content
stringlengths
0
129k
পার্টনাচ প্রায় ১৮ কিলোমিটার লম্বা এক পাহাড়ি খরস্রোতা নদী, দারুন গর্জন করে গুহার মধ্যে দিয়ে বয়ে চলেছে
আকাশ একদম মেঘে ঢাকা ছিল তাই দিনের বেলায়ও গুহার ভেতরটা একদম অন্ধকার, সামনে ৫ মিটার দূরে কি আছে কিছুই দেখা যাচ্ছে না
বেশ খানিকটা দূরে-দূরে একটা ল্যাম্প থাকলেও তার আলোতে সামনের ২-৪ মিটার এর বেশি কিছুই দেখা যাচ্ছে না
তার মধ্যে গুহার কিছু কিছু জায়গায় ওপর থেকে পাহাড়ি ঝর্ণার জল খুব জোরে বৃষ্টির মতো পড়ছে, ঠিক মতো খেয়াল না করলে একদম ভিজে যাওয়ার সম্ভবনা রয়েছে
একবার তো বেশ জোরেই গুহার দেওয়ালে আমার মাথা ঠুকে গেলো
কপাল টা বেশ ফুলে গেলেও, কপালের জোরেই বড়ো দুর্ঘটনার হাত থেকে রেহাই পেলাম
আর রিস্ক না নিয়ে আমরা সবাই মোবাইল এর টর্চ অন করে গুহার বাকি পথ পেরোতে লাগলাম
৭০২ মিটার লম্বা গুহা, মাঝে মাঝে বেশ খানিকটা চড়াই, পাথর কেটে কেটে উঁচু-নিচু রাস্তা, পেরোতে প্রায় দুই ঘন্টা লেগে গেলো
বেশিরভাগ দর্শনার্থী এখানে গুহা দর্শন করতেই আসেন, আমাদের সঙ্গে সামান্য কয়েকজন দর্শনার্থী ছিলেন, ওনারা গুহার শেষে একটা সমান্তরাল জায়গায় চলে গেলেন
ওখানে পার্টনাচ নদী আর ওই পরিবেশ কে পুরোপুরি উপভোগ করার জন্য একটা রেস্টপ্লেস ও একবাউয়ার নামের একটি রেস্টুরেন্ট আছে
পরে ওনারা এখান থেকে আবার একই পথে গুহার মধ্যে দিয়ে অথবা একবাউয়ার ট্রেনে করে নিচে গার্মিশ ফিরে আসবেন
আমাদের গন্তব্য অনেক দূর, আমরা গুহা থেকে বেরিয়ে একটা চওড়া পাহাড়ি রাস্তা ধরলাম, দু ধারে চিরহরিৎ গাছের জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে এই রাস্তাটা চলে যাচ্ছে আর রাস্তার পাশে সমান্তরাল ভাবে বয়ে চলেছে পার্টনাচ নদী
এতো সুন্দর একটা পরিবেশে, আমরা যে আস্তে আস্তে বেশ খানিকটা চড়াই ভেঙে ওপরে উঠছি সেই কষ্টটা প্রায় ভুলেই গেছিলাম
আমরা ছাড়া এই পথে আর কোনো ট্রেকার চোখে পড়লো না
এই রাস্তায় অনেকগুলো ট্রেকিং রুট আছে তাই রাস্তার পাশে রুট নির্দেশক সাইনবোর্ড আর সঙ্গে থাকা ম্যাপ সবসময় ঠিক মতো অনুসরণ করতে হবে
এই সাইনবোর্ড দেখে আমরা আমাদের পরের গন্তব্যস্থল বকহুটের দিকে এগিয়ে চললাম
খানিকটা হাঁটার পর আস্তে আস্তে বৃষ্টি শুরু হলো, সবাই সোয়েট-শার্ট এর ওপর রেইন জ্যাকেট চাপিয়ে নিলাম
বৃষ্টির জন্য হাঁটার গতি একটু শ্লথ হয়ে গেছিলো, কিন্তু থামলাম না
আমরা একটা চেন করে হাঁটছিলাম, আমি আর মুন্নি আগে ছিলাম, পিছনে অগ্নি আর সান্ত্বনা
আসলে সান্ত্বনা বেশ আস্তে হাঁটছিলো, প্রয়োজন মতো অগ্নি কে সাপোর্ট দিতে হচ্ছিলো
একসময় দেখলাম আমরা অনেকটা এগিয়ে এসেছি তাই বাকিদের জন্য অপেখ্যা করতে হলো
