবাই বললে, ‘আজ আমাদের খিদে নেই।’ কাজেই কেলের অনেক ভাত লোকসান হল। এমনি ভাবে দিন তিনেক যেতেই কেলে বেশ বুঝতে পারল যে ছেলেদের খুশি না রাখতে পারলে লাভের অংশ খুবই কম। তারপর থেকেই দেখা গেল কেলের মেজাজটিও একটু নরম, কথাবার্তাও কতকটা ভাল।
উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী
গিল্‌ফয় সাহেবের অদ্ভুত সমুদ্র-যাত্রা উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী তোমরা ‘ইউনাইটেড্‌ স্টেট্‌স’ কোথায় জান? পৃথিবীর মানচিত্রের বাঁ ধারে গোলাকাটির নাম নূতন মহাদ্বীপ। নূতন মহাদ্বীপের বড় দেশটা আমেরিকা। আমেরিকার মাঝখানটা খুব সরু, দেখিতে দুটি দেশের মত দেখায়। এই দুইটির উপরেরটির নাম উত্তর আমেরিকা আর নীচেরটির নাম দক্ষিণ আমেরিকা। উত্তর আমেরিকার যত দেশ, ইউনাইটেড্‌ স্টেট্‌স তাহার মধ্যে সকলের বড়। ইউনাইটেড্‌ স্টেট্‌সে গিলফয় সাহেবের বাড়ি। গিলফয় সাহেব বড় মজার লোক। বয়স তেত্রিশ বৎসর হবে। সাহেব এই বয়েসটা প্রায় জাহাজে থাকিয়াই কাটাইয়াছেন। জাহাজে চড়িয়া কত দেশে গিয়েছেন, কত তামাশা দেখিয়াছেন, কিন্তু একা ছোট নৌকায় প্রশান্ত মহাসাগর পার হন নাই, এই দুঃখে সাহেবের আর মন ঠাণ্ডা হয় না। ছুতোরকে বলিলেন, ‘আমাকে একখানা নৌকা গড়িয়া দাও।’ ছুতোর তাহাই করিল। নৌকা দৈর্ঘ্যে বার হাত, আর উচুতে দুই হাত হইল। পঞ্চাশ মন জিনিস ধরে। নাম রাখিলেন ‘প্যাসিফিক্‌’। সাহেব বলিলেন, ‘জল-বিহার করিয়া করিয়া অষ্ট্রেলিয়া যাইব।’ অস্ট্রেলিয়া আমেরিকা হইতে প্রায় ছ’হাজার মাইল দূরে। পাঁচ মাসের আন্দাজ খাদ্যসমগ্রী নৌকায় উঠান হইল। ১৮৮২ সালের ১৯ এ আগস্ট গিল্‌ফয় সাহেব যাত্রা করিলেন। প্রথম সপ্তাহ বেশ সুখে সুখে গেলেন-তবে নৌকা বড় নিচু বলিয়া জল ছিটিয়া খাবার জিনিসগুলি ভিজাইয়া দিতে লাগিল-এই একটু অসুবিধা। এরপর প্রয় একমাস পর্যন্ত কোনদিন বাতাস পান, কোনদিন বা বাতাস থাকেই না। খাবার জিনিসও বেশি নাই। সাহেব দেখিলেন অত বেশি খাইলে চলিবে না। এক জায়গায় বসিয়া থাকিতে থাকিতে এই সময়ে সাহেবের ক্ষুধা হ্রাস হইয়া উঠিল। বেশি খাইতে পারেন না- সুবিধার বিষয়ই হইল। ভোর হইবার পূর্বে তিন-চার ঘন্টা নিদ্রা যাওয়া অভ্যাস ছিল, কিন্তু নৌকায় নিচে কিসে ঠকঠক করিয়া তাহার বিলক্ষণ ব্যাঘাত জন্মাইতে লাগিল। সাহেব দেখিলেন, হাঙ্গরের তাড়ায় ছোট ছোট মাছ আসিয়া নৌকায় ঠেকে- তাহাতেই এই শব্দ হয়। তিনি হাঙ্গর তাড়াইবার উপায় দেখিতে লাগিলেন। তোমরা অনেকে বোটের মাঝিদের হাতে একরকমের লগি দেখিয়াছে, তাহার মাথায় লোহার একটা বঁড়শির মত লাগান থাকে। সাহেবের এর একটা ছিল। তিনি তাহার অগ্রভাগটা সোজা করিয়া লইলেন। এই অস্ত্র হাতে করিয়া তিনি হাল ধরিতে বসিতেন আর হাঙ্গর কাছে আসিলেই সুট করিয়া ঘা মরিতেন। হাঙ্গারগুলি ভয় পাইল, তিনি যতক্ষণ বাহিরে বসিয়া থাকিতেন ততক্ষণ আর কাছে আসিতে সাহস পাইত না। ঘুমাইবার সময় একটা পিরাণ তাঁহার বসিবার জায়গায় লটকাইয়া রাখিতেন। তাহাতে হাঙ্গরগুলি মনে করিত মানুষটাই বুঝি রহিয়াছে। সুতরাং ঠ্‌ক-ঠকি থামিল। ১০ই নভেম্বর একখানা জাহাজ দেখিতে পাইলেন। তিনি তাহার কাছে গিয়া কিছু খাবার চাহিয়া লইলেন। তাহার পর কয়েকদিন এত বাতাস পাইয়াছিলেন যে একদিন প্রায় একশত ছয় মাইল গিয়াছিলেন। ১৪ই ডিসেম্বর, ঝড় তুফানের দিন; একটা বড় ঢেউ আসিয়া তাঁহার নৌকাখানি উল্টাইয়া ফেলিল। সাহেব সাঁতরিয়া নৌকার পাশ দিয়া গেলেন এবং নোঙরের দড়ি ধরিয়া প্রাণপণে টানাটানি করিতে করিতে এক ঘন্টায় নৌকাটিকে সোজা করিলেন। জল সেঁচিতে গিয়া তিনি বেশি হুড়োহুড়ি করিতে লাগিলেন। নৌকাখানি আবার উল্টাইয়া গেল। দ্বিতীয় বার নৌকা সোজা করিতে তত কষ্ট বোধ হইল না; এবার খুব সাবধান ইহয়া জল সেঁচিলেন। এই গোলমালে সাহেবের ঘড়ি এবং কম্পাস হারাইয়া গেল। কিছু কাল পরে একটা কিরিচ মাছ আসিয়া নৌকায় ছিদ্র করিয়া দিয়া গেল। সাহেব তখন টের পাইলেন না। কিন্তু শেষে যখন দেখিলেন নৌকায় জল উঠিয়া জিনিসপত্র ভাসিতেছে, তখন চেতনা হইল। তাড়াতাড়ি ছিদ্র বন্ধ করিলেন। নূতন বৎসর আসিল। ৭ই জানুয়ারি একটি পাখি উড়িয়া নৌকায় আসিল, সাহেব তাহা ধরিয়া খাইলেন। ১১ জানুয়ারি আর একটি পাখি ধরিলেন। কখন কখন দই একটি “উড়ক্কু” মাছ নৌকায় আসিয়া পড়িত, তাহাও বিনা আপত্তিতে ভক্ষণ করিতেন। ১৭ তারিখ তাহার হালটি ভাঙিয়া গেল; তিনি আর একটি করিয়া লইলেন। ইহার পর আর-একদি একটি পাখি ধরিয়াছিলেন। কিন্তু ২১ এ হইতে ক্ষুধায় তাহাকে রোগা করিতে লাগিল। নৌকার গায়ে যে-সমস্তক শামুক ছিল, তাহার বড়গুলি চুষিয়া খাইলেন। আর-একদিন গুলি করিয়া একটি পাখি মারিয়াছিলেন; কিন্তু জল হইতে উঠাইতে পারিলেন না। ৩০এ একটি পাখি ধরিয়া দেশলাই-এর আগুনে পোড়াইয়া খাইলেন। তারপর এত দুর্বল ইহয়া পড়িলেন যে নৌকা কোন দিকে যাইতেছে তাহার প্রতি মনোযোগ রহিল। একদিন হেঁট মস্তকে বসিয়া নিজের অবস্থার কথা ভাবিতেছেন, এমন সময় হঠাৎ মাথা তুলিয়া দেখিলেন-একটা জাহাজ। তিনি আনন্দে জাহাজের দিকে যাইতে লাগিলেন। জাহাজের লোকেরাও দেখিতে পাইয়া জাহাজ ফিরাইল। জাহাজে উঠিয়াই কিছু খাবার চাহিলেন। খাবার শীঘ্রই আনা হইল। খাইয়া ঠাণ্ডা হইলে পর সমস্ত লোক তাঁহার ইতিহাস শুনিতে আসিল। তিনি নোট বহিতে সব লিখিয়া রাখিয়াছিলেন। সেই বহি হইতে ইংরেজি পত্রিকায় এই গল্পটি ছাপা হইয়াছে।
উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী
গুপি গাইন ও বাঘা বাইন উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী তোমরা গান গাইতে পার? আমি একজন লোকের কথা বলব, সে একটা গান গাইতে পারত। তার নাম ছিল গুপি কাইন, তার বাবার নাম ছিল কানু কাইন। তার একটা মুদীর দোকান ছিল। গুপি কিনা একটা গান গাইতে পারত, আর সে গ্রামের আর কেউ কিছু গাইতে পারত না, তাই তারা তাকে খাতির ক’রে বলত, গুপি ‘গাইন’। গুপি যদিও একটা বই গান জানত না, কিন্তু সেই একটা গান সে খুব ক’রেই গাইত। সেটা না গেয়ে সে তিলেকও থাকতে পারত না, তার দম আটকে আসত। যখন সে ঘরে বসে গাইত, তখন তার বাবার দোকানের খদ্দের সব ছুটে পালাত। যখন সে মাঠে গিয়ে গান গাইত, তখন মাঠের যত গরু সব দড়ি ছিঁড়ে ভাগত। শেষে আর তার ভয়ে তার বাবার দোকানে খদ্দেরই আসে না, রাখালেরাও মাঠে গরু নিয়ে যেতে পারে না। তখন একদিন কানু কাইন তাকে এই বড় বাঁশ নিয়ে তাড়া করতে সে ছুটে মাঠে চ’লে গেল। সেখানে রাখালের দল লাঠি নিয়ে আসতে বনের ভিতর গিয়ে খুব ক’রে গলা ভাঁজতে লাগল। গুপিদের গ্রামের কাছেই আরেকটা গ্রামে একজন লোক থাকত, তার নাম ছিল পাঁচু পাইন। পাঁচুর ছেলেটির বড্ড ঢোলক বাজাবার শখ ছিল। বাজাতে বাজাতে সে বিষম ঢুলতে থাকত, আর পা নাড়ত আর চোখ পাকাত, আর দাঁত খিঁচোত, আর ভ্রুকুটি করত। তার গ্রামের লোকেরা তা দেখে হাঁ ক’রে থাকত আর বলত, ‘আহা! আ-আ-আ!! অ-অ-অ-হ-হ- হ!!!’ শেষে যখন ‘হাঃ, হাঃ, হা-হা!’ বলে বাঘের মত খেঁকিয়ে উঠত, তখন সকলে পালাবার ফাঁক না পেয়ে চিৎপাত হয়ে পড়ে যেত। তাই থেকে সকলে তাকে বলত ‘বাঘা বাইন।’ তার এই বাঘা নামই রটে গিয়েছিল। আসল নাম যে তার কি, তা কেউ জানত না। বাঘা ঢোলক বাজাত আর রোজ একটা ক’রে ঢোলক ভাঙত। শেষে আর পাঁচু তার ঢোলকের পয়সা দিয়ে উঠতে পারে না! কিন্তু বাঘার বাজনা বন্ধ হবে, তাও কি হয়? গ্রামের লোকেরা পাঁচুকে বলল, ‘তুমি না পার, না হয় আমরাই সকলে চাঁদা করে ঢোলকের পয়সাটা দি। আমাদের গ্রামে এমন একটা ওস্তাদ হয়েছে, তার বাজনাটা বন্ধ হয়ে যাবে!’ শেষে ঠিক হল যে গ্রামের সকলে চাঁদা করে বাঘাকে ঢোলক কিনে দেবে, আর সেই ঢোলকটি আর তার ছাউনি খুব মজবুত হবে, যাতে বাঘার হাতেও সেটা আর সহজে না ছেঁড়ে। সে যা ঢোলক হল! তার মুখ হল সাড়ে-তিন হাত চওড়া, আর ছাউনি মোষের চামড়ার। বাঘা সেটা পেয়ে যার পর নাই খুশি হয়ে বলল, ‘আমি দাঁড়িয়ে বাজাব।’ তখন থেকে সে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সেই ঢোলক লাঠি দিয়ে বাজায়। দেড় মাস দিনরাত বাজিয়েও বাঘা সেটাকে ছিঁড়তে পারল না। ততদিনে তার বাজনা শুনে শুনে তার বাপ মা পাগল হয়ে গেল, গ্রামের লোকের মাথা ঘুরতে লাগল। আর দিনকতক এইভাবে চললে কি হত বলা যায় না। এর মধ্যে একদিন গ্রামের সকলে মিলে মোটা মোটা লাঠি নিয়ে এসে বাঘাকে বললে, ‘লক্ষ্মী, দাদা! তোমাকে দশ হাঁড়ি মিঠাই দিচ্ছি, অন্য কোথাও চলে যাও, নইলে আমরা সবাই পাগল হয়ে যাব!’ বাঘা আর কি করে? কাজেই তখন তাকে অন্য একটা গ্রামে যেতে হল। সেখানে দুদিন না থাকতে সেখানকার সকলে মিলে তাকে গ্রাম থেকে বার করে দিল। তারপর থেকে সে যেখানেই যায়, সেখান থেকেই তাকে তাড়িয়ে দেয়। তখন সে করল কি, সারাদিন মাঠে মাঠে ঘুরে বেড়ায়, ক্ষুধার সময় তার নিজের গ্রামে গিয়ে ঢোলক বাজাতে থাকে, আর গ্রামের লোক তাড়াতাড়ি তাকে কিছু খাবার দিয়ে বিদায় করে বলে, ‘বাঁচলাম!’ তারপর এমন হল যে আর কেউ তাকে খেতে দেয় না। আর তার ঢোলকের আওয়াজ শুনলেই আশপাশের সকল গ্রামের লোক লাঠি নিয়ে আসে। তখন বেচারা ভাবল, ‘আর না! মূর্খদের কাছে থাকার চেয়ে বনে চলে যাওয়াই ভাল। না হয় বাঘে খাবে, তবু আমার বাজনা চলবে!’ এই বলে বাঘা তার ঢোলকটিকে ঘাড়ে ক’রে বনে চ’লে গেল। এখন বাঘার বেশ মজাই হয়েছে। এখন আর কেউ তার বাজনা শুনে লাঠি নিয়ে আসে না। বাঘে খাবে দূরে থাক, সে বনে বাঘ-ভালুক কিছু নেই। আছে খালি একটা ভয়ানক জানোয়ার। বাঘা আজও তাকে দেখতে পায় নি, শুধু দূর থেকে তারি ডাক শুনে ভয়ে থরথরিয়ে কাঁপে আর ভাবে, ‘বাবা গো। ওটা এলেই ত ঢোলক-সুদ্ধ আমাকে গিলে খাবে!’ সে ভয়ানক জানোয়ার কিন্তু কেউ নয়, সে গুপি গাইন। বাঘা যে হাক শুনে কাঁপে, সে গুপির গলা ভাঁজা। গুপিও বাঘার বাজনা শুনতে পায়, আর বাঘারই মত ভয়ে কাঁপে। শেষে একটু ভাবল, ‘এ বনে থাকলে কখন প্রানটা যাবে, তার চেয়ে এই বেলা এখান থেকে পালাই।’ এই ভেবে গুপি চুপিচুপি বন থেকে বেরিয়ে পড়ল। বেরিয়েই দেখে, আর-একটি লোকও এক বিশাল ঢোল মাথায় ক’রে সেই বনের ভিতর থেকে আসছে। তাকে দেখেই ভারি আশ্চর্য হয়ে গুপি জিজ্ঞাসা করল, ‘তুমি কে হে?’ বাঘা বললে, ‘আমি বাঘা বাইন; তুমি কে?’ গুপি বললে, ‘আমি গুপি গাইন; তুমি কোথায় যাচ্ছ?’ বাঘা বললে, ‘যেখানে জায়গা জোটে, সেইখানেই যাচ্ছি। গ্রামের লোকগুলো গাধা, গানবাজনা বোঝে না, তাই ঢোলটি নিয়ে বনে চলে এসেছিলাম। তা ভাই, এখানে যে ভয়ঙ্কর জানোয়ারের ডাক শুনেছি, তার সামনে পড়লে আর প্রাণটি থাকবে না। তাই পালিয়ে যাচ্ছি।’ গুপি বললে, ‘তাই ত! আমিও যে একটা জানোয়ারের ডাক শুনেই পালিয়ে যাচ্ছিলাম। বলো ত, তুমি জানোয়ারটাকে কোথায় বসে ডাকতে শুনেছিলে?’ বাঘা বললে, ‘বনের পূর্বধারে, বটগাছের তলায়।’ গুপি বললে, ‘আচ্ছা, সে যে আমারই গান শুনেছ। সে কেন জানোয়ারের ডাক হবে? সেই জানোয়ারটা ডাকে বনের পশ্চিম ধারে, হরতুকীতলায় ব’সে।’ বাঘা বললে, ‘সে ত আমার ঢোলকের আওয়াজ, আমি যে ঐখানে থাকতাম।’ এতক্ষণে তারা বুঝতে পারল যে, তারা তাদের নিজেদের গান আর বাজনা শুনেই ভয়ে পালিয়ে যাচ্ছিল। তখন যে দুজনার কি হাসি! অনেক হেসে তারপর গুপি বললে, ‘ভাই, আমি যেমন গাইন, তুমি তেমনি বাইন! আমরা দুজনে জুটলে নিশ্চয় একটা কিছু করতে পারি।’ এ কথায় বাঘারও খুবই মত হল। কাজেই তারা খানিক কথাবার্তার পর ঠিক করল যে, তারা দুজনায় মিলে রাজামশাইকে গান শোনাতে যাবে। রাজা মশাই যে তাতে খুব খুশি হবেন, তাতে ত আর ভুলই নেই। চাই কি অর্ধেক রাজ্য বা মেয়ের সঙ্গে বিয়েও দিয়ে ফেলতে পারেন। গুপির আর বাঘার মনে এখন খুবই আনন্দ, তারা রাজাকে গান শোনাতে যাবে। দুজনে হাসতে হাসতে আর নাচতে নাচতে এক প্রকাণ্ড নদীর ধারে এসে উপস্থিত হল। সেই নদী পার হয়ে রাজবাড়ি যেতে হয়। নদীতে খেয়া আছে, কিন্তু নেয়ে পয়সা চায়। বেচারারা বন থেকে এসেছে, পয়সা কোথায় পাবে! তারা বলল ‘ভাই, আমাদের কাছে ত পয়সা-পয়সা’ নেই, আমরা না হয় তোমাদের গেয়ে বাজিয়ে শোনাব, আমাদের পার করে দাও।’ তাতে খেয়ার চড়নদারেরা খুব খুশি হয়ে নেয়েকে বলল, ‘আমরা চাঁদা ক’রে এদের পয়সা দেব, তুমি এদের তুলে নাও।’ বাঘার ঢোলটি দেখেই নেয়েরও বাজনা শুনতে ভারি সাধ হয়েছিল, কাজেই সে এক কথায় আর কোনো আপত্তি করল না। গুপিকে আর বাঘাকে তুলে নিয়ে নৌকো ছেড়ে দেওয়া হল। নৌকো-ভরা লোক, ব’সে বাজাবার জায়গা কোথায় হবে? অনেক কষ্টে সকলের মাঝখানে খানিকটা জায়গা হতে হতে নৌকোও নদীর মাঝখানে এসে পড়ল। তারপর খানিকটা একটু গুনগুনিয়ে গুপি গান ধরল, বাঘা তার ঢোলকে লাঠি লাগাল, আর অমনি নৌকোসুদ্ধ সকল লোক বিষম চমকে গিয়ে গড়াগড়ি আর জড়াজড়ি করে দিল নৌকোখানাকে উলটে। তখন ত আর বিপদের অন্ত নেই। ভাগ্যিস বাঘার ঢোলকটি এত বড় ছিল, তাই আঁকড়ে ধরে দুজনার প্রাণরক্ষা হল। কিন্তু তাদের আর রাজবাড়ি যাওয়া ঘটল না। তারা সারাদিন সেই নদীর স্রোতে ভেসে শেষে সন্ধ্যাবেলায় এক ভীষণ বনের ভিতর গিয়ে কূলে ঠেকল। সে বনে দিনের বেলায় গেলেই ভয়ে বয়ে প্রাণ উড়ে যায়, রাত্রির ত আর কথাই নেই। তখন বাঘা বলল, ‘গুপিদা, বড়ই ত বিষম দিখছি! এখন কি করি বলত।’ গুপি বলল, ‘করব আর কি?’ আমি গাইব, তুমি বাজাবে। নিতান্তই যখন বাঘে খাবে, তখন আমাদের বিদ্যোটা তাকে না দেখিয়ে ছাড়ি কেন? বাঘা বলল, ‘ঠিক বলেছ দাদা। মরতে হয় ত ওস্তাদলোকের মতন মরি, পাড়াগেঁয়ে ভূতের মত মরতে রাজি নই!’ এই ব’লে দুজনায় সেই ভিজা কাপড়েই প্রাণ খুলে গান বাজানা শুরু করল। বাঘার ঢোলটি সেদিন কিনা ভিজা ছিল, তাইতে তার আওয়াজটি হয়েছিল যার পর নাই গম্ভীর। আর গুপিও ভাবছিল, এই তার শেষ গান, কাজেই তার গলার আওয়াজটিও খুবই গম্ভীর হয়েছিল। সে গান যে কি জমাট হয়েছিল, সে আর কি বলব? এক ঘণ্টা দু ঘণ্টা ক’রে দুপুর রাত হয়ে গেল, তবু তাদের সে গান থামছেই না। এমন সময় তাদের দুজনারই মনে হল, যেন চারিদিকে একটা কি কাণ্ড হচ্ছে। ঝাপসা ঝাপসা কালো কালো, এই বড় বড় কি যেন সব গাছের উপর থেকে উঁকি মারতে লেগেছে। তাদের চোখগুলো জ্বলছে যেন আগুনের ভাঁটা, দাঁতগুলো বেরুচ্ছে যেন মুলোর সার। তা দেখে তখনই আপনা হতে বাঘার বাজানা থেমে গেল, তার সঙ্গে সঙ্গে দুজনার হাত-পা গুটিয়ে, পিট বেঁকে, ঘাড় বসে, চোখ বেরিযে মুখ হাঁ করে এল। তাদের গায়ে এমনি কাঁপুনি আর দাঁতে এমনি ঠকঠকি ধ’রে গেল যে, আর তাদের ছুটে পালাবারও জো রইল না। ভূতগুলি কিন্তু তাদের কিছু করল না। তারা তাদের গান বাজনা শুনে ভারি খুশি হয়ে এসেছে, তাদের রাজার ছেলের বিয়েতে গুপির আর বাঘার বায়না করতে। গান থামতে দেখে তারা নাকিসুরে বলল, ‘থামলি কেন বাপ? বাজা, বাজা, বাজা!’ এ কথায় গুপির আর বাঘার একটু সাহস হল। তারা ভাবল, ‘এ ত মন্দ মজা নয়, তবে একটু গেয়েই দেখি না।’ এই ব’লে যেই তারা আবার গান ধরেছে, অমনি ভূতেরা একজন দুজন ক’রে গাছ থেকে নেমে এসে তাদের ঘিরে নাচতে লাগল। সে যে কি কাণ্ডকারখানা হয়েছিল, সে কি না দেখলে বোঝবার জো আছে! গুপি আর বাঘা তাদের জীবনে আর কখনো এমন সমজদারে দেখা পায় নি। সে রাত এমনি ভাবেই কেটে গেল ভোর হলে ত আর ভূতেদের বাইরে থাকবার জো নেই, কাজেই তার একটু আগেই তারা বলল, ‘চল্‌ বাবা মোদের গোদার বেটার বে’তে! তোদের খুশি ক’রে দিব।’ গুপি বলল, ‘আমরা যে রাজাবাড়ি যাব! ভূতেরা বলল, ‘সে যাবি এখন, আগে মোদের বাড়ি একটু গানবাজনা শুনিয়ে যা! তোদের খুশি করে দিব!’ কাজেই তখন তারা দুজনে ঢোল নিয়ে ভূতেদের বাড়ি চলল। সেখান গান-বাজনা যা হল, সে আর বলে কাজ নেই।‌ তারপর তাদের বিদায় করবার সময় ভূতেরা বলল, ‘তোরা কি চাস্‌? গুপি বলল, ‘আমরা এই চাই যে, আমরা যেন গেয়ে বাজিয়ে সকলকে খুশি করতে পারি।’ ভূতেরা বলল, ‘তাই হবে, তোদের গানবাজনা শুনলে আর সে গান শেষ হওয়ার আগে কেউ সেখান থেকে উঠে যেতে পারবে না। আর কি চাস্‌? গুপি বলল, ‘আমরা এই চাই যে আমাদের যেন খাওয়া-পরার কষ্ট না হয়।’ এ কথায় ভূতেরা তাদের একটি থলে দিয়ে বলল, ‘তোরা যখন যা খেতে বা পরতে চাস, এই থলের ভিতরে হাত দিলেই তা পাবি। আর কি চাস্‌?’ গুপি বলল, ‘আর কি চাইব, তা ত বুঝতে পারছি না!’ তখন ভূতেরা হাসতে হাসতে তাদের দুজনকে দুজোড়া জুতো এনে দিয়ে বলল, ‘এই জুতো পায়ে দিয়ে তোরা যেখানে যেতে চাইবি, অমনি সেখানে গিয়ে হাজির হবি।’ তখন ত আর কোনো ভাবনাই রইলো না। গুপি আর বাঘা ভূতদের কাছে বিদায় হয়ে সেই জুতো পায়ে দিয়েই বলল, ‘তবে আমরা এখন রাজবাড়ি যাব।’ অমনে সেই ভীষণ বন কোথায় যেন মিলিয়ে গেল গুপি আর বাঘা দেখল, তারা দুজনে একটা প্রকাণ্ড বাড়ির ফটকের সামনে দাঁড়িয়ে আছে। এত বড় আর সুন্দর বাড়ি তারা তাদের জীবনে কখনো দেখে নি। তারা তখনই বুঝতে পারল যে, এ রাজবাড়ি। কিন্তু এর মধ্যে ভারি একটা মুশকিল হল্‌ রাজাবাড়ির ফটকে যমদূতের মত কতকগুলো দারোয়ান দাঁড়িয়ে ছিল, তারা গুপি আর বাঘাকে সেই ঢোল নিয়ে আসতে দেখেই দাঁত খিঁচিয়ে বলল, ‘এইয়ো! কাঁহা যাতা হ্যায়?’ গুপি থতমত খেযে বলল, ‘বাবা, আমরা রাজামশাইকে গান শোনাতে এসেছি।’ তাতে দারোয়ানগুলো আরো বিষম চটে গিয়ে লাঠি দেখিয়ে বলল, ‘ভাগো হিঁয়াসে।’ গুপিও তখন নাক সিঁটকিয়ে বলল, ‘ঈস্‌! আমরা ত রাজার কাছে যাবই।’ বলতেই অমনি সেই জুতোর গুণে, তারা তৎক্ষণাৎ গিয়ে রাজামশায়ের সামনে উপস্থিত হল। রাজবাড়ির অন্দর মহলে রাজামহাশয় ঘুমিয়ে আছেন, রানী তাঁর মাথার কাছে বসে তাঁকে হাওয়া করছেন, এমন সময় কথা নেই বার্তা নেই, গুপি আর বাঘা সেই সর্বনেশে ঢোল নিয়ে হঠাৎ গিয়ে উপস্থিত হল। জুতোর এমনি গুণ, দরজা জানালা সব ব রয়েছে, তাতে তাদের একটুও আটকায় নি। কিন্তু আসবার বেলা আটকাক, আর নাই আটকাক, আসবার পরে খুবই আটকাল। রানী তাদের দেখে বিষম ভয় পেয়ে, এক চিৎকার দিয়ে তখনই অজ্ঞান হয়ে গেলেন। রাজামশাই লাফিয়ে উঠে পাগলের মত ছুটাছুটি করতে লাগলেন। রাজবাড়িময় হুলস্থুল পড়ে গেল। সিপাই সান্ত্রী সব খাঁড়া ঢাল নিয়ে ছুটে এল। বেগতিক দেকে গুপি আর বাঘার মাথায় গোল লেগে গেল। তারা যদি তখন শুধু বলে, ‘আমরা এখান থেকে অমুক জায়গায় চলে যাব, ‘তবেই তাদের জুতোর গুণে সকল ল্যাঠা চুকে যায়্‌ কিন্তু সে কথা তাদের মনেই হল না।‌ তারা গেল ছুটে পালাতে, আর দু-পা যেতে না যেতে না যেতেই বেচারারা যে মারটা খেল! জুতো, লাঠি, চাবুক, কিল, চড়, কানমলা- কিছুই তাদের বাকি রইল না। শেষে রাজামশাই হুকুম দিলেন, ‘বেটাদের নিয়ে তিন দিন হাজতে ফেলে রাখো। তারপর বিচার করে, হয় এদের মাথা কাটব, না হয় কুত্তা দিয়ে খাওয়াব।’ হায় গুপি! হায় বাঘা! বেচারারা এসেছিল রাজাকে গান শুনিয়ে কতই বকশিশ পাবে ভেবে, তার মধ্যে একি বিপদ? পেয়াদারা বেঁধে মারতে মারতে একটা অন্ধকার ঘরে নিয়ে ফেলে রাখল। সেখানে পড়ে বেচারারা একদিন আর গায়ের ব্যাথায় নড়তে চড়তে পারল না। তাতে তেমন দুঃখ ছিল না, কিন্তু বাঘার ঢোলটি যে গেল, সেই হল সর্বনাশের কথা! বাঘা বুক মাথা চাপড়িয়ে ভেউ ভেউ ক’রে কাঁদছে, কাঁদছে আর বলছে, ‘ও গুপিদা।-ওঃ-ওঃ-হ-হ-হ-অ-অ! আরে ও গুপিদা! মার খেলাম, প্রাণ যাবে, তাতে দুঃখ নেই কিন্তু দাদা, আমার ঢোলকটি যে গেল!’ গুপির কিন্তু ততক্ষণে মাথা ঠাণ্ডা হয়ে গেছে। সে বাঘার গায় মাথায় হাত বুলিয়ে বলল, ‘ভয় কা দাদা? ঢোল গিয়েছে, জুতো আর থলে তো আছে। আমরা নিতান্ত বেকুব, তাই এতগুলো মার খেলাম।’ যা হোক, যা হবার হয়ে গিয়েছে, এখন এর ভিতর থেকে একটা মজা ক’রে নিতে হবে।’ বাঘা এ কথায় একটু শান্ত হয়ে বলল, কি মজা হবে দাদা?’ গুপি বলল, আগে ত খাবার মজাটা ক’রে নিই, তারপর অন্য মজার কথা ভেবে দেখব এখন। এই ব’লে সেই ভূতের দেওয়া থলির ভিতরে হাত দিয়ে বলল, ‘দাও ত দেখি, এক হাঁড়ি পোলাও।’ অমনে একটা সুগন্ধ যে বেরুল! তেমন পোলাও রাজরাও সচরাচর খেতে পান না। আর সে কি বিশাল হাঁড়ি! গুপি কি সেটা থলির ভিতর তেকে তুলে আনতে পারে? যা হোক, কোনমতে সেটাকে বার ক’রে এনে তারপর থলিকে বলর, ‘ভাজা ব্যঞ্জন, চাটনি, মিঠাই, দই, রাবড়ি, শরবত। শিগগির দাও।’ দেখতে দেখতে খাবার জিনিসে আর সোনা-রূপোর বাসনে ভ’রে গেল। দুজন লোকে আর কত খাবে? সে অপূর্ব খাবার খেয়ে তাদের গায়ের ব্যথা কোথায় চলে গেল তার আর ঠিক নেই। তখন বাঘা বলল, ‘দাদা চলো এই বেলা এখান থেকে পালাই, নইলে শেষে কুত্তা দিয়ে খাওয়াবে? দেখাই যাক-না, কি হয়।’ এ কথায় বাঘা খুব খুশি হল। সে বুঝতে পারল যে, গুপিদা একটা-কিছু মজা করবে। দুদিন চ’লে গেল, আর একদিন পরেই রাজা তাদের বিচার করবেন। বিচারের দিন রাত থাকতে উঠে গুপি থলের ভিতর হাত দিয়ে বলল, ‘আমাদের দুজনের রাজপোশাক চাই।’ বলতেই তার ভিতর থেকে এমন সুন্দর পোশাক বেরুল যে, তেমন পোশাক কেউ তয়েরই করতে পারে না। সেই পোশাক তারা দুজনে পরে তাদের পুরনো কাপড় আর বাসন কখানি পুঁটলি বেঁধে নিয়ে জুতো পায় দিযে তার বলল, ‘এখন আমরা মাঠে হাওয়া খেতে যাব।’ অমনি দেখে, রাজবাড়ির বাইরের প্রকাণ্ড মাঠে চ’লে এসেছে। সে মাঠের এক জায়গায় তাদের পুঁটুলিটি লুকিয়ে রেখে, তারা বেড়াতে এরে রাজবাড়ির সামনে উপস্থিত হল। দূর থেকে তাদের আসতে দেখেই রাজার লোক ছুটে গিয়ে তাঁকে খবর দিয়েছিল যে, ‘মহারাজ, দুজন রাজা আসছেন।’ রাজাও তা শুনে তাঁর ফটকের সামনে এসে দাঁড়িয়েছিলেন। বাঘা আর গুপি আসতেই তিনি তাদের যার পর নাই আদর দেখিয়ে বাড়ির ভিতর নিয়ে গেলেন। চমৎকার একটি ঘরে তাদের বাসা দেওয়া হল। কত চাকর, বামুন, পেয়াদা, পাইক তাদের সেবাতে লেগে গেল, তার অন্ত নেই। তারপর গুপি আর বাঘা হাত-পা ধুয়ে জলযোগ করে একটু ঠাণ্ডা হলেই রাজামশাই তাদের খবর নিতে এলেন। তাদের পোশাক দেখে অবধিই তিনি ভেবে নিয়েছেন যে, ‘না জানি এঁরা কত বড় রাজাই হবেন।’ তারপর শেষে যখন তিনি গুপিকে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘আপনারা কোন দেশের রাজা?’ তখন গুপি হাত জোড় ক’রে তাঁকে বলল, ‘মহারাজা! আমরা কি রাজা হতে পারি? আমরা আপনার চাকর!’ গুপি সত্য কথাই বলেছিল, কিন্তু রাজার তাতে বিশ্বাস হল না। তিনি ভাবলেন,‘কি ভাল মানুষ, কেমন নরম হয়ে কথা বলে। যেমন বড় রাজা, তেমনি ভদ্রলোকও দেখছি!’ তিনি তখন আর বিশেষ কিছু না বলে তাদের দুজনকে তাঁর সভায় নিয়ে এলেন। সেখানে সেদিন সে দুটো লোকের বিচার হবে-তিনদিন আগে যারা গিয়ে তাঁর শোবার ঘরে ঢুকেছিল। বিচারের সময় উপস্থিত, আসামী দুটোকে আনতে পেয়াদা গিয়েছে। কিন্তু তাদের আর কোথায় পাবে? এ তিন দিন তাদের ঘরে তালা বন্ধ ছিল, সেই তালা খুলে দেখা হল, সেখানে কেই নেই, খালি ঘর প’ড়ে আছে। তখন ত ভারি একটা ছুটোছুটি হাঁকাহাঁকি পড়ে গেল। দারোগামশাই বিষম ক্ষেপে গিয়ে পেয়াদা গুলোকে বকতে লাগলেন। পেয়াদারা তাহ জোড় করে বলল, ‘হুজুর! আমাদের কোনো কসুর নেই। আমরা তালা দিয়ে রেখেছিলা, তার উপর আবার আগাগোড়া দরজার সামনে দাড়িয়েছিলা,। ও দুটো ত মানুষ ছিল না, ও দুটো ছিল ভুত; নইলে এর ভিতর থেকে কি ক’রে পালাল?’ এ কথায় সকলেরই বিশ্বাস হল। রাজামশাইও প্রথমে দারোগার উপর রেগে তাকে কেটেই ফেলতে গিয়েছিলেন, শেষে ঐ কথা শুনে বললেন, ‘ঠিক, ও দুটো নিশ্চয় ভূত। আমার ঘরও ত বন্ধ ছিল, তার ভিতর এত বড় ঢোল নিয়ে কি করে ঢুকেছিল?’ তা শুনে সকলেই বলল, ‘হাঁ হাঁ, ঠিক ঠিক, ও দুটো ভূত!’ বলতে বলতেই তাদের শরীর শিউরে উঠল, গা বেয়ে ঘাম পড়তে লাগল। তখন তারা বাঘার সেই ঢোলকটির কথা মনে করে বলল, ‘মহারাজ! ভূতের ঢোল বড় সর্বনেশে জিনিস! ওটাকে কখনো আপনার ঘরে রাখবেন না। ওটাকে এখুনি পুড়িয়ে ফেলুন।’ রাজামশাইও বললেন, ‘বাপ্‌ রে! ভূতের ঢোল ঘরে রাখব? এক্ষুনি ওটাকে এনে পোড়াও! যেই এ কথা বলা, অমনি বাঘা দুহাতে চোখ ঢেকে ‘হাউ- হাউ-হাউ-হাউ-হাউ’ ক’রে কেঁদে গড়াগড়ি দিতে লাগল! সেদিন বাঘাকে নিয়ে গুপির কি মুশকিলই হয়েছিল। ঢোল পোড়াবার নাম শুনেই বাঘা কাঁদতে আরম্ভ করেছে, ঢোল এনে তাতে আগুন ধরিয়ে দিলে না-জানি সে কি করবে। তখন, সেটা যে তারই ঢোল, সে কথা কি আর বাঘা সামলে রাখতে পারবে? সর্বনাশ! এখন বুঝি ধরা প’ড়ে প্রাণটাই হারাতে হয়। গুপির বড়ই ইচ্ছা হচ্ছিল যে বাঘাকে নিয়ে ছুটে পালায়। কিন্তু তার ত আর জো নেই। সভায় বসবার সময় যে সেই জুতোগুলো পা থেকে খুলে রাখা হয়েছে। এদিকে কিন্তু বাঘার কাণ্ড দেখে সভাময় এক বিষম হুলুস্থুল প’ড়ে গেছে। সবাই ভাবছে, বাঘার নিশ্চয় একটা ভারি অসুখ হয়েছে, আর সে বাঁচবে না। রাজবাড়ির বদ্যিঠাকুর এসে বাগার নাড়ী দেখে যার পর নাই গম্ভীরভাবে মাথা নাড়লেন। বাঘাকে খুব ক’রে জোলাপের ওষুধ খাইয়ে তার পেটে বেলেস্তারা লাগিয়ে দেওয়া হল। তারপর বদ্যিঠাকুর বললেন, ‘এতে যদি বেদনা না সারে, তবে পিঠে আর-একটা, তাতেও না সারলে দুপাশে আর দুটো বেলেস্তারা লাগাতে হবে।’ এ কথা শুনেই বাঘার কান্না তৎক্ষণাৎ থেমে গেল। তখন সকলে বালল যে, বদ্যিঠাকুর কি চমৎকার ওষুধই দিয়েছেন, দিতে বেদনা সেরে গেছে। যা হোক, বাঘা যখন দেখল যে তার কান্নাতে ঢোল পোড়াবার কথাটা চাপা প’ড়ে গেছে, তখন সেই বেলেস্তারার বেদনার ভিতরেই তার মনটা কতক ঠাণ্ডা হল। রাজামশাই তখন তাকে খুব যত্নের সহিত তার ঘরে শুইয়ে রেখে এলেন। গুপি তার কাছে ব’সে তার বেলেনস্তারায় হাওয়া করতে লাগল। তারপর সকলে ঘর থেকে চলে গেলে গুপি বাঘাকে বলল, ‘ছি ভাই, যেখানে-সেখানে কি এমন করে কাঁদতে আছে। দেখ দেখি, এখন কি মুশকিলটা হল।’ বাগা বলল, ‘আমি যদি না কাঁদতুম, তা হলে ত এতক্ষণে আমার ঢোলকটি পুড়িয়ে শেষ করে দিত। এখন না হয় একটু জ্বলুনি সইতে হচ্ছে, কিন্তু আমার ঢোলকটা ত বেঁচে গেছে!’ বাঘা আর গুপি এমনি কথাবার্তা বলছে। এদিকে রাজামশাই সভায় ফিরে এলে দারোগামশাই তাঁর কানে কানে বললেন, ‘মহারাজ, একটা কথা আছে, অনুমতি হয় ত বলি।’ ‘রাজা বললেন, ‘কি কথা?’ দারোগা বললেন, ‘মহারাজ, ঐ যে লোকটা গড়াগড়ি দিয়ে কাঁদল, সে আর তার সঙ্গের ঐ লোকটা সেই দুই ভূত। আমি চিনতে পেরেছি।’ রাজা বললেন, ‘তাই ত হে, আমারও একটু যেন সেইরকম ঠেকছিল। তা হলে ত বড় মুশকিল দেখছি। বলো ত এখন কি করা যায়?’ তখন এ কথা নিয়ে সভার ভারি একটা কানাকানি শুরু হল। কেউ বলল, ‘রোজা ডাকো, ও দুটোকে তাড়িয়ে দিক।’ আর-একজন বলল, ‘রোজা গদি তাড়াতে না পারে, তখন ত সে দুটো কে পুড়িয়ে মারুন না।’ এ কথাটা সকলেরই খুব পছন্দ হল, কিন্তু এর মধ্যে একটু মুশকিল এই দেখা গেল যে, ভূতদের পোড়াতে গেলে রাজবাড়িতেও তখন আগুন ধরে গেদে পারে। শেষে অনেক যুক্তির পর এই স্থির হল যে, একটা বাগানবাড়িতে তাদের বাসা দেওয়া হবে। বাগানবাড়ি পুড়ে গেলেও বিশেষ ক্ষতি হবে না। রাজামশাই বললেন, ‘সেই ঢোলকটাকেও তা হলে সেই বাগানবাড়িতে নিয়ে রাখা যাক। বাগানবাড়ি পোড়াবার সময় একসঙ্গে সকল আপদ চুকে যাবে।’ বাগানবাড়ি যাবার কথা শুনে গুপি আর বাঘা খুব খুশি হল। তারা ত জানে না যে এর ভিতর কি ভয়ানক ফন্দি রয়েছে। তারা খালি ভাবল যে বেশ আরামে নিরিবিলি থাকা যাবে, সংগীত চর্চার সুবিধা হতে পারে। জায়গাটি খুবই নিরিবিলি আর সুন্দর। বাড়িটি কাঠের, কিন্তু, দেখতে চমৎকার। সেখানে গিয়ে দেখতে দেখতে বাঘা ভাল হয়ে গেল। তখন গুপি তাকে বলল, ‘ভাই, আর এখানে থেকে কাজ কি? চলো আমরা এখান থেকে চ’লে যাই।’ বাঘা বলল, ‘দাদা, এমন সুন্দর জায়গায় ত আর থাকতে পাব না, দুদিন এখানে রইলামই বা। আহা, আমার ঢোলকটি যদি থাকত!’ সেদিন বাঘা বাড়ির এঘর-ওঘর ঘুরে বেড়াচ্ছে, গুপি বাগানের এক জায়গায় ব’সে গুনগুন করছে, এমন সময় হঠাৎ বাঘা ভয়ানক চেঁচামেচি ক’রে উঠল। তার সকল কথা বোঝা গেল না, খালি ‘ও গুপিদা। ও গুপিদা!’ হাকটা খুবই শোনা যেতে লাগল। গুপি তখন ছুটে এসে দেখল যে, বাঘা তার সেই ঢোলকটা মাথায় ক’রে পাগলের মত নাচছে, আর যা-তা আবোল-তাবোল বলতে বলতে ‘গুপিদা গুপিদা চেঁচাচ্ছে! ঢোলক পেয়ে তার এত আনন্দ হয়েছে যে, সে আর কিছুতেই স্থির হতে পারছে না, গুছিয়ে কথাও বলতে পারছে না। এমনি ক’রে প্রায় আধঘণ্টা চলে গেলে পর বাঘা একটু শান্ত হয়ে বলল, ‘গুপিদা, দেখছ কি, এই ঘরে আমার ঢোলকটি-আর কি মজা-হাঃ-হাঃ’ বলে আবার সে মিনিট দশেক খুব নেচে নিল। তারপর সে বলল, ‘দাদা, এত দুঃখের পর ঢোলকটি পেয়েছে। খাওয়া দাওয়ার পর রাত্রে বারান্দায় ব’সে দুজনায় খুব ক’রে গানবাজনা করা যাবে।’ রাজামশাই কিন্তু ঠিক করেছেন, সেই রাত্রেই তাদের পুড়িয়ে মারবেন। দারোগার উপর হুকুম হয়েছে যে, সেদিন সন্ধ্যার সময় সেই বাগানবাড়িতে মস্ত ভোজের আয়োজন করতে হবে।‌ দারোগামশায় পঞ্চাশ-ষাট জন লোক নিয়ে সেই ভোজে উপস্থিত থাকবেন। খাওয়াদাওয়ার পর গুপি আর বাঘা ঘুমিয়ে পড়লে, তাঁরা সকলে মিলে একসঙ্গে সেই কাঠের বাড়ির চারদিকে আগুন দিয়ে তাদের পালাবার পথ বন্ধ করবেন। সেদিনকার খাওয়া বেশ ভালমতই হল। গুপি আর বাঘা ভাবল যে, লোকজন চ’লে গেলেই তারা গান বাজনা আরম্ভ করবে। দারোগামশাই ভাবলেন যে গুপি আর বাঘা ঘুমোলেই ঘরে আগুন দেবেন। তিনি তাদের ঘুম পড়াবার জন্য বড়ই ব্যস্ত হয়ে উঠলেন। তাঁর ভাব দেখে যখন স্পষ্টই বোঝা গেল যে, তারা না ঘুমোলে তিনি সেখান থেকে যাবেন না, তখন গুপি বাঘাকে নিয়ে গিয়ে বিছানায় প’ড়ে নাক ডাকাতে লাগল। একটু পরেই গুপি আর বাঘা দেখল যে লোকজন সব চ’লে গেছে, আর কারু সাড়াশব্দ নেই। তারপর আর একটু দেখে যখন মনে হল যে, বাগান একেবারে খালি হয়ে গেছে, তখন তারা দুজনে বারান্দায় এসে ঢোল বাজিয়ে গান জুড়ে দিল। এদিকে দারোগামশাই তাঁর লোকদের বলে দিয়েছেন, ‘তোরা প্রত্যেক দরজায় বেশ ভাল ক’রে আগুন ধরাবি। খবরদার, আগুন ভাল ক’রে ধরলে চ’লে যাস নি যেন!’ তিনি নিজে গিয়েছেন সিঁড়িতে আগুন ধরাতে। আগুন বেশ ভাল মতই ধরেছে, দারোগামশাই ভাবছেন, ‘এই বেলা ছুটে পালাই’। এমন সময় বাঘার ঢোল বেজে উঠল, গুপিও গান ধ’রে দিল। তখন আর দারোগামশাই বা তাঁর লোকদের কারু সেখান থেকে গড়বার জো রইল না, সকলেই পুড়ে মরতে হল। ততক্ষণে গুপি আর বাঘাও আগন দেখতে পেয়ে তাদের জুতোর জোরে, তাদের ঢোল আর থলেটি নিয়ে সেখান থেকে চম্পট দিল। সেদিনকার আগুনে দারোগামশাই ত পুড়ে মারা গিয়েছিলেন, তাঁর দলের অতি অল্প লোকই বেঁচেছিল। সেই লোকগুলো গিয়ে রাজামশাইকে এই ঘটনার খবর দিতে তাঁর মনে বড়ই ভয় হল। পরদিন আর দু-চার জন লোক রাজসভায় এস বলল যে, তারা সেই আগুনের তামাশা দেখতে সেখানে গিয়েছিল। তারা তখন ভারি আশ্চর্যরকমের গান-বাজনা শুনেছে, আর ভূত দুটোকে শূন্যে উড়ে পালাতে স্বচক্ষে দেখেছে। তখন যা রাজামশায়ের কাঁপুনি! সেদিন তাঁর সভা করা হল না।‌ তুনি তাড়াতাড়ি বাড়ির ভিতরে এসে ভূতের ভয়ে দরজা এঁটে লেপ মুড়ি দিয়ে শুয়ে রইলেন, এক মাসের ভিতরে আর বাইরে এলেন না। এদিকে গুপি আর বাঘা সেই আগনের ভিতর থেকে পালিয়ে একেবারে তাদের বাড়ীর কাছের সেই বনে এসে উপস্থিত হয়েছে, যেখানে প্রথমে তাদের দেখা হয়েছিল। তাদের বড় ইচ্ছা যে এত ঘটনার পর একবার তাদের মা-বাপকে দেখে যায়। বনে এসেই বাঘা বলল, ‘গুপিদা, এইখানে না তোমার আমায় দেখা হয়েছিল? গুপি বলল, ‘হ্যাঁ!’ বাঘা বলল, ‘গুপিদা, ‘তবে এমন জায়গায় এসে কি একটু গান-বাজনা না ক’ রে চলে যেতে আছে?’ গুপ বলল, ‘ঠিক বলেছ ভাই, তবে আর দেরি কেন? এই বেলা আরম্ভ ক’রে দাও।’ এই বলে তারা প্রাণ খুলে গান-বাজনা করতে লাগল। এর মধ্যে এক আশ্চর্য ঘটনা হয়েছে। এক দল ডাকাত হাল্লার রাজার ভাণ্ডার লুটে, তার ছোট ছেলে দুটিকে সুদ্ধ চুরি করে নিয়ে পালিয়ে এসেছিল। রাজা অনেক সৈন্য নিয়ে তাদের পিছু পিছু প্রাণপণে ছুটেও ধরতে পারছিলেন না। গুপি আর বাঘা যখন গান ধরেছে, ঠিক সেই সময়ে সেই ডাকাতগুলো সেই বনের ভিতর দিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু সে গান একবার শুনলে ত আর তার শেষ অবধি না শনে চ’লে যাবার জো নেই। কাজেই ডাকাতদের তখনি সেখানে দাঁড়াতে হল। সারা রাত্রের ভিতরে আর সে গান-বাজনাও থামল না, ডাকাতদেরও সেখান থেকে যাওয়া ঘটল না। সকালে হাল্লার রাজা এসে অতি সহজেই তাদের ধ’রে ফেললেন। তারপর যখন তিনি জানলেন যে, গুপি আর বাঘার গানের গুণেই তিনি ডাকাত ধরতে পেরেছেন, তখন আর তাদের আদর দেখে কে? রাজকুমারেরাও বললেন, ‘বাবা, এমন আশ্চর্য গান আর কখখনো শোন নি। এদের সঙ্গে নিয়ে চলো!’ কাজই রাজা গুপি আর বাঘাকে বললেন, ‘তোমারা আমার সঙ্গে চলো! তেমাদের পাঁচশো টাকা ক’রে মাইনে হল।’ এ কথায় গুপি জোড়হতে রাজমশাইকে নমস্কার ক’রে বলল, ‘মহারাজ, দয়া ক’রে দুদিনের ছুটি দিতে আজ্ঞা হোক। আমরা আমাদের পিতা- মাতাকে দেখে তাঁদের অনুমতি নিয়ে আপনার রাজধানীতে গিয়ে উপস্থিত হব।’ রাজা বললেন, ‘আচ্ছা, এ দুদিন আমরা এই বনেই বিশ্রাম করছি। তোমারা তোমাদের মা-বাপকে দেখে দু’দিন পরে এসে এই খানেই আমাদের পাবে।’ গুপিকে তাড়িয়ে অবধি তার বাবা তার জন্য বড়ই দুঃখিত ছিল, কাজেই তাকে ফিরে আসতে দেখে তার বড় আনন্দ হল। কিন্তু বাঘা বেচারার ভাগ্যে সে সুখ মেলে নি। তার মা-বাপ এর বললে, ‘ঐ রে! সেই বাঘা বেটা আবার আমাদের হাড় জ্বালিয়ে মারবে। মার বেটাকে!’ বাঘা বিনয় ক’রে বলল, ‘আমি কালি আমার মা-বাবাকে দেখতে এসেছি, দুদিন থেকেই চ’লে যাব, রাজাব-টাজাব না।’ সে কথা কি তারা শোনে? তারা দাঁত খিচিয়ে তার মা-বাপের মৃত্যুর কথা বলে এই বড় লাঠি নিয়ে তাকে মারতে এল। সে প্রাণপণে ছুটে পালাতে পালাতে ইঁট মেরে তার পা ভেঙ্গে মাথা ফাটিয়ে রক্তরক্তি ক’রে দিল। গুপি তাদের ঘরির দাওয়ায় ব’সে তার বাপের সঙ্গে কথা বলছিল। এমন সময় সে দেখন যে, বাঘা পাগলের মত হয়ে খোঁড়াতে ছুটে আসছে। তার কাপড় ছিঁড়ে ফালি ফালি আর রক্তে লাল হয়ে গেছে। অমনি সে তাড়াতাড়ি বাঘার কাছে ছুটে গিয়ে জিজ্ঞাসা করল, ‘কি হয়েছে? তোমার এ দশা কেন?’ গুপিকে দেখেই বাঘা একগাল হেসে ফেলেছে। তারপর সে হাঁপাতে হাঁপাতে বলল, ‘দাদা, বড্ড বেঁচে এসেছি! মূর্খগুলো আর একটু হলেই আমার ঢোলটি ভেঙে দিয়েছিল! গুপিদের বাড়ি এসে গুপির যত্নে আর তার মা-বাপের আদরে বাঘার দুদিন যতটা সম্ভব সুখেই কাটল। দুদিন পর গুপি তার মা-বাপের কাছ থেকে বিদায় নেবার সময় ব’লে গেল, ‘তোমরা তয়ের হয়ে থাকবে। আমি আবার ছুটি পেলেই এসে তোমাদের নিয়ে নিয়ে যাব।’ তারপর কয়েক মাস চ’লে গিয়েছে। গুপি আর বাঘা এখন হাল্লার রাজার বাড়িতে পরম সুখে বাস করে। দেশ বিদেশে তাদের নাম রটে গিয়েছে- ‘এমন ওস্তাদ আর কখনো হয় নি, হবেও না।’ রাজামশাই তাদের ভারি ভালোবাসেন; তাদের গান না শুনে একদিনও থাকতে পারেন না।‌ নিজের দুঃখ সুখের কথা সব গুপির কাছে বলেন। একদিন গুপি দেখল, রাজামশায়ের মুখখানি বড়ই মলিন। তিনি ক্রমাগতই যেন কি ভাবছেন, যেনতাঁর কোনো বিপদ হয়েছে।শেষে একবার তিনি গুপিকে বললেন, ‘গুপি, মুশকিলে পড়েছি, কি হবে জানি না। শুণ্ডীর রাজা আমার রাজ্য কেড়ে নিতে আসছে।’ শুণ্ডীর রাজা হচ্ছেন সেই তিনি, যিনি গুপি আর বাঘাকে পুড়িয়ে মারতে চেয়েছিলেন্‌ তাঁর নাম শুনেই গুপির মনে একটা চমৎকার মতলব এল। সে তখন রাজামশাইকে বলল, ‘মহারাজ! এর জন্য কোন চিন্তা করবেন না। আপনার এই চাকরকে হুকুম দিন, আমি এ থেকে হাসির কাণ্ড ক’রে দেব। রাজা হেসে বললেন, ‘গুপি, তুমি গাইয়ে বাজিয়ে মানুষ, যুদ্ধের ধারও ধার না, তার কিছু বোঝও না। শুণ্ডীর রাজার বড় ভারি ফৌজ, আমি কি তার কিছু করতে পারি?’ গুপি বলল, ‘মহারাজ, হুকুম পেলে একবার চেষ্টা ক’রে দেখতে পারি। ক্ষতি ত কিছু হবে না।’ রাজা বললেন, ‘তোমার যা ইচ্ছা তাই তুমি করতে পার।’ এ খথায় গুপি যার পর নাই খুশি হয়ে বাঘাকে ডেকে পরামর্শ করতে লাগল। গুপি আর বাঘা সেদিন অনেকক্ষণ ধরে পরামর্শ করেছিল্‌ বাঘার তখন কতই উৎসাহ! সে বলল, ‘দাদা, এবারে আমরা দুজনে মিলে একটা কিছু করবই করব। আমার শুধু এক কথায় একটু ভয় হচ্ছে। হঠাৎ যদি প্রাণ নিয়ে পালাবার দরকার হয়, তবে হয়ত আমি জুতোর কথা ভুলে গিয়ে সাধারণ লোকের মত কষে ছুট দিতে যাব, আর মার খেয়ে সারা হব। এমনি করে দেখ-না সেবারে আমাদের গাঁয়ে মূর্খগুলোর হাতে আমার কি দশা হ’ল!’ যা হোক, গুপি কথায় বাঘার সে ভয় কেটে গেল, আর পরদিন থেকেই তারা কাজে লাগল। দিনকতক ধরে রোজ রাত্রে তারা শুন্ডী চলে যায়, আর রাজবাড়ির আশেপাশে ঘুরে সেখানকার খবর নেয়। যুদ্ধের আয়োজন যা দেখতে পেল, সে বড়ই ভয়ঙ্কর। এ আয়োজন নিয়ে এরা হাল্লায় গিয়ে উপস্থিত হলে আর রক্ষা নেই। রাজার ঠাকরবাড়িতে রোজ মহাধুমধামে পুজো হচ্ছে। দশ দিন এমনিতর পুজো দিয়ে, ঠাকরকে খুশি ক’রে তারা হল্লায় রওনা হবে। গুপি আর বাঘা এর সবই দেখল, তারপর একদিন তাদের ঘরে ব’সে,দরজা এঁটে,সেই ভুতের দেওয়া থলিটিকে বলল, ‘নতুন ধরনের মিঠাই চাই, খুব সরেস।’ সে কথায় থলির ভিতর থেকে মিঠাই যা বেরুল, সে আর বলবার নয়। তেমনি মিঠাই কেউ কায় নি, চোখেও দেখে নি। সেই মিঠাই নিয়ে বাঘা আর গুপি শুন্ডীর রাজার ঠাকুরবাড়ীর বিশাল মন্দিরের চূড়োয় গিয়ে বসল নীচে খুব পুজোর ধুম-ধূপধুনো শঙ্খঘন্টা কোলাহলের সীমা নেই, আঙিনায় লোকে লোকারণ্য। সেই সব লোকের মাথার উপরে ঝড়াৎ ক’রে মিঠাইগুলো ঢেলে দিয়ে বাঘা আর গুপি মন্দিরের ভিতর দিয়ে চুড়ো আঁকড়ে ধরে তামাশা দেখতে লাগল। অন্ধকারের মধ্যে সেই ধূপধূনা আর আলোর ধোঁয়ায় কেউ তাদের দেখতে পেল না। মিঠাইগুলো আঙিনায় পড়তেই অমনি কোলাহল থেমে গেল। অনেকেই লাফিয়ে উঠল,কেউ কেই চেঁচিয়ে ছুটও দিল। তারপর দু-চার জন সাহসী লোক কয়েকটা মিঠাই তুলে, আলোর কাছে নিয়ে ভয়ে ভয়ে দেখতে লাগল। শেষে তাদের একজন চোখ বুজে তার একটু মুখে পুরে দিল। দিয়েই আর কথাবার্তা নেই-সে দুহাতে আঙিনা থেকে মিঠাই তুলে খালি মুখে দিচ্ছে আর নাচছে আর আহাদে চেঁচাচ্ছে। তখন সেই আঙিনা-সুদ্ধ লোক মিঠাই খাবার জন্য পাগলের মত কাড়াকাড়ি আর কিচিরমিচির করতে লাগল। এদিকে কয়েকজন ছুটে গিয়ে রাজামশাইকে বলছে, ‘মহারাজ! ঠাকুর আজ পুজোয় তুষ্ট হয়ে স্বর্গ থেকে প্রসাদ পাঠিয়ে দিয়েছেন। সে যে কি অপূর্ব প্রসাদ, সে কথা আমরা বলতেই পারছি না।’ সে কথা শুনবামাত্রই রাজামশাই প্রাণপণে কাছা গুঁজতে গুঁজতে ঊর্ধ্বশ্বাসে এস ঠাকুরবাড়িতে উপস্থিত হলেন। কিন্তু হায়! ততক্ষণে সব প্রসাদ শেষ হযে গিয়েছিল্‌ সমস্ত উঠোন ঝাঁট দিয়েও রাজামশাইয়ের জন্য একটু প্রসাদের গুঁড়ো পাওয়া গেল না। তখনি তিনি ভারি চটে গিয়ে বললেন, ‘তোমাদের কি অন্যায়। পুজো করি আমি,আর প্রসাদ খেয়ে শেষ কর তোমরা! আমার জন্যে একটু গুঁড়োও রাখ না! তোমাদের সকলকে ধ’রে শুলে চড়াব।’ এ কথায় সকলে ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে জোড়াহাতে বলল, ‘দোহাই মাহরাজ! আপনার প্রসাদ কি আমরা খেয়ে শেষ করতে পারি? বাপ্‌ রে! আমরা খেতে না খেতেই ঝাঁ করে কোনখান দিয়ে ফুরিয়ে গেল।! আজ আমাদের প্রসাদগুলো আপনি মাপ করুন; কালতকের যত প্রসাদ, সব মহারাজ একাই খাবেন।’ রাজা তাতে বললেন, ‘আচ্ছা তাই হবে। খবরদার ! মনে তাকে যেন।’ পরদিন রাজামশাই প্রসাদ খাবেন, তাই একপ্রহর বেলা থাকতেই তিনি ঠাকুরবাড়ির আঙিনায় এসে আকাশের পানে তাকিয়ে বসে আছেন। আর সকলে ভযে ভয়ে একটু দূরে বসে তাঁকে ঘিরে তামাশা দেখছে। আজ পুজোর ঘটা অন্যদিনের চেয়ে শতগুণ্‌ সবাই ভাবছে, দেবতা তাতে খুশি হয়ে রাজামশাইকে আরো ভাল প্রসাদ দেবেন। রাত-দুপুরের সময় গুপি আর বাঘা আরো আশ্চর্যরকমের মিঠাই নিয়ে এসে মন্দিরের চুড়োয় বসল। আজ তাদের পরনে খুব জমকালো পোশাক, মাথায় মুকুট, গলায় হার, হাতে বালা, কানে কুণ্ডল। তারা দেবতা সেজে এসেছে। ধোঁয়ার জন্য কিছুই দেখা যাচ্ছে না, কিন্তু তবু রাজামশাই আকাশের পানে তাকিয়ে আছেন। এমন সময় গুপি আর বাঘা হাসতে হাসতে তাঁর উপরে সেই মিঠাইগুলো ফেলে দিল। তাতে রাজামশাই প্রথমে একটা চিৎকার দিয়ে তিন হাত লাফিয়ে উঠলেন, তারপর তাড়াতাড়ি সামলিয়ে নিয়ে,হাতে মিঠাই তুলে মুখে দিতে লাগলেন, আর ধেই ধেই ক’রে নাচনটা যে নাচলেন! এমন সময় গুপি আর বাঘা হঠাৎ মন্দিরের চুড়ো থেকে নেমে এসে রাজার সামনে দাঁড়াল। তাদের দেখে সকলে ‘ঠাকুর এসেছেন’ বলে কে আগে গড় করবে ভেবে ঠিক পায় না। রাজামশাই ত লম্বা হয়ে মাটিতে পড়েই রয়েছেন, আর খালি মাথা ঠুকছেন। গুপি তাঁকে বলল, ‘মহারাজ! তোমার নাচ দেখে আমরা বড়ই তুষ্ট হয়েছি। এসো তোমার সঙ্গে কোলাকুলি করি।’ রাজা তা শুনে যেন হাতে স্বর্গ পেলেন। দেবতার সঙ্গে কোলাকুলি, সে কি কম সৌভাগ্যের কথা? কোলাকুলি আরম্ভ হল। সকলে ‘জয় জয়’ বলে চেঁচাতে লাগল। সেই অবসরে গুপি আর বাঘা রাজামশাইকে খুব ক’রে জড়িয়ে বলল, ‘এখন তবে আমাদের ঘরে যাব!’ বলতে বলতেই তারা তাঁকে সুদ্ধ একেবারে এসে তাদের নিজের ঘরে উপস্থিত। ঠাকুরবাড়ির আঙিনায় সেই লোকগুলো অনেকক্ষন ধরে হাঁ করে আকাশের পানে চেয়ে রইল। তারপর তখন রাজামশাই আর ফিরলেন না, তখন তারা যে যার ঘরে এসে বলল, ‘কি আশ্চর্যই দেখলাম! রাজামশাই সশরীরে স্বর্গে গেলেন! দেবতারা নিজে তাঁকে নিতে এসেছিলেন!’ এদিকে রাজামশাই গুপি আর বাঘার কোলে অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিলেন, তাদের ঘরে এসেও অনেকক্ষণ তাঁর জ্ঞান হয় নি। ভোরের বেলায় তিনি চোখ মেলে দেখলেন যে, সেই দুটো ভূত তাঁর মাথার কাছে ব’সে আছে। অমনি তিনি তাদের পায়ে প’ড়ে কাঁপতে কাঁপতে বললেন, ‘দোহাই বাবা! আমাকে খেয়ো না! আমি দুশো মোষ মেরে তোমাদের পুজো করব।’ গুপি বলল, ‘মহারাজ, আপনার কোনো ভয় নেই। আমরা ভূতও নই, আপনাকে খেতেও যাচ্ছি না।’ রাজামশাইয়ের কিন্তু তাতে একটুও ভরসা হল না। তিনি আর কোনো কথা না ব’লে মাথা গুঁজে বসে কাঁপতে লাগলেন। এদিকে বাঘা এসে হাল্লার রাজাকে বলল, ‘কার রাত্রে আমরা শুণ্ডীর রাজাকে ধ’রে এনেছে। একন কি আজ্ঞা হয়?’ হাল্লার রাজা বললেন, ‘তাঁকে নিয়ে এসো!’ দুই রাজার যখন দেখ হল, তখন শুণ্ডীর রাজা বুঝতে পারলেন যে তাঁকে ধ’রে এনেছে । হাল্লা জয় করা ত তাঁর ভাগ্যে ঘটলই না, এখন প্রাণটিও যাবে। কিন্তু হাল্লার রাজা তাঁকে প্রাণে না মেরে শুধু তাঁর রাজ্যই কেড়ে নিলেন। তারপর তিনি গুপি আর বাঘাকে বললেন, ‘তোমরাই আমাকে বাঁচিয়েছ, নইলে হয়ত আমার রাজ্যও যেত, প্রাণও যেত। শুন্ডীরাজ্যের অর্ধেক আর আমার দুটি কন্যা তোমাদের দুজনকে দান করলাম’। তখন খুবই একটা ধুমধাম হল। গুপি আর বাঘা হাল্লার জামাই হয়ে আর শুণ্ডীর অর্ধেক রাজ্য পেয়ে পরম আনন্দে সঙ্গীতের চর্চা করতে লাগল। গুপির মা- বাপের মান্য আর সুখ তখন দেখে কে?
উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী
ঘ্যাঁঘাসুর উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী এক যে ছিল রাজা, তাঁর ছিল একটি মেয়ে। মেয়েটি, হইয়া অবধি খালি অসুখেই ভুগিতেছে। একটি দিনের জন্যেও ভাল থাকে না। কত বদ্যি, কত ডাক্তার, কত চিকিৎসা, কত ওষুধ-মেয়ে ভাল হইবে দূরে থাকুক, দিনি দিনই রোগা হইতেছে। এত ধন জন থাকিয়াও রাজার মনে সুখ নাই। কিসে মেয়েটি ভাল হইবে, তাঁহার কেবল সেই চিন্তা। এমনি করিয়া দিন যায়; এর মধ্যে এক সাধু রাজার সঙ্গে দেখা করিতে আসিলেন। তিনি রাজার মেয়ের অসুখের কথা শুনিয়া বলিলেন, ‘মহারাজ, তোমার মেয়ে একটি লেবু খাইয়া ভাল হইবে।’ একটু লেবু! সে কোন লেবুটি, কোথায় কাহার বাগানে তাহা পাওয়া যাইবে, সাধু তাহার কিছু না বলিয়াই চলিয়া গেলেন। রাজা আর উপায় না দেখিয়া দেশের লোককে এই কথা জানাইয়া দিলেন, ‘যাহার লেবু খাইয়া আমার মেয়ে ভাল হইবে, সে আমার মেয়েকে বিবাহ করিবে, আর আমার রাজ্য পাইবে।’ এখন মুশকিলের কথা এই যে, সে রাজ্য লেবু মিলে না। কেবলমাত্র এক চাষীর বাড়িতে একটি লেবুর গাছ আছে, চাষী অনেক কষ্ট করিয়া শ্রীহট্র হইতে সেই গাছটি আনিয়াছিল। সবে সেই বৎসর তাহাতে লেবু হইয়াছে। লেবু ত নয়, যেন রসগোলা! এক-একটা বড় কত! যেন এক-একটা বেল! তেমন লেবু তোমরা দেখও নাই, খাওও নাই। আমি দেখিতে পাই নাই। দেখিতে পাইলে খাইতে চেষ্টা করা যাইত। চাষীর তিন ছেলে, যদু গোষ্ঠ আর মানিক। রাজার হুকুম শুনিয়া চাষী যদুকে এক ঝুড়ি লেবু দিয়া বলিল, ‘শিগ্‌গির এগুলি রাজার বাড়ি নিয়ে যা। এর একটা খেয়ে যদি রাজার মেয়ে ব্যামো সারে, তবে রাজার মেয়েকে বিয়ে করতে পাবি।’ যদু লেবুর ঝুড়ি মাথায় করিয়া রাজার বাড়ি চলিয়াছে, এমন সময় পথে একহাত লম্বা একটি মানুষের সঙ্গে তাহার দেখা হইল। সেই লোকটি তাহাকে জিজ্ঞাসা করিল, ‘তোমার ঝুড়িতে কি ও? যদু বলিল, ‘ব্যাঙ।’ সেই লোকটি বলিল, ‘আচ্ছা তাই হোক।’ রাজার দারোয়ানেরা লেবুর কথা শুনিয়া যার পর নাই আদরের সহিত যদুকে রাজার নিকট লইয়া গেল। রাজামহাশয় ব্যস্ত হইয়া নিজেই ঝুড়ির ঢাকা খুলিলেন, আর অমনি চারিটি ব্যাঙ তাঁহার পাগড়ির উপর লাফাইয়া উঠিল। সেই ঝুড়িতে যতগুলি লেবু ছিল, সব কয়টাই ব্যাঙ হইয়া গিয়াছে। সুতরাং লেবু খাওয়াইয়া রাজার মেয়েকে ভাল করা, আর রাজার জামাই হওয়া, যদুর ভাগ্যে ঘটিল না। সে বেচারা অনেকগুলি লাথি খাইয়া প্রাণে-প্রাণে বাড়ি ফিরিল, তাহাই ঢের বলিতে হইবে। এরপর চাষী এক ঝুড়ি লেবু দিয়া গোষ্ঠকে পাঠাইল। এবারেও সেই একহাত লম্বা মানুষটি কোথা হইতে আসিয়া গোষ্ঠর ঝুড়িতে কি আছে জিজ্ঞাসা করিল। গোষ্ঠ বলিল, ‘ঝিঙের বীচি।’ একহাত লম্বা মানুষটি বলিল, ‘আচ্ছা, তাই হোক।’ রাজবাড়ির দারোয়ানেরা প্রথমে গোষ্ঠকে ঢুকিতে দেয় নাই। তাহারা বলিল, ‘তোরই মতন একটা সেদিন এসে রাজামশাইয়ের পাগড়ি নোংরা করে দিয়ে গেছে। তুই আবার একটা কি করে বসবি কে জানে!’ অনেক পীড়াপীড়ির পর গোষ্ঠ ঢুকিয়া রাজার মেয়েকে কিরূপ লেবু খাওয়াইল, বুঝিতে পার। সাজাটাও তার তেমনিই হইল। মানিককে সকলেই একটু বোকা মনে করে। কাজেই তাহাকে আর লেবুর ঝুড়ি দিয়া রাজার বাড়ি পাঠাইতে কেহ বলিল না। কিন্তু সে যাইবার জন্য একেবারে সাজিয়া গুজিয়া প্রস্তুত হইয়া আছে। যতক্ষণ না চাষী তাহাকে যাইতে বলিল, ততক্ষণ তাহাকে কিছুতেই ছাড়িল না। শেষটা তাহাকেও এক ঝুড়ি লেবু দিয়া পাঠাইতে হইল। পথে সেই একহাত লম্বা মানুষের সহিত মানিকেরও দেখা হইল। একহাত লম্বা মানুষ জিজ্ঞাস করিল, ‘ঝুড়িতে কি ও?’ মানিক বলিল, ‘ঝুড়িতে লেবু আছে, তাই খেয়ে রাজার মেয়ের অসুখ সারবে।’ একহাত লম্বা মানুষ বলিল, ‘আচ্ছা তাই হোক।’ রাজবাড়িতে ঢুকিতে মানিকের যার পর নাই মুশকিল হইয়াছিল। অনেক মিনতি আর হাত জোড়ের পর দারোয়ানেরা তাহাকে পথ ছাড়িয়া দিল আর বলিল, ‘দেখিস, যেন ব্যাঙ কি ঝিঙের বীচি-টিচি হয় না। তা হলে কিন্তু তোর প্রাণটা থাকবে না।’ যাহা হউক মানিকের ঝুড়িতে লেবুই পাওয়া গেল। রাজামহাশয় ত খুবই খুশী! তাড়াতাড়ি বাড়ির ভিতর লেবু পাঠাইয়া দিয়া বলিলেন, ‘কেমন হয়, আমাকে খবর দিস!’ খবরের আশায় রাজামহাশয় বসিয়া আছেন, এমন সময় মেয়ে নিজেই খবর লইয়া উপস্থিত! সেই লেবু মুখে দিতে না দিতেই তাহার অসুখ একেবারে সারিয়া গিয়াছে! ইহাতে রাজামহাশয় যার পর নাই আনন্দিত হইলেন, কিন্তু তাহার পরেই ভাবিতে লাগিলেন-‘তাই ত, করিয়াছি কি! এখন যে চাষীর ছেলের সঙ্গে মেয়ের বিয়ে দিতে হয়!’ এই ভাবিয়া রাজামহাশয় স্থির করিলেন যে, চাষীর ছেলেকে যেমন করিয়াই হউক ফাঁকি দিতে হইবে। মানিকলাল ভাবিতেছে, ‘এরপর বুঝি মেয়ে বিয়ে দিবে।’ এমন সময় রাজামহাশয় তাহাকে বলিলেন, ‘বাপু, তুমি কাজটা বেশ ভালই করিয়াছ, কিন্তু রাজার মেয়ে বিবাহ সহজ কথা নয়। আগে আর-একখানা কাজ করিয়া দাও, তারপর দেখা যাইবে কি হয়। জলে যেমন চলে, ডাঙায়ও তেমনি চলে, এইরূপ একখানা নৌকা আমাকে গড়িয়া না দিতে পারিলে, তোমার কোন আশাই নাই।’ মানিক ‘যে আজ্ঞা’ বলিয়া বিদায় হইল। তারপর বাড়ি আসিয়া সকল কথা বলিল। বাড়ির সকলেই মানিককে বোকা ঠাওরাইয়া রাখিয়াছিল। সুতরাং তাহারা মনে করিল যে, মানিক যখন রাজার মেয়েকে ভাল করিয়া আসিয়াছে, তখন নৌকাখানা ইচ্ছা করিলেই যে-সে তয়ের করিতে পারে। যদু একখানা কুড়াল লইয়া নৌকা গড়িতে চলিল। বনের ভিতর হইতে গাছ কাটিয়া সেখানেই কাজ আরম্ভ করিয়া দিল। ইচ্ছা, সেইদিনই নৌকা প্রস্তুত করিয়া ফেলে। পরিশ্রমেরও কসুর নাই। এমন সময় কোথা হইতে সেই একহাত লম্বা মানুষ আসিয়া উপস্থিত। ‘কিহে যদুনাথ, কি হচ্ছে?’-‘গামলা’। আচ্ছা, তাই হোক।’ ‘তাই হোক’ বলিয়া একহাত লম্বা মানুষ চলিয়া গেল। যদুও নৌকা গড়িতে লাগিল। কিন্তু সে যত পরিশ্রম করে, তাহার সমস্তই বৃথা হয়। সেই সর্বনেশে কাঠ খালি গামলার মত গোল হইয়া ওঠে, নৌকার মতন কিছুতেই হইতে চায় না। শেষটা যদুর রাগ হইয়া গেল। কিন্তু রাগের ভরে এক কাঠ ফেলিয়া দিয়া, ক্রমাগত আর দুই তিনটা কাঠ লইয়াও গামলা ছাড়া আর কিছু তয়ের করিতে পারিল না। যাহা হউক, গামলাগুলি হইল বাড়ি সরেস। সুতরাং সন্ধ্যার সময় যদুনাথ গোটা তিন চার গামলা ঘাড়ে করিয়া বাড়ি ফিরিল। এমন ভাল গামলাগুলি বনে ফেলিয়া আসিতে কিছুতেই তাহার ইচ্ছা হইল না। তারপর গোষ্ঠ নৌকা গড়িতে চলিল, আর সেই একহাত লম্বা মানুষের অনুগ্রহে সন্ধ্যাবেলা পাঁচখানি অতিশয় উঁচুদরের লাঙল কাঁধে ঘরে ফিরিল। অবশ্য, এরপর মানিক নৌকা গড়িতে গেল, আর তাহাকেও সেই একহাত লম্বা মানুষ আসিয়া জিজ্ঞাসা করিল, ‘কি হচ্ছে?’ মানিক সাদাসিধা উত্তর দিল-‘জলে যেমন চলে ডাঙায়ও তেমনি চলে, এমন একখান নৌকা গড়ে দিতে পারলে, রাজামশাই বলেছেন, মেয়ে বিয়ে দেবেন।’ এই কথা শুনিয়া একহাত লম্বা মানুষ বলিল, ‘আচ্ছা, তাই হোক।’ মানিক সবে নৌকার কাঠ কাটিয়া সবে তাহাতে চড়িয়া বসিয়াছিল। একহাত লম্বা মানুষের কথা শেষ হইতে না হইতেই সেই কাঠ ছুটিয়া চলিয়াছে। সে আর এখন কাঠ নাই; অতি চমৎকার একখানা নৌকা। তাহাতে দাঁড়ি নাই, মাঝি নাই, দাঁড় নাই। যেখানে যাইবার দরকার, তাহা নিজেই বুঝিয়া লয়, সেখানে সে নিজেই থামে। রাজা-রাজড়ার উপযুক্ত মখমলের গদি তাকিয়ায় তাহার ভিতর সাজানো। বাহিরটা দেখিতে কি সুন্দর, তা কি বলিব। যে জিনিসে তাহা সাজাইয়াছে, তাহা সেই একহাত লম্বা মানুষের দেশে হয়। আমি তাহার নাম জানি না। রাজামহাশয় সভায় বসিয়া আছেন, এমন সময় মানিকলালের নৌকা সেইখানে গিয়া উপস্থিত। সকলে নৌকার রূপগুণ দেখিয়া আশ্চর্য হইয়া গেল, আর কত প্রশংসা করিতে লাগিল। রাজামহাশয়ও খুব আশ্চর্য না হইয়াছিলেন এমন নয়। কিন্তু তাহা চাপিয়া গিয়া মুখে মানিককে বলিলেন, ‘এতেও হচ্ছে না; আর-একখানা কাজ করে দিতে হবে। একগাছ ঘ্যাঁঘাসুরের লেজের পালক হলে আমার মুকুটের শোভা হয়। এই জিনিসটি এনে দিলে নিশ্চয় আমার মেয়েকে বিয়ে করতে পাবে।’ মানিক ‘যে আজ্ঞা’ বলিয়া ঘ্যাঁঘাসুরের পালক আনিতে চলিল। খানিকটা পাখি খানিকটা জানোয়ার, বিদ্‌ঘুটে চেহারা, খিটখিটে মেজাজ, ভারী জ্ঞানী, বেজায় ধনী, অসুর ঘ্যাঁঘা, এক মাসের পথ দূরে, অজানা নদীর ধারে, অচেনা শহরে সোনার পুরীতে বাস করেন। মানুষটিকে দেখতে পাইলেই রসগোলাটির মত টপ্‌ করিয়া তাহাকে গিলেন। সেই ঘ্যাঁঘা মহাশয়ের পালক আনিতে মানিক চলিয়াছে। যাহাকে দেখে, তাহাকেই ঘ্যাঁঘাসুরের মুলুকের পথ জিজ্ঞাসা করে; আর ডাইনে বাঁয়ে না চাহিয়া ক্রমাগত সেই পথে চলে। রাত্রি হইলে কাহারো বাড়িতে আশ্রয় লয়; আবার সকালে উঠিয়া চলিতে থাকে। ঘ্যাঁঘাসুরের মুলুকে যাইতেছে শুনিয়া, সকলে তাহাকে আদর করিয়া জায়গা দেয়। একদিন রাত্রিতে এইরূপে সে একজন খুব ধনী লোকের অতিথি হইয়াছে। সেই ধনী অনেক কথাবার্তার পর তাহাকে বলিল, ‘বাপু, তুমি ঘ্যাঁঘাসুরের দেশে চলেছ শুনেছি, সে অনেক বিষয়ের খবর রাখে। আমার লোহার সিন্ধুকের চাবিটা হারিয়ে ফেলেছি, ঘ্যাঁঘা তার কোন সান বলতে পারে কি না, জিজ্ঞাসা কোরো তো।’ মানিক বলিল, ‘আচ্ছা মশাই, আমি জেনে আসব।’ আর-একদিন সে আর-এক বড়লোকের বাড়িতে অতিথি হইয়াছে। সেই বড়লোকের মেয়ের ভারী অসুখ। তাহার বেয়ারামটা যে কি, কোনো ডাক্তার কবিরাজ তাহা ঠিক করিতে পারে না। মেয়ে দিন দিন খালি রোগা হইয়া যাইতেছে। সেই বড়লোক মানিককে খুব যত্ম করিয়া খাওয়াইয়া তারপর বলিলেন, ‘আমার মেয়ের অসুখ কিসে সারবে, ‘এই কথাটা যদি ঘ্যাঁঘার কাছ থেকে জেনে আসতে পার, তবে বড় উপকার হয়।’ মানিক বলিল, ‘অবশ্যি মশাই, আমি নিশ্চয়ই জেনে আসব।’ এইরূপে একমাস চলিয়া মানিক অজানা নদীর ধারে আসিয়া ওপারে ঘ্যাঁঘাসুরের সোনার বাড়ি দেখিতে পাইল। অজানা নদীর নৌকা নাই, খেয়া নাই, এক বুড়ো সকলকেই কাঁধে করিয়া পার করে। মানিকও তাহারি কাঁধে চড়িয়া নদী পার হইল। বুড়ো তাহাকে বলিল, ‘বাপু, আমার এই দুঃখ কবে দূর হবে, ঘ্যাঁঘার কাছে জিজ্ঞেস কোরো ত! আমার খাওয়া নাই, দাওয়া নাই, খালি কাঁধে ক’রে দিনরাত্তির মানুষই পার করছি। ছেলেবেলা থেকে এই করছি, আর এখন বুড়ো হয়ে গেছি।’ মানিক বলিল, ‘তোমার কিছু ভয় নেই, আমি নিশ্চয়ই তোমার কথা জিজ্ঞেস করব!’ নদী পার হইয়া মানিক ঘ্যাঁঘার বাড়িতে গেল। ঘ্যাঁঘা তখন বাড়ি ছিল না; ঘেঁঘী ছিল। ঘেঁঘী তাহাকে দেখিয়া বলিল, ‘পালা বাছা, শিগ্‌গির পালা। ঘ্যাঁঘা তোকে দেখতে পেলেই গিল্‌বে!’ মানিক বলিল, ‘আমি যে ঘ্যাঁঘার লেজের একগাছি পালক চাই। সেটি না নিয়ে কেমন ক’রে যাব? আর সেই যাদের চাবি হারিয়ে গেছে সেই চাবিটি কোথায় আছে? আর যাদের মেয়ের অসুখ, তার ওষুধ জেনে যেতে বলেছে। আর যে বুড়ো পার ক’রে দিলে, সে বাড়ি যাবে কেমন ক’রে? ঘেঁঘী বলিল, ‘প্রাণটি নিয়ে কোথায় পালাবে, না আবার তার পালক চাই, আর তাকে একশো খবর বলে দাও। তুই কে রে বাপ? মানিক বলিল, ‘আমি মানিক। পালক না নিয়ে গেলে রাজা মেয়ে বিয়ে দেবে না; একগাছি পালক আমার চাই।’ হাজার হোক স্ত্রীলোক। মানিককে দেখিয়া ঘেঁঘীর দয়া হইল। সে বলিল, ‘আচ্ছা বাপু, তাহলে তুই খাটের তলায় লুকিয়ে থাক্‌’ তোর ভাগ্যে থাকলে হবে এখন।’ মানিক ঘ্যাঁঘার খাটের তলায় লুকাইয়া রহিল। সন্ধ্যার পর ঘ্যাঁঘাসুর বাড়ি আসিল। ঘেঁঘী তাড়াতাড়ি পা ধুইবার জলটল দিয়া সোনার থালায় খাবার হাজির করিল। ঘ্যাঁঘার মেজাজটা বড়ই খিটখিটে; সবটাতেই দোষ ধরে। বাড়ি আসিয়াই সে জোরে জোরে নিঃশ্বাস টানিতে লাগিল, আর বলিতে লাগিল, ‘মানুষের গন্ধ কোত্থেকে এল? হুঁ হুঁ-মানুষের গন্ধ। মানুষ দে, খাই। ঘ্যাঁঘার কথা শুনিয়া খাটের তলায় মানিকলালের মুখ শুকাইয়া গেল, ঘেঁঘীর বুক ধড়াস্‌ ধড়াস্‌ করিতে লাগিল। সে অনেক কৌশল করিয়া ঘ্যাঁঘাকে বুঝাইল যে, একটা মানুষ আসিয়াছিল, কিন্তু সেটা ঘ্যাঁঘার নাম শুনিয়াই পলাইয়াছে। ইহাতে ঘ্যাঁঘা কিছু শান্ত হইয়া খাবার খাইতে বসিল। খাওয়া শেষ হইলে, ঘ্যাঁঘা খাটে শুইয়া নিদ্রা গেল। ঘুমের ভিতর তাহার লম্বা লেজটি লেপের বাহিরে আসিয়া খাটের পাশে ঝুলিয়া পড়িয়াছে। সেই লেজের আগায় অতি চমৎকার পালকের গোছা। মানিক খাটের তলায় অপেক্ষা করিয়া আছে, লেজ দেখিয়াই, সে খ্যাচ করিয়া একটি পালক ছিঁড়িয়া লইল। অমনি ঘ্যাঁঘা ব্যস্তসমস্ত হইয়া উঠিয়া বলিল, ‘ঘেঁঘী, আমার লেজ ধরে যেন কে টানলো। হুঁ হুঁ মানুষের গন্ধ!’ ঘেঁঘী বলিল, ‘তোমার ভুল হয়েছে। অত বড় পালকের গোছা কোথায় আটকে লেজে টান পড়েছে। আর মানুষ ত একটা এসেছিল বলেছি, এ তারই গন্ধ। সেই মানুষটা কত কথা বললে। সেই কাদের বাড়ি লোহার সিন্ধুকের চাবি হারিয়ে গেছে-ঘেঁঘীর কথা শেষ হইতে না দিয়াই ঘ্যাঁঘা বলিল, ‘হ্যাঁ হ্যাঁ! সেই লোহার সিন্ধুকের চাবি! আমি জানি! সেটাকে তাদের খোকা গদির ফুটোর ভিতরে ঢুকিয়ে দিয়েছে।’ ঘেঁঘী বলিল, ‘আবার কাদের মেয়ের কি অসুখ-।’ অমনি ঘ্যাঁঘা বলিল, ‘কোনা ব্যাঙে ওর চুল নিয়ে গেছে, ঘরের কোনেই তার গর্ত। ঐখান থেকে খুঁড়ে সেই চুল আনলেই মেয়ের ব্যামো সারবে।’ আবার ঘেঁঘী বলিল, ‘যে লোকটা মানুষ ঘাড়ে করে নদী পার করে-?’ ঘ্যাঁঘা বলিল, ‘সেটা একটা মস্ত গাধা। একজনকে কেন নদীর মাঝখানে নামিয়ে দেয় না। তাহলেই ত সে বাড়ি যেতে পারে। যাকে নামিয়ে দেবে, সে-ই মানুষ পার করতে থাকবে!’ মানিকের সকল কাজই আদায় হইল। এখন রাত পোহাইলে ঘ্যাঁঘা বাহিরে চলিয়া যায়, আর সেও বাহিরে আসিতে পারে। রাত ভোর হইলে ঘ্যাঁঘা জলখবার খাইয়া বেড়াইতে বাহির হইল। ঘেঁঘীও মানিককে পেট ভরিয়া খাওয়াইয়া বিদায় করিল। এরপর প্রথমেই সেই বুড়োর সঙ্গে দেখা। বুড়ো জিজ্ঞাসা করিল, ‘আমার কথা কিছু হল?’ মানিক বলিল, ‘সে হবে এখন, আগে পার কর, আমার বড্ড তাড়াতাড়ি।’ বুড়ো মানিককে কাঁধে করিয়ে পারে লইয়া গেলে পর ডাঙায় উঠিয়া মানিক বলিল, ‘এরপর একজনকে মাঝখানে নামিয়ে দিয়ো; তা হলেই তোমার ছুটি।’ এই কথা শুনিয়া বুড়ো মানিককে অনেক ধন্যবাদ দিয়া বলিল, ‘ভাই, তুমি আমার এমন উপকারটা করলে, ‘আমার ইচছা হচ্ছে, তোমাকে আর দুবার কাঁধে করে পার করি।’ মানিক বলিল, তুমি দয়া করে যা করেছ তাই ঢের। আর আমার বুড়ো মানুষের কাঁধে চড়ে কাজ নেই। আমি এখন দেশে চললাম।’ চারদিন চলিয়া মানিক, যাহাদের মেয়ের অসুখ ছিল, তাহাদের বাড়িতে আবার অতিথি হইল। বাড়ির কর্তা অত্যন্ত আগ্রহের সহিত জিজ্ঞাসা করিলেন, ‘ঘ্যাঁঘা কিছু বলেছে?’ মানিক বলিল, ‘হ্যাঁ।’ এই বলিয়া ঘরের কোণ হইতে ব্যাঙের গর্ত খুঁড়িয়া যেই চুল বাহির করিল, আর অমনি যে মেয়ে দুই বৎসর যাবৎ মড়ার মতন পড়িয়া ছিল, সে উঠিয়া হাসিয়া বেড়াইতে লাগিল। ইহাতে বাড়ির সকলে যে কত খুশী হইল, তাহা কি বলিব! মানিককে তাহারা এত টাকা দিল যে, দশটা উটে তাহা বহিতে পারে না। যাহাদের চাবি হারাইয়া গিয়াছিল, তাহারাও চাবি পাইয়া মানিককে ঢের টাককড়ি দিল। এই সমস্ত টাকাকড়ি লইয়া সে দেশে ফিরিয়া রাজামহাশয়কে ঘ্যাঁঘাসুরের পালক বুঝাইয়া দিল। দেশের সকল লোক ইহাতে মানিকের যার পর নাই প্রশংসা করিল। তাহারা সকলেই বলিল যে, মানিককে এত ক্লেশ দেওয়া রাজার ভারী অন্যায় হইয়াছে, তাহার সঙ্গে মেয়ের বিবাহ দিতে আর দেরী করা উচিত নয়। রাজামহাশয় আর কি করেন, শেষটা অনেক কষ্টে রাজি হইলেন। তারপর খুব জাঁকজমকের সহিত রাজকন্যা ও মানিকের বিবাহ হইল। মানিক এত টাকাকড়ি লইয়া আসিয়াছে যে, তাহাতেই তাহার পরমসুখে দিন কাটিতে লাগিল। কিন্তু রাজামহাশয়ের ইহাতে ভারি হিংসা হইল। তিনি মনে করিলেন, ‘ঘ্যাঁঘাসুরের দেশে গেলে যদি এত টাকা নিয়ে আসা যায়, তবে আমি সেখানে যাব।’ এই ভাবিয়া রাজামহাশয় ঘ্যাঁঘার মুলুকে যাত্রা করিলেন। কিন্তু সেখানে পৌঁছাইতে পারেন না। কারণ, অজানা নদী পার হইবার সময়, সেই বুড়ো তাঁহাকে মাঝখানে নামাইয়া দিল। রাজামহাশয় হাত জোড় করিয়া মিনতি করিতে লাগিলেন। কিন্তু বুড়ো তাঁহার কথায় কান দিবার অবসর পায় নাই। ততক্ষণে সে ডাঙ্গায় উঠিয়া উর্দ্ধশ্বাসে বাড়ি পানে ছুঁটিয়াছে, তাড়াতাড়ি রাজামহাশয়কে ছুটি পাইবার কৌশলটি বলিয়া দিবার কথা তাহার মনে নাই। সুতরাং রাজামহাশয় আজও সেই স্থানেই মানুষ পার করিতেছেন। পাঠক-পাঠিকার মধ্যে কেহ যদি কখনো ঘ্যাঁঘাসুরের মুলুকে যান, তাহা হইলে দয়া করিয়া বেচারাকে সেই কথাটা বলিয়া দিবেন। কিন্তু পূনরায় নদীর এপারে ফিরিয়া না আসিয়া এ কথা বলিবেন না, কারণ তাহা হইলে কিঞ্চিৎ অসুবিধা হইতেপারে।
উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী
ছোট ভাই উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী সাতটি ভাই ছিল, তাদের সকলের ছোটটির নাম ছিল রুরু। দেশের মধ্যে তারা সাতটি ভাই দেখতে আর সকল ছেলের চেয়ে সুন্দর ছিল। তাদের মধ্যে আবার রুরু ছিল সকলের চেয়ে সুন্দর। রুরুকে সকলেই কেন এত সুন্দর বলে আর তাদের ব’লে না, এই জন্য রুরুর বড় ভাইয়েরা তাকে বড্ড হিংসা করত। ভাল ভাল কাপড়গুলো সব তারা ছ’জনায় পরে বেড়াত, রুরুকে পরতে দিত শুধু ছেঁড়া ন্যাকড়া। যত বিচ্ছিরি নোংরা কাজ, সব তারা রুরুকে দিয়ে করাত, আর নিজেরা বাবুগিরি করে বেড়াত। তবু সকল লোকে রুরুকেই বেশি ভালবাসত, বড় কটিকে কেউ দেখতে পারত না। তাতে তারা আরো চটে রুরুকে যখন তখন ধরে ঠ্যাঙাত। বেচারাকে এক দণ্ডও সুখে থাকতে দিত না। রুরুদের গ্রাম থেকে ঢের দূরে ররঙ্গা বলে একটি মেয়ে থাকত। এমন সুন্দর মেয়ে এই পৃথিবীতে আর কোথাও ছিল না।‌ তার কথা শুনেই রুরুর দাদারা বলল, ‘চল্‌, আমরা সেই মেয়েকে দেখতে যাব। আমাদের মত সুন্দর ছেলে আর কোথায় আছে? আমাদের দেখলেই নিশ্চয় সেই মেয়ে আমাদের একজনকে বিয়ে করে ফেলবে।’ তখন ত তাদের খুবই আনন্দ আর উৎসাহ হল। ছ‘জনের প্রত্যেকে ভাবল, ‘ররঙ্গা নিশ্চয়ই আমাকে বিয়ে করবে।’ কত গহনা এনে যে তারা তাদের ছ’টি পুঁটলির ভিতরে পুরল, তার লেখাজোখা নেই। মস্ত বড় পানসি তাদের জন্য তয়ের হল। ছ’ভাই মিলে আজ কতরকম করেই পোশাক পরেছে আর চুল আঁচড়েছে, একটু পরে পানসিতে চড়ে বউ আনতে যাবে। তাদের মা জিজ্ঞাসা করলেন, ‘হ্যাঁরে, তোরা রুরুকে সঙ্গে নিবি না?’ অমনি তারা ছ’জন একসঙ্গে বলল, ‘নেব বইকি। নইলে আমাদের রান্না কে করবে? ররঙ্গাকে দেখতে যাবার সময় আমরা তাকে আমাদের বাসায় রেখে যাব। ও যে ছেঁড়া কাপড় পরে, ও আমাদের ভাই, এ কথা জানলে লোকে কি বলবে?’ রুরু সবই শুনল, কিন্তু কিচ্ছু বলল না। সেও তার দাদাদের সঙ্গে সেই পানসি চড়ে ররঙ্গাদের দেশে গিয়ে উপস্থিত হল। সেখানকার লোকেরা এর আগেই শুনতে পেয়েছিল যে, কয়েকটি খুব সুন্দর ছেলে তাদের দেশে বউ খুঁজতে যাচ্ছে। তারা সেই পানসি পৌছিবামাত্রই এসে রুরুর দাদাদের আদর করে তাদের গ্রামে নিয়ে গেল। সেখানে তারা বাড়ি ঘর সাজিয়ে মস্ত ভোজের আয়োজন আগেই করে রেখেছিল। ছ’ভাই হাসতে হাসতে দুলতে দুলতে তাদের সঙ্গে চলে গেল। রুরুকে বলে গেল, ‘আমাদের জন্য একটি বাসা ঠিক করে জিনিসপত্র সব তাতে নিয়ে রাখবি।’ তারপর তাদের খাওয়া-দাওয়া আমোদ-আহ্লাদ খুবই হল। সেখানে অনেক মেয়ে ছিল, কিন্তু তাদের কোনটি যে ররঙ্গা, ছ’ভাইয়ের কেউ তা বুঝতে পারল না। তাদের প্রত্যেকেই তার পাশের মেয়েটিকে চুপি চুপি জিজ্ঞাসা করল, ‘কোনটি ররঙ্গা?’ সেই মেয়েদের প্রত্যেকেই বলল, ‘আমিই ররঙ্গা, কাউকে বোলো না।’ এ কথা শুনে ত ভাইদের আনন্দের সীমাই রইল না। অত সহজে ররঙ্গাকে পেয়ে যাবে, তা তারা মোটেই ভাবে নে। তারা তখনই সেই মেয়েগুলোর সঙ্গে বিয়ের কথা ঠিক করে ফেলল। তারপর কয়েক দিনের মধ্যেই তাদের বিয়ে হয়ে গেল। সকলেই ভাবল, ররঙ্গাকে বিয়ে করেছি। ঠকেছে যে, সে কথা কারুরই মনে হল না। রুরু বিচারা এত কথার কিচ্ছু জানে না, আর তার জানবার দরকারই বা কি? প্রথম দিন বাসা ঠিকঠাক করে সে কলসী হাতে জল আনতে বেরিয়েছিল। জল কোথায় আছে, তা ত সে আর জানে না, তাই সে একটি ছোট্র মেয়েকে জিজ্ঞাসা করল, ‘হ্যাঁ গা, কোথায় জল পাব?’ মেয়েটি বলল, ‘ঐ যে ররঙ্গার বাড়ি, তার পাশে ঝরনা আছে।’ রুরু সেই দিকে জল আনতে চলল। যেতে যেতে সে ভাবল, ‘ররঙ্গা ত ভোজে গিয়েছে। এর মধ্যে আমি একটি উঁকি মেরে দেখে নিই না, তার বাড়িটি কেমন।’ এই ভেবে সে আস্তে আস্তে সেই ঘরটির দরজার কাছে গিয়ে উঁকি মারল। উঁকি মেরে আর তার সেখান থেকে চলে আসবার কথা মনে রইল না। সে দেখল, ঘরের ভিতরে ররঙ্গা বসে আছে! নিশ্চয় সে ররঙ্গা, নইলে এত সুন্দর আর কে হবে? ররঙ্গা তাকে দেখেই ভারি খুশি হয়ে অমনি তাকে ডাকল, ‘এসো, এসো, ঘরে এসো।’ রুরু জড়সড় হয়ে গেল। তখন ররঙ্গার জিজ্ঞাসা করল, ‘তুমি কে?’ রুরু বলল, ‘সেই যে ছ’জন লোক বউ খুঁজতে এসেছে, যাদের জন্য ভোজ হচ্ছে, আমি তাদের ছোট ভাই।’ ররঙ্গা বলর, ‘তুমি কেন তবে ভোজে যাও নি?’ রুরু বলল, ‘আমাকে তারা নিয়ে যায় নি, কাজ করবার জন্য বাসায় রেখে গেছে। আমার এর চেয়ে ভাল কাপড় নেই। এগুলো কাজ করতে করতে ময়লা হয়ে ছিঁড়ে গেছে।’ রুরুকে দেখেই ররঙ্গার যার পর নাই ভাল লেগেছিল, তার কথা শুনে তার বড়ই দুঃখ হল। সে বুঝতে পারল যে রুরুর দাদারা বড় দুষ্টু, তাকে কষ্ট দেয়। তখন রুরুকে তার আরো ভাল লাগল। দুদিন পরে তাদে বিয়ে হয়ে গেল। তার পরদিন রুরুর দাদারা বউ নিয়ে ঘরে যাবে।‌ রুরুযে তার আগেই ররঙ্গাকে নিয়ে নৌকোর তলায় লুকিয়ে রেখেছে, সে কথা তাদের কেউ টের পায় নি। তারা ভারি ধুমধাম করে দেশে এল। তারপর বউ নিয়ে বাড়িতে পা দিয়েই সকলের বড় ভাই তাদের মাকে বলল, ‘এই দেখো মা, ররঙ্গাকে বিয়ে করে এনেছি!’ অমনি তার ছোট ভাই তার চেয়ে বেশি করে চেঁচিযে বলল, ‘না মা, ও মিছে কথা বলছে, আমি ররঙ্গাকে এনেছি।’ তখন ত ভারি মজা হল। সবাই বলছে, ‘ওদের কথা মিথ্যে, আমি ররঙ্গাকে এনেছি।’ ভয়ানক চটাচটি, মারামারি হয় হয়। বউ কটি থতমত খেয়ে মুখ চাওয়া- চাওয়ি করছে, তারা ভাবে নি যে অত সহজে ধরা পড়ে যাবে। তখন মা বললেন, ‘বাবা, ররঙ্গা ত ছটি নয়, আর এদের একটিও তেমন সুন্দরীও নয়। তোমরা ঠকে এসেছ।’ রুরু এতক্ষণ চুপ করে দাঁড়িয়েছিল, মার কথা শুনে সে বলল, ‘ঠিক বলেছ মা, ঠকে এসেছে। আমার সঙ্গে এসো, আমি ররঙ্গাকে দেখিয়ে দিচ্ছি।’ এ কথায় রুরুর দাদারা ত হেসেই গড়াগড়ি দিতে লাগল। কিন্তু মা বললেন, ‘আচ্ছা গিয়েই দেখি না।’ বলেই তিনি রুরুর সঙ্গে নৌকায় এলেন, আর একটিবার ররঙ্গার মুখের দিকে চেয়েই তাকে কোলে নিয়ে আনন্দে নাচতে লাগলেন। সে খরব দেখতে দেখতে গ্রামময় ছেয়ে ফেলল। তখন পাড়ার ছেলে বুড়ো, গিন্নি বউ সকলে ছুটে এসে ররঙ্গাকে ঘিরে নাচতে লাগল। এ সব দেখে দাদারা চোখ লাল করে, দাঁত খিঁচিয়ে তাদের স্ত্রীদের বলল, ‘ফাঁকি দিয়েছিস?’ শুনে সকলে হো হো করে হাসল। তাদের মা বললেন, ‘আর কেন বাছা? চুপ করো! তোমরা যেমন, তোমাদের তেমনি জুটেছে।’
উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী
