content
stringlengths
0
129k
যার ফলে ওর হাসি স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি
রহমান সাহেবের ঠোঁট এখনো নড়ছে, আমিও কিছু বলছি
কদিন যাবত অসহ্য মাথাব্যথার হিস্ট্রি বলছি হয়ত
বা স্পাইনাল কডের তীব্র যন্ত্রনার কথা
খলবলে হাসির দমকে সেসব কথা হারিয়ে যাচ্ছে
রহমান সাহেবের বিস্মিত দৃষ্টির সামনে দিয়ে একসময় বেরিয়ে আসি
লম্বা করিডোরে ভর দুপুরের নির্জনতা
করিডোর সংলগ্ন পুরুষ ওয়ার্ড গুলোর পাশ দিয়ে দ্রুত ফেরার সময় অন্যরকম কিছু উপলব্ধি করি
চারপাশ সুনসান
যাবার সময় এমনটি ছিল না
অসুস্থ পুরুষদের আর্ত চিৎকারে তখন জায়গাটুকু প্রায় দৌড়ে পার হয়েছিলাম
কিন্তু এত নির্জনতার কারন খুঁজতে সেদিকে খুব বেশি নজর দিতে পারলাম না
আমার পাশাপাশি কিছু একটা আমার মতই দ্রুত হাঁটছিল
ভয়ে কুঁকড়ে উঠছিলাম
লিফটের সামনে মানুষের কিউ নেই
পাশে সেই অশরীরী অনুভূতি
মুহূর্তকে বছর মনে হতে লাগলো
সরকারী অন্য হাসপাতালে যেমন ওষুধের গন্ধ, স্ট্রেচারের ঘড়ঘড়ানি, রোগী-নার্স-ডাক্তারের দৌড়াদৌড়ি, এখানে তার কিছুই নেই
বেশ কিছুটা দূরে রিসিপশনে বেঁটে মত মেয়েটি পাশের সুদর্শন যুবকের সাথে গল্প করছে
মেয়েটির কপালের চুলগুলো এমন যে সেখানে একটি সেকেন্ড ব্র্যাকেট তৈরি হয়েছে
সরল অঙ্কে সেকেন্ড ব্র্যাকেটের কাজ আগে নাকি ভাগের কাজ আগে সেটা নিয়ে একদিন বিভাসের সাথে বেশ ঝগড়া হয়েছিল
ও অঙ্কে খুব ভাল ছিল
আমি তর্কের জন্যই শুধু তর্ক করেছিলাম
বিভাস কখনো হার মানতে চাইত না
সেদিনও জিতে গিয়েছিল
আমি মনে করার চেষ্টা করলাম আসলে সেকেন্ড ব্র্যাকেটের কাজ আগে নাকি ভাগের? অংকের প্রয়োজন ফুরিয়েছে বহুদিন হল
লিফট এসে গিয়েছে
ঠাসাঠাসি লোক দেখে বেশ খুশি হলাম
কয়েকজন পুরুষ যেখানে জটলা করে দাঁড়িয়ে ছিল তার মাঝখানে নিজেকে সেঁধিয়ে দিলাম
সুন্দরী নারীকে শরীরের স্পর্শে পেয়ে কারো কারো মন মন্দিরে সুনিশ্চিত ঘণ্টী বাজছে বুঝতে পারছিলাম
কিন্তু আদতে তাঁরা ছিলেন আমার ঢাল
যদিও সেই চলন্ত অনুভূতি আমি লিফটে অনুভব করলাম না
লিফট খুব দ্রুতগতিতে আমাদেরকে নীচে নামিয়ে নিয়ে এলো
এই হাসপাতালে আজই প্রথম এসেছি
একবছর আগে বর্তমান প্রধানমন্ত্রী উদ্বোধন করেছেন
বিশাল শ্বেত পাথর সেটির সাক্ষ্য বহন করছে
মখমলের মলমলে কাপড়টি এখনো দুভাগ হয়ে লেখাটির দুপাশে ঝুলছে
বৃষ্টিতে ভিজে রোদে পুড়ে রঙটা পানসে লাল
আমি সামনের চত্বরে দাঁড়িয়ে চারপাশ খুব দ্রুত চোখ বুলিয়ে নিলাম
কোন অসঙ্গতি চোখে পড়ল না
তবুও মন সংকটে পরিপূর্ণ
রবিউলের নম্বর কিছুতেই খুঁজে পাচ্ছি না
রবিউল আমার গাড়ীর ড্রাইভার
হাত কাঁপছে
মোবাইলের স্ক্রিনের উপর আঙুল অনির্দিষ্ট ভাবে নড়ছে
বেশ কিছুক্ষণ বাদে ওকে ফোনে ধরতে পারলাম
রবিউল গাড়ী নিয়ে পাঁচ মিনিটে হাজির হলো
কি ঘটেছিল বা কি ঘটতে পারে কোনকিছু ভাবার মত মন নেই
ক্লান্তি আর অবসাদে শরীর একটু বিশ্রাম চাইছিল
চোখ বন্ধ করে সীটে শরীর এলিয়ে দিলাম
সুজাতা, টায়ার্ড লাগছে?