বেশ খানিকটা পর অগ্নি আর সান্ত্বনা কে দেখতে পেলাম, সান্ত্বনার রুকসাক দেখলাম অগ্নির পিঠে
এইভাবে দুটো রুকসাক নিয়ে বাকিটা পথ অগ্নির পক্ষ্যে হাঁটা বেশ কষ্টের তাই সান্ত্বনার রুকসাকের সমস্ত জিনিস বার করে তিনটে ভাগ করে আমাদের তিন জনের রুকসাকে নিয়ে নিলাম
এইভাবে সাড়ে নয় কিলোমিটার হেঁটে প্রায় দুপুর দুটোর সময় আমরা ১০৫২ মিটার উচ্চতায় বকহুটে পর্যন্ত পৌঁছলাম
এমনিতে বকহুটেতে আমাদের দাঁড়াবার কথা ছিল না কিন্তু সবার অবস্থাই বেশ কাহিল হয়ে পড়েছিল তাই হুটে তে কিছুক্ষন রেস্ট নেবার সিদ্ধান্ত নিলাম
আগেই লিখেছি যে হুটেগুলো পাহাড়ি এলাকার ছোটোখাটো হোটেলের মতো
এখানে রাত্রিবাস করা যায় ডর্মিটরিতে, খাওয়ার জন্য ছোট ডাইনিং হল আছে যেখানে একসঙ্গে ২০ থেকে ২৫ জন বসে খেতে পারে, রেস্টুরেন্টে পিজা, পাস্তা, গ্রীলড ভেজিটেবল, গ্রীলড পর্ক, সসেজ থেকে শুরু করে ওমলেট, বিভিন্ন রকমের সুপ্, বিভিন্ন কেক, ঠান্ডা ও গরম পানিও পাওয়া যায়
এছাড়া সমস্ত যাত্রীদের জন্য টয়লেট ও স্নান করার মতো প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা আছে
একটা কথা এই প্রসঙ্গে বলে নেওয়া খুব দরকার যে হুটে গুলোতে কিন্তু কার্ডে পেমেন্ট করা যাবে না শুধু ক্যাশ পেমেন্ট করতে হবে তাই এই সব রাস্তায় ট্রেকিং এ আস্তে গেলে সঙ্গে পর্যাপ্ত পরিমান ক্যাশ টাকা থাকার খুব প্রয়োজন
আমরা হুটের বাইরের দিকের বাগানে সাজানো টেবিলের একটায় বসলাম
আমাদের পাশেই খাড়া হয়ে দাঁড়িয়ে আছে একটা পাথরের পাহাড়
বৃষ্টিটা একটু আগেই বন্ধ হয়েছে, তাপমাত্রা ১৫ ডিগ্রী সেলসিয়াস, আকাশটা একদম পরিষ্কার, মেঘের কোনো চিহ্নমাত্র নেই
বিকালের রোদটা আমাদের গায়ে এসে পড়েছে
দারুন একটা আরামদায়ক, মনোরম পরিবেশ
প্রায় চোখ বুজে আসছিলো এমন সময় সান্ত্বনা বললো ভালো করে তো লাঞ্চ হলো না কিন্তু কফি টাইম এসে গেলো
মুন্নি গরম কফি আর চিজ কেক নিয়ে এলো, এখানে সেলফ সার্ভিস
লাঞ্চ ডিস্ বানাতে মিনিমাম আধ ঘন্টা সময় লাগবে তাই মুন্নি কোনো রিস্ক না নিয়ে যেটা রেডি ছিল সেটাই নিয়ে এসেছে
একদম সঠিক সিদ্ধান্ত
রাত্রিতে ডিনার এর সাথে লাঞ্চ ও দেওয়া হবে এই প্রতিশ্রুতি পেয়ে সান্ত্বনা কফি টাইম এ রাজি হয়ে গেলো
কেক আর কফির রসাস্বদন করতে করতে কখন যে আধ ঘন্টা কেটে গেলো বুজতেই পারলাম না
বকহুটে তে খুব বেশি লোকজন ছিল না কিন্তু যারা ছিলেন তাঁদের মধ্যে অনেককেই, হুটে ছেড়ে, আমরা যে রাস্তায় এসেছিলাম সেই দিকে চলে যেতে দেখলাম
মনের মধ্যে একটা প্রশ্ন বার বার আসছিলো তাহলে কি আমরা রাস্তা ভুল করলাম? বাকি যারা বসেছিলেন তাদের মধ্যে একমধ্যবয়সী ভদ্রলোককে গিয়ে জিজ্ঞাসা করেই ফেললাম
আমরা সুগস্পিৎজ যাবো শুনে ভদ্রলোক বেশ অবাকভাবে আমাদের দেখলেন
তারপর উনি বললেন আপনারা ঠিক পথেই এসেছেন আর যাদের চলে যেতে দেখলেন তাঁরা এই হুটে অব্দি এসে আবার নিচে ফেরত গেলেন, আমরা ৬ জনের গ্ৰুপ আজ এখানে রাত্রিবাস করে কাল আবার নিচে ফেরত যাবো
শুনে আমার তো বেশ ভয় ভয় পেলো, তার মানে শুধুমাত্র আমাদের এখনো সাড়ে ৫ কিলোমিটার হেঁটে পরের হুটে পর্যন্ত যেতে হবে
আমরা একবার বসে নিজেদের মধ্যে আলোচনা করে নিলাম এই হুটেতেই রাত্রিতে থেকে যাবো না এখনই তল্পি-তল্পা গুটিয়ে পরের হুটের দিকে হাঁটা শুরু করবো
মুন্নি আর অগ্নি বললো যে আমাদের পরের হুটেতেই পৌঁছতে হবে রাত্রিতে থাকার জন্য নাহলে আগামীকাল আমরা বিকাল চারটের মধ্যে সুগস্পিৎজ কিছুতেই পৌঁছতে পারবো না
কথাটা একদম সত্যি, এমনিতেই কালকের চড়াই আজকের থেকে অনেক বেশি, তার ওপর এক্সট্রা ৬ কিলোমিটার হাঁটার লোড তো নেবার কোনো প্রশ্নই উঠছে না
সান্ত্বনার দিকে তাকাতে ও বললো, চলো এখনই আমরা বাকি পথে হাঁটা শুরু করি
একটু রেস্ট নেওয়ার জন্যই হোক বা মনের মধ্যে একটা ভয় থাকার জন্যই হোক সান্ত্বনা কিন্তু বাকি সাড়ে পাঁচ কিলোমিটার রাস্তা প্রায় একই গতিতে আমাদের সাথে হেঁটেছিলো
পথের মধ্যে শুধু এক জায়গায় পাটনাচ নদীর ধারে আমরা ৫ মিনিটের একটা ব্রেক নিয়েছিলাম
বাকি প্রায় ৬ কিলোমিটার রাস্তা হেঁটে আমরা যখন ১৩৭০ মিটার ওপরে রাইনটাল-আঙ্গারহুটে পৌঁছলাম তখন বিকাল ৬ টা বেজে ৪০ মিনিট
দিনের আলো তখনও আছে
এই হুটে টা আগেরটার থেকে একটু বড়ো, সামনে একটা বেশ বড়ো খোলা মাঠের মতো জায়গাকে ঘিরে সাজিয়ে বাগান মতন করা আছে, তার ই অনতিদূরে নদীর ছোট ধারাটা বয়ে চলেছে
হুটের চারিদিকে পাহাড় দিয়ে ঘেরা
বাগানের মধ্যে দু-তিন মিটার ছাড়া-ছাড়া চেয়ার টেবিল পাতা আছে
হুটের মধ্যে না ঢুকে আমরা সোজা বাগানে ঢুকে একটা টেবিল নিয়ে বসে গেলাম
এখন আমরা একদম নিশ্চিন্ত কারণ আজ রাতটা আমরা এখানেই থাকবো
বিকালের শেষ রোদটা একদম আমাদের গায়ে এসে পড়েছে
সবাই চেয়ারে গা এলিয়ে দিলাম
এর মধ্যেই অগ্নি সবার জন্য ক্যাপুচিনো নিয়ে এলো
এইভাবে প্রায় এক ঘণ্টা আলপীয়ান সৌন্দর্য উপভোগ করে আমরা সাড়ে সাত টার সময় হুটে তে চেকইন করলাম
যে ঘরেতে আমাদের ডর্মিটরি ছিল সেখানে অনেকগুলো বাংক বেড ছিল
এক একটা বাংক বেডে পাশাপাশি চার জন শোয়ার ব্যবস্থা ছিল
কোভিড-১৯ ডিসট্যান্সিং এর জন্য আমাদের পাশের বাংক বেডটা খালি ছিল কিন্তু ওপরে কয়েকজনের শোয়ার ব্যবস্থা ছিল
কিছুক্ষনের মধ্যে আমি স্নান সেরে ফ্রেশ হয়ে নিচে ডাইনিং এ চলে এলাম
ডাইনিং হল টা বেশ বড়ো আর খুব সুন্দর
একটা বিরাট বড়ো ফায়ার প্লেস পুরো ঘরটাকে গরম করে রেখেছে
