content
stringlengths
0
129k
এই নিয়মকে আমরা মানতে চাইনি
অনেক কাজ আছে যাদের কারণ আমরা সব সময় খুঁজে পাওয়া পাই না
আমাদের জীবনে এমন সব অদ্ভুত অদ্ভুত ঘটনা ঘটে, যার কারণ খুঁজে পাওয়া মুশকিল
অথচ প্লট কিন্তু কার্য-কারণ নিয়েই গঠিত হয়
সেই কারণেই আমরা প্লট নির্ভর গল্প বর্জন করে ছিলাম
এই প্রসঙ্গে ফর্স্টারের ' '-এর কথা বলা যেতে পারে
সেখানে তিনি একটা চমৎকার উদাহরণ দিয়ে গল্পের () সঙ্গে কাহিনীর () পার্থক্য বুঝিয়েছেন
রাজা মারা গেল
তারপর রানী মারা গেল
রাজা মারা গেল
শোকে রাণী মারা গেল
এটা কাহিনী বা প্লট
আর গুলি করে মারা তো মজা করে বলা
কিন্তু দুঃখের কথা পাঠক মজাটা বুঝতে পারল না
পাঠক এটাও ধরতে পারল না লাইনটার জন্য আমরা মার্ক টোয়েনের কাছে ঋণী
এই ছিল পাঠকের ও সাহিত্যের অবস্থা!
আসলে, বাংলা সাহিত্যে তারাশঙ্কর, মানিক প্রমুখ লেখকদের হাতে তথাকথিত বাস্তববাদী সাহিত্যের যে ধারা তৈরি হয়েছিল তাকে বর্জন করাই ছিল শাস্ত্রবিরোধী সাহিত্যের উদ্দেশ্য
তারাশঙ্করের লেখা ছিল অতিনাটকীয়
আর মানিক মনে করেছিলেন জীবনের কাদার মধ্যেই জীবনের বাস্তবতা রয়েছে
আমরা এর থেকে বেরোতে চেয়েছিলাম
আমরা চেয়েছিলাম বাস্তবের সঙ্গে ফ্যান্টাসি মিশিয়ে নতুন সাহিত্য রচনা করতে
যেখানে বাস্তব ও স্বপ্নের ব্যবধান মুছে যাবে
আমাদের মনে হয়েছিল, বাস্তববাদী রীতিতে আজকের মানুষের জটিলতার প্রকাশ সম্ভব নয়
তার জন্য প্রয়োজন বাস্তব ও ফ্যান্টাসি মেশান নতুন রচনারীতি
এই নতুন রচনারীতির জন্যই আমরা প্লট বর্জন করতে চেয়েছিলাম
প্রশ্ন: আপনি বাস্তববাদকে অগ্রাহ্য করেছেন
মানে আপনি কি অবাস্তব গল্প লিখতে চাইছেন? আমাদের আরও স্পষ্ট করে বলুন বাস্তববাদী রীতির কোন কোন বৈশিষ্ট আপনারা মানতে চাননি? তার সঙ্গে এটাও বলুন যে আপনি কি মনে করেন বাস্তববাদী রীতি ছাড়া অন্য কোনও রীতিতে জীবনকে ফুটিয়ে তোলা সম্ভব?
উত্তর: বাস্তবতা আর বাস্তববাদ এক নয়
আমরা বাস্তববাদের বিরুদ্ধে
বাস্তববাদ একটা ক্ষয়ে যাওয়া জীর্ণ রীতি
এই রীতির লেখকরা, যেমন- মোঁপাসো, জোলা এক ফটোগ্রাফিক রিয়ালিজমের মধ্য দিয়ে তাঁদের কাহিনী বিবৃত করেছেন
আমরা তা চাইনি
আমাদের মনে হয়েছিল, বাইরের ঘটনার মধ্য দিয়ে মানুষের জীবনকে ধরা যায় না
জোলাদের রীতিতে আজকের সময়কে ফুটিয়ে তোলা যায় না
মানুষের ভেতরের জীবনের মধ্যে প্রকৃত বাস্তবতা রয়েছে
মোঁপাসো, জোলা এরা প্রত্যেকেই বড় লেখক, কিন্তু আজকের প্রেক্ষিতে অচল
আমরা নতুন বাস্তবতার সন্ধান করতে চেয়েছিলাম
নতুন প্রকাশরীতিতে সেই নতুন বাস্তবতার সন্ধান করতে চেয়েছিলাম
প্রশ্ন: তার মানে আপনারা মনস্তাতিক লেখা লিখতে চেয়েছিলেন, যার অন্যতম উদাহরণ চেতনা প্রবাহ বা ?