উহ্! আমি রবিউলের সাথে খুব জোরে জোরে গল্প শুরু করি
ওর সংসারের খোঁজ নেই
ওর ক্লাস সেভেনে পড়া ছেলেটা কবে যেন বাড়ি থেকে পালিয়ে গিয়েছিল
কিছুদিন পর নিজেই ফিরে আসে
সে আবার পালাবে কিনা তার সম্ভাবনা নিয়ে আলোচনা করি
ওর বউকে একটা সূর্যমুখী রঙের শাড়ি কিনে দিয়েছিলাম, পছন্দ হয়েছিল কিনা জানতাম না
সে বিষয়েও প্রশ্ন করি
ও বোধ হয় একটু অবাকই হয়েছিল
কারন গাড়ীতে সচরাচর আমি কথা বলি না
কিন্তু রবিউল জানে না, আমার পাশেই বিভাসের অস্তিত্ব অনুভব করছি এবং প্রগলভতায় আমি সেই অস্তিত্বকে অস্বীকার করতে চাইছি
এক সময় কি দারুণভাবে অস্তিত্বময় ছিল আমার জীবনে ও
শিশু বয়স থেকে আমরা পাশাপাশি বাড়িতে বড় হয়েছি
ওর বাবা প্রফেসর, আমার বাবা ব্যবসায়ী
মতে একদম মিল নেই কিন্তু আমাদের মধ্যকার সঘন প্রেমে তাঁদের কারো দ্বিধা ছিল না
কেন ছিল না সেটা একটা বিস্ময়
ভার্সিটিতে ভর্তি হবার ক'মাসের মধ্যে এক বড় ভাইয়ের উস্কানিতে বিভাস কমিউনিজম জ্বরে আক্রান্ত হলো
ওর মনে হতে লাগলো সমাজের একশ্রেণীর পুঁজিবাদী মানুষ আর্থসামাজিক অধিকার জবর দখল করে রেখেছে
এরাই শ্রেণী শত্রু, এদেরকে ধ্বংস করতে হবে
ও গোপন একটি কম্যুনিস্ট পার্টির সক্রিয় সদস্য হলো
একদিন আমাকেও সেই বিপ্লবী চেতনায় দীক্ষিত করল
আমার উপর ওর প্রভাব ছিল সীমাহীন
দুজন মিলে মার্কসবাদ-লেলিনবাদ গুলে খেতাম
সমাজ বদলানোর চিন্তা আমাদের মাথায় এমন চেপে বসল যে প্রতিজ্ঞা করেছিলাম ততদিন পর্যন্ত থামব না যতদিন পুঁজিবাদী এই সমাজকে সাম্যবাদী সমাজে রূপান্তরিত না করা যাবে
ভার্সিটি ফাঁকি দিয়ে চলে যেতাম পুরনো ঢাকার গলি ঘুপচিতে
গোপন মিটিং গুলোয় বিভাস রগচটা উদ্ধত যুবক
অন্যায় বললে লিডারকেও ছাড় দিয়ে কথা বলে না
আবার আমার পাশে একান্ত যখন, তখন সে পাগল প্রেমিক
আমাদের আটুল বাটুল শ্যামলা শাটুলের প্রেমে একের পর এক সাজিয়ে ফেলত নিখাদ ছায়ার ঝাউবীথি
যুগলে ছুঁয়ে যাওয়া হাওয়ায় ভৈরব সুর সঞ্চারিত হতো আমাদের শরীর মনের তাবৎ পাড়ায়
সুজাতা, তোমার গাড়ীটির দাম কত?
আবার চমকে উঠলাম
ও কেন দাম জানতে চাইছে আমি জানি
পুঁজিবাদী ধনী শ্রেণীকে ওর প্রচন্ড ঘৃণা
এই ঘৃণা ওকে দিনে দিনে হিংস্র করে তুলেছিল
ও আমার জবাবের অপেক্ষা করছে কিনা জানি না
কিন্তু আমি কিছু বললাম না
গাড়ী মগবাজার চৌরাস্তা পার হয়ে বেইলি রোডে আমার বাড়িতে থামল
তালা খুলে খুব দ্রুত ভেতরে ঢুকে গেলাম
কিছুতেই এ বাড়িতে ওর উপস্থিতি আমি চাই না
এসি অন করে সোজা বিছানায়
ওয়াও! সেন্ট্রাল এসি নাকি? কুল, সুজাতা!
ঘর যেন নয় ধূধূ প্রান্তর
প্রতিটি কথার ইকো হচ্ছে
আমার পাশে শুয়ে আছে ও
দেখতে পাচ্ছি না, অনুভব করছি ওর তপ্ত নিঃশ্বাস
খুব অদ্ভুত একটা ব্যাপার ঘটলো
ওকে আমি আর মোটেই ভয় পাচ্ছি না
বরং প্রচন্ড লোভ হচ্ছে
কামনা করছি বিভাস ওর শরীরে ফিরে আসুক