ডাইনিং এর একদিকে পুরোটা গ্লাস দিয়ে ঘেরা, সেখান দিয়ে বাইরের পাহাড়, বয়ে চলা নদী সব কিছু এতো স্পষ্ট ভাবে দেখা যাচ্ছে যে মনে হচ্ছে আমরা ওই নদীর পাশে পাহাড়ের তলায় বসে আছি
এমনই গ্লাস ওয়াল এর পাশে আমি চারটে চেয়ার এর একটি টেবিল বুক করে বাকিদের জন্য অপেখ্যা করছিলাম
এমন সময় আমার পাশের টেবিলে এক মাঝবয়েসী ভদ্রলোক এসে বসলেন
আমার দিকে তাকিয়ে হ্যালো বললেন আর একটু হাসলেন
আমিও প্রতুত্তরে হ্যালো বললাম
এর পর উনি আমায় বললেন আমি যদি কিছু না মনে করি তাহলে উনি জানতে চান আমি কোন দেশে থেকে এসেছি
কিছুদিন আগেই জার্মানিতে একটা রুল পাস্ করে হটাৎ করে কোনো মানুষকে তার আইডেন্টিটি নিয়ে প্রশ্ন করা নিষিদ্ধ করা হয়েছে, তাই হয়তো উনি এমন বিনীত ভাবে আমায় এই প্রশ্নটি করলেন
আমি এসব নিয়ে খুব একটা সিরিয়াস নই, তাই বললাম ইন্ডিয়া থেকে
ইন্ডিয়া শুনে উনি এবার ওনার ইন্ডিয়া ভ্রমণের গল্প শুরু করলেন, আস্তে আস্তে আমাদের পুরো টীম টেবিল এ চলে এলো
আমরা পুরো ফ্যামিলি সুগস্পিৎজ অব্দি ট্রেকিং করবো শুনে উনিও বেশ অবাক হয়ে গেলেন
আমাদের একটুও নিরুৎসাহ না করে উনি আমাদের অনেক সাহস আর কিছু সাজেশন দিলেন
আগামীকাল খুব সকাল-সকাল আমাদের ট্রেকিং শুরু করতে বললেন, দরকার হলে রেস্টুরেন্টে বলে সকালের ব্রেকফাস্ট প্যাকিং করে নিয়ে নিতে বললেন
বেশি দেরি না করে আমরা ডিনার অর্ডার করলাম
স্টার্টারে থাকলো মাশরুম স্যুপ, সাথে গার্লিক ব্রেড
মেন্ ডিশ মুন্নি আর অগ্নি নিলো প্রন পাস্তা, আমি আর সান্ত্বনা গ্রিলড চিকেন সাথে বেকড পটেটো
ডিনার খেতে খেতে মনটা আবার চলে গেলো ২২ বছর আগের এরকম ই এক গোধূলি বেলায়, সেদিন বসেছিলাম কেদারনাথ যাওয়ার পথে রুদ্রপ্রয়াগে, চাঁদের আলোয় আলোকিত খোলা আকাশের নিচে
পাশ দিয়ে বয়ে চলেছিল মন্দাকিনী
সেই দিন একটা সামান্য চটিতে বসে মাইজির হাতে তৈরি গরম গরম রুটি আর আলুর চোকার স্বাদ কোনো অংশেই প্রন পাস্তা আর গ্রীলড চিকেনের থেকে কম ছিল না
ডিনার শেষ করে রাত্রি প্রায় ১১ টায় আমরা ওপরে ডর্মিটরিতে ফিরে প্রত্যেকে একটা করে ম্যাগনেসিয়াম ট্যাবলেট খেয়ে যে যার স্লিপিং ব্যাগ এর ভেতর ঢুকে গেলাম
শরীরে অসম্ভব ক্লান্তি, পায়েও বেশ ব্যথা
ওপরে যারা শুয়ে ছিলেন তাঁদের মধ্যে দু জন মহিলা তখনও খুব আস্তে আস্তে নিজেদের মধ্যে বাক্যালাপ করে চলেছেন, হটাৎ চোখ দুটো একদম বুজে এলো ...
চলবে .....
আপনি কি আঁতেল? -
শেষবেলা -
পায়ে পায়ে সুগস্পিৎজে (তৃতীয়/শেষ পর্ব) -
পায়ে পায়ে সুগস্পিৎজে (প্রথম পর্ব ) -
মা -
নীরবতা -
প্রধানমন্ত্রী, দয়া করে কিছু করুন -
হল্লা বোল -
আমার প্রতিবাদ -
কোথায় তোমার দেশ গো বন্ধু? পর্ব ৪ -