উত্তর: -টাও একটা রীতি
যার বড় উদাহরণ জয়েসের , বা ভার্জিনিয়া উলফের . কিন্তু আমরা সেই রীতিতে হাঁটতে চাইনি
আমরা নৈর্ব্যক্তিক ভাবে ( ) লিখতে চেয়েছিলাম
যেমন, কাফকার
কেউ সকালবেল উঠে পোকা হয়ে যায় না
কিন্তু এই আবসার্ড পরিস্থতি তৈরি করে কাফকা যে পারিবারিক বাস্তবতা তুলে ধরেছেন, বিশ্ব সাহিত্যে তার তুলনা নেই
এই প্রসঙ্গে রেমো কঁনোর ( ) কথা বলা যেতে পারে
তিনি তার বইতে একটি সামান্য অকিঞ্চিতকর ঘটনাকে নিরানব্বই ভাবে লিখেছেন
এই ঘটনা আমাদের অনুপ্রাণিত করেছিল
আমাদেরও মনে হয়েছিল, একটা গল্প অনেক ভাবে লেখা যেতে পারে
প্রশ্ন: একটি প্রবন্ধে আপনি রবীন্দ্রনাথের নাটক 'ডাকঘর' নিয়ে আলোচনা করেছেন
আপনি বলেছেন 'ডাকঘর' ও ফ্রাঞ্জ কাফকার 'মেটামরফোসিস' আপনাকে খুব প্রভাবিত করেছে
সেই সূত্রেই আমার পরের প্রশ্ন
প্রখ্যাত নাট্য ব্যক্তিত্য গিরিশ কারনাড রবীন্দ্রনাথকে দ্বিতীয় শ্রেণীর নাট্যকার বলেছেন
তিনি বলেছেন, বাংলা বা বাংলার বাইরে অন্য কোনও নাট্যকার রবীন্দ্রনাথের পথে হাঁটেননি
রবীন্দ্রনাথের সময়ে বা পরবর্তিকালে রবীন্দ্রনাটক সেভাবে অভিনীত হয়নি
(শম্ভু মিত্রের রবীন্দ্রনাটকের সফল মঞ্চায়ন নিয়ে উনি কোনও মন্তব্য করেননি
) নাট্যকার হিসেবে রবীন্দ্রনাথ অপ্রাসঙ্গিক, তাঁর কোন প্রভাব নেই
তার ভাষা মেকি, জীবন থেকে দূরে
এ বিষয়ে আপনি কী বলতে চান?