জাপানী দেবতা উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী জাপান দেশে ‘কোজিকী’ বলে একখানা পুরানো পুঁথি আছে। তাতে লেখা আছে যে, পৃথিবীটা যখন হয়েছিল সেটা তেলের মত পাতলা ছিল, আর ফেনার মত সমুদ্রে বেসে বেড়াত। তখন নাকি মোটে তিনটি দেবতা ছিলেন। এই তিনটি মরে গেলে আর দুটি হলেন; তাঁরা মরে গেলে আর দুটি হলেন; তাঁরা মরে গেল আর দুটি- তাঁরা মরে গেরে আবার দশটি দেবতা হলেন। এই দশটি দেবতার একজন ছিলেন ‘ইজানাগী’; তাঁর স্ত্রী নাম ছিল ‘ইজানামী’ অন্য দেবতারা এঁদের দুজনের হাতে একটা শূল দিয়ে বললেন, ‘তোমরা এই তেলের মতন জিনিসটা থেকে পৃথিবী তয়ের করো।’ ইজানাগী আর ইজানামী বললেন, ‘আচ্ছা।’ বলে তাঁরা সেই শূল দিয়ে সমুদ্রটাকে ঘাঁটতে লাগলেন। তারপর যখন শূল তুললেন, তখন তার মুখ বেয়ে যে জল পড়েছিল, তাই থেকে একটা দ্বীপ হল, তার নাম ‘ওনগরো’। এই ওনগরো দ্বীপে একটি সুন্দর বাড়ি তয়ের করে, তার ভিতরে ইজানাগী আর ইজানামী বাস করতে লাগলেন। সেইখান থেকেই তাঁরা জাপান দেশটাকে গড়েছিলেন। এই দেশকে আমরা বলি ‘জাপান’ কিন্তু সে দেশের লোকেরা বলে ‘নেপ্পন’ বা ‘দাই-নিপ্পন’। ইজানাগী আর ইজানামীর অনেক ছেলে মেয়ে। তার মধ্যে ‘আগুন-দেবতা’ একজন। এই দেবতার জন্মের সময় ইজানামী মরে গেলেন। তখন মনের দুঃখে ইজানাগী চোখের জল ফেলতে লাগলেন, আর সেই চোখের জল থেকে ‘কান্না-পরীর’ জন্ম হ’ল। কাঁদতে কাঁদতে শেয়ে ইজানাগীর রাগ হল। তখন তিনি তলোয়ার দিয়ে আগুন-দেবতার মাথা কেটে ফেললেন, তাতে সেই কাটা দেবতার শরীর আর রক্ত হতে ষোলটা দেবতা উঠে দাঁড়াল। কিন্তু ইজানাগীর মনের দুঃখ তাতেও ঘুচল না। শেষে তিনি ইজানামীকে খুঁজতে খুঁজতে গিয়ে পাতালে উপস্থিত হলেন-সেই যেখানে মৃত্যুর পরে সকলকেই যেতে হয়। পাতালের ভিতর মস্ত পুরী আছে, সেই পুরীর দরজার গিয়ে ইজানামীর সঙ্গে তাঁর দেখা হল। ইজানামী তাঁকে বললেন, ‘একটু দাঁড়াও। আমি জিজ্ঞাসা করে আসি, তারপর তোমার সঙ্গে যাব।’ এই বলে ইজানামী ভিতরে গেলেন। ইজানাগী খানিক বাইরে দাঁড়িয়েছিলেন, শেষে ইজানামীর দেরি দেখে তিনিও ভিতরে গেলেন। ভিতরে যেতেই এমনি ভয়ানক গন্ধ এসে তাঁর নাকে লাগল যে কি বলব। এমন ভয়ঙ্কর নোংরা জায়গায় কথা কেউ ভাবতেও পারে নাঃ আর সেখানে থেকে থেকে ইজানামীও এমন নোংরা হয়ে গিয়েছেন যে, তাঁর কাছে যাবার সাধ্য নাই। এ-সব দেখে ইজানাগী নাকে হাত দিয়ে সেখান থেকে ছুটে পালালেন। পেয়াদাগুলো তাঁকে পালাতে দেখে ‘ধর্‌ ধর্‌’ বলে তাড়া করেছিল, কিন্তু ধরতে পারে নি। কি বিষম গন্ধই সে জায়গায় ছিল! দেশে ফিরেও ইজানাগীর গা থেকে সে গন্ধ গেল না। গন্ধে অস্থির হয়ে তিনি নদীতে স্নান করতে গেলেন। সেই সমযে তাঁর কাপড় আর গা থেকে অনেকগুলি দেবতা বেরিয়েছিলেন। এঁদের মধ্যে একটি মেয়ে ইজানাগীর বাম চোখ দিয়ে বেরিয়েছিলেন, সেটি এমন সুন্দর যে তেমন আর কেউ দেখে নি। সেই মেয়েটির নাম ‘গগন আলো’ তিনি সূর্যের দিবতা! ইজানাগীর ডান চোখ দিয়ে আর-একটি দেবতা বেরিয়েছিলেন, সেটির নাম ‘তেজবীর’। তখন ইজানাগী তাঁর নিজের গলার হার গগন-আলোর গলায় পরিয়ে দিয়ে বললেন, ‘মা তুমি হলে স্বর্গের রানী।’ চন্দ্রপতিকে তিনি বললেন, ‘তুমি হরে রাত্রির রাজা।’ আর তেজবীরকে বললেন, ‘তুমি হবে সমুদ্রের রাজা।’ তখন গগন আলো গিয়ে স্বর্গের রানী হলেন, চন্দ্রপতি গিয়ে রাত্রির রাজা হলেন। কিন্তু তেজাবীর সেইখানে বসেই কাঁদতে লাগলেন। দিন নাই, রাত নাই, কেবলই গালে হাত দিয়ে কান্না। তাঁর দাড়ি লম্বা হয়ে ভুঁড়িতে গিয়ে ঠেকল, তবুও তাঁর কান্না থামল না। ইজানাগী বলরেন, ‘আরে তোর হল কি? রাজ্য দিলাম, রাজ্যে গেলি না, খালি যে কাঁদ্‌ছিস?’ তেজবীর বললেন, ‘আমি রাজ্য চাই না। আমি সেই পাতালে আমার মার কাছে যাব।’ ইজানাগী বললেন, ‘তবে যা বেটা তুই এখান থেকে দূর হয়ে।’ বলে তিনি তাঁকে তাড়িয়ে দিলেন।’ যখন তেজবীর স্বর্গে গিয়ে গগন-আলোর কাছে উপস্থিত হলেন। গগন- আলো জানতেন, তাঁর মন ভাল নয়, কাজেই তিনি তাঁকে দেখে ভাবলেন, ‘না জানি কেন এসেছে!’ তেজবীর কিন্তু বললেন, ‘বাবা তাড়িয়ে দিয়েছেন, তাই মার কাছে চলেছি্‌ যাবার আগে তোমাকে দেখতে এলাম।’ গগন-আলো বললে, ‘তাই যদি হয়, তবে তোমার তলোয়ারখানা দাও ত।’ তেজবীরের কাছ থেকে তলোয়ার নিয়ে গগন-আলো সেটাকে চিবিয়ে গুঁড়ো করে ফেললেন। সেই গুঁড়ো থেকে তিনটি দেবতা জন্মাল। তখন তেজবীর বললেন, ‘আচ্ছা, এখন তোমার গহনাগুলি দাও ত?’ গহনা নিয়ে তিনি চিবিয়ে গুঁড়ো করে ফেললেন, আর সেই গুঁড়ো তেকে পাঁচটি দেবতা হল। এখন, এই যে সব দেবতা হল, এরা কারা? গগন-আলো বললেন, ‘তোমার তলোয়ার থেকে যারা হয়েছে, তারা তোমার, আর আমার গহনা থেকে যারা হয়েছে তারা আমার।’ কথাটা ত বেশ ভালোই হয়েছিল, কিন্তু হলে কি হয়, গগন-আলোর গহনা থেকেই যে বেশি দেবতা হয়েছিল। কাজেই সে সে কথা তেজবীরের পছন্দ হল না। তাতে বিষম চটে গিয়ে গগন-আলোর ক্ষেত মাড়িয়ে, খাল বুজিয়ে, বাগান ভেঙে, বিষম দৌরাত্ম্য আরম্ভ করলেন। পর্বতের গুহার ভিতরে নিজের ঘরে বসে সখীদের নিয়ে গগন-আলো কাপড় বুনছিলেন, সেই ঘরের ছাত ভেঙে তেজবীর ভিতরে ছাল-ছাড়ানো মরা ঘোড়া ফেলে দিলেন। কাজেই তখন আর গগন-আলো কি করেন, তিনি তেজবীরের ভয়ে গুহার দরজা বন্ধ করে দিলেন। এখন তিনিই হলেন সূর্যের দেবতা, আলোর মালিক। সেই আলোর মালিক হখন গুহায় লুকোতে গেলেন, তখন কাজেই জগৎ-সংসার অন্ধকার হয়ে গেল। সকলে বলল, ‘সর্বনাশ! এখন উপায়?’ তখন তারা করল কি, তারা সবাই মিলে অনেক যুক্তি করে একখানা চমৎকার আরশি তয়ের করল, আর যার পর নাই সুন্দর একছড়া মণির মালা গড়াল, আরো কত কি জিনিস। তারা হেসে, গেয়ে, নেচে, লাফিয়ে চেঁচিয়ে, মোরগ ডাকিয়ে কি যে একটা শোরগোল জুড়ে দিলে, তা না শুনলে বোঝা যায় না। শুহার ভিতর থেকে সেই গোলমাল শুনে গগন-আলো ভাবলেন, ‘না জানি কি হয়েছে।’ তিনি আস্তে আস্তে গুহার দরজা একটু ফাঁক করে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘আরে তোরা কিসের এত গোলমাল করছিস?’ তারা বলল, ‘গোলমার করব না? দেখো এসে, তোমার চেয়ে কত সুন্দর একটি মেয়ে পেয়েছি।’ বলেই সেই আরশিখানা এনে তাঁর সামনে ধরল। সেই আরশির ভিতরে নিজের সুন্দর মুখখানি দেখে আর সূর্যের দেবতা লুকিয়ে থাকতে পারলেন না। তিনি তখনি ছুটে বেরিয়ে এলেন-আর অমনি সকালে গিয়ে তাড়াতাড়ি দরজা বন্ধ করে হুড়কো এঁটে দিল। তখন আবার সূর্য উঠল, আবার আলো হল, আবার সংসারে সুখ এল। তারপর সবাই মিলে সেই দুষ্ট তেজবীরকে দূর করে তাড়িয়ে দিল। সেখান থেকে তাড়া খেয়ে, তেজবীর ঘুরতে হী নদীর ধারে গিয়ে উপস্থিত হলেন। সেখানে দুটি বুড়োবুড়ি একটি ছোট্ট মেয়েতে নিয়ে বসে কাঁদছিল, তাদের দেখে তিনি জিজ্ঞাসা করলেন, ‘তোমরা কাঁদছ কেন? কি হয়েছে?’ বুড়োটি বলল, ‘বাবা, আমার দুঃখের কথা শুনে কি করবে? আমার আটটি মেয়ে ছিল, তার সাতটি অজগরে খেয়েছে, এই একটি আছে। সে বড় ভয়ঙ্কর অজগর, তার আটটি মাথা। বছরে একবার করে আসে, আর আমার একটি মেয়েকে খেয়ে যায়। আবার তার আসবার সময় হয়েছে, এবারে এটিকেও খাবে। তাই আমরা কাঁদছি।’ তেজবীর বললেন, ‘এই কথা? আচ্ছ তোমাদের কোনো চিন্তা নাই। আমি যা বলছি, তাই করো। আট জালা খুব কড়া রকমের সাকী (জাপানী মদ) তয়ের করো ত। করে, ঐ জায়গায় রেখে দাও, তারপর দেখো কি হয়।’ বুড়ো সেইদিনই আট জালা সাকী তয়ের করে তেজবীরের কথামত সাজিয়ে রেখে দিল। সাকীর গন্ধে চারিদিকে ভুর ভুর করতে লাগল। ঠিক সেই সময় অজগর গড়াতে গড়াতে আর ফোঁস ফোঁস করতে করতে এসে উপস্থিত হয়েছে, আর সকলের আগে সেই সাকীর গন্ধ গিয়েছে তার নাকে। আর কি সে বেটা তার লোভ সামলাতে পারে? সে অমনি আট জালায় আট মাথা ঢুকিয়ে দিয়ে সাকী খেতে লাগল। খেতে খেতে তার চোখ বুঁজে এল, মাথা ঢুলে পড়ল; তবু হুশ নাই, সে চোঁ চোঁ করে খাচ্ছে। শেষে ঘুমে অচেতন হয়ে একেবারে মাটিতে গড়াগড়ি খেতে লাগল। তা দেখে তেজবীর বললেন, আর কি? এই বেলা!’ বলেই তিনি তাঁর তলোয়ার নেয়ে এসে সেটাকে টুকরো টুকরো করে কেটে ফেললেন। তখন তেজবীর খুঁজে দেখলেন যে, সেই লেজের ভিতরে আশ্চর্য রকমের একখানা তলোয়ার রয়েছে। তিনি তখই সেই তলোয়ারখানা বার করে নিলেন। তখন ত সকলেরই খুব সুখ হল। তারপর বুড়োর মেয়েকে বিয়ে করে, সেই দেশে সুন্দর বাড়ি তয়ের করে, দুজনে সুখে বাস করতে লাগলেন। আর সেই বাড়িতে যারপরনাই আদর যত্নে থেকে বুড়োবুড়িরও শেষকাল খুব আরামেই কাটল। গগন-আলোর যে নাতি, তাঁর তিন ছেলে; দীপ্তানল, ক্ষিপ্তানল আর তৃপ্তানল। দীপ্তানল মাছ ধরেন আর তৃপ্তানল শিকার করেন। একদিন তৃপ্তানল দীপ্তানলকে বললেন, ‘দাদা, চলো না, তোমার কাজটি আমি করিম আর আমার কাজটা তুমি করো-দেখি কেমন হয়।’ বলে, নিজের তীরধনুক দাদাকে দেয়ে, দাদার বঁড়শি আর ছিপ তিনি চেয়ে নিলেন। নিয়ে মাছ ত ধরলেন খুবই, লাভের মধ্যে বঁড়শিটা মাছে ছিড়ে নিয়ে গেল। তারপর একদিন দীপ্তানর বললেন, ‘ভাই, শখ কি মিটেছে? এখন কেন আমার বঁড়শি আর আমাকে ফিরিয়ে দাও না।’ তাতে তৃপ্তানল ভারি লজ্জিত হয়ে বললেন, ‘দাদা বঁড়শি ত মাছে নিয়ে গেছে। এখন কি করে দিই?’ এ কথায় দীপ্তানর যার পর নাই রেগে বললেন, সে আমি জানি না। আমার বড়শি আমাকে এনে দাও।’ তখন তৃপ্তানল আর কি করেন, নিজের তলোয়রখানা ভেঙে টুকরো টুকরো করে তাই দিয়ে বঁড়শি বানিয়ে দাদাকে দিলেন। কিন্তু দাদার তাতে মন উঠল না। তিনি বললেন, ‘ও আমি চাই না, আমার বঁড়শি নিয়েছে, তাই এনে আমাকে দাও।’ তৃপ্তানল হাজার বঁড়শি এনে দীপ্তানলকে দিতে গেলেন, তাতেও হল না। দৃপ্তানল আরো রেগে গিয়ে বললেন, ‘আমার সেই বঁড়শিটি আমাকে এনে দিতে হবে।’ তা শুনে তৃপ্তানল মাথা হেঁট করে চোখের জল ফেলতে সেখান থেকে চলে গেলেন। ভাবলেন, ‘হায়! এখন আমি কি করি? সমুদ্রের মাছে বঁড়শি নিয়ে গেছে, তাকে আমি কোথায় খুঁজে পাব?’ এই কথা ভাবতে ভাবতে তিনি সমুদ্রের ধারে গিয়ে বসে কাঁদছেন, এমন সময় সমুদ্রের দেবতা লবণেশ্বর সেইখানে এসে তাঁকে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘তোমার কি হয়েছে বাছা? তুমি কাঁদছ কেন? তৃপ্তানল বললেন, ‘দাদার বঁড়শি নিয়ে মাছ ধরতে এসেছিলাম, সেটা মাছে নিয়ে গেছে। তাতে দাদা বড্ড রাগ করেছেন। আমি আরো কত কাঁটা তাঁকে দিতে গেলাম, তিনি নিলেন না, বললেন, আমার তাই করো।’ বলে, তিনি তখনি একখানা নৌকা তয়ের করে তৃপ্তানলকে তাতে বসিয়ে দিলেন, আর দিয়ে গড়া একটা বাড়ি দেখতে পাবে, সেইকানে সমুদ্রর রাজা সিন্ধুপতি থাকেন। সেই বাড়ির পাশে বাগানের ভিতরে কুয়োর ধারে একটা গাছ আছে, তার আগায় উঠে তুমি বসে থাকবে। সে বাগানে রাজার মেয়ে বেড়াতে আসেম সে তোমাকে তোমার বঁড়শির কথা বলে দেবে।’ এ কথায় তৃপ্তানল সেই নৌকা বেয়ে, সেই রাজার বাড়িতে গিয়ে সেই গাছে উঠে বসে রইলেন। খানিক বাদে রাজার মেয়ের দাসীরা কলসী হাতে করে সেই কুয়ো থেকে জল নিতে এল। এসে তারা দেখল যে, গাছের উপরে কেমন সুন্দর একটি রাজপুত্র বসে আছে। তৃপ্তানল তাদের বললেন, ‘হ্যাঁ গা, তোমরা দয়া করে আমাকে একটু জল খেতে দেবে? দাসীরা অমনি সোনার গেলাসে দেবার সময়ে নিজের গলা থেকে মণি খুলে তার ভিতর ফেলে দিলেন। দাসীরা তা দেখতে পায় নি, তারা সেই মণিসুদ্ধ গেলাস নিয়ে রাজার মেয়ের ঘরে রেখে দিয়েছে। তারপর রাজার মেযে জল খাবার জন্য গেলাস খুঁজতে এসে বললেন-‘এ কি? গেলাসের ভিতর মণে কোথেকে এল রে?’ তা ত আমরা জানি না, কুয়োর ধারে একটি রাজপুত্র খেতে দিলাম। মণি হয়ত তারই হবে।’ রাজার মেয়ে তখনি ছুটে গিয়ে তাঁর বাবাকে সব কথা বললেন। রাজা সিন্ধুপতিও এ কথা শুনেই তাড়াতাড়ি সেই কুয়োর ধারে চলে এলেন। এসে গাছের উপরি তৃপ্তানলকে দেখেই তিনি যার পর নাই আশ্চর্য আর খুশি হয়ে বললেন, ‘আরে, তোমার নাম না তৃপ্তানল? আমাদের স্বর্গের রানী গগন-আলোর নাতির ছেলে! তুমি কেন কুয়োর ধারে বসে থাকবে বাবা? এসো এসো, ঘরে এসো!’ বলে, তাঁকে জড়িয়ে ধরে আদর করতে করতে রাজা তাঁকে সভায় নিয়ে এলেন। সভার লোক তাঁর নাম শুনেই ব্যস্ত হযে উঠে তাঁকে সেলাম করে জোড়হাতে তাঁর সামনে দাঁড়িয়ে রইল। তারপর বাজা অনেক ধূমধাম করে তাঁর সঙ্গে নিজের মেয়ের বিয়ে দিলেন। তারপর থেকে বেশ সুখেই দিন যায়। রাজা রোজই খবর নেন, তৃপ্তানল কেমন আছেন, রাজার মেয়ে বলেন, ‘বেশ ভাল আছেন।’ এমন করে তিন বৎসর চলে গেল। তারপর একদিন রাজা খবর নিতে এসে শুনলেন যে, তৃপ্তানল বিচানায় শুয়ে একটা খুব লম্বা নিশ্বাস ফেলেছিলেন। অমনি রাজা জিজ্ঞাসা করলেন, ‘বাবা, তুমি কেন নিশ্বাস ফেলেছিলে? তোমার কিসের দুঃখ?’ তৃপ্তানল বলরেন, ‘দাদার বঁড়শি নিয়ে মাছ ধরতে এসেছিলাম, সেই বঁড়শি মাছে নিয়ে গেছে। এতে দাদার বড্ড রাগ হয়েছে, আর বলেছেন যে, সেই বঁড়শি তাঁকে ফিরিয়ে না দিলে কিছুতেই হবে না।’ শুনে রাজা বললেন, ‘এই কথা? আচ্ছা-ডাক ত রে সকল মাছকে!’ রাজার হুকুমে পৃথিবীর যত মাছ কতরে এসে তাঁর কাছে হাজির হল, আর রাজা তাদের সকলকে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘বলো ত, তোমাদের কার গলায় সেই বঁড়শি আটকেছিল?’ তারা সকলে বললেন ‘তাই মাছের গলায় সেই বঁড়শি আটকেছিল। আজও তার খোঁচা লাগে।’ তখন রাজামশায় তাকে বললেন, ‘হাঁ কর, ব্যাটা, দেখি তোর গলাঢ কি আছে!’ এ কথায় তাই যেই ‘অ-অ-অ-আ-ক!’ করে দুহাত চওড়া হাঁ-টি করেছে, অমনি দেখা গেল যে ঠিক সেই বঁড়শিটি তার গলায় বিঁধে রয়েছে। অমনি চিমটা দিয়ে সেটাকে বার করে আনা হল। তখন ত আর তৃপ্তানলের আনন্দের সীমা রইল না। রাজামশাই তাঁর হতে সেই বঁড়শীটি দিয়ে আরো দুটি মাণিক তাঁকে দিলেন! তার একটির নাম জোয়ার-মাণিক; তাকে ছুঁড়ে মারলে সেই সমূদ্র ছুটে এসে শত্রুকে ডুবিয়ে দেয়। আর একটির নাম ভাটা-মাণিক; তাকে ছুঁড়ে মারলে সেই সমুদ্র ফিরে চলে যায়। তারপর কুমিরের রাজাকে ডেকে সিন্ধুপতি বললেন, ‘তুমি তৃপ্তানলকে তার দেশে পৌঁছিয়ে দিয়ে এসো। দেখো যেন তার কোনো ক্ষতি না হয়।’ সেই পাহাড়ের মত কুমির তৃপ্তানলকে পিঠে করে তাঁর দেশে পৌঁছিয়ে দিয়ে এল। তারপর দীপ্তানলকে তাঁর বঁড়শি ফিরিযে দিতে আর বেশিক্ষণ লাগল না। কিন্তু দীপ্তানল কোথায় তাঁর বঁড়শি পেয়ে খুশি হবেন, না তিনি আরো রেগে তলোয়ার নিয়ে তৃপ্তানলকে কাটতে গেলেন। তখন তৃপ্তানল আর কি করেন, তাড়াতাড়ি সেই জোয়ার-মানিককে ছুড়ে মারলেন। মারতেই ত সমুদ্রের জল পাহাড়ের মত উঁচু হয়ে এসে দীপ্তানলকে ভাসিয়ে নিয়ে চলল। তখন আর তিনি যাবেন কোথায়? ঢকঢক জল খেতে খেতে চেঁচিয়ে বলতে লাগলেন, ‘রক্ষে করো ভাই! আমার ঘাট হয়েছে, আমি- আর অমন করব না!’ সে কথায় তৃপ্তানল ভাটা-মানিক ছুঁড়ে জল সরিয়ে তাঁকে বাঁচালেন। তারপর থেকে দীপ্তানল ভাল মানুষ হয়ে গেলেন, আর ছোট ভাইকেই রাজ্য ছেড়ে দিলেন।
উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী
জেলা আর সাত ভুত উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী এক জোলা ছিল সে পিঠে খেতে বড় ভালবাসত। একদিন সে তার মাকে বলল, ‘মা, আমার বড্ড পিঠে খেতে ইচ্ছে করছে,আমাকে পিঠে করে দাও।’ সেইদিন তার মা তাকে লাল-লাল, গোল-গোল, চ্যাপটা-চ্যাপটা সাতখানি চমৎকার পিঠে করে দিল। জোলা সেই পিঠে পেয়ে ভারি খুশি হয়ে নাচতে লাগল আর বলতে লাগল, ‘একটা খাব, দুটো খাব, সাত বেটাকেই চিবিয়ে খাব!’ জোলার মা বলল, ‘খালি নাচবিই যদি, তবে খাবি কখন?’ জোলা বলল, ‘খাব কি এখানে? সবাই যেখানে দেখতে পাবে, সেখানে গিয়ে খাব।’ ব’লে জোলা পিঠেগুলি নিয়ে নাচতে নাচতে বাড়ি থেকে গেল, বলতে লাগল, ‘একটা খাব, দুটো খাব, সাত বেটাকেই চিবিয়ে খাব!’ নাচতে নাচতে জোলা একেবারে সেই বটগাছতলায় চলে এল, যেখানে হাট হয়। সেই গাছের তলায় এসে সে খালি নাচছে আর বলছে, ‘একটা খাব, দুটো খাব, সাত বেটাকেই চিবিয়ে খাব!’ এখন হয়েছে কি-সেই গাছে সাতটা ভূত থাকত। জোলা ‘সাত বেটাকেই চিবিয়ে খাব’ বলছে, আর তা শুনে তাদের ত বড্ড ভয় লেগেছে। তারা সাতজনে গুটিগুটি হয়ে কাঁপছে, আর বলছে,‘ওরে সর্বনাশ হয়েছে! ঐ দেখ, কেত্থেকে এক বিটকেল ব্যাটা এসেছে, আর বলছে আমাদের সাতজনকেই চিবিয়ে খাবে! এখন কি করি বল্‌ ত! অনেক ভেবে তারা একটা হাঁড়ি নিয়ে জোলার কাছে এল। এসে জোড়হাত করে তাকে বলল, ‘দোহাই কর্তা! আমাদের চিবিয়ে খাবেন না। আপনাকে এই হাঁড়িটি দিচ্ছি, এইটি নিয়ে আমাদের ছেড়ে দিন।’ সাতটা মিশমিশে কালো তালগাছপানা ভূত, তাদের কুলোর মত কান, মুলোর মত দাঁত, চুলোর মত চোখ-তারা জোলার সামনে এসে কাঁইমাই করে কথা বলছে দেখেই ত সে এমনি চমকে গেল যে, সেখান থেকে ছুটে পালাবার কথা তার মনেই এল না। সে বলল, ‘হাঁড়ি নিয়ে আমি কি করব?’ ভূতেরা বলল, ‘আজ্ঞে, আপনার যখন যা খেতে ইচ্ছে হবে, তাই এই হাঁড়ির ভিতর পাবেন।’ জোলা বলল, ‘বটে! আচ্ছা পায়েস খাব।’ বলতে বলতেই সেই হাঁড়ির ভিতর থেকে চমৎকার পায়েসের গন্ধ বেরুতে লাগল। তেমন পায়েস জোল কখনো খায় নি, তার মাও খায় নি, তার বাপও খায় নি। কাজেই জোলা যার-পর-নাই খুশি হয়ে হাঁড়ি নিয়ে সেখান থেকে চলে এল, আর ভূতেরা ভাবল, ‘বাবা! বড্ড বেঁচে গিয়েছি।’ তখন বেলা অনেক হয়েছে, আর জোলার বাড়ি সেখান থেকে ঢের দূরে। তাই জোলা ভাবল, ‘এখন এই রোদে কি করে বাড়ি যাব? বন্ধুর বাড়ি কাছে আছে, এবেলা সেইখানে যাই। তারপর বিকেলে বাড়ি যাব এখন।’ বলে সে তার বন্ধুর বাড়ি এসেছে। সে হতভাগা কিন্তু ছিল দুষ্টু। সে জোলার হাঁড়িটি দেখে জিজ্ঞাসা করল, হাঁড়ি কোত্থেকে আনলি রে।’ জোলা বলল, ‘বন্ধু, এ যে-সে হাঁড়ি নয়, এর ভারি গুণ।’ বন্ধু বলল ‘বটে? আচ্ছা দেখি ত কেমন গুণ।’ জোলা বলল, ‘তুমি যা খেতে চাও, তাই আমি এর ভিতর থেকে বার করতে পারি।’ বন্ধু বলল, ‘আমি রাবড়ি, সন্দেশ, রসগোল্লা, সরভাজা, মালপুয়া, পাস্তুয়া, কাঁচাগোল্লা, ক্ষীরমোহন, গজা, মতিচুর জিলিপি, অমৃতি, চমচম এইসব খাব।’ জোলার বন্ধু যা বলছে, জোলা হাঁড়ি ভিতর হাত দিয়ে তাই বার করে আনছে। এ-সব দেখে তার বন্ধু ভাল যে, এ জিনিসটি চুরি না করলে হচ্ছে না। তখন জোলাকে কতই আদর করতে লাগল! পাখা এনে তাকে হাওয়া করল, গামছা দিয়ে তার মুখ মুছিয়ে দিল, আর বলল, ‘আহা ভাই, তোমার কি কষ্টই হয়েছে! গা দিয়ে ঘাম বয়ে পড়েছে! একটু ঘুমোবে ভাই? বিছানা করে দেব?’ সত্যি সত্যি জোলার তখন ঘুব পেয়েছিল। কাজেই সে বলল, ‘আচ্ছা বিছানা করে দাও।’ তখন তার বন্ধু বিছানা করে তাকে ঘুম পাড়িয়ে, তার হাঁড়িটি বদ্‌লে তার জায়গায় ঠিক তেমনি ধরনের আর একটা হাঁড়ি রেখে দিল। জোলা তার কিছুই জানে না, সে বিকালে ঘুম থেকে উঠে বাড়ি চলে এসেছে আর তার মাকে বলছে, ‘দেখো মা, কি চমৎকার একটা হাঁড়ি এনেছি। তুমি কি খাবে, মা? সন্দেশ খাবে? পিঠে খাবে? দেখো আমি এর ভিতর থেকে সে-সব বার করে দিচ্ছি।’ কিন্তু এ ত আর সে হাঁড়ি নয়, এর ভিতর থেকে সে-সব জিনিস বেরুবে কেন? মাঝখান থেকে জোলা বোকা ব’নে গেল, তার মা তাকে বকতে লাগল। তখন ত জোলার বড্ড রাগ হয়েছে, আর সে ভাবছে, ‘সেই ভূত ব্যাটাদেরই এ কাজ।’ তার বন্ধু যে তাকে ঠকিয়েছে, এ কথা তার মনেই হল না। কাজেই পরদিন সে আবার সেই বটগাছতলায় গিয়ে বলতে লাগল, ‘একটা খাব, দুটো খাব, সাত বেটাকেই চিবিয়ে খাব!’ তা শুনে আবার ভূতগুলো কাঁপতে কাঁপতে একটা ছাগল নিয়ে এসে তাকে হাত জোড় করে বলল, ‘মশাই গো! আপনার পায়ে পড়ি, এই ছাগলটা নিয়ে যান। আমাদের ধরে খাবেন না।’ জোলা বলল, ‘ছাগলের কি গুণ?’ ভূতরা বলল, ‘ওকে সুড়সুড়ি দিয়ে ও হাসে, আর ও মুখ দিয়ে খালি মোহর পড়ে।’ অমনি জোলা ছাগলের গায়ে সুড়সুড়ি দিতে লাগল। আর ছাগলটাও ‘হিহি হিহি’ করে হাসতে লাগল, আর মুখ দিয়ে ঝর ঝর করে খালি মোহর পড়তে লাগল। তা দেখে জোলার মুখে ত আর হাসি ধরে না। সে ছাগাল নিয়ে ভাবল যে, এ জিনিস বন্ধুকে না দেখালেই নায়। সেদিন তার বন্ধু তাকে আরো ভাল বিছানা করে দিয়ে দুহাতে দই পাখা দিয়ে হাওয়া করল। জোলার ঘুমও হল তেমনি। সেদিন আর সন্ধ্যার আগে তার ঘুম ভাঙল না। তার বন্ধু ত এর মধ্যে কখন তার ছাগল চুরি করে তার জায়গয় আর-একটা ছাগল রেখে দিয়েছে। সন্ধ্যার পর জোলা তাড়াতাড়ি ঘুম থেকে উঠে তার বন্ধুর সেই ছাগলটা নিয়ে বাড়ি এল। এসে দেখল, যে তার মা তার দেরি দেখে ভারি চটে আছে। তা দেখে সে বলল, ‘রাগ আর করতে হবে না, মা। আমার ছাগলের গুণ দেখলে খুমি হয়ে নাচবে!’ বলেই সে ছাগলের বগলে আঙুল দিয়ে বলল, ‘কাতু কুতু কুতু কুতু কুতু!!!’ ছাগল কিন্ত তাতে হাসলো না, তার মুখ দিযে মোহরও বেরুল না। জোলা আবার তাকে সুড়সুড়ি দিলে বলল, ‘কাতু কুতু কুতু কুতু কুতু কুতু কুতু কুতু!!’ তখন সেই ছাগল রেগে গিয়ে শিং বাগিয়ে তার নাকে অমনি বিষম গুঁতো মারল যে, সে চিত হয়ে পড়ে চেঁচাতে লাগল। আর তার নাক দিয়ে রক্তও পড়ল প্রায় আধ সের তিন পোয়া। তার উপর আবার তার মা তাকে এমনি বকুনি দিল যে, তেমন বকুনি সে আর খায় নি। তাতে জোলার রাগ যে হল, সে আর কি বলব! সে আবার সেই বটগাছতলায় গিয়ে চেঁচিয়ে বলতে লাগল, ‘একটা খাব, দুটো খাব, সাত বেটাকেই চিবিয়ে খাব!’ ‘বেটারা আমাকে দুবার ফাঁকি দিয়েছিস, ছাগল দিয়ে আমার নাক থেঁতলা করে দিয়েছিস-আজ আর তোদের ছাড়ছি নে!’ ভূতেরা তাতে ভারি আশ্চর্য হয়ে বলল, সে কি মশাই, আমার কি করে আপনাকে ফাঁকি দিলুম, আর ছাগল দিয়েই বা কিরে আপনার নাক থেঁতলা করলুম?’ জোলা তার নাক দেখিয়ে বলল, ‘এই দেখ না, গুঁতো মেরে সে আমার কি দশা করেছ। তোদের সব কটাকে চিবিয়ে খাব!’ ভূতেরা বলল, ‘সে কখনো আমাদের ছাগল নয়। আপনি কি এখান থেকে সোজাসুজি বাড়ি গিয়েছিলেন?’ জোলা বলল, ‘না, আগে বন্ধুর ওখানে গিয়েছিলুম।সেখানে খানিক ঘুমিয়ে তারপর বাড়ি গিয়েছিলুম।’ ভূতেরা বলল, ‘তবেই ত হছেয়ে! আপনি যখন ঘুমোচ্ছিলেন, সেই সময় আপনার বন্ধু আপনার ছাগল চুরি করেছে।’ একথা শুনেই জোলা সব বুঝতে পারল। সে বলল, ‘ঠিক ঠিক। সে বেটাই আমার হাঁড়ি চুরি করেছে। এখন কি হবে?’ ভূতেরা তাকে একগাছি লাঠি দিয়ে বলল, ‘এই লাঠি আপনার হাঁড়িও এনে দেবে, ছাগলও এনে দেবে। ওকে শুধু একটিবার আপনার বন্ধুর কাছে নিয়ে বলবেন, ‘লাঠি লাগ। ত!’ তা হলে দেখবেন, কি মজা হবে! লাখ লোক ছুটে এলেও এ লাঠির সঙ্গে পারবে না, লাঠি তাদের সকলকে পিটে ঠিক করে দেবে।’ জোলা তখন সেই লাঠিটি বগলে করে তার বন্ধুর গিয়ে বলল, ‘বন্ধু, একটা মজা দেখবে?’ বন্ধু ত ভেবেছে, না জানি কি মজা হবে। তারপর যখন জোলা বলল, ‘লাঠি, লাগ্‌ ত!’ তখন সে এমনি মজা দেখল, যেমন তার জন্মে আর কখনো দেখে নি। লাঠি তাকে পিটে পিটে তার মাথা থেকে পা অবধি চামড়া তুলে ফেলল। সে ছুটে পালাল, লাঠি তার সঙ্গে সঙ্গে গিয়ে তাকে পিটতে পিটতে ফিরিয়ে নিয়ে এল। তখন সে কাঁদতে কাঁদতে হাত জোড় করে বলল, ‘তার পায়ে পড়ি ভাই, তোর হাড়ি নে, তোর ছাগল নে আমাকে ছেড়ে দে।’ জোলা বলল, ‘আগে ছাগল আর হাঁড়ি আন্‌, তবে তোকে ছাড়ব।’ কাজেই বন্ধুমশাই আর করেন? সেই পিটুনি খেতে খেতেই হাঁড়ি আর ছাগল এনে হাজির করলেন। জোলা হাঁড়ি হাতে নিয়ে বলল, ‘সন্দেশ আসুক ত“!’অমনি হাঁড়ি সন্দেশে ভরে গেল। ছাগলকে সুড়সুড়ি দিতে না দিতেই সে হো হো করে হেসে ফেলল, আর তার মুখ দিয়ে চারশোটা মোহর বেরিয়ে পড়ল। তখন সে তার লাঠি, হাঁড়ি আর ছাগল নিয়ে বাড়ি চলে গেল। এখন আর জোলা গরিব নেই, সে বড়মানষ হয়ে গেছে। তার বাড়ি, তার গাড়ি হাতি-ঘোড়া-খাওয়া-পরা, চাল-চলন, লোকজন সব রাজার মতন। দেশের রাজা তাকে যার পর নাই খাতির করেন, তাকে জিজ্ঞাসা না করে কোন ভারি কাজে হাত দেন না। এর মধ্যে একদিন হয়েছে কি, আর কোন দেশের এক রাজা হাজার লোকজন নিয়ে এসে সেই দেশ লুটতে লাগল। রাজার সিপাইদের মেরে খোঁড়া করে দিয়েছে, এখন রাজার বাড়ি লুটে কখন তাঁকে ধরে নিয়ে যাবে, তার ঠিক নেই। রাজামশাই তাড়াতাড়ি জোলাকে ডাকিয়ে বললেন, ভাই, এখন কি করি বল্‌ ত? বেঁধেই ও নেবে দেখছি।’ জোলা ললর, ‘আপনার কোন ভয় নেই। আপনি চুপ করে ঘরে বসে থাকুন, আমি সব ঠিক করে দিচ্ছি।’ বলেই সে তার লাঠিটি বগলে করে রাজার সিংহদরজার বাইরে গিয়ে চুপ ক’রে বসে রইল। বিদেশী রাজা লুটতে লুটতে সেই দিকেই আসছে, তার সিপাই আর হাতি ঘোড়ার গোলমালে কানে তালা লাগছে, ধুলোয় আকাশ ছেয়ে গিয়েছে। জোলা খালি চেয়ে দেখছে, কিছু বলে না। বিদেশী রাজা পাহাড়ের মতন এক হাতি চড়ে সকলের আগে আগে আসছে, আর ভাবছে, সব লুটে নেবে। আর, জোলা চুপ করে দাঁড়িয়ে আছে আর ভাবছে, আর একটু কাছে এলেই হয়। তারপর তারা যেই কাছে এসেছে, অমনি জোলা তার লাঠিকে বলল, ‘লাঠি, লাগ্‌ ত।’ আর যাবে কোথায়? তখনি এক লাঠি লাখ লাখ হয়ে রাজা আর তার হাতি- ঘোড়া সকলের ঘাড়ে গিয়ে পড়ল্‌ আর পিটুনি যে কেমন দিল, সে যারা সে পিটুনি খেয়েছিল তারাই বলতে পারে। পিটুনি খেয়ে রাজা চেঁচাতে চেঁচাতে বলল, ‘আর না বাবা, আমাদের ঘাট হয়েছে, এখন ছেড়ে দাও, আমরা দেশে চলে যাই।’ জোলা কিছু বলে না, খালি চুপ করে চেয়ে দেখছে আর একটু একটু হাসছে। শেষে রাজা বলল, ‘তোমাদের যা লুটেছি, সব ফিরিয়ে দিচ্ছি, আমার রাজ্য দিচ্ছি, দোহই বাবা, ছেড়ে দাও।’ তখন জোলা গিয়ে তার রাজাকে বলল, ‘রাজামশাই, সব ফিরিয়ে দেবে বলছে, আর তাদের রাজ্যও আপনাকে দেবে বলছে, আর বলছে, দোহাই বাবা, ছেড়ে দাও। এখন কি হুকুম হয়?’ রাজামহাশয়ের কথায জোলা তার লাঠি থামিযে দিলে। তারপর বিদেশী রাজা কাঁদতে কাঁদতে এসে রাজামশাইয়ের পায়ে পড়ে মাপ চাইল। রাজামশাই জোলাকে দেখিয়ে বললেন,‘ আর এই লোকটিকে যদি তোমার অর্ধেক রাজ্য দাও, আর তার সঙ্গে তোমার মেয়ের বিয়ে দাও, তা হলে তোমার মাপ করব।’ সে ত তার সব রাজ্যই দিতে চেয়েছিল। কাজেই জোলাকে তার অর্ধেক রাজ্য আর মেয়ে দিতে তখনি রাজি হল। তারপর জোলা সেই অর্ধেক রাজ্যের রাজা হল,আর রাজার মেয়ের সঙ্গে তার বিয়ে হল। আর ভোজের কি যেমন তেমন ঘটা হল! সে ভোজ খেয়ে যদি তারা শেষ করতে না পেরে থাকে, তবে হয়ত এখনো খাচেছ। সেখানে একবার যেতে পারলে হত।
উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী
ঝানু চোর চানু উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী ছেলেবেলা থেকেই চানু শয়তানের একশেষ, আশেপাশের লোকজন তার জ্বালায় অস্থির। চানুর বাবা বড় গরিব ছিল, চানু ভাবল-বিদেশে গিয়ে টাকা পয়সা রোজগার করে আনবে। যেমন ভাবা তেমনি কাজ, একদিন সে বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়ল। খানিক দূরে গিয়েই বনের ভিতর দিয়ে একটা নির্জন রাস্তা-চানু সেই রাস্তা ধরে চলল। সমস্ত দিন বৃষ্টিতে ভিজে শ্রান্ত-কান্ত হয়ে স্যার সময় পথের ধারেই একটি কুঁড়েঘর ছিল, সেখানে এসে উপস্থিত। ঘরের ভিতর আগুনের পাশে একটি বুড়ি বসেছিল, চানুকে দেখে সে জিজ্ঞাসা করল, ‘কি চাই বাপু তোমার?’ চানু বলল, ‘চাইব আর কি, কিছু খাবার দাবার চাই, আর একটি বিছানা চাই।’ বুড়ি বলল, ‘সরে পড় বাপু, এখানে কিছু পাবে না। আমার ছয়টি ছেলে, সারাদিন খেটেখুটে তারা এখনই বাড়ি ফিরবে। তোমাকে এখানে দেখতে পেলে তারা তোমার চামড়া তুলে ফেলবে।’ চানু। ‘সেটা আর বেশি কথা কি? এই ঠাণ্ডায় বাইরে গাছের তলায় দাড়িয়ে মরার চাইতে গায়ের চামড়া তুলে ফেলবে, সেইটাই বরং ভাল।’ বুড়ি দেখলে, সে সহজ লোকের পালায় পড়েনি। কি আর করে,চানুকে পেট ভরে খেতে দিল। শুতে যাবার সময় চানু বুড়িকে বলল, ‘দেখো বুড়ি! তোমার ছেলেরা এসে যদি আমার ঘুম ভাঙ্গায়, তা হলে কিন্তু বড্ড মুশকিল হবে বলছি।’ পরের দিন ঘুম ভাঙলে পর চানু দেখল, ছয় জন অতি বদ চেহারার লোক তার বিছানার পাশে দাঁড়িয়ে-সে তাদের দেখেও গ্রাহ্যও করল না। দলের সদারটি তখন জিজ্ঞাসা করল, ‘তুমি কে হে বাপু? কি চাও এখানে?’ চানু। ‘আমার নাম সর্দার চোর, আমার দলের জন্য লোক খুঁজে বেড়াচ্ছি। তোমরা যদি চালাক চতুর হও, তা হলে তোমাদের অনেক বিদ্যে শিখিয়ে দেব।’ সর্দার বলল, ‘আচ্ছা বেশ, তুমি তা হলে এখন উঠে একটু খাও-দাও,তারপর দেখা যাবে এখন, কে সর্দার।’ বিছানা থেকে উঠে সকলের সঙ্গে বসে চানু খেল। ঠিক তারপরই সকলে দেখল, একটা সুন্দর ছাগল সঙ্গে নিয়ে একজন কৃষক বনের পাশে যাচ্ছে। তখন চানু বলল, ‘আচ্ছা, তোমাদের কেউ কোনরকম জবরদস্তি না করে শুধু ফাঁকি দিয়ে ঐ লোকটার ছাগলটা নিয়ে আসতে পার?’ একজন করে সকলেই বললে, ‘না ভাই, আমরা কেউ তা পারব না।’ চানু। ‘ব্যস, ত হলেই দেখো আমি তোমাদের সর্দার কিনা-অমি ছাগলটা নিয়ে আসছি।’ এই বলে তো তখনই বনের ভিতর দিয়ে রাস্তার মোড়ে তার ডান পায়ের জুতোটা রেখে দিল, তারপর ছুটে গিয়ে কিছু দূরে রাস্তার আর একটা মোড়ে বাঁ পায়ের জুতোটাও রেখে রাস্তার ধারে বনের ভিতর চুপ করে লুকিয়ে রইল। খানিক পরেই সেই কৃষক এসে প্রথম জুতোটা দেখে মনে করল, ‘খাসা জুতোটা পড়ে রয়েছে, কিন্তু এক পাটী জুতো দিয়ে কি হবে, আর এক পাটীও থাকলে ভাল হত।’ খানিক দূরে এগিয়ে গিয়ে কৃষক আর-এক পাটী জুতো দেখে ভাবল, ‘আমি কি বোকা, ও পাটীটা যদি নিয়ে আসতাম। যাই, তা হলে ওটা নিয়ে আসি গিয়ে।’ একটা গাছে ছাগলটা বেঁধে সে চলল জুতো আনতে। এদিকে চানু কিন্তু ছুটে গিয়ে আগেই সেটা নিয়ে এসেছে। তারপর কৃষক ছাগলটাকে বেঁধে রেখে যখন চলে গেল, তখন চানুও বাঁ পায়ের জুতোটা নিয়ে ছাগলটার বাঁধন খুলে সেটাকেও নিয়ে বনের ভিতর দিয়ে বুড়ির কুটিরে এসে উপস্থিত। কৃষক গিয়ে প্রথম জুতোটাও পেল না, ফিরে এসে পরের জুতোটাও পেল না। তার উপর আবার যখন দেখল যে ছাগলটিও সেখানে নেই, তখন সে ভাবল, এখন করি কি? গিন্নিকে যে বলে এসেছি, বাজারে ছাগলটা বেচে তার জন্যে একখানা গায়ের চাদর কিনে নিয়ে যাব! যাই তা হলে, চুপচাপ গিয়ে আর-একটা জন্তু নিয়ে আসি, ত নইলে যে ধরা পড়ে যাব-গিন্নি ভাববে, আমি বোকার একশেষ। এদিকে চানু ছাগল নিয়ে বুড়ির বাড়িতে যখন গেল, তখন সেই চোরেরা ত একেবারে অবাক! চানুকে কত করে জিজ্ঞাসা করল, কিন্তু কিছুতেই সে বলল না, কি করে সেই ছাগল আনল। খানিক বাদেই সেই কৃষক একটা মোটাসোটা সুন্দর ভেড়া নিয়ে এসে উপস্থিত। চানু বলল, ‘যাও দেখি, কে জবরদস্তি না করে ভেড়াটা আনতে পার।’ ছয় চোরের সকলেই অস্বীকার করল। তখন চানু বলল, ‘আচ্ছা, দেখি আমি পারি কি না। আমাকে একটা দড়ি দাও দেখি।’ দড়ি নিয়ে চানু বনের ভিতরে ঢুকে পড়ল। এদিকে কৃষকটি তার ছাগল চুরির কথা ভাবতে ভাবতে রাস্তা দিয়ে চলেছে, মোড়ের কাছেই এসে দেখে, গাছের ডালে একটা মড়া ঝুলছে। মড়া দেখেই তার গায়ে কাঁটা দিল, ‘রক্ষা করো বাবা। খানিক আগে ত এখানে মড়া-টড়া কিছু দেখতে পাই নি!’ সামনের মোড়ে গিয়ে কৃষক দেখল আর একটা মড়া গাছের ডালে ঝুলছে। ‘রাম রাম রাম-এ হল কি? আমার মাথাটা গুলিয়ে যায় নি ত?’ কৃষক তাড়াতাড়ি চলল। কিন্তু কি সর্বনাশ! রাস্তার আর একটা মোড়ে গিয়ে দেখে, সেখানেও একটা মড়া ঝুলছে। পর পর তিন-তিনটে মড়া এতটা কাছাকাছি ঝুলছে দেখে তার মনে সন্দেহ হল-‘নাঃ, এ কখনই হতে পারে না। আমারই বোধ করি মাথ খারাপ হয়েছে। আচ্ছা, দেখে আসি আগের মড়া দুটো এখনো গাছে ঝুলছে কি না।’ কৃষক সবে মাত্র মোড়টা ফিরেছে, তখন ডালের মরা চট করে নেমে এসে বাঁধন খুলে ভেড়াটাকে নিয়ে বনের ভিতর দিয়ে একেবারে বুড়ির বাড়ি গিয়ে হাজির। এদিকে কৃষক গিয়ে দেখল, মড়া-টরা কিছুই গাছে ঝুলছে না। ফিরে এসে দেখল তার ভেড়াটাও নেই, কে জানি দড়ি খুলে নিয়ে চম্পট দিয়েছে। তখন তার মনটা কেমন হল তা বুঝতেই পার! বেচারি মাথা খুঁড়তে লাগল-‘হায়, হায়। কার মুখ দেখে আজ বেরিয়েছিলাম! এখন গিন্নি কি বলবে? সমস্ত সকালটাই মাটি হয়ে গেল, ছাগল ভেড়া দুটোই গেল। এখন করি কি? একটা কিছু এনে বাজারে বিক্রি করে গিন্নির শাল না কিনলেই চলবে না। আসবার সময় দেখেছিলাম, ষাঁড়টা মাঠে চরে বেড়াচ্ছে। যাই, সেটাই নিয়ে আসি-গিন্নিও দেখতে পারে না।’ চানু যখন চোরদের বাড়ি ভেড়া নিয়ে গিয়ে উপস্থিত, তখন চোরদের আক্কেল গুডুম হয়ে গেল। সর্দার চোরটি বলল, ‘আর-একটা যদি এরকম চালাকি খেলতে পার, তাহলে তোমাকেই আমাদের সর্দার করব।’ ততক্ষণে কৃষকটিও ষাঁড় নিয়ে এরে উপস্থিত। চানু বলল, ‘যাও ত, জবরদস্তি না করে ষাঁড়টা ফাঁকি দিয়ে আনতে পার? কেউ যখন ভরসা পেল না। তখন সে বলল, আচ্ছা, দেখি, আমি পারি কি না।’ চানু বনের মধ্যে ঢুকে পড়ল। কৃষকটি খানিক দূর এগিয়ে গিয়েই বনের মধ্যে একটা ছাগলের ডাক শুনতে পেল। ঠিক তার পরেই একটা ভেড়াও ডেকে উঠল। আর তাকে রাখে কে! একটা গাছে ষাঁড়টাকে বেঁধে রেখে ছুটল বনের ভিতর। কৃষক যত যায়, ততই শোনে এই একটু আগেই ডাকছে, দেখতে দেখতে প্রায় আধ মাইল দূরে চলে গেল। তখন হঠাৎ সব চুপচাপ, ভেড়া ছাগলের ডাক আর শুনেত পাওয়া গেল না। এদিক-ওদিক খুঁজে কৃষক একেবারে হয়রান হয়ে গেল-কোথায় বা ছাগল আর কোথাই বা ভেড়া। বেচারি কাহিল হয়ে আবার ফিরে এল। কিন্তু সর্বনাশ! এসে দেখে, ষাঁড়টিও সেখানে নেই। বন উলট পালট করে ফেলল, কিছুতেই আর ষাঁড়ের খোঁজ পেল না। চানু যখন ষাঁড় নিয়ে এসে উপস্থিত, তখন আর কথাটি নেই। চোরেরা চানুকে তাদের সর্দার করল। তাদের আনন্দ দেখে কে, সমস্তটা দিন এমন করেই কাটিয়ে দিল। লুটপাট করে চোরেরা যা-কিছু আনত, একটা গহ্বরের মধ্যে সব লুকিয়ে রাখত, রাত্রে খাওয়া-দাওয়ার পর তারা চানুকে নিয়ে সেই সমস্ত টাকাকড়ি সব দেখিয়ে দিল-চানুই যে এখন তাদের সর্দার, তাকে সব না দেখালে চলবে কেন। দলের সর্দার হবার প্রায় এক সপ্তাহ পরে চোরেরা একদিন চানুকে বাড়ির জিম্মায় রেখে চুরি করতে গেল। খালি বাড়ি, চানু সেই শয়তান বুড়িকে জিজ্ঞাসা করল, ‘আচ্ছা, তুমি যে এদের ঘর সংসার দেখ, এরা তোমাকে তার দরুণ কিছু বকশিশ-টকশিশ দেয় না? বুড়ি। ‘বকশিশ দেয়, না ওদের মাথা দেয়!’ চানু! ‘বটে, কিছু দেয় না! আচ্ছা এসো আমার সঙ্গে, আমি তোমাকে ঢের টাকা দেব।’ বুড়িকে সঙ্গে করে চানু টাকার ঘরে গেল। জন্মেও বুড়ি এত ধন কোনোদিন দেকে নি-মুখ হাঁ করে সেই রাশি রাশি টাকা মোহরের দিকে বুড়ি খানিকক্ষণ চেয়ে রইল। তারপর বুড়ির আহ্লাদ আর ধরি না। হাঁটু গেড়ে মাটিতে পড়ে দুই হাতে টাকাগুলো ঘাঁটতে লাগল। সময় বুঝে চানুও তার পকেট বোঝাই ত করলেই, তারপর একটা থলে মোহর দিয়ে ভর্তি করে চুপিচুপি ঘর থেকে বেরিয়ে এসে বাইরের দিক থেকে দরজায় চাবি লাগিয়ে দিল। বুড়ি সেই টাকার ঘরেই আটকা পড়ে রইল। বেরিয়ে এসেই চানু সুন্দর একটা পোশাক পরলে, তারপর সেই ছাগল, ভেড়া আর ষাঁড়টাকে নেয়ে একেবারে সেই কৃষকের বাড়ি গিয়ে উপস্থিত। কৃষক তার স্ত্রীকে নিয়ে বাড়ির দরজায়ই বসেছিল, তারপর সেই হারানো জন্তুগুলো কার বলতে পার কি? ‘এগুলো যে আমাদের, আপনি কোথায় পেলেন মশায়? ‘এই বনের ভিতর চরে বেড়াচ্ছিল। আচ্ছা, ছাগলটার গলায় একটা থলে ঝুলছে, তাতে দশটা মোহর রয়েছে-ওগুলিও কি তোমাদের? ‘না মশায়্‌ আমরা গরীব দুঃখী লোক, মোহর কোথা পাব? ‘আচ্ছা, মোহরগুলোও তোমরা নাও, আমার কিছু দরকার নেই। ‘মোহরগুলি নিয়ে দুই হাত তুলে কৃষক চানুকে আশীর্বাদ করল। সমস্ত দিন চলে চানু প্রায় সায় সময় তার বাড়িতে এসে উপস্থিত। বাড়ির ভিতরে গিয়ে দেখল, তার মা বাবা বসে আছে। চানু বলল, ‘ভগবান আপনাদের ভাল করুন, আজ রাতটা আপনাদের বাড়ি থাকতে পারি কি? ‘আপনার মত ভদ্রলোক কি এখানে থাকতে পারবেন? আমরা যে বড্ড গরিব।’ চানু আর চুপ থাকতে পারল না, ‘বাবা, তুমি কি তোমার ছেলেকেও চিনতে পারছ না?’ চানুর মা-বাবা খানিকক্ষণ অবাক হয়ে রইল, তারপর চানুকে বুকে জড়িয়ে ধরে বলল, ‘এমন সুন্দর পোশাক তুমি কোয়ায় পেলে বাবা?’ চানুঃ ‘পোশাক দেখেই অবাক হয়ে গেলে, তা হলে এই টাকাগুলো দেখে কি করবে?’ এই বলে চানু পকেট খালি করে সব মোহর টেবিলের উপর রাখল। এতগুলো মোহর দেখে চানুর বাবার বড্ড ভয় হল। চানু তখন সব কথা খুলে বলল। তার আশ্চর্য বুদ্ধির কথা শুনে চানুর মা-বাপের আনন্দ আর ধরে না। পরের দিন সকালে চানু বাবাকে বলল, ‘বাবা, যাও জমিদারবাড়ি। বলো গিয়ে, আমি তাঁর মেয়েকে বিয়ে করতে চাই।’ চানুর কথা শুনে তার বাবার চোখ বড় হয়ে গেল, ‘বলিস কিরে বেটা! তা হলে যে আমার পিছনে কুকুর লেলিয়ে দেবে।’ ‘না! তুমি বোলো যে আমি সর্দার চোর, আমার মত ঝানু চোর দুনিয়ায় নেই, জবরদস্ত ও ওস্তাদ চোরদের ফাঁকি দিয়ে লাখ টাকা রোজগার করে এনেছি। দেখো বাবা, যখন দেখবে জমিদারের মেয়েও সেখানে আছে, তখনই এ-সব কথা বোলো।’ ‘আচ্ছা, এত করে যখন বলছ, যাচ্ছি। কিন্তু কিছু হবে বলে মনে হয় না।’ প্রায় দুই ঘণ্টা পরে চানুর বাবা ফিরে এল। চানু বলল, ‘কি করে এলে, বাবা?’ ‘নেহাত মন্দ নয়। মেয়েটি যে বড় অনিচ্ছুক, তা ত মনে হল না। বোধ করি বাবাজি তুমি এর আগেও তার কাছে এ প্রস্তাবটি করেছ-না? যা হোক, জমিদার বললেন, আসছে রবিবারে তাঁরা বাকি একটি হাঁস ভেজে খাবেন। তুমি যদি কড়া থেকে হাঁসটা বে-মালুম চুরি করতে পার, তা হলে তিনি তোমার কথা ভেবে দেখবেন।’ ‘এ আর তেমন শক্ত কাজ কি? দেখা যাবে এখন।’ রবিবার দিন জমিদার এবং বাড়ির সকলে রান্নাঘরে রয়েছেন। হাঁস ভাজা হচ্ছে, এমন সময় রান্নাঘরের দরজা কুলে গেল। একটা অতি কুৎসিত বুড়ো ভিখারি, পিঠে তার একটা মস্তবড় থলে ঝুলছে, সে এসে রান্নাঘরের দরজায় উঁকি মেরে বলল, ‘জয় হোক বাবা! আপনাদের খেয়ে-দেয়ে কিছু থাকলে আমি বুড়ো ভিখারি কিছু খেতে পাব কি?’ জমিদারমশায় বললেন, ‘অবশ্যি পাবে। রান্নাঘরের দাওয়ায় একটু বোসো।’ জানালার পাশে একজন লোক বসেছিল। খানিক পরে সে চেঁচিয়ে উঠল, ‘আরে, মস্তবড় একটা খরগোশ ছুটে বাগানের দিকে যাচ্ছে-এটাকে মারলে হয় না?’ জমিদার ধমক দিয়ে বললেন, ‘খরগোশ মারবার ঢের সময় মিলবে, এখন চুপ করে বসে থাকো।’ খরগোশটা বাগানে গিয়ে ঢুকল। ভিখারি পোশাক- পরা চানু থলের থেকে আর-একটা খরগোশ ছেড়ে দিল। একটু পরেই চাকর আবার চেঁচিয়ে উঠল, ‘বাবু বাবু, খরগোশটা এখনো রয়েছে- এখনো চেষ্টা করলে মারা যায়।’ আবার জমিদার ধমক দিলেন, ‘চুপ করে থাকো বলছি।’ খানিক বাদে চানু আরো একটা খরগোশ থলে থেকে বের করে ছেড়ে দিল। চাকরও চেঁচিয়ে উঠল-আর যায় কোথা! একজন একজন করে সবকটি চাকর রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে খরগোশের পেছনে তাড়া করল, জমিদারমশায়ও বাদ পড়লেন না। খরগোশ তাড়িয়ে সকলে ফিরে এসে দেখে, ভিখারিও নেই, কড়ার মধ্যে হাঁসও নেই। জমিদারমশাই বললেন, ‘আচ্ছা ফাঁকিটা দিয়েছে চানু, সত্যি সত্যি আমাকে জব্দ করেছে।’ একটু পরেই চানুদের বাড়ি থেকে একজন চাকর এসে জমিদারমশায়কে বলল, ‘আজ্ঞে, আমার মনিব বলে পাঠিয়েছেন, আপনারা অনুগ্রহ করে আমাদের বাড়ি গিয়ে খাবেন।’ জমিদার বড় চমৎকার সাদাসিধে লোক ছিলেন, মনে একটুও অহংকার ছিল না। স্ত্রীকে ও মেয়েকে নিয়ে চানুদের বাড়ি গেলেন। চানুর চালাকির কথা বলে জমিদারমশায় হাসতে হাসতে পাঁজরে ব্যথা ধরিয়ে ফেললেন। মেয়েটি ত আগে থেকেই চানুকে পছন্দ করত, এখন তার পোশাক দেখে এবং তার আদব-কায়দা দেখে মনে মনে আরো খুশি হল। খাওয়া-দাওয়ার পর জমিদার বললেন, ‘চানু, শুধু হাঁস চুরি করেই আমার মেয়ে পাবে না।‌ কাল রাত্রে আমার আস্তাবল থেকে আমার ছয়টি ঘোড়া যদি চুরি করতে পার, তা হলে দেখা যাবে এখন। ছ’জন সহিস কিন্তু ছয়টি ঘোড়ার পিঠে চড়ে পাহারা দেবে মনে রেখো।’ চানু বললে ‘আচ্ছা, চেষ্টা করে দেখব এখন।’ সোমবার রাত্রে জমিদারের আস্তাবলে ছয়জন সহিস ছয়টি ঘোড়ার পিঠে বসে আছে। বেজায় ঠাণ্ডা, রক্ত যেন জমে যেতে চায়। তাই প্রত্যেকের জামার পকেটে একটি করে মদের বোতল, খানিক পরে পরে একটু করে মদ খেয়ে গা গরম করে নিচ্ছে। ঘুমিয়ে পড়লে চলবে না, তাই সকলে মিলে মহা গল্প জুড়ে দিল। চানুর জন্য আস্তাবলের দরজা খোলাই রেখেছিল। রাত যত বেশি হতে লাগল, ঠাণ্ডাটাও যেন বাড়তে লাগল। মদে আর শানায় না, গায়ে কাঁপুনি ধরে গেল। এমন সময় ঠকঠক করে কাঁপতে কাঁপতে একটা কদাকার বুড়ি এরে উকি মেরে বলল, ‘বাবা সকল, শীতে জমে গেলাম, একমুঠো খড় দাও ত, আস্তাবলের এককোণে রাতটা পড়ে থাকি। তা না হলে বুড়ো মানুষ-শীতে মরেই যাব। ‘বুড়ির পিঠে ছয়টা থলে, মুখে প্রায় দু আঙ্গুল লম্বা দাড়ি-চেহারাটি কুৎসিতের একশেষ! বুড়ি আস্তাবলের দরজার উঁকি মেরে বলল, ‘লক্ষ্মী বাপ আমার, বুড়ো মানুষ শীতে মরে গেলাম, ঐ কোণটাতে একটু জায়গা দাও, একমুঠো খড়া নিয়ে পড়ে থাকব এখন।’ সহিসরা ভাবল, ‘এলই বা বুড়ি, বেচারি শীতে জমাট বেঁধে গেল, ও ত আর কোনো অনিষ্ট করবে না।’ আস্তাবলের কোণে খড় পেতে বুড়ি বেশ আরামে বসল। সহিসরা দেখল, বুড়ি খানিক পরিই একটা কালো বোতল বের করে একটু মদ খেল। তার মুখে আর হাসি ধরে না, যেন সে খুবই আরাম বোধ করেছে। সহিসদের বুড়ি বলল, ‘বাবা, তোমাদের সব বোধ করি শেষ করে ফেলেছ, তা আমার কাছে ঢের আছে। তরে কিনা তোমরা পাছে কিছু মনে কর, তাই তোমাদের দিতে ভরসা পাচ্ছি না।’ এতে বেজায় শীত, তার উপরে সত্যি সত্যি তাদের মদ শেষ হয়ে গেছে, বুড়ির কথা শুনে সহিসরা যেন হাতে চাঁদ পেল-’ সে কি বুড়িমা, তুমি দাও তা হলে ত বেঁছে যাই। ঠাণ্ডায় মরে গেলাম। বুড়ির বোতলটি দেখতে দেখতে শেষ হয়ে গেল, তবুও সহিসদের শীত গেল না।‌ শয়তান বুড়ি তখন আর একটি বোতল বের করে তাদের দিল। এ বোতলটার মদের সঙ্গে কি মেশানো ছিল, খাবা মাত্র সত কটা সহিস ঘোড়ার পিঠে গদির উপরে বসেই নাক ডাকিয়ে ঘুম দিল। তখন বুড়ি উঠে সব কটা সহিসকে খড়ের উপর শুইয়ে ঘোড়াগুলোর পায়ে মোজা পরিয়ে দিল। তারপর সবগুলিকে নিয়ে একেবারে চানুদের বাইরের একটা ঘরে গিয়ে হাজির। পরের দিন সকালে ঘুম থেকে উঠে জমিদারমশায় প্রথমেই কি দেখলেন? তাঁর বাড়ির সামনের রাস্তা দিয়েই চানু ঘোড়ায় চড়ে যাচ্ছে, আর তার ঘোড়ার পিছনে পিছনে অপর পাঁচটা ঘোড়াও চলেছে। জমিদারমশায় অবাক হয়ে রইলেন। মনে মনে বললেন, ‘গোল্লায় যা তুই চানু, আর যাদের চোখে ধুলো দিয়েছিস সে বেচারারাও গোল্লায় যাক।’ আস্তাবলে গিয়ে সহিস বেটাদের জাগতে জমিদারমশায়কে বেগ পেতে হয়েছিল। সকালবেলা জমিদারমশায় খেতে বসেছেন, চানুকেও ডেকে এনেছেন, খেতে খেতে চানুকে বললেন, ‘কতগুলো বোকা পাঁঠার চোখে ধুলো দিয়েছ্‌ এতে তেমন বাহাদুরি নেই। আচ্ছা, আজ বেলা একটা থেকে তিনটে পর্যন্ত আমি ঘোড়ায় চড়ে বাড়ির সামনে ঘুরে বেড়াব। নিও দেখি বাপু আমার ঘোড়াটা চুরি করে! তা হলে বুঝব তুমি বাহাদুর এবং আমার জামাই হবার উপযুক্ত।’ চানু মাথা নিচু করে উত্তর করল, ‘যে আজ্ঞে, একবার চেষ্টা করে দেখব এখন।’ একটার পর থেকে জমিদার ঘোড়ায় চড়ে পাইচারি করে একেবারে কাহিল হয়ে পড়লেন। তিনটে বেজে গেল, চানুর টিকিটিও দেখতে পেলেন না্‌ মনে করলেন এবারে বাড়ি ফিরে যাবেন, এমন সময় তাঁর একটা চাকর পাগলের মত ঊর্ধ্বশ্বাসে ছুটে এসে হাজির-‘কর্তা শিগগির বাড়ি যান, মা ঠাকরুনকে বুঝি বা আর দেখতে পেলেন না। সিঁড়ির উপর থেকে তিনি পড়ে গেছেন। বোধ করি হাত-পা সব ভেঙে গেছে, তিনি অজ্ঞান হয়ে পড়ে আছেন। আমি চললাম ডাক্তারের বাড়ি।’ জমিদারের হোঁচট খেতে খেতে বাড়ি এসে উপস্থিত। এসে দেখলেন, সাড়া শব্দ কিছু নেই, সব চুপচাপ। ব্যস্ত সমস্ত হয়ে বাড়ির ভেতরে গেলেন, সেখানে বসবার ঘরে গিন্নি আর মেয়ে দিব্যি আরাম করে বসে আছেন। ততক্ষণে জমিদারমশায়ের চৈতন্য হল। তিনি বুঝতে পারলেন, এ-সব চানু বেটারই চালাকি-বেটা তাঁকে আচ্ছা ঘোল খাইয়েছে। খানিক পরেই দেখলেন, চানু তাঁর ঘোড়ায় চড়ে বাড়ির সামনে দিয়ে যাচ্ছে। সেই চাকর বেটার কিন্তু আর কোন উদ্দেশ পাওয়া গেল না। চাকর তার জন্য একটুও কেয়ার করে না, নাইবা করল তার চাকরি-চানু যে তাকে দশটা মোহর দিয়েছিল, তা দিয়ে তার অনেক দিন চলবে। পরের দিন চানু এসে জমিদার বাড়ি উপস্থিত। জমিদার বললেন, ‘তুমি বাপু এবারে নেহাত ফাঁকি দিয়েছ, ওতে তোমার উপার আমার বড্ড রাগ হয়েছে। যা হোক আজ রাত্তিরে যদি আমাদের বিছানার থেকে চাদরখানা চুরি করতে পার, তা হলে কালকেই বিয়ের আয়োজন করব।’ চানু বলল, ‘আজ্ঞে আচ্ছা, একবার চেষ্টা করে দেখব। কিন্তু এবারেও যদি ফাঁকি দেন তা হলে কিন্তু আপনার মেয়েকেই চুরি করি নিয়ে যাব।’ রাত্রে জমিদার আর তাঁর গিন্নি শুয়েছেন। দিব্যি জ্যোৎস্না। কাঁচের জানালার ভিতর দিয়ে চাঁদের আলো এসে ঘরে পড়েছে। জমিদারমশাই দেখলেন, হঠাৎ যেন একটা মাথা জানালা দিয়ে উঁকি মেরে দেখতে যাচ্ছিল, তাঁদের দেখতে পেয়েই আবার সরে পড়ল। জমিদার গিন্নিকে বললেন-‘দেখলে ত? এ বেটা নিশ্চয় চানু।’ তারপর বন্দুকটা হাতে করে নিয়ে বললেন, ‘দেখো, আমি বেটাকে এখনি চমকে দিচ্ছি।’ বন্দুক দেখেই জমিদার গিন্নি ব্যস্ত হয়ে বললেন, ‘কর কি, চানুকে গুলি করবে না কি? জমিদার বললেন, ‘আরে না, তুমি কি পাগল হলে নাকি? বন্দুকে কি আর গুলি পুরেছি-শুধু বারুদ।’ খানিক পরেই আবার জানালায় মাথা উঁকি মারল, দড়াম করে জমিদার বন্দুক ছুঁড়ে দিলেন-সঙ্গে সঙ্গে শুনতে পেলেন, ধপ করে কি নীচে পড়ে মাটিতে গড়াগড়ি দিতে লেগেছে। জমিদার গিন্নি চেঁচিঁয়ে উঠলেন, ‘হায় ভগবান, বেচারি বোধ করি মরে গেছে, আর নাহয় জন্মের মত খোঁড়া কানা হয়ে থাকবে।’ জমিদার মশায় কেমন জানি থতমত খেয়ে গেয়ে ঊর্ধ্বশ্বাসে ছুটলেন- দরজা খোলাই পড়ে রইল। জমিদার মশায় বোধ করি তখনো বাইরের জানালার কাছে পৌঁছান নি, কিন্তু গিন্নিঠাকরুণ শুনলেন, কর্তা ফিরে এরে দরজার কাছে দাঁড়িয়ে বলছেন, ‘শিগগির বিছানার চাদরখানা দাও। বেটা মরেনি বোধ হয়, কিন্তু বেজায় রক্ত পড়ছে-একটু পরিস্কার করে বেঁধে টেঁধে ওকে নিয়ে আসব।’ গিন্নিঠাকরুন একটানে চাদরখানা বিছানা থেকে তুলে দরজায় ছুঁড়ে দিলেন। চাদর নিয়ে জমিদারমশায় আবার ছুটলেন। কিন্তু কি আর্শ্চয, সেই মুহূর্তেই তিনি ফিরে এসে ঘরে উপস্থিত-সে সময়ের মধ্যে বাগানে জানালার কাছে গিয়ে ফিরে আসা একেবারে অসম্ভব। ঘরে ঢুকেই জমিদার রেগে মেগে বলতে লাগলেন-‘বেটা পাজি চানু, তোকে ফাঁসি দেওয়া দরকার।’ কর্তার কথা শুনে গিন্নি অবাক হয়ে বললেন-বেচারির বেজায় লেগেছে আর তুমি কিনা তাকে গালাগালি দিচ্ছ! ‘ওর বাস্তবিক লাগাটাই উচিত ছিল। বেটার বদমাইশি দেখেছ? খড় দিয়ে একটা মানুষ বানিয়ে সেটাকে কাপড়-চোপড় পরিয়ে এনে জানালায় ধরেছিল।’ ‘কী ছাই মাথা মুণ্ডু বলছ, আমি বুঝতেই পারছি না। খড়ের মানুষ হলে তার রক্ত মুছবার জন্য আবার বিছানার চাদর চেয়ে নিয়ে গেলে কেন? ‘বিছানার চাদর-বলছ কি! আমি ত বিছানার চাদর-টাদর চাইতে আসি নি।’ ‘চাদর চাইতে আস আর না আস, আমি সে-সব কিছু জানি না। তুমি এস দরজায় দাঁড়িয়ে চাদর চাইলে, আর আমিও তোমাকে দিয়েছি।’ গিন্নির কথা শুনে জমিদার মশায় মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়লেন-‘কি ভীষণ শয়তান রে বাবা চানু্‌ ওর সঙ্গে আর পেরে উঠব না। কাল সকালেই বিয়ের বন্দোবস্ত করতে হবে দেখছে।’ এরপর চানুর সঙ্গে জমিদার মশায় কন্যার বিয়ে হয়ে গেল বিয়ের পর চানু খুব ভাল হয়ে গেল। তার মত জামাই সচরাচর মেলে না। জমিদার মশায় এবং তাঁর গিন্নি শতমুখে চানুর সুখ্যাতি করেন আর লোকের কাছে বলেন- ‘আমার ঝানু চোর চানু।’
উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী
ঠাকুরদা উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী একগ্রামে এক বুড়ো ব্রাহ্মণ ছিলেন। তাঁর নাম ছিল ভবানীচরণ ভট্রাচার্য। গ্রামের ছেলেদের সঙ্গে তাঁর খুব ভাব ছিল। তাঁরা তাঁকে বলত ঠাকুরদাদা। তাদের কাছ থেকে শিখে দেশসুদ্ধ লোকেও তাঁকে ঐ নামেই ডাকত। ছেলেরা ঠাকুরদার কাছে খুবই আদর পেত, আর তাঁকে জ্বালাতন করত তার চেয়েও বেশি। ঠাকুরদা ভারি পণ্ডি আর বুদ্ধিমান ছিলেন। খালি এক বিষয়ে তাঁর একটা পাগলামি ছিল। পেয়াদার নাম শুনলেই তিনি ভয়ে কেঁপে অস্থির হতেন। ছেলেরা সে কথা খুবই জানত আর তা নিয়ে ভারি মজা করত। ঠাকুরদা রোজ তাঁর চণ্ডীমণ্ডপের সামনে বসে পুঁথি লিখতেন। সেই সময়ে মাঝে মাঝে পাড়ার এক-একটা দুষ্ট ছেলে দাড়ি পরে, লাল পাগড়ি এঁটে, মালকোচ্চা মেরে লাঠি হাতে এসে ঘরের আড়াল থেকে গলা ভার করে বলত, ‘ভওয়ানী ভটচাজ কোন হ্যায়?’ ঠাকুরদা তাতে বিষম থতমত খেয়ে ঘাড় ফিরিয়েই যদি লাল পাগড়ির খানিকটা দেখতে পেতেন, তবে আর সে পাগড়ি কার মাথায় সে কথার খবর নেবার অবসর তাঁর থাকত না। তিনি অমনি এক দৌড়ে বাড়ির ভিতর গিয়া একেবারে দিদিমার কাছে হাজির হতেন। ছেলেরা বলে যে, তখন নাকি প্রায়ই ঠাকুরদাকে স্নান করতে হত। কিন্তু সে বোধ হয় তাদের দুষ্টুমি। যা হোক, এমন বিষম ভয়ের কাণ্ডটা যে ছেলেদের কাজ, এ কথা মুহুর্তের তরেও ঠাকুরদার মাথায় আসত না। তিনি ছেলেগুলিকে বাস্তবিকই খুব ভালবাসতেন। তাঁর কুলগাছটিতে কুল পাকলে তাদের সকলকে ডেকে ডেকে একটি-একটি করে কুল প্রত্যেকের হাতে দিতেন, কাউকে বঞ্চিত করতেন না- একটি বেশিও কখন কাউকে দিতেন না। সেই পরগণার ভিতরে এমন মিষ্টি কুল আর কোথাও ছিল না। কাজেই, একটি খেয়ে ছেলেদের যেমন ভাল লাগত, আর খেতে না পেলে তাদের অমনি কষ্ট হত। তবুও এমন কথা শোনা যায় নি যে, ঠাকুরদার দেওয়া ছাড়া আর-একটি কুল কেউ কখনো তাঁর গাছ থেকে খেতে পেরেছে। তাঁর চণ্ডীমণ্ডপ থেকে সেই কুল গাছটি পরিস্কার দেখা যেত। সেদিকে কাউকে যেতে দেখলেই তিনি ‘কে-রে-এ বলে এমন বিষম হাঁক দিতেন যে কি বলব! তখন আর হাত-পা সামলে ছুট দেবারও উপায় থাকত না। দু মাইল দুরে থেক লোকে বলত, ‘ঐ রে! ঠাকুরদা তাঁর কুল আগলাচ্ছেন।’ খালি একবার ছেলেরা ঠাকুরদার কাছ থেকে একপোয়া সন্দেশ আদায় করেছিল। ঠাকুরদা চন্ডীমণ্ডপের সামনে বসে একমনে পুঁথি লিখছিলেন। তিনি দেখতে পান নি যে, এর মধ্যে ও পাড়ার বোসেদের বানরটা কেমন করে ছুটে এসে সেখানে উপস্থিত হয়েছে, আর তার পঁয়ত্রিশ বছরের পুরনো বাঁধানো হুঁকোটি নিয়ে গাছে উঠেছে। তারপর তামাক খেতে গিয়ে দেখেন, কি সর্বনাশ! বানরটিকে তিনি কত ঢিল ছুঁড়ে মারলেন, কত লম্বা লম্বা সংস্কৃত বকুনি বকলেন, কিছুতে তার কাছ থেকে হুঁকোটি আদায় করতে পারলেন না। লাভের মধ্যে সে বেটা তাঁকে গোটাদশেক ভেংচি মেরে হুঁকোসুদ্ধ পাশের বাড়ির আমবাগানে চলে গেল। সেদিন ছেলেরা না থাকলে ঠাকুরদার আবার তাঁর হুঁকোর মুখ দেখবার কোন আশাই ছিল না। তিনি তাদের সন্দেশ কবুল করে অনেক কষ্টে তাদের দিয়ে বানরের হাত থেকে হুঁকোটি আদায় করালেন। তার পরদিনই নিজে গিয়ে বেচু ময়রার দোকান থেকে তাদের জন্যে এক পোয়া সন্দেশ কিনে আনলেন। সে সন্দেশ খেয়ে নাকি তারা মুখ সিটকিয়েছিল। ঠাকুরদা তার কারণ জিজ্ঞাসা করতে তারা বলল, ‘সন্দেশটা বড্ড মিষ্টি।’ ঠাকুরদা তখন খুব গম্ভীরভাবে মাথা নেড়ে বললেন, ‘তাই ত, আমি জানতুম না যে তোমরা তেতো সন্দেশ খাও। আমি মিষ্টি সন্দেশই কিনে এনেছি।’ পরসা খরচ নিয়ে কিন্তু ঠাকুরদার একটু বদনাম ছিল। ঐ যে হুঁকোর খাতিরে ছেলেদের একপোয়া সন্দেশ কিনে খাইয়েছিলেন, তা ছাড়া আর তাঁর জীবনে তিনি কখনো কাউকে কিছু কিনে খাওয়ান নি। লোকে বলত, তাঁর ঘরের ভিতরে তিন-জালা টাকা পোঁতা আছে। কিন্তু নিজে তিনি এমনভাবে চলতেন যেন অনেক কষ্টে তাঁর দুটি খাবার জোটে, সেও বুঝি-বা একবেলা বই দুবেলা নয়। একদিন দিদিমা ডাল রাঁধতে গিয়ে তাতে একটু বেশী ঘি দিয়ে ফেলেছিলেন। সেই অপরাধে নাকি ঠাকুরদা দুমাস তাঁর সঙ্গে কথা কন নি। ছেলেরা তাঁর সেই সন্দেশ খেয়ে অবধি তাঁর উপর কম চটে ছিল না। না চটবেই বা কেন? সেই হতভাগা বানরটার কাছ থেকে হুঁকো আদায় করতে গিয়ে কি তারা কম নাকাল হয়েছিল? কুড়ি জন মিলে তিনটি ঘন্টা ধরে তারা সেদিন কত গাছই বেয়েছে, কত ছুটোছুটি করেছে, কত কাদাই লাগিয়েছে, কত বিছুটির ছ্যাঁকাই খেয়েছে। তার পুরস্কার কিনা অমনিতর একপোয়া সন্দেশ! তখন ছিল পুজোর সময়। কুমোরদের বাড়িতে অনেক ঠাকুর গড়া হচ্ছিল, তার তামাশা দেখবার জন্যে সকালে বিকালে ছেলেদের প্রায় সকলেই সেখানে যেত। সেইখানে তাদের একটা মস্ত মিটিং হল। ঠাকুরদাকে জব্দ করতে হবে। তিনি যেমন সন্দেশ খাইয়েছেন, তাঁকে দিয়ে কিছু বেশী হাতে টাকা খরচ করাতে পারলে তবে তার দুঃখটা মেটে। কিন্ত এমন লোকের পয়সা ত সহজে খরচ করানো যেতে পারে না, তার কি উপায় হতে পারে। কতজনে কত কথা বলতে লাগল, কেউ বলল, ‘চল ঠাকুরদার কুলগাছ কেটে ফেলি।’ কেউ বলল, ‘তার হুঁকো লুকিয়ে রাখি।’ কিন্তু এ-সব কথা কারুর পছন্দ হল না। এমন কুলগাছটা কাটলে ভারি অন্যায় হবে। হুঁকো লুকিয়ে রাখলেও শেষটা তাঁকে ফিরিয়ে না দিলে চলবে না। তা ছাড়া, এ-সব করলে তাঁকে আর টাকা খরচ করানো হল কই? ঠাকুরদাকে ছেলেরা আসলে ভালবাসত, নাহক তাঁর লোকসান করাতে কারো ইচ্ছা ছিল না। কাজেই এ-সব কথায় সকলের অমত হল। এমন ভাবে তাঁকে দিয়ে টাকা খরচ করাতে হবে যে সেটা তাঁর ক্ষতির মধ্যে ধরা না যেতে পারে। ছেলেরা দেখল, কাজটি তেমন সোজা নয়। বুড়ো কুমোর এর মধ্যে এসে বুদ্ধি জুগিয়ে না দিলে তাদের পক্ষে এর একটা মতলব ঠিক করাই ভার হত। বুড়ো যে যুক্তি বলল, সে ভারি চমৎকার। ছেলেরা তার কথায় যার পর নাই খুশি হয়ে ঘরে চলে গেল। ঠিক হল, পরদিনই সেই কাজটি করতে হবে। রাত থাকতেই ঠাকুরদার ঘুম ভাঙ্গে, তখন তিনি শুয়ে শুয়ে সুর ধরে শোলোক আওড়ান। তারপর ভোর হবার একটু আগে উঠে, স্নান তর্পণ সেরে, শেষে গিয়ে চণ্ডীমণ্ডপের সামনে বসেন। সেদিনও দোয়েল ডাকবার আগেই তিনি জেগে সবে বলেছেন, ‘ব্রহ্মামুরারিস্ত্রিপুরান্তকারী’-অমনি বাইরে কে যেন ডাকল, ‘ভওয়ানী ভট্‌চাজ ঘরমে হ্যায়?’ আর ঠাকুরদা শোলোক আওড়ানো হল না। স্নান আহ্নিক আজ তিনি খিড়কির পুকুরেই সারলেন। চণ্ডীমণ্ডপের সামনে বসে পুঁথি লেখার কাজটিও আজ বন্ধ রইল-তার চেয়ে দিদিমার রান্নাবান্নার খবর নেওয়াই বেশি দরকার মনে হয়েছে। এমনি ভাবে দুপুর অবধি কেটে গেল। এরপর যখন আর কেউ ‘ভওয়ানী ভটচাজ’ বলে ডাকল না, তখন ঠাকুরদা সাহস পেয়ে ভাবলেন, একটু বাইরে গিয়ে দেখে আসি না কেন! এই বলে আস্তে আস্তে বাইরে এসে ঠাকুরদা দেখলেন-কি সর্বনাশ! কি চমৎকার! তার মণ্ডপের মাঝখানে দূর্গা প্রতিমা ঘর আলো করে বসে আছেন। ঠাকুরদার আর পা সরল না। তিনি সেইখানেই মাথায় হাত দিয়ে বসে ভাবলেন-হায়, হায়! কোন্‌ শয়তান এমন কাজ করল! এই প্রতিমা আমার ঘরে রেখে গেছে, এখন একে পূজো না করলে মহাপাপ হবে। আর পূজো করতে গেলেও যে তিনশোটি টাকা’র কম লাগবে না। বাবা গো, আমি কোথায় যাব! যা হোক, ঠাকুরদা কৃপণ হলেও অতি ধার্মিক আর পণ্ডিত লোক ছিলেন। তিনি তখনই ভাবলেন-আর দুঃখ করে কি হবে? ঘরে টাকা রেখেও আমি সেবায় হেলা করেছিলাম, তাই দেবতা আমাকে শিক্ষা দিয়েছেন। ভালোই হল, এখন থেকে আমি ফি-বছর দুর্গোৎসব করব। ততক্ষণে ছেলেদের দুটি একটি করে প্রাণপণে হাসি চাপতে চাপতে এসে উপস্থিত হয়েছে। কাজটি ত তাদেরই, তারাই ঠাকুরদাকে পেয়াদার ভয় দেখিয়ে বাড়ির ভিতর পাঠিয়ে সেই অবসরে প্রতিমাটিকে এনে মণ্ডপের ভিতরে রেখে গেছে। তাদের মুখের দিকে চেয়ে ঠাকুরদারও আর সে কথা বুঝিতে বাকি রইল না। তখন তিনি বললেন, ‘ভালই করেছ দাদা, বুড়ো পাপীর সুমতি জন্মিয়ে দিয়েছ। তোমরা বেঁচে থাকো। আমি খালি ভাবছি-এত বড় ব্যাপার, আমার লোকজন কিছু নেই, আমি কুলোব কি করে?’ ছেলেরা ভেবেছিল, ঠাকুরদা লাঠি নিয়ে তাদের তাড়া করবেন। তার বদলে তিনি এমন কথা বলবেন, তা তারা মোটেই ভাবে নি। তারা তাতে ভারি খুশি হয়ে বলল, ‘তার জন্য চিন্তা কি, ঠাকুরদার? আমরা সব ঠিক করে দিচ্ছি। আপনি শুধু বসে বসে হুকুম দিন।’ অমনি ঠাকুরদার মুখ ভরে হাসি ফুটে উঠল, তাঁর চোখ দুটি বুজে এল। ছেলেদের মাথায় হাত বুলিয়ে, গাল টিপে আর নাকে চিমটি কেটে তিনি তাদের বিদায় করলেন। এবারে ঠাকুরদা যে সন্দেশ এনেছিলেন, তা খেয়ে আর কারো নাক সিটকাতে হয় নি।
উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী
ঠানদিদির বিক্রম উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী আমাদের এক ঠানদিদি ছিলেন। অবশ্য ঠাকুরদাদাও ছিলেন, নইলে ঠানদিদি এলেন কোত্থেকে? তবে ঠাকুরদাদাকে পাড়ার ছেলেরা ভালরকম জানত না। ঠাকুরদাদার নাম রামকানাই রায়; লোকে তাঁকে কানাই রায় বলে ডাকত, কেউ কেউ রায়মশায়ও বলত। ঠাকুরদাদাকে যে ছেলেরা জানত না, তার একটু নমুনা দিচ্ছি। ঠানদিদির বাড়িতে এক-ঝাড় তল্‌তা বাঁশ ছিল, ঐ বাঁশে ভাল মাছ ধরবার ছিপ হত। একবার কয়েকটি ছেলে ছিপ তৈরী করবে বলে চুপিচুপি একটা বাঁশ কেটে রাস্তায় টেনে এনেছে, অমনি দেখে-রায়মশায় সম্মুখে। তাহারা অমনি হাত জোড় করে বললে, ‘আপনার পায়ে পড়ি, ঠানদিদিকে বলবেন না!’ তিনি ত শুনে অবাক!-আরে বলিস কি? আমার বাঁশ নিয়ে পালাচ্ছিস, আর বলছিস “বলবেন না”!’ ছেলেগুলি সকলে মিলে কেবলইত বলতে লাগল, ‘আপনার পায়ে পড়ি, ঠানদিদিকে বলবেন না।’ তখন রায়মশায় বেগতিক দেখে বললেন, ‘তোরা বাঁশ দিয়ে কি করবি?’ আজ্ঞে, ছিপ করব।’ ‘আচ্ছা, নিয়ে যা।’ তখন আবার ‘দেখবেন, ঠানদিদিকে যেন বলবেন না’ বলে ছেলেগুলো বাঁশ নিয়ে ছুট। এখন বোধ করি তোমরা বুঝতে পারছ, রায়মশাই যে ঠাকুরদাদা, তো অনেক ছেলেই জানত না। ছেলেরা জানত-ঠানদিদির বাড়ি, ঠানদিদির বাঁশঝাড়, ঠানদিদির কাঁঠালগাছ, বিশেষ ভাবে ঠানদিদির কুলগাছ আর পেয়ারাগাছ। ঠানদিদির পুত্রসন্তান নেই, কেবল তিনটি মেয়ে। বড় মেয়ে দুটির বিবাহ হয়ে গিয়েছে, ছোটটির বয়স ন-দশ বৎসর। ঠানদিদির বয়স চল্লিশের উপর। বাড়িতে অন্য লোকজন নেই, কিন্তু হলেও, ঠাকুরদাদা বিদেশ গেলে ঠানদিদির চৌকিদার বা ঘরে শোবার জন্য বুড়া স্ত্রীলোকের দরকার হয় না। ঠানদিদি অনায়াসে একাই থাকেন। একবার ঠাকুরদাদা বিদেশ গিয়াছেন। ঠানদিদি কেবল ছোট মেয়েটিকে নিয়ে বাড়িতে আছেন, সেই সময়ে একদিন দুপুর রাত্রে মেয়েটি বলল, মা! কে যেন আমার গায়ে হাত দিল!’ ঠানদিদি বললেন, ‘চুপ কর, কথা বলিস না।’ ঠানদিদি পূর্বেই টের পেয়েছেন, ঘরে চোর ঢুকেছে। তারপর চোর যেই বাক্স পেটরার সন্ধানে ঘরের অন্য দিকে গিয়েছে, অমনি ঠানদিদি আস্তে আস্তে উঠে, বাটনাবাটা শিলখানা এনে সিঁদের মুখে চাপা দিলেন। তোমরা শহরের ছেলেরা বোধ করি বুঝতে পারলে না, সিঁদ কি। পাড়াগাঁয়ে অনেক মেটে ঘর। ঐ-সব মেটে ঘরের সিঁদকাঠি খুঁড়ে চোর ঘরের ভিতরে ঢুকে চুরি করে। এইবার আরো মুশকিল হল, সিঁদকাঠি কি? সিঁদকাঠি যে কি, তা আমিও কখনো চোখে দেখিনি। সম্ভবত ওটা খন্তা বা সাবলের মত লোহার কোন অস্ত্র হবে। এই সিঁদকাঠি তৈরী সম্বন্ধে পাড়াগাঁয়ে একটা কথা আছে, ‘চোর কামারে কখনো দেখা হয় না।’ সিঁদকাঠি যখন লোহার অস্ত্র, তখন অবশ্যই ওটা কামারে গড়ে। কিন্তু চোর কি কামারের বাড়ি গিয়ে বলে, ‘কর্মকার ভায়া, আমাকে একটা সিঁদকাঠি তৈরি করে দাও!’ নিশ্চয়ই না। তা হলে ত সেইখানেই সে চোর বলে ধরা দিল। কামার ভায়া চোরের নিতান্ত বন্ধু হলেও সময় মত অন্য দু-দশজন বন্ধুর কাছে সে গল্পটা করবেই। দরকার হলে পুলিশের কাছেও বলতে পারে। তবে চোর কি করে সিঁদকাঠি গড়ায়? আমরা ছেলে বেলায় শুনতাম, চোরের সিঁদকাঠির দরকার হলে, চোর একখানি লোহা আর একটি আধুলি রাত্রে কামারশালের এমন জায়গায় রেখে যায় যে কামার সকালে কামারশাল খুলবার সময়েই সেটা তার নজরে পড়ে। কামার অন্য কাজ বন্ধ রেখে, সকলের অসাক্ষাতে সিঁদকাঠিটি তৈরি করে। কামারশাল বন্ধ করবার সময়, ঠিক সেই জায়গায় সেটি রেখে দেয়। রাত্রে চোর এসে সেটি নিয়ে যায়। এখন আসল কথা শোনো। ঠানদিদি সিঁদের মুখে শিলটি চাপা দিয়ে তার পাশে চুপ করে বসে আছেন। তারপর চোর নাকী সুরে বলল, ‘মা ঠাকরুন, ছেড়ে দিন! ‘ ঠানদিদি বললেন, ‘বল্‌ বেটা তুই কে? নইলে এখনি পাড়ার লোক ডেকে তোকে শ্বশুরবাড়ি পাঠাবার ব্যবস্থা করব।’ চোর দেখল নাম না বললে আর নিস্কৃতি নেই, কাজেই বলল, ‘মা ঠাকরুন, আমি শীতল!’ তা শুনে ঠানদিদি বললেন, ‘হতভাগা! মরতে আর জায়গা পাও নি? যাও! ঐ বাইরে কলসী আছে-পুকুরে গিয়ে জল আনো, তারপর কাদা করে সিঁদ বোজাও। ঐ গোয়ালে গোবর আছে, গোবর দিয়ে ভিতর-বার ভাল করে নিকিয়ে দিয়ে যাও। আমি সকালে উঠে এ সব হাঙ্গামা কত্তে পারব না।’ শীতল তখন কলসীটি নিয়ে আস্তে আস্তে পুকুর ঘাটে গেল। তখন ফাল্‌গুন মাস, পাড়াগাঁয়ে বেশ শীত। সেই শীতে পুকুর থেকে জল এনে, কাদা করে, সিঁদ বুজিয়ে, ভাল করে নিকিয়ে তবে শীতল ছুটি পায়। তোমরা চালাক ছেলেরা ভাবছ, চোরটা কি বোকা, কলসী নিয়ে অমনি পালাল না কেন? শীতল কলসী নিয়ে পালালে তার কি দশা হত, তা আর একদিন তোমাদের বলব।
উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী
তারপর? উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী এক যে রাজা; তার ভারি গল্প শোনার শখ। কিন্তু তা থাকলে কি হয়, রাজামশাইকে কেউ গল্প শুনিয়ে খুশি করতে পারে না। রাজামশাই বলরেন, ‘যে আমাকে গল্প গুনিয়ে খুশি করতে পারবে, তাকে আমার অর্ধেক রাজ্য দিব, না পারলে কান কেটে নিব’। তা শুনে দেশ বিদেশের কত ভারি ভারি নামজাদা গল্পওয়ালা কোমর বেঁধে গোঁফে তা দিয়ে গল্পের ঝুড়ি নিয়ে আসে কিন্তু কেই রাজামশাইকে খুশি করতে পারে না। যাবার সময় সকলেই কাটা কান নিয়ে দেশে যায়। গল্প বলতে গেলেই রাজামশাই খালি বলেন, ‘তারপর? ‘তারপর’ তারপর’ করে গল্পওয়ালার দফা শেষ করে তবে তিনি ছাড়েন। ‘রাক্ষস মরে গেল’-‘তারপর?’ ‘রাজপুত্র বেঁচে গেলেন’-‘তারপর? ‘বৌ নিয়ে দেশে এলেন’-তাপর?’-‘ভারি আনন্দ হল’-‘তারপর?’ ‘আমার কথা ফুরল।’ ‘তারপর? ‘নটে গাছটি মুড়ুল’-‘তারপর?’ এমনি করে আর কত বলবে? কাজেই শেষে একবার তাকে বলতে হয় ‘আর আমি জানি না’ ‘আর আমি জানি না’ বা ‘আর বলতে পারছি না।’ তা হলেই রাজা বলেন ‘তবে গল্প বলতে এসেছিলে কেন? কাট তবে বেটার কান।’ এই ত ব্যাপার। রাজামশাইয়ের তারপরের শেষও কেউ করে উঠতে পারে না, অর্ধেক রাজ্য পায় না, লাভে মধ্যে কানটি যায়। সেই দেশে থাকে এক নাপিত। সে বড্ড কুঁড়ে, কিন্তু ভারি সেয়ানা। সে ভাবল, অর্ধেক রাজ্য যদি পাই, তবে নেহাৎ মন্দ হবে না। একবার চেষ্টা করে দেখতে ক্ষতি কি? না হয় কান কাটা যাবে। এই বলেই সে জামা জোড়া পরে বলল, ‘মহারাজের জয় হোক। হুকুম হয় ত কিছু গল্প শোনাই।’ রাজা বলেলন, ‘ভাল, ভাল। কিন্তু আমার সর্ত জান ত, খুশি করতে পারলে অর্ধেক রাজ্য দিব, না পারলে কানটি কেটে নিব।’ নাপিত বলল, ‘আমার গল্পের আগাগোড়া শুনতে হবে, মাঝখানে থামতে বলতে পারবেন না।’ রাজা বললেন ‘তাই সই, আমি ও ত তাই চাই।’ তখন নাপিত চাকর মহলে দিয়ে আচ্ছা করে ছিলিম আট দশ তামাক টেনে এসে খুব গম্ভীর হয়ে বলতে লাগল-‘মহারাজ, এখান থেকে অনেক দূরে এক আজব দেশ আছে।’ অমনি মহারাজ বললেন, ‘তারপর?’ সেইখানে অনেকদিন আগে ভারি নামজাদা একা রাজা ছিলেন।-তারপর? তার রাজ্যের একধার থেকে আরেক ধার যেতে ছ’মাস লাগত।-তারপর? আর সে রাজ্যের মাটি যে কি সরেস ছিল, কি বলব?-তারপর? তাতে একসের ধান বুনলে, দশমন ধান পাওয়া যেত।-তারপর? তাই দেখে রাজামশাই তাঁর রাজ্যের সকল জমিতে ধানের চাষ করালেন।-তারপর? আর তাতে ধান যা হল। সে ধান রাখবার জন্য যে গোলা তয়ের হয়েছিল, তার একধারে দাঁড়ালে আর এক ধার দেখা যেত না।-তারপর? লাখে লাখে মোষের গাড়ি লেগেছিল সে ধান গোলায় আনতে। এত বড় গোলা একেবারে বোঝাই হয়ে গিয়েছিল, আর-একটু হলেই ফেটে যেত।-তারপর? তারপর সেই ধানের খবর পেয়ে পঙ্গপাল যা এল! পঙ্গাপালে দশদিক ছেয়ে গেল। আকাশ অকার, হওয়া চলবার জো নাই, শ্বাস টানলে ঝাঁকে ঝাঁকে পঙ্গপাল নাকে ঢোকে।-তারপর? তারপর? বেটারা এসেছে ধান খেতে। কিন্তু রাজামশায়ের গোলা কি যেমন তেমন করে গড়া? পঙ্গপালের সাধ্যি কি, তাতে ঢুকবে? দশদিন বেটারা বন্‌ বন্‌ করে গোলার চারধারে ঘুরে বেড়াল, বেড়ার কোনখানে একটা বিঁধ বার করতে পারল না। -তারপর? তারপর? তারপর এগার দিনের দিন কয়েকটা ডানপিটে ছোকরা পঙ্গপাল খুঁজে খুঁজে কোত্থকে গিয়ে একটা বিঁধ বার করেছে, অনেক ঠেলাঠেলি করলে তা দিয়ে ভিতরে ঢোকা যায়।-তারপর? তারপর? তখন তাদের পালের গোদাটা এসে সেইবিঁধের মুখে বসে বলল, ঠ্যাল্‌ ত রে বাপু-সকলে তোরা সবাই মিলে, দেখি, ভিতরে ঢুকতে পারি কি না।।-তারপর? তারপর,ওঃ সে কি বিষম ঠেলাঠেলি! গোদা বেটা চ্যাপ্টা হয়ে গেল, তবু বলল ‘ঠ্যাল, ঠ্যাল্‌।’-তারপর? শেষে অনেক কষ্টে, অর্ধেক ছাল বাইরে রেখে তবে গিয়ে ভিতরে ঢুকল-তারপর? ঢুকে একটি ধান মুখে করে নিয়ে, বিঁধের কাছে এসে বলল, এবারে আমাকে টেন বার কর।-তারপর? ওহ! সে কি টানাটানি! আর-একটু হলেই বেটা ছিঁড়ে যেত যা। যা হোক অনেক কষ্টে সে ধানটি নিয়ে বাইরে এল।-তারপর? তারপর আর-একটা বেটা গিয়ে বসেছে সে বিঁধের মুখে, আর তেমনি ঠেলাঠেলির পর ভিতরে ঢুকছে, আর একটি ধান নিয়ে তেমনি টানাটানির পর বাইরে এসেছে।-তারপর? তারপর আরেক বেটা।-তারপর? আরেক বেটা।-তারপর? আরেক বেটা। তারপর? আরেক বেটা।- রাজামশাই যতই বললেন, ‘তারপর? নাপিত ততই খালি বলে, আরেক বেটা। দণ্ডের পর দণ্ড এইভাবে গেল, রাজামশাই ব্যস্থ হয়ে উঠছেন। কিন্তু না শুনে উপায় নাই। বলেছেন আগা-গোড়া শুনবেন, থামিয়ে দিতে পারবেন না। সন্ধ্যার সময় রাজামশাই আর থাকতে না পেরে বললেন, ‘আরে, আর কত বলবে? এখানো কি শেষ হল না?’ নাপিত জোড়হাতে বলল, ‘সে কি মহারাজ? সবে ত আরম্ভ। গুটি কয়েক পঙ্গপাল সবে গুটি কয়েক ধান নিয়েছে। এখনো গোলা ধানে বোঝাই, আকাশ পঙ্গপালে অন্ধকার।’ কাজেই আর কি করা যায়? আরও দুদিন বসে পঙ্গপালের কথা শুনলেন। তারপর আর কিছুইতেই থাকতে না পেরে, কেঁদে বললেন, ‘আমার ঢের হয়েছে বাবা, অর্ধেক রাজ্য নেও, নিয়ে আমাকে ছেড়ে দাও, আমি একটু হাঁপ ছেড়ে বাঁচি।’ তখন নাপিতের খুব মজাই হল।
উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী
তিনটি বর উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী এক দেশে এক কামার ছিল, তার মত অভাগা আর কোনো দেশে কখনো জন্মায় নি। তাকে এক জিনিস গড়তে দিলে তার জায়গায় আর-এক জিনিস গড়ে রাখত। একটা কিছু সারাতে দিলে তাকে ভেঙে আরো খোঁড়া করে দিত। আর লোককে ফাঁকি যে দিত, সে কি বলব! কাজেই কেউ তাকে কোনো কাজ করতে দিতে চাইত না, তার দুবেলা দুটি ভাতও জুটত না। লাভের মধ্যে সে তার গিন্নীর তাড়া খেয়ে সারা হত। একদিন সে দোকানে বসে গালে হাত দিয়ে ভবছে। ভয়ানক শীত, গায়ে জড়াবার কিছু নেই। খিদেয় পেট জ্বলে যাচ্ছে, ঘরে খাবার নেই। এমন সময় কোত্থেকে এক লম্বা সাদা দাড়িওয়ালা বুড়ো লাঠি ভর করে কাঁপতে কাঁপতে এসে তার দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে বলল, ‘জয় হোক বাবা, দুঃখী বুড়োকে কিছু খেতে দাও।’ কামার বলল, ‘বাবা, খাবার যদি থাকত, তবে নিজেই দুটি খেয়ে বাঁচতুম। দুদিন পেটে কিছু পড়ি নি। ছেলেপুলে নিয়ে উপোস করছি-তোমাকে কোত্থেকে দেব? তুমি না হয় ঘরে এসে একটু গরম হয়ে যাও, আমি হাপর ঠেলে আগুনটা উসকিয়ে দিচ্ছি।’ বুড়ো তখন কাঁপতে কাঁপতে ঘরে এসে বলল, ‘আহা, বাঁচালে বাবা। শীতে জমে গিয়েছিলুম। তুমি দেখছি তবে আমার চেয়েও দুঃখী। আমার নিজে খেতে পেলেই চলে, তোমার আবার স্ত্রী আর ছেলেপুলেও আছে।’ এই বলে বুড়ো আগুনের কাছে এসে বসল, ‘কামার খুব করে হাপর ঠেলে আগুন উসকিয়ে তাকে গরম করে দিল। যাবার সময় বুড়ো তাকে বলল, ‘তমি আমাকে খেতে দিতে পার নি, তবু তোমার যতদূর সাধ্য তুমি করেছ। এখন তোমার যেমন ইচ্ছা তিনটি বর চাও, আমি নিশ্চয় দেব।’ এ কথায় কামার অনেকক্ষণ বুড়োর মুখের দিকে চেয়ে মাথা চুলকোতে লাগল, কিন্তু কি বর চাইতে হবে, বুঝতে পারল না। বুড়ো বলল, ‘শিগগির বলো। আমার বড্ড তাড়াতাড়ি-ঢের কাজ আছে।’ তখন কামার থতমত খেয়ে বলল, ‘আচ্ছা, তবে এই বর দিন যে, আমার এই হাতুড়িটি যে একবার হাতে করবে, সে আর আমার হুকুম ছাড়া সেটি রেখে দিতে পাবে না। আর যদি তা দিয়ে ঠুকতে আরম্ভ করে, তবে আমি থামতে না বললে আর থামতে পারবে না।’ বুড়ো বলল, ‘আচ্ছা, তাই হবে। আর কি বর চাই?’ কামার বলল, ‘আমার এই কেদারাখানিতে যে বসবে, সে আমর হুকুম ছাড়া তা থেকে উঠছে পারবে না।’ বুড়ো বলল, ‘আচ্ছা, তাও হবে। আর কি?’ কামার বলল, ‘আমার এই থলিটির ভিতরে আমি কোনো টাকা রাখলে আমি ছাড়া আর কেউ তাকে তা থেকে বার করতে পারবে না।’ সেই বুড়ো ছিলেন এক দেবতা। তিনি এই শেষ বরটিও সেই কামারকে দিয়ে ভয়ানক রেগে বললেন, ‘অভাগা, তুই ইচ্ছা করলে এই তিন বরে পরিবার সুদ্ধ স্বর্গে চলে যেতে পারতিস, তার মধ্যে তোর এই দুর্মতি!’ এই বলে দেবতা চলে গেলেন, কামার আবার বসে বসে ভাবতে লাগল্‌ হঠাৎ তার মনে যে, তাই ত, এই তিন বরের জোরে ত আমি বেশ দু পয়সা রোজগার করে নিতে পারি। তখন সে দেশময় এই কথা রটিয়ে দিল যে, ‘আমার দোকানে এলে আমি বিনে পয়সায় কাজ করে দেব।’ দেশের যত কিপটে পয়সাওয়ালা লোক, সে কথা শুনে তার দোকানে এসে উপস্থিত হতে লাগল। এক-একজন আসে, আর কামার তাকে দু হাতে লম্বা লম্বা সেলাম করে তার সেই কেদারাখানায় নিয়ে বসতে দেয়। বিনি পয়সায় কাজ করিয়ে চলে যাবার সময় আর সে বেচারা তা থেকে উঠতে পারে না, কামারও বেশ ভালমতে তার কাছ মেকে কিছু টাকা আদায় না করে তাকে উঠতে দেয় না। এমনি করে দিন কতক সে খুব টাকা পেতে লাগল। কাউকে এনে চেয়ারে বসায়, কারু হাতে তার হাতুড়িখানা তুলে দেয়, তারপর টাকা না দিলে আর তাকে ছাড়ে না। যা হোক, ক্রমে সকলেই তার দুষ্টুমি টের পেয়ে গেল। তখন আর কেউ তার কাছে আসে না, কাজেই আবার তার দুর্দশার একশেষ হতে লাগল। এই সময় কামার একদিন বনের ভিতর বেড়াতে গিয়ে একটি সাদাসিধে গোছের বুড়োকে দেখতে পেল। বুড়োকে দেখে সে আগে ভাবল, বুঝি কোনো উকিল হবে। কিন্তু তখনই আবার কোনো উকিলের সেই বনের ভিতর আসা তার ভারি অসম্ভব মনে হল। তারপর সে আবার ভাল করে চেয়ে দেখল যে, সেই লোকটার পা দুখানিতে ঠিক ছাগলের পায়ের মত খুর আছে। তখন আর তার বুঝতে বাকি রইল না যে, সেই বুড়ো আর কেউ নয়, স্বয়ং শয়তান। শয়তানের পা ঠিক ছাগলের মত থাকে, এ কথা সেই কামার ছেলেবেলা থেকে শুনে আসছিল। আর কেউ হলে তখনই সেখান থেকে ছুটে পালাত। কিন্তু সেই কামার তেমন কিছু না করে জোড়হাতে শয়তানকে নমস্কার করে বলল, ‘প্রণাম হই।’ শয়তান অমনি হাসতে হাসতে তার নাম ধরে বলল, ‘কি হে, কেমন আছ?’ কামার বলল, ‘আজ্ঞে। কেমন আর থাকব? দুবেলা দুটি ভাতও খেতে পাই নে।’ শয়তান বলল, ‘বটে! তুমি এতই কস্ট পাচ্ছ? তুমি কেন আমার চাকরি করো না, আমি তোমাকে ঢের টাকা দেব।’ ঢের টাকার নাম শুনে কামার তখনই শয়তানের কথায় রাজি হল, যদিও সে জানত যে তা কাজে একবার ঢুকলে আর কেউ ছেড়ে আসতে পারে না। শয়তান তখন তাকে তিন থলি মোহর দিয়ে খুব আরামে খাও-দাও। সাত বছর পরে আমি তোমার কাছে আসব, তখন তোমাকে আমার সঙ্গে যেতে হবে।’ এই বলে শয়তান চলে গেল। কামারও হাসতে হাসতে টাকার থলি নিয়ে ঘরে ফিরল। সেই তিন থলি মোহর নিয়ে কামার যার পর নাই খুশি হয়ে নাচতে নাচতে বাড়ি এল। ভাবল, এখন সাত বছর এই মোহর দিয়ে খুব ধুমধাম করে নেবে। সাত বছর পরে শয়তানের তাকে নিতে আসবার কথা, তখন তার সঙ্গে যেতেই হবে। তারপর লোকে দেখল যে কামার কেমন করে রাতারাতি বড়লোক হয়ে গেছে। এখন আর সে হাপরও ঠেলে না, লোহাও পেটে না। এখন তার গাড়ি ঘোড়া চাকর বাকরের অন্ত নেই। দিন যাচ্ছে আর তার বাবুগিরি ক্রমেই বেড়ে উঠছে। সে বাবুগিরিতে সাত বছর শেষ হবার ঢের আগেই শয়তানের দেওয়া সব টাকা ফুরিয়ে গেল, আর ঘরে একটি পয়সা নেই, নইলে খাবে কি? তারপর একদিন সে তার দোকানে বসে একটা লোহা পিটছে আর ভবছে, কখন খদ্দের আসবে, এমন সময় একজন বুড়ো-হেন লোক ধীরে ধীরে এসে তার কাছে দাঁড়াল। কামার আগে ভাবল, ‘এই রে, খদ্দের!’ তারপর চেয়ে দেখল, ‘ওমা! এ যে শয়তান!’ শয়তান বলল, মনে আছে ত? সাত বছর শেষ হয়েছে, এখন আমার সঙ্গে চলো।’ কামার বলল, ‘তুমি ছাড়বেই না যখন, তখন ত চলতেই হবে। কিন্তু আমার হাতের এই কাজটি শেষ করে যেতে পারলে আমার ছেলেগুলোর পক্ষে বড় ভাল হত-এর দরুন কিছু পয়সা পাওয়া যাবে। তুমি দাদা আমার এই উপকারটুকু করো না-আমি সকলের কাছে বিদায় হয়ে নিই, ততক্ষণ বসে এই হাতুড়িটা দিয়ে এই লোহাখানিকে পেটো।’ শয়তান কাজে এমন দুষ্টু হলেও কথাবার্তায় ভারি ভদ্রলোক, সে কামারের কথা শুনে তখনই তার হাত থেকে হাতুড়িটি নিয়ে লোহাটাকে পেটাতে লাগল। সে জানত না যে সেটা সেই দেবতার বর দেওয়া সর্বনেশে হাতুড়ি, তা দিয়ে একবার পিটতে আরম্ভ করলে আর কামারের হুকুম ছাড়া থামবার উপায় নেই। কামার তার হাতে সেই হাতুড়ি দিয়েই অমনি যে ঘর থেকে বেরুল, আর একমাসের ভিতরে সেই মুখেই হল না। একমাস পরে কামার দোকানে ফিরে এসে দিখল যে, শয়তান তখনো ঠনাঠন ঠনাঠন করে বেদম হাতুড়ি পিটছে, আর তার দশা যে হয়েছে! খালি শয়তান বলে সে এতক্ষণ বেঁচে আছে,আর কেউ হলে মরেই যেত। কামারকে দেখে সে অনেক মিনতি করে বলল, ‘ভাই, ঢের ত হয়েছে। আমাকে মেরে ফেলে তোমার লাভ কি? তার চেয়ে তোমাকে আরো তিন থলি মোহর দিচ্ছি, আরো সাত বছরের ছুটি দিচ্ছি, আমাকে ছেড়ে দাও।’ কামার ভাবল, মন্দ কি। আর তিন থলি মোহর দিয়ে সাত বছর সুখে কাটানো যাক। কাজেই সে শয়তানকে বলল, ‘আচ্ছা তবে তাই হোক।’ তখন শয়তান কামারকে আবার তিন থলি মোহর দিয়ে তাড়াতাড়ি সেখান খেকে চলে গেল, কামারও সেই টাকা দিয়ে আবার ধুমধাম জুড়ে দিল। তারপর সে টাকা শেষ হতেও আর বেশি দেরি হল না, তখন আর হাতুড়ি পেটা ভিন্ন উপায় নেই। এমনি করে আবার সাত বছর কেটে গেল। এবার শয়তান কামারকে নিতে এসে দেখে, তার বাড়িতে ভারি গোলমাল। কি কথা নিয়ে কামার তার গিন্নির উপর বিষম চটেছে, আর তাকে ধরে ভয়ানক মারছে। কামার গিন্নিও যেমন-তেমন মেয়ে নয়, পাড়ার সকলে তার জ্বালায় অস্থির থাকে। কামারকে সে ঝাঁটা দিয়ে কম নাকাল করছে না, কিন্তু কামারের হাতে কিনা হাতুড়ি, কাজেই জিত হচ্ছে তারই। শয়তান এসে এ সব দেখে কামারকে ভয়ানক দুই থাপ্পড় লাগিয়ে বলল, ‘বেটা পাজি, স্ত্রীকে ধরে মারিস? চল্‌, আমার সঙ্গে চল্‌।’ শয়তান ভেবেছিল, এতে কামারের স্ত্রী খুব খুশি হয়ে তার সাহায্য করবে। কিন্তু কামারের স্ত্রী তার কিছু না করে, ‘বটে রে হতভাগা, তোর এতবড় স্পর্ধা! আমার স্বামীর গায়ে হাত তুলছিস!’ বলে, সেই ঝাঁটা দিয়ে শয়তানের নাকে মুখে এমনি সপাংসপ মারতে লাগল সে বেচাবার দমই ফেলা দায়। সে তাতে বেজায় থতমত খেয়ে একটা চেয়ারের উপর বসে পড়ল-সেই চেয়ার, যাতে একবার বসলে আর বিনা হুকুমে ওঠবার জো নেই। কামার দেখল যে, শয়তান এবারে বেশ ভালমতেই ধরা পড়েছে, হাজার টানাটানিতেও উঠতে পারছে না। তখন সে তার চিমটেখানি আগুনে তাতিয়ে নিয়ে আচ্ছা করে তার নাকটা টিরে ধরল। তারপর তারা স্বামী- স্ত্রী দুজনে মিলে ‘হেঁইয়ো’ বলে সেই চিমটে ধরে টানতেই নাকটা রবারের মত লম্বা হতে লাগল। এক হাত, দু হাত, চার হাত, আট হাত-নাক যতই লম্বা হচ্ছে, শয়তান বেটা ততই ষাঁড়ের মত চেঁচাচ্ছে। নাকটা যখন কুড়ি হাত লম্বা হল, তখন শয়তান আর থাকতে না পেরে নাকি সুরে বলল, ‘দোহাই দাদা! আর টেনো না, মরে যাব।’ কামার বলল, ‘আরো তিন থলি টাকা, আর সাত বছরের ছুটি-দেবে কিনা বলো।’ শয়তান ব্যস্ত হয়ে বলল, ‘এক্ষুনি এক্ষুনি, এই নাও।’ বলতে বলতেই তিন থলি ঝকঝকে মোহর এসে কামারের কাছে হাজির হল। কামার সেগুলো সিন্দুকে তুলে শয়তানকে বলল, ‘আচ্ছা, তবে যাও।’ শয়তান ছাড়া পেয়েই সেখান থেকে এমনি ছুট দিল যে, ছুট যাকে বলে। তখন কামার আর তার স্ত্রী মেঝেয় গড়াগড়ি দিয়ে যে হাসিটা হাসল! আর সাত বছরের জন্য তাদের কোনো ভাবনা রইল না। সাত বছর যখন শেষ হল, তখন কামারের টাকাও ফুরিযে গেল, তাকে আবার তার ব্যবসা ধরতে হল, ততদিনে শয়তানও আবার তাকে নেবার জন্য এসে উপস্থিত হল। সাত বছর পরে শয়তান আবার কামারকে নেবার জন্য উপস্থিত হয়েছে। কিন্তু গতবারে সে নাকে যে চিমটি খেয়ে গিয়েছিল, তার কথা ভেবে আর সে সোজাসুজি কামারের সামনে এসে দাঁড়াতে ভরসা পাচ্ছে না, তাই এবারে সে এক ফন্দি এঁটে এসেছে। শয়তান জানে যে, কেউ যদি তাকে নিজে থেকে আদর করে নিয়ে যায়, তা হলে আর সে কিছুতেই তার হাত ছাড়তে পারে না। তখন শয়তান করল কি, একটি ঝকঝকে মোহর হয়ে ঠিক কামারের দোকানের সামনে রাস্তায় গিয়ে পড়ে রইল। সে ভাবল যে, কামার খেতে পায় না, মোহরটি দেখলে সে পরম আদরে এসে তুলে নিয়ে যাবে। তারপর আর সে শয়তানকে ফাঁকি দিয়ে যাবে কোথায়? যে কথা সেই কাজ। কামার সেই মোহরটিকে দেখতে পাওয়া মাত্রই ছুটে গিয়ে সেটিকে তুলে এনে তার থলেয় পুরল। তখন থলের ভিতর থেকে শয়তান হেসে তাকে বলল, ‘কি বাপু, এখন কোথায় যাবে? নিজে ধরে আমাকে ঘরে এনেছ, তার মজাটা এখনই দেখতে পাবে!’ কামার বলল, ‘কি রে বেটা? তুই নাকি! তোর বুঝি আর মরবার জায়গা জোটে নি, তাই আমার থলের ভিতরে এসেছিস? দাঁড়া, তোকে দেখাচ্ছি!’ এ কথায় শয়তান এমনি রেগে গেল যে, পারলে সে তখনই কামারকে মেরে শেষ করে। কিন্তু থলের বাইরে এলে তবে ত শেষ করবে! সে যে সেই বিষম থলে-তার ভিতর ঢুকলে আর বেরোবার হুকুম নেই! শয়তান বেচারার খালি ছটফটই সার হল, সে আর থলের ভিতর থেকে বেরুতে পারল না। ততক্ষণে কামার সেই থলেটি তার নেহাইয়ের উপর রেখে গিন্নীকে ডেকে দুজনে দুই প্রকাণ্ড হাতুড়ি নিয়ে, দমাদ্দম দমাদ্দম এনি পিটুনি জুড়ল যে পিটুনি যাকে বলে! পিটুনি খেয়ে শয়তান খানিক খুব চেঁচাল। তরপর যখন আর চেঁচানি আসে না, তখন গোঙাতে গোঙাতে বলল, ‘ছেড়ে দাও দাদা, তোমার পায়ে পড়ি। এবার তোমাকে বিশাল বিশাল ছয় থলে ভরা মোহর দেব, আর-কখনো তোমার কাছে আসব না।’ এ কথায় কামারের গিন্নি বলল, ‘ওগো, সে হলে নেহাত মন্দ হবে না। দাও হতভাগাকে ছেড়ে।’ তখন কামার বলল, ‘কই তোর মোহরের থলে?’ বলতে বলতেই এমনি বড় বড় মোহরের থলে এসে হাজির হল যে তারা দুজনে মিলেও তার একটাকে তুলতে পারল না। তখন কামার একগাল হেসে, তার থলের মুখ খুলে দিয়ে বলল, ‘যা বেটা! ফের তোর পোড়া মুখ এখানে দেখাতে আসবি ত টের পাবি।’ ততক্ষণে শয়তান থলের ভিতর থেকে বেরিয়ে এমনি ব্যস্ত হয়ে ছুট দিল যে, কামারের সব-কথা শুনতেও পেলনা।’ সেই ছটা থলের ভিতর এতই মোহর ছিল যে, কামার হাজার ধুমধাম করেও তা শেষ করতে পারল না। চার থলে ভাল করে ফুরুতেই সে বুড়ো হয়ে শেষে একদিন মরে গেল। মরে গিয়ে ভূত হয়ে সে ভাবল যে, এখন ত হয় স্বর্গে না হয় নরকে দুটোর একটায় যেতে হবে। আগে স্বর্গের দিকে গিয়েই দেখি-না, যদি কোনোমতে সেখানে ঢুকতে পারি। স্বর্গের ফটকের সামনে গিয়ে তার সেই দেবতাটির সঙ্গে দেখা হল, যিনি তাকে সেই বর দিয়েছিলেন। তাঁকে দেখে কামার ভারি খুশি হয়ে ভাবল, ‘এই ঠাকুরটি না আমাকে সেই চমৎকার বরগুলো দিয়েছিলেন? ইনি অবশ্য আমাকে ঢুকতেও দেবেন।’ কিন্তু দেবতা তাকে দেখেই যার পর নাই রেগো বললেন, ‘এখানে এসেছিস কি করতে? পালা হতাভাগা, শিগগির পালা!’ কাজেই তখন বেচারা আর কি করে? সে সেখান থেকে ফিরে নরকের দিকে চলল। সেখানকার ফটকের সামনে উপস্থিত হলে শয়তানের দারোয়ানেরা তাকে জিজ্ঞাসা করল, ‘তোমার নাম?’ কামার তার নাম বলতেই পাঁচ-ছয়টা দারোয়ান ঊর্ধ্বশ্বাসে ছুটে গিয়ে শয়তানকে বলল, ‘মহারাজ! সেই কামার এসেছে!’ তা শুনে শয়তান বিষম চমকে গিয়ে একটা লাফ যে দিল! তারপর পাগলের মত ফটকের কাছে ছুটে এসে দারোয়ানদের বলল, ‘শিগগির দরজা বন্ধ কর্! আঁট্ হুড়কো! লাগা তালা! খবরদার! ও বেটাকে ঢুকতে দিবি না! ও এলে আর কি আমাদের রক্ষা থাকবে!’ শয়তানের গলা শুনে কামার গরাদের ভিতর দিয়ে উঁকি মেরে হাসতে হাসতে বলল, ‘কি দাদা! কি খবর?’ সে কথা শেষ না হতেই শয়তান এক লাফে এসে অমনি তার নাক মলে দিল যে কি বলব! কামার তখনই সেখান থেকে চেঁচাতে চেঁচাতে ছুটে পালাল, কিন্তু তার আগেই তার নাকে আগুন ধরে গিয়েছিল। সে আগুন আজও নেবেনি। কামার তার জ্বালায় অস্থির হয়ে জলায় জলায় নাক ডুবিয়ে বেড়ায়। সে আগুন দেখতে পেলে লোকে বলে, ‘ঐ আলেয়া।’
উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী
দুঃখীরাম উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী দুঃখীরাম খুব গরীব ঘরের ছেলে ছিল। সকলে তাহাকে দুঃখীরাম বলিয়া ডাকিত, কিন্তু তাহার এর চাইতে ঢের ভাল একটা নাম ছিল-সেটা আমি ভুলিয়া গিয়াছি। দুঃখীরামের যখন দুই বৎসর বয়স, তখন তাহার মা-বাপ মরিয়া গেল। পৃথিবীতে তাহার আপনার বলিতে আর কেহই ছিল না, খালি ছিল মামা কেষ্ট। দু বছরের ছেলে দুঃখীরাম মামার খবর কিছুই জানিত না, তাহার মামাও তাহার কোন খবরই লইল না। কাজেই পাড়ার লোকেরা দয়া করিয়া তাহাকে মানুষ করিতে লাগিল। তখন হইতেই লোকে তাহাকে দুঃখীরাম বলিয়া ডাকিত। গরীবের ছেলে দু বেলা পেট ভরিয়া খাইতে পাওয়াই অনেক সময় মুশকিল হয়, এর উপর আবার কে তহাকে লেখাপড়া শিখাইবে? অন্য ছেলেদের ফেলিয়া দেওয়া ছেঁড়া বই পড়িয়া আর পাড়ার লোকের খুঁটিনাটি কাজ করিয়া তাহার দিন যাইতে লাগিল। ইহার মধ্যে একদিন দুঃখীরাম শুনিল যে কেষ্ট বলিয়া তাহার এক মামা আছে। শুনিয়াই সে মনে করিল যে, একবার মামার বাড়ি যাইতে হইবে। অনেক সন্ধান করিয়া শেষে সে কেষ্টর বাড়ি বাহির করিল। কেষ্ট তাহাকে দেখিয়াই বলিল, ‘তাই ত, দুঃখীরাম এসেছ! এখানে কত কষ্ট পাবে, তা ত জান না। আমরা দু মাসে একদিন খাই, কাল খেয়েছি, আবার দু মাস পরে খাব।’ দুঃখীরাম বলিল , ‘মামা, তার জন্য ভাবনা কি? তোমরা যখন খাবে, আমিও তখনই খাব।’ কেষ্ট আর কিছুই বলিল না। দুঃখীরামও আর কিছু বলিল না। মামার বাড়িতে খালি মামা আর মামাত ভাই হরি ছাড়া আর কেহ নাই। মামাত ভাইকে সে দাদা বলিয়া ডাকিতে লাগিল। সারাদিন কেষ্ট আর হরি কেহই কিছু খাইল না। কাজেই দুঃখীরামেরও খাওয়া জুটিল না। দুঃখীরাম এর চাইতে অনেক বেশী সময় না খাইয়া কাটাইয়াছে, সুতরাং তাহার বড় একটা ক্লেশও হইল না। সন্ধ্যার সময় সে কেষ্টকে বলিল, ‘মামা বড্ড ঘুম পেয়েছে, আমি ঘুমোই।’ ইহাতে কেষ্ট যেন ভারি খুশি হইল, আর তখনই তাহাকে একটু মাদুর বিছাইয়া দিল। দুঃখীরাম সেই মাদুরে চুপ করিয়া শুইয়া রহিল। খানিক পরে কেষ্ট আর হরি আসিয়া তাহার পাশেই ঘুমাইতে লাগিল। আসল কথা, কেহই ঘুমায় নাই- মামা খালি ভাবিতেছে, কতক্ষণে ঘুমাইবে, আর দুঃখীরাম ভাবিতেছে, এরপর মামা কি করে। দেখিতে দেখিতে হরির নাক ডাকিল। দুঃখীরাম বুঝিল যে দাদা ঘুমাইয়াছে, আর একটু পরে দুঃখীরাম পাশে একটা খচমচ শব্দ শুনিয়া বুঝিতে পারিল যে, এবারে মামা উঠিয়াছে। এরপর হেঁশেলে হাঁড়ি নাড়ার শব্দ হইল। তারপর হাঁড়ি ধোয়ার খলখল শব্দ, উনান ধরাইবার ফুঁ-সকলই শুনা গেল। দুঃখীরামের আর কিছুই বুঝিতে বাকি রহিল না। তখন সে চুপি চুপি উঠিয়া রান্নাঘরের বেড়ার ফুটা দিয়া দেখিল, কেউ পায়েস রাঁধিতেছে। দুঃখীরাম এক-একবার উঠিয়া দেখে, আবার আসিয়া চুপ করিয়া শুইয়া থাকে। যখন সে দেখিল যে, পায়েস প্রস্তুত হইয়াছে, তখন হাউমাউ করিয়া উঠিয়া বসিল। গোলমাল শুনিয়া কেষ্ট তাড়াতাড়ি রান্নাঘর হইতে আসিয়া জিজ্ঞাসা করিল, ‘কি রে দুঃখীরাম, কি হইয়াছে?’ দুঃখীরাম বলিল, “মামা, ও ঘরে তুমি কি করছিলে, আর একজন লোক বেড়ার ফুটো দিয়ে উকি মারছিল।“ দুঃখীরাম নিজের কথাই বলিয়াছে, কিন্তু কেষ্ট মনে করিল বুঝি চোর আসিয়াছে। তাই সে লাঠি হাতে ঘরের পেছনে বনের ভিতরে চোর তাড়াইতে ছুটিল। তখন দুঃখীরাম তাহার দাদাকে ঠেলিয়া তুলিয়া বলিল, ‘দাদা, শিগ্‌গির ওঠো, মামা একটা লাঠি হাতে তাড়াতাড়ি কোথায় যেন বেরিয়ে গেলেন।’ হরি বেচারার মনে ভারি ভয় হইল। সে মনে করিল যে লাঠি হাতে যখন গিয়াছে তখন নিশ্চয়ই একটু দূরে কোথাও গিয়াছে। তিন মাইল দূরে হরির ভগ্নীর বাড়ি, হয়ত হঠাৎ তাহার কোন ব্যারাম হইয়াছে, আর বাবা খবর পাইয়া তাহাকে দেখিতে গিয়াছে। এইরূপ ভাবিয়া হরি ব্যস্ত হইয়া তাহার ভগ্নীর বাড়ি চলিল। খানিক পরে কেষ্ট ফিরিয়া আসিল। সে চোরকে ধরিতে পারে নাই, লাভের মধ্যে বিছুটি লাগিয়া তাহার সর্বাঙ্গ জ্বলিয়া গিয়াছে। সে আসিয়া হরিকে দেখিতে না পাইয়া দুঃখীরামকে জিজ্ঞাসা করিল, ‘হরি কোথায় রে?’ দুঃখীরাম বলিল, মামা তুমিও গেলে, আর যে লোকটা তোমার ঘরে উঁকি মারছিল, সেই লোকটা দাদাকে ঘুম থেকে উঠিয়ে তার সঙ্গে কথা কইল; আর দাদাও তখ্‌খুনি বেরিয়ে গেল।’ ইহা শুনিয়া কেষ্ট মনে করিল যে হরি নিশ্চয়ই পাড়ার দুষ্টু ছেলের সঙ্গে জুটিয়া তাস খেলিতে গিয়াছে। সুতরাং হরি এবং সেই পাড়ার দুষ্ট ছেলেটার উপর তার ভয়ানক রাগ হইল, আর সেই লাঠি হাতে করিয়াই সে তাহার সঙ্গীকে শাস্তি দিবার জন্য পাড়া খুঁজিতে বাহির হইল। দুঃখীরাম যখন দেখিল যে, ওর মামা আর দাদার বাড়ি ফিরিতে একটু বিলম্ব হইবে, তখন সে আস্তে আস্তে রান্নাঘরে গিয়া পায়েসের হাঁড়ি নামাইল। একে দুঃখীরামের বড়ই ক্ষুধা পাইয়াছিল, তার উপর আবার তার মামা রাঁধে বড় সরেস। সুতরাং দেখিতে দেখিতে সেই পায়েসের হাঁড়ি খালি হইয়া গেল। তারপর দুঃখীরাম আবার সেই মাদুরে শুইয়া আরামে নিদ্রা গেল। হরি ভগ্নীর বাড়িতে গিয়া তাহাকে ভালই দেখিতে পাইল। কিন্ত সে রাত্রে তাহার বোন আর তাহাকে বাড়ি ফিরিয়া আসিতে দিল না। এদিকে কেষ্ট তাহাকে আকাশ পাতাল খুঁজিতেছে, এবং কোথাও তাহাকে না পাইয়া রাগে আর বিছুটির জ্বলায় ছটফট করিতেছে। সুতরাং ভোরবেলা হরি যেই বাড়ি ফিরিয়া আসিল, অমনি কেষ্ট সেই লাঠি দিয়া তাহাকে কয়েক ঘা লাগাইল। এইরূপে সমস্ত রাত্রি নাকাল হইয়া, শেষে রান্নাঘরে গিয়া সে দেখে-পায়েসের হাঁড়ি খালি। তখন আর কিছুই বুঝিতে বাকি রহিল না। দুঃখীরাম সকালে উঠিয়া অবধি কেমন আড়চোখে চায় আর একটু হাসে। সুতরাং তাহা যে দুঃখীরামের কাজ, বেশ বুঝা গেল। পরদিন বাপ-বেটায় মিলিয়া রাজার নিকট নালিশ করিতে গেল। রাজা দুঃখীরামকে ডাকাইয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, হ্যাঁরে তুই এমন কাজ কেন করলি? ওদের পায়েস চুরি করে কেন খেলি? মিছে কথা বলে কেন ওদের নাকাল করলি? দুঃখীরাম হাত জোড় করিয়া বলিল, ‘দোহাই ধর্মাবতার! ওঁরা দু মাসে একদিন খান। পরশু খেয়েছিলেন, আবার কাল পায়েস রাঁধলেন কেন? ওঁরাই বলুন। তারপর নাকাল করার কথা বলছেন? তা আমি ত সত্যি কথাই বলছি,তাতে যদি ওঁরা খামকা নাকাল হতে গেলেন, তা আমার কি দোষ?’ রাজা আগাগোড়া সমস্ত শুনিয়া খুব হাসিতে লাগিলেন। মোকদ্দমা ডিসমিস হইয়া গেল। দুঃখীরামকে বেশ চালাক চতুর দেখিয়া রাজা তাহাকে একটি চাকরি দিলেন। দুঃখীরাম এত ভাল করিয়া কাজ করিতে লাগিল যে, কয়েক বৎসরের ভিতরেই সেই সামান্য চাকরি হইতে ক্রমে সে ছোট মন্ত্রীর পদে উঠিল। বড় মন্ত্রীর পদ খালি হইলে যে তাহাও সে পাইবে, এ কথা সকলেই বলিতে লাগিলেন। বড় মন্ত্রী লোকটা বড় সুবিধার ছিলেন না। দুঃখীরামকে তিনি ভারি হিংসা করিতেন, আর কি করিয়া তাহাকে জব্দ করিবেন, ক্রমাগত তাহাই ভাবিতেন। এক সওদাগরের সাথে বড় মন্ত্রীর বন্ধুতা ছিল। সেই সওদাগরের একটা পক্ষিরাজ ঘোড়া ছিল। পক্ষিরাজ ঘোড়া মানুষের মত কথা কহিতে পারে, শূণ্যে উঠিয়া এক মাসের পথ এক মিনিটে যাইতে পারে, ভূত ভবিষৎ সব বলিয়া দিতে পারে। এই ঘোড়াটাকে পাইবার জন্য মন্ত্রীমহাশয় অনেক দিন হইতে চেষ্টা করিতেছেন। কিন্ত সওদাগর কিছুতেই সেটা তাঁহাকে দিতে চায় না। এরমধ্যে সওদাগর একবার বিদেশে গিয়াছিল, সেখান হইতে একটা খুব আশ্চর্য আমের আঁটি লইয়া আসিয়াছে। সে আঁটির এই গুণ যে, তাহা পুতিবামাত্র গাছ হয়, তাতে তৎক্ষণাৎ আম হয়, তখনই সেটা পাকে, আর তখনই তাহা খাওয়া যায়। খাওয়ার পর আবার সেই আঁটি মাটির ভিতর হইতে তুলিয়া বাক্সে পুরিয়া রাখা যায়। মন্ত্রীমহাশয় সওদাগরের চাকরকে টাকা দিয়া বশ করিলেন। সে তাঁহার কথায় সওদাগরের আমের আটি সিদ্ধ করিয়া রাখিল। তারপর একদিন মন্ত্রীমহাশয় সওদাগরের সঙ্গে কথা বলিতে বলিতে জিজ্ঞাসা করিলেন, ‘বন্ধু, তুমি নাকি ভারি আশ্চর্য একটা আমের আঁটি আনিয়াছ?’ সওদাগর বলিল, ‘হ্যাঁ বন্ধু, সেটাকে পুতিলে তখনই গাছ হয়, তখনই তাতে ফল হয়, তখনই তাহা পাকে, তখনই তাহা খাইয়া আঁটিটি আবার বাক্সে রাখিয়া দেওয়া যায়।’ মন্ত্রীমহাশয় নাক মুখ সিঁটকাইয়া বলিলেন, ‘ও কথা আমার বিশ্বাস হয় না।’ সওদাগর বলিল , ‘আচ্ছা বাজি রাখুন। আমার কথা সত্য হয় ত কি হইবে?’ মন্ত্রী বলিলেন, ‘তাহা-হইলে পরদিন আমার বাড়িতে গিয়া প্রথমে যে জিনিসটাতে হাত দিবে সেইটা তোমার, আর যদি তোমার কথা সত্য না হয়?’ সওদাগর বলিল, ‘তবে আপনি পরদিন আমার বাড়িতে আসিয়া প্রথমে যাহাতে হাত দিবেন, তাহাই আপনার হইবে।’ ঠিক হইল, পরদিন সওদাগরের বাড়িতে মন্ত্রীমহাশয়ের নিমন্ত্রণ, আর তখন আমের আঁটির পরীক্ষা হইবে। আঁটি সিদ্ধ করিয়া রাখিয়াছে, সুতরাং পরীক্ষার ফল কি হইল তাহা বলিয়া দিতে হইবে না। সওদাগর বেচারার মাথায় যেন আকাশ ভাঙ্গিয়া পড়িল। এবারে সে বুঝিতে পারিল, আর পক্ষিরাজ ঘোড়াকে রাখিতে পারিবে না। অনেক ভাবিয়া কোন উপায় স্থির করিতে না পারিয়া শেষে সওদাগর ছোট মন্ত্রীর কাছে গেল। সেখানে হাত জোড় করিয়া কাঁদিতে কাঁদিতে সকল কথা নিবেদন করিল। বুদ্ধিমান ছোট মন্ত্রী একটু চিন্তা করিয়া উপায় বলিয়া দিলেন। সওদাগর সন্তুষ্টচিত্তে বাড়ি ফিরিয়া পক্ষিরাজ ঘোড়ার আস্তাবলের দরজা দড়ি দিয়া বাঁধিয়া সুখে নিদ্রা গেল। পরদিন ভোর হইতে না হইতেই মন্ত্রীমহাশয় সওদাগরের বাড়ি গিয়া ডাকিতে লাগিলেন, ‘বন্ধু!’ ‘বন্ধু!’ সওদাগর শশব্যস্ত হইয়া উঠিয়া তাঁহার অভ্যর্থনা করিল। মন্ত্রীমহাশয় একটু বসিবার দেরি সয় না। তিনি না বসিয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, ‘কই বন্ধু সে কথার কি হইল?’ সওদাগর বলিল, ‘আমি প্রস্তুত আছি, এখন আপনার যাহাতে খুশি হাত দিয়া লইয়া যাইতে পারেন।’ মন্ত্রীমহাশয় অমনি আস্তাবলের দিকে চলিলেন। সওদাগরও সঙ্গে সঙ্গে গেল। আস্তাবলের দরজা বাঁধা ছিল। মন্ত্রীমহাশয় দড়ি ধরিয়া এক টান দিয়া বাঁধন খুলিয়া ফেলিলেন। অমনি সওদাগর বলিল, ‘সে কি বন্ধু। আপনার মতন লোকের ঐ সামান্য দড়ি গাছাটায় লোভ! একটা কোন দামী জিনিস লইলে সুখী হইতাম।’ মন্ত্রীর ত চক্ষু স্থির! অত সহজে ঠকিবেন, তাহা তিনি মনেও করিতে পারেন নাই। সওদাগরের কথার উত্তর দিতে না পারিয়া আমতা আমতা করিয়া ঘরে ফিরিলেন। পথে যাইতে যাইতে মন্ত্রীমহাশয় স্থির করিলেন যে, ছোট মন্ত্রী ছাড়া এ আর কাহারো কর্ম নয়। তারপর যখন শুনিলেন যে, সেদিন রাত্রে সওদাগর ছোট মন্ত্রীর বাড়ি গিয়াছিল তখন বুঝিলেন, নিশ্চয় ইহা ছোট মন্ত্রীর কাজ। পরদিন দুপুরবেলা যখন রাজা ঘুমাইতেছিলেন, তখন মন্ত্রীমহাশয় গিয়া জোড়হাতে তাঁহার সামনে দাঁড়াইয়া রহিলেন। খানিক পরে রাজা চক্ষু মেলিয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, কি মন্ত্রী?’ মন্ত্রী বলিলেন, ‘দোহাই মহারাজ! সুলক্ষণ সওদাগরের একটা পক্ষিরাজ ঘোড়া আছে, কিন্তু মহারাজের আস্তাবলে একটাও পক্ষিরাজ ঘোড়া নাই।’ রাজা বলিলেন, ‘বটে! ও ঘোড়া আমার চাই।’ মন্ত্রী আর বিনয় করিয়া কাঁদো-কাঁদো স্বরে বলিলেন, মহারাজের যাহাতে ভাল হয় আমার সেই চেষ্টা, আর ছোট মন্ত্রী দিনরাত তাহাতে বাধা দেয।’ রাজা বলিলেন, ‘সে কিরকম?’ মন্ত্রী বলিলেন, ‘মহারাজের জন্য সেই পক্ষিরাজ ঘোড়া আমি আনিতে গিয়াছিলাম, কিন্তু ছোট মন্ত্রী সুলক্ষণকে মন্ত্রণা দিয়া সে ঘোড়া আনিতে দেয় নাই।’ রাজার মেজাজ সেকালে বড়ই অস্থির ছিল। সহজেই সন্তুষ্ট হইতেন, আর সামান্য কথাতেই চটিয়া উঠিতেন। বকশিশ দিতেন ত অর্ধেক রাজ্যই দিয়া ফেলিতেন, আর সাজা দিতেন ত মাথাটাই কাটিয়া ফেলিতেন। রাজা ছোট মন্ত্রীর উপর এতদিন সন্তুষ্ট ছিলেন, তাই তাহাকে ছোট মন্ত্রী করিয়াছিলেন। আজ বড় মন্ত্রীর কথা শুনিয়া এতই চটিয়া গেলেন যে, তখনই তাহাকে হাত-পা বাঁধিয়া আনিতে হুকুম দিলেন। বেচারা কোন বিপদের কথা জানিতেন না, সুখে ঘুমাইতেছিল, এমন সময় রাজার লোক আসিয়া তাহার হাত-পা বাঁধিয়া লইয়া চলিল। দুঃখীরামের এই সাজার হুকুম হইল যে, তাহাকে থলের ভিতর পুরিয়া পাথর বাঁধিয়া সমুদ্রে ফেলিয়া দেওয়া হইবে। রাজামশায়ের সামনেই থলে আর পাথর আনিয়া সব বাঁধিয়া ঠিক করা হইল,তারপর রাজা চারিটা জল্লাদকে যে, ‘একে সমুদ্রে ফেলিয়া দিয়া আয়।’ দুঃখীরামকে সকলেই ভালবাসিত। সুতরাং তাহার এই সাজার কথা শুনিয়া সকলেরই ভারি ক্লেশ হইল। পথে যাইতে যাইতে জল্লাদেরা চুপিচুপি পরামর্শ করিল যে, এমন ভাবে লোককে কখনই সমুদ্রে ফেলিয়া মারা হইবে না। এইরূপ স্থির করিয়া তাহারা সমুদ্রের ধারে একটা বনের ভিতরে দুঃখীরামকে রাখিয়া থলের মুখ খুলিয়া দিয়া আসিল। আসিবার সময় তাহাকে একখানি কুড়াল আর এক টুকরো নেকড়া দিয়া বলিয়া আসিল, ‘ছোট মন্ত্রীমশাই, আমরা আর তোমাকে কি দিতে পারি, এই নেকড়া ও কুড়াল নাও, কাঠ কেটে বাজারে বিক্রি করে খেও। তোমার দোহাই ছোট মন্ত্রীমশাই, আমাদের রাজার দেশে যেও না। সেখানে তোমাকে দেখতে পেলে রাজা তোমাকেও রাখবে না, আমাদেরও রাখবে না। দুঃখীরাম এখন কাঠুরে হইয়াছে, লম্বা লম্বা চূল দাড়ি গোঁফ রাখিয়াছে আর নিজের পোষাকটা ফেলিয়া দিয়া সেই জল্লাদের দেওয়া নেকড়াখানা পরে। ভাল করিয়া স্নান না করাতে তাহার গায়ের রং ময়লা হইয়া গিয়াছে। পেট ভরিয়া খাইতে না পাওয়াতে ঢের রোগা হইয়া গিয়াছে। এখন তাহাকে দেখিলে আর চট করিয়া চেনা যায় না। এইরূপ অবস্থায় কষ্টে দুঃখীরামের দিন কাটিতে লাগিল। একদিন কাঠ কাটিতে বাহির হইয়া দুঃখীরাম দেখিল যে, ঝরনার ধারে গাছতলায় এক বুড়ি ঘুমাইতেছে। সে এতই বুড়া হইয়াছে যে, তেমন বুড়ামানুষ আর দুঃখীরাম কখনো দেখে নাই। বুড়িকে দেখিয়া সে চলিয়া যাইতেছে, এমন সময় দেখিল যে, একটা বিষাক্ত সাপ চুপিচুপি সেই বুড়ির দিকে যাইতেছে। দুঃখীরাম তখনই কুড়াল দিয়া সাপটাকে টুকরা টুকরা করিয়া ফেলিল আর সেই টুকরাগুলি ঝরনার জলে ফেলিয়া দিল। কি আশ্চর্য! সেই টুকরাগুলি জলে পড়িবামাত্র জলটা টগবগ করিয়া ফুটিতে লাগিল। তাহার শব্দ শুনিয়া বুড়ি ব্যস্ত হইয়া উঠিয়া বসিল। বুড়ি খানিক অবাক হইয়া ঝরনার দিকে তাকাইয়া রহিল। তারপর দঃখীরামকে জিজ্ঞাসা করিল, ‘তুমি কে বাবা?’ দুঃখীরাম বলিল, ‘আমি দুঃখীরাম”’ বুড়ি বলিল, ‘বাবা, তুমি কি চাও?’ দুঃখীরাম বলিল, ‘আমি কিছুই চাই না। তুমি বুড়োমানুষ বনের ভিতর কোন আসিয়াছ? কত জন্তু আছে, শীঘ্র চলিয়া যাও।’ বুড়ি বলিল, ‘বাপু, তুমি আমাকে প্রাণে বাঁচাইয়াছ, আমি তোমাকে কিছু না দিয়া অমনি যাইতে পারিতেছি না।’ দুঃখীরাম কিন্তু কিছুই লইবে না, সুতরাং বুড়ি চলিয়া গেল। কিন্তু যাইবার সময় চুপিচুপি বলিয়া গেল, ‘তুমি কিছু লইলে না-আচ্ছা আমি তোমাকে এক বর যাইতেছি যে, তুমি যাহা ইচ্ছা কর তাহাই হইবে।’ দুঃখীরাম ততক্ষণে কুড়াল হাতে অনেক দূরে চলিয়া গিয়াছে, সুতরাং এ সকল কথা সে শুনিতে পাইল না। আজ দুঃখীরামের ঢের বেলা হইয়া গিয়াছে। কখন কাঠ কাটা হইবে, সেই কাঠ বাজারে বিক্রি হইবে, তবে তাহার পেটে দুটি ভাত পড়িবে। এ-সকল কথা ভাবিয়া বেচারীর মনটা একটু দঃখিত ছিল, তাই তত সাবধান হইয়া পথ চলিতে পারিতেছে না। সামনে একটা ছোট গাছ পড়িয়াছিল, তাহাতে হোঁচট খাইয়া দুঃখীরাম পড়িয়া গেল। একে মন ভাল নহে, তাহার উপর এরূপ দূর্ঘটনা হইলে কাহার না রাগ হয়? দুঃখীরাম রাগিয়া বলিল, ‘দূর হ ছাই। এ মুল্লুকে গাছপালা না থাকিলেই ভাল ছিল।’ যেই এ কথা বলা, আর অমনি সেখানকার যত গাছপালা সব কোথায় চলিয়া গেল, যেখানে ভয়ানক বন ছিল,সেখানে খালি মাঠ ধূ ধূ করিতে লাগিল। কি সর্বনাশ! এখন কাঠই বা কোথা হইতে মিলে, আর দুঃখীরামের খাওয়াই বা কি করিয়া হয়? বেচারা ব্যাপার দেখিয়া একেবারেই অবাক! ইহার কারণ কিছুই ঠিক করিতে না পারিয়া আপনমনে খালি হাটিয়া চলিল। বেলা ঢের হইয়াছে ক্ষুধা আরো বেশী হইয়াছে, এমন অবস্থায় শুধু পথ চলিলেই কত কষ্ট, তাহাতে আবার হাতে প্রকাণ্ড কুড়াল। সে যে-সে কুড়াল নয়,জল্লাদের কুড়াল। সাধারন কুড়ালের দুখানার সমান তাহার একখানা ভারি হয়। সেদিন দুঃখীরামের কাছে সেটা যেন দশটা কুড়ালের মত ভারি ঠেকিতে লাগিল, আর সেটাকে বহিয়া নিতে ইচ্ছা হয় না। সুতরাং দুঃখীরাম সেটাকে ছুঁড়িয়া ফেলিয়া বলিল আর পারি না, অত বড় কুড়ালের হাত পা-থাকা উচিত, তাহা হইলে আমার সঙ্গে চলিতে পারে।’ কুড়াল তাহাই করিল। কোথা হইতে মাকড়সার পায়ের মতন তাহার সব পা হইল। আর সে টুকটাক করিয়া দুঃখীরামের পিছু পিছু চলিল। দেখিয়া শুনিয়া বেচারার মাথায় আরো গোল লাগিয়া গেল। সে একভাবেই চলিয়া যাইতে লগিল, আর ভাবিতে লাগিল, হইল কি! যাইতে যাইতে দুঃখীরাম একেবারে নিজের দেশের বাজারে গিয়া উপস্থিত। প্রভুভক্ত কুড়াল সঙ্গেই আছে। সে এমনিভাবে চলিয়াছে, যেন চিরকাল তাহার ঐরকম করিয়াই চলা অভ্যাস। একটা কুড়াল যদি লম্বা লম্বা পা ফেলিয়া তোমার সামনে দিয়া চলিয়া যায়, তুমি তাহা হইলে কি কর? আর তেমন একটা কুড়াল যদি বাজারে গিয়া উপস্থিত হয়,তাহা হইলে বাজারের লোকগুলিই বা কি করে? বাজারে প্রথম মোড়েই এক গোয়ালার দোকান। সেখানে এক বড়লোকের দারোয়ান ঘি কিনিতে আসিয়াছে। গোয়ালার হাতে ঘিয়ের বাটি দিয়া সবে সে পৈঠায় বসিয়া তামাকু খাইবার আয়োজন করিতেছিল, এমন সময় হঠাৎ ফিরিয়া চাহিয়া দেখে, দুঃখীরামের সেই কুড়াল হাত-পা সুদ্ধ একেবারে তাহার সামনে উপস্থিত। ‘হায় বাপ’ বলিয়া চারি হাত-পা উর্দ্ধে উঠাইয়া দারোয়ানজী আপনিই এক লাফে একেবারে গোয়ালার ঘাড়ে গিয়া উঠিল। গোয়ালাও তাড়াতাড়ি দারোয়ানজীকে ঠেলিয়া মাখনের হাঁড়িতে, ঘরে দরজা আঁটিল। তারপর যখন দেখিল যে, সেটা কাহাকেও কিছু বলে না, তখন দরজা খুলিয়া তাহার পিছু পিছু তামাশা দেখিতে চলিল। সেদিন বাজারে কেনাবেচা বন্ধ। বাবুদের চাকর যাহারা বাজার করিতে আসিয়াছিল, তাহারা সকলেই কুড়ালের পিছু পিছু চলিয়াছে, তাহাদের বাজার করা আর হয় নাই। দোকানীরাও তাহাই করিতেছে-পুলিশ-পাহারাদার সকলেই সেই কুড়ালের পিছু চলিয়াছে। চাকরদের সান লইতে বাবুরা আসিয়াছিলেন, তাঁহারাও সেই কুড়ালের তামাশা দেখিতেই রহিয়া গেলেন। এইরূপ করিয়া দেশের প্রায় কল লোক সেইখানে আসিয়া জড়ো হইল। দুঃখীরামের সেই মামা আর মামাত ভাই কেষ্ট আর হরিও তাহাদের ভিতরে ছিল। কেষ্ট আর হরি প্রথমে কুড়ালের তামাশা দেখিতেই ব্যস্ত ছিল, তারপর একবার যেই দুঃখীরামের মুখের উপর চোখ পড়িল, অমনি তাহাদের বুকের ভিতর ধড়াস ধড়াস করিতে লাগিল। ভাল করিয়া দেখিয়া তাহারা বেশ বুঝিতে পারিল যে, এ দুঃখীরাম। সুতরাং তাহারা তাড়াতাড়ি মন্ত্রীর নিকট গিয়া খবর দিল, ‘মন্ত্রীমহাশয়, সেই দুখেটা আসিয়াছে।’ মন্ত্রী অবিলম্বে এই সংবাদ রাজাকে দিলেন আর বলিলেন, ‘মহারাজ, কুড়াল কি কখনো হাঁটে? এ নিশ্চয় কোন জাদু-টাদু শিখিয়া বদ মতলবে এখানে আসিয়াছে। রাজা শুনিয়া বলিলেন, ‘ঠিক বলিয়াছ, মন্ত্রী। এখনি দশজন সিপাহী পাঠাইয়া দাও, উহাকে বাঁধিয়া নিয়া আসুক।’ রাজার হুকুমে দানবের মত দশটা পালোয়ান দুঃখীরামকে আনিতে চলিল। এদিকে বাজারের লোকেরা দুঃখীরামকে তত গ্রাহ্য করে নাই, কিন্তু তাহার কুড়ালটাকে রাজার কাছে লইয়া যাইতে অনেক চেষ্টা করিয়াছে, কিন্তু সে কুড়ালের গায়ে কি ভয়ানক জোর! তাহার গলায় দড়ি বাঁধিয়া বাজারের সমস্ত লোক মিলিয়া কত টানিল, কিছুতেই তাহাকে এক পাও নাড়িতে পারিল না। বরং তাহারা যে দশ মিনিট ধরিয়া প্রাণপণে ‘হিঁয়ো’ করিয়াছে, ততক্ষণে দুঃখীরামের কুড়ালই তাহাদিগকে আধ মাইল খানেক টানিয়া লইয়া গিয়াছে। এমন সময় রাজার পালোয়ানেরা আসিয়া দুঃখীরামকে বাঁধিতে লাগিল। দুঃখীরমের কাছে আজ আর কিছুই আশ্চর্য বলিয়া বোধ হয় না। সে কেবল দেখিতেছে, এরপর কি হয়। স্বয়ং বড় মন্ত্রী পালোয়ানের সঙ্গে আসিয়াছেন,আর বলিতেছেন, ‘শক্ত করিয়া বাঁধ।’ এ কথা শুনিয়া দুঃখীরাম নিতান্ত দুঃখিত হইয়া বলিল, ‘অন্যে বেলা বলা খুব সহজ; তোমাকে একবার ওরকম করিয়া বাঁধিত তবে দেখিতে কেমন লাগে।’ অমনি চারটা পালোয়ান মন্ত্রীমশায়কে চিত করিয়া ফেলিয়া ঠিক দুঃখীরামের মতন করিয়া বাঁধিতে লাগিল। মন্ত্রীমহাশয় প্রথমে আশ্চর্য বোধ করিলেন, তারপর চটিয়া লাল হইলেন। কিন্তু পালোয়ানেরা তাঁহাকে গ্রাহ্য করিল না। রাগে মন্ত্রীমহাশয়ের কথা বাহির হইতেছে না, চোখ দুটো ফুটিয়া বাহির হইবার উপক্রম হইয়াছে, গলার শিরা ফুলিয়াছে, মুখে ফেনা উঠিতেছে। কিন্তু পালোয়ানেরা তথাপি তাহাকে বাঁধিতে কসুর করিতেছে না। বেশ করিয়া বাঁধিয়া তারপর পরীক্ষা করিয়া দেখিল, ঠিক দুঃখীরমের মতন বাঁধা হইয়াছে কি না। যখন দেখিল যে দুজনকেই ঠিক একরকম করিয়া বাঁধা হইয়াছে, তখন তাঁহাদিগকে কাঁধে করিয়া রাজার নিকট লইয়া চলিল। বাজারের লোকেরা এই অদ্ভুত কাণ্ড দেখিয়া অবাক হইয়া সঙ্গে সঙ্গে চলিল। এই সকল লোক যখন রাজার কাছে উপস্থিত হইল, তখন রাজামহাশয়ের ভারি রাগ হইল এমনও নহে। মন্ত্রীর বাঁধন তিনি নিজ হাতে খুলিয়া দিলেন, তারপর তাঁহাকে লইয়া দুঃখীরমের বিচার করিতে বসিলেন। যে সকল পালোয়ান মন্ত্রীমশায়কে বাঁধিয়া আনিয়াছিল, প্রথমে তাহাদের ফাঁসির হুকুম হইল। দুঃখীরামের সম্বন্ধে একটা হুকুম দিবার পূর্বেই আহারের সময় হওয়াতে মাঝখানে রাজামহাশয় উঠিয়া গেলেন, খাওয়া-দাওয়ার পর দুঃখীরামের হুকুম হইবে। দুঃখীরাম বেচারা সেই বাঁধা অবস্থাতেই পড়িয়া আছে। তাহার চারধারে বিস্তর প্রহরী আছে, দর্শদিগেরও অধিকাংশই রহিয়া গিয়াছে। দুঃখীরামের দুঃখের কথা আর কি বলিব। অন্য কষ্টের বিষয় আর এখন ততটা ভাবে না, কিন্তু ক্ষুধা ত কিছুতেই থামিয়া থাকিবার নহে। রাজামহাশয়, মন্ত্রীমহাশয়, সকলেই আহার করিতে গিয়াছেন। কত সুখাদ্য জিনিস খাইয়া তাঁহারা পেট ভরিয়া আসিবেন। দুঃখীরাম দীর্ঘনিঃশ্বাস ছাড়িয়া বলিল, ‘আহা, ওসব জিনিস যদি আমাকে কেহ এখন আনিয়া দিত!’ রাজা মহাশয় আহারে বসিয়াছেন, সোনার পাত্রে শত ব্যাঞ্জন সাজাইয়া তাঁহার সামনে রাখিয়াছে তাহার সুগন্ধে নাকে গেলে লম্বা লম্বা নিশ্বাস টানিতে ইচ্ছা হয়, জিভে জল আসে। হাত ধুইয়া সবে রাজামহাশয় খাইবার উপক্রম করিয়াছেন, অমনি থালাসুদ্ধ খাবার জিনিস কোথায় মিলাইয়া গেল! মন্ত্রীমহাশয়েরও ঐরূপ দশা হইল। এদিকে দুঃখীরামের আপে শেষ না হইতে না হইতেই তাহার সামনে রাজা ও মন্ত্রীর আহারের সমস্ত আয়োজন আসিয়া হাজির হইল। দুঃখীরাম তাহাতে কিছুতেই আশ্চর্য বোধ করিল না। তাহার খালি দুঃখ হইতে লাগিল, ‘হায় হাত পা বাঁধা!’ বলিতে বলিতে তখনি তাহার বাঁধন খুলিয়া গেল, সে এক লাফে উঠিয়া বসিয়া দু হাতে লুচি, মাংশ, পোলাও, পায়স, মেঠাই, মোণ্ডা মুখে পুরিতে লাগিল। প্রহরীরা ব্যাপার দেখিয়া এতক্ষণে হতবুদ্ধি হইয়া ছিল। হঠাৎ তাহাদের চৈতন্য হইল। একজন বলিল, ‘আরে ধর, পালাবে।’ আর একজন বলিল, ‘কোথায় আর পালাবে, আমরা এতজন চারধারে দাঁড়িয়ে আছি। আহা, বেচারার সামনে এত জিনিস এসেছে,একটু খেয়ে নিতে দে।’ ও কথা শুনিয়া সকলেই বলিল, ‘আহা, খাক্‌ খাক্‌! দুঃখীরাম ইহাতে কৃতার্থ হইয়া বলিল, ‘বাপুসকল, তোমরা রাজা হও।’ সেই রাজসভায় রাজার সিংহাসন ছিল। দেখিতে দেখিতে সেখানে তেমনি আরো হাজার সিংহাসন হইল। তারপর সকলেই রাজার মত বেশভূষা হইল, আর তাহারা এক-একটা সিংহাসনে উঠিয়া বসিল। রাজামহাশয় সভায় আসিয়া দেখেন, তাঁহার মতন ঢের রাজা সভায় বসিয়া আছে। তাহারা তাহাকে বলিল, ‘মহারাজ, উহাকে ছাড়িয়া দেওয়া হউক।’ রাজা আর কি করেন, এতগুলি রাজার অনুরোধ ঠেলিয়া ফেলা ত সহজ কথা নয়। কাজেই দুঃখীরাম তাড়াতাড়ি খালাস পাইল। এমন সময় মন্ত্রীমহাশয় আসিয়া উপস্থিত। তিনি এতগুলি রাজাকে একঠাঁই দেখিয়া একেবারে হতবুদ্ধি হইয়া গেলেন। যেদিকে চান সেই দিকেই রাজা, আর মন্ত্রীমহাশয় খালি দু হাতে সেলাম করেন। সেদিন পেটে ভাত অল্পই পড়িয়াছিল, তাহাও হাজার রাজাকে সেলাম করিতে করিতে কখন হজম হইয়া গেল। দুঃখীরামের কথা শুনিয়া মন্ত্রীমহাশয় যার পর নাই ব্যস্ত হইলেন। জোড়হাতে তিনি রাজাদিগকে অনুনয় করিতে লাগিলেন, ‘দোহাই ধর্মাবতারগণ, পুনরায় ইহার বিচার করিতে আজ্ঞা হয়। এমন দুষ্ট লোককে সহজে ছাড়িয়া দিবেন না, কখন কার সর্বনাশ করে তার ঠিক নাই।’ এই কথা শুনিয়া রাজাদের ভিতর হইতে একজন বলিল, ‘সর্বনাশটা যে কে করলে, তা ত বুঝতে পারছি না। আমি তোমার মেথর ছিলাম, আর আজ আমাকে রাজা করে দিয়েছে। এই এখনি তুমি দু হাতে আমাকে কত সেলাম করলে!’ মন্ত্রীমহাশয় আশ্চর্য হইয়া দেখিলেন, সত্যি সত্যি তাঁহার মেথর রাজা সাজিয়া বসিয়া আছে, আর তিনি তাহাকে সেলাম করিয়াছেন। ক্রমে দেখা গেল যে, যত রাজা বসিয়া আছে সকলেই কেহ সহিস,কেহ পাইক, কেহ দারোয়ান, কেহ দোকানী, কেহ ভিখারী। রাজামহাশয় আর মন্ত্রীমহাশয় লজ্জা রাখিবার আর স্থান পান না। রাজা তাড়াতাড়ি হুকুম দিলেন, ‘আবার বিচার হইবে, উহাকে ধর।’ কিন্তু কে ধরিবে? সবাই রাজা সাজিয়া বসিয়াছে, হুকুম খাটিতে কাহারো ইচ্ছা নাই, অগত্যা মন্ত্রীমহাশয়ই ধরিতে গেলেন। দুঃখীরাম তাহা দেখিয়া বলিল, “মন্ত্রীমহাশয়, অত কষ্ট করেন কেন? এই যে আমি হাজির আছি। কিন্তু আমার প্রাণদণ্ড হইলে আমাকে মারিবে কে? জল্লাদ যে রাজা হইয়া গিয়াছে। এখন আপনি আর রাজামহাশয় জল্লাদ হইলে তবে হয়।“ বলিতে বলিতে রাজা ও মন্ত্রীর সেই সুন্দর চেহারা আর জমকালো পোষাক কোথায় চলিয়া গেল, তাহার পরিবর্তে নেংটি-পরা, কুড়াল-হাতে, কালো ভূত দুই জল্লাদ জোড়হাতে হুকুমের অপেক্ষাকরিতে লাগিল। এখন হুকুম দেয় কে? দুঃখীরাম এতক্ষণে বুজিতে পারিয়াছে যে, যে কারণেই হউক, সে যে ইচ্ছা প্রকাশ করিতেছে, ঘটনায় তাহাই হইতেছে। ইচ্ছা করিলে এখন সে কি না করিতে পারিত। কিন্তু সে বলিল, ‘মহারাজ আপনার নুন খেয়েছি, আপনার নিকট অকৃতজ্ঞ হইব না। আপনার রাজত্ব আপনারই রহিল। এখন আমাকে বিদায় দিতে আজ্ঞা হউক।’ লজ্জায় রাজামহাশয় মাথা হেট করিয়া আছেন। দুঃখীরামের কথার তিনি আর কি উত্তর দিবেন। কেবল বলিলেন, ‘আমার সমস্ত রাজ্যই তুমি লইতে পারিতে, ইচ্ছা করিলে আমায় প্রাণেও মারিতে পারিতে। এখন তুমি যাহা বলিলে তাহাতে বুঝিলাম, তুমি মহৎ লোক। আমার অর্ধেক রাজ্য তোমার হউক, আমার কন্যাকে তুমি বিবাহ করিয়া সুখে রাজত্ব করো।’ দুঃখীরাম রাজকন্যাকে বিবাহ করিয়া পরমসুখে রাজত্ব করিতে লাগিল। আর-সকলের কি হইল? মন্ত্রীমহাশয়ের সম্বন্ধে দুঃখীরাম কিছু বলে নাই, সুতরাং তিনি জল্লাদই রহিয়া গেলেন। যাহারা রাজা হইয়াছিল, তাহাদের সম্বন্ধে এক নতুন মুশকিল উপস্থিত হইল। রাজা হইয়াছে বটে, কিন্তু এত রাজ্য কোথায় পাইবে? অথচ সকলেই বলে, ‘আমি রাজা হয়েছি যে, কাজ কেন করব?’ ইহাতে ভারি অসুবিধা হইতে লাগিল। দুঃখীরাম বলিল, ‘বাপুসকল, তোমাদের রাজা-টাজা হইয়া কাজ নাই, তোমরা যার যার যোগ্যতা অনুসারে কাজকর্ম কর গিয়া, আর সৎপথে থাকিয়া সুখে দিন কাটুক।’
উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী
দুষ্ট দানব উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী এক দানব আর এক চাষা, দুজনে পাশা খেলছিল। খোলায় চাষার হার হল। পাশায় হেরে চাষা হায় হায় করতে লাগল। খেলবার আগে সে বাজি রেখেছিল যে, সে হারলে দানব তার ছেলেটিকে নিয়ে যাবে। এখন উপায় কি হবে? দানব কিছুতেই ছাড়বে না। সে বলছে, ‘কালই এসে আমি ছেলে নিয়ে যাব। যদি তাকে রাখতে চাও, তবে এমন করে তাকে লুকিয়ে রেখে দাও, যাতে আমি খুঁজে বার করতে না পারি। খুঁজে পেলে কিন্তু আর তাকে ফেলে যাব না।’ হায়, কি বিপদ! ছেলেটিকে কোথায় লুকোবে? যেখানেই রাখুক, দানব নিশ্চয় তাকে খুঁজে বার করবে। চাষা ভেবে কিছু বুঝতে না পেরে শেষে দেবতার রাজাকে ডাকতে লাগল। দেবতার রাজা তাঁর দুঃখ দেখে দয়া করে বললেন, ‘তোমার কোনোচিন্তা নেই। আমি তোমার ছেলেটিকে এমন করে লুকিয়ে দেব যে দানবের বাবাও তাকে খুঁজে বার করতে পারবে না।’ এই বলে তিনি ছেলেটিকে গমের ক্ষেতে নিয়ে গিয়ে তাকে একটা ছোট্র গমের ভিতরে লুকিয়ে রাখলেন। তার পরদিন দানব এসে চাষার ঘরে, বাদগানে , পুকুরে, বাক্সে, উনুনে, হাঁড়িতে, হুঁকোর ভিতরে- কতই খুঁজল, কোথাও ছেলেটিকে দেখতে পেল না। কিন্তু সে এমনি দুষ্ট দানব ছিল- সে তখনি বুঝে নিল যে, তবে নিশ্চয় গমের ক্ষেতে গমের ভিতরে লুকিয়ে রেখেছে! অমনি সে কাস্তে নিয়ে গিয়ে ঘ্যাঁশ ঘ্যাঁশ করে গম কাটতে লাগল! সব গম কেটে, তারপর তার এক-একটি করে দানা হাতে নিয়ে উলটেপালটে দেখে, সে দুদণ্ডের মধ্যেই ধরে ফেলল যে, এই গমটার ভিতর চাষার ছেলে বসে আছে। আর- একটু হলেই সে সেই গমটার ভিতর থেকে ছেলেটিকে বার করে নিয়ে যেত এর মধ্যে দেবতার রাজা এসে তার হাত থেকে সেটা কেড়ে নিয়ে ছেলেটিকে তাড়াতাড়ি চাষার হাতে দিয়ে বললে, ‘আমর যা সাধ্য, আমি তা করেছি। এর বেশি আর পারব না।’ দানব ছেলেটিকে নিতে না পেরে ভারি চটে বলল, ‘বটে, আমাকে ফাঁকি দিলে? সে হবে না, আমি কাল আবার আসব।’ দেবতার রাজা যখন পারলেন না, তখন চাষা আলোর দেবতার কাছে গেল। আলোর দেবতা এসে তার ছেলেটিকে একটি রাজহাঁসের গলায় পালক বানিয়ে রেখে দিলেন। কিন্তু তাতে কি সে দানবকে ঠকাবার জো আছে? সে এসেই হাঁসের গলা ছিঁড়ে সে পালকটি সুদ্ধ তাকে মুখে দিতে গিয়েছে। ভাগ্যিস পালকটি তখন তার ঠোঁটে লেগে রইল, নইলে আর উপায়ই ছিল না। পালকাটকে দানবের ঠোঁটে লাগতে দেখেই আলোর দেবতা সেটিকে উড়িয়ে নিয়ে চাষার কাছে পৌঁছে দিলেন, আর বললেন, ‘আমি আর কিছু করতে পারব না।’ দানব সেদিনও ঠকে গেল, কিন্তু যাবার সময় বলে গেল, ‘কাল আবার আসব।’ দেবতার রাজা হেরে গেলেন, আলোর দেবতা হেরে গেলেন। তখন আগুনের দেবতাকে ডেকে বলল, ‘ঠাকুর! আপনি আমার ছেলেটিকে বাঁচান!’ আগুনের দেবতা তখন ছেলেটিকে সমুদ্রে নিয়ে একটা মাছের পেটের মধ্যে তার একটি ডিমের ভিতরে লুকিয়ে রাখলেন। দানব নিন্তু এর সবই টের পেয়েছে, আর তাই এবারে সে ছিপ নিয়ে তয়ের হয়ে এসেছে।‌ সমুদ্রে কত কোটি কোটি মাছ, তার ভিতর থেকে সে সেই ডিমটাকে দেখতে দেখতে খুঁজে বার করল। তখন আগুনের দেবতা সেই ডিমটি তার হাত থেকে ছিনিয়ে নিয়ে চুপিচুপি ছেলেটিকে বললেন, ‘শিগগির ঘরে পালিয়ে যা, ভেতরে ঢুকেই দরজা বন্ধ করে দিস।’ এ কথা তখন দানব শুনতে পায় নি। তারপর ছেলেটি পালিয়ে অনেক অনেক দূরে গেলে সে তাকে দেখতে পেল। অমনি ঘোঁত করে লাফিয়ে উঠে সে তার পিছু পিছু ছুটল। কিন্তু ছেলেটি ততক্ষণে ঘরে ঢুকে গিয়েছে। দানবটা তাকে ধরবার জন্য তাড়াতাড়ি গেল সেই ঘরে ঢুকতে। সে জানত না যে আগুনের দেবতা এর আগেই কখন সেই ঘরের দরজায় তিনহাত লম্বা এক লোহার খোঁচ বসিয়ে রেখেছেন। দানব রাগে ভূত হয়ে ঘরে ঢুকবার সময় সেই খোঁচ আগাগোড়া গেল তার মাথায় ঢুকে। তখন সে ভয়ানক চেঁচিয়ে চিৎপাত হয়ে পড়ে যেতেই আগুনের দেবতা ছুটে এসে তার একটা পা কেটে ফেললেন। কিন্তু পা কাটলে কি তহবে? দুষ্ট দানব তাকে কি জাদুই করে রেখেছে- সেই কাটা পা তখনি এসে আবার জোড়া লেগে গেল! যা হোক, আগুনের দেবতা সেই দানবের থেকে বড় জাদুকর ছিলেন্‌ তিনি জানতেন যে কাটা জায়গায় লোহা আর পাথর ফেলে দিলে আর তা জোড়া লাগতে পারে না। কাজেই তিনি তাড়াতাড়ি দানবের আর একটা পা কেটেই লোহা আর পাথর দিয়ে কাটা জায়গা চাপা দিয়ে ফেললেন। তখন আর দানবের জাদু খাটল না, দেখতে দেখতে তার প্রাণ বেরিয়ে গেল। তখন ত চাষার খুবই আনন্দ হল। সে আগুনের দেবতাকে কত প্রণাম যে কারল, তা গুণে শেষ করা যায় না। তারপর থেকে সে সকলকে বলত যে, এই দেবতাটির মত দেবতা নেই।
উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী
নরওয়ে দেশের পুরান উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী আমাদের দেশের পুরাণে যেমন দেবতা আর অসুরের গল্প আছে, পুরাতন নরওয়ে আর সুইডেন দেশের পুরাণেও তেমনি সব দেবতা আর অসুরের কথা লেখা আছে। নরওয়ের পুরাণে আছে, সেকালের আগে যখন পৃথিবী বা সমুদ্র বা বায়ু কিছুই ছিল না-তখন কেবল বিশ্ব-পিতা (All Father) ছিলেন। তাঁহাকে কেহ সৃষ্টি করে নাই, কেহ তাঁহাকে দেখিতে পায় না। তিনি যাহা চাহেন, তাহাই হয়। সৃষ্টির আগে চারিদিকে শূন্য আর অকার ছিল, সেই শূন্যের মাঝখানে ছিল গিন্নুঙ্গা নামে গহ্বর। সেই গহ্বরের উত্তরে কুয়াশার দেশ, তাহার মাঝখানে হ্নরগেল্‌মির নামে ঝরণার জল টগবগ করিয়া ফুটিত। সেই গ্‌হবরের দক্ষিন মস্পেল্‌স্‌হাইম্‌ অথাৎ আগুনের দেশ, সুৎর্র্‌ নামে বিশাল দৈত্য জ্বলন্ত তলোয়ার হাতে সেই দেশে পাহারা দিত। সেই যে গিন্নুঙ্গা নামে গহ্বর, তাহার ভিতরটা ছিল বড়ই ঠাণ্ডা। হ্নরগেল্‌মির ঝরণার জল তাহাতে পড়িয়া বরফ হইয়া যাইত, সুৎর্রের তলোয়ার হইতে আগুনের ফিনকি পড়িয়া সেই বরফকে গলাইয়া দিত। সেই আগুন আর বরফের লড়াই হইতে গিন্নুঙ্গা গহ্বরের ভিতরে য়ীমির নামক অতি ভীষণ দৈত্য আর আধম্‌লা নামে গাছ জন্মাইল। য়ীমির আধম্‌লাকে পাইয়া তাহার দুধ খাইতে লাগিল, আর আধম্‌লা আশেপাশের বরফে লবনের গন্ধ পাইয়া তাহাই চাটিতে আরম্ভ করিল। চাটিতে চাটিতে সেই বরফের ভিতর হইতে একটি দেবতা বাহির হইলেন, তাঁহার নাম বুরি। এই য়ীমির হইতে অসুর আর বুরি হইতে দেবতাগণের জন্ম, আর জন্মাবধিই অসুর আর দেবতার বিবাদ। যুগযুগ ধরিয়া সেই বিবাদ চলিতে থাকে, শেষে অনেক যুদ্ধের পর দেবতারা য়ীমিরকে মারিয়া ফেলেন। আর যত অসুর ছিল, য়ীমিরের রক্তের বন্যায় সকলেই ডুবিয়া মরে, বাকি থাকে কেবল বার্গেল্‌মির আর তাহার স্ত্রী। এই দুজনে একখানি নৌকায় করিয়া সকল জায়গার শেষে একেবারে ব্রহ্মাণ্ডের কিনারায় গিয়া ঘর বাঁধিল। সেই স্থানের নাম হইল ‘জোতন্‌হাইম’ বা দৈত্যপুরী। সেই দৈত্যপুরীতে অসুরের বংশ বাড়িতে লাগিল, দেবতা অসুরের বিবাদও আবার জাগিয়া উঠিল। এদিকে অসুরেরা সব মরিয়া যাওয়াতে দেবতারা কিছুদিনের জন্য যেন একটু আরাম পাইলেন। তখন তাঁহাদের মনে হইল যে, চারিদিকে কেবলই শূন্য আর কুয়াশা আর আগুন আর বরফের লড়াই দেখিতে একটুও ভাল লাগে না। তাই তাঁহারা সকলে মিলিয়া যুক্তি করিলেন যে, চলো আমরা য়ীমিরের দেহ হইতে গাছ-পালা নদ-নদী আর পাহাড় পর্বতের সৃষ্টি করি। এই বলিয়া তাঁহারা য়ীমিরের বিশাল দেহটাকে সকলে মিলিয়া গড়াইয়া গিন্নুঙ্গা গহ্বরে নিয়া ফেলিলেন। তাহাতে গহ্বর বুজিল, এই সৃষ্টি রাখিবার একটা জায়গাও জুটিল। য়ীমিরের রক্তে সমুদ্র ত আগেই হইয়াছিল, উহার মাংশে মাটি গড়িতেও বেশী বেগ পাইতে হইল না, হাড় আর দাঁত হইল পাহাড়-পর্বত, চুল-দাড়ি হইল গাছপালা, মাথার খোলটা হইল আকাশ, মগজগুলি হইল মেঘ, কাছেই আগুনের দেশ ছিল, সেখানে সেই সুৎর্র্‌ নামক দৈত্য থাকিত-সেইখানকার আগুনের ফিনকি দিয়া চন্দ্র সূর্য আর তারা হইল। এদিকে কিন্তু য়ীমিরের মাংশ পচিয়া তাহাতে পোকা ধরিয়াছে। দেবতারা ভাবিলেন, ‘তাই ত, এই পোকাগুলিকে কি করা যায়? এগুলি হইবে পরী, ভূত আর বামন।’ পরীরা দেখিতে ভারি সুন্দর; তাহারা আকাশ অঅর পৃথিবীর মাঝখানে থাকে, চাঁদের আলোতে খেলা করে, প্রজাপতির পিঠে চড়িয়া ফুলগুলিকে ফুটাইতে আসে, আর নানামতে লোকের উপকার করে। ভূত আর বামনগুলি দেখিতে যেমন বিশ্রী তেমনি দুষ্টু। তাহারা মাটির নীচে থাকে, সোনা-রূপা মনি-মানিকের সন্ধান রাখে, আর লোকের মন্দ করিতে রাত্রে বাহিরে আসে। দিনে তাহাদের মাটির উপরে আসিবার হুকুম নাই, আসিলে পাথর হইয়া যায়। সকলের মাঝখানে দেবতারা আগেই তাঁহাদের নিজের থাকিবার জায়গা রাখিয়াছিলেন। সেই জায়গার নাম আসগার্ড বা স্বর্গ। সেখানকার রাজা ছিলেন বিশ্ব-পিতা। তাঁহার নাম ওডিন (Odin) বা উওডেন (Woden) যাহা হইতে বুধবারের নাম ওয়েডনেজ ডে হইয়াছে। ইঁহা হইতেই সকল দেবতা আর মানুষের জন্ম। ইঁহার নাম বিশ্ব-পিতা। স্বর্গের সকলের চেয়ে উঁচু সিংহাসনে ওডিন তাঁহার রানী ফ্রিগ্‌গার (Frigga) সহিত বসিয়া স্বর্গ মর্ত পাতাল কোথায় কি হইতেছে তাহার সংবাদ লইতেন। কিছুই তাঁহার চোখ এড়াইতে পারিত না। ওডিনের একটিমাত্র চোখ ছিল, আর একটি চোখ তিনি মিমির নামে এক বুড়োকে দিয়াছিলেন। সেই বুড়ার একটা ঝরণা ছিল, তাহার জল খাইলে ভূত ভবিষৎ সকল বিষয় জানা যাইত। ওডিন সেই ঝরণার জল খাইতে গেলেন। বুড়া বলিল, ‘তোমার একটি চোখ না দিলে জল খাইতে পাইবে না।’ কাজেই একটি চোখ খুলিয়া দিয়া ওডিনকে সেই জলের দাম দিতে হইল। বুড়া সেই চোখটি নিয়া তাহার ঝরণার জলে ডুবাইয়া রাখিল। সেখানে সেটি দিনরাত ঝিকমিক করিত। ওডিন ঝরণার জল খাইয়া সকলের চেয়ে বেশী জ্ঞানী হইলেন। আর সেই ঘটনার চিহ্ন রাখিবার জন্য ঝরণার ধারে গাছের ডাল দিয়া একটা বল্লম তয়ের করাইয়া লইলেন। সে এমনি আশ্চর্য বল্লম যে কিছুতেই তাহাকে ঠেকাইতে পারিত না। ওডিনের এক পুত্রের নাম টিউ (Tiu)। ইহার নামে মঙ্গলবারের নাম টিউজ ডে (Tuesday) হইয়াছে। ইনি বীরত্ব এবং যুদ্ধের দেবতা। ওডিনের যেমন একটা আশ্চর্য বল্লম ছিল, ইহার তেমন একটা তলোয়ার ছিল। লোকে এই তলোয়ারকে বড়ই ভক্তি করিত, আর যার পর নাই যত্নে এক মন্দিরের ভিতরে তাহা রাখিয়া দিত। তাহাদের বিশ্বাসই ছিল যে, এই তলোয়ার যাহার কাছে থাকিবে সে কখনো যুদ্ধে হারিবে না। কিন্ত হায়! একদিন কে সেই তলোয়ার লইয়া অনেকে পৃথিবী জয় করিয়াছে, আবার সেই তলোয়ারেই তাহারা মারা গিয়াছে। এমনি করিয়া তাহার দ্বারা কত কাণ্ড হইল। কিন্তু টিউর ঘরে আর তাহা ফিরিয়া আসিল না। ওডিনের আর-এক পুত্র থরের (Thor) নামে ইংরেজী থার্সডে (Thursday) হইয়াছে। থরের মত জোর কোনো দেবতার ছিল না, দেখিতেও কেহ তাঁহার মত এমন বিশাল ছিলেন না। তাঁহার হাতুড়ি দিয়া যাহাকেই তিনি ঠাই করিয়া মারিতেন, সে পাহাড়ই হউক, আর পর্বতই হউক, তখনই গুঁড়া হইয়া যাইত। স্বর্গে বাইফ্রেস্ট্ নামে বিচিত্র সেতু আছে (যাহাকে তোমরা বল রামধনু) সেই সেতুর উপর দিয়া দেবতারা যাওয়া আসা করিতেন। অর্থাৎ আর সকল দেবতারাই করিতেন-কিন্তু থর্‌ কখনো সেই সেতুর উপর দিয়া যাইতেন না, গেলে তাহা ভাঙ্গিয়া পড়িত। ফ্রাইডে (Friday, শুক্রবার) যাঁহার নামে হইয়াছে, তাঁহার নাম ছিল ফ্রিয়া (Freya)। তিনি ছিলেন সৌন্দর্যের দেবতা। কেহ বলে, ইনিই ওডিনের রানী ফ্রিগ্‌গা। যুদ্ধে যত বীরের মৃত্যু হইত, তাহাদের অর্ধেক ফ্রিয়ার কাছে যাইত। ফ্রিয়া তাহার সঙ্গিনী ভ্যাল্‌কীরদিগকে লইয়া সেই বীরদিগকে নিতে যুদ্ধ ক্ষেত্রে আসিতেন। তাঁহার সভায় গিয়া বীরদিগের সুখের আর সীমা পরিসীমা থাকিত না। সেখানে হাইদ্রুন্‌ নামে ছাগল ছিল, তাহার দুধ ছিল অমৃতের মত, সে দুধ দোওয়াইয়া শেষ করা যাইত না। আর সেহ্রিম্‌নির নামে যে শুয়োরটি ছিল, তাহার মাংশও ছিল তেমনি মিষ্ট। এলধ্রিম্‌নির নামে পাচক তাহা ততোধিক মিষ্ট করিয়া রাঁধিত। বীরের ক্ষুধা-বুঝিতেই পার, তাহারা খাইত কেমন! কিন্তু সে মাংশ কিছুতেই ফুরাইত না। খাওয়া দাওয়া শেষ হইয়া গেলে আবার যেমন শুয়োর তেমনটি বাঁচিয়া উঠিয়া ঘোঁত্‌ ঘোঁত্‌ করিতে থাকিত।
উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী
নুতন গল্প উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী এক রাজা, তার তিন ছেলে। বড় ছেলে গাঁজা খায়, মেজ ছেলে লাঠি হাতে ঘুরিয়া বেড়ায়, ছোট ছেলে বাপের কাছে বসিয়া রাজ্যের কাজকর্ম দেখে। বড় দুটো ছোটটিকে দেখিতে পারে না। ‘সোনার গাছ রূপোর পাতা, শ্বেত কাকের বাসা তাতে!’ রাজার বড় ইচ্ছা এই গাছ ছেলেরা আনিয়া দেয়। তিন ছেলে কত জায়গায় ঘুরিল। বড় দুটির কি হইল জানা গেল না, ছোটটি ঘুরিয়া ঘুরিয়া এক রাজার বাড়িতে যাইয়া উপস্থিত। সেখানে জন-প্রাণী কিছুই নাই, সব খালি। এক ঘরে একটি মেয়ে ঘুমাইয়া আছে; তার মাথার কাছ রূপোর কাঠি, পায়ের কাছে সোনার কাঠি। সে পায়ের কাঠিটি মাথায় আনিল আর মাথার কাঠিটি পায়ের দিকে লইল, অমনি মেয়েটি জাগিয়া উঠিয়া তাহাকে বলিতে লাগিল, ‘হায়! মানুষের ছেলে তুই এখানে কেন এলি? তোকে এখনি খেয়ে ফেলবে। এ বাড়িতে রাক্ষস থাকে। আমার বাবাকে খেয়েছে, মাকে খেয়েছে, বাড়ির সকলকে খেয়েছে, সেদিন দুটি রাজার ছেলে ‘সোনার গাছ রূপোর পাতা, শ্বেত কাকের বাসা তাতে’ এই গাছ নিতে এসেছিল, তাদেরও খেয়েছে। আমাকে যে কোন খায় নি জানি নে।’ সে বুঝিতে পারিল যে মেয়ে তাহার দুই দাদার কথাই কহিতেছে। তাহার সঙ্গে আলাপ করিয়া কত কথাই জানিয়া লইল। রাক্ষসগুলি সহজে মরিবে না, তবে যদি কেহ ঐ পুকুরের তলায় যে স্ফটিকের স্তম্ভ আছে, সেটাকে এক নিশ্বসে ডুব দিয়া তুলিতে পারে, তারপর তাহাকে ভাঙ্গিয়া তাহার ভিতরে যে ভ্রমরটি আছে, তাহাকে মারিয়া ফেলিতে পারে, তবে ঐগুলি মরিবে। রাক্ষসেরা যত লোককে খাইয়াছে, তাহাদের হাড়গুলি সবই রাখিয়া দিয়াছে। যদি কেহ রাক্ষসগুলি মারিয়া তারপর ঐ হাড়গুলিতে এই সোনার কাঠি এবং রূপোর কাঠি ধোওয়া জল ছড়াইয়া দিতে পারে, তবে ঐ-সকর লোক বাঁচিয়া উঠিবে। রাজার ছেলে এই কথা শুনিয়া একদিন রাক্ষসদের অনুপস্থিতিতে এই-সকল কার্য সাধন করিল। রাক্শসও মারিল, ভাইদেরও বাঁচাইল। আরো এক গল্প শুনিয়াছি। রাজার মেয়ে মরিয়া গেল, মুনি-ঠাকুর আসিয়া রজার নিকট বলিলেন, ‘রাজা, তোমার মেয়েকে আমি বাঁচাইয়া দিতেছি। আমাকে একটা বড় কড়া দাও, একটা টেবিল দাও, একটা ছুড়ি দাও, আর জল ও আগুন দাও।’ রাজা সকলই দিলেন। মুনি-ঠাকুর সেই মড়াটাকে কড়াতে সিদ্ধ করিয়া তার মাংসগুলি ফেলিয়া দিলেন। পড়ে হাড়গুলি পরিষ্কার করিয়া টেবিলে রাখিয়া তাহাতে মন্ত্রপূর্বক জল ছড়াইয়া দিলেন, আর অমনি যে মেয়ে ছিল সেই মেয়ে হইয়া উঠিল। এ-সব ত গেল গল্প। সত্যি মড়া বাঁচাইতে দেখিয়াছ? দেখি নাই, কিন্তু শুনিয়াছি। চোরাসান্নিপাত রোগে যাহারা মরে, তাহাদের অনেককে দেশীয় শাস্ত্রীয় কবিরাজেরা বাঁচাইয়াছেন, এরূপ গল্প অনেকের মুখে আমি শুনিয়াছি। একখানি ইংরেজি কাগজে নিম্নলিখিত গল্পটি পড়িয়াছি- ‘বিলাতের একজন ডাক্তার একটি ছোট কুকুরের গরার শিরা কাটিয়া দিলেন। কুকুরটি দেখিতে দেখিতে রক্ত পড়িয়া মরিয়া গেল। মরিয়া গেলে পর তিন ঘন্টা কাল একটি ঘরে কুকুরটিকে রাখিয়া দেওয়া হইল। কুকুরটি শক্ত হইয়া গেল। তারপর তাহাকে গরম জলে ফেলিয়া ক্রমাগত মাজিয়া দেওয়া হইল। হাত-পাণ্ডলি অনেকক্ষণ নাড়িয়া চাড়িয়া দিলে পর শরীরটা যেন বেশ নরম হইল। তারপর সাহেব একটা রবারের নল দিয়া তাহার পেটে তিন ছটাক রক্ত পুরিয়া দিলেন। একটা নল দিয়া কৃত্রিম নিশ্বাস করান হইতে লাগিল এবং একটা বড় কুকুরের রক্ত ঐ ছোট কুকুরটির গায়ে প্রবেশ করাইয়া দেওয়া হইল। এই-সকল কার্য একবারে হইতে লাগিল। অর্থাৎ একজন সাহেব নিশ্বাস প্রশ্বাস করাইতে লাগিলেন, একজন রক্ত দিতে লাগিলেন আর-একজন তাহার শরীরটা মাজিতে লাগিলেন। ক্রমে কুকুরটি চক্ষু সতেজ হইল, আর কয়েক মুহূর্ত পরে শরীরটা একটু একটু কাঁপিতে লাগিল। তারপর কুকুরটি হাঁপাইতে লাগিল, চক্ষু উজ্জ্বল হইল, শেষে ফিট হইলে যেমন হয়, সেইরূপ করিতে লাগিল। তারপর ক্রমেই শান্ত হইয়া আসিতে লাগির, একটু একটু কোঁকাইতেও লাগিল। প্রথম রক্ত দেওয়ার কুড়ি মিনিটের মধ্যে কুকুরটি উঠিয়া বসিল। শীঘ্রই দাঁড়াইয়া তারপর হাঁটিতে লাগিল। দুই দিনের মধ্যে সে রাস্তায় দৌড়িয়া বেড়াইতে লাগিল।’ ‘সাহেবদের গরু বাছুর মারিতে আপত্তি নাই, সুতরাং ডাক্তার মহাশয় একটি বাছুরকেও ঐরূপ করিয়া দেখিলেন। সেও বাঁচিল। আর একটি ছোট কুকুরকে জলে ডুবাইয়া মারিয়া আবার ঐ প্রণালীতে বাঁচাইয়া দিলেন।’ আমরা ছোট-খাট রকমে একপ্রকার মরা জানোয়ার বাঁচাইয়াছি। সে হয়ত পাঠকগণের মধ্যে সকলেই এক-এক বার করিয়া থাকিবেন। মাছিগুলিকে দু-একটা চড় চাপড় মারিলেই তাহারা মরিয়া যাইতে রাজি হয়। একটি মাছিকে ঐরূপ করিয়া তাহাকে সহজেই পুনরায় বাঁচান যাইতে পারে। মাছিটিকে এক হাতে রাখিয়া আর-এক হাত দিয়া তাহার উপর একটি ঘর নির্মাণ করিয়া দাও। ঘরের একটি ছোট দরজা রাখিয়া তাহার মধ্যে দিয়ে খুব ফুঁ দিতে থাক। দেখিবে, শীঘ্রই মাছিটি বাঁচিয়া উঠিবে। আমাদের দেশের কথা শুনিয়াছি, সর্পঘাতে মরা লোকগুলিকে তিন দিন পরে ওঝা আসিয়া মন্ত্র পড়িয়া বাঁচাইয়া দিতে পারে। সত্য মিথ্যা শপথ করিতে পারি না।
উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী
পণ্ডিতের কথা উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী সেই যে হবুচন্দ্র গবুচন্দ্র মন্ত্রী ছিল, সেই হবুচন্দ্র রাজার একটা ভারি জবর পণ্ডিতও ছিল। তার এতই বুদ্ধি ছিল যে, তার পেটে অত বুদ্ধি ধরত না। তাই তাকে দিন রাত নাকে কানে তুলোর ঢিপ্‌লী গুঁজে বসে থাকতে হত, নইলে বুদ্ধি বেরিয়ে যেত। তুলোর ঢিপ্‌লী গুঁজত বলে নাম হয়েছিল ‘ঢিপ্‌লী’ পণ্ডিত। একদিন হয়েছি কি, হবুচন্দ্রের দেশের জেলেরা একটা এঁদো পুকুরে জাল ফেলতে গিয়েছে। সেই পুকুর কোত্থেকে একটা শূয়র এসে ঝাঁঝি পাটার ভিতরে গা ঢাকা দিয়েছিল। জেলেরা জাল ফেলতেই সে গিয়েছে তার মধ্যে আটকে, তারপর জাল টেনে তুলে সেই শূয়র দেখতে পেয়েই ত জেলেরা ভারি আশ্চর্য হয়ে গিয়েছে। তাদের দেশে আর কেউ কখনো এমন জানোয়ার দেখে নি। তারা কিছুতেই ভেবে ঠিক করতে পারল না, এটা কি জানোয়ার। তারা জাল দিয়ে কত বড় বড় শাল, বোয়াল, কচ্ছপ ধরেছে, কিন্তু এমন জানোয়ারের কথা ত কখনো শোনে নি। যা হোক তারা ঠিক করল যে রাজা হবুচন্দের সভায় নিয়ে এটাকে দেখাতে হবে। এই বলে সেই শূয়রটাকে খুব করে জাল দিয়ে জড়িয়ে তারা রাজার সভায় নিয়ে এল। রাজা তার ছটফটি দেখে দেখে আর চ্যাঁচানি শুনে বললেন, ‘বাপ্‌ রে। এটা-আবার কি জন্তু?’ সভার লোকেরা কেউ সে কথার উত্তর দিতে পারল না। যে-সব পণ্ডিত সেখানে ছিল, তারা দু দল হয়ে গেল। কয়েকজন বললে, ‘গজয়’, অর্থাৎ হাতি ছোট হয়ে গিয়ে এমন হয়েছে। কেউ বললে, ‘মূষা বৃদ্ধি’, অর্থাৎ ইঁদুর বড় হয়ে এমনি হয়েছে। এখন এ কথার বিচার ঢিপাই ছাড়া আর কে করবে? কাজেই রাজা তাকে ডেকে পাঠালেন। ঢিপাই এসে অনেকক্ষণ ধরে সেই শূয়রটাকে দেখ বলল, ‘আরে তোমরা কেউ কিছু বোঝ না। এটাকে জলে ছেড়ে দাও। যদি ডুবে যায়, তবে এটা মাছ। যদি উড়ে পালায় তবে পানকৌড়ি। আর যদি সাঁতরে ডাঙ্গায় ওঠে, তা হলে কচ্ছপ, না হয় কুমির।’ তখন সভার লোকেরা ভারি খুশি হয়ে বলল, ‘ভাগ্যিস ঢিপাই মশাই ছিলেন, নইলে এমন কথা আর কে বলতে পারত।’ আমরা ছেলেবেলায় এই ঢিপাইয়ের গল্প শুনতাম।এইরূপ এক-একটা পণ্ডিত বা পাড়াগেয়েঁ বুদ্ধিমানে গল্প অনেক দেশেই আছে, তার দু-একটি নমুনা শোন। ঢিপাইয়ের যে ছেলে, সেও বড় হয়ে তার বাপের মতন বড় পণ্ডিত হয়েছিল। তার গ্রামের লোকেরা একটা কিছু জানতে হলেই তার কাছে আসত। এর মধ্যে একদিন রাত্রে তাদের গ্রামের ভিতর দিয়ে একটা হাতি গিয়েছে। ভাবনা হল, না জানি এ-সব কিসের দাগ, আর না জানি তাতে কি হবে। তারা এর কিছুই বুঝতে না পেরে শেষে ঢিপাইয়ের ছেলেকে নিয়ে এল। সে এসে অনেক ভেবে বললে, ‘ওহ্‌! বুঝেছি রাত্রে চোর এসে উঘ্‌লি নিয়ে গেছে। সে বেটা বারবার বসেছিল, তাইতে উঘ্‌লির তলায় দাগ পড়েছে।’ কাশীর ওদিকে এমনি একটা পণ্ডিতের গল্প আছে, সেই পণ্ডিতের নাম ছিল ‘লাল বুঝগ্‌র।’ সে এমনি হাতির পায়ের দাগ দেখে বলেছিল- ‘লাল বুঝগ্‌গর সব সম্‌ঝো আউর না সমঝো কোই, চার পয়ের মে চক্‌কর বাঁধকে হরণা কূদে হোই।’ অর্থাৎ লাল বুঝগ্‌গর সব বুঝতে পারে, আর কেউ বুঝতে পারে না; চার পায়ে জাঁতা বেধে হরিণ ছুটে গিয়েছে। তুরস্ক দেশেও এমনি একটি বেজায় বুদ্ধিমান লোক ছিল। একবার একটা উট দেখে একজন তাকে জিজ্ঞাসা করল, ‘মশায়, এটা কি জন্তু?’ বুদ্ধিমান বললে, ‘তাও জান না? খরগোশ হাজার বছরের বুড়ো হয়েছে, তাইতে তার এমনি চেহারা হয়ে গিয়েছে।’ কথাটা কিন্তু নিতান্ত মন্দ বলে নি, খরগোশ যদি হাজার বছর বেঁচে থাকতে পারত, আর সেই হিসাবে তার নাক তুবড়ে গাল বসে মুখ লম্বা হয়ে আসত, তবে তার অনেকটা উটের মত চেহারা হত বইকি! পাঞ্জাবে এক বুদ্ধিমান বুড়োর কথা আছে, সে বেশ মজার। গ্রামের মধ্যেই সেই লোকটি সকলের চেয়ে বুড়ো আর বুদ্ধিমান, আর সব বড্ড বোকা। একদিন রাত্রে সেই গ্রামের ভিতর দিয়ে একটা উট গিয়েছিল। সকালে উঠে তার পায়ের দাগ দেখে কেউ বুঝতে পারছে না যে, কিসের দাগ। শেষে তারা সেই বুড়োর কাছে গিয়ে বলল, ‘দেখ ত এসে বুড়ে দাদা, এ-সব কিসের দাগ?’ বুড়ো দাদা সঙ্গে সঙ্গে এসে এই উটের পায়ের দাগগুলো দেখে খানিক হাউ হাউ কাঁদল, তারপর হিহি হিহি করে হেসে ফেলল। তাতে সকলে ভারি আশ্চর্য হয়ে বললে, ‘তুমি কাঁদলে কেন দাদা?’ বুড়ো বললে, ‘কাঁদব না? হায় হায়। আমি মরে গেলে তোরা কার ঠেঞে এ-সব কথা জিজ্ঞেস করবি?’ তাতে সকলে ভারি দুঃখিত হয়ে বলরে, ‘আহা, টিক বলেছ দাদা। তুমি না থাকলে আর কাকে জিজ্ঞাসা করব? তুমি আবার হাসলে কেন?’ বুড়ো বলল, ‘হাসব না? হাঃ হাঃ হা-হা-আ-আ, আরে আমিও যে বুঝতে পারলুম না, এ ছাই কিসের দাগ। হাঃ হাঃ হা-হা-আ-আ-আ।’ আর দু-ভাইয়ের কথা বলে শেষ করি। এক গ্রামে অনেক চাষা ভুষো থাকে, তাদের সকলের কিছু কিছু টাকা কড়ি আছে, কিন্তু তাদের কেউ কখনো লেখাপড়া শেখে নি। সেজন্য তারা বড়ই দুঃখিত। একদিন তারা সবাই মিলে যুক্তি করল, ‘চল আমরা দুটি ছেলেকে শহরে পাঠিয়ে লেখাপড়া শিখিয়ে আনি। আমাদের গ্রামে একটাও পণ্ডিত নেই, কেমন কথা?’ এই বলে তারা তাদের গ্রামের মোড়লের দুটি ছেলেকে শহরে পাঠিয়ে দিল। তাদের বলে দিল, ‘তোরা বিদ্যে শিখে পণ্ডিত হয়ে আসবি।’ তারা দু ভাই শহরে চলেছে, পথে পাশে যা কিছু দেখছে, কোনটারই খবর নিতে ছাড়ছে না। এক জায়গায় গাছতলায় একটা হাতি বাঁধা ছিল, তাকে দেখে তারা ভারি আশ্চর্য হয়ে পথের লোককে জিজ্ঞাসা করল, ‘এটা কি ভাই?’ তারা বলল, ‘এটা হাতি।’ তা শুনে দু ভাই ভারি খুশি হয়ে বলল, ‘বাঃ এরি মধ্যে ত এক বিদ্যা শিখে ফেলুলম-হাতি, হাতি হাতি।’ তারপর শহরের কাছে এসে মন্দির দেখতে পেয়ে তারা একজনকে জিজ্ঞাসা করল, ‘এটা কি ভাই সে বলল, ‘এটা মন্দির।’ তাতে দু ভাই বলল, ‘মন্দির মন্দির, মন্দির, বাঃ, আরেক বিদ্যে শেখা হল।’ বলতে বলতে তারা বাজারের ভিতর দিয়ে চলেছে। বাজারে মাছ, তরকারি, ডাল, চাল সবই আছে, আর সবই তারা চেনে, খালি আলু আর কখনো দেখে নি। সেই জিনিসটার দিকে তারা অনেকক্ষণ হাঁ করে চেয়ে রইল, তারপর আলুওয়ালাকে জিজ্ঞাস করল, ‘এগুলো কি ভাই?’ সে তাতে রেগে বলল, ‘কোথাকার বোকা? এ যে আলু তাও জান না?’ তারা দু ভাই সে কথার কোন উত্তর না দিয়ে খালি বলতে লাগল, ‘আলু, আলু, আলু।’ তখন তাদের মনে হল ‘ইস, আমরা কত বড় পণ্ডিত হয়ে গেছি, একটা বিদ্যে শিখলেই তাকে পণ্ডিত বলে। আর আমরা দেখতে দেখতে তিনটে বিদ্যে শিখে ফেললুম। আর কি, এখন দেশে ফিরে যাই।’ কাজেই তারা গ্রামে ফিরে এল। তারপর থেকে তারা পালকি ছাড়া চলে না, গ্রামের লোক তাদের দেখলেই দণ্ডবৎ করে আর বড় বড় চোখ করে বলে ‘বাপ রে, তিন মুখো পণ্ডিত হয়ে এসেছে।’ এমনি করে কয়েক বছর চলে গেল। তারপর একদিন হয়েছে কি, সেই গ্রামে কোত্থেকে এসেছে এক হাতি। গ্রামের লোক তাকে দেখেই ত আগে ছুটে পালাল। তারপর অনেক দূর থেকে উঁকি ঝুঁকি মেরে তাকে দেখতে লাগল, কিন্তু কেউ বলতে পারল না, এটা কি। শেষে একজন বলল, ‘শিগ্‌গির পণ্ডিতমশাইদের ডাক।’ তখনি পালকি ছুটল পণ্ডিতদের আনতে। তারা এসে চশমা এঁটে অনেকক্ষণ ধরে হাতিটাকে দেখল, বড় ভাই বলল, ‘এটা মন্দির।’ ত শুনে ছোট ভাই বলল, ‘দাদার যে কথা! এত টাকা দিয়ে বিদ্যে শিখে এসে শেষে কিনা বলছে, এটা মন্দির। আরে না না, এ মন্দির। আরে না না, এ মন্দির নয়, এটা আলু। আলু।’
উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী
পাকা ফলার উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী পাড়াগাঁয়ে এক ফলারে বামুন ছিল। তাহাকে যাহারা নিমন্ত্রণ করিত, তাহারা সকলেই খুব গরিব, দৈ-চিঁড়ের বেশি কিছু দিবার ক্ষমতা তাহাদের ছিল না। ব্রাহ্মণ শুনিয়াছিল, দৈ-চিঁড়ের ফলারের চাইতে পাকা ফলারটা ঢের ভাল। সুতরাং এরপর যে ফলারের নিমন্ত্রণ করিতে আসিল, তাহাকে সে বলিল, ‘পাকা ফলার খাওয়াতে হবে।’ সে বেচারা গরিব লোক, পাকা ফলার সে কোথা হইতে দিবে? তাই সে বিনয় করিয়া বলিল, ‘মশাই, পাকা ফলার দেওয়া কি যার তার কাজ? রাজা রাজড়া হলে তবে পাকা ফলার দিতে পারে।’ এই কথা শুনিয়া ব্রাহ্মণ বলিল, ‘তবে রাজা যেখানে থাকে, সেইখানে গিয়ে আমি পাকা ফলার খাব।’ ব্রাহ্মণ পাকা ফলার খাইবার জন্য রাজার বাড়ি চলিয়াছে। পথে যাহাকে দেখে, তাহাকেই জিজ্ঞাসা করে, ‘হ্যাঁগা, রাজার বাড়িটা কোনখান্‌টায়?’ একজন তাহাকে রাজার বাড়ি দেখাইয়া বলিল, ‘ঐ যে পাকা বাড়ি দেখছ, ঐটে রাজার বাড়ি।’ ব্রাহ্মণ ‘পাকা ফলার’ যেমন খাইয়াছে, ‘পাকা বাড়ি’ও তেমনি দেখিয়াছে। সুতরাং, ‘পাকা বাড়ি’র কথা শুনিয়া সে ভারি আশ্চর্য হইয়া রাজার বাড়ির দিকে তাকাইল। সে দেশের সব লোকেরই কুঁড়েঘরঃ খালি রাজার একটি সুন্দর পাকা বাড়ি ছিল। রাজার বাড়ি দেখিয়া ব্রাহ্মণের মুখে লাল পড়িতে লাগিল। সে গদগদ স্বরে বলিল, ‘পাকা বাড়ি! আহা! পাকা বাড়িই বটে! না হবে কেন? সে যে রাজা, তাই সে অমন বাড়িতে থাকে। ওটা তয়ের করতে না জানি কত ক্ষীর, ছানা আর চিনি লেগেছিল!’ এ মনে করিয়া ব্রাহ্মণ তাড়াতাড়ি গিয়া রাজার বাড়ির একটা কোণ কামড়াইয়া ধরিল; আবার তখনই ‘উঃ- হু-হু’ করিয়া কামড় ছাড়িয়া দিল। তারপর সে ভাবিতে লাগিল, ‘তাই ত, এই পাকা ফলারের এত নাম!’ আর খানিক ভবিয়া সে বলিল ‘ওঃ হো! বুঝেছি। নারকেলের মতন আর কি! ওটা ওর খোলা; আসল জিনিসটা ভিতরে আছে!’ এই বলিয়া সে আগের চাইতে দ্বিগুণ উৎসাহে কামড়াইতে আরম্ভ করিল। তাহার দুইটা দাঁত ভাঙ্গিয়া গেল, তাহাতে গ্রাহ্য নাই। কামড়াইতে কামড়াইতে সে সেই কোণের অনেকখানি ভাঙ্গিয়া ফেলিয়াছে, আর মনে করিতেছে যে, ‘আর বেশী দেরী নেই, এরপরই পাকা ফলার আসবে!’ এমন সময় কোথা হইতে মস্ত পাগড়িওয়ালা দারোয়ান আসিয়া তাহাকে ধরিয়া ফেলিল। ‘আরে ঠাকুর, ক্যা করতে হো? মহারাজকে ইমারত খা ডাল্‌তে হো? চলো তুম হমারে সাথ।’ এই বলিয়া দারোয়ান তাহাকে রাজার নিকট লইয়া চলিল। দারোয়ানের কাছে সকল কথা শুনিয়া রাজা বলিলেন, ‘কি ঠাকুর, ওখানে কি করছিলে?’ ব্রাহ্মণ উত্তর করিল, ‘মহারাজ! আমি পাকা ফলার খাচ্ছিলুম। খোলাটা না ভাঙ্গতেই এই বেটা দারোয়ান আমাকে ধ’রে এনেছে!’ এই কথা শুনিয়া রাজামহাশয় হো-হো করিয়া হাসিতে লাগিলেন, আর বেশ বুঝিতে পারিলেন যে, ঠাকুরের পেটে অনেক বুদ্ধি। যাহা হউক, তাহার সাধাসিধা কথাগুলি রাজার বেশ ভাল লাগি। সুতরাং তিনি হুকুম দিলেন যে, এই ব্রাহ্মণকে পেট ভরিয়া পাকা ফলার খাইবার মত ময়দা, ঘি আর মিঠাই দাও। ব্রাহ্মণ মনের সুখে রাজাকে আশীর্বাদ করিতে করিতে ময়দা, ঘি আর মিঠাই লইয়া ঘরে ফিরিল। আসিবার সময় বলিয়া আসিল যে, পাকা ফলার খাইয়া আবার রাজামশাইকে আশীর্বাদ করিতে আসিবে। পরদিন সকালে রাজামহাশয়, মুখ হাত ধুইয়া সভায় আসিয়াই সেই ব্রাহ্মণকে দেখিয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, কি ঠাকুর, কাল পাকা ফলার খেলে কেমন? ব্রাহ্মণ বলিল, ‘মহারাজ অতি চমৎকার খেয়েছি, পাকা ফলার কি আর মন্দ হতে পারে? গুঁড়োগুলো আগে গলায় বড্ড আটকাচ্ছিল! জল দিয়ে গুলে নিতে শেষে তরল হল, কিন্ত অর্ধেক খেতে না খেতেই বমি হয়ে গেল।’ ময়দা আর ঘি দিয়া যে লুচি তৈয়ার করিতে হয়, ব্রাহ্মণ বেচারা তাহা জানিত না। কাজেই সে ঐ কাঁচা ময়দাগুলিকেই ঘি আর মিঠাই দিয়া মাখিয়া খাইতে বিশেষ চেষ্টা করিয়াছে। সহজে তরল হয় না দেখিয়া, আবার তাহার সঙ্গে জল মিশাইয়াছে। খাইতে তাহার খুব ভালই লাগিয়াছিল। তবে, পেটে রহিল না, এই যা দুঃখ। রাজা দেখিলেন, লুচি নিজে তয়ের করিয়া খাইতে হইলে আর ব্রাহ্মণের ভাগ্যে পাকা ফলার ঘটিতেছে না। সুতরাং তিনি তাঁহার রসুয়ে বামুনদের একজনকে ডাকাইয়া বলিলেন, ‘এখান থেকে ময়দা ঘি নিয়ে, তোমার বাড়িতে লুচি তয়ের ক’রে, এই ঠাকুরকে পেট ভ’রে পাকা ফলার খাইতে দাও।’ রসুয়ে বামুন ফলারে বামুনকে তাহার বাড়ি দেখাইয়া বলিল, ‘আমি ফলার তয়ের করে রাখব, বিকালে আসিয়া আপনি খাবেন। আমি বাড়ি থাকব না, আমার ছেলে আপনাকে খেতে দেবে এখন।’ ব্রাহ্মণ রাজি হইয়া বাড়ি গিয়া বিকাল বেলার জন্য অপেক্ষা করিতে লাগিল। রসুয়ে বামুনের সেই ছেলেটা ভাল লোক ছিল না; একটা চোরের সঙ্গে তাহার বন্ধুতা ছিল। রসুয়ে বামুন ফলারে বামুনের জন্য লুচি, সন্দেশ ইত্যাদি তয়ের করিয়া তাহার ছেলেকে বলিল, ‘সেই লোকটি এলে তাকে বেশ ক’রে খাওয়াস।’ তাহার ছেলে বলিল, ‘তার জন্যে কিছু চিন্তা করো না, আমি তাকে খুব যত্ন ক’রে খাওয়াব এখন।’ রসুয়ে বামুন রাজবাড়ির রান্না করিতে চলিয়া গেল; আর তাহার ছেলে ফলারে বামুনের খাবারের আয়োজনে মন দিল। দু সেরের বেশি লুচি আর তাহার মত তরকারি মিঠাই ইত্যাদি প্রস্তুত হইয়াছিল। খানচারেক লুচি আর খানিক তরকারি ফলারে বামুনের জন্য রাখিয়া, আর সমস্ত সেই হতভাগা তাহার সেই বন্ধু আর নিজের জন্য রাখিয়া দিল। ফলারে বামুন আসিলে পর সে সেই চারখানা লুচি তাহাকে খাইতে দিল। সে বেচারা জন্মেও লুচি খায় নাই, তাহাতে আবার এমন চমৎকার লুচি-রাজার বামুন ঠাকুর তয়ের করিয়াছে। এমন জিনিস দু-চারখানি মাত্র খাইয়া তাহার পেট ত ভরিলই না, বরং তাহার ক্ষুধা বাড়িয়া গেল। সে খালি দুঃখ করিতে লাগিল, ‘আহা! আর যদি খানকতক দিত।’ রসুয়ে বামুনের বাড়ি হইতে বাহির হইয়া ফলারে বামুন রাস্তা দিয়া চলিল। তাহার মনের দুঃখ রাখিবার আর জায়গা দেখিতেছে না। চলে, আর খালি বলে, ‘আহা! আর যদি খানকতক দিত।’ এখন সময় হইয়াছে কি, রাজার প্রধান ভাণ্ডারী সেই রাস্তা দিয়া চলিয়াছে। সে নিজের হাতে সেদিন সকাল বেলায় ঐ ফলারে বামুনের জন্য পুরো দু সের ময়দা আর তাহার মতন অন্য সব জিনিস মাপিয়া দিয়াছে। ফলারে বামুনের মুখে ঐ কথা শুনিয়া সে জিজ্ঞাসা করিল, ‘কি ঠাকুরমশাই! কি যদি আর খানকতক দিত।’ ফলারে বামুন বলিল, ‘বাবা আমি পাকা ফলারের কথা বলছি। রাজামশাই চিরজীবি হউন, আমাকে এমন জিনিস খাইয়েছেন! খালি যদি আর খানকতক হত।’ ভাণ্ডারী জিজ্ঞাস করিল, ‘আপনাকে কখানা দিয়েছিল?’ ফলারে বামুন বলিল, ‘চারখানি পাকা ফলার আমাকে দিয়েছিল।’ ভাণ্ডারী সবই বুঝিতে পারিয়া বলিল, ‘সে কি ঠাকুরমশাই! দু সের ময়দা দিয়েছি, তাতে কি মোটে চারখানা লুচি হয়?’ ব্রাহ্মণ বলিল, ‘হ্যাঁ বাপু, চারখানাই ছিল। আর তাতে খুব চমৎকার লেগেছিল। ভাণ্ডারী বলিল, ‘দু সের ময়দায় তার চেয়ে ঢের বেশী লুচি হয়। আমার বোধ হচ্ছে, ঐ রসুয়ে বামুনের ছেলেটা বাকি লুচিগুলো মাচায় তুলে রেখেছে। আপনি আবার যান। এবারে গিয়ে একেবারে মাচায় উঠবেন। দেখবেন আপনার লুচি সেখানে আছে।’ ব্রাহ্মণ বলিল, তাই নাকি? বাপু তুমি বেচে থাকো। ‘হতভাগা বেল্লিক, বাঁদর, শয়তান পাজি’ বলতে বলতে ব্রাহ্মণ সেই রসুয়ে বামুনের বাড়ির পানে ছুটিল। গালিগুলি অবশ্য ভাণ্ডারীকে দেয় নাই-রসুয়ে বামুনের ছেলেকে দিয়াছিল। রসুয়ে বামুনের ছেলে ফলারে বামুনকে চারিখানি লুচি খাওয়াইয়া বিদায় করিয়াই, তাহার সেই চোর বন্ধুর কাছে গিয়াছিল। সেখানে গিয়া সে চোরকে বলিল, ‘বন্ধু ঢের লুচি তয়ের ক’রে মাচার উপর রেখে এসেছি। তুমি শিগ্‌গির যাও। আমিও এই বাজার থেকে একটা জিনিস নিয়ে এখনি আসছি।’ চোর রসুয়ে বামুনের মাচার উপর উঠিয়া সবে লুচির ডাকনা খুলিতে যাইবে, এমন সময় ফলারে বামুন আসিয়া উপস্থিত। এবারে কথাবার্তা নাই, একেবারে মাচায় গিয়া উঠিল। চোর মুশকিলে পড়িল। লুকাইবার স্থান নাই, পলাইবার পথ নাই। এখন সে যায় কোথায়? শেষটা আর কি করে, মাচার কোণে একটা কাঠের থাম জড়াইয়া কোনরকমে বেমালুম হইয়া থাকিতে চেষ্টা করিতে লাগিল। একে ‘সন্ধ্যাকাল’ তাহাতে আবার ফলারে বামুন নিতান্তই সাধাসিধে লোক, লুচি খাইবার জন্য তাহার মনটা যার পর নাই ব্যস্ত রহিয়াছে। সুতরাং চোরকে সে দেখিতে পাইল না। ফলারে বামুন সামনে লুচি, সন্দেশ, তরকারি মিঠাই সাজানো দেখিয়া খাইতে বসিয়া গেল। পেটে যত ধরির, তত সে খাইল। আর একটি হজমি গুলির স্থানও নাই। এমন সময় ভারি একটা মজা হইল। রসুয়ে বামুনের ছেলেও বাজার হইতে ফিরিয়া আসিয়াছে, আর ঠিক সেই সময় রসুয়ে বামুনও আসিয়াছে। অন্যদিন সে প্রায় দুপুর রাত্রের পূর্বে ফিরে না, কিন্তু সেদিন সে ভুলিয়া একটা ঝঁজরা ফেলিয়া দিয়াছিল, সেটার ভারি দরকার। ছেলে আশ্চর্য হইয়া জিজ্ঞাসা করিল, ‘বাবা, তুমি এখনি ফিরে এলে যে?’ রসুয়ে বামুন বলিল, ‘ঝাঁজরা ফেলে দিয়েছিলুম, তাই নিতে এসেছি।’ এতক্ষণে ফলারে বামুনের পেট এত বোঝাই হয়েছে যে, আর-একটু হইলেই তাহার দম আটকায়। পিপাসায় গলা শুকাইয়া গিয়াছে, কিন্ত সেখানে জল নাই। সে ‘জল জল’ বলিয়া চেঁচাইতে চেষ্টা করিল, কিন্ত ভাল করিয়া কথা ফুটিল না। রসুয়ে বামুন তাহার ছেলেকে বলিল, ‘ওটা কি রে?’ ছেলে দেখিল, ভারি মুশকিল। সে ফলারে বামুনের কথা ত আর জানত না, কাজেই সে মনে করিয়াছে যে ওটা তাহার বন্ধু, গলায় সন্দেশ আটকাইয়া বিশ্রী স্বরে জল চাহিতেছে। বন্ধুর খররটা বাপকে দিলে সে আর বন্ধুর হাড় আস্ত রাখিবে না, আর কিছু না বলিলেও হয়ত এখনই মাচায় উঠিয়া দেখিবে। এমন সময় হঠাৎ তাহার বুদ্ধি জোগাইল- সে বলিল, ‘বাবা, ওটা নিশ্চয়ই ভূত। তা নইলে মাচায় থেকে অমন বিশ্রী আওয়াজ দেবে কেন?’ ভূতের কথা শুনিয়া রসুয়ে বামুন কাঁপিতে লাগিল। আরো মুশকিলের কথা এই যে, ভূতটা জল চাহিতেছে। তাহার কাছে জল লইয়া যাইতে কিছুতেই ভরসা হইতেছে না, অথচ জল না পাইলে সে নিশ্চয়ই ভয়ানক চটিয়া যাইবে। তার সে কি করে তাহার ঠিক কি? ছেলের ভারি ইচ্ছা যে, সে ভূতকে জল দিয়া আসে। কিন্ত রসুয়ে বামুন বলিল, ‘তা হবে না, যদি তোর ঘাড় ভেঙ্গে দেয়।’ এই সময়ে তাহার মনে হইল যে, মাচার উপর কয়েকটা নারকেল ছাড়ানো আছে, সুতরাং সে ভূতকে বলিল, ‘মাচায় নারকেল আছে, থামে আছড়ে ভেঙ্গে খাও।’ ফলারে বামুনের হাতের কাছেই নারকেলগুলি ছিল। সে তাহার একটা হাতে লইয়া থামে আছরাইয়া ভাঙ্গিতে গেল। যে থাম জড়াইয়া চোর দাঁড়াইয়াছিল, ব্রাহ্মন পিপাসার চোটে থাম মনে করিয়া সেই চোরের মাথাতেই নারকেল আছড়াইয়া বসিয়াছে বাড়ি-একেবারে মাথা ফাটাইয়া ফেলিবার জোগাড় আর কি! এরপর একটা মস্ত গোলমাল হইল। নারকেলের বাড়ি খাইয়া চোর ভয়ানক চেঁচাইয়া উঠিল। আর তাহাতে ভয়ানক চমকাইয়া গিয়া ব্রাহ্মণের হাঁউমাঁউ করিতে লাগিল। গোলমাল শুনিয়া পাড়ার সমস্ত লোক সেখানে আসিয়া জড়ো হইল। আসল কথাটা জানিতে এরপর আর বেশী দেরি হইল না। চোর ধরা পড়িল, আর রসুয়ে বামুন তাহার ছেলেকে সেই ঝাঁজরা দিয়া এমনি ঠেঙান ঠেঙাইল যে কি বলিব!
উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী
ফিঙে আর কুঁকড়ো উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী একটা দানব ছিল, তার নাম ছিল ফিঙে। সে দেড়াশো হাত লম্বা শালগাছের ছড়ি হাতে নিযে বেড়াত। আর একটা দানব ছিল, তার নাম কুঁকড়ো। সে ঘুঁষো মেরে লোহার মুগুর থেঁতলা করে দিত। আর যত দানব ছিল, তাদের সকালকেই কুঁকড়ো ঠেঙিয়ে ঠিক করে দিয়েছে, এখন সে ফিঙের সন্ধানে দেশে বিদেশে ঘুরে বেড়ায়। এ কথা শুনে অবধি ফিঙের আর ঘুম হয় না, কাজেই সে কুঁকড়োকে এড়াবার জন্য খালি দেশ- বিদেশে ঘুরে বেড়ায়। ফিঙে সমুদ্রের ধারে গেলে, তা শুনে কুঁকড়ো সেই দিক পানে রওনা হল। সে খবর পেয়েই ফিঙে ঊর্ধ্বশ্বাসে ছুটে তার নিজের ঘরে চলে এল। ঘরখানি ছিল একটা উঁচু পর্বতের উপর। সেখান থেকে দশ দিনের পথ অবধি দেখতে পাওয়া যায়। কাজেই ফিঙে ভাবল যে, ওখানে গেলে কুঁকড়ো নিতান্ত আচমকা এসে তাকে মারতে পারবে না। ফিঙেকে অমন ব্যস্ত হয়ে ফিরে আসতে দেখে তার স্ত্রী ঊনা বলল, ‘কি হয়েছে?’ ফিঙে আঙুল দিয়ে সমুদ্রের দিকে দেখিয়ে বলল, ‘ঐ কুঁকড়ো আসছে। বেটা ঘুঁষো মেরে লোহার মুগুর থেঁতলা করে দেয়। এবারে দেখছি ভারি বেগতিক।’ ঊনা সেদিকে দেখল, সত্যি সত্যিই কুঁকড়ো আসছে, কিন্তু এখনো সে ঢের দূরে, তিন- চার দিনের কমে এসে পৌছবে না। তখন সে ফিঙেকে বলল, ‘তোমার কোন ভয় নেই। তুমি পায়ের উপর পা তুলে বসে থাকো, আমি কুঁকড়োকে ঠিক করে দিচ্ছি।’ কিন্তু ফিঙের মনের ভয় তাতে গেল না। সে মাথা হেঁট করে বসে কত কথা ভাবতে লাগল। ঊনা কিন্তু ততক্ষণে চুপ করে ছিল না। সে গ্রামের লোকের বাড়ি বাড়ি ঘুরে যার ঘরে যত ভাঙা দা, কুডুল, কাস্তে, খন্তা , কোদাল, হুড়কো, ছিটকিনি আর পেরেক ছিল, সব চেয়ে ঝুড়ি ভরে নিয়ে এল। তারপর সেই গুলো ভিতরে পুরে পুরে সে দুদিন ধরে খালি পাটিসাপটাই তয়ের করল। ফিঙে অবাক হয়ে হয়ে দেখে, আর বলে,‘ও কি করছ? ঊনা বলে, ‘যাই করি না কেন- তুমি চুপ করে থাকো।’ পিঠে হয়ে গেলে ঊনা তিন গামলা ছানাও তয়ের করল। তারপর ফিঙেকে অনেক পরামর্শ দিয়ে, অনেক সন্ধান শিখিয়ে রেখে,সে সব ঠিকঠাক করে রাখল। এখন কুঁকড়ো এলেই হয়। পরদিন দুপুরবেলা কুঁকড়ো এসে উপস্থিত হয়েছে। এসেই ভয়ংকর গর্জনে আকাশপাতাল কাঁপিয়ে জিজ্ঞাসা করল,‘ফিঙে কোথায়?’ ঊনা বলল, ‘সে ত বাড়ি নেই। কুঁকড়ো বলে নাকি একটা ছোকরা তাকে খুঁজতে সমুদ্রের ধারে গিয়ে ভারি বড়াই করছিল, তাই শুনে ফিঙে বিষম রেগে লাঠি হাতে তাকে মারতে বেরিয়েছে। যদি তাকে দেখতে পায়, তবে আর বেচারাকে আস্ত রাখবে না।’ তা শনে কুঁকড়ো ভারি আশ্চর্য হয়ে বলল, ‘আমিই ত কুঁকড়ো , তার সঙ্গে যুদ্ধ করতে এসেছি।’ এ কথায় ঊনা হো হো করে হেসেই কুটিপটি। তারপর অনেকক্ষণ নাক সিঁটকিয়ে কুঁকড়োর পানে তাকিয়ে থেকে সে বলল, ‘এই টিকটিকির মত জোয়ানটি হয়ে তুমি ফিঙের সঙ্গে যুদ্ধ করবে? অমন কাজও করতে নাই বাছা। কেন ফিঙের হাতে প্রাণ দেবে? আমার কথা শুনে চলো, আমি তোমাকে বাঁচিয়ে দিচ্ছি। ততক্ষণ একটা কাজ কর দেখি। বড্ড হাওয়া আসছে, ফিঙে বাড়ি নেই, কে ঘরখানিকে ঘুরিয়ে দেবে? দেখো ত তুমি পার কি না।’ কুঁকড়ো ভাবল, ‘বাবা! হাওয়া থামাতে হলে ফিঙে এই ঘরটা ঘুরিয়ে দেয় নাকি? এখন আমি যদি “না” বলি, তবে ত দেখছি আমার বড্ড নিন্দে হবে।’ তখন সে আগে খুব করে তার ডান হাতের মাঝের আঙুলটা মটকে নিল। আঙুলটাতেই তার যত জোর ছিল, ওটি না হলে সে কিছুই করতে পারত না। আঙুর মটকানো হয়ে গেলে সে দুহাতে ঘরখানিকে জড়িয়ে ধরে তাতে এমনি পাক দিল সে দেখতে দেখতে পাহাড়ের চূড়া সুদ্ধ ঘরখানি ঘুরে গেল। এতক্ষণ ফিঙে কি করছে? সে ঊনার পরামর্শে তার নিজের খোকা সেজে, কাঁথা মুড়ি দিয়ে শুয়ে আছে, আর কুঁকড়োর কাণ্ড দেখে সেই কাঁথার ভিতরে ভয়ে ঘেমে আর কেঁপে অস্থির হচ্ছে। এদিকে ঊনা আবার কুঁকড়োকে বলল,‘বেশ বাপু! লক্ষ্মী ছেলে তুমি। আহা! ঘরে এক ফোঁটা জল নেই, তোমাকে কি দিয়ে একটু মেঠাই খেতে দিই। পাহাড়টার নীচে জল থাকে, ফিঙে পাহাড় সরিয়ে তাই তুলে আনে। আজ ত সে বাড়ি নেই, এখন উপায় কি হবে? দেখো ত বাপু, তুমি পাহাড়টা ঠেলে একটু জল আনতে পার কি না!’ কুঁকড়ো আবার খুব করে তার আঙুল মটকে নিয়ে, সেই পাহাড়ের নীচে গিয়ে এমনি গুতো মারল যে তাতে দশহাত গভীর এক প্রকাণ্ড দীঘি হয়ে গেল, আর তাতে জলও হল তেমনি। তা দেখে ঊনা আর একটু হলেই ‘মাগো!’ বারে চেঁচিয়ে ফেলছিল,কিন্তু সে ভারি বুদ্ধিমতী মেয়ে তাই তাড়াতাড়ি সামলে নিয়ে বলল, ‘চলো,এখন তোমাকে কিছু পিঠে খেতে দিই গে।’ এই বরে ঊনা কুঁকড়োকে ঘরে এনে দিয়েছে সেই পিঠে খেতে। সে বেটাও এমনি লোভী- একেবারে তার দশটা তুলে নিয়ে মুখে দিয়েছে। দিয়েই সে ‘উঃ- হুঃ- হুঃ-’ বলে এমনি ভয়ংকর চেঁচিযে উঠল যে, আর একটু হলেই তাতে ঘরের ছাত উড়ে যেত। বেজায় ব্যস্ত হয়ে সেই পিঠে চিবোতে গিয়ে তার চারটে দাঁত ভেঙে রক্তারক্তি হয়ে গিয়েছে, কাজেই না চেঁচাবে কেন? ঊনা তখন বলল, ‘আরে অত চেঁচিও না, খোকার ঘুম ভেঙে যাবে আমি ভাবছিলাম তুমি জোয়ান লোক, ঐ পিঠে খেতে তোমার ভাল লাগবে। ফিঙে আর খোকা ও পিঠে খুব খায়।’ বলতে বলতে সেই খোকাটা কাঁথার ভিতর থেকে ষাঁড়ের মত চেঁচিয়ে বলল ‘অঁ- য়্যা-আ-আ বদ্দ খিদে পেয়েথে! পিতে থাব।’ খোকার গলার সে আওযাজ শুনেই ত কুঁকড়োর পিলে চমকে উঠেছে। ঊনা অবশ্য খোকার জন্য ভালো পিঠে করে রেখেছিল। তাই থেকে কয়েকটা খেতে-দিল। কুঁকড়ো ত আর তা জানে না। সে দেখল, যাতে তার নিজের দাঁত ভেঙে গেঙে গেছে, ‘খোকা’ তাই কপাকপ খাচ্ছে। কাজেই সে ভাবল, ‘বাবা গো, খোকাই যদি অমনি পিঠে খেতে পারে, তবে বাব না জানি কি করতে পারে! ভাগ্যিস সে বেটা বাড়ি নেই।’ এমন সময়‘খোকা ’ আবার বলল, ‘পাথল দে। দল বাল কব্ব! ঊনা তাকে একতাল ছানা, আর কুঁকড়োকে একটা সাদা পাথর দিয়ে বলল, ‘খোকার ঐ এক খেলা- পাথর টিপে জল বার করে। তুমিও একখানা পাথর টিপে দেখো ত।’ কুঁকড়ো সেই পাথর প্রাণপণে টিপেও তা থেকে জল বার করতে পারল না। খোকার ছানা থেকে অবশ্য জল বার হতে লাগল। তা দেখে কুঁকড়ো ঠকঠক কারে কাঁপতে কাঁপতে বলল, ‘বাবা গো! আমি এই বেলা পালাই। এই খোকার বাবা এলে আমাকে আস্ত রাখবে না। আমার খালি দেখতে ইচ্ছে করছে যে এই খোকার দাঁতগুলো কেমন, যা দিয়ে সে ঐ পিঠেগুলো খায়।’ এই বলে সে তাড়াতাড়ি গিয়ে যেই ‘খোকা’র মুখে আঙুল ঢুকিয়ে দিয়েছে, অমনি খোকাও কটাস করে তার সব- কটি আঙুল একেবারে গোড়াসুদ্ধ কামড়িয়ে নিয়েছে, সেই আঙুলেই নাকি ছিল কুঁকড়োর জোর, কাজেই সে আঙুল কাটা যেতে হায় হায় করে মাটিতে পড়ে গেল। ‘খোকা’ও তখন লাফিয়ে উঠে তার সেই দেড়শো হাত লম্বা শালের ছড়িগাছি দিয়ে তার হাড় ভাঙতে আর কিছুমাত্র দেরি করল না।
উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী
বানর রাজপুত্র উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী এক রাজার সাত রানী, কিন্ত ছেলেপিলে একটিও নাই। রাজার তাতে বড়ই দুঃখ; তিনি সভায় গিয়ে মাথা গুঁজে বসে থাকেন, কেউ এলে ভাল করে কথা কন না। একদিন হয়েছে কি-এক মুনি রাজার সঙ্গে দেখা করতে এসেছেন। মুনি রাজার মুখ ভার দেখে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘রাজা তোমার মুখ যে ভার দেখছি; তোমার কিসের দুঃখ?’ রাজা বললেন, ‘সে কথা আর কি বলব, মুনি-ঠাকুর! আমার রাজ্য, ধন, লোকজন সবই আছে, কিন্ত আমার যে ছেলেপিলে নেই, আমি মরলে এ-সব কে দেখবে?’ মুনি বললেন, ‘ঐ কথা? আচ্ছা, তোমার কোন চিন্তা নেই। কাল ভোরে উঠেই তুমি সোজাসুজি উত্তর দিকে চলে যাবে। অনেক দূর গিয়ে একটা বনের ধারে দেখবে একটা আমগাছ রয়েছে। সেই আমগাছ থেকে সাতটি আম এনে তোমার সাত রাণীকে বেটে খাইয়ে দিলেই, তোমার সাতটি ছেলে হবে। কিন্ত খবরদার, আম নিয়ে আসবার সময় পিছনের দিকে তাকিয়ো না যেন!’ এই কথা বলে মুনি চলে গেলেন। তারপর দিন গেল, রাত হল, ক্রমে রাত ভোর হল। তখন রাজামশাই তাড়াতাড়ি বিছানা থেকে উঠে সোজাসুজি উত্তর দিকে চলতে লাগলেন। যেতে যেতে অনেক দূর গিয়ে তিনি দেখলেন, সত্যি সত্যি বনের ধারে একটা আম গাছ আছে, তাতে পাকা সাতটি আমও দেখতে পাওয়া যাচ্ছে। সেই বনে তিনি কতবার শিকার করতে এসেছেন, কিন্ত আমগাছ কখনো দেখতে পাননি। যা হোক, তিনি তাড়াতাড়ি সেই গাছে উঠে আম সাতটি পেড়ে নিয়ে বাড়িতে ফিরে চললেন। খানিক দূর যেতে না যেতেই শুনলেন, কে যেন পিছন থেকে তাঁকে ডাকছে, ওগো রাজা ফিরে চাও, আরো আম নিয়ে যাও। মুনি যে সাবধান করে দিয়েছিলেন, সে কথা রাজার মনে ছিল না। তিনি পিছন দিক থেকে ডাক শুনেই ফিরে তাকিয়েছেন, আর অমনি আমগুলো তাঁর হাত থেকে ছুটে গিয়ে আবার গাছে ঝুলতে লেগেছে। কাজেই রাজামশাই-এর আবার গিয়ে গাছে উঠে আমগুলি পেড়ে আনতে হল। এবার আর তিনি কিছুতেই মুনির কথা ভুললেন না। তিনি চলে আসবার সময় পিছন থেকে তাঁকে কতরকম করে ডাকতে লাগল, ‘চোর ‘চোর’ বলে কত গালও দিল। রাজামশাই তাতে কান না দিয়ে বোঁ বোঁ করে বাড়ি পানে ছুটলেন। বাড়ি এসে রাণীদের হাতে সাতটি আম দিয়ে রাজামশাই বললেন, ‘তোমরা সাতজনে এই সাতটি আম বেটে খাও।’ ছোটরানী তখন সেখানে ছিলেন না। বড় রাণীরা ছজনে মিলে তাঁকে কিছু না বলেই সব কটি আম খেয়ে ফেললেন। ছোটরানী এর কিছুই জানতে পারলেন না, কিন্তু তাঁর ঝি সব দেখল। বড় রাণীদের খাওয়া শেষ হয়ে গেলে সে আমের ছালগুলি চুপিচুপি কুড়িয়ে নিয়ে গেল। সেই ছালগুলো ধুয়ে বেটে ছোটরাণীর হাতে দিয়ে বলল, ‘মা, এই ওষুধটা খাও, তোমার ভাল হবে।’ ওষুধ খেতে হয়, তাই ছোটরাণী আর কোন কথা না বলেই সেটা খেয়ে ফেললেন। তারপর বড় রাণীদের সকলেরই এক-একটি সুন্দর খোকা হল, রাজা তাতে খুশি হয়ে খুব ধুমধাম আর গানবাজনা করালেন। ছোটরানীরও একটি খোকা হল, কিন্ত সেটি হল বানর। বানর দেখে রাজা চটে গিয়ে ছোটরাণীকে বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দিলেন। দেশের লোকের তাতে বড়ই দুঃখ হল। তারা একটি কুঁড়ে বেঁধে ছোটরাণীকে বলল, ‘মা তুমি এইখানে থাকে।’ সেইখানে ছোটরাণী থাকেন। বানরটি সেখানে থেকে দিন দিন বড় হচ্ছে। সে মানুষের মত কথা কয়। আর তার এমনি বুদ্ধি যে, কোন কথা তাকে শিখিয়ে দিতে হয় না। যখন যে কাজের দরকার, অমনি সে তা করে। সারাদিন সে গাছে গাছে ঘুরে বেড়ায়, যেখানে যে ফল দেখে তা খায়; খুব ভাল লাগলে মার জন্য নিয়ে আসে। তাকে কেউ কিছু বলে না, কারুর গাছের ফল খেতে গেলে সে ভারি খুশি হয় ভাল ভাল ফল দেখিয়ে দেয়। তার বুদ্ধি দেখে সকলে আশ্চর্য হয়ে যায়। এমনি করে দিন যাচ্ছে। বড় রাণীদের ছটি ছেলেও এখন বড় হয়েছে। তারা বানরটিকে যারপর নাই হিংসা করে, সে তাদের সঙ্গে খেলা করতে গেলে তাকে মেরে তাড়িয়ে দেয়। তারপর একদিন বানরটি দেখল যে, বড় রাণীদের ছেলেদের জন্য মাস্টার এসেছে, তারা পুঁথি নিয়ে তার কাছে বসে পড়ে। তা দেখে বানর গিয়ে তার মাকে বলল, ‘মা, আমাকে পুঁথি এনে দাও, আমি পড়ব।’ মা কাঁদতে কাঁদতে বললেন , ‘হায় বাছা, কি করে পড়বে? তুমি যে বানর।’ বানর বলল, ‘সত্যি মা, আমি পড়ব; তুমি বই এনেই দিয়েই দেখো। তুমি আমাকে পড়াবে।’ বানরের এমনি বুদ্ধি, যে বই পায় সে দুদিনে পড়ে শেষ করে ফেলে। সে দু বছরে মস্ত পণ্ডিত হয়ে উঠল। বড় রাণীদের ছেলেরা তখনো দু-তিনখানি বই-পুঁথি শেষ করতে পারেনিঃ রোজ খালি মাস্টারের বকুনি খায়। এ-সব বকুনি শুনে রাজা একদিন বললেন, ‘বটে? বানরের এমনি বুদ্ধি? নিয়ে এসো তো তাকে, আমি দেখব।’ বানরের কিছুতেই ভয় নেই। রাজা ডেকেছেন শুনে সে অমনি তাঁর কাছে উপস্থিত হল। তাকে দেখে আর তার কথাবার্তা শুনে রাজার এমনি ভাল লাগল যে, তিনি আর কিছুতেই ছোটরানীকে কুঁড়েঘরে ফেলে রাখতে পারলেন না। বাড়িতে আনতেও ভরসা পেলেন না, পাছে বড় রাণীরা কিছু বলেন। তাই তিনি ছোটরাণীকে রাজবাড়ির পাশেই একটি খুব সুন্দর বাড়ি করে দিলেন। সেই বাড়িতে তখন থেকে ছোটরাণী তাঁর বানর নিয়ে থাকেন। টাকাকড়ি যত লাগে রাজার লোক এসে দিয়ে যায়। লোকে তাঁর বাড়িটাকে বলে বানরের বাড়ি। এ সব দেখে বড় রাণীদের ছেলেরা বানরকে আরো বেশী হিংসা করতে লাগল। একটু একটু করে ছেলেরা বড় হয়ে উঠল। সকলে রাজাকে বলল, ‘রাজপুত্রেরা বড় হয়েছেন, এখন এদের বিয়ে দিন।’ রাজা বললেন, ‘তাদের দেশ বিদেশ ঘুরতে দাও। তারা নানান জায়গা দেখে, নানারকম শিখে, টুকটুকে ছয়টি রাজকন্যা বিয়ে করে আনুক।’ সকলে বলল, ‘বেশ বেশ! তাই হোক।’ তারপর ছয় রাজপুত্র সেজেগুজে, টাকাকড়ি সঙ্গে নিয়ে ঘোড়ায় চড়ে নানান দেশ দেখতে বেরুল। তা দেখে বানর তার মাকে গিয়ে বলল, ‘মা, আমিও যাব।’ তার মা বললেন, ‘তুমি কি করতে যাবে, জাদু? তোমাকে কোন টুকটুকে রাজকন্যা বিয়ে করবে?’ বানর বলল, ‘মা, আমি অনেক দেশ দেখতে পাব।’ মা বললেন, ‘তুমি যে দেশ দেখতে যাবে, আমি তোমাকে ছেড়ে কি করে থাকব?’ বানর বলল, ‘আমি দেখতে দেখতে ফিরে আসব। তোমার পায়ে পড়ি মা, আমাকে যেতে দাও।’ কাজেই ছোটরানী আর কি করেন? বানরকে যেতে দিতেই হল। ছয় রাজপুত্র ঘোড়ায় চড়ে যাচ্ছে; রাজবাড়ি থেকে অনেক দূর চলে এসেছে। একটা বনের ভিতর দিয়ে তাদের পথ, সেই পথ চলতে চলতে তাদের নানারকম কথাবার্তা হচ্ছে, এমন সময় বনের ভিতর থেকে বানর বেরিয়ে এসে বলল, ‘দাদা, আমিও এসেছি, আমাকে সঙ্গে নিয়ে চলো।’ তাতে রাজপুত্রেরা যার পর নাই রেগে বলল, ‘বটে রে, তোর এতবড় আস্পর্ধা! আমরা রাজকন্যা বিয়ে করে আনতে যাচ্ছি বলে তুইও তাই করতে যাবি! দাঁড়া, তোকে দেখাচ্ছি!’ এই বলে তারা বানরকে মারতে মারতে আধমরা করে একটা গাছে বেঁধে রেখে চলে গেল। সেইবনে ছিল একদল ডাকাত। তারা দেখল যে ছয়জন রাজপুত্র ভারি সাজ করে টাকাকড়ি নিয়ে ঘোড়ায় চড়ে যাচ্ছে। দেখেই ত তারা মার-মার করে চারদিকে থেকে তাদের ঘিরে ফেলল। রাজপুত্রেরা ভয়েই জড়সড়, তলোয়ার খুলবার কথা আর তাদের মনেই নেই। তাদের টাকাকড়ি, ঘোড়া, পোশাক-সবসুদ্ধ তাদের হাত-পা বেঁধে নিয়ে যেতে তাদের দু মিনিটও সময় লাগল না। রাজপুত্রদের ধরে নিয়ে খানিক দূরে এসেই ডাকাতেরা দেখল, পথের ধারে একটা বানর বাঁধা রয়েছে। তাকেও তারা সঙ্গে নিয়ে চলল। বানর যেন তাতে বেশ খুশি হয়ে লাফিয়ে লাফিয়ে তাদের সঙ্গে যেতে লাগল। তা দেখে ডাকাতেরা ভাবল, বুঝি কারু পোষা বানর, কাজেই তাকে আর তারা তেমন করে বাঁধল না। সেই বনের ভিতরই ডাকাতদের ঘর। সেদিন তাদের বড্ড পরিশ্রম হয়েছিল, তাই রাজপুত্রদের নিয়ে স্যার সময় ঘরে ফিরে এসে বাঁধনসুদ্ধই ছটি ভাইকে একটা জায়গায় ফেলে রেখে তারা খাওয়া-দাওয়া করে ঘুমিয়ে পড়ল। যখন খুব করে তাদের নাক ডাকতে লেগেছে,তখন বানর চুপিচুপি তার নিজের বাঁধন দাঁত দিয়ে কেটে তাড়াতাড়ি গিয়ে রাজপুত্রদের বাঁধন খুলে দিয়েছে। তখন আর তারা বানরকে ফেলে যাবে কোন লাজে? কাজেই তাকেও সঙ্গে করে, জিনিসপত্র নিয়ে, ঘোড়ায় চড়ে অমনি তারা প্রাণপণে ছুট দিল, ডাকাতেরা কিছু টের পেল না। ডাকাতদের ওখান থেকে পালিয়ে রাজপুত্রেরা প্রাণপণে ঘোড়া ছুটিয়ে যেতে লাগল, ভোরের আগে আর তারা কোথাও থামল না। সকালে তারা দেখল যে, তারা ভারি চমৎকার একটা শহরে এসে উপস্থিত হয়েছে। সে খুব বড় এক রাজার দেশ; তাঁর বাড়ি দূর থেকে দেখা যাচ্ছে, যেন একটা ঝকঝকে সাদা পাহাড়। ছয় রাজপুত্র সেই বাড়ির কাছে গিয়েই টকটক করে ঘোড়া হাঁকিয়ে তার ভিতরে ঢুকে পড়ল। দারোয়ানেরা তাদের পোষাক আর ঘোড়ার সাজ দেখে জড়সড় হয়ে দাঁড়িয়ে তাদের সেলাম করল, আর কিছু বলল না। বানর কিন্ত জানে যে, সে সেখানে গেলেই তাকে ধরে ফেলবে, তাই সে রাজবাড়ির পিছনের দিকে গিয়ে, খিড়কির পুকুরের ধারে শুয়ে রইল। সেই দেশের রাজারও ছিল সাত রাণী। তাদের বড় ছজন ছিল ভারি হিংসুক আর দেখতে বিশ্রী, আর ছোটটি ছিলেন পরীর মত সুন্দর আর বড় লক্ষী। বড়রা রাজাকে মিছমিছি নানান কথা বলে, ছোটরাণীকে ঘর থেকে তাড়িয়ে দিয়েছিল; তিনি খিড়কির পুকুরের ধারে একটি কুঁড়ের ভিতরে থাকতেন, রাজা তাঁর কোন খবরও নিতেন না। বড় ছয় রাণীর ছটি মেয়ে ছিল, তারা দেখতে ছিল ঠিক তাদের মায়ের মতন, আর তাদের মনও ছিল তেমনি। আর ছোটরাণীর যে মেয়েটি ছিল, সেও ছিল ঠিক তার মার মত-তেমনি সুন্দর, তেমনি লক্ষী। তা হলে কি হয়, বড় রাণীরা রাজাকে বুঝিয়ে বুঝিয়ে দিয়েছিল যে, ছোটরাণীর মেয়েটা পাগল, কালো, কুঁজো, কানা, খোঁড়া, কালা আর বোবা। সেই খিড়কির পুকুরের ধারে, সেই ছোটরানীর কুঁড়েরঘরের কাছে বানর গিয়ে শুয়ে রয়েছে। খানিক বাদে বড় রাণীদের ছয় মেয়ে ছটি ঘটি নিয়ে সেখানে স্নান করতে এল, ছোটরাণীর মেয়েটিও তার ছোট ঘটিটি নিয়ে এল। তারা স্নান করে চলে আসবার সময় সেই মেয়েটির ঘটি থেকে কেমন করে খানিকটা জল বানরের গায়ে পড়ে গেল, অমনি বড়রাণীদের ছয় মেয়ে হাততালি দিয়ে চেঁচিয়ে বলতে লাগল, ‘ওম! তোমরা দেখো এসো-ছোটরাণীর মেয়ে বাদরটিকে বিয়ে করেছে।’ বড়রাণীরাও তা শুনে ছুটে এসে বলতে লাগল,‘তাই ত,তাই ত। ছোটরানীর মেয়ে বানরটাকে বিয়ে করেছে।’ সেই খবর তখুনি তারা রাজার কাছে পাঠিয়ে দিল। দেশের সকল লোক রাজার সভায় বসে শুনল যে, ছোটরানীর মেয়ের একটা বানরের সঙ্গে বিয়ে হয়েছে। ছোটরানীর মনে কি কষ্ট হল, তা আর কি বলব? তিনি খাওয়া দাওয়া ছেড়ে দিয়ে মেয়েটিকে বুকে নিয়ে মাটিতে পড়ে কাঁদতে লাগলেন। তা দেখে বানর তাঁদের ঘরের দরজায় এসে বাইরে থেকে হাত জোঁর করে বলল, ‘মা, আপনি কাঁদবেন না। ভগবান যা করেন ভালই করেন। এ থেকেও আপনাদের ভাল হতে পারে।’ বানরকে মানুষের মত কথা কইতে দেখে রানী উঠে বসলেন। তাঁর মনের দুঃখ যেন কোথায় চলে গেল। সেই থেকে বানর তাঁর ঘরের কাছে গাছের উপর থাকে আর প্রাণপণে তাঁর সেবা করে। রানী যখন শুনলেন যে, সে রাজপুত্র, তখন সে যে বানর, সে কথা তিনি ভুলে গেলেন। তাঁর মনে হল যে এমনি ভাল আর বুদ্ধিমান লোক আর মানুষের ভিতরে নাই।। এদিকে হয়েছে কি, সেই ছয় রাজপুত্রও রাজার বাড়িতে ঢুকে একেবারে তার সভায় এসে হাজির হয়েছে। রাজা দেখেই বুঝতে পেরেছেন, এরা রাজপুত্র। তিনি জিজ্ঞাসা করলেন, ‘বাপু, তোমরা কে? কি করতে এসেছ?’ তারপর যখন তাদের বাপের নাম শুনলেন যে তারা বিয়ে করবার জন্য রাজকন্যা খুঁজতে বেরিয়েছে, তখন তাঁর আর খুশির সীমাই রইল না। তিনি বললেন, ‘বাঃ! তোমরা যে আমার বন্ধুর ছেলে। বেশ হল; আমার ছ মেয়েকে তোমরা ছজনে বিয়ে করবে।’ ঠিক এমনি সময় বাড়ির ভিতর থেকে খবর এল যে, ছোটরানীর মেয়ের একটা বাঁদরের সঙ্গে বিয়ে হয়েছে। রাজপুত্ররাও তখনি বুঝে নিল যে এ আর কেউ নয়, তাদেরই বাঁদর। তাদের মনে হিংসেটা যে হল। বাঁদর এসে তাঁদের আগেই রাজার মেয়ে বিয়ে করে ফেলল। লোকে আবার কানাকানি করে বলে যে সে মেয়ে নাকি রাজার আর ছয় মেয়ের চেয়ে ঢের বেশি সুন্দর আর ভাল-এ সব কথা তারা যত ভাবে, ততই খালি হিংসায় জ্বলে মরে। যা হোক রাজার ছয় মেয়ের সঙ্গে তা তাদের বিয়ে হয়ে গেল, তারপর ঝকঝকে ময়ূরপঙ্খী সাজিয়ে ঢাক ঢোল বাজিয়ে তারা বউ নিয়ে দেশে চলল। বানরও একটি ছোট নৌকায় করে তার স্ত্রীকে নিয়ে তাদের পিছু পিছু চলেছে। তাকে দেখেই ছয় রাজপুত্র রেগে ভূত হয়ে গেছে আর ভেবেছে যে, একে বউ নিয়ে দেশে ফিরতে দেওয়া হবে না। মুখে কিন্তু ‘ভাই, ভাই’ বলে ভারি আদর দেখাতে লাগল, যেন তাকে কতই ভালবাসে। শেষে যখন বাড়ির কাছে এসেছে, তখন রাত্রে ঘুমের ভিতরে বেচারার হাত-পা বেঁধে তাকে জলে ফেলে দিল। ভাগ্যিস ছোট বউ টের পেয়ে তাড়াতাড়ি একটা বালিশ ফেলে দিয়েছিল, আর তাই ধরে অনেক কষ্টে সে কোনমতে ডাঙায় উঠল, নইলে সে যাত্রা আর উপায়ই ছিল না। তারপর সকালবেলায় নৌকা এসে ঘাটে লাগল, রাজা খবর পেয়ে ছেলে বউদের আদর করে ঘরে নিতে এলেন। ছয় ছেলে এসে তাঁকে প্রণাম করল, রাজা তাদের জিজ্ঞেস করলেন, ‘আমার বানর কই?’ তারা বলল, ‘সে জলে ডুবে মারা গিয়েছে।’ বানর ত মরে নি, সে নদীর ধারে ধারে তাদের আগেই ঘাটে এসে গাছের আড়ালে লুকিয়ে ছিল। ওরা ‘সে জলে ডুবে মারা গেছে’ বলতেই বানর আড়াল থেকে বেরিয়ে এসে রাজাকে প্রণাম করে বলল, ‘আমি মরিনি বাবা, ওরা আমার হাত-পা বেঁধে আমাকে জলে ফেলে দিয়েছিল, আমি অনেক কষ্টে বেঁচে এসেছি।’ তখন ত রাজপুত্রদের মুখ চুন। রাজা ভয়ানক রেগে তাদের বললেন, ‘বটে। তোদের এই কাজ? দূর ত তোরা আমার দেশ থেকে। আর তোদের মুখ দেখব না।’ এই বলে দুষ্টু ছেলেগুলিকে তাড়িয়ে দিয়ে রাজার যার পর নাই আদরের সহিত বানর আর ছোট বউকে ঘরে নিয়ে এলেন। বানরের মা ছেলেকে ফিরে পেয়ে আর এমন সুন্দর লক্ষী বউ ঘরে এনে যে কত সুখী হলেন তা বুঝতেই পার। তারপর খুব সুখেই তাঁদের দিন কাটতে লাগল। এর মধ্যে হয়েছে কি, বউমা দেখলেন যে বানর শুধু দিনের বেলায়ই বানর সেজে বেড়ায়; রাত্রে সে বানরের ছাল খুলে ফেলে দেবতার মত সুন্দর মানুষ হয়। এ কথা তিনি ছোটরানীকে বললেন, ছোটরানী আবার রাজাকে জানালেন। রাজা ত শুনে ভারি আশ্চর্য হয়ে এসে বললেন, ‘বউমা, তুমি এক কাজ করো। আজ রাত্রে যখন সে বানরের ছাল খুলে ঘুমোবে, তখন তুমি সেই ছালটাকে পুড়িয়ে ফেলবে। সেদিন বানরের শোবার ঘরের পাশের ঘরে মস্ত আগুন জ্বেলে রাখা হল, বানর তা জানতে পেল না। তারপর রাত্রে যেই ছাল খুলে রেখে সে ঘুমিয়েছে, অমনি রাজকন্যা চুপিচুপি নিয়ে সেটাকে সেই আগুনে ফেলে দিয়েছেন। সকালে বানর উঠে দেখে, তার ছাল নেই। তখন সে ত ধরা পড়ে গিয়ে খুবই ব্যস্ত হল, কিন্তু ব্যস্ত হয়ে কি হবে, আর বানর হবার জো নেই। দেখতে দেখতে সেই খবর দেশময় ছড়িয়ে পড়ল, আর ছেলেবুড়ো সকলে ছুটে এসে, সব শুনে ধেই ধেই করে নাচতে লাগল।
উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী
বুদ্ধিমান চাকর উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী এক কাজ সাহেবের এক চাকর ছিল, তার নাম বুদ্ধু। চাকরটা একে বিদেশী , তাতে বুদ্ধি- সুদ্ধির ধার ধারে না- কাজেই কাজি সাহেবের মহা মুস্কিল। চাকরটা কায়দা কানুন কিছুই জানে না- বাড়িতে লোক আসলে হাঁ করে তাকিয়ে থাকে। একদিন রাজি সাহেব তাকে দুই ধমক দিয়েবললেন, ‘ফের যদি এরকম বেয়াদবী করিস- কাউকে সেলাম না করিস, তবে তোকে আমি দেখাব। সকলকে খাতির করবি আর ‘সেলাম’ বলবি।’ সেই থেকে রাস্তায় বেরিযে যাকে দেখে, সকলকেই বুদ্ধু ‘সেলাম’ করে। ছেলে বুড়ো মানুষ গরু কাউকে বাদ দেয় না। এক গাধাওয়ালা তার গাধা বিয়ে চলেছে- চাকরটা তাকে সেলাম করল আর গাধাগুলোকেও খুব খাতির ক’রে বলল “সেলাম”। তা শুনে গাধাওয়ালা খুব হাসতে লাগল, আর বলল, ‘দূর আহাম্মক ওদের বুঝি সেলাম বলতে হয়? ওদের “হেই হেই” ক’রে চালাতে হয়।’ বুদ্ধু বেচারা কিছু দূর গিয়ে দেখল, একজন শিকারী ফাঁদ পেতে বসে আছে, আর অনেকগুলো পাখি সেই ফাঁদের কাছে ঘুরছে। তাই দেখে সে “হেই হেই” করে এমনি চেঁচায়ে উঠল যে পাখি- টাখি সব উড়ে পালাল। শিকারী ত চটে লাল! আর- একদিন এক বড় লোকের বাড়িতে কাজি সাহেবের নেমন্তন্ন। বুদ্ধুও সঙ্গে সঙ্গে গিয়েছে। তারা নবাব বংশের লোক- আশ্চর্য তাদের আদব- কায়দা। খেতে খেতে নিমন্ত্রণকর্তার দাড়িতে একটা ভাত পড়ল- অমনি একজন চাকর যেন গান করছে এমনি ভাবে গুন গুন ক’রে বলতে লাগল- ফুলের তলে বুলবুল ছানা তারে উড়িয়ে দেনা- উড়িয়ে দেনা- অমনি তার মনিব ইশার বুঝতে পেরে দাড়ি ঝেড়ে ভাত ফেলে দিল। কাজি সাহেব বাড়ি এসে বুদ্ধুকে বললেন, ‘দেখলি ত কেমন কায়দা! আমার দাড়িতে যদি খাবার সময় ভাত লাগে, তুইও ঠিক তেমনি ক’রে বলবি।’ তারপর একদিন কাজি সাহেবের বাড়িতে খুব ভোজ হচ্ছে, কাজি সাহেব চাকরের কেরামতি দেখাবার জন্য ইচ্ছা ক’রে তাঁর দাড়িতে একটা ভাত ফেলে দিলেন আর বুদ্ধুকে চোখ টিপে ইশারা করলেন। বুদ্ধু অমনি চেঁচিযে বলল, ‘সেই যে সেদিন অমুকদের বাড়িতে না কিসের কথা হয়েছিল? আপনার দাড়িতে তাই হয়েছে- তানানা নানা।’ শুনে সব লোক হো হো করে হেসে উঠল। একদিন মনিব বল্লেন,‘দেখ তুই বড় বিশ্রী ভাত রাঁধিস। তুই এখানো ফেন গালাতেই শিখিস নি। আজ যখন ভাত বানাবি, ভাত সিদ্ধ হলেই আমাকে ডাকিস আমি দেখিয়ে দেব। আমাকে না দিখেয়ে কিছু করিস্‌ নি।’ সেদিন ভাত সিদ্ধ হতেই ত চাকর মনিবকে ডাকতে গিয়েছে। দরজার বাইরে থেকে উঁকি মেরে একটা আঙুল দিয়ে ইশারা করে সে মনিবকে ডাকতে লাগল। কাজ সাহেব তখন দরজার দিকে পিছন ফিরে কি যেন লিখছিলেন, তিনি এ- সব কিছুই জানেন না। চাকরটা ঘণ্টাখানেক এইরকম ‘ডেকে’ শেষটায় হয়রান হয়ে পড়ল। তখন সে রেগে চিৎকার করে বলল, ‘আর কতক্ষন ডাকব? এদিকে ভাতটাত সব ত পুড়ে ছাই হয়ে গেল।’ তখন কাজি সাহেব ফিরে দেখেন, চাকর তাঁকে একটা আঙুল দিয়ে ইশারা করছে- ওদিকে সত্যি সত্যিই ভাত পড়ে ছাই। একদিন রাত্রে কাজি সাহেবের বাড়ি চোর ঢুকেছে। বুদ্ধু খচমচ শব্দ শুনে জিজ্ঞাসা করল, ‘কে রে?’ চোরটা গম্ভীর বাবে বলল, ‘কেউ নই।’ তা শুনে বুদ্ধু আবার নিশ্চিন্ত হয়ে ঘুমাতে লাগল। সকালে উঠে কাজি সাহেব দেখেন , তাঁর সব চুরি হযে গিয়েছে। বুদ্ধুকে জিজ্ঞাসা ক’রে যখন রাত্রের সব শুনলেন, তিনি খুব রেগে গালাগালি করতে লাগলেন। কিন্তু বুদ্ধু তাতে মুখ ভারি বেজার করে বলল, “তা কি করব- সে আমায় বারবার করে বললে, ‘কেউ নই, কেউ নই’। লোকটা ত দেখছি শুধু চোর নয় – ব্যাটা বেজায় মিথ্যাবাদী।” একদিন কাজি সাহেব শহরের বাইরে কোথায় যাবেন। যাবার সময় বুদ্ধুকে বরে গেলেন, ‘দেখিস , দরজাটার উপর ভাল করে চোখ রাখিস, দরজা ছেড়ে কোথাও যাস নে, তা হলে চোরে আমার সব নিয়ে যাবে।’ কাজি সাহেব চলে গেলেন, চাকর বেচারা এক লাঠি নিয়ে দরজায় পাহারা দিতে লাগল্‌ একদিন গেল, দুদিন গেল। তারপর দিন বুদ্ধু শুনল, এক জায়গায় ভারি তামাশা দেখান হচ্ছে। তাই ত, বেচারা কি করে? অনেক ভেবে সে করল কি, বাড়ির দরজা খানা খুলে সেটাকে ঘাড়ে নিয়ে তামাশা দেখতে গেল। এদিকে বাড়িতে চো ঢুকে যা কাণ্ড করে গেল, সে আর কি বলব! কাজি সাহেব বাড়িতে এসে দেখেন- সর্বনাশ, বাড়ির সিন্দক আলমারি সব খালি। ওদিকে বুদ্ধ ব’সে তামাশা দেখছে আর খুব সাবধানে দরজা পাহারা দিচ্ছে।
উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী
বেচারাম কেনারাম (নাটক) উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী প্রথম দৃশ্য (জামা রিপু করিতে করিতে কেনারাম চাকরের প্রবেশ) কেনা। ঐ যা! আবার খানিকটা ছিঁড়ে গেল। ছুঁতেই ছিঁড়ে যায়, তা রিপু করব কি? ভাল মনিব জুটেছে, যাই হোক, এই জামাটা দিয়েই ক’বছর কাটালে। তিন বছর ত আমিই এইরকম দেখছি, আরো বা ক’বছর দেখতে হয়। তবু যদি চারটে পেট ভরে খেতে দিত! তাও কেমন? সকালে মনিব চারটি ভাত খান, আমি ফ্যানটুকু খাই, রাত্রিরে তিনি হাঁড়ি চাটেন, আমি শুঁকি। তার উপর শ্রবণশক্তিটি কি প্রখর! বাড়িওয়ালা সেদিন টাকার জন্যে কি-ই না বললে! বাড়িওয়ালা বলে, ‘টাকা দেও, ঢের টাকা বাকি।’ মনিব বলেন, তা ভাল ভাল, তোমার বাড়ি আজ নেমন্তন্ন?’ বাড়িওয়ালা বলে, ‘এমন করে ভাড়া ফেলে রাখলে চলে কই?’ মনিব বলেন, ‘তা আচ্ছা চাকরটিও সঙ্গে যাবে।’ বাড়িওয়ালা বেচারী রেগেমেগে চলে গেল। বড়লোক হতে হলে বোধহয় আমার মনিবের মতই কত্তে হয়, কিন্তু এঁর কাছে থেকে বড়লোক হওয়ার কায়দাটাই শেখা হবে। বড়লোক হওয়ার ভরসা বড় নেই। রাখবার সময় কত আশাই দিয়েছিলেন, আর আজ এই তিন বছরে একটি পয়সাও মাইনে দিলেন না! দেখি আজ যদি মাইনে না দেয়, তবে আর এর কাজ করা হচ্ছে না। [প্রস্থান] (বেচারাম মনিবের প্রবেশ) মনিব। চাকরটা জামাটা নিয়ে কত কথাই বলছিল! বেটা ভেবেছে, আমি সত্যিই কালা। আরে আমার মত যদি কান থাকত, তা হলে আর চাকরি কত্তে হত না। আমি যা করে খাই, তাই করে খেতে পাত্ত। ঘরের ভিতরে ক’জন লোক, ক’জন জেগে আছে, ক’জন ঘুমুচ্ছে, দাওয়ায় কান পেতে সব বুঝে নি’। কোথায় সিন্দুকের ভেতরে আরশুলা কড়কড় কচ্চে, বাইরে থেকে বুঝে নি’। বাপু হে! কানে শুনি, কানে শুনি, কানে শোনাটা ত বেশ ভালই, কিন্তু না শোনার যে সুবিধা আছে, তা ত বুঝবে না? এই সেদিন বাড়িওয়ালা বেটা ফাঁকি দিয়ে টাকা আদায় কত্ত! কানে না শোনার কত সুবিধা দেখো, পাওনাদারদের টাকা দিতে হয় না, বাড়ি ভাড়া দিতে হয় না, চাকরের মাহিনা দিতে হয় না- (কেনারামের প্রবেশ) কেনা। (উচ্চৈঃস্বরে)। মশাই, হয় তিন বছরের মাইনে দিন, নাহয় আপনার এই-সব রইল, আমি চললেম। মনিব। ডাকওয়ালা? চিঠি? দেখি? কেনারাম। (স্বগত)। এই মুশকিল কল্লে! তা এবারে বাপু এক ফন্দি এঁটেছি-সব লিখে এনেছি। (প্রকাশ্যে) চিঠিই বটে, এই নিন্‌। মনিব (পাঠ)। ‘মনিব মহাশয়, কানে শুনেন না, কিন্তু পড়িতে অবশ্যই পারেন। তিনটি বৎসরের বেতন চুকাইয়া বিদায় দিতে আজ্ঞা হয়। শ্রীকেনারাম চাকর।’ – তাই ত, তোমার বেতনটা দিতে হল। তা রাখবার সময় ত কোন বন্দোবস্ত হয়নি, কাজকর্মও তেমন ভাল করে করনি। তিন বছরে তিন পয়সার বেশি তোমার প্রাপ্য হয় না। তা এই নেও। (তিন পয়সা প্রদান ও ধাক্কা দিয়া বহিস্করণ) দ্বিতীয় দৃশ্য (কেনারামের প্রবেশ) কেনা। এই বড়লোক হলাম আর কি! তিন-তিন বছরের মাইনে, ঢের টাকা-ঢের টাকা। এক দুই তিন, চার পাঁচ ছয়, সাত আট নয়, দশ এগার বার (পয়সা তিনটি পকেটে স্থাপন) (ছদ্মবেশী স্বর্গীয় দূতের প্রবেশ) স্বর্গীয় দূত। আরে ভাই, তোর যে ভারি ফূর্তি? কেনা। কে ও ? ছোট মানুষ? দাড়াঁও, চশমাটা বার করে নি’। দূত। কেন! চোখে কম দেখ বুঝি? কেনা। তা কেন? বড়লোক হয়েছি যে, ছোটমানুষ আর তেমন চট করে চোখে মালুম পড়ে না। দূত। বটে। এত বড়লোক কি করে হলি ভাই? কেনা। (পকেট চাপড়াইয়া)।-তি-ন-টি-ব-ছ-রে-মা-ই-নে। (এক একটি পয়সা বহিস্করণ ও গম্ভীরভাবে গণন) এ-এ-এ-ক-দু-উ-উ-ই, তি-ই-ই-ন (পকেট উল্টাইয়া গম্ভীরভাবে অবস্থান)। দূত। তাই ত ভাই, এত টাকা নিয়ে তুই কি করবি? আমি গরিব, আমাকে কিছু দে-না। কেনা। নিবি? এই নে। ভগবান আমাকে খেটে খাবার শক্তি দিয়েছেন, খেটে খাব। (পয়সা তিনটি প্রদান) দূত। তুই ভাই বেশ লোক, তোর মনটা খবই খোলা। আমি ঈশ্বরের দূত, ভাল লোক দেখলে পুরস্কার দি’। তোর ব্যবহারে খুব খুশী হয়েছি, তুই কি চাস্‌ বল্‌, যা চাস তাই পাবি। কেনা। অ্যাঁ, আপনি ঈশ্বরের দূত? তবে ত আপনার সম্মুখে আমি বড় বেয়াদপি করেছি? দূত। তোর কিছু ভয় নেই। তুই আমাকে ‘তুই’ ‘তুমি’ যা খুশি বল্‌, কিছুতেই বেয়াদপি হবে না। এখন তুই কি নিবি বল্‌। কেনা। তা দাদা, যদি দেবে এমন একখানা বেয়ালা দাও যে, যে তার আওয়াজ শুনবে তাকেই তিড়িং তিড়িং করে নাচতে হবে। দূত। (ঝুলি হইতে বেয়ালা বাহির করিয়া) এই নে। কেনা। বাঃ, বেশ হল, আমাকে ত সঙ্গে সঙ্গে নাচতে হবে না? দূত। না, সে ভয় তোর নেই। যা এখন ফূর্তি কর্‌গে। (দূতের প্রস্থানোদ্যম ও কেনারামের বাদ্যোদ্যম) আরে দূর্‌ হতভাগা, আমারই উপর পরীক্ষা করে বসলি। কেনা। তুমিই যে ফূর্তি করতে বললে দাদা! দূত। আমি আগে যাই, তারপর করিস। কেনা। আচ্ছা। তৃতীয় দৃশ্য (বেচারামের প্রবেশ) বেচা। ঐ ঝোপটাতে ফেলে গিয়েছিলুম। পুলিশ বেটা এমনি তাড়া কল্লে, ধরেই ফেলেছিল আর কি। চট করে টাকার থলেটি ঐ ঝোপটাতে ফেলে পালালুম, এখন পেলে বাঁচি। (থলি খুঁজিতে ঝোপে প্রবেশ) বাপ রে, কি ভয়ানক কাঁটা-এই পেয়েছি।! (কেনারামের প্রবেশ) কেনা। (স্বগত)। ঐ যে বেচুবাবু কাঁটাবনে ঢুকছেন। এইবারে এক গৎ বাজিয়ে নি, পুরোনো মনিব বটে! (বেহালাবাদন) বেচা। (নৃত্য করিতে করিতে)। আরে! আরে! ও কী? উঃ আঃ! আরে তুমি কি-উঃ চক্ষু হু-আরে আর না-জামাটা-উঃ-গায়ের চামড়াও যে ছিঁড়ে গেল-উঃ! কেনা। আজ্ঞে, আমি আপনার বকেয়া চাকর কেনারাম, মাইনে চুকিয়ে দিয়েছেন বলে কি এমন মনিবকে ভুলতে পারি? আপনাকে বাজনা শুনিয়ে আমার বেয়ালা সার্থক হল। (পুনরায় দ্বিগুণ উৎসাহে বাদন) বেচা। (নৃত্য)। কি মুশকিল। বাবা কেনারাম রক্ষে কর বাবা। এ কি বাজনা যে, শুনলেই নাচতে হয়? বাবা আর কাজ নেই, আমি খুব খুশি হয়েছি, এই টাকার থলি তোমায় দিচ্ছি, তোমার মাইনে এ থেকে পুষিয়ে নাও। দোহাই বাবা, আমায় নাচিও না। (টাকার থলি কেনারামের হাতে প্রদান) কেনা। (বিনীত অভিবাদন করিয়া)। আজ্ঞে, না হবে কেন? আপনার মত মনিব না হলে গুণ কে বোঝে! দেখছি বেয়ালার আওয়াজে আপনার ‘কানে খাটর’ ব্যারামটাও সেরে গেল। ভাল ভাল, আর এ ব্যারামের সুত্রপাত দেখলে আমায় খবর দেবেন, আমি বেয়ালা নিয়ে এসে চিকিৎসা করব। (দীর্ঘ অভিবাদন করিয়া প্রস্থান) বেচা। হতভাগা বেটা, লক্ষীছাড়া বেটা, জোচ্চোর, বাটপাড়, ডাকাত-বেটাকে দেখাচ্ছি। পুলিস। পুলিস। চোর-চোর! চতুর্থ দৃশ্য (বিচারালয়। ব্যস্তভাবে বেচারামের প্রবেশ) বেচা। দোহাই হুজুর, আমাকে ধনে-প্রাণে মেরেছে, ও হো হো (ক্রন্দন) বিচারক। আরে ব্যাপার কি? তোমার কি হয়েছে? বেচা। (কাঁটার আঁচড় ও তবিত শরীর দেখইয়া)-আর কি হবে, আমি ধনে-প্রানে গিয়েছি। বড় রাস্তার ধারে ঐ কেনা বেটা আমাকে মেরে ধরে টাকাকড়ি কেড়ে নিয়েছে-এঁ হেঁ হেঁ (‌ক্রন্দন)। বেটাকে তিন বছর আমি খাইয়ে মানুষ কলুম, আর তার এই প্রতিশোধ দিলে। বেটা দিনরাত বেহালা নিয়ে ফেরে, এখনি ধরতে পাঠান, তাকে দেখলেই চিনতে পারবেন! বিচারক। চারজন লোক এখনি গিয়ে কেনারামকে ধরে নিয়ে এসো। (কেনারামকে লইয়া চারজন লোকের প্রবেশ) বেচা। ঐ! ঐ! ঐ বেটা। হুজুর! ঐ কেনারাম বেটা আমার সর্বনাশ করেছে, বেটাকে আচ্ছা করে- বিচারক। চুপ। (কেনার প্রতি) তুমি একে মেরে এর টাকা কেড়ে নিয়েছ? কেনা। সে কি, হুজুর! উনি আমার বেয়ালা বাজানো শুনে আমায় এক থলি টাকা পুরস্কার দিয়েছেন-আমি যথার্থ বলছি। বিচারক। ওর যে চেহারা দেখছি, তাতে ও যে বেহালা শুনে তোমায় এতগুলো টাকা দিয়েছে, তা আমি কিছুতেই বিশ্বাস কত্তে পারিনে। আর ওর গায়েও এই-সব দাগ দেখছি। সুতরাং প্রমান হচ্ছে, তুমিই ওকে মেরে টাকার থলি কেড়ে নিয়েছ। এ ডাকাতি। ডাকাতির শাস্তি ফাঁসি-তোমার ফাঁসি হবে। এখন তোমার যদি কোন আকাঙ্খা থাকে ত বলো। কেনা। হুজুর, আমার আর কোন সাধ নেই। খালি জন্মের মত বেয়ালা খানা একবার বাজাতে চাই। বেচা। সর্বনাশ! হুজুর এমন হুকুম দেবেন না। চাপরাশী। (বেচারামকে রুলের গুঁতো মারিয়া) চুপ্‌ রও। বিচারক। আর কোন সাধ তোমার নাই? আচ্ছা বাজাও। (কেনারামের উৎসাহের সঙ্গে বেহালাবাদন ও বিচারক হইতে চাপরাশী পর্যন্ত সকলে নৃত্য।) বিচারক। হাঁপাইতে হাঁপাইতে।) আরে বাপু! থাম্‌ থাম্‌। শিগ্‌গির থাম্‌; তোকে বেকসুর খালাস দিচ্ছি, প্রাণ যায়-থাম্‌। বাপ রে, এ কি রকম বেহালা বাজনা! কেনা। (সেলাম করিয়া)। হুজুর! বেচুবাবুকে এখন সমস্ত ঘটনা বলতে হুকুম হয়। নইলে আমি পুনরায় বেয়ালায় ছড়ি দিলাম। বিচারক। (বেচারামের প্রতি সরোষে)। বল্‌ বেটা কি হয়েছিল, সত্যি করে এখনি বল্‌। বেচা। ওগো, না গো, আর বেহালা ধরো না। ও টাকা আমিই দিয়েছি-দিয়েছি। বিচারক। তুই এত টাকা কোথা পেলি, বল। বেচা। আমি-আমি- কেনা। এই বেয়ালা ধরেছি। বেচা। না না-আমি, হুজুর আমি-কাল রাত্তিরে হুজুর, চুরি করেছিলাম। দোহাই হুজুর। কেনা। ধর্মের ঢাক আপনি বাজে। দেখলেন ত বেচুবাবু? বিচারক। একে পঁচিশ ঘা বেত মারো।
উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী
বড়লোক কিসে হয়? উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী ‘সহজে কি বড়লোক হওয়া যায়’ এই নামের প্রস্তাবটি শেষ করিবার সময় আমরা গিরিশের পরে কি হইল, তৎসম্বন্ধে কিছু বলিতে প্রতিশ্রুত হইয়াছিলাম। কিন্ত গিরিশের জীবনে এত কষ্ট সহ্য করিতে হইয়ছিল যে আমরা সে-সব বলিতেও কষ্ট বোধ করি। তবে এইমাত্র বলা আবশ্যক যে, বেচারা কোন দিনই বড়লোক হইতে পারে নাই। দুঃখ কষ্টের একশেষ তাহার জীবন হইয়াছিল। পরিশেষে সে নিজের হাতে নিজের জীবন শেষ করিয়া দিল। গিরিশেস সম্বন্ধে যে-সকল কথা বলা হইয়াছে, মোটামুটি সকলগুলিই সত্য। কথাগুলি যথার্থ বলিয়াই সেগুলি এত গুরুতর। তাহার ভাগ্যে যাহা ঘটিয়াছিল,আমরা যদি তাহার মতন কাজ করি, কে জানে, কোন দিন আমাদের সম্বন্ধেও কেউ এইরূপ গল্পসকল বলিয়া লোককে সাবধান করিবে না। পরে কষ্ট পাওয়ার চাইতে আগে সতর্ক হওয়া ভাল। বড়লোক হওয়ার ইচ্ছা থাকিলেই কিন্ত বড়লোক হয় না; তাহা হইলে অত কম লোক বড়লোক হইতে দেখিতাম না। ইচ্ছা ত সকলেরই আছে, তোমার আমার নাই? কিন্ত আমি তো আজিও ছোটলোকই রহিয়াছি! শুধু ইচ্ছা থাকিলেই বড়লোক হয় না; ইচ্ছার খুব দরকার, কিন্ত আরো কিছু চাই। গিরিশের ইচ্ছা যথেষ্ট ছিল। তাহার পক্ষে যতটুকু কুলাইয়াছিল, সে ত চেষ্টার ত্রুটি করে নাই। কিন্ত তবুও সে বড়লোক হইল না! হইবে কেমন করিয়া? কিরূপে কেমন করিয়া কি করিতে হইবে তাহা যদি না জানিলাম, তবে ত সেই গাধা রামকন্তের মতই রহিলাম। রাম কাসে একদিনও উপরে উঠিতে পারিল না, নীচে নামিবারও জায়গা ছিল না গুরু মহাশয় তাহাকে তিরস্কার করিয়া বলিতেন, ‘ ওরে তোর আর কি কিছু হবে! ভাল ছেলে হ’তে হ’লে তেল পোড়াতে হয়, খাটতে হয়, কষ্ট সহ্য করতে হয়!’ রামকান্ত একদিন বাড়ি আসিয়াই দু সের তেল কিনিয়া আনিল। ঐ তেলে কাপড় ভিজাইয়া তাহাতে আগুন লাগাইয়া দিল। তারপর ঘরের চালে দড়ি বাঁধিয়া তাহাতে প্রাণপণে দুলিতে লাগিল। সর্বশেষে দড়ি ছিঁড়িয়া আগুনের উপর অর্ধ দগ্ধ, অর্ধ ভগ্ন শরীরে নিস্কৃতি পাইল। যে দুই সপ্তাহ শয্যাগত থাকিতে হইয়াছিল, তাহার মধ্যে অনেক ভাবিয়া চিন্তিয়া ঠিক করিল, মাষ্টার মহাশয় ভুল করিয়াছেন। সে সরল লোক, যেদিন স্কুলে গেল সেদিনই মাস্টার মহাশয়ের সঙ্গে এ বিষয়ে তর্ক করিল। রামকান্তের যে ভুল, গিরিশ বেচারারও সেই ভুল। ভাই, আমরা যে বড়লোক হই না, আমাদেরও অনেকের সেই ভুল। যদি বড়লোক হইতে ইচ্ছা থাকে-‘নাই’ যদি বল তবে আমি হাসিব-তবে প্রথমে কি কি কাজ করিলে বড়লোক হয়, বেশ করিয়া জান। তারপর নিঃশব্দে শান্তভাবে আপন কার্যে প্রবৃত্ত হও। অনেক কষ্ট পাইতে হইবে; তাহার জন্য যথেষ্ট সহিষ্ণুতা চাই। অনেক সুখ পায়ে ঠেলিতে হইবে; তাহার জন্য সমুচিত ত্যাগ স্বীকারের প্রয়োজন। এত করিয়াও কত জন উপযুক্ত বুদ্ধির অভাবে বড় হইতে পারিতেছে না। তুমিও পারিবে কি না জানি না-আমি ইচ্ছা করিতেছি তোমরা সকলেই পারিবে।-কিন্ত ইহা বলিতে পারি যে তোমার পক্ষে যতটুকু হওয়া সম্ভব, তাহা হইতে গেলেই আমি যাহা বলিলাম সব কয়টি করিতে হইবে। বড়লোক, বড়লোক, এতবার বলিলাম। কিন্ত কতজন বড়লোক হইতে চাহিতেছেন, সকলেই কি বুঝিতে পারিতেছেন যে বড়লোক হওয়ার অর্থ কি? একটা লোক বলিতেছিল যে, ‘আমার ছেলের বিবাহেতে লক্ষ লক্ষ টাকা ব্যয় করিয়াছি।’ তাহাকে জিজ্ঞাসা করা হইল, ‘বল ত দেখি লাখ টাকার কথা বলা বলিলে কতগুলি টাকার কথা বলা হয়?’ সে বলিল কেন, ‘কেন, লাক টাকা আর লাক টাকা, দুকুড়ি দশ টাকা।’ বড়লোক হওয়া সম্বন্ধেও অনেকের ঐরূপ মত। অনেকের কেবল নিজের বেলাই ঐ মত। তাহারা বড় ছোট লোক। ভাই, বড়লোক না হও দুঃখ নাই; কিন্ত ছোট লোক হইও না। কোন ভাল বিষয়ে খুব ভাল হইলে বড়লোক হয়। যেমন বিদ্যাসাগর মহাশয় বড়লোক, মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর বড়লোক, লর্ড রিপন বড়লোক, ডাক্তার মহেন্দ্রলাল সরকার বড়লোক, সুরেন্দ্র বাবু বড়লোক, ইত্যাদি, ইঁহাদের সকলেই এক বিষয়ের জন্য বড় হন নাই। কিন্ত একটু চিন্তা করিলেই দেখিবে, ইঁহাদের যাঁহার মধ্যে যেটুকু ভাল তাহার জন্যই তাঁহাকে বড়লোক বলা হয়। বড় চোরকেও বড়লোক বলা হয় না, বড় ডাকাতকেও বড়লোক বলা হয় না। আর এক কথা। বিদ্যাসাগর মহাশয়ের বিদ্যার জন্য আমরা তাঁহাকে অত বড়লোক বলি না। মহেন্দ্র বাবু নিজের ঘরে কবাট দিয়া বিজ্ঞান চর্চা করিলে আমরা তাঁহাকে অত বড়লোক বলিতাম না, অন্তত তাঁহার প্রতি আমাদের অত শ্রদ্ধা হইত না। দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর, লর্ড রিপন, ইঁহারা কে কি শাস্ত্র অধিক জানেন, কি কিছুই জানেন না, তাহার হিসাবও হয়ত আমরা কেহ দিতে পারিব না। সুরেন্দ্র বাবুর স্কুল আছে, সেখানে তিনি পড়ান, এজন্য তাঁহাকে কেহ বড়লোক বলে না। যিনি যে পরিমানে লোকের উপকার করিতেছেন, তিনি সেই পরিমানে লোকের ভালবাসা পাইতেছেন। বড়লোক এবং ভাল লোক, এ উভয়ই যথার্থ বড়লোক। বড়লোক হওয়া যেরূপই কঠিন হউক না কেন, ভাল লোক চেষ্টা করিলেই হওয়া যায়। এবং তাহাই আগে হওয়া উচিত। কাহারো যদি এক কোটি টাকা থাকে, তাঁহাকে সুদ্ধ ঐ টাকাগুলির জন্য বড়লোক বলিব না। তিনি নিজের সদ্‌গুনের সাহায্যে উহা উপার্জন করিয়া থাকিলে অবশ্য তাঁহাকে বড়লোক বলিব। কিন্ত যখন দেখি ঐ টাকা দিয়া দেশের উপকার করিতেছেন, তখনই তাঁহাকে যথার্থ বড়লোক বলিব। কারণ, তখন তিনি বড়লোক এবং ভাল লোক উভয়ই হইয়াছেন। বড়লোক বড়, ভাল লোক ভাল, বড়লোক ভাল হইলে বড় ভাল।
উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী
ভীতু কামা (জুলু দেশের গল্প) উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী এক যে ছিল ছোট ছেলে, তার নাম ছিল কামা। সে এতটুকু মানুষ ছিল, তার পেটটি ছিল বড়, হাত-পা ছিরল কাঠি কাঠি। সে অন্য ছেলেদের সঙ্গে জোরে পারত না, খেলতে গেলে খালি তাদের হাতে মার খেত। বেচারা চুপ করে সে সব সয়ে থাকত, তার গায়ে জোর ছিল না, কাজেই কি নিয়ে ঝগড়া করবে? তার ইচ্ছা হত যে সে খুব ভারি ভারি কাজ করে, খালি গায় জোর ছিল না বলে সেসব কিছু করতে পারত না। গ্রামের লোকেরা তাকে বলত ভীতু কামা। তারা চাইত যে, গ্রামের ছেলে পিলে খুব ষণ্ডা আর সাহসী হয়। তাদের সর্দার যখন দেখল যে কামা তার কিছুই হচ্ছে না, তখন সে তাকে গ্রাম থেকে তাড়িয়ে দিল। কামা ভাবল-ওমা! কি হবে? আমি কোথায় যাব? গ্রাম থেকে ত আমাকে তাড়িয়ে দিয়েছে। এখন পরীর পাহাড়ে গিয়ে দেখি, পরীরা আমাকে কি করে! সে দেশে একটা গোলপানা পাহাড় ছিল, তাতে পরীরা থাকত! সেখানকার লোকেরা তাদের ভয়ে কেউ সেখানে যেত না। কামা ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে সেই পরীর পাহাড়ে গিয়ে উপস্থিত হল, আর অমনি খুদে খুদে কালো সব পরী এসে তাকে ঘিরে ফেলল। তারা জুলু দেশের পরী কিনা, তাই কালো, তাদের ফড়িং-এর মতন ডানা আর হাতে ঢাল আর বর্শা। কামাকে তাদের পাহাড়ে আসতে দেখে তারা এমনি চটেছে যে কি আর বলব। তাদের রাজা এসে তাকে বলল-‘তুই যে আমাদের পাহড়ে এলি? দাঁড়া, এখনি তোকে মেরে ফেলছি।’ কামা কাঁপতে কাঁপতে হাতজোড় করে বলল-‘দোহাই রাজামশাই, আমাকে মারবেন না। আমি ভীতু কামা, আপনাদের কোন ক্ষতি করবার ক্ষমতা আমার নাই, আমাকে মেরে কি হবে? পরীর রাজা বলল-‘বটে? তুই ভীতু কামা? হাঁ হাঁ, তোর কথা শুনেছি বটে। তোর গায় জোর নাই, কিন্তু তোর মনটাতে সাহস আছে। আচ্ছা বাছা, তোর আর অমনি করে ভয়ে কাঁপতে হবে না, আমি তোকে পালোয়ন করে দিচ্ছি।’ বলে পরীর রাজা মাটিতে একটা সিংহের চামড়া বিছিয়ে কামাকে বলল-‘এর উপর শুয়ে একটু ঘুমো দেখি?’ কামা সেই সিংহের চামড়ার উপরে ঘুমিয়ে পড়ল। তারপর যখন তার ঘুম ভেঙ্গে ছে, তখন সে দেখে, তার আর সেই কাঠি কাঠি হাত পা নাই, সে ভারি এক পালোয়ান হয়ে গেছে। আর তার মনে হচ্ছে, যেন সে এক থাপ্পড়ে হাতি মেরে ফেলতে পারে! তখন কামা চারদিকে চেয়ে দেখল যে, সেই পাহাড়ের উপর সে একলাটি দাঁড়িয়ে আছে। পরীদের একজনও সেখানে নাই, তার জন্য মস্ত বড় ঢাল আর বর্শা রেখে কোথায় চলে গেছে। সেই ঢাল আর সেই বর্শা হাতে করে কামা পাহাড় থেকে নেমে ঘরের দিকে চলল। খানিক দূর এসে সে দেখল যে ভয়ঙ্কর একটা সিংহ হাঁ করে তাকে খেতে এসেছে। সে কি আর এখনর সিংহকে ডরায়? তার বর্শার এক খোঁচা খেয়েই সেই সিংহ জিব বার করে, চোখ উলটিয়ে মরে গেল। সেই সিংহটাকে কাঁধে ফেলে, ঢাল আর বর্শা হাতে যখন কামা গ্রামে এসে উপস্থিত হয়েছে, তখন ত তাকে দেখে আর কারুর মুখ দিয়ে কথা বেরুচ্ছে না। গ্রামের জোয়ানেরা এসে তার ঢাল আর বর্শা আর সিংহটাকে নিয়ে কত টানাটানি করল, কিন্তু কেউ তাকে একটু নাড়াতেও পারল না! গ্রামের সর্দার আগে আমাকে তাড়িয়ে দিয়েছিল, এখন সে তাকে কি করে আদর দেখাবে, তাই ভেবে ঠিক করতে পারছে না! তখনি সে তাকে একখানি ঘর আর অনেকগুলি ষাড় দিয়ে দিল। এখন আর কামার কোন দঃখ নাই। সে সেই ঘরখানিতে তার মাকে নিয়ে থাকে। আগে যারা বলত ‘ভীতু কামা’-এখন তারা বলে ‘কামা পালোয়ান।’
উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী
ভুতো আর ঘোঁতো উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী ভুতো ছিল বেঁটে আর ঘোঁতো ছিল ঢ্যাঙা। ভুতো ছিল সেয়ানা, আর ঘোঁতো ছিল বোকা। দুজনে মিলে গেল কুলগাছ থেকে কুল পড়াতে। ঘোঁতো কিনা ঢ্যাং, সে দুহাতে খালি কুলই পাড়ছে। ভুতো কিনা বেঁটে, তাই সে কুল নাগাল পায় না, সে শুধু ঘোঁতোর পাড়া কুল খাচ্ছে। কুল পাড়া হয়ে গেলে ঘোঁতো বলল, ‘কুল কইরে?’ ভুতো বলল, ‘নেই। খেয়ে ফেলেছি।’ ঘোঁতো বলল, ‘বটে রে? তবে দাঁড়া লাঠি আনছি।’ বলেই অমনি ঘোঁতো গেল গাছ কাটতে। গাছ দিয়ে লাঠি বানাতে। লাঠি দিয়ে ভুতোকে মারতে। সে কেন কুল খেয়ে ফেলল-একটাও রাখল না? গাছ বলল, ‘এই যে ঘোঁতো। কেমন আছ? কোথা যাচ্ছ?’ ঘোঁতো বলল, ‘গাছ কাটতে; গাছ দিয়ে লাঠি বানাতে; লাঠি দিয়ে ভুতোকে মারতে; সে কেন কুল খেয়ে পেলল, একটাও রাখল না?’ গাছ বলল, ‘আমাকে কাটবে? কি দিয়ে কাটবে? কুড়ুল কই? ঘোঁতো গেল কুড়ুল আনতে। কুড়ুল বলল, ‘এই যে ঘোঁতো? কেমন আছ? কোথায় যাচ্ছ?’ ঘোঁতো বলল, ‘কুড়ুল আনতে; কুড়ুল দিয়ে গাছ কাটতে; গাছ দিয়ে লাঠি বানাতে; লাঠি দিয়ে ভূতোকে মারতে; সে কেন কুল খেয়ে ফেল, একটাও রাখল না?’ কুড়ুল বলল, ‘আমাকে নেবে? শানাবে কিসে? পাথর কই?’ ঘোঁতো গেল পাথর আনতে। পাথর বলল, ‘এই যে ঘোঁতো! কেমন আছ? কোথায় যাচ্ছ?’ ঘোঁতো বলল, ‘পাথার আনতে; আথর দিয়ে কুড়ুল শানাতে; কুড়ুল দিয়ে গাছ কাটতে; গাছ দিয়ে লাঠি বানাতে, লাঠি দিয়ে ভুতোকে মারতে; সে কেন কুল খেয়ে ফেলল, একটাও রাখল না?’ পাথর বলল, ‘আমাকে নেবে? ভেজাবে কি দিয়ে? জল কই?’ ঘোঁতো গেল জল আনতে। জল বলল, ‘এই যে ঘোঁতো। কেমন আছ? কোথা যাচ্ছ?’ ঘোঁতো বলল, ‘জল আনতে; জল দিয়ে পাথর ভেজাতে; পাথর দিয়ে কুড়ুল শানাতে; কুড়ুল দিয়ে গাছ কাটতে; গাছ দিয়ে লাঠি বানাতে; লাঠি ভুতোকে মারতে, সে কেন কুল খেয়ে ফেলল, একটাও রাখল না?’ জল বলল, ‘আমাকে নেবে? হরিণ আসবে, আমাতে নামবে, গা ভিজবে, তবে ত হবে।’ ঘোঁতো গেল হরিণের কাছে হরিণ বলল, ‘এই যে ঘোঁতো, কেমন আছ? কোথায় যাচ্ছ?’ ঘোঁতো বলল, ‘হরিণ দিয়ে জল তোলাতে; জল দিয়ে পাথর ভেজাতে; পাথর দিয়ে কুড়ুল শানাতে; কুড়ুল দিয়ে গাছ কাটতে; গাছ দিয়ে লাঠি বানাতে; লাঠি দিয়ে ভুতোকে মারতে; সে কেন কুল খেয়ে ফেলল, একটাও রাখল না?’ হরিণ বলল, ‘আমাকে নেবে? কুকুর কই? আমাকে ধরবে কে?’ ঘোঁতো গেল তাদের কুকুর ভোলাকে ডাকতে। ভোলা বলল, ‘এই যে ঘোঁতো! কেমন আছ?’ ঘোঁতো বলল, ‘ভোলাকে ডাকতে; ভোলাকে দিয়ে হরিণ ধরাতে; হরিণ দিয়ে জল তোলাতে; জল দিয়ে পাথর ভেজাতে; পাথর দিয়ে কুড়ুল শানাতে; কুড়ুল দিয়ে গাছ কাটতে; গাছ দিয়ে লাঠি বানাতে; লাঠি দিয়ে ভুতোকে মারতে ; সে কেন কুল খেয়ে ফেলল, একটাও রাখল না?’ ভোলা বলল, ‘আমাকে নেবে? তবে মাখন আনো, নখে মাখি।’ ঘোঁতো গেল মাখন আনতে। মাখন বলল, ‘এই যে ঘোঁতো! কেমন আছ? কেথায় যাচ্ছ?’ ঘোঁতো বলল, ‘মাখন আনতে, ভোলাকে দিতে, নখে মেখে হরিণ ধরতে; হরিণ দিয়ে জল তোলাতে; জল দিয়ে পাথর ভেজাতে; পাথর দিয়ে কুড়ুল শানাতে; কুড়ুল দিয়ে গাছ কাটতে; গাছ দিয়ে লাঠি বানাতে; লাঠি দিয়ে ভুতোকে মারতে; সে কেন কুল খেয়ে ফেলল, একটাও রাখল না?’ মাখন বলল, ‘আমাকে নেবে? তবে বেড়াল আনো, চেটে তুলুক।’ ঘোঁতো গেল তাদের মেনির কাছে। মেনি বলল, ‘এই যে ঘোঁতো! কেমন আছ! কোথায় যাচ্ছ? ঘোঁতো বলল, ‘মেনিকে খুঁজতে, মাখন চেটে ভোলাকে দিতে, নখে মেখে হরিণ ধরতে, হরিণ দিয়ে জল তোলাতে; জল দিয়ে পাথর ভেজাকে; পাথর দিয়ে কুড়ুল শানাতে; কুড়ুল দিয়ে গাছ কাটতে; গাছ দিযে লাঠি বানাতে; লাঠি দিয়ে ভুতোকে মারতে; সে কেন কুল খেয়ে ফেলল, একটাও রাখল না? মেনি বলল, আমকে নেবে? দুধ দাও তবে, খাই আগে।’ ঘোঁতো গেল গাইয়ের কাছে। গাই বলল, ‘এই যে ঘোতো! কেমন আছ? কোথায় যাচ্ছে?’ ঘোঁতো বলল, ‘গাইয়ের কাছে দুধ আনতে; মেনির তা খেয়ে মাখন চেটে ভোলাকে দিতে, নখে মেখে হরিণ ধরতে; হরিণ দিয়ে জল তোলাতে; জল দিয়ে পাথর ভেজাতে; পাথর দিয়ে কুড়ুল শানাতে; কুড়ুল দিয়ে গাছ কাটতে; গাছ দিয়ে লাঠি বানাতে; লাঠি দিয়ে ভুতোকে মারতে; সে কেন কুল খেয়ে ফেলল, একটাও রাখল না?’ ‘দুধ নেবে? খড় আনো তবে, খাই আগে!’ ঘোঁতো গেল চাষার কাছে। চাষা বলল, ‘এই যে ঘোঁতো! কেমন আছ? কোথায় যাচ্ছ! ঘোঁতো বলল, চাষার কাছে খড় আনতে; গাইকে দুধ পেতে, মেনি খেয়ে মাখন চেটে ভোলাকে দিতে, নখে মেখে হরিণ ধরতে; হরিণ দিয়ে জল তোলাতে; জল দিয়ে পাথর ভেজাতে; পাথর দিয়ে কুড়ুল শানাতে; কুড়ুল দিয়ে গাছ কাটতে; গাছ দিয়ে লাঠি বানাতে; লাঠি দিয়ে ভুতোকে মারতে। সে কেন কুল খেয়ে ফেলল, একটাও রাখল না?’ চাষা বলল, ‘খড় নেবে? আটা আনো, পিঠে খাব।’ ঘোঁতে গেল মুদীর কাছে। মুদী বলল, ‘এই যে ঘোঁতো! কেমন আছ? কোথায় যাচ্ছ?’ ঘোঁতো বলল, ‘মুদীর কাছে আটা আনতে, চাষাকে দিয়ে খড় নিতে; খড় নিয়ে গাইকে দিয়ে দুধ পেতে, মেনি তা খেয়ে মাখন চেটে ভোলাকে দিতে; নখে মেখে হরিণ ধরতে; হরিণ দিয়ে জল তোলাতে, জল দিয়ে পাথর ভেজাতে; পাথর দিয়ে কুড়ুল শানাতে; কুড়ুল দিয়ে গাছ কাটতে; গাছ দিয়ে লাঠি বানাতে; লাঠি দিয়ে ভুতোকে মারতে। সে কেন কুল খেয়ে ফেলল, একটাও রাখল না?’ মুদী বলল, ‘নদী থেকে এই চালনি ভরে জল আনো, নইলে আটা পাবে না।’ চালনি নিয়ে খুশি হয়ে ঘোঁতো গেল নদী থেকে জল আনতে। জল ত তাতে থাকে না, তুলতে গেলেই পড়ে যায়। যত তোলে ততই পড়ে। বেলা হল, বেলা গেল, সন্ধ্যা এল। ঘোঁতো তবু খালি চালনি ডোবাচ্ছ আর তুলছে, আর খালি ঝরঝর করে পড়ে যাচ্ছে। ঘোঁতো বলল, কি মুশকিল! এখনকি হবে? সেখানে কতকগুলো হাঁস ছিল, তাঁরা প্যাঁক প্যাঁক করে ডাকছিল। তা শুনে ঘোঁতো বলল, ‘আরো তাই ত, ঠিকই ত বলেছে। চালনিতে পাঁক মাখিয়ে নিতে হবে, তাহলেই ফুটো বন্ধ হয়ে যাবে আর জল ধরবে।’ নদীর ধারে পাঁক ছিল, ঘোঁতো তাই নিয়ে চালনিতে মাখাল। ফুটো বন্ধ হয়ে গেল, আর জল পড়তে পেল না। ঘোঁতো তখন হাসতে হাসতে জল নিয়ে মুদীর কাছে ফিরে এল। মুদী তাতে খুশী হয়ে ঘোঁতোকে ঢের আটা দিল। আটা নিয়ে ঘোঁতো গেল চাষার কাছে। চাষা তাতে খুশি হয়ে ঘোঁতোকে খড় দিল। খড় নিয়ে ঘোঁতো দিল গাইকে; গাই তা খেয়ে খুশি হয়ে ঢের দুধ দিল। দুধ নিয়ে ঘোঁতো দিল মেনিকে; মেনি তা খেয়ে খুশি হয়ে মাখন চেটে ভোলাকে দিল। ভোলা সে মাখন নখে মেখে হরিণ ধরে আনল। হরিণ গিয়ে জলে নেমে গা ভিজিয়ে এল। ঘোঁতো তার গা থেকে জল নিয়ে পাথরে দিল, সেই পাথরে কুড়ুল শান দিল, সেই কুড়ুল দিয়ে গাছ কাটল, সেই গাছ দিয়ে লাঠি বানাল, সেই লাঠি নিয়ে দাঁত কড়মড়িয়ে ছুটে গেল কুলগাছতলায় ভুতোকে মারতে। ভুতো কি ততক্ষণ গাছতলায় বসে? সে তার কত আগেই ছুটে পালিয়েছে।
উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী
ভূতের গল্প উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী সূচিপত্রসূচিপত্র আমি ভূতের গল্প বড় ভালবাসি। তোমরা পাঁচ জনে মিলিয়া গল্প কর, সেখানে পাঁচ ঘন্টা বসিয়া থাকিতে পারি। ইহাতে যে কি মজা! একটা শুনিলে আর-একটা শুনিতে ইচ্ছা করে, দুটা শুনিলে একটা কথা কহিতে ইচ্ছা করে। গল্প শেষ হইয়া গেলে একাকী ঘরের বাহিরে যাইতে ইচ্ছে হয় না। তোমাদের মধ্যে আমার মতন কেহ আছ কি না জানি না, বোধ হয় আছে। তাই আজ তোমাদের কাছে একটা গল্প বলি। গল্পটা একখানি ইংরেজি-কাগজে পড়িয়াছি। তোমাদের সুবিধার জন্য ইংরেজি নামগুলি বদল করিয়া দিতে ইচ্ছা ছিল, কিন্তু গল্পটি পড়িলেই বুঝিতে পারিবে যে শুধু নাম বদলাইলে কাজ চলিবে না। সুতরাং ঠিক যেরূপ পড়িয়াছি, প্রায় সেইরূপ অনুবাদ করিয়া দেওয়াই ভাল বোধ হইতেছে। ‘স্কটল্যাণ্ডের ম্যাপটার দিকে একবার চাহিয়া দেখিলে বাঁ ধারে ছোট ছোট দ্বীপ দেখিতে পাইবে। তাহার উপরেরটির নাম নর্থ উইস্ট্‌, নীচেরটির নাম সাউথ্‌ উইস্ট্। এর মাঝামাঝি ছোট-ছোট আর কতকগুলি দ্বীপ দেখা যায়। এ সেকালের কথা, তখত স্টীম্ এঞ্জিনও ছিল না, টেলিগ্রাফ্‌ও ছিল না। আমার ঠাকুরদাদা তখন এর একটি দ্বীপে স্কুলে মাস্টারি করিতেন।’ ‘সেখানে লোক বড় বেশি ছিল না। তাদের কাজের মধ্যে কেবল মাত্র মেষ চরান, আর কষ্টে সৃষ্টে কোন মতে দিন চলার মত কিছু শস্য উৎপাদন করা। সেখানকার মাটি বড় খারাপ; তারি একটু একটু সকলে ভাগ করিয়া নেয় আর জমিদারকে খাজনা দেয়। … এরা বেশ সাহসী লোক ছিল। আর ঐরকম কষ্টে থাকিয়া এবং সামান্য খাইয়াও বেশ একপ্রকার সুখে স্বচ্ছন্দে কাল কাটাইত।’ ‘এই দ্বীপে এল্যান্‌ ক্যামেরন নামে একজন লোক ছিলেন, তাঁহার বাড়ি গাঁ থেকে প্রায় এক মাইল দূরে। এল্যানের সঙ্গে মাস্টারমহাশয়ের বড় ভাব, তাঁর কাছে তিনি কত রকমের মজার গল্প বলিতেন। হঠাৎ একদিন ক্যামেরন বড় পীড়িত হইলেন, আর কিছুদিন পরে তাঁহার মৃত্যু হইল। তাঁহার কেউ আপনার লোক ছিল না, সুতরাং তাঁহার বিষয়-সমস্ত বিক্রি হইয়া গেল। তাঁর বাড়িটা কেহই কিনিতে চাহিল না বলিয়া তাহা অমনি খালি পড়িয়া রহিল।’ ‘এর কয়েক মাস পরে একদিন জ্যোৎন্সা রাত্রিতে ডনাল্ড্‌ ম্যাকলীন বলিয়া একটি রাখাল ঐ বাড়ির পাশ দিয়া যাইতেছিল। হঠাৎ জানালার দিকে তাহার দৃষ্টি পড়িল, আর সে ঘরের ভিতরে এল্যান্‌ ক্যামেরনের ছায়া দেখিতে পাইল। দেখিয়াই ত তার চক্ষু স্থির! সেখানেই সে হাঁ করিয়ার দাঁড়াইয়া রহিল। তাহার চুলগুলি খ্যাংরা কাঠির মত সোজা হইয়া উঠিল, ভয়ে প্রাণ উড়িয়া গেল, গলা শুকাইয়া গেল।’ ‘শীঘ্রই তাহার চৈতন্য হইল। ঐরকম ভয়ানক পদার্থের সঙ্গে কাহারই বা জানাশুনা করিবার ইচ্ছা থাকে? সে ত মার দৌড়! একেবারে মাস্টার-মশাইয়ের বাড়িতে। তাঁহার কাছে সব কথা সে বলিল। মাস্টারমহাশয় এ-সব মানেন না। তিনি তাহাকে প্রথম ঠাট্টা করিলেন, তারপরে বলিলেন, তাহার মাথায় কিঞ্চিৎ গোল ঘটিয়াছি; আরো অনেক কথা বলিলেন-বলিয়া যাথাসাধ্য বুঝাইয়া দিতে চেষ্টা করিলেন যে, ঐরূপ কিছুতে বিশ্বাস থাকা নিতান্ত বোকার কার্য।’ ‘ডনাল্ড্‌ কিন্তু ইহাতে বুঝিল না, সে অপেক্ষাকৃত সহজ বুদ্ধি বিশিষ্ট অন্যান্য লোকের কাছে তাহার গল্প বলিল। শীঘ্রই ঐ দ্বীপের সকলেই গল্প জানিতে পারিল। ঐ-সব বিষয় মীমাংসা করিতে বৃদ্ধরাই মজবুত। তাঁহারা ভবিষ্যতের সম্বন্ধে ইহাতে কত কুলক্ষণই দেখিতে পাইলেন।’ ‘ঐ দ্বীপের মধ্যে কেবলমাত্র মাস্টারমহাশয়ের কাছে খবরের কাগজ আসিত। মাসের মধ্যে একবার করিয়া কাগজ আসিত আর সেদিন সকলে মাস্টারমহাশয়ের বাড়িতে গিয়া নূতন খবর শুনিয়া আসিত। সেদিন তাহাদের পক্ষে একটা খুব আনন্দের দিন। রান্নাঘরে বড় আগুন করিয়া দশ-বার জন তাহার চারিদিকে সন্ধ্যার সময় বসিয়া কাগজের বিজ্ঞাপন হইতে আরম্ভ করিয়া অমুক কর্তৃক অমুক যন্ত্রে মুদ্রিত হইল ইত্যাদি পর্যন্ত সমস্ত বিষয়ের তদারক ও তর্কবিতর্ক করিত। শেষে কথাগুলি সকলেরই একপ্রকার মুখস্থ হইয়াছিল, এবং পড়া শেষ হইলে ঐ কথাটা প্রায় সকলে একসঙ্গে একবার বলিত।’ ‘এই-সকল সভায় রাখাল, কৃষক, গির্জার ছোট পাদরি প্রভৃতি অনেকেই আসিতেন। গ্রামের মুচি ররীও আসিত। ররী ভয়ানক নাছোড়বান্দা লোক। একটি কথা উঠিলে তাহাকে একবার আচ্ছা করিয়া না ঘাঁটিলে সহজে ছাড়িবে না।’ ‘ডনাল্ড ম্যাকলীনের ঐ ঘটনার কয়েক সপ্তাহ পরে একদিন সকলে এইরূপ সভা করিয়া বসিয়াছে, মাস্টারমহাশয় চেঁচাইয়া তর্জমা করিতেছেন, এমন সময় একজন আসিয়া বলিল যে, এল্যান্‌ ক্যামেরনের ছায়া আবার দেখা গিয়াছে। এবারে একজন স্ত্রীলোক দেখিয়াছে। এ রাখাল যে স্থানে যেভাবে উহাকে দেখিয়াছির, এও ঠিক সেইরকম দেখিয়াছে।’ ‘এরপর আর পড়া চলে কি করিয়া! মাস্টারমহাশয় চটিয়া গেলেন এবং ঠাট্টা করিতে লাগিলেন। ররী তৎক্ষাণাৎ তাহার প্রতিবাদ করিল। ররী কোন কথাই ঠিক মানে না। এবারেও মাস্টারমহাশয়ের কথাগুলি মানিতে পারিল না। প্রচণ্ড তর্ক উপস্থিত। ভূতের কথা লইয়া সাধারণভাবে এবং ক্যামেরনের ভূতের বিষয় বিশেষভাবে বিচার চলিতে লাগিল। আর সকলে বেশ মজা পাইতে লাগিলেন। কিন্তু রীরর মেজাজ গরম হইয়া উঠিল। সে বলিল-’ ‘দেখ মস্টারের পো, যতই কেন বল না, আমি এক জোড়া নতুন বুট হারব, তোমার সাধ্যি নেই আজ দুপুর রেতে ওখান থেকে গিয়ে দেখে এস।’ ‘সকলে করতালি দিয়া উঠিল। মাস্টারমহাশয় হাসিয়া উড়াইয়া দিতে চাহিলেন, কিন্তু ররী ছাড়িবে কেন? সে সকলের উপর বিচারের ভার দিল। তাহারা এই মত দিল যে, মাস্টারমহাশয় যখন গল্পগুলি মানিতেছেন না, সে স্থলে তাঁহার যে নিদেন পক্ষে তিনি যে এ মানেন না তা প্রমাণ করিয়া দেন।’ ‘মাস্টারমহাশয় দেখিলে, অস্বীকার করিলে যশের হানি হয়। তিনি বলিলেন, “যাব বই কি? কিন্তু আমি ফিরে এলেও এর চাইতে আর তোমাদের জ্ঞান বাড়বে না।” ররী-‘আচ্ছা দেখা যাউক।’ মাস্টারমহাশয়-‘ভাল, ওখানে গিয়ে আমি কি কর্‌ব?’ ররী-‘ওখানে গিয়ে দরজার কাছে দাঁড়িয়ে তিনবার বলবে-এল্যান্‌ ক্যামেরন আছে গো!’ কান জবাব না পাও ফিরে এস, আমি আর ভূত মানবো না। মাস্টারমহাশয় হাসিয়া বলিলেন, ‘এটা ঠিক জেনো যে, এল্যান, সেখানে থাকলে আমার কথার উত্তর দিবেই। আমাদের বড় ভাব ছিল।’ একজন বলিল, ‘তাকে যদি দেখতে পাও, তা হলে মুচির কাছে যে ও টাকা পেতে, সে কথাটা তুল না।’ এ কথায় সকলে হাসিয়া ফেলিল, ররী একটু অপ্রস্তুত হইল। ‘এইরূপে হাসি-তামাশা চলিতে বলিল-‘বারটা বাজতে কুড়ি মিনিট বাকি। তুমি এখন গেলে ভাল হয়; তাহলেই ঠিক ভূতের সময়টাতে পৌঁছতে পারবে।’ ‘বেশ করিয়া কাপড়-চোপড় জড়াইযা মাস্টারমহাশয় যষ্টি হস্তে সেই বাড়ির দিকে চলিলেন। মাস্টারের যাইবার সময়ে সকলেই দু-একটি খোঁচা দিয়া দিল এবং স্থির করিল, ফলটা কি হয় দেখিয়া যাইবে।’ ‘রাত্রি অন্ধকার। এতক্ষণ বেশ জ্যোৎস্না ছিল, কিন্তু এক্ষণে কাল কাল মেঘে আসিয়া চাঁদকে ঢাকিয়া ফেলিতেছে। মাস্টার চলিয়া গেলে সকলে আরম্ভ করিল যে, সমস্ত রাস্তাটা সাহস করিয়া যাওয়া তাঁর পক্ষে সম্ভব কি না। ছোট পাদরি বলিল যে তিনি হয়ত অর্ধেক পথ গিয়াই ফিরিয়া আসিয়া যাহা ইচ্ছা বলিবেন, তখন আর কাহারো কিছু বলিবার থাকিবে না। ইহা শুনিয়া মুচির মনে ভয় হইল, জুতা জোড়াটা নেহাত ফাঁকি দিয়া নেয়, এটা তাহার ভাল লাগিল না। তখন একজন প্রস্তাব করিল যে, ররী যাইয়া দেখিয়া আসুক।’ ‘প্রথমে ররী ইহাতে আপত্তি করিল। কিন্তু উহার বক্তৃতায় পরে রাজি হইল। সকলে তাহাকে সাবধান করিয়া দিল যেন মাস্টার তাহাকে দেখিতে না পায়, তারপর সে বাহির হইল। খুব চলিতে পারিত এই গুণে শীঘ্রই সে মাস্টারকে দেখিতে পাইল। ররী একটু দূরে দূরে থাকিতে লাগিল। রাস্তাটা একটা জলা জায়গার মধ্যে দিয়া। একটি গাছপালা নাই যে মাস্টার ফিরিয়া চাহিলে তাহার আড়ালে থাকিয়া বাঁচিবে।’ ‘পরে মাস্টারমহাশয় যখন ঐ বাড়িতে পৌঁছিলেন, তখন ররী একটু বুদ্ধি খাটাইয়া খানিকটা ঘুরিয়া বাড়ির সম্মুখে আসিল। সেখানে একটু নিচু বেড়া ছিল, তাহার আড়ালে শুইয়া পড়িল।’ ‘সে অবস্থায় দূতের কার্য করিতে যাইয়া তাহার অন্তরটা গুর গুর করিতে লাগিল। মাস্টারমহাশয় ছিলেন বলিয়া, নইলে সে এতক্ষণ চেঁচাইয়া ফেলিত। কষ্টে সৃষ্টে কোন মতে প্রাণটা হাতে করিয়া দেখিতেছে কি হয়। মনে করিয়াছে, মাস্টারমহাশয় যেরূপ ব্যবহার করেন, তাহা দেখা হইয়া গেলেই সে বাহির হইবে।’ ‘গ্রামের গির্জার ঘড়িতে বারটা বাজিল। সে বেড়ার ছিদ্র চাহিয়া দেখিল যে মাস্টারমহাশয় নির্ভয়ে দরজার সম্মুখে আসিয়া দাঁড়াইয়াছেন।’ ‘মাস্টারমহাশয় গলা পরিষ্কার করিলেন এবং একটু শুষ্ক স্বরে বলিলেন-‘এল্যান্‌ ক্যামেরন আছে গো!’-কোন উত্তর নাই। ‘দু-এক পা পশ্চাৎ সরিয়া একটু আস্তে আবার বলিলেন, ‘এল্যান্‌ ক্যামেরন আছ গো!’-কোন উত্তর নাই। ‘তারপর বাড়িতে আসিবার রাস্তাটি মাথা পর্যন্ত হাঁটিয়া গিয়া থতমত স্বরে অর্থচিৎকার অর্থ আহ্বানের মত করিয়া তৃতীয়বার বলিলেন, ‘এল-ক্যামেরন-আছ-।’ তারপর আর উত্তরের অপেক্ষা নাই।-সটান চম্পট। ‘কি সর্বনাশ! কোথায় মাস্টারের সঙ্গে বাড়ি যাইবে, মাস্টার যে এ কি করিয়া ফেলিলেন মুচি বেচারীর আর আতঙ্কের সীমা নাই।তবে বুঝি ভূত এল! আর থাকিতে পারিল না। এই সময়ে তার মনে যে ভয় হইয়াছিল, তারই উপযুক্ত ভয়ানক গোঁ গোঁ শব্দ করিতে করিতে সে মাস্টারমহাময়ের পেছনে ছুটিতে লাগিল। সেই ভয়ানক চিৎকার শব্দ মাস্টারমহাশয় শুনিতে পাইলেন। পশ্চাতে একপ্রকার শব্দও শুনিতে পাইলেন। আর কি? ঐ এল্যান্‌ ক্যামেরন! ভয়ে আরো দশগুণ দৌড়িতে লাগিলেন। ররী বেচারা দেখিল বড় বিপদ! ফেলিয়াই বুঝি গেল। কি করে, তারও প্রাণপণ চেষ্টা। মাস্টারমহাশয় দেখিলেন, পাছেরটা আসিয়া ধরিয়াই ফেলিল। তাঁহার যে আর রক্ষা নাই, তখন তিনি সাহস ভর করিলেন এর খুব শক্ত করিয়া লাঠি ধরিয়া সেই কল্পিত ভূতের মস্তকে ‘সপাট’-সাংঘাতিক এক ঘা! তারপর সেটাও যেন কোথায় অন্ধকারে অদৃশ্য হইল।’ ‘ভূতটা যাওয়াতে এখন একটু সাহস আসিল, কিন্তু তথাপি যতক্ষণ গ্রামের আলোক না দেখা গেল, ততক্ষণ থামিলেন না। গ্রামে প্রবেশ করিবার পূর্বে সাবধানে ঘাম মুছিয়া ঠাণ্ডা হইয়া লইলেন। মনটা যখন নির্ভয় হইল, তখন ঘরে গেলেন-যেন বিশেষ একটা কিছু হয় নাই। অনেক কথা তাঁহাকে জিজ্ঞাসা করা হইল, তিন সকলগুলিরই উত্তরে বলিলেন’- ‘ঐ আমি যা বলেছিলাম, ভূতটুত কিছুই ত দেখতে পেলাম না!’ ‘এরপর মুচির জন্য সকলে অপেক্ষা করিতে লাগিল। মাস্টারকে তাহারা বলিল যে, সে স্থানান্তরে গিয়াছে, শীঘ্রই ফিরিয়া আসিবে।’ ‘আধ ঘণ্টা হইয়া গেল, তবু মুচি আসে না। সকলে মুখ চাওয়া চাওয়ি করিতে লাগিল। চিন্তা বাড়িতে লাগিল, ক্রমে একটা বাজিল। তারপর আর থাকিতে পারিল না, মুচির অনুপস্থিতির কারণ তাহারা মাস্টারমহাশয়কে বলিয়া ফেলিল। মাস্টারমহাশয় শুনিয়া চিৎকার করিয়া উঠিলেন। লাফাইয়া উঠিয়া লণ্ঠন হাতে করিয়া দৌড়িয়া বাহির হইলেন এবং সকলকে পশ্চাৎ আসিতে বলিয়া দৌড়িয়া চলিলেন।’ সকলেরই বিশ্বাস হইর, মাস্টারমহাময়ের বুদ্ধিসুদ্ধি লোপ পাইয়াছে। হৈ চৈ কাণ্ড! সকলেই জিজ্ঞাসা করে, ব্যাপারটি কি? তাড়াতাড়ি ঘরের বাহির আসিয়া তাহারা মাস্টারকে দাঁড়াইতে বলিতে লাগিল। তাঁহাদের শব্দ শুনিয়া কুকুরগুলি ঘেউ ঘেউ করিয়া উঠিল। কুকুরে গোলমালে গাঁয়ের লোক জাগির। সকলেই জিজ্ঞাসা করে, ব্যাপারখানা কি?’ ‘এই সময়ে মাস্টারমহাশয় জলার মধ্য দিয়ে দৌড়িতেছেন। মাথা ঘুরিয়া গিয়াছে- কেবল পুলিস-ম্যাজিস্ট্রট-জুরী-ইত্যাদি ভয়ানক বিষয় মনে হইতেছে। তাঁহার লণ্ঠনের আলো দেখিয়া অন্যেরা তাঁহার পশ্চাৎ আসিতেছে।’ ‘সকলে তাঁহার কাছে আসিয়া তাঁহাকে ধরিল এবং ইহার কারণ জিজ্ঞাসা করিতে লাগিল। মাস্টারমহাশয়ের উত্তর দিবার পূর্বেই সেই মাঠের মধ্য হইতে গালি এবং কোঁকানি মিশ্রিত একপ্রকার শব্দ শুনা যাইতে লাগিল। কতদূর গিয়া দেখা গেল, একটা লোক জলার ধারে বসিয়া আছে। লণ্ঠনের সাহায্যে নির্ধারিত হইল যে এ আর কেহ নহে, আমাদের সেই মুচি। সেইখানে বেচারা দুই হাতে মাথা চাপিয়া বসিয়া আছে আর তাহাদের মাস্টারমারের উদ্দেশে গালাগালি দিতেছে। তাহার নিকট হইতে সকলে সমস্ত শুনিল।’ ‘শেষে অনুসন্ধানে জানা গেল যে ঐ বাড়ির জানালার ঠিক সম্মুখে একটা ছোট গাছ ছিল। তাহারই ছায়া চন্দ্রের আলোকে দেয়ালে পড়িত। আশ্চর্যের বিষয় এই যে সেই ছায়ার আকৃতি দেখিতে ঠিক ক্যামেরনের মুখের মত। সেদিন চন্দ্র ছিল না, মাস্টারমহাশয় সেই ছায়া দেখিতে পান নাই।’
উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী
লাল সূতো আর নীল সূতো উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী এক জোলা একদিন তাহার স্ত্রীকে বলিল,‘আমি পায়েস কাব, পায়েস রেঁধে দাও।’ জোলার স্ত্রী বলিল, ‘ঘরে কাঠ নেই। কাঠ এনে দাও, পায়েস রেঁধে দিচ্ছি। জোলা কাঠ আনিতে গেল। পথেরা ধারে একটা বড় আম গাছ ছিল, তাহার একটা শুকনো ডালের আগায় বসিয়া জোলা তাহারই গোড়ার দিকটা কাটিতেছে। তাহা দেখিয়া পথের লোক একজন ডাকিয়া বলিল, ‘ওহে, ও ডাল কেটো না, কাটলে পড়ে যাবে।’ জোলা বিরক্ত হইয়া বলিল, ‘তুমি শুনতে জানো নাকি? ও ডাল কাটলে পড়ে যাব, তা তুমি কি করে জানলে? আমি পায়েস খাব না বুঝি!’ পথের লোক আর কিছু না বলিয়া চলিয়া গেল্‌ আর, খানিক পরে জোলাও ডালসুদ্ধ পড়িয়া গেল। গাছ হইতে পড়িয়াই জোলা ভাবিল, ‘তাই ত! আমি যে প’ড়ে যাব, তা ও জানলে কি করে? ও নিশ্চয় একটা কেউ হবে।’ এই ভাবিয়া জোলা ছুটিয়া গিয়া সেই পথিকের পা জড়াইয়া ধরিয়া জিজ্ঞাসা করিল, ‘প্রভু, আপনি কে? আমি কবে মরব, সেটি আমাকে বলে দিন।’ পথিক ভারি মুশকিলেই পড়িল। জোলার খুব বিশ্বাস হইয়াছে যে, এ পথিক সামান্য পথিক নয়; সুতরাং তাহার প্রশ্নের উত্তর না পাইলে তাহাকে কিছুতেই ছাড়িতেছে না। শেষটা পথিক যখন দেখিল যে, একটা কিছু না বলিলে তাহার আর ঘরে যাওয়া হইতেছে না, তখন সে রাগিয়া বলিল, ‘তোর পেটের ভিতর থেকে লাল সুতো আর নীল সুতো যখন বেরুবে, তখন তুই মরবি।’ এই কথায় জোলা সন্তুষ্ট হইয়া বাড়ি ফিরিল। এখন হইতে জোলা ঠিক হইয়া বসিয়া আছে যে, লাল সূতা আর নীল সূতা বাহির হইলেই তাহার মৃত্যু। সুতরাং সে রোজ পরীক্ষা করিয়া দেখে, তাহা বাহির হইল কি না। এইরূপ পরীক্ষা করিতে গিয়া একদিন সত্য সত্যই তাহার কাপড়ে একখণ্ড লাল সূতা আর একখন্ড নীল সূতা পাইল আর অমনি সে চিৎকার করিয়া তাহার স্ত্রীকে বলিল,‘ওগো শিগগির এস, আমি মরে গিয়েছি- আমার লাল সুতো নীল সূতা বেরিয়েছে।’ তাহার স্ত্রী আসিয়া দেখিল, সত্য সত্যই লাল সূতা আর নীল সূতা।‌ তখন সে বেচারা আর কি করে, জোলাকে বিছানায় শোয়াইয়া কাপড় চাপা দিয়া সে কাঁদিতে বসিল। এর মধ্যে আর দু- চারজন জোলা বেড়াইতে আসিয়া দেখে যে, জোলার স্ত্রী কাঁদিতেছে। তারপর জিজ্ঞাসা করিয়া যখন জানিল যে, লাল সূতা নীল সূতা পাওয়া গিয়াছে, তখন সকলে স্থির করিল যে, জোলা নিশ্চয়ই মরিয়া গিয়াছে। সুতরাং তাহারা সৎকারের চেষ্টা দেখিতে লাগিল। কিন্তু ইহার মধ্যে ভারি মুশকিল দেখা দিল। পোড়ানোতে জোলা কিছুতেই রাজি নয়। পোড়ানোর কথা তুলিতেই সে বলে, ‘ওমা! পুড়ে যাব যে!’ মরিয়া গেলে তাহাকে পোড়ানো ছাড়া আর কি করা যায়?- গোর দেওয়া! কিন্তু জোলা তাহাতেও অসম্মত। বলল, ওমা! দম আটকে যাবে যে!’ শেষে অনেক যুক্তির স্থির হইল যে, জোলাকে গোর দেওয়াই হইবে, কিন্তু মুখখানা জাগাইয়া রাখা যাইবে। জোলা তাহাতে রাজি হইল। কিন্তু সে বলিল যে, ‘খিদে পেলে চারটি ভাত দিয়ো।’ এইরূপ পরামর্শের পর জোলাকে গোর দেওয়া হইল- অর্থাৎ তাহার মুখ জাগিয়া রহিল, আর- সব মাটি দিয়া ঢাকিয়া দিল। এইরূপে সমস্ত দিন চলিয়া গেল। রাত্রিতে চারটি ভাত খাইয়া জোলা একটু নিদ্রার চেষ্টা দেখিল। সেই রাত্রিতে সাত চোর রাজার বাড়িতে চুরি করিতে চলিয়াছে। চোরেরা ত আর বাবুদের মতন সদর রাস্তা দিয়া চলে না- তাহারা প্রায়ই ঝোপজঙ্গলের ভিতর দিয়া চলে, আর সে-সব জায়গা অনেক সময়টই নোংরা থাকে। চলিতে চলিতে একজন চোর কাদার মতন একটা কি জিনিস মাড়াইল, সে জিনিসটার বিশ্রী গন্ধ। সে পা মুছিবার জন্য একটা জায়গা খুঁজিতে লাগিল। উহার নিকটেই জোলাকে গোর দিয়াচে, সে চোর পা মুছিবি ত মোছ, সেই জোলার মুখে গিয়া মুছিতে লাগিল। ঘষার আর গন্ধের চোটে জোলার ঘুম ভাঙ্গিয়া গেল। সে রাগিয়া বলিল, ‘উঃ-হুঁ-হু-! তোমার কি চোখ নাই না কি?’ চোর আশ্চর্য হইয়া জিজ্ঞাসা করিল, ‘তুই কে রে?’ জোলা বলিল, ‘আমি জোলা।’ ‘এখানে কি করছিস?’ ‘আমি মরে গিয়েছি। আমার লাল সুতো নীল সুতো বেরিয়েছে- তাই আমাকে গোর দিয়েছে!’ এই কথা মুনিয়া চোরেরা খুব হাসিতে লাগিল। তারপর তাহাদের একজন বলিল, ‘একে আমাদের সঙ্গে নিয়ে চল।’ চোরেরা জোলাকে বুঝাইয়া দিল যে, তাহার মৃত্যু হয় নাই, আর তাহাদের সঙ্গে গেলে পেট ভারিয়া খাইতে পারিবে। জোলা জিজ্ঞাসা করিল, ‘কি খাওয়াবে? পায়েস?’ চোরোর বলিল, ‘হাঁ পায়েস – চল!’ পায়েসের কথা শুনিয়া জোলা কোন আপত্তি করিল না। চোরেরা তাহাকে উঠাইয়া লইয়া চলিল। রাজার বাড়িতে গিয়া চোরেরা রাজার ঘরে প্রকাণ্ড সিঁদ কাটিল। তারপর জোলাকে ঐ সিঁদের ভিতর ঢুকাইয়া দিয়া বলিল, ‘রাজার মাথার মুকুটটা নিয়ে আয়।’ রাজার খাটে মশারি খাটানো ছিল, তাহা দেখিয়া জোলা ভারি আশ্চর্য হইয়া গেল। সে মশারির চারিদিকে ঘুরিয়া কোথাও তাহার দরজা দেখিতে পাইল না। সুতরাং চোরেদের নিকট ফিরিয়া আসিয়া বলিল, ‘হল না। ওর ভিতর আর একটা ঘর আছে, তার দরজা নেই।’ চোরোর বলিল, ‘দূর বোকা! ওটা ঘর নয়, মশারি। ওটাকে তুলে দেখলি না কেন? জোলা আবার ঘরের ভিতরে গেল।’ এবার জোলা মশারি তুলিতে অনেক চেষ্টি করিল, কিন্তু সেটাকে নাড়িতেও পারিল না- কারণ সে খাটসুদ্ধ ধরিয়া টানাটানি করিয়াছিল। সে আবার ফিরিয়া আসিয়া আসিয়া বলিল, ‘না ভাই, ওটা বড্ড ভারি।’ ‘আরে, এমন গাধাও আর দেখি নি! তুই বুঝি খাটসুদ্ধ তুলতে গিয়েছিলি? শুধু ওর কাপড়টা টানতে হয়।’ এবারে জোলা আর কোনা ভুল করিল না। মশারির কাপড় ধরিয়া টানিতেই সেটা উঠিয়া আসিল। ভিতরে খুব উঁচু গদির উপরে রাজা শুইয়া আছেন, তাঁহার গায় ঝালর- দেওয়া অতিশয় পুরু লেপ। দেখিয়া জোলার মনে ভারি দুঃখ হইল। সে ভাবিল, বুঝি রাজাকে গোর দিয়াছে। এরও লাল সুতো নীল সুতো বেরিয়েছিল নাকি?’ জোলা যত ভাবে, ততই আশ্চর্য হয়, আর তত তাহার জানিতে ইচ্ছা করে, রাজা মহাশয়েরও লাল সূতা নলি সূতা বাহির হইয়াছিল কি না। শেষটা এমন হইল যে, এই খবরটা তাহার না জানিলেই নয়। সুতরাং সে ঠেলিয়া জাগাইল। আর, তিনি চোখ মেলিবামাত্রই, জিজ্ঞাসা করিল, ‘লাল সূতো নীল সূতো বেরিয়েছিল?’ ইহার পর একটা মস্ত গোলমাল হইল। রাজবাড়ির সকলে জাগিয়া গেল, সাত চোর ধরা পড়িল, তাহার সঙ্গে সঙ্গে জোলাও ধারা পড়িল। পরদিন বিচার। জোলা আগাগোড়া সকল কথা খুলিয়া বলিল। লাল সুতো নীল সুতোর কথা, গোর দিবার কথা, চোরের পা মুছিবার কথা, পায়েসের কথা- কিছুই বাকি রাখিল না। বিচারে সাত চোরের উচিত সাজা হইল। আর জোলাকে পেট ভরিয়া উত্তম উত্তম পায়েস খাওয়াইয়া বিদায় দেওয়া হইল।
উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী
সহজে কি বড়লোক হওয়া যায়? উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী ছেলেবেলায় একটু একগুঁয়েমো প্রায় সকলের থাকে। আমার কথা শুনিয়া কেহ চটিবেন না। চটিলেও বড় একটা অসুবিধা বোধ করিব না। অনেকের অভ্যাস আছে, তাহারা খাঁটি কথা শুনিলে বিরক্ত হয়, কিন্ত কাহাকেও বিরক্ত করা আমার উদ্দেশ্য নহে। আমার নিজের দশা দেখিয়াই আমি উপরের কথাগুলিতে বিশ্বাস স্থাপন করিয়াছি। ছেলেমানুষের একটা রোগ আছে। অনেক কাজ তাহারা আপনা আপনি করিয়া অন্য লোককে বিরক্ত করে, আবার যদি কেহ সেই কাজ তাহাদিগকে করিতে বলিল, অমনি সেই কাজের মিষ্টতাটুকু তাহাদের নিকট হইতে চলিয়া যায়। দাদা প্রথমে বই পড়িতে শিখিয়াছে, তাহার বইয়ে সন্দর সুন্দর ছবি। পড়িবার সময় দাদা বই খুঁজিয়া পাইত না। আমার চোখে পড়িলেই আমি বইখানা হস্তে করিয়া, কেহ খুঁজিয়া না পায় এমন জায়গায় যাইয়া বসিতাম। শেষে, একদিন শুনিলাম ঐ বইখানা আমারও পড়িতে হইবে। আমার আনন্দের সীমা রহিল না; তখন দৌড়িয়া যাইয়া সঙ্গীদের সকলকে খবরটা দিয়া আসিলাম। পরদিন মাষ্টার আসিলেই বই হাতে করিয়া হাজির। মনে করিলাম, প্রথম ছবিটার কথা আজ হইবে। মাষ্টার প্রথমে ছবির পাতে একটুও আসিলেন না-ছবিশূন্য একটা পাতা উল্টাইয়া, এ, বি, সি, ডি করিয়া কি বলিতে লাগিলেন। তখন হইতে আর সে বই আমার ভাল লাগিল না।। দাদা স্কুলে যাইবার সময় মাঝে মাঝে আমাকে সঙ্গে করিয়া নিয়া যাইত। দাদাদের মাষ্টার বড় ভালমানুষ। আমি মনে করিলাম, ইস্কুলের সকল মাষ্টারই বুঝি ঐরূপ। বাড়িতে তিন বছর থাকিয়া কয়েকখানা বই শেষ করিলাম। তাহার পর আমাকেও স্কুলে পাঠাইয়া দিল। কয়েক বছর পর বেশ চলিতে চলিতে লাগিলাম; কিন্ত মাষ্টারকে আর তত ভাল লাগে না। কবে বড়মানুষ হইয়া ইস্কুল ছাড়িয়া দিব, এই চিন্তাটা বড় বেশী মনে হইত। তখন তৃতীয় শ্রেণীতে পড়ি, ইংরেজী যে কয়েকখানা বই পড়িয়াছিলাম, তাহার একখানিতে এক সাহেবের কথা লেখা ছিল। তিনি বাড়ি ছাড়িয়া বিদেশে গিযাছিলেন, সেখানে অনেক কষ্ট ভোগ করিয়া শেষটা অনেক টাকা করিয়াছিলেন। সাহেব যে বয়সে ছাড়িয়াছিলেন, মিলাইয়া দেখিলাম আমারও এখন ঠিক সেই বয়স। তবে আর কি চাই! ক্লাসে সতীশের সঙ্গে আমার বড় ভাব; আমি সতীশের সঙ্গে মনের কথাগুলি খুলিয়া বলিয়া ফেলিলাম। কথা শুনিয়া সতীশ যেন আর তার ছোট শরীরটির মধ্যে আঁটে না। তখনই সে লাফাইয়া উঠিল। বোধ হইল বাড়ি হইতে বিদেশে চলিয়া গেলেই বড়লোক হওয়া যাইবে। সতীশ বলিল, ‘কালই চল’। কাল চলাটা তত সহজ বোধ হইল না। কিন্তু বেশী দেরী করা হইবে না, সেটা ঠিক করা হইল। একদিন স্কুল হইতে ছুটি পাইয়া বাড়ি আসিলাম; সতীশও আসিল। বাবা বাড়ি ছিলেন না। বাড়ির অন্যান্য লোকও চুপ করিয়া বিশ্রাম করিতেছিল। চুপি চুপি কয়েকখানা কাপড় দিয়া একটি পুটঁলি বাঁধিলাম। তারপর বাবার বাক্স হইতে কতকগুলি টাকা লইয়া দুজনে চোরের মত বাড়ির বাহির হইলাম। পাছে কেহ আসিয়া ধরে, সেই ভয়ে দুজনে মাঝে মাঝে দৌড়াইতে লাগিলাম। এইরূপে স্যা পর্যন্ত হাঁটিয়া এক বাড়িতে যাইয়া উঠিলাম। সেই বাড়ির কর্তা আমাদের অবস্থা দেখিয়া বড় দুঃখিত হইলেন। আমাদের সম্বন্ধে যা যা কথা সমস্ত জিজ্ঞাসা করিতে লাগিলেন। আমরা কোন কথারই ঠিক উত্তর দিই নাই। স্থানে স্থানে দু-একটি কথা গড়িয়া কহিতে হইল। তিনি আমাদের কথায় বুঝিয়া লইলেন যে, আমরা দুজন পথ হারাইয়া ঘুরিতেছি। বলিলেন, ‘কাল আমি একজন লোক দিয়া তোমাদের দুজনকে বাড়ি পাঠাইয়া দিব।’ খাইবার সময় ভদ্রলোকটি আমাদের সম্মুখে বসিয়া থাকিলেন, আহার শেষ না হওয়া পর্যন্ত উঠিলেন না। একটি কুঠুরিতে আমাদের দুজনের ঘুমাইবার বন্দোবন্ত করিয়া দেওয়া হইল। সেখানে আর কেহ ঘুমাইতে আসিল না। আমি কিছু সুবিধা বোধ করিলাম। ভাবিলাম কর্তা যাহা বলিলেন তাহা কাজে করিলে আর বড়লোক হওয়া হইবে না; সুতরাং কেহ জাগিবার পূর্বে কর্তাকে ধন্যবাদ না দিয়া চলিয়া যাওয়া ঠিক হইল। সতীশকে ডাকিলাম, ‘সতীশ! সতীশ!’-সতীশ কথা কয় না। সতীশের চক্ষে জল পড়িতেছে। কর্তার কথায় সতীশের মন ফিরিয়া গেল নাকি? বাস্তবিকই তাই, অনেক পীড়াপীড়ি করার পর বলিল, ‘আমি তোমার সঙ্গে যাইব না।’ আপনারা কি মনে করিতেছেন? সতীশের কথা শুনিয়া আমার মনের ভাব কিপ্রকার হইল? বড়লোক হওয়ার ইচ্ছাটা আমার এত বেশী হইয়াছিল যে, বাড়ি ছাড়িয়া অবধি আমার বোধ হইতেছিল-যেন বড়লোকের কাছাকাছি একটা কিছু হইয়াছি। সতীশকে আমি কাপরুষ মনে করিতে লাগিলাম। সতীশের মা বাপ আছে, আমারও মা বাপ আছেন। প্রভেদ এই যে, আমি স্বার্থপর; সতীশ তাহা নহে। সতীশের মনে যে-সকল চিন্তা উঠিতেছিল, আমার অন্তঃকরণে তাহা স্থান পাইল না। আমি সতীশের অবস্থা বুঝিতে পারিলাম না। ম বাপের মনে কষ্ট দেওয়া আমার ইচ্ছা ছিল না; কিন্ত নিজের কথা লইয়া এত ব্যস্ত ছিলাম যে তাঁহাদের কথা ভাবিবার অবসরই পাই নাই। নানা চিন্তার মধ্যে ঘুম আসিল। ঘুমাইতে ঘুমাইতে স্বপ্নে দেখিলাম যে, আমি বাড়িতে কি একটা কথা লইয়া মার সঙ্গে রাগারাগি করিয়াছি, মা কত সাধিতেছেন, আমার ভ্রুক্ষেপ নাই; রাগ যেন ক্রমেই বাড়িতেছে। মার চক্ষে জল পড়িতেছে দেখিয়া যেন আমার প্রতিহিংসার ভাবটা চরিতার্থ হইতে লাগিল। আমি দাত খিঁচাইয়া মাকে বিদ্রূপ করিতে লাগিলাম। মা আমার হাত ধরিতে আসিলেন; আমি পাশের একটা গাছে উঠিতে চেষ্টা করিলাম। হঠাৎ পা পিছলাইয়া পড়িয়া যাইতেছিলাম; এমন সময় আমার ঘুম ভাঙ্গিয়া গেল। স্বপ্নের কথা ভাবিয়া চক্ষে দুফোঁটা জল আসিল; কিন্ত আবার সে বড়লোক হওয়ার কথা। সতীশের মন ফিরিয়া গিয়াছে। সতীশ জাগিয়া আর যাইতে চাহিবে না, হয়ত আমারও যাওয়া হইবে না। রাত হয়ত আর বেশী দেরী নাই; এই বেলা সতীশকে না বলিয়া যাওয়াই ভাল। আমি আস্তে আস্তে উঠিলাম। আমার কাপড় আর টাকাগুলি লইয়া বাহির হইলাম। রাত্রি তখনো অনেক ছিল, কিন্ত আমার বোধ হইতে লাগিল যেন এই ভোর হইয়া আসিতেছে। একটা বড় রাস্তা ধরিয়া চলিলাম। অনেকক্ষণ হাঁটিলাম, কিন্ত রাত ফুরায় না। রাস্তাটা একটা নদীর ধারে যাইয়া শেষ হইয়াছে; আমিও সেইখানে যাইয়া থামিলাম-তারপর যাই কোথা? রাস্তাটা নিশ্চয়ই ওপার যাইয়া আবার চলিয়াছে, কিন্ত ওপারে যাই কেমন করিয়া? এতক্ষনে রাত ফুরাইল না। হয়ত আরো অনেক দেরী। ঘাটে একখানি নৌকা বাঁধা ছিল-নৌকার ছই নাই। একজন লোককে অনায়াসে ওরূপ নৌকা চালাইতে দেখিয়াছি, আমার বোধ হইতে লাগিল, আমিও পারি। নৌকায় উঠিতে বিলম্ব হইল না। যে লগিটিতে নৌকা বাঁধা ছিল, তাহা তুলিয়া লইলাম। ডাঙ্গায় ভর করিয়া ঠেলিয়া নৌকা জলে ভাসাইয়া দিলাম। জলের গায় এত জোর আগে ভাবি নাই। শোঁ শোঁ করিয়া নৌকার গায় জল বাধিতে লাগিল; নৌকাখানা ঘুরিয়া গেল। হঠাৎ ঘুরিবার সময় তাড়াতাড়ি লগিটি ছাড়িয়া দিলাম। নৌকা ঘুরিয়া ঘুরিয়া ডাঙ্গা হইতে অনেক দুরে যাইয়া পড়িল-স্রোতে ভয়ানক বেগের সহিত ভাসিয়া যাইতে লাগিল, আমি কিছুকাল হতবুদ্ধি হইয়া থাকিলাম। বিপদের পরিমানটা প্রথমে তত বুঝি নাই, শেষে কিছু কিছু করিয়া হুঁশ হইতে লাগিল। মাথা ঘুরিয়া গেল। দুহাতে চোখ ঢাকিয়া বসিয়া পড়িলাম। ঢেউগুলি তড়াক তড়াক করিয়া নৌকাখানিকে দোলাইতে লাগিল, তখন মায়ের সেই মুখখানি মনে হইল। কেন বাড়ি ছাড়িয়া আসিলাম? সেই অন্ধকার রাত্রি, ভয়ানক নদী, আর বাড়ির ছোট কুঠুরিটি-সেই কোমল সুন্দর বিছানাটি মনে হইল। দুই চক্ষে জল পড়িতে লাগিল। সেই আঁধারে পড়িয়া, মা মা বলিয়া কাঁদিতে লাগিলাম। কেন সতীশের সঙ্গে গেলাম না, তাহাকে কেন ছাড়িয়া আসিলাম? এইভাবে কতক্ষণ ছিলাম বলিতে পারিব না। হঠাৎ নৌকাখানি একদিকে যাইয়া ঠেকিল। চমকিয়া দেখিলাম, কতকগুলি বড় নৌকা, তাহারি একটাতে আমার নৌকা ঠেকিয়াছে। আমি সেই মূহুর্তের জন্য আশ্বস্ত হইলাম। কিন্ত তার পক্ষেণেই নৌকা হইতে কতকগুলি কালো অর্ধ উলঙ্গ লোক বাহির হইয়া কেঁউ মেঁউ করিয়া কি বলিতে লাগিল। আমি বুঝিতে পারিলাম আমাকে গালি দিতেছে তাহারা আমার কথা বুঝিতে পারিল বলিয়া বোধ হইল না। আরো বেশী গালাগালি দিতে লাগিল। ক্রমে অন্যান্য নৌকার লোক আসিয়া গোলমালে যোগ দিল। আমার কথা শুনিয়া সকলেই ঐ লোকগুলিকে গালি দিতে লাগিল। একটি ভদ্রলোক সেখানে ছিলেন। তিনি দয়া করিয়া আমাকে তাঁহার নৌকায় লইয়া গেলেন, নিজ হাতে আমার পুটলিটি যত্ন সহকারে এককোণে রাখিয়া দিলেন। তারপর আমাকে বলিলেন, ‘আমি কা- যাইতেছি; তোমার আপত্তি না থাকিলে আমার সঙ্গে যাইতে পার, আমার বাড়িতে কোন ক্লেশ হইবে না।’ আমি তাঁহার সঙ্গেই চলিলাম। কা- ছোট একটি শহরের মত। অনেক লোক। বড়লোকও অনেকগুলি আছেন। আমি যাঁহার সঙ্গে গিয়াছিলাম, তাঁহাকে এখানে কালিদাসবাবু বলিব, তিনিও একজন বড়লোক। এই-সব দেখিয়া শুনিয়া আমার পুরাতন রোগ আবার দেখা দিল। আমি ভাবিতে লাগিলাম, এখানে থাকিয়া বড়লোক হওয়া যায় কি? যায় বই কি। না হইলে ইহারা এত বড় গাড়ি চড়ে কি করিয়া? বোধ হইল যেন কালিদাসবাবু বাড়িতে থাকিয়া হঠাৎ একদিন বড়লোক হইয়া যাইব। একদিন কালিদাসবাবু ডাকিলেন। কালিদাসবাবুর উপর প্রথম হইতেই আমার বড় শ্রদ্ধা হইয়াছিল। যখনই তিনি আমাকে ডাকিতেন, তখনই একখানা সুন্দর কিছু উপহার পাইতাম। আমার বয়সের অনেকেই এখন ভাল কাজ করিতেছেন। কিন্ত আমার যেন তখনো শিশু ভাবটা যায় নাই। কালিদাসবাবু তাহা বেশ বুঝিতেন। যাহা হউক আমি কালিদাসবাবুর নিকট যাইয়া দাঁড়াইলাম। তিনি আমার নাম ধরিয়া বলিলেন, ‘গিরিশ, এখানে তোমার কেমন লাগে?’ ‘দিব্যি।’ ‘বটে? তা এখানে থেকে তোমার আর কোথাও যেতে ইচ্ছা হয় না?’ ‘কোথায় যাব? এখানেই থাকব।’ ‘তা বেশ বলিয়া কালিদাসবাবু কপাল হইতে চশমা নামাইয়া ছাপার কাগজ পড়িতে লাগিলেন। কাগজের প্রথম পাতে একটি ছবি। আমার সেই সাহেব। অমি একটু আশ্চর্য হইলাম। অনেকদিন পরে কোনো পরিচিত বন্ধুর সাক্ষাৎ পাইলে যেরূপ হয়, আমারও সেইরূপ হইল। একটি ছোট কথা আমার মুখ দিয়া বাহির হইল, আমি বলিয়া উঠিলাম, ‘আরে।’ কালিদাসবাবু কাগজ নামাইয়া আমার মুখের দিকে চাহিলেন। তাহার অর্থ, ব্যাপারখানা কি? আমি বলেলাম, ‘আজ্ঞে ঐ ছবিটে।’ ‘ইনি একজন বড়লোক ছিলেন। তোমারও বড়লোক হতে ইচ্ছে হয়, না?’ আমি ভাবিলাম এই বুঝি! হঠাৎ প্রশ্ন হওয়াতে থতমত খাইয়া বলিলাম, ‘বড়লোক কি সবাই হয়?’ ‘হয় বইকি। ইচ্ছে করলে তুমিও হতে পার।’ ‘আমি পারি?’ ‘অবিশ্যি। কাল থেকে তোমাকে স্কুলে পাঠিয়ে দেব ভেবেছি। লেখাপড়া না শিখলে বড়লোক হওয়া যায় না। তাই তোমাকে ডেকেছিলাম। কেমন?’ আমার বাতাসের ঘর ভাঙ্গিয়া গেল। যার চোটে বাড়ি ছাড়া, সেই আপদ। আমি কোন কথা কহিলাম না। কালিদাসবাবু এতে সন্দেহ করেন নাই, সুতরাং কিছু বলিলেন না। এরূপ কথাবার্তা কালিদাসবাবুতে আর আমাতে অনেকদিন হইত। তিনি আমার অবস্থার কথা জিজ্ঞাসা করিতেন। ‘সেই রাত্রিতে নৌকায় কেমন করিয়া আসিলে।’ বাড়ি কোথা। ‘মা-বাপ নাই? ইত্যাদি-আমি প্রায়ই চুপ করিয়া থাকিতাম। কালিদাসবাবুর ইচ্ছা ছিল, সূযোগ পাইলেই আমাকে বাড়ি পাঠাইয়া দিবেন। কিন্ত এসব সম্বন্ধে কোন খবরই আমি তাঁহাকে দিতে চাহিতাম না। তখন তিনি সে-সব বিষয়ে ক্ষান্ত হইয়া সেখানেই আমাকে লেখাপড়া শিখাইবার মনস্থ করিলেন। ইস্কুলে যাইয়া অবধি আমার আর মনে শান্তি ছিল না। কয়েকদিন কোনো মতে কাটাইলাম, কিন্ত শেষটা অসহ্য হইয়া উঠিল। কালিদাসবাবুর বাড়িতে থাকা হইবে না। কিন্ত হঠাৎ যাই কোথায়? গেলেও আর এবার হাঁটিয়া যাওয়া যাইবে না। কা-হইতে দুখানা স্টিমার ধু-তে যাতায়াত করিত। সপ্তাহে দুদিন স্টিমার চলে। ধু-যাইতে তিনদিন লাগে। হিন্দুরা এই তিনদিনে চিঁড়ে পুঁটলি-বাঁধিয়া লইয়া জাহাজে উঠে। ভোরবেলা জাহাজ ছাড়ে। একদিন নদীর ধারে বেড়াইতে যাইয়া দেখি একখানা স্টিমার এইমাত্র ঘাটে আসিয়া থামিল। পরের দিন ভোরে চলিয়া যাইবে। হঠাৎ স্টিমারে উঠিয়া ধু-চলিয়া যাইতে বড় ইচ্ছা হইতে লাগিল। বাড়ি আসিয়া কেহ না দেখে এমন ভাবে আমার কাপড়-চোপড় সব একত্র জড় করিলাম। কালিদাসবাবুর বাড়ি আসিবার কালে সঙ্গে করিয়া যে টাকা আনিয়াছিলাম, তাহার একটিও ব্যয় হয় নাই। কালিদাসবাবুও মাঝে মাঝে আমার ইচ্ছামত খরচ করিবার জন্য দু-একটি টাকা দিতেন। আমি সমস্তই সঞ্চয় করিতাম। শুনিয়াছিলাম, বড়লোকেরা সহজে টাকা খরচ করিতে চাহে না। যাত্রার উপযোগী সমস্ত জিনিস প্রস্তত রাখিয়া ঘুমাইলাম। মনে একটা চিন্তা থাকিলে সহজে ঘুম হয় না, ঘুম হইলেও শীঘ্রই ভাঙ্গিয়া যায়। আমারও তাই হইল, বড় কামরার ঘড়িতে চারটা বাজিল, আমি অমনি উঠিলাম। সঙ্গে পুটলি। পুটুলিতে কয়েকখানা কাপড়, একজোড়া চটী জুতো, নগদ কিছু টাকা, কালিদাসবাবু মাঝে মাঝে যে উপহার দিতেন সেগুলি-কয়েকখানা ছবি, একটা বড় ছুরি আর আমার স্কুলের পুস্তকগুলি। পুস্তকগুলি কেন সঙ্গে লইলাম বলিতে পারি না। তবে কালিদাসবাবু বলিয়াছিলেন, ‘লেখাপড়া না শিখিলে বড়লোক হওয়া যায় না।’ তাহাতেই মনে কেমন করিয়া একটা ভয় রহিয়া গিয়াছিল। এইরূপ সাজ-সজ্জা করিয়া, ছাতাটি হাতে করিয়া, বিছানার চাদরখানা পুটলির উপর জড়াইয়া আস্তে বাহির হইলাম, স্টিমার ঘাটে আসিতে অধিকক্ষণ লাগিল না। সেখানেই মুদীর দোকান আছে, সেই দোকান হইতে চিড়ে কিনিয়া বিছানার চাদরের এক কোণে বাঁধিয়া লইয়া, জাহাজের একজন লোক আমাকে একটা জায়গা দেখাইয়া দিল, আমি সেইখানে যাইয়া বসিলাম। জাহাজে বিশেষ কিছু ঘটনা হইল না। তবে সঙ্গে যে টাকা আনিয়াছিলাম, তাহ প্রায় শেষ হইয়া আসিল। নিয়মিত সময় জাহাজ ধু-পৌছিল। রামলোচনবাবু আমাদের ওদিককার লোক, তিনি ধু-তে থাকেন, সেখানকার একজন নামজাদা উকীল। আমি ভাবিলাম দেশের একজন লোক, তাঁর কাছে গেলে তিনি অবশ্যই কিছু খাতির করিবেন। জাহাজ হইতে তীরে উঠিয়াই তাঁহার কথা জিজ্ঞাসা করিলাম। একটি ভদ্রলোক তাঁহার বাড়ি দেখাইয়া দিলেন। আমি আস্তে আস্তে বাড়ির একজন চাকরের মতে লোককে যাইয়া জিজ্ঞাসা করিলাম, ‘রামলোচনবাবুর এই বাড়ি’? সে লোকটা আমার কথার উত্তর দেওয়া দূরে থাকুক, আমার দিকে একবার ফিরিয়াও চাহিল না। মুখ বিকৃত করিয়া একটা বড় ঘরে চলিয়া গেল। অগত্যা আমি অন্য লোকের আশ্রয় গ্রহন করিলাম। সে যাহা বলিল তাহাতে জানিলাম, আমি যাহাকে রামলোচনবাবুর চাকর মনে করিয়াছিলাম, তিনিই রামলোচনবাবু। তাই অত রাগ! আমি ভয়ে ভয়ে রামলোচনবাবুর ঘরের দরজায় দাঁড়াইলাম। তিনি একটা তাকিয়া ঠেস দিয়া বসিয়া রহিয়াছেন। অত কালো আমি আর দেখি নাই। মোটা বেশী নন, কিন্ত প্রায় বুকের উপর কাপড় পরেন। গোঁপগুলি সোজা সোজা, চুল অধিকাংশ পাকিয়া গিয়াছে। কানে একটা কলম, হাঁটুর উপর পর্যন্ত কাপড় টানিয়া বসিয়াছেন। উরুদেশের উপর একটা লম্বা খাতা রাখিয়া তাহাই দেখিতেছেন, আর মাঝে মাঝে কাহার উদ্দেশ্যে মুখ বাকাইতেছেন। তাকিয়ার একটা অংশ কলম মুছিবার স্থান বলিয়া বোধ হইল। কিছুকাল পরে দেখিলাম যে তাহা নহে। পাশে একটি মাটির দোয়াত, তাহা হইতে ঘাটিঁয়া এক কলম লইয়া খাতায় কি যেন লিখিলেন। তারপর কলমটি মাথায় চুলে ঘষিয়া কানে বসাইয়া হাতের দুটি আঙুল তাকিয়ার ঐ স্থানটিতে পুছিলেন। তার পরক্ষণেই এক হাতের কনুই তাকিয়ার উপর রাখিয়া, একখানা পা আমার দিকে বাড়াইয়া ‘ভাউ’ শব্দ উদগার করিলেন। শেষটা আমার দিকে মুখ তুলিয়া চাহিলেন। প্রথম প্রশ্ন হিন্দী ভাষায় হইল; তাহার পর বাঙলা। ‘কি চাই?’ ‘আজ্ঞে আমি অনেক দূর থেকে এসেছি- ‘আমিও অনেক দূর থেকে এসেছি।’ ‘আমার নিবাস সু- ‘আমারও নিবাস সু-। তারপর?’ ‘মহাশয় যদি-’ ‘ম-হ-শ-য় যদি? কি-ঞ্চি-ৎ-সা-হা-য্য? দক্ষিন হস্তের ব্যপার আমার কাছে নাই। হিঁয়াসে চলে যাও।’ আমি আর এক মুহূর্তও সেখানে বিলম্ব করিলাম না। কোথা যাইব ঠিক নাই, কিন্তু রামলোচনবাবুর বাড়িতে আর পদার্পণ করা হইবে না। রাস্তায় বাহির হইয়া একজনের কাছে জিজ্ঞাসা করিলাম, তিনি বলিলেন, ‘যে কোন মুদীকে পয়সা দিলেই থাকবার জায়গা আর খেতে দিবে।’ মুদীর দোকান খুঁজিয়া লওয়া কঠিন বোধ হইল না। দু’দিন মুদীর দোকানে খাইলাম। কিন্ত এরূপ ভাবে খাইলে বেশিদিন পয়সায় কুলাইবে না, এই চিন্তায় রাত্রিতে ঘুম হয় না। একদিন প্রাতকালে উঠিয়া মুদীর পয়সা হিসাব করিয়া দিলাম। তারপর পুটলিটি হাতে করিয়া বাহির হইলাম। রাস্তায় কতদূর হাঁটিয়া দেখি, একটা বড় বাড়ি। এ বাড়ির কর্তা রামলোচনবাবুর মত নাও হইতে পারেন। আস্তে আস্তে বৈঠকখানার দিকে গিয়া দেখিলাম কর্তা বসিয়া আছেন, আর ইয়ার গোছের একটা অভ্যাগত লোক তাঁহার সহিত কথা বহিতেছেন। আমি দাঁড়াইবামাত্রই কর্তা জিজ্ঞাসা করিলেন, ‘তুমি কে বাপু?’ আমি।-‘আমি পথিক, কষ্টে পড়েছি-।’ ইয়ার।-‘বড় খিদে পেয়েছে বুঝি?’ আমি কোন উত্তর করিলাম না; ইয়ার-বাবু উত্তর দিকে আঙুল নির্দেশ করিয়া চোখ বড় করিয়া মাথা নাড়িয়া বলিতে লাগিলেন- ‘হোটেল আছে। বাবুরচি লোক দিব্যি রাঁধে-রোজ পাঁচ টাকাতেই চলে।’ আমি নিরাশ হইয়া বাবুর দিকে তাকাইলাম, বাবু ইয়ারের উপর অত্যন্ত রাগ করিয়া বলিলেন, ‘নিজের বাড়িতে একটি লোককে খেতে দিত পার না, অন্য লোকের বাড়ি এসে চাষামো কর। আর আমার বাড়ি এসো না।’ বলা বাহুল্য, বাবুর উপর আমার ভক্তি, শ্রদ্ধা, ভালবাসা, সম্মান ইত্যাদি যত হইতে পারে,সব কটা জন্মিয়া গেল। বাবু আমাকে বলিলেন, ‘তোমার অন্য কোনরূপ কষ্ট না হ’লে আমার বাড়িতে তোমার থাকবার জায়গা আর খাবার বন্দোবস্ত হতে পারে।’ ‘আজ্ঞে আমি অমনি থাকতে চাই নে। আপনার কিছু কাজ করে দেব, তার পরিবর্তে যদি কিছু খাবার দেন, তা হলে ভাল হয়।’ ‘উত্তম! তুমি ইংরেজি লিখতে পার?’ ‘কিছু কিছু ইংরেজি পড়েছিলাম বটে, কিন্ত ভাল লেখা পড়া জানি না।’ ‘কতদূর পড়েছ?’ আমি বলিলাম। ‘বেশ, তাতেই হবে।’ আমি বাবুর বাড়ি রহিলাম। কাজের মধ্যে এই, বাবুর চিঠিপত্র সব একটা নকল করিয়া রাখিতে হয়। এখানে থাকিয়া মাঝে মাঝে বাড়ির কথা ভাবিতাম। বড়লোক হইবার জন্য কত কষ্ট পাইলাম, কিন্ত বড়লোক হইবার ত লক্ষণ দেখিতেছি না। কেবল বাড়ি হইতে চলিয়া অসিলেই কি বড়লোক হওয়া যায়? আরো কিছু চাই, আমার তাহা নাই। এইরূপ যতই ভাবিতে লাগিলাম, ততই বাড়ি ফিরিবার ইচ্ছা হইতে লাগিল। শেষটা ঠিক করিলাম বাড়ি যাইতে হইবে। আমার হাতে যে কিছু টাকা আছে, তাহাতে পথ খরচা চলিবে না। সুতরাং এবার স্টিমারে যাওয়া হইবে না। বৈ-তীর্থ এখান হইতে বেশি দূরে নয়; সেখানে গেলে সঙ্গী পাওয়া যাইতে পারে। এইরূপ চিন্তার পর মনে করিলাম, বাবুর নিকট হইতে বিদায় লইয়া বৈ-যাইব; সেখানে সঙ্গী পাইলে তাহাদের সহিত বাড়ি যাইব। কর্তার নিকট হইতে বিদায় লইয়া বৈ-আসিতে বড় বেশী দেরি হইল না। জায়গাটা দেখিতে বড় সুন্দর, একটি ছোট পাহাড়, তার উপরে তীর্থস্থান। পাথরের গায়ে সিড়ি কাটা আছে। সেই সিড়ি দিয়া উপরে উঠিতে হয়। অনেকগুলি সিড়ি; উঠিতে অনেক্ষেন লাগে। আমি উঠিতে উঠিতে তিনবার বিশ্রাম করিলাম। প্রথমেই যাহাকে দেখিলাম, তাহার নিকট জিজ্ঞাসা করিলাম, যাত্রীরা কোথায় থাকে?’ সে বলিল, যাত্রীদের থাকিবার ভাল জায়গা নাই। প্রায় সকলেই পাণ্ডাদের বাড়িতে থাকে। উপরে যে দেব মন্দির, সেই পুরোহিতদের নাম পাণ্ডা। পাণ্ডা খুঁজিতে অধিকক্ষণ ঘুরিতে হইল না। প্রথমে যে পাণ্ডা আমাকে দেখিল, সেই হাত ধরিয়া আমাকে তাহার বাড়ি লইয়া গেল। পাণ্ডার বাড়ি দুদিন থাকিয়াই বুঝিতে পারিলাম যে বিষয়টা তত সুবিধাজনক নহে। আমি যে সময় গিয়াছি সে সময় যাত্রীরা প্রায়ই আসে না। সঙ্গী পাইতে হইলে আরো তিনমাস অপেক্ষা করিতে হইবে। তিন মাসের ত কথাই নাই, পাণ্ডা মহাশয় যেরূপ করিলেন, তাহাতে তৃতীয় দিনেই আমাকে পৃষ্ঠ ভঙ্গ দিতে হইল। তৃতীয় দিন সকালে পাণ্ডা আসিয়া বলিলেন, ‘দেখিবি? চল্’ আমি চলিলাম। অনেক জিনিস দেখা হইল। শেষে এক জায়গায় গেলাম; সেটি একটি বড় মন্দির। মধ্যে গহ্বর, গহ্বরের নীচে ছোট এক ঝরণার মত। পাণ্ডা বলিল, ‘এখানে পূজা করিতে হইবে।’ কত লাগিবে তাহারও হিসাব দেওয়া হইল। আমি দেখিলাম, তা হলে আমার বাড়ী যাওয়া হয় না। আমি বলিলাম আমি ছেলেমানুষ, পূজা কি করিব?’ পাণ্ডা চটিয়া গেল; সেদিন হইতে আর আমাকে তাহার বাড়িতে জায়গা দিল না। অগ্যতা আমার সেখান হইতে প্রস্থান করিতে হইল। কিছুদূর গেলেই কতকগুলি ছোট ছোট ছেলে আসিয়া ‘পয়সা’ ‘পয়সা’ করিয়া আমাকে ঘিরিয়া ধরিল। আমি কোন মতেই পয়সা দিতে চাহিলাম না। তাহারা ক্ষেপিল। কেহ গাল দেয়, কেহ কাপড় ধরিয়া টানে, কেহ দূর হইতে ছোট ছোট ঢিল ছুঁড়িয়া ফেলে। আমার মাথ গরম হইয়া গেল। কাছে একখানা ছোট কাঠ পড়িয়াছিল, রাগের চোটে তাহাই হাতে করিয়া লইয়া ছেলেগুলিকে তাড়া করিলাম। মুহূর্তের মধ্যে সকলে অদৃশ্য হইল। আমার যেন ভূত ছাড়িল। সেখান হইতে উর্ধ্বশ্বাসে দৌড়িয়া পাহাড়ের প্রায় অর্ধেক পথ আসিয়া পড়িলাম। তখন মনে হইল, জুতা জোড়াটি ফেলিয়া আসিয়াছি। কিন্ত ইহার পূর্বের পঁচিশ মিনিটের মধ্যে পাহাড় সম্বন্ধে যেটুকু জ্ঞান লাভ করিয়াছিলাম, তাহাতে মনে ভয়ানক আতঙ্ক উপস্থিত হইতে লাগিল। আমি জুতার আশা পরিত্যাগ করিলাম। চলিবার সময় সর্বদাই চটি জোড়াটি পুটুঁলিতে বাঁধিয়া লইয়া যাইতাম, এক্ষণে তাহাই খুঁজিয়া লইলাম। পাহাড়ের নীচে নামিতে অনেক বেলা হইল। একটু একটু করিয়া ক্ষুধা বাড়িতে লাগিল কোনো দোকানে যাইতে হইলে অন্তত এক প্রহর চলিতে হইবে। সেই রোদে আর এক ঘন্টা চলাই অসম্ভব বোধ হইতে লাগিল। পথের ধারে দু-একটি গাছ দেখিলেই ইচ্ছা হইতেছিল যে সেইখানে শুইয়া পড়ি। কিন্ত একদিকে তৃষ্ণায় গলা শুকাইয়া যাইতেছে এবং অন্যদিকে ক্ষুধায় পেট জ্বলিতেছে। কি করিব কিছু ঠিক করিতে না পারিয়া পথের ধারে একটি বাড়ি খুজিয়া লইলাম। বাড়িতে উঠিয়া একটা বড় ঘরে গেলাম; সেখানে দুটি ছেলে বসিয়াছিল। আমি তাহাদের নিকট আমার ক্ষুধার কথা জানাইলাম, তাহারা ‘তুই’ ‘তুই’ করিয়া আমার কথার উত্তর দিতে লাগিল। একজন বলিল- ‘বাঙালী লোক চোর আর খ্রীষ্টান; বাঙালী লোককে কিছু দিব না।’ ‘আমি ভদ্রলোক ব্রাহ্মন; চোর নই।’ ‘যা তুই এখান থেকেঃ C-r-i-p crip : d-a-s-h dash.’ আমার তখন ঠাট্রার মেজাজ ছিল না। তথাপি এর পর আর হাসি থামাইতে পারিলাম না। তখন তাহাদের ধরণে কথা কহিতে লাগিলাম- ‘ওর মানে কি হোল?’ ‘ ও ইংরাজি। Ram is ill. I will not let him run in the sun বাঙালী লোক চোর; যা তুই এখান থেকে।’ তোরা ইস্কুলে পড়িস?’ এবার যেন তাহারা কিছু ভয় পাইল। আমাদের মাষ্টার বড় বই পড়ে।’ ‘তোমাদের মাষ্টারের চাইতে আমি কি কম একটা কিছু? এই দেখ ত!’ আমার পুঁটুলিতে যে বইগুলি ছিল, তাহার মধ্যে Lamb’d Tales ও ছিল। সেইখানা এখন বাহির করিলাম। এইলা একটু পরিবর্তন দেখা গেল। তাহাদের মুখভঙ্গিতে বুঝা গেল যেন তাহারা মনে করিয়া লইয়াছে যে আমি একটা কিছু হইব। একজন মাথ চুলকাইতে চুলকাইতে উঠিয়া গেল। যে রহিয়া গেল, আমি তাহাকে আশ্বস্ত করিয়া তাহার সহিত আলাপ পরিচয়ের চেষ্টা করিতে লাগিলাম। তাহার কথায় বুঝা গেল যে তাহার দুভাই। সে ছোট। বাবা নাই; মা আছেনঃ ইস্কুলে পড়ে; টাকা আছে, চাকর চাকরানী আছে। বলা বাহুল্য, সে বাড়িতে তখনকার জন্য আমার বিশ্রামের সংস্থান হইল। আমার জন্য একটি ছোট ঘর নিদিষ্ট করা হইল। আমি তাহাতে যাইয়া বসিলাম। তখন সকলের খাওয়া হইয়া গিয়াছে, সুতরাং নতুন আহারের আয়োজন করা হইল। একজন আসিয়া আমাকে স্নান করিতে বলিল। আমি কাছের একটা পুকুর হইতে স্নান করিয়া আসিলাম। আসিয়া দেখিলাম যে জল-খাবারের জন্য কতকগুলি ভিজানো চাল আর কিছু সন্দেশ লইয়া বড় ছেলেটি আমার ঘরে বসিয়া আছে। চালগুলি ভিজিয়া ঠিক ভাতের মত হইয়াছে। সেখানে খাবার সময় ঐরূপ চাল অনেককে খাইতে দেখিয়াছি। আমি খাইতে বসিলাম। ছেলেটি আমার কাছে বসিয়া রহিল। তাহার ভাব ভঙ্গিতে বোধ হইতে লাগিল যেন কিছু বলিতে আসিয়াছে। কিছুকাল পরেই সে আমার গায় মাথায় হাত বুলাইতে লাগিল। আমি কিছু চমৎকৃত হইয়া তাহার দিকে চাহিলাম, সে বলিল, ‘মা ব’লে দিয়েছেন আপনি ব্রাহ্মণ, আপনি শাপ দিলে আমার অনিষ্ট হবে। আমি আপনাকে মন্দ কথা বলেছি।’ ‘তোমার উপর রাগ করি নাই। তোমার কথায় আমার কিছুমাত্র অনিষ্ট হয় নাই। আমি ভগবানের নিকট প্রার্থনা করিব, যেন তিনি তোমার ভাল করেন।’ তাহাকে বুঝানো কিছু কষ্টকর বোধ হইল। কিন্ত শেষটা সে যেন সুখী হইল এবং বলিল, ‘তবে যাই, মা’র কাছে বলিগে।’ বেলা প্রায় শেষ হইয়া আসিলে সেই ছেলে দুটির নিকট হইতে বিদায় লইয়া বাহির হইলাম। সেদিন রাত্রিতে এক বাজারে মুদীর দোকানে ছিলাম। তারপর দুই দিন ঐ ভাবে গেল। সারদিন পথ চলিতাম; কেবল দু-বেলা খাবার জন্য কোনো মুদীর দোকানে উঠিতাম। রাত্রিতে কোন মুদীকে পয়সা দিয়া তাহার ঘরে থাকিবার জায়গা পাইতাম। তৃতীয় দিন রাত্রিতে থাকিবার জন্য আর মুদীর ঘর পাইলাম না। কাজেই একজন গৃহস্থের বাড়ি যাইতে হইল। গৃহস্থ জায়গা দিতে কোনো আপত্তি করিলেন না। কিন্ত খাওয়া শেষ হইলে ‘কড়া’ ‘বগুণো’ সব দেখাইয়া বলিলেন, ‘কাল চলে যাবার আগে এইগুলো মেজে দিয়ে যেতে হবে। তুমি বাঙালী, তোমার এঁটো কে নেবে?’ আমি মহা বিপদে পড়িলাম। বলিলাম, ‘ওগুলো আমি ছুঁই নাই। তবে আমি যা যা ছুঁয়েছি সেগুলো দাও, এখনি মেজে দিচ্ছি।’ একখানা থালা আর একটি বগুণো (বগুণোতে ডাল ছিল) আমার ঘাড়ে চাপিল। তিনি বাড়ির কাছে একটা পুকুর দেখাইয়া দিলেন; আমি তথায় যাইয়া সমস্ত পরিস্কার করিয়া আসিলাম। প্রায় অর্ধঘন্টা সময় লাগিল। পরিশ্রমের পর সুনিদ্রা হইল। পরদিন গৃহস্থ ডাকিয়া ঘুম ভাঙ্গাইলেন, উঠিয়া দেখি সূর্য উঠিয়াছে। তাড়াতাড়ি পুঁটুলি হাতে করিয়া বাহির হইলাম। গৃহস্থের নিকট বিদায় লইবার সময় ফা-যাইবার পথ জিজ্ঞাসা করিলাম। তিনি বলিলেন, ‘একটা বড় মাঠ, তারপর একটা পাহাড়, তারপর ফা-। একই পথ, ভূল হবার জো নাই।’ কিছুদূর হাঁটিয়াই একটা মাঠে আসিলাম। সেখানে পথিকদিগের জন্য একটা ঘর আছে। তথায় একজনার সাহিত সাক্ষাৎ হইল। তাহার সঙ্গে একটা ঘোড়া। সে আমাকে দেখিয়াই বলিল, ‘বেশ, চল। একজন সঙ্গীর জন্য বসিয়াছিলাম। আমি জিজ্ঞাসা করিলাম, ‘সঙ্গীর প্রয়োজন কি?’ সে বলিল, ‘তুমি আর কখনো এখানে চল নাই? একা গেলে খেয়ে ফেলবে!’ আমার ভয় হইল। মাঠের এপাশ থেকে ওপাশ দেখা যায় না। অতি কম চওড়া পথ; দশ বারো হাত অন্তর ছোট ছোট খসখসের ঝোপ। জীবজন্তুর মধ্যে এক জাতীয় পাখি। পাখিটি একটি চড়াই অপেক্ষা কিঞ্চিৎ বড়, গায়ের রং সবুজ; ঠোট সরু এবং লম্বা, স্বভাব অত্যন্ত চঞ্চল। ক্রমাগত একই রূপ শব্দ করিতেছে-”টিরিরণ টিরিরণ টিরিরণ।” লেজে একটা নতুনত্ব আছে। লেজের মধ্যদেশ হইতে প্রায় দেড় ইঞ্চি লম্বা একটি সূচীর মত বাহির হইয়াছে। আমার সঙ্গী বলিল, ‘শ্বশুর বাড়ি গিয়ে ছুঁচ চুরি করেছিলেন। তাতেই ঐ শাস্তি।’ অন্য কিছু না থাকাতে ঐ পাখিকেই বারবার ভাল করিয়া দেখিতে লাগিলাম। বেলা আন্দাজ চারিটার সময় ছোট একটি ঘর দেখিতে পাইলাম। সঙ্গী বলিল, ‘আজ এখানেই থাকিতে হইবে।’ আমি প্রতিবাদ করিয়া বলিলাম, ‘চারটের সময় বসে থাকতে হবে কেন?’ সঙ্গী বলিল, ‘মাঠে রাত হলে বাঘে খাবে।’ বাঘে খায় এরূপ ইচ্ছা আমার ছিল না। সুতরাং সে রাত্রির জন্য ঐ ঘরেই থাকিলাম। রাত্রিতে ঘুমাইয়া ঘুমাইয়া অনেক প্রকার শব্দ শুনিতে পাইলাম। সে-সব নাকি হাতির শব্দ। সৌভাগ্যক্রমে হাতিগণ আমাদের কোন খবর লইতে আসিলেন না। কিন্ত পরদিন উঠিয়া দেখি ঘোড়াটি নাই। ঘোড়ার স্বামী অনেক আক্ষেপ করিল। মাঠ পার হইতে প্রায় চারটা বাজিল। মাঠ যে জায়গায় শেষ হইয়াছে, সেখানেও দেখিলাম একটি ছোট ঘর। সেখানে আসিলে সঙ্গী বিদায় লইয়া অন্য পথে গেল। আমি আমার নিদিষ্ট পথে আস্তে আস্তে চলিলাম। কিছুদূর যাইয়া একটি মাহুতকে পাইলাম, সে হাতি লইয়া ফা- চলিয়াছে। আমি চারি আনা পয়সা দিব বলাতে সে আমাকে তাহার হাতির পিঠে একটু স্থান দিল। মহাসুখে ফা-আসিলাম। কালিদাসবাবুর সঙ্গে সাক্ষাৎ করিতে সাহস পাইলাম না। রাত্রিতে একটী মুদীর দোকানে থাকিয়া পরদিন ভোরে রওনা হইলাম। পথে যে-সকল ছোটখাট ঘটনা হইয়াছিল, তাহা বলিবার প্রয়োজন নাই। তবে একদিনের কথা আবশ্যক। দুই প্রহরের পর আর মানুষের সাড়া শব্দ পাইলাম না। বেলা যতই কমিয়া আসিতে লাগিল, ততই ক্রমাগত নির্জন স্থানে যাইয়া পড়িতে লাগিলাম, তারপর কেবল একটা মাঠ; দুই ধারে উলুবন এবং অন্যান্য দুই একটি ছোট ছোট গাছ। এরূপ জায়গায় সন্ধ্যা হইল। কি করি, কোথায় যাই! প্রাণপণে দৌড়িতে লাগিলাম। পথ এত সংকীর্ণ যে দুই পাশের গাছে গা লাগে। থাকিয়া থাকিয়া আমার বুক গুড় গুড় করিয়া উঠিতে লাগিল। এমন সময় হঠাৎ যেন পিঠে একটা কি লাগিল। চমকিয়া ফিরিয়া দেখিলাম একজন পাহাড়ী লোক। সে আমাকে কি একরকম ভাষায় বলিল-‘তুই কোথায় যাস? তোর প্রাণের ভয় নাই?’ এই বলিয়া সে আমাকে তাহার পিছু পিছু যাইতে সংকেত করিল। আমি সহজেই সে আজ্ঞা পালন করিতে লাগিলাম। সে দুই হাতে উলবন সরাইয়া শুয়োরের মত দৌড়াইতে লাগিল, আর মাঝে মাঝে আমাকে ডাকিয়া বলিতে লাগিল ‘আরে আয়, মরে যাবি।’ আমি হতবুদ্ধি হইয়া তাহার অনুসরণ করিতে লাগিলাম। কতক্ষণ এইরূপে চলিলাম বলিতে পারি না। অবশেষে একটা বড় নদীর ধারে আসিলাম, সেখানে দেখিলাম আরো কয়েকজন লোক বসিয়া আছে। পাহাড়ী বলিল, যতক্ষণ নৌকা আসিয়া ও-পারে না যায়, ততক্ষন এখানে বসিয়া থাকিতে হইবে। আমি তাহাদের সঙ্গে মাটিতে বসিলাম। অন্যান্য সকলে পুঁটলি হইতে খাবার খুলিয়া খাইতে লাগিল। পাহাড়ীর সঙ্গে কতকগুলি কমলালেবু ছিল। সে আমাকে তাহার খাবারটা খাইতে দিল। আমি তাহাই খাইয়া, নাক মুখ কাপড়ে ঢাকিয়া সেইখানেই শুইয়া পড়িলাম। অন্যান্য লোকেরা আমাকে বলিতে লাগিল ‘ঘুমিও না, খেয়ে ফেলবে।’ তেমন অবস্থায় ঐরূপ উপদেশ বাক্যের অত্যন্ত আবশ্যক ছিল, কারণ সমস্ত দিনের পরিশ্রমে আমার গা অবশ হইয়া আসিতেছিল। এবং একটু পরেই অতি নিকটে ‘ঘ্যাঁওর’ ‘ঘ্যাঁওর’ করিয়া বাঘ ডাকিতে লাগিল। সমস্ত রাত্রি চারিপাশে দূরে নিকটে হিংস্র জন্তুর শব্দ হইতে লাগিল। সে রাত্রির কথা আমার জীবনে আর কখনো ভুলি নাই। নৌকাওয়ালা ওপারে বসিয়া সুখভোগ করিতেছে; সেখানে নৌকা বোঝাই না হইলে ফিরিয়া আসিবে না। সমস্ত রাত্রি আমাদের প্রান হাতে করিয়া সেই ভয়ানক স্থানে বসিয়া থাকিতে হইল। পরদিন নৌকা আসিলে আমরা ওপারে গেলাম। ইহার তিনদিন পর বাড়ির কাছে বাজারে আসিলাম, সেখানে দই, চিড়ে, সন্দেশ ইত্যাদি যাহা কিছু মনে হইল উদরস্থ করিয়া পথকষ্টের প্রতিহিংসা বিধান করিলাম। দুইটার সময় বাড়ি আসিলাম। তখন বাহির বাটিতে কেহ ছিল না। গা ভয়ানক কাঁপিতে লাগিল; শীতে অস্থির হইয়া গেলাম। আশে পাশে যে কয়খানা লেপ কাঁথা ছিল, উপর্যুপরি গায় দিয়া বিছানায় পড়িলাম। শক্ত জ্বর হইল। ফাঁকি দিয়া বড়লোক হওয়ার স্বপ্নটা ভালরকমেই ভাঙ্গিয়া গেল।
উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী
সাগর কেন লোনা? উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী এক যে ছিল রাজা, তার নাম ফ্রদি। তার ছিল একটা যাঁতা, তাকে বলত গ্রত্তি। সে যাঁতা যেমন তেমন যাঁতা ছিল না, তাকে ঘুরিয়ে যে জিনিস ইচ্ছা, তাই তার ভিতর বার করা যেত। কিন্তু ঘোরাবে কে? সে যাঁতা ছিল পাহাড়ের মত বড়। রাজার চাকরেরা সেটা নাড়তেই পারল না। রাজার দেশে যত জোয়ান ছিল, সকলে হার মেনে গেল, সে যাঁতা কিছুতেই ঘুরবার নয়। রাজার মনে বড় দুঃখ। ভেবেছিলেন, যাঁতা ঘুরিয়ে কত হীরা-মাণিক বার করে নেবেন। কিন্তু, হায়! যাঁতা আর ঘুরল না! এমনি করে দিন যায়। তারপর একবার বিদেশে গিয়ে তিনি দুটি দানবের মেয়েকে দেখতে পেলেন। তারা দুটি বোন। একজনের নাম মেনিয়া, আর একজনের নাম ফেনিয়া। তারা চলতে গেলে মাটি কাঁপে, বসতে গেলে গর্ত হয়ে যায়। তাদের দেখে রাজা ভাবলেন-‘এইবার আমার যাঁতা ঠেলাবার লোক জুটেছে।’ তখন রাজা খুশি হয়ে মেনিয়া-ফেনিয়া কিনে নিয়ে দেশে ফিরে এলেন। এসেই তাদের দুজনকে যাঁতার কাছে নিয়ে গিয়ে বললেন- ‘ঠেল, ঠেল, ঠেল। সোনা বেরোক, রূপো বেরোক, ঠেল, ঠেল!’ মেনিয়া আর ফেনিয়া যাঁতা ঠেলতে লাগল আর গাইতে লাগলঃ- ‘আয় সোনা-হুঁই রে হাঁ! আয় রূপো-হুঁই রে হাঁ! ফ্রদির ঘরে-হুঁই রে হাঁ! সিন্দুক ভরে হুঁই রে হাঁ!’ দেখতে দেখতে সোনা-রূপোয় রাজার বাড়ি ভরে গেল, তবু খালি বলেন-‘ঠেল, ঠেল, ঠেল!’ দিনের পর দিন যাঁতা ঠেলতে ঠেলতে মেনিয়া-ফেনিয়া কাহিল হয়ে পড়ল, তাদের পিঠে ধরে গেল, অবশ হয়ে এল, তবু রাজা খালি বলছেন-‘ঠেল, ঠেল, ঠেল!’ তখন কাজ ত করিয়ে নেবেই। কিন্তু মনে মনে তাদের বড্ড রাগ হল। একদিন রাজা খাওয়া দাওয়া সেরে ঘুমিয়ে আছেন, মেনিয়া-ফেনিয়া যাঁতা ঠেলছে। ঠেলতে ঠেলতে তারা বলল-‘দাড়াও, এই বেলা একটু মজা দেখাচ্ছি!’ বলে তারা গাইতে লাগল- ‘আয় ডাকাত-হুঁইরে হাঁ! হাজার হাজার-হুঁইরে হাঁ! মার মার-হুঁইরে হাঁ! লাগা আগুন-হুঁইরে হাঁ!’ অমনি হাজারে হাজারে ডাকাত এসে দেশ ছেয়ে ফেলল। তারা জাহাজে চড়ে সাগর পার হেয় দেশ বিদেশে ডাকাতি করে বেড়ায়, তাদের বলে বোম্বেটে , তাদের সঙ্গে কেউ পারে না। রাজা ঘুমুতেই লাগলেন। ডাকাতেরা তাঁদের সকলকে মেরে, যত টাকা কুড়ি লুটে নিয়ে গেল, মেনিয়া-ফেনিয়া শুদ্ধ সেই যাঁতাটাও নিয়ে জাহাজে তুলল। তারপর ডাকাতদের সর্দার বলল-‘বাঃ বেশ হয়েছে। যাঁতাটার ভিতর থেকে যা চাই তাই বেরোবে! টাকা কড়ি ত আমারে ঢের আছে- নাই খালি নুন। এবারে আমাদের নুনের দুঃখ দূর হবে। ঠেল, ঠেল, ঠেল,-নুন বেরোক, নুন, নুন!’ মেনিয়া-ফেনিয়া যাঁতা ঠেলতে লাগল, আর কেবল নুন বেরোতে লাগল। নুন, নুন আর নুন! শেষে জাহাজ একেবারে ডুবেই গেল। সব ডাকাত তার সঙ্গে ডুবে মরল। সেই ভয়ঙ্ক যাঁতা ডুববার সময়ে কি যে কাণ্ড হয়েছিল, কি বলব! সাগরের জল গর্হ হযে, হড়-হড় শব্দে জল তার চারদিকে ঘুরপাক খেতে লাগল,-যে ঘুরুনি আজো থামে নি! আর সেই লবণের কি হল? আর হবে? সেই নুন সমুদ্রের জল ভেসে গেল। দুই দানবীতে মিলে কম নুন তোর বার করে নি, সাগরের সব জল তাতে লোনা হয়ে গেছে। আমার কথায় বিশ্বাস না-হয়, মুখে দিয়ে দেখে আসতে পার।
উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী
সাতমার পালোয়ান উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী এক রাজার দেশে এক কুমার ছিল, তার নাম ছিল কানাই। কানাই কিছু একটা গড়িতে গেলেই তাহা বাঁকা হইয়া যাইত, কাজেই তাহা কেহ কিনিত না। কিন্তু তাহার স্ত্রী খুব সুন্দর হাঁড়ি কলসি গড়িতে পারিত্‌ ইহাতে কানাইয়ের বেশ সুবিধা হইবারই কথা ছিল। সে সকল মেহন্নত তাহার স্ত্রী ঘাড়ে ফেলিয়া সুখে বেড়িয়া বেড়াইতে পারিত। কিন্তু তাহার স্ত্রী বড়ই রাগী ছিল, কানাইকে আলস্য করিতে দেখিলেই সে ঝাঁটা লইয়া আসিত। সুতরাং মোটের উপর বেচারার কষ্টই ছিল বলিতে হইবে। একদিন কানাইয়ের স্ত্রী কতকগুলি হাঁড়ি রোদে দিয়ে বলিল, ‘দেখ যেন কিছুতে মাড়ায় না।’ কানাই কিছু চিঁড়ে আর ঝোলাগুড় এবং এবং একটা লাঠি লইয়া হাঁড়ি পাহারা দিতে বসিল। এক-একবার চিঁড়ে খায় আর এক-একবার হাঁড়ির পানে তাকাইয়া দেখে, কিছুতে মাড়াইল কি না। কানাইয়ের ঝোলাগুড়ের খানিকটা কেমন করিয়া হাঁড়ির উপর পড়িয়াছিল, অনেকগুলি মাছি রোসো!’ এই বলিয়া সে তাহার লাঠি দিয়া মাছিগুলিকে এমন এক ঘা লাগাইল যে তাহাতে মাছিও মরিয়া গেল, হাঁড়িও গুঁড়া হইয়া গেল। কানাই গনিয়া দেখিল যে, সাতটা মাছি মরিয়াছে। তাহাতে সে লাঠি বগলে করিয়া ভারি গম্ভীর হইয়া বসিয়া রহিল। হাঁড়ি ভাঙ্গার শব্দ শুনিয়া তাহার স্ত্রী ঝাঁটা হাতে আসিয়া জিজ্ঞাসা করিল, ‘কি হয়েছে?’ কানাই কথা কয় না। তাহার স্ত্রী যতই জিজ্ঞাসা করে, সে খালি আরো গম্ভীর হইয়া যায়। শেষটা যখন তাহার স্ত্রী বাড়াবাড়ি করিল, তখন সে চোখ লাল করিয়া বলিল, ‘দেখ, হিসেব করে কথা কোস। এক ঘায় সাতটা মেরেছি, জানিস?’ কানাই আর কাহারো সঙ্গে কথা কয় না। বেশি পীড়াপীড়ি করিলে খালি বলে, ‘হিসেব করে কথা কোস্‌। এক ঘায় সাতটা মেরেছি, জানিস?’ শেষে একদিন কানাই এক থান মার্কিন দিয়া মাথায় একটা পাগড়ি বাঁধিল। বনের ভিতর হইতে বাঁশ কাটিয়া একটা ভয়ানক মোটা লাঠি তয়ের করিল। তারপর পিরান গায়ে দিয়া কোমর বাঁধিয়া, ঢাল হাতে করিয়া, জুতা পায় দিয়া, রাজার বাড়িতে পালেয়ানগিরি করিতে চলিয়া যাইবার সময় তাহার স্ত্রীকে বলিয়া গেল-‘আমি আর তোদের এখানে থাকব না। আমি এক ঘায় সাতটা মারতে পারি।’ পথের লোক জিজ্ঞাসা করে , ‘কানাই, কোথায যাও?’ কানাই সে কথার কোন উত্তর দেয় না। সে মনে করিয়াছে যেন এখন আর কানাই বলিয়া ডাকিলে উত্তর দিবে না। সে এক ঘায় সাতটা মারিয়া ফেলিয়াছে! এখন কি আর তাহাকে কানাই ডাকা সাজে? এখন তাহাকে বলিতে হইবে, ‘সাতমার পালোয়ান।’ রাজার নিকট গিয়া কানাই জোড়হাত করিয়া দাঁড়াইল। রাজা তাহার সেই এক থান মার্কিনের পাগড়ি দেখিয়া আশ্চর্য হইয়া জিজ্ঞাসা কারিলেন, ‘তোমার নাম কি হে?’ কানাই বলিল, ‘মহারাজ, আমার নাম সাতমার পালোয়ান। আমি এক ঘায় সাতটাকে মারতে পারে।’ কানাই রাজার বাড়িতে পালোয়ান নিযুক্ত হইল। মাইনে পঞ্চাশ টাকা। এখন তার দিন সুখেই যায়। ইহার মধ্যে একদিন সেই রাজার দেশে এক বাঘ আসিয়া উপস্থিত। সে মানুষ মারিয়া গরু বাছুর খাইয়া, দৌরাত্ম্য করিয়া দেশ ছারখার করিবার জোগাড় করিল। যত শিকারী তাহাকে মারিতে গেল, সব কটাকে সে জলযোগ করিয়া ফেলিল। রাজামহাশয় অবধি ব্যস্ত হইয়া উঠিলেন, বলিলেন, ‘দেশ আর থাকে না।’ এমন সময় কোথাকার এক দুষ্ট লোক আসিয়া রাজার কানে কানে বলিল, ‘মহারাজশয়, এত যে ভাবছেন, তবে পঞ্চাশ টাকা দিয়ে পালোয়ান রেখেছেন কি করতে? তাকে ডেকে কেন বাঘ মেরে দিতে হুকুম করুন না।’ রাজা বলিলেন, ‘আরে তাই ত। ডাক্ পালোয়ানকে!’ রাজার তলব পাইয়া কানাই আসিয়া হাত জোড় করিয়া দাঁড়াইরে রাজা বলিলেন, ‘সাতমার পালোয়ান, তোমাকে ঐ বাঘ মেরে দিতে হবে। নইলে তোমার মাথা কাটব।’ কানাই লম্বা সেলাম করিয়া বলিল, ‘বহুত আচ্ছা মহারাজ, এখনি যাচ্ছি।’ ঘরে আসিয়া কানাই মাথায় হাত দিয়া বসিয়া পড়িল। হায়, হায়! এমন সুখের চাকরিটা আর রহিল না, সঙ্গে সঙ্গে বুঝি প্রাণটাও যায়! কানাই বলিল, ‘এখন আর কি? বাঘ মারতে গেলে বাঘে খাবে, না গেলে রাজা মারবে। দূর হোক গে, আমি আর এদেশে থাকব না।’ সেদিন সন্ধ্যার পর কানাই তাহার পাগড়িটা মাথায় জড়াইয়া, কোমরটা আঁটিয়া বাঁধিল। এক হাতে ঢাল, আর-এক হাতে ডান্ডা, পিঠে পুঁটুলি, পায়ে নাগরা জুতো। সকলে মনে করিল, সাতমার পালোয়ান বাঘ মারিতে চলিয়াছে। কানাই মনে করির, এ রাজার দেশ ছাড়িয়া যাইতে হইবে। যত শীঘ্র যাওয়া যায় ততই ভাল। একটা ঘোড়া হইলে আরো শীঘ্র যাওয়া হইত। ততক্ষণে বাঘ করিয়াছে কি-এক বুড়ির ঘরের পিছনে চুপ মারিয়া বসিয়া আছে। ইচ্ছাটা, বুড়ি কিংবা তাহার নাতনী একটিবার বাহিরে আসিলেই ধরিয়া খাইবে। বুড়ি ঘরের ভিতরে লেপ মুড়ি গিয়া শুইয়াছে। তাহার বাহিরে আসিবার ইচ্ছা একেবারেই নাই। এতক্ষণে যে কখন ঘুমাইয়া পড়িত, খালি নাতনীটার জ্বালায় পারিতেছে না। বুড়ি অনেক চেষ্টা করিয়াছে, কিন্তু তাহাকে ঘুম পাড়াইতে পারে নাই। শেষে রাগিয়া বলিল, ‘তোকে বাঘে ধরে নেবে।’ নাতনী বলিল, আমি বাঘে ভয় করি না।’ বুড়ি বলিল, ‘তবে তোকে ট্যাঁপায় নেবে।’ বাস্তবিক ট্যাঁপা বলিতে একটা কিছু নাই, বুড়ি তাহার নাতনীকে ভয় দেখাইবার জন্যই ঐ নামটা তয়ের করিয়াছিল। কিন্তু বাঘ ঘরের পিছন হইতে ট্যাঁপার নাম শুনিয়া ভারি ভয় পাইয়া গেল। সে মনে মনে বলিল, ‘বাস রে! আমাকে ভয় করে না, কিন্তু ট্যাঁপাকে ভয় করবে! সেটা না জানি কেমন ভয়ঙ্কর জানোয়ার। যদি একবার সেই জানোয়ারটা এই দিক দিয়ে আসে, তা হরল ত মুশকিল? দেখছি।’ অন্ধকারে বসিয়া বাঘ এইরূপ ভাবিতেছে, আর ঠিক এমনি সময় কানাই সেই পথে পলায়ন করিতেছে। বাঘকে দেখিয়া কানাই মনে ভাবিল, ‘বাঃ, এই ত একটা ঘোড়া বসে আছে!’ এই বলিয়াই সে কোমরের কাপড়টা খুলিয়া বাঘের গলায় বাঁধিল। আন্ধকারে বাঘকে কানাই ভাল করিয়া চিনিতে পারে নাই। বাঘও কানাইকে তাহার পাগড়ি-টাগড়ি সুদ্ধ একটা নিতান্তই অদ্ভুত জন্তুর মতন দেখিল। একটা মানুষ হঠাৎ আসিয়া যে তার মতন জন্তুর সামনে একটা বেয়াদবি করিয়া বসিবে, এ কথা তাহার মাথায় ঢুকে নাই। সে বেচারা নেহাত ভয় পাইয়া ভাবিতে লাগিল-‘এই রে, মাটি করেছে। আমাকে ট্যাঁপায় ধরেছে!’ কানাই ভাবিল, ‘ঘোড়া যখন পেয়েছি, তখন আর তাড়াতাড়ি কিসের? ঘরে একটু ঘুমুই, তারপর শেষরাত্রে ঘোড়ায় চড়ে ছুট দেব।’ এই ভাবিয়া বাঘকে তাহাকে বাড়ির পানে টানিয়া লইয়া চলিল। বাঘ বেচারা আর কি করে! মনে করিল, ‘এখন ট্যাঁপার হাতে পড়েছি, এর কথা মতনই চলতে হবে।’ বাড়ি আসিয়া কানাই বাঘকে একটা ঘরে বন্ধ করিয়া দরজা আঁটিয়া দিল। তারপর বিছানায় শুইয়া ভাবিতে লাগিল, ‘শেষ রাতেই উঠে পালাব।’ কানাইয়ের ঘুম ভাঙিতে ফরসা হইয়া গেল। তখন সে তাড়াতাড়ি উঠিয়া ঘোড়া আনিতে গিয়া দেখে-সর্বনাশ! বাঘ যে ঘরে বন্ধ আছে! বাহিরে আসিয়া তাহাকে খাইতে পারিবে না, সে কথা তখন তাহার মনেই হইল না। সে তাড়াতাড়ি নিজের ঘরে গিয়া দরজার হুড়কা আঁটিয়া বসিয়া কাঁপিতে লাগিল। এদিকে সকাল বেলা সকলে সাতমার পালোয়ানের বাড়িতে খবর লইতে আসিয়াছে, বাঘ মারা হইল কি না। তাহারা আসিয়া দেখিল যে, বাঘ ঘরে বাঁধা রহিয়াছে। তখন সকলে ছুটিয়া গিয়া রাজাকে বলিল, ‘রাজামশাই, দেখুন এসে, সাতমার পালোয়ান বাঘকে ধরে এনে ঘরে বেঁধে রেখেছে!’ রাজামহাশয় আশ্চর্য হইয়া সাতমার পালোয়ানের বাড়ি চলিলেন। সেখানে গিয়া দেখেন যে সত্যই বাঘ ঘরে বাঁধা। ততক্ষণে কানাই ব্যাপার বুঝিতে পারিয়া আসিয়া রাজামহাশয়কে সেলাম করিয়া দাঁড়াইয়াছে। রাজা বলিলেন, ‘সাতমার, ওটাকে মার নি কেন?’ কানাই বলিল, ‘মহারাজ, আমি এক ঝায় সাতটাকে মারি, ও যে শুধু একটা।’ এখন হইতে সাতমার পালোয়ানের নাম দেশ বিদেশে রাষ্ট্র হইয়া গেল। রাজামহাশয় যার পর নাই সন্তুষ্ট হইয়া তাহার মাইনে পাঁচ শত টাকা করিয়া দিলেন। কানাইয়ের দিন খুব সুখেই কাটিতে লাগিল। কিন্তু সুখের দিন কি চিরকাল তাকে? দেখিতে দেখিতে বানাইয়ের আর এক নূতন বিপদ আসিয়া উপন্থিত হইল। এবারে বাঘ নয়, আর-একটা রাজা! সে অনেক হাজার সৈন্য লইয়া এই রাজার দেশ লুটিতে আসিয়াছে। এ রাজাটা নাকি বড়ই ভয়ানক লোক, তাহার সঙ্গে কিছুতেই আঁটা যায় না। রাজামহাশয় বলিলেন, ‘সাতমার, এখন উপায়? তুমি না বাঁচালে আমার আর রক্ষে নেই। তোমাকে আমার অর্ধেক রাজ্য দেব, যদি এবার বাঁচিয়ে দিতে পার।’ কানাই বলিল, ‘রাজামশাই, কোনা চিন্তা করবেন না, এই আমি যাচ্ছি! আমাকে একটা ভাল ঘোড়া দিন।’ রাজার হুকুমে সরকারি আস্তাবলের সকলের চাইতে ভাল যুদ্ধের ঘোড়াটি আনিয়া কানাইকে দেওয়া হইল। কানাই আজ দুই থান মার্কিন দিয়া পাগড়ি বাঁধিল। পোশাকটাও দস্তুর মতল করিল। মনে মনে কিন্তু তাহার মতলব এই যে, যুদ্ধে যাইবার ভান একবার ঘোড়ার পিঠে চড়িতে পারিলেই পলায়নের সুবিধা হয়। কিন্তু হায়, সেটা যে যুদ্ধের ঘোড়া কানাই তাহা জানিত না। সে বেচারা যতই ঘোড়াটাকে অন্য দিকে লইয়া যাইতে চায়, ঘোড়া কিছুতে রাজি হয় না। যুদ্ধের বাজনা শুনিয়া ঘোড়া যখন নাচিতে লাগিল, কানাইয়ের তখন পিঠে টিকিয়া থাকা ভার হইল। শেষে ঘোড়া তাহার কোন কথা না শুনিয়া একেবারে যুদ্ধের জায়গায় গিয়া উপস্থিত। পথে কানাই লতাপাতা গাছপালা খড়ের গাদা যাহা কিছু পাইয়াছে, তাহাকেই আঁকড়িয়া ধুরিয়া ঘোড়া থামাইতে চেষ্টা করিয়াছে, কিন্তু কিছুতেই সে ঘোড়া থামিল না। সেই গাছপালা আর খড়ের গাদা সব শুদ্ধই সে কানাইকে লইয়া ছুটিল। এদিকে সেই বিদেশী রাজার সৈন্যরা শুনিতে পাইয়াছে যে এদেশে একটা সাতমার পালোয়ান আছে, সে এক ঘায় সাতটাকে মারে-বাঘকে ধরিয়া আনিয়া ঘরে বাঁধিয়া রাখে! এ কথা শুনিয়াই তাহারা বলাবলি করিতেছে ‘ভাই’ ওটা আসিলে আর যুদ্ধ-টুদ্ধ করা হইবে না। বাপরে, এক ঘায় সাতটাকে মারিবে।’ এমন সময় সাতমারের ঘোড়া সেই দুই থান মার্কিনের পাগড়ি আর সেই সব গাছপালা আর খড়ের গাদা সুদ্ধু সাতমারকে লইয়া আসিয়া দেখা দিল! দূর হইতে বোধ হইতে লাগিল, যেন একটা পাহাড়-পর্বত ছুটিয়া আসিতেছে। বিদেশী রাজার সৈন্যরা তাহা একবার দেখিয়া আর দুবার দেখিবার জন্য দাঁড়াইল না। একজন যেই চেঁচাইয়া বলিল, ‘ঐ রে আসছে। এবারে গাছ পাথর ছুঁড়ে মারবে।’ অমনি মুহূর্তের মধ্যে সেই হাজার হাজার সৈন্য চ্যাঁচাইয়া চ্যাঁচাইয়া কোথায় ছুটিয়া পালাইল তাহার ঠিকানা নাই। কানাই দেখিল যে, বিদেশী সৈন্য সব পালাইয়াছে, খালি তাহাদের রাজাটা ছুটিতে পারে নাই বলিয়া ভ্যাবাচ্যাকা লাগিয়া দাঁড়াইয়া আছে। কানাই মনে মনে ভাবিল, ‘এ তা মন্দ নয়! পালাতে চেয়েছিলুম, মাঝখানে থেকে কেমন করে যুদ্ধ জিতে গেলুম! এখন রাজাটাকে বেঁধে নিলেই হয়! আর কি! এখন ত সাতমার পালোয়ানের জয়জয়কার! অর্ধেক রাজ্য পাইয়া এখন সে পরম সুখে বাস করিতে লাগিল।
উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী
অগস্ত্য উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী বিখ্যাত মুনি। পাণ্ডবরা যখন তীর্থে গিয়েছিলেন তখন এঁর জীবন-কাহিনী ওঁরা শোনেন। ওঁর স্ত্রী লোপমুদ্রা ছিলেন বিদর্ভরাজের কন্যা। উনিও একজন তপস্বিনী ছিলেন। ওঁদের পুত্রের নাম দৃঢ়স্যু। অগস্ত্যমুনি একবার তাঁর পত্নী লোপামুদ্রার ইচ্ছাপূরণের জন্য রাক্ষস ইল্বলের কাছে ধন চাইতে এসেছিলেন, তখন ওঁর চোখের সন্মুখে ইল্বলের ভ্রাতা বাতাপি একটি মেষ হয়ে গেলেন। ইল্বল সেই মেষটি কেটে রন্ধন করে অতিথিদের দিতে, অগস্ত্য বললেন আমিই একে খাব। এর আগে বহুবার ইল্বল এইভাবে তাঁর মেষরূপী ভ্রাতাকে কেটে ব্রাহ্মণদের খাইয়ে, উদরস্থ ভ্রাতাকে পুনর্জীবিত করে ব্রাহ্মণদের অপমৃত্যু ঘটিয়েছেন। এবারও তাই ঘটবে তিনি ভেবেছিলেন। কিন্তু অগস্ত্যের খাওয়া শেষ হলে ইল্বল যখন বাতাপিকে ডাকলেন, তখন অগস্ত্য বললেন যে,বাতাপি আসবে না,কারণ তিনি তাঁকে জীর্ণ করে ফেলেছেন। কালেয় দানবরা যখন রাত্রিকালে সমুদ্র থেকে বেরিয়ে তপস্বী ব্রাহ্মণদের বধ করছিলেন তখন দেবতাদের অনুরোধে অগস্ত্য মহাসমুদ্র পান করেন। ফলে কালেয়দের আর আত্মগোপন করার স্থান রইলো না – দেবতাদের হাতে নিহত হলেন। দানবরা বিনষ্ট হবার পর দেবতারা যখন অগস্ত্যকে বললেন উদর থেকে জলরাশি উদ্গার করে সমুদ্রকে আবার পূর্ণ করতে, তিনি বললেন,সব জল জীর্ণ হয়ে গেছে। পরে ব্রহ্মা ভগীরথকে দিয়ে সমুদ্র আবার জলপূর্ণ করেন। দানবরা একবার দেবতাদের পরাজিত করে স্বর্গ থেকে বিতাড়িত করলে দেবতারা অগস্ত্যের শরণাপন্ন হন। অগস্ত্য সেই শুনে ক্রোধে প্রজ্বলিত হলে,দানবরা দগ্ধ হয়ে প্রাণশূন্য হয়ে অন্তরীক্ষ থেকে নিপাতিত হতে লাগলেন। শুধু যাঁরা মর্তে আর পাতালে ছিলেন – তাঁরাই রক্ষা পেলেন। স্বর্গস্থ দানবরা সব বিনষ্ট হলে দেবতারা অগস্ত্যকে অনুরোধ করলেন,মর্ত ও পাতালের দানবদেরও বিনষ্ট করতে। অগস্ত্য রাজি হলেন না। দেবতাদের বললেন যে,ওঁদের অনুরোধ রক্ষা করতে উনি স্বর্গের দানবদের ধবংস করেছেন, কিন্তু এখন অন্য অনুরোধ রক্ষা করতে হলে,ওঁর নিজের তপোবল ক্ষয়প্রাপ্ত হবে। একবার বিন্ধ্যপর্বত মেরুপর্বতের প্রতি ঈর্ষান্বিত হয়ে বাড়তে শুরু করেছিলেন যাতে মেরু-প্রদক্ষিণকারী চন্দ্রসূর্যের পথরোধ হয়। দেবতারা অগস্ত্যের শরণ নিলে অগস্ত্য বিন্ধ্যের কাছে গিয়ে বললেন যে,তিনি দক্ষিণে যাবেন – বিন্ধ্য যেন ওঁর পথ করে দেন। আর অগস্ত্য না ফেরা পর্যন্ত বিন্ধ্য যেন আর বর্ধিত না হন। বিন্ধ্য অগস্ত্যকে ভক্তি করতেন বলে তাতে স্বীকৃত হলেন। অগস্ত্য দক্ষিণ দিকে চলে গেলেন,কিন্তু আর ফিরলেন না। বিন্ধ্যপর্বতও আর বাড়তে পারলেন না।
উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী
ইন্দ্র হওয়ার সুখ উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী ইন্দ্র হওয়ার সুখ  দেবতাদের যিনি রাজা, তাঁহাকে বলে ইন্দ্র। তাঁহার কথা তোমরা অবশ্যই শুনিয়াছ। তাঁহার এক হাজার চক্ষু আর সবুজ রঙের দাড়ি ছিল। তাঁহার আসল নাম শত্রু, পিতার নাম কশ্যপ, রানীর নাম শচী, পুত্রের না জয়ন্ত, হাতির নাম ঐরাবত, ঘোড়ার নাম উচ্চৈঃশ্রবা, সারথির নাম মাতলি, সভার নাম সুধর্মা, বাগানের নাম নন্দন আর অস্ত্রের নাম বজ্র। তাঁহার সভায় গন্ধর্বেরা গান গাইত, অপ্সরারা নাচিত।  লোকে ভাবিত ইন্দ্র বড়ই সুখে থাকেন আর অনেক সময়ই যে তিনি খুব জাঁকজমকের ভিতর দিন কাটাইতেন, একথা সত্যও বটে। কিন্তু সময় সময় তাঁহাকে বেগও কম পাইতে হইত না। দেবতাদের সঙ্গে অসুরদের ভয়ানক শত্রুতা ছিল, আর সেই সূত্রে অসুরেরা মাঝে মাঝে ইন্দ্রকে বড়ই নাকাল করিত। দেবতা আর অসুরের যুদ্ধে একবার বৃত্র নামে একটা অসুর ইন্দ্রকে ধরিয়া গিলিয়া ফেলিয়াছিল। দেবতারা তখন অনেক বুদ্ধি করিয়া সেই অসুরটাকে ‘জ্বম্ভিকা’ অস্ত্র ছুঁড়িয়া মারেন, তাই ইন্দ্র রক্ষা পান, নচেৎ সে যাত্রা আর তাঁহার বিপদের সীমা ছিল না। জ্বম্ভিকা অস্ত্রের গুণ অতি আশ্চর্য। সে অস্ত্র গায়ে লাগিবামাত্র অসুরটা ভয়ানক হাই তুলিল, আর ইন্দ্র সেই ফাঁকে তাহার পেটের ভিতর হইতে বাহির হইয়া আসিলেন।  এই যুদ্ধ ভালো করিয়া শেষ হইতে না হইতেই আবার ইন্দ্রের এক নূতন বিপদ উপস্থিত হইল। পূর্বে কোন কারণে তাঁহার ব্রহ্মহত্যার পাপ হয়। বৃত্রের মৃত্যুর পরে সেই ব্রহ্মহত্যা তাঁহাকে তাড়াইয়া বেড়াইতে লাগিল। বেচারা ভয়ে অস্থির হইয়া যেখানেই পলাইতে যান, ব্রহ্মহত্যা তাঁহাকে তাড়াইয়া সেইখানে গিয়া উপস্থিত হয়। শেষে আর উপায় না দেখিয়া, তিনি একটা প্রকাণ্ড সরোবরের মধ্যে, পদ্মের মৃণালের ভিতরে গিয়া সূতা হইয়া লুকাইয়া রহিলেন। তখন কাজেই ব্রহ্মহত্যা ঠকিয়া গেল। কিন্তু, তথাপি সে তাঁহাকে সহজে ছাড়ে নাই, সে প্রায় সাড়ে তিন লক্ষ বৎসর সেইখানে তাঁহার অপেক্ষায় বসিয়াছিল।  সাড়ে তিন লক্ষ বছর তো আর একদিন দুইদিনের কথা নয়, দেবতার হিসাবেও তাহা এক হাজার বৎসর। কাজেই দেবতারা তাঁকে এতদিন দেখিতে না পাইয়া ব্যস্তভাবে তাঁহাকে খুঁজিতে লাগিলেন। শেষে ব্রহ্মার কথায় যদিও তাঁহার সন্ধান পাইলেন তথাপি তাঁহাকে ঘরে আনিতে সাহস পান নাই, কারণ ব্রহ্মহত্যা তখনও তাঁহার জন্য সেখানে বসিয়া আছে, সে তাহাকে সহজে ছড়িবে কেন? তখন দেবতারা পরামর্শ করিয়া স্থির করিলেন যে, কোনো পবিত্র নদীতে স্নান করাইয়া ইন্দ্রের শরীরের পাপ ধুইয়া ফেলিবেন, তাহা হইলেই ব্রহ্মহত্যা তাঁহকে ছড়িয়া দিবে। এই বলিয়া তাঁহারা ইন্দ্রকে গৌতমী নদীতে স্নান করাইতে গেলেন। সেখানে মহর্ষি গৌতমের আশ্রম ছিল। গৌতম যারপরনাই রাগিয়া তাহাদিগকে বলিলেন, “সে হইবে না, এই পাপীকে এখানে স্নান করাইলে আমি তোমাদিগকে শাপ দিয়া ভস্ম করিব! তোমরা শীঘ্র এখান হইতে যাও।”  এ কথায় দেবতারা নর্মদার জলে ইন্দ্রকে স্নান করাইতে গেলেন। সেখানে মাণ্ডব্য মুনির আশ্রম ছিল। মাণ্ডব্য মুনি বিষম ভূকুটির সহিত তাঁহাদিগকে বলিলেন, “এখানে যদি ইঁহাকে স্নান করাও তবে এখনি তোমাদের শাপ দিয়া ভস্ম করিব।”  যাহা হউক, শেষে দেবতারা অনেক স্তুতি মিনতি করায় মাণ্ডব্য ইন্দ্রকে সেখানে স্নান করাইতে দিলেন। তারপর তাঁহাকে গৌতমীতে নিয়ে গিয়াও স্নান করান হইল। ইহার পর আবার ব্রহ্মা তাঁহার কমণ্ডলুর জল দিয়া ইন্দ্রকে ধুইলেন, তবে সে যাত্রার মতো তিনি একটু নিশ্চিন্ত হইলেন।  বাস্তবিক, ইন্দ্র হওয়া আগাগোড়াই সুখের কথা ছিল না। কিন্তু, লোকে ভাবিত ইন্দ্র বড় সুখী। তাই অনেকে ইন্দ্র হইবার জন্য কঠোর তপস্যা করিত। সেজন্য কাহাকেও খুব তপস্যা করিতে দেখিলেই ইন্দ্র ভাবিতেন সর্বনাশ! এইবার বুঝি বা আমার কাজটি যায়!’ তখন তিনি লোকটির তপস্যা ভাঙ্গিয়া দিবার জন্য প্রাণপণে চেষ্টা করিতেন। কিন্তু, তাহা সত্ত্বেও মাঝে মাঝে এক এক জন লোক ইন্দ্র হইয়া যাইত!  নহুষ নামে এক রাজা একবার ইন্দ্র হইয়া কি হুলস্থুলই বাধাইয়া ছিলেন! উচ্চৈঃশ্রবা ঐরাবতে তাঁহার মন উঠিল না, তিনি বলিলেন, “আমি বড়-বড় মুনিদের ঘাড়ে চড়িয়া বেড়াইব!”  অমনি এক আশ্চর্য পালকি প্রস্তুত হইল, মুনিরা হইলেন তাহার বেহারা। নহুষ তাহাতে উঠিয়া বসিয়া মুনিঠাকুরদের উপরে অসম্ভব তম্বি জুড়িয়া দিলেন। সে বেচারদের গায়ে জোর কম। ফলমূল খাইয়া থাকেন, পালকি বহার অভ্যাস কাহারও নাই, তাঁহাদের কাজে নহুষের মন উঠিবে কেন? নহুষ তখন বেজায় চটিয়া মহর্ষি অগস্ত্যের মাথায় ধাঁই শব্দে এক প্রচণ্ড লাথি লাগাইয়া দিলেন। তার ফলও পাইলেন হাতে হাতেই কেননা, তাহার পরমুহূর্তেই মুনির শাপে তাঁহার সেই সুখের ইন্দ্রগিরি ঘুচিয়া গেল, আর তিনি এক প্রকাণ্ড সাপ হইয়া হিমালয়ের নিকটে পড়িয়া গড়াগড়ি যাইতে লাগিলেন!  আর একবার অসুরদের সঙ্গে দেবতাদের ভীষণ যুদ্ধ চলিয়াছে, কিন্তু কেহই জয়লাভ করিতে পারিতেছে না। সেই সময়ে পৃথিবীতে রজি নামে একজন অতিশয় ক্ষমতাশালী রাজা ছিলেন। দুই দলই ভাবিলেন, “এই রজিকে আনিয়া আমাদের সঙ্গে জুটাইতে পারিলে নিশ্চয় আমরা জিতিব।”  এই ভাবিয়া দেবতারা রজিকে আসিয়া বলিলেন, “হে রাজন, তুমি আমাদের সঙ্গে মিলিয়া অসুর বধ কর, নহিলে আমরা কিছুতেই তাহাদের সঙ্গে পারিয়া উঠিতেছি না।” রজি বলিলেন, “আপনারা যদি আমাকে ইন্দ্র করেন, তবে আমি আপনাদের সঙ্গে মিলিতে পারি।”  দেবতারা বলিলেন, “অবশ্য তোমাকে আমরা ইন্দ্র করিব, তুমি শীঘ্র আইস!”  এই বলিয়া দেবতারা সবে চলিয়া গিয়াছেন, অমনি অসুরেরা আসিয়া রজিকে বলিল, “মহারাজ, আপনি আমাদের পক্ষ হইয়া যুদ্ধ করুন।” রজি দেবতাদিগকে যেমন বলিয়াছিলেন, তেমনি অসুরদিগকেও বলিলেন, “আপনারা যদি আমাকে ইন্দ্র করেন, তবে আমি আপনাদের কথায় রাজি আছি!”  কিন্তু, অসুরেরা সে কথায় অতিশয় ঘৃণার সহিত বলিল, “এমন সাহায্যের আমাদের প্রয়োজন নাই। আমাদের ইন্দ্র প্রহ্লাদ আর কোনো ইন্দ্র আমরা চাই না। আপনি না হয় আমাদের পক্ষে নাই আসিলেন।”  তখন রজি দেবতাদের সঙ্গে জুটিয়া ভয়ানক রাগের সহিত অসুর মারিতে আরম্ভ করিলেন, আর তাহাতে অতি অল্পদিনের মধ্যেই দেবতাদের জয়লাভ হইল। ইন্দ্র দেখিলেন, এখন তো বড়ই বিপদ উপস্থিত, রজিকে এখন সিংহাসন ছাড়িয়া দিতে হইবে। তাই তিনি রজি নিজে কিছু বলিবার আগেই তাঁহাকে বলিলেন, “মহারাজ! লোকে বলে, যে ভয় হইতে রক্ষা করে, সে পিতা। আপনি আমাকে ভয় হইতে উদ্ধার করিয়াছেন, কাজেই আপনি আমার পিতা হইলেন। আর তাহাতেই আপনি ইন্দ্রও হইলেন, কেননা ইন্দ্রের পিতা হইলে আর ইন্দ্র হওয়ার চেয়ে বেশি বৈ কম কি হইল?”  রজিও ইন্দ্রের সেই ফাঁকিতে ভুলিয়া আহ্লাদের সহিত দেশে ফিরিয়া আসিলেন, স্বর্গে রাজা হওয়ার কথা আর মুখে আনিলেন না।  এই রজির পাঁচশত মহাবীর পুত্র ছিল। রজির মৃত্যুর পরে এই পাঁচশত বীর মিলিয়া যুক্তি করিল, “দেবতারা ফাঁকি দিয়া আমাদের পিতাকে ইন্দ্রপদ হইতে বঞ্চিত করিয়াছিল, আইস, আমরা তাহার শোধ লইব!”  এই বলিয়া তাহারা দেবতাদিগের সহিত ঘঘারতর যুদ্ধ আরম্ভ করিল, আর দেখিতে দেখিতে দলবল সহিত ইন্দ্রকে তাড়াইয়া দিয়া স্বর্গ আর পৃথিবী দুইই দখল করিয়া বসিল।  এই পাঁচশত ভাই যেমন বীর, তেমনি যদি বুদ্ধিমান হইত তবে আর ইন্দ্রের নিজ রাজ্য ফিরিয়া পাইবার কোনো উপায়ই থাকিত না। কিন্তু ইহারা বুদ্ধিমানের মতন ধর্মপথে থাকিয়া রাজ্যপালন করার বদলে, নানারূপ অসৎ কার্যে নিজেদের বিষয় ও বল নষ্ট করিয়া ফেলিল। তাহার ফলে, অল্পদিনের ভিতরেই ইন্দ্র তাহাদিগকে আড়াইয়া আবার আসিয়া স্বর্গের রাজা হইলেন।  ইন্দ্র হওয়ার যে কি সুখ, তাহার সম্বন্ধে আর একটা মজার গল্প আছে। একবার অসুরেরা ঘোরতর যুদ্ধে দেবতাদিগকে যারপরনাই ব্যস্ত করিয়া তুলিলে, তাঁহারা সূর্যবংশের রাজা পরঞ্জয়কে আসিয়া বলিলেন, “মহারাজ, তুমি আমাদের হইয়া অসুরদের সঙ্গে যুদ্ধ কর।”  পরঞ্জয় কহিলেন, “আমি যুদ্ধ করিতে প্রস্তুত আছি যদি আপনারা আমার একটি কথায় রাজি হন। আপনাদের যিনি ইন্দ্র, আমি তাঁহার কাঁধে চড়িয়া যুদ্ধ করিব।”  এ কথায় ইন্দ্র আর অন্য দেবতারা সকলেই বলিলেন, “হাঁ হাঁ, তাহাই হইবে, তুমি আইস!”  তারপর আবার যুদ্ধ আরম্ভ হইলে, ইন্দ্র বিশাল এক ষাঁড় সাজিয়া পরঞ্জয়কে কাঁধে করিয়া লইলেন, পরঞ্জয়ও তাহাতে ভারি খুশি হইয়া দুই দণ্ডের মধ্যে অসুর মারিয়া শেষ করিলেন। সেই ষাঁড়ের ‘ককুদ্‌’ অথবা কাঁধে চড়িয়া যুদ্ধ করায় তখন হইতে পরঞ্জয়ের নাম হইল ‘ককুৎস্থ’। দশরথের পুত্র রাম এই ককুৎস্থ বংশের লোক ছিলেন বলিয়া, তাঁহাকেও অনেক সময়ে বলা হয় ‘কাকুৎস্থ’।  ইন্দ্রগিরির মজার আর একটা গল্প বলিয়া শেষ করিব। একজন অতি বিখ্যাত মুনি ছিলেন, তাঁহার নাম আত্রেয় (অত্রি মুনির পুত্র)। ঠাকুরটি বিস্তর যাগযজ্ঞ করিয়াছিলেন, আর তাহাতে তাঁহার ইচ্ছামতো সংসারের সর্বত্র চলাফেরার ক্ষমতা জন্মিয়াছিল।  একদিন তিনি বেড়াইতে বেড়াইতে ইন্দ্রের সভায় আসিয়া উপস্থিত হইলেন। সেখানকার শোভা দেখিয়া, সেখানকার গীত-বাদ্য শুনিয়া, আর সেখানকার ময়রাদের তৈরি মিষ্টান্ন খাইয়া ঠাকুরের মন এমনই ভুলিয়া গেল যে, তিনি দিনরাতই কেবল ভাবিতে লাগিলেন, ‘আহা! এই তো সুখ, এমনিই তো চাই!’  তারপর আশ্রমে ফিরিয়া আর তাঁহার নিজের কুঁড়েঘরটি কিছুতেই তাঁহার পছন্দ হয় না। ব্রাহ্মণীকে ডাকিয়া বলিলেন, “ওগো! এসব কি ছাই খাবার আমাকে খাইতে দাও? এসব কি খাইতে ভালো লাগে? ইন্দ্রের বাড়িতে যে চমৎকার মিঠাই খাইয়া আসিয়াছি, ফলমূলের তরকারি কিছুতেই তেমন করিতে পারিবে না!”  এই বলিয়া তিনি বিশ্বকর্মাকে ডাকিয়া হুকুম দিলেন, “আমার এই আশ্রমটিকে ঠিক ইন্দ্রের পুরীর মতো করিয়া দাও। নইলে তোমাকে শাপ দিয়া ভস্ম করিব! ঠিক তেমনি বাড়ি, তেমনি সভা, তেমনি বাগান, তেমনি হাতি, তেমনি ঘোড়া, তেমনি ঝাড়-লণ্ঠন, তেমনি গান-বাজনা, তেমনি মিঠাই-মণ্ডা, লোকজন—সব অবিকল চাই! খবরদার! যেন কোনো কথার একটু তফাত হয় না!”  শাপের ভয়ে বিশ্বকর্মা তখনই তাড়াতাড়ি সেখানে এক ইন্দ্রপুরী তয়ের করিয়া দিলেন। মুনি ঠাকুর সেই পুরীতে থাকেন, আর বলেন, “আহা এই তো সুখ! এমনই ত চাই।”  এমনিভাবে কিছুদিন যায়। ইহার মধ্যে অসুরেরা সেই পুরীর দিকে ভ্রুকুটি করিয়া তাকায় আর বলে, “দেখ ভাই, ইন্দ্র বেটা স্বর্গ ছাড়িয়া চুপিচুপি পৃথিবীতে আসিয়া ঘর বাঁধিয়াছে। চল, এই বেলা উহাকে ধরিয়া বৃত্রকে মারিবার সাজাটা ভালোমতে দিই!”  অমনি দলে দলে অসুর, “ইন্দ্র বেটাকে মার!” “ইন্দ্র বেটাকে মার!” বলিতে বলিতে আসিয়া সেই পুরী ঘিরিয়া বসিল।  মুনিঠাকুর মনের সুখে খাটের উপর বসিয়া আছেন, ইহার মধ্যে অসুরদের বিকট চীৎকারে তাঁহার প্রাণ উড়িয়া গেল। দেখিতে দেখিতে লাখে লাখে শেল, শূল, মুষল, মুদ্‌গর, গাছ, পাথর, আসিয়া তাঁহার সাধের পুরী চুরমার করিয়া দিতে লাগিল। দু-একটা তীরের খোঁচা যে না খাইলেন তাহাও নহে।  তখন তিনি তাড়াতাড়ি কাঁপিতে কাঁপিতে অসুরদের সামনে আসিয়া জোড়হাতে বলিলেন, “দোহাই বাবা, আমি ইন্দ্র নহি! আমি মুনি, ব্রাহ্মণ, অতি নিরীহ দীন হীন মানুষ! আমার উপরে তোমাদের এত ক্রোধ কেন?”  অসুরেরা বলিল, “ইন্দ্র নহ, তবে ইন্দ্র সাজিয়াছ কেন? শীঘ্র তোমার এসব সাজগোজ দুর করিয়া দাও।”  মুনি বলিলেন, “এই যে বাপু! এক্ষুণি আমি এসব দুর করিয়া দিতেছি। আমার নিতান্তই মাথা খারাপ হইয়াছিল তাই এমন বেকুবী করিতে গিয়াছিলাম। আর কখনো এমন কাজ করিব না।”  তখন আবার বিশ্বকর্মার ডাক পড়িল।  বিশ্বকর্মা আসিলে মুনি বলিলেন, “ভাই! শীঘ্র এসব দুর করিয়া আমার সেই আশ্রম আবার আনিয়া দাও, নহিলে তো অসুরের হাতে আমার প্রাণ যায় দেখিতেছি!”  বিশ্বকর্মা দেখিলেন মুনির বড়ই বিপদ, কাজেই তিনি তাঁর কথামতো কাজ করিতে আর বিলম্ব করিলেন না। দেখিতে দেখিতে সেই সোনার পুরীর জায়গায় আবার কুঁড়েঘর আর বন হইল। অসুরদেরও রাগ থামিল, মুনিরও বিপদ কাটিল বিশ্বকর্মাও হো হো শব্দে হাসিতে হাসিতে ঘরে চলিয়া গেলেন।
উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী
কুবলয়াশ্ব উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী কুবলয়াশ্ব  পূর্বকালে শত্রুজিৎ নামে অতি বিখ্যাত এক রাজা ছিলেন। তাঁহার পুত্রের নাম ঋতধ্বজ। ঋতধ্বজের গুণের কথা আর কি বলিব। যেমন রূপ, তেমনি বুদ্ধি, তেমনি বিনয়, তেমনি বল, তেমনি বিক্রম। এমন পুত্রলাভ করিয়া রাজা শত্রুজিৎ খুবই খুশি হইয়াছিলেন, তাহাতে আর সন্দেহ কি?  ইহার মধ্যে একদিন গালব নামে এক মুনি একটি সুন্দর ঘোড়া লইয়া রাজা শত্রুজিতের নিকট আসিয়া বলিলেন, “মহারাজ, আমি বিপদে পড়িয়া আপনার নিকট আসিয়াছি। একটা দুষ্ট দৈত্য আমাকে বড়ই ক্লেশ দিতেছে। সে কখনো সিংহ, কখনো বাঘ, কখনো হাতি, কখনো আর কোনো জন্তুর বেশে আসিয়া দিবারাত্র আমাকে অস্থির রাখে, উহার জ্বালায় আমার তপস্যাই অসম্ভব হইয়া উঠিয়াছে। আমি ইচ্ছা করিলে শাপ দিয়া উহাকে বধ করিতে পারি, কিন্তু তাহাতে তপস্যার হানি হয়, কাজেই আর কি করিব, শুধু নীরবে দীর্ঘনিশ্বাস ফেলি। এমন সময় একদিন এই ঘোড়াটি আকাশ হইতে আমার নিকট পড়িল, আর দৈববাণী হইল, ‘গালব! এই ঘোড়াটির নাম কুবলয়। ইহার কিছুতেই ক্লান্তি নাই, সংসারে ইহার অগম্য স্থান নাই, ইহাকে রোধ করিবার শক্তি কাহারও নাই। রাজা শত্রুজিতের পুত্র ঋতধ্বজ ইহাতে চড়িয়া তোমার শত্রু সেই দুষ্ট দানবকে বধ করিয়া কুবলয়াশ্ব নামে বিখ্যাত হইবে।’  “মহারাজ তাই আমি এই ঘোড়াটি লইয়া আপনার নিকট আসিয়াছি। আপনার পুত্র যদি ইহাতে চড়িয়া দানবটাকে তাড়াইয়া দেন, তবেই এ ব্রাহ্মণের তপস্যা হয়।”  রাজার আজ্ঞায় তখনই ঋতধ্বজ সেই আশ্চর্য ঘোড়ায় চড়িয়া মুনির সঙ্গে তাহার আশ্রমে আসিলেন। তারপর মুনিরা সকলে তাঁহাদের সন্ধ্যাবন্দনা আরম্ভ করিতে না করিতেই সেই দুষ্ট দানব শূকর সাজিয়া আসিয়া উপস্থিত হইল। মুনির শিষ্যেরা তাহাকে দেখিয়া প্রাণপণে চ্যাঁচাইতে লাগিল। রাজপুত্র তখনই সেই ঘোড়ায় চড়িয়া তাহাকে তাড়া করিলেন। তাঁহার হাতের অর্ধচন্দ্র বাণের বিষম খোঁচা খাইয়া আর কি দুষ্ট দানব সেখানে দাঁড়ায়? সে প্রাণের মায়ায় কোন পথে পলায়ন করিবে কিছুই বুঝিতে পারিল না। পাহাড়ে, বনে, শূন্যে, সাগরে, যেখানে যায়, রাজপুত্র ঘোড়ায় চড়িয়া, ধনুর্বাণ হাতে সেইখানেই গিয়া উপস্থিত হন। এইভাবে চারি হাজার ক্রোশ চলিয়া শেষে সে একটা গর্তের ভিতরে লাফাইয়া পড়িল। রাজপুত্রও তাহার সঙ্গে সঙ্গেই গর্তে গিয়া ঢুকিলেন বটে, কিন্তু সেখানকার সেই ঘোর অন্ধকারের ভিতরে আর তাহাকে দেখিতে পাইলেন না।  রাজপুত্র সেই গর্তের পথে দানবকে খুঁজিতে খুঁজিতে একেবারে পাতালে গিয়া উপস্থিত হইলেন। সেখানে আর অন্ধকার নাই, সেখানে ইন্দ্রপুরীর ন্যায় অতি অপরূপ সোনার পুরী। রাজপুত্র তাহারা ভিতরে কতই খুঁজিলেন কিন্তু দানবকে পাইলেন না। মানুষও সেখানে কেহই ছিল না। ছিল কেবল দুটি মেয়ে। তাহার একটি যে কি সুন্দর, সে আর বুঝাইবার উপায়ই নাই।  এই কন্যার নাম মদালসা, ইঁহার বৃত্তান্ত অতি আশ্চর্য। ইঁহার পিতার নাম বিশ্বাবসু, তিনি গন্ধর্বের রাজা। একদিন মদালসা তাঁহার পিতার বাগানে খেলা করিতেছিলেন, এমন সময় হঠাৎ চারদিক অন্ধকার হইয়া গেল। সে অন্ধকার আর কিছুই নহে, উহা পাতালকেতু নামক দুষ্ট দানবের মায়া। দুরাত্মা সেই অন্ধকারের ভিতর সেই অসহায় বালিকাকে লইয়া পলায়ন করিল, কেহ সে কথা জানিতে পারিল না। তাহার আর্তনাদও কেহ শুনিতে পাইল না।  তদবধি সেই দুষ্ট তাঁহাকে পাতালে আনিয়া নিজ বাড়িতে আটকাইয়া রাখিয়াছে, বলিয়াছে যে, ভালো দিন পাইলেই তাঁহাকে বিবাহ করিবে।  ইহার মধ্যে একদিন মদালসা মনের দুঃখে আত্মহত্যা করিতে যান, তখন সুরভি তাঁহার নিকটে উপস্থিত হইয়া বলেন, “বাছা, তোমার কোনো ভয় নাই, এই দুষ্ট দানব তোমাকে বিবাহ করিতে পাইবে না! ইহার মৃত্যু যাঁহার হাতে হইবে, তিনিই অবিলম্বে তোমাকে বিবাহ করিবেন।”  রাজপুত্র মদালসার সঙ্গের মেয়েটির নিকট এ সকল সংবাদ শুনিতে পাইলেন। মেয়েটির নাম কুণ্ডলা! তিনি একজন তপস্বিনী এবং মদালসার সখী। কুণ্ডলা আরো বলিলেন যে, সেদিন পাতালকেতু শূকর সাজিয়া মুনিদের আশ্রম নষ্ট করিতে গিয়াছিল, সেখান হইতে এইমাত্র এক রাজপুত্রের হাতে সাংঘাতিক বাণের খোঁচা খাইয়া আসিয়াছে।  তখন আর ঋতধ্বজের বুঝিতে বাকি রহিল না যে তিনিই সেই রাজপুত্র, আর পাতালকেতুই তাহার সেই দানব।  সে কথা শুনিয়া মেয়ে দুটির যে আনন্দ হইল!  রাজপুত্রকে দেখিয়াই মদালসার যারপরনাই ভালো লাগিয়াছিল আর সেজন্য তাঁহার মনে দুঃখও হইয়াছিল যতদূর হইতে হয়। কেননা, ইঁহাকে তো আর পাওয়ার কোনো আশাই নাই, যেহেতু সুরভি বলিয়াছেন, ‘যে দানব মারিবে, সেই মদালসাকে বিবাহ করিবে তাঁহার কথা বৃথা হইবার নহে।  যাহা হউক, এখন সে ভয় কাটিয়া গেল, সুতরাং দুঃখের জায়গায় আনন্দ হইল চতুর্গুণ! তবে আর বিলম্ব কেন? তখনই পুরোহিত তম্বুরু আসিয়া উপস্থিত হইলেন। দেখিতে দেখিতে পবিত্র আগুন জ্বলিল, ঘৃতের আহুতি পড়িল, মন্ত্রের ধ্বনি উঠিল, শুভকার্য শেষ হইল।  তারপর কুণ্ডলা আবার তপস্যা করিতে গেলেন। রাজপুত্র মদালসা সহ সেই আশ্চর্য ঘোড়ায় চড়িয়া দেশে ফিরিবার আয়োজন করিলেন। অমনি পাতাল কাঁপাইয়া ভীষণ চিৎকার উঠিল, ‘নিয়া গেল রে, নিয়া গেল! শীঘ্র আয়, শীঘ্র আয় তোরা।’  তাহার সঙ্গে সঙ্গে হাজার হাজার দানব কোথা হইতে খাঁড়া ঢাল গদা শূল হাতে আসিয়া মার, মার!’ শব্দে ঋতধ্বজকে আক্রমণ করিল।  ঋতধ্বজ তখন করিলেন কি, তাঁহার তৃণ হইতে ত্বাষ্ট্র নামক অস্ত্রখানি লইয়া, মারিলেন তাহা সেই দানবের ভেঙ্‌চির ভিড়ের উপর ছুঁড়িয়া। অমনি দানবের দল চ্যাঁচাইতে চ্যাঁচাইতে পলকের মধ্যে পুড়িয়া ছাই হইয়া গেল, রাজপুত্রও মনের সুখে মদালসাকে লইয়া দেশে চলিয়া আসিলেন। তখন সেখানে না জানি কেমন বাজি, বাদ্য আর ভোজের ঘটা হইল! না জানি সকলে কতদিন ধরিয়া কত কি খাইল!  ইহার পর হইতে ঋতধ্বজের নাম হইল কুবলয়াশ্ব। এখন তিনি রাজার আজ্ঞায় প্রতিদিনই সেই ঘোড়ায় চড়িয়া মুনিদের আশ্রম হইতে দানব তাড়াইয়া বেড়ান। ইহাদের মধ্যে হইয়াছে কি, সেই পাতালকেতুর ভাই ছিল তালকেতু, সে বেটা দিব্য একটি শুদ্ধ শান্ত মুনি সাজিয়া, যমুনার ধারে আশ্রম করিয়া চোখ বুজিয়া বসািয় থাকে, যেন সে ভারি একটা তপস্বী!  কুবলয়াশ্ব ঘোড়ায় চড়িয়া সেই পথে যাইতেছেন, এমন সময় সে চোখ মিট্‌ মিট্‌ করিতে করিতে আসিয়া তাঁহাকে বলিল, “রাজপুত্র! আমার একটা যজ্ঞ করিতে ইচ্ছা হইয়াছে, কিন্তু দক্ষিণা দিবার পয়সা নাই। আপনি যদি দয়া করিয়া আপনার গলার ঐ হারখানি আমাকে দেন, তবে আমার সাধ পূর্ণ হয়।”  রাজপুত্র তৎক্ষণাৎ গলার হার তাহাকে দিলেন। তখন সে আবার বলিল, “আপনার জয় হোক! এখন তবে আর একটি কাজ যদি করেন, আমি জলের ভিতরে থাকিয়া বরুণের স্তব করিতে যাইব, ততক্ষণ আমার আশ্রমটির উপর একটু চোখ রাখিবেন।”  রাজপুত্র তাহাতেই সম্মত হইলেন। তালকেতুও চলিয়া গেল। কিন্তু সে তো তপস্যা করিতে গেল না, সে সোজাসুজি কুবলয়াশ্বের বাড়িতে গিয়া কাঁদিতে কাঁদিতে বলিল, “হায়, হায়! ওগো! সর্বনাশ হইয়াছে! রাজপুত্রকে দানবে মারিয়াছে। মৃত্যুর সময়ে তিনি এই হার আমার হাতে দিয়া বাড়িতে সংবাদ দিতে বলিয়াছেন!”  কুবলয়াশ্বের হার দেখিয়া আর কাহারও এ কথায় অবিশ্বাস করিবার উপায় রহিল না। তখন দেশময় হাহাকার পড়িয়া গেল; সে দারুণ সংবাদ সহিতে না পারিয়া মদালসা প্রাণত্যাগ করিলেন।  ততক্ষণে সেই দুষ্ট তালকেতু আশ্রমে ফিরিয়া আসিয়া হাসিতে হাসিতে কুবলয়াশ্বকে বলিল, “আহা! আপনি আমার বড়ই উপকার করিলেন। আপনি এখানে থাকায় আমি প্রাণ ভরিয়া যজ্ঞ করিয়াছি! এখন তবে আপনি ঘরে ফিরিয়া যাউন।”  এ কথায় রাজপুত্র তথা হইতে চলিয়া আসিলে, দুষ্ট ঘরে বসিয়া হো হো শব্দে হাসিতে লাগিল।  কুবলয়াশ্ব সেই মুনিবেশধারী দুষ্ট দানবের আশ্রম হইতে ফিরিয়া আসিলে সকলে কিরূপ আশ্চর্য আর আহ্লাদিত হইল, তাহা বুঝিতেই পার। কিন্তু মদালসার মৃত্যুর কথা শুনিয়া কুবলয়াশ্বের প্রাণে বড়ই কষ্ট হইল। তিনি সেই দুঃখ ভুলিবার জন্য বন্ধুদিগের সহিত মিশিয়া নানারূপ আমোদ-প্রমোদে দিন কাটাইতে লাগিলেন।  এই সময়ে নাগরাজ অশ্বতরের দুইটি পুত্র ব্রাহ্মণের বেশে তাঁহার সঙ্গে আমোদ-প্রমোদ করিতে আসিতেন! ইঁহাদের কথাবার্তা তাহার বড় ভালো লাগিত। এইরূপে তাঁহাদের সহিত কুবলাশ্বের এমনি বন্ধুত্ব হইয়া গেল যে পরস্পরকে ছাড়িয়া থাকিতে আর তাঁহাদের কিছুতেই ভালো লাগিত না। নাগপুত্রেরা সমস্ত দিন কুবলয়াশ্বের নিকটে কাটাইয়া রাত্রে গৃহে যাইতে বড়ই কষ্ট বোধ করিতেন, আর কোনোপ্রকারে রাত্রিটি কাটাইয়া প্রভাত হইবামাত্রই পুনরায় কুবলয়াশ্বের নিকট চলিয়া আসিতেন।  একদিন নাগরাজ অশ্বতর তাঁহাদিগকে জিজ্ঞাসা করিলেন, “বাবা, এখন তো আর তোমাদিগকে দিনের বেলায় পাতালে দেখিতে পাইনা, রাত্রিটি কোনোমতে এখানে কাটাইয়া, প্রভাত হইতেই তোমার পৃথিবীতে চলিয়া যাও। ঐ স্থানটার প্রতি তোমাদের এত অনুরাগ কেমন করিয়া হইল?”  নাগপুত্রেরা বলিলেন, “বাবা, আমরা মহারাজ শত্রুজিতের পুত্র ঋতধ্বজকে বড়ই ভালোবাসি; তাঁহাকে না দেখিয়া থাকিতে আমাদের নিতান্ত কষ্ট হয়। তাই প্রভাতে উঠিয়া প্রত্যহ তাঁহার নিকট চলিয়া যাই। বাবা, এমন সুন্দর, এমন সরল, এমন ধার্মিক, এমন মিষ্টভাষী লোক আর এ জগতে নাই!”  এ কথায় নাগরাজ বলিলেন, “বাছা, এমন মহৎ লোকের সহিত তোমাদের বন্ধুত্ব হইয়াছে, আর তাঁহার নিকটে তোমরা এত সুখ পাইতেছ, তোমরা তাঁহার সুখের জন্য কি কিছু করিয়াছ?”  নাগপুত্রেরা বলিলেন, “বাবা, তাঁহার তো কোনো বস্তুরই অভাব নাই এমন মহৎ লোকের যোগ্য কি আছে, যাহা দ্বারা তাঁহাকে সুখী করিতে পারি? তাঁহার কোনো কষ্ট দূর করিতে পারিলে আমরা নিশ্চয় করিতাম। তাঁহার স্ত্রী মদালসার মৃত্যুই তাহার একমাত্র কষ্টের কারণ। সেই মদালসাকে আমরা কোথা হইতে আনিয়া দিব?”  কিন্তু, এ কাজটি যতই কঠিন হউক না কেন, ইহা যে একেবারেই অসাধ্য, নাগরাজ তাহা মনে করিলেন না। তিনি অবিলম্বে হিমালয় পর্বতের প্লক্ষাবতরণ নামক তীর্থে গিয়া কঠোর তপস্যা আরম্ভ করিলেন। সে তপস্যা এমনই চমৎকার হইয়াছিল, আর তখন যে নাগরাজ সরস্বতীর স্তব করিয়াছিলেন, তাহা সরস্বতীর এত ভালো লাগিয়াছিল যে, তিনি আর সেখানে না আসিয়া থাকিতে পারিলেন না!  সরস্বতী আসিয়া বলিলেন, “হে অশ্বতর! আমি তোমাকে বর দান করিব;বল তোমার কি লইতে ইচ্ছা হয়।”  অশ্বতর অমনি করজোড়ে বলিলেন, “মা, যদি কৃপা হইয়া থাকে, তবে আমাকে আর আমার ভাই কম্বলকে সংগীতে অসাধারণ পণ্ডিত করিয়া দিন!”  একথায় সরস্বতী ‘তথাস্তু’ বলিয়া সেখান হইতে চলিয়া গেলে অশ্বতর আর কম্বল দুভাই তৎক্ষণাৎ সংগীত শক্তি লাভ করত অপরূপ তান লয় সহকারে বীণা বাজাইয়া মহাদেবের স্তবগান আরম্ভ করিলেন। অনেকদিন এইরূপ সংগীত আর স্তবের পর, মহাদেবকেও তুষ্ট হইয়া তাঁহাদিগকে বর দিতে আসিতে হইল। তখন দুই ভাই তাঁহার পদতলে পড়িয়া এই বর প্রার্থনা করিলেন, “কুবলয়াশ্বের স্ত্রী মদালসা যেমন বয়সে, যেমন বেশে, যেমন শরীরে প্রাণত্যাগ করিয়াছিলেন, অবিকল সেই মূর্তিতে, পূর্বজন্মের সকল কথা স্মরণে রাখিয়া, পুনরায় অশ্বতরের গৃহে জন্মলাভ করুন।”  মহাদেব কহিলেন, “তাহাই হউক। অশ্বতর শ্রাদ্ধ করিতে বসিলে তাঁহার মধ্যম ফণা হইতে মদালসা অবিকল তাঁহার পূর্বের শরীর লইয়া বাহির হইবেন।”  কি আনন্দের কথা হইল! ইহার পর দুই ভাই পাতালে চলিয়া আসিতে আর তিলমাত্রও বিলম্ব করিলেন না। সেখানে আসিয়া অশ্বতর একটি নির্জন স্থানে চুপিচুপি শ্রাদ্ধ করিতে আরম্ভ করিলে, মহাদেবের কথামতো মদালসা, তাঁহার মধ্যম ফণা হইতে বাহির হইয়া আসিলেন। অবিকল সেই মদালসা কিছুমাত্র প্রভেদ নাই, যেন দুদিনের জন্য কুবলয়াশ্বের নিকট হইতে পাতালে বেড়াইতে আসিয়াছেন। এ ব্যাপারে কেবল অশ্বতরই উপস্থিত ছিলেন, আর কেহ ইহা দেখিলও না, এ বিষয়ে কোনো কথা জানিতেও পারিল না।  তখন নাগরাজ কয়েকটি বুদ্ধিমতী, মিষ্টভাষিণী সখী সঙ্গে দিয়া মদালসাকে একটি সুন্দর ঘরে লুকাইয়া রাখিলেন।  তারপর সন্ধ্যাকালে নাগপুত্রেরা দুভাই কুবলয়াশ্বের নিকট হইতে ঘরে ফিরিয়া আসিলেন। তাঁহারাও অবশ্য এ ব্যাপারের কিছুই জানেন না। নাগরাজ অন্যান্য দিনের ন্যায় সেদিনও তাঁহাদের সহিত কথাবার্তা আরম্ভ করিয়া কহিলেন, “বৎসগণ, সেই রাজপুত্রকে একদিন আমার নিকট আনিলে না?”  এ কথায় কুবলয়াশ্ব সম্মত হইলে তিনজনে মিলিয়া তখনই পাতালে যাত্রা করিলেন। কুবলয়াশ্ব কিন্তু জানেন না যে তাহাকে পাতালে যাইতে হইবে বা তাঁহার বন্ধুগণ নাগপুত্র। তিনি জানেন, উঁহারা ব্রাহ্মণকুমার। গোমতী নদীতে আসিয়া নাগপুত্রেরা তাহার জলে নামিতে গেলেন; কুবলয়াশ্ব ভাবিলেন, গোমতীর পরপারে ব্রাহ্মণকুমারদের বাড়ি। এমন সময় নাগপুত্রেরা হঠাৎ তাঁহাকে লইয়া পাতালে প্রবেশ করিলেন। ইহাতে কুবলয়াশ্ব ভয় পাইলেন না, কেননা, সে স্থান তাঁহার দেখিতে বাকি নাই। যাহা হউক, সেবারে তিনি দানবের বাড়িই দেখিয়াছিলেন, এবারে সাপের দেশটিও তাঁহার নিকট যারপরনাই আশ্চর্য এবং সুন্দর বোধ হইল। তাঁহার বন্ধুদ্বয়ও ততক্ষণে ব্রাহ্মণের বেশ ছাড়িয়া নিজের রূপ ধারণ করিয়াছেন। সে রূপ যে ঠিক কি প্রকার, তাহা আমি বলিতে পারি না। সে-সকল সাপের ফণার কথা লেখা আছে স্বস্তিক চিহ্ন[১] এবং মণিরও উল্লেখ দেখা যায়। অথচ মানুষের মতো তাহাদের হাত পা, বেশভুষা, কানে কুণ্ডল, গলায় হার!  যাহা হউক, নাগপুত্রেরা কুবলয়াশ্বকে অবিলম্বেই তাঁহাদের পিতার নিকট নিয়া উপস্থিত করিলেন, সেখানে সেরূপ অবস্থায় যেমন কথাবার্তা, প্রণাম, আশীর্বাদাদির প্রথা আছে, সকলই হইয়া গেল। এত পথ চলিয়া আসাতে সকলই ক্লান্ত, সুতরাং অতঃপর স্নানাহারপূর্বক সুস্থ হওয়া প্রথম কাজ!  আহারান্তে বিশ্রামের পর, নাগরাজ আর কুবলয়াশ্বের অনেক কথাবার্তা হইল।  শেষে নাগরাজ বলিলেন, “বাছা, তুমি আমার পুত্রগণের বন্ধু, সুতরাং আমার পুত্রেরই তুল্য। আমারও তোমার প্রতি অতিশয় স্নেহ হইয়াছে। আমার বড় ইচ্ছা হয় যে, আমার পুত্রেরা যেমন আমার নিকট যাহা ইচ্ছা চাহিয়া লয়, তুমিও সেইরূপ কিছু চাহিয়া লও।”  কুবলয়াশ্ব বলিলেন, “আপনার আশীর্বাদে আমার কোনো বস্তুরই অভাব নাই, সুতরাং আমি কি চাহিব? আমি যে আপনাকে দেখিলাম, আপনার পায়ের ধূলা পাইলাম, ইহার উপর আর আমার কিছুই চাহিবার নাই।”  অশ্বতর কহিলেন, “বাবা, তোমার মনে কি কোনো কষ্ট আছে? তাহার কথাই না হয় আমাকে বল, আমি সাধ্য মতো তাহা নিবারণের চেষ্টা করিব।”  এ কথায় নাগপুত্রেরা বলিলেন, “মদালসার মৃত্যুতে ইঁহার বড়ই কষ্ট হইয়াছে, কিন্তু তাহা তো আর দূর হইবার নহে!”  অশ্বতর বলিলেন, “অবশ্য মরা মানুষকে আর কি করিয়া বাঁচানো যাইবে? তবে মন্ত্রবলে তাহারও মায়ামূর্তি আনিয়া দেখাইতে পারি।”  ইহা শুনিয়া কুবলয়াশ্ব নিতান্ত ব্যস্তভাবে বলিলেন, “যদি তাহা সম্ভব হয়, তবে দয়া করিয়া একবার তাহাই দেখান।”  অশ্বতর বলিলেন, “এই কথা? আচ্ছা, তবে দেখাইতেছি। কিন্তু মনে রাখিও, ইহা মায়া!”  তারপর অশ্বতর খুব গম্ভীরভাবে বসিয়া বিড়বিড় করিতে লাগিলেন, যেন কতই মন্ত্রতন্ত্র আওড়াইতেছেন। ততক্ষণে তাহার ইঙ্গিত অনুসারে মদালসাকে সেখানে আনিয়া উপস্থিত করা হইল। সকলে ভাবিল, মন্ত্রের কি জোর! কুবলয়াশ্বও জানেন, উহা মন্ত্রেরই কাজ, মায়ার মূর্তি। তথাপি তাঁহার এত আনন্দ হইল যে তাহা আর বলিয়া শেষ করা যায় না।  তারপর যখন অশ্বতর বলিলেন যে, উহা মায়া নহে বাস্তবিকই মদালসা, তখন না জানি ব্যাপারখানা কিরূপ হইয়াছিল!  কুবলয়াশ্ব পাতালেই মদালসাকে পাইয়াছিলেন, এখন সেই পাতালেই তাহাকে আবার পাইয়া মহানন্দে তাহাকে লইয়া গৃহে ফিরিলেন। সেখানে অবশ্য ইহা লইয়া খুবই আনন্দ আর উৎসবাদি হইল। — [১. সাপের ফণায় যে চক্র থাকে।]
উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী
কৃষ্ণের কথা উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী কৃষ্ণের কথা  পূতনা বলিয়া একটা বড়ই ভীষণ রাক্ষসী কংসের রাজ্যে বাস করত। ছোট ছোট ছেলেদিগকে কৌশলে বধ করাই ছিল ইহার ব্যবসায়। রাত্রিকালে কোনো খোকাখুকি এই হতভাগিনীর দুধ পান করিলে আর তাহাদের রক্ষা ছিল না। সে সব খোকাখুকির দেহ তখনই চূর্ণ হইয়া যাইত।  যখন জানা গেল যে কংসকে মারিবার লোকের জন্ম হইয়াছে। অমনি সে দুষ্ট এই পূতনাকে ডাকিয়া বলিল যে যত ষণ্ডা-ষণ্ডা খোকা দেখিবে, সকলকেই বধ করিতে হইবে। তদবধি সেই হতভাগিনী কেবলই লোকের ছোট ছোট খোকা মারিয়া বেড়ায়। এমনি করিয়া কত খোকার প্রাণ যে সে হরণ করিল, তাহার সংখ্যা নাই।  নন্দের একটি খোকা হইয়াছে শুনিয়া, এই রাক্ষসী একদিন গোকুলে আসিয়া উপস্থিত হইল। তখন কিন্তু তাহার রাক্ষসী মূর্তি ছিল না। সে এমনি সুন্দর একটি মেয়ে সাজিয়া, এমনি সুন্দর বেশভূষা করিয়া, এমনি মিষ্ট হাসি হাসিয়া আসিয়াছিল যে তাহাকে দেখিয়া সকলে ভাবিল, নিশ্চয় স্বয়ং লক্ষ্মী গোকুলে আসিয়াছেন। সে যেদিকে যায়, সকলে তাহাকে পথ ছাড়িয়া দিয়া জড়সড়ভাবে সরিয়া দাঁড়ায়। দুষ্ট রাক্ষসী ধীরে ধীরে সূতিকা ঘরে ঢুকিল, কেহই তাহাকে নিষেধ করিল না। সে ঘরে যশোদা ছিলেন, বলরামের মা রোহিণীও ছিলেন, তাঁহারা তাহাকে দেখিয়া অবাক হইয়া চাহিয়া রহিলেন।  রাক্ষসী এক পা দু পা করিয়া আসিয়া বিছানার পাশে বসিল ও হাসিতে হাসিতে যেন কতই আদরে, খোকাটিকে কোলে তুলিয়া দুধ খাওয়াইতে লাগিল। যশোদাও কিছু বলিলেন না, রোহিণীও কিছু বলিলেন না, রাক্ষসীর মায়ায় তাঁহারা ভুলিয়া গিয়াছিলেন।  কিন্তু খোকা সে মায়ায় ভোলে নাই। যিনি স্বয়ং বিষ্ণু, রাক্ষসীর মায়া তাঁহার কাছে খাটিবে কেন! রাক্ষসী হাসিতে হাসিতে খোকাকে দুধ খাইতে দিল, খোকা সেই দুধের সঙ্গে অভাগীর প্রাণ অবধি চুষিয়া লইল। তখন সে রাক্ষসী চ্যাঁচাইয়া ছিল, তেমন চীৎকার আর গোকুলের কেহ কোনোদিন শুনে নাই। তাহারা সকলি ভয়ে কাঁপিতে কাঁপিতে তখনই ঊর্ধ্বশ্বাসে ছুটিয়া আসিয়া দেখিল কি ভীষণ ব্যাপার। বিকট রাক্ষসী মৃত্যু যন্ত্রণায় ছট্‌ফট্‌ করিতেছে, তিন গব্যুতি (ছয় ক্রোশ) পরিমিত স্থানের গাছপালা তাহার দেহের চাপনে চূর্ণ হইয়া গিয়াছে। রাক্ষসীর এক একটা দাঁত যেন একেকটি লাঙ্গলের ফাল, নাকের ছিদ্র যেন পর্বতের গুহা চোখদুটা যেন দুটা কুয়া। সেই রাক্ষসীর বুকের উপর শুইয়া খোকা আনন্দে হাত পা ছুঁড়িতেছে। তখনই সকলে খোকাকে কোলে তুলিয়া লইল। আর ক্রমাগত ষাট্‌ ষাট‌্ বলিতে বলিতে কত দেবতার নাম যে করিল তাহার অন্তই নাই।  উহারা যদি জানিত যে সেই খোকাটাই রাক্ষসীটাকে মারিয়াছে, তবে না জানি কত আশ্চর্য হইত।  আর একদিন খোকাকে একটা গাড়ির নীচে, একটি ছোট্ট খাটে শোয়াইয়া রাখা হইয়াছিল। বোধহয় এইভাবে তাহাকে প্রায়ই শোয়াইয়া রাখা হইত। সেদিন বাড়িতে কিসের উৎসব ছিল, সকলে তাহাতেই মত্ত, খোকার কথা আর কাহারও মনে নাই; খোকার কিন্তু এদিকে বড়ই ক্ষুধা হইয়াছে, তাহার দরুন সে পা ছুঁড়িয়া কাঁদিতে আরম্ভ করিয়াছে। পা ছুঁড়িতে ছুঁড়িতে একবার তাহার লাথি লাগিয়া, হাঁড়ি কলসীতে বোঝাই সেই প্রকাণ্ড গাড়িখানা উলটিয়া গেল। সে সব হাঁড়ি কলসী তখনই খান্‌ খান্‌ হইয়া ভাঙ্গিয়া গেল। আর শব্দও অবশ্য যেমন তেমন হইল না। তাহা শুনিয়া সকলে ছুটিয়া আসিয়া দেখিল যে খোকা চিৎ হইয়া শুইয়া পা ছুঁড়িতেছে। তাহার পাশে গাড়িখানা উলটান, আর হাঁড়ি কলসী চুর্ণ হইয়া তুমুল কাণ্ড উপস্থিত। এত বড় গাড়ি কি করিয়া উলটিল, এ কথা সকলেই তখন ব্যস্তভাবে জিজ্ঞাসা করিতে লাগিল। সেখানে আর কয়েকটি বালক ছিল, তাহারা খোকাকে দেখাইয়া বলিল, “এই খোকা পা ছুঁড়িতে ছুঁড়িতে গাড়ি উলটাইয়া ফেলিয়াছে আমরা দেখিয়াছি।” শুনিয়া সকলে হাঁ করিয়া একবার খোকার দিকে একবার গাড়িখানার দিকে তাকাইতে লাগিল।  খোকাটি একটু বড় হইলে তাহার ‘কৃষ্ণ’ নাম রাখা হইল। রোহিণীর খোকার নাম যে বলরাম’ তাহাও এই সময়ে রাখা হয়। কি দুরন্ত দুটি খোকাই তাহারা ছিল।  যখন কৃষ্ণ আর বলরাম একসঙ্গে হামাগুড়ি দিয়া বেড়াইতে শিখিলেন, তখন হইতে আর এক মুহূর্তের জন্যেও কাহারও নিশ্চিন্ত থাকিবার জো রহিল না। ছাই আর গোবর দেখিলেই দুটি খোকা অমনি তাহা লইয়া গায়ে মাখাইবে, যশোদার সাধ্য কি যে তাহাদিগকে বারণ করেন। একটু চোখের আড়াল হইলেই তাহারা গোয়াল ঘরে ঢুকিয়া ছোট ছোট বাছুরগুলির লেজ ধরিয়া টানাটানি আরম্ভ করিত। ইহাদের পিছুপিছু ছুটাছুটি করিয়া যশোদা নাকালের একশেষ হইতে লাগিলেন। শেষে একদিন তিনি আর কিছুতেই ইহাদিগকে সামলাইতে না পারিয়া, রাগের ভরে বকিতে বকিতে লাঠি হাতে কৃষ্ণকে তাড়া করিলেন। তারপর তাঁহাকে ধরিয়া মোটা দড়ি দিয়া একটা উদূখলের সঙ্গে বাঁধিয়া বলিলেন, “পালা দেখি এখন!”  এই বলিয়া যশোদা নিশ্চিন্ত মনে ঘরের কাজে গিয়াছেন, আর কৃষ্ণও অমনি সেই উদূখল টানিয়া উঠান পাড়ি দিতে আরম্ভ করিয়াছেন। উদূখল টানিতে টানিতে তিনি দুটি অর্জুন গাছের মধ্য দিয়া চলিয়া গেলেন। কিন্তু গাছ দুটি খুব কাছাকাছি থাকায় উদূখলটি সেখান দিয়া গলিতে না পারিয়া আটকাইয়া গেল। তখন কৃষ্ণের টানাটানিতে সেই প্রকাণ্ড গাছ দুটি মহাশব্দে ভাঙ্গিয়া পড়ায় সকলে ভাবিল না জানি কি হইয়াছে। তাহারা নিতান্ত ব্যস্তভাবে ছুটিয়া আসিয়া দেখিল যে খোকা দুইগাছের মাঝখানে বসিয়া, তাহার ছোট ছোট দাঁতকটি বাহির করিয়া হাসিয়া অস্থির, তাহার পেটের সঙ্গে দড়ি দিয়া উদূখল বাধা। সেই হইতে কৃষ্ণের একটি নাম হইল দামোদর, কিনা ‘পেটে দড়ি’ (দাম—দড়ি, উদর—পেট)। যা হোক, সে প্রকাণ্ড গাছ ভাঙ্গা যে সেই খোকার কাজ এ কথা কেহ বুঝিতে পারিল না। বুড়ারা বলিল, “এখানে বড়ই উৎপাত আরম্ভ হইয়াছে দেখিতেছি; গাড়ি উলটিয়া যায়, বিনা ঝড়ে গাছ ভাঙ্গিয়া পড়ে। এখানে আর থাকা উচিত নয়; চল আমরা বৃন্দাবনে চলিয়া যাই।” এই বলিয়া তখনই সকলে গোকুল ছাড়িয়া বৃন্দাবনে চলিয়া গেল।
উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী
গঙ্গা আনিবার কথা উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী গঙ্গা আনিবার কথা  অগস্ত্য মুনি সাগরের জল খাইয়া ফেলিয়াছিলেন, এ কথা তোমরা শুনিয়াছ। সেই সাগর অনেকদিন শুকনোই পড়িয়াছিল;তারপর যে কেমন করিয়া তাহাতে জল আসিল, সে অতি আশ্চর্য ব্যাপার।  অযোধ্যায় এক রাজা ছিলেন; তাহার নাম ছিল সগর। রাজার বড় রানীর একটি ছেলে ছিল, তাহার নাম অসমঞ্জ। তাঁহার ছোট রানীর ষাট হাজার ছেলে ছিল, তাহাদের নাম জানি না।  অসমঞ্জ এমনি দুষ্ট ছিল যে ছোট ছোট ছেলেদিগকে ধরিয়া সে জলে ফেলিয়া দিত আর তাহারা খাবি খাইয়া মরিবার সময় হাসিত। কাজেই রাজা বিরক্ত হইয়া তাহাকে তাড়াইয়া দিলেন। যা হোক, অসমঞ্জের পুত্র অংশুমান বড় ভালো ছেলে ছিল; রাজা যত্নের সহিত তাহাকে মানুষ করিলেন।  ইহার অনেক বৎসর পরে একবার রাজা খুব ধুমধামের সহিত অশ্বমেধ যজ্ঞের আয়োজন করিলেন। ঘোড়ার কপালে জয়পত্র বাঁধিয়া তাহাকে ছাড়িয়া দিতে হয়; সেই ঘোড়া সমস্ত পৃথিবী ঘুরিয়া, ফিরিয়া আসিলে তাহার মাংসে যজ্ঞ হয়, সেই যজ্ঞের নাম অশ্বমেধ। জয়পত্রের মানে এই যে, তাহাতে লেখা থাকে, “খবরদার! এ ঘোড়া কেহ আটকাইয়ো না!” সে কথা যে পড়ে, সেই চটে, আর গায়ে জোর থাকিলে তখনি ঘোড়া আটকায়। কাজেই ঘোড়াকে ছাড়াইয়া আনিবার জন্য তাহার সঙ্গে খুব মজবুত লোক দিতে হয়।  সগর অংশুমানকে সঙ্গে দিয়া তাঁহার জয়পত্র বাঁধা যজ্ঞের ঘোড়াটি ছাড়িয়া দিয়াছেন; সে ঘোড়া সেই জয়পত্রসুদ্ধ পড়বি তো পড় স্বয়ং দেবরাজ ইন্দ্রের সামনেই গিয়া পড়িয়াছে আর ইন্দ্রও অমনি এক রাক্ষসের বেশ ধরিয়া তাহাকে চুরি করিয়া বসিয়াছেন।  এখন উপায় কি হইবে? ঘোড়া না পাইলে তো যজ্ঞই মাটি, আর তাহা হইলে নিতান্তই বিপদের কথা। রাজার ষাট হাজার ছেলে তখনই ব্যস্ত হইয়া ঘোড়া খুঁজিতে ছুটিল। শহর বন্দর, পাহাড় পর্বত, বন মাঠ কিছুই তাহারা বাকি রাখিল না। তাহাতেও ঘোড়ার দেখা না পাইয়া ষাট হাজার ভাই ষাট হাজার খস্তা হাতে মাটি খুঁড়িতে আরম্ভ করিল। তাহাতেও ঘোড়া না পাইয়া রাজাকে আসিয়া বলিল, “বাবা, ঘোড়া তো পাওয়া গেল না, এখন কি করি?” রাজা বলিলেন, “আবার খুঁজিয়া দেখ; ঘোড়া না লইয়া ফিরিয়ো না!”  কাজেই বেচারারা আর কি করে, তাহারা আবার প্রাণপণে মাটি খুঁড়িতে লাগিল। খুঁড়িতে খুঁড়িতে পূর্বদিকে গিয়া তাহারা দেখিল যে পর্বতের মতো বিশাল হাতি পৃথিবীটাকে মাথায় করিয়া দাঁড়াইয়া আছে। সেই হাতির নাম বিরূপাক্ষ; যখন ঘাড় নাড়ে, তখনই ভূমিকম্প হয়। যাহা হউক, বিরূপাক্ষের কাছে সেই ঘোড়া ছিল না, কাজেই রাজপুত্রেরা সেখান হইতে আবার দক্ষিণদিকে খুঁড়িয়া চলিল;খুঁড়িতে খুঁড়িতে দেখিল সেদিকেও মহাপক্ষ নামে তেমনি বিশাল এক হাতি পৃথিবীটাকে মাথায় বহিতেছে। এমনি করিয়া তাহারা পশ্চিমে সৌমনাং আর উত্তরে ভদ্র নামে আরো দুটা হাতি পাইল, কিন্তু ঘোড়াকে পাইল না। কেমন করিয়া পাইবে? সে ঘোড়া পূর্ব, পশ্চিম, উত্তর, দক্ষিণ কোনো দিকেই ছিল না, ছিল ঈশান কোণে। সেইখানে যাইবামাত্র রাজপুত্রেরা দেখিল যে, কপিল মুনি সেখানে বসিয়া আছেন, ঘোড়াটি তাঁহার কাছে পাইচারি করিতেছে।  কপিলকে দেখিয়াই রাজপুত্রেরা ভাবিল, ‘এই চোর!’ অমনি তাহারা ষাট হাজার ভাই মিলিয়া খস্তা, লাঙ্গল, গাছ, পাথর হাতে তাঁহার দিকে ছুটিতে ছুটিতে বলিল, ‘বটে রে দুষ্ট, তুই আমাদের ঘোড়া চুরি করিয়াছিস? দাঁড়া! এই আমরা যাইতেছি।’  তখন কপিল ভয়ংকর রাগের সহিত এমনি এক হুংকার ছড়িলেন যে, সে হুংকারেই সেই ষাট হাজার রাজপুত্র পুড়িয়া ছাই হইয়া গেল।  এদিকে রাজা পথ চাহিয়া বসিয়া আছে, তাঁহার পুত্রেরা ঘোড়া লইয়া আসিবে, তবে যজ্ঞ শেষ হইবে। কিন্তু রাজপুত্রেরা আর ফিরিল না। তখন তিনি আবার অংশুমানকে ডাকিয়া ঘোড়া খুঁজিতে পাঠাইলেন। এবারে অংশুমানের কাজ অনেকটা সহজ, কারণ তাহার খুড়ারা ইহার আগেই পাতালে যাইবার পথ প্রস্তুত করিয়া রাখিয়াছে। সেই পথে চলিতে চলিতে কিছুদিন পরে সেই ভয়ংকর হাতির সহিত তাঁহার দেখা হইল। অংশুমান তাহাকে নমস্কার করিয়া বলিলেন, “হাতি মহাশয়, আপনার মঙ্গল তো? আমি অসমঞ্জের পুত্র অংশুমান, আমার খুড়াদিগকে খুঁজিতে আসিয়াছি। আপনি কি তাঁহাদের বা আমাদের ঘোড়াটির কোনো সংবাদ রাখেন?” হাতি বলিল, “হা ঁবাপু, এই পথে যাও, ঘোড়া পাইবে।”  এমনি করিয়া ক্রমে সেই চারিটা হাতির প্রত্যেকের সঙ্গেই অংশুমানের দেখা হইল। তাহার সকলেই বলিল, “যাও বাপু, তুমি ঘোড়া পাইবে।” তারপর আর কিছুদূর গিয়াই তিনি দেখিলেন, তাঁহার খুড়াদের দেহের ছাই পড়িয়া রহিয়াছে, আর তাহার কাছেই সেই ঘোড়াটাও ঘুরিয়া বেড়াইতেছে। খুড়াদের এই দুর্দশার কথা ভাবিয়া অংশুমানের মনে বড়ই কষ্ট হইল; কিন্তু এখন তো আর দুঃখ করিয়া ফল নাই, এখন ইহাদের তর্পণ করিতে পারিলে তবেই ইঁহাদের স্বর্গ লাভ হয়। তর্পণের জন্য অংশুমান জল খুঁজিতে লাগিলেন, কিন্তু কোথাও একটু জল পাওয়া গেল না।  জল খুঁজিতে খুঁজিতে গরুড় পক্ষীর সহিত অংশুমানের দেখা হইল। সেই পাখি ছিল অংশুমানের খুড়াদিগের মামা। সে অংশুমানকে বলিল, “ভাই, তোমার খুড়াদিগের তর্পণের কাজ যে-সে জলে হইবে না। কপিলের তেজে তাহারা ভস্ম হইয়াছে গঙ্গার জল ছাড়া ইহাদের তর্পণ তো হইবার নয়। তুমি এখন ঘোড়াটি নিয়া দেশে যাও, তোমার পিতামহের যজ্ঞ সমাপন হউক।”  সুতরাং অংশুমান অগত্যা ঘোড়া লইয়া দেশে ফিরিলেন। পুত্রগণের দুর্দশার সংবাদে নিতান্ত দুঃখিত হইয়া সগর যজ্ঞ শেষ করিলেন, কিন্তু গঙ্গার জল দিয়া পুত্রগণের তর্পণের কোনো উপায় তিনি করিতে পারিলেন না। গঙ্গা তো তখন পৃথিবীতে ছিলেন না, তিনি থাকতেন স্বর্গে। সগর আরো ত্রিশ হাজার বৎসর রাজত্ব করিয়াছিলেন, এই ত্রিশ হাজার বৎসরের মধ্যে তিনি গঙ্গাকে আনিতেও পারেন নাই, তাঁহার পুত্রগণের উদ্ধারও হয় নাই।  সগর গঙ্গা আনিতে পারেন নাই। অংশুমানও পারেন নাই। অংশুমানের পুত্র দিলীপ খুবই বড় রাজা ছিলেন, কিন্তু তিনিও গঙ্গা আনিতে পারেন নাই।  দিলীপের পরে রাজা হইলেন তাঁহার পুত্র ভগীরথ। তিনি যেমন ধার্মিক ছিলেন, তপস্যাও করিয়াছিলেন তেমনি আশ্চর্য। চারিদিকে আগুন জ্বালিয়া, তাহার মাঝখানে বসিয়া তিনি হাত তুলিয়া তপস্যা করিয়াছিলেন। হাজার বৎসরের মধ্যে আর সে হত নামান নাই, এই সময়ের মধ্যে মাসে শুধু একটিবারের বেশি খানও নাই।  হাজার বৎসর এমনিভাবে চলিয়া গেল। তাহার পরে ব্রহ্মা দেবতাগণকে সঙ্গে করিয়া আসিয়া বলিলেন, “ভগীরথ। আমি তোমার তপস্যায় বড়ই তুষ্ট হইয়াছ। তুমি কি চাহ?”  ভগীরথ ভক্তিভরে তাঁহাকে প্রণাম করিয়া, জোড়হাতে বলিলেন, “প্রভু! যদি তুষ্ট হইয়া থাকেন, তবে দয়া করিয়া আমাকে গঙ্গা আনিবার উপায় করিয়া দিন।”  ব্রহ্মা বলিলেন, “আচ্ছা বাপু, আমি তাহাই করিয়া দিতেছি। এই যে আমাদের সঙ্গে এই দেবতাটি দেখিতেছ, ইনিই গঙ্গা, হিমালয়ের জ্যেষ্ঠা কন্যা। ইনি তোমার কাজ করিতে পৃথিবীতে যাইবেন। কিন্তু এক কথা—ইনি স্বর্গ হইতে পৃথিবীতে লাফাইয়া পড়েন, তবে পৃথিবী তো তাহার চোট সামলাইতে পারিবে না। সে ভয়ংকর চোট খালি একজনে সহিতে পারেন, তিনি হচ্ছেন শিব। সুতরাং তুমি আগে গিয়া শিবকে সেই কাজটি করিতে রাজি করাও, তবেই গঙ্গা পৃথিবীতে নামিতে পারেন।”  তখন ভগীরথ কেবলমাত্র পায়ের বুড়া আঙ্গুলের উপর দাঁড়াইয়া এক বৎসর ধরিয়া ক্রমাগত শিবের স্তব করিলেন। সে স্তব শুনিয়া আর মহাদেব না আসিয়া থাকিতে পারিলেন না। আসিয়াই তিনি মাথা পাতিয়া দাঁড়াইলেন, এখন গঙ্গা নামিলেই হয়।  এদিকে গঙ্গা ভাবিতেছে, ‘দাঁড়াও, এই বুড়োকে ভাসাইয়া পাতালে লইয়া যাইব।’ এ কথা যে মহাদেব টের পাইবেন, সে খেয়াল গঙ্গার ছিল না, আর সেই বুড়ার যে কতখানি ক্ষমতা তাহাও তিনি বুঝিতে পারেন নাই। তিনি ভাবিয়াছিলেন শিবকে নাকাল করিবেন, তাহার বদলে নিজেই নাকালের একশেষ। শিবকে ভাসাইয়া নেওয়া দূরে থাকুক, তাঁহার জটার ভিতরে পড়িয়া আর তিনি বাহির হইবার পথ পান না। সে জটা এখন হিমালয়ের মতো বিশাল হইয়া গিয়াছে, তাহার গলি-ঘুচির ভিতরে গঙ্গাদেবী মা-হারা খুকির মতো ঘুরিয়া বেড়াইতেছেন।  বৎসরের পর বৎসর যায়, গঙ্গা তবুও সেই সর্বনেশে জটার ভিতর হইতে বাহির হইতে পারেন না। ভাগ্যিস ভগীরথ তাঁহাকে দেখিতে না পাইয়া আবার প্রাণপণে তপস্যা আরম্ভ করিয়াছিলেন, নইলে আরো কতদিন গঙ্গাকে সেখানে থাকিতে হইত কে জানে। ভগীরথের তপস্যায় তুষ্ট হইয়া শিব গঙ্গাকে ছাড়িয়া দিলেন, গঙ্গাও তখন সপ্তধারা হইয়া সাতদিকে বহিয়া চলিলেন।  তখন অবশ্য খুবই একটা তুমুল ব্যাপার হইয়াছিল; আর সকলে ছুটিয়া তাহা দেখিতে আসিয়াছিল। এত জল, এত ফেনার এমন নৃত্য আর কখনো দেখা যায় নাই, এমন ডাকও কেহ কখনো শুনে নাই। মাছ, কুমির, কচ্ছপ, শুশুক আর সাপে পৃথিবী ছাইয়া গিয়াছিল।  গঙ্গা সাতটি ধারায় বহিয়া সাতদিকে ছুটিলেন;তাহার একটি ধারা ভগীরথের রথের পিছু পিছু যাইতে লাগিল। যত দেবতা, যত দানব, যত মুনি-ঋষি যক্ষ রাক্ষস গন্ধর্ব পিশাচ কিন্নর সকলেই সেই রথের পিছু পিছু গঙ্গার সঙ্গে সঙ্গে ছুটিয়া চলিল।  সেই পথের ধারে ছিল জহ্নু মুনির আশ্রম। মুনি যজ্ঞ করিতে বসিয়াছেন এমন সময় গঙ্গার জল সো ঁসো ঁশব্দে আসিয়া তাঁহার সকল আয়োজন ভাসাইয়া নিল। মুনি তাহাতে যারপরনাই ব্যস্ত হইয়া, আর তাহার চেয়েও বেশি রাগিয়া সেই জল সমস্তই খাইয়া ফেলিলেন। খাইবার সময় সকলে অবাক হইয়া সেই আশ্চর্য ব্যাপারের তামাশা দেখিয়াছিল, মুনিকে বারণ করিতে সাহস পায় নাই। মুনি সকল জল খাইয়া ফেলিলে পর তাহারা তাঁহাকে অনেক মিনতি করিয়া বলিল, “ঠাকুর! দয়া করিয়া গঙ্গাকে গড়িয়া দিন; ও যে আপনার মেয়ে!”  এ কথায় মুনি অতিশয় তুষ্ট হইয়া কানের ভিতর দিয়া আবার গঙ্গাকে বাহির করিয়া দিলেন। সেই হইতে গঙ্গার নাম হইয়াছে “জাহ্নবী”, অর্থাৎ জহ্নুর মেয়ে।  ইহার পরে আর গঙ্গার কোনো বিপদ ঘটে নাই। তিনি ভগীরথের পিছু পিছু পাতালে গিয়া সগরের সেই ষাট হাজার পুত্রের ছাই ভিজাইয়া দিলেন, আর অমনি তাঁহারা সকলে দেবতার ন্যায় সুন্দর রূপ ধরিয়া স্বর্গে চলিয়া গেল।  সেই যে অগস্ত্য মুনি সাগরের জল খাইয়া ফেলিয়াছিলেন, তাহার পর হইতে এতদিন সেই সাগর শুকনো পড়িয়াছিল। এতদিন পরে গঙ্গার জল আসিয়া আবার তাহাকে ভরিয়া দিল।  তখন ব্রহ্মা ভগীরথকে বলিলেন, “যতদিন পর্যন্ত এই সাগরে জল থাকিবে, ততদিন সগরের পুত্রেরা স্বর্গে বাস করিবে। আর এখন হইতে গঙ্গা তোমার কন্যার মতো হইলেন, সুতরাং লোকে তাহাকে ‘ভাগীরথী’ বলিয়া ডাকিবে।”
উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী
গণেশ উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী শিব ও পার্বতীর পুত্র। গণেশ জন্মাবার পর শিব গৃহে প্রবেশ করার চেষ্টা করলে গণেশ তাঁকে বাধা দেন। কারণ পার্বতী গণেশকে বলেছিলেন, বাড়িতে যেন কেউ না ঢোকে। শিব নিজের পুত্রকে চিনতে না পেরে ক্রুদ্ধ হয়ে গণেশের মুণ্ডচ্ছেদ করলেন। পার্বতী বেরিয়ে এসে ছিন্ন-মস্তক পুত্রকে দেখে শোকে অধীর হয়ে শিবকে ভর্ৎসনা করতে লাগলেন। শিব তাড়াতাড়ি হাতের কাছে আর কিছু না পেয়ে একটি হস্তিমুণ্ড গনেশের দেহের ওপর বসিয়ে গণেশকে পুনর্জীবিত করেন। (অসীম ক্ষমতাশালী হয়েও শিব কেন গণেশের নিজের মুণ্ডটি দেহের ওপর বসালেন না – সেটা কোথাও পরিষ্কার করে বলা হয় নি)। সর্বজ্ঞ গণেশ খুব দ্রুত লিখতে পারতেন। ব্যাসদেবকৃত মহাভারতের শ্লোকগুলি গণেশ লিখতে রাজি হয়েছিলেন এই শর্তে যে, ব্যাসদেব শ্লোক বলার সময় কখনও থামতে পারবেন না। ব্যাসদেব বলেছিলেন যে, তিনি এতে সন্মত আছেন যদি গণেশ কথা দেন যে, তিনিও কোনও শ্লোকের অর্থ পুরো না বুঝে লিখতে পারবেন না। এই কারণেই ব্যাসদেব মহাভারতে কিছু কিছু কঠিন শ্লোক ঢুকিয়েছিলেন (এইগুলি ব্যাসকূট বলে পরিচিত) যার অর্থ বুঝতে গণেশের মত সর্বজ্ঞরও সময় লেগে যেত। সেই ফাঁকে ব্যাসদেব আরও কিছু শ্লোক বানিয়ে ফেলতে পারতেন।
উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী
গণেশের বিবাহ উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী গণেশের বিবাহ  গণেশ কেমন যুদ্ধ করিয়াছিলেন তাহা বলিয়াছি, গণেশের বিবাহ কেমন করিয়া হইয়াছিল আজ তাহা বলিব।  যুদ্ধের পর হইতে শিব গণেশকে যারপরনাই স্নেহ করেন, আর পার্বতীর তো কথাই নাই। কার্তিক যেমন শিব আর পার্বতীর পুত্র, গণেশ তাঁহাদের তেমনি পুত্র হইলেন, আর তাহাদের নিকট তেমন স্নেহ পাইতে লাগিলেন।  কার্তিক আর গণেশ যখন বড় হইলেন, তখন একটা কথা লইয়া দুজনের মধ্যে বড়ই তর্ক উপস্থিত হইল;কার্তিক বলেন, “আমি আগে বিবাহ করিব,” গণেশ বলেন, “না আমি আগে বিবাহ করিব!”  তাঁহাদের এইরূপ তর্ক শুনিয়া শিব আর পার্বতী বড়ই ভাবনায় পড়লেন। দুই পুত্রকেই তাঁহারা সমান স্নেহ করেন; ইহাদের কাহাকে চটাইয়া কাহার বিবাহ আগে দেন? শেষে অনেক ভাবিয়া শিব স্থির করিলেন, “তোমাদের মধ্যে যে আগে এই পৃথিবী প্রদক্ষিণ করিয়া (অর্থাৎ তাহার চারিদিকে ঘুরিয়া) আসিতে পারিবে, তাহার বিবাহই আগে দিব।”  এ কথা শুনিয়া কার্তিক তখনই পৃথিবী প্রদক্ষিণ করিতে বাহির হইলেন। গণেশের এই বড় ভুঁড়ি, তাহা লইয়া ছুটাছুটি করিবার সুবিধা নাই;তিনি ভাবিলেন, ‘তাইতো, এখন করি কি? ক্রোশখানেক যাইতে না যাইতেই আমার হাঁপ ধরে, পৃথিবীর চারিদিক আমি কি করিয়া ঘুরিব?’  যাহাই হউক, গণেশ বড়ই বুদ্ধিমান ছিলেন। তিনি মনে মনে এক চমৎকার যুক্তি স্থির করিয়া, স্নানের পর দুখানি আসন হাতে পিতামাতার নিকট আসিয়া বলিলেন, “বাবা! মা! এই দুইখানি আসনে আপনারা দুজনে বসুন, আমি আপনাদের পূজা করিব।”  এই কথায় শিব আর পাবর্তী সন্তুষ্ট হইয়া দুই আসনে দুইজন বসিলেন। গণেশও ভক্তির সহিত তাঁহাদের পূজা করিয়া, সাতবার তাঁহাদের চারিদিকে ঘুরিলেন। তারপরে জোড়হাতে তাহাদিগকে বলিলেন, “এখন তবে আমার বিবাহ দিন।”  শিব কহিলেন, “বাবা, আমি তো বলিয়াছি কার্তিকের আগে যদি পৃথিবীর চারিদিকে ঘুরিয়া আসিতে পার, তবে তোমার বিবাহই আগে হইবে।”  তাহাতে গণেশ বলিলেন, “সে কি বাবা, আমি যে সাতবার পৃথিবী প্রদক্ষিণ করিলাম, তবে কেন এমন কথা বলিতেছেন?”  শিব কহিলেন, “তুমি কখন পৃথিবী প্রদক্ষিণ করিলে?”  গণেশ বলিলেন, “এই যে আমি আপনাদের পূজা করিয়া সাতবার আপনাদিগকে প্রদক্ষিণ করিয়াছি। বেদে আর শাস্ত্রে আছে যে, পিতামাতাকে পূজা করিয়া প্রদক্ষিণ করিলে তাহাতে পৃথিবী প্রদক্ষিণের ফল পাওয়া যায়, ইহাতে সংশয় নাই। বেদের কথা যদি সত্য হয়, তবে অবশ্যই আমার পৃথিবী প্রদক্ষিণ করা হইয়াছে। সুতরাং আমার শীঘ্র বিবাহ দিন, নচেৎ বেদের কথা মিথ্যা হইয়া যাইবে।”  এ কথায় শিব যারপরনাই আশ্চর্য হইয়া বলিলেন, “তাইতো বাবা, তুমি তো ঠিক কথাই বলিয়াছ। বেদে আর শাস্ত্রে যাহা আছে তাহাই তুমি করিয়াছ, সুতরাং তোমার পৃথিবী প্রদক্ষিণ করা হইয়াছে বৈকি!”  তখনই গণেশের বিবাহের আয়োজন আরম্ভ হইল। দুটি কন্যাও পাওয়া গেল, রূপে গুণে কুলে শীলে সকলের চেয়ে ভালো, নাম সিদ্ধি আর বুদ্ধি। সুতরাং বিবাহ হইতে আর বিলম্ব হইল না।  এদিকে হইয়াছে কি, গণেশের বিবাহের কিছুদিন পরে কার্তিক প্রাণপণে পৃথিবীর চারিদিকে ছুটিয়া হাঁপাইতে হাঁপাইতে কৈলাসে উপস্থিত হইয়াছেন, আর অমনি নারদ মুনি আসিয়া তাঁহাকে বলিয়াছেন, “দেখিলে ইহাদের কাজ? তোমাকে ফাঁকি দিয়া তোমার পিতামাতা পৃথিবী প্রদক্ষিণ করিতে পাঠাইলেন আর সেই অবসরে গণেশের বিবাহ দিলেন। শাস্ত্রে বলে এমন মা-বাপের মুখ দেখিতে নাই, এখন তোমার যেমন ভালো মনে হয়, কর।”  এই বলিয়া যেই নারদ বিদায় হইলেন, অমনি কার্তিকও শিব আর পার্বতীকে প্রণাম করিয়া রাগের ভরে ক্রৌঞ্চ পর্বতে চলিয়া গেলেন।  শিব আর পার্বতী ব্যস্ত হইয়া বলিলেন, “কোথায় যাইতেছ বাছা? তোমার যে বিবাহ ঠিক করিয়াছি।”  কার্তিক কি তাহাতে থামেন? তিনি বলিলেন, “না, আমি এখানে আর থাকিব না;আপনারা আমাকে ফাঁকি দিয়াছেন।”  সুতরাং কার্তিকের আর বিবাহ হইল না;এইজন্যই তাঁহার আর এক নাম হইয়াছে ‘কুমার’।  ইহাতে শিব আর পার্বতীর মনে কিরূপ কষ্ট হইল, বুঝিতেই পার। তাহারা কার্তিককে ফিরাইতে না পারিয়া নিজেরাই সেই ক্রৌঞ্চ পর্বতে গিয়া বাস করিতে লাগিলেন। কিন্তু কার্তিকের কিনা বড়ই রাগ হইয়াছিল, তাই তিনি তাঁহার পিতামাতাকে আসিতে দেখিয়া ক্রৌঞ্চ পর্বতে থাকিতে চাহিলেন না। দেবতারা অনেক বলিয়া কহিয়া সেখান হইতে বারো ক্রোশের মধ্যে থাকিতে তাঁহাকে রাজি না করাইলে না জানি তিনি কোথায় চলিয়া যাইতেন।
উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী
ত্রিপুর উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী ত্রিপুর দেবতাদের সঙ্গে অসুরদের ভয়ানক শক্রতা ছিল। দিনরাতই কেবল ইহাদের মারামারি চলিত, তাহাতে অনেক সময় অসুরেরাও হারিত, অনেক সময় দেবতারাও হারিতেন। দেবতারা অসুরদের জ্বালায় অস্থির থাকিতেন, আবার অসুরেরা তপস্যা করিলে তাহাদিগকে বর না দিয়াও পারিতেন না। বর দিয়া তারপর তাহার ধাক্কা সামলাইতে তাঁহাদের প্রাণান্ত হইত। একটা অসুর ছিল তাহার নাম ময়। জাদু, মায়া, ভেলকিবাজি যত আছে, ময় তাহার সকলই জানিত, আর তাহার জোরে সময় সময় দেবতাদিগকে ভারি নাকাল করিত। একবার যুদ্ধে হারিয়া ময় তপস্যা করিতে লাগিল; বিদ্যুন্মালী আর তারক নামে আর দুইটা অসুরও তাহার দেখাদেখি তপস্যা আরম্ভ করিল। তাহারা উপবাস করিয়া শীতে ভুগিয়া, বৃষ্টিতে ভিজিয়া এমনি আশ্চর্য তপস্যা করিল যে, ব্রহ্মা আর তাহাদের কাছে না আসিয়া থাকিতে পারিলেন না। ব্রহ্মা বলিলেন, “বাপুসকল, আমি তোমাদের তপস্যায় বড়ই তুষ্ট হইয়াছি, এখন, কি বর লইবে বল।” তখন ময় জোড়হাতে মিষ্ট কথায় তাহকে বিনয় করিয়া বলিল, “প্রভু, দেবতারা আমাদিগকে মারিয়া ধরিয়া তাড়াইয়া দিয়াছে, এখন আমরা কোথাও একটু থাকিবার জায়গা পাইতেছি না। দয়া করিয়া আমাকে এমন বর দিন, যাহাতে আমি একটি খুব ভালো দুর্গ প্রস্তুত করিতে পারি। সে দুর্গের ভিতরে বসিয়া থাকিলে আর কেহই যেন আমাকে কিছু করিতে না পারে।” ব্রহ্মা বলিলেন, “একেবারে কেহই কিছু করিতে পারিবে না, এমন কি হয়?” ময় বলিল, “তাহা যদি না হয়, তবে এই বর দিন, যে একমাত্র শিব ছাড়া আর কেহ সে দুর্গ নষ্ট করিতে পারবে না; আর শিবকেও একটিমাত্র বাণ মারিয়া সে কাজ করিতে হইবে।” তখন ব্রহ্মা বলিলেন, “আচ্ছা তাহাই হইবে।” এই বলিয়া ব্রহ্মা চলিয়া গেলেন, ময়ও যারপরনাই খুশি হইয়া দুর্গ প্রস্তুত করিতে লাগিল। ময় বলিল, “আমি এমন দুর্গ বানাইব যে, তাহা তিন ভাগ হইয়া তিন জায়গায় থাকিবে। তাহা হইলে আর এক বাণে তাহাকে নষ্ট করা যাইবে না। খালি, একদিন সেই তিনটি ভাগ একত্র হইবে— যেদিন চন্দ্র আর সূর্য একসঙ্গে পুষ্য নক্ষত্রে থাকিবেন। সেইদিন যদি শিব আসিয়া বাণ মারেন, তবেই আমার এই দুর্গ তিনি নষ্ট করিতে পারিবেন, নহিলে নয়।” এমনি করিয়াই সে তাহার দুর্গ প্রস্তুত করিল। পৃথিবীর উপরে করিল একটি লোহার দুর্গ; সেটা তারকের জন্য। স্বর্গে করিল একটা রূপার দুর্গ; সেটা বিদ্যুন্মালীর জন্য। আর স্বর্গেরও উপরে একটা সোনার দুর্গ, সেটা করিল তাহার নিজের থাকিবার জন্য। এইরূপে তিনটি পুরী মিলিয়া দুর্গটি প্রস্তুত হইল, তাই তাহার নাম হইল ত্রিপুর। তেমন দুর্গ আর কেহ কখনো দেখে নাই। যেমন বড়, তেমনি মজবুত, তেমনি সুন্দর! মাঠ, বাগান, পথ ঘাট, হাট বাজার, নদী পুকুর সকলই তাহার ভিতর আছে, কোনো জিনিসের জন্যই দুর্গের বাহিরে যাইতে হয় না। অসুরেরা যে যেখানে ছিল, খবর পাইয়া সকলে আসিয়া সেই দুর্গে বাস করিতে লাগিল। তাহাদের আর আনন্দের সীমা নাই। আর তাহাদের কিসের ভয়?  তখন তাহাদের সাহস বাড়িয়া গেল। এতদিন দেবতাদের ভয়ে ঝোপে জঙ্গলে লুকাইয়া ছিল, এখন আবার সুবিধা পাইয়া তাঁহাদের সঙ্গে খোঁচাখুঁচি আরম্ভ করিল। কোনোদিন স্বর্গের বাগান ভাঙ্গে, কোনদিন দেবতাদের বাড়িতে গিয়া ঝগড়া করে, কোনোদিন মুনি-ঋষিদিগের তপস্যা মাটি করিয়া দেয়।  ময় নিজে তেমন মন্দ লোক ছিল না কিন্তু অসুরেরা তাহার কথা শুনিলে তো? তাহারা দল বাঁধিয়া সংসারময় ঘুরিয়া বেড়াইতে লাগিল। যাহাকে পায়, তাহাকেই ধরিয়া মারে; তাহাদের ভয়ে লোকে স্থির হইয়া ঘরে থাকিতে পারে না।  তখন সকলে ব্রহ্মার নিকটে গিয়া জোড়হাতে বলিল, “হে পিতামহ। আপনি তো অসুরদিগকে বর দিয়াছেন, এখন আমাদের কি উপায় হইবে? অসুরের জ্বালায় আমাদের প্রাণে বাঁচাই যে ভার হইয়াছে। আপনি যদি ইহাদের শাসন না করেন, তবে আর সংসারে দেবতা, মানুষ বা জীবজন্তু কিছুই থাকিবে না।” ব্রহ্মা বলিলেন, “তোমরা ব্যস্ত হইও না। আমি বর দিয়াছি বটে কিন্তু উপায়ও রাখিয়া দিয়াছি। উহাদের ঐ দুর্গ একটি বাণেই ভাঙ্গিয়া ফেলা যায়। কিন্তু তাহা তোমরা পারিবে না। চল শিবের কাছে যাই। তিনিই এ কাজের উপযুক্ত লোক।”  শিব তাহার ঘরে বসিয়া আছেন, এমন সময় তেত্রিশ কোটি দেবতা সকলে মিলিয়া তাঁহার নিকটে আসিয়া জোড়হাতে তাঁহার স্তব করিতে লাগিলেন।  শিব বলিলেন, “তোমরা কি জন্য আসিয়াছ? বল আমি তোমাদের কি উপকার করিতে পারি; এখনি তাহা করিব।”  দেবতারা বলিলেন, “অসুরেরা তো আর আমাদের কিছু রাখিল না, এখন আপনি আমাদিগকে রক্ষা করুন। আমাদের বাড়ি বাগান সব ভাঙ্গিয়া দিয়াছে, হাতি ঘোড়া ধরিয়া নিয়াছে, ধনরত্ন লুট করিয়াছে, এরপর প্রাণে মারিবে। দোহাই ঠাকুর। আমাদিগকে রক্ষা করুন।”  তাহা শুনিয়া শিব বলিলেন, “তোমাদের কোনো ভয় নাই, আমি ত্রিপুর দুর্গ পোড়াইয়া দিতেছি। একখানা ভালোরকম রথ আন তো।”  এ কথায় দেবতারা সকলে মিলিয়া সংসারের সকল ভয়ংকর আর আশ্চর্য জিনিস দিয়া, এমনি চমৎকার এক রথ প্রস্তুত করিলেন সে কি বলিব। রথের দিকে চাহিয়া শিব অনেকক্ষণ ধরিয়া খালি ‘বাঃ! বাঃ!’ এইরূপই কবিতে লাগিলেন। তারপর তিনি বলিলেন, “বেশ রথ হইয়াছে। এখন ইহার উপযুক্ত একটি সারথি চাই।”  দেবতারা তো বড়ই সংকটে পড়িলেন। এমন রথের সারথি তো যেমন তেমন হইলে চলিবে না—হায় এখন সারথি কোথায় পাই?  তখন ব্রহ্মা বলিলেন, “চিন্তা কি? আমিই সারথি হইব।” এই বলিয়া ব্রহ্মা যখন রথে উঠিয়া রাশ ধরিয়া বসিলেন তখন সকলের কী আনন্দই হইল। শিবও তখন যারপরনাই সুখী হইয়া বলিলেন, “এইবার ঠিক সারথি হইয়াছে।”  সেই রথে চড়িয়া শিব যুদ্ধ করিতে চলিলেন, সঙ্গে দেবতা গন্ধর্ব সকলে জয় জয় শব্দে ছুটিয়া চলিল। ষাঁড়ে চড়িয়া নন্দী চলিল, ময়ুরে চড়িয়া কার্তিক চলিলেন, ঐরাবতে চড়িয়া ইন্দ্র চলিলেন, সাপে চড়িয়া বরুণ চলিলেন, মহিষে চড়িয়া যম চলিলেন। শিবের যত ভূত, তাহারাও শিবের রথ ঘিরিয়া গর্জন করিতে করিতে চলিল, হাতির মতো, পাহাড়ের মতো তাহাদের শরীর, মেঘের মতো তাহাদের ডাক।  এদিকে অসুরেরা এ সকল দেখিয়া শুনিয়া বড়ই ব্যস্ত হইয়া উঠিয়াছে। ময় তাড়াতাড়ি অসুরদিগকে ডাকিয়া বলিলেন, “সাবধান, সাবধান। ঐ দেখ দেবতারা যুদ্ধ করিতে আসিতেছে। দেখিয়ো, যেন উহাদিগকে সহজে ছাড়িয়ো না।”  এমনি করিয়া ক্রমে দেবতা আর অসুরদিগের ঘোরতর যুদ্ধ আরম্ভ হইল। অসুরগুলি দেখিতে যেমন ভয়ংকর, শিবের ভূত সকলও তেমনি বিকট; আর তাহাদের যুদ্ধও হইল বড়ই সাংঘাতিক। অসুরেরা মনে করে যে তাহারা দেখিতে ভারি সুন্দর, তাই ভূতগুলির জানোয়ারের মতো মুখ দেখিয়া, তাহারা আর হাসি রাখিতে পারে না।  সেই ভূতদের সঙ্গে খানিক যুদ্ধ করিলেই আবার তাহাদের সে হাসি শুকাইয়া যায়। তবুও অসুরেরা যেমন তেমন যুদ্ধ করে নাই। ময় আর তারক দুজনে নানারূপ মায়া খেলাইয়া ভূত আর দেবতা সকলকেই যারপরনাই ব্যস্ত করিয়া তুলিয়াছিল। কোথা হইতে যে তাহারা যত রাজ্যের আগুন, আর বৃষ্টি, আর ঝড়, আর বাঘ, আর সাপ, আর কুমীর আনিয়া দেবতাদের উপর ফেলিতে লাগিল, তাহা কেহই বুঝিতে পারিল না। তথাপি ক্রমে দেবতাদেরই জয় হইতে লাগিল, নন্দীর হাতে বিদ্যুম্মালী মারা গেল, আর সকল অসুরই কাবু হইয়া পড়িল। তখন ময় দেখিল যে এখন একবার দুর্গের ভিতরে গিয়া একটু বিশ্রাম না করিলে আর চলিতেছে না।  দুর্গের ভিতরে আসিয়া ময় ভাবিতেছে, এখন উপায় কি হয়? এমন দুর্গ করিয়াও দেবতাদের হাতে শেষে এত নাকাল হইতে হইল। বলিতে বলিতে চট্‌ করিয়া তাহার মাথায় বুদ্ধি জোগাইয়াছে, আর অমনি সে মায়ার বলে দুর্গের ভিতরে এক আশ্চর্য পুকুর তৈয়ীর করিয়া ফেলিয়াছে। সে পুকুরের জল অমৃত, সে জল একবার খাইলে বা তাহাতে স্নান করিলে মরা যে সেও বাঁচিয়া উঠে।  তখন আর কিসের ভয়? যত অসুর মরে, সকলকেই আনিয়া সেই পুকুরে স্নান করায়। এমনি করিয়া তাহারা বিদ্যুন্মালীকে আবার বাঁচাইয়া তুলল আর কত মরা অসুর যে বাঁচাইল তাহার তো লেখা জোখাই নাই। বাঁচিয়া উঠিয়াই তাহারা আবার বলিল, “কোথায় গেল শিব? কোথায় নন্দী? কোথায় দেবতা? কোথায় ভূত? মার তাহাদের সকলকে।”  এবারে দেবতারা বড়ই সংকটে পড়িলেন। যত অসুর মারেন, সকলেই খানিক পরে আবার আসিয়া যুদ্ধ করিতে থাকে। একি আশ্চর্য ব্যাপার। মরিয়াও মরে না, বরং তাহাদের গায়ের জোর যেন আরো বাড়িয়া যায়। দেবতাগণ আর ভাবিয়া পথ পাইতেছেন না।  এমন সময় শিবের একটা ভূত ছুটিয়া আসিয়া বলিল, “কর্তা, অসুর মারিয়া আর কি হইবে? এদের ঘরে পুকুর আছে, তাহর জলে চোবাইলে মরাটি চাঙ্গা হয়।”  অসুরেরা তখন বড়ই ভয়ানক যুদ্ধ করিতেছিল। দেবতারা একে ইহাদের জ্বালায় অস্থির, তাহাতে আবার শিবের রথের চাকা মাটিতে বসিয়া গিয়াছে, সকলে প্রাণপণে টানাটানি করিয়া তাহাকে তুলিতে পারিতেছেন না। তখন যদি বিষ্ণু তাড়াতাড়ি এক বিশাল ষাঁড় সাজিয়া শিং দিয়া সেই রথ না উঠাইতেন, তবে না জানি সেদিন কি সর্বনাশই হইত। ইহারই মধ্যে তারকাসুর ঝড়ের মতো ছুটিয়া আসিয়া ব্রহ্মাকে এমনি গুঁতা মারিয়াছিল যে, তিনি হাতের রাশ রথে ফেলিয়া কেবলই হাঁপাইতেছিলেন।  এদিকে বিষ্ণু রথখানিকে শিং দিয়া উঠাইয়া দিয়াই অসুরদিগের দুর্গের দিকে ছুটিয়া চলিয়াছে। অসুরেরা তাহার বিশাল দেহ আর শিং নাড়া দেখিয়া আর গর্জন শুনিয়া, আর তাঁহাকে আটকাইতে সাহসই পাইল না। তিনি ছুটিতে ছুটিতে সেই পুকুরে গিয়া চোঁ চোঁ শব্দে তাহার সমস্ত জল খাইয়া ফেলিলেন।  ইহার পর আর অসুরেরা ভূতদের সঙ্গে কিছুতেই পারিয়া উঠিল না; তাহারা ঢিপ্‌ ঢাপ্‌ ভূতের কিল খাইতে খাইতে ছুটিয়া দুর্গের ভিতরে ঢুকিয়া গেল। তাহা দেখিয়া সকলে হাততালি দিয়া হাসিতে লাগিল।”  তখন আর অসুরেরা ভূতের ভয়ে স্থির থাকিতে না পারিয়া তাহাদের দুর্গসুদ্ধ সমুদ্রের উপরে চলিয়া গেল। কিন্তু দেবতারা তাহাদিগকে এত সহজে ছড়িবেন কেন? তাঁহারা সেইখানে গিয়া আবার তাহাদের সঙ্গে বিষম যুদ্ধ আরম্ভ করিলেন। দেখিতে দেখিতে তারকাসুর নন্দীর হাতে মারা গেল, বিদ্যুন্মালীরও সেই দশা হইতে আর অধিক বিলম্ব হইল না।  তারপর ক্রমে সেই সময় আসিয়া উপস্থিত হইল, যখন চন্দ্র আর সূর্য একসঙ্গে পুষ্যা নক্ষত্রে আসিবেন। সেই পুণ্যযোগে ত্রিপুর দুর্গের তিনটি ভাগও এক জায়গায় আসিয়া মিলিবার কথা। তখন তাহার উপরে শিবের বাণ পড়িলে, এক বাণেই সেই দুর্গ নষ্ট হইয়া যাইবে। শিব তাহার জন্যই ধনুর্বাণ লইয়া প্রস্তুত আছে। ঠিক সময়টি উপস্থিত হইবামাত্র ভীষণ শব্দে তিনি সেই বাণ ছড়িয়া দিলেন, অমনি তাহা আকাশ পাতাল আলো করিয়া অসুরদিগের দুর্গের উপর গিয়া পড়িল। সে বাণের তেজ এমনি ছিল যে দুর্গের উপরে তাহা পড়িবামাত্রই দেখিতে দেখিতে সেই দুর্গ পুড়িয়া ছাই হইয়া গেল।  এইরূপে ত্রিপুর দুর্গের শেষ হইল। অসুরেরা আর সকলেই তাহার সঙ্গে পুড়িয়া মরিয়াছিল, কেবল ময় মরে নাই। সে শিবের ভক্ত ছিল, তাই শিব দয়া করিয়া নন্দীকে পাঠাইয়া আগেই তাহাকে সাবধান করিয়া দেন।নন্দীর কথায় সে তাহার থাকিবার ঘরখানি সুদ্ধ পলাইয়া প্রাণ বাঁচাইয়াছিল।
উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী
ধ্রুব উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী ধ্রুব  সে যে কত কালের কথা, তাহা আমি জানি না। সেই অতি প্রাচীনকালে আমাদের দেশে উত্তানপাদ নামে এক রাজা ছিলেন। উত্তানপাদের দুই রাণী ছিলেন, একটির নাম সুনীতি, আর একটির নাম সুরুচি।  সুনীতি বড় লক্ষ্মী মেয়ে ছিলেন, কিন্তু সুরুচি ছিলেন ঠিক তাহার উলটা। আর সুনীতিকে তিনি প্রাণ ভরিয়া হিংসা করিতেন। রাজা সেই সুরুচিকে এতই ভালোবাসিতেন, যে তাঁহার কথা না রাখিয়া থাকিতে পারিতেন না। সুরুচি তাঁহার নিকট সুনীতির নামে কত মিথ্যা কথাই বলিতেন, তিনি ভাবিতেন, তাহার সকলই বুঝি সত্য। শেষে রাজা একদিন সুরুচির কথায় সুনীতিকে রাজপুরী হইতে বাহির করিয়া দিলেন।  দুঃখিনী সুনীতি তখন আর কি করেন? মুনিদের তপোবনে গিয়া আশ্রয় লওয়া ভিন্ন তাঁহার আর উপায় রহিল না। সেইখানে কয়েকদিন পরেই তাঁহার একটি খোকা হইল, তাহার নাম হইল ধ্রুব। তখন হইতে ধ্রুবকে লইয়া তিনি মুনিদের আশ্রমেই থাকেন। খোকাটি ক্রমে বড় হইতে লাগিল। সে মুনিকুমারদের সঙ্গে খেলা করে, মুনিদের হোম তপস্যা দেখে আর তাঁহাদের মুখে ভগবানের নাম শুনে। এইরূপে শিশুকালেই তাহার প্রাণে ভগবানের প্রতি ভক্তি জন্মিল।  এমনি করিয়া দিন যায়। ক্রমে ধ্রুবের বয়স চারি-পাঁচ বৎসর হইয়াছে। ইহার মধ্যে সে একদিন শুনিল যে সে রাজার পুত্র, মহারাজ উত্তানপাদ তাহার পিতা। এ কথা শুনিবামাত্র পিতাকে দেখিবার জন্য তাহার প্রাণ ব্যাকুল হইল। সে ভাবিল আমি এখনই পিতাকে দেখিতে যাইব।’  রাজা উত্তানপাদ সিংহাসনে বসিয়া আছেন, সুরুচি তাঁহার নিকটেই দাঁড়াইয়া, সুরুচির পুত্র উত্তম রাজার কোলে। এমন সময় ধ্রুব সেখানে আসিয়া তাঁহার কোলে উঠিবার জন্য তাহার ছোট হাত দুখানি বাড়াইয়া দিল। রাজার হয়তো তাহাকে কোলে লইতেন খুবই ইচ্ছা হইয়াছিল, কিন্তু সুরুচির বিষম ভ্রুকুটি করিয়া নিতান্ত কর্কশভাবে ধ্রুবকে বলিলেন, ‘‘ছেলের আস্পর্ধা দেখ। এত কষ্ট কেন করিতেছিস্ বাছা? জানিস না কি যে তুই সুনীতির ছেলে? উনি তোর পিতা হইলে কি হয়? আমি তো তোর মা নই। রাজাসনে বসা তোর কপালে নাই, সে শুধু আমার ছেলেরই জন্য।” ধ্রুবের প্রাণে এই নিষ্ঠুর কথাগুলি বড়ই লাগিল। সে আর এক মুহূর্তও সেখানে বিলম্ব না করিয়া, ঠোঁট দুখানি ফুলাইয়া মার নিকট আসিয়া উপস্থিত হইল। মা তাহার কাঁদ কাঁদ মুখ আর ছল ছল চোখ দুটি দেখিবামাত্র তাহাকে কোলে লইয়া তাহার মাথায় হাত বুলাইতে বুলাইতে জিজ্ঞাসা করিলেন, “কি হইয়াছে বাবা? কেহ কি তোমাকে কিছু বলিয়াছে?”  ধ্রুব কহিল, “মা আমি বাবার কোলে উঠিতে গিয়াছিলাম, সৎমা বলিলেন, আমি তোমার ছেলে বলিয়া নাকি তাঁহার কোলে উঠিতে পাইব না; আমার নাকি কপালে নাই।”  ধ্রুব দীর্ঘনিশ্বাস ফেলিতে ফেলিতে এই কথাগুলি বলিল; তাহা শুনিয়া সুনীতির যে কি কষ্ট হইল তাহা লিখিয়া বুঝাইবার সাধ্য নাই। তিনি কোনো মতে চোখের জল থামাইয়া ধ্রুবকে বলিলেন, “বাবা, সুরুচি সত্যই বলিয়াছে। তোমার কপাল মন্দ, তাই তুমি আমার মতো অভাগিনীর পুত্র হইয়াছ। তোমার কপাল ভালো হইলে কেহ তোমাকে এমন কথা বলিতে পারিত না। রাজার আসনে বসা, ভালো ভালো হাতি ঘোড়ায় চড়া, এ সকল যাহার পুণ্য আছে তাহার ভাগ্যেই জোটে। সুরুচির ছেলে উত্তম অন্যজন্মে অনেক পুণ্য করিয়াছিল, তাই এখন সে রাজার কোলে বসিতে পায়। তুমি কর নাই তাই তুমি তাঁহার কোলে বসিতে পাইলে না। সুরুচির কথায় যদি তোমার দুঃখ হইয়া থাকে, তবে যাহাতে তোমার খুব পুণ্য হয় সেইরূপ কাজ কর, তাহা হইলেই তোমার কপাল ভালো হইয়া যাইবে।”  ধ্রুব কহিল, “মা আমার মনে যে বড়ই লাগিয়াছে তোমার কথায় তো আমার দুঃখ যাইতেছে না। আমি এমন কাজ করিব যাহাতে সকলের চেয়ে যে ভালো তাহার চেয়েও ভালো স্থান পাইতে পারি। তোমার ছেলে যে আমি, আমার তেজ তুমি দেখ। বাবার যাহা আছে সবই উত্তমের হউক, অন্যের দেওয়া আমি কিছু চাহি না। আমি নিজে এমন জায়গা দেখিয়া লইব যে বাবাও তাহা পান নাই।”  এই বলিয়াই ধ্রুব ঘর হইতে বাহির হইয়া গেল, তারপর একমনে পথ চলিতে চলিতে সে বনের ভিতরে একস্থানে আসিয়া দেখিল যে সেখানে সাতজন মুনি কুশাসনে বসিয়া আছেন। সে তাঁহাদিগকে প্রণাম করিয়া বলিল, “আমি উত্তানপাদের পুত্র ধ্রুব, আমার মার নাম সুনীতি। আমি মনে বড় কষ্ট পাইয়া আপনাদের নিকটে আসিয়াছি’’ মুনিগণ বলিলেন, “বাছা, তুমি চারি-পাঁচ বৎসরের বালক, তোমার মনে আবার কি কষ্ট হইল।” ধ্রুব কহিল, “আমার বিমাতা আমাকে কটু কথা কহিয়াছেন, তাই আমার মনে কষ্ট হইয়াছে।”  ধ্রুবের নিকট সকল কথা শুনিয়া মুনিরা বড়ই আশ্চর্যাম্বিত হইয়া বলিলেন, “আচ্ছা বাছা, এখন তুমি কি চাহ? আমরা তোমার কি সাহায্য করিতে পারি?” ধ্রুব কহিল, “আমি সেই স্থান পাইতে চাহি, যাহা অন্য কেহ পায় নাই। সে স্থান কি করিয়া পাইব আপনারা তাহা আমাকে বলিয়া দিন।” মুনিগণ বলিলেন, “যিনি সকলের বড়, যাহা কিছু আছে সকলই যাঁহার, তুমি সেই হরিকে ডাক, তাহা হইলেই তুমি সে স্থান পাইবে।”  ধ্রুব কহিল, “কি করিয়া তাঁহাকে ডাকিলে তিনি খুশি হইবেন তাহা তো আমি জানি না, তাহা আমাকে বলিয়া দিন।” মুনিরা বলিলেন, “আর কিছুরই কথা ভাবিবে না, কেবল তাঁহারই কথা ভাবিবে, আর শুধু বলিবে, ‘তুমি সকলের, তোমাকে কেহ জানিতে পারে না, তুমি সকলই জান, তোমাকে নমস্কার।’ ইহাতেই তিনি তুষ্ট হইবেন। তোমার পিতামহ মনু এইরূপেই তাঁহাকে তুষ্ট করিয়াছিলেন।”  তখন ধ্রুব সেই মুনিদিগকে প্রণাম করিয়া মনের আনন্দে সেখান হইতে যমুনার তীরে মধুবন নামক বনে গিয়া উপস্থিত হইল। সেখানে গিয়া সে দিনরাত একমনে এমনি ব্যাকুলভাবে হরিনাম করিতে লাগিল যে, আর কেহ কখনো তেমন করিয়া তাঁহাকে ডাকিতে পারে নাই। সেই আশ্চর্য তপস্যা দেখিয়া দেবতারা ভয় পাইলেন, পৃথিবী কাঁপিল, সাগর উছলিয়া উঠিল।  ইন্দ্র ভাবিলেন, না জানি এই বালক এমন তপস্যা করিয়া কি বিপদ ঘটাইবে। তখন তিনি আর কতগুলি দেবতার সহিত মিলিয়া ধ্রুবের তপস্যা ভাঙ্গিবার আয়োজন করিলেন। একজন দেবতা সুনীতির বেশে, ‘হায় বাছা’ ‘হায় বাছা’ বলিয়া কাঁদিতে কাঁদিতে গিয়া ধ্রুবকে বলিল, “বাবা, কত আশা করিয়া তোমাকে পাইয়াছি। দুঃখিনীর ধন, আমার যে বাছা আর কেহ নাই, আমাকে কি এমন করিয়া ফেলিয়া আসিতে হয়? তুমি যদি তপস্যা না ছাড়, তবে আমি তোমার সম্মুখেই মরিয়া যাইব।”  কিন্তু ধ্রুরের মন তখন হরির ধ্যানেই মজিয়াছিল সে সকল কপট কান্না শুনিয়াও শুনিল না। তখন সেই দুষ্ট দেবতা “বাবা গো! কি ভয়ানক রাক্ষস আসিয়াছে। পালাও পালাও,” বলিতে বলিতে সেখান হইতে চলিয়া গেল।  অমনি কোথা হইতে ভীষণ রাক্ষসগণ দলে দলে মার্‌-মার্‌ কাট-কাট শব্দে ধ্রুবকে খাইতে আসিল। সঙ্গে সঙ্গে শত শত শিয়াল ডাকিয়া উঠিল। রাক্ষসেরাও তাহাদের সিংহের মতো, উটের মতো, কুমিরের মতো মুখ দিয়া আগুন ফুঁকিতে ফুঁকিতে কতই গর্জন করিল, শেল, শূল, মুষল, মুদ্‌গর কতই ঘুরাইল, আর দাঁত খিচাইল! ধ্রুব তাহা টেরও পাইল না।  এইরূপে যখন ধ্রুবের তপস্যা ভাঙ্গিবার সকল চেষ্টাই বিফল হইল, তখন দেবতারা ভয়ে কাঁপিতে কাঁপিতে শ্রীহরির নিকটে আসিয়া বলিলেন, “হে প্রভু, আমাদিগকে রক্ষা করুন। উত্তনপাদের পুত্র অতি ভীষণ তপস্যা আরম্ভ করিয়াছে, না জানি আমাদের কাহার কাজটি কাড়িয়া নিবে। শীঘ্র উহার তপস্যা থামাইয়া দিন।”  শ্রীহরি বলিলেন, “তোমাদের কোনো ভয় নাই। ধ্রুব কি চাহে, আমি তাহা জানি। তাহার বাঞ্ছা পূর্ণ করিয়া আমি তাহার তপস্যা শেষ করিয়া দিতেছি।” তারপর তিনি সেই মধুবন আলো করিয়া ধ্রুবের সম্মুখে উপস্থিত হইয়া বলিলেন, “ধ্রুব! তোমার মঙ্গল হউক। আমি তোমার তপস্যায় তুষ্ট হইয়া বর দিতে আসিয়াছি; তুমি কি চাহ?” তখন ধ্রুব চক্ষু মেলিয়া সেই সকল দেবতার শ্রেষ্ঠ দেবতাকে সম্মুখে দেখিয়া যারপরনাই আনন্দিত হইল, ভয়ও পাইল। সে অমনি তাঁহার পায়ে লুটাইয়া বলিল, “আমি তো জানি না, কি করিয়া আপনার স্তব করিতে হয়; আমাকে তাহা শিখাইয়া দিন।” বলিতে বলিতে শ্রীহরির কৃপায় তাহার জ্ঞান হইল। তখন সে প্রাণ ভরিয়া অতি মধুর বাক্যে শ্রীহরির স্তব করিতে করিতে বলিল, “বিমাতা আমাকে ধমকাইয়া বলিয়াছেন, যে তাঁহার পুত্র নহি বলিয়া আমি রাজাসনে বসিতে পাইব না। হে প্রভু, আমি আপনার নিকট এমন স্থান চাই যে তাহা সংসারের সকল স্থানের চেয়ে ভালো।” শ্রীহরি বলিলেন, “ধ্রুব, তুমি তাহাই পাইবে। চন্দ্র, সূর্য, বুধ, বৃহস্পতি সকলের উপরে তোমার স্থান হইল। তোমার মাতাও তারা হইয়া তোমার নিকটে থাকিবেন।”  সেই অবধি শ্রীহরির বরে ধ্রুব আকাশে ধ্রুবতারা হইয়া সংসারচক্র ঘুরাইতেছে এইরূপ আমাদের পুরাণে লেখা।
উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী
পিপ্পলাদ উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী পিপ্পলাদ  দধীচি মুনির নাম হয়তো তোমরা অনেকেই শুনিয়াছ। তাঁহার মতন তপস্যা অতি অল্পলোকেই করিয়াছে। মহর্ষি দধীচি অতিশয় শান্ত আর পরম দয়ালু ছিলেন। গঙ্গার ধারে নিজের আশ্রমে থাকিয়া পত্নী প্রাতিথেয়ীকে লইয়া ভগবানের নাম করা, গাছপালার প্রতি যত্ন, সকল জীবে দয়া আর অতিথি আসিলে তাহার সেবা করা, এ সকল ছাড়া তাঁহার আর কাজ ছিল না। কিন্তু এই নিরীহ লোকটির তপস্যার এমনি তেজ ছিল যে, তাহার ভয়ে অসুরেরা তাঁহার আশ্রমের কাছে আসিতেই থরথর করিয়া কাঁপিত। অথচ দেবতাদিগকে সেই অসুরেরা জ্বালাতনের একশেষ করিত। কতকাল ধরিয়া যে ইঁহাদের যুদ্ধ চলিয়াছিল, তাহার ঠিকানাই নাই। সেই যুদ্ধে কখনো দেবতারা জিততেন, কখনো বা অসুরদিগের নিকট হারিয়া বিধিমতে নাকাল হইতেন। যাহা হউক, একবার দেবতারা নানারকমের আশ্চর্য আশ্চর্য অস্ত্র সংগ্রহ করিয়া অসুরদিগকে খুবই হারাইয়া দিলেন। তারপর তাঁহাদের এই চিন্তা হইল যে, এ সকল অস্ত্রের কাজ তো ফুরাইল, এখন এগুলোকে কোথায় রাখা যায়? যুদ্ধ করিয়া শরীব অত্যন্ত কাহিল হইয়াছে, এগুলোকে আর স্বর্গে বহিয়া নেওয়ার শক্তি নাই, সেখানে লইয়া গেলেও হয়তো আবার কোনদিন অসুরেরা আসিয়া কাড়িয়া নিবে।  শেষে অনেক ভাবিয়া চিস্তিয়া তাঁহারা দধীচির নিকট আসিয়া বলিলেন, “মুনিঠাকুর, আমাদের এই অস্ত্রগুলি যদি দয়া করিয়া আপনার নিকট রাখেন, তবে আমাদের বড় উপকার হয়। আপনার কাছে থাকিলে আর দৈত্যেরা এগুলি চুরি করিতে পারিবে না।” এ কথায় দধীচি সবে বলিয়াছিলেন, “যে আজ্ঞা” অমনি প্রাতিথেয়ী তাঁহাকে বাধা দিয়া বলিলেন, “ওগো, তুমি এই ফ্যাঁসাদের ভিতরে যাইয়ো না। দেবতা মহাশয়েরা এখন মিষ্ট কথা কহিতেছেন, কিন্তু আমাদের এখানে থাকিয়া যদি জিনিসগুলি নষ্ট হয় বা চুরি যায়, তখন ইঁহারা বড়ই চটিবেন।” দধীচি বলিলেন, “তাই তো এখন আর কি করা যায়? “যে আজ্ঞা” বলিয়া ফেলিয়াছি, এখন তো আর ‘না’ বলা যাইতে পারে না।  কাজেই অস্ত্রগুলি দধীচির আশ্রমেই রহিল, আর দেবতারা তাহাতে যারপরনাই তুষ্ট হইয়া নিজের নিজের ঘরে চলিয়া গেলেন। তারপর এক বৎসর যায়, দু বৎসর যায়, ক্রমে সাড়ে তিনলাখ বৎসর কাটিয়া গেল, তবুও দেবতাদের আর কোনো খোঁজ-খবর নাই। ততদিনে অস্ত্রে মরিচা তো ধরিয়াছেই, তাহা ছাড়া অসুরদের আবার বেজায় তেজ বাড়িয়া উঠিয়াছে। দিনরাত কেবল ঐ অস্ত্রগুলির উপর তাহাদের চোখ;না জানি কখন কোন ফাঁকে সেগুলিকে লইয়া যাইবে। তখন দধীচি ভাবিলেন যে, দেবতারা তো আসিলেনই না, এখন অস্ত্রগুলি যাহাতে অসুরদের হাতে না পড়ে, তাহার উপায় দেখিতে হয়।  সে বড় আশ্চর্য উপায়। জলে মন্ত্র পড়িয়া অস্ত্রগুলিকে তাহা দ্বারা ধুইবামাত্র, তাহাদের সকল তেজ সেই জলে গুলিয়া গেল। সে জল দধীচি তখনই খাইয়া ফেলিলেন, কাজেই আর কোন চিন্তার কথাই রহিল না। তারপর দেখিতে দেখিতে অস্ত্রগুলি আপনা হইতেই ক্ষয় হইয়া গেল, তখন অসুরেরা আর কি নিবে?  দধীচি সবে এই কাজটি করিয়া একটু নিশ্চিন্ত হইয়াছেন, আর ঠিক সেই সময়ে দেবতাদের অস্ত্রগুলির কথা মনে পড়িয়াছে। এতদিন বাদে, এত কাণ্ডকারখানার পরে, তাঁহারা আসিয়া দধীচিকে বলিলেন, “ঠাকুর, অসুরেরা তো আবার ভারি মুশকিল বাধাইয়াছে। শীঘ্র আমাদের অস্ত্রগুলি দিন।”  দধীচি বলিলেন, “তাই তো আপনারা এতদিন আসেন নাই, তাই আমি দৈত্যদের ভয়ে সেগুলি খাইয়া ফেলিয়াছি। এখন কি করি বলুন?”  তাহা শুনিয়া দেবতারা বলিলেন, “আমরা আর কি বলিব? আমরা বলি আমাদের অস্ত্রগুলি দিন। অস্ত্র না পাইলে আর আমাদের বিপদের সীমাই থাকিবে না!”  দধীচি বলিলেন, “সে সকল অস্ত্র তো এখন আমার হাড়ের সহিত মিশিয়া গিয়াছে। আপনারা না হয় সেই হাড়গুলি নিন।”  দেবতারা বলিলেন, “আমাদের অস্ত্রেরই দরকার, আপনার হাড় লইয়া আমরা কি করিব?”  দধীচি বলিলেন, “আমার হাড় দিয়া অতি উত্তম অস্ত্র প্রস্তুত হইবে আমি এখনই দেহত্যাগ করিতেছি।”  কাজেই তখন দেবতারা আর কি করেন? তাঁহারা বলিলেন, “আচ্ছা তবে একটু শীঘ্র শীঘ্র তাহই করুন।”  দেবী প্রাথিতেয়ী তখন ঘরে ছিলেন না, স্নান করিতে গিয়াছিলেন দেবতারা সেই বুদ্ধিমতী, তেজস্বিনী মেয়েকে বড়ই ভয় করিতেন, তাই তাঁহারা ভাবিলেন যে, তিনি ফিরিয়া আসিবার পূর্বেই কাজ শেষ করিতে হইবে। দধীচি যোগাসনে বসিয়া একমনে ভগবানের চিন্তা করিতে লাগিলেন; দেখিতে দেখিতে তাঁহার পবিত্র আত্মা দেহ ছাড়িয়া চলিয়া গেল।  তখন দেবতারা বিশ্বকর্মাকে বলিলেন, “এখন তুমি ইহার হাড় দিয়া অস্ত্রশস্ত্র তয়ের কর।”  বিশ্বকর্মা বলিলেন, “আমি কি করিয়া অস্ত্র তয়ের করিব? ইহার দেহ কাটিলে তবে তো হাড় পাওয়া যাইবে। বাপ রে! সে কাজ আমা দ্বারা হইবে না! হাড়গুলি পাইলে আমি এখনই তাহা দিয়া অস্ত্র গড়িয়া দিতে পারি।”  তখন দেবতাদের কথায় গোরুর দল আসিয়া গুঁতাইয়া মুনির দেহ হইতে হাড় বাহির করিয়া দিল, দেবতারাও মহানন্দে তাহা লইয়া প্রস্থান করিলেন। সেই হাড় দিয়া শেষে বিশ্বকর্মা বজ্র প্রভৃতি নানারূপ আশ্চর্য অস্ত্র প্রস্তুত করিয়াছিলেন।  এদিকে প্রাতিথেয়ী স্নান আহ্নিকের পর কলসী হতে আশ্রমে ফিরিয়া দেখেন, মহর্ষি নাই, তাঁহার মাংস, লোম আর চামড়া মাত্র পড়িয়া আছে। ঘরে অগ্নি ছিলেন, তাঁহাকে জিজ্ঞাসা করিয়া দেবী সকল কথাই জানিতে পারিলেন। সেই দারুণ সংবাদ বজ্রাঘাতের ন্যায় তাঁহার চেতনা হরণ করিয়া লইল; তাঁহার দেহ ধূলায় লুটাইয়া পড়িল। জ্ঞান হইলে পর অনেক কষ্টে শোক সম্বরণপূর্বক তিনি দধীচির দেহের অবশিষ্টটুকু লইয়া আগুনে ঝাঁপ দিলেন। যাইবার সময়ে নিজের নিতান্ত শিশুপুত্রটিকে গঙ্গার নিকটে আর গাছপালার নিকটে সঁপিয়া দিয়া বলিয়া গেলেন, “এই পিতৃমাতৃহীন শিশুটিকে তোমরা দয়া করিয়া দেখিবে।”  দধীচিও গেলেন প্রতিথেয়ীও গেলেন। আশ্রম অন্ধকার হইল। তপোবনের পশুপক্ষী আর বৃক্ষলতারা তখন কাঁদিয়া বলিল, “হায়! যাঁহারা আমাদের পিতা মাতার মতো ছিলেন, তাঁহাদের দুজনকেই হারাইলাম। আমাদের কি দুর্ভাগ্য! আর তো আমরা তাঁহাদের সেই পবিত্র মুখ দেখিতে পাইব না। এখন তাঁহাদের এই শিশুটিকে দেখিয়াই আমাদের মন শান্ত থাকিবে।”  এখন হইতে এই শিশুটিকে পালন করাই হইল তাহাদের একমাত্র কাজ। চন্দ্রের নিকট হইতে অমৃত চাহিয়া আনিয়া তাহারা শিশুটিকে খাইতে দিল, সেই অমৃতের গুণে শিশু দেখিতে দেখিতে শুক্লপক্ষের চাঁদের মতো বাড়িয়া উঠিল। পিপুল (অশ্বত্থ) গাছেরা তাহার বড়ই যত্ন করিয়াছিল, তাই তাহার নাম হইল পিপ্পলাদ।  পিপ্পলাদ জানিত, সে সেই সকল গাছপালারই ছানা। তারপর যখন তাহার বুদ্ধি একটু বাড়িয়াছে, তখন সে একদিন তাহাদিগকে জিজ্ঞাসা করিল, “গাছের ছানা তো গাছের মতোই হয়, মানুষের ছানা মানুষের মতো হয়, পাখির ছানা হয় পাখির মতো আর জন্তুর ছানা জন্তুর মতো। কিন্তু আমি যে তোমাদের ছানা, আমার এমন হাত পা হইল কি করিয়া?”  গাছেরা বলিল, “বাছা, তুমি তো আমাদের ছনা নও। তুমি মুনির পুত্র, তোমার পিতা মহর্ষি দধীচি, মাতা দেবী প্রাতিথেয়ী।”  পিপ্পলাদ বলিল, “আমার বাবা আর মা তবে কোথায় গেলেন?” গাছেরা বলিল, “তোমার পিতা দেবতাদের উপকারের জন্য প্রাণত্যাগ করিয়াছেন, তোমার মাতা সেই দুঃখে আগুনে ঝাঁপ দিয়াছেন।”  এমনি করিয়া গাছেরা সকল কথাই পিপ্পলাদকে বলিল। তাহা শুনিয়া সে আগে গড়াগড়ি দিয়া কাঁদিল, তারপর গাছেদের মিষ্ট কথায় একটু শান্ত হইয়া রাগে কাঁপিতে কাঁপিতে বলিল, “আমার পিতাকে যাহারা মারিয়াছে, তাহাদিগকে আমি মারিব।”  তখন গাছেরা সেই ছেলেটিকে চন্দ্রের নিকট লইয়া গিয়া সকল কথা বলিল।  তাহা শুনিয়া চন্দ্র বলিলেন, “বৎস পিপ্পলাদ! বল, বুদ্ধি, বিদ্যা, ধন, রূপ, গুণ, সুখ, মান, যশ, পুণ্য সকলই আমি তোমাকে দিতেছি, তুমি গ্রহণ কর।”  পিপ্পলাদ বলিল, “আমার পিতাকে যাহারা মারিয়াছে, তাহাদিগকে যদি না মারিতে পারিলাম, তবে এ সব লইয়া আমার কি হইবে? আগে বলুন, কোথায়, কোন দেশে, কোন তীর্থে গিয়া, কি মন্ত্র বলিয়া, কোন দেবতাকে ডাকিয়া আমি এ কাজ করিতে পারিব?”  চন্দ্র বলিলেন, “শিবকে ডাক, তোমার কাজ হইবে।”  পিপ্পলাদ বলিল, “আমি যে ছেলেমানুষ, আমি তো কিছুই জানি শুনি না আমি কেমন করিয়া তাঁহাকে ডাকিব?”  চন্দ্র বলিলেন, “তুমি চক্রেশ্বর তীর্থে গিয়া ভক্তিভরে তাঁহার কথা ভাব, আর তাঁহাকে ডাক, তবেই তিনি আসিবেন।”  পিপ্পলাদ তখনই সেই তীর্থে গিয়া প্রাণপণে শিবকে ডাকিতে লাগিল সেই ডাকে শিব তাহার সম্মুখে আসিয়া বলিলেন, “পিপ্পলাদ, কি চাহ?”  পিপ্পলাদ বলিল, “আমার দেবতুল্য ধার্মিক পিতামাতাকে যাহারা মারিয়াছে, আমি তাহাদিগকে মারিতে পারি, এমন ক্ষমতা আমাকে দিন।”  শিব কহিলেন, “আচ্ছা, তুমি যদি আমার তিনটা চোখই দেখিতে পার, তাহা হইলে দেবতাদিগকে মারিতে পারিবে।”  কিন্তু পিপ্পলাদ অনেক চেষ্টা করিয়াও তাঁহার দুইটা বৈ চোখ দেখিতে পাইল না।  তখন শিব বলিলেন, “আর কিছুদিন তপস্যা কর, দেখিতে পাইবে।”  এ কথায় পিপ্পলাদ এমনি ভয়ংকর তপস্যা আরম্ভ করিল যে, অল্পদিনের ভিতরেই সে দেখিল, শিবের কপালে আর একটি চোখ আছে। তখন শিবের সেই চোখ হইতে আগুনের ঘোড়ার মতন একটা ভয়ংকর ‘কৃত্যা’ (ভূত) বাহির হইয়া ঘোরতর শব্দে পিপ্পলাদকে বলিল, “কি করিব?”  পিপ্পলাদ বলিল, “দেবতাদিগকে ধরিয়া খাও!”  বলিতে বলিতেই সেটা খপ্‌ করিয়া পিপ্পলাদকে ধরিয়া মুখে দিতে গিয়াছে!  পিলাদ ভয়ানক থতমত খাইয়া চ্যাঁচাইয়া বলিল, “আরে, আরে, ও কি কর?”  সেটা বলিল,“দেবতাদিগকে খাইতে হইলে, তাহারা যে তোমার শরীর গড়িয়াছে তাহাও খাইব।”  একথায় পিপ্পলাদ আবার শিবের স্তব করিলে, শিব সেই ভয়ংকর জিনিসটাকে বলিলেন, “এ স্থানের এক যোজনের মধ্যে তুমি কাহাকেও খাইতে পারিবে না!” তখন সেই ভূতটা সেখান হইতে দূরে গিয়া এমনই সর্বনেশে আগুন জ্বালাইয়া বসিল যে, আর একটু হইলেই সে দেবতার দলকে পোড়াইয়া শেষ করিত! দেবতারা প্রাণের ভয়ে কাঁপিতে কাঁপিতে শিবের নিকট আসিয়া বলিলেন, “রক্ষা করুন প্রভু! আপনার ভূত আমাদিগকে পোড়াইয়া মারিল। আপনি রক্ষা না করিলে এ যাত্রা আর আমাদের উপায় নাই।”  শিব তাঁহাদিগকে বলিলেন, “তোমরা এইখানে আসিয়া বাস কর। এখানে ওটা তোমাদের কিছু করিতে পারিবে না।”  দেবতারা বলিলেন, “স্বর্গ আমাদের বাসস্থান, তাহা ছাড়িয়া এখানে কি করিয়া থাকি?”  শিব কহিলেন, “তবে এক কাজ কর;সূর্যই হইতেছেন এই সংসারের পিতা। তিনি আসিয়া এখানে বাস করুন, তাহাতেই সকল দেবতার বাস করা হইবে।” এইরূপে তখনকার মতো বিপদ কাটিয়া গেল।  তারপর শিবের উপদেশে পিপ্পলাদের রাগও দূর হইল। তখন শিব অনেকবার পিপ্পলাদকে বর লইতে বলিলেন। পিপ্পলাদ এমন সব বর প্রার্থনা করিল, যাহাতে জগতের উপকার হয়। নিজের জন্য সে কিছুই চাহিল না।  ইহাতে দেবতাগণ যারপরনাই তুষ্ট হইয়া তাহাকে বলিলেন, “বাছা, তুমি তো তোমার নিজের জন্য কিছুই চাহিলে না। আমরা তোমাকে বর দিব, তুমি তোমার নিজের জন্য কিছু চাহিয়া লও।”  তখন পিপ্পলাদ জোড়হাতে দেবতাদিগকে নমস্কার করিয়া বলিল, “আমার পিতামাতার পবিত্র নাম কানে শুনিয়াছি মাত্র, তাঁহাদিগকে দেখিবার সুখ এই অভাগার ভাগ্যে ঘটে নাই, ইহাতে আমার মন বড় অস্থির থাকে।”  দেবতারা বলিলেন, “সেজন্য তুমি কিছুমাত্র দুঃখিত হইয়ো না, এখনই তোমার পিতামাতাকে দেখিতে পাইবে।”  এ কথা শেষ হইতে না হইতেই পিপ্পলাদের পিতামাতা দিব্য কেশ পরিয়া, সোনার রথে চড়িয়া স্বর্গ হইতে আসিয়া উপস্থিত হইলেন। পিপ্পলাদ অমনি তাঁহাদের পায়ে লুটাইয়া পড়িল, কিন্তু তাঁহাদের মুখের দিকে চাহিয়া ক্রমাগত চোখের জল ফেলা ভিন্ন আর একটিও কথা কহিতে পারিল না।  দধীচি ও প্রাতিথেয়ী তাহাকে অনেক আদর, অনেক আশীর্বাদ করিয়া, তাহার মনের সকল দুঃখ দূর করিয়া, আবার স্বর্গে চলিয়া গেলেন।  এইভাবে সকল দিকেই সুখ হইল, এখন পিপ্পলাদের সেই ভয়ংকর ভূতটা থামিলেই আর কোনো কথা ছিল না।  দেবতারা বলিলেন, “পিপ্পলাদ, তোমার এটাকে থামাও।”  পিপ্পলাদ বলিল, “সে সাধ্য তো আমার নাই। আপনারা গিয়া উহাকে থামিতে বলুন; আমাকে দেখিলে আবার কি না জানি করিতে চাহিবে।”  সে কথায় দেবতারা সেই ভয়ংকর জিনিসটার কাছে গিয়া তাহাকে থামিতে বলিলেন।  সে তাহাতে খেঁকাইয়া বলিল, “তাহা হইবে না! সকলকে খাইব, তবে তো থামিব। তাহার আগে আমার এ আগুন কিছুতেই নিভিবার নয়। বাস্তবিক, ইহাকে থামাইতে দেবতাদের বড়ই বেগ পাইতে হইয়াছিল। সে অনেক কথা, এখন আমার তাহা বলিবার অবসর নাই।
উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী
পৃথিবীর পিতা উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী সকলের আগে যাঁহাকে লোকে রাজা বলিয়াছিল, তাঁহার নাম ছিল পৃথু। তিনি সূর্যবংশের লোক ছিলেন, তাঁহার পিতার নাম ছিল বেণু। ‘রাজা’ কিনা, যে ‘রঞ্জন’ করে অর্থাৎ খুশি রাখে। পৃথু নানারকমে প্রজাদিগকে খুশি করিয়াছিলেন, তাই সকলে মিলিয়া তাঁহাকে ‘রাজা; নাম দিয়াছিল। পৃথুর পূর্বে লোকের দিন বড়ই কষ্টে যাইত। সেকালে গ্রাম নগর পথঘাট কিছুই ছিল না, ঝোপে জঙ্গলে, পর্বতের গুহায় সকলে বাস করিত। পৃথু তাহাদিগকে বাড়ি-ঘর বাঁধিয়া এক জায়গায় থাকিতে শিখান। আর পথ বানাইয়া চলাফেরার সুবিধা করিয়া দেন। সেই হইতে শহর বস্তির সৃষ্টি হইল। সে কালের লোকে চাষবাস করিতে জানিত না। ফলমূল খাইয়া অতি কষ্টে দিন কাটাইত। জমিতে কাঁকর, আকাশে মেঘ নাই, খটখটে শুকনো মাটি ফাটিয়া চৌচির হইয়া আছে। তাহাতে শস্য জন্মাইতে গেলেও তাহা হয় না। প্রজারা পৃথুকে বলিল, “হে রাজা, পৃথিবী সকল শস্য খাইয়া বসিয়াছে, আমরা কেমন করিয়া বাঁচিত? ছধায় বড়ই কষ্ট পাইতেছি আমাদিগকে শস্য আনিয়া দাও।“ পৃথু বলিলেন, ‘বটে, পৃথিবীর এমন কাজ? শস্য সব খাইয়া বসিয়াছে? আচ্ছা ইহার সাজা দিতেছি। আন তো রে ধনুক, নিয়ে আয় তো তীর!’ পৃথিবী ভাবিল, ‘মাগো, মারিয়াই ফেলে বুঝি।’ সে প্রাণের ভয়ে গাই সাজিয়া লেজ উঁচু করিয়া ছুটিয়া পলাইতে লাগিত। কিন্তু পৃথুর বড়ই রাগ হইয়াছিল, তিনি তাহাকে কিছুতেই ছাড়িলেন না। আকাশ পাতাল ঘুরিয়া বেড়াইতে লাগিল, ব্রহ্মলোক অবধি ছুটিয়া গেল, কিছুতেই সে তাঁহাকে এড়াইতে পারিল না। তখন পৃথিবী কাঁপিতে কাঁপিতে বলিল, ‘দোহাই মহারাজ! আমি স্ত্রীলোক, আমাকে মারিলে আপনার পাপ হইবে।’ পৃথু বলিলেন, ‘তুমি ভারি দুষ্ট। তোমাকে মারিলে অনেক উপকার হইবে। কাজেই ইহাতে পাপ নাই, বরং পুণ্য আছে।’ পৃথিবী বলিল, ‘প্রজাদের যে উপকার হইবে বলিতেছেন, আমি মরিলে তাহারা থাকিবে কোথায়?’ পৃথু বলিলেন, ‘কেন? আমি তপস্যা করিয়া তাহাদের থাকিবার জায়গা করিব।’ পৃথিবী বলিল, “আমাকে মারিলে শস্য পাওয়া যাইবে না। শস্য পাইবার উপায় আমি বলিতেছি। সে আর এখন শস্য নাই, আমর পেটে হজম হইয়া দুধ হইয়া গিয়াছে। আমাকে দোহাইলে সেই দুধ পাইতে পারেন। কিন্তু একটি বাছুর চাই, নহিলে দুধ বাহির হইবে না। আর জমির উঁচু নিচু দূর করিয়া দিন, যেন দুধ দাঁড়াইতে পারে, গড়াইয়া না চলিয়া যায়।“ রাজা তখনই ধনুকের আগা দিয়া জমির উপরকার ঢিপি সরাইয়া দিলেন। তাহাকে জমি সমান হইল, আর ঢিপি-সকল এক-এক জায়গায় জড়ো হইয়া পর্বতের সৃষ্টি হইল। সমান জমির উপরে লোকে ঘর-বাড়ি বাঁধিল। সেই হইতেই গ্রাম নগরের সৃষ্টি, তাহার আগে এ সব ছিল না। জমি সমান হইল, এখন একটি বাছুর হইলেই গাই দোহাইয়া সেই জমির উপরে দুধ ছড়ান যাইতে পারে। সেই বাছুর হইলেন স্বয়ম্ভূব মনু। এমন বাছুর তো আর সহজে পাওয়া যায় না, তাঁহাকে দেখিয়াই গাইয়ের বাঁট দিয়া দুধ ঝরিতে লাগিল। তখন পৃথু নিজ হাতে গাই দোহাইতে লাগিলেন। সে আশ্চর্য গাই না জানি কতই দুধ দিয়াছিল। সংসারে যত শস্য, সকলই তাহাকে দোহাইয়া পাওয়া গেল, সেই শস্য খাইয়া এখনো আমরা বাঁচিয়া আছি। শুধু তাহাই নহে, পৃথুর পরে দেব, দানব, যক্ষ, রাক্ষস প্রভৃতি সকলে আসিয়া সেই গাই দোহাইতে লাগিল। সকলেই নিজের নিজের বাসন আনিল। নিজের এক একটি বাছুর ঠিক করিয়া আনিল, দোহাইবার লোক অবধি আনিতে ভুলিল না। কেহ সোনার বাসনে, কেহ রূপার বাসনে, কেহ লোহার হাঁড়িতে, কেহ পাথরের বাটিতে, কেহ লাউয়ের খোলায়, কেহ পদ্মপাতায় এমনি করিয়া তাহারা কতরকমের জিনিসে যে দোহাইয়া নিল, তাহা বলিয়া শেষ করা যায় না। তথাপি দুধে কম পড়ে নাই। পৃথিবীও বাঁচিয়া গেল। এত জিনিস যাহার কাছে পাওয়া যায়, তাহাকে কি বুদ্ধিমান লোকে মারে? কাজেই পৃথু তাহাকে ছাড়িয়া দিলেন। পৃথু তাহাকে প্রাণদান করিয়াছিরেন, তাই আজও পৃথিবী বাঁচিয়া আছে- আর, প্রাণ দিয়াছিলেন বলিয়াই পৃথু পৃথিবীর পিতার তুল্য হইলেন। সেইজন্যেই পৃথিবীকে পৃথুর কন্যা বলা হয়, আর তাহার নাম হইয়াছে ‘পৃথিবী’ বা ‘পৃথ্বী’। যাহা হউক, পৃথিবীর নামের অন্যরূপ অর্থও দেখা যায়। পৃথ্বী বলিতে খুব বড়ও বুঝায়। পৃথিবী যে খুবই বড়, তাহাও তো আমরা দেখিতেই পাইতেছি। সুতরাং পৃথিবী নাম যথার্থই হইয়াছে।
উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী
প্রথম কবি ও প্রথম কাব্য উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী তমসা নদীর ধারে বাল্মীকি মুনির তপোবন ছিল। দুধারে গভীর বন, তাহার মাঝখান দিয়া সুন্দর ছোট নদীটি কুলকুল করিয়া বহিতেছে। তাহার জল এতই পরিষ্কার যে তলার বালি অবধি স্পষ্ট দেখিতে পাওয়া যায়। একটুও কাদা নাই, একগাছিও শ্যাওলা নাই। কাচের মতো টলমল করিতেছে। বাল্মীকি নদীর ধারে বেড়াইতে আসিলেন, আর সেই নির্মল জল দেখিয়া তাঁহার মনে বড়ই সুখ হইল। সঙ্গে তাঁহার শিষ্য ভরদ্বাজ ছিলেন, তাঁহাকে তিনি বলিলেন, “দেখ ভরদ্বাজ, নদীর জল কি নির্মল, যেমন সাধু লোকের মন। আমার বল্কল দাও, আমি এখানে স্নান করিব।” সেই খানে দুটি বক নদীর ধারে খেলা করিতেছিল। এমন সুন্দর দুটি পাখি এবং তাহাদের এমন মিষ্ট ডাক, আর তাহারা মনের আনন্দে এমনি চমৎকার খেলা করিতেছিল যে দেখিয়া মুনি আর চোখ ফিরাইতে পারিলেন না। পাখি দুটির উপরে মুনির কেমন স্নেহ জন্মিয়া গেল, তিনি স্নানের কথা ভুলিয়া কেবলই তাহাদের খেলা দেখিতে লাগিলেন। এমন সময় কোথা হইতে এক দুষ্ট ব্যাধ আসিয়া পাখি দুটির পানে তীর ছুঁড়িয়া মারিল। এমন সুখে পাখী দুটি খেলা করিতেছিল, তাহাদের কোনো দোষ ছিল না,কোনো বিপদের কথা তাহারা জানিত না। এমন নিরীহ জীবকে বধ করে, এমন নিষ্ঠুরও লোক হয়? তীর খাইয়া পুরুষ পাখিটি যাতনায় ছট্‌ফট্‌ করিতে লাগিল, মেয়েটি শোকে আর ভয়ে কাঁদিয়া আকুল হইল। মুনি আর এ দুঃখ সহিতে না পারিয়া ব্যাধকে বলিলেন, “ওরে ব্যাধ, এমন সুখে পাখিটি খেলা করিতেছিল, তাহাকে তুই বধ করিলি? তোর কখনই ভালো হইবে না!” দয়ালু মুনির মনের দুঃখ তাঁহার চোখের জলের সঙ্গে সঙ্গে এই কথাগুলির ভিতর দিয়া ফুটিয়া বাহির হইল। সেই কথায় আপনা হইতেই ছন্দ আসিয়া আপনা হইতেই তাহা কবিতা হইয়া গেল। সেই কবিতাই সকলের প্রথম কবিতা, তাহার পূর্বে কেহ কবিতা রচনা করে নাই। মুনি আশ্চর্য হইয়া বলিলেন, “এ কি চমৎকার কথা আমি বলিলাম! আমি কিছুই জানি না, তবু ইহাতে বীণার ছন্দের মতন কেমন সুন্দর ছন্দ হইল! ইহার চারিভাগে সমান সমান অক্ষর হইল! আমি বলি, ইহার নাম ‘শ্লোক’ হউক, কেননা আমার শোকের সময় ইহা আমার মুখ দিয়া বাহির হইয়াছে।” ভরদ্বাজও বলিলেন, ‘গুরুদেব! কি সুন্দর কথা, এমন কথা তো আর কেহ কখনো বলে নাই। ইহার নাম শ্লোকই হউক।” তারপর মুনি স্নান শেষে ঘরে আসিয়া সেই পাখির আর সেই সুন্দর ছন্দের কথা ভাবিতেছেন, এমন সময় ব্রহ্মা আসিয়া সেখানে উপস্থিত হইলেন, পাখি দুইটির দুঃখে কাতর হইয়া মুনি আর ব্রহ্মাকে অন্য কথা বলিবার অবসর পাইলেন না, তাঁহাকে সেই দুষ্ট ব্যাধের কথা বলিয়া সেই কবিতাটি গাহিয়া শুনাইলেন। তাহা শুনিয়া ব্রহ্মা বলিলেন, “বাল্মীকি, তোমার এ কবিতার নাম শ্লোকই হউক। এইরূপ শ্লোক লিখিয়া তুমি রামের বৃত্তান্ত বর্ণনা কর। সে বড় সুন্দর কাহিনী, তাহা যে পড়িবে, তাহারই মঙ্গল হইবে। তুমি যাহা লিখিবে, তাহার একটি কথাও মিথ্যা হইবে না। যতদিন পৃথিবীতে পর্বত আর নদী সকল থাকিবে, ততদিন লোকে তোমার ‘রামায়ণে’র আদর করিবে। আর ততদিন রামায়ণের আদর থাকিবে, তুমি স্বর্গে গিয়া ততদিন আমার লোকে থাকিতে পাইবে।” এই বলিয়া ব্রহ্ম চলিয়া গেলেন, আর তাঁহার কথাগুলি মনে করিয়া বাল্মীকি বলিলেন, “এইরূপ মিষ্ট শ্লোক দিয়া আমি রামায়ণ রচনা করিব।” তারপর সেই ধার্মিক কুশাসনে বসিয়া জোড়হাতে ভগবানকে স্মরণপূর্বক রামায়ণ লিখিতে আরম্ভ করিলেন। ক্রমে রামায়ণ শেষ হইল। তখন মুনি ভাবিলেন, ‘কাব্য তো শেষ হইল, এখন ইহা গাহিবে কে? ঠিক সেই সময়ে ‘কুশী’ ‘লব’ দুই ভাই আসিয়া তাঁহাকে প্রণাম করিলেন। দুটি ভাই রামেরই পুত্র, মুনির বেশে সেই আশ্রমে থাকিয়া লেখাপড়া শিখেন। দেবতার মতন সুন্দর, গন্ধর্বের মত মিষ্ট গান গাহেন। মুনি বলিলেন, “এই আমার রামায়েণের উপযুক্ত গায়ক।” সেই দুটি ভাইকে পরম যত্নের সহিত মুনি রামায়ণ শিক্ষা দিলেন। তারপর একদিন সকল মুনিদিগকে সভায় ডাকিয়া সেই রামায়ণের গান তাঁহাদিগকে শোনানো হইল। মুনিরা সকেল মোহিত হইয়া সে গান শুনিলেন, তাঁহাদের চোখ দিয়া দরদর ধারে জল পড়িতে লাগিল, আর মুখ দিয়া ক্রমাগত কেবল “আহা!” “আহা!” এই শব্দ বাহির হইতে লাগিল। শেষে তাঁহারা আর স্থির থাকিতে পারিলেন না। একজন মুনি তাঁহার নিকটে যাহা কিছু ছিল, সকলই কুশী-লবকে দিয়া দিলেন। অন্যেরা কেহ বল্কল, কেহ হরিণের ছাল, কেহ কমণ্ডলু, কেহ কুড়াল, কেহ কৌপীন দিলেন। একজন মুনি কাঠ আনিতে চাহিয়াছিলেন, সেই কাঠ বাঁধিবার দড়িগাছি ভিন্ন তাঁহার নিকটে আর কিছু ছিল না, তিনি সেই দড়িগাছিই কুশীলবকে দিয়া বারবার আশীর্বাদ করিলেন।
উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী
বিষ্ণুর অবতার উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী বিষ্ণুর অবতার  পুরাণে আছে যে, বিষ্ণু সময় সময় নানারূপ জন্তু ও মানুষের রূপ ধরিয়া অনেক আশ্চর্য কাজ করিয়াছিলেন। বিষ্ণুর এইসকল রূপ ধারণকে তাহার এক একটি ‘অবতার’ বলা হয়।  এই যে সৃষ্টি তাহার জীবন নাকি এক কল্প কাল। এক এক কল্প পরে ‘প্রলয়’ অর্থাৎ সৃষ্টিনাশ হইয়া আবার নাকি নূতন সৃষ্টি হয়। এখনকার এই জগতের সৃষ্টি হইবার পূর্বে আর এক জগতের প্রলয় হইয়াছিল। বিষ্ণু তাহার পূর্বেই বুঝিতে পারিয়াছিলেন যে প্রলয়ের কাল উপস্থিত হইয়াছে। তখন তিনি একটি খুব ছোট মাছের রূপ ধরিয়া কৃতমালা নামক নদীতে গিয়া উপস্থিত হইলেন। সেই সময়ে সূর্যের পুত্র বৈবস্বত মনু সেই নদীর নিকটে থাকিয়া তপস্যা করিতেছিলেন। একদিন মনু কৃতমালার জলে নামিয়া তর্পণ করিতেছেন, এমন সময় হঠাৎ তিনি দেখিলেন যে একটি নিতান্ত ছোট মাছ তর্পণের জলের সঙ্গে তাঁহার অঞ্জলির ভিতর উঠিয়াছে।  সেই মাছটিই ছিলেন বিষ্ণু, কিন্তু মনু তাহা জানিতেন না। তিনি মাছটিকে জলে ফেলিয়া দিতে যাইবেন, এমন সময় সে তাঁহাকে মিনতি করিয়া বলিল, “আমাকে জলে ফেলিবেন না। বড় মাছেরা আমাকে খাইয়া ফেলিবে।” এ কথায় মনু তাহাকে তাঁহার ঘরে আনিয়া কলসীর ভিতরে রাখিয়া দিলেন। কিন্তু সে মাছ এত তাড়াতাড়ি বাড়িতে লাগিল যে দেখিতে দেখিতে আর সে সেই কলসীতে ধরে না। কলসী হইতে চৌবাচ্চায় রাখিলেন, খানিক পরেই আর সে তাহাতেও ধরে না; চৌবাচ্চা হইতে পুকুরে রাখিলেন, শেষে তাহাতেও ধরে না, সেখান হইতে হ্রদে রাখিলেন, ক্রমে তাহাও তাহার পক্ষে ছোট হইয়া গেল।  তখন মনু তাঁহাকে কাঁধে করিয়া সমুদ্রের জলে ফেলিবামাত্র সে লক্ষ যোজন বড় হইয়া যাওয়ায়, তিনি যারপরনাই আশ্চর্যাম্বিত হইয়া বলিলেন, “ভগবন্‌, আপনি কে? আপনি নিশ্চয় স্বয়ং বিষ্ণু! আপনাকে নমস্কার।” মাছ বলিল, “তুমি ঠিক বুঝিয়াছ আমি দুষ্টের দমন আর শিষ্টের পালনের নিমিত্ত মৎস্যরূপ ধারণ করিয়াছি। আজ হইতে সাতদিনের মধ্যে সকল সৃষ্টি সাগরের জলে ডুবিয়া যাইবে। সেই সময়ে তোমার নিকট একখানি নৌকা আসিবে, তুমি সপ্তর্ষিদিগকে আর সকল জীবের দুটি দুটিকে সঙ্গে লইয়া তাহাতে উঠিয়া বসিও তখন আমিও আবার আসিব, আমার শিঙে তোমার নৌকাখানাকে বাঁধিয়া দিও। এই বলিয়া বিষ্ণু চলিয়া গেলেন; তারপর ক্রমে তাঁহার কথামতো সমস্তই ঘটিতে লাগিল। সমুদ্র উথলিয়া উঠিল, নৌকা আসিল, সেই মাছও আসিয়া দেখা দিল—সে এখন দশ লক্ষ যোজন বড়, তাহার দেহ সোনার, আর মাথায় একটা শিং। সেই শিঙে নৌকা বাঁধিয়া দিলে আর কোনো বিপদের আশঙ্কা রহিল না।  ইহাই হইল বিষ্ণুর মৎস্যাবতার, তারপর কূর্মাবতার। সমুদ্রের ভিতর অমৃত ছিল, সেই অমৃত পাইবার জন্য দেবতারা দৈত্যগণের সহিত মিলিয়া সমুদ্রকে মন্থন করিয়াছিলেন। সেই মন্থনের দণ্ড হইয়াছিল মন্দার পর্বত, আর দড়ি হইয়াছিল বাসুকি নাগ। মন্থন আরম্ভ হওয়ামাত্রই সেই পর্বত জলের ভিতরে ঢুকিয়া যাইতে লাগিল, কাজেই দেবতারা দেখিলেন যে তাঁহাদের সকল পরিশ্রমই মাটি হইতে চলিয়াছে। সেই সময় বিষ্ণু বিশাল কচ্ছপের রূপ ধরিয়া পর্বতটাকে পিঠে করিয়া লইয়াছিলেন, নচেৎ নিশ্চয় তাহা একেবারেই তল হইয়া যাইত, মন্থন অসম্ভব হইত, দেবতাদের ভাগ্যেও আর অমৃত খাওয়া ঘটিত না।  কূর্মাবতারের পর বরাহবতার। হিরণ্যাক্ষ আর হিরণ্যকশিপু নামে দুইটা ভারি ভয়ানক দৈত্য ছিল। দেবতাদিগকে যে তাহারা কিরূপ নাকাল করিয়াছিল, সে আর বলিবার নহে। হিরণ্যাক্ষ ছেলেবেলায় হাতি আর সিংহে চড়িয়া সূর্যটাকে লইয়া খেলা করিত। তারপর একদিন সে করিল কি, কুকুর যেমন মুখে করিয়া পিঠা লইয়া ছুট দেয়, তেমনিভাবে সে পৃথিবীটাকে মুখে লইয়া জলের ভিতরে গিয়া ঢুকিল। ইহাতে ব্রহ্মা নিতান্তই ব্যস্ত হইয়া পড়িলেন। কিন্তু তাঁহার এমন শক্তি হইল না যে দুষ্ট দৈত্যের মুখ হইতে পৃথিবীটাকে ছিনাইয়া আনেন। তখন তিনি উপায় না দেখিয়া বিষ্ণুর স্তব আরম্ভ করিলেন। বিষ্ণু একটা শূকরের বেশ ধরিয়া তাঁহার নাকের ভিতর হইতে বাহির হইয়া আসিলেন। তারপর সেই শূকর বাড়িতে বাড়িতে পর্বতপ্রমাণ হইয়া জলের দিকে ছুটিয়া চলিল।  সেই জলের নিকটে নারদ মুনি ছিলেন, তিনি সেই শূকরকে দেখিয়াই চিনিতে পারিয়া জোড়হাতে বলিলেন, “আজ্ঞা করুন কি করিব।” শূকর বলিল, “আমি যতক্ষণ হিরণ্যাক্ষের সঙ্গে যুদ্ধ করিব, ততক্ষণ তুমি কেবলই জল শুষিতে থাকিবে।” নারদ দুহাতে জল তুলিয়া ক্রমাগত মুখে দিতে লাগিলেন, যতক্ষণ না হিরণ্যাক্ষের সহিত বিষ্ণুর যুদ্ধ শেষ হইয়াছিল, ততক্ষণ তিনি থামেন নাই। সেই যুদ্ধ জলে পাঁচশত বৎসর, আর স্থলে পাঁচশত বৎসর, সব সুদ্ধ এক হাজার বৎসর চলিয়াছিল। তারপর সেই শূকর হিরণ্যাক্ষকে মারিয়া মুখে করিয়া, পৃথিবীকে জল হইতে তুলিয়া আনিয়া ব্রহ্মাকে দিল।  ইহার পর নৃসিংহবতার। এবারে বিষ্ণু অর্ধেক মানুষের আর অর্ধেক সিংহের মতো অতি ভীষণ মূর্তি ধারণ করিয়া হিরণ্যাক্ষের ভাই হিরণ্যকশিপুকে বধ করিয়াছিলেন। হিরণ্যাক্ষের মৃত্যুতে ভয়ানক রাগিয়া গিয়া হিরণ্যকশিপু তাহার প্রতিশোধ লইবার জন দশ হাজার বৎসর ঘোরতর তপস্যা করে। তাহার দেহে গাছ হইল, তাহাতে পাখিরা বাসা করিল, তথাপি সে তপস্যা ছড়িল না। তখন ব্রহ্মা আর থাকিতে না পারিয়া তাহাকে বর দিতে আসিলে, সে বলিল, “আপনার সৃষ্ট কোনো বস্তু বা জীব আমাকে বধ করিতে পারবে না, এই বর আমাকে দিন।” ব্রহ্মা সেই বর তাহাকে দিয়া চলিয়া গেলেন, আর অমনি সেই দৈত্য তাহার জ্ঞাতিবন্ধুগণের সহিত মিলিয়া সৃষ্টি তোলপাড় করিয়া তুলিল। ইন্দ্র, বরুণ, কুবের কাহাকেও সে নিশ্চিন্ত হইয়া থাকিতে দিল না, সকলেরই ধনসম্পত্তি কাড়িয়া লইল। তখন দেবতাগণ তাহার জ্বালায় অস্থির হইয়া বিষ্ণুর নিকট নিজ নিজ দুঃখ জানাইলে বিষ্ণু বলিলেন, “তোমাদের কোনো ভয় নাই, আমি শীঘ্রই এই দৈত্যকে বধ করিয়া তোমাদের দুঃখ দূর করিব।”  কিন্তু বিষ্ণুর উপরেই হিরণ্যকশিপুর সর্বাপেক্ষা অধিক রাগ ছিল। সে তাঁহার পূজা বন্ধ করিয়া দিবার জন্য কোনো চেষ্টারই ত্রুটি করে নাই। তাহার নিজের পুত্র প্রহ্লাদ বিষ্ণুভক্ত ছিল, সেজন্য দুষ্ট দৈত্য সেই বালককে কি ভীষণ যন্ত্রণাই দিয়াছিল। কিন্তু প্রহ্লাদ কিছুতেই হরিনাম পরিত্যাগ করে নাই। হিরণ্যকশিপু প্রহ্লাদকে জিজ্ঞাসা করিল, “তোর হরি কোথায় আছে?” প্রহ্লাদ বলিল, “তিনি সর্বত্রই আছেন।” হিরণ্যকশিপু একটা থাম দেখাইয়া জিজ্ঞাসা করিল, “এই থামের ভিতর আছে?” প্রহ্লাদ বলিল, “অবশ্য আছেন।” হিরণ্যকশিপু তখন খড়গ লইয়া মহারোষে সেই স্তম্ভে আঘাত করিল। আমনি বজ্রপাতের ন্যায় ভীষণ গর্জনে বিষ্ণু সেই স্তম্ভের ভিতর হইতে বাহির হইলেন, তাঁহার দেহ অর্ধেক মানুষের, অর্ধেক সিংহের ন্যায়; নখ অতি ভীষণ; কেশর উড়িয়া মেঘে ঠেকিয়াছে মুখ দিয়া আগুন বাহির হইতেছে। দৈত্যেরা ক্ষণমাত্র তাঁহার সহিত ভীষণ যুদ্ধ করিল। কিন্তু সেই ভয়ংকর নৃসিংহ মূর্তি নিজের নিঃশ্বাস দ্বারাই আর সকল দৈত্যকে মুহূর্তে ভস্ম করিয়া, দেখিতে দেখিতে হিরণ্যকশিপুর বুক নখে চিরিয়া তাহার রক্ত খাইতে আরম্ভ করিলেন।  এত করিয়াও সেই ভীষণ মূর্তির রাগ দূর হইল না, তাঁহার মুখের আগুনও নিভিল না। তখন দেবতাগণ যারপরনাই ভয় পাইয়া তাঁহাকে থামাইবার উপায় দেখিতে লাগিলেন কিন্তু কাহারও তাঁহার নিকটে যাইতে ভরসা হইল না। ইন্দ্র বলিলেন, “আমার চোখ ঝলসিয়া যাইবে।” ব্রহ্মা বলিলেন, “আমার দাড়ি পুড়িয়া যাইবে।”  গণেশ অনেক সাহস করিয়া তাঁহার ইঁদুরে চড়িয়া কিছুদূর আসিয়াছিলেন, কিন্তু এর মধ্যে হঠাৎ নৃসিংহের ফুঁ লাগিয়া তাঁহার ইঁদুরটি উলটিয়া যাওয়াতে তাঁহাকে তাঁহার সেই বিশাল ভুঁড়িসুদ্ধ গড়াগড়ি যাইতে হইল।  শেষে আর কোনো উপায় না দেখিতে পাইয়া দেবতাগণ মহাদেবের শরণাপন্ন হইলে, মহাদেব অতি অদ্ভুত শরভের মূর্তি ধরিয়া নৃসিংহের নিকট গিয়া উপস্থিত হইলেন। সেই শরভকে দেখিবামাত্র নৃসিংহের রাগ থামিয়া গেল, সকলের ভয়ও দূর হইল।  দেবতাদিগের সহিত অসুরেরা চিরকালই ঘোরতর শত্রুতা করিত, আর অনেক সময়ই তাহাদের লাঞ্ছনা করিত যতদূর হইতে হয়। প্রহ্লাদের পিতা কি করিয়াছিল, তাহা আমরা পূর্বেই শুনিয়াছি। প্রহ্লাদের নাতি ‘বলি’ও তাহার চেয়ে নিতান্ত কম করে নাই। এদিকে বলি ধার্মিক ছিল খুবই, কিন্তু তাহা হইলে কি হয়? সে যে অসুর, কাজেই দেবতাদের সঙ্গে শত্রুতা না করিয়া থাকিতে পারিত না।  একবার সে ইন্দ্রের সহিত যুদ্ধ করিয়া তাঁহাকে দলবলসুদ্ধ স্বর্গ হইতে তাড়াইয়া দিল। তখন দেবতাগণ আর কি করিবেন? তাঁহারা অতিশয় দুঃখিত হইয়া বিষ্ণুর আশ্রয় লইলেন। এদিকে ইন্দ্রের মাতা অদিতিদেবীও একমনে বিষ্ণুকে ডাকিয়া এই প্রার্থনা করিতে লাগিলেন, “হে দেব। আমাকে এমন একটি পুত্র দান কর, যে এই সকল অসুরকে বধ করিতে পারে।” কিছুকাল এইরূপে প্রার্থনা করার পর বিষ্ণু তাঁহাকে দেখা দিয়া বলিলেন, “মা, তুমি দুঃখ করিও না, আমি নিজেই তোমার পুত্র হইয়া অসুর বধ করিব।”  সেই পুত্রের নাম বামন। এমন সুন্দর ছোট্ট খোকা আর কেহ কখনো দেখে নাই। ঐরূপ ছোট্ট ছিলেন বলিয়াই তাঁহার নাম বামন। দেবতারা তাঁহার স্তব করিতে লাগিলেন, আর কত সুন্দর সুন্দর জিনিস যে তাঁহাকে দিলেন কি বলিব। কেহ দিলেন পৈতা, কেহ দিলেন লাঠি, কেহ কমণ্ডলু, কেহ কাপড়, কেহ বেদ, কেহ জপের মালা।  বড় হইয়াও সেই খোকা তেমনি ছোট্টটিই রহিয়া গেলেন। তারপর একবার বলি এক বিশাল যজ্ঞ আরম্ভ করিল, মুনি-ঋষি কত যে তাহাতে আসিলেন তাহার সংখ্যা নাই। বামনও সেই যজ্ঞের কথা শুনিয়া বেদের মন্ত্র আওড়াইতে আওড়াইতে তথায় গিয়া উপস্থিত হইলেন, বলি দেখিল, কোথা হইতে একটি ছোট্ট মুনি আসিয়াছেন, তাহার মাথায় জটা, হাতে দণ্ড কমণ্ডলু আর ছাতা। সে অতিশয় আদরের সহিত তাহাকে নমস্কার করিয়া জিজ্ঞাসা করিল, “কি ঠাকুর, আপনার কি চাই?” বামন বলিলেন, “আমি তোমার নিকট তিন পা জমি চাই।”  এ কথায় বলি হাসিয়া বলিল, “সে কি ঠাকুর, তিন পা জমি দিয়া কি করিবে? এ তো ছেলেমানুষের কথা। বড়-বড় গ্রাম চাও, টাকাকড়ি লোকজন যত খুশি চাও।”  বামন বলিলেন, “আমার অত জিনিসের দরকার নাই! আমার তিন পা জমি হইলেই চলিবে। বেশি লোভ করা ভালো নয়।”  তখন বলি বলিল, “আচ্ছা, তবে তুমি তিন পা জমিই নাও।” তারপর হাতে জল লইয়া সে বামনকে তিন পা জমি দান করিতে যাইবে, এমন সময় তাহার গুরু শুক্রাচার্য ব্যস্তভাবে তাহাকে বাধা দিয়া বলিলেন, “মহারাজ, কর কি? ওঁকে যে সে লোক ভাবিও না। ইনি আর কেহ নহেন, নিজে বিষ্ণুই বামন সাজিয়া আসিয়াছেন। ইহাকে কিচ্ছুই দিও না, দিলে তোমার সর্বনাশ হইবে।”  বলি বলিল, “সামান্য একজন ভিক্ষুককেও আমি অমনি ফিরাই না,ইঁহাকে কেমন করিয়া ফিরাইব? বিশেষত আমি ‘দিব’ বলিয়াছি।”  এই বলিয়া বলি তিনপাদ ভূমি দান করিবামাত্র দেখিল, সেই খোকা আর খোকা নাই সে এখন আকাশের চেয়েও উঁচু বিরাট পুরুষ হইয়া গিয়াছে। তারপর দেখিতে দেখিতে সেই বিরাট পুরুষে নাভি দিয়া আর একটি পা বাহির হইল। তখন তিনি এক পদে পৃথিবী, এক পদে স্বর্গ আর তৃতীয় পদে স্বর্গেরও উপরে মহর্লোক জনলোক প্রভৃতি ঢাকিয়া ফেলিয়া, বলির যত রাজ্য সকলই কড়িয়া লইলেন। ইহার পর দুষ্ট অসুরগুলিকে বধ করা তো বিষ্ণুর পক্ষে অতি সহজ কাজ। তিনি সে কাজ শীঘ্র শীঘ্র শেষ করিয়া, পুনরায় ইন্দ্রকে ত্রিভুবনের রাজ্য দিয়া দিলেন।  যাহা হউক, বলি ধার্মিক লোক ছিল; সুতরাং শ্রীবিষ্ণু তাহাকে বধ না করিয়া স্নেহের সহিত বলিলেন, “তুমি এক কল্পকাল বাঁচিয়া থাক। এই ইন্দ্রের পরে তুমি ইন্দ্র হইবে। এখন তুমি সুতল নামক পাতালে গিয়া বাস কর। সে অতি সুন্দর স্থান। দেখিও আর কখনো যেন দেবতাদের সঙ্গে বিরোধ করিও না।” তদবধি বলি পাতালে বাস করিতেছে।  ইহাই হইল বিষ্ণুর বামন অবতার। ইহার পরের অবতার পরশুরাম। সে অবতার বিষ্ণু জমদগ্নি মুনির পুত্র হইয়া জন্মগ্রহণ করেন।  সে কালে ক্ষত্রিয়েরা বড়ই উদ্ধত হইয়া উঠিয়াছিল। তাহাদিগকে সাজা দিবার জন্যই পরশুরামের জন্ম।  তখনকার প্রধান ক্ষত্রিয় রাজা ছিলেন কার্তবীর্য, অর্থাৎ কৃতবীর্যের পুত্র, অর্জুন। দত্তাত্রেয়ের বরে অর্জুনের এক হাজার হাত হইয়াছিল। সেই এক হাজার হাতে এক হাজার অস্ত্র লইয়া তিনি দেবতাদিগকে অবধি যুদ্ধে হারাইয়া দিতেন, এজন্য তাঁহার দর্পের আর সীমাই ছিল না।  একবার কার্তবীর্য মৃগয়া করিতে গিয়া বনের ভিতর অতিশয় ক্লান্ত হইয়া পড়েন। সেই সময়ে মহর্ষি জমদগ্নি তাঁহাকে নিমন্ত্রণপূর্বক, নিজের আশ্রমে আনিয়া বিবিধ উপচারে আহার করাইয়াছিলেন। ভালো লোক হইলে ইহাতে সে মুনির প্রতি কতই কৃতজ্ঞ হইত। আর হয়তো তাঁহার কত উপকার হইত। কিন্তু কার্তবীর্য সেরূপ স্বভাবের লোক ছিলেন না। মুনি যে তাঁহাকে কত ক্লেশ হইতে বাঁচাইলেন, সে কথা তাঁহার মনেই আসে না। তিনি একদৃষ্টে কেবল মুনির গাইটিকেই দেখিতে লাগিলেন। সেটি কামধনু, মুনি তাহার নিকট যাহা চাহেন, তাহাই পান, রাজার লোক তাহা খাইয়া শেষ করিতে পারে না। রাজা ভাবিলেন, এ গাইটি তাঁহার না হইলেই চলিতেছে না। কাজেই তিনি মুনিকে বলিলেন, “ভগবন্, গাইটি আমাকে দিন।” মুনি সে কথায় রাজি না হওয়ায় রাজা সেটি তাঁহার নিকট হইতে কড়িয়া লইয়া গেলেন।  পরশুরাম কার্তবীর্যকে বধ করিয়া সেই গাই ফিরাইয়া আনিলেন। তারপর তিনি বনে চলিয়া গিয়াছেন এমন সময় কার্তবীর্যের পুত্রেরা আসিয়া অতি নিষ্ঠুরভাবে মহর্ষি জমদগ্নির প্রাণনাশ করিল।  পরশুরাম আশ্রমে ফিরিয়া সেই দারুণ সংবাদ শুনিবামাত্র ক্রোধে অধীর হইয়া প্রতিজ্ঞা করিলেন যে পৃথিবীর যত ক্ষত্রিয় সব তিনি মারিয়া শেষ করবেন। তারপর ভীষণ কুঠার হস্তে সেই যে তিনি ক্ষত্রিয় মারিতে আরম্ভ করিলেন, তাহাদিগকে শেষ না করিয়া আর ক্ষান্ত হইলেন না। একবার নয়, দুবার নয়, ক্রমাগত একুশবার তিনি এইরূপে পৃথিবী নিঃক্ষত্রিয় করেন। ক্ষত্রিয়ের রক্তে কুরুক্ষেত্রে পাঁচটি কুণ্ড প্রস্তুত করিয়া তাহাতে পিতার তর্পণ করিলে, তবে তাঁহার ক্রোধ কিঞ্চিৎ শান্ত হইল।  ক্ষত্রিয়েরাই ছিল পৃথিবীর রাজা; তাহাদিগকে বধ করিয়া তাঁহাদের সকলের রাজ্যই পরশুরামের হইল। সেই সব রাজ্য তখন তিনি মহর্ষি কশ্যপকে দান করিলেন। দান করিয়া তাঁহার মনে এই চিন্তা হইল যে সকলই তো পরের রাজ্য হইল। এখন কোথায় বাস করি? এই ভাবিয়া তিনি অস্ত্রদ্বারা সমুদ্রের জল সরাইয়া এক নূতন রাজ্যের সৃষ্টি করিলেন। তদবধি উহাই তাঁহার বাসস্থান হইল।
উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী
মহিষাসুর উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী মহিষাসুর  একটা ভারি ভয়ংকর অসুর ছিল। সে মহিষ সাজিয়া বেড়াইত, তাই সকলে তাকে বলিত মহিষাসুর।  দেবতারা কিছুতেই মহিষাসুরকে আঁটিতে পারিতেন না। একশত বৎসর ধরিয়া তাঁহারা তাহার সঙ্গে যুদ্ধ করিলেন, তাহাতে সে তাঁহাদিগকে হারাইয়া স্বর্গ হইতে তাড়াইয়া দিয়া নিজে আসিয়া ইন্দ্র হইল।  দেবতারা তখন আর কি করেন? তাঁহারা ব্রহ্মাকে সঙ্গে করিয়া মহাদেব আর বিষ্ণুর নিকটে গিয়া উপস্থিত হইলেন, বলিলেন, “হে প্রভু, মহিষাসুর তো আমাদের বড়ই দুর্দশা করিয়াছে, আমাদিগকে যুদ্ধে হারাইয়া স্বর্গ হইতে তাড়াইয়া দিয়াছে; এখন আপনারা যদি আমাদিগকে রক্ষা না করেন, তবে আমাদের উপায় কি হইবে?”  অসুরদের অত্যাচারের কথা শুনিয়া শিব এবং বিষ্ণুর বড়ই রাগ হইল। সেই রাগে তাঁহাদের আর সকল দেবতাদের শরীর হইতে এমন একটা তেজ বাহির হইল যে সে বড়ই আশ্চর্য; মনে হইল যেন একটা আগুনের পর্বত আকাশ পাতাল ছাইয়া সকলের সামনে আসিয়া উপস্থিত হইয়াছে। দেখিতে দেখিতে সেই তেজ জমাট বাঁধিয়া একটি দেবীর মতো হইল।  তাহাকে দেখিয়া দেবতাদিগের আনন্দের আর সীমা রহিল না। তাঁহারা সকলে মিলিয়া কেহ অস্ত্র, কেহ বস্ত্র, কেহ বর্ম, কেহ অলংকার আনিয়া তাঁহাকে দিতে লাগিলেন। হিমালয় বিশাল একটি সিংহ আনিয়া তাঁহার বাহন করিয়া দিলেন।  দেবীর হাজারখানি হাতে দশদিক ছইয়া গিয়াছে, তাঁহার মুকুট আকাশ ভেদ করিয়া উঠিয়াছে, তাঁহার ভারে পৃথিবী বসিয়া পড়িয়াছে, ধনুর শব্দে আকাশ পাতাল কাঁপিতেছে। তিনি যখন হাজার হাতে হাজার অস্ত্র লইয়া গর্জন করিলেন, তখন বিশ্ব-ব্রহ্মাণ্ড কাঁপিয়া উঠিল; অসুরেরা সেই গর্জন শুনিয়া ছুটিয়া আসিল।  তারপর কি যেমন তেমন যুদ্ধ হইল? মহিষাসুর নিজে যেমন ভয়ংকর তাহার এক একটি সেনাপতিও তেমনি। তাহাদের একটার নাম চিকুর, আর একটার নাম চামর, আরগুলির নাম উদগ্র, মহাহনু, অসিলোমা, বাস্কল, পারিবারিত আর বিড়ালাক্ষ। এইসকল সেনাপতি আর কোটি কোটি অসুর লইয়া মহিষাসুর দেবীর সঙ্গে যুদ্ধ করিতে আসিল। সকলে মিলিয়া অস্ত্র যে কত ছুঁড়িল তাহার সীমা সংখ্যা নাই। কিন্তু সে অস্ত্রে দেবীর কিছুই হইল না। তাঁহার এক এক নিশ্বাসে হাজার হাজার ভূত উপস্থিত হইয়া অসুরের দলকে ঠেঙ্গাইয়া ঠিক করিতে লাগিল। দেবীর সিংহও আঁচড়-কামড় দিয়া তাহাদিগকে কম নাকাল করিল না। আর দেবীর নিজের তো কথাই নাই। তাহার হাজার হাতে হাজার অস্ত্র; সে অস্ত্রে তিনি অসুরদিগকে কাটিয়া, ফুঁড়িয়া, পিষিয়া, পুঁতিয়া শেষ করিতে লাগিলেন। সেনাপতিগুলিও কোনোটা দেবীর অস্ত্রের ঘায়ে, কোনোটা তাঁহার কিলে আর চাপড়ে, কোনোটা বা সিংহের কামড়ে মারা গেল। তখন আর মহিষাসুর চুপ করিয়া থাকিতে পারিল না। সে শিং নাড়িয়া লেজ ঘুরাইয়া, গর্জন করিতে করিতে দেবীর ভূতগুলিকে এমনি তাড়া করিল যে তাহারা পলাইতে পারিলেই বাঁচিত, কিন্তু বাঁচিতে পারিলে তো পলাইবে! দেখিতে দেখিতে সে ভূতের দলকে শেষ করিয়া দেবীর সিংহের পানে ছুটিয়াছে, তাহার লেজের তাড়ায় সাগর লণ্ডভণ্ড, শিং-এর নাড়ায় মেঘ সব খণ্ড খণ্ড হইতেছে, নিশ্বাসের চোটে পাহাড় পর্বত উড়িয়া যাইতেছে। এমন সময় দেবীর পাশ অন্ত্র আসিয়া তাহাকে এমনি বাঁধন বাঁধিল যে আর তাহার নড়িবার শক্তি নাই। কিন্তু, অসুরের মায়া, সে কি সহজ কথা? চোখের পলকে মহিষটা সিংহ হইয়া বাঁধন ছড়াইয়া আসিল! দেবী তখনই সেই সিংহকে কাটিলেন। অমনি দেখা গেল যে আর সিংহ নাই, তাহার জায়গায় খড়্গ হতে একটা মানুষ খেপিয়া আসিতেছে। মানুষ কাটা যাইতে না যাইতেই কোথা হইতে এক হাতি আসিয়া দেবীর সিংহকে শুঁড় দিয়া জড়াইয়া বসিয়াছে। দেবী খড়্গ দিয়া হাতির শুঁড় কাটিলেন, অমনি হাতি আবার মহিষ হইয়া গেল, সেটা আবার শিং দিয়া দেবীকে পর্বত ছুঁড়িয়া মারে। দেবী এক লাফে সেই মহিষের ঘাড়ে চড়িয়া তাহাকে এমনি শূলের ঘা মারিলেন যে তখন অসুর মহাশয়কে সেই মহিষের ভিতর হইতে বাহির হইতেই হইল। কিন্তু তখনো তাহার তেজ কমে নাই, সে আধাআধি বাহির হইয়া যুদ্ধ আরম্ভ করিয়াছে!  যাহা হউক, যুদ্ধ আর তাহার বেশিক্ষণ করিতে হইল না। কেননা, দেবী সেই মুহূর্তেই খড়্গ দিয়া তাহার মাথা কাটিয়া ফেলিলেন।  তখন তো দেবতাগণের খুব আনন্দ হইবেই। তাঁহারা দেবীকে প্রণাম করিয়া তাঁহার অনেক স্তবস্তুতি করিলেন।  দেবী তাহাতে তুষ্ট হইয়া বলিলেন, “তোমরা কি বর চাও?”  দেবগণ বলিলেন, “আবার কি বর চাহিব? মহিষাসুর মরিয়াছে। তাহাতেই আমাদের ঢের ইয়াছে। এখন শুধু এইটুকু বল যে আমাদের আবার যদি বিপদ হয় তখন ডাকিলে আসিবে।”  দেবী বলিলেন, “আচ্ছা, আমি আসিব।”  এই বলিয়া তিনি আকাশে মিলাইয়া গেলেন।  অসুর যতদিন আছে, ততদিন দেবতাদিগের বিপদ হওয়ার আর ভাবনা কি?  কাজেই বুঝিতেই পার যে দেবীকে শীঘ্রই আবার তাঁহাদের ডাকে আসিতে হইয়াছিল।
উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী
রাবণ উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী রাবণ  রাবণের কথা তোমরা সকলেই জান। রাবণের পিতার নাম বিশ্রবা, মায়ের নাম কৈকসী। বিশ্রবা পরম ধার্মিক মুনি ছিলেন। রাবণ আর তাহার ভাইবোনেরা জন্মিবার পূর্বেই তিনি বলিয়াছিলেন যে, ইহাদের সকলের ছোটটি খুব ধার্মিক হইবে, আর সকলেই ভয়ংকর দুষ্ট রাক্ষস হইবে।  মুনি যাহা বলিয়াছিলেন, তাহাই হইল। রাবণ, কুম্ভকর্ণ আর তাহাদের বোন সূর্পনখা, ইহাদের এক একটা এমনি বিকট আর দুষ্ট রাক্ষস হইল যে কি বলিব। ইহাদের ছোট ভাই বিভীষণও রাক্ষস ছিল বটে কিন্তু সে যারপরনাই ভালো লোক ছিল।  রাবণের দশটা মাথা আর কুড়িটা হাত ছিল। দাঁতগুলো ছিল থামের মতো বড়-বড়। চুলগুলি আগুনের শিখার মতো লাল, আর শরীরটা কালো পর্বতের মতো বিশাল। তাহার জন্মের সময় পৃথিবী কাঁপিয়াছিল, সূর্য ময়লা হইয়া গিয়াছিল আর সমুদ্রের জল তোলপাড় হইয়া উঠিয়াছিল। দশটা মাথা দেখিয়া তাহার পিতা তাহার নাম রাখিয়াছিলেন দশগ্রীব’। উহাই উহার আসল নাম, রাবণ নাম পরে হইয়াছিল।  ছেলেবেলায় রাবণ ভাইদিগকে লইয়া দশ হাজার বৎসর ভয়ংকর তপস্যা করিয়াছিল। এই দশ হাজার বৎসর সে আহার করে নাই। এক এক হাজার বৎসর যাইত আর নিজের এক একটি মাথা কাটিয়া সে আগুনে আহুতি দিত। নয় হাজার বৎসরে নয়টি মাথা সে এইরূপ করিয়া আগুনে দিল। তারপর দশ হাজার বৎসর পূর্ণ হইলে, যেই সে তাহার বাকি একটি মাথাও কাটিতে যাইবে, আমনি ব্রহ্মা আসিয়া বলিলেন, “দশগ্রীব, আমি খুশি হইয়াছি, এখন তুমি বর লও।”  দশগ্রীব বলিল, “আমাকে অমর করিয়া দিন।” ব্রহ্মা বলিলেন, “সেটি হইবে না, অন্য বর লও।” দশগ্রীব বলিল, “তবে এই বর দিন যে দানব, দৈত্য, যক্ষ, রক্ষ, নাগ, পক্ষী ইহাদের কেহই আমাকে মারিতে পরিবে না।” ব্রহ্মা বলিলেন, “আচ্ছা তাহাই হইবে। তাহা ছাড়া তোমার যে মাথাগুলি কাটিয়া দিয়াছ তাহাও ফিরিয়া পাইবে, ইহার ওপর আবার যখন যেরূপ তোমার ইচ্ছা হয়, তেমনি চেহারা করিতে পরিবে।”  কুম্ভকর্ণ আর বিভীষণও এই দশ হাজার বৎসর খুব তপস্যা করিয়াছিল, সুতরাং ব্রহ্মা তাহাদিগকেও বর দিতে গেলেন। বিভীষণ বলিল, “আমাকে দয়া করে এই বর দিন, যেন আমার ধর্মে মতি থাকে।” এ কথায় ব্রহ্মা অতিশয় তুষ্ট হইয়া তাহাকে সে বর তো দিলেনই উপেন্দ্র—৯০ তাহা ছাড়া তাহাকে অমর করিয়া দিলেন।  কুম্ভকর্ণকে বর দিবার সময় দেবতারা ব্রহ্মাকে বলিলেন, “প্রভু এমন কাজ করিবেন না, এ বেটা বর পাইলে আমাদের সকলকে খাইয়া ফেলিবে। এর মধ্যেই কতজনকে ধরিয়া খাইয়াছে।  তাইতো, এখন কি করা যায়? তপস্যা করিয়াছে কাজেই বর দিতেই হইবে, আবার বর দিলেও বিপদের কথা, তখন ব্রহ্মা বুদ্ধি করিয়া সরস্বতীকে কুম্ভকর্ণের মুখের ভিতরে ঢুকাইয়া দিলেন। সরস্বতী ঢুকিতেই তাহার মাথায় কি যে গোল লাগিয়া গেল, আর বেচারা ঠিক করিয়া কথা কহিতে পারিল না। ব্রহ্মা বলিলেন, “কুম্ভকর্ণ, কি চাহ?” কুম্ভকর্ণ বলিল, “আমি খালি ঘুমাইতে চাই। ছয়মাস ঘুমাইয়া একদিন উঠিয়া খাইব।” ব্রহ্মা বলিলেন, “বেশ কথা, তাই হোক।” এই বলিয়া ব্রহ্মা দেবতাদিগকে লইয়া চলিয়া গেলেন, আর কুম্ভকর্ণ মাথা চুলকাইতে চুলকাইতে ভাবিল, ‘তাইতো। এটা কি করিলাম? দেবতা বেটারা আমাকে ফাঁকি দিয়া গেল নাকি?”  যা হোক, আমরা দশগ্রীবের কথা বলিতেছি। সে তো বর পাইয়া নিতান্তই ভয়ংকর হইয়া উঠিল; এখন আর কেহ তাহার কোনো কথায় ‘না’ বলিতে ভরসা পায় না। দশগ্রীবের এক দাদা ছিলেন, তাঁহার নাম কুবের। তিনিও বিশ্রবা মুনির পুত্র, তাঁহার মাতা, ভরদ্বাজ মুনির কন্যা দেববর্ণিনী। কুবের লঙ্কায় বাস করিতেন। দশগ্রীব তাঁহাকে বলিয়া পাঠাইল, “দাদা লঙ্কাপুরীখানি আমাকে ছাড়িয়া দাও।”  কাজেই তখন কুবের আর কি করেন? ভালোয় ভালোয় না দিলে জোর করিয়া কাড়িয়া নিবে। তাহার চেয়ে তিনি কৈলাস পর্বতে বাস করিতে লাগিলেন। দশগ্রীবও তখন পরম আনন্দে রাক্ষসের দলসমেত লঙ্কায় আসিয়া রাজা হইয়া বসিল।  ইহার কিছুদিন পরেই দশগ্রীব বিদ্যুজ্জিহ্‌ নামক দানবের সহিত সুর্পনখার বিবাহ দিল। তাহাদের তিন ভাইয়ের বিবাহ হইতেও আর বেশি বিলম্ব হইল না। কিন্তু হায়, শুভকার্য শেষ হইতে না হইতেই ব্রহ্মার আজ্ঞায় ঘোর নিদ্রা আসিয়া কুম্ভকর্ণকে ধরিয়া বসিল। তাহার চোখ বুজিয়া আসিল, মাথা ঢুলিয়া পড়িল, সে বিকট মুখে ভীষণ হাই তুলিয়া বলিল, “দাদা, বড়ই ঘুম পাইয়াছে আমার শয়নের জন্য ঘর করিয়া দাও।” তখনই রাবণের হুকুমে চমৎকার ঘর প্রস্তুত হইল। তাহার ভিতরে গিয়া সেই যে কুম্ভকর্ণ শুইল, হাজার হাজার বৎসরেও আর উঠিল না।  এদিকে দশগ্রীবের জ্বালায় ত্রিভুবন অস্থির! সে দেবতা গন্ধর্ব, মুনি-ঋষি কাহাকেও মানে না, এক ধার হইতে সকলকে মারিয়া তাহাদের বাড়ি, ঘর, বাগান সব চুরমার করিতে আরম্ভ করিয়াছে। কুবের তাহাতে নিতান্ত দুঃখিত হইয়া তাহাকে বারণ করিবার জন্য দূত পাঠাইলেন। সে দূতের কথা দশগ্রীব তো শুনিলই না; লাভের মধ্যে বেচারাকে কাটিয়া রাক্ষসদিগকে খাইতে দিল। তারপর রথে চড়িয়া এই বলিয়া সে বাহির হইল, “আমি ত্রিভুবন জয় করিব।”  বাহির হইয়াই সে সকলের আগে গিয়া কুবেরের নিকট উপস্থিত হইল, তাহার উপরেই রাগটা বেশি। কুবেরের যক্ষ অনেক যুদ্ধ করিয়াও তাহার কিছুই করিতে পারিল না। দশগ্রীবের সঙ্গে ভীষণ রাক্ষসেরা গিয়াছিল; তাহারা যক্ষদের এমনি দুর্গতি করিল যে তাহা আর বলিবার নহে। যক্ষেরা সোজাসুজি সরলভাবে যুদ্ধ করে, আর রাক্ষসেরা নানারকম ফাঁকি দেয়; কাজেই যক্ষেরা হারিয়া গেল। কুবের নিজে আসিয়াও বিশেষ কিছুই করিতে পারলেন না। দশগ্রীব তাঁহাকে অস্ত্রের আঘাতে অজ্ঞান করিয়া, তাঁহার ‘পুষ্পক’ নামক রথখানি লইয়া চলিয়া গেল। সে রথ বড়ই আশ্চর্য ছিল। তাহাতে সঙ্গে দানা, পানি, সইস, কোচমান কিছুরই দরকার হইত না। যেখানে যাইবার হুকুম পাইত অমনি সে উড়িয়া গিয়া সেখানে হাজির হইত।  সেই পুষ্পকরথে চড়িয়া দশগ্রীব স্বর্গের বিশাল শরবনে গিয়া উপস্থিত হইল। পর্বতের উপরে সে অতি পবিত্র বন, কার্তিকেয়ের জন্মস্থান, তাহার উপর দিয়া কোনো রথেরই যাইবার হুকুম নাই! বিশেষত শিব আর পার্বতী তখন সেখানে ছিলেন। কাজে কাজেই পুষ্পক রথ সেখানে গিয়া আটকাইয়া গেল। ইহাতে দশগ্রীব যারপরনাই আশ্চর্য হইয়া নানারূপ চিন্তা করিতেছে, এমন সময় শিবের দূত নন্দী আসিয়া তাহাকে বলিল, “দশগ্রীব, মহাদেব এখানে আছেন, তুমি ফিরিয়া যাও।”  নন্দীর চেহারা বড়ই অদ্ভুত ছিল। ছোট্টো-খাট্টো পিঙ্গলবর্ণ লোকটি, হাত দুখানি এতটুকু, মাথাটি নেড়া, মুখখানি বানরের মতো। দশগ্রীব তাহার কথা শুনিবে কি, সে হাসিয়া অস্থির। কিন্তু নন্দী ছাড়িবার পাত্র নহে। সে ছোট হইলেও দেখিতে বড়ই ষণ্ডা, তাহাতে আবার হাতে ভয়ংকর শূল। দশগ্রীব রাগের ভরে রথ হইতে নামিয়া সবে বলিয়াছিল, “কে রে তোর মহাদেব?” অমনি নন্দী তাহাকে দুই ধমক লাগাইয়া দিল। তখন সে ভারি চটিয়া বলিল, “বটে? আমাকে যাইতে দিবি না? আচ্ছা, দাঁড়া তোদের পাহাড় আমি তুলিয়া নিব।” এই বলিয়া সত সত্যই সে গুঁড়িহাতে সেই পর্বতের তলা ধরিয়া টানাটানি করিতে লাগিল। সেকি যেমন তেমন টান? টানের চোটে পর্বত নড়িয়া উঠিল, শিবের ভূতগুলি ভয়ে কাঁপিতে লাগিল, পার্বতী যারপরনাই ব্যস্ত হইয়া মহাদেবকে জড়াইয়া ধরিতে গেলেন। মহাদেব কিন্তু কিছুমাত্র ব্যস্ত হইলেন না।  তিনি কেবল পায়ের বুড়ো আঙুলটি দিয়া পর্বতখানিকে একটু চাপিয়া ধরিলেন তাহাতেই সে তাহার জায়গায় বসিয়া গেল, আর অমনি দরজার কামড়ে দুষ্টু খোকার আঙুল আটকাইবার মতন দশগ্রীব মহাশয়ের হাতখানিও পর্বতের চাপনে আটকাইয়া গেল।  তখন তো দশগ্রীব দশমুখে ভ্যাঁ ভ্যাঁ শব্দে চ্যাঁচাইয়া অস্থির! চীৎকারে ত্রিভুবন কাঁপিতে লাগিল; সাগর উছলিয়া উঠিল, দেবতারা ছুটিয়া পথে বাহির হইলেন!  হাজার বৎসর ধরিয়া দশগ্রীব ঐরূপ চ্যাঁচাইয়াছিল, আর মহাদেবকে ক্রমাগত মিনতি করিয়াছিল। মহাদেবের দয়ার কথা সকলেই জানে। বেচারার এই কষ্ট দেখিয়া তিনি আর চুপ করিয়া থাকিতে পারলেন না। তিনি তাহাকে ছাড়িয়া তো দিলেনই, তাহার উপর আবার ভারি ভারি কয়েকটি অস্ত্রও তাহাকে দিয়া দিলেন, আর বলিলেন, “দশগ্রীব, তুমি চমৎকার চ্যাঁচাইয়াছিলে, তোমার চীৎকারে সকলেই ভয় পাইয়াছিল। অতএব এখন হইতে তোমার নাম ‘রাবণ’ (যে চীৎকারে লোকের ভয় লাগাইয়া দেয়) হইল।” দশগ্রীব দেখিল, পাহাড় চাপা পড়িয়া মোটের উপর তাহার লাভই হইয়াছে, কাজেই সে খুব খুশি হইয়া সেখান হইতে চলিয়া আসিল।  দশগ্রীব শিবের নিকট বর পাইয়া রাবণ হইল, অস্ত্রশস্ত্রও অনেকগুলি পাইল। তখন হইতে সে ব্রহ্মাণ্ডময় কেবল ঘুরিয়া বেড়ায়, আর রাজরাজড়া যাহাকে সামনে পায় তাহাকেই বলে, “হয় যুদ্ধ কর না হয় হার মান।”  উষীরবীজ নামে একটা জায়গায় মরুত্ত নামে এক রাজা যজ্ঞ করিতেছেন, রাবণ পুষ্পক রথে চড়িয়া হেঁইয়ো হেঁইয়ো শব্দে সেখানে আসিয়া উপস্থিত। যজ্ঞের স্থানে দেবতাদের অনেকেই ছিলেন, রাবণকে দেখিয়াই ভয়ে তাঁহাদের মুখ শুকাইয়া গেল। ছুটিয়া যে পলাইবেন, এতটুকুও তাহাদের ভরসা হইল না; কি জানি পাছে ধরিয়া ফেলে। তাই তাহারা সেইখানেই নানা জন্তুর বেশ ধরিয়া লুকাইয়া রহিলেন। ইন্দ্র হইলেন ময়ূর, ধর্ম হইলেন কাক, কুবের হইলেন গিরগিটি, বরুণ হইলেন হাঁস।  এদিকে মরুত্তের সঙ্গে রাবণের খুবই যুদ্ধ বাধিবার জোগাড় দেখা যাইতেছে, গালাগালি আরম্ভ হইয়াছে মারামারিরও বিলম্ব নাই, এমন সময় মরুত্তের গুরু সম্বর্ত মুনি তাঁহাকে বলিলেন, “মহারাজ! যুদ্ধ করিয়া কাজ নাই কেননা তাহা হইলে তোমার যজ্ঞ নষ্ট হইয়া যাইবে, তাহাতে সর্বনাশ হইবে।” কাজেই মরুত্ত চুপ করিয়া গেলেন, আর রাবণ “জিতিয়াছি জিতিয়াছি” বলিয়া খুবই বাহাদুরী করিতে লাগিল। তারপর সেখানে যত মুনি উপস্থিত ছিলেন, তাহাদের সকলকে খাইয়া যারপরনাই খুশি হইয়া সে সেখান হইতে চলিয়া গেল।  তখন দেবতামহাশয়েরা আবার যার যার বেশ ধরিয়া মনে করিলেন, “বাবা, বড্ড বাঁচিয়া গিয়াছি।” যে সকল জন্তুর সাজ তাঁহারা নিয়াছিলেন, তাহাদের উপরে অবশ্য তাঁহারা খুবই খুশি হইলেন, আর তাহাদিগকে বর দিতে লাগিলেন।  ইন্দ্র ময়ূরকে বলিলেন, “তোমার সাপের ভয় থাকিবে না, আর আমার যেমন হাজার চোখ, তোমার লেজেও তেমনি হাজার চোখ হইবে।” ময়ূরের লেজে আগে শুধুই নীলবর্ণ ছিল, তখন হইতে তাহাতে চমৎকার চক্র দেখা দিল।  ধর্ম কাককে বলিলেন, “তোমার আর কোনো অসুখ হইবে না। মরণের ভয়ও তোমার দূর হইল; কেবল মানুষে যদি মারে তবেই তোমার মৃত্যু হইবে।”  বরুণ হাঁসকে বলিলেন, “তোমার গায়ের রঙ ধব্‌ধবে সাদা হইবে। তখন হইতে হাঁস সাদা হইয়াছে, আগে তাহার আগাগোড়া সাদা ছিল না, পাখার আগা নীল, আর কোলের দিকে ছেয়ে রঙের ছিল।  কুবের গিরগিটিকে বলিলেন, “তোমার মাথা সোনার মতো হইবে।” সেই হইতে গিরগিটির মাথায় সোনালি রঙ।  এদিকে রাবণের আর গর্বের সীমাই নাই। দুষ্মন্ত, সুরথ, গাধি, গয়, পুরুরবা প্রভৃতি বড় বড় রাজারা তাহার নিকট হার মানিয়া গেলেন। অন্যের তো কথাই নাই। কিন্তু অযোধ্যার রাজা অনরণ্য কিছুতেই তাঁহার নিকট হার মানিতে রাজি হইলেন না। তিনি আগেই অনেক সৈন্য প্রস্তুত করিয়া রাখিয়াছিলেন, রাবণ তাঁহার রাজ্যে আসিবামাত্র সেইসকল সৈন্য লইয়া তিনি তাহার সহিত যুদ্ধ আরম্ভ করিলেন। হায়, তাঁহার সে সৈন্য রাবণের সৈন্যদের কাছে দুদণ্ডের মধ্যেই শেষ হইয়া গেল, নিজেও রাবণের হাতে ভয়ানক আঘাত পাইয়া রথ হইতে পড়িয়া কাঁপিতে লাগিলেন। রাবণ তখন তাঁহাকে বিদ্রুপ করিয়া বলিল, “কি? আমার সঙ্গে যুদ্ধ করিয়া এখন কেমন হইল?” অনরণ্য বলিলেন, “মরিতে তো একদিন সকলকেই হয়, কিন্তু আমি তোমার কাছে হটি নাই, যুদ্ধ করিয়া প্রাণ দিতেছি আর আমি এ কথা তোমাকে বলিতেছি যে, আমাদের এই বংশে দশরথের পুত্র রামের জন্ম হইবে, সেই রামের হাতে তুমি তোমার উচিত সাজা পাইবে।”  রাজার কথা শেষ হইতে না হইতেই দেবতারা তাঁহার উপরে পুষ্পবৃষ্টি করিতে লাগিলেন। স্বর্গে দুন্দুভি বাজিয়া উঠিল। দেখিতে দেখিতে রাজাও দেহ ছাড়িয়া সেখানে চলিয়া গেলেন।  একবার রাবণ মানুষ তাড়াইয়া ফিরিতে ফিরিতে দেখিলেন যে মেঘের উপর দিয়া নারদ মুনি হরিনাম গান করিতে করিতে আসিতেছেন। রাবণ তাঁহাকে নমস্কার করিয়া বলিল, “কি ঠাকুর মহাশয়, মঙ্গল তো? কিজন্য আসিয়াছেন?  নারদ বলিলেন, “আসিয়াছি যে বাপু, একটা কথা আছে। এইসব মানুষ যখন মৃত্যুর বশ, তখন এরা তো মরিয়াই রহিয়াছে; ইহাদিগকে মারিবার জন্য তুমি আবার এত পরিশ্রম কেন করিতেছ? ইহারা আপনা আপনিই একদিন যমের বাড়ি যাইবে! বাস্তবিক যমই যত নষ্টের গোড়া। অতএব, সেই বেটাকে যদি জব্দ করিতে পার, তবে সকলকেই জয় করা হইবে।”  রাবণ বলিল, “বড় ভালো কথা বলিয়াছেন, ঠাকুর মহাশয়! আমি এখনি যাইতেছি।” বলিয়াই আর এক মুহূর্তও দেরি নাই, অমনি রাবণ যমপুরীর পথ ধরিয়াছে। তখন নারদ ভাবিলেন, ‘এবারে মজাটা হইবে ভালো। যাই, একবার দেখিয়া আসি।”  নারদ রাবণের আগেই গিয়া যমের নিকট উপস্থিত হইলেন। যম বিচারাসনে বসিয়া অগ্নিসাক্ষী করিয়া সকলের পাপপুণ্যের বিচার করিতেছিলেন, নারদকে দেখিয়া ব্যস্তভাবে উঠিয়া নমস্কারপূর্বক বলিলেন, “মুনিঠাকুরের আজ কি চাই?”  নারদ বলিলেন, “সাবধান হও বাছা, রাবণ তোমাকে জয় করিতে আসিতেছে। মুশকিল হইতে আটক নাই কিন্তু বেটা বড় বেখাপ্পা লোক।”  বলিতে বলিতেই রাবণের ঝক্‌ঝকে পুষ্পক রথও আসিয়া দেখা দিল। রথ হইতে নামিয়াই সে দেখিল যে নরকের কুণ্ডে দলে দলে পাপী সকল যমদূতগণের তাড়নায় চীৎকার করিতেছে। অমনি আর কথাবার্তা নাই, সে যমদূতগুলিকে বিধিমতে ঠ্যাঙাইয়া সকল পাপীকে ছাড়িয়া দিল। সে বেচারারা হঠাৎ ছাড়া পাইয়া যে কি আশ্চর্য আর খুশি হইল, তাহা আর বলিবার নয়। তখন যে যুদ্ধ আরম্ভ হইল, সে বড়ই ভয়ংকর। যমপুরীতে অসংখ্য সিপাহী সান্ত্রী থাকে, তাহদের এক একজন ভয়ানক যোদ্ধা। তাহারা রাবণ আর তাহার লোকগুলিকে মারিয়া রক্তারক্তি করিয়া দিল। মার খাইয়াও কিন্তু রাবণ যুদ্ধ করিতে ছাড়ে না। শূল শক্তি প্রাস গদা গাছ পাথর কত যে ছুঁড়িল তাহার লেখাজোখা নাই। তখন যমের লোকেরা আর রাক্ষসকে ছাড়িয়া কেবল রাবণের উপরেই এমন ভয়ানক অস্ত্র বৃষ্টি করিতে লাগিল যে, তাহাতে পুষ্পক রথ অবধি ডুবিয়া গিয়া রাবণের দম আটকিয়া মরিবার গতিক। দুর্দশার একশেষ। রক্তধারায় দেহ ভাসিয়া গেল; কবচ কোথায় গিয়াছে তাহার ঠিক নাই। তখন কাজেই তাহাকে রথ হইতে নামিয়া আসিতে হইল।  এতক্ষণে আর রাবণের বুঝিতে বাকি রহিল না যে এবারে একটু বেগতিক, একটা বড়রকমের অস্ত্র না ছাড়িতে পারিলে আর চলিতেছে না। কাজেই সে তখন ধনুকে পাশুপত অস্ত্র জুড়িয়া যমের লোকদিগকে বলিল, “দাঁড়া বেটারা, এবারে তোদের দেখাইতেছি।” এই বলিয়া সে সেই ভয়ংকর অস্ত্র ছুঁড়িবামাত্রই, তাহার তেজে যমের সকল সিপাহী ভস্ম হইয়া গেল। তখন রাবণের আর রাক্ষসগণের সিংহনাদে ব্রহ্মাণ্ড ফাটে আর কি?  সেই সিংহনাদ শুনিয়াই যম বুঝিতে পারিলেন যে রাক্ষসদিগের জয় হইয়াছে। তখন কাজেই রথে চড়িয়া তাঁহাকে স্বয়ংই বাহির হইতে হইল! সে যে কি ভয়ংকর রথ সে কথা আমি বলিয়া বুঝাইতে পারিব না। তাহার উপর আবার স্বয়ং মৃত্যু প্রাস মুদগর লইয়া ভীষণ বেশে যমের সম্মুখে দাঁড়াইয়া, কালদণ্ড প্রভৃতি ভয়ংকর অস্ত্রসকল ধূ ধূ করিয়া জ্বলিতেছে।  সেই রথ আর তাহার ভিতর মৃত্যুকে দেখিয়াই রাবণের লোকেরা “বাপ রে। আমাদের যুদ্ধে কাজ নাই” বলিয়াই ঊর্দ্ধশ্বাসে চম্পট দিল। কিন্তু রাবণ তাহাতে ভয় না পাইয়া যমের সঙ্গে খুবই যুদ্ধ করিতে লাগিল। অস্ত্রের ভয় তো তাহার নাই, কারণ সে জানে যে ব্রহ্মার বরের জোরে সে মরিবে না! কাজেই অনেক খোঁচা যেমন খাইল, খোঁচা দিলও ততোধিক। খোঁচা খাইয়া যম রাগে অস্থির হইয়া উঠিলেন, তাঁহার মুখ দিয়া আগুন বাহির হইতে লাগিল।  তখন মৃত্যু যমকে বলিল, “আমাকে আজ্ঞা করুন আমি এখনই এই দুষ্টকে মারিয়া দিতেছি। আমি ভালো করিয়া তাকাইলে আর ইহাকে এক মুহূর্তও বাঁচিতে হইবে না।” যম বলিলেন, “দেখ না, আমি ইহাকে কি সাজা দিই।” এই বলিয়াই তিনি রাগে দুই চোখ লাল করিয়া তাঁহার সেই ভীষণ ‘কালদণ্ড’ হাতে নিলেন। সে দণ্ড যাহার উপর পড়ে তাহার আর রক্ষা থাকে না।  যমকে কালদণ্ড তুলিতে দেখিয়া ভয়ে সকলের প্রাণ উড়িয়া গেল, কে কোন দিক দিয়া পলাইবে তাহার ঠিক নাই, দেবতাদের অবধি বুক ধড়াস্ ধড়াস্‌ করিতেছে। তখন ব্রহ্মা নিতান্ত ব্যস্তভাবে ছুটয়া আসিয়া যমকে বলিলেন, “সর্বনাশ, কর কি? এই কালদণ্ড তুমি ছুঁড়িলেই যে আমার কথা মিথ্যা হইয়া যাইবে। কালদণ্ড আমিই গড়িয়াছি, রাবণকেও আমি বর দিয়াছি। আমিই বলিয়াছি যে কালদণ্ড কিছুতেই ব্যর্থ হইবে না। আবার আমিই বলিয়াছি যে রাবণ কোনো দেবতার হাতে মরিবে না। এখন এই অস্ত্রে যদি রাবণ মরে, তাহা হইলেও আমার কথা মিথ্যা হয়, যদিনা মরে তাহা হইলেও আমার কথা মিথ্যা হয়। লক্ষ্মীটি আমাব মান রাখ, এ অস্ত্র তুমি ছুঁড়িও না।”  কাজেই যম তখন আর কি করেন? তিনি বলিলেন, “আপনি হইতেছেন আমাদের প্রভু, সুতরাং আপনার হুকুম মানিতেই হইবে। কিন্তু যদি এ দুষ্টকে মারিতেই না পারিলাম, তবে আর আমার এখানে থাকিয়াই কি ফল?” এই বলিয়া যম সেখান হইতে চলিয়া গেলেন। তাহা দেখিয়া রাবণ হাততালি দিয়া নাচিতে নাচিতে বলিল, “দুয়ো! দুয়ো! হারিয়া গেলি! হারিয়া গেলি!” ততক্ষণে অন্য রাক্ষসদেরও খুবই সাহস হইয়াছে, আর তাহারা আসিয়া, “জয় রাবণের জয়।”—বলিয়া আকাশ ফাটাইতে আরম্ভ করিয়াছে।  ব্রহ্মার কথায় যম যুদ্ধ ছড়িয়া দিলেন। রাবণ ভাবিল, সেটি তাহার নিজেরই বাহাদুরী। তখন আর তাহার গর্বের সীমাই রহিল না। সে বাছিয়া বাছিয়া বড়-বড় যোদ্ধাদের সহিত বিবাদ করিয়া বেড়াইতে লাগিল। বরুণের পুত্রগণ তাহার নিকট হারিয়া গেলেন, বরুণ নিজে ব্রহ্মার বাড়িতে গান শুনিতে যাওয়ায় সেখানে উপস্থিত ছিলেন না, তাই তাঁহার মান বাঁচিল। সূর্য যুদ্ধ না করিয়াই বলিলেন, “আমি হার মানিতেছি।” রাবণের ভগ্নিপতি বিদ্যুজিহ্‌ বেচারাও তাহার হাতে মারা গেল।  কিন্তু সকল জায়গায়ই যে রাবণ বাহাদুরী পাইয়াছিল তাহা নহে। বলির বাড়িতে গিয়া সে অনেক বড়াই করিয়াছিল। বলি তাহাকে ধরিয়া নিজের কোলে বসাইয়া বলিলেন, “কি চাও বাপু?” রাবণ বলিল, “শুনিয়াছি বিষ্ণু নাকি আপনাকে আটকাইয়া রাখিয়াছেন। আমি আপনাকে ছাড়াইয়া দিতে পারি।”  এ কথা শুনিয়া বলির ভারি হাসি পাইল। তারপর তিনি কথায় কথায় তাহাকে বলিলেন, “ঐ যে ঝক্‌ঝকে চাকাটি দেখিতেছ ওটি আমার কাছে লইয়া আইস তো?” এ কথায় রাবণ নিতান্ত অবহেলার সহিত গিয়া সেই জিনিসটি উঠাইল, কিন্তু কিছুতেই সেটিকে লইয়া আসিতে পারিল না। সে লজ্জিত হইয়া প্রাণপণে টানাটানি করিতে করিতে শেষে অজ্ঞান হইয়া পড়িয়া গেল।  খানিক পরে রাবণের জ্ঞান হইয়াছে, কিন্তু তখন আর লজ্জায় বেচারা মাথা তুলিতে পারে না। তখন বলি তাহাকে বলিলেন, “এই চাকাটি আমার পুর্বপুরুষ হিরণ্যকশিপুর কুণ্ডল।”  আর একবার রাবণ পশ্চিম সমুদ্রে গিয়া একটি দ্বীপে আগুনের মতো তেজস্বী এক ভয়ংকর পুরুষকে দেখিল। তাঁহাকে দেখিয়াই রাবণ বলিল, “যুদ্ধ দাও।” তারপর সে তাঁহাকে কত শূল, কত শক্তি, কত ঋষ্টি, কত পট্টিশের ঘা মারিল, কিন্তু তাঁহার কিছুই করিতে পারিল না। তখন সেই ভয়ংকর পুরুষ রাবণকে টিকটিকির মতন ধরিয়া দুহাতে এমনি চাপিয়া দিলেন যে তাহাতেই তাহার প্রাণ যায় যায়। তারপর তিনি তাহাকে মাটিতে ফেলিয়া পাতালে চলিয়া গেলেন। কিঞ্চিৎ পরে রাবণ উঠিয়া রাক্ষসদিগকে জিজ্ঞাসা করিল, “সেই ভয়ংকর লোকটা কোথায় গেল?” রাক্ষসেরা একটা গর্ত দেখাইয়া বলিল, “সে ইহারই ভিতরে ঢুকিয়া গিয়াছে।” অমনি রাবণও তাড়াতাড়ি সেই গর্তের ভিতর ঢুকিল। তারপর পাতালের মধ্যে খুঁজিতে খুজিতে এক জায়গায় গিয়া দেখিল সেই মহাপুরুষ একটা খাটের উপর ঘুমাইয়া আছেন। সেখানে গিয়া রাবণ সবে দুষ্ট ফন্দি আঁটিতেছে, এমন সময় সেই ভয়ংকর পুরুষ হো হো শব্দে হাসিয়া উঠিলেন, আর তাহাতেই রাবণ কানে তালা লাগিয়া মাথা ঘুরিয়া পড়িয়া গেল। তখন ভয়ংকর পুরুষ তাহাকে বলিলেন, “আর কেন? এই বেলা চলিয়া যাও! ব্রহ্মা তোমাকে অমর হইবার বর দিয়াছেন। কাজেই তোমাকে বধ করা হইল না।” এই ভয়ংকর পুরুষ ছিলেন ভগবান কপিল।  আর একবার রাবণ গিয়াছিল মাহিষ্মতীর রাজা অর্জুনের সহিত যুদ্ধ করিতে। মাহিষ্মতীতে গিয়া সে অর্জুনের মন্ত্রীদিগকে বলিল, “তোমাদের রাজা কোথায়? আমি তাহার সহিত যুদ্ধ করিব।” মন্ত্রীরা বলিলেন, “তিনি বাড়ি নাই।”  এ কথায় রাবণ সেখান হইতে বিন্ধ্যপর্বতে চলিয়া আসিল। বিন্ধ্য অতি সুন্দর পর্বত। সেই পর্বতের নীচ দিয়া নর্মদা নদী বহিতেছে, তাহার শোভা দেখিলে চক্ষু জুড়াইয়া যায়। এমন নির্মল জল, এমন শীতল বায়ু, এতরকমের ফুল আর অতি অল্পস্থানেই আছে। রাবণ মনের সুখে সে জলে নামিয়া স্নান করিল।  ঠিক সেই সময়ে একটা ভারি আশ্চর্য ঘটনা ঘটিতেছিল। নর্মদার জল স্বভাবতই পূর্ব হইতে পশ্চিম দিকে বহিয়া থাকে, কিন্তু সেদিন দেখা গেল যে তাহা এক একবার হঠাৎ উঁচু হইয়া পশ্চিম হইতে পূর্ব দিকে ফিরিয়া আসিতেছে। ইহাতে রাবণ যারপরনাই আশ্চর্য হইয়া শুক সারণকে বলিল, “দেখ তো ব্যাপারটা কি?”  শুক সারণ তখনই পশ্চিম দিকে চলিয়া গেল, আর খানিক পরেই ব্যস্তভাবে ফিরিয়া আসিয়া বলিল, মহারাজ, প্রকাণ্ড শালগাছের মতো উঁচু একটা লোক নর্মদায় নামিয়া স্নান করিতেছে। উহার এক হাজারটা হাত। সেই হাজার হাতে সে এক একবার নদীর জল আগলাইয়া ঠেলিয়া দিতেছে, আর তাহাতেই সে জল এত উঁচু হইয়া ফিরিয়া আসিতেছে।  এ কথা শুনিয়া রাবণ বলিয়া উঠিল—“অর্জুন”। তারপর আর এক মুহূর্তও বিলম্ব না করিয়া অমনি গদা ঘুরাইতে ঘুরাইতে অর্জুনের সহিত যুদ্ধ করিতে চলিল। অর্জুনের লোকেরা খাইয়া নাকাল করিয়াছিল।  অর্জুন একথা শুনিতে পাইয়া বিশাল গদা হাতে ছুটয়া আসিলেন। রাক্ষসেরা তাঁহাকে বাধা দিয়াছিল, কিন্তু সেই গদার সম্মুখে তাহারা কিছুতেই টিকিতে না পারিয়া শেষে ছুটিয়া পলাইল। তখন রাবণ আর অর্জুনের যে যুদ্ধ হইল, সে বড়ই ভয়ানক। দুজনেরই যেমন বিশাল দেহ, হাতে তেমনি ভীষণ গদা। রাবণ ভয়ানক তেজের সহিত অনেকক্ষণ যুদ্ধ করিয়াছিল, কিন্তু শেষে অর্জুনের গদার ঘায়ে অস্থির হইয়া কাঁদিতে কাঁদিতে বসিয়া পড়িল। অর্জুনও অমনি তাহাকে ধরিয়া এমনি বাঁধন বাঁধিলেন যে সে কথা আর বলিবার নয়; তাহা দেখিয়া দেবতাগণের কি আনন্দই হইল। তাহারা যে যত পরিলেন, অর্জুনের মাথায় পুষ্পবৃষ্টি করিলেন।  এদিকে রাক্ষসেরা আসিয়া অর্জুনের হাত হইতে রাবণকে ছাড়াইয়া নিতে কত চেষ্টাই করিল, কিন্তু সে কি তাহাদের কাজ? অর্জুন তাহাদিগকে বিধিমতে ঠ্যাঙইয়া রাবণকে লইয়া ঘরে চলিয়া গেলেন।  এখন রাবণের তো আর সংকটের সীমাই নাই, এ সংকট হইতে তাহাকে কে বাঁচায়? বাঁচাইবার লোক একটিমাত্র আছেন, তিনি হইতেছেন উহার পিতামহ পুলস্ত্য মুনি। মুনিঠাকুর নাতির মায়া এড়াইতে না পারিয়া তাড়াতাড়ি আসিয়া অর্জুনকে বলিলেন, “বাছ, আমার নাতিটিকে ছাড়িয়া দাও। উহাকে যে সাজা দিয়াছ তাহাতেই তোমার খুব নাম হইবে, আর উহাকে রাখিয়া লাভ কি?”  এ কথায় অর্জুন খুশি হইয়া তখনই রাবণকে ছাড়িয়া দিলেন; সে লজ্জায় মাথা হেট করিয়া চোরের মতো সেখান হইতে চলিয়া আসিল। কিন্তু দুষ্ট লোকের লজ্জা আর কতকাল থাকে? দুদিন পরেই দেখা গেল যে, রাবণ আবার রাজাদিগকে খোঁচাইয়া ফিরিতেছে।  মুনির কথায় অর্জুন রাবণকে ছাড়িয়া দিলেন, আবার তাহার সহিত বন্ধুতাও করিলেন। কাজেই তখন আর তাহার দর্পের সীমা রহিল না। যে কোনো বীরের নাম শুনিলেই সে তাহার সহিত যুদ্ধ করিতে গিয়া উপস্থিত হয় আর তর্জন গর্জন করিয়া আকাশ ফাটাইয়া দেয়। এমনি করিয়া একদিন সে কিষ্কিন্ধ্যায় গিয়া তর্জন গর্জন করিতে লাগিল,—“বালী কোথায়? আমি যুদ্ধ করিব।”  বালী তখন বাড়ি ছিল না, সমুদ্রের ধারে সন্ধ্যা করিতে গিয়াছিল। অন্য বানরেরা রাবণকে বলিল, “বালী সন্ধ্যা করিতে গিয়াছেন, এখনই আসিবেন। ততক্ষণ তুমি এই বিচিত্র সংসারখানি একবার শেষ দেখা দেখিয়া লও; কারণ বালী আসিলে তোমার প্রাণের আশা তিলমাত্রও থাকিবে না। আর, যদি তোমার নিতান্তই শীঘ্র শীঘ্র মরিবার প্রয়োজন হইয়া থাকে, তবে না হয় দক্ষিণ সমুদ্রে গিয়া তাঁহাকে খুঁজিয়া লও।”  রাবণ তখনই বানরদিগকে বকিতে বকিতে পুষ্পকরথ হাঁকাইয়া চলিয়া গেল, আর খানিক দূর গিয়াই দেখিল, বালী সোনার পাহাড়ের ন্যায় সমুদ্রের ধারে বসিয়া আছে। তাহার মুখখানি সকালবেলার সূর্যের মতো লাল আর উজ্জ্বল দেখা যাইতেছে। রাবণ ভাবিল, চুপি চুপি গিয়া বানরকে হঠাৎ জাপটিয়া ধরিতে হইবে। এই বলিয়া সে খুবই চুপি চুপি যাইতে লাগিল; সে জানে না যে, বালী ইহার আগেই তাহাকে দেখিতে পাইয়াছে। আর তাহার মনের কথাটি ঠিক বুঝিয়া লইয়া তাহারই জন্য চুপ করিয়া বসিয়া আছে—একটিবার হাতের কাছে পাইলেই তামাশাটা দেখাইয়া দিবে।  চোখে ভ্রুকূটি, মুখে ঘামাচি, হাত দুটি বিষম ব্যগ্রভাবে বাড়ান, এমনিভাবে আসিয়া রাবণ চোরের মতো বালীর পিছনে দাঁড়াইল; ভাবিল, ‘এইবার ধরি!’ কিন্তু হায়, তাহার আগেই বালী তাহাকে ধরিয়া বগলে পুরিয়া ফেলিল। সে একটিবার পিছনবাগে তাকাইয়াও দেখে নাই, অথচ ঠিক ফড়িংটির মতো রাক্ষসের বাছাকে ধরিয়া বগলে পুরিয়াছে। রাবণের সঙ্গের রাক্ষসগুলি অবশ্য তখন বড়ই ব্যস্ত হইয়া বালীকে মারিতে গিয়াছিল, কিন্তু বালীর কয়েকটা হাত-পা নাড়া খাইয়াই তাহারা কাঁপিয়া অস্থির, যুদ্ধ আর করিবে কি?  এদিকে রাবণ বালীর বগলে থাকিয়া প্রাণপণে তাহাকে আঁচড় কামড় দিতেছে, কিন্তু বালীর কাছে তাহা পিঁপড়ের কামড়ের মতোও ঠেকিতেছে না। বালী সেসব অগ্রাহ্য করিয়া নিজের সন্ধ্যাবন্দনায় মন দিল। দক্ষিণ সাগরের সন্ধ্যা শেষ হইলে, রাবণকে বগলে লইয়াই সে শূন্যপথে পশ্চিম সমুদ্রে গিয়া সন্ধ্যা করিতে লাগিল। তারপর উত্তর সমুদ্রে আর পূর্ব সমুদ্রেও ঠিক সেইরূপ সন্ধ্যা শেষ না করিয়া সে কিষ্কিন্ধ্যায় ফিরিল না। ততক্ষণে সেই বগলের চাপে আর গন্ধে আর ঘামে রাবণের কি দশা হইয়াছিল, বুঝিয়া লও।  কিষ্কিন্ধ্যায় বালী রাবণকে বগল হইতে বাহির করিয়া হাসিতে হাসিতে জিজ্ঞাসা করিল, “তুমি কোথা হইতে আসিয়াছ?” রাবণ যাতনায় মিটিমিটি চোখে বলিল, “আমি লঙ্কার রাজা রাবণ, আপনার সঙ্গে যুদ্ধ করিতে আসিয়াছিলাম। আপনি আমাকে পশুর মতো ধরিয়া এত পথ ঘুরাইয়া আনিলেন, আপনার কি আশ্চর্য ক্ষমতা! আমি আপনার সঙ্গে বন্ধুতা করিব।” সুতরাং তখন দুজনে বন্ধুতা হইয়া গেল। কাজেই সাজা পাইয়াও রাবণের শিক্ষা হইল না। সে আবার ব্রহ্মাণ্ডময় খুঁজিয়া বেড়াইতে লাগিল, কোন ছলে কাহারও সহিত যুদ্ধ করিয়া একটু বাহাদুরী লইতে পারে কি না।  ঘুরিতে ঘুরিতে আবার একদিন নারদ মুনির সঙ্গে রাবণের দেখা হইয়াছে। রাবণ বলিল, “মুনিঠাকুর, বলুন তো, কোন দেশের লোকের গায়ে সকলের চেয়ে বেশি জোর? তাহাদের সহিত আমি যুদ্ধ করিব।” মুনি বলিলেন, “ক্ষীরোদ সমুদ্রে শ্বেতদ্বীপ নামে একটি প্রকাণ্ড দ্বীপ আছে। সেই দ্বীপের লোকের মতো বলবান আর ধার্মিক মানুষ পৃথিবীতে আর কোথাও নাই।” এ কথা শুনিবামাত্রই রাবণ শ্বেতদ্বীপের দিকে পুষ্পকরথ চালাইয়া দিল, মুনিঠাকুরও একটু চিন্তা করিয়া তামাশা দেখিবার জন্য সেইখানেই চলিয়া গেলেন।  তারপর রাক্ষসেরা তো সিংহনাদ করিতে করিতে শ্বেতদ্বীপে গিয়া উপস্থিত হইয়াছে। কিন্তু সে স্থানের এমনি তেজ যে তাহারা কিছুতেই সেখানে টিকিয়া থাকিতে পারিতেছে না। হাওয়ায় পুষ্পক রথ উড়াইয়া নিল, রাক্ষসেরা সকলে ভয়ে পলায়ন করিল। কাজেই তখন আর কি করে? সে রথ আর লোকজন সব ছাড়িয়া দিয়া নিজেই গিয়া দ্বীপের ভিতরে প্রবেশ করিল।  সেখানে কয়েকটি মেয়ে বেড়াইতেছিল। তাহারা দেখিল, দশ মাথা আর কুড়ি হাতওয়ালা উপেন্দ্র—৯১ একটা লোক পথ দিয়া যাইতেছে, আর প্রাণপণে নিজের চেহারাটাকে ভয়ংকর করিবার চেষ্টা করিতেছে। এসব দেখিয়া তাহাদের বড়ই হাসি পাওয়ায় তাহাদের একজন আসিয়া রাবণের হাত ধরিয়া জিজ্ঞাসা করিল, “তুমি কে বাপু? তোমার বাবার নাম কি? এখানে আসিয়াছ কি করিতে?” এ কথায় রাবণের একটু রাগ হইল। সে খুব গম্ভীর সুরে উত্তর দিল, “আমি বিশ্রবার পুত্র রাবণ। এখানে যুদ্ধ করিতে আসিয়াছি, কাহাকেও দেখিতে পাইতেছি না।”  শুনিয়া মেয়েরা সকলে খিল খিল করিয়া হাসিতে লাগিল। তারপর তাহাদের একজন এক হাতে রাবণের কোমর ধরিয়া অন্য মেয়েদের সামনে নিয়া তাহাকে ঘুরাইতে ঘুরাইতে বলিল, “দেখ দেখ, আমি কেমন একটা কালো পোকা ধরিয়াছি; এর আবার দশটা মাথা, কুড়িটা হাত!” বলিয়াই সে সেটা আর একজনকে ছুঁড়িয়া দিল, সে আবার দিল আরেকজনের হাতে ছুঁড়িয়া। তখন তো রাবণকে লইয়া খুবই একটা লোফালুফির ধুম পড়িয়া গেল। মেয়েদের তাহাতে আমোদের সীমাই নাই, কিন্তু রাবণ বেচারার প্রাণ লইয়া টানাটানি। কাজেই তখন সে আর কি করে? সে দশ মুখের তিনশত বিশ দাঁতে ‘কট্টাশ!’ করিয়া এক মেয়ের হাতে এক কামড় বসাইয়া দিল। সে মেয়ে তো তখনই “মা-া-া-া গো-া-া!” বলিয়া তাহাকে ছুঁড়িয়া ফেলিয়া প্রাণপণে হাত ঝাড়িতে লাগিল। ততক্ষণে আরেকটি মেয়ে তাহাকে ধরিয়া শূন্যে লইয়া গিয়াছিল, তাহার হাতে সে দিল ভয়ানক আঁচড়াইয়া! সে মেয়েটি তখন তাড়াতাড়ি তাহাকে ছুঁড়িয়া একেবারে সমুদ্রের মাঝখানে ফেলিয়া দিল।  নারদমুনি অবশ্য এতক্ষণ সেইখানে দাঁড়াইয়া তামাশা দেখিতেছিলেন, আর আনন্দে অস্থির হইয়া কেবলই হো হো শব্দে হাস্য আর করতালি দিয়া নৃত্য করিতেছিলেন।  বলাবাহুল্য, রাবণের যুদ্ধের সাধ সেদিন সেই সমুদ্রের জল খাইয়া মিটিয়াছিল।
উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী
রেবতীর বিবাহ উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী রেবতীর বিবাহ  এক রাজা ছিলেন, তাঁহার নাম ছিল রৈবত ককুদ্মী। পশ্চিম সমুদ্রের ধারে, কুশস্থলী নামক নগরে তিনি বাস করিতেন। রৈবতের একটি কন্যা ছিল, তাহার নাম রেবতী। রেবতীর গুণের কথা আর বলিয়া শেষ করা যায় না। মেয়েটি দেখিতে যেমন অপরূপ সুন্দরী, তেমনি সুশীলা আর মিষ্টভাষিণী, আর বুদ্ধিমতীও যতদুর হইতে হয়।  রেবতী যতই বাড়িয়া উঠিলেন, রাজার মনেও ততই ভাবনা হইল যে, ‘আহা! আমার এই স্নেহের মেয়েটিকে এখন কাহার হাতে সমর্পণ করি?’  সংসারের যত ভালো ভালো রাজপুত্র একে একে সকলের সংবাদ রাজা লইলেন, কিন্তু কাহাকেও তাঁহার পছন্দ হইলনা। মন্ত্রী, পুরোহিত, আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধব সকলকেই বলিলেন, কেহই তেমন ভালো একটি পাত্রের সন্ধান করিয়া দিতে পারিল না।  শেষে আর কোনো উপায় না দেখিয়া তিনি ভাবিলেন, ‘ব্রহ্মার কাছে যাই, তিনি অবশ্যই আমার মনের মতন একটি ছেলের কথা বলিতে পারিবেন।’  এই ভাবিয়া রাজা কন্যাটিকে লইয়া ব্রহ্মার সভায় গিয়া উপস্থিত হইলেন। তখন হাহা আর হুহু নামে দুইজন গন্ধর্ব সেইখানে বসিয়া ব্রহ্মাকে গান শুনাইতেছিলেন। হাহা আর হুহুর মতো ওস্তাদ আর এই ত্রিভুবনে কখনো দেখা যায় নাই, তাঁহাদের সেই বিচিত্র সংগীত শুনিতে যে কি মিষ্ট লাগিতেছিল, তাহা কি বলিব! সে গান একবার শুনিতে আরম্ভ করিলে আর সকল বিষয়ের কথা ভুলিয়া যাইতে হয়। যতক্ষণ সে গানের শেষ না হয় ততক্ষণ আর উঠিয়া আসিবার জো থাকে না। সে আশ্চর্য গান একবার আরম্ভ হইলে আর শীঘ্র শেষও হইতে চাহে না। সেটা ছিল ত্রেতাযুগের আরম্ভ। গাহিতে গাহিতে সে যুগ শেষ হইয়া গেল, তারপর দ্বাপর আসিল, তাহাও প্রায় শেষ হইতে চলিল, তবে হাহা হুহু গান শেষ করিয়া তম্বুরা নামাইলেন। এতকাল যে চলিয়া গিয়াছে, রাজার কিন্তু সে খেয়ালই নাই। তিনি ভাবিতেছেন, ‘আহা, এমন সুন্দর গান মুহূর্তের মধ্যেই ফুরাইয়া গেল?’  যাহা হউক, এখন নিজের কাজ সারিয়া লইতে হইবে আর বিলম্ব করা ভালো নহে। এই ভাবিয়া রাজা ব্রহ্মার সিংহাসনের সামনে গিয়া ভক্তিভরে প্রণামের পর জোড়হাতে বলিলেন, “ভগবন্‌! আমার এই কন্যাটির বিবাহ কাহার সঙ্গে দিব, দয়া করিয়া আমাকে বলিয়া দিন। আমি অনেক রাজপুত্রের সন্ধান লইয়াছি, কিন্তু ইহাদের কোনটি যে সকলের চেয়ে ভালো, তাহা স্থির করিতে পারিতেছি না।”  ব্রহ্মা বলিলেন, “আচ্ছা, তুমি কাহার কাহার কথা ভাবিয়াছ, আমাকে বল দেখি।”  সে কথায় রাজা অনেকের নাম করিয়া বলিলেন, “ইঁহাদের মধ্যে একটি হইলে আমি সুখী হইতাম।” তাহা শুনিয়া ব্রহ্মা হাসিয়া বলিলেন, “মহারাজ, তুমি যাহাদের নাম করিলে, এখন তো তাহাদের কেহই বাঁচিয়া নাই; তাহারা ছিল ত্রেতা যুগের লোক, আর এখন হইল দ্বাপরের শেষ। এতদিনে তাহাদের ছেলের ছেলে, নাতির নাতি অবধি মরিয়া গিয়াছে, তাহাদের রাজ্য, বংশ, নাম অবধি লোপ পাইয়াছে!”  তোমরা হয়তো ভাবিতেছ যে, পৃথিবীর আর সব লোক মরিয়া গেল, আর শুধু রাজা আর তাঁহার মেয়েটি বাঁচিয়া রহিয়াছে, এ কেমন কথা হইল?  কিন্তু সে যে ব্রহ্মার পুরী, সেখানে তো জরা মৃত্যুর অধিকার নাই। কাজেই তাঁহারা দুজন শুধু যে বাঁচিয়া আছেন তাহাই নহে, ঠিক যেমনটি গিয়াছিলেন তেমনি আছেন, একটুও বুড়া হন নাই!  যাহা হউক, ব্রহ্মার কথায় রাজা নিতান্তই আশ্চর্য হইলেন আব ভয় পাইলেন, আর ব্যস্ত হইলেন তাহার চেয়েও বেশি।  তিনি বিষম থতমত খাইয়া বলিলেন, “এ্যাঁ, এ্যাঁ! কি সর্বনাশ। তাই তো! প্রভু, এখন উপায়? এখন তবে আমার এই মেয়েটিকে কাহার হাতে দিই? আমার সমকক্ষ রাজা এখন কে কে আছেন?”  ব্রহ্মা বলিলেন, “মহারাজ! এতদিনে কি আর তোমার সে রাজ্য আছে? তোমার রাজ্যও নাই, প্রজারাও নাই। তোমার সেই সুন্দর কুশস্থলী নগরটি অবধি নাই। তাহার জায়গায় এখন দ্বারকা নামক পুরী হইয়াছে। সেই দ্বারকার রাজা কৃষ্ণ, তাঁহার ভাই বলরাম। সেই বলরামের সঙ্গে গিয়া তোমার এই কন্যার বিবাহ দাও। এ মেয়েটি যেমন লক্ষ্মী, বলরামও তেমনি মহাশয় লোক, সকলরকমেই ইহার উপযুক্ত।”  কাজেই রাজা তখন আর কি করেন? তিনি ব্রহ্মাকে প্রণাম করিয়া মাথা চুলকাইতে চুলকাইতে পৃথিবীতে ফিরিয়া আসিলেন। আসিয়া দেখেন বাস্তবিকই তাঁহার রাজ্য, রাজধানী, লোকজন, আত্মীয়স্বজন সব লোপ পাইয়াছে। পৃথিবী আর সে পৃথিবীই নাই। তাঁহাদের সময়ে চৌদ্দ হাত লম্বা এক একটা মানুষ হইত, আর এখনকার লোকগুলি মোটে সাত হাত লম্বা আর তাহাদের চালচলনও যেন কেমন কেমন হইয়া গিয়াছে। যাহা হউক, আর দুঃখ করিয়া কি হইবে? রাজা বলরামকে খুজিয়া বাহির করিয়া, তাঁহার সহিত মেয়ের বিবাহ দিয়া বনবাসী হইলেন।  এদিকে রেবতীকে পাইয়া বলরামের আর আনন্দের সীমাই নাই। কেবল একটি কথায় তিনি একটু মুশকিলে পড়িয়াছেন, বলরাম হইতেছেন দ্বাপর যুগের লোক, তিনি সাত হাত লম্বা, রেবতী ত্রেতা যুগের মেয়ে, তিনি চৌদ্দ হাত লম্বা, বলরাম প্রাণপণে হাত বাড়াইয়াও তাহার মাথা নাগাল পান না!  তখন বলরাম করিলেন কি, তাঁহার লাঙ্গলের আগা দিয়া রেবতীকে চাপিয়া অন্যান্য মেয়েদের মতো বেঁটে করিয়া লইলেন। তারপর আর কোনো অসুবিধা রহিল না।
উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী
শব্দবেধী উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী শব্দবেধী  জন্তুকে না দেখিয়া, কেবলমাত্র তাহার শব্দ শুনিয়াই যে তাহাকে তীর দিয়া বিঁধিতে পারে, তাহাকে বলে ‘শব্দবেধী’।  রাজা দশরথ এইরূপ ‘শব্দবেধী’ ছিলেন। যুবা বয়সে অনেক সময় তিনি রাত্রিতে বনে গিয়া এইরূপে কত হাতি, মহিষ, হরিণ শিকার করিতেন। বর্ষার রাত্রে তীর-ধনুক লইয়া চুপিচুপি সরযুর ধারে বসিয়া থাকিতে তাঁহার বড়ই ভালো লাগিত। নদীর ঘাটে নানারূপ জন্তু জল খাইতে আসিত; সেই জলপানের শব্দ একটিবার দশরথের কানে গেলে আর সে জন্তুকে ঘরে ফিরিতে হইত না।  একবার এইরূপ বর্ষার রাত্রিতে দশরথ সরযুর ধারে তীর-ধনুক লইয়া বসিয়া আছেন। মনে আর কোনো চিন্তা নাই, খালি কান পাতিয়া রহিয়াছেন, কখন কোন জানোয়ারের শব্দ শোনা যাইবে। প্রায় সমস্ত রাত্রি এইভাবে কাটিয়া গিয়াছে, ভোর হইতে আর বেশি বাকি নাই। এমন সময় নদীর ঘাট হইতে ‘গুড়্‌-গুড়্‌-গুড়্‌-গুড়্‌’ করিয়া একটা আওয়াজ আসিল!  দশরথ চমকিয়া ভাবিলেন, ‘ঐ হাতি।’ আর সেই মুহূর্তেই সেই শব্দের দিকে একটি ভয়ংকর বাণ শন্‌শন্‌ শব্দে ছুটিয়া চলিল।  দশরথ জানেন না যে সে বাণে কি সর্বনাশ হইবে। সে শব্দ তো হাতির শব্দ নয়, ঋষির পুত্র ভোরের বেলায় কলসী হাতে ঘাট হইতে জল নিতে আসিয়াছেন, সেই কলসীতে জল পোরার ঐ শব্দ।  অন্ধ পিতামাতা বিছানায় পড়িয়া কষ্ট পাইতেছেন; তাঁহারা একে যারপরনাই বুড়া, তাহাতে আবার নিতান্ত দুর্বল, চলিবার শক্তি নাই। পিপাসায় তাঁহাদের প্রাণ ওষ্ঠাগত, তাই ছেলেটি ছুটিয়া জল নিতে আসিয়াছেন, এমন সময় কোথা হইতে এই নিদারুণ বাণ আসিয়া তাহার বুকে বিঁধিল। রক্তে দেহ ভাসিয়া গেল, কলসী হাত হইতে পড়িয়া গেল।  ঋষিপুত্র ধুলায় পড়িয়া ছট্‌ফট্‌ করিতে করিতে বলিলেন, “আহা! আমি তো কাহারও কোনো অনিষ্ট করি না। বনে থাকি, ফলমূল খাই আর বৃদ্ধ অন্ধ পিতামাতার সেবা করি! ওগো! আমি তোমার নিকট কি অপরাধ করিয়াছিলাম যে এমন নিষ্ঠুর সাজা আমাকে দিলে? হায় হায়! আমার পিতামাতাকে দেখিবার যে আর কেহই নাই। আমি মরিলে যে আর তাঁহারা কিছুতেই বাঁচিবেন না!’’  ঋষিপুত্রের কথা শুনিয়া দশরথেব হাত হইতে ধনুর্বাণ পড়িয়া গেল। তিনি দুঃখে অস্থির হইয়া পাগলের মতো ছুটিয়া আসিয়া দেখিলেন যে সর্বনাশ হইয়া গিয়াছে!  তখন ঋষিপুত্র অতি কষ্টে তাহাকে বলিলেন, “মহারাজ! আমার কি অপরাধ ছিল? এই এক বাণে আমারও প্রাণ গেল, আমার পিতামাতারও প্রাণ গেল। আহা! মা আর বাবা পিপাসায় কাতর হইয়া পথ চাহিয়া আছেন, আমি গেলে জল খাইতে পাইবেন।”  দুঃখে দশরথেব বুক ফাটিয়া যাইতেছে, তাঁহার কথা বলিবার শক্তি নাই। তাহা দেখিয়া সেই যাতনার মধ্যেও ঋষিপুত্রের দয়া হইল; তিনি বলিলেন, “মহারাজ! আর এখানে বিলম্ব করিবেন না। এই সরু পথে আমাদের কুটিরে যাওয়া যায়। শীঘ্র গিয়া আমার পিতাকে এই সংবাদ দিন, আর তাঁহার রাগ দূর করুন, নইলে তিনি আপনাকে ভয়ংকর শাপ দিবেন। আর এই বাণ যে আমার বুকে বিঁধিয়া রহিয়াছে, ইহার যন্ত্রণা আমি সহ্য করিতে পারিতেছি না, শীঘ্র এটাকে তুলিয়া দিন।”  দশরথ ভাবিলেন, “হায়! আমি এখন কি করি? বাণ না তুলিলে ইঁহার যন্ত্রণা যাইবে না, কিন্তু বাণ তুলিলেই ইঁহার মৃত্যু হইবে।”  তখন ঋষিপুত্র বলিলেন, “আপনার কোনো ভয় নাই। বাণ তুলিবার সময় যদি আমি মরিয়া যাই, তাহাতে আপনার ব্রাহ্মণবধের পাপ হইবে না। আমি ব্রাহ্মণ নহি, আমার পিতা বৈশ্য, মা শূদ্রের মেয়ে।”  এ কথায় দশরথ ঋষিপুত্রের বুক হইতে বাণ টানিয়া বাহির করিলেন, আর তাহার সঙ্গে সঙ্গেই ছেলেটির প্রাণ বাহির হইয়া গেল। তখন সেই কলসী ভরিয়া জল লইয়া দশরথ নিতান্ত দুঃখিত মনে ধীরে ধীরে কুটিরের দিকে চলিলেন। সেখানে অন্ধ মুনি আর তাঁহার অন্ধ পত্নী পিপাসায় কাতর হইয়া পুত্রের আশায় বসিয়া আছেন। দশরথেব পায়ের শব্দ শুনিয়া মুনি বলিলেন, “বাবা, এত বিলম্ব কেন হইল? তোমার জন্য তোমার মা বড় ব্যস্ত হইয়াছেন, শীঘ্র ঘরে আইস। তুমি কি রাগ করিয়াছ বাবা? আমাদের যদি কোনো দোষ হইয়া থাকে, তাহা তোমার মনে করা উচিত নয়। তুমি কথা কহিতেছ না কেন?”  দশরথের চোখ জলে ভরিয়া গেল। তিনি অনেক কষ্টে কাঁদিতে কাঁদিতে বলিলেন, “ভগবন, আমি আপনার পুত্র নহি। আমি ক্ষত্রিয়, আমার নাম দশরথ। আজ এই অভাগার বাণে আপনার পুত্রের মৃত্যু হইয়াছে। আমি জন্তু মারিবার জন্য সরযুর ধারে বসিয়াছিলাম। আপনার পুত্রের কলসীতে জল ভরার শব্দ শুনিয়া মনে করিলাম বুঝি হাতির শব্দ। অন্ধকারের ভিতরে সেই শব্দের দিকে বাণ ছুঁড়িলাম, তাহাতেই এই সর্বনাশ হইল। এখন এই পাপীর প্রতি আপনার যাহা ইচ্ছা হয় করুন।”  এই বলিয়া দশরথ ছল ছল চোখে জোড়হাতে দাঁড়াইয়া রহিলেন।  মুনি এই দারুণ সংবাদ শুনিয়াও সাধারণ লোকের মতো ব্যস্ত হইলেন না, রাজাকে কোন কঠিন শাপও দিলেন না। তিনি কেবল একটি দীর্ঘনিশ্বাস ফেলিয়া বলিলেন “মহারাজ। তুমি না জানিয়া এ কাজ করিয়াছ, তাই রক্ষা পাইলে, নাহলে আজ তোমার বংশসুদ্ধ নষ্ট হইত। এখন এক কাজ কর, আমরা আমাদের পুত্রের নিকট যাইতে চাহি, একটিবার আমাদিগকে সেখানে লইয়া চল।”  রাজা তখনই তাঁহাদের দুজনকে সরযুর ধারে লইয়া আসিলেন। তাঁহাদের চক্ষু নাই, সুতরাং জন্মের মতো একটিবার পুত্রের মুখ দেখিবার উপায় নাই। তাঁহারা কেবল তাঁহার দেহের উপর পড়িয়া বারবার তাঁহাকে আশীর্বাদ করিতে লাগিলেন। তারপর চিতা প্রস্তুত করিয়া সেই দেহ পোড়ান হইল।  তখন অন্ধ মুনি নিতান্ত দুঃখের সহিত রাজাকে বলিলেন, “মহারাজ। পুত্রের শোকে আমি এখন যে দুঃখ পাইতেছি, এইরূপ পুত্রশোক তোমাকেও পাইতে হইবে।”  এই বলিয়া তাঁহারা দুজনে সেই চিতায় ঝাঁপ দিয়া পড়িলেন, আর দেখিতে দেখিতে তাঁহাদের শরীর ভস্ম হইয়া গেল।  ইহার অনেক বৎসর পরে বৃদ্ধ বয়সে, কৈকেয়ীর ছলনায় দশরথ রামকে বনে দেন, আর সেই রামের শোকে তাঁহার মৃত্যু হয়। তখন অন্ধ মুনির সেই কথাগুলি তাহার মনে পড়িয়াছিল— ‘পুত্রব্যসনজং দুঃখং যদেতস্মম সাম্প্রতম্‌এবং ত্বং পুত্রশোকেন রাজন্‌ কালং করিষ্যসি॥’
উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী
শিবের বিয়ে উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী শিবের বিয়ে  দুর্গার এক নাম ‘পার্বতী’, অর্থাৎ পর্বতের মেয়ে। তাঁর পিতা হিমালয়, মা মেনকা। শিবের সঙ্গে যাতে তাঁর বিয়ে হয়, এজন্য পার্বতী অনেকদিন ধরে কঠিন তপস্যা করেছিলেন, তার ফলে শেষে শিবের সঙ্গেই তাঁর বিয়ে হল।  পার্বতীর তপস্যায় তুষ্ট হয়ে শিব তাঁকে বিবাহ করতে চাইলেন। কিন্তু বর যে, সে তো আর নিজের কনের বাপের কাছে গিয়ে বিয়ে ঠিক করতে পারে না, তাহলে লোকে হাসে! কাজেই শিব সপ্তর্ষিদের ডেকে পাঠালেন। সপ্তর্ষিরাও তখনই সোনার বল্কল পরে, মুক্তামালা গলায় দিয়ে, মণি-মাণিক্যের গহনা ঝল্‌মলিয়ে তাঁর কাছে এসে জোড়হাতে বললেন, ‘‘আমাদের কি সৌভাগ্য! প্রভু আজ আমাদের স্মরণ করেছেন। আজ্ঞা করুন, আমাদের কি করতে হবে।”  শিব বললেন, ‘‘আমি হিমালয় পর্বতের মেয়ে পার্বতীকে বিয়ে করতে চাই; তোমরা তাঁর কাছে গিয়ে সব ঠিকঠাক কর। দেখো যেন ভালোমতে কাজটি করে আসতে পার।”  সপ্তর্ষিরা তখন নিমেষের মধ্যে আকাশে উড়ে, সেই ঝক্‌ঝকে হিমালয় পর্বতে গিয়ে উপস্থিত হলেন। হিমালয় দূরে থেকে তাঁদের দেখতে পেয়ে মেনকাকে বললেন, “না জানি ঐ সাতটি সূর্য কি করতে আমাদের এখানে আসছে!” বলতে বলতেই তিনি দেখলেন, ওসব সূর্য নয়, সাতটি মুনি। তখন তিনি তাড়াতাড়ি তাঁদের কাছে গিয়ে, জোড়হাতে তাঁদের নমস্কার করে বসতে সুন্দর আসন দিয়ে বললেন,“মুনি-ঠাকুরেরা কি মনে করে আমাদের এখানে পায়ের ধুলো দিয়েছেন?” মুনিরা বললেন, ‘‘শিব তোমার কন্যা পার্বতীকে বিয়ে করতে চেয়েছেন, তাই আমরা এসেছি। এমন জামাই আর পাবে না রাজা, শিবের কাছে তোমার পার্বতীর বিয়ে দাও।”  তা শুনে হিমালয়ের আর আনন্দের সীমাই রইল না। তিনি তখনি ছুটে গিয়ে, পার্বতীকে সাজিয়ে গুজিয়ে এনে মুনিদের কোলে বসিয়ে দিয়ে বললেন, “এই নিন, আমার পার্বতীকে।” এমন সুন্দর লক্ষ্মী মেয়ে আর কখনো হয় নি, হবেও না। পার্বতীকে দেখে স্নেহে মুনিদের মন গলে গেল। তাঁরা তাঁর গায়ে হাত বুলিয়ে, তাঁকে কত আশীর্বাদ করে, বিয়ের সব কথাবার্তা বলে সেখান থেকে পরম আনন্দে হাসতে হাসতে চলে এলেন। স্থির হল যে আর তিনদিন পরেই শিবের সঙ্গে পার্বতীর বিয়ে হবে।  সপ্তর্ষিরা শিবের কাছে এসে এসব কথা জানালে শিব যারপরনাই খুশি হয়ে বললেন, “বেশ বেশ! বিয়ের সময় তোমরা আমার পুরুত হবে কিন্তু। তোমাদের শিষ্যদেরও নিয়ে আসবে।”  মুনিরা সে কথায় ‘যে আজ্ঞা’ বলে চলে যেতেই শিব বিয়ের আয়োজন করবার জন্য তাঁর ভূত প্রেত নিয়ে কৈলাস পর্বতে চলে এলেন। তারপর তিনি নারদকে ডেকে বললেন, “নারদ, বিয়ের ঠিক করেছি; কনে হচ্ছেন হিমালয়ের মেয়ে পার্বতী। এখন তুমি একটি কাজ কর তো; দেবতাদের সকলকে নিমন্ত্রণ করে এস। মুনি-ঋষিদেরও বলবে; যক্ষ-গন্ধর্বেরাও যেন বাদ না পড়ে। সকলকেই আসতে হবে; যে না আসবে তার সঙ্গে আমার ছাড়াছড়ি হবে।”  নারদ মুনি যেমন তেমন চালাক লোক ছিলেন না, শিবের হুকুমমতো সব কাজ করে ফেললেন।  ততক্ষণে কৈলাস-পর্বতে খুবই ধুমধাম পড়ে গেছে; ভূতেরা ঢাক, ঢোল, শিঙ্গা, সানাই, কাঁসর, করতাল সব বাজিয়ে সৃষ্টি মাথায় করে তুলেছে। তাদের মুখে আজ আর হাসি ধরে না। ক্রমে দেবতারাও একজন দুজন করে এসে উপস্থিত হলেন। হাঁসে চড়ে ব্রহ্মা এলেন, গরুড়ে চড়ে বিষ্ণু এলেন। ইন্দ্র, যম, কুবের, বরুণ, কেউ আসতে বাকি রইলেন না। গন্ধর্ব আর অপ্সরারা তো এর ঢের আগেই এসে গান বাজনা জুড়ে দিয়েছে। শিবও সেই কখন থেকে সেজেগুজে প্রস্তুত হয়ে আছেন। বরের বেশে তাঁকে কি সুন্দরই দেখাচ্ছে।  তারপর সকলে শিবকে নিয়ে রওনা হলেন। দেবতারা নিজ নিজ দল নিয়ে বরের আগে আগে যেতে লাগলেন, বাজনদারেরা মাথা দুলিয়ে নাচতে নাচতে তাদের সঙ্গে সঙ্গে বাজিয়ে চলল।  এদিকে হিমালয়ও চুপ করে বসে থাকেন নি। পার্বতীকে নাইয়ে, সাজিয়ে তাঁরাও প্রস্তুত হয়ে আছেন। বাড়ি ঘর সাজিয়ে, তোরণ বানিয়ে, নিশান উড়িয়ে, স্বপ্নপুরীর মতো সুন্দর করা হয়েছে। পর্বতেরা সকলে সেজেগুজে সপরিবারে এসে কাজকর্মে ব্যস্ত রয়েছেন। শিবকে এগিয়ে আনবার জন্য স্বয়ং গন্ধমাদন পর্বত কখন বেরিয়ে গেছেন। বর এলে তাকে আদর করে আনতে হবে, সেজন্য নিজে হিমালয় ফটকে দাঁড়িয়ে।  বাড়ির ভিতরেও অবশ্যি কেউ চুপ করে নাই। মেয়েদের আজ বড়ই আনন্দ আর উৎসাহ। পার্বতীর মা মেনকাদেবী তো আনন্দে মাথা ঠিকই রাখতে পাচ্ছেন না। তিনি এরই মধ্যে নারদ মুনিকে সঙ্গে করে গিয়ে ছাতে উঠে আছেন—যার জন্যে মেয়ে এত তপস্যা করলেন, সেই শিবকে সকলের আগে দেখতে হবে। সাধারণ দেবতারাই যখন দেখতে এত সুন্দর, শিব না জানি তবে কত সুন্দর।  এমন সময় গন্ধর্বের রাজা বিশ্বাবসু এলেন। তিনি দেখতে খুবই সুন্দর, তাঁকে দেখে মেনকা বললেন, “এই বুঝি শিব!” নারদ তাতে হেসে বললেন, “না, না—ও তো আমাদের বাজনদার, ও কেন শিব হবে? তা শুনে মেনকা তো থতমত খেয়ে চুপ করে গেলেন, ভাবলেন, ‘বাজনদারই দেখতে এমন, শিব না জানি তবে কেমন!’  তারপর এলেন যক্ষদের নিয়ে কুবের; তিনি গন্ধর্বের রাজার চেয়ে দ্বিগুণ সুন্দর। মেনকা বললেন, “তবে এই শিব!” নারদ বললেন, “না!” শুনে মেনকা আরো আশ্চর্য হলেন।  তারপর এলেন বরুণ, তিনি কুবেরের চেয়ে দ্বিগুণ সুন্দর; তারপর এলেন যম, তিনি বরুণের চেয়ে দ্বিগুণ সুন্দর; তারপর এলেন ইন্দ্র, তিনি যমের চেয়েও দ্বিগুণ সুন্দর। মেনকা এঁদের একেকজনকে দেখে ভারি খুশি হয়ে বললেন, “এ নিশ্চয় শিব!” নারদ তাতে না বললেন, তিনি অপ্রস্তুত হয়ে মাথা চুলকাতে লাগলেন।  এমনি করে সূর্য, চন্দ্র, ব্রহ্মা, বিষ্ণু, বৃহস্পতি সকলকে দেখেই মেনকা বললেন, “এই শিব!” যখন শুনলেন যে এঁদের কেউ শিব নন, শিব এঁদের চেয়েও বড়, তখন তাঁর এতই আশ্চর্য বোধ হল যে, তিনি আর ভাবতেই পারলেন না, সেই শিব তবে কত সুন্দর।  এমন সময় ভূত প্রেত ব্রহ্মদৈত্যি সব নিয়ে শিব এসে উপস্থিত। এত ভূত আর মেনকা কখনো একসঙ্গে দেখেন নি; তাদের সেই বিকট ভেঙ্‌চি দেখেই তাঁর মাথা ঘুরে গেল। তাদের সঙ্গে যে আবার পাঁচমুখো একটা কে ষাঁড়ে চড়ে এসেছে—মাথায় জটা, পরনে বাঘছাল, গায়ে ছাই মাখা, গলায় মড়ার মাথা—সে কথার খবর নিবার খেয়ালই তাঁর রইল না। তখন নারদ সেই দেবতাকে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে বললেন—“এই শিব!”  যেই এই কথা বলা, অমনি মেনকা, “ও লক্ষ্মীছাড়া পোড়ারমুখী পার্বতী! করেছিস কি!” বলে অজ্ঞান হয়ে পড়ে গেলেন।  শিব সে কথা জানতে পেরে ছুটে এসে মেনকার মাথায় জল ঢেলে অনেক হাওয়া করতে শেষে তাঁর জ্ঞান হল।  তখন যে তিনি শিবকে আর নারদকে বকুনিটা বকলেন! নারদের অপরাধ ছিল এই যে তিনি বলেছিলেন, “শিব বড় ভালো, তাঁর সঙ্গে পার্বতীর বিয়ে হবে।” বকতে বকতে তাঁর সেই সাত মুনির কথা মনে পড়ল যাঁরা পার্বতীর বিয়ে ঠিক করতে এসেছিলেন। অমনি তিনি তাঁদের উপর যারপরনাই চটে বললেন, “বেটারা গেল কোথায়? আজ তাদের দাড়ি ছিঁড়তে হবে।” আবার তখনই মাথায় চাপড় মেরে বললেন, “আর তাদেরই বা দোষ কি! ঐ অভাগী মেয়েই তো যত নষ্টের গোড়া!” এই বলে তিনি পার্বতীকে কত গালই দিলেন। শেষে তিনি বললেন, “আমি কিছুতেই এই কদাকার বুড়োর কাছে মেয়ের বিয়ে দিব না। ওর না আছে টাকা, না আছে গুণ, না জানে লেখাপড়া, না পারে একটা ঘোড়া কিনে চড়তে।”  তখন সকলে মিলে মেনকাকে কত বুঝাইলেন, কারও কথায় কিছু হল না। পার্বতী নিজে এসে একবার তাঁকে মিনতি করে দুটো কথা বলেছিলেন, তাতে তিনি দাঁত কড়্‌মড়িয়ে খেপে উঠে পার্বতীকে এমনি কিল আর কনুয়ের গুঁতো মারতে লাগলেন যে, নারদ মুনি তাড়াতাড়ি এসে তাঁকে ছড়িয়ে না নিলে সেদিন ভারি মুশকিল হত আর কি!  যা হোক শেষে বিষ্ণু এসে অনেক উপদেশ দিতে মেনকার মন একটু শান্ত হল। ঠিক সেই সময়ে নারদও শিবকে বুঝিয়ে সুঝিয়ে তাঁর চেহারা অনেকটা শুধরিয়ে এনে মেনকার সামনে উপস্থিত করলেন। তখন মেনকা দেখলেন যে শিবের মাথায় জটা আর গায়ে ছাঁই বলে তাঁকে একটু উস্কোখুস্কো দেখায় বটে, কিন্তু আসলে তিনি সকল দেবতার চেয়ে সুন্দর। মেনকা যতই তাঁর মুখের দিকে তাকান, ততই তাঁর মনে হয় যে, ‘আহা কি মিষ্টি! কি সরল!’  এমনিভাবে মেনকা অনেকক্ষণ অবাক হয়ে শিবের মুখের দিকে চেয়ে থেকে বললেন, “আহা! আমার পার্বতীর কপাল ভালো যে এমন স্বামী পেয়েছে!” তা শুনে শিবের ভারি লজ্জা হওয়ায় তিনি জড়সড় ভাবে দেবতার কাছে চলে গেলেন।  এদিকে মেয়েদের মহলে ভয়ানক ছুটাছুটির ধুম লেগে গেছে। সবাই বলছে, “আরে, দেখ এসে, পার্বতীর কি সুন্দর বর হয়েছে।” তারা যে যেমন ছিল, তেমনি ভাবে, কেউ রান্না ফেলে, কেউ কলসী কাঁকে, কেউ চুল বাঁধতে বাঁধতে কেউ ঘোমটা টানতে টানতে, কেউ আছাড় খেতে খেতে এসে উপস্থিত হল। শিবকে তারা চন্দন দিয়ে, খৈ দিয়ে, আরো কতরকমে পূজো যে করল তা কি বলব! তাঁকে নিয়ে হাসি তামাশা কত হল, তার তো অন্তই নাই। মেনকা অবধি এসে তাতে যোগ না দিয়ে থাকতে পারলেন না। তিনি শিবের পিছনে গিয়ে, তাঁর গলায় কাপড় জড়িয়ে টানতে আরম্ভ করেছিলেন, দেবতারা দেখে ফেলায় হাসতে হাসতে ঘরে পালিয়ে গেলেন।  তারপর শিবকে রেশমী কাপড় পরিয়ে তাঁর গলায় সোনার ফুলের মালা, কপালে তিলক দিয়ে তাঁকে আর পার্বতীকে বিয়ের জায়গায় নিয়ে যাওয়া হল। মুনিরা বেদ পড়তে লাগলেন। ব্রহ্মা তাঁদের দিয়ে বিয়ের সকল কাজ করিয়ে নিলেন। তারপর তাঁর কথায় এসে শিব আর পার্বতীর কপালে খৈ ছড়িয়ে দিতে লাগল। আর, গন্ধর্ব আর অন্সরারা মিলে গান বাজনা যে খুবই করল, তার তো কথাই নাই।  এমনি করে শিব আর পার্বতীর বিয়ে হয়ে গেল। হিমালয় দেবতাদের সকলকে এমনি আদর অভ্যর্থনা করলেন যে তাঁদের লাজে মাথা হেঁট করে থাকতে হল। তারা হিমালয়কে কত আশীর্বাদ যে করলেন, তার লেখাজোখা নাই। তখন মেনকা লাজে জড়সড় হয়ে তাঁদের কাছে এসে বললেন, “ঠাকুর। আপনাদের কাছে আমি ভারী পাগলামি করেছি, আমার বড় অপরাধ হয়েছে, আমাকে মাপ করতে হবে।” দেবতারা হেসে বললেন, “আপনার কোনো চিন্তা নাই; আপনি যা করছেন তাতে আমরা আমোদই পেয়েছি। আপনার দিন দিন সৌভাগ্য বাড়তে থাকুক।”  তখন আবার বাজনা বেজে উঠল, সকলে সেজে প্রস্তুত হল, দেবতারা মনের সুখে বর কনে নিয়ে কৈলাসে যাত্রা করলেন। হিমালয় আর মেনকা সকলকে নিয়ে এঁদের গন্ধমাদন পর্বত অবধি এগিয়ে দিয়ে, ঘরে ফিরে এসে ভাবলেন, ‘হায়, সব যে অন্ধকার! কোথায় গেল আমাদের পার্বতী?”
উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী
শুম্ভ-নিশুম্ভ উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী শুম্ভ-নিশুম্ভ  শুম্ভ, আর তাহার ভাই নিশুম্ভ, এই দুটা অসুর দেবতাদিগকে বড়ই নাকাল করিয়াছিল। তাহারা তাঁহাদিগকে স্বর্গ হইতে তাড়াইয়া দিয়া আর অস্ত্র-শস্ত্র কাড়িয়া লইয়াই সন্তুষ্ট থাকে নাই, তাঁহাদের ব্যবসায় পর্যন্ত নিজেরা করিতে আরম্ভ করিল। চন্দ্র, সূর্য, কুবের, পবন, অগ্নি কাহারও ব্যবসাই তাঁহাদের হাতে রাখিল না।  বিপাকে পড়িয়া দেবতারা বলিলেন, “আর কাহার কাছে যাইব। মহিষাসুরের হাত হইতে যে দেবী আমাদিগকে বাঁচাইয়াছিলেন; সেই চণ্ডিকা দেবীকেই ডাকি।” এই বলিয়া তাঁহারা হিমালয় পর্বতে গিয়া চণ্ডিকা দেবীর স্তব করিতে লাগিলেন। সেই সময় পার্বতী সেই পথে যাইতেছিলেন, তিনি দেবতাদিগকে জিজ্ঞাসা করিলেন, “আপনারা কাহার স্তব করিতেছেন?” তাহার কথা শেষ হইতে না হইতেই তাঁহার শরীর হইতে চণ্ডিকা দেবী বাহির হইয়া বলিলেন, “দেবতারা আমাকেই ডাকিতেছেন, শুম্ভ-নিশুম্ভ তাঁহাদিগকে তাড়াইয়া দিয়াছে।” এই বলিয়া চণ্ডিকা দেবী যারপরনাই সুন্দর একটি মেয়ে সাজিয়া হিমালয় পর্বতে বসিয়া রহিলেন।  চণ্ড আর মুণ্ড নামে দুটা অসুর সেইখানে কি করিতে আসিয়াছিল, তাহারা সেই মেয়েটিকে দেখিতে পাইয়া শুম্ভকে গিয়া বলিল যে, “মহারাজ, হিমালয় পর্বতে কি আশ্চর্য সুন্দরী একটি মেয়েকে দেখিয়া আসিয়াছি কি বলিব। এমন আর কেহ কখনো দেখে নাই। মহারাজ, সংসারে যত ভালো ভালো জিনিস, সব আপনারা আনিয়াছেন, কিন্তু এই মেয়েটিকে রানী করিতে না পারিলে সবই মাটি।”  এ কথা শুনিয়া শুম্ভ তখনই সুগ্রীব নামে একটা অসুরকে ডাকিয়া বলিল, “সুগ্রীব, শীঘ্র যাও। যেমন করিয়া পার সেই মেয়েটিকে খুশি করিয়া এখানে লইয়া আইস।”  সুগ্রীব হিমালয়ে গিয়া দেবীকে বিশেষ করিয়া বুঝাইতে লাগিল, “আমার প্রভু যে শুম্ভ আর নিশুম্ভ, তাহাদের মতন আর জগৎ-সংসারে কেহই নাই। হে দেবি, ইঁহাদের একজনকে বিবাহ করিলে তোমার আর সুখের সীমা থাকিবে না।”  দেবী বলিলেন, “আহা। তুমি বড় ভালো কথা বলিয়াছ, তোমার যে প্রভু, তাঁহাদের মতন আর কোথাও কেহ নাই। কিন্তু আমার ছেলেমানুষী খেয়াল হইয়াছে, আমাকে যুদ্ধে হারাইতে না পারিলে কেহ আমাকে বিবাহ করিতে পারিবে না। তোমার প্রভুকে গিয়া বল শীঘ্র আসিয়া আমাকে যুদ্ধে হারাইয়া বিবাহ করুন।”  এ কথা শুনিয়া শুম্ভ কি ভয়ানক চটিল, বুঝিতে পার। সে অমনি তাহার সেনাপতি ধুম্রলোচনকে বলিল, “যাও তো ধূম্রলোচন, সেই ঠেঁটা মেয়েটাকে চুলে ধরিয়া নিয়া আইস।” ধূম্রলোচন অনেক লোক লইয়া ভারি ঘটা করিয়া দেবীকে আনিতে গেল। কিন্তু সে তাঁহাকে ধরিয়া আনিবে কি, তিনি কেবল একটিবার ‘হুঁ’ করিয়া তাহার দিকে চাহিবামাত্রই পুড়িয়া ছাই, তাহার সঙ্গে আর যত অসুর আসিয়াছিল, দেবীর সিংহই তাহাদিগকে শেষ করিয়া দিল।  তখন শুম্ভ আরো অনেক সৈন্য, রথ, হাতি, ঘোড়া সঙ্গে দিয়া সেই চণ্ড আর মুণ্ডকে পাঠাইল। তাহারা খাঁড়া ঢাল হাতে হিমালয়ে গিয়া বিষম কাঁইমাই শব্দে যেই দেবীকে ধরিতে যাইবে অমনি দেবী ভ্রূকুটি করিয়া তাহাদের দিকে তাকাইলেন। ভ্রূকুটি করিবামাত্র তাঁহার কপাল হইতে আর একটি দেবতা বাহির হইয়া আসিলেন, তাঁহার নাম চামুণ্ডা। তাঁহার চেহারা বড়ই ভয়ংকর। রঙ কালো, চোখ লাল, শরীরে মাংস নাই, খালি হাড় আর চামড়া। হা ঁকরিলে পাহাড় পর্বত গিলিয়া ফেলিতে পারেন, চ্যাঁচাইলে দেব দানব সকলের মাথা ঘুরিয়া যায়। চামুণ্ডা বাঘের ছাল পরিয়া, মানুষের মাথার মালা গলায় দিয়া গদা খড়্গ পাশ হাতে আসিয়াই অসুরদিগকে ধরিয়া মুড়ি-মুড়কির মতো মুখে পুরিতে লাগিলেন। হাতি, রথ, ঘোড়া, মাহুত, সারথি, অঙ্কুশ, জাঠা, গদা, যাহা হাতে উঠে, মনের সুখে চিবাইয়া খান, বাছিবার দরকার হয় না। অসুরদের যত অস্ত্র আসে, সব গিলিয়া ফেলেন, আর হি, হি, হি, হি করিয়া হাসেন। দেখিতে দেখিতে চামুণ্ডা সকল অসুর খাইয়া শেষ করিলেন। বাকি রহিল কেবল চণ্ড আর মুণ্ড! তাহাদের চুলে ধরিয়া মাথা কাটিতেও মুহূর্তেক মাত্র লাগিল।  ইহার পর শুম্ভ আর নিশুম্ভ নিজেই যুদ্ধ করিতে আসিল। তাহাদের সঙ্গে অতি ভয়ংকর ভয়ংকর অসুর যে কত আসিল, আর হাতি, ঘোড়া, রথ, অস্ত্র যে কতরকম আসিল, তাহার সীমা সংখ্যা নাই। আর যুদ্ধ যাহা হইল, তাহার কথা কি বলিব! দেবীর সঙ্গে চামুণ্ডা আছেন, আর অন্য দেবতারাও নানারকমে তাহাকে সাহায্য করিতেছেন, আর দেবীর সিংহ তো আছেই। সে সময়ে দেবী এমন বিকট হাসি হাসিতেছিলেন, যে অনেক অসুর তাহাতেই মাথা ঘুরিয়া পড়িয়া যাইতেছিল, আর তখন চামুণ্ডার মতন দেবী নিজেও তাহাদিগকে ধরিয়া মুখে দিতেছিলেন। ইহার পর আর টিকিতে না পারিয়া অসুরেরা ছুটিয়া পলাইতে লাগিল।  অসুরদের মধ্যে একজন ছিল, তাহার নাম রক্তবীজ সে বেটা বড়ই ভয়ংকর;তাহার এক বিন্দু রক্ত মাটিতে পড়িলেই সেখান হইতে একটা বিশাল অসুর দাঁত খিচাইয়া উঠিয়া দাঁড়ায়। সেই রক্তবীজকে লইয়া দেবী প্রথমে একটু মুস্কিলে পড়িলেন। তাহাকে যত কাটেন, ততই রক্ত পড়ে, আর ততই হাজার হাজার অসুর উঠিয়া দাঁড়ায়। অসুরে ত্রিভুবন ছাইয়া গেল, তাহাদের চীৎকারে পাতালের লোক অবধি কালা হইয়া গেল। দেবতারা তো ভাবিলেন, সর্বনাশ বুঝি হয়।  তখন দেবী চামুণ্ডাকে বলিলেন, “এক কাজ কর। অসুরের গায়ে খোঁচা লাগিতে না লাগিতেই তাহার রক্ত চাটিয়া খাইবে। আর সেই রক্ত হইতে অসুর হইতে না হইতেই তাহাকে গিলিয়া ফেলিবে।” চামুণ্ডা বলিলেন, “আচ্ছা”, ইহার পর আর রক্তবীজের বেশি বাড়াবাড়ি করিতে হয় নাই। গিলিয়া খাইলে আর অসুর হইয়াই কি করিবে? কাজেই দেখিতে দেখিতে অসুরের দল কমিয়া গেল, রক্তবীজের গায়ের রক্তও ফুরাইয়া আসিল। এতক্ষণ সে ভয়ানক যুদ্ধ করিতেছিল, কিন্তু রক্ত ফুরাইয়া গেলে আর তাহার কিছু করবার শক্তি রহিল না। দেখিতে দেখিতে দেবী নানা অস্ত্রে তাহাকে মারিয়া ফেলিলেন।  তখন বাকি রহিল কেবল শুম্ভ আর নিশুম্ভ। নিশুম্ভ খানিকক্ষণ খুব যুদ্ধ করিয়া অজ্ঞান হইয়া গেল। তারপর শুম্ভ একাই যুদ্ধ করিতে লাগিল। শুম্ভের আটটা হাত ছিল, গায়ে জোরও ছিল তেমনি; সে যুদ্ধও করিল খুব। কিন্তু শেষে সেও অজ্ঞান হইয়া গেল।  ততক্ষণে নিশুম্ভের আবার জ্ঞান হইয়াছে। নিশুম্ভের দশ হাজার হাত। সেই দশ হাজার হাতে দশ হাজার অস্ত্র লইয়া সে দেবীর সঙ্গে বিষম যুদ্ধ করিতে লাগিল। মরিবার সময়ও সে সহজে মরিল না। দেবী শূল দিয়া তাহার বুক ভেদ করিয়া ফেলিলেন, সেই বুকের ভিতর হইতে আবার ‘দাঁড়া, দাঁড়া,’ বলিয়া একটা বিকট অসুর বাহির হইয়া আসিল। যাহা হউক, সে ভালো করিয়া বাহির হইতে না হইতেই দেবী হাসিতে হাসিতে তাহার মাথা কাটিয়া ফেলাতে, বেচারা যুদ্ধ করিবার অবসর পায় নাই।  শুম্ভ ইহার মধ্যেই আবার উঠিয়া যুদ্ধ আরম্ভ করিয়াছে। ইহাই তাহার শেষ যুদ্ধ। সে অনেকক্ষণ ধরিয়া বিধিমতে দেবীকে মারিবার চেষ্টা করিল। একটি একটি করিয়া তাহার সকল অস্ত্রই দেবী কাটিয়া ফেলিলেন তারপর বাকি রহিল খালি কিল আর চাপড়। একবার দেবীর চাপড় খাইয়া সে চিৎ হইয়া পড়িয়া গিয়াছিল। কিন্তু তখনই আবার উঠিয়া দেবীকে ধরিয়া এক লাফে আকাশে উঠিয়া গেল। তারপর আকাশে থাকিয়াই দুজনের কম যুদ্ধ হইল না। যুদ্ধ করিতে করিতে দেবী তাহাকে বনবন করিয়া ঘুরাইয়া মাটিতে আছড়াইয়া ফেলিলেন; তাহাতেও কি সে মরে? সে তখনই উঠিয়া কিল বাগাইয়া দেবীকে মারিতে চলিয়াছে। তখন দেবী তাঁহার শূল দিয়া তাহার বুকে এমনি ঘা মারিলেন যে তাহার পর তাহাকে উঠিতে হইল না।  তখন যে দেবতারা দেবীর স্তব খুব ভালো করিয়াই করিয়াছিলেন, তাহা আমি না বলিলেও তোমরা বুঝিয়া লইতে পারিবে। দেবী তুষ্ট হইয়া বলিলেন, “তোমরা কি চাও?” দেবতারা বলিলেন, “এমনি করিয়া আমাদের শত্রুদিগকে বধ করিও।”
উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী
সাপ রাজপুত্র উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী সাপ রাজপুত্র  এক রাজা ছিলেন, তাঁহার নাম ছিল শূরসেন! রাজার পুত্র না থাকায় তাঁহার মনে বড়ই দুঃখ ছিল। সেই দুঃখ দূর করিবার জন্য তিনি অনেক দান ধ্যান, অনেক যাগযজ্ঞ করিলেন। তাহার ফলে শেষে তাঁহার একটি পুত্র হইল বটে, কিন্তু সে সাধারণ লোকের ছেলেপিলের মতন নহে। সে একটি ভীষণ সর্প! যদিও মানুষের মতো কথা কয়!  রাজা মনের দুঃখে বলিলেন, “হায়, হায়! এই সর্প লইয়া আমি কি করিব? ইহার চেয়ে যে পুত্র না হওয়া আমার অনেক ভালো ছিল।” কিন্তু সাপ সে কথা ভাবিলই না, সে রাজাকে বলিল, “বাবা, আমার চূড়াকরণ, উপনয়ন করাইলে না? আমার হাতেখড়ি দিলে না? বেদ পড়াইলে না? তাহা হইলে যে আমি মূর্খ থাকিয়া যাইব।”  রাজা আর কি করেন? তিনি ব্রাহ্মণ ডাকিয়া সব করাইলেন। সেই সাপ তখন দেখিতে দেখিতে সকল শাস্ত্র শেষ করিয়া মস্ত বড় পণ্ডিত হইয়া উঠিল। তারপর একদিন সে রাজাকে বলিল, “বাবা, আমার বিবাহ দিলে না? তাহা হইলে যে লোকে আমাকে ছেলেমানুষ ভাবিবে, আমার কথা গ্রাহ্য করিবে না। আর তোমারও বংশ লোপ হইয়া যাইবে, তাহার দরুন শেষে তোমাকে নরকে যাইতে হইবে।”  রাজার মাথায় আকাশ ভাঙ্গিয়া পড়িল। তিনি বলিলেন, “বাছা, তুমি যদি মানুষ হইতে তবে তো কোনো মুশকিল ছিল না, কিন্তু তুমি যে সাপ, তোমাকে দেখিলে পালোয়ানেরাও ছুটিয়া পলায়। তোমাকে কে তাহার মেয়ে দিতে চাহিবে বল?”  সাপ বলিল, “নাই বা চাহিল। রাজাদের তো জোর করিয়া মেয়ে ধরিয়া আনিয়াও বিবাহ হইতে পারে, তাই কেন কর না? আমার যদি বিবাহ না হয়, তবে আমি নিশ্চয় গঙ্গায় ডুবিয়া মরিব।”  এ কথায় রাজামহাশয় তো বড়ই সংকটে পড়িলেন।  এখন উপায় কি? শেষে অনেক ভাবিয়া তিনি তাঁহার অমাত্যদিগকে বলিলেন, “আমার পুত্র এখন বড় হইয়াছে, আর খুব উপযুক্তও বটে! তোমরা তাহার বিবাহের চেষ্টা দেখ।”  রাজার যে একটি ছেলে আছে অমাত্যরা সকলেই তাহা জানে, কিন্তু সেটি যে একটি সাপ, সে কথা তাহাদের কেহই জানে না। সে কথাটি রাজামহাশয় গোপন রাখিয়াছেন। কাজেই রাজার কথা শুনিয়া তাহারা খুব উৎসাহের সহিত বলিল, “মহারাজ! আপনার যখন ছেলে, তখন আর চেষ্টার বিশেষ দরকার কি? দেশ-বিদেশে আপনার নাম; আপনি যাহার নিকট চাহিকেন, সেই মেয়ে দিবে।”  রাজার একটি খুব পুরাতন বিশ্বাসী কর্মচারী ছিল, কিন্তু সে রাজার কথার ভাবে বুঝিয়া লইল যে ইহার মধ্যে কিছু চেষ্টার দরকার আছে। সে বলিল, “মহারাজ! আপনার মনের কথা আমি বুঝিয়াছি। আপনার অনুমতি হইলে, আমি কন্যার চেষ্টায় যাইতে পারি। পূর্বদেশে বিজয় নামে এক রাজা আছেন, তাঁহার রাজ্য ধন লোকজন হাতি ঘোড়ার সীমা নাই। তাঁহার আটটি মহাবল পুত্র আর ভোগবতী নামে সাক্ষাৎ লক্ষ্মীর মতো একটি কন্যা আছেন। সেই কন্যাই আপনার বউ হইবার উপযুক্ত।”  সে কথায় রাজা ভারি খুশি হইয়া তখনই বিস্তর টাকাকড়ি ও লোকজন সঙ্গে দিয়া কর্মচারীটিকে পূর্বদেশে রওয়ানা করিয়া দিলেন। কর্মচারী রাজা বিজয়ের সভায় উপস্থিত হইয়া শূরসেনের পুত্রের জন্য তাহার কন্যা ভোগবতীকে প্রার্থনা করিল। সেই সাপকে সে জন্মেও চক্ষে দেখে নাই, জানেও না যে সেটা সাপ। সে তাহাকে মানুষ ভাবিয়া আন্দাজি তাহার কত প্রশংসাই যে করিল, তাহা আর বলিবার নয়। তাহার একটি কথাও সত্য নহে, কিন্তু রাজা বিজয় তাহার আগাগোড়াই বিশ্বাস করিলেন, কাজেই বিবাহের কথা স্থির হইতে আর বিলম্ব হইল না। তারপর আর দু-একবার লোক আসা যাওয়া করিলেন। বিজয় এ কথায়ও রাজি হইলেন যে, বর বিবাহ করিতে আসিবেন না, নিজের অস্ত্র পাঠাইয়া দিবেন, তাহার সঙ্গেই কন্যার বিবাহ হইবে। ক্ষত্রিয়দের মধ্যে এরূপ ঘটনা ঢের হইয়া থাকে, কাজেই তেমনি করিয়া কিছুদিনের মধ্যেই ভোগবতীর বিবাহ হইয়া গেল। কেহই জানিল না যে সে বিবাহ একটা সাপের সঙ্গে হইয়াছে; ভোগবতীও তাহা জানিল না।  সে শ্বশুরবাড়ি গেলে পর প্রথমে কেহই তাহাকে সেই সাপের কথা জানাইতে সাহস পায় নাই। কিন্তু শেষে যখন সে সকল কথা জানিল, আর সাপকে দেখিল, তখন সেই সাপকেই তাহার যারপরনাই ভালো লাগিল। সে দিনরাত পরম যত্নে তাহার সেবা করে, অতি মিষ্টভাবে তাহার সঙ্গে কথাবার্তা কহে, আর গান গাহিয়া, বাজনা বাজাইয়া, খেলা করিয়া, বিধিমতে তাহাকে খুশি রাখে।  তখন একদিন সাপ তাহাকে বলিল, “ভোগবতী, আমি তোমার উপর বড়ই সন্তুষ্ট হইয়াছি; পূর্বের কথা এখন আমার মনে হইতেছে। আমি অনন্তের পুত্র মহাবল নাগ; মহাদেবের হাতে আমি থাকিতাম। তখন তুমি আমার স্ত্রী ছিলে। একদিন শিব আমার উপর চটিয়া আমাকে এই শাপ দেন যে, ‘তোমাকে মানুষের ঘরে সাপ হইয়া জন্মাইতে হইবে।’ তখন তুমি আর আমি দুজনে মিলিয়া শিবকে অনেক মিনতি করায় তিনি বলিলেন, ‘আচ্ছা, তোমরা দুজনে যখন গৌতমী নদীতে গিয়া আমার পূজা করিবে, তখন তোমাদের শাপ কাটিয়া যাইবে।’ এখন তুমি আমাকে গৌতমী নদীতে লইয়া চল।”  ভোগবতী তখনই তাহাকে লইয়া গৌতমীতে যাত্রা করিল, আর সেখানে গিয়া শিবের পূজা করিতেই সেই সাপের আবার দেবতার মতো সুন্দর চেহারা হইল।  তখন সে শূরসেনের নিকট গিয়া বলিল, “বাবা, এখন আমার পৃথিবীতে থাকার প্রয়োজন শেষ হইয়াছে; অনুমতি কর, আমি শিবের নিকট যাই।”  শূরসেন বলিলেন, “বাবা, তুমি হইলে যুবরাজ; কিছুদিন এখানে থাকিয়া রাজ্যভোগ কর, তোমার ছেলেপিলে হউক, আমরা দেখিয়া চক্ষু জুড়াই। তারপর আমার মৃত্যু হইলে শেষে শিবের নিকট যাইও!”  সে কথায় সম্মত হইয়া মহাবল সুখে রাজ্যভোগ করিতে লাগিল।
উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী
সূর্যের গৃহিনী উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী সূর্যের গৃহিনী  বিশ্বকর্মার নাম তোমরা সকলেই শুনিয়াছ। বিশ্বকর্মা দেবতাদের কারিগরদের দেবতা। এই দেবতার একটি মেয়ে ছিল, তাহার নাম সংজ্ঞা; কেহ কেহ তাহাকে উষা আর সুরেণু বলিয়াও ডাকিত।  বাপের ঘরে সংজ্ঞা সুখেই ছিলেন। কিন্তু, শেষে তাঁহার পিতা যখন সূর্যদেবের সহিত তাঁহার বিবাহ দিলেন, তখন হইতেই বেচারীর দুঃখের দিন আরম্ভ হইল। সূর্যের যে কি ভয়ানক তেজ, তাহা তোমরা সকলেই দেখিতেছ। দুরে থাকিয়াই এত তেজ, কাছে গেলে সে যে কিরকম হইবে, তাহা তো আমরা ভাবিয়াই উঠিতে পারি না। এর উপর আবার সেকালে নাকি সূর্যের তেজ এখনকার চেয়ে ঢের বেশি ছিল। তখন সূর্যের দেহ এমন সুন্দর গোল ছিল না; কদম ফুলের কেশরের মতো, তাহার চারিদিকে কিরণের ছটা বাহির হইত, তাহার যে কি ভয়ংকর তেজ, তাহা বেচারী সংজ্ঞাই বুঝিতে পারিয়াছিলেন।  তবু সে তেজ সহিয়া থাকিতে সংজ্ঞা চেষ্টার ত্রুটি করেন নাই। ঝলসিয়া পুড়িয়া ফোস্কা পড়িয়া, তাঁহার দুর্দশার একশেষ হইল, তবু তিনি অনেকদিন ধরিয়া সূর্যের সেবা করিলেন। ক্রমে, মনু, যম, আর যমুনা বলিয়া তাঁহার তিনটি খোকা-খুকি হইল। খোকা-খুকিরা দূরে দূরে খেলা করিয়া বেড়ায়, তাহাদের কোনো কষ্ট নাই। যত কষ্ট সংজ্ঞার, কেননা, তাঁহাকে সূর্যের কাছে থাকিয়া তাহার সেবা করিতে হয়। এতদিন সে কষ্ট সহিয়া সহিয়া তাঁহার শরীর মাটি হইয়া গেল, আর সহিতে পারেন না।  তখন সংজ্ঞা অনেক ভাবিয়া এক বুদ্ধি বাহির করিলেন। বিশ্বকর্মার মেয়ে, কাজেই অনেকরকম কারিকুরি তাঁহার জানা ছিল। আর সেই কারিকুরিতে এখন তাঁহার বড়ই কাজ হইল। তিনি সকলের অসাক্ষাতে এমন একটি মেয়ে তয়ের করিলেন যে, সে দেখিতে অবিকল তাহার নিজেরই মতন, কিন্তু সূর্যের তেজে তাহার কিছুই হয় না। মেয়েটির নাম রাখিলেন ছায়া।  ছায়া তয়ের হওয়ামাত্র হাতজোড় করিয়া সংজ্ঞাকে বলিল, “আমাকে কি করিতে হইবে?” সংজ্ঞা বলিলেন, “আমি বাপের বাড়ি যাইতেছি, তুমি এখানে থাকিয়া ঘরকন্না কর। আমার খোকা-খুকিদের যত্ন করিয়া খাইতে পরিতে দিয়ো। আর, আমি যে চলিয়া গেলাম, এ কথা কাহাকেও বলিয়ো না।”  এইরূপ কথাবার্তার পর সংজ্ঞা ছায়াকে সেখানে রাখিয়া ভয়ে ভয়ে, তাঁহার পিতার নিকট গিয়া উপস্থিত হইলেন। বিশ্বকর্মা কিন্তু ন্যার দুঃখ বুঝিতে পারিলেন না। তিনি সংজ্ঞাকে দেখিয়া আশ্চর্য তো হইলেনই, বিরক্ত হইলেন তাহার চেয়েও বেশি। তিনি বলিলেন, “তুমি ভারি অন্যায় করিয়াছ, এখনি ফিরিয়া যাও।”  বাপের বাড়িতে আসিয়াও সংজ্ঞার দুঃখ ঘুচিল না। বকুনির জ্বালায় সেখানে টিকিয়া থাকাই তাহার দায় হইল। কাজেই তখন আর কি করা যায়? সংজ্ঞা একটি ঘোটকী সাজিয়া সেখান হইতে উত্তর মুখে ছুটিয়া পলাইলেন। সকল দেশের উত্তরে কুরুবর্ষ বা উত্তর কুরু। সেখানকার সুন্দর সবুজ মাঠের কচি কচি ঘাসগুলি খাইতে বড়ই মিষ্ট। সংজ্ঞা ছুটিতে ছুটিতে সেই দেশে গিয়া, সেখানকার সুন্দর মাঠের মিষ্ট ঘাস খাইয়া মনের আনন্দে কাল কাটাইতে লাগিলেন। সেখানে পুড়িয়াও মরিতে হয় না, বকুনিও খাইতে হয় না।  এদিকে সূর্যদেবের ঘরে কাজকর্ম সুন্দর মতেই চলিতেছে। ছায়া দেখিতে ঠিক সংজ্ঞারই মতো, আর কাজেকর্মেও বেশ ভালো। সুতরাং সূর্যদেব টেরই পান নাই যে একটা কিছু হইয়াছে। খোকা-খুকিরা কিন্তু ইহার মধ্যে বুঝিতে পারিয়াছে যে তাহাদের মা আর তাহাদিগকে ভালোবাসে না। তাহারা জানুক, আর নাই জানুক, ছায়া তো আর তাহাদের মা নয়। সে তাহাদিগকে মার মতো ভালবাসিবে কি করিয়া? মনু শান্ত ছেলে, সে আদর না পাইয়াও চুপ করিয়া রহিল। যম রাগী, সে অভিমানের ভয়ে ছায়াকে পা দেখাইয়া বলিল, “তোমাকে লাথি মারিব।” ছায়াও তখন রাগে অস্থির হইয়া বলিল, “বটে? এত বড় আস্পর্দা? তোর ঐ পা খসিয়া পড়ুক।”  শাপের ভয়ে যম কাঁদিতে কাঁদিতে সূর্যের নিকট গিয়া নালিশ করিল, “বাবা, মা আমাদের ভালোবাসেন না বলিয়া আমি তাঁহাকে পা দেখাইয়াছিলাম, তাহাতে তিনি বলিয়াছেন, আমার পা খসিয়া পড়িয়া যাইবে। বাবা আমি তো লাথি মারি নাই, তুমি আমার পা খসিয়া পড়িতে দিয়ো না।” সূর্য বলিলেন, “বাবা, তোমার মা যখন শাপ দিয়াছেন, তখন তো আর তাহা আটকাইবার উপায় নাই। তবে, এইটুকু করা যাইতে পারে যে পোকায় তোমার পায়ের মাংস অল্পে অল্পে লইয়া যাইবে, আস্ত পা খসিয়া পড়ার দরকার হইবে না।”  তারপর সূর্যদেব ছায়ার নিকট গিয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, “তুমি মা হইয়া ছেলের সঙ্গে এমন ব্যবহার কেন করিতেছ?” ছায়া প্রথমে চুপ করিয়া রহিল কিন্তু তারপরই যখন সূর্য বিষম রাগের ভরে তাঁহার চুল ধরিয়া শাপ দিবার আয়োজন করিলেন, তখন আর সে না বলিয়া যায় কোথায়?  সেকথা শুনিয়া সূর্য যে কিরূপ ব্যস্তভাবে তাঁহার শ্বশুরের নিকট ছুটিয়া আসিলেন, তাহা কি বলিব। বিশ্বকর্মা দেখিলেন, ঠাকুর বড় বেজায় রকমের চটিয়াছে, তাঁহার মুখ দিয়া ভালো করিয়া কথাই বাহির হইতে পারিতেছে না। তখন তিনি তাঁহাকে অনেক মিষ্টকথায় শান্ত করিয়া বলিলেন, “ঠাকুর জানেন তো আপনার তেজ কি ভয়ংকর। আমার মেয়ে সে তেজ কিছুতেই সহিতে না পারিয়া ভয়ে পলায়ন করিয়াছে। তবে, আপনি যদি চাহেন তো আপনার এই তেজ আমি অনেকটা কমাইয়া দিতে পারি। তাহা হইলে সংজ্ঞারও আপনার নিকট থাকিতে কষ্ট হইবে না। আর আপনার চেহারাটাও অনেক মোলায়েম হইয়া যাইবে।”  সূর্য বাস্তবিকই সংজ্ঞাকে অতিশয় ভালোবাসিতেন। কাজেই তিনি তৎক্ষণাৎ বিশ্বকর্মার কথায় রাজি হইলেন। বিশ্বকর্মা আর দেরি না করিয়া তাড়াতাড়ি ঠাকুরকে কুঁদে চড়াইয়া দিলেন। আগেই বলিয়াছি, সূর্য সে সময়ে তেমন গোল ছিলেন না। কুঁদে চড়াইয়া সোঁ সোঁ শব্দে কয়েক পাক দিতেই তাহার উষ্কশুষ্ক কিরণগুলি বাটালির মুখে উড়িয়া গেল আর তাহার ভিতর হইতে তাহার ঐ সুন্দর গোল মুখখানি দেখা দিল, তখন সকলেই বলিল, “বাঃ, বেশ হইয়াছে। এখন ঠাকুর যেমন ঠাণ্ডা, তেমনি দেখিতে ভালো।”  এ কথায় সূর্যদেব যারপরনাই সন্তুষ্ট হইয়া সংজ্ঞাকে খুঁজিতে বাহির হইলেন। তিনি শুনিয়াছিলেন, সংজ্ঞা ঘোটকী সাজিয়া উত্তরদিকে পলায়ন করিয়াছেন। কাজেই তাঁহাকে কোন দিকে যাইতে হইবে তাহা আর বুঝিতে বাকি রহিল না। সংজ্ঞা সাজিয়াছিলেন ঘোটকী, তিনি সাজিলেন ঘোড়া। তারপর সেই যে সেখান হইতে তিনি চিঁ-হিঁ হিঁ হিঁ শব্দে ছুট দিলেন আর একেবারে সংজ্ঞার সম্মুখে উপস্থিত না হইয়া থামিলেন না। কিন্তু সংজ্ঞাকে তিনি সহজে ধরিতে পারেন নাই, কারণ সে বেচারী কি করিয়া জানিবেন যে ঐ যে চিঁ-হিঁ হিঁ হিঁ শব্দে ঘোড়াটি ছুটিয়া আসিতেছে সেই হইতেছে তাঁহার স্বামী? কাজেই তিনি তাহাকে দেখিয়া প্রাণপণে ছুটিয়া পলাইয়াছিলেন। যাহা হউক, শেষে সকল গোলই চুকিয়া গেল, আর তখন তো সুখের সীমাই রহিল না।
উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী
স্যমন্তক মণি উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী স্যমন্তক মণি  এক রাজা ছিলেন, তাঁহার নাম ছিল প্রসেন। প্রসেনের ভ্রাতার নাম ছিল সত্রাজিৎ। সূর্যের সহিত সত্রাজিতের বিশেষ বন্ধুত্ব ছিল।  একদিন সত্রাজিৎ তোয়কূল নামক নদীতে নামিয়া সূর্যের উপাসনা করিতেছেন, এমন সময় সূর্য স্নেহবশত নিজেই তাঁহার নিকট আসিয়া উপস্থিত হইলেন। সত্রাজিৎ সূর্যের সেই আশ্চর্য উজ্জ্বল মূর্তি দেখিয়া নিতান্ত বিস্ময়ের সহিত তাঁহাকে বলিলেন, “ভগবন্‌, আকাশে আপনাকে যেমন উজ্জ্বল দেখি, এখনো তেমনি উজ্জ্বল দেখিতেছি। আপনি যে স্নেহ করিয়া আমার নিকট আসিলেন, তাহার দরুন তো আপনার রূপ কিছুমাত্র কোমল হয় নাই।”  সূর্য তখন একটু হাসিয়া নিজের কণ্ঠ হইতে একটি মণি খুলিয়া রাখিয়া দিলেন। তখন দেখা গেল যে তাঁহার মূর্তি অতি সুন্দর এবং স্নিগ্ধ।  সেই যে মণি, উহারই তেজে সূর্যকে এত উজ্জ্বল দেখা গিয়াছিল। সে মণির নাম স্যমন্তক। উহার এতই গুণ যে, যাহার গৃহে উহা থাকে, তাহার কোনো অসুখ বা অকল্যাণ হয় না। যে দেশে উহা থাকে তথা হইতে দুর্ভিক্ষ, অনাবৃষ্টি প্রভৃতি সকল উৎপাত দূর হইয়া যায়।  সেই মণিটি সত্রাজিতের বড়ই ভালো লাগিল, সুতরাং সূর্য যাইবার সময় তিনি তাঁহাকে বিনীতভাবে বলিলেন, “হে প্রভু! আপনি তো আমাকে কতই স্নেহ করেন, দয়া করিয়া এই মণিটি আমাকে দিয়া যান।”  সে কথায় সূর্য তখনই তাহাকে মণিটি দিয়া গেলেন।  সেই মণি লইয়া সত্রাজিৎ যখন নিজের নগরে ফিরিলেন, তখন নগরে সমস্ত লোক নিতান্ত ব্যস্তভাবে “ঐ সূর্য যাইতেছেন!” “ঐ সূর্য যাইতেছেন!” বলিয়া তাঁহার পিছু-পিছু ছুটিল। সে আশ্চর্য মণি যে দেখে সেই অবাক হইয়া যায়। তাঁহার গুণের কথা যে শোনে, সেই ছুটিয়া তাহা দেখিতে আসে।  সে মণি পাইবার জন্য কৃষ্ণের খুবই ইচ্ছা হইয়াছিল, সত্রাজিৎ তাঁহাকে তাহা দেন নাই। কৃষ্ণ ইচ্ছা করিলে উহা সত্রাজিতের নিকট হইতে কাড়িয়া লইতে পারিতেন, কিন্তু তাঁহার মতো মহৎ লোকে এমন কাজ কেন করিবেন?  সত্রাজিৎ সেই মণি তাহার ভাই প্রসেনকে দেন। প্রসেন প্রায়ই উহা পরিয়া চলাফেরা করিতেন। একদিন সেই মণি গলায় পরিয়া তিনি বনের ভিতর শিকার করিতে গিয়াছেন, এমন সময় ভয়ংকর এক সিংহ আসিয়া তাঁহাকে আক্রমণ করিল। সে ভীষণ সিংহের হাত হইতে আর তিনি রক্ষা পাইলেন না।  কিন্তু কি আশ্চর্য। সিংহ যে প্রসেনকে হত্যা করিল, সে তাঁহাকে খাইবার জন্য নহে, তাহার ঐ মণিটি পাইবার জন্য। সে তাঁহাকে মারিয়া মণিটি লইয়া চলিয়া গেল, তাঁহার দেহের দিকে ফিরিয়াও তাকাইল না।  যে বস্তুর প্রতি এক জন্তুর লোভ হয়, অন্য জন্তুরও তাহার প্রতি লোভ হইতে পারে! সিংহ সেই মণি লইয়া বেশিদূর যাইতে না যাইতেই পর্বতের গুহার ভিতর হইতে এক বিশাল ভল্লুক আসিয়া তাহার ঘাড় ভাঙ্গিয়া মণিটি কাড়িয়া নিল।  প্রসেন যখন আর ঘরে ফিরিলেন না, তখন তাঁহার আত্মীয়েরা মনে করিল যে নিশ্চয়ই কৃষ্ণ সেই মণির লোভে তাঁহাকে বধ করিয়াছে, নহিলে এমন কাজ আর কে করিবে? পুর্ব হইতেই কৃষ্ণের ঐ মণির প্রতি লোভ ছিল, তাঁহারই এই কাজ!  বাস্তবিক এ বিষয়ে কৃষ্ণের কোনো অপরাধই ছিল না, কাজেই এই মিথ্যা অপবাদের কথা শুনিয়া, তিনি অতিশয় দুঃখিত হইলেন। আর প্রতিজ্ঞা করিলেন যে যেমন করিয়াই হউক, এই মণি আনিয়া দিতে হইবে।  প্রসেন যখন শিকারে গিয়া প্রাণ হারাইয়াছিলেন, তখন সহজেই বুঝা যায় যে সেই শিকারের জায়গায় গিয়াই তাহাকে খুঁজিতে হইবে! কৃষ্ণ ও বলরাম কয়েকটি সাহসী, চতুর আর বিশ্বাসী লোক লইয়া চুপি চুপি সেই স্থানে গিয়া উপস্থিত হইলেন। সেখানে গিয়া প্রসেনের দেহ খুঁজিয়া বাহির করিতে তাহাদের অধিক বিলম্ব হইল না। প্রসেনেব ঘোড়াটিও সেইখানে মরিয়া পড়িয়াছিল। দুটি দেহের চারিধারে সিংহের পায়ের দাগ, সিংহের নখ, দাঁতে দেহ দুটি ক্ষতবিক্ষত!  সেই সিংহের পদচিহ্ন ধরিয়া কিছুদূর গেলেই দেখা গেল যে উহার দেহও ক্ষতবিক্ষত হইয়া পড়িয়া আছে। তাহাকে যে ভল্লুকে মারিয়াছে পায়ের চিহ্ন দেখিয়া আর, সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ রহিল না। এখন এই ভল্লুককে খুঁজিয়া বাহির করিতে পারিলেই হয়। তাহারা অতি সাবধানে সেই ভল্লুকের পায়ের দাগ দেখিয়া চলিতে লাগিলেন। সে দাগ ক্রমে একটা গুহার সম্মুখে আসিয়া উপস্থিত হইয়াছে। সুতরাং বুঝা গেল, সেই গুহার ভিতরেই ভল্লুকের বাড়ি।  এই কথার আরো প্রমাণ তখনই পাওয়া গেল। গুহার ভিতর হইতে একটি স্ত্রীলোকের গলার শব্দ আসিতেছে, একটি ছেলেরও কান্না শুনা যাইতেছে। স্ত্রীলোকটি ছেলেটিকে শান্ত করিবার জন্য বলিতেছে, “কাঁদিয়ো না বাছা! সিংহ প্রসেনকে মারিয়াছিল, তোমার পিতা সেই সিংহকে মারিয়া স্যমন্তক মণি আনিয়াছেন। এখন সেই মণি লইয়া তুমি খেলা করিবে, আর কাঁদিয়ো না।”  কাজেই আর কিছু বুঝিতে বাকি রহিল না। তখন কৃষ্ণ, বলরাম আর সঙ্গের লোকদিগকে গুহার দরজায় রাখিয়া যেই একা ভিতরে প্রবেশ করিয়াছে, অমনি পর্বতপ্রমাণ এক বিশাল, বিকট ভল্লুক ভীষণ গর্জনে পাহাড় কাঁপাইয়া তাঁহাকে আক্রমণ করিল। তখন যে তাঁহাদের কি ঘোরতর যুদ্ধ হইয়াছিল, তাহা আর বলিয়া শেষ করা যায় না। একদিন, দুদিন করিয়া সপ্তাহের পর সপ্তাহ চলিয়া গেল, তথাপি সে যুদ্ধের বিরাম নাই।  এদিকে কৃষ্ণের বিলম্ব দেখিয়া আর ভল্লুকের ভয়ংকর গর্জন শুনিয়া, বলরাম আর সঙ্গের লোকেরা দ্বারকায় আসিয়া সকলকে বলিয়াছেন যে কৃষ্ণ আর নাই, তাঁহাকে ভল্পকে খাইয়াছে।  একুশ দিনের পর সেই যুদ্ধ শেষ হইল। একুশ দিন যুদ্ধ করিয়া ভল্লুক বুঝিতে পারিল যে কৃষ্ণের নিকট হার মানা ভিন্ন আর উপায় নাই। তখন সে অশেষ অনুনয়ের সহিত তাঁহার নিকট ক্ষমা প্রার্থনা করিল। তারপর সে যেই জানিল যে তিনি এই মণির জন্য আসিয়াছেন, অমনি মণি তো তাঁহাকে দিলই সঙ্গে সঙ্গে নিজের কন্যাটিও দান করিল।  কৃষ্ণ সেই মণি আর কন্যা লইয়া মনের সুখে দ্বারকায় চলিয়া আসিলেন। দ্বারকার লোকেরা তাঁহাকে দেখিয়া কি বলিল, তাহা আমি জানি না, তবে সত্রাজিৎ যে মণি পাইয়া খুবই খুশি হইয়াছিলেন, এ কথা নিশ্চয় বলিতে পারি।  সেই ভল্লুকটি যে সে ভল্লুক ছিল না। সে সেই জাম্ববান্, রামায়ণে যাহার কথা তোমরা পড়িয়া নিশ্চয়ই খুব সন্তুষ্ট হইয়াছ। আর তাহার মেয়েটির নাম ছিল জাম্ববতী। সেও কি ভল্লুক ছিল?
উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী
হনুমানের বাল্যকাল উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী হনুমানের বাল্যকাল  হনুমানের মায়ের নাম ছিল অঞ্জনা। বানরের স্বভাব যেমন হইয়া থাকে, অঞ্জনার স্বভাবও ছিল অবশ্য তেমনিই। হনুমান কচি খোকা, তাহাকে ফেলিয়া অঞ্জনা বনের ভিতরে গেল, ফল খাইতে। বনে গিয়া সে মনের সুখে গাছে গাছে ফল খাইয়া বেড়াইতে লাগিল, এদিকে খোকা বেচারা যে ক্ষুধায় চ্যাঁচাইতেছে, সে কথা তাহার মনেই হইল না।  হনুমান বেচারা তখন আর কি করে? চ্যাঁচাইয়া সারা হইল, তবু মার দেখা নাই, কাজেই তাহার নিজেকেই কিছু খাবারের চেষ্টা দেখিতে হইল। সেটা ছিল ভোৱের বেলা, টুকটুকে লাল সূর্যটি তখন সবে বনের আড়াল হইতে উঁকি মারিতেছে সেই টুকটুকে সূর্য দেখিয়াই হনুমান ভাবিল ওটা একটা ফল। অমনি আর কথাবার্তা নাই, সে একলাফে আকাশে উঠিয়া ভয়ানক সোঁ সোঁ শব্দে সেই ফল পাড়িয়া খাইতে ছুটিল।  তোমরা আশ্চর্য হইও না। মুমান তখন কচি খোকা বটে, কিন্তু সে যে-সে খোকা ছিল না, সে কথা আমরা সহজেই বুঝিতে পারি। সেই শিশুকালেই তাহার বিশাল দেহ ছিল, আর গায়ের রঙটি ছিল সেই ভোরবেলার সূর্যের মতোই ঝক্‌ঝকে লাল। দেব দানব যক্ষ সকলেই তাহার কাণ্ড দেখিয়া অবাক হইয়া গেল। অবাক না হইবেই বা কেন? সেই খোকা এমন ভয়ংকর ছুটিয়া চলিয়াছে যে, তেমন গরুড়েও পারে না, ঝড়েও পারে না। সকলে বলিল, “শিশুকালেই এমন, বড় হইলে না জানি এ কেমন হইবে।”  এদিকে হনুমান গিয়া তো সূর্যের কাছে পৌছিয়াছে, কিন্তু ইহার মধ্যে আর এক ব্যাপার উপস্থিত। সেইদিন ছিল গ্রহণের দিন, রাহু বেচারা অনেক দিনের উপবাসের পর সেইদিন সূর্যকে খানিক সময়ের জন্য গিলিয়া একটু শান্ত হইতে পাইবে। সে অনেক আশা করিয়া সূর্যকে গিলিবার জন্য প্রস্তুত হইয়া আসিয়াছিল, কিন্তু সেখানে হনুমানকে দেখিয়া ভয়ে তাহার প্রাণ উড়িয়া গেল। সে অমনি “বাবা গো!” বলিয়া প্রাণপণে দে ছুট্‌, ছুটিতে ছুটিতে একেবারে ইন্দ্রের সভায় গিয়া উপস্থিত।  ইন্দ্রের কাছে গিয়া সে নিতান্ত ব্যস্তভাবে বলিল, “আপনারই হুকুমে আমি সূর্যটাকে গিলিয়া ক্ষুধা দূর করি; এখন আবার সেই সূর্য কাহাকে দিয়া ফেলিয়াছেন? আজ তো দেখিতেছি আর একটা রাহু তাহাকে গিলিতে আসিয়াছে।”  এ কথায় ইন্দ্র যারপরনাই আশ্চর্য হইয়া তখনই ঐরাবতে চড়িয়া দেখিতে চলিলেন, ব্যাপারটা কি? রাহু তাহার আগে ছুটিয়া আবার সূর্যের নিকট গিয়াছিল, কিন্তু বেশিক্ষণ সেখানে টিকিতে পারে নাই।  রাহুর কিনা দেহ নাই, শুধুই একটি গোল মাথা, কাজেই হনুমান, তাহাকে দেখিবামাত্র ফল মনে করিয়া ধরিতে আসিল। রাহু তখন “ইন্দ্র! ইন্দ্র।” বলিয়া চ্যাঁচাইয়া অস্থির। ইন্দ্র বলিলেন, “ভয় নাই আমি এটাকে এখনই মারিয়া ফেলিতেছি।”  তখন হনুমান তাড়াতাড়ি ইন্দ্রের দিকে ফিরিয়া তাকাইতেই, ঐরাবতের প্রকাণ্ড সাদা মাথাটা তাহার চোখে পড়িল। সে ভাবিল, এটাও বুঝি একটা ফল। এই ভাবিয়া যেই হনুমান, সেটাকে ধরিতে গিয়াছে, অমনি ইন্দ্র ব্যস্ত সমস্ত হইয়া তাহার উপরে বজ্র ছুঁড়িয়া মারিলেন।  সেই বজ্রের ঘায়ে একটা পাহাড়ের উপর পড়িয়া ‘হনু’ অর্থাৎ দাড়ি ভাঙিয়া যাওয়াতেই তাহার ‘হনুমান’ এই নামটি হইয়াছিল। পাহাড়ের উপর পড়িয়া সে যন্ত্রণায় ছট্‌ফট্‌ করিতেছে এমন সময় তাহার পিতা পবন আসিয়া তাহাকে কোলে করিয়া একটা পর্বতের গুহায় লইয়া গেলেন। তারপর তিনি রাগে অস্থির হইয়া বলিলেন, “দাঁড়াও ইহার শোধ ভালো মতেই লইব।”  পবন, অর্থাৎ বায়ু, হইতেছে সংসারের প্রাণ, সেই বায়ু রাগিয়া বসিলে কি বিপদই না ঘটিতে পারে। সেই রাগের চোটে বাহিরের বায়ু কোথায় চলিয়া গেল, দেহের ভিতরের বায়ু উৎকট হইয়া উঠিল। নিশ্বাস ফেলিতে না পারিয়া জীবজন্তুর প্রাণ যায় যায়। বায়ুর উৎপাতে সকলের মাথা খারাপ হইয়া গেল, তাহারা এক করিতে আর করিয়া বসে। দেবতাদের অবধি পেট ফাঁপিয়া ফানুসের মতো হইয়া গেল ঠিক যেন উদরীর বেয়ারাম।  সেই অবস্থায় সকল দেবতা কাঁদিতে কাঁদিতে ব্রহ্মার নিকট গিয়া বলিলেন, “প্রভু! আমাদের দশা দেখুন। ইহার উপায় কি হইবে?” ব্রহ্মা বলিলেন, “উপায় আর কি? চল বায়ুর নিকট গিয়া তাহাকে খুশি করি। ইহা ভিন্ন আর আমাদের গতি নাই।”  পবন অচেতন হনুমানকে লইয়া কোলে করিয়া গুহায় বসিয়া আছেন এমন সময় ব্রহ্মাকে লইয়া দেবতাগণ সেখানে গিয়া উপস্থিত। ব্রহ্মা আসিয়া হনুমানের মাথায় হাত বুলাইয়া দিতেই সে সুস্থ হইয়া উঠিয়া বসিল, যেন তাহার কখনো কোনো অসুখ হয় নাই। ইহাতে পবন কত দূর খুশি হইলেন বুঝিতেই পার। পবনের রাগ চলিয়া যাওয়াতে কাজেই সংসারের সকল জীবের বিপদও কাটিয়া গেল।  তখন ব্রহ্মা দেবতাদিগকে ডাকিয়া বলিলেন, “দেখ, এই খোকা বড় হইলে তোমাদের অনেক কাজ করিয়া দিবে। সুতরাং তোমরা সকলে ইহাকে বর দিয়া খুশি কর।” এ কথায় দেবতারা যারপরনাই সন্তুষ্ট হইয়া হনুমানকে বর দিতে লাগিলেন। সেই সকল বরের জোরে হনুমান চিরজীবী হইয়া গেল। কোনো দেবতা বা যক্ষ, গন্ধর্ব বা মানুষের কোনো অস্ত্রে তাহার মরণের ভয় রহিল না। কেহ শাপ দিয়া তাহার প্রাণনাশ করার পথ অবধি বন্ধ হইল। তাহা ছাড়া ব্রহ্মা বলিলেন, “তুমি ভগবানকে জানিতে পারিবে, আর যখন যেমন ইচ্ছা, তেমনি রূপ ধরিতে পারিবে।” সূর্য বলিলেন, “আমার তেজের শতভাগের এক ভাগ তোমাকে দিলাম। আর একটু বয়স হইলে আমি তোমাকে লেখাপড়া শিখাইব:তাহা হইলে তুমি খুব বলিতে কহিতে পারিবে।”  বর পাইয়া হনুমান বড় লোক হইয়া গেল! তবে অবশ্য;ইহার সকল ফল ফলিতে সময় লাগিয়াছিল। শিশুকালে তাহার স্বভাব অন্যান্য বানরছানার চেয়ে বেশি উঁচুদরের ছিল না। মুনিদের আশ্রমে গিয়া সে দৌরাত্মটা যা করিত, সে আর বলিবার নয়। তাহার পিতামাতা কত নিষেধ করিতেন, কিন্তু সে কি নিষেধ শুনিবার পাত্র? তাহার উৎপাতে মুনিদের কোশাকুশী, ঘটি, বাটি, কাপড়-চোপড় কিছু আগলাইয়া রাখিবার জো ছিল না। এদিকে আবার তাহাকে শাপ দিয়াও ফল নাই, কারণ, ব্রহ্মার বরে শাপে মরিবার ভয় তাহার কাটিয়া গিয়াছে আর তাহাকে দেখিয়া তাঁহাদের কতকটা মায়াও হইত। কাজেই তাঁহারা নিরুপায় হইয়া তাহার অত্যাচার সহ্য করিতেন, আর ভাবিতেন, উহাকে বেশি ক্লেশ না দিয়া কি উপায়ে একটু জব্দ করা যায়। শেষে অনেক বুদ্ধি করিয়া তাঁহারা তাহাকে এই শাপ দিলেন, “যা বেটা, তোর যত ক্ষমতা তাহার কথা তুই একেবারে ভুলিয়া যা। বড় হইলে কেহ সেই ক্ষমতার কথা তোকে মনে করাইয়া দিবে, তখন তুই অনেক অদ্ভুত কাজ করিবি।”  তখন হইতে হনুমান সামান্য বানরছানার ন্যায় নিতান্ত ভয়ে ভয়ে চলে, আর দূর হইতে কাহাকেও দেখিলেই প্রাণপণে ছুটিয়া পলায়। কাজেই মুনিদেরও আর তাহার অত্যাচার সহিতে হয় না। যাহা হউক, সে এর মধ্যে সূর্যের নিকটে ঢের লেখাপড়া শিখিয়া ফেলিল। মুনিদের বাড়ি গিয়া সে যাহাই করুক, লেখাপড়ায় যে সে খুব লক্ষ্মীছেলে ছিল, একথা স্বীকার করিতেই হইবে। কি পরিশ্রম করিয়াই না সে লেখাপড়া শিখিয়াছিল। সূর্য তো আর এক জায়গায় বসিয়া থাকেন না, যে, পুঁথি লইয়া তাহার কাছে গিয়া বসিলেই কাজ হইবে। হনুমানকে উদয় হইতে অন্ত পর্বত পর্যন্ত রোজ তাঁহার পিছু পিছু ছুটাছুটি করিয়া পড়া বুঝিয়া লইতে হইত। তাহার ফলে সে বিদ্বানও হইয়াছিল বড়ই ভারি রকমের। এমন পণ্ডিত অতি অল্পই জন্মাইয়াছে।