উত্তর: নাটক সম্পর্কে সম্যক ধারণা না থাকলেই এরকম কথা বলা যায়
গিরিশ কারনাডের মত নাট্যকারেরা মনে করেন, নাটকে কিছু বাস্তববাদী সংলাপ লিখলেই বাস্তবকে প্রকাশ করা যায়
শেক্সপিয়ার বা বেকেটের নাটকে পাত্র পাত্রীরা যে ভাষায় কথা বলে আমরা কি বাস্তবে সেই ভাষায় কথা বলি? রবীন্দ্রনাথের নাটক ইউরোপে জনপ্রিয় হয়েছে
তাঁর 'ডাকঘর' ইউরোপের বহু দেশে অভিনীত হয়েছে
অন্দ্রে জিঁদ (e ) ফরাসীতে সেই নাটক অনুবাদ করেন
অন্দ্রে জিঁদ রবীন্দ্রনাথের নাটকে সারবত্তা খুঁজে পেলেন
গিরিশ কারনাড পেলেন না
আসলে এরা (গিরিশ কারনাডের সমমনস্করা) ঐ সোসাল রিয়ালিজমের পদ্ধতিতেই লিখে গেলেন
নতুন কোনও ভাবনা চিন্তা তাদের লেখায় দেখা গেল না
রবীন্দ্রনাথের পর বাদল সরকার
এর মাঝে বা পরে কারও নাটকে নতুন কোনও ভাবনা পাওয়া গেল না
প্রশ্ন: ১৯৮২ সালে প্রকাশিত আপনার প্রথম উপন্যাস 'ছবির সঙ্গে দেখা'-কে বাংলা সাহিত্যের প্রথম অ্যান্টি নভেল আখ্যা দেওয়া হয়ে থাকে
আপনি আপনার এক প্রবন্ধে বলেছেন, আপনি একটা অসমাপ্ত উপন্যাস লিখতে চেয়েছিলেন
আপনি এই প্রসঙ্গে বৈষ্ণব পদাবলীরও উল্লেখ করেছিলেন
এই অ্যান্টি নভেল, অসমাপ্ত উপন্যাস বা বৈষ্ণব পদাবলী... এই ব্যাপারগুলো একটু বুঝিয়ে বলুন
উত্তর: অ্যান্টি নভেল মানে তখন যেভাবে উপন্যাস লেখা হত সেভাবে লেখা হয়নি
তাই সমালোচকরা ওটাকে অ্যান্টি নভেল বলেছিলেন
বেকেটের উপন্যাসকেও তাই বলা হয়েছিল
যেহেতু বেকেট সমসাময়িক উপন্যাস লেখার ধারা অনুসরণ করেননি
যেমন ধরো, কোর্তাজার-এর 'হপস্কচ'
এই উপন্যাসটাকে বহুভাবে পড়া যায়
একটা পড়ায় ১০ এর পরে হয়ত ৫৩ নম্বর অধ্যায়, অন্যটায় আবার অন্যভাবে
ধর, ৭ নং অধ্যায়ের পর ৫২ নং পড়লে
কার পর কোন অধ্যায় পড়বে তার নির্দেশ বইয়ের শুরুতে দেওয়া আছে
এর আগে এভাবে উপন্যাস লেখার কথা কেউ ভাবতে পারেননি
তাই এটা হয়ে গেল অ্যান্টি নভেল
ব্রিটিশ লেখক বি এস জনসন-এর সম্পর্কেও সমালোচকরা একই কথা বলেছিলেন
জনসন প্রকাশ রীতি নিয়ে অনেক পরীক্ষা-নীরিক্ষা করেছিলেন
আর অসমাপ্ত উপন্যাসের উদাহরণ বেশ কিছু আছে
যে লেখা পড়ার পর মনে হয়, ঠিক শেষ হল না, গল্প আরও এগোতে পারত
রবার্ট মিউসিলের 'দ্য ম্যান উইদাউট কোয়ালিটিজ' বা শরৎচন্দ্রের 'শ্রীকান্ত' এর বড় উদাহরণ
'শ্রীকান্ত' চার খণ্ডের পরেও লেখা যেতে পারত
শরৎচন্দ্র পঞ্চম খণ্ডের কথা ভেবেওছিলেন
কিন্তু শেষ পর্যন্ত লেখা হয়ে ওঠেনি
তবে এই সমস্ত উপন্যাসগুলো বিভিন্ন কারণে সম্পূর্ণ হয়ে উঠতে পারেনি
সম্পূর্ণ না হয়ে উঠলেও কোথাও রস হানি হয়নি
আর আমি সচেতন ভাবে অসমাপ্ত উপন্যাস লিখতে চেয়েছিলাম, এটাকে একটা ফর্ম হিসেবে ভাবতে চেয়েছিলাম
'ছবির সঙ্গে দেখা'র শেষে নায়ক নায়িকার সঙ্গে কথা বলতে বলতে পার্কে হাঁটতে থাকে
অথচ নায়িকা সেখানে সশরীরে ছিল না
এভাবেই নায়ক ও অনুপস্থিত নায়িকার মিলন হয়
এই মিলনের ভাবনাটা আমি পেয়েছিলাম বৈষ্ণব পদাবলীর ভাব সম্মিলন পর্ব থেকে যেখানে কৃষ্ণ সশরীরে না থাকা সত্তেও রাধা কৃষ্ণের মিলন